অসার খলু সংসারে
সরকার সারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন, এই সংবাদে জাতীয় অর্থনীতিতে যে পরিমাণ অস্বস্তি ফুটে উঠেছিল, কয়লার দাম বাড়াবার সিদ্ধান্তে আবার সেই পরিমাণ স্বস্তি ফিরে এসেছে।
যোজনা দফতরের জনৈক ঘনিষ্ঠ মুখপাত্র বলেন, ‘সরকারের সার ও কয়লার দাম বাড়াবার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োচিত হয়েছে। এতে সরকারের অর্থাৎ জাতির লোকসান কমবে এবং জনসাধারণের উপর এর এক সুদূরপ্রসারী সুপ্রভাব পড়বে। এবং দেশের অর্থনীতি এবার সুদৃঢ় হবে।’
জাতীয় সার সংস্থার পক্ষ থেকেও সরকারের এই বলিষ্ঠ নীতিকে অভিনন্দন জানান হয়। তাঁদের মতে সারের সঙ্গে কয়লার দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত খুবই দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করছে। সার ও কয়লার দাম যুগপৎ বৃদ্ধির মধ্যে সরকারের দূরদর্শিতার পরিচয় তাঁরা কী এমন পেলেন, এই প্রশ্নের উত্তর জাতীয় সার সংস্থার মুখপাত্র শ্রীওল্লাগান্ডি অসার খলু সংসারম্ বলেন, ‘কয়লার দাম না বাড়িয়ে সরকার যদি শুধু সারের দাম বাড়াতেন তাহলে ডিম্যান্ড ও সাপ্লাইয়ের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হত, ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে একটা বেসামাল অবস্থার সৃষ্টি হত।’
‘এমন কি,’ কেন্দ্রীয় সার উপদেষ্টা শ্রীসারভাতে বলেন, ‘আমাদের সারনীতির গাড়ি ওল্লা হয়ে যাবার আশঙ্কাও ছিল। কয়লার দাম বাড়িয়ে দিয়ে সেই আশঙ্কা দূর করা হল।’
শ্রীওল্লাগাড্ডি শ্রীসারভাতের কথা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করলেন।
কিন্তু সারের সঙ্গে কয়লার যোগাযোগটা কোথায়? আমাদের দেশে তো কয়লাভিত্তিক সার উৎপাদনের কোনও ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি?
এই প্রশ্নের উত্তরে শ্রীসারভাতে বললেন, ‘অত্যন্ত ইনটেলিজেন্ট প্রশ্ন। আমার মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর আমার বন্ধু শ্রীওল্লাগাড্ডি অসার খলু সংসারম্ই ভাল দিতে পারবেন।
শ্রীওল্লাগাড্ডি বললেন, ‘সারের সঙ্গে কয়লার যোগাযোগটা যে কোথায়, সেটা বুঝতে হলে আমাদের একেবারে মূলে চলে যেতে হবে। সারের সঙ্গে ভাতের যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, এই তাত্ত্বিক ব্যাপারটার সঙ্গে আশা করি আমার বন্ধু শ্রীসারভাতে একমত হবেন।’
‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বটে যে, সারে আর ভাতে সম্পর্ক খুবই নিকট’ শ্রীসারভাতে বললেন। ‘তবে বৈজ্ঞানিক তথ্য অনুযায়ী ওটা সাজালে ব্যাপারটা ঠিক অতটা নিকটের মনে হয় না। ব্যাপারটা প্রিসাইজলি এই রকম দাঁড়াবে। যথা : সারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ চাষের। চাষের সঙ্গে ধানের। ধানের সঙ্গে চালের। নাউ চাল এবং কয়লার শান্তিপূর্ণ সহযোগের ফলে ভাত কাম্স্ ইন দি পিকচার। যেমন থিসিস এবং অ্যানটি থিসিসের ডায়েলেকটিসে পরদা হয় সিনথিসিস। ক্লিয়ার? পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত আমরা ডায়েলেকটিক্স বলতাম, এখন বলছি শান্তিপূর্ণ সহযোগিতা।’
শ্রীওল্লাগাড্ডি বললেন, শ্রীসারভাতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সার ও ভাতের সম্পর্কগত তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করেছেন। আমি এবার ব্যবহারিক দিকটাই তুলে ধরতে চাই। অর্থাৎ সার ও কয়লার দর বৃদ্ধির কো-রিলেশানের ব্যাপারটাই বলতে চাইছি।’
শ্রীসারভাতে স্মিত হেসে সম্মতি দিলে শ্রীওল্লাগাড্ডি অসার খলু সংসারম্ বললেন, ‘আমাদের সার নীতির বাহাদুরি হল এই যে আমরা আচমকা সারের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছি। এর ফলে দুটো উপকার হবে। যথা: সারের অবৈজ্ঞানিক ব্যবহার বন্ধ হবে এবং সারের অযথা অপচয় রোধ হবে। ফলে অনেক জমি অতিলোভী চাষীদের শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাবে।’
কিন্তু সবুজ বিপ্লবের কী হবে?
‘সবুজ বিপ্লবের?’ শ্রীসারভাতে বললেন, ‘ওল্লাগাড্ডি।’
কী বললেন! ওল্লাগাড্ডি। মানে গাড়ি ওল্লা!
‘আরে না না।’ শ্রীসারভাতে বললেন, ‘আমি ওল্লাগাড্ডিকে ওই ব্যাপারে বলতে অনুরোধ জানালাম।’
‘সবুজ বিপ্লব কথাটা আমরা এখন আর ব্যবহার করছি নে।’ শ্রীওল্লাগাড্ডি শান্তভাবে বললেন। ‘ওর মধ্যে কেমন যেন একটা রাজনীতির গন্ধ আছে। আমরা টেকনিক্যাল লোক তো। হোয়াই শুভ্ উই মেডল ইন পলিটিক্স?’
‘তাহলে উচ্চ ফলনশীল ধান গম।’ এসব?
‘উচ্চ ফলনশীল ধান, গম?’ শ্রীসারভাতে বললেন, ‘ওল্লাগাড্ডি।’
মানে গাড়ি ওল্লা!
‘না, না,’ শ্রীসারভাতে বললেন, ‘ওল্লাগাড্ডি, প্লিজ টেল দেম।’
শ্রীওল্লাগাড্ডি বললেন, ‘উচ্চ ফলনশীল ধান গম যাতে আনস্তুপুলাস চাষীর কব্জায় চলে না যায় তার জন্যই তো সারের দাম বাড়িয়ে দিয়ে ট্যাক্ট্ফুলি ওটা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছি।’
কিন্তু স্যর, এর ফলে কি দেশে খাদ্যসংকট দেখা দেবে না?
‘কে বলেছে, খাদ্য সংকট দেখা দেবে?’ উভয়েই এক যোগে বলে উঠলেন।
কে বলেছে মানে! আপনারাই তো বললেন। উচ্চ ফলনশীল ভ্যারাইটির চাষ তো কমে আসবে?
‘আমরা নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছি,’ শ্রীসারভাতে বললেন, ‘বাকিটার অর্থ আপনি করে নিচ্ছেন। অফিসিয়ালি আমরা নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যাখ্যা দিইনি।’
শ্রীওল্লাগাড্ডি বললেন, ‘জেনটেলমেন, আপনারা বৃথাই আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছেন। খাদ্যাভাব ঘটবে না। কারণ, কয়লার দাম বিজ্ঞানসম্মত হিসেব অনুসারে এমনভাবেই বাড়ানো হচ্ছে যে যতটুকু শস্য সিদ্ধ করার মতো কয়লা কেনার ক্ষমতাই লোকের থাকবে। অপচয় বন্ধের এই নীতি দেশকে বলিষ্ঠ করে তুলবে।
শ্রীসারভাতে বললেন, ‘দেয়ার ইউ আর। শস্য সিদ্ধ না হলে মানুষ তা খেতে পারে না। তা অখাদ্য। আমরা এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই খাদ্যনীতি সাজিয়েছি। এবং সেই কারণেই সারের দাম ও কয়লার দাম বৃদ্ধির যুগপৎ সিদ্ধান্তকে দূরদর্শী নীতি বলেছি।’
কিন্তু স্যর, কয়লা না হয় নাই পাওয়া গেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস তো আছে।
শ্রীওল্লাগাড্ডি বললেন, ‘ওসবের দামও তো বাড়ল বলে।’
কাঠ, ঘুঁটে, বাড়ির ফারনিচার?
শ্রীসারভাতে : ‘কাঠ, ঘুঁটে, বাড়ির ফারনিচার! হাঃ হাঃ হাঃ! ওল্লাগাড্ডি! আই মিন
থাক, আর ব্যাখ্যা করতে হবে না স্যর! আমরা বুঝে নিয়েছি। এই অসার খলু সংসারে সারের শত্রু কয়লায় মারবে।
৫ জুন ১৯৭৪