অসীমের উপলব্ধি

অসীমের উপলব্ধি

উপনিষদ বলেন: “মানুষ যদি এ জীবনে ঈশ্বরকে বুঝতে পারে তা হলে সে সত্য হয়ে ওঠে; অন্যথা, তার চরম দুর্দশা হয়।”

কিন্তু এই ঈশ্বরলাভের স্বরূপ কী? এটি স্পষ্ট যে অসীম অনেকের মধ্যে কোনো একটি সামগ্রীর মতো নন, যে তাঁর নির্দিষ্ট শ্রেণীবিভাগ করা যায় ও আমাদের অধিকৃত সামগ্রীর মধ্যে রাখা যায়, যাতে আমাদের রাজনীতিতে, যুদ্ধে, ধন-অর্জনে অথবা সামাজিক প্রতিযোগিতায়, আমাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বন্ধুরূপে তাঁকে ব্যবহার করা যায়। আমাদের ঈশ্বরকে আমরা আমাদের গ্রীষ্মকালীন আবাসনের, মোটরগাড়ির, অথবা আমাদের ব্যাঙ্কে জমানো টাকার সঙ্গে একই তালিকায় রাখতে পারি না, যেমন ক’রে মনে হয় অনেকেই চাইছেন।

আমাদের অবশ্যই বুঝতে চেষ্টা করতে হবে যে মানুষের আত্মা যখন তার ঈশ্বরকে আকুল ভাবে পেতে চায় সেই চাওয়ার প্রকৃত স্বরূপ কী? একি তার নিজস্ব সম্পদের মধ্যে, যত মূল্যবানই হোক না কেন, আরো একটি সংযোজন করার ইচ্ছা? জোরের সঙ্গে না! আমাদের সঞ্চিত ভাণ্ডারে এই ক্রমাগত সংযোজন এক বিরামহীন ক্লান্তিকর কাজ। বাস্তবিক, আত্মা যখন ঈশ্বরকে খোঁজে, তখন সে এই অবিরাম সংগ্রহ করা, স্তূপাকার করা ও কখনো শেষ না করার থেকে পরম নিষ্কৃতি খোঁজে। সে যা খোঁজে তা কোনো অতিরিক্ত বিষয় নয়, কিন্তু তা “নিত্যোঽনিত্যানাম্,” সমস্ত অনিত্যের মধ্যে নিত্য, “রসানাং রসতমঃ”, সমস্ত আনন্দরস একীভূত করা পরমানন্দ। সেইজন্য উপনিষদ যখন আমাদের সমস্ত কিছু ব্রহ্মের মধ্যে উপলব্ধি করার উপদেশ দেন, তা অতিরিক্ত কিছু খোঁজার জন্য নয়, নতুন কিছু নির্মাণ করার জন্য নয়।

“এই জগতে যা কিছু রয়েছে সবই ঈশ্বর দ্বারা পরিব্যাপ্ত বলে জেনো।”

“তিনি যা দিয়েছেন ত্যাগের দ্বারা ভোগ করো, যে ধন তোমার নয় তার প্রতি লোভ তোমার মনে স্থান দিও না।”

যখন তুমি জানো যা কিছু রয়েছে সবই তাঁর দ্বারা পরিব্যাপ্ত এবং তোমার যা কিছু আছে সবই তাঁর দান, তখন তুমি সীমার মধ্যে অসীমকে, দানের মধ্যে দাতাকে উপলব্ধি করো। তখন তুমি জানো যে বাস্তবের সমস্ত তথ্যের একমাত্র অর্থ রয়েছে একই সত্যের প্রকাশে, আর তোমার সমস্ত সম্পদের একমাত্র তাৎপর্য রয়েছে অসীমের সঙ্গে যে সম্বন্ধ তারা স্থাপন করে তার মধ্যে, তাদের নিজেদের মধ্যে নয়।

কাজেই এ কথা বলা যায় না যে আমরা যেমন ক’রে অন্য বস্তু খুঁজে পাই ব্রহ্মকেও সেই ভাবে পাই; একটি বস্তু ছেড়ে পছন্দ মতো অন্য একটি বস্তুর মধ্যে, একটি স্থানের বদলে অন্য একটি স্থানে তাঁকে অনুসন্ধানের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ভোরের আলোর জন্য আমাদের কোনো মুদিখানায় দৌড়াতে হয় না; আমরা চোখ খুলি আর সেখানেই সে থাকে; ব্রহ্ম সর্বত্র রয়েছেন তা দেখার জন্য আমাদের শুধু নিজেকে দিয়ে দেওয়া দরকার।

এই কারণে বুদ্ধদেব আমাদের ব্যক্তিজীবনের বদ্ধ অবস্থা থেকে নিজেদের মুক্ত করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। এর জায়গায় আরো সদর্থক ভাবে পরিপূর্ণ ও তৃপ্তিকর কিছু যদি না থাকে, তা হলে এই শিক্ষা সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে যাবে। কোনো কিছু লাভ না ক’রে নিজের সর্বস্ব সমর্পণ করার এই উপদেশ কোনো মানুষ গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না, এর জন্য নিতান্ত কম উৎসাহ বোধ করে।

সেই কারণে আমাদের প্রতিদিনের ঈশ্বর-উপাসনা আসলে তাঁকে ক্রমে ক্রমে অধিগ্রহণ করার পদ্ধতি নয়, বরং মিলনের সমস্ত বাধা দূর ক’রে ও তাঁর সম্বন্ধে আমাদের চেতনাকে ভক্তিতে ও কর্মে, মঙ্গলে ও প্রেমে প্রসারিত ক’রে নিজেদের সমর্পণ করার দৈনন্দিন প্রক্রিয়া।

উপনিষদ বলেন: “পুরোপুরি লক্ষ্য বিদারক তীরের মতো ব্রহ্মে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাও।” এই রকম সম্পূর্ণভাবে ব্রহ্মের দ্বারা আবৃত হওয়া সম্বন্ধে সচেতন থাকা শুধুমাত্র মনঃসংযোগের কাজ নয়। এ আমাদের সারা জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমাদের সমস্ত চিন্তায় ও কর্মে অসীমের সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিনে যেন এই সত্যের উপলব্ধি সহজ হয়ে ওঠে যে, “সর্বব্যাপী আনন্দের কর্মচাঞ্চল্য যদি আকাশ ভরে না থাকতো, তা হলে কেউ জীবিত থাকতে পারতো না, সচল থাকতো না।” আমাদের সমস্ত কর্মে আমরা যেন সেই অসীম কর্মচাঞ্চল্যের প্রেরণা অনুভব করি এবং আনন্দিত হয়ে উঠি।

বলা যেতে পারে অসীম আমাদের অভীষ্ট লাভের থেকে অনেক দূরে, তাই হতে পারে আমাদের কাছে যেন তার অস্তিত্বই নেই। হ্যাঁ, অভীষ্ট লাভ শব্দটি যদি কোনো অধিকারের ধারণার ইঙ্গিত দেয়, তা হলে স্বীকার করতেই হয় যে অসীম অনধিগম্য। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের সর্বোচ্চ আনন্দ কোনো কিছুর অধিকারের মধ্যে নয় কিছু পাওয়ার মধ্যে, যা একই সঙ্গে পাওয়া নয়। অনুপলব্ধ সুখের জন্য আমাদের দৈহিক সুখ কোনো প্রান্তই ছেড়ে দেয় না। পৃথিবীর প্রাণহীন উপগ্রহের মতো, তাদের চারপাশে কিন্তু সামান্য পরিমণ্ডল থাকে। যখন আমরা খাদ্য গ্রহণ করি ও আমাদের ক্ষুধা পরিতৃপ্ত হয় তখন তা হয় সম্পূর্ণ অধিকারের কাজ। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষুধা তৃপ্তি না হয় ততক্ষণ খাওয়া সুখের হয়। কারণ তখন আমাদের খাওয়ার আনন্দ প্রতিক্ষণে অসীমকে স্পর্শ করে। কিন্তু যখন তা সম্পূর্ণ হয়ে যায়, বা অন্য ভাবে বললে, যখন আমাদের খাওয়ার ইচ্ছা না মিটবার শেষ পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন তার আনন্দও শেষ হয়ে যায়। আমাদের সমস্ত বুদ্ধিগত সুখের প্রান্ত অনেক বিস্তৃত, সীমা সুদূরপ্রসারী। আমাদের গভীরতর প্রেমে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি সবসময় সমান্তরাল যায়। আমাদের একটি বৈষ্ণব গীতিকবিতায় প্রেমিক প্রেমিকাকে বলেন, “মনে হয় আমার জন্মের থেকে আমি যেন তোমার মুখের সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে আছি, তবুও আমার দুইটি চোখ এখনো ক্ষুধার্ত রয়ে গেছে: আমি যেন কোটি কোটি বৎসর তোমাকে আমার হৃদয়ে জড়িয়ে রেখেছি, তবুও আমার হৃদয় তৃপ্ত হয়নি।”

এর থেকে স্পষ্ট হয় যে আমাদের সুখের মধ্যে আসলে আমরা অসীমকে খুঁজি। আমাদের ধনী হওয়ার বাসনা কোনো বিশেষ অঙ্কের অর্থলাভের বাসনা নয় বরং এই বাসনা অনির্দিষ্ট, আর আমাদের সব থেকে ক্ষণস্থায়ী সুখ আসলে অসীমের মুহূর্তের স্পর্শ। মানবজীবনের বিয়োগান্ত নাটক (ট্র্যাজেডি) রয়েছে যা কখনো অসীম হবে না সেই বস্তুর সীমাকে প্রসারিত করে— অদ্ভুতভাবে সসীমের সোপান ধরে অসীমে পৌঁছানোর জন্য আমাদের নিষ্ফল প্রচেষ্টার মধ্যে।

এর থেকে স্পষ্ট হয় যে আমাদের আত্মার প্রকৃত ইচ্ছা আমাদের সমস্ত অধিকৃত সামগ্রী অতিক্রম ক’রে যাওয়া। যা সে স্পর্শ করতে পারে ও অনুভব করতে পারে, তার দ্বারা পরিবৃত হয়ে থেকে সে আর্তনাদ করে, “আমি পেয়ে পেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি; হায়, তিনি কোথায় যাঁকে কখনো পাওয়া যায় না?”

