অসুখ-বিসুখ
‘অ সোভান, কৈ যাস? সুলতান ডাক্তাররে কইয়া আউজকা দাওয়াই আনতে পারবি? আমি তো আর খাড়াইতে পারি না বাবা, অ সোভান, হুনলি? মাথামুথা খালি ঘুরান দিতাছে, ডাক্তাররে খবর দিবি?’
পেছন থেকে মায়ের ডাক শুনে সোবহান দরজা থেকে ফিরে আসে, কিন্তু আতমন্নেসার ঘরে না গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে হাঁক ছাড়ে আলমের মাও, এক গিলাস পানি দিয়া যাও তো!’
বারান্দায় ঘরের দেওয়ালের সঙ্গে পেতে-রাখা বেঞ্চ, বসবে বলে সোহবান পাছা ঠেকায় বেঞ্চের ওপর। কিন্তু সারা শরীর তার ছটফট করে, তাই একবার বসে তো দুবার দাঁড়ায়। এই ব্যায়াম করতে করতে সে অবিরাম বিড়বিড় করে, ‘কৈ যাওনের টাইমে খালি পিছে ডাকবো, খালি পিছু-ডাক দিবো। কাম হয় ক্যামনে? দুনিয়ার মাইনষে হালায় কামাইয়া লাল হইয়া গেলো, আমাগো হইবো ক্যামনে?’ ওদিকে ঘরের ভেতর আতমন্নেসার গোঙানি এখন স্থগিত। তক্তপোষের তলা থেকে চিলমচি টেনে নেওয়ার শব্দ আসে, থুক করে পানের ছিবড়ে ফেলে আতমন্নেসা চিলমচি ফের নিচে ঠেলে দেয়।
সিতারা তখন উঠানের এক কোণে উপুড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছেলের পাছায় পানি ঢেলে দিচ্ছে, রাস্তার ধারের নালা থেকে আলম এক্ষুণি পায়খানা করে এলো। সিতারা ওখান থেকেই জবাব দেয়, ‘পাকঘরে সুরাই থাইকা ঢাইলা খাও।
পানি না খেয়েই সোবহান সশব্দ পা ফেলে বেরিয়ে যায়। পিপাসাও ছিলো না। তার, মায়ের পিছু-ডাক শুনে বাইরে গেলে ময়দার পারমিট পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায় বলে ঘরে এসে সে ফের প্রথম থেকে যাত্রা করলো।
আত্মন্নেসা ফের মুখ খোলে, অ মতি, দেখলি তোর ভাইয়ে এক গিলাস পানি ভি খাইয়া যাইতে পারলো না, দেখলি?’ মেয়ের দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সে এবার সরাসরি কথা বলতে চায় বৌয়ের সঙ্গে, অ বৌ, আমার পোলাডারে তুমি এক গিলাস পানি ভি দিবার পারো না? এই রইদের মইদ্যে হুকনা মুখ লইয়া পোলায় বারাইয়া গেলো, এ্যা?’
কিন্তু বৌয়ের দিক থেকেও কোনো সাড়া নেই।
‘রাও করবার পারস না বৌ? অ আলমের মাও, হুনলি?’ বিছানায় কাত হয়ে নতুন করে পান সাজাতে সাজাতে আতমন্নেসা চিৎকার করে, ‘পোলায় আমার পানি না পাইয়া বাড়ি থাইকা বারাইয়া যায়, খানকি মাগী তুই পানি না দিয়া ভাতাররে বাইর কইরা দিলি? ঘরটারে কারবালার ময়দান বানাইবার হাউস করছস, এ্যাঁ?’ –এই যে তৃষ্ণার্ত ঠোঁটে, শুকনো গলায় রোদের ভেতর বাইরে চলে গেলো তার ছেলে সোবহান, সে যদি আর ফিরে না আসে তো খানকি মাগীটার উচিত শিক্ষা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে যদি খবর আসে যে গলি থেকে বেরিয়ে আলুবাজারের বড়ো রাস্তায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোবহান একটা ট্রাকের তলায় পড়ে গেছে মুখ থুবড়ে, শেষবারের মতো দেখতে চাইলে সবাই মেডিক্যাল কলেজ চলো, তো এই শয়তান বৌটার বাপের বাড়ি পর্যন্ত উদ্ধার না করে আতমন্নেসা ছাড়বে না। পুত্রবধূকে যথোচিত শিক্ষা দেওয়ার উৎসাহে আতমন্নেসা বিছানায় উঠে বসে। মনে হলো মাথাটা বোঁ করে ঘুরতে শুরু করলো। জানলা দিয়ে দ্যাখে উঠানের একদিকে পায়খানার চটের পর্দা খুব দ্রুতগতিতে একবার সামনে আসছে একবার পেছনে যাচ্ছে। এরকম হলে তার খুব ভয় হয়। শুয়ে পড়তেও ভয় হয়। অনেক সময় ছাদটা এমন বোঁ বোঁ করে ঘোরে যে মনে হয় চুন-সুরকির ছেঁড়াখোঁড়া কাঁথাকম্বল ভেদ করে ছাদের এই বিশাল বন্ধু বুঝি তার ঝরঝরে গতরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। তবে মাথাঘোরার প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে পারলে সমস্ত জগতের গতি আস্তে আস্তে কমে আসে, চারপাশ তখন ধীরে ধীরে দোলে। কিন্তু আতমনেসার এসব কথায় কান দেয় কে? তবু চিঁহি চিহি করে তার মেয়েকে ডাকে, ‘মতিবানু, অ মতি! আমারে এটুখানি দুধ দিবার পারস? মাথাটা কেমুন চক্কর দিয়া উঠলো। অ মতি!’
সকালবেলা জ্বর আসেনি বলে মতিবানু রান্নাঘরে ঢুকছে, রাত্রের ঠাণ্ডা ভাত খাবে, একটু বাসি তরকারির জন্য সে এখন এ-তাক ও-তাক হাতড়াচ্ছে, মায়ের ডাকে মনোযোগ দিলে সিতারা এসে তরকারির বাটি লুকিয়ে ফেলতে পারে। ভাবীটা কি তার কম দজ্জাল?
আতমন্নেসা শেষ পর্যন্ত ধর্ণা দেয় বৌয়ের কাছে, ‘অ বৌ, অ আলমের মাও, আমারে দুধ দিবা এট্টু? আমার মাথাটা কেমুন ঘুরান দিতাছে, অ বৌ!’
আলমের উরু, পায়ের পাতা সব জায়গায় গু লেগে ছিলো। এসব ভালো করে ধুতে গেলে সে চেঁচিয়ে ওঠে, সিতারা তার দুই গালে কষে চড় লাগায়। পায়খানার চটের পর্দা ধরে আলম আর্তস্বরে কাঁদতে শুরু করলে সিতারা ধীরে সুস্থে বারান্দায় আসে। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলে— ‘দুধ পাই কই?’
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আতমন্নেসা নানাভাবে তার চোখের দিকে তাকাবার চেষ্টা করে, ‘আমি মইরা যামু বৌ, দুই চোক্ষে খালি আন্ধার দেহি, আমারে এক পেয়ালা দুধ দিবি?
‘দুধ নাই কা!’
সিতারার এই সংক্ষিপ্ত জবাবে আতমন্নেসা মুষড়ে পড়ে। –কি একখান বৌ লইয়া আইছে তার পোলায়, হায়রে রাও করবো না, বাত করবো না। একটা কথা কইবো মনে লয় বাপের বাড়ির সোনাদানা হীরা জহরতের হিসসা দিতাছে।
‘ঐ দিনকা মতির জামাই লাইন দিয়া খাড়াইয়া বড়ো টিন লইয়া আইছে না একটা? ব্যাকটি খাইছো?’
‘ঐ দুধ দিলে মতিবিবিরে কি দিমু? ডাক্তারে অরে দুধ খাইতে কইছে না?’
