অসাধু সিদ্ধার্থ – ১২

॥ বার ॥

সিদ্ধার্থর চোখের সম্মুখে দিবারাত্র জ্বলজ্বল করে সন্ধ্যাকাশের যুগল তারকার মত অজয়ার চক্ষু দুটি। মুর্ছাভঙ্গে চোখ মেলিয়াই সে দেখিয়াছিল, অজয়ার উৎকণ্ঠিত চক্ষু―দুটি যেন প্রাণ ঢালিয়া দিয়া তার চেতনাসঞ্চার নিরীক্ষণ করিতেছে।

চোখে চোখে মিলন হইয়াছিল। অজয়ার চোখের অতলে ছিল একটা বিন্দুবাসিনী দ্যুতি।

তারপর সিদ্ধার্থ চোখ বুজিয়াছিল, দোবল্যবশত নহে, পুলকে। তার অবশ জিহ্বা জড়িতস্বরে উচ্চারণ করিয়াছিল,–আমি কোথায়? অজয়া―

কিন্তু আগাগোড়া তার অভিনয়। সিদ্ধার্থ ভাবে, মূর্ছা যাওয়া নিখুঁত হইয়াছিল, বেশ পড়িয়াছিলাম।

কিন্তু তার বিবেক যেন তপ্তস্পর্শে চম্‌কিয়া পিছাইয়া দাঁড়ায়। দেবতার শুচি-শুভ্র মন্দির―সেখানে শুধু পুষ্পচন্দনের স্থান―শোভা আর সৌরভ। সিদ্ধার্থর মনে হয়, সেখানে সে পায়ের কাদা ছিটাইয়া দিয়া আসিয়াছে।

একে একে মনে পড়ে জীবনের কথা।

সে চোর, জারজ; বেশ্যার দাসত্ব সে করিয়াছে।

যে-রত্ন আহরণ করিতে সে সিঁদকাঠি লইয়া বাহির হইয়াছে, তাহার মত কুক্কুটের জন্য সে অপরূপ রত্নের সৃষ্টি হয় নাই।

জীবনের আরম্ভ মুদিখানায়। তার পূর্বে সে কোথায় ছিল কে জানে―

মুদিখানাটাই স্পষ্ট মনে পড়ে। সেখানে সে মুদির ভৃত্য ছিল। তামাক সাজিত, বাটখারা ধুইত, সকালে সন্ধ্যায় ঘরে ঘৃনা আর চৌকাঠে জলের ছিটা দিত; ঝগড়া বিদ্রোহ করিত।

আর ভালো করিয়া মনে পড়ে, থিয়েটারের কথাটা

মুদিখানা হইতে প্রোমোশন পাইয়া সে সখের থিয়েটারে আসে―একটি বাবুর অনুগ্রহে। তাহার কণ্ঠের সুরসম্বলিত শ্রীমতীর বিরহ-সঙ্গীত শুনিয়া ম্যানেজারবাবু তাহাকে মুদির নিকট হইতে চাহিয়া লইয়া যান।

মফঃস্বলের থিয়েটার। রাজকন্যার সখী সাজিয়া তাহাকে ঘাগ্রা ঘুরাইয়া নাচিতে হইত; এবং প্রণয়াস্পদের জন্য ব্যাকুলা নায়িকাকে নাকি সুরে প্রবোধ দিতে হইত, ‘সখি, ভেবো না, সে আসবে, আসবে, আসবে।’

থিয়েটারের লোকগুলি নিজেদের গরজেই তাহার একটি মহদুপকার করিয়া ছাড়িয়া দিলো। তাহার উচ্চারণে গ্রাম্যাদ্যেষ থাকিত; এবং সেই ত্রুটি সংশোধনের জন্য, অর্থাৎ ফুল্লকে যাহাতে ফুললো আর সে না বলে সেইজন্যই তাহাকে একটু ‘তৈরী’ করিয়া লইতে একখানি বর্ণ পরিচয় কিনিয়া দিয়া তাহাকে পাঠ দিতে লাগিয়া গেল।

মেধা ছিল, আগ্রহ ছিল। খুশী হইয়া ম্যানেজারবাবু তাহাকে ইস্কুলে ভর্তি করিয়া দিলেন।

লেখা-পড়ায় উন্নতি হইল ঢের, কিন্তু মনের ইতরতা ঘুচিল না।

অর্থলোভে এক বৃদ্ধা বারাঙ্গনার―

সিদ্ধার্থ এইখানে ব্যথায় মুখ বিকৃত করিয়া ‘উঃ’ বলিয়া একটা আর্তনাদই করিল। সেই নরক!

তারপর সেই বৃদ্ধকে হাসপাতালের ডোমের স্কন্ধে তুলিয়া দিয়া তাহারই পরিত্যক্ত অর্থ মূলধন করিয়া সে শুরু করিল ব্যবসা।

পাপের কড়ি প্রায়শ্চিত্তে গেল। নিঃস্ব ঋণগ্রস্ত হইয়া সে হাটের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল।

দিক্ ভ্রান্ত অবস্থায় ইতস্ততঃ ঘুরিতে ঘুরিতে সাক্ষাৎ হইয়া গেল সেই আসল সিদ্ধার্থ বসুর সঙ্গে।

*** সর্বত্যাগী মহাপুরুষ আর্তরক্ষায় একদিন জীবন দান করিল তাহারই চোখের সম্মুখে।

এখন তাহারই লাঠি আর নাম গ্রহণ করিয়া তাহারই কথা উচ্চারণ করিয়া সে বেড়াইতেছে। সিদ্ধার্থর ব্রতপরিচয় সহ জীবনের আদ্যন্ত কথা নটবরের জীবনকথায় রূপান্তরিত হইয়া গেছে। তারই ভূমিকা অভিনয় করিয়া সে মুগ্ধ করিয়াছে একটি নারীকে।

আর একবার আর একটি নারীকে সে মুগ্ধ করিয়াছিল; কিন্তু তাহাতে প্রাণ জুড়ায় নাই―সেই ক্ষিপ্ততার স্মৃতি এখন কটু হইয়া উঠিয়াছে।

ভগবান রক্ষা করিয়াছিলেন। মহাপাতকের দ্বার হইতে ফিরিয়া আসিতে হইয়াছিল। কিন্তু আজ অবৈধতার বাধা নাই। সে আজ বৈকুণ্ঠের অধিবাসী।

মন খোলসা হইয়া সিদ্ধার্থ ঊর্দ্ধলোকে আরোহণ করিতে লাগিল।

মনে হইল, পৃথিবীর স্পর্শ প্রভাবের সে অতীত।

মূর্ছাভঙ্গে অজয়ার চোখে যে নির্নিমেষ চাহনিটা দেখিয়াছিল, সিদ্ধার্থর মনে হইল, সেই চাহনির ভিতরেই অঙ্গ দেবতার অরুণনেত্র ফুটিয়া ছিল, এবং তাহারই রক্তরশ্মি যেন তাহাকে রথে তুলিয়া লইয়া ছুটিয়া চলিয়াছে।

এই পৃথিবীর সাধারণ লোকের মত নিজেকে এতক্ষণ অতিশয় বিবেক বিব্রত মনে করায় সিদ্ধার্থ মনে মনে খুব হাসিতেছে, এমন সময় তাহার বদ্ধ দুয়ারের উপর ভীষণ শব্দে করাঘাত পড়িল।

―কে?

প্রশ্নটা যেন একটা ঝটিকাবর্তা। এমনি করিয়া সে সিদ্ধার্থর সুখের চূর্ণ প্রাসাদটিকে মুখে করিয়া বাহির হইয়া আসিল।

বাহির হইতে আওয়াজ আসিল―পাওনাদার।

সিদ্ধার্থর কানের ভিতর ঝমঝম করিতেছিল, বলিল,―ভেতরে আসুন।

আসিল রাসবিহারী। এবং আসিয়াই খলখল করিয়া হাসিতে লাগিল; বলিল,―আমি গো, মাত্তর রাসবিহারী, তোমার বন্ধু আর অনুগ্রহপ্রার্থী।

কিন্তু সিদ্ধার্থর মনে হইল, তাহার বন্ধু এবং অনুগ্রহপ্রার্থী রাসবিহারী বর্শায় বিদ্ধ করিয়া তাহাকে তাহার নিজের বায়ু আকাশ হইতে নামাইয়া, যেখানে সে বাঁচিতে পারে না, সেই উষ্ণ বাষ্পের ভিতর টানিয়া আনিয়াছে।

সিদ্ধার্থ কথা কহে না দেখিয়া রাসবিহারী বলিল,―বুকের ধড়ফড়ানি থামেনি এখনো? দেবরাজও আসছে―

সিদ্বধার্থ বলিল,―সেদিন তোমায় আমি অপমান ক’রেই বিদায় করেছিলাম। তুমি রাগ ক’রেও আমায় ত্যাগ করছ না কেন, রাসবিহারী?

―কম্‌লি, কম্‌লি―সে কি অল্পে ছাড়ে? সেদিন বড় দুঃখিত মনেই ফিরেছিলাম, কিন্তু তুমি যে আমার পুরাতন বন্ধু, ভাই? তোমায় কি আমি একটি দিনের একটি কথায় ত্যাগ করতে পারি?

দেবরাজ রাসবিহারীর পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল; বলিল,―যে জন্য আসা সে কথাটা―

―বলছি, আগে বসি।

রাসবিহারী বসিয়া বলিতে লাগিল,―মামলা রুজু করতে চাই, সিদ্ধার্থ বাবু। এখন তোমার সহৃদয় অনুমতি পেলেই শুভ দেখে একটা দিন ঠিক ক’রে ফেলি।

–আমি যদি দাসখতের টাকা দিতে অঙ্গীকার করি―

শুনিয়া রাসবিহারীর চোখ কপালে উঠিয়া গেল না―একটু বড় হইল। বলিল,―এক মিনিট সময় দাও! সেদিন ভেবেছিলাম তোমার মন খারাপ; এখন দেখছি, তোমার মন ওলট-পালট হয়ে গেছে। সিদ্ধার্থ বাবু, তুমি বলছ কি!

–বলছি এই, যদি টাকাটা দিয়ে দিতে অঙ্গীকার করি, তাহলে তাকে ক্ষমা করবে?

–কাকে?

–যার সর্বনাশ করবে ব’লে কোমর বেঁধেছ!

―সর্বনাশ করবো ব’লে কোমর বেঁধেছি যদি জানো তবে টাকা দেখাচ্ছ কেন? টাকা আমার ঢের আছে―ব’য়ে ব’য়ে টাক পড়ে গেছে। আর তুমি যে টাকার কথা শোনাচ্ছ সে টাকা কাকে রাজা ক’রে দিয়ে বখ্শিস পেয়েছে, শুনি?

দেবরাজ বলিল,―সুর এক লম্ফেই যে সপ্তমে চ’ড়ে গেল!

সিদ্ধার্থর কাতর মুখ দেখিয়া তাহার মমতা জন্মিয়াছিল। কিন্তু রাসবিহারী মর্মাহত হইয়া গলা চড়াইয়া দিলো,―দেখো লোকটার কৃতঘ্নতা!―তারপর সে সিদ্ধার্থর দিকে ফিরিল,–অনাহারে শুকিয়ে যখন মরছিলে তখন ধর্ম তোমায় রাখেনি, ধর্মাবতার। এই পাপাত্মার অধর্মের পয়সাই তখন তোমায় বাঁচিয়েছিল।

―নিজের কাজে লাগাবার উদ্দেশ্য। তবু সেই দানের জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ কিন্তু কৃতজ্ঞতা ছাড়া মনের আরো অনেক বৃত্তি আছে যা আমি তোমায় বুঝিয়ে বলতে পারবো না।

রাসবিহারী ঘাড় বাঁকাইল,―চাওইনে বুঝতে। যা পারো তাই তোমায় করতে বলছি।

সিদ্ধার্থর প্রাণ ছলছল করিতে লাগিল। সে কায়মনোবাক্যে সংশোধিত হইয়া খোলস ছাড়িতে চায়, সেইক্ষণটি তার এখন উপস্থিত―যে ক্ষণটি মানুষের জীবনে বিদ্যুতের মত একবার চকিতে দেখা দেয়―তাহারই আলোক যে ধরিয়া রাখিতে পারে জীবনে তার আলোর অভাব ঘটে না। কিন্তু তাহার সঙ্গে গ্রথিত রহিয়াছে দুষ্কৃতির সূত্রে আর স্মৃতিতে আরো বহু লোক, আর এই রাসবিহারী।

স্মৃতিকে সে সরাইয়া রাখিয়াছে। অনুভূতির পরিধি তার সুসংস্কৃত হইয়া ব্যাপক হইয়া গেছে। কেবল রাসবিহারীই পুনঃপুনঃ দেখা দিয়া তাহাকে মনে করাইয়া দিতেছে যে, পৃথিবীর কোনো রূপান্তর ঘটে নাই। কণ্টকবনের পঙ্কিল সঙ্কীর্ণ পথে সে সেই মানুষই আছে।

সিদ্ধার্থ হঠাৎ যেন অজ্ঞান হইয়া গেল।

হেঁট হইয়া রাসবিহারীর পা সে ছুঁইয়া ফেলিল। বলিল, তোমার পায়ে ধ’রে কিছুদিনের সময় চাইছি; অন্তত দুটি মাস আর অপেক্ষা করো।

রাসবিহারী সিদ্ধার্থর হাতের নাগালের বাহিরে সরিয়া আসিয়াছিল, কিন্তু রাগে তার ব্রহ্মাণ্ড জ্বলিতেছিল; বলিল,―না হয় করা গেল, কিন্তু তার পরে?

― ঋণ পরিশোধ করবো।

―কিন্তু ঋণ পরিশোধের তাগিদ এ ত’ নয়।

–নয় নয়, তা-ই। কৃতজ্ঞতার ঋণ। ঐ কথাটা শোনাতে না পারলে সাধ্য কি তোমার যে আমার গলায় হাত দাও! সময় দিলে ত’?

–দিলাম, বড় অনিচ্ছার সঙ্গেই দিলাম। কিন্তু উড়ো না যেন। একবার কিছুদিন তোমায় খুঁজে পাইনি।

–আমার ঐ সঙ্কোচটুকু আছে ব’লেই টাকা তোমার নিরাপদ, তা তুমি জানো।

―জানি। একটা কথা মনে রাখতে তোমায় ব’লে যাই―কলিতে ধর্ম নাই। নিজের কাজ বাজিয়ে নাও―এই কলির একমাত্র ধর্ম।

.

রাসবিহারীরা চলিয়া গেলে সিদ্ধার্থ কিছুক্ষণ পর্যন্ত কিছুই ভাবিতে পারিল না―ভাবনা যেন দানাই বাঁধিল না। তারপর অল্পে অল্পে কাজ সুরু হইল―রাসবিহারীর সদুপদেশটা সে ভাবিয়া দেখিল, এবং বুঝিল ঠিকই। শূন্য উদরে ধর্মের জয়ঢাক বাজাইয়া বেড়ানো নির্বোধের কাজ, আত্মঘাতীর কাজ। আত্ম-প্রবঞ্চনা করিবারও অধিকার কাহারও নাই―তাহারও নাই। কে কবে গল্পের মুখের দিকে চাহিয়া নিজের প্রাপ্য কপর্দক ত্যাগ করিয়াছে! কথকের মুখে শোনা গেছে, শত্রুভাবেও ভগবানকে লাভ করা যায়। সে-ও অধর্ম; তবে অধর্ম ঘৃণ্য কিসে? ভগবানকে সে চায় না―সে চায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে―একটি সুমধুর সুস্থ নারী-হৃদয় জয় ক’রে সেখানে নির্বিঘ্নে সিংহাসন স্থাপিত করতে। রাসবিহারীই যথার্থ বন্ধু―দৃষ্টান্ত দেখাইয়া একটি কথায় বিবেকের বিদ্রোহ দমন করিয়া দিয়া গেছে।

সুতরাং রাসবিহারীর ঋণ সর্বাগ্রে বিবেচ্য।

দু’-দশ মিনিট পূর্বেই যে রাসবিহারীকে সিদ্ধার্থ পরম শত্রু ছাড়া আর কিছু ভাবিতে পারে নাই, সে-ই এখন তার পরম মিত্র হইয়া উঠিল।

মানুষের কেবল নিজের বাগ্রতায় ডিগবাজি খাইয়া চলিয়াছে। কিন্তু সে তা জানে না। মনে করে, পৃথিবীরই রূপ ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হইতেছে। বিস্ময়ে সে অবাক হইয়া যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *