॥ এক ॥
সিদ্ধার্থ তার নামই নয়। নাম তার নটবর; নিরষ্কার নটবর―“ঘোষ বোস গুহ মিত্তির” ইত্যাদি কুলাধিকারীর পরিচয় একটিও তার নামের পশ্চাতে কখনো ছিল না।
কেবল নটবর; প্রয়োজন বোধ করিলে মাত্র দাস শব্দটা জুড়িয়া দিত―অতিশয় বিনয়বশত।
কিন্তু বহুদিন হইতে নটবর সিদ্ধার্থ নামেই অবাধে চলিয়া আসিতেছে।
এই গোপনচারিতা কেউ টের পায় নাই; তাই অনুসন্ধিৎসু হইয়া আজ পর্যন্ত ঐ পরিবর্তন সম্পর্কে কেহ প্রশ্ন করে নাই।
নিজের মনে তার বিবিধ প্রশ্ন জাগে―কিন্তু সে পরের কথা।
সিদ্ধার্থের ঋজু বলিষ্ঠ দেহ; বর্ণ গৌর; মুখে বুদ্ধির দীপ্তি। এমনি করিয়া সে মাটিতে পা ফেলিয়া চলে যেন পৃথিবীর যাবতীয় প্রতিকূলতা আর বিমুখতা সে অতীব অবজ্ঞার সহিত দু-পা দিয়া মাড়াইয়া চলিয়াছে। মানুষের সঙ্গ দিয়া, সাহচর্য দিয়া তার কোনো প্রয়োজন নাই; সহানুভূতির সে ধার ধারে না।
এই তার বাহ্যিক মূর্তি।
কিন্তু ভিতরটা তার অন্য রকম―কিছুদিন হইতে সেখানে অগ্নিগিরির অগ্নিবমন সুরু হইয়া গেছে। ভিতরে সে শ্রান্ত, অতিশয় পরমুখাপেক্ষী।
প্রাপ্ত সিদ্ধার্থ নাম, তদুপরি প্রাপ্ত বসু উপাধিটি এবং উহাদের সংযোগে প্রাপ্ত একটি জীবনধারার অতীত ইতিহাস ও সুবিধাগুলি সে প্রাণাপণে খাটাইয়া দেখিয়াছে।
সুফল তেমন ফলে নাই; ঋণগ্রস্ত হইয়া তাহাকে কারবার তুলিতে হইয়াছে।
.
সহরের এক অনুন্নত অংশে তার বাস। কোনো প্রকারে দেহটাকে সজীব রাখিবার আয়োজন সেখানে আছে; আর কোনো সুখের বস্তু নাই।
সিদ্ধার্থ বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছে।
ভাবনার আদিও নাই, অন্তও নাই; কি ভাবিতেছে তারও বিশেষ দিক্ দিশা নাই―-তবে ভাবনাটা যেন মাঝে মাঝে থমকিয়া হা হা করিয়া শূন্যে উঠিয়া যাইতেছে―যেমন দীপের চঞ্চল শিখাগ্রটা ঊর্ধ্বের অন্ধকারের অঙ্গে সূক্ষ্মতম রেখায় বিদ্ধ হইয়া অদৃশ্য হইয়া যায়―
কিন্তু দাহ তার থাকেই।
সিদ্ধার্থর বড় অর্থাভাব। ঋণ মিলিতেছে না; মিলিতেছে কেবল ঋণ পরিশোধ করিবার অসহিষ্ণু কঠিন তাগিদ।
সিদ্ধার্থ ক্ষুধার্ত।
চক্ষু বুজিয়া আসিতেছে।
দরজার সম্মুখে হঠাৎ কে হাঁকিয়া উঠিল―সিদ্ধার্থ জেগে আছ?
সিদ্ধার্থর ক্লান্ত চোখের ভারি পল্লব দ্রুতগতি উঠিয়া গেল―পরিচিত কণ্ঠ; বলিল, আছি, এস।
যে আসিল সে যে সিদ্ধার্থর বন্ধু তাহাতে কোনো বিসম্বাদই নাই; উপরন্তু সে পথে পাওয়া লৌকিক বন্ধু নয়, সুখ-দুঃখের দরদী জন।
সিদ্ধার্থ বলিল,―ব’স; বড় অন্ধকার, বন্ধু।
দেবরাজ হাসিয়া উঠিল।
ইদানীং সিদ্ধার্থর চালচলন দেখিয়া আর কথাবার্তা শুনিয়া বেচারীর মস্তিষ্ক সম্বন্ধে তাহাদের দারুণ একটা সন্দেহ জন্মিয়াছে।
তাই দেবরাজ ফিক্ ফিক্ করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল,―অন্ধকার কোথায়? দিব্যি দিনের মত ফুট্টুটে জ্যোছনা।
―বাইরে নয় ভাই, ভেতরে।―বলিয়া অনিচ্ছুক দেবরাজের ডান হাতখানা বুকের উপর টানিয়া তুলিয়া লইয়া সিদ্ধার্থ বলিল,―অন্ধকার এইখানে। কান পেতে থাকো একটা শব্দ শুনতে পাবে। ভগবানের অভিসম্পাত বুকের গহ্বর জুড়ে চেপে বসে আছে; তার ভেতর থেকে অবিশ্রান্ত উঠছে পৃথিবীর ক্ষুধার গোঙানি।–বলিয়া দীর্ঘ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে সে বন্ধুরই মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, কিন্তু অনুভব করিতে লাগিল কেবল নিজেকে।
দেবরাজ গাম্ভীর্য্যের ভান করিতেছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত টি’কাইতে পারিল না; হাসিয়া ফেলিয়া বলিল,―বড় বেশী অন্ধকারই বটে। কিন্তু এ অন্ধকারের মানে কি? অভাব ত? আমি চাঁদ এনেছি একেবারে পূর্ণচন্দ্র, ষোলকলা; উঠি-উঠি করছে। দেখবে?―বলিয়া চাঁদ দেখাইবার জন্যই যেন সে হাত টানিয়া লইল।
―দেখতে ত চাই। কিন্তু তোমার হাত দিয়ে যখন অযাচিতভাবে উঠে আসছে তখন সন্দেহ হয়, সে চাঁদে কলঙ্ক বিস্তর।
ভারি একটি তামাসার কথা যেন―
দেবরাজ ভারি দেহ দুলাইয়া দুলাইয়া অজস্র হাসিতে লাগিল; বলিল,―হাসালে সিদ্ধার্থ, এত দিন পরে। চাঁদের কলঙ্ক দেখে ডরাচ্ছ তুমি। সে কলঙ্ক কি কলঙ্ক! সে গল্পের বুড়ি, আর জ্যোতির্বিদের পাহাড়। যাক্ সে কথা-কাজের কথা মন দিয়ে শোনো। রাসবেহারী একখানা চিঠি দিয়েছে তোমায় দিতে; কিন্তু চিঠি হস্তান্তর করবার আগে একটা প্রতিশ্রুতি নেবার কথা আছে। প্রস্তাবে তুমি রাজি হলে, চিঠি দেবো না। চিঠি আগে চাও, না প্রস্তাবটাই আগে শুনবে?
―প্রস্তাবটাই আগে শোনাও, তবে সংক্ষেপে।
―সংক্ষেপেই বলছি। রাসবেহারী স্যাক্রা এবং মহাজন তা জানো। তার একটা পুরনো শত্রু আছে, পারিবারিক শত্রু। এই শত্রুটার বাড় সে একটু দমিয়ে দিতে চায়, মানে একটু থেঁতলে দেওয়া আর কি―
―কিন্তু আমি ত’ মুগুর চালাতে জানিনে।
―জানো যে তা-ও ত আমি বলিনি। মুগুর ত নির্বোধের অস্ত্র; বুদ্ধিমানের যে অস্ত্র তাই ব্যবহার করতে হবে। তাতে তুমি দক্ষ। শত্রুটি গরীব কিন্তু জেদী আর দুষ্টু।
―সে তার বাপের শ্রাদ্ধের সময় বসত-বাড়ী বাঁধা রেখে চারশো টাকার আবদ্ধ তশুক লিখে দিয়েছে―মানে, সেইটে তোমায় লিখতে হবে। তুমি বিশ্বাসী গুণী লোক। একশোখানি রূপচাঁদ, নিষ্কলঙ্ক, নগদ, হাতে হাতে। অন্ধকার―
দুইজনে পা ঝুলাইয়া তক্তপোষে বসিয়াছিল।
সিদ্ধার্থ তক্তপোষের কিনারাটা আঙুল বাঁকাইয়া চাপিয়া ধরিয়া উপরের দিকে টানিতে লাগিল; বলিল,―দাঁড়াও―
টানিতে টানিতে হাত দু’খানা তার টান টান্ হইয়া সমস্ত দেহটাই খাড়া হইয়া দেখিতে দেখিতে আড়ষ্ট শক্ত হইয়া উঠিল।
দেবরাজ তাহার দিকে একবার আড়চোখে চাহিয়া লইয়া নিঃশব্দে অপেক্ষা করিতে লাগিল―এবং তাহার মানসিক হাসির আর বিরাম রহিল না। তার বুদ্ধিতে সে ইহাই বুঝিল যে, এটুকু সিদ্ধার্থর অভিনয়―যেন ভিতরে সুমতি আর কুমতির তুমুল একটা লড়াই বাধিয়াছে।
কিন্তু দেবরাজ ভুল বুঝিল।
পুরাতন বন্ধু, তবু সিদ্ধার্থের খানিকটা তার চোখের আড়ালেই ছিল।
সত্যই একটা দ্বন্দ্ব চলিতেছিল। যতদূর অধঃপতিত এবং হীনতার মান বলিয়া সিদ্ধার্থ পরিচিত তাহা একেবারেই ভুল না হইলেও, দুর্বিপাকের পাকের ভিতর পড়িয়া ও তার অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত মনে দেবরাজের অনুমানের অতীত একটা স্থানে কু ও সু-এর কলহ এখনো ঘটে।
নিরতিশয় ক্লেশকর অপমানবোধের সহিত সিদ্ধার্থর মনে হইতে লাগিল, মানুষের মনে কতদূর গভীর ইতরাতয় নিঃসংশয় বিশ্বাস জন্মিলে তবে সে এহেন প্রস্তাব লইয়া আর একজনে টাকার রোভ দেখাইতে আসিতে পারে। ভিখারীরও কান্ডজ্ঞান আছে―অভাবের তাড়নায় দেহ আর রূপ যার পণ্য তারও ধর্ম আছে; তারও ঘৃণার বস্তু পৃথিবীতে আছে; তার নিবৃত্তির আকাঙ্ক্ষা আছে; পরলোক, পাপ-পুণ্য সে মানে; শ্রদ্ধার দাবীও সে করে; কিন্তু কোন্ নরকের অতল গহ্বরে নামিয়া গেলে মানুষ দুনিয়ার আর সবই একধারে ঠেলিয়া দিয়া কেবল অর্থকেই প্রাপ্তির চরম স্বার্গ মনে করে!
সিদ্ধার্থ এক নিমেষেই যেন একটা ঘুরপাক খাইয়া ভাসিয়া উঠিল।
চোখে পড়িল, জীবনের অতীত ইতিহাসের সমস্তটা―তার যত দুষ্কৃতি, যত অপকার্য, যত অধর্ম। কিন্তু সিদ্ধার্থর মনে হইল, তারাও যেন একটা নির্দিষ্ট সীমার বাহিরে তাহাকে আনিতে পারে নাই―সমতল ভূমির উপর শিলাস্তূপের মত কঠিনতম আর উচ্চতম হইয়া উঠিল চোখের সম্মুখে এইটাই। কাহারও সর্বনাশ সে কখনো করে নাই; নিরাশ্রয় অন্নের কাঙাল করিয়া কাহাকেও সে পথে বসায় নাই।
সিদ্ধার্থ হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া বলিল,―ভয় করে। আমি পারব না, ভাই।
হাসিয়া দেবরাজ বলিল,―জেলের?
―না। যদি টাকা হাতের ওপর জ্বলে ওঠে।
―খাসা বলেছ। নতুন রকম কথা কইবার যোগ্যতা তোমার বেশ। চিঠিই তবে শোনো।–বলিয়া পড়িতে লাগিল।
প্রিয় বন্ধু সিদ্ধার্থ,
যদিও তুমি ইংরেজি ভাষা ঠিক ইংরেজের মতই বলিতে ও লিখিতে শিখিয়াছ, তথাপি এই চিঠিখানি বাংলাতেই লিখিলাম, আমারই সুবিধার খাতিরে―আমি ইংরেজি জানি না। অত্যন্ত দুঃখের সহিত নিবেদন করিতেছি যে, তোমার অনুরোধ আমি এ যাত্রা রক্ষা করিতে পারিলাম না। প্রথম কারণ, আমি বহুসংখ্যক সন্তানের পিতা, তদ্ধেতু অর্থের অভাব অনুক্ষণ অনুভব করিয়া থাকি; দ্বিতীয় কারণ, হিসাবে দেখিলাম, সুদ বাবদ তোমার নিকট হইতে এ পর্যন্ত একটি পাইও পাই নাই; অথচ হ্যান্ড নোট দুইবার পরিবর্তন করিতে হইয়াছে।
সুস্থিরচিত্তে একটি সৎ পরামর্শ গ্রহণ করিবে কি? তোমার শ্রীবৃদ্ধি বিষয়ে আমি সন্দিহান নহি! তোমার বিচার বুদ্ধি, ভূয়োদর্শন, বাকচাতুর্থ প্রভৃতি সবই আছে এবং ছিল; কিন্তু ক্ষেত্রনির্বাচনে তোমার ভুল হইয়াছিল। ব্যবসা তোমার কাজ নহে, অতএব সে সঙ্কল্প ত্যাগ কর। এই পতনের পর আবার যদি পড়ো, তাহা হইলে আর তোমাকে তোলা যাইবে না।
তোমার দেহে কান্তি আছে, সৌষ্ঠব আছে, সর্বাঙ্গে তোমার লক্ষ্মীশ্রী বিরাজ করিতেছে; তোমার অশেষ গুণ; তোমার বাক্য প্রাণস্পর্শী, তোমার গাম্ভীর্য শ্রদ্ধেয়, তোমার মাথা হেলাইবার ভাগী চমৎকার, তোমার বাহাজ্ঞান অসাধারণ এবং সুদ জমিয়াছে ঢের। শেষোক্ত দ্রব্যটিকে পরিশোধ করিয়া অপরাপর সদ্ গুণগুলি কাজে লাগাও। তুমি বিবাহ কর। আজকাল তোমার উপযুক্ত পাত্রী মিলিতেছে। এমন স্ত্রী গ্রহণ করিবে যে তোমাকে তুলিতে পারে। তোমার বয়স এখন ত্রিশ কিম্বা তার কিছু বেশী; সুতরাং পাঁচ-সাতটি বৎসর তুমি অকারণে জলে নিক্ষেপ করিয়াছ। বয়সের অপব্যয়টা স্মরণ করিয়া তৎপর হও।
সুদাদি কিছু পরিশোধ করিবার সুবিধা হইবে কি? তোমাকে তাগিদ দিতে বাধ্য হই, ইহাতে আমার প্রাণে যেমন ব্যথা বাজে, তেমন বোধ করি তোমারও বাজে না। কিন্তু কি করিব বল! এই যে আমার জীবিকা, ভাই! মাতৃ-অঙ্গের অলঙ্কার বলিয়া যে অনন্ত জোড়া বাঁধা রাখিয়াছ, তাহা ঠিক স্বর্ণের নহে বলিয়া সন্দেহ করিবার কারণ জন্মিয়াছে। তখন অতটা দেখি নাই―বন্ধুকে বিশ্বাস করিয়াছিলাম। ব্যাপার গুরুতর; আশা করি, এরূপ ব্যবহারের ফলাফল সম্বন্ধে তুমি অন্ধ নহে―
ভাল আছি। সর্বদা তোমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা করিতেছি, এবং যতদিন মনে রাখিবে ততদিন পর্যন্ত―
তোমার বিশ্বস্ত
শ্রীরাসবিহারী রার।
.
―সিদ্ধার্থ বাবু আছ কি?
বলিয়া ডাক দিয়া এবং প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই যে ব্যক্তি ঘরে ঢুকিল তাহাকে সুপুরুষ বলা চলে না; মুখ―চোখের অত্যন্ত নিষ্ঠুর চেহারা―যেন নরবলি দিয়া আসিল।
তাহার দিকে চাহিয়াই সিদ্ধার্থর ম্লান চক্ষু আরো নিষ্প্রভ হইয়া উঠিল।
লোকটার নামে আমাদের প্রয়োজন নাই, তার প্রয়োজন দিয়াই প্ৰয়োজন। সিদ্ধার্থ “আসুন” বলিয়া অভ্যর্থনা করিতেই সে ব্যক্তি শোন-চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া বলিল,―থাক; আর সমাদরে কাজ নেই। কত দিচ্ছ বল!
মুহূর্তের জন্য চক্ষু অবনত করিয়া সিদ্ধার্থ যখন চোখ তুলিল, তখন লোকটাকে ছাপাইয়া শুদ্ধমাত্র তার খরতাপ কণ্ঠই যেন সিদ্ধার্থর দৃষ্টির সম্মুখে বিরাজ করিতেছে, এবং সেই কণ্ঠকে উদ্দেশ করিয়া সিদ্ধার্থ বলিল,―আজ, দাদা, ফিরতে হবে; কাল বিকালতক্―
বলিতে বলিতে সে তাড়াতাড়ি চক্ষু পুনরায় নত করিল; মিথ্যা যে মিথ্যাই―এ জ্ঞানটা মিথ্যা কহিবার আজন্ম অভ্যাসেও লুপ্ত হয় না; পাওনাদারের ভূভঙ্গী তাই বেশীক্ষণ তার সহ্য হইল না।
–আমি নিজে এলে কখন ফিরি না; আমার দস্তুর, গুরুর আদেশ। বিকালতক কি বলছিলে? চম্পট দেবার মতলব বুঝি? শুনছি, চারিদিকে তোমার দেনা; তিনবার তুমি কড়ার ভেঙ্গেছ; চতুর্থবারে আমি নিজে কিছু করবো না; বাইরে আমার লোক দাঁড়িয়ে আছে; তারাই যা করবার তা করবে। কি বললাম শুনেছ সব?
―শুনেছি! কিন্তু উপায় নেই; সারাদিন আমি অভুক্ত আছি।
―সুবিধের কথা লড়তে পারবে কম।
বলিয়া সে-ই যেন লড়িবার উদ্যোগ করিতে লাগিল।
সিদ্দাৰ্থ হাত জুড়িয়া বলিতে লাগিল―আপনি ধনী, লক্ষ্মী আপনার ঘরে অচলা হয়ে আছেন। কত দীন, আতুর, পথের কুকুর আপনার অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছে। আমি আপনার ধনসাগরের মাত্র একটি বিন্দু তুলে নিয়েছি; হিসাবের অঙ্কে ছাড়া আর কোনো প্রকারেই আপনি সে ক্ষতি অনুভব করতে পারছেন না। দয়া করে এতদিন যদি সয়ে আছেন, তবে আর ঘণ্টা কতক সবুর করুন, তারপর আপনি আমাকে
বলিতে বলিতে কিসে যে তার কণ্ঠ বুজিয়া আসিল তাহা সে নিজে ছাড়া আর কেহ গ্রাহ্য করা দূরে থাক লক্ষ্যও করিল না।
পাওনাদার তেমনি করিয়া বলিয়া যাইতে লাগিল,―তুমি যে-সব কথা বললে, গৃহে আমার লক্ষ্মী অচলা হয়ে আছেন, দ্রূপ অবস্থাতেই বরাবর থাকবেন, আমি মস্ত একটি ধনসাগর―এমনধারা কথা আমি দায়গ্রস্থের মুখে এত শুনেছি আর এত ঠকেছি যে, সে কথা শুনলে এখন আর প্রাণ গলে না। তুমি অভুক্ত আছ শুনে তোমার কথা আর একবার রাখলাম; কিন্তু মনে রেখো, আমায় ফাঁকি দিয়ে কেউ পার পায়নি।
বলিয়া দম্ দম্ করিয়া পা ফেলিয়া পাওনাদার প্রস্থান করিল।
এবং তারই ক্রুদ্ধ আক্রোশের কথাগুলিকে কে যেন সিদ্ধার্থকে দিয়া মনে মনে বারবার ঘুরাইয়া ফিরাইয়া আবৃত্তি করাইতে লাগিল।
সিদ্ধার্থর আর কিছু না থাক্, একটা চাকর ছিল এবং অঙ্গুরীটি খুলিয়া ভৃত্যের হাতে দিয়া বলিল―এস―
দেবরাজ এতক্ষণ বসিয়া বসিয়া কেবল মুচকি হাসিতেছিল; এইবার ফুরসৎ পাইয়া বলিল,―অন্ধকার দেখে ভয় খাচ্ছিলে : কিন্তু তার ওপরেও ঢের কিছু বাকি ছিল দেখছি।
―ছিল, ওরা দিয়ে গেল কিছু, তুমি দিতে এসেছ কিছু। আমি রাজি। রাসবেহারীর প্রস্তাব অতি সাধু প্রস্তাব। কাল সকালে যাবো।
―নিশ্চয়?
―নিশ্চয়।
তবে এখন আমি উঠি। মূল কথা, অন্ধকার কেটে গেলে যেন চাঁদের ভাগ পাই।–বলিয়া সিদ্ধার্থর পিঠে আদরের দু’টি করাঘাত করিয়া দেবরাজ বিদায় নিল।
.
তাহারই পদশব্দ কানে লইয়া সিদ্ধার্থ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল―তাহাকে যেন সবাই কাঁধে করিয়া বহিয়া আনিয়া বিসর্জন দিয়া গেল―চিরবিদায় দিয়া যাহারা ফেলিয়া গেল, যাওয়াই তাদের কাজ।
সিদ্ধার্থ খানিক কান পাতিয়া রহিল।
যেন স্পষ্ট কানে আসে, দূরের অন্ধকারে কাহার পায়ের ধ্বনি মৃদু হইতে মৃদুতর হইয়া ধীরে ধীরে মিলাইয়া যাইতেছে।
সকলের আগে গিয়াছেন লক্ষ্মী।
তখন দেহটা বিবর্ণ শীতল হইয়া উঠিয়াছিল―বহির্মুখী মন ভিতরের দিকে ধাবিত হইয়াছিল―তাঁহার অঞ্চলচ্যুত হইয়া যেখানে সে পড়িয়াছিল সেটি দুস্তর নিঃশ্বাসভূমি। সেইদিন হইতে তার উদরে অন্ন নাই, চোখে নিদ্রা নাই―কিন্তু দোষ কার!
.
আশা ফলিত, ছিল সবই, কিন্তু ছিল না কেবল সেইটি যার সংজ্ঞা নাই, যার স্বরূপ বলিয়া বুঝান যায় না; যাহাতে উদ্যম সফল হয়, বড় আরো বড় হয়, ছোট উঠিতে থাকে, ছিল না তাই। ―সে অদৃষ্ট নয়, দৈব নয়, পুরুষকার নয়―এই সকলের মিলিত সে নিরুপাধিক অজ্ঞাত একটা বস্তু―ছিল না তার তাই।
পালাইয়াছে সবাই সঙ্গে আছে কেবল সয়তান।
বহু দিনের প্রিয় ইচ্ছাটিকে আড়াল করিয়া সয়তান আজ সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। প্রলোভন দুর্বার।
হাতের কাছেই একখানা আয়না পড়িয়াছিল; হঠাৎ সেইখানা তুলিয়া লইয়া নিজের মুখের সম্মুখে সে বহুক্ষণ ধরিয়া রাখিল; নিজের ছায়াটির দিকে চাহিয়া তাহার মনে হইতে লাগিল, এ মুখ ত’ লক্ষ্মীছাড়ার মুখ নয়, সৌভাগ্যবানেরই মুখ। কিন্তু এই মুখখানা লুকাইবার স্থান তার নাই।
―আবর্ত রচনা করিয়া কালের স্রোত ছুটিয়া চলিয়াছে। স্রোতের বেগ ক্ষিপ্ত, প্রখর; কিন্তু ঐ স্রোত আর আবর্তই ত’ মানুষের অদ্বিতীয় কর্মক্ষেত্র। স্রোতের বাহিরে পলুল আর পঙ্ক।
পলুলের পঙ্কেই আজ সে আবদ্ধ।
ঊর্ধ্বে নিস্তরঙ্গ নীলিমা―নিম্নে তরঙ্গায়িত শ্যামলিমা― দু’টিতে চুম্বনে মেশামেশি।
তাহার অন্তরও ত ঐ দুর্নিরীক্ষা দিরেখা পর্যন্ত প্রসারিত হইয়া মিলন-চুম্বনের স্থানটিতে যাইতে চায়।
কিন্তু জীবনের হিল্লোল কেবল অতীতের দিকে উজান বহিতেছে।
উজান দিকের একটি ঠিকানায় তার জীবন বাঁধা পড়িয়া আছে! সে দৃঢ়বন্ধন সে কাটিবে কি করিয়া!
পাশাপাশি অনেকগুলি ঘর।
একটি ঘরের বাসিন্দা হারমোনিয়ম বাজাইয়া গান গাহিতে লাগিল। কণ্ঠ মধুর নহে, কিন্তু আনন্দ অনাবিল, উচ্ছল।
লোকটি শ্রমজীবী; বারি হইয়াছিল সকাল সাতটায়; ফিরিয়াছে সন্ধ্যা সাতটায়। এই দিনব্যাপী কঠিন শ্রান্তি এক মূহূর্তেই কি করিয়া ভুলিয়া ঐ লোকটি প্রভাতের পাখীটির মত আনন্দে মাতাল হইয়া গান গাহিতেছে!
সিদ্ধার্থর বুভুক্ষু আত্মা ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল।
এ গান মুখের গান নয়―কেবল বুকের গানও নয়।
এ গান গৃহের; চারিটি দেওয়ালে ঘেরা ক্ষুদ্র একটু চতুষ্কোণ স্থানের ভিতর যে সুখ―স্বাচ্ছন্দ্য, তৃপ্তি, আরাম আর বিলাস সঞ্চিত হইয়া ছিল, তাহাই যেন লোকটির কণ্ঠ আশ্রয় করিয়া মহোল্লাসে মুখর হইয়া উঠিয়াছে।
সিদ্ধার্থ গৃহী নয় গৃহ তার নাই।
বৈরাগী সে নহে; বৈরাগ্য তার জন্মে নাই। মাঝখানে সে দুলিতেছে।
ইহা যে কত বড় ব্যর্থতা, বিরহ আর শূন্যতা তাহা কেবল সে-ই জানে যার ঘটিয়াছে।