‘হায়রে আমার কপাল।’ নিজের কপালে একটা চড় মারতে গিয়ে আতমন্নেসার ডান হাত বুক পর্যন্ত উঠে ফের পড়ে যায়, কপালের সঙ্গে যেকোনো সামান্য সংঘর্ষে তার মাথাঘোরা বেড়ে যেতে পারে। ‘বিমার খালি মতিবানুরই হইছে? আমি বলে মইরা যাই, হায়রে চুকি মাইরাও যুদিল কেউ দ্যাহে।’
আধঘণ্টা পর সিতারা ঘোলাটে রঙের কাঁচের চায়ের গ্লাসে দুধ গুলে আতমন্নেসার সামনে ধরলে সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। শান্ত গলায় সিতারা বলে, ‘দুধ খাইবেন কইলেন না?’
‘না আমারে কি দুধ দিবা?’ আতমন্নেসার স্বর জলীয় ও নিচু। তার চোখের পাতা নোয়ানো। আমি দুধ খামু ক্যান? আমার কি বিমার হইছে?’
‘বিমারের লগে দুধ খাওনের কি কথা হইলো? হাউস হইছে দুধ খাইবেন, তে খান!’ ততোক্ষণে দুধের গ্লাস আতমন্নেসার হাতে চলে এসেছে। তার চোখের ঘোলা মণিতে দুধের ছায়া পড়ে কি পড়ে না! গোটা গ্লাসটা এই খানকিটার মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে বাড়ি মাথায় করে চ্যাচাতে পারলে এখন সুখ পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, তার বাড়াবাড়ি মানে বৌয়ের জিত। সুতরাং দুধটা তাকে খেয়েই ফেলতে হয়।
আলমের কান্না থামাবার জন্য আরেকটা চড় মারা দরকার, সিতারা তাই চলে যায় উঠানে। বিছানার ওপর শূন্য গ্লাস হাতে বসে আতমন্নেসা তার রোগের উপসর্গসমূহ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্যাখে। তার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। মাথা তুললেই দুনিয়া কেবল ঘোরে। তার না আছে গতরের আরাম, না আছে জানের শান্তি। তামাম জিন্দেগী ভর তার দিকে কেউ খেয়াল করেনি। তার পোলাপানের বাপ সারা জীবন নিজেই ছিলো হাঁপানির রোগী। সারাটা শীত খক খক করে কাশতো, হাঁসফাঁস করে নিশ্বাস নিতো। একটু বৃষ্টি হলো কি একটু গরম পড়লো, ব্যস শুরু হলো সোবহানের বাপের হাঁপের টান। তখন রাতে ঘুম থেকে উঠে চুন দিয়ে তেল গরম করো, বুকে পিঠে মালিশ করো, রসুন ছেঁচে গলায় পট্টি লাগাও, সেটা করো—এই করেই তো তার কাটলো। না, এমনি লোকটা তার সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করতো না,–মিছা কথা কইলে গুণা, দিলের মইদ্যে রাখলে ভি গুণাই হইবো, হইবো না?–সোবহানের বাপ বৌকে মারধোর করতো না, বিয়ের পর বছর চার পাঁচ একটু যা করেছে তা ঐ চড়টা-চটকানাটার ওপর দিয়েই গেছে। অথচ আতমন্নেসার ভাসুর তিনজনের সকলেরই পরিবার ছিলো দুটো করে, সেজো ভাসুর তো কুমিল্লা না পাবনা — জায়গার নাম কি ছাই মনে থাকে–কোথায় গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে সেখানেই বাস করতে শুরু করে। সোবহানের বাপ ছিলো কলেজিয়েট স্কুলের দপ্তরি, ভালো ভালো লোকের সঙ্গে তার ওঠাবসা–না ঐসব খাসলত তার একেবারেই ছিলো না। কিন্তু তার দোষের মধ্যে ঐ—মত্ত থাকতো খালি নিজের অসুখ নিয়ে। সপ্তাহের কম করে হলেও দুটো দিন কোনো না কোনো ওষুধ ঘরে আসতোই। হেকিমি হোক, কোবরেজি হোক, হোমিওপ্যাথি হোক, ডাক্তারি হোক, গাছ-গাছড়া, টোটকা–রোজই কোনো না কোনো ভাবে নিজের পরিচর্যা করতো। অথচ দ্যাখো—, চোখ থেকে পানির বিন্দু গড়িয়ে পড়লে আতমন্নেসার দুটো চোখই খচখচ করে— অথচ কৈ তার জন্যে তো এক ফোঁটা ওষুধ কোনোদিন আসেনি। আতমন্নেসার শরীরটা ভালো ছিলো। বড়ড়ো বেশি রকমের ভালো। তা হোক, — শরীর লোহার হোক কাঠের হোক—রোগ ব্যারাম ছাড়া কি মানুষ বাঁচে? অবেলায় গোসল করে আতমন্নেসার যদি কখনো গা গরম করেছে সে আর বলা হয়নি। এই না-বলাটাই হয়েছে তার কাল। এতে সকলে ভাবতে শুরু করলো কি বৌয়ের গতর হইল লোহার পিঞ্জর একখান। পানি হাওয়া রইদে এ্যারে কিছুই করবার পারে না—সবাই ভাবতো, সোবহানের মায়ের শরীর একেবারে নীরোগ। হায়রে কপাল তার, ছ’টা সাতটা ছেলেমেয়ে হলো, সন্তানের সংখ্যা তার ভালো করে মনেও পড়ে না, মনে করার জন্য চোখ বন্ধ করে নিবিষ্টচিত্ত হতেও তার ভয় করে পাছে মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে, একবার মনে হয় আটটা, সবচেয়ে বড়োটার কথা মনে পড়ে, সেটা ছিলো ছেলে, সাত আট মাস টমাস বোধহয় বেঁচে ছিলো, তারপর বোধহয় নুরুন্নেসা–তার জীবিত সন্তানদের মধ্যে বড়ো। তারপর কে? সোবহান। না, সেই মরা ছেলেটা! –কি জানি? এখন আর মনে করে লাভ কি? তখনই কেউ খেয়াল করলো না! না, পোয়াতির শরীরের দিকে কেউ দ্যাখেনি। প্রত্যেকবার গর্ভ যখন পূর্ণ হয় হয়, ‘না, অহন ফুলজানেরে লইয়া আহি’–এই কথা বলে সোবহানের বাপ চলে যেতো নাজিরা বাজার। নাজিরা বাজার থেকে আসতো তার ননদ ফুলজান। ঘোড়ার গাড়ি বোঝাই হয়ে আসতো। তার পাঁচটা ছ’টা ছেলেমেয়ে, তার কাঁথাবালিস, তার মাদুর, তার পানের ডিবে, বেতের বাকসো, টিনের বাকসো। আর আসতো তার এক গাদা ওষুধপত্রের একটা ঝুড়ি। নাও, এইগুলোকে এখন সামলাও। এইটুকু বাড়ি, মানুষে মানুষে গিজগিজ করতো। এরই মধ্যে ননদের এটা ওটা বায়না। তার এ রোগ, সে রোগ। সে এটা খাবে না, ওটা খাবেনা। তার ওপর সূতিকা রোগী সে, যখন তখন পায়খানা যায়, মাটিতে হাত না ঘষেই ভাত বাড়ে। উঠানে, বারান্দায়, রান্নাঘরে ছেলেমেয়েগুলো যখন তখন বসে সের সের চালের ভাত উজাড় করে দেয়। আর ননদ এসেছে তার দ্যাখ্যাশোনা করতে, তার নিজের জ্বরজারি নিয়েই সে ব্যস্ত থাকতো বেশি। গায়ের তাপ বাড়তো, মুখও ছুটতো ফুলজানের। মুখটা তার বড়ো খারাপ ছিলো, একবার ছুটতে শুরু করলে ছেলে-মেয়ে, ছেলে-মেয়ের বাপ, নিজের ভাই ভাবী এমন কি বাপ মা পর্যন্ত রেহাই পেতো না। আর দ্যাখো, আতমন্নেসার প্রসবের ব্যাপারটি কারো কাছে কিছুই না। না ডাক্তার, না কোনো ওষুধ, না বিশেষ কোনো পথ্যি। সাবিত্রী দাই তো কাছেই থাকতো, মহল্লার মেয়েদের প্রসবের আগে তাদের পেট মালিস করে দিতো না সোবহানের বাপ তাকেও যদি একবার ডাকতো! আতমন্নেসা একেকটা বাচ্চা বিয়াতো, সোবহানের বাপ পাশের ঘরে তার কাশিতে একটু বিরতি দিয়ে জিগ্যেস করতো, ‘কি হইলো? অ ফুলজান, কি হইলো?’ যদি জবাব আসতো ‘পোলা হইছে মিয়াভাই’ তো তক্ষুণি বিছানা থেকে উঠে বংশালের ওজিউল্লা মৌলবিকে ডেকে দিয়ে ফের বাইরে চলে যেতো। ভাঙা গলায় কাঁদো কাঁদো সুরে ওজিউল্লা মৌলবির আজান শেষ হতে না হতে সোবহানের বাপ ঠিক ফিরে এসেছে। তার দুই হাত জুড়ে কাঁঠাল-পাতা ও কাগজের ঠোঙায় লাড্ডু, নিমকপারা, বাকেরখানি। এই পর্যন্তই। একবার উঁকি দিয়ে দ্যাখেওনি বৌটা মরলো কি বাঁচলো। প্রসবের পর আতমন্নেসার খুব খিদে পেতো, প্রচণ্ড ক্ষুধা। ফুল খসাতো তার ননদ, এই কাজে তার জুড়ি ছিলো না। পর পরই তার জন্যে গামলা ভরে ভাত এনে দিতো। মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত। আতমন্নেসার ইচ্ছা করতো, মাখামাখা করে রাঁধা গলদা চিংড়ির ঘন সুরুয়া দিয়ে ভাতটা মেখে নেয়। সোবহানের বাপের চিংড়ি নিষেধ, ঐ জিনিস তাই ঘরে কখনো আসেনি। ওষুধ না দিক, চিকিৎসা না হোক,–কেবল তারই জন্যে কোনো একটা পথ্য যদি কোনোদিন আসতো! এখন, হ্যাঁ এক্ষুণি এই বিছানায় এমনি কাত হয়ে শুয়ে চিংড়ির ঘন সুরুয়া দিয়ে ঝরঝরে চারটে ভাত খাওয়ার জন্যে আতমন্নেসার প্রাণটা আইঢাই করে। তার পান-চুন-খয়ের দোক্তার পলেস্তারা পড়া পুরু জিভে কতোকাল আগে মায়ের রান্না করা ঝাঁঝালো গন্ধের ঝাল চিংড়ির ঘন স্বাদ পুনরুদ্ধার করবে বলে সে একাগ্রচিত্ত হয়। এই স্বাদের খানিকটা হয়তো উদ্ধার হতো, কিন্তু এই সময় আলম আলম’ ডাক শুনে জানালা দিয়ে বারান্দায় তাকালে সুরুজ মিয়াকে দ্যাখা যায়। সুরুজ মিয়ার হাতে খাকি কাগজের ঠোঙা দেখে আতমন্নেসার জিভ, টাকরা, ঠোঁট সব ফের ছড়িয়ে পড়ে। গলদা চিংড়ির স্বাদ কোথায় পালায়!
সুরুজ মিয়া থাকে ডেমরার ওপার। ডেমরা ঘাটে শীতলক্ষা পার হয়ে তারাবো, তারপর আরো খানিকটা গেলে বোলতা। সেই গ্রামে ওদের বাস। সুরুজ মিয়া আজকাল সুতার ব্যবসা করে অনেক টাকার মালিক, শ্বশুরবাড়িতে খালি হাতে কখনো আসে না। হাঁপানির চিকিৎসা করতে বাপের বাড়িতে এসেছে তার বৌ, তা মাস তিনকে তো হতেই চললো। সুরুজ মিয়া প্রায় একদিন পর পর বৌকে দেখতে আসে। তার হাতের ঠোঙায় হয় ফলমূল নয়তো ওষুধপত্র থাকে। মতিবানুর কি এমন অসুখ করলো যে দুদিন পর ডাক্তার, একদিন পর পর ওষুধপত্র নিয়ে আসতে হবে? পেটের মেয়ে হলে কি হয়, এই যে রোগ-বিমারের নাম করে মতিবানুর কথায় কথায় বাপের বাড়ি আসা, সব সময় গা এলিয়ে থাকা এসব তার একটুও ভালো লাগে না। মেয়ে তো তার আরো আছে। নুরুন্নেসা থাকে লালবাগে, সেতো কাছেই, কৈ বছরেও তো একবার আসা হয় না তার। ঐ জামাইটার বয়স একটু বেশি, সোবহানের বাপের কাছাকাছিই হবে। নুরুন্নেসা তার তৃতীয় পরিবার। কিন্তু কম বয়সের বৌয়ের কাছে লোকটা ভাউরা হয়ে যায়নি। তার অবশ্য খানদান অনেক ভালো, লালবাগের সর্দারদের সঙ্গেও তার রিশতা। তাদের আচার আচরণও অনেক শরীফ। কিন্তু এবার অন্যরকম ঝামেলা আতমন্নেসার মগজে কাঁটা বেঁধায়; বড়ো মেয়েরই বা এ কিরকম আচরণ? মানী মানুষের বিবি হলে কি নিজের মাকে ভুলে যেতে হবে? তার সব কটা মেয়ে বড়ো বাপসোহাগী। বাপের কাশি আর হাঁপানির পরিচর্যা করে বাপের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছে, বিয়ের পরও এখানে এলে খালি বাপের কথাই বলে। বাপ মারা যাওয়ার আগে নুরুন্নেসা মাঝে মাঝে আসতো। অন্তত ঈদের পরদিন সকালবেলা ও শবেবরাতের রাত্রে আসাটা বাঁধা ছিলো। বাপ মরলো, কিসের ঈদ আর কিসের শবেবরাত! মায়ের কথা কি মেয়েটার মনেও পড়ে না? দুলামিয়া এতো বড়ো ঘরের মানুষ, প্রায়ই শোনা যায় মেম্বার টেম্বার কি সব হচ্ছে! কিরকম চাপদাড়ি তার মাথায় সর্বদা কিস্তিটুপি। সব সময় তার পাশে লোকজন, এ বিচার সে বিচার, এই স্কুল ঐ মাদ্রাসা, গোরস্থান মসজিদ এতিমখানা। এতো যে খেয়াল করে বিধবা শাশুড়ির কথাটা তার একবারো মনে হয় না কেন? আ-র জামাই! মেয়েই যদি মাকে ভোলে তো পরের ছেলেকে দোষ দিয়ে লাভ কি?
‘আলম, আলম শুইনা যাও তো বাবা।’
সুরুজ মিয়ার আহ্বানে আলম আস্তে আস্তে তার সামনে দাঁড়ায়। সুরুজ মিয়া কাগজের ঠোঙা থেকে একটা কমলালেবু বার করে দিলে ছোঁ মেরে নিয়ে আলম চলে আসে আতমনেসার ঘরে। বারান্দায় বেঞ্চে বসে সুরুজ মিয়া জোরে জোরে বলে, ‘ও ভাবী কি পাকান?’
রান্নাঘর থেকে সিতারার জবাব আসে, বহেন, ডাইভাত খাইয়া যাইয়েন। ঘরের ভেতর থেকে আতমন্নেসা এসব স্পষ্ট শুনতে পারে। জানলা দিয়ে তাকালে দ্যাখা যায় মতিবিবি বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। দ্যাখো, সোয়ামী আসতে না আসতে ছেমরির মুখ কেমন ধুকধুকে হয়ে উঠলো! এই মুখ দেখলে কে বলবে যে আধঘন্টাও হয় নি, মেয়েটা তেলে ভাজা লাল লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুন ও তেল দিয়ে এক থাল ভাত সেঁটে দিয়েছে! আর এখন দ্যাখো না, তার গলায় জোর নেই, সে এই হাঁটতে পারে কি পারি না! রাত্রের ঠাণ্ডা বাসি জ্বরকে সরবাটার মতো সে মেখে রেখেছে তার মুখে, গালে ও চোখের কোণে। এই সব ভড়ং করেই তো স্বামীটাকে সে তুর্কিনাচন নাচাচ্ছে। জামাইটাই বা কিরকম পুরুষমানুষ যে বিয়ের পর চার বছর বাচ্চা হয় না, এখনো অন্য বিয়ে করার নাম পর্যন্ত করেনা। আবার ডাক্তার দ্যাখায়। বলে কি হাঁপানি ভালো হলে মতিবিবির বাচ্চা হতে পারে। কতো রঙের কথাই যে এরা জানে! নিজে পারো না, মাইনা কইরা ডাক্তার রাইখা পোলা পয়দা করবা, না? রাগে আত্মন্নেসার মুখ খারাপ করতে ইচ্ছা করে।
‘দাদী, একটা পান দাও।’
কমলালেবু পকেটে রেখে আলম আতমন্নেসার পানের ডিবেতে হাত দেওয়ার জন্যে অনেকক্ষণ ধরে একনাগাড়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ছ’টা পায়ার নিচে তিন ছয়ে আঠারোটা ইঁট দিয়ে উঁচু করা এই তক্তপোষে ওঠার জন্যে পেছন থেকে, সামনে থেকে, পাশ থেকে নানাভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে তাকে সরাসরি আতমনেসার শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু নাতি পান চাইলেই কি সঙ্গে সঙ্গে দিতে হবে?
‘কমলা খা গিয়া।’
‘না আমারে পান দাও।’
‘তর মায়ে কি করে রে?’
কিন্তু আলমকে ভোলানো অতো সহজ নয়, না আমারে পান দাও।’
‘তর মায়ে কি করে দেইখা আয় না!’
‘মায়ে পাকঘরে বইসা না খালি পানি ফালাইতাছে আর আমারে আমড়া দিবার চায় না। মায়ে না চামিচ ফালাইয়া দিছিলো! —কইছি। অহন পান দাও।’
‘পান দিমু। তর ফুফু কি করে দেইখা আয়।’
‘না যামু না। তুমি আমারে পান দাও।’
‘যা না ছ্যামরা, পান দিমু তো কইলাম। তর ফুপায় কি দাওয়াই লইয়া আইছে দেইখা আয়, যা! তরে দুই আনা পয়সা দিমু, যা!’
কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে আলম ফিরে আসে।
‘দাদী, ফুফু না কমলা খাইতে চায় না। ফুপায় একটা কোয়া লইয়া ফুফুর মুখের মইদ্যে হান্দাইয়া দিছে তো ফুফু থুক কইরা ফালাইয়া দিলো। ফুফু কয়, জ্বরের মুখে কমলা তিতা লাগে! হি হি! কমলা তিতা হইতে পারে, এ্যা?’
হায়রে, যতো অসুখ-বিসুখ কি কেবল তাদের কপালেই জোটে! আর আতমন্নেসার শরীরের দিকে কেউ একবার এতোটুকু খেয়াল পর্যন্ত করে না? মেয়ের এসব খুনসুটিতে আত্মন্নেসার কোনো আগ্রহ নেই, তার জানা দরকার ওষুধপত্রের কথা।
‘দাওয়াই দেখলি?’
‘দেখছি না?’ স্মার্ট ভঙ্গিতে আলম সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সে একটু হিমসিম খায়, বলতে কি কমলালেবু দেখে ওষুধের কথা তার মনেই ছিলো না, কিন্তু সে কথা তো স্বীকার করা যায় না। ওষুধের ওপর দাদীর টানের কথা সে ভালো করে জানে।
‘দাওয়াই দেখছি তো! ঠোঙার মইদ্যে কি সোন্দর ওষুধ দাদী, কতো বোতল, কতো বাকসো!’
.
‘ও ভাবী যাই গিয়া।’–জোরে জোরে এই কথা বলে সুরুজ মিয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
‘আম্মারে কইয়া যাই।’ গলা খাঁকারি দিয়ে সুরুজ মিয়া আতমন্নেসার ঘরে ঢোকে। জামাইকে দেখে আতমন্নেসা জড়সড় হয়, শুয়ে শুয়েই মাথায় আঁচল চড়ায়, সমস্ত শরীর গুছিয়ে নিতে গিয়ে তার ডান পায়ের হাঁটুতে শাড়ি উঠে আসে। মায়ের পায়ের কাছে বসে মতিবানু মায়ের শাড়ি টেনে দিলো।
‘আম্মা কেমন আছেন? শরীর কেমুন?’ যতো দোষ থাক, সুরুজ মিয়ার গলায় বড়ো মায়া।
‘আর বাবা শরীল!’
‘আম্মার শরীল মাশাল্লা খুব ভালো। আমরা কুনোদিন আম্মার জ্বর ভি হইতে দেহি নাই।’
মতিবানুর এই মাতৃস্তুতিতে আতমন্নেসার একটু আগে গোছানো শরীর ফের এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, জামাইয়ের সামনে না থাকলে সে হয়তো বিছানা থেকে গড়িয়েও পড়তে পারতো। পানের ছিবড়ে আটকানো প্রায়-ভাঙা গলায় সে হঠাৎ গোঙাতে শুরু করে, ‘না বাবা শরীলের মইদ্যে আমার কিছু নাই। বল পাই না বাবা! কিছু খাইতে পারি না, ভাত দেখলে মনে লয় বমি কইরা ফালাই, কি কই বাবা, তোমারে কই, এই দুইটা চোক্ষের মইদ্যে নিন্দের একখান দানা ভি নাইকা, রাইতে একবার জাগনা পাইছি তে তামানটা রাইত চোক্ষের পাতা আর এক করবার পারি না।’
‘না আম্মা, বিমার তোমার মনের মইদ্যে। বয়স হইছে, সংসারের মইদ্যে সুখ শান্তি পাইবা না তয়, মতিবানু আড়চোখে রান্নাঘরের দিকে একবার দ্যাখে, ‘শরীল আর ক্যামনে ঠিক থাকে? আম্মার বিমারি তার মনে, তার শরীল মাশাআল্লা বহুত ভালো।’
এই নতুন একটা রঙের কথা পেয়েছে এরা, আতমন্নেসার পুত্র-কন্যার দল। তার রোগ নাকি তার মনের, তার মনের খবর তার চেয়ে এরাই ভালো জানে! এদের বাপই কোনোদিন জানতে চেষ্টা করলো না, আর এরা কিনা আজ আতমন্নেসার মনের সুখ-শান্তি নিয়ে আচার-বিচার করে! এইসব বড়োলোকি বচন এই বাড়িতে চালু করে আতমন্নেসার মেজো ছেলে। মাস ছয়েক আগে নতুন বিয়ে করা বৌ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে বাড়ির সকলের বিশেষভাবে নতুন-বিয়ে-করা তার মায়ের সুখ-দুঃখ, রোগ-শোক ও অসুখ-বিসুখের একেবারে চূড়ান্ত পরিচয়টি উদ্ঘাটন করার জন্য খোরশেদ তৎপর হয়ে ওঠে। সুযোগ করে নিয়ে প্রায়ই বলতো, ‘আব্বায় তো জিন্দেগী ভইরা খালি খক খক কইরা কাশছে আর তার খেদমত করতে করতে আম্মার তামাম লাইফটা ইস্পয়েল হইয়া গেছে। আম্মার মনের মইদ্যে কুনো শান্তি নাই, বুঝলা না, আম্মার পুরাটাই হইলো মনের বিমার।’ সে আমলই দেয় না যে তার মায়ের শরীরের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে, পেটের ওপরের দিকে দিনরাত অস্বস্তিকর ঠেকে, চোখে ঘুম নাই! ছেলেটা বিশ্বাসই করে না। অথচ, নিজের পেটের পোলার গিবত কইতে হয় না, দুঃখে আতমন্নেসার পেটের অস্বস্তিকর পিন্ড ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে! বাপ মারা যাওয়ার পর খোরশেদের লেখাপড়া চালাবার জন্য তাকে কতো ঝামেলাই না পোহাতে হয়েছে! প্রতি মাসেই তখন সোবহান ওর লেখাপড়ার খরচ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। আতমনেসার তখন কতো কান্নাকাটি, সোবহানের বাপের নাম করে বানোয়াট সব সংলাপ ছাড়া,–এইসব করেই তো খোরশেদের লেখাপড়া এতোটা হলো! নইলে এই বংশে কেউ কোনোদিন স্কুল-কলেজে গেছে? লেখাপড়ার জোরে খোরশেদ বিয়েও করলো ভালো ঘরে, মেয়ে নিজেও ম্যাট্রিক ফেল। খোরশেদের বন্ধু-বান্ধব সব শিক্ষিত সমাজে, ভালো এলাকার লোক না হলে খোরশেদ মেলামেশা করতে চায় না। কিন্তু লেখাপড়া শিখলে যে মানুষ এতো রঙর কথা বলে সে কথা আগে জানলে কি আর–!
‘না আম্মা, ভাইবেন না। আপনের বিমার ঠিক হইয়া যাইবো ইনশাল্লা। এট্টু হাইটা-হুইটা বেড়ায়েন। চলাফিরা না করলে শরীল ঠিক থাকে না। বুঝেন না?’ তারপর সেই নির্লজ্জ জামাই শাশুড়ীর সামনেই বৌকে সোহাগী ধমক দেয়, ‘আম্মার শরীলখান দ্যাহো তো! এই বয়সেও কি আছে, এ্যা? আর তোমার? তুমি তো মায়ের কিছুই পাইলা না! মায়ের পাবেটা কি? মায়ের জন্য মতিবানু করলো কি যে মায়ের কিছু পাবে? আতমন্নেসা বিড়বিড় করে, ‘মাইয়া আমার বাপসোহাগী আছিলো, বাপে তারে দিয়াও গেছে। সোনাদানা, ঘরবাড়ি, খাট পালঙ্ক তো আর দিয়া যাইতে পারে নাই, বিমারটা দিয়া গেছে মতিবানুরে।’
‘হেইডা তো ঠিকই।’ সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিলো সুরুজ মিয়া। কি নিমকহারাম জামাই, বছরের ছ’টা মাস বৌকে রেখে দেয় তার বাপের বাড়ি; কোনো খরচপাতি না, পয়সা-কড়ি না। আর দ্যাখো, আতমন্নেসা কি বলতে কি বলেছে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, ‘হেইডা তো ঠিকই!’ তবে এই কথা বলার পর মতিবানুর চোখের ধমকে বাঁ হাতের মৃদু কোনো ইঙ্গিতে সে ফের প্রথম থেকে নামতা পড়ে, আম্মা, আপনে এট্টু চলাফিরা করেন। বুকের মধ্যে বল রাইখেন, দেইখেন আপনের বিমারী-উমারী কৈ যাইবো গিয়া! আমার ফুফুরে তো দ্যাহেন নাই, না?’ এবার শুরু হয় তার ফুফুর বৃত্তান্ত, ‘আমাগো বাড়ির কাছেই বিয়া হইছে। তয় ফুফুর এই ব্যারাম, বুঝলেন? ডাক্তারে, হেকিমে, কবিরাজে ছেইচা খাওয়াইছি। না কিছুই হয় না—ক্যামনে হয়? ব্যারাম তো তার মনের মইদ্যে!’ এরকম কতো ফুফু আর খালা আর দাদী আর নানীর গল্প আত্মন্নেসার শোনা হয়েছে। এসব আর ভাল্লাগে না। রাতে বলে তার ঘুম নেই, হাতে-পায়ে দিনরাত জ্বালা, মনে হয় হাতের তালুতে পায়ের তালুতে লঙ্কাবাটা লেপে দেওয়া হয়েছে আর এরা কেউ আমলই দেয় না। আর কতো? কখন সুরুজ মিয়ার গল্প শেষ হয় বোঝা যায় না। সুরুজ মিয়া চলে গেলে মতিবানু ভেতরের বারান্দায় গিয়ে আলমের খোঁজ করে। বারান্দা থেকে চি ৎকার করে কথা বলে সিতারার সঙ্গে, ‘ও ভাবী, নিমকপারা খাইবা? আলমরে পাঠাইয়া মোচড়ের দোকান থাইকা আট আনার নিমকপারা লইয়া আহি! খাইবা?’—বারান্দা আর রান্নাঘর—কটা হাত আর তফাৎ, এর জন্য এতো চেঁচিয়ে কথা বলার দরকার কি? গলায় এতো সুখের জোর এরা পায় কোত্থেকে? আতমনেসার চোখের সামনে হঠাৎ ঝাপশা ঠেকে। আজকাল প্রায়ই এরকম হয়। সে তখন কাত হয়ে শোয়। বালিশের পাশে রাখা ন্যাকড়ায় জড়ানো পান বের করতে করতে বালিশ থেকে মাথাটা একটু তুলতেই চোখের সামনে সব কিছু দুলে ওঠে। তার বুক ও পেটের মাঝখানে জোড়া স্তন যেখানে বিভক্ত হয়ে ঝুলে গেছে নিচের দিকে, তারও একটু নিচে একটা মাংসপিণ্ড ঠেলে ঠেলে কেবল ওপরের দিকে উঠে আসছে। তার একেকটা ধাক্কায় পেটের তরল পদার্থ সব গলার দিকে ছোটে! গলার কাছটা তেতো ঠেকে। তাড়াতাড়ি একটা পান খাওয়া দরকার। চোখ বন্ধ করে সে পানের একটা ছোটো টুকরো ছেঁড়ে। আরেক হাতে চুনের কৌটা খুলতে গিয়ে বোঝে যে এটা খোলাই ছিলো। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে পানের টুকরায় সে চুনকাম করে। কুচি-করা সুপারি আছে কাগজের বাক্সে, পান চুন সুপারি মুখে দিয়ে চিবোতেও তার ভয়, কি জানি এই ঘর ফের দুলে ওঠে। সাজা পান দাঁতের দুই পাটির মাঝখানে ফেলে চাপ দিলে একটু একটু ঝাঁঝালো রস তার গলার নল বেয়ে সেই দুষ্টু মাংসপিণ্ডের নিচে ও ওপরে গড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে তার পাকস্থলীতে। বমি বমি ভাবটা এখন কম, জানলা দিয়ে বাইরে তাকানো যাচ্ছে। জানলার ওপারে সরু বারান্দার পর ছোটো রোগা উঠান। এই উঠানে কোনো একটা জায়গা নেই যেখানে নির্ভেজাল মাটি পাওয়া যায়। সব জায়গায় সুড়কি সিমেন্টের গুড়ো ছড়ানো। আজকাল চোখের কি হয়েছে, এই বালু কি সিমেন্টের গুড়োর দিকে তাকালেই চোখ খচখচ করে। উঠানের একপ্রান্তে বাজে কাঠ ও কেরোসিন টিনের ঘেরাও দিয়ে এক চিলতে রান্নাঘর, রান্নাঘরের দরজায় পিঠ দিয়ে বসে মতিবানু গল্প করছে। সিতারার সঙ্গে মতিবানুর কি এতো সোহাগের কথা?
‘দাদী, ও দাদী, একটা রিকসা না একটা টেরাকের লগে বাড়ি খাইয়া এক্কেরে ছেঁইচা গেছে।’ আলমের কথা শুনে আত্মন্নেসার মাথার ভেতরে আবার নতুন বিন্যাস শুরু হয়।
দাদী আমারে পান দিলা না? পানের ডিবে চোখে পড়ায় ট্রাক ও রিকশার সংঘর্ষের কথা আলম ভুলে যায়।
‘তরে না কইলাম তর ফুফুর ঘরে গিয়া দেইখা আয় দাওয়াই কই রাখছে! যা!’
‘তাইলে আমারে দুই আনা পয়সা দিতে হইবো।
‘দিমু। যা!’
মতিবানুর ওষুধপত্র থাকে তার টিনের সুটকেসের ওপর। কিন্তু আতমন্নেসা একদিন তার মেয়ের এক বোতল বি-কমপ্লেক্স গিলে ফেলার পর থেকে মতিবানু ওষুধপত্র রাখে সুটকেসের আড়ালে। আলম সেই জায়গাটাও চেনে। কিছুক্ষণের ভেতর আলম ফিরে আসে খাকি কাগজের ঠোঙা হাতে। ঠোঙা দেখে আতমন্নেসার প্রায়-তোবড়ানো গালের ভাঁজে ভাঁজে রক্ত ছলকে ওঠে, তার বুক কাঁপে, অগোছালো হাত সে বাড়িয়ে দেয়, ‘এক্কেরে লইয়া আনছস! দে! আরে আমার ভাইধন!’ ‘ফুফুর দাওয়াই ব্যাকটি লইয়া আইছি। দুই আনা না দিলে দিমু না।’ রান্নাঘরের দরজায় বসে নিমকপাড়া খেতে খেতে মতিবানু সিতারার সঙ্গে গল্প করে।
আতমন্নেসা চাপা গলায় নাতিকে ধমকায়, ‘চুপ কর ছ্যামরা।’ বালিশের নিচে একটু হাতড়াতে কয়েকটা মুদ্রা পাওয়া যায়। দুটো দশ পয়সা আলমের হাতে তুলে দিলে সে ফের ঘ্যানঘ্যান করে, ‘চাইর আনা দাও দাদী, একটা আইসক্রীম খামু।’ আতমন্নেসার তৃপ্ত হাতের উদার ফোকর গলে দশ পয়সার আর একটি মুদ্রা আলমের হাতে পড়লে সে বাইরে চলে যায়।
আতমন্নেসার কাঁপা-কাঁপা আঙুল ও তালুতে ধরে রাখা এখন কতো ওষুধ। আহা, মতিবানু কতো কিসিমের দাওয়াই খায়। যৌবন তো একদিন আত্মন্নেসারও ছিলো। হয়তো হাঁপানি হয়নি, যক্ষা কালাজ্বর পায়ে পানি -ধরা কলেরা আমাশা—এইসব রোগ তাকে চিরকাল অদ্ভুত মনে করে তার ধারে কাছে ঘেঁষেনি। কিন্তু কখনো কখনো গা-গরম তো করতোই। করতো না? ভরপেট সেহরি খাওয়ার ফলে সারাটা রমজান মাস ধরে সকালবেলা তার চোঁয়া ঢেকুর উঠতো, বুকটা জ্বলতো, –কৈ এক ফোঁটা দাওয়াই তো তার জন্যে ঘরে আসেনি। তার হাতে এখন একটা স্বচ্ছ খয়েরি রঙের ছোটো শিশি,–শিশির ভেতরে সাদা তুলোর নিচে দুই রঙের লম্বাটে বড়ি, আহা রঙের কি বাহার! কিন্তু এই ওষুধ বার করা যাবে না, মতিবানু এটা একবারো ব্যবহার করেনি, এর মুখটা এখন পর্যন্ত টাইট করে সাঁটা। একটা আঠার মতো তরল ওষুধের শিশি, এই শিশিটাও বেশ সুন্দর। —মাথার কাছে সাজিয়ে রাখলে কি সুন্দর লাগে! —ওষুধ শেষ হলে দুটো শিশিই সে চেয়ে নেবে মতিবানুর কাছ থেকে। ছোটোটায় জরদা রাখবে, বড়োটা কিভাবে ব্যবহার করা যায় তাই নিয়ে সে ভাবনায় পড়ে। ওষুধ আরো আছে, শক্ত রাঙতা পাতায় খচিত বড়ো বড়ো ট্যাবলেট, দশটা ট্যাবলেট। এরকম একটা পাতা শিয়রের কাছে রাখলে কতো সুখ! আর একটা কাগজের পেট-উঁচু খাম। খুলতে গিয়ে বেকায়দায় কয়েকটা ছোটো ট্যাবলেট গড়িয়ে মেঝেতে ও চিলমচির প্রান্তে পড়ে যায়। কয়েকটা ট্যাবলেট তার হাতে। এইসব ট্যাবলেট হঠাৎ তার হাতে এবং ক্রমে মাথায় আবাবিল পাখির মতো ঠোকরাতে চায়, প্রায় লাফ দিয়ে সে উঠে বসে বিছানার মাঝখানে। এই তো সেই ছোট্টো ট্যাবলেট, তার স্বামী সারা জীবন কেবল একা একা ভোগ করে গেছে, তার কপালে একটা দানাও জোটেনি কোনোদিন। সোবহানের বাপকে মনে হয় এই ট্যাবলেটই সে দিতো রোজ রাত্রে। এতোকাল পর সেই বড়ি ফের তার হাতে এসেছে। না, এই সুযোগ নষ্ট করা যায় না। পাশে জানালার তাকে সকাল থেকে রাখা আছে আধ গ্লাস পানি। আত্মন্নেসা ডান হাতের ট্যাবলেট বা হাতে চালান করে ডান হাতে সেই গ্লাস ধরে। বিড়বিড় করে করে ‘বিসমিল্লা’ বলে এক ঢোক পরিমাণ পানি মুখে নিলো, তারপর জরদা মুখে দেওয়ার মতো চার পাঁচটা ট্যাবলেট ঝেড়ে ফেললো মুখের ভেতর।
এরপর ভালো করে শুয়েছে কি শোয়নি, বালিশে মাথাটা তেমনভাবে পড়েও নি, তার চোখের সামনে থেকে মতিবানু ও সিতারাকে নিয়ে রান্নাঘরের দরজা, বাসন-কোসন, নালা, নালার পাশের ময়লা ও সুড়কি ও সিমেন্টের গুঁড়োময় উঠান এবং বারান্দার প্রান্ত একসঙ্গে উধাও হয়ে গেলো। এইসব পরিচিত দৃশ্য চলে যাওয়ার পর সেই শূন্যতা আর পূর্ণ হলো না। সুতরাং তার চোখের সামনে কেবলি অন্ধকার। কোথাও কোনো সাড়া নেই। আরো কয়েকটা পলক কেটে গেলে মনে হয় পেটের সেই ছোট্টো দলাটা যেন পাকস্থলির গভীর ভেতর থেকে আস্তে আস্তে ওপরে ভেসে উঠছে। খুব ধীরে ধীরে কি যেন তার পেটের ওপর দিকটায় দুলছে। একবার দোলে ডানদিকে, একবার তার গতির বৃত্ত ছিঁড়ে ওপরের দিকে উঠে আসতে চায়। সে সময়টা পেট জুড়ে জানান দিয়ে যায় তীব্র ব্যথা। ফের তার নিজস্ব বৃত্তে ধীর গতিতে সে দুলে দুলে ফিরে আসে। আরো পলক কাটে। সেই মাংসপিণ্ড এখন কেবলি বুকের দিকে আসছে। আতমন্নেসার চোখের সামনে জগৎ তীব্র গতিতে ঘুরতে শুরু করে। এ কি তার বুক বেয়ে গলার নল বেয়ে তিরতির করে একেবারে মুখে চলে আসবে? এই ঘোরতর অন্ধকার এবং মহাদোলনের ঝোঁকেও বহুকাল আগেকার খুব কচি একটা মুখ একেকবার ভেসে ভেসে ওঠে মতিবানুর পর একটা ছেলে হয়েছিলো আত্মন্নেসার, সেই ছেলেটা পেটে থাকতে তার এরকম হতো। মনে হতো পেটের শিশু এবার বোধহয় হামাগুড়ি দিয়ে ওপর দিকে উঠছে। তখন তার কথাকে কি কেউ পাত্তা দেয়? ননদকে একদিন বলেছিলো, তা ফুলজান হেসেই অস্থির, সোবহানের বাপকে ডেকে বলে, ‘অ মিয়াভাই, হুনছো? ভাবীর প্যাটের মইদ্যে কোন পীরসাব না শাসাবে আইয়া খানকা বানাইছে! হুনছো? পীরসাব নিচ দিয়া বারাইবার চায় না। পীরসাবে ভাবীর সিনার মইদ্যে না উইঠা একখান ফাল পাড়বো তে এক্কেরে বারাইয়া পড়বো ভাবীর মুখের মইদ্যে দিয়া! আল্লারে আল্লা!’
—তা ননদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ শুনতে তার খুব গোপন একটা সাধ হয়—এইবার ছেলে হলে তাকে মৌলবি বানাবে। কিন্তু সেবার পেট থেকে নিচে দিয়ে নামলো একটা মৃত শিশু। সেই শিশুর অনুচ্চারিত ওঁয়া ওয়া ধ্বনি কোন দূর পরপার থেকে তার কানে বাজে। এবার সেই রকম আওয়াজ করতে করতে, পেটের দলাপাকানো বস্তুটি হড়হড় করে চলে আসছে ওপরের দিকে। এইতো এখন তার বুকে, বুকের ন্যাতানো স্তনে ঢেউ খেলে যায়, তারপর এইতো এখন তার গলার নিচে, এইবার –। এবার মাংসপিণ্ড বেরিয়ে আসছে গলা বেয়ে। বমি করার জন্য নিচু হয়ে চিলমচি টানতে যাবে, আত্মন্নেসা চিলমচি আর হাতড়ে পায় না। সামনে এখন অন্ধকার,—ঘুরঘুইটা আন্ধার! তার চারদিকে পানির মতো চাপবাঁধা বাতাস। বাতাস কি পানিতে পরিণত হলো? পানি কি পাথর হয়ে জমে গেছে? নিশ্বাস নেওয়ার জন্য বাতাস পাওয়া যায় না। একটা শ্বাস এই নিলো তো সহজে ছাড়া যায় না, নাকের সামনে পাথর। আর কিছু দ্যাখা যায় না। চারদিকে পাথরে জমা অন্ধকার ঘুরছে, অন্ধকারের ভেতর অন্ধকার। তার বলহীন হাত পা মাথামুণ্ডু বুক পিঠ-এপাশে ওপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, অন্ধকারের নিচে আরো অন্ধকার গহ্বরে আতমন্নেসা ডুবে যায়।
শীতলপাটির নিচে চুনসুড়কির এবড়োখেবড়ো মেঝে পিঠে লাগে। এদিক ওদিক পানির ঝাপটা। তার চার পাশে এতো লোক কেন? এসব কারা? চোখ সম্পূর্ণ খোলাও যায় না যে ভালোভাবে দেখে নেয়। বিছানার সঙ্গে জানলা কোথায়? জানলার ওপারে বারান্দা কোথায় বারান্দার ওপার উঠান পর্যন্ত আতমন্নেসা মনে করতে পারে না। তাকে চোখ মেলতে দেখে ফোঁপানিরত মতিবানু হাউমাউ করে ওঠে, ‘জেতা রইছো, আম্মা জিন্দা রইছো, জিন্দা আছো গো আম্মা?’
‘চিল্লাও ক্যান? চুপ করো।’ সুলতান ডাক্তারের ধমক খেয়ে মতিবানু ফের ফোঁপানিতে ফিরে আসে। আতমন্নেসার চোখজোড়া আস্তে আস্তে সব দেখতে শুরু করে। এতো লোক কারা? এতো লোক কেন? এরা কারা?–হ্যাঁ, এইতো তার মেজো ছেলে খোরশেদ,–সুলতান ডাক্তারের কানের কাছে মুখ নিয়ে কি বলছে। এইতো বড়ো ছেলে সোবহান, আলমের কাছ থেকে একটা কাঁচের গ্লাস কেড়ে নিচ্ছে,–আঃ! পিচ্চিডার লগে কি করে!–সুলতান ডাক্তার কেন? মতিবানুর হাঁপানির টান কি বাড়লো? না কি তার নতুন কোনো উপসর্গ দ্যাখ্যা দিলো? না, মতিবানু তো তার কপালে হাত রেখে ফোঁপাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে হাসান আলি ওস্তাগার, তার পাশে আমীর পাগলার বৌ, পায়ের কাছে আহসানুল্লার মেয়ে ছুটকি। এতো লোকজন দেখতে দেখতে তার চোখ হয়রান হয়ে ঘুমে জড়িয়ে আসে। এরই ভেতর নিজের কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আতমন্নেসার হাত এদিক ওদিক করে। কিন্তু শিথিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বশে আসতে চায় না।
আতমন্নেসার জ্ঞান ফিরে আসার পরও সুলতান ডাক্তার নানাভাবে তাকে পরীক্ষা করে। ওষুধপত্র অসাবধানে রাখার জন্য মতিবানুকে সে একটু বকলো। মানুষের বার্ধক্য ও শৈশবের সাদৃশ্যের ওপর একটি বক্তৃতাও সে দিয়ে ফেলতো, কিন্তু আতমন্নেসার শরীরের বিভিন্ন খাদ, অভাব ও ঘোরতর অনিয়ম দেখে তার নিজেরই অবস্থা কাহিল। এই মহল্লায় তার প্র্যাকটিস আজ বহুদিনের; প্রথম দশ পনেরো বছর ছিলো ন্যাশনাল-পাশ মন্মথ ডাক্তারের কম্পাউণ্ডার, মনাথ বসাক ইণ্ডিয়া চলে গেলে সে পুরোপুরি ডাক্তার হয়ে বসেছে,–তা সেও বিশ বছরের কম নয়। এদের সবাইকে সে চেনে এদের জন্ম থেকে। সোবহান ও খোরশেদকে আড়ালে ডেকে সে বলে, ‘তোমাগো মায়েরে একবার মেডিক্যাল লইয়্যা যাও!’
‘ক্যান?’ সোবহান বেশ বিচলিত হয়, ‘মতির ওষুদ যা খাইছিলো ব্যাকটি না বারাইয়া গেছে।
‘এটা কোনো প্রবলেম না। মনে হয় তোমাগো মায়ের কঠিন ব্যারামে ধরছে।
‘কি ব্যারাম?’
‘টেস্ট না কইরা কিছু কইতে পারি না। আমিও তোমাগো লগে মেডিক্যাল যামু। বড়ো ডাক্তারগো লগে কথা কইতে হইবো।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সিতারা এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এলে আতমন্নেসা বড়ো কাচুমাচু হয়ে বলে, ‘আমার লাইগা আবার দুধ লইয়া আইছো ক্যান?’ অপরাধে সে একেবারে নুয়ে পড়ে, মতিবানুর লাইগা রাখছো? আলমে খাইবো কি?’
.
পরপর কয়েকটা দিন একবার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, একবার বাড়ি—এই করে কাটে ওদের। সোবহান মেডিক্যাল কলেজ যায় সকালে, আটটার আগেই মাকে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। একটু বেলা করে যায় খোরশেদ, সোবহান তখন ফেরে ওর বেকারিতে। ডাক্তারদের তোয়াজ করা, নার্সদের সামলানো—এসব দ্যাখে খোরশেদ। তারপর সোয়া দুটো আড়াইটের দিকে নিজেই একটা রিকশা করে মাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। পয়সা বেরিয়ে যাচ্ছে পানির মতো। কতোরকমভাবে আতমন্নেসার পরীক্ষা চলছে। তার বুকের ভেতরকার রহস্য এবং তার পেটের অন্তর্গত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কুশল জানবার জন্য ছবি তুলতে তাকে নিয়ে গিয়েছিলো একটা একটু অন্ধকার ঘরে। সেই ঘরের বারান্দায় বেঞ্চে বসে থাকে সারি সারি রোগী। আর ঘরে যন্ত্র লাগিয়ে আতমন্নেসার ভেতরকার ছবি তোলা হয়। তার হৃদপিণ্ডের মাপ নেওয়ার জন্য তার বুক পিঠ হাত পা সব ফিতে দিয়ে বেঁধে ওরা কিসব করলো। আতমন্নেসা ঠিক সাজিয়ে বলতে পারে না, একটার সঙ্গে আরেকটা বড্ডো গুলিয়ে ফেলে। বাড়ি ফিরে সে হাঁপাতে হাঁপাতে গোঙায়, মতি, অ মতি, কি করস? অ বৌ, কি করো? আউজকা না আমারে একটা ঘরের মইদ্যে লইছে, বুঝলি, ঘুরঘুইট্টা আন্ধার বুঝলি?–একটা বেটায় না কয়, আপনের রক্ত লমু। আমি না ডরাইয়া গেছি! আমার খালি গতর কাঁপে!’ মেলা দেখে আসা ছোটো মেয়ের মতো কোনটা আগে বলবে সে বুঝতে পারে না, ‘অ মতি, আউজকা না খোরশেদে আমারে একটা ঘরের মইদ্যে লইয়া গেছে, বুঝলি? হি হি, কিসব ফিতাফুতা দিয়া আমার বুক বান্দে, পিঠ বান্দে, হাত পাওয়ের উংলি ভি বান্দে, কি করবো? না, আমার কলিজার মাপ লইবো! হি হি! খুশিতে আতমন্নেসার নিশ্বাস নিতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়।
ডাক্তাররা শেষ পর্যন্ত জানায় যে অপারেশনের সময় পার হয়ে গেছে; না, টিউমার না, টিউমারের বাবার বাবা, ক্যান্সার। এখন কিছু করার নেই, মাঝে মাঝে হাসপাতালে নিয়ে রেডিও থেরাপির ফুঁ দিয়ে মরণকে যতোদিন ঠেকানো যায়!
বাড়িটা রাতারাতি মন্থর হয়ে গেলো। সিতারার নীরব ও সরব মুখ ঝামটানি আপাতত স্থগিত। মতিবানুর রঙ-ঢঙ সোহাগীপনা সব শেষ। মেয়েটা কেবল কথায় কথায় ফুঁপিয়ে কাঁদে, অ আম্মা, আম্মাগো, কি বিমারি ধরলো তোমারে!’
‘আমি কই নাই? গোঙাতে গোঙাতে জবাব দেওয়ার সময় আতমনেসার পান-খেতে-না-পারা ফ্যাকাশে ঠোঁটের কোণে ছোটো একটু গোলাপি মিষ্টি হাসি চিকচিক করে, যেন বাজি রেখে সে জিতে গেছে, আমি তগো আগেই কইছিলাম!’
খবর পেয়ে বড়োমেয়ে তার নিজের ও তার সতীনের এক গাদা ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে হাউমাউ করে খানিকটা কাঁদলো। আতমন্নেসা বলে, ‘অ নুরু, তর জামাইরে আইতে কইস! খানদানী ঘরের মানুষ, দাওয়াইগুলি চিনবো, কতো দাওয়াই দিছে, দ্যাখস না?’
দিনে দিনে পেটের ব্যথা বাড়ে। রোজ কয়েকবার বমি হয়। বেশি পরিমাণে বমি হলে পেটের ব্যথা থিতিয়ে ভোঁতা হয়ে আসে। পাতলা তন্দ্রায় তখন শরীর শিথিল হয়। পেটের অবাঞ্ছিত মাংসপিণ্ডের হৃদস্পন্দন অনুভব করার জন্য কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে আতমন্নেসা নিজের পেটে আস্তে আস্তে হাত বুলায়। প্রথমবার যখন সে গর্ভবতী হলো সোবহানের বাপ তখন কোনো কোনো রাত্রে এমনি করে হাত বুলিয়ে দিয়েছে, কি জানি হয়তো একদিন দিয়েছিলো কিংবা দু’দিন—মনে নাই। সে যে কতোদিন হয়ে গেলো, কতোকালের কথা! সময়টা কিছুতেই ঠাহর করা যায় না, মেলে না, কোনো হিসাব মেলে না। বছরের হিসাব মেলাতে গেলে তার মাথা ঘোরে, বমি বমি লাগে, বমি করার পর ঘুম পায়। ঘুমের মধ্যেও তার এক হাত থাকে নিজের পেটের ঐ জায়গায়। হাত মাঝে মাঝে সরে যায় কিংবা কাঁপে-। সোবহানের বাপ তার পেটে হাত বোলাতে বোলাতে পেটে না পিঠে?—একটা শাড়ি ঘেরা রিকশায় করে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে–রূপমহল না মায়া কি একটা হলের নাম ছাই মনেও থাকে না, কি একটা খেল দেখতে। কি খেল? না মনে নাই। ইন্টারভ্যালের সময় মেয়েদের ক্লাসের আয়া এসে হাতের ভেতর চিনেবাদামের ঠোঙা গুঁজে দিলো,–‘আলুবাজার থন আইছো না? তোমারে পাঠাইয়া দিছে।’ শুনে আশেপাশের মেয়েদের কি হাসি। —ছবি শেষ হলে বাড়ি ফেরার সময় সোবহানের বাপ জিগ্যেস করে, ‘হায় হায় একটা বাদাম ভি খাও নাই?’ ‘অতোগুলি মানুষের সামনে ক্যামনে খাই?’ ‘হায় রে, মানুষ কই দেখলা, তোমার আগেপিছে ব্যাকটি তো মাইয়ামানুষ! হায়রে বিবি আমার, বাঙ্গুবিবি একখান!’ ‘হ বাঙ্গুই তো, বাঙ্গুই ভালো!’—ঘুমের মধ্যে সোবহানের বাপ পেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পাছার নিচে থেকে রিকশার সিট কখন সরে যায়, এখন ঘোড়ার গাড়ি করে সদরঘাট থেকে ফিরে যাচ্ছে আলুবাজারের দিকে।—জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে রাস্তা দেখছে আত্মন্নেসা। সোবহানের বাপ চিনিয়ে দেয়, এইটা চিনো? এটা চিনো?? কোন একটা হলের সামনে কোন বায়োস্কোপের মস্ত বড়ো ছবি। একটা মেয়ে মস্ত বড়ো গাছের সঙ্গে দোলনা বেঁধে দোল খাচ্ছে। এতবড়ো মেয়ে, লজ্জা-শরম যদি একটু থাকে। মেয়েটা দোলে। এদিক দোলে ওদিকে দোলে, এই দ্যাখা যায় একেবারে আতমন্নেসার মুখের সামনে, আবার সরে যায় খানিকটা দূরে। দুলছে, দুলতে দুলতে মেয়েটা দুলছে I ‘আম্মাগো, যাই গিয়া, অ মা!’ বড়োমেয়ের ভিজে কণ্ঠস্বরে আতমন্নেসা ঘুম থেকে তন্দ্রায় আসে।
‘যাওন নাই!’ নিজের খসখসে স্বরে তার তন্দ্রাও ছিঁড়ে যায়, কিন্তু ঘোর কাটতে চায় না। জড়ানো চোখ মেলে ডানদিকে তাকায়, ডানদিকে একটা টুল। টুলের ওপর ওষুধপত্রের লম্বা রোগা মোটা ও বেঁটে শিশি বোতল, ট্যাবলেটের পাতা, টয় গ্লাস, থার্মোমিটার, হটওয়াটার ব্যাগ, আইস ব্যাগ। আতমন্নেসা নিজের ঐ এক অবাধ্য চোখজোড়া প্রায় ধাক্কা দিয়ে সম্পূর্ণ খুলে দ্যাখে, না সব ঠিক আছে। পাশের শিশিটা কি সুন্দর! ওটা একেবারে ধারে রেখে দিলো কে? কার হাত লেগে পড়ে যাবে, দ্যাখো তো! তবু সারি সারি ওষুধ কি সুন্দর দ্যাখায়! না, সব ঠিক আছে! কিন্তু পোড়ার চোখ কি বশে থাকে? কিছুতেই খোলা রাখা যায় না। ওষুধের দিকে দেখতে দেখতে তার চোখ বুজে আসে, অন্ধকার জগৎ ফের দুলতে শুরু করে। নিজেই দোলনায় দুলতে দুলতে জড়ানো গলায় আতমন্নেসা জামাইয়ের প্রতি সাদর নিমন্ত্রণ পাঠায়, ‘অ নুরু! দামানরে আইতে কইস! কইস আমার বহুত কঠিন বিমার হইছে, একদিন আইয়া দেইখা যাইবো। বহুত কঠিন বিমার।’
১৯৭৫