মানব ইতিহাসে সর্বত্র আমরা দেখি ত্যাগের ভাবই মানবাত্মার গভীরতম সত্য। আত্মা যখন কোনো কিছু সম্বন্ধে বলে, “আমি এটি চাই না, কারণ আমি এর ঊর্দ্ধ্বে” তখন তার অন্তরের পরম সত্য তার মুখে ধ্বনিত হয়। যখন একটি বালিকার জীবন তার পুতুলকে ছাড়িয়ে যায়, যখন সে উপলব্ধি করে যে তার পুতুলের থেকে সে সব দিক দিয়ে বড়, তখন তাকে সে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অধিকার করার মধ্যে দিয়ে আমরা জানি যে আমাদের অধিকৃত সামগ্রীর থেকে আমরা মহত্তর। আমাদের থেকে নিকৃষ্ট বস্তুর সঙ্গে বাঁধা পড়ে থাকা পরম দুঃখের। এটিই মৈত্রেয়ী অনুভব করেছিলেন, যখন তাঁর স্বামী গৃহত্যাগ করার প্রাক্কালে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তাঁকে দান করেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এই পার্থিব বস্তু কি কাউকে পরমার্থ লাভে সাহায্য করে?” — অথবা, অন্য ভাষায়, “আমার আত্মার থেকে তারা কি আমার কাছে বেশী?” যখন তার স্বামী উত্তর দিয়েছিলেন, “এইসব তোমাকে পার্থিব সম্পদে ঐশ্বর্যশালী করবে,” তৎক্ষণাৎ তিনি বলেছিলেন, “তা হলে আমি এ সব দিয়ে কি করবো?” একমাত্র যখন মানুষ যথার্থই উপলব্ধি করে তার বিষয়-সম্পত্তি কি, তখন এসব সম্বন্ধে তার আর কোনো মোহ থাকে না; তখন সে জানে তার আত্মা এই সবের থেকে অনেক ঊর্দ্ধ্বে আর তাদের বন্ধন থেকে সে মুক্ত হয়ে যায়। এইভাবে মানুষ নিজের বিষয় সম্পদকে অতিক্রম ক’রে যথার্থই আত্মাকে উপলব্ধি করে, এবং এইভাবে শাশ্বত জীবনের পথে মানুষের অগ্রগতি একের পর এক ত্যাগের মধ্যে দিয়ে হয়।

আমরা যে পরমাত্মাকে সম্পূর্ণ অধিকারের মধ্যে আনতে পারি না এ কোনো বুদ্ধিগত বিবৃতি মাত্র নয়। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয়, এবং এই অভিজ্ঞতাই পরম আনন্দ। পাখি, যখন আকাশে ওড়ে, তার ডানার প্রতিটি ঝাপটের মধ্যে এই অভিজ্ঞতা লাভ করে যে আকাশ অসীম, একে অতিক্রম ক’রে তার ডানা কখনোই তাকে নিয়ে যেতে পারবে না। সেখানেই তার আনন্দ। খাঁচার ভিতর আকাশ সীমিত; হতে পারে একটি পাখির জীবনের সমস্ত প্রয়োজনের পক্ষে তা যথেষ্ট, যতটুকু প্রয়োজন তার বেশী সে নয়। প্রয়োজনের সীমার মধ্যে পাখি কখনো আনন্দ লাভ করে না। তাকে অবশ্যই অনুভব করতে হবে তার যা আছে তা যা সে সব সময় চাইতে বা বুঝতে পারে তার থেকে প্রচুর পরিমাণে বেশী, আর একমাত্র তখনই সে আনন্দিত হতে পারে।

এইভাবে আমাদের আত্মাকে অসীমে উন্নীত হতে হবে, এবং প্রতি মুহূর্তে তাকে অনুভব করতে হবে যে একদিক দিয়ে তার প্রাপ্তির শেষ পর্যায়ে পৌঁছাতে না পারাতে রয়েছে তার পরম আনন্দ, তার পরম মুক্তি।

মানুষের স্থায়ী সুখ কোনো কিছু পাওয়ার মধ্যে থাকে না থাকে নিজের থেকে মহত্তরের কাছে, তার ব্যক্তিজীবনের থেকে বৃহত্তর ধারণার কাছে, তার দেশের ধারণার কাছে, মানব জাতির কাছে, ঈশ্বরের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যে। নিজের জীবন ছাড়া তার যথাসর্বস্ব ত্যাগ করাকে তারা আরো সহজ ক’রে দেয়। তার জীবন দুঃখময় ও ঘৃণ্য হয়ে যায় যতক্ষণ না সে এমন কোনো মহৎ ধারণা খুঁজে পায় যা প্রকৃতই তার সর্বস্ব অধিকার ক’রে নিতে পারে, তাকে তার নিজস্ব বিষয় সম্পত্তির আকর্ষণ থেকে মুক্ত করতে পারে। বুদ্ধদেব ও যিশুখ্রীষ্ট, এবং আমাদের সমস্ত দিব্যপ্রেরণা প্রাপ্ত মহান ঋষিরা, এই ধরনের মহৎ ভাবের প্রতীক। তাঁরা আমাদের সামনে আমাদের সর্বস্ব উৎসর্গ করার সুযোগ ক’রে দেন। তাঁরা যখন তাঁদের ভিক্ষাপাত্র তৈরি করেন আমাদের মনে হয় আমরা দান না দিয়ে পারবো না, আর আমরা দেখি এই দেওয়াতেই আমাদের প্রকৃত আনন্দ ও মুক্তি, কারণ অসীমের সঙ্গে আমাদের মিলিত করা পর্যন্ত তার বিস্তার।

মানুষ সম্পূর্ণ নয়; তাকে আরো হতে হবে। সে যা হয়ে আছে তাতে সে ক্ষুদ্র, আর যদি আমরা কল্পনা করি চিরকালের মতো সে সেখানে থেমে থাকবে, তা হলে মানুষের কল্পনায় সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ যে নরক রয়েছে তার সম্বন্ধে একটা ধারণা আমাদের অবশ্যই হবে। যা তাকে হতে হবে সেখানে সে অসীম, সেখানে তার স্বর্গ, তার মুক্তি। যা সে আছে তাতে প্রতি মুহূর্তে সে কি পেতে পারে আর কিভাবে ব্যবহার করতে পারে তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে; যা তাকে হতে হবে তাতে সে যা পেতে পারে তার থেকে বেশী কিছুর জন্য ক্ষুধিত থাকে, এমন কিছু যা সে কখনো হারাতে পারে না, কারণ তা সে কখনো অধিকার করেনি।

