অসম্ভব
এক ডাক্তারবাবু নাকি রোগী দেখার পর দুটো বড়ি রোগীকে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই দুটো বড়ি খেলেই হয়ে যাবে। একটা বড়ি ঘুম থেকে ওঠার আগে খাবেন, আর একটা ঘুম থেকে ওঠার পরে খাবেন।’
রোগী বেচারা সরল বিশ্বাসে বড়ি দুটো নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে আবিষ্কার করে ব্যাপারটা অসম্ভব, ঘুম থেকে ওঠার আগে কী করে বড়ি খেতে হয় সে তা জানে না।
এই জাতীয় অন্য একজন রোগী আরেকরকম বিপদে পড়েছিলেন।
এমনিতে, খুব সোজা মনে হলেও সেটা খুবই একটা অসম্ভব সমস্যা।
ডাক্তারবাবু রোগীকে সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর হাত-মুখ ধুয়ে ওষুধের বড়ি খালি পেটে খেয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
পরের দিন খুব সকাল