অসম্ভবের দেশে
প্রথম পরিচ্ছেদ – অদ্ভুত জন্তু
সকাল বেলায় উঠানের ধারে বসে কুমার তার বন্দুকটা সাফ করছিল৷ হঠাৎ পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখে, হাসিমুখে বিমল আসছে৷
কুমার বিস্মিত স্বরে বলল, ‘এ কী, বিমল যে! তুমি কবে ফিরলে হে?’
‘আজকেই৷’
‘তোমার তো এত তাড়াতাড়ি ফেরবার কথা ছিল না!’
‘ছিল না৷ কিন্তু ফিরতে হল৷ তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে এসেছি৷’
কুমার অধিকতর বিস্ময়ে বলল, ‘আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে! ব্যাপার কী?’
‘গুরুতর৷ আবার এক ভীষণ নাটকের সূচনা!’
কুমার উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তাহলে এ নাটকে তুমি কি আমাকেও অভিনয় করবার জন্যে ডাকতে এসেছ?’
‘তা ছাড়া আর কী?’
‘সাধু, সাধু! আমি প্রস্তুত৷ যাত্রা শুরু হবে কবে!’
‘কালই৷’
‘কিন্তু তার আগে ব্যাপারটা একটু খুলে বলবে কি?’
‘তা বলব বই কী! শোনো! . . . তুমি জানো, সুন্দরবনে আমি শিকার করতে গিয়েছিলাম৷ যে-জায়গাটায় ছিলাম তার নাম হচ্ছে মোহনপুর৷ কিন্তু সেখানে গিয়ে শিকারের বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারিনি৷ একটিমাত্র বাঘ পেয়েছিলাম কিন্তু সে-ও আমার বুলেট হজম করে হয়তো খোশমেজাজে বহাল তবিয়তেই তার বাসায় চলে গিয়েছে৷
‘স্থলচরেরা আমাকে ‘বয়কট’ করছে দেখে শেষটা জলচরের দিকে নজর দিলাম৷ আমার সুনজরে পড়ে একটা কুমির আর একটা ঘড়িয়াল তাদের পশুজীবন থেকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মুক্তিলাভ করল৷ তারপর তারাও আর আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হল না৷ মনটা রীতিমতো তিক্তবিরক্ত হয়ে উঠল৷ ভাবলাম, কাজ নেই বনেজঙ্গলে ঘুরে, ঘরের ছেলে আবার ঘরেই ফেরা যাক৷
‘ঠিক এমনি সময়ে এক অদ্ভুত খবর পাওয়া গেল৷ মোহনপুর থেকে মাইল-পনেরো তফাতে আছে রাইপুর গ্রাম৷ রাইপুরের একজন লোক এসে হঠাৎ একদিন খবর দিল, সেখানে জঙ্গলে নাকি কী-একটা আশ্চর্য জীব এসে হাজির হয়েছে৷ সে জীবটাকে কেউ বলে বাঘ, কেউ বলে গণ্ডার, কেউ-বা বলে অন্য কিছু৷ যদিও তাকে ভালো করে দেখবার অবসর কেউ পায়নি, তবু এক বিষয়ে সকলেই একমত৷ আকারে সে নাকি প্রকাণ্ড-যে-কোনো মোষের চেয়েও বড়ো৷ তার ভয়ে রাইপুরের লোকেরা রাত্রে ঘুম ভুলে গিয়েছে৷’
কুমার সুধাল, ‘কেন? সে জীবটা মানুষ-টানুষ বধ করেছে নাকি?’
‘না৷ সে এখনও মানুষ-টানুষ বধ করতে পারেনি বটে, তবে রাইপুর থেকে প্রতি রাত্রেই অনেক হাঁস, মুরগি, ছাগল আর কুকুর অদৃশ্য হয়েছে৷ এর মধ্যে আর-একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, সেই অজানা জীবটার কবলে পড়ে রাইপুরের অনেক বেড়াল ভবলীলা সাঙ্গ করেছে বটে, কিন্তু বেড়ালগুলোর দেহ সে ভক্ষণ করেনি৷’
কুমার বলল, ‘কেন, এর মধ্যে তুমি উল্লেখযোগ্য কী দেখলে?’
বিমল বলল, ‘উল্লেখযোগ্য নয়? হাঁস, মুরগি, ছাগল আর কুকুরগুলোর দেহ পাওয়া যায়নি কিন্তু প্রত্যেক বেড়ালেরই মৃতদেহ পাওয়া যায় কেন? সেই অজানা জীবটা আর সব পশুর মাংস খায় কিন্তু বেড়ালের মাংস খায় না কেন? আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার শোনো৷ দু-তিনজন মানুষও তার সামনে পড়েছিল৷ তারা তার গর্জন শুনেই পালিয়ে এসেছে, কিন্তু তাদের আক্রমণ করবার জন্যে সে পিছনে পিছনে তেড়ে আসেনি৷’
কুমার কৌতূহলভরে বলল, ‘তারপর?’
বিমল বলল, ‘তারপর আর কী, এমন একটা কথা শুনে আর কি স্থির হয়ে বসে থাকা যায়! আমিও মোটঘাট বেঁধে নিয়ে রাইপুরে যাত্রা করলাম৷’
কুমার বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘তাহলে নিশ্চয়ই তুমি সে জীবটাকে দেখে এসেছ?’
‘হ্যাঁ৷ বনেজঙ্গলে দুই রাত্রি বাস করবার পর তৃতীয় রাত্রে তার সাক্ষাৎ পেলাম৷ আমি একটা গাছের উপরে বন্দুক হাতে নিয়ে বসে বসে ঢুলছিলাম৷ রাত তখন বারোটা হবে৷ আকাশে খুব অল্প চাঁদের আলো ছিল, অন্ধকারে ভালো নজর চলে না৷ চারিদিকের নীরবতার মাঝখানে একটা গাছের তলায় হঠাৎ শুকনো পাতার মড়মড় শব্দ কানে এল৷ শব্দটা হয়েই থেমে গেল৷ সেইদিকে তাকিয়ে দেখি, অন্ধকারের ভিতরে ভাঁটার মতন বড়ো-বড়ো দুটো আগুন-চোখ জেগে উঠেছে৷ সে-চোখদুটো আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল৷ চোখদুটো কোন জানোয়ারের আমি বোঝবার চেষ্টা করলাম না, তারপরেই বন্দুকে লক্ষ্য স্থির করে ঘোড়া টিপে দিলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে বিষম এক আর্তনাদ ও ছটফটানির শব্দ৷ সে আর্তনাদ বাঘ-ভাল্লুকের ডাকের মতন নয়, আমার মনে হল যেন এক দানব-বেড়াল আহত হয়ে ভীষণ চিৎকার করছে৷
‘খানিক পরে আর্তনাদ ও ছটফটানির শব্দ ধীরে ধীরে থেমে এল৷ কিন্তু আমি সেই রাতের অন্ধকারে গাছের উপর থেকে আর নামলাম না৷ গাছের ডালেই হেলান দিয়ে কোনো রকমে রাতটা কাটিয়ে দিলাম৷ সকাল বেলায় চারিদিকে লোকজনের সাড়া পেয়ে বুঝলাম, রাত্রে আমার বন্দুকের শব্দ আর এই অজানা জন্তুর চিৎকার শুনেই এত ভোরে সবাই এখানে ছুটে এসেছে৷ আস্তে আস্তে নীচে নেমে পাশের ঝোপের ভিতর দিয়েই দেখতে পেলাম, একটা আশ্চর্য ও প্রকাণ্ড জীব সেখানে মরে পড়ে রয়েছে৷ জন্তুটা যে-কোনো বাঘের চেয়ে বড়ো৷ তাকে দেখতে বাঘের মতন হলেও সে মোটেই বাঘ নয়৷ তার গায়ের রং ধবধবে সাদা, কিন্তু মুখটা কালো৷ আসলে তাকে একটা অসম্ভব-রকম প্রকাণ্ড বেড়াল ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না৷’
কুমার সবিস্ময়ে বলল, ‘তুমি বলো কী হে বিমল, বাঘের চেয়েও বড়ো বেড়াল? এও কি সম্ভব!’
বিমল বলল, ‘কী যে সম্ভব আর কী অসম্ভব তা আমি জানি না৷ আমি স্বচক্ষে যা দেখেছি তাই বলছি৷ কিন্তু এখনও সব কথা শেষ হয়নি৷’
কুমার বলল, ‘এর উপরেও তোমার কিছু বলবার আছে নাকি? আচ্ছা শুনি!’
বিমল বলল, ‘বেড়ালটার দেহ পরীক্ষা করতে করতে আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ল৷ তার গলায় ছিল একটা ইস্পাতের বকলস আর একটা ছেঁড়া শিকল৷ দেখেই বোঝা গেল, এ বেড়ালটাকে কেউ বেঁধে রেখে দিয়েছিল৷ কোনোগতিকে শিকল ছিঁড়ে এ পালিয়ে এসেছে৷ . . . কিন্তু কথা হচ্ছে, এমন একটা বিচিত্র বেড়াল এ-অঞ্চলে যদি কারুর বাড়িতে বাঁধা থাকত তাহলে সকলে তার কথা নিশ্চয়ই জানতে পারত৷ কিন্তু কেউ এই বেড়াল ও তার মালিক সম্বন্ধে কোনো কথাই বলতে পারল না৷ এই বেড়ালের কথা লোকের মুখে মুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল৷ নানা গ্রাম থেকে দলে দলে লোক এসে তাকে দেখতে লাগল৷ এমন একটা অসম্ভব জীব দেখে সকলে হতভম্ব হয়ে গেল!’
কুমার বলল, ‘এইখানেই তাহলে তোমার কথা ফুরোল?’
বিমল বলল, ‘মোটেই নয়৷ এইখানেই যদি আমার কথা ফুরিয়ে যেত, তাহলে তোমায় নিয়ে যাবার জন্যে আমি আবার কলকাতায় ফিরে আসতাম না৷’
কুমার উৎসাহিতভাবে বলল, ‘বটে, বটে, তাই নাকি?’
বিমল বলল, ‘বিকেল বেলায় দূর গ্রাম থেকে রাইপুরে একটা লোক এল, ওই বেড়ালটাকে দেখবার জন্যে৷ এমনভাবে সে বেড়ালটাকে দেখতে লাগল যাতে করে আমার মনে সন্দেহ হল যে, এই লোকটার এ সম্বন্ধে কিছু জানা আছে৷ তাকে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করাতে বলল, সে হচ্ছে মাঝি, নৌকো চালানোই তার জীবিকা৷ আমি জানতে চাইলাম, এই বেড়ালটাকে সে আগে কখনো দেখেছে কি না? খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ও কিছু ইতস্তত করে সে বলল-বাবু, এই রাক্ষুসে বেড়ালটাকে আমি আগে কখনো দেখিনি বটে, কিন্তু বোধ হয় এর ডাক আমি শুনেছি!-তার কথা শুনে আমার কৌতূহল আরও বেড়ে উঠল৷ তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে সব কথা জানতে চাইলাম৷ সে যা বলল তা হচ্ছে এই :
‘দিন-পনেরো আগে একটি বুড়ো ভদ্রলোক আমার নৌকো ভাড়া করতে আসেন৷ সে-বাবুকে আমি আগে কখনো দেখিনি৷ তাঁর মুখেই শুনলাম, তিনি অন্য একখানা নৌকো করে এখানে এসেছেন, সেই নৌকোর মাঝির সঙ্গে ঝগড়া হওয়াতে সে তাঁকে আমাদের গ্রামে নামিয়ে দিয়েছিল৷
‘তিনি গঙ্গাসাগরের কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায় যেতে চান৷ যে তাঁকে নিয়ে যাবে তাকে তিনি রীতিমতো বকশিশ দিয়ে খুশি করবেন, এমন কথাও আমাকে জানালেন৷ সঙ্গে সঙ্গে একখানা দশ টাকার নোটও আগাম ভাড়া বলে আমার হাতে গুঁজে দিলেন৷ আগাম এতগুলো টাকা পেয়ে আমি তখনই তাঁকে নিয়ে যেতে রাজি হলাম৷ তাঁর সঙ্গে ছিল মস্ত বড়ো একটা সিন্দুক, এত বড়ো সিন্দুক আমি আর কখনো দেখিনি৷ আমরা সকলে মিলে ধরাধরি করে সেই সিন্দুকটাকে নৌকোর উপরে নিয়ে গিয়ে তুললাম৷ তোলবার সময় শুনতে পেলাম, সিন্দুকের ভিতর থেকে কী-একটা জানোয়ার বিকট গর্জন করছে৷
‘আমরা ভয় পাচ্ছি দেখে বাবুটি বললেন-তোমাদের কোনো ভয় নেই, ওর ভিতরে একটা খুব বড়োজাতের বনবেড়াল আছে৷-সে যে কোন জাতের বনবেড়াল তা বলতে পারি না, বনবেড়াল যতই বড়ো হোক তার চিৎকার এমন ভয়ানক হয়, আমি তা জানতাম না৷ আমি বললাম-বাবু, এ যদি সিন্দুক থেকে বেরিয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের কোনো বিপদ হবে না তো?-তিনি হেসে বললেন-না, সিন্দুকের ভিতরে ও বেড়ালটা শিকলে বাঁধা আছে৷
‘কিন্তু নৌকো নিয়ে আমাদের বেশিদূর যেতে হল না৷ সমুদ্রের কাছে গিয়ে আমরা হঠাৎ এক ঝড়ের মুখে পড়লাম৷ ঢেউয়ের ধাক্কা থেকে নৌকো বাঁচানোই দায়৷ দাঁড়িরা সব বেঁকে বসল, বলল-ওই ভারী সিন্দুকটা নৌকা থেকে নামিয়ে না দিলে কারুকেই আজ প্রাণে বাঁচতে হবে না৷
‘কিন্তু তাদের কথায় সেই বুড়ো ভদ্রলোকটি প্রথমটা কিছুতেই সায় দিতে চাইলেন না৷ শেষটা দাঁড়িরা যখন নিতান্ত রুখে উঠল, তখন তিনি নাচার হয়ে বললেন-তোমাদের যা-খুশি করো আমি আর কিছু জানি না৷
‘সকলে মিলে সেই বিষম ভারী সিন্দুকটা তখনই জলে ফেলে দেবার জোগাড় করল৷ কেবল আমি বাধা দিয়ে বললাম-ওর ভিতরে যে বনবেড়ালটা আছে, তার কী হবে?-দাঁড়িরা বলল-বনবেড়ালটাকে বাইরে বার করলে আমাদের কামড়ে দেবে, তার চেয়ে ওর জলে ডুবে মরাই ভালো!
‘ভদ্রলোকও ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন-না, না, ওকে বাইরে বার করতে হবে না, সিন্দুক সুদ্ধই ওকে জলে ফেলে দাও!
‘সিন্দুকটাকে আমরা তখন জলের ভিতর ফেলে দিলাম৷ তার একটু পরেই জলের ভিতর থেকে কী-একটা মস্ত জানোয়ার ভেসে উঠল৷ সেটা যে কী জানোয়ার, দূর থেকে আমরা ভালো করে বুঝতে পারলাম না-বোঝবার সময়ও ছিল না, কারণ আমরা সবাই তখন নৌকো নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছি৷
‘ঝড়ের মুখ থেকে অনেক কষ্টে নৌকোকে বাঁচিয়ে, সন্ধ্যার সময় আমরা সমুদ্রের মুখে মাতলা নদীর মোহানায় গিয়ে পড়লাম৷ দূরে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছিল, আঙুল দিয়ে সেইটে দেখিয়ে ভদ্রলোক বললেন-আমাকে তোমরা ওইখানে নামিয়ে দাও৷ আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম-এই অসময়ে ওই দ্বীপে নেমে আপনি কোথায় যাবেন?
‘ভদ্রলোক একটু বিরক্তভাবেই বললেন-সে-কথায় তোমাদের দরকার নেই, যা বলছি শোনো৷-আমরা আর কিছু না বলে নৌকো বেয়ে দ্বীপের কাছে গিয়ে পড়লাম৷ তখন বেশ অন্ধকার হয়েছে-দ্বীপের বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে আর নজর চলে না৷
‘এ দ্বীপে আমরা কখনো আসিনি, এখানে যে কোনো মানুষ থাকতে পারে তাও আমাদের বিশ্বাস হয় না৷ কিন্তু বুড়ো ভদ্রলোকটি অনায়াসেই নৌকো থেকে নেমে সেই অন্ধকারের ভিতরে কোথায় মিলিয়ে গেলেন৷
‘তখন ভাঁটা আরম্ভ হয়েছে৷ নৌকো নিয়ে আর ফেরবার চেষ্টা না করে সে রাতটা আমরা সেইখানেই থাকব বলে স্থির করলাম৷ নৌকো বাঁধবার চেষ্টা করছি, এমন সময় অন্ধকারের ভিতর থেকে সেই ভদ্রলোকের গলায় শুনলাম-তোমরা এখানে নৌকো বেঁধো না, শিগগির পালিয়ে যাও, নইলে বিপদে পড়বে!
‘আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম-এখানে থাকলে বিপদ হবে কেন বাবু?
‘ভদ্রলোক খুব কড়া গলায় বললেন-আমার কথা যদি না শোনো, তাহলে তোমরা কেউ আর প্রাণে বাঁচবে না!
‘তবুও আমি বললাম-বাবু, সারাদিন খাটুনির পর এই ভাঁটা ঠেলে আমরা নৌকো বেয়ে যাই কী করে? এখানে কীসের ভয়, বলুন না আপনি! বুনো জন্তুর, না ডাকাতের?
‘ভদ্রলোক বললেন-জন্তুও নয়, ডাকাতও নয়৷ এ-দ্বীপে যারা আছে তাদের দেখলেই ভয়ে তোমাদের প্রাণ বেরিয়ে যাবে! শিগগির সরে পড়ো!
‘আমি আর একবার জিজ্ঞাসা করলাম-তবে এমন ভয়ানক জায়গায় আপনি নামলেন কেন?
‘ভদ্রলোক হা-হা-হা-হা করে হেসেই চুপ করলেন, তারপর তাঁর আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না৷ আমাদেরও মনে কেমন একটা ভয় জেগে উঠল, সেখান থেকে তখনই নৌকো চালিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলাম৷
‘বাবু, আমার বিশ্বাস, আপনি এই যে রাক্ষুসে বেড়ালটাকে মেরেছেন, সেই সিন্দুকের ভিতর এইটেই ছিল৷’
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – নতুনত্ব কী
বিমলের গল্প শেষ হলে পর কুমার খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল৷ তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘সেই বুড়ো লোকটি যে কে, সে-কথা তুমি জানতে পেরেছ কি?’
‘তাই জানবার জন্যেই তো আমার এত আগ্রহ! তবে মাঝির মুখে শুনেছি, লোকটি নাকি বাঙালি, আর বুড়ো হলেও তিনি খুব লম্বা-চওড়া জোয়ান, আর তাঁর মেজাজ বড়ো কড়া৷’
‘কিন্তু বিমল, সে দ্বীপে এমন কী থাকতে পারে? বৃদ্ধ কি মিছিমিছি ভয় দেখিয়েছেন? দ্বীপে ভয়ের কিছু থাকলে তিনি একলা সেখানে নামবেন কেন!’
‘কুমার, তুমি আমায় যে প্রশ্নগুলি করলে, আমারও মনে ঠিক ওইসব প্রশ্নই জাগছে৷ ওইসব প্রশ্নের সদুত্তর পাবার জন্যেই আমরা সেই দ্বীপের দিকে যাত্রা করব৷’
‘কিন্তু আগে থাকতে তবু কিছু ভেবে দেখা দরকার তো৷ বৃদ্ধ বলেছেন, সে দ্বীপে যারা আছে তারা জন্তু নয়, ডাকাতও নয়৷ তবে তারা কে? মানুষ তাদের দেখলে ভয় পেতে পারে৷ তবে কি তারা ভূত? তাই বা বিশ্বাস করি কেমন করে? ভূতপ্রেত তো কবির কল্পনা, খোকা-খুকিদের ভয় দেখিয়ে শান্ত করবার উপায়৷’
‘না, কুমার ভূত-টুত আমিও মানি না, আর বৃদ্ধ যে ভূতের ভয় দেখিয়েছিলেন তাও আমার মনে হয় না৷’
‘তবে?’
‘কিছুই বুঝতে পারছি না৷ অবশ্য সেই দ্বীপে যদি এইরকম দানব-বেড়ালের আত্মীয়রা থাকে তাহলে সেটা বিশেষ ভয়ের কথা হবে বটে৷ কিন্তু বৃদ্ধ জন্তুর ভয় দেখাননি৷’
কুমার কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘দেখো, আমার বোধ হয় সেই বৃদ্ধ মিথ্যা কথাই বলেছেন৷ দ্বীপের ভিতর হয়তো কোনো অজানা রহস্য আছে৷ অন্য কেউ সে-কথা টের পায়, হয়তো বৃদ্ধ তা পছন্দ করেন না৷ হয়তো সেইজন্যেই তিনি দাঁড়ি মাঝিদের মিথ্যে ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন৷’
বিমল বলল, ‘কিন্তু সে-রহস্যটা কী? যে-দ্বীপে এমন দানব-বেড়াল পাওয়া যায় সে-দ্বীপ যে রহস্যময় তাতে আর সন্দেহ নেই৷ কিন্তু সেখানে এমন অসম্ভব বেড়ালের চেয়েও অসম্ভব আরও কোনো রহস্য আছে কি না সেইটেই আমি জানতে চাই৷’
কুমার বলল, ‘মঙ্গলগ্রহে, ময়নামতীর মায়াকাননে, আসাম আর আফ্রিকার বনেজঙ্গলে, সুন্দরবনে, অমাবস্যার রাতে আর হিমালয়ের দানবপুরীতে অনেক অসম্ভব রহস্যই আমরা দেখলাম৷ তার চেয়েও বেশি অসম্ভব কোনো রহস্য যে আর ত্রিজগতে থাকতে পারে এ-কথা আমার বিশ্বাস হয় না৷ প্রেতলোক যদি সম্ভবপর হত তাহলেও বরং নতুন-কিছু দেখবার সম্ভাবনা ছিল৷ কিন্তু প্রেত যখন মানি না তখন নতুন-কিছু দেখবার আশাও রাখি না৷’
বিমল মাথা নেড়ে বলল, ‘না কুমার, ত্রিজগতে নূতনত্বের অভাব কোনোদিনই হয়নি৷ ধরো ওই চন্দ্রলোক৷ ওর আগাগোড়াই তুষারে ঢাকা, ওকে তুষারের এক বিরাট মরুভূমি বললেও অত্যুক্তি হয় না৷ অথচ পণ্ডিতরা বলেন ওর ভিতরও নাকি জীবের অস্তিত্ব আছে৷ তাঁদের মতে সে-সব জীব মোটেই মানুষের মতো দেখতে নয়, তাদের দেখলে হয়তো আমরা নতুন কোনো জন্তু বলেই মনে করব, যদিও মস্তিষ্কের শক্তিতে হয়তো মানুষেরও চেয়ে তারা উন্নত৷ হয়তো তারা বাস করে তুষার মরুভূমির পাতালের তলায়, সেখানে গেলে আমাদেরও তারা নতুন কোনো জন্তু বলেই সন্দেহ করবে৷ তুমি কি বলতে চাও কুমার, সেখানে গেলে তুমি এক নতুন জগৎ দেখবার সুযোগ পাবে না?’
কুমার বলল, ‘কিন্তু আপাতত চন্দ্রলোকের কথা তো হচ্ছে না, আমরা থাকব এই পায়ে-চলা মাটির পৃথিবীতেই৷ সুন্দরবনের প্রান্তে, গঙ্গাসাগরের কাছে ছোট্ট এক দ্বীপ, কলকাতা থেকে সে আর কত দূরই বা হবে? সেখানে যে বিশেষ কোনো নূতনত্ব আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে আমি তা বিশ্বাস করি না৷’
বিমল মাটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, ‘দেখো কুমার, একসার পিঁপড়ে খাবার মুখে করে কোথায় যাচ্ছে৷’
কুমার বলল, ‘ওই যে, চৌকাঠের তলায় ওই গর্তের ভিতরে গিয়ে ওরা ঢুকছে৷’
‘হুঁ৷ এটা তোমার নিজের বাড়ি, এখানকার প্রতি ধূলিকণাটিকেও তুমি চেন৷ কিন্তু তোমারই ঘরের দরজার তলায় পিঁপড়েদের যে উপনিবেশ আছে, তার কথা তুমি কিছু বলতে পারো?’
‘তুচ্ছ প্রাণী পিঁপড়ে, তার সন্ধান আবার রাখব কী?’
‘তুচ্ছ প্রাণী পিঁপড়ে, কিন্তু এবার থেকে তাদেরও সন্ধান রাখবার চেষ্টা করো৷ মানুষের তুলনায় তাদের মস্তিষ্ক হয়তো ওজনে বেশি হবে না; কিন্তু সন্ধান রাখলে জানতে পারবে, মানুষের সমাজের চেয়ে পিঁপড়ের সমাজ অনেক বিষয়েই উন্নত৷ পৃথিবীতে কর্তব্যে অবহেলা করে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি৷ কিন্তু লক্ষ-লক্ষ পিঁপড়ের ভিতরে এমন একটি পিঁপড়েও তুমি পাবে না, নিজের কর্তব্যে যার মন নেই৷ যার যা করবার নিজের ইচ্ছাতেই সে অশ্রান্তভাবে করে যাচ্ছে৷ পিঁপড়েদের দেশে অবাধ্য ছেলেমেয়ে একটিও নেই৷ তাদের যে রানি সেও এক মুহূর্ত অলস হয়ে বসে থাকে না, অষ্টপ্রহরই ডিম প্রসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকে৷ একদল পিঁপড়ে সর্বদাই করছে রানির সেবা-যত্ন, একদল করছে একমনে ডিম আর বাচ্চাদের পরিচর্যা, আর একটা বৃহৎ দলের কাজ খালি বাইরে থেকে রসদ বহন করে আনা৷
‘এদের উপনিবেশের ভিতরটা পরীক্ষা করার সুযোগ পেলে অতি বড়ো বুদ্ধিমান মানুষও অবাক হয়ে যাবে৷ তার ভিতরে হাওয়া-চলাচলের ব্যবস্থা আছে, রসদখানা আছে, ডিম রাখবার আলাদা মহল আছে, এমনকী পিঁপড়েদের উপযোগী সবজিবাগান পর্যন্ত আছে৷ কুমার, তুমি বোধ হয় জানো না যে, পিঁপড়েরা গাভী পালন করে৷ অবশ্য সে গাভীকে দেখতে আমাদের গাভীর মতো নয়, কিন্তু তারা ‘দুগ্ধ’দান করবে বলেই তাদের পালন করা হয়৷’
কুমার সবিস্ময়ে বলল, ‘বলো কী বিমল, এ-সব কথা যে আমার কাছে একেবারে নতুন বলে মনে হচ্ছে!’
‘অথচ এই পিঁপড়েদের উপনিবেশ তোমার ঠিক পায়ের তলাতেই৷ পৃথিবীতে তুমি নতুনত্বের অভাব বোধ করছ, কিন্তু নিজের পায়ের তলায় কী আছে তার খবর তুমি রাখ না৷ কেবল তুমি নও, অধিকাংশ মানুষেরই স্বভাব হচ্ছে এইরকম৷ যাদের জানবার আগ্রহ আছে, জ্ঞানলাভের প্রবৃত্তি আছে, দেখবার মতো চোখ আছে, জীবনে তাদের কোনোদিনই নতুনত্বের অভাব হয় না৷’
কুমার অপ্রতিভভাবে বলল, ‘মাফ করো ভাই বিমল, আমারই ভ্রম হয়েছে৷ কিন্তু এখন আসল কথাই হোক৷ নতুনত্ব খুঁজে পাই আর না পাই, তোমার সঙ্গে থাকার চেয়ে আনন্দ আর কিছুই নেই৷ তাহলে কবে আমরা যাত্রা করব?’
বিমল বলল, ‘যে মাঝির কাছ থেকে সেই দ্বীপ আর সেই দ্বীপবাসীর খবর পেয়েছি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে সেই-ই৷ আমার যে মোটরবোট আছে, তাতেই চড়ে আমরা কলকাতা থেকে যাত্রা করব৷ রাইপুর থেকে মাঝি তার নৌকো নিয়ে আমাদের সঙ্গে যাবে৷ সে প্রথমটা কিছুতেই রাজি হয়নি, টাকার লোভ দেখিয়ে অনেক কষ্টে শেষটা তাকে আমি রাজি করাতে পেরেছি৷ মাঝি তার নৌকো আর লোকজন নিয়ে রাইপুরেই প্রস্তুত হয়ে আছে, তোমার যদি অসুবিধা না হয়, তাহলে কালকেই আমরা বেরিয়ে পড়তে পারি৷’
কুমার বলল, ‘আমার আবার অসুবিধে কী? কালকেই আমি যেতে পারি৷’
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – পুনরাবির্ভাব
মাঝির নাম ছিল কাসিম মিয়া৷ রাইপুরের ঘাটে মোটরবোট ভিড়িয়ে বিমল ও কুমার তার দেখা পেল৷
বিমলকে মোটরবোট ছেড়ে ডাঙায় নামতে দেখে সে-ও তাড়াতাড়ি জাল বোনা রেখে নিজের নৌকো থেকে নেমে এল৷
বিমল তাকে দেখে সুধোল, ‘কী মিয়াসায়েব, তোমরা সব তৈরি আছ তো?’
কাসিম সেলাম ঠুকে বলল, ‘হ্যাঁ হুজুর, আমরা সবাই তৈরি৷ আজকে বলেন, আজকে যেতে পারি৷’
‘তোমার সঙ্গে ক-জন লোক নিয়েছ?’
‘চারজন দাঁড়ি নিয়েছি হুজুর৷’
‘কিন্তু এ-যাত্রায় দাঁড় বোধ হয় তাদের কারুকেই টানতে হবে না৷ আমাদের বোটই তোমাদের পানসিকে টেনে নিয়ে যাবে৷ তোমরা খাবেদাবে আর মজা করে ঘুমোবে৷’
কাসিম একটুখানি হাসবার চেষ্টা করে বলল, ‘ঘুমোতে কি আর পারব হুজুর? আমার লোকেরা ভারি ভয় পেয়েছে!’
বিমল আশ্চর্য স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভয় পেয়েছে? কেন?’
কাসিম কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে বলল, ‘তাদের বিশ্বাস যেখানে আমরা যাচ্ছি সেখানে গেলে মানুষ আর ফিরে আসে না৷ অছিমুদ্দি মাঝির মুখে তারা শুনেছে, ও-দ্বীপে নাকি ভূত-প্রেত দৈত্য-দানোরা বাস করে৷ সেই দ্বীপের কাছে গিয়ে তিন-চারখানা নৌকো নাকি আর ফিরে আসেনি৷ নৌকোয় যারা ছিল তারা কোথায় গেল, তাও কেউ জানে না৷ জল-ঝড় নেই, অথচ মাঝে মাঝে ওখানে নাকি অনেকবার নৌকোডুবি হয়েছে৷ পেটের দায়ে নৌকো চালিয়ে যাই, আপনি ডবল ভাড়া আর তার উপরে বখশিশের লোভ দেখালেন বলেই আপনাকে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছি৷ কিন্তু আগে অছিমুদ্দির কথা শুনলে আমরা এ কাজে বোধ হয় হাত দিতাম না৷’
বিমল তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি এমন জোয়ানমদ্দ কাসিম মিয়া, তুমিই শেষটা ভয় পেয়ে গেলে নাকি?’
কাসিম বলল, ‘একেবারে ভয় পাইনি বললে মিথ্যে বলা হয় হুজুর! দ্বীপের সেই বুড়ো বাবুটিও তো আমাদের ভয় দেখাতে কসুর করেননি৷ কেন তিনি আমাদের সেখানে রাত কাটাতে মানা করলেন? কেন তিনি বললেন, সেখানে জন্তুর ভয় নয়, ডাকাতের ভয় নয়, অন্য কিছুর ভয় আছে? অন্য কীসের ভয় থাকতে পারে? আমরা ভেবেচিন্তে কোনোই হদিস খুঁজে পাচ্ছি না!’
বিমল বলল, ‘অত হদিস খোঁজবার দরকার কী মিয়াসাহেব? একটা কথাই খালি ভেবে দেখো না৷ সেই বুড়োবাবুটি তো মানুষ, সেখানে যদি অন্য কিছুর ভয় থাকত, তাহলে কি তিনি নিজে সেই দ্বীপে নামতে সাহস করতেন? অত বাজে ভাবনা ভেবো না, সেই দ্বীপে হয়তো এমন কিছু আছে, বুড়োবাবুটি যা অন্য লোককে জানতে দিতে রাজি নন৷ তাই তিনি তোমাদের মিথ্যে ভয় দেখিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছেন!’
কাসিম বলল, ‘সেখানে অন্য কিছু কী আর থাকতে পারে?’
‘ধরো হয়তো সেই দ্বীপে গুপ্তধন আছে, আর বুড়োবাবুটি কোনো রকমে তা জানতে পেরেছেন!’
গুপ্তধনের নামেই কাসিমের সারা মুখ সাগ্রহে কৌতূহলে প্রদীপ্ত হয়ে উঠল৷ কিন্তু তার পরেই সে আবার নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে বলল, ‘আপনি যা বলছেন তা অসম্ভব নয় বটে৷ কিন্তু রাক্ষুসে বেড়ালের মতো দেখতে সেই ভূতুড়ে জানোয়ারটার কথা আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন? সেই জানোয়ারটা কোত্থেকে এল? সেই দ্বীপ থেকেই তো?’
বিমল বলল, ‘জানোয়ারটা যে দ্বীপ থেকেই এসেছে এমন কথা জোর করে কিছুতেই বলা যায় না৷ তোমার নৌকোর সিন্দুকের ভিতরে যে সেই জানোয়ারটাই ছিল এটা তো তুমি আর স্বচক্ষে দেখোনি, আন্দাজ করছ মাত্র৷ তারপর ধরো, জানোয়ারটা না-হয় সেই সিন্দুকের ভিতরেই ছিল৷ কিন্তু বুড়োবাবুটি তাকে নিয়ে হয়তো সেই দ্বীপ থেকে আসছিলেন না, দ্বীপের দিকেই যাচ্ছিলেন! হয়তো তিনি অন্য কোনো জায়গা থেকে সেই জানোয়ারটাকে ধরে এনেছিলেন৷ এত বড়ো এই সুন্দরবন, এর ভিতরে কোথায় কত অজানা জানোয়ার আছে, তার খোঁজ কি তোমরা রাখো?’
কাসিম যেন অনেকটা আশ্বস্ত হল৷ সে বলল, ‘আর একটা নতুন খবর আছে হুজুর৷ সেই বুড়োবাবুটি আবার এখানে এসেছিলেন৷’
বিমল বিস্মিত স্বরে বলল, ‘তাই নাকি? তারপর?’
‘আপনি যেদিন মোহনপুর থেকে চলে যান, ঠিক তার পরের দিনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷ আমাকে দেখেই তিনি চিনতে পারলেন৷ তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসে বললেন-কাসিম, তোমাদের এ-অঞ্চলে নাকি কী-একটা আশ্চর্য জানোয়ার এসে উৎপাত করছে?-আমি বললুম-হ্যাঁ হুজুর, একটা জানোয়ার এসে এখানে উৎপাত করছিল বটে, কিন্তু কলকাতার এক বাবু এসে বন্দুক ছুড়ে তার লীলাখেলা সাঙ্গ করে দিয়েছেন৷ শুনেই রাগে তাঁর সারা মুখখানা রাঙা হয়ে উঠল, আর কোনো কথা না বলে হনহন করে তিনি একদিকে চলে গেলেন৷’
বিমল ব্যস্তভাবে বলল, ‘কাসিম, আমরা যে সেই দ্বীপে যাব সে-কথা তাঁকে তুমি বলোনি তো?’
কাসিম বলল, ‘আজ্ঞে না হুজুর, বলবার সময়ই পাইনি৷’
বিমল হাঁপ ছেড়ে বলল, ‘সেই বাবুটি এখনও এখানে আছেন নাকি?’
কাসিম বলল, ‘বোধ হয় নেই৷ কোথায় যে তিনি গেলেন, তার পর থেকে আমরা কেউ আর তাঁকে দেখতে পাইনি৷’
বিমল জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবুটি কেমন দেখতে বলো দেখি৷’
কাসিম বলল, ‘বলেছি তো খুব, লম্বা-চওড়া জোয়ান লোক৷ তাঁর বয়স ষাট বছরের কম হবে না, কিন্তু তাঁকে দেখলেই বোঝা যায় এখনও তাঁর গায়ে অসুরের মতো জোর আছে৷ তাঁর রং শ্যামলা, মাথায় লম্বা সাদা চুল আর মুখে লম্বা লম্বা সাদা দাড়ি৷ নাকে ধোঁয়া-রঙের চশমা, সেই চশমার ভিতর থেকে মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁর চোখদুটো যেন দপদপ করে জ্বলছে!’
বিমল খানিকক্ষণ চুপ করে রইল৷ তারপর বলল, ‘কাসিম, আমাদের মোটগুলো বোট থেকে নামিয়ে তোমাদের পানসিতে তুলে নাও৷ আজ বিকালেই আমরা নৌকো ছাড়ব৷’
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – জ্যোৎস্নাময় জঙ্গলে
পূর্ণিমা রাত৷ নির্মেঘ নীল আকাশে তারাদের সভা বসেছে আর তারই ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে ভরা জোছনার জোয়ার৷
পৃথিবীতেও দুই ধারে যেন পরির-হাতে-সাজানো নীল বনের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে কানায় কানায় ভরা নদীর জোয়ারের জল৷ সে-জলস্রোতকে মনে হচ্ছে রুপোলি জোছনার স্রোত৷
নির্জনতা যে কত সুন্দর, মায়াময় হতে পারে শহরে বসে কেউ তা অনুভব করতে পারে না৷
বনে বনে গাছের ডালে ডালে সবুজ পাতা-শিশুরা খেলা করছে আলো-ছায়ার ঝিলমিলি দুলিয়ে দুলিয়ে এবং নদীর বুকে বুকে ঢেউ-শিশুরা খেলা করছে হিরে-ধারার জাল বুনতে বুনতে৷
এক-একবার ঠান্ডা বাতাসের উচ্ছ্বাস ভেসে আসছে, আর সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ-শিশু আর পাতা-শিশুরা খুশির হাতে চারিদিকের নীরবতা অস্ফুট, অপূর্ব শব্দময় করে তুলছে৷
কিন্তু এই বনভূমির মৌনব্রত ভঙ্গ করেছে অনেক ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি৷ চাঁদের আলোর যে একটি নিজস্ব শান্ত সুর আছে, যা এই নির্জন বনভূমিকে মোহনীয় করে তুলেছে, ওইসব ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তার অনেকখানি সৌন্দর্যই নষ্ট করে দিচ্ছে৷
বিমলদের মোটরবোটের যন্ত্রের গর্জন এই নিরালায় কী কর্কশ শোনায়!
সেই গর্জন শুনে মাঝে মাঝে চরের উপর থেকে জীবন্ত ও ভয়াবহ গাছের গুঁড়ির মতো কী-কতকগুলো জলের উপর সশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে চারিদিক তোলপাড় করে তোলে৷
কাসিম বলে ওঠে, ‘হুজুর, কুমির!’
বিমল ও কুমার তা জানে৷ জলবাসী ওই করাল মৃত্যুর শব্দ তারা আরও অনেকবার শুনেছে৷
একজায়গায় চার-পাঁচটি হরিণ জলপান করছে৷ কাছেই অরণ্যের অন্তঃপুরে বাঘের ঘন ঘন হুংকার জেগে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ভীত মৃগদের জলপান করার শব্দ৷
অরণ্যের মধ্যে দিনে যারা ঘুমোয়, সদলবলে জেগে উঠেছে তারা আজ রাত্রে৷ লক্ষ লক্ষ কীটপতঙ্গ৷ জ্যোৎস্নার মুখে কালো অভিশাপের মতো দলে দলে বাদুড় ও কালো পেচক৷ কোথাও গাছের ভিতর থেকে ভীরু পাখির দল আর্তনাদ করে উঠল, হয়তো তাদের বাসার ভিতরে এসেছে বিপজ্জনক কোনো অতিথি৷
থেকে থেকে অদ্ভুত ভূতুড়ে স্বরে ডেকে উঠছে তক্ষকের দল৷ কোনো গাছের টং থেকে যেন একদল অশরীরী ও অমানুষ নরশিশু ককিয়ে কেঁদে উঠল, তারা হচ্ছে বকের ছানা৷ মাঝে-মাঝে অস্বাভাবিক স্বরে ব্যাং চিৎকার করে উঠছে-এ আর কিছু নয়, সর্পের কবলগত হয়ে হতভাগ্যের প্রবল অথচ ব্যর্থ প্রতিবাদ৷
এই চন্দ্রকিরণের রাজ্য দিয়ে, এই বনস্পতিদের তপোবন দিয়ে, এই ধ্বনি-প্রতিধ্বনির জগৎ দিয়ে, জলের বুকে ফেনার আলপনা কাটতে কাটতে তীব্র গতির বেগে উন্মত্ত হয়ে ছুটে চলেছে বিমলদের মোটরবোট৷
চারিদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে, চারিদিকের শব্দ শুনতে শুনতে বিমল হঠাৎ বলে উঠল, ‘শোনো কুমার, কান পেতে শোনো! মহাকাল এই নির্জন অরণ্যে একলা বসে জীবনসংগ্রামের অনন্ত ইতিহাস নিজের মনেই উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করে যাচ্ছেন! কবিরা বনে এসে বিজনতা আর নীরবতার সন্ধান পান৷ কিন্তু এই মিষ্ট চাঁদের আলোয়, এই অরণ্যের অন্তঃপুরে এসে, তুমি কি মৃত্যুর নিষ্ঠুর রথচক্রের ধ্বনি নিজের কানে শুনতে পাচ্ছ না? এ-বন নির্জন বটে, কিন্তু এখানকার অন্ধকারের অন্তরালে বসে কত কোটি কোটি কীটপতঙ্গ আর জীবজন্তু জীবনযুদ্ধের চিরন্তন নিষ্ঠুরতায় অশ্রান্ত আর্তনাদ করছে-কত দুর্বল কত সবলের কবলে পড়ে অত্যাচারিত হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে কত সহস্র জীবের প্রাণ নষ্ট হচ্ছে! আমরা মানুষ, আমরা হচ্ছি নগরবাসী সামাজিক জীব, প্রতি পদে আমাদেরও আত্মরক্ষা করতে হয় বটে,-কিন্তু সে হচ্ছে অন্য নানান কারণে৷ জীবনের ভয় যে সেখানে নেই এমন কথা বলি না, কিন্তু এখানকার তুলনায় সেখানকার নীতি হচ্ছে স্বর্গীয় নীতি! সেখানেও বিপদ আছে বটে, কিন্তু সে বিপদের পূর্বাভাস পেয়ে আমরা প্রায়ই সাবধান হতে পারি৷ আর এখানকার নীতি কী? এখানকার একমাত্র নীতি হচ্ছে-হয় মরো, নয় মারো! জীবন আর মৃত্যু নিয়ে এখানে চিরদিনের নির্দয় খেলা চলছে৷ যে অপরকে মারতে পারবে না, এখানে তাকে অপরের হাতে মরতেই হবে৷ এ অরণ্য হচ্ছে এক মহাযুদ্ধের ক্ষেত্র-যে-যুদ্ধে কোনোদিন সন্ধি নেই, শান্তি নেই৷ চারিদিকে ওই যে ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি জেগে রয়েছে, ওর ভিতর থেকে আমি খালি এক কঠিন বাণীই শুনতে পাচ্ছি-হয় মরো, নয় মারো! এখানকার আকাশের নীলিমার মধুরিমা, চাঁদের আলোর ঝরনা, সবুজ পাতার গান আর নদীর কলতান যার মনে স্বপ্ন আর কবিত্ব সঞ্চার করবে সে নিরাপদ থাকতে পারবে না এক মুহূর্তও! বুঝেছ কুমার, এখানে এসে আমাদের সজাগ হয়ে সর্বদা এই মন্ত্রই জপ করতে হবে-হয় মরো, নয় মারো৷ কবিরা বনের নিষ্ঠুর ধর্ম ভালো করে জানেন না, কবিতার অরণ্যে তাই আমরা কেবল মাধুর্যকেই দেখতে পাই৷’
কুমার হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার বন্দুক তৈরি আছে বন্ধু! বলো, কাকে মারতে হবে? ওই চন্দ্রকিরণ, না কাসিম মিয়াকে?’
বিমল একটা হাই তুলে মুখের কাছে তুড়ি দিতে দিতে বলল, ‘তুমি তৈরি আছ শুনে সুখী হলাম৷ থাক, আজকের মতো চাঁদের আলো আর কাসিম মিয়াকে অব্যাহতি দাও; এসো, এখন বিছানা পেতে ফেলে হাত-পা ছড়ানো যাক৷’
পরদিন সকালে বোটের কামরায় বসে স্পিরিট ল্যাম্প জ্বেলে বিমল চা-পানের আয়োজন করছিল৷
কুমার বাইরে বসে দুই ধারের দৃশ্য দেখছিল৷
দৃশ্যের কিছুই পরিবর্তন হয়নি, কেবল চাঁদের আলোর বদলে সূর্য এসে এখন দিকে দিকে কাঁচা সোনার জল ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ নদীর দুই তীরে সবুজ বন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার ভিতর থেকে রাত্রের সেই ভয়ানক ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আর শোনা যাচ্ছে না৷ বোট একদিকের তীর ঘেঁসে যাচ্ছিল, কিন্তু অধিকাংশ স্থানেই বনের ভিতরে গাছপালারা এমন নিবিড়ভাবে পরস্পরের সঙ্গে গা মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাইরে থেকে ভিতরের কিছুই নজরে আসে না৷ মাঝে মাঝে যেখানে একটু ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানটা দেখাচ্ছে ঠিক জলাভূমির মতো৷ সেখান দিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে গেলে এক-কোমর কর্দমাক্ত জল ভেঙে অগ্রসর হতে হয়৷ সেই কর্দমাক্ত জলের উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে নলখাগড়ার দল৷ দূরে দূরে বনের শিয়রে শিয়রে দেখা যাচ্ছে কুয়াশার মতো বাষ্পের মেঘ৷
এক জায়গায় দেখা গেল কুৎসিত দেহের আধখানা ডাঙার উপরে তুলে প্রকাণ্ড একটা কুমির স্থিরভাবে রোদ পোয়াচ্ছে৷ এত বড়ো কুমির কুমার আর কোনোদিন দেখেনি৷ তার বন্দুকটা পাশেই ছিল, সে আস্তে আস্তে সেটা তুলে নিয়ে কুমিরের দিকে নিজের লক্ষ্য স্থির করল৷
বিমল তখন দুটো চায়ের পেয়ালা হাতে করে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে, কুমারের অবস্থা দেখে সে-ও কুমিরের দিকে দৃষ্টি ফেরাল৷ তারপর তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘থামো কুমার, বন্দুক ছুড়ো না!’
কুমার একটু আশ্চর্য হয়ে বন্দুক নামিয়ে বলল, ‘কেন?’
বিমল বলল, ‘কুমিরের ঠিক উপরে গাছের ডালের দিকে তাকিয়ে দেখো৷ এখন রাত নেই, কিন্তু জীবনযুদ্ধের জের এখনও চলেছে৷’
কুমার সেইদিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে দেখল, একটা প্রকাণ্ড গাছের ডাল জড়িয়ে একটা মস্ত অজগর সাপ স্থিরভাবে কুমিরকে লক্ষ করছে৷ হঠাৎ তার মাথাটা ডাল থেকে একটুখানি নীচে নেমে পড়ল, তারপর দু-একবার এদিকে-ওদিকে দুলতে লাগল-এবং তার পরেই ঠিক বিদ্যুতের ঝড়ের মতো তার দেহটা একেবারে কুমিরের ঘাড়ের উপরে এসে পড়ল৷ তারপর সমস্ত জল তোলপাড় করে যে দৃশ্য শুরু হল ভাষায় তা বর্ণনা করা যায় না! কুমির চায় তার বলিষ্ঠ লাঙুলের প্রচণ্ড ঝাপটা মেরে অজগরকে কাবু করে জলে ডুব দিতে আর অজগর চায় পাকে পাকে কুমিরকে ক্রমেই বেশি করে জড়িয়ে ডাঙার উপরে টেনে তুলতে৷
এই বন্য নাটকের শেষ দৃশ্য দেখবার আগেই বোটখানা নদীর একটা মোড় ফিরে আড়ালে গিয়ে পড়ল৷
কুমার বলল, ‘কুমিরটাকে আমি মারতে পারতাম, অজগরটাকেও পারতাম৷ কিন্তু বিমল, প্রকৃতির অভিশাপ যাদের উপরে এসে পড়েছে, তাদের কারুকে মারতে আমার হাত উঠল না৷ ওরা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা পূরণ করুক৷’
বিমল বলল, ‘এখন বন্দুক রেখে চা খাও৷ তারপর এসো, কাসিম মিয়ার সঙ্গে একটু কথা কওয়া যাক৷ ওরা আজ সকাল থেকে মাছ ধরতে বসেছে দেখছি৷’
পানসি থেকে বিমলের কথা শুনতে পেয়ে কাসিম বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হুজুর, হাতে কোনো কাজ নেই, কী আর করি বলুন!’
বিমল বলল, ‘মাছ-টাছ কিছু ধরতে পেরেছ নাকি কাসিম?’
‘ধরেছি হুজুর৷ দুটো মাছ ধরেছি৷’
‘বেশ, বেশ, আমাদের দু-একটা উপহার দিয়ো৷ . . . কিন্তু বলতে পারো কাসিম, সে-দ্বীপে গিয়ে পৌঁছোতে আমাদের আরও কত দেরি লাগবে?’
কাসিম বলল, ‘আমাদের পানসিতে দাঁড় টেনে গেলে সেখানে পৌঁছোতে হয়তো আরও দু-দিন লাগত৷ কিন্তু আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওই বিলিতি বোট, বোধ হয় আজ রাতেই আমরা সেখানে পৌঁছে যাব৷’
দুপুর গেল, বিকাল গেল, সন্ধ্যার পর আবার রাত এল৷ আকাশ থেকে আবার প্রতিপদের চাঁদের সাজি চারিদিকে আলোর ফুল ছড়াতে লাগল, অরণ্যের মর্মরধ্বনি ও নদীর জল-কল্লোল আবার স্পষ্টতর হয়ে উঠল, বনভূমির ভিতর থেকে আবার স্ফুট ও অস্ফুট বিচিত্র সব ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শোনা যেতে লাগল-চারিদিকে আবার অন্ধকারের আবছায়ায় নানা বিভীষিকার সাড়া পাওয়া গেল৷
নদী ক্রমেই চওড়া হয়ে উঠছে, দুই তীরের বনরেখা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে৷
কাসিম বলল, ‘হুজুর, আমরা সমুদ্দুরের কাছেই এসে পড়েছি৷’
আরও ঘণ্টাখানেক পরে নদীর দুই তীর এত দূরে সরে গেল যে, বনের ভিতরকার শব্দ আর বড়ো কানে আসে না৷ সেখানে শোনা যায় চারিদিক-আচ্ছন্ন-করা কেবল নদীর অশ্রান্ত কোলাহল৷ এ যেন নদী-কল্লোলের পৃথিবী!
সেই কোলাহলের ভিতরে দূর থেকে আর-একটা শব্দ বিমল ও কুমারের কানে ভেসে এল৷
সে শব্দ কাসিমও শুনেছিল৷ সে উদবিগ্ন স্বরে বলে উঠল, ‘হুজুর, ও আবার কীসের আওয়াজ?’
বিমলও কান পেতে শুনতে লাগল৷ শব্দটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে,-তার মানে, শব্দটা ক্রমেই তাদের কাছে এগিয়ে আসছে৷
বিমল গম্ভীর স্বরে বলল, ‘কাসিম, আমাদের মতো আর একখানা মোটরবোট এই দিকে আসছে৷ ও তারই শব্দ৷’
কুমার বলল, ‘ওটা যে মোটরবোটের শব্দ তাতে আর কোনোই সন্দেহ নেই৷ কিন্তু কথা হচ্ছে, এমন অসময়ে এখানে কার ও মোটরবোট? হ্যাঁ, কাসিম, এখান দিয়ে প্রায়ই কি এইরকম নৌকো আর মোটরবোট আনাগোনা করে?’
কাসিম বলল, ‘না হুজুর, এখান দিয়ে নৌকো আনাগোনা করে না৷ সেই বুড়োবাবুটি পথ দেখিয়ে নিয়ে না এলে আমরা কোনোদিনই এদিকে আসতাম না৷’
বিমল বলল, ‘কাসিম, তাহলে ওই মোটরবোটে চড়ে আসছেন তোমাদের সেই বুড়োবাবুটি৷’
কাসিম বলল, ‘হতে পারে হুজুর, আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম, সেই বুড়োবাবুটি আবার রাইপুরে গিয়েছেন৷ হয়তো তিনিই ফিরে আসছেন৷’
বিমল বলল, ‘তোমাদের সেই বুড়োবাবু রোজ এদিকে ফিরে আসুন, আমাদের তাতে কোনোই আপত্তি নেই৷ কিন্তু আজ তিনি আমাদের যাতে এইখানে দেখতে না পান, এখনই এমন কোনো ব্যবস্থা করতে হবে৷’
কুমার বলল, ‘কিন্তু এই খোলা নদীতে লুকোতে গেলে নৌকোসুদ্ধ পাতালে প্রবেশ ছাড়া আমাদের তো আর কোনো উপায় নেই৷’
বিমল বলল, ‘উপায় বোধ হয় আছে কুমার! মাইল খানেক তফাতে ছোটো একটা চরের মতো কী যেন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না?’-মোটরবোট যে চালাচ্ছিল তার দিকে ফিরে সে বলল, ‘ওহে জোরে চালাও, খুব জোরে!’
বোটের গতি তখন দ্বিগুণ বেড়ে উঠল এবং মিনিটদুয়েক পরেই তারা একটা চরের কাছে এসে পড়ল৷
গঙ্গাসাগরের কাছে সুন্দরবনের অসংখ্য নদীর ভিতরে এইরকম সব ছোটো-ছোটো চর দেখা যায়৷ বছরের অন্যান্য সময়ে এই চরগুলো জলের উপরে জেগে থাকে, তার বুকে ঝোপঝাপ ও জঙ্গলের আবির্ভাব হয় এবং দূর থেকে তাদের দেখায় একটা ক্ষুদ্র দ্বীপের মতো৷ কিন্তু বর্ষার সময়ে নদীর জল যখন বেড়ে ওঠে তখন এইসব চরের কোনো চিহ্নই আর খুঁজে পাওয়া যায় না৷
তাদের বোট এইরকম একটা চরের কাছেই এসে পড়েছিল৷ এখানেও ঝোপঝাপ ও বনজঙ্গলের কোনোই অভাব ছিল না৷
বিমল বলল, ‘আরও এগিয়ে মোড় ফিরে বোটখানাকে চরের ওপাশে নিয়ে চলো৷ ঝোপের আড়ালে গিয়ে পড়লে কেউ আমাদের দেখতে পাবে না৷’
বোটের চালক বিমলের কথামতোই কাজ করল৷
বিমলদের বোট দ্বিগুণ বেগে এগিয়ে এসেছিল বলে পিছনের বোটের ইঞ্জিনের আওয়াজ তখন আর শোনা যাচ্ছিল না৷ কিন্তু খানিক পরেই সেই শব্দটা ধীরে ধীরে আবার জেগে উঠল৷
কুমার বলল, ‘বিমল, আমরা যখন ও-বোটের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, তখন ওরাও যে আমাদের শব্দ শুনতে পায়নি এমন কথা বলা যায় না৷’
বিমল চিন্তিতভাবে বলল, ‘তা যদি পেয়ে থাকে তাহলে ভাবনার কথা৷’
কুমার বলল, ‘ভাবনা কীসের?’
‘তুমি তো শুনেছ কুমার, দ্বীপের ওই ভদ্রলোক চান না যে আর কেউ তাঁর ওখানে গিয়ে ওঠে৷ আমরা এসেছি শুনলে তিনি খুশি হবেন বলে মনে হচ্ছে না৷’
পিছনের মোটরবোটের শব্দ তখন খুব কাছেই এসে পড়েছে৷ কিন্তু চরের কাছে এসেই শব্দটা থেমে গেল৷
বিমল মৃদু স্বরে বলল, ‘কুমার, তোমার সন্দেহই সত্য৷ ওরা আমাদের বোটের শব্দ নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছে৷ তাই ওরা বোট থামিয়ে লক্ষ করছে আমরা কোথায় মিলিয়ে গেলাম৷’
কুমার বলল, ‘ওরা যদি এদিকে আমাদের খুঁজতে আসে?’
‘খুঁজতে যদি আসে তাহলে উপায় কী? তাদের সঙ্গে আমাদের আলাপ করতেই হবে৷’
‘তুমি কি কোনোরকম বিপদের ভয় করছ বিমল?’
‘বিপদ? বিপদের ভয় আছে কি না ঠিক বলতে পারি না, তবে এখানে আমাদের দেখতে পেলে ওই বোটের লোকেরা হয়তো নতুন জামাই বলে ভ্রম করবে না৷ কুমার, সকলের চোখের আড়ালে যারা লুকিয়ে এমন জায়গায় বাস করে, তারা খুব ভালোমানুষ বলে মনে হয় না৷’
কুমার আর কিছু না বলে তাড়াতাড়ি নিজের বন্দুকটা টেনে নিল৷
বিমল বলল, ‘আমারও বন্দুকটা এগিয়ে দাও,-সাবধানের মার নেই৷’
কাসিম ভীত স্বরে বলল, ‘হুজুর, আমরা কী করব?’
বিমল বলল, ‘তোমরা আপাতত চুপ করে নৌকোর ভিতরে বসে থাকো৷ দরকার হলে আমি তোমাদের ডাকব৷’
সেই অজানা মোটরবোটের শব্দ আবার জেগে উঠল৷
কুমার বন্দুকটা পরীক্ষা করতে করতে চুপিচুপি বলল, ‘বিমল, বোধ হয় ওরা এইদিকেই খুঁজতে আসছে৷’
বিমল বলল, ‘খুব সম্ভব তাই-‘
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – অমানুষিক কন্ঠস্বর
বিমল ও কুমার উৎকর্ণ হয়ে মোটরবোটের গর্জন শুনতে লাগল৷
কিন্তু খানিক পরেই তারা বুঝতে পারল, গর্জনটা ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে আসছে৷
ক্রমে শব্দ এতটা ক্ষীণ হয়ে এল যে, আর কোনোই সন্দেহ রইল না৷
কুমার সানন্দে বলে উঠল, ‘যাক, বাঁচা গেল! ও-বোটখানা এদিকে আসছে না, অন্যদিকে চলে যাচ্ছে!’
বিমল বলল, ‘কিন্তু ওদের মনে সন্দেহ হয়েছিল বলেই যে বোটখানা হঠাৎ এখানে থেমেছিল, সেটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে৷ এখন আমাদের উচিত হচ্ছে, ও-বোটখানাকে আরও খানিক এগিয়ে যেতে দেওয়া৷ ততক্ষণে এইখানে বসে বসে রেঁধে-বেড়ে খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়া যাক৷ ইকমিক কুকারে খিচুড়ি চড়িয়ে দাও কুমার৷ কাসিম মিয়া, আমাদের চুবড়ি থেকে একটা মুরগি বার করে স্বর্গে পাঠাব, না তোমরা দু-একটা মাছ উপহার দিতে পারবে?’
সন্ধ্যার মায়া-আলো মিলিয়ে গেল, আকাশ থেকে নেমে এল অন্ধকারের যবনিকা৷ বিমলদের মোটরবোট চলছে-চারিদিকে চল-চল-ছল-ছল জলের কান্না৷
প্রতিপদের চাঁদ উঠল৷ কিন্তু আজকে আর বন্যজীবনের কোনো ধ্বনি-প্রতিধ্বনি নেই- এমনকী কোনোদিকে বনজঙ্গলের কোনো চিহ্নই নেই,-উপরে আছে খালি আকাশের অনন্ত চন্দ্রাতপ এবং ডাইনে আর বাঁয়ে, সুমুখে আর পিছনে আছে শুধু সেই চল-চল-ছল-ছল জলের কান্না৷
চতুর্দিকে সেই অসীমতার অপূর্ব আভাস দেখে কুমার বলল : ‘প্রলয়পয়োধিজলে নারায়ণ যেদিন বটপত্রে ভেসে গিয়েছিলেন, সেদিন তাঁরও অবস্থা হয়েছিল বোধ করি আমাদের মতো! এই অকূল জলের জগতে আমাদের বোটখানাকে বটপত্রের চেয়ে বড়ো বলে মনে হচ্ছে না৷’
বিমল তখন কুমারের কথা মন দিয়ে শুনছিল না, সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে কী যেন লক্ষ করছিল৷
নৌকোর পিছনের হালের কাছে দাঁড়িয়ে কাসিমও সেই দিকে তাকিয়ে ছিল৷ হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘ওই সে দ্বীপ, হুজুর!’
বিমল বলল, ‘তুমি ঠিক চিনতে পেরেছ তো কাসিম? কোনো ভুল হয়নি?’
‘না হুজুর, ভুল হতে পারে না৷ এখানে আর কোনো দ্বীপ নেই৷’
বোট এগিয়ে চলল-দ্বীপ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল৷
এখানটা সমুদ্র ছাড়া আর কিছু বলা যায় না৷
কুমার বলল, ‘এখানে যদি নৌকো ডোবে, বাঁচবার কোনো উপায়ই নেই!’
বিমল বলল, ‘বাঁচবার একমাত্র উপায় ওই দ্বীপ৷ কিন্তু ওখানেও আছেন সেই দ্বীপবাসী বৃদ্ধ-যিনি অতিথি পছন্দ করেন না৷’
কুমার বলল, ‘কে জানে ওই দ্বীপের কী রহস্য!’
কাসিম বলল, ‘হুজুর, আপনারা কি আজকেই ওখানে গিয়ে নামবেন?’
বিমল বলল, ‘এই রাত্রে? নিশ্চয়ই নয়! আমরা ডাঙার কাছে একটা ঝুপসি জায়গা পেলেই নোঙর করব৷ ডাঙায় নামব কাল সকালে৷ ড্রাইভার, তুমি মোটরের ইঞ্জিন থামাও, নইলে ও-শব্দ দ্বীপে গিয়ে পৌঁছোবে৷ কাসিম, এখন বেশ জোয়ারের টান আছে এইবারে তোমার নৌকো আমাদের বোটকে দ্বীপের কাছে টেনে নিয়ে যেতে পারবে?’
কাসিম বলল, ‘পারবে৷’
তখন সেই ব্যবস্থাই হল৷
বিমল বলল, ‘সবাই আস্তে আস্তে দাঁড় ফেলো৷ সাবধানের মার নেই৷’
দ্বীপ কাছে এসে পড়ল৷ তার বনজঙ্গলে জ্যোৎস্নার ঝালর ঝিকমিক করছে এবং তার সর্বত্র বিরাজ করছে নিস্তব্ধ এক থমথমে বিজনতা৷
কুমার বলল, ‘বুড়ো এখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপন দেখছে৷’
বিমল বলল, ‘স্বপন দেখতে দেখতে সে জেগে উঠতেও পারে!’
দ্বীপের ভিতর থেকে জীবনের টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত কানে এল না৷ এখানে যে মানুষ আছে, গাছ-পাতার ফাঁক দিয়ে কোনো কম্পমান আলোক-শিখাও তার ইঙ্গিত দিল না৷ এখানে যে প্রবল ও দুর্বল পশু আছে, পূর্ব পরিচিত বন্য নাট্যাভিনয়ের কোনো হুংকার বা আর্তনাদও তার প্রমাণ দিল না৷ বিমল ও কুমারের মনে হল গঙ্গাসাগরের লবণাক্ত অশ্রুজলের উপরে অজানা বিভীষিকার ছায়া নাচিয়ে এই রহস্যময় দ্বীপ যেন পৃথিবীর ভিতরে থেকেও পৃথিবীর ভিতরে নেই৷
বিমল চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করল, ‘কাসিম, বুড়োবাবুকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছিলে সেখানটা তুমি চিনতে পারবে?’
কাসিম মাথা নেড়ে বলল, ‘না হুজুর৷ তিনি বোধ হয় কোনো আঘাটায় নেমেছিলেন৷ এখানে কোনো ঘাট আছে কি না আমরা জানি না৷’
বিমল বলল, ‘তাহলে কাল সকালে আমাদেরও আঘাটাতেই নামতে হবে৷ আপাতত এক কাজ করো৷ ওই যেখানে অনেকগুলো বড়ো বড়ো গাছ প্রায় জলের উপরে হেলে পড়ে চারিদিক অন্ধকার করে তুলেছে, ওইখানে গিয়েই নৌকো বাঁধো৷ এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের দেখতে পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে না; এরপর একবার ওই অন্ধকারের ভিতরে গিয়ে ঢুকতে পারলেই আমরা আজকের রাতের মতো নিশ্চিন্ত হতে পারব৷’
কাসিম বলল, ‘কিন্তু ও অন্ধকার তো ভালো নয় হুজুর! মাথার উপরে গাছপালা-সেখানে অজগর থাকতে পারে৷ পাশেই ডাঙা-সেখানে বাঘ থাকতে পারে৷ যদি তাদের কেউ নৌকোয় এসে ওঠে?’
‘আমরা কামরার সব জানলা-দরজা বন্ধ করে ভিতরে শুয়ে থাকব৷ এখন তো রাতদুপুর, বাকি রাতটুকু কোনো রকমে কাটিয়ে দিতে পারব বোধ হয়৷’
নৌকা ও মোটরবোট ধীরে ধীরে অন্ধকারের ভিতরে ঢুকল৷ সেইখান থেকে তারা দেখতে পেল, আশেপাশের কষ্টিপাথরের মতো কালো ও নিরেট ছায়ার সীমানা ছাড়িয়েই শুরু হয়েছে মুক্ত আকাশ থেকে নেমে-আসা চাঁদের আলো-লহর-রুপোর জলতরঙ্গে নেচে নেচে উঠছে আলো-চিকণ ফেনার মালা৷ সেই রূপময় তরল ও চঞ্চল অসীমতা নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে যে সুন্দর সংগীত গাইতে গাইতে, ভাবুকের মন নিয়ে তা শুনলে শান্তি ও আনন্দে প্রাণ পরিপূর্ণ হয়ে যায়৷
সবাই কামরার ভিতরে ঢুকে দরজা-জানলা বন্ধ করে দিল৷
বিছানা পেতে বিমল ও কুমার শুয়ে পড়ল৷
এ-কথা সে-কথা কইতে কইতে তাদের দু-জনেরই চোখের পাতা তন্দ্রার আমেজে যখন ভারী হয়ে এসেছে, তখন বাইরের জলকল্লোলের মাঝখানে আচম্বিতে কী একটা বেসুরো শব্দ জেগে উঠল৷
প্রথমে উঠল গাছের পাতার মর্মর শব্দ,-যেন তিন-চারটে বড়ো বড়ো জীব ডাল-পাতার ভিতরে লাফাতে লাফাতে নৌকোর কাছে এগিয়ে আসছে৷
বিমল ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, ‘অজগর নাকি?’
তারপর শোনা গেল-‘কিচির-মিচির কিচির-মিচির কিচির-মিচির!’
কুমার আবার পাশ ফিরে শুয়ে চোখ মুছে বললে, ‘বাঁদর৷’
বিমলও আবার শুয়ে পড়বার চেষ্টা করছে, এমন সময়ে শোনা গেল- ‘কিচির-মিচির কিচির-মিচির কিচমিচ-
কচমচে কাঁচা মাথা
কুচি-কুচি কচু-কাটা
কিছু যদি বোঝো দাদা,
ফিরে যাও ক্যালকাটা৷
হা হা হা হা হা হা হা হা হা!’ -সে কী হাসি, যেন থামতেই চায় না!
বিমল একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ‘ওঠো, কুমার! বন্দুক নাও! আমি দরজা খুলে টর্চ জ্বেলে চারিদিক দেখি, তুমি বন্দুক বাগিয়ে তৈরি হয়ে পাশে থাকো৷ বিপদ দেখলেই বন্দুক ছুড়বে৷’
দরজা খুলে টর্চের উজ্জ্বল আলোকে কেবল দেখা গেল, বোটের ঠিক ওপারেই মস্ত বটগাছের দুটো-তিনটে ডাল খুব জোরে নড়ছে, যেন এইমাত্র কেউ সেখান থেকে লাফ মেরে ঘন পাতার আড়ালে সরে গিয়েছে৷
কুমার বলল, ‘প্রথমে বাঁদরের কিচির-মিচির, তারপরই মানুষের গান আর হাসি!’
বিমল বলল, ‘বাঁদরের কিচির-মিচির ঠিকই শুনেছি বটে৷ কিন্তু যে গান আর যে হাসি শুনলাম, ও কি মানুষের? অমন অস্বাভাবিক আওয়াজ কোনো মানুষের গলায় কেউ কি কখনো শুনেছে?’
কুমার আর একবার চারিদিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু কোনো গাছে বাঁদরও নেই৷ তবে কি আমরা কোনো অশরীরীর সাড়া পেলাম?’
বিমল হতভম্বের মতো বললে, ‘এতদিন পরে শেষটা কি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করতে হবে?’
খানিক তফাত থেকে আবার আর-একরকম আওয়াজ জেগে উঠল-
‘ঘট-ঘট ঘ্যাট-ঘ্যাট!
ঘট-ঘট ঘ্যাট-ঘ্যাট!’
কুমার চমকে বলে উঠল, ‘ও আবার কী?’
বিমল বলল, ‘ওই শোনো!’
‘ঘট-ঘট ঘ্যাট-ঘ্যাট
ঘট-ঘট ঘ্যাট-ঘ্যাট-
ঘুটঘুটে আন্ধি,
একলাটি কান্দি,
রেখে গেছে বান্ধি
সমুদ্রে!
মোটরের পাণ্ডা!
জল খুব ঠান্ডা
মোরগের আন্ডা
দে ক্ষুদ্রে!
দাও যদি ঝম্প-
মোর মুখে লম্ফো
নিবে যাবে লম্ফ
চক্ষের!
কেন শ্রম-যত্ন?
মোরা দুঃস্বপ্ন,
হেথা নেই রত্ন
যক্ষের!’
বিমল তাড়াতাড়ি জলের উপরে টর্চের আলো নিক্ষেপ করল- কিন্তু বৃথা৷ কোথাও জনপ্রাণী নেই, কেবল এক জায়গায় জল অত্যন্ত তোলপাড় করছে-যেন কেউ সেখানে সবে ডুব দিয়েছে৷
বিমল বোকার মতন কুমারের মুখের পানে তাকাল৷ কিন্তু কুমার বলে উঠল, ‘বুঝেছি, বুঝেছি! এ-সব হচ্ছে ওই দ্বীপের বুড়োর চালাকি! নিশ্চয়ই সে ভেনট্রিলোকুজম জানে! লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে!’
বিমল বলল, ‘অসম্ভব নয়৷ কিন্তু গাছের ডাল কেন হঠাৎ দোল খায়, জল কেন হঠাৎ তোলপাড় করে?’
কুমার জুতসই কোনো জবাব না দিতে পেরে বলল, ‘বুড়ো হয়তো ম্যাজিকের নানান কল-কৌশল জানে৷’
বিমল বলল, ‘ও-সব বাজে কথা ভাববার সময় এখন নয়৷ উপরে গাছে, নীচে জলে ভিন্ন-ভিন্ন গলায় কারা অমন অদ্ভুতরকম শব্দ করে, পদ্যে কথা কয়, হা-হা করে হাসে, আমাদের ভয় দেখায়, আবার সাবধান করেও দেয়? তারা আমাদের দেখে, কিন্তু নিজেরা দেখা দেয় না! তারা স্পষ্টই বলেছে-এ বড়ো মারাত্মক জায়গা, এখানে ধনরত্ন কিছুই নেই, ভালোয়-ভালোয় তোমরা প্রাণ নিয়ে কলকাতায় ফিরে যাও!-কে তারা? তারা শত্রু বলে মনে হচ্ছে না, কিন্তু তারা কি আমাদের বন্ধু?’
হঠাৎ কোনোরকম পূর্বাভাস না দিয়েই সারা দ্বীপ যেন সশব্দে সজাগ হয়ে উঠল৷
সমুদ্রে প্রবল বন্যার দুরন্ত গর্জনের মতো, আগ্নেয়গিরির অগ্নিহুংকারের মতো কল্পনাতীত কী এক ভয়াবহ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি যেন ক্রুদ্ধ আবেগে আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ করে তুলল৷ এবং তারই মাঝে মাঝে আবার শোনা যেতে লাগল-কিচির মিচির কিচির মিচির কিচ কিচ কিচ! ঘ্যাট-ঘ্যাট ঘট-ঘট ঘ্যাট-ঘ্যাট! বানর ও আর একটা কোনো পশুর ভীত আর্তনাদ৷
কুমার বিহ্বলের মতো বলল, ‘দ্বীপে ও কাদের চিৎকার? হুড়মুড় করে গাছ ভেঙে পড়ছে-চিৎকারও যেন আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে!’
ওদিকে পানসি থেকে কাসিমও সভয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘হুজুর! আমার লোকজনরা ভয়ে পাগলের মতো হয়ে উঠেছে! বলছে, তারা এই শয়তানের দ্বীপের কাছে আর একদণ্ড থাকবে না! আমরা পানসি নিয়ে চলে যেতে চাই!’
বিমল ফাঁপরে পড়ে বলল, ‘সে কী কাসিম-মিয়া, তোমরা কি আমাদের এখানে ফেলেই পালাতে চাও?’
‘কী করব হুজুর, ভূতের সঙ্গে কে লড়াই করবে? আমরা গরিব মানুষ, ঘরে মা-বউ-ব্যাটা আমাদের পথ চেয়ে দিন গোনে, আমরা কি ভূতের হাতে প্রাণ দিতে পারি?’
বিমল বলল, ‘শোনো কাসিম, আরও বকশিশ চাও তো বলো!’
কাসিম মাথা নেড়ে বলল, ‘মাপ করবেন হুজুর! প্রাণ গেলে বকশিশ নেবে কে? . . . ভাই-সব! বোট থেকে আমাদের নৌকোর দড়ি খুলে নাও!’
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – বিপদ জলে-স্থলে
কিন্তু সামুদ্রিক বন্যার গর্জনের মতো, আগ্নেয়গিরির হুংকারের মতো, কালবৈশাখীর বজ্রকন্ঠের চিৎকারের মতো ওসব কীসের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি দ্বীপের ভিতর থেকে ক্রমেই জলের দিকে এগিয়ে আরও এগিয়ে আসছে? ওইসব সৃষ্টিছাড়া আওয়াজ তো কোনো প্রাকৃতিক বিপ্লবের নয়, ওদের উৎপত্তি যেন জ্যান্ত জীবজন্তুর কন্ঠ থেকেই! . . . পৃথিবীতে এমন কোন জীবজন্তু আছে, যারা এমন সব ভয়ানক অপার্থিব চিৎকার করতে পারে?
সেই আশ্চর্য চিৎকার একেবারে দ্বীপের প্রান্তে নদীর ধারে এসে পড়ল৷ বিমল অবাক হয়ে দেখল, একটা বনের অনেকখানি অংশ যেন হেলে বেঁকে একবার দুমড়ে পড়ছে এবং আর্তনাদ করে আবার শূন্যে ঠিকরে উঠছে,-তার ভিতরে যারা আজ এসে ঢুকছে, বনস্পতিরা তাদের যেন কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না৷ সেই অসহনীয় অত্যাচারী কল্পনাতীত দুরন্তদের ভৈরব হুংকার বনস্পতিদের আর্ত মর্মরনাদকেও ডুবিয়ে দিল৷
কুমার হঠাৎ বিমলের কাঁধ চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দেখো, দেখো!’
বিমল আগেই দেখেছিল৷ চাঁদ তখন পশ্চিম দিকে গিয়ে একটা তালকুঞ্জের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে৷ আচম্বিতে সেই কুঞ্জের তালগাছগুলো চারিদিকে ঠিকরে পড়ল এবং তার মধ্যে বিকট দুঃস্বপ্নের মতো জেগে উঠল সুদীর্ঘ ও বিরাট একটা ছায়ামূর্তি-চকিতের জন্যে৷ পরমুহূর্তে সেই মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল এবং তালগাছগুলোও আবার খাড়া হয়ে উঠে যেন বিষম যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল৷
ওই মুহূর্তের মধ্যেই বিমল দেখে নিল, সেই বিরাট দানবের দেহ প্রায় তালগাছগুলোরই মতো উঁচু৷
কাসিম কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘হুজুর, আমরা নৌকো খুলে দিয়েছি! আপনারা কী করবেন?’
বিমল বলল, ‘আমরাও যাব৷ ড্রাইভার, মোটরের স্টার্ট দাও৷ কাসিম, তোমাদের পানসি আমাদের বোটের পিছনে বেঁধে নাও৷’
হঠাৎ অন্ধকার জলের ভিতর থেকে আরও-অন্ধকার মস্ত একটা কুৎসিত মুখ জেগে উঠল-তার চোখদুটো জ্বলন্ত কয়লার টুকরোর মতো৷ পানসির লোকেরা চেঁচিয়ে উঠল, ‘কুমির!’
কুমিরটা আবার ডুব মেরে অদৃশ্য হয়ে গেল৷
গাছের একটা বড়ো ডাল হঠাৎ দোল খেল-সেখানেও দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে৷ সেটা বানর, না মানুষ, না অন্য কোনো জীব তা বোঝা গেল না বটে, কিন্তু সে যে অত্যন্ত আগ্রহভরে নৌকোর লোকদের গতিবিধি লক্ষ করছে, এটুকু ভালো করেই বুঝতে পারা গেল৷
দ্বীপের বনজঙ্গলের ভিতর থেকে এতক্ষণ যে ভীষণ হট্টগোল উঠে চতুর্দিক শব্দময় করে তুলেছিল, আচম্বিতে তা থেমে গেল৷ অরণ্যের ছটফটানিও বন্ধ হয়ে গেল৷ বিমল ও কুমারের মনে হল যেন বিরাট এক নিস্তব্ধ বিভীষিকা দম বন্ধ করে ওৎ পেতে তাদের উপরে হঠাৎ লাফিয়ে পড়বার জন্যে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে৷
মোটরবোটের ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল কে একজন হা-হা-হা-হা করে অট্টহাস্য করছে৷
কুমার তাড়াতাড়ি টর্চের আলোটা সেইদিকে নিক্ষেপ করল৷
একটা প্রকাণ্ড গাছের তলায় এক দীর্ঘদেহ মানুষ দাঁড়িয়ে আছে৷ সে মূর্তির কাছ পর্যন্ত টর্চের আলোক-রেখা ভালো করে পৌঁছোল না বলে তাকে স্পষ্ট করে দেখা গেল না; কিন্তু এটা বোঝা গেল, তার ধবধবে সাদা দীর্ঘ চুল, দাড়ি ও গায়ের জামাকাপড় লটপট করে হু-হু বাতাসে উড়ছে৷
কাসিম বলল, ‘ওই সেই বুড়ো ভদ্রলোক!’
বিমল তাঁর উদ্দেশে চিৎকার করে বলল, ‘নমস্কার মশাই, নমস্কার! এ-যাত্রায় আর আপনার সঙ্গে আলাপ করা হল না৷’
সে মূর্তি যেন পাথরের মূর্তি৷ একটু নড়লও না, আর কোনো সাড়াও দিল না৷
মোটরবোট ক্রমেই দ্বীপ থেকে দূরে গিয়ে পড়ছে, দ্বীপ ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে আসছে৷ বিমল ও কুমার একদৃষ্টিতে সেই রহস্যরাজ্যের দিকে তাকিয়ে গুম হয়ে বসে রইল৷
তারপর দ্বীপটা যখন একেবারে চোখের আড়ালে চলে গেল বিমল বলল, ‘কুমার আবার আসব, আর রীতিমতো প্রস্তুত হয়েই আসব৷ ও-দ্বীপের কিছুই আমি জানতাম না বলে এবারে ব্যর্থ হতে হল, কিন্তু এর পরের বারের ইতিহাস হবে অন্যরকম৷’
কুমার বলল, ‘কলকাতা থেকে আমরা আশি মাইলের বেশি দূরে এসেছি বলে মনে হচ্ছে না, মনে হয় আমরা যেন অন্য কোনো পৃথিবীতে এসে হাজির হয়েছি৷ যা দেখলাম, আর যা শুনলাম তা দুঃস্বপ্ন, না চোখ আর কানের ভ্রম?’
বিমল বলল, ‘আমাদের সামনে এখন অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে৷ প্রথমত, ওই বুড়ো কে? কেন সে এমন অদ্ভুত জায়গায় বাস করে? দ্বিতীয়ত জল আর গাছের উপর থেকে কারা ছড়া কেটে আমাদের সাবধান করে দিচ্ছিল? কেনই বা তারা এখানে থাকে আর কেনই বা দেখা দেয় না? তৃতীয়ত দ্বীপের বনজঙ্গলের ভিতরে কারা অমন হট্টগোল আর হুড়োহুড়ি করছিল? চতুর্থত, তালগাছগুলো ঠেলে যে অসম্ভব বিরাট ছায়ামূর্তিটা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল, সেটা কী? পঞ্চমত, সেই বাঘের মতন বড়ো বেড়ালটা কি এই দ্বীপেই বাস করত? সেরকম বিড়াল কি এখানে আরও আছে?’
কুমার বলল, ‘দ্বীপের ব্যাপার যা দেখলাম তাতে মনে হচ্ছে বেশ একটি বড়ো দলবল না নিয়ে এলে আমরা ওখানে নামতেই পারব না৷’
বিমল বলল, ‘হ্যাঁ৷ কেবল দলবল নয়, দলে বাছা-বাছা লোক নিতে হবে৷ কাসিমদের মতো ভীতু লোক নিয়ে কোনো কাজ হবে না৷ এবারে যখন আসব, তখন আমাদের দলে বিনয়বাবু, কমল আর রামহরি তো থাকবেই, তার উপরে জনকয়েক বন্দুকধারী পুলিশের লোক যাতে পাওয়া যায়, সে চেষ্টাও করতে হবে; নইলে এবারে এসেও হয়তো দ্বীপে গিয়ে নামতে পারব না৷ দ্বীপে যারা আছে তারা বাধা দেবেই৷’
কুমার বলল, ‘আর আমাদের বাঘা? সে কার কাছে থাকবে?’
বিমল বলল, ‘বাঘার মতন চালাক কুকুর অনেক মানুষের চেয়ে ভালো৷ এখানে তাকেও হয়তো দরকার হবে৷ সেও আমাদের দলে থাকবে৷’
পানসি থেকে কাসিম সুধোল, ‘হুজুর আপনারা কোন দিকে যাবেন?’
বিমল বলল, ‘আমরা পোর্ট ক্যানিংয়ে গিয়ে নামব৷’
‘তাহলে হুজুর আমাদের রাইপুরের কাছে ছেড়ে দেবেন৷’
‘আচ্ছা৷ চলো কুমার, শেষ-রাতে আমরা একটু ঘুমিয়ে নিই৷’
বিমলের কথা শেষ হবামাত্রই হঠাৎ চারিদিকের নিস্তব্ধতাকে তলিয়ে দিয়ে একটা আর্তনাদ জেগে উঠল-‘রক্ষা করো, রক্ষা করো!’
বিমল ও কুমার বিস্মিতভাবে চারিদিকে তাকাতে লাগল৷ এই জনমানবহীন জলের দেশে সাহায্য চায় কে!
তখন একটা ছোট্ট চরের পাশ দিয়ে বোট যাচ্ছিল৷ তারা চাঁদের নির্বাণোন্মুখ ম্লান জ্যোৎস্নায় দেখল চরের উপরে সাদামতো চলন্ত কী একটা দেখা যাচ্ছে৷
আবার আর্তনাদ শোনা গেল, ‘রক্ষা করো! আমাকে এখানে ফেলে যেয়ো না!’
বিমল বলল, ‘ড্রাইভার, বোট চরে ভেড়াও৷’
কাসিম ভীত স্বরে বলল, ‘হুজুর, এও ভূতের কারসাজি! এখানে মানুষ থাকে না!’
বিমল তার কথায় কর্ণপাত করল না৷
বোট চরে গিয়ে ঠেকল৷ টর্চ জ্বেলে দেখা গেল, একটা লোক পাগলের মতো নৌকোর দিকে ছুটে আসছে-তার জামাকাপড় ছেঁড়া, চুল উশকোখুশকো, দৃষ্টি উদভ্রান্ত৷
লোকটা কাতর স্বরে বলল, ‘আজ তিন দিন অনাহারে এখানে পড়ে আছি! আমাকে বাঁচান!’
বিমল তাকে নৌকোর উপরে উঠতে বলল৷
নৌকোয় উঠে সে বলল, ‘আগে আমাকে কিছু খেতে দিন!’
কুমার তখনই একটখানা পাঁউরুটি, কিছু মাখন ও খানিকটা জেলি এনে দিল৷ লোকটা গোগ্রাসে তা খেয়ে ফেলল৷
সে একটু ঠান্ডা হলে পর বিমল জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কেমন করে এখানে এলে?’
সে বলল, ‘গ্রহের ফেরে! আমি হচ্ছি কাঠের ব্যাপারী৷ নৌকো করে লোকজনের সঙ্গে এইদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম৷ পথে একটা দ্বীপ পেয়ে ভাবলাম, ওখানে নেমে দেখব ভালো কাঠের গাছ পাওয়া যায় কি না৷ সেই কুবুদ্ধিই হল আমার কাল৷ দ্বীপে গিয়ে নামামাত্র চারিদিকে যেন দৈত্যদানবরা চিৎকার করতে লাগল আর ভূমিকম্প হতে লাগল! আমার দলের লোকদের কী হল জানি না, কিন্তু আমি দেখলাম, হাতির মতো কী-একটা জানোয়ার তিরের মতো আমার দিকে তেড়ে আসছে!’
বিমল বলল, ‘সে জানোয়ারটাকে কি মস্ত একটা বিড়ালের মতো দেখতে?’
‘বিড়াল? না, তাকে দেখতে হাতির মতো বড়ো যেন একটা ডালকুত্তা৷’
‘তার পর?’
‘আমি তখন জলের কাছে ছিলাম৷ প্রাণের ভয়ে তখনই জলে ঝাঁপ দিলাম-সঙ্গে সঙ্গে আমার খুব কাছেই প্রকাণ্ড একটা কুমির ভেসে উঠল৷ ডাঙায় প্রকাণ্ড অদ্ভুত জানোয়ার আর জলে কুমির দেখে আমার যে কী অবস্থা হল, সেটা বুঝতেই পারছেন৷ যদিও প্রাণের আশা আর রইল না, তবু দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সাঁতার কাটতে লাগলাম,-কারণ আমি শুনেছিলাম, মানুষ যখন সাঁতার কাটে কুমির তখন তাকে ধরতে পারে না৷ এ-কথা সত্যি কি না জানি না, কিন্তু সেই কুমিরটা নাছোড়বান্দার মতো আমার সঙ্গে সঙ্গে অনেকদূর এল বটে, তবু আমাকে ধরবার কোনো চেষ্টাই করল না৷ তারপর সে ডুব মারল৷ আমার ভয় আরও বেড়ে উঠল, ভাবলাম জলের ভিতর থেকে এইবার সে আমাকে কামড়ে ধরবে! ক্রমাগত পা ছুড়তে লাগলাম! . . . সেইভাবে ভাসতে ভাসতে যখন এই চরে এসে উঠলাম, তখন আমি আধমরা৷ এই চরেই আজ তিন দিন তিন রাত কেটে গেছে৷ আজ আপনাদের নৌকো এ-পথে না এলে আমি অনাহারেই মারা পড়তাম৷’
সপ্তম পরিচ্ছেদ – কুম্ভকর্ণের বংশধর
বিনয়বাবু তাঁর পরীক্ষাগারে বসে একমনে আকাশের গ্রহ-তারা দেখবার বড়ো দূরবিনটা সাফ করছিলেন, এমন সময় একখানা খবরের কাগজ হাতে করে কমল সেই ঘরে প্রবেশ করল৷
কমলের পায়ের শব্দ বিনয়বাবু চিনতেন, কাজেই দূরবিন থেকে মুখ না তুলেই বললেন, ‘এসো কমল৷’
কমল উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘বিনয়বাবু, আজকের খবরের কাগজ পড়েছেন?’
‘না৷ তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছে, নতুন কোনো খবর আছে৷’
‘কেবল নতুন নয়, আশ্চর্য খবর!’
বিনয়বাবু দূরবিন থেকে চোখ তুলে বললেন, ‘আমরা মঙ্গলগ্রহে গিয়েছি, ময়নামতীর মায়াকাননে গিয়েছি, হিমালয়ের ভয়ংকরের দেশে গিয়েছি৷ আমাদের কাছে কি কোনো খবরই আর আশ্চর্য বলে মনে হবে?’
কমল বলল, ‘আচ্ছা, আগে আপনি খবরটা শুনুন৷’ এই বলে সে কাগজখানা খুলে পড়তে লাগল :
গঙ্গাসাগরে কুম্ভকর্ণ
‘গঙ্গাসাগরের নিকটে এক অদ্ভুত রহস্যের সংবাদ পাওয়া গিয়াছে৷
সাগরদ্বীপের নিকটস্থ নদ-নদীতে যাহারা নৌকা লইয়া আনাগোনা করে, সম্প্রতি তাহাদের ভিতরে অত্যন্ত বিভীষিকার সঞ্চার হইয়াছে৷
কয়েকখানি নৌকার এবং তাহাদের মাঝিমাল্লার ও লোকজনের কোনো খবর পাওয়া যাইতেছে না, তাহারা যেখান হইতে যাত্রা করিয়াছিল সেখানেও ফিরিয়া আসে নাই, অথবা গন্তব্য স্থলেও গিয়া উপস্থিত হয় নাই৷ যদি মনে করা যায় কোনোকরম দুর্ঘটনায় হঠাৎ নৌকাডুবি হইয়াছে, তবে এই কথা জিজ্ঞাস্য হওয়া স্বাভাবিক যে, দুর্ঘটনা কি এমন নিয়মিতভাবে ঘটিতে পারে? ঝড়-বাদল বা বন্যা নাই, অথচ পরে-পরে কয়েকখানা নৌকা আরোহীদের সহিত একেবারে অদৃশ্য হইয়া গেল, একজন লোকেরও প্রাণরক্ষা হইল না? এটা কি যারপরনাই অস্বাভাবিক নহে?
নদীর কেবল এক নির্দিষ্ট অংশের মধ্যেই নৌকাগুলি অদৃশ্য হইয়াছে৷ সাগরদ্বীপের পরে ফ্রেজারগঞ্জ৷ তাহার পর জামিরা নদী৷ তাহার পর বুলছুড়ি দ্বীপ৷ তাহার পর মাতলা নদী৷ জামিরা নদীর জল যেখানে সুন্দরবনের মধ্যে ঢুকিয়া মাতলা নদীর সঙ্গে মিশিয়াছে, সেইখানেই কোনো এক জায়গায় গিয়া প্রত্যেক নৌকাই হঠাৎ অদৃশ্য হইয়াছে৷
পুলিশের লোকেরা তদন্তে গিয়া আর-এক বিস্ময়কর ব্যাপার আবিষ্কার করিয়াছে৷
পুলিশের নৌকা একটা অজানা দ্বীপের নিকটে নোঙর ফেলিয়াছিল৷ শুক্লপক্ষের শুভ্র রজনী৷ নৌকার উপরে বসিয়া একজন চৌকিদার পাহারা দিতেছিল৷
দ্বীপের উপরে হঠাৎ সে এক অদ্ভুত দৃশ্য দর্শন করিল৷ প্রায় তালগাছ-সমান উচ্চ ভয়াবহ এক মূর্তি স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে৷ দূর হইতে যদিও তাহার মুখ-চক্ষু দেখা যাইতেছিল না, তবে সেটা যে কোনো দানব মনুষ্যমূর্তি, সে-বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নাই৷
চৌকিদারের ভীত চিৎকারে নৌকার অন্যান্য লোক বাহিরে আসে এবং তাহারাও সেই বিরাট মূর্তিকে দেখিতে পায়৷ সকলে তখন নৌকা লইয়া সভয়ে পলায়ন করে৷
যে-সব নৌকা অদৃশ্য হইয়াছে তাহার সহিত উক্ত অমানুষিক মূর্তির কোনো সম্পর্ক আছে কি না, পুলিশ এখন এই কথা লইয়াই মাথা ঘামাইতেছে৷
প্রকাশ, শীঘ্রই বৃহৎ এক পুলিশবাহিনী ওই অজানা দ্বীপের দিকে যাত্রা করিবে৷
স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস এই-লঙ্কাদ্বীপের কোনো অজ্ঞান অংশ হইতে কুম্ভকর্ণের বংশধরগণ সন্তরণ দিয়া সমুদ্র পার হইয়া গঙ্গাসাগরের নিকটস্থ ওই দ্বীপের মধ্যে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে৷ অদৃশ্য নৌকাগুলির আরোহীরা গিয়াছে তাহাদেরই বিপুল উদরের মধ্যে৷
অবশ্য এরকম কুসংস্কারে আমরা বিশ্বাস করি না৷ কিন্তু ব্যাপারটা যে ভালো করিয়া তদন্ত করা উচিত, সে-বিষয়ে দ্বিমত থাকিতে পারে না৷ নহিলে সুন্দরবনের ও-অঞ্চলে নৌকা চলাচল একেবারেই বন্ধ হইয়া যাইবে৷
বিনয়বাবু তাঁর মাথার কাঁচা-পাকা চুল ক-গাছির ভিতরে আঙুল চালাতে চালাতে একমনে সমস্ত কথা শ্রবণ করলেন৷ তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘পৃথিবীতে কি আবার পুরাকাল ফিরে এল? এখন দানবের অত্যাচার যেন ক্রমেই বেড়ে উঠেছে! আমরা মৃনুকে উদ্ধার করতে গিয়ে হিমালয়ের যে-সব ভয়ংকরকে দেখে এসেছি, এতদিন অনেকে তাদের কথা বিশ্বাস করত না৷ ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের এভারেস্ট অভিযানের লোকেরা হিমালয়ের টঙে যে বিরাট পদচিহ্ন দেখেছিল, সেটা তখন একটা মজার গল্প বলেই মনে করা হয়েছিল৷ কিন্তু সে গল্প যে সত্যি, আমরা তা প্রমাণিত করবার চেষ্টা করি৷ আমাদের চেষ্টা বেশি বুদ্ধিমানদের কাছে সফল হয়নি৷ তারপর গেল বছরে যখন খবরের কাগজে বেরোল যে, দার্জিলিংয়ের আরও নীচে আর বাংলাদেশের নানা স্থানে দানবের মতো বৃহৎ মানুষ দেখা গেছে, তখন আমাদের কাহিনির উপরে লোকের শ্রদ্ধা হল৷ বিমল বলে, হিমালয়ের ভয়ংকররা তাদের দেবীকে অর্থাৎ আমাদের মৃনুকে সারা দেশে তন্ন-তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং একদিন তারা মৃনুকে আবার খুঁজে বার করবেই করবে৷ গেল ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর তারিখের ‘স্টেটসম্যান’ কাগজে দেখেছি, মি. সিপটন নামে এক ভদ্রলোক মালয়ের ষোলো হাজার ফুট উপরে বরফের গায়ে আবার দানবের পদচিহ্ন আবিষ্কার করেছেন৷ বিমলের মত যদি ঠিক হয় তবে কে বলতে পারে, মৃনুকে খুঁজতে খুঁজতে দু-একটা দানব গঙ্গাসাগরের কাছে গিয়ে হাজির হয়নি?’
কমল বলল, ‘বিমলবাবু আর কুমারবাবু যে গঙ্গাসাগরের কাছাকাছি কোনো একটা দ্বীপে দানববিড়ালের খোঁজে গিয়েছেন, সে কথাটাও মনে রাখবেন৷ দানবদের দেশে গিয়ে আমরা কিন্তু বাঘের মতো কোনো বিড়াল-টিড়াল দেখতে পাইনি৷ সেখানকার কুকুর দেখেছি, সাধারণ কুকুরের চেয়ে সে বড়ো নয়৷ গঙ্গাসাগরে কাছে কি তাহলে দানবজীবদের অজানা কোনো আস্তানা আছে?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কেমন করে তা বলব? তবে এইটুকু জানি যে, বিলাতেও দানব-মানুষের কাহিনি কেবল গালিভারের গল্পে বা ছেলেভুলানো রূপকথায় পাওয়া যায় না৷ বিংশ শতাব্দীর সভ্য মানুষেরাও তাদের চর্মচক্ষে দেখতে পেয়েছে৷ ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পাহাড় হচ্ছে, বেল মাকবুই৷ সে পাহাড়টি আছে হাইল্যান্ডারদের দেশে৷ যখন বরফ পড়ে তখন স্থানীয় লোকেরা কিছুতেই সেই পাহাড়ের উপরে উঠতে রাজি হয় না৷ কারণ তারা বলে, বরফ পড়লেই সেখানে Lang mon রা বেড়াতে আসে, তারা সাধারণ মানুষকে সুনজরে দেখে না৷ Lang mon হচ্ছে Long man-এরই রূপান্তর-অর্থাৎ লম্বা মানুষ৷ সকলেই এই লম্বা মানুষদের অলীক কল্পনা বলেই মনে করত৷ কিন্তু কিছুদিন আগে Alpine club-এর ভূতপূর্ব সভাপতি আর এভারেস্ট অভিযানেরই এক সাহেব স্বচক্ষে একজন লম্বা মানুষকে দেখতে পেয়েছেন৷ মাথায় সে উঁচু ছিল প্রায় ১২ ফুট৷ এই দু-জন নির্ভরযোগ্য, বিখ্যাত আর শিক্ষিত দর্শকের কথা আজ আর কেউ উড়িয়ে দিতে পারে না৷’
কমল বলল, ‘কিন্তু গঙ্গাসাগরের এই দানবমানুষ নাকি প্রায় তালগাছের সমান উঁচু৷ হিমালয়ের ভয়ংকররাও এদের চেয়ে ঢের ছোটো ছিল৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘উঁচু দানবের কথা যখন তুললে তখন আর একটা সত্য কাহিনি বলি শোনো৷ এরও ঘটনাস্থল হচ্ছে বিলাতে, ডিভনশায়ারে৷ ক্রিমিয়াযুদ্ধের সময়ে, ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ফেব্রুয়ারির সকাল বেলায় ডিভনশায়ারের অনেকগুলো শহরের বাসিন্দারা সবিস্ময়ে দেখল যে, বরফের উপরে অদ্ভুত সব খুরের চিহ্ন সারি-সারি এগিয়ে গেছে৷ এ ঘোড়া বা গাধা বা অন্য কোনো চতুষ্পদ পশুর খুরের দাগ নয়-এ দাগ হচ্ছে কোনো দু-পেয়ে জীবের৷ পৃথিবীতে এমন কোনো দু-পেয়ে জীব নেই যার পায়ে খুর আছে৷ প্রায় একশো মাইল পর্যন্ত চলে গেছে ওই আশ্চর্য পদচিহ্ন৷ যে সারা রাত ধরে অশ্রান্তভাবে পথ চলেছে এবং এক রাতে যে একশো মাইল পথ চলে, সে কীরকম জীব তা বুঝে দেখো! যেতে যেতে একটা এক মাইল চওড়া নদীও (River Exe) সে অনায়াসে পার হয়ে গেছে-কারণ তার পদচিহ্ন নদীর এপারে জলের ধারে শেষ হয়ে গিয়ে আবার ওপার থেকে আরম্ভ হয়েছে৷ পথে অনেক ছোটো-বড়ো বাড়ি পড়েছিল, কিন্তু সেই রহস্যময় জীবটা কোনো বাড়ির ভিতরেই ঢোকেনি৷ অনেক বাড়ির ছাদের উপরেও পদচিহ্ন পাওয়া যায়, আবার পদচিহ্ন অনেক বাড়ির এপাশে শেষ হয়ে গিয়ে ফের ওপাশ থেকে শুরু হয়েছে, তাদের ছাদের উপরে কোনো দাগই নেই-যেন সে অনায়াসেই গোটা বাড়িটাই ডিঙিয়ে চলে গেছে৷ …এখন ভাববার চেষ্টা করো, এ কোন জীব? এরকম পদচিহ্ন ডিভনশায়ারে তার আগে বা পরে আর কখনো দেখা যায়নি৷ তার খুরওয়ালা দু-খানা পা, সে এক মাইল চওড়া নদী পার হয়, অম্লান বদনে এক রাতেd একশো মাইল হাঁটে, বাড়ির ছাদে উঠে নেমে যায় বা বিনা কষ্টেই বাড়ি-কে-বাড়ি লঙ্ঘন করে অগ্রসর হয়৷ স্থানীয় লোকেরা ধরে নিল, গত রাত্রের তুষারবৃষ্টির সময়ে শয়তান ডিভনশায়ারে বেড়াতে এসেছিল-কারণ, প্রচলিত মতে, শয়তানের দুই পায়ে খুর আছে৷ এই ঘটনার পরে অনেক দিন পর্যন্ত ডিভনশায়ারের বাসিন্দারা সন্ধ্যার আগেই যে-যার বাড়ির ভিতরে পালিয়ে এসে ভয়ে দরজা-জানলা বন্ধ করে বসে থাকত৷’
কমল বলল, ‘তবু লোকে বলে, পৃথিবীতে এখন আর অসম্ভব ঘটনা ঘটে না!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘আপাতত ও-সব কথা থাক৷ . . . কমল, বিমল আর কুমার কি সুন্দরবন থেকে কোনো খবর পাঠিয়েছে? তারা তো এই দানবের খবর পাওয়ার আগেই গঙ্গাসাগরের দিকে গিয়েছে, এর জন্যে প্রস্তুত হয়েও যায়নি,-যদি তারা কোনোরকম বিপদে পড়ে?’
এমন সময়ে একতলা থেকে শোনা গেল, একটা কুকুর পরিচিত গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠল-‘ঘেউ, ঘেউ ঘেউ!’
কমল উৎসাহ-ভরে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ওই বাঘা আমাদের ডাকছে! বাঘা যখন আসছে, তখন ওইসঙ্গে বিমলবাবুদেরও দেখা নিশ্চয় পাওয়া যাবে!’
বলতে বলতে ঘরের দরজাটা দুম করে খুলে গেল এবং বিমল ও কুমারের আগে-আগে বাঘা ভিতরে ঢুকে বিনয়বাবুর কাছে গিয়ে দু-পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে সামনের পা দিয়ে তাঁর কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের প্রাণের আনন্দ জ্ঞাপন করল৷ তারপর কমলকেও সেইভাবে আদর করে বিপুল বেগে পটপট রবে ল্যাজ নাড়াতে লাগল৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘এই যে! তোমরা যে এরই মধ্যে ফিরে এলে?’
বিমল বলল, ‘আমরা ফিরে এলাম না বিনয়বাবু, পালিয়ে এলাম!’
‘দানবমানুষের ভয়ে?’
‘এই যে, আপনিও খবর পেয়েছেন দেখছি! হ্যাঁ, দানবের ভয়েই বটে৷ কিন্তু পালিয়ে এসেছি, আটঘাট বেঁধে পুনরাক্রমণ করব বলে৷’
‘আবার তোমরা যাচ্ছ?’
‘নিশ্চয়! কিন্তু এবারে কেবল আমরা দুজনই নই, আপনি যাবেন, কমল যাবে, রামহরি যাবে-এমনকী বাঘাও পড়ে থাকবে না৷ নিন! উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত! আমরা প্রস্তুত, আপনারাও দ্বিগুণ উৎসাহে মোটঘাট বেঁধে তৈরি হয়ে নিন৷ আমরা কালকে সকালেই যাত্রা করব৷’
বিনয়বাবু দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে বললেন, ‘তার মানে?’
‘তার মানে, কাল সকালেই আমরা আপনাদের নিয়ে সম্ভবের মুল্লুক থেকে অসম্ভবের দেশে যাত্রা করব৷ তালগাছের মতো উঁচু মানুষ! হাতির মতো বড়ো ডালকুত্তা! বাঘের মতো মস্ত বিড়াল! পুলিশের লঞ্চ আর বন্দুকধারী সেপাই আমাদের সাহায্য করবার জন্যে এতক্ষণে প্রস্তুত হয়েছে, আমাকে ডানপিটে বলে গালাগাল দিতে দিতে আর রাগে গরগর করতে করতে বুড়ো রামহরি পর্যন্ত সমস্ত তল্পিতল্পা বেঁধে নিয়েছে, আর আপনারা এখনও অলস হয়ে এখানে বসে আছেন? ছিঃ বিনয়বাবু! ছিঃ কমল!’
বিনয়বাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! আমরা কেমন করে জানব যে-‘
বাধা দিয়ে বিমল বলল, ‘ব্যাস, ব্যাস, আর কথা নয়! এখন জেনেছেন তো? কাল সকালে আমরা সুন্দরবনে যাত্রা করব, আপনার জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিন৷ আমাদের হাতে এখনও অনেক কাজ রয়েছে৷-চলো কুমার, আয় বাঘা৷’
বাঘা বিনয়বাবুর দিকে ফিরে আবার বলল-‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ,’ কুক্কুর-ভাষায় তার অর্থ বোধ হয়-‘কর্তা, এখন আসি?’
বিমল ও কুমার দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ বিনয়বাবু হতাশভাবে ধপাস করে একখানা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, ‘না, আমার অপঘাত-মৃত্যু না ঘটিয়ে বিমল বোধ হয় ছাড়বে না! ওঁরা এল আর গেল যেন কালবৈশাখীর মতো, -এখন সামলাও ধাক্কা!’
খিলখিল করে হেসে উঠে কমল বলল, ‘আমার কিন্তু ভারি মজা লাগছে!’
বিনয়বাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘তা তো লাগবেই, সব গাধারই যে এক বুলি! কিন্তু আমার বয়স যে পঞ্চাশ পার হয়েছে, আমার কি এ-সব পোষায়, না শোভা পায়?’
দুষ্টু কমল বলল, ‘শাস্ত্রে বলে পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যেতে৷ আপনি তো সুন্দরবনেই যাচ্ছেন বিনয়বাবু! যে-সে বন নয়, পরমসুন্দর বন!’
বিনয়বাবু আরও রেগে বললেন, ‘থামো, থামো! আর জ্যাঠামি করতে হবে না!’
অষ্টম পরিচ্ছেদ – অমানুষিক কন্ঠস্বর
আবার সেই সুন্দরবন৷ নির্জন বনভূমির মধ্যে আবার সেই নদীর ‘জলতরঙ্গ’ বাজনা৷ সে যেন নিস্তব্ধতার বীণায় কার মূর্ছা ভাঙাবার অশ্রান্ত সুর৷
কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ আজ দেরি করে মুখ দেখাবে৷ জ্যোৎস্নার যে কুহক স্বপ্ন নিয়ে বিমল ও কুমার গেলবারে ফিরে গিয়েছিল, এবার তারা সেই মাধুর্যের অভাব অনুভব করতে লাগল অত্যন্ত৷ আকাশে একটিমাত্র চাঁদকে দেখা না গেলে বনবাসী রাত্রির চেহারা যে কীরকম বদলে যায়, যারা তা দেখেনি তারা কিছুতেই বুঝতে পারবে না৷ আকাশে কোটি কোটি তারকার নির্নিমেষ নেত্রে যেটুকু আলোর বোবা ভাষা ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে কিছুমাত্র সান্ত্বনার আভাস নেই৷ বাতাসে বাতাসে কী যেন একটা বুকচাপা স্বপ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে৷ কে যেন ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠতে গিয়ে আতঙ্কে কাঁদতে পারছে না! অন্ধকার, অন্ধকার অন্ধকার! পায়ের তলা থেকে নদী সাড়া দিচ্ছে, দু-পাশ থেকে বিরাট অরণ্যের শিউরে-ওঠা মর্মর আর্তরব শোনা যাচ্ছে এবং তার জঠর থেকে ভেসে ভেসে আসছে লক্ষ লক্ষ নিশাচর জীবের জীবনযুদ্ধের ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি৷ কারুকেই দেখবার জো নেই, কেবল শব্দ-কেবল শব্দ৷ অন্ধকারের বিভীষিকা সমস্ত ধ্বনি-প্রতিধ্বনিকে করে তুলেছে ভয়াবহ৷ যে-দেশে তারা সবাই আজ যাত্রা করেছে, পথের এই অন্ধকারময় বিভীষিকা তারই স্বরূপের আভাস দেবার চেষ্টা করছে৷
গভীর আঁধার-সাগরে যেন ভেসে চলেছে দুটি ছোটো-বড়ো আলোক-দ্বীপ-বিমলদের মোটরবোট ও পুলিশের স্টিমার৷
বোটের কামরার ভিতরে বসে রামহরি ইকমিক কুকারে রান্না চড়িয়ে দিচ্ছে এবং এখনও আহারের যথেষ্ট বিলম্ব দেখে বাঘা কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করছে৷ অত্যন্ত উজ্জ্বল পেট্রোলের লন্ঠনের আলোকে কমল একখানা গল্পের বই পড়ছে এবং বিনয়বাবু, বিমল ও কুমার কথাবার্তা কইছে৷
বিমল বলছিল, ‘না বিনয়বাবু, এই দ্বীপে হিমালয়ের সেই ভয়ংকর দানবেরা এসে যে আস্তানা গেড়েছে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না৷ হিমালয়ের ভয়ংকরদের কাহিনি যে আমাদের কল্পনার দুঃস্বপ্ন নয়, বাংলাদেশে এখন এ-সত্য প্রমাণিত হয়েছে বলে আমি খুবই খুশি হয়েছি; কিন্তু সেদিন দ্বীপের উপরে যে দানবমূর্তির আভাসমাত্র দেখেছি, হিমালয়ের ভয়ংকররাও হাত বাড়িয়ে তার মাথার নাগাল পাবে বলে মনে হয় না! সে এক নতুন আর অসম্ভব দানব!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘তুমি আভাসমাত্র দেখেছ৷ তোমার চোখের ভ্রম হতেও তো পারে?’
‘আমাদের চোখের ভ্রম যদি হয়ে থাকে, তাহলেই মঙ্গলের কথা, কারণ ওই দ্বীপে অমন সৃষ্টিছাড়া দানব যদি আরও গোটাকয়েক থাকে, তাহলে এই যাত্রাই আমাদের শেষ যাত্রা হতেও পারে!’
রামহরি প্রায় কাঁদো-কাঁদো মুখে বলে উঠল, ‘খোকাবাবু, এই বুড়ো বয়সে ভূতুড়ে রাক্ষসের খোরাক হবার জন্যেই কি তোমরা আমাকে ধরে আনলে?’
কুমার হেসে ফেলে বলল, ‘ভয় কী রামহরি, গঙ্গাসাগরে মরলে রাক্ষসের পেটের ভিতর থেকে আবার বেরিয়ে তুমি সোজাসুজি স্বর্গে গিয়ে হাজির হতে পারবে৷ সকলে তখন মহা-পুণ্যবান বলে তোমাকে হিংসা করবে!’
রামহরি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘থামো থামো, আর কথার ফোড়ন দিতে হবে না, ঢের হয়েছে! রাক্ষসের পেটেই যদি হজম হই, তাহলে স্বর্গে যাবে কে?’
কুমার বলল, ‘এইবারে রামহরি তুমি নিরেট বোকার মতো কথা কইলে৷ রাক্ষসের ভুঁড়ি বড়োজোর তোমার দেহকেই হজম করতে পারে, কিন্তু তোমার আত্মাকে হজম করে এমন সাধ্য কার আছে? মানুষের দেহ তো স্বর্গে যায় না, স্বর্গে যায় তার আত্মাই!’
রামহরি বলল, ‘অমন স্বর্গে যাওয়ার পায়ে আমি গড় করি,-অমন করে আমি স্বর্গেও যেতে চাই না!’
কমল বই থেকে মুখ তুলে বলল, ‘বিনয়বাবু, আপনি ভাবছেন বিমলবাবুদের চোখের ভ্রম হয়েছে৷ কিন্তু আপনি খবরের কাগজের রিপোর্ট ভুলে যাচ্ছেন কেন? তাতেও তো এখানকার একটা দ্বীপে তালগাছ-সমান উঁচু এক দানবের কথা আছে!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কী জানি বাপু, এখানকার ব্যাপারটা আমার মনে কেবল একটা অমঙ্গলের ভাব জাগিয়ে তুলছে! মনে হচ্ছে এদিকে না আসাই যেন উচিত ছিল!’
কুমার জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, ‘এতক্ষণে চাঁদ উঠল৷ কিন্তু চাঁদের আর জেল্লা নেই৷’
বিনয়বাবু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘নাই বা রইল জেল্লা! চাঁদ যে উঠেছে, এই অন্ধ-করা অন্ধকারে সেইটেই হচ্ছে বড়ো কথা৷ এতক্ষণ আমার তো মনে হচ্ছিল চাঁদের বুঝি মৃত্যু হয়েছে, আলো আর ফুটবে না!’
কমল বলল, ‘কিন্তু ও চাঁদ যেন অন্ধকারকেই ভালো করে দেখবার চেষ্টা করছে! গাছের তলায় নড়ন্ত ছায়াগুলোকে দেখে সন্দেহ হয়, ওরা যেন বিরাটদেহ প্রেতমূর্তি, আমাদের ঘাড় ভাঙতে পারলে আর ছেড়ে কথা কইবে না!’
রামহরি কাজ করতে করতে মুখ তুলে ভয়ে-ভয়ে বনজঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সন্দেহ আবার কী, সত্যি কথাই! নিশ্চয় ওখানে ভূতপ্রেত আছে!’
বিমল বলল, ‘পৃথিবীর শৈশবে আদিম মানুষেরা গিরিগুহার ভিতর থেকে বাইরের আলো-আঁধারিতে চোখের ভ্রমে অমনি সব কত বিভীষিকাই দেখতে পেত৷ সেই সময় থেকেই ভূত-প্রেতের মিথ্যা ভয়ের সৃষ্টি৷ সে ভয় আজও আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে রয়েছে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে পণ্ডিত হয়েও মানুষ তাই তাকে আর ভুলতে পারে না!’
হঠাৎ বাঘা একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে কানদুটো খাড়া করে কী শুনতে লাগল৷
বিমলও বাইরের দিকে তাকাল৷ বোট তীরের একদিক ঘেঁষে যাচ্ছিল-দেখা গেল কেবল খানিক-কালো আর খানিক-আলো মাখা গাছপালা৷ সেখানে কোনো জীবজন্তুর সাড়া পর্যন্ত নেই৷
আচম্বিতে শোনা গেল-
‘ঘোঁ-ঘট ঘট ঘোঁ-ঘট ঘট ঘোঁ-ঘট ঘট ঘট ঘট!
ঘণ্টা বাজে যমালয়ে, কে যাবি আয় চটপট!’
কুমারের মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠল এবং বাঘাও বোটের ধারে গিয়ে জলের ধারে ঝুঁকে পড়ে চিৎকার করতে লাগল৷
বিমল লাফিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল৷ অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় হু-হু করে জলস্রোত ছুটে চলেছে, তা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না৷
রামহরি ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘কোথাও জনপ্রাণী নেই, তবে এমন হেঁড়ে গলায় ভয়ানক চেঁচিয়ে কে কথা কইলে খোকাবাবু?’
সত্য-সত্যই সে এমন উচ্চ কন্ঠস্বর যে, পিছনের স্টিমারে পুলিশের লোকেরাও তা শুনতে পেয়েছিল, স্টিমারের সার্চলাইট তখনই নদীর বুকের উপরে তীব্রোজ্জ্বল আলোক-সেতুর মতন গিয়ে পড়ল, তার পর সে অরণ্যের বক্ষ ভেদ করেও খুঁজে দেখল, কিন্তু কোথাও জ্যান্ত কোনোকিছুর সন্ধান পাওয়া গেল না৷
বিনয়বাবু হতভম্বের মতো বললেন, ‘এ কী ব্যাপার, কুমার? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’
কুমার বলল, ‘এ কন্ঠস্বর গেলবারেও আমরা দ্বীপের কাছে এসে শুনেছি৷ কিন্তু কে যে কথা কয়, কিছুতেই দেখতে পাইনি!’
কমল বলল, ‘মানুষের কথা শুনলাম বটে, কিন্তু এমন বিকট স্বরে কোনো মানুষ কি কথা কইতে পারে?’
বিমল বলল, ‘দ্বীপটা এখনও মাইল দশ-বারো দূরে আছে বোধ হয়৷ কিন্তু গেল বারে কেউ তো দ্বীপ থেকে এত দূরে এসে এমন স্বরে কথা কয়নি!’
কুমার বলল, ‘তাহলে আমরা যে আবার আসছি, এর মধ্যেই কি দ্বীপে সে-খবর পৌঁছে গেছে?’
বিমল জবাব দেবার আগেই অনেক দূর থেকে আবার সেই উৎকট ভৈরব আওয়াজ জেগে উঠল-
‘ঘোঁ ঘটঘট ঘোঁ-ঘট ঘট ঘোঁ-ঘট ঘট ঘট ঘট!’
বিমল বলল, ‘এ ভালো লক্ষণ নয়৷ শব্দটা দ্বীপের দিকেই চলে যাচ্ছে৷’
রামহরি বলে উঠল, ‘রাম রাম রাম রাম! অনেক ভূতের কথা শুনেছি, কিন্তু শব্দ-ভূতের কথা তো কখনো শুনিনি!’
বিমল বলল, ‘কুমার, বাঘার গলায় শিকল দাও! ও পাগলের মতো হয়ে উঠেছে-জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি না বটে, কিন্তু ওর পশু-চোখ বোধ হয় জলের ভিতরেই কোনো বিপদকে আবিষ্কার করেছে!’
বিমল টর্চ নিয়ে আবার নদীর ভিতরটা দেখতে লাগল-ঝাপসা চাঁদের আলো আর আবছায়া নিয়ে লোফালুফি করতে করতে ও পাক খেতে খেতে প্রবল জলের স্রোত ছুটছে এবং চিৎকার করে যেন নিকটস্থ সমুদ্রকে ডাকের পর ডাক দিচ্ছে৷ জলচর কুমির ও হাঙর ছাড়া সেখানে কোনো মানুষের পক্ষে এতক্ষণ ডুব দিয়ে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব৷
স্টিমার থেকে মেগাফোনে মুখ দিয়ে ইনস্পেকটর জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে কোনো লোক ভয়ানক চেঁচিয়ে কথা কয়েছে৷ আপনারা কেউ দেখতে পেয়েছেন?’
বিমল বলল, ‘না৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘বিমল, আমার মতে আজ রাতে দ্বীপের কাছে না যাওয়াই ভালো, আজ এইখানেই নোঙর ফেলে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যাক, কাল সকালে আলোয়-আলোয় দ্বীপের কাছে গিয়ে হাজির হব৷’
বিমল বলল, ‘আমারও সেই মত৷’
পরদিন পূর্ব-আকাশে প্রভাত এসে যখন রঙিন আলোর লাইন টানছিল, বিনয়বাবু তখন বোটের ভিতর থেকে বাইরে এসে বসলেন৷
কাল সারারাত তাঁর অশান্তিতে কেটেছে, একবারও ঘুম আসেনি, কারণ জলধারার একটানা ঐকতানের মাঝে মাঝে সেই অমানুষিক মানুষের চিৎকার আরও কয়েকবার জেগে উঠেছে- অনেক দূর থেকে৷
কার এই কন্ঠস্বর? এ যদি কোনো দানবের কন্ঠস্বর হয় তাহলে কোথায় সে? দানবের আকার যদি আশ্চর্যরকম প্রকাণ্ড হয় তবে তাকে তো আরও সহজেই দেখতে পাবার কথা! আর, এই গভীর নদীর গর্ভে কোনো নরদেহী দানবের এতক্ষণ ধরে থাকবার ঠাঁই-ই বা কোথায়?
এইসব উত্তরহীন প্রশ্ন নিয়েই বিনয়বাবুর রাত কেটে গেছে, এখন ভোরের আলো দেখে বাইরে এসে বসে তিনি অনেকটা আরাম বোধ করলেন৷ রামহরি তাঁর আগেই উঠে তখন চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে বসে গেছে- স্টোভে চায়ের জল গরম হচ্ছে এবং আর-একটা স্টোভ জ্বালিয়ে অমলেট ভাজবার উদ্যোগ চলছে৷ রামহরি সকলকে রেঁধে খাওয়াতে ভারি ভালোবাসত, বিষম সব বিপদ-আপদের মাঝখানেও এ বিভাগের কর্তব্যপালনের জন্যে সে সাধ্যমতো চেষ্টা করত৷ তাই পৃথিবীর ভিতরে ও বাইরে অনেক সৃষ্টিছাড়া দেশে গিয়েও বিমল ও কুমার প্রভৃতিকে কখনো কোনো কষ্টবোধ করতে হয়নি৷
রাত্রের বিভীষিকা রোদের সোনার জলের ধারায় কুয়াশার মতোই ধুয়ে-মুছে গিয়েছে, নদীর কলধ্বনি শুনে মনে হচ্ছে যেন ছোটো শিশুর খুশিভরা হাসির শব্দ৷ দূরে বনে বনে গায়ক পাখির দলও জেগে উঠে চারিদিক সরগরম করে তুলেছে এবং বাতাসের উচ্ছ্বাসে ভেসে আসছে যেন কোনো চন্দনস্নিগ্ধ পুলকস্পর্শ৷
বিমল, কুমার ও কমল বাইরে এসে বসতে-না-বসতেই রামহরি সকলের সামনে চায়ের পিয়ালা এবং প্লেটে করে গরম টোস্ট ও অমলেট সাজিয়ে দিয়ে গেল৷
বাঘাও যথাসময়ে অত্যন্ত সভ্যভব্যের মতো সকলের মাঝখানে এসে বসে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রামহরির গতিবিধি লক্ষ করছিল৷ তার জন্যেও এল কতকগুলো কুকুর-বিস্কুট৷
বিমল আগে বোট ও স্টিমার চালাবার হুকুম দিল, তারপর এক স্লাইস রুটি তুলে নিয়ে বলল, ‘বিনয়বাবু, আর ঘণ্টাদুয়েক পরেই আমরা সেই দ্বীপের কাছে গিয়ে হাজির হতে পারব৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘তার পর?’
‘তার পর আমরা একেবারে তীরে গিয়ে নামব৷’
‘যদি কেউ বাধা দেয়?’
‘স্টিমারে মিলিটারি পুলিশ আছে-এমনকী একটা মেশিনগানও আছে৷ যদি সত্যই সেখানে কোনো বিপজ্জনক অতিকায় বিড়াল, কুকুর, বাঘ ও দানব থাকে, তাহলে তাদের মেজাজ ঠান্ডা করবার জন্যে আমরা কোনো আয়োজনেরই ত্রুটি করিনি৷’
‘কিন্তু এইসব অদ্ভুত জীবের সঙ্গে সেই দ্বীপবাসী বৃদ্ধের সম্পর্ক কী, সেটা তো আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না! লোকালয়ের বাইরে এমন বিজন জায়গায় নির্বাসিতের মতো বসে দানবজীবদের নিয়ে তিনি কী করেন? দানবের ভয় তার যখন নেই তখন এটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে, দানবরাও তাঁর উপরে কোনো অত্যাচার করে না৷’
কুমার বলল, ‘আরও একটা মস্ত জানবার কথা হচ্ছে, সামান্য এক তুচ্ছ অজানা দ্বীপের বিড়াল আর কুকুর কেমন করে বাঘ আর হাতির মতো প্রকাণ্ড হয়ে উঠল?’
বিনয়বাবু সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললেন, ‘কিন্তু, এ-সব কি সত্যি?’
বিমল বলল, ‘কুকুরটাকে আমি দেখিনি বটে, কিন্তু বাঘের মতো বড়ো একটা বিড়ালকে আমি নিজেই যে গুলি করে মেরেছি সে-কথা তো আপনি শুনেছেন?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার! আর তার চেয়েও আশ্চর্য হচ্ছে এই যে, যেখানেই আশ্চর্য ব্যাপার, সেখানেই তোমরা? আমাদের এই নিত্য-দেখা একঘেয়ে পৃথিবীটাকে তোমরা ক্রমেই অসাধারণ আর বিচিত্র করে তুলছ!’
বোট ও স্টিমার তখন ছুটে চলেছে পুরোদমে-কেবল একদিকেই নদীর বনশ্যামল তটরেখা দেখা যাচ্ছে, অন্য তীর হারিয়ে গেছে প্রায় অসীমতার মধ্যেই৷
হঠাৎ কুমার দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ‘দূরে ওই সেই দ্বীপ দেখা যাচ্ছে!’
আর-সকলেও সাগ্রহে দাঁড়িয়ে উঠল৷ দূরে একটা গাছপালা-ভরা ভূমি জেগে উঠেছে বটে৷
বিমল খানিকক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘হ্যাঁ, কুমারের চোখ ঠিক দেখেছে৷’
ধীরে ধীরে দ্বীপটা স্পষ্টতর হয়ে উঠতে লাগল৷ কিন্তু বাহির থেকে সে-দ্বীপের মধ্যে কোনো নতুনত্বই আবিষ্কার করা গেল না-প্রবল হাওয়ায় গাছপালা দুলছে এবং নদীর জলে ঝিলমিল করছে তাদের ছায়া৷ কালকের রাতের সেই অমানুষিক কন্ঠস্বর আজ আর কারুকে ভয়াবহ অভ্যর্থনা করল না এবং বনজঙ্গলের উপরে তাল-গাছ-সমান উঁচু দেহ নিয়ে কোনো বিরাট দানবও আবির্ভুত হল না৷
বিনয়বাবু একটা দূরবিনের সাহায্যে দ্বীপটা পরীক্ষা করছিলেন৷ হঠাৎ তিনি চমকে উঠে দূরবিনটা বিমলের হাতে দিয়ে উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘দেখো বিমল, দেখো!’
দূরবিনটা তাড়াতাড়ি চোখে লাগিয়ে বিমল দেখল, দ্বীপের একটা উঁচু জমির উপরে একটি লোক পাথরে-তৈরি মূর্তির মতো স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে-যেন সে স্টিমারের দিকেই তাকিয়ে আছে নিষ্পলক নেত্রে৷ আজকেও তার ধবধবে সাদা লম্বা চুল, দাড়ি ও পায়ের জামাকাপড় লটপট করে হু-হু বাতাসে উড়ছে৷
দূরবিনটা নামিয়ে বিমল বলল, ‘ওই সেই দ্বীপবাসী বৃদ্ধ! এখানে যত রহস্যের সৃষ্টি বোধ হয় ওই লোকটির জন্যেই! . . . যাক, সব রহস্য পরিষ্কার হয়ে যেতে আর বেশি বিলম্ব নেই!’
নবম পরিচ্ছেদ – উড়ো বোট
দ্বীপ ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে৷
গেল বারে রাত-আঁধারে আর নানারকম অস্বাভাবিক ধ্বনি-প্রতিধ্বনির বিভীষিকার জন্যে এই অজানা দ্বীপটাকে যেমন রহস্যময় বলে মনে হয়েছিল, আজ তাকে দেখে বিমল ও কুমারের মনে তেমন কোনো ভাবেরই উদয় হল না৷
নীল আকাশের ছায়া-দোলানো, নদীর গান-জাগানো চপল জলের কোলে আজ এই সূর্যকরের আলো-আদর-মাখা সবুজসুন্দর দ্বীপটিকে মনে হতে লাগল ঠিক যেন কোন ভোরের-স্বপ্নে-দেখা পরিস্থানের মতো৷
গায়ক পাখিরা গাছের এ-ডালে বসে খানিক নেচে আবার ও-ডালে উড়ে গিয়ে বসে নাচ-গানে মেতে উঠছে, ছবিতে আঁকা শকুন্তলার তপোবনের হরিণের মতো দুটি ছোটো ছোটো হরিণ একজায়গায় চুপ করে বসে আছে একান্ত নির্ভয়ে এবং দ্বীপের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে দলে দলে বকেরা আকাশে দোলন্ত বেলের গোড়ের মতো৷
বিনয়বাবু ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘কী চমৎকার দ্বীপটা! যেন মুনিঋষির সাধনকুঞ্জ! এখানে ভয়ানক কিছু দেখবার আশাই করা যায় না!’
বিমল বলল, ‘দিনের আলো বড়ো কপট, ভয়াবহকে অনেক সময়ে সুন্দর করে দেখায়৷’
কুমার বলল, ‘বাইরের খোলস অনেক সময়ে চোখে ধাঁধা দেয়৷ সুন্দর মৌমাছিকে দেখলে কে বলবে যে তার ভিতরে বিষাক্ত হুল আছে!’
এমন সময়ে স্টিমার থেকে মেগাফোনে, ইনস্পেকটরের কন্ঠস্বর শোনা গেল-‘স্টিমার আর এগোতে পারবে না, এখানে জল বেশি নেই৷’
বিমল চেঁচিয়ে বলল, ‘বেশ, আর এগিয়ে যাবার দরকার নেই, এইখানেই নোঙর ফেলা যাক৷’
দ্বীপ সেখান থেকে একশো হাতের ভিতরেই৷
কমল বলল, ‘ওই ভদ্রলোক কিন্তু এখনও সেইভাবে সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছেন!’
কুমার বলল, ‘বোধ হয় আমরা কী করি তাই দেখছেন৷’
বিমল বলল, ‘কিংবা কী করে আমাদের তাড়ানো যায় তাই ভাবছেন৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু ওকে দেখলে তো আমার চেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে হয় না!’
বিমল বলল, ‘হ্যাঁ, দিনের বেলায় উনি এই দ্বীপের মতোই নিরীহ৷ কিন্তু রাত্রে বিপরীত মূর্তি ধারণ করেন৷ ….এইবার দ্বীপে নামবার ব্যবস্থা করা যাক, কী বলেন? স্টিমারের সঙ্গে দু-খানা বোট আছে, তাতে সিপাইরা আর ইনস্পেকটর থাকবেন৷ আমরা মোটরবোটেই যাব৷’
সবাই যখন দ্বীপের উপরে গিয়ে উঠল, দুপুরের রোদ তখন অত্যন্ত উজ্জ্বল-অধিকাংশ ঝোপঝাপের ভিতরে পর্যন্ত নজর চলে৷
দ্বীপের মধ্যে কোনোরকম নূতনত্ব নেই-চারিদিকে গাছপালা জঙ্গল ঝোপঝাপ, মাঝে মাঝে আঁকাবাঁকা পায়ে-চলা পথ, মাঝে মাঝে ছোটো-বড়ো মাঠ৷
বিমল বলল, ‘ইনস্পেকটরবাবু, আপনার সেপাইদের বন্দুক তৈরি রাখতে বলুন৷’
ইনস্পেকটরবাবু হেসে বললেন, ‘যত সব গাঁজাখোরের কথা শুনে আমরা এসেছি বটে, কিন্তু এখানে তো ভয় পাবার কিছুই দেখছি না৷ কোথায় মশাই আপনাদের কুম্ভকর্ণ? এখনও ঘুমোচ্ছে নাকি?’
বিমল গম্ভীর স্বরে বলল, ‘হতে পারে৷ হয়তো শেষ পর্যন্ত আমরা তার টিকিটিও আবিষ্কার করতে পারব না৷’
‘তাহলে এখানে এত তোড়জোড় করে এসে কী লাভ হল?’
‘আমরা এসেছি জনরব সত্য কি না জানবার জন্যে৷ জনরব যদি মিথ্যে হয়, তবে ফিরে গিয়ে সেই রিপোর্টই দেবেন৷’
‘জনরব কী মশাই? কুম্ভকর্ণকে তো আপনারাও দেখেছেন বললেন৷ তারপর হাতির মতো বড়ো ডালকুত্তা, বাঘের মতো বড়ো বিড়াল, কত আজগুবি গল্পই যে শুনলাম!’
‘কাল রাতে নদীর মাঝখানে যে অমানুষিক কন্ঠস্বর আপনারা শুনেছেন সেটাও তো আমাদের বানানো নয়৷’
ইনস্পেকটর একটু যেন শিউরে উঠলেন এবং আর কোনো কথা বললেন না৷
যে পথ ধরে সবাই চলেছে, হঠাৎ তার মোড় ফিরেই দেখা গেল, সামনেই একখানা বাংলোর মতো ছোটো একতলা মেটে বাড়ি, উপরে পাতার ছাউনি৷
বারান্দায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছেন সেই বুড়ো ভদ্রলোক৷
সকলে যখন বাড়ির কাছে গিয়ে উপস্থিত হল, বুড়ো ভদ্রলোকটি দুই পা এগিয়ে এলেন৷ একবার সকলের মুখের উপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে শান্ত হাসি হাসতে হাসতে বললেন, ‘এত সেপাই-সান্ত্রি নিয়ে আপনারা কোন রাজ্য জয় করতে যাচ্ছেন?’
বিমল এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আমরা দিগ্বিজয়ে বেরোইনি৷ খালি এই দ্বীপটা খুঁজতে এসেছি৷’
‘কেন?’
‘এখানে এমন কিছু দেখেছি যা অন্য কোথাও দেখা যায় না৷’
‘বলেন কী মশাই? আমি এখানে বাস করি, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছুই তো দেখিনি!’
এমন সময়ে ইনস্পেকটর তাঁর সমুখে গিয়ে বললেন, ‘আপনার নাম কী?’
‘ধরণীকুমার মজুমদার৷’
‘এই নির্জন দ্বীপে আপনি কী করেন?’
‘আমি সন্ন্যাসী নই বটে, কিন্তু সংসার ত্যাগ করেছি৷ এখানে বসে পরকালের চিন্তা করি৷’
‘আপনার সঙ্গে আর কে আছে?’
‘একজন পুরোনো চাকর৷’
‘কোথায় সে?’
ধরণী মুখ ফিরিয়ে ডাকলেন, ‘হরিদাস!’
ঘরের ভিতর থেকে আর একটি অতিশয় নিরীহের মতো দেখতে প্রাচীন লোক বেরিয়ে এল৷
ইনস্পেকটর তাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে বললেন, ‘ধরণীবাবু, আপনার বাড়ির ভিতরটা আমরা একবার দেখব৷’
‘স্বচ্ছন্দে৷’
কিন্তু সেখানেও নতুন কিছু আবিষ্কার করা গেল না৷ আসবাবপত্র খুবই কম৷
বিমল সুধোল, ‘আপনার একখানা মোটরবোট আছে না?’
ধরণী বললেন, ‘আছে৷ দেখতে চান তো ওইদিকে নদীর ধারে গেলেই দেখতে পাবেন৷’
বিমল বলল, ‘না৷ আজ অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে৷ কাল আমরা সারা দ্বীপটা একবার ভালো করে ঘুরে দেখব, আশা করি আপনি আমাদের সাহায্য করবেন?’
‘নিশ্চয়ই করব! কিন্তু আগে থাকতেই বলে রাখছি, এখানে বনজঙ্গল ছাড়া দেখবার কিছুই নেই৷’
বিমল তাঁর কাছে গিয়ে খুব চুপিচুপি সুধোল, ‘বনজঙ্গলের ভিতরে গিয়ে দু-একটা হাতির মতো বড়ো ডালকুত্তা আর বাঘের মতো বড়ো বেড়ালও খুঁজে পাওয়া যাবে না?’
ধরণী যেন কিছুতেই বুঝতে না পেরে বিমলের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন৷
‘আর তালগাছ-সমান উঁচু মানুষ?’
‘আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন?’ বলেই ধরণী হা-হা করে অট্টহাস্য করে উঠলেন৷ সে অট্টহাস্য বিমল ও কুমার আগেই শুনেছিল-গেল বারে দ্বীপের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার সময়ে৷
কমল সেদিন রামহরিকে ধরে বসেছিল, তাকে একটা নতুন রান্না খাওয়াতে হবে!
রামহরি যত বলে, ‘সুমুদ্দুরের জলে ডোঙায় বসে কি নতুন রান্না খাওয়ানো চলে ভাই?’
কমল ততই বলে, ‘পাকা-রাঁধিয়ে আকাশে উড়েও হাতের বাহাদুরি দেখাতে পারে! রামহরি, তুমি তাহলে কোনো কর্মের নও!’
তার রন্ধন-নিপুণতার উপরে কেউ কৌতুকছলে ঠাট্টা করলেও রামহরি সহ্য করতে পারত না৷ অতএব সবাই যখন গিয়েছিল দ্বীপে বেড়াতে, রামহরি তখন ছিল নৌকোয় বসে মাছ ধরতে ব্যস্ত৷ এবং আজ রাত্রে সে যে নতুন রান্না করল ও আর-সব্বাইকে খাওয়াল, তার নাম রেখেছিল ‘মুখবন্ধ’৷
রান্নাটি কমলের এতই ভালো লেগেছিল যে, মনের ভাব আর প্রয়োগ করতে পারল না৷
বিনয়বাবু প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে মস্ত এক বক্তৃতা দিয়ে শেষটা বললেন, ‘এটা কোনদেশি রান্না বিমল?’
বিমল বলল, ‘তা আমি জানি না৷ তবে বিলিতি মতে একে ‘মাছের রোস্ট’ বলেও ডাকা যায়৷’
আহারাদির পর যখন শয়নের ব্যবস্থা হচ্ছে, তখন কুমার বলল, ‘দ্বীপটা স্বচক্ষে দেখে আমি কিন্তু হতাশ হয়েছি৷ মনে হচ্ছে আমাদের খালি কাদা ঘেঁটে মরাই সার হল!’
বিমল বলল, ‘আমি কিন্তু এখনও হতাশ হইনি৷ আমি কালকের জন্যে অপেক্ষা করছি৷ হয়তো নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারব৷’
বিনয়বাবু সারাদিন দ্বীপের কথা নিয়ে কোনো মত প্রকাশ করেননি৷ এখন তিনি হঠাৎ সবাইকে বিস্মিত করে বললেন, ‘দ্বীপে গিয়ে আমি কিন্তু একটা আশ্চর্য আবিষ্কার করেছি৷’
কুমার বলল, ‘আপনি! কী আবিষ্কার?’
‘ধরণীবাবুর বাংলোর পিছনে আছে একটা জলাভূমির মতো জায়গা৷ সেখানে ভিজে মাটির উপরে আমি এমন কতকগুলো পায়ের দাগ দেখেছি, যা মানুষের পায়ের দাগের মতোই, কিন্তু মানুষের পায়ের দাগের চেয়ে বারো-তেরো গুণ বেশি বড়ো৷’
কমল সবিস্ময়ে বলল, ‘কিন্তু আপনি এতক্ষণ তো এ-কথা বলেননি!’
বিমল হাসতে হাসতে বলল, ‘বিনয়বাবু বলেননি, আমিও বলিনি৷ সে-পায়ের দাগগুলো আমিও দেখেছি৷’ -বলেই সে একখানা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল এবং বিনয়বাবুও তার দৃষ্টান্তের অনুকরণ করলেন৷
কুমার ও কমল একবার পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল৷ তারপর যে-যার জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল৷
ঠিক সেই সময়েই সকলকার কানে অদ্ভুত স্বর জেগে উঠল :
‘ঘোঁ-ঘট ঘট,
ঘোঁ-ঘট ঘট!
ঘোঁ-ঘট ঘট,
চল রে চল,
চটপট চল
দি চম্পট!’
সকলেই সচমকে ধড়মড় করে আবার উঠে বসল৷ গতকল্য গভীর রাত্রে নদীর বক্ষে এই অমানুষিক কন্ঠস্বরই শোনা গিয়েছিল৷
সকলেই বোটের ধারে ঝুঁকে পড়ে মুখ বাড়াল৷ কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, কিছুই দেখা গেল না এবং কিছুই দেখবার উপায় নেই৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘বিমল, আমরা মঙ্গলগ্রহেও গিয়েছি, কিন্তু সেখানেও এমন আশ্চর্য কন্ঠস্বর শুনিনি!’
বিমল টর্চের কল টিপে আলো জ্বেলে বলল, ‘নদীর জল একজায়গায় খুব তোলপাড় হচ্ছে,-যেন কেউ ওখানে বিরাট দেহ নিয়ে সবে ডুব দিয়েছে৷ কিন্তু আর কিছুই দেখা যায় না৷’
এমন সময়ে খানিক তফাতে উপর থেকে আবার অন্য একটা কন্ঠস্বর শোনা গেল :
‘কিচির-মিচির কিচির-মিচির
কচ মচ-মচ কচ মচ-মচ!
বুকের কাছে করছে কেমন
খচ মচ-খচ খচ মচ-খচ!
মানুষ-ভূতে কালকে পাবে,
কলকাতা কি শালকে যাবে,
কাটবে মগজ চালিয়ে ছুরি
কচু-কাটা কচ কচ-কচ!’
টর্চের আলো শূন্যের অন্ধকার ফুঁড়ে খুঁজে পেল খালি শূন্যতাই৷
কমল উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘বিংশ শতাব্দীতেও তাহলে দৈববাণী হয়?’
কুমার একদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলল, ‘কিন্তু এ দৈববাণীর জন্ম বোধ হয় গাছগুলোর ভিতর থেকেই৷’
সকলে দেখল, নদীর জলের উপরে ঘন শাখাপল্লব নিয়ে একটা মস্তবড়ো গাছ ঝুঁকে পড়েছে এবং তারই ডালপালাগুলো সশব্দে দুলে দুলে উঠছে-যেন তার ভিতরে কোনো জীব লুকিয়ে এদিকে-ওদিকে আনাগোনা করছে৷
রামহরি বন্দুক নিয়ে বলল, ‘খোকাবাবু, আন্দাজে আন্দাজে একটা গুলি ছুড়ব নাকি?’
বিমল বলল, ‘না রামহরি, কেউ তো এখনও আমাদের সঙ্গে কোনো শত্রুতা করেনি! আমরাই বা আগে থাকতে অস্ত্র ব্যবহার করব কেন?’
এমন সময়েই স্টিমারের সার্চলাইট অন্ধকারের উপর দিয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে নদীর জলের তোলপাড় শব্দ এবং গাছের ডালপালার মড়মড়ানি একেবারে থেমে গেল৷
কুমার বলল, ‘এখানে যে-সব কবি কবিতা শোনায়, তারা সশরীরে দেখা দিতে রাজি নয় দেখছি!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু কে ওরা? আমাদের ভয় দেখাচ্ছে, না সাবধান করে দিচ্ছে?’
স্টিমার থেকে চেঁচিয়ে ইনস্পেকটর বললেন, ‘এ-সব কী কাণ্ড মশাই!’
বিমল বলল, ‘যা শুনছেন আর দেখছেন, তা কি গাঁজাখোরের কল্পনা বলে মনে হচ্ছে?’
‘কিন্তু কেউ বোধ হয় ভয় দেখাবার জন্যে আমাদের ঠাট্টা করছে! এটা তো আর সত্যযুগ নয় যে, জল আর গাছ কথা কইবে!’
‘কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ঠাট্টা করছে কে?’
‘নিশ্চয় সেই বুড়ো জাদুকরটা! আমি কালই ধরণীকে গ্রেপ্তার করব!’
‘কী অপরাধে? সে তো এখনও আমাদের কোনো অনিষ্ট করেনি!’
‘সরকারি লোকেদের ভয় দেখানোর মজাটা তাকে টের পাইয়ে দেব!’
দ্বীপের ভিতর থেকে হা-হা-হা-হা করে কে ভীষণ অট্টহাসি হেসে উঠল৷ এ সেই হাসি,-যে হাসি সবাই আজই ধরণীর কন্ঠে শুনে এসেছে, কিন্তু এখন তার চেয়ে ঢের বেশি তীব্র ও ভীতিপ্রদ৷
ইনস্পেকটর খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘সেপাই, সেপাই! সবাই বন্দুক নাও! বোট ভাসাও! আজই আমি বুড়োকে গ্রেপ্তার করব!’
বিমল তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না, আজ আর গোলমালে কাজ নেই৷ আজ খালি দেখুন, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়৷ নইলে সব পণ্ড হবে৷’
অট্টহাসি থামল না,-কিন্তু ধীরে ধীরে দূরে চলে যেতে লাগল৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘ধরণী পাগল নয় তো?’
অনেক দূর থেকে যথাক্রমে নদীর জলে ও গাছের উপরে উঠছে সেই আশ্চর্য ঘোঁ-ঘট ঘট ও কিচির-মিচির শব্দ৷
কুমার বলল, ‘ওই হাসি আর শব্দ দুটো যখন একসঙ্গে হচ্ছে, তখন বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, এখানে তিনটে আলাদা আলাদা জীব আছে৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘তাহলে এই তৃতীয় জীবটি কে? দ্বীপে গিয়ে আমরা তো কেবল ধরণী আর তার চাকর হরিদাসের দেখা পেয়েছি৷’
বিমল ভাবতে ভাবতে বলল, ‘কুমার তুমি ঠিক ধরেছ৷ হ্যাঁ বিনয়বাবু, এই তৃতীয় জীবটি কে, এখন সেইটেই আমাদের আবিষ্কার করতে হবে৷’
ক্রমে সমস্ত কন্ঠস্বর থেমে গেল, নির্জনতা সজাগ হয়ে উঠল এবং রাত্রির অন্ধ স্তব্ধতাকে সংগীতময় করে তুলতে লাগল সাগরসঙ্গমে উচ্ছ্বসিত নদীর কলধ্বনি৷ …সে অশ্রান্ত ধ্বনি যেন সুদূর অসীমের স্মৃতিকে কানের কাছে ডেকে আনে৷ সে ধ্বনি যেন নিকটের যা-কিছুকে সুদূর অসীমতায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়৷
বিমল বাঘাকে বোটের বাইরে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘যা বাঘা, বাইরে যা৷ আমরা এখন একটু ঘুমোব, তুই পাহারা দে৷’
বাঘা যেন বিমলের কথা বুঝতে পারল৷ সে বোটের ধারে গিয়ে কান খাড়া করে বসে রইল৷
বোটের তলায় নদীর করাঘাতের শব্দ শুনতে শুনতে সবাই একে একে ঘুমিয়ে পড়ল৷
এমনকী শেষটা বাঘার চোখেও ঢুল এল৷
গভীরা নিশীথিনীর কালো শাড়ির আঁচল সরিয়ে বেরিয়ে এল যেন রুগণ চাঁদের অত্যন্ত হলদে মুখ৷ তাকে এই বিজনতার মধ্যে দেখলে ভয় হয়, চিতার পাশে খাটে-শোয়ানো মড়ার মুখ মনে পড়ে যায়৷
আচম্বিতে বাঘা ভয়ানক জোরে চেঁচিয়ে উঠল এবং কমল জেগে ধড়মড় করে উঠে বসল৷
কমলের মনে হল, সে বোটের ভিতরে আছে বটে, কিন্তু বোট যেন আর নদীগর্ভে নেই! কী অদ্ভুত অনুভূতি!
হঠাৎ বাঘা ভয় পেয়ে বোটের উপর থেকে লাফ মারল৷ অনেক উঁচু থেকে জলে লাফিয়ে পড়লে যে-রকম শব্দ হয়, সেইরকম একটা শব্দ হল৷
ইতিমধ্যে আর সকলেও জেগে উঠল৷ তাদেরও মনে হল তারাও যেন কারুর মাথার উপরে ঝাঁকার ভিতরে মোরগের পালের মতো বসে রয়েছে৷
বিমল তাড়াতাড়ি কামরার বাইরে মুখ বাড়িয়ে অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে বিস্মিত চোখে দেখল, তারা দ্বীপের গাছের সারের চেয়েও আরও উপরে উঠেছে এবং অনেক নীচে আলো-আঁধারির মধ্যে চিকচিক করছে নদীর জল৷
একটা নিশ্বাস ফেলে, কঠিন হাস্য করে বিমল বলল, ‘বোধ হয় সেই কুম্ভকর্ণই বোটসুদ্ধ আমাদের মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে!’
সেই রুগ্ন চাঁদের হলদে মুখ৷ মিটমিটে আলোতে পৃথিবীর কিছুই ভালো করে নজরে পড়ে না৷ বিমল বোটের তলায় উঁকিঝুঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না৷ বোটের তলায় রয়েছে কেবলই অন্ধকার-কষ্টিপাথরের মতো কালো আর নিরেট৷
বোটের ভিতরে আর সবাই তখন নির্বাক বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে বসে আছে, বোধ হয় তাদের মাথার ভিতরে তখনও বিমলের সেই অসম্ভব কথাগুলোই বারংবার ঘোরাফেরা করছে-‘সেই কুম্ভকর্ণই বোটসুদ্ধ আমাদের মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে!’
বোটের নীচের দিকটা দেখবার ব্যর্থ চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে বিমল আবার বলল, ‘না, আর কোনো সন্দেহ নেই৷ কুম্ভকর্ণই আজ ঝাঁকামুটে হয়েছে! তার ঝাঁকা হয়েছে এই বোট, আর বোটের মধ্যে আছি আমরা!’
বিনয়বাবুর মুখে অস্ফুট স্বর শোনা গেল-‘অসম্ভব!’
বিমল শুকনো হাসি হেসে বলল, ‘হ্যাঁ অসম্ভবই বটে, কিন্তু অসম্ভবের দেশে অসম্ভবও সম্ভব হয়৷ জলে সাঁতার কাটা যার একমাত্র কর্তব্য, সেই বোট পাখিও নয়, এরোপ্লেনও নয় যে শূন্য দিয়ে উড়ে যাবে৷ বিনয়বাবু, চেয়ে দেখুন-নদীর জল এখন কত দূরে!’
সকলে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখল, নদীর জলে আলোর ঝিকিমিকি বহু দূরে সরে গিয়েছে এবং ক্রমে আরও দূরে সরে যাচ্ছে৷ জলতরঙ্গের কলকল্লোলও আর শোনা যায় না৷
বিমল বলল, ‘আমাদের মাথায় নিয়ে কালাপাহাড় এখন জমির উপর দিয়ে হাঁটছে৷’
বিনয়বাবু উৎকন্ঠিত স্বরে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছে সে!’
‘এর উত্তর সেই-ই জানে৷ কলকাতায় ঝাঁকায় চড়ে রামপাখিরা আসে আমাদের জন্যে৷ এখানে ঝাঁকায় চড়ে আমরা যাচ্ছি হয়তো ধরণীর বাসায়!’
এতক্ষণে রামহরির হুঁস হল৷ সে হাউমাউ করে বলে উঠল, ‘ও খোকাবাবু! ওই ধরণী কি পিচাশ? আমাদের কেটে খানা খাবে নাকি?’
কুমার বলে উঠল, ‘বন্দুক নাও বিমল! বোটের তলার দিকে গুলিবৃষ্টি করো!’
বোটের তলায় কে আছে৷ ভগবানই জানেন৷ কিন্তু যে-জীবই থাকুক, সে যে কুমারের কথা শুনতে পেল ও বুঝতে পারল, তৎক্ষণাৎ তার প্রমাণ পাওয়া গেল৷ কারণ কুমারের মুখের কথা শেষ হতে-না-হতেই বোটখানা ধরে সে এমন ঘন ঘন বিষম ঝাঁকুনি দিতে লাগল যে, সকলেই তার ভিতরে চারিদিকে ছিটকে পড়ল৷ সে ভয়ানক ঝাঁকুনি আর থামে না-সকলেরই অবস্থা হল কুলোর মধ্যে ফুটকড়াইয়ের মতো, গতর গুঁড়ো হয়ে যাবার জোগাড় আর কী! ঝাঁকুনি যখন থামল, বোটের ভিতরে সবাই তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে৷
. . . . . . . . .
একে একে যখন তাদের জ্ঞান হল, তখন রাত কি দিন প্রথমে তা বোঝা গেল না৷ চারিদিকে না-আলো না-অন্ধকার,-সন্ধ্যার মুখেই পৃথিবীকে দেখতে হয় এইরকম আবছায়া মায়া-মাখা, রহস্যময়৷
সামনেই দেখা যাচ্ছে একটা দরজার মতো, বিমলের চোখ সেই ফাঁকা জায়গাটুকু দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল-কিন্তু সেখানেও আলো খুব স্পষ্ট নয়৷
বিমল ওঠবার চেষ্টা করল, পারল না৷ তার সর্বাঙ্গ দড়ি দিয়ে বাঁধা৷
কুমার বলল, ‘বন্ধু, আমরা বন্দি!’
বিমল বলল, ‘হুঁ! কিন্তু কার বন্দি-ধরণীর না কুম্ভকর্ণের?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘বোধ হয় ধরণীর৷ বিমল, ভালো করে তাকালেই বুঝতে পারবে, আমরা একটা অন্ধকার ঘরে বন্দি হয়ে আছি৷ এর দরজাটা সাধারণ মানুষ ঢোকবারই উপযোগী, এর ভিতর দিয়ে তোমাদের ওই কুম্ভকর্ণ কিছুতেই দেহ গলাতে পারবে না৷ সুতরাং যে আমাদের এ ঘরে এনে রেখেছে তার দেহ তোমার-আমার চেড়ে বড়ো হতে পারে না৷’
বিমল বলল, ‘কিন্তু আমরা কোথায় আছি? বাহির থেকে গাছপালার আওয়াজ আসছে-একটা কাকও কা-কা করছে৷ মনে হচ্ছে এখন দিনের বেলা৷ কিন্তু আলো এত কম কেন?’
কমল বলল, ‘বাইরে যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেখানে আলো আসছে যেন উপর থেকেই৷ আমরা বোধ হয় কোনো উঠানওয়ালা বাড়ির একতলার ঘরে বন্দি হয়ে আছি৷’
বিমল বলল, ‘কিন্তু দ্বীপে এমন কোনো উঁচু বাড়ি থাকলে কালকেই আমাদের নজরে পড়ত৷ . . . বিনয়বাবু, আমরা বোধ হয় জমির নীচে কোন পাতালপুরীতে বন্দি হয়েছি!’
হঠাৎ রামহরি আর্তস্বরে বলে উঠল, ‘ওই৷ আবার সেই শব্দ-ভূত!’
সকলে কান পেতে শুনল, বাইরে আবার কোথায় সেই পরিচিত কিচির-মিচির কিচির-মিচির শব্দ হচ্ছে-সঙ্গে সঙ্গে ডাল-পাতা নড়ে ওঠারও শব্দ; কে যেন গাছের এ-ডাল থেকে ও-ডালে লাফালাফি করছে৷
তারপরেই সেই অদ্ভুত কন্ঠস্বর শোনা গেল-
‘নেইকো হেথায় রম্ভা-টম্ভা
আছে অষ্টরম্ভা
লম্বা লম্বা লম্ফ মেরে
জলদি দে রে লম্বা৷
হুমড়োমুখো দুমড়ো বিড়াল,
আকাশমুখো দৈত্য,
দেখলে তাদের চিত্ত কাঁপায়
হিমালয়ের শৈত্য৷
মুখ বাড়িয়ে কুত্তা ধরে
বটের ডালের পক্ষী,
পালাও ভায়া! কেমন করে
সইবে এ-সব ঝক্কি৷’
বিমল অভিভূত স্বরে বলল, ‘সেই কন্ঠস্বর! আবার আমাদের সাবধান করে দিচ্ছে৷’
কুমার বলল, ‘অতিকায় বিড়াল, কুকুর, দৈত্য-সকলকার কথাই ও বলছে৷ কে ও, বিমল? অমন করে লুকিয়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে কেন, বিপদের আগেই সাবধান করে দেয় কেন, আর কবিতাতেই বা কথা কয় কেন?’
বিমল বলল, ‘আর-একটা কন্ঠস্বরও আমরা শুনেছি-নদীর জলে সেই ভীষণ অমানুষিক কন্ঠস্বর৷ এখানে জল নেই বলেই বোধ হয় সেই গলার আওয়াজটা আর শোনা যাচ্ছে না৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘চুপ চুপ, ওই শোনো৷’
আবার শব্দ হতে লাগল-কিচির-মিচির৷ আবার গাছের ডালে ডালে লাফালাফির শব্দ৷ কিচির-মিচির শব্দ আরও কাছে এগিয়ে এল৷ তারপর শোনা গেল, অত্যন্ত দুঃখে যাতনায় যেন ভেঙে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে কে বলছে-
‘অনেক দিনের রূপকথা ভাই,
বহুকালের গল্প-
ছিলাম যেন মাটির মানুষ,
সুখ ছিল না অল্প!
রাঙা রাঙা খোকা-খুকি
খেলত আমার বক্ষে,
টুকটুকে মোর বউটি সদাই
হাসত মুখে-চক্ষে!
আজ অর্দৃষ্ট শক্ত করে
আমায় যখন বাঁধছে-
হায়রে তারা কোথায় বসে
আমার তরেই কাঁদছে!’
হঠাৎ একটা নতুন কন্ঠে উচ্চস্বরে শোনা গেল, ‘হা, হা, হা, হা! কী হে কবি, এখনও কবিতা ভোলোনি? হা হা হা হা!’ এ ধরণীর-হাসি৷
কবিতা আর শোনা গেল না . . . খালি গাছের ডালপাতার শব্দ হল৷ তারপরেই আর এক শব্দ৷ কে যেন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছে৷ বিমল ও কুমার পরস্পরের মুখের পানে তাকিয়ে দেখল৷ দরজার কাছটা অন্ধকার করে একটা মূর্তি এসে দাঁড়াল-ধরণী৷
খানিকক্ষণ সেইখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ধরণী ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল৷ তারপর সহাস্যে বলল, ‘এই যে বন্ধুগণ! ধরণীর শ্রেষ্ঠ শয্যা ভূমিশয্যায় শুয়ে আছ, আশা করি বিশেষ কোনো কষ্ট হচ্ছে না?’ কেউ কোনো জবাব দিল না৷ ধরণী তেমনি হাসতে হাসতে বলল, ‘হাতির মতো বড়ো ডালকুত্তা দেখতে চেয়েছিলে, শীঘ্রই তাকে দেখতে পাবে৷ আর বাঘের মতো বড়ো বিড়ালকে তো তোমরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছ৷ আর তালগাছের মতন উঁচু মানুষকে কাল অন্ধকারে তোমরা ভালো করে দেখতে পাওনি-নয়?’
বিমল বলল, ‘কে সে?’
ধরণী বলল, ‘দেখছি এখনও তোমার কৌতূহল দূর হয়নি৷ সে কে জানো? আমার চাকর হরিদাসকে কাল দেখছে তো? সে তার ছোটো ভাই রামদাস-তোমরা যার নাম রেখেছ কুম্ভকর্ণ৷’
বিমল সবিস্ময়ে থেমে থেমে বলল, ‘হরিদাসের ছোটো ভাই রামদাস?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কুম্ভকর্ণ নয়, আর কেউ নয়, হরিদাসের ছোটো ভাই রামদাস৷ ভাবছ, কেমন করে রামদাস এত বড়ো হল? হা, হা, হা, হা!’-তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে অত্যন্ত কঠোর ও গম্ভীর স্বরে ধরণী বলল, ‘কেন তোমরা আমাকে জ্বালাতন করবার জন্যে এখানে এসেছ? মূর্খ মানুষদের মুখ বন্ধ করবার জন্যে আমি এত দূরে পৃথিবীর একপ্রান্তে এসে অজ্ঞাতবাস করছি, কিন্তু এখানেও তোমাদের মূর্খতা আর অন্যায় কৌতূহল থেকে মুক্তি নেই? যতসব তুচ্ছ জীব, কতটুকু শক্তি তোমাদের, এসেছ আমার সাধনায় বাধা দিতে? জানো, আমি একটা আঙুল নাড়লে তোমরা এখনই ধুলোয় মিশে যাবে?’-ধরণী জ্বলন্ত চক্ষে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল অতিশয় উত্তেজিতভাবে৷
বিনয়বাবু শান্ত কন্ঠে বললেন, ‘ধরণীবাবু, আমাদের আপনার শত্রু বলেই বা ধরে নিচ্ছেন কেন? আমরা তো আপনার সঙ্গে শত্রুতা করবার জন্যে এখানে আসিনি, আমরা এসেছি শুধু এখানকার অদ্ভুত ঘটনাগুলো স্বচক্ষে দেখবার জন্যে৷’
ধরণী আরও বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে আরও বেশি চেঁচিয়ে বলল, ‘দেখবার জন্যে, না মরবার জন্যে? তোমরা আমার বিড়ালকে হত্যা করেছ, তোমাদের আমি ক্ষমা করব না!’
বিমল বলল, ‘আপনার বিড়ালকে মেরেছি একলা আমি৷ আমার অপরাধে ওঁরা কেন শাস্তি পাবেন? ওঁদের ছেড়ে দিন৷’
‘ছেড়ে দেব? হা হা হা হা! ছেড়ে দেবই বটে! ওদের ছেড়ে দিই, আর ওরা দেশে গিয়ে সারা পৃথিবীর লোককে নিয়ে আবার এখানে ফিরে আসুক! সবাই আমার গুপ্তকথা জানুক! জানো বাপু, যে আমার গুপ্তকথা জেনেছে তার আর মুক্তি নেই!’
‘আপনার কী গুপ্তকথা আমরা জানতে পেরেছি?’
‘কিছু-কিছু জানতে পেরেছ বই কী৷ আসল কথা এখনও জানতে পারোনি বটে, তবে তোমাদের কাছে তা বলতে এখন আমার আর আপত্তিও নেই৷ তোমরা তো আর দেশে ফিরে যাবে না!’
ঘরের কোণে একটা টুল ছিল, ধরণী তার উপরে গিয়ে বসল৷ তারপর বলতে লাগল, ‘এই নির্জনে একলা বসে আমি সাধনা করি৷ কী সাধনা করি জানো? পুরাতন পৃথিবীকে নূতন রূপ, নূতন শক্তি দেবার সাধনা৷ মানুষ বড়ো ছোট্ট, বড়ো দুর্বল জীব৷ তার মস্তিষ্ক অন্য সব জীবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, কিন্তু দেহ হিসেবে তার চেয়ে বৃহৎ আর বলবান প্রাণী আছে অনেক৷ কাজেই মানুষকে কী করে আরও বড়ো ও শক্তিমান করে তোলা যায় প্রথমে সেইটেই হল আমার ধ্যানধারণা৷ কেমন করে সে ধ্যানধারণা সফল হল, তোমাদের কাছে সে-কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলে লাভ নেই৷ কারণ সাধারণ মানুষের গোবরভরা মাথায় তা ঢুকবে না৷ তবে সামান্য দু-একটা ইঙ্গিত দিচ্ছি শোনো৷ Glands বা গ্রন্থিদের নাম শুনেছ তো! এই গ্রন্থিদের রসেই মানুষের দেহ টিকে থাকে৷ গুটি পাঁচেক গ্রন্থি দেহের ভিতর রস সঞ্চার করে; আর তাদের মধ্যে প্রধান তিনটি গ্রন্থির নাম হচ্ছে Thyroid, Adrenal ও Pituitary. প্রথমটির অবস্থান মানুষের কন্ঠে, দ্বিতীয়টির মূত্রাশয়ে আর তৃতীয়টির মস্তিষ্কে৷ এইসব গ্রন্থির হের-ফেরে মানুষের দেহের অদল-বদল হয়৷ ধরো Thyroid গ্রন্থির কথা৷ যে-শিশুর দেহে এই গ্রন্থি বিকৃত অবস্থায় থাকে-‘
বিনয়বাবু ধরণীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,-‘তার মস্তিষ্ক আর কঙ্কালের বাড় বন্ধ হয়ে যায়৷ ত্রিশ বছর বয়সেও তার দেহ আর বুদ্ধি হয় খোকারই মতন৷ আমি এ সব জানি ধরণীবাবু৷ আবার Pituitary গ্রন্থি অতিরিক্ত রস ঢাললে মানুষের দেহের বাড়ও অতিরিক্ত রকম হয়ে ওঠে-কেউ হয় আশ্চর্যরকম মোটা, আবার কেউ বা হয় আট-দশ ফুট লম্বা৷ গ্রন্থি নিয়ে মিছামিছি লেকচার না দিয়ে আপনি কাজের কথা বলুন, -যতটা ভাবছেন আমরা ততটা মূর্খ নই!’
ধরণী একটু থতমত খেয়ে অল্পক্ষণ বিনয়বাবুর মুখের দিয়ে তাকিয়ে রইল৷ তারপর বলল, ‘তাহলে তোমাদের ঘটে একটু-আধটু বুদ্ধি আছে দেখছি! তবে আমার পরীক্ষার আসল পদ্ধতিটা তোমাদের কাছে আর খুলে বলা হবে না৷ যদিও ওই দেহ নিয়ে তোমরা আর এ-ঘরের বাইরে যেতে পারবে না, তবু সাবধানের মার নেই৷’
কুমার বলল, ‘দেহ নিয়ে বাইরে বেরোতে পারব না! তার মানে?’
ধরণী হেসে উঠে বলল, ‘মানে? মানে নিশ্চয়ই একটা আছে৷ হ্যাঁ, শীঘ্রই তোমাদের চেতনা থাকবে বটে, কিন্তু তোমাদের দেহগুলো পঞ্চভূতে মিশে যাবে৷’
সকলে মহা বিস্ময়ে এই ধাঁধার কথা ভাবতে লাগল! চেতনা থাকবে, কিন্তু দেহ থাকবে না? আশ্চর্য! ভয়ানকও বটে!
ধরণী বলল, ‘তারপর শোনো৷ আমার পরীক্ষাপদ্ধতির কথা আর বলব না বটে, কিন্তু পরীক্ষার ফলের কথা তোমাদের কাছে বলতে ক্ষতি নেই৷ আমি এমন সব বিশেষ ঔষধ বা খাবার আবিষ্কার করেছি, দ্রব্যগুণে যা গ্রন্থিদের রস উৎপাদনের ক্ষমতা কল্পনাতীতরূপে বাড়িয়ে তোলে৷ ওই আবিষ্কারের দৌলতে আমি এখন মানব-দানব সৃষ্টি করতে পারি৷’
বিমল বলল, ‘যেমন হরিদাসের ভাই রামদাস?’
‘হ্যাঁ৷ রামদাস জন্মাবার পর থেকেই মানুষ হয়েছে আমার আবিষ্কৃত খাবার খেয়ে৷ সে যখন তিন মাসের শিশু, তখনই তার দেহ লম্বায় হয়ে উঠেছিল তিন ফুট৷ তার অতি বাড় দেখে পাড়ার লোক এমন কৌতূহলী হয়ে উঠল যে আমাকে এই নির্জন দ্বীপে পালিয়ে আসতে হল৷ কেবল রামদাস নয়, একটা বিড়াল ও একটা কুকুরকে আমি আমার খাবার খাইয়ে বাঘ আর হাতির মতো বড়ো করে তুলেছি৷ এতে অবাক হবার কিছুই নেই৷ আদিম যুগের হাতি, বাঘ, সিংহ আর ষাঁড়রা এখনকার চেয়ে ঢের বড়ো হত কেন? কোমোডোর গোসাপরা এখনও বড়ো-বড়ো কুমিরেরও চেয়ে মস্ত হয় কেন? কেবল ওই গ্রন্থির অতিরিক্ত রসের মহিমায়৷ এদিকে আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে৷ আমি এখন সুদিনের অপেক্ষায় বসে আছি৷’
বিনয়বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কীসের সুদিন?’
ধরণী বিকট উল্লাসে চিৎকার করে বলল, ‘আমি এই ক্ষুদ্র দুর্বল মানুষের পৃথিবী জয় করব! আর বছর-বারো পরে আমার দানববাহিনী নিয়ে তোমাদের মতো জ্যান্ত পুতুলের খেলাঘর আক্রমণ করব, ধীরে ধীরে একালের সমস্ত মানুষজাতিকে লুপ্ত করে দিয়ে দুনিয়ার সর্বশক্তিমান সম্রাট হয়ে নূতন এক মহামানবের পৃথিবী গড়ে তুলব! সে পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ হবে প্রায় কলকাতার মনুমেন্টের মতন উঁচু, আর সেখানকার বড়ো বড়ো অট্টালিকা উঁচু হবে দার্জিলিং পাহাড়ের সমান! আমার তৈরি মানুষরা তিন-চারবার পা ফেলে হেঁটেই গঙ্গা আর পদ্মা নদী পার হয়ে যাবে! আমার রামদাস তো এখনও বালক, মাথায় সে আরও কত উঁচু হবে আমিই তা জানি না!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘পৃথিবীর মানুষ যত ছোটো আর দুর্বলই হোক, আপনার ওই রামদাসের মতন একটিমাত্র দানবকে বধ করবার শক্তি তাদের আছে৷’
‘একটিমাত্র দানব? মোটেই নয়, মোটেই নয়! আর-এক দ্বীপে আমি আমার শিশু-দানবদের লুকিয়ে পালন করছি৷ সেই দ্বীপ থেকে এখানে আসবার সময়েই তো আমার বিড়াল-বাচ্চাটাকে হতভাগা মাঝিমাল্লারা জলে ফেলে দিয়েছিল! না জানি সে বাচ্চা আরও কত বড়ো হতে পারত! তাকেই তোমরা হত্যা করেছ, তোমাদের ও অপরাধ আমি কিছুতেই ক্ষমা করব না!’
বিমল একটুখানি চুপ করে থেকে বলল, ‘দানবরহস্য তো বুঝলাম, কিন্তু ছড়া কাটে কারা?’
প্রশ্ন শুনেই ধরণী ও-হো-হা-হা-হা-হা করে হেসে যেন গড়িয়ে পড়ল৷ তারপর অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, ‘ছড়া কাটে কারা? ছড়া কাটে কারা? এখনও তাদের দেখতে পাওনি বুঝি? তারা হচ্ছে বাংলাদেশের মাসিকপত্রের দু-জন কবি!’
বিমল সবিস্ময়ে বলল, ‘কবি!’
‘হ্যাঁ৷ তারা এমনই যাচ্ছেতাই কবিতা লিখত যে বাংলা মাসিকপত্রগুলো অপাঠ্য হয়ে উঠেছিল৷ কত সমালোচক তাদের গালাগালি দিয়েছে, কিন্তু তাদের ভয়ংকর কবিতা লেখার উৎসাহ একটুও কমাতে পারেনি৷ বাধ্য হয়ে আমি তাদের এখানে এনে ধরে রেখেছি-অবশ্য তাদের দেহকে নয়, তাদের মস্তিষ্ককে৷’
‘সে আবার কী?’
‘তোমরা কি এখনকার ইউরোপীয় অস্ত্র-চিকিৎসকদের বাহাদুরির কথা শোনোনি? বাঁদরের দেহের গ্রন্থি কেটে তারা মানুষের দেহের ভিতরে বসিয়ে দিচ্ছে৷ একজন মানুষের হৃৎপিণ্ড খারাপ হয়ে গেলে কেটে বাদ দিয়ে, তার জায়গায় কোনো সদ্যমৃত মানুষের হৃৎপিণ্ড তুলে বসিয়ে দিচ্ছে৷ আমি নিজেও ডাক্তারি পাশ করেছি৷ তাই এ-সব নিয়েও পরীক্ষা করি৷ মানুষের মস্তিষ্ক জন্তুর মাথায় চালান করলে কী ব্যাপার হয় সেটা দেখবার জন্যে আমার যথেষ্ট কৌতূহল ছিল৷ তাই একদিন ওই দুই নাছোড়বান্দা দুষ্ট কবিকে ধরে এনে কী করলাম জানো? করলাম ছোটোখাটো একটা অস্ত্রোপচার৷ একটা কুমির আর একটা হনুমান ধরলাম, তারপর তাদের জানোয়ারি মস্তিষ্ক কেটে বাদ দিয়ে দুই কবির মস্তিষ্ক কেটে নিয়ে বসিয়ে দিলাম৷ কিন্তু হতভাগা কবির মস্তিষ্ক! কুমির আর হনুমানের দেহে ঢুকেও কবিতা রচনা করতে ভোলে না! করুক তারা এই অরণ্যে রোদন৷ কিন্তু বাংলা মাসিকের পাঠকরা বেঁচে গিয়িছে *
এই ভীষণ কথা যারা শুনল তাদের মনের ভিতরটা তখন কেমন করছিল, তা জানেন কেবল অন্তর্যামীই! ধরণী আবার অট্টহাস্য করে বলল, ‘তোমরাও বেশি ভয় পেয়ো না, তোমাদেরও আমি একেবারে মেরে ফেলব না৷ তোমাদের দেহগুলো নষ্ট হবে বটে, কিন্তু তোমাদের মস্তিষ্ক বেঁচে থাকবে পশুদের মাথার ভিতরে গিয়ে৷ তবে, কোন পশুকে কার মস্তিস্ক দান করব, সেটা এখনও স্থির করে উঠতে পারিনি৷ আজ রাত্রেই একটা কোনো ব্যবস্থা করতে পারব বলে বোধ হচ্ছে! হা হা হা হা!’
কুমার গর্জন করে বলল, ‘পিশাচ! দুরাত্মা! মনে করছিস আমাদের হত্যা করে তুই নিস্তার পাবি? স্টিমারে আমাদের বন্ধুরা আছে, তারা তোকে ক্ষমা করবে না!’
বিমল শান্তভাবেই বলল, ‘ধরণীবাবু, এখনও আমাদের ছেড়ে দিন, নইলে আপনাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে৷’
অট্টহাসি হাসতে হাসতে ধরণী বলল, ‘তোমরা হাসালে দেখছি! আমরা এখন কোথায় আছি জানো? পাতালে! এই পাতালে ঢোকবার পথ এমন গভীর জঙ্গলে ঢাকা আছে, আজ সারাদিন ধরে খুঁজলেও স্টিমারের লোকেরা কোনো সন্ধান পাবে না! আজ রাত্রেও যদি স্টিমার দ্বীপের কাছে থাকে, তাহলে অন্ধকারে গা ঢেকে রামদাস গিয়ে সেখানাকে জলে ডুবিয়ে দিয়ে আসবে৷ সুতরাং বুঝতেই পারছ, মনুষ্যদেহ ত্যাগ করবার জন্যে তোমরা এখন প্রস্তুত হও! হা হা হা!’ হাসতে হাসতেই ধরণী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷
রামহরি হঠাৎ গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল৷ বিমল হেসে বলল, ‘থামো রামহরি, থামো! অমন শেয়ালের মতো চ্যাঁচালে ধরণী এখনই এসে তোমাদের মগজ কেটে নিয়ে হয়তো শেয়ালেরই মাথায় ঢুকিয়ে দেবে!’
বিনয়বাবু গম্ভীরভাবে বলল, ‘না, ঠাট্টা নয় বিমল! যা শুনলাম তা আমাদের পক্ষেও ভয়াবহ, সমস্ত মানুষ জাতির পক্ষেও ভয়াবহ! এখন কীসে প্রাণ বাঁচে, ভালো করে সেটা ভেবে দেখা দরকার৷’
বিমল অবহেলা-ভরে বলল, ‘আর মিথ্যা ভাবনা! আছি পাতালপুরীতে-বাইরে রামদাসের পাহারা৷ আমাদের হাত-পা এমনভাবে বাঁধা যে, নড়বার ক্ষমতাও নেই৷ বিনয়বাবু, বাঁচবার ভাবনা মিথ্যা!’
খানিকক্ষণ কেউই কথা কইবার ভাষা খুঁজে পেল না৷
পাতালপুরীর গর্ভে যেটুকু রোদ এসে পড়েছিল, সে-ও যেন ভয়ে ভয়ে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে-ঘরের ভিতরে দিনের বেলাতেই সন্ধ্যার আভাস ফুটে উঠছে৷
বাহির থেকে মাঝে মাঝে গাছপালার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো শব্দই ভেসে আসছে না৷
কুমার বলল, ‘পৃথিবী আর মঙ্গলগ্রহ জয় করেও শেষটা কি তাহলে ওই বুড়ো ধরণীর হাতে আমাদের হার মানতে হবে?’
বিমল বলল, ‘উপায় কী? মরতে তো হবেই একদিন! আজ না হয় ধরণী হবে আমাদের যমদূত! জীবনের প্রবল আনন্দ আমরা দুই হাতে লুন্ঠন করে নিয়েছি-সাধারণ মানুষের দশ জন্মের যৌবন আমাদের এক জন্মের মধ্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে; তোমার আর কী অভিযোগ থাকতে পারে কুমার? এই অতিরিক্ত জীবনের বন্যা আমার যৌবনকে শ্রান্ত করে তুলেছে, আমি এখন ঘুমোতে পেলে দুঃখিত হব না!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু এ তো চিরনিদ্রা নয় বিমল, এ যে জীবন্ত মৃত্যু! আমাদের মস্তিষ্ক নিয়ে ধরণী কী করতে চায়, শুনলে তো!’
বিমল চিন্তিত মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, ওই কথা ভেবেই মাঝে মাঝে মন আমার বিদ্রোহী হয়ে উঠছে৷ মানুষের দেহ থাকবে না, কিন্তু মানুষের প্রাণ থাকবে-কিন্তু সে প্রাণের মূল্য কী? কারণ এক হিসাবে মস্তিষ্কই হচ্ছে মানুষের প্রাণ! কিন্তু বিনয়বাবু, এও কি সম্ভব?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘আজীবন বিজ্ঞানচর্চা করছি, কিন্তু এমন উদ্ভট কল্পনার কথা কখনও মনে আসেনি৷ এ কল্পনায় যুক্তি আছে বটে, কিন্তু সে যেন রূপকথার যুক্তি!’
কমল বলল, ‘আমাদের মধ্যে বাঘাই সুখী! রামদাস আমাদের বোট ঘাড়ে করতে-না-করতেই সে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে গেছে!’
রামহরি কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘আহা, সে কি আর বেঁচে আছে!’
কুমার বলল, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে৷ শত বিপদেও বাঘা কখনো আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি৷ বেঁচে থাকলে নিশ্চয় সে রামদাসের পিছনে পিছনে আসত৷’
বাঘার কী হল সেটা আমাদের দেখা দরকার৷ বিমল ও কুমারের সমস্ত ইতিহাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরাই জানেন, বাঘা সাধারণ কুকুর নয়৷ পশুর মাথায় মানুষের মস্তিষ্ক ঢুকিয়ে ধরণী নতুন পরীক্ষা করতে চায়, কিন্তু পশুর মস্তিষ্কে যে খানিকটা মানুষি বুদ্ধি থাকতে পারে, অনেক কুকুরই অনেকবার তার জ্বলন্ত প্রমাণ দিয়েছে৷ বাঘাও হচ্ছে সেই জাতীয় কুকুর৷
হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই বাঘা যখন দেখল জলের নৌকো আকাশে উড়ছে, তখন তার আর বিস্ময়ের সীমা রইল না৷ এমন অস্বাভাবিক কাণ্ড কোন কুকুর কবে দেখেছে? ভয়ে তার আর দিগ্বিদিক জ্ঞান রইল না, বিকট চিৎকার করে এক লাফে সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷
পড়ে জলে সাঁতার কাটতে কাটতে সে দেখল, খানিক তফাতেই একটা তালগাছ-সমান উঁচু ছায়ামূর্তি কোমর-জল ভেঙে ডাঙার দিকে অগ্রসর হচ্ছে৷
কিন্তু সেই দানবমূর্তি দেখেও বাঘা বিশেষ বিস্মিত হল না৷ কারণ বিমল ও কুমারের সঙ্গে গিয়ে ‘হিমালয়ের ভয়ংকর’-দেরও সে দেখে এসেছে, তার চক্ষে দানবমূর্তি এখন আর অস্বাভাবিক নয়৷ সে খালি এইটুকু বুঝে নিল যে, ওই দানবের কাছ থেকে যত তফাতে থাকা যায় ততই ভালো৷
এমন সময়ে আর একদিকে তার নজর পড়ল৷ জলের উপরে আবছা-আলোর ভিতরে যেন খানিকটা নিরেট অন্ধকার জমাট হয়ে আছে৷ খালি তাই নয়, অন্ধকারের একজায়গায় যেন দু-টুকরো আগুনের মতো কী জ্বলজ্বল করছে৷
সে অন্ধকার আর কিছুই নয়, মস্ত বড়ো একটা কুমির৷
এই জলচর জীবটিও বাঘার চোখে নূতন নয়৷ জলে এর সঙ্গে লড়াই হলে তারই যে সমধিক বিপদের সম্ভাবনা এটাও সে বুঝতে পারল৷
কুমির হঠাৎ বলল :
‘ঘোঁ-ঘট-ঘট ঘোঁ-ঘট-ঘট, ঘোঁ-ঘট-ঘট!
দে চম্পট দে চম্পট দে চম্পট!’
হতভম্ব বাঘার দুই কান খাড়া হয়ে উঠল৷ সে মানুষের ভাষায় কথা কইতে পারে না বটে, কিন্তু শুনলে মানুষের ভাষা বুঝতে পারে৷ এই কুমিরটার কথা যে মানুষের মতন শোনাচ্ছে!
কিন্তু এ-সব কথা নিয়ে এখন সময় নষ্ট করবার সময় নেই৷ সে নিজের দেহ দিয়ে কোনো ক্ষুধার্ত জলচরের উপবাস ভঙ্গ করতে মোটেই রাজি নয়৷ অতএব বাঘা তাড়াতাড়ি সাঁতার কেটে অনেক দূরে চলে গেল৷
কিন্তু কুমিরটা তাকে একবারও আক্রমণ করবার চেষ্টা করল না৷
বাঘা তখন আবার ডাঙার দিকে ফিরল৷ তখন আবার সেই ছায়া-দানবের কথা তার মনে পড়ল৷ কিন্তু কোথায় গেল সে? কোনোদিকেই তাকিয়ে বাঘা তাকে আবিষ্কার করতে পারল না৷
বোট যে কেন আকাশে উড়েছিল, সে এখন তা বুঝতে পেরেছে৷ দানবের মাথায় বোটের ভিতরেই যে তার মনিবরা আছেন, এও সে জানে৷ এখন সে অনায়াসেই পুলিশের স্টিমারে উঠে নিজে নিরাপদ হতে পারত, কিন্তু সে-কথা একবারও তার মনে হল না৷ বাঘা যে-জাতের জীব, সে-জাত প্রাণের চেয়েও বড়ো মনে করে মনিবকে৷ অতএব সে সাঁতার কেটে ডাঙায় গিয়ে উঠল, কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস হল যে, মনিবরা দানবের মাথায় চড়ে ওই দ্বীপেই গিয়েছেন৷
কিন্তু দ্বীপে উঠে হল আর এক মুশকিল৷ দানবটা কোনদিকে গিয়েছে? চারিদিকেই গভীর জল, কোনদিকে যাওয়া উচিত?
মানুষ হলে বাঘাকে এখন হতাশ হতে হত৷ কিন্তু সে হচ্ছে কুকুর, তার তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি আছে, তাকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়৷ রামদাস যখন বোট শূন্যে তুলেছিল, তখনই তার গায়ের বিশেষ গন্ধ বাঘার নাকে এসেছিল৷ সে এখন চারিদিকে মাটি শুঁকে শুঁকে রামদাসের গায়ের গন্ধ আবিষ্কারের চেষ্টায় লেগে গেল৷
ভোর হল৷ সূর্য উঠল৷ গাছের মাথায় মাথায় রোদের আলপনা৷ বাঘা তখনও ব্যস্ত হয়ে মাটি শুঁকে শুঁকে বেড়াচ্ছে৷
আরও কতক্ষণ পরে এক জায়গায় বড়ো-বড়ো কয়েকটা পায়ের দাগ দেখা গেল৷ সেইখানে নাক বাড়িয়েই বাঘা আনন্দে অস্ফুট কন্ঠে ডেকে উঠল৷ এতক্ষণে সেই গন্ধ পাওয়া গেছে!
আর কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না! মহা খুশি হয়ে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বাঘা মাটিতে নাক রেখে অগ্রসর হল৷
কখনো খোলা জমির উপর দিয়ে এবং কখনো ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অনেকক্ষণ পথ চলে বাঘা শেষটা একজায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ সেখানে একটা শুকনো গাছের গুঁড়ির পাশে তাদের সেই মোটরবোটখানা কাত হয়ে পড়ে আছে৷
বাঘা দৌড়ে গিয়ে বোটে উঠল৷ কামরার ভিতরে ঢুকল৷ সেখানে তার মনিবদের জিনিস-পত্তর ও বন্দুকগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে, কিন্তু তার মনিবরা কোথায়?
কামরা থেকে বেরিয়ে এসে বাঘা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, এমন সময় হঠাৎ একটা দাড়িওয়ালা লোক ঠিক যেন মাটি ফুঁড়ে উপরে উঠে এল৷
এ-লোকটাকে বাঘা আগেও দেখেছে এবং তার কুকুরবুদ্ধি বলল, এ তাদের বন্ধুলোক নয়৷ সে চটপট আবার কামরার ভিতরে গা-ঢাকা দিল৷
খানিক পরে সাবধানে মুখ বাড়িয়ে দেখল, সেই সন্দেহজনক লোকটা অদৃশ্য হয়েছে৷
তখন, অমন হঠাৎ লোকটা কেমন করে আবির্ভুত হল তার তদারক করবার জন্যে কৌতূহলী বাঘা খুব সন্তর্পণে এগিয়ে গেল৷
ঝোপের মধ্যে কতকগুলো ডালপাতা রাশীকৃত হয়ে রয়েছে এবং তারই ফাঁক দিয়ে একসার সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে৷ ঝোপের বাইরে থেকে এ-সব কিছুই দেখা যায় না এবং ঝোপের ভিতরে এসে দাঁড়ালেও সহজে সেই সিঁড়ির সার আবিষ্কার করা যায় না৷
বাঘা সেই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল৷ তারপরেই তার কানে এল পরিচিত কন্ঠস্বর৷ খুশিতে বাঘার ল্যাজ তখনই বেজায় ব্যস্ত হয়ে উঠল৷
আনন্দে বিহ্বল হয়ে বাঘা সর্বপ্রথমে কুমারের ভূতলশায়ী দেহের উপরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং আদর করে তার গা চেটে দিতে লাগল৷
রামহরি বিষাদ-ভরা গলায় বলল, ‘কেন বাঘা মরতে এলি এখানে? আমরা মরব, তুইও মরবি!’
বিমল কিন্তু বিপুল উৎসাহে বলে উঠল, ‘না, না! আমরাও বাঁচব, বাঘা বাঁচবে! ভগবান এখনও বোধ হয় আমাদের স্বর্গের টিকিট দিতে রাজি নন! বাঘা সেই খবরই নিয়ে এসেছে!’
বিনয়বাবু ম্লান মুখেই বললেন, ‘বিমল, হঠাৎ তোমার এতটা খুশি হওয়ার কারণ বুঝলাম না!’
‘বুঝলেন না? কিন্তু আমি বুঝেছি৷ বাঘা যখন এসেছে, তখন ধরণীর ছুরি থেকে নিশ্চয়ই আমাদের মাথা বাঁচাতে পারব৷ মরি তো একেবারেই মরব, কিন্তু মাসিকপত্রের ওই দুই কবির মতো কুমির কি হনুমান হয়ে থাকব না!’
কমল বলল, ‘আমাদের হাত-পা দুই-ই বাঁধা, ধরণী আমাদের নিয়ে যা-খুশি তাই করতে পারে!’
কুমার বলল, ‘না, তা আর পারে না! বিমল কী বলছে আমি বুঝেছি৷-বাঘা!’ বলেই সে বাঘার মুখের কাছে নিজের বাঁধা হাতদুটো কোনোরকমে এগিয়ে দিল৷
বাঘা প্রথমটা থতমত খেয়ে গেল৷
কুমার তখন বাঘার মুখের উপরে নিজের হাতদুটো ঘষতে ঘষতে বলল, ‘ওকি রে বাঘা, তুই আমার ইশারা বুঝতে পারছিস না? নে, নে, দড়ি কাট!’
বাঘার আর কোনো সন্দেহ রইল না৷ সে তখনই নিজের ধারালো দাঁত দিয়ে কুমারের হাতের দড়ি চেপে ধরল৷ দেখতে দেখতে তার হাতের দড়ি খসে পড়ল৷ কুমার তখন আগে নিজেই নিজের পায়ের বাঁধন খুলে ফেলল৷ এবং তার পর একে-একে সকলেরই বন্ধনদশা ঘুচতে আর দেরি লাগল না৷
বিমল বাঘাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, ‘ওরে বাঘা, বাঘা রে! গেল জন্মে তুই আমাদের কে ছিলি রে বাঘা?’ বাঘাও সুখে যেন গলে গিয়ে বিমলের কোলের ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে দিল৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘ওঠো বিমল, পরে বাঘাকে ধন্যবাদ দেবার অনেক সময় পাবে৷’
বিমল একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ‘ঠিক বলেছেন! আগে এই পাতালপুরী থেকে বেরোতে না পারলে নিস্তার নেই! এসো সবাই! কিন্তু খুব ধীরে আর খুব হুঁশিয়ার হয়ে!’
একে-একে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল, যেখানটাকে তারা এতক্ষণ উঠান বলে মনে করেছিল, সেখানে রয়েছে মস্ত বড়ো একটা জলের ইঁদারা!
বিমল চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘বিনয়বাবু, এই পাতালপুরীটা কীরকম তা বুঝেছেন? লখনউয়ের নবাবরা গরমের সময়ে মাটির নীচে ঘর তৈরি করে বাস করতেন৷ সেই আদর্শেই এটা তৈরি হয়েছে৷ বর্ধমানেও এইরকম পাতালপুরী আছে৷ বিপদের সময়ে লুকোবার জন্যেই ধরণী এটা বোধ হয় তৈরি করেছে৷’
তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হো-হো-হো-হো করে একটা বিষম অট্টহাসি সেই পাতালপুরীর ভিতরে প্রতিধ্বনির পর প্রতিধ্বনি জাগিয়ে তুলল৷ বিমল সচমকে মুখ তুলে দেখল, সিঁড়ির উপরকার ধাপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে ধরণী৷
ধরণী হঠাৎ হাসি থামিয়ে নিষ্ঠুর স্বরে বলল, ‘এই যে, দড়ি-টড়ি সব বুঝি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে?’
বিমল দুই পা এগিয়ে বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ আমরা মানুষ, দড়ি-বাঁধা থাকতে ভালো লাগল না!’
ধরণী দুই পা পিছিয়ে ব্যঙ্গের স্বরে বলল, ‘ও! এখনও তোমরা মানুষই বটে! কিন্তু ভয় নেই, তোমাদের মনুষ্যদেহ আর বেশিক্ষণ থাকবে না!’
বিমল সিঁড়ির উপরে এক ধাপ উঠে বলল, ‘আজ্ঞে না, এখনও আমাদের নরদেহ ত্যাগ করবার ইচ্ছা হয়নি৷’
ধরণী গর্জে উঠে বলল, ‘খবরদার! আর এক পা এগিয়ো না! ভাবছ এখান থেকে বেরোতে পারলেই বাঁচবে? জানো, বাইরে কে পাহারা দিচ্ছে?’
-‘রামদাস৷’
-‘হ্যাঁ, এখান থেকে এক পা বেরোলেই সে তোমাদের পায়ের কড়ে-আঙুলে টিপে বধ করবে!’
-‘বেশ, সেইটেই একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক’-বলেই বিমল দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল এবং তার পিছনে পিছনে আর সকলেও৷
বিমলের ইচ্ছা ছিল ধরণীকে গ্রেপ্তার করে৷ কিন্তু তার অভিপ্রায় বুঝে ধরণী এক মুহূর্তেই তিন লাফ মেরে বাইরে বেরিয়ে গেল৷
তারাও তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে দেখল ধরণী তিরবেগে ছুটছে এবং প্রাণপণে চেঁচিয়ে ডাকছে-‘রামদাস! রামদাস! রামদাস!’
ঝোপের বাইরে একটুখানি ঘাস জমি এবং তারপরেই নিবিড় অরণ্য যেন দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ধরণী সেই অরণ্যের ভিতরে মিলিয়ে গেল৷
বিনয়বাবু ব্যগ্র কন্ঠে বললেন, ‘এখন আমরা কোনদিকে যাব?’
কুমার বলল, ‘আমাদের আর কোনোদিকে যেতে হবে না৷ ওই দেখুন!’
অরণ্যের এক অংশ আচম্বিতে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠেছে-মড়-মড় করে বড়ো বড়ো ডালপালা ভেঙে পড়ার এবং মাটির উপরে ধুপ-ধুপ করে আশ্চর্য পায়ের শব্দ৷
তারপরেই এক অতি ক্রুদ্ধ উচ্চ কন্ঠস্বর-‘রামদাস, রামদাস! ওই পোকাগুলোকে পায়ে থেঁতলে, ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দাও!’
বিমল মৃদু হেসে বলল, ‘এইবারে রামদাসকে আমরা স্বচক্ষে দেখব৷’
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – কবির আবির্ভাব
রামদাস, ছোট্ট হরিদাসের মস্ত ভাই রামদাস, ধরণীর সৃষ্টিছাড়া পরীক্ষার জ্যান্ত ফল রামদাস,-যার পায়ের তলে পৃথিবী টলে, যার হাতের জোরে মানুষ-ভরা মোটরবোট জল ছেড়ে শূন্যে ওড়ে, যার মাথা দোলে বুড়ো তালগাছের মাথার সমান উঁচু হয়ে ঝড়ের হুহুংকারে!
সেই রামদাস আসছে আজ বিমলদের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে, ধরণীর নিষ্ঠুর হুকুম পালন করবার জন্যে, এক-এক বিরাট পায়ের চাপে পাঁচ-পাঁচটি ক্ষুদ্র মানুষের দেহ ঠুনকো কাঁচের পেয়ালার মতো চূর্ণ করবার জন্যে!
সকলে অত্যন্ত অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল,-কিন্তু কোথায় পালাবার পথ? সামনে খোলা জমি, তারপরেই দুর্ভেদ্য বন, যার ভিতর দিয়ে মড়মড় করে বড়ো বড়ো ডালপালা ভাঙতে ভাঙতে আসছে স্বয়ং রামদাস, বামপাশে ও ডানপাশেও নিবিড় অরণ্য যেন নিরেট প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে-হয়তো তার ভিতরেও তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে সেই হাতির মতো ডালকুত্তা এবং সেখানে গিয়ে পথ খোঁজবারও সময় নেই৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘বিমল, আমাদের আবার সেই পাতালপুরীতেই ফিরে গিয়ে বন্দি হতে হবে-রামদাস তার ভিতরে ঢুকতে পারবে না৷’
দাঁতে দাঁত চেপে বিমল বলল, ‘সেখানে গিয়ে ধরণীর ছুরিতে মস্তিষ্ক দান করব? প্রাণ থাকতে নয়!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু এখানেই প্রাণ আর থাকছে কই?’
কুমার বলল, ‘রামদাসের সঙ্গে লড়তে লড়তে আমি প্রাণ দিতে রাজি আছি, কিন্তু ধরণীর ছুরিতে মস্তিষ্ক দিয়ে মরেও বেঁচে থাকতে পারব না!’
কমল বলল, ‘আমারও ওই মত!’
রামহরি কেবল কাঁদতে লাগল৷
কিন্তু বাঘা চ্যাঁচাচ্ছে শুধু ঘেউ ঘেউ করে-সে বোধ হয় রামদাসকে শুনিয়ে শুনিয়ে কুকুর ভাষায় সবচেয়ে খারাপ গালাগালিগুলো বর্ষণ করছে৷
হঠাৎ কমল বলে উঠল, ‘বিমলবাবু, দেখুন-দেখুন!’
সকলে মুখ ফিরিয়ে দেখল, ডানদিকের একটা বড়ো গাছের উপর থেকে তাড়াতাড়ি নেমে আসছে মস্ত একটা হনুমান৷ নীচের ডাল থেকে এক লাফে ভূতলে অবতীর্ণ হল এবং তারপর দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে হাত নেড়ে ব্যস্তভাবে সবাইকে ডাকতে লাগল৷
বিনয়বাবু সবিস্ময়ে বললেন, ‘ও কী ব্যাপার?’
বিমল বলল, ‘বোধ হয় সেই হনুমান-যার মাথায় বেঁচে আছে মানুষের মগজ!’
কুমার বলল, ‘ও যে আমাদের ডাকছে!’
বনের ডালপালা ভাঙার শব্দ তখন খুব কাছে এসে পড়েছে-রামদাসের দেখা পেতে বোধ হয় আর আধ মিনিটও দেরি লাগবে না৷
বিমল বলল, ‘ধরণীর কথা যদি সত্য হয়, তাহলে ওই পশুদেহের ভিতরে আছে মানুষেরই মন৷ চলো সবাই, প্রাণ তো গিয়েছেই, এখন ওর কথা শুনে কী হয় সেইটেই দেখা যাক!’
বাঘা গরর-গরর করে এগিয়ে যাচ্ছিল হনুমানজিকে নিজের বীরত্ব দেখিয়ে বাহাদুরি নেবার জন্যে; কিন্তু কুমারের কাছ থেকে এক চড় খেয়ে সে ল্যাজ গুটিয়ে সকলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল-কিন্তু বুঝতে পারল না যে, হনুমানের মতো একটা জানোয়ারকে কামড়াতে যাওয়াটা আজ হঠাৎ অপরাধ হয়ে দাঁড়াল কেন?
তারা সবাই হনুমানের দিকে অগ্রসর হল, হনুমানও গিয়ে দাঁড়াল একেবারে অরণ্যের ধার ঘেঁষে একটা ঝোপের পাশে৷ তার পর, কী আশ্চর্য, সে ঠিক মানুষের মতো ঝোপের দিকে হাত তুলে আঙুল দিয়ে কী ইঙ্গিত করল৷
কিন্তু বিমলের তখন অসম্ভব ব্যাপার দেখে বিস্মিত হবার অবকাশ ছিল না, তারা তাড়াতাড়ি যখন সেই ঝোপের গাছে গিয়ে দাঁড়াল হনুমান তখন লাফ মেরে একটা গাছে উঠে আবার কোথায় অদৃশ্য হয়েছে৷
ঝোপের পিছনেই প্রায়-নিরেট বনের তলায় একটা অন্ধকার-মাখা পায়ে-চলা সরু পথ৷
বিমল মহা খুশি হয়ে বলে উঠল, ‘হনুমান আমাদের পথ দেখিয়ে দিল! জয় হনুমান!’
সকলে সেই পথ ধরে যখন বনের ভিতরে প্রবেশ করল তখন তাদের মনে হল, যেন পৃথিবীর সমস্ত আলো চোখের সমুখে ‘সুইচ’ টিপে কে নিবিয়ে দিল৷ সে-অরণ্য এমনই নিবিড় যে, তার ভিতরে রোদ বা জ্যোৎস্না কোনোদিন বেড়াতে আসতে পারেনি!
অন্ধকার যখন একটু চোখ-সওয়া হয়ে এল, তখন তারা চারিদিক হাতড়াতে হাতড়াতে কোনোগতিকে গুঁড়ি মেরে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল৷
সেই সময়ে পিছন থেকে ভেসে এল যেন গম্ভীর মেঘগর্জন৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘আমাদের দেখতে না পেয়ে রামদাস বোধ হয় খাপ্পা হয়ে গর্জন করছে!’
সকলে সেই অবস্থাতে যথাসম্ভব পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল৷ সৌভাগ্যের বিষয়, এই চির-অন্ধকারের রাজ্য দিয়ে তাদের আর বেশিক্ষণ যেতে হল না, অরণ্যের নিবিড়তা ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগল এবং আলোকের আভাসে বনের ভিতরটা ক্রমেই বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল৷
প্রায় আধঘণ্টা পরে অরণ্য শেষ হয়ে গেল, তারা আবার একটা বড়ো মাঠের উপরে এসে দাঁড়াল৷ সারা আকাশ তখন প্রখর রৌদ্রে সমুজ্জ্বল, ময়দানের নীলিমার উপর দিয়ে সোনালির স্রোত বয়ে যাচ্ছে৷
বিমল একটি সুদীর্ঘ ‘ আঃ উচ্চারণ করে যেন সেই নির্মল আলো আর প্রমুক্ত বাতাসকে দৃষ্টি আর নিশ্বাস দিয়ে নিজের বুকের ভিতরে টেনে নিতে লাগল৷
কুমার বলল, ‘এখনও আঃ বলে নিশ্চিন্ত আরাম করবার সময় হয়নি বিমল! রামদাস গোটা-কয় লাফ মারলেই এখানে এসে হাজির হতে পারবে!’
বিমল বলল, ‘ঠিক! খোলা মাঠ পেয়েছি, চলো এইবার আমরা দৌড়োই!’
কমল বলল, ‘কিন্তু কোনদিকে যাব?’
কুমার বলল, ‘কোনদিকে আবার! আমরা এসেছি পূর্বদিক থেকে আমাদের যেতেও হবে পূর্বদিকে৷’
সবাই পূর্বদিকে ছুটতে শুরু করল৷ ছুটোছুটিতে বাঘার ভারি আমোদ! সে ভাবল এইবার খেলার পালা শুরু হল! তখনই সে ভালো করে দেখিয়ে দিল ছুটোছুটি খেলায় তাকে হারিয়ে কেউ ‘ফার্স্ট প্রাইজ’ নিতে পারবে না৷
ময়দানের ওপারে আবার একটা বনের আরম্ভ,-এ-বন তেমন ঘন নয়৷
কিন্তু সকলে এখানে এসেই সভয়ে শুনল, বনের ভিতর দিয়ে কারা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে৷
শত্রুরা কি তাদের স্টিমারে যাবার পথ বন্ধ করে আক্রমণ করতে আসছে?
পিছনে আছে রামদাস, আর এদিকে আছে কে! সশস্ত্র ধরণী, হরিদাস-আর সেই হাতির মতো ডালকুত্তা?
তাহলে উপায়? তারা নিরস্ত্র, বাধা দেবার কোনো উপায়ই নেই৷ এক উপায়, পালানো৷ কিন্তু এবারে তারা কোনদিকে পালাবে?
কুমার হঠাৎ প্রচণ্ড উৎসাহে বলে উঠল, ‘পুলিশ! পুলিশ! মিলিটারি পুলিশ!’
বিমল চকিতে ফিরে দাঁড়িয়ে দেখল, বনের ভিতর থেকে সার বেঁধে সমতালে পা ফেলে মিলিটারি পুলিশের লোক বেরিয়ে আসছে৷
সে সানন্দে বলল, ‘আর আমাদের কোনো ভয় নেই! বিনয়বাবু, ওই দেখুন বন্দুকধারী পুলিশ ফৌজ, ওই দেখুন মেশিন গান! আসুক এখন রামদাস, আসুক এখন ধরণী আর আসুক তার হাতি-কুকুর!’
ইনস্পেকটর তাদের দেখে দৌড়ে এসে বললেন, ‘বিমলবাবু, ব্যাপার কী? মোটরবোটসুদ্ধ কোথায় উধাও হয়েছিলেন?’
বিমল বলল, ‘আমরা যমালয়-ফেরত মানুষ!’
‘তার মানে?’
‘তার মানে তালগাছের মতন উঁচু দৈত্য মোটরবোটসুদ্ধ আমাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল!’
‘কী যে আপনি বলেন!’
‘বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে শুনুন৷’
বিমল তাড়াতাড়ি খুব অল্প কথায় মোটামুটি সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করল৷
ইনস্পেকটর সব শুনে খানিকক্ষণ হতভম্বের মতো চুপ করে রইলেন৷ তারপর বললেন, ‘আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না! এ যে গাঁজাখুরি কথার মতো শোনাচ্ছে!’
‘বিশ্বাস করুন মশায়, বিশ্বাস করুন৷ গাঁজার ধোঁয়া যেমন সত্য, আমাদের কথাও তেমনই সত্য৷’
‘আপনারা স্বপ্ন বা ম্যাজিক দেখেছেন কি না জানি না, কিন্তু আপনারা যে বিপদে পড়েছেন, এটা আমি আন্দাজ করেছিলাম৷ তাই তো লোকজন নিয়ে আমি আপনাদের খুঁজতে বেরিয়েছি!’
‘বড়ো ভালো কাজ করেছেন মশাই, বড়ো ভালো কাজ করেছেন৷ আমাদের তো খুঁজে পেয়েছেন, এইবারে চলুন সেই রামদাসের খোঁজে!’
‘নিশ্চয়ই যাব! কিন্তু ওই যে বললেন, আপনাদের এই রামদাসের গল্প গাঁজার ধোঁয়ার মতন সত্য, শেষটা গাঁজার ধোঁয়ার মতোই রামদাস উপে যাবে না তো?’
কুমার বলল, ‘হুঁ! রামদাস উপে যাবারই ছেলে বটে! ওই দেখুন, মাঠের পারের ওই বনে দাঁড়িয়ে রামদাস আমাদেরই দেখছে!’
ইনস্পেকটর সেইদিকে তাকিয়েই চমকে মস্ত এক লাফ মারলেন৷
ময়দানের ওদিককার বনের সারের উপরে এক মানুষ-তালগাছ স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সকলকে লক্ষ করছে, দুই হাত দুই কোমরে রেখে৷ তার অদ্ভুত দেহের তুলনায় বড়ো বড়ো তালগাছগুলোকেও ছোটো দেখাচ্ছে৷ এতদূর থেকে তার মুখের ভাব দেখা যাচ্ছিল না বটে, কিন্তু সেটা যে বিপুলবপু এক নরদৈত্যের মূর্তি, সে-বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই৷
মিলিটারি পুলিশের দলের ভিতর থেকে একটা বিস্মিত কোলাহলধ্বনি উঠল৷
বিমল বলল, ‘কিন্তু সেই হাতির মতো ডালকুত্তা? সে এখনও একবারও দেখা দিল না কেন?’
ইনস্পেকটর বললেন, ‘রক্ষে করুন মশায়, আর আমি তাকে দেখতে চাই না! যা দেখেছি, তাতেই পিলে চমকে উঠেছে! এই সেপাই, ফায়ার করো-ফায়ার করো!’
বিমল ব্যস্তভাবে বলল, ‘না না! আগে দেখাই যাক, রামদাসকে আমরা জ্যান্ত অবস্থায় গ্রেপ্তার করতে পারি কি না!’
ইনস্পেকটর দুই চক্ষু ছানাবড়ার মতো করে তুলে সবিস্ময়ে বললেন, ‘গ্রেপ্তার! ওকে গ্রেপ্তার করতে চায় কে? ওর কাছে গেলে ও তো পুঁটিমাছের মতো টপটপ করে আমাদের মুখে ফেলে দেবে! ওর হাতে পরাবার হাতকড়িই বা কোথায় পাব? স্টিমারে ওর দেহ কুলোবে না, নিয়ে যাব কেমন করে? না না, গ্রেপ্তার-ট্রেপ্তার নয়, ওকে একেবারে বধ করতে হবে!’
বিমল বলল, ‘কিন্তু এত দূর থেকে গুলি ছুড়লে তো ওর গায়ে লাগবে না!’
‘তবু বন্দুক ছুড়ুক! বন্দুকের শব্দে ভয় পেয়ে দৈত্য ব্যাটা এখান থেকে পালিয়ে যাক? ওকে দেখতে আমার একটুও ভালো লাগছে না! এই সেপাই, বন্দুক ছোড়ো-মেশিন-গান ছোড়ো!’
বন্দুক ও কলের কামানের ঘন ঘন বজ্রগর্জনে চতুর্দিক ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল৷ এবং সঙ্গে সঙ্গে রামদাসের দেহ বনের ভিতর ডুব মারল৷ তাহলে আগ্নেয়াস্ত্রের শক্তি সে জানে৷
ইনস্পেকটর উৎসাহভরে বলে উঠলেন, ‘দেখছি দৈত্য ব্যাটা গোঁয়ারগোবিন্দ নয়৷ তবে চলো সবাই অগ্রসর হই৷ কিন্তু খবরদার, বন্দুক ছোড়া বন্ধ কোরো না৷ সেই ফাঁকে দৈত্যটা কাছে এসে পড়লে আর রক্ষে নেই!’
সকলে মিলে অগ্রসর হল-যেখানটায় রামদাসকে দেখা গিয়েছিল সেইদিকে৷
কিন্তু সেখানে গিয়ে রামদাসের বদলে পাওয়া গেল ধরণীকে৷ একটা গাছের তলায় ধরণী লম্বা হয়ে শুয়ে আছে-বন্দুকের গুলি লেগে তার কপাল বেয়ে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে৷
বিমল তার বুকে হাত দিয়ে দেখে বলল, ‘ধরণী, এ-জীবনে আর আমাদের মগজ নিয়ে পরীক্ষা করতে পারবে না!’
তারপর আবার রামদাসের সন্ধান আরম্ভ হল৷ কিন্তু দ্বীপের চারিদিক, ছোটো-বড়ো সমস্ত বন খুঁজেও তার কোনোই পাত্তা পাওয়া গেল না৷
সবাই যখন দ্বীপের ওপাশে আবার নদীর ধারে এসে পড়ল, বিনয়বাবু তখন একদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন৷
আগেই বলা হয়েছে, নদী এখানে প্রায় সমুদ্রের মতন দেখতে৷ সেই বিশাল জলের রাজ্যে দেখা গেল, বহুদূরে দুটো বড়ো বড়ো জীব সাঁতার কেটে কোথায় ভেসে চলেছে৷
বিমল বলল, ‘নিশ্চয়ই ওরা হচ্ছে রামদাস আর সেই বিরাট কুকুর!’
‘কিন্তু রামদাসের দাদা হরিদাসটা গেল কোথায়?’
‘হয়তো রামদাসের চওড়া পিঠে বসে নদী পার হচ্ছে! কী বলেন ইনস্পেকটর মশাই, স্টিমারে চড়ে আবার ওদের তাড়া করব নাকি?’
ইনস্পেকটর বললেন, ‘আপদ যখন নিজেই বিদেয় হয়েছে, তখন আর হাঙ্গামা করে দরকার কী? কীসে কী হয় বলা তো যায় না, ও ব্যাটা যদি ডুবসাঁতার দিয়ে এসে ঢুঁ মেরে স্টিমারের তলা ফাটিয়ে দেয়?’
সকলে যখন বনের ভিতর দিয়ে আবার ফিরে আসছে, তখন মাথার উপরকার একটা গাছের ডালপাতা হঠাৎ নড়ে উঠল, তারপর শোনা গেল-কিচির-মিচির কিচির-মিচির কিচ কিচ কিচ কিচ৷
‘মানুষ আমি নইকো রে ভাই,
আজকে আমি মানুষ নই,
তোমরা সবাই চললে দেশে
একলা আমি হেথায় রই!
আমার দেশের সবুজ মাঠে
ধানের খেতে সোনার দোল,
বইছে নদীর রুপোর লহর,
শিউলি-ঝরা মাটির কোল!’
সে করুণ স্বর শুনে সকলেরই মন ব্যথায় ভরে উঠল৷
বিনয়বাবু উপরদিকে মুখ তুলে মমতা-ভরা কন্ঠে বললেন, ‘কবি, আজ তোমার চেহারা যে-রকমই হোক, তুমি আমাদের প্রাণ রক্ষা করেছ৷ তুমি গাছ থেকে নেমে এসো, আমাদের সঙ্গে আবার দেশে ফিরে চলো৷’
গাছের উপর থেকে আবার সেই দুঃখ-মাখা কন্ঠ শোনা গেল :
‘আমার ঘরের মিষ্টি বধূ
ডাকছে আমায় রাত্রি-দিন,
আমার খোকার, আমার খুকির
কন্ঠে বাজে স্বপ্ন-বীণ৷
কেমন করে ফিরব ঘরে,
আজকে আমি মানুষ নই,
তোমরা সবাই চললে দেশে
একলা আমি হেথায় রই!’
________________________________
* পশুর মাথায় মানুষের মস্তিষ্ক চালান করবার এই অদ্ভুত কল্পনার জন্যে আমি এক বিলাতি লেখকের কাছে ঋণী৷
ইতি-লেখক