॥ সতের ॥
সিদ্ধার্থ ভালবাসিয়াছে। কিন্তু তার যন্ত্রণার অবধি নাই।
আগে অজয়ার সম্মুখে আসিলে তার অস্বস্তি লাগিত, এখন সেটা নাই। এখন সে বেশ থাকে যতক্ষণ অজয়ার কাছাকাছি থাকে―একটা আশ্রয় পায়। অজয়ার রূপ নয়―তার সুদৃঢ় অন্তরের প্রভাবেই সিদ্ধার্থ নিজের ভিতর ফুটিতে পাইয়া বাঁচিয়া যায়।
কিন্তু ছাড়াছাড়ি হইলেই এখন তার মনে হয়, যেন অতিশয় গুরুভার একটা দৈব নির্যাতন গুটি গুটি অগ্রসর হইয়া আসিতেছে―তারই জ্বালা বহুদূর হইতে নিক্ষিপ্ত বিষাক্ত কুশাঙ্কুরের মত আসিয়া অস্থি-মজ্জায় ফুটিতেছে। একটা কালো পর্দা বাদুড়ের দুটো পাখার মত পৃথিবীকে দু’ভাগ করিয়া উঠিয়া আসে।
মধ্যস্থলে দুটি নিষ্পলক চক্ষু। পর্দার ও দিকে কুঞ্জে কুঞ্জে আলোর মধু উৎসব―,, এদিকে অনন্ত অন্ধকার। রূপলালসার সঙ্গে প্রয়োজন, তারপর জয়াকাঙ্ক্ষা যতদিন মিশিয়াছিল ততদিন তার মনের বেগ দুর্ধর্মনীয় ছিল; কিন্তু জিত-রাজ্যে জয়পাতাকা উড়ায়া আসিয়াই সে ভাঙিয়া পড়িতেছে।
.
সেই দৃশ্যটা সিদ্ধার্থর অনুক্ষণ মনে পড়ে।
অজয়াকে পাশে লইয়া সে রজতের সম্মুখীন হইতেই রজত অজয়ার মাথায় হাত রাখিয়া আশীর্বাদ করিয়াছিল।
পিসিমা উভয়ের অক্ষয় সুখের কামনা করিয়াছিলেন।
অজয়ার মুখের উপর সুন্দর আলো আসিয়া পড়িয়াছিল―কিন্তু সে ছবিটা সিদ্ধার্থর সহ্য হয় নাই। সরিয়া যাইয়া সে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়াছিল।
আর্শিতে সে মুখ দেখে। মুখের সে উজ্জ্বলতা নাই, চক্ষু কোটরে প্রবেশ করিয়াছে।
এখনও সে আর্শিতে নিজের মুখখানা দখিতেছিল।
দেখিতে দেখিতে হঠাৎ আর্শি ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল-তার উদভ্রান্ত দৃষ্টির সম্মুখে পৃথিবী যেন ঘুলাইয়া উঠিল―পৃথিবীর কোথায় কোন্ প্রান্তে কি দৃশ্য অভিনীত হইতেছে তার কিছুই যেন তার ঠাহর হইতেছে না।
সে পলাইবে। এই ধাঁধা আর দোলার পাকের ভিতর হইতে সে পলাইয়া বাঁচিবে। ধূমকেতুর যেমন উদয়ের তেমনি অস্তে যাওয়ার খেয়াল―দু’দিনের জন্য উঠিয়া মানুষের মনে অশেষ অকল্যাণের আশঙ্কা জাগাইয়া তুলিয়া দুষিত বাষ্পট ছড়াইয়া দিয়া আবার অন্য আকাশে দেখা দেয়। সে পলাইলে কাহারও ক্ষতি হইবে না। কিন্তু সে হাঁফ লইয়া বাঁচিবে। কেবল একখানি বুক ক্রন্দনবেগে দুই-চারিবার দুলিয়া উঠিবে, দু’চার ফোঁটা চোখের জল গড়াইয়া পড়িবে, দু’চারিটি রাত্রি অনিদ্রায় কাটিবে।
কিন্তু যে দূষিত বাষ্প সে ছড়াইয়া দিয়াছে তাহার বিষে সে যদি শুকাইয়া ওঠে! অমন সোনার রং নীল হইয়া যাইবে, অমন দৃঢ় অটল মন সহসা স্থানচ্যুত হইয়া এলইয়া পড়িবে, অমন দৃষ্টি অন্ধকার পথে পাইবে না।
এ ত’ গেল ভাবের কথা। অভাবের কথাটিও ভাবা চাই।
টাকা নাই, কিন্তু দেনা আছে, আর ক্ষুধা আছে। এই যুগলমূর্তি প্রভুভক্ত কুকুরের মত এক মুহূর্ত তার সঙ্গ ছাড়িবে না। তাদের অশ্রান্ত চীৎকার তাকে কেবলই নরকের দিকে ঠেলিতে থাকিবে।
কাজেই পলায়ন স্থগিত রাখিয়া সিদ্ধার্থ মাথা ঠাণ্ডা করিতে বসিল।
.
বসিয়া থাকিতে থাকিতে সিদ্ধার্থ কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল।
স্বপ্ন দেখিয়া ধড়ফড় করিয়া সে ঘর্মান্ত দেহে উঠিয়া বসিল।
লন্ঠনের কাচটা কেরোসিনের কালিতে ভরিয়া উঠিয়াছে। তাহার ভিতর দিয়া আলোর শিখাটা অস্বাভাবিক লাল দেখাইতেছে।
সিদ্ধার্থ প্রস্তনেত্রে চারিদিকটা একবার চাহিয়া দেখিল।
স্বপ্নই বটে। এবং তাহার বিবরণ এই :―
শ্মশানে চিতা জ্বলিতেছে। চিতার আগুনে ধোঁয়া নাই; কিন্তু তার অবিশ্রান্ত সোঁ সোঁ শব্দ নিবিড় আর নিস্তব্ধ অন্ধকারের ভিতর দিয়া যেন তরল একটা স্রোতের মত বহিয়া চলিয়াছে। চিতায় শায়িত শবদেহটা দেখা যাইতেছে।
পুড়িতে পুড়িতে দেহটা কাষ্ঠশয্যার উপর উঠিয়া বসিয়া ধীরে ধীরে মাটির উপর পা রাখিয়া নামিয়া দাঁড়াইল-আগুনের ভিতর হইতে বাহিরে আসিল।
চক্ষু তার নির্নিমেষ। আসিয়া সে সিদ্ধার্থরই সম্মুখে দাঁড়াইল; বলিল,―চিনতে পারছ?
–না, কে তুমি?
–আমি সিদ্ধার্থ। আমার প্রত্যাবর্তন আশা করনি বুঝি?
–তুমি ত’ মৃত।
―না, আমি জীবিত। বিবাহ করতে যাচ্ছি। আমার পরিচয় চুরি ক’রে যাকে তুমি মুগ্ধ করেছ, সে ত’ আমার। তুমি তার কে?
এমনি সময়ে অজয়া আসিল। কপালে তার প্রথম অভিসারের প্রগাঢ় লজ্জা।
হাতে তার সদ্যস্ফুট শুভ্র মল্লিকার একগাছি মালা। অজয়া হাসিমুখে তাহারই দিকে অগ্রসর হইতেছিল। শবদেহ হাত তুলিয়া নিষেধ করিল; বলিল, –তুমি ওকে ভালবাসো না; তুমি ভালবাসো আমার গল্পটিকে। জানো না লোকটা জারজ, অর্থলোভে করূপা বৃদ্ধা বারাঙ্গানার সেবা করতো। তুমি তার গলায় এসেছ মালা দিতে!―বলিয়া দেহ হাত বাড়াইয়া দিলো।
অজয়ার শান্ত স্বপ্নালস চোখে হাসির দীপ্তি ঝলজিয়া উঠিল। সে সেই হাতের হাড় জড়াইয়া ধরিল।
অসহ্য যন্ত্রণায় ক্ষিপ্ত হইয়া সিদ্ধার্থ শবদেহকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইতেই পিছন হইতে কে মার মার করিয়া উঠিল―মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেব তোর। চমকিয়া পিছন ফিরিয়া সিদ্ধার্থ দেখিল, যার দোকানে সে বালকভৃত্য ছিল, সেই মুদি-লাঠি তুলিয়া তাড়িয়া আসিতেছে। পলায়নের উদ্দেশ্যে ছুটিবার উপক্রম করিতেই সিদ্ধার্থ মাটিতে পড়িয়া গড়াইয়া চলিল―ঘোরা শেষ হইলে লাটিম যেমন করিয়া গড়াইয়া ছোটে। অজয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল।
সেই হাসির শব্দ কানে লইয়া সিদ্ধার্থ ঘুম ভাঙিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে।
মৃহদেহের সেই পলকহীন চক্ষু। সেই চক্ষু দুটি সিদ্ধার্থর সম্মুখে অনিৰ্বাণ হইয়া জাগিয়া রহিল।
কিন্তু গলদঘর্মকরা এত ক্লেশের মধ্যেও সিদ্ধার্থর তৃপ্তি এইটুকু যে, পরম দুঃখের ভিতরেও যে সুখর অমৃতবিন্দু লুকাইয়া থাকিতে পারে তাহারই আস্বাদ তার মিলিয়াছে। অজয়াকে ছিনাইয়া লইতে যে আসিয়াছিল, সে পরলোকের লোক।
তবু তাহাতেই বড় ব্যথা বাজিয়াছিল।
সেই অপায় ব্যথার তাড়নে তার শরীরের স্নায়ুতন্ত্রী এখনো টনটন করিতেছে। কিন্তু সেই ব্যথার পশ্চাতেই যে আনন্দ হাসিয়া উঠিয়াছে তাহার তুলনা নাই। সে আনন্দ বিশল্যকরণীর অমোঘ রসে তাহাকে পুনর্জীবিত করিয়া তুলিয়াছে।
স্বপ্ন মিথ্যা, কিন্তু আনন্দটি ত’ পরম সত্য।
আজ সিদ্ধার্থ যেখানে, সেখানে প্রাণের ফোয়ারা সহস্র ধারায় উৎসাহিত―এই প্রাণের নির্ঝরে অবগাহন করিয়া সে বাঁচিবে, অমর হইবে। রিক্তা প্রকৃতির বুকের উপর যে দিন আদি প্ৰাণমুকুলটি শুক্তিকোষে মুক্তাটির মত প্রথম সঞ্জীবিত হইয়া উঠিয়াছিল, সেইদিন হইতে এই বাঁচিবার প্রয়াস সংগ্রাম চলিয়া আসিতেছে―একমাত্র রব―বাঁচো, বাঁচো। অমোঘ আদেশ, অনন্ত তাগিদ―ক্লীব দুর্বলতার দোহাই দিয়া পরিহার করিবার উপায় নাই। প্রেমে পশুত্ব যে দিয়াছে সেও ধন্য। প্রেমে স্বর্গীয় দেহাতীত পরিবত্রতা কল্পনা করিয়া মানুষের এই অতিষ্ঠকর কলরব কতদিনের? দেহ স্বল্পজীবী, আত্মা অমর―কিন্তু দেহ কি মানুষের বাঁচিবার ইচ্ছার বিগ্রহ নয়? শিবের পূজা শুদ্ধমাত্র তাঁর মাঙ্গলের পূজা নয়―সৃষ্টি প্রবাহ অক্ষয় রাখিবার তাঁর যে শক্তি তাহারও পূজা।
তারপর হাতে-খড়ির দিনটাকে সিদ্ধার্থর খুব শুভদিন মনে হইতে লাগিল।
সে দিনটা বিদ্যারম্ভের পক্ষে শুভদিন ছিল কি না, পঞ্জিকা খুলিয়া তাহা কেহ দেখে নাই। কোনো দেবতাকে স্মরণ করা হয় নাই; পুরোহিতের পদধূলি অস্পৃশ্যের বিদ্যারম্ভ পবিত্র করেনি।
এতগুলি ত্রুটি-অনিয়ম সত্ত্বেও সেই কাজটি আজ সর্বার্থসাধক, সার্থক হইয়া উঠিয়াছে। মা সরস্বতীর হাস্যচ্ছটা নিকষের উপর সূক্ষ্ম স্বর্ণরেখাটির মত, কঠিন অজ্ঞানান্ধকারের কোন্ স্থানটি প্রথম আলোকিত করিয়াছিল তাহার উদ্দেশ নাই। কিন্তু তাহারই বিস্তৃতিতে আজ ত্রিলোক উদ্ভাসিত।
আশা জন্ম নিলো। তাহাকে হাত ধরিয়া লইয়া চলিল।
সিদ্ধার্থ দেখিতে দেখিতে চলিল, সে এক আশ্চর্য মায়াপূরী―সেখানে কর্কশ শব্দ নাই, দুর্নীতির গণিকারবৃত্তি নাই, অভাবের প্রেমনৃত্য নাই।
সে যেন মেঘরাজ্যের অপর পায়ের দুষ্প্রবেশ্য কল্পলোক―তাহার মূর্তি দেখিয়া আসিয়া সিদ্ধার্থর প্রলুব্ধ মন নিতাকার জীবনের সঙ্গে বিরোধ বাধাইয়া দিলো।
বন্দী অতি গোপনে শৃঙ্খল কাটিতে লাগিল। তারপর সে সুকৌশলে পথ কাটিয়া কাটিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে শৈলশৃঙ্গে।
সেখানে একটিমাত্র গোলাপ ফুটিয়া আছে। গোলাপের দলে দলে অফুরন্ত সৌরভ, সদ্যোখিত সূর্যের মত তার রঙ। তার মুখের উপর কখনো মেঘের ছায়া, কখনো আকাশের আলো।
কিন্তু একেবারে নিঃসঙ্গ। অপরদিকে অতল অন্ধকার, তার নীচে পাথর। পড়িলে অন্ধকারের উপরে দেহ চূর্ণ হইয়া মিলাইয়া যাইবে।
সিদ্ধার্থ শিহরিয়া চোখ বুজিল। কিন্তু সে রাত্রি তার পায়চারি করিয়াই কাটিল, চোখে ঘুম আসিল না।