প্রয়োজনের জগতে আমাদের অস্তিত্বের সসীম প্রান্ত অবস্থিত। সেখানে মানুষ জীবন ধারণের জন্য খাদ্য অনুসন্ধান করে, উষ্ণতার জন্য পোশাকের অনুসন্ধান করে। এই অংশে— প্রকৃতির এই অংশে— তার কাজই হলো বস্তু সংগ্রহ করা। সহজাত ভাবে মানুষ তার বিষয় সম্পত্তি সম্প্রসারণে নিমগ্ন থাকে।

কিন্তু এই সংগ্রহের কাজ আংশিক। মানুষের প্রয়োজনে তা সীমাবদ্ধ। আমাদের যতটুকু প্রয়োজন একমাত্র ততটুকু পর্যন্ত আমরা কোনো বস্তু পেতে পারি, ঠিক যেমন একটি কলসী যতটুকু খালি কেবল তত পর্যন্তই জল নিতে পারে। খাদ্যের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ কেবল খাওয়াতে, কোনো বাড়ির সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ কেবল বাস করাতে। আমাদের কোনো বিশেষ প্রয়োজনের সঙ্গে যখন কোনো বস্তু খাপ খেয়ে যায়, আমরা তাকে উপকার বলে থাকি। এইভাবে পাওয়া সব সময়ই আংশিক পাওয়া, আর কোনো ক্রমেই তার অন্যথা হতে পারে না। কাজেই সংগ্রহ করার এই আকুলতা আমাদের সসীম সত্তার মধ্যেই রয়েছে।

কিন্তু আমাদের অস্তিত্বের যে অংশের লক্ষ্য অসীমের দিকে সেখানে সে ধনের অনুসন্ধান করে না, করে মুক্তির ও আনন্দের। সেখানে প্রয়োজনের আধিপত্যের শেষ আর সেখানে আমাদের কাজ পাওয়া নয়, হওয়া। কি হওয়া? ব্রহ্মের সঙ্গে এক হওয়া। কারণ অসীমের স্থান ঐক্যের স্থান। সেইজন্য উপনিষদ বলেন, “মানুষ যদি ঈশ্বরের সম্বন্ধে সচেতন হয় সে সত্য হয়ে ওঠে।” এই হলো হয়ে ওঠা, আরো কিছু পাওয়া নয়। যখন তুমি শব্দ সমূহের অর্থ জানো, তখন তারা ভারী হয়ে ওঠে না; ভাবের সঙ্গে এক হয়ে গিয়ে তারা সত্য হয়ে ওঠে।

যিনি পরম পিতার সঙ্গে নিজের একত্ব দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, আর ঈশ্বরের মতো পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য নিজের শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছিলেন তাঁকে পাশ্চাত্য দেশ গুরু বলে স্বীকার করলেও অসীম সত্তার সঙ্গে আমাদের এই ঐক্যের ধারণাকে মেলাতে পারেননি। মানুষের ঈশ্বর হয়ে ওঠার যে কোনো অর্থ প্রকাশকে এঁরা ঈশ্বর নিন্দার এক উদাহরণ বলে ধিক্কার জানান। যিশুখ্রীষ্ট যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা অবশ্যই এই পরম উত্তরণের ধারণা নয়, সম্ভবত খ্রীষ্টধর্মীয় অতীন্দ্রিয়বাদীদের ধারণাও নয়, কিন্তু মনে হয় ওই ধারণাই খ্রীষ্টধর্মীয় পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

কিন্তু প্রাচ্যের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক জ্ঞান, ঈশ্বর লাভ করাকে, কোনো বিশেষ বস্তুগত প্রয়োজনে তাঁকে ব্যবহার করাকে আমাদের আত্মার কাজ বলে বিবেচনা করে না। আমরা চিরকাল সেই পর্যন্ত উচ্চাভিলাষ করতে পারি যাতে ঈশ্বরের সঙ্গে আমরা আরো বেশী একাত্ম হয়ে উঠি। প্রকৃতির রাজ্যে, যে রাজ্য বৈচিত্র্যের, সেখানে আমরা সংগ্রহ করার দ্বারা বড় হয়ে উঠি; আধ্যাত্মিক জগতে, যে জগৎ ঐক্যের, সেখানে আমরা নিজেদের হারিয়ে, একাত্ম হয়ে বড় হয়ে উঠি। আমরা যেমন বলেছি, কোনো বস্তু লাভ করা তার স্বভাব অনুযায়ী আংশিক, শুধু কোনো বিশেষ প্রয়োজনের মধ্যে তা সীমিত; কিন্তু অস্তিত্ব সম্পূর্ণ, আমাদের পূর্ণতার মধ্যে সে রয়েছে, কোনো প্রয়োজন থেকে সে উদ্ভূত নয় বরং অসীমের সঙ্গে আমাদের যোগের থেকে উদ্ভূত, এই হলো পূর্ণতার আদর্শ যা আমাদের আত্মায় রয়েছে।

হ্যাঁ, আমাদের ব্রহ্ম হতে হবে। এই শপথ নিতে আমরা যেন সঙ্কুচিত না হই। আমাদের অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে যায় যদি আমরা পূর্ণতা উপলব্ধির প্রত্যাশা কখনো না করি। যদি আমাদের কোনো লক্ষ্য থাকে আর তবুও সেখানে কখনো পৌঁছাতে না পারি, তা হলে তা আদৌ কোনো লক্ষ্য নয়।

কিন্তু তা হলে কি বলা যাবে যে ব্রহ্ম এবং আমাদের ব্যক্তিসত্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই? অবশ্যই এই পার্থক্য সুস্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান। একে মায়া বলুন বা অবিদ্যা বা যে কোনো নাম দিতে পারেন, সে সেখানে রয়েছে। আপনি এর নানা রকম ব্যাখ্যা দিতে পারেন কিন্তু কৈফিয়ত দিয়ে এড়িয়ে যেতে পারেন না। মায়া হলেও সে মায়া রূপেই সত্য।

ব্রহ্ম ব্রহ্মই, তিনি পরিপূর্ণতার পরম আদর্শ। কিন্তু আমরা সত্যই যা, তা নই; আমাদের চিরকাল সত্য হয়ে উঠতে হবে, চিরকাল ব্রহ্ম হয়ে উঠতে হবে। এই অস্তিত্ব আর হয়ে ওঠার সম্বন্ধের মধ্যে প্রেমের নিত্য লীলা চলছে; এবং এই রহস্যের গভীরে রয়েছে সমস্ত সত্য ও সৌন্দর্যের উৎস যা সৃষ্টির অবিরাম অগ্রগতিকে শক্তি দেয়।

উদ্দাম ঝরনার সঙ্গীতে আনন্দময় প্রতিশ্রুতি ধ্বনিত হয়, “আমি সমুদ্র হয়ে যাব।” এ কোনো অসার ধারণা নয়; এ যথার্থ নম্রতা কারণ এ হলো সত্য। নদীর আর কোনো বিকল্প নেই। তার দুই দিকের তীরেই রয়েছে বহু প্রান্তর ও অরণ্য, গ্রাম ও শহর; সে নানা ভাবে তাদের সেবা করতে পারে, তাদের বিশুদ্ধ করতে পারে, আহার দিতে পারে, তাদের উৎপাদিত সামগ্রী স্থান থেকে স্থানান্তরে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এদের সঙ্গে তার কেবলমাত্র আংশিক সম্বন্ধ হতে পারে, আর যত দীর্ঘকালই এদের মধ্যে সে থাকুক না কেন, এদের থেকে সে স্বতন্ত্র; সে কখনো কোনো শহর বা কোনো অরণ্য হতে পারবে না।

কিন্তু সে সমুদ্র হতে পারে, হয়ও। অপেক্ষাকৃত কম তরঙ্গায়িত জলের সঙ্গে সমুদ্রের বিশাল নিস্তরঙ্গ জলের যোগ রয়েছে। তার অগ্রগতির পথে সে সহস্র বস্তুর মধ্যে দিয়ে চলে, আর তার গতি সম্পূর্ণ হয় যখন সে সমুদ্রে পৌঁছায়।

নদী সমুদ্র হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু সে কখনোই সমুদ্রকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিতে পারে না। যদি, কোনোক্রমে, সে কোনো বিস্তীর্ণ জলরাশির চারপাশে ঘুরে আসে আর ভাব দেখায় সে যেন সমুদ্রকে তার নিজের এক অংশ করেছে, আমরা তৎক্ষণাৎ জানি যে তা হয়নি, তার স্রোত তখনো সেই মহাসমুদ্রে বিশ্রাম খুঁজে চলেছে, সীমার মধ্যে যাকে সে কখনো বাঁধতে পারে না।

এই রকম ভাবে, আমাদের আত্মা শুধু ব্রহ্মই হয়ে উঠতে পারে যেমন ক’রে নদী সমুদ্র হয়ে উঠতে পারে। অন্য সব কিছু সে কোনো না কোনো মুহূর্তে স্পর্শ করে, তারপরে তাদের ছেড়ে দেয় ও এগিয়ে চলে, কিন্তু সে কখনো ব্রহ্মকে ছাড়তে পারে না, আর তাঁকে অতিক্রমও করতে পারে না। একবার যখন আমাদের আত্মা উপলব্ধি করে যে ব্রহ্মই তার পরম শান্তি, তখন তার সমস্ত গতি এক লক্ষ্য অর্জন করে। এই সেই অসীম শান্তির সমুদ্র, যা বিরামহীন কর্মকে অর্থপূর্ণ করে। অস্তিত্বের এই সেই পূর্ণতা, যা হয়ে ওঠার অপূর্ণতাকে সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য দান করে, যা সমস্ত কাব্য, নাটক, শিল্পের মধ্যে নিজের অভিব্যক্তি খুঁজে পায়।

কোনো কবিতাকে প্রাণবন্ত করার জন্য একটি সম্পূর্ণ ভাব থাকা প্রয়োজন। কবিতার প্রতিটি পঙ্‌ক্তি সেই ভাব স্পর্শ করে। পাঠক যখন সেই পরিব্যাপ্ত ভাবটি পড়তে পড়তে উপলব্ধি করতে পারেন তখন কাব্যপাঠ তাঁর কাছে আনন্দপূর্ণ হয়। তখন কবিতার প্রতিটি অংশ পূর্ণতার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে অর্থপূর্ণ হয়। কিন্তু কবিতা যদি কখনো সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ না করে, যত সুন্দরই হোক, শুধু কিছু অসম্বদ্ধ প্রতিরূপ রচনা ক’রে সীমাহীন ভাবে চলতে থাকে, তা হলে ক্লান্তিকর ও যৎপরোনাস্তি নিষ্ফল হয়ে ওঠে। আমাদের আত্মার অগ্রগতি এক সম্পূর্ণ কবিতার মতো। এর একটি অনন্ত ভাব রয়েছে একবার তার উপলব্ধি হলে সমস্ত গতি অর্থপূর্ণ ও আনন্দময় হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা যদি তার সমস্ত গতি পরম ভাবের থেকে বিযুক্ত করি, যদি তার পরম শান্তি না দেখে শুধু তার বিরামহীন গতি দেখি, তা হলে আমাদের কাছে অস্তিত্ব এক ভয়ঙ্কর অশুভ রূপে দেখা দেয়, এক অনন্ত লক্ষ্যহীনতার দিকে প্রচণ্ড বেগে অস্থির ভাবে ছুটে যায়।

আমার মনে আছে ছোটবেলায় আমাদের একজন মাস্টারমশাই সাঙ্কেতিক ভাবে লেখা সংস্কৃত ব্যাকরণের কোনো অর্থ ব্যাখ্যা না ক’রে সম্পূর্ণ গ্রন্থ আমাদের মুখস্ত করাতেন। দিনের পর দিন আমরা কঠোর পরিশ্রম করতাম, কিন্তু কিসের জন্য করতাম, তার লেশমাত্র ধারণা আমাদের ছিল না। কাজেই, আমাদের পাঠ্য বিষয়গুলি সম্বন্ধে, আমাদের অবস্থা ছিল একজন দুঃখবাদীর মতো যিনি কেবল জগতের শ্বাসরুদ্ধকর কর্মের হিসাব রাখেন, কিন্তু যে সময়ে এই সমস্ত কর্ম প্রতি মুহূর্তে ভারসাম্য লাভ ক’রে সম্পূর্ণ সঙ্গত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সেই পরিপূর্ণতার অক্ষয় শান্তি দেখতে পান না। এইরকম গভীর ভাবে অস্তিত্বের চিন্তা করলে আমরা সমস্ত আনন্দ হারিয়ে ফেলি কারণ আমরা সত্যকে খুঁজে পাই না। আমরা নর্তকের অঙ্গভঙ্গি দেখি, আর কল্পনা করি এগুলি যেন সুযোগের নির্মম খেয়ালী নির্দেশে ঘটছে, অথচ যে শাশ্বত সঙ্গীতে এই নৃত্যের প্রতিটি ভঙ্গিকে অপরিহার্য ভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ও সুন্দর ক’রে তোলে সে সম্বন্ধে আমরা তখন বধির হয়ে থাকি। এই ভঙ্গিগুলি সর্বদা সেই পরিপূর্ণ সঙ্গীতের দিকে অগ্রসর হয়, তার সঙ্গে এক হয়ে যায়, প্রতি পদক্ষেপে যে বহুসংখ্যক রূপ তারা সৃষ্টি ক’রে চলে সেই সুরে তাদের উৎসর্গ করে।

আর এই হলো আমাদের আত্মার সত্য, আর এই তার আনন্দ, যে তাকে সদা সর্বদা ব্রহ্মে উন্নত হতে হবে, তার সমস্ত গতিকে এই পরম ভাবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে হবে, আর তার সমস্ত সৃষ্টিকে সেই পরিপূর্ণ পরমাত্মার কাছে অর্ঘ রূপে নিবেদন করতে হবে।

উপনিষদে একটি লক্ষণীয় বাণী আছে:

“আমি মনে করি না আমি তাঁকে সম্যক ভাবে জানি, অথবা আমি তাঁকে জানি, বা তাঁকে আদৌ জানি না।”

জ্ঞানের প্রক্রিয়া দিয়ে আমরা কখনোই পরমাত্মাকে জানতে পারি না। কিন্তু তিনি যদি সর্বতোভাবে আমাদের নাগালের বাইরে থাকেন, তা হলে আমাদের কাছে তাঁর কোনো অস্তিত্বই থাকে না। সত্য হলো আমরা তাঁকে জানি না, তবুও আমরা তাঁকে জানি।

উপনিষদের আরেকটি বাণীতে এর ব্যাখ্যা রয়েছে: “মনের সঙ্গে বাক্য ব্যর্থ হয়ে ব্রহ্মের থেকে প্রতিনিবৃত্ত হয়, কিন্তু যিনি তাঁকে তাঁর আনন্দ দিয়ে জানেন, তিনি সমস্ত ভয় মুক্ত হন।”

বুদ্ধিগত জ্ঞান আংশিক, কারণ আমাদের বুদ্ধি এক উপায় মাত্র, এ আমাদের অংশ মাত্র, এ আমাদের সেই সকল বিষয়ে তথ্য দিতে পারে যা বিভাজন ও বিশ্লেষণ করা যায়, আর যার গুণাবলীর শ্রেণীবিভাজন নানা অংশে করতে পারা যায়। কিন্তু ব্রহ্ম পরিপূর্ণ, আর আংশিক জ্ঞান কখনো তাঁর জ্ঞান হতে পারে না।

কিন্তু আনন্দ দিয়ে, প্রেম দিয়ে তাঁকে জানতে পারা যায়। কারণ আনন্দ হলো পরিপূর্ণ জ্ঞান, এ হলো আমাদের সমগ্র সত্তা দিয়ে জানা। যা কিছু জানতে হবে তার থেকে বুদ্ধি আমাদের দূরে সরিয়ে রাখে, কিন্তু প্রেম একত্র মিলিত হয়ে তার জানার বিষয় জানে। সেই জ্ঞান অপরোক্ষ আর তা কোনো সংশয় স্বীকার করে না। এই জ্ঞান আত্মজ্ঞানের অনুরূপ, শুধু আরো গুরুত্বপূর্ণ।

এই কারণে, উপনিষদ বলেন, মন কখনো ব্রহ্মকে জানতে পারে না, শব্দ কখনো তাঁকে বর্ণনা করতে পারে না; একমাত্র আমাদের আত্মার দ্বারা, তাঁর মধ্যে তার আনন্দের দ্বারা, তার প্রেমের দ্বারা তাঁকে জানতে পারা যায়। অথবা, অন্য ভাবে বললে, একমাত্র মিলনের মধ্যে দিয়ে আমরা তাঁর সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারি— আমাদের সমগ্র সত্তার মিলন দিয়ে। আমাদের পরম পিতার সঙ্গে অবশ্যই আমরা এক হবো, তাঁর মতো সম্পূর্ণ হবো।

কিন্তু কেমন করে তা হবে? অন্তহীন পরিপূর্ণতার কোনো ক্রম হয় না। আমরা ক্রমে ক্রমে ব্রহ্ম হয়ে উঠতে পারি না। তিনি এক অদ্বিতীয়, তাঁর অতিরিক্ত বা অল্প হতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষে, আমাদের অন্তরাত্মায় পরমাত্মার উপলব্ধি এক পরিপূর্ণ সমাহিত অবস্থা। আমরা ভাবতে পারি না তিনি অস্তিত্বহীন আর তাঁর ক্রমিক গঠনের জন্য আমাদের সীমিত শক্তির উপর তিনি নির্ভরশীল। ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ যদি আমাদের নিজেদের গড়া হতো, তা হলে কি সত্য বলে তাঁর উপরে আমাদের নির্ভর করা উচিত হতো, আর তাঁরই বা আমাদের প্রতিপালন করা উচিত হতো?

হ্যাঁ, আমাদের জানা আবশ্যক যে আমাদের মধ্যেই তা রয়েছে যেখানে দেশ ও কালের শাসন থেমে যায় আর যেখানে ক্রমবিকাশের নানা রূপ এক হয়ে মিশে যায়। আত্মার সেই অনন্ত স্থিতিতে, পরমাত্মার প্রকাশ পূর্ব থেকেই সম্পূর্ণ। সেইজন্য উপনিষদ বলেন: “যিনি আত্মার গভীরে নিহিত সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ, অনন্তস্বরূপ ব্রহ্মকে জানেন, তিনি পরম ব্যোমে (চেতনার অন্তরাকাশে) সর্বজ্ঞ ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে সমস্ত কাম্য ফল ভোগ করেন।”

এই মিলন আগে থেকেই হয়ে আছে। পরমাত্মা স্বয়ং আমাদের আত্মাকে বধূরূপে মনোনীত করেছেন, আর এই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। পবিত্র মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে: “আমার এই হৃদয় যেমন তোমার হৃদয়ও তেমন হোক।” এই বিবাহে পুরোহিতের ভূমিকায় কর্ম করার কোনো স্থান ক্রমবিকাশের নেই। “এষঃ” যাঁকে “এই” ছাড়া আর কোনোভাবে বর্ণনা করা যায় না, তাঁর নামহীন সাক্ষাৎ উপস্থিতি এখানে আমাদের অন্তরতম সত্তায় চিরদিন রয়েছে। “এই এষঃ অন্য এই এর পরম গতি”: “ইনি এর পরম সম্পদ”: “ইনি এর পরম লোক”১০: “ইনি এর পরম আনন্দ।”১১ কারণ পরম প্রেমের এই বিবাহ অনন্তকালে সম্পন্ন হয়েছে। আর এখন অনন্ত লীলা, প্রেমের লীলা চলছে। যাঁকে অনন্তের মধ্যে পাওয়া হয়েছে, তাঁকে এখন দেশ ও কালের মধ্যে, আনন্দ ও দুঃখের মধ্যে, এই জগৎ ও জগৎ অতিরিক্তের মধ্যে পাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। যখন আত্মা-বধূ তা সম্যক ভাবে বুঝতে পারে, তখন তার হৃদয় আনন্দে ভরে যায় ও শান্তি লাভ করে। সে জানে যে সে একটি নদীর মতো, তার সত্তার এক প্রান্তে সে তার পূর্ণতার সমুদ্রে পৌঁছে গেছে, আর অন্য প্রান্তে প্রতিনিয়ত সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছে; এক প্রান্তে এ হল চিরশান্তি ও পূর্ণতা, অন্য প্রান্তে অবিরাম গতি ও পরিবর্তন। যখন সে জানে যে দুইটি প্রান্তই অবিচ্ছেদ্য ভাবে সংযুক্ত, তখন জগতের প্রভুকে তার নিজের প্রভু বলে জানার অধিকার দিয়ে এই জগৎকে সে নিজের সংসার বলে জানে। তখন তার সমস্ত সেবা প্রেমের সেবা হয়ে ওঠে, জীবনের সমস্ত সমস্যা ও কঠোর দুঃখ দুর্দ্দশা তার কাছে পরীক্ষা রূপে আসলে নিজের প্রেমের শক্তি প্রমাণ করার জন্য, মৃদু হাস্যে তার প্রেমিকের বাজি জিতে নেওয়ার জন্য তাকে সে সহ্য ক’রে জয়ী হয়। কিন্তু যতক্ষণ সে জেদের সঙ্গে অন্ধকারে থাকে, তার অবগুণ্ঠন তোলে না, তার প্রেমিককে চেনে না, আর তার থেকে বিচ্ছিন্ন জগৎকে একমাত্র জানে, ততক্ষণ যেখানে নিজের অধিকারে সে রাণীর মতো রাজত্ব করতে পারতো সেখানে পরিচারিকার মতো সেবা করে; সে দ্বিধায় দোলে, দুঃখে ও হতাশায় বিলাপ করে। “সে ক্ষুধিত অবস্থা থেকে ক্ষুধিত অবস্থায়, ক্লেশ থেকে ক্লেশে এবং ভয় থেকে ভয়ে যেতে থাকে।”১২

আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না সেই গানের কলি আমি একটি উৎসবের আগের রাতে সমবেত লোকজনের কোলাহলের মধ্যে ঊষাকালে একবার শুনেছিলাম: “ খেয়ার মাঝি, আমায় অন্য তীরে পার ক’রে দাও!”

আমাদের সমস্ত কাজের গোলমালের মধ্যে এই কান্না উঠে আসে, “আমায় ওপারে নিয়ে যাও।” ভারতবর্ষে গরুর গাড়ির চালক গাড়ি চালাতে চালাতে গান গায়, “আমায় ওপারে নাও।” ফেরিওয়ালা ক্রেতার কাছে তার জিনিসপত্র বিক্রি করে আর গান করে, “আমায় ওপারে নাও।”

এই কান্নার অর্থ কী? আমরা অনুভব করি আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাইনি; আর আমরা জানি আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম দিয়েও আমরা কাজের শেষে আসি না, আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাই না। পুতুল নিয়ে অতৃপ্ত এক শিশুর মতো, আমাদের হৃদয় কেঁদে বলে, “এটা নয়, এটা নয়।” কিন্তু সেই অন্যটা কী? দূরের সেই তীর কোথায়?

আমাদের যা আছে এ কি তার থেকে অন্য কিছু? আমরা যেখানে আছি তার থেকে এ কি অন্য কোনোখানে? এ কি আমাদের সমস্ত কাজের থেকে বিশ্রাম, জীবনের সমস্ত দায়িত্বের থেকে অব্যাহতি?

না, আমাদের সমস্ত কর্মতৎপরতার অন্তস্তলে আমরা কর্মের শেষ অনুসন্ধান করছি। এমনকি যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেখানেই ওপারের জন্য কাঁদছি। সেইজন্য আমাদের ওষ্ঠে যখন অন্য পারে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা উচ্চারিত হয়, তখনো আমাদের ব্যস্ত হাত কোনো সময়ে অলস হয়ে থাকে না।

সত্যই, হে আনন্দের সাগর, তোমার মধ্যে এই পার ও ওই পার এক ও সমান। যখন আমি একে আমার নিজস্ব বলি, অন্যটি তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে; আর আমার মধ্যে যে পরিপূর্ণতা রয়েছে তা বুঝতে না পেরে, আমার হৃদয় অবিরাম অন্যটির জন্য কাঁদে। আমার এই সমস্ত ও সেই অন্য, তোমার প্রেমে সম্পূর্ণ মিলিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে।

আমার এই “আমি” তার নিজস্ব বলে জানা গৃহের জন্য, দিবারাত্র, অক্লান্ত পরিশ্রম করে। হায়, যতক্ষণ সে এই গৃহকে তোমার বলতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার দুঃখ ভোগের কোনো শেষ থাকবে না। ততক্ষণ সে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে সংগ্রাম ক’রে চলবে, আর তার হৃদয় অনুক্ষণ কেঁদে বলবে, “খেয়ার মাঝি আমাকে পার করো।” যখন আমার এই গৃহ তোমার ক’রে দেওয়া হয়, সেই মুহূর্তে তাকে অন্যপারে নিয়ে যাওয়া হয়, এমনকি তার পুরানো দেওয়ালগুলি তখনো তাকে ঘিরে থাকলেও। এই ‘আমি’ অস্থির। কিছু পাওয়ার জন্য সে এমন কর্ম করে যা কখনোই তার আত্মার সঙ্গে একীভূত হতে পারে না, তাঁকে ধরতেও পারে না, রাখতেও পারে না। যা সকলের জন্য, তাকে নিজের হাতের মধ্যে রাখার চেষ্টায় সে অন্যদের আঘাত করে আর নিজের দিক দিয়েও আহত হয়, আর কেঁদে ওঠে, “আমায় পার করো।” কিন্তু যখনই সে বলতে পারে, “আমার সব কাজই তোমার,” তখনো সমস্ত একই রকম থাকে, শুধু তাকে অন্য পারে নিয়ে যাওয়া হয়।

তোমার ক’রে দেওয়া আমার এই গৃহ ছাড়া তোমার সঙ্গে আমি আর কোথায় মিলিত হবো? তোমার কর্মে রূপান্তরিত আমার এই কর্ম ছাড়া আর কোথায় আমি তোমার সঙ্গে যুক্ত হবো? আমি যদি আমার নিজের গৃহ ছেড়ে যাই তোমার গৃহে পৌঁছাতে পারবো না; আমি যদি আমার কর্ম বন্ধ করি তোমার কর্মে কখনো যুক্ত হতে পারবো না। কারণ তুমি আমার মধ্যে বিরাজ করো আর আমি তোমার মধ্যে। আমাকে ছাড়া তুমি অথবা তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই নই।

সেইজন্য, আমাদের গৃহের ভিতর থেকে আর আমাদের কর্মের থেকে এই প্রার্থনা জেগে ওঠে, “আমাকে পার করো।” তার কারণ এখানে সমুদ্র তরঙ্গায়িত হচ্ছে আর এখানেই অন্য তীর পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষা করছে— হ্যাঁ, এখানেই রয়েছে চিরন্তন বর্তমান, দূরে নয়, অন্য কোনোখানেও নয়।

তথ্যসূত্র

১. ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ

২. তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্

৩. কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ

৪. নাহং মন্যে সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ।

৫. যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ

আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান ন বিভেতি কুতশ্চন।

৬. সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তং ব্রহ্ম যো বেদ নিহিতং গুহায়াং পরমে ব্যোমন্

সোহশ্নুতে সর্বান্ কামান্ সহ ব্রহ্মণা বিপশ্চিতা।

৭. যদেতৎ হৃদয়ং মম তদস্তু হৃদয়ং তব।

৮. এষাস্য পরমা গতিঃ।

৯. এষাস্য পরমা সম্পৎ।

১০. এষোহস্য পরম লোকঃ।

১১. এষোহস্য পরম আনন্দঃ।

১২. দৌর্ভিক্ষাৎ যাতি দৌর্ভিক্ষং, ক্লেশাৎ ক্লেশম্, ভয়াৎ ভয়ম্।

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *