গুলশান এলাকায় মুক্তি নামের একটা ক্লিনিক আছে৷ মানসিক রোগী, ড্রাগ অ্যাডিক্ট ধরনের সমস্যার চিকিৎসা করা হয়৷ মুক্তি ক্লিনিকের একজন চিকিৎসক (ঢাকা মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিভাগের প্রফেসর) একদিন আমাকে ক্লিনিকে ডেকে পাঠালেন৷ তার কিছু বিশেষ ধরনের রোগীর চিকিৎসায় আমার সাহায্য প্রয়োজন৷
আমি অবাক হয়েই গেলাম৷ ভদ্রলোক অভিযোগের মতো করে বললেন, আপনি এসব কী করছেন? লেখার মাধ্যমে সমাজে অসুস্থতা ছড়াচ্ছেন? হিমু আবার কী?
আমি বিনীত ভঙ্গিতে হিমু কী ব্যাখ্যা করলাম৷ প্রফেসর সাহেব ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হলেন না৷ গলা কঠিন করে বললেন, হিমু উপন্যাসের কোনো চরিত্র না৷ হিমু হলো একটা ব্যাধির নাম৷ তা কি আপনি জানেন?
আমি জানি না৷
হিমু ছোঁয়াচে ধরনের ব্যাধি৷ কনটেজিয়াস ডিজিজ৷ এই ডিজিজ আপনি ছড়াচ্ছেন৷ আপনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন৷ অবশ্যই আপনার লেখালেখি বন্ধ করে দেওয়া দরকার৷ লেখকরা সমাজের উপকার করেন৷ আপনি করছেন অপকার৷ ইজ ইট ক্লিয়ার?
এখনো ক্লিয়ার না৷ আপনি ব্যাখ্যা করলে বুঝব৷
ডাক্তার সাহেবের কাছে জানলাম, মুক্তি ক্লিনিকে অনেক বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের চিকিৎসার জন্য পাঠান যারা হিমু নামক অদ্ভুত অসুখে ভুগছে৷ এরা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে৷ গভীর রাতে কাউকে কিছু না বলে হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়৷ কয়েকদিন কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না৷ তারা মনে করে, ঐশ্বরিক কিছু ক্ষমতা তাদের হয়েছে৷ তারা যা বলবে তাই হবে৷
আমি বললাম, এই মুহূর্তে আপনার ক্লিনিকে কি কোনো হিমু আছে যার চিকিৎসা চলছে? ডাক্তার সাহেব দু:খিত গলায় বললেন, তিনজন ছেলে হিমু আছে৷ একটা আছে মেয়ে হিমু৷ মেয়ে হিমুর কী আলাদা নাম আছে?
আমি বললাম, মেয়ে হিমুর আলাদা কোনো নাম নেই৷ মেয়ে হিমুও হিমু৷ যদিও কেউ কেউ বলেন হিমি৷ আমার হিমি পছন্দ না৷
ডাক্তার সাহেব বললেন, যে তিন ছেলে হিমু আছে তার দুটা হিমু হওয়ার পরে ড্রাগ ধরেছে৷ ভয়ঙ্কর একডিলিউশনে ভুগছে৷ আসুন আপনার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেই৷ কী প্রচণ্ড ডিলিউশনে যে এরা ভুগছে দেখে আপনারই খারাপ লাগবে৷
আমি ওদের দেখতে গেলাম৷ সত্যি মনটা খারাপ হলো৷ জীবনের আনন্দে এদের ঝলমল করা উচিত ছিল৷ তা না, স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ক্লিনিকে৷ চোখের দৃষ্টিতে ঘোর৷ জীবন থেকে বিতাড়িত কিছু যুবক৷ আমি তাদেরকে ব্যাখ্যা করলাম যে, হিমু ফিকশন ছাড়া কিছু না৷ হিমুর চিন্তাভাবনা বা হিমুকে নিয়ে লেখকের চিন্তাভাবনা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার কিছু নেই৷ যেহেতু হিমুকে নিয়ে বইগুলো আমি লিখেছি, আমি জানি৷
যুবকদের ভেতর একজন চাপা গলায় বলল, হিমুর বিষয়ে আমরা যা জানি আপনি তা জানেন না৷ আমি চমৎকৃত হয়ে বললাম, তোমরা কী জানো?
যুবক গলা আরও নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, প্রতিটা বড় শহরে একজন প্রধান হিমু থাকেন৷ তিনি শহর কন্ট্রোল করেন৷ অনেক রাতে হাঁটাহাঁটি করলে উনার দেখা পাওয়া যায়৷
উনি কী পীর টাইপ কেউ?
উনি পীরের বাবা!
যারা পীরের বাবার দেখা পেয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন৷ আমি চুপ করে গেলাম৷ একটা বিষয় আমাকে অবাক করল, হিমুর লেখককে নিয়ে তাদের নিস্পৃহতা৷ হিমুর যে জগৎ তারা তৈরি করেছে সেখানে আমার স্থান নেই৷
চিকিৎসাধীন মহিলা হিমুকে দেখতে গেলাম৷
কলেজ পড়া বাচ্চা একটা মেয়ে৷ সে কোনো এক হিমুর বইতে পড়েছে গভীর রাতে নির্জন রাস্তাগুলো সব নদী হয়ে যায়৷ হিমুরা সেই নদী দেখতে পায়৷ কাজেই এই মেয়ে রাস্তার নদী হওয়ার দৃশ্য চাক্ষুষ দেখার জন্য এয়ারপোর্ট চলে গেল৷ অনেক দূর দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে চলে গেল রানওয়েতে৷ গভীর রাতে রানওয়ের মাঝখানে ঘাপটি মেরে বসে রইল৷
কোনো এক বিমানের পাইলট ল্যান্ড করতে এসে এই দৃশ্য দেখে প্রায় ভিরমি খেলেন৷ জানালেন কন্ট্রোল টাওয়ারকে৷ পুলিশ এসে মেয়েটিকে গেপ্তার করল৷ মেয়ের মা উপায় না দেখে তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করলেন৷
মেয়েটি এখন সুস্থ৷ মেয়ের মা মেয়েকে নিয়ে নুহাশ পল্লীতে এসেছিলেন৷ আমি তাকে দিয়ে মিউজিক ভিডিওতে কিছু কাজও করিয়েছি৷ হিমুর এই ব্যাপারে আমি বুঝতে পারছি না৷ কেন কিছু মানুষ হিমুকে সত্যি ভাববে? এদের সাইকি কি আলাদা?
নিউইয়র্কের এক মহিলার কথা বলি৷ বাঙালি মহিলা৷ স্বামীর সঙ্গে বাস করেন৷ স্বামী ট্যাক্সি চালান৷ তিনি নিজেও ইন্ডিয়ান শাড়ির দোকানে সেলস গার্লের চাকরি করেন৷ ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা হচ্ছে৷ এক পর্যায়ে তিনি বললেন, হুমায়ূন ভাই, হিমু নিউইয়র্কে বেড়াতে এসেছে এরকম একটা উপন্যাস লিখুন৷
আমি বললাম, লেখা যেতে পারে৷
ভদ্রমহিলা বললেন, হিমুর আসা-যাওয়ার খরচ আমি দেব৷ সে আমাদের বাসায় থাকবে৷
এবার আমি চমকালাম৷ উপন্যাসের একটি চরিত্রের জন্য আসা-যাওয়ার খরচ দিতে হয় না৷ তার ঘুমুবার জন্য খাট লাগে না৷ আমি বললাম, হিমু আপনার বাড়িতে থাকবে?
তিনি লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁ৷ তার সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে৷ সে যে কদিন আমার সঙ্গে থাকবে আমি কাজ করব না৷ ছুটি নেব৷
আমি বললাম, আপনি একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন হিমু বলে কেউ নেই৷ হিমু আমার কল্পনার একটি চরিত্র৷
ভদ্রমহিলা রাগত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনি তাকে নিউইয়র্কে আনতে রাজি না সেটা সরাসরি বললেই হয়৷ অযুহাত দেওয়া শুরু করেছেন৷
আমি চুপ করে গেলাম৷ কিছুক্ষণের জন্য আমার মধ্যেও বিভ্রম তৈরি হলো৷ আসলেই হিমু বলে কেউ আছে না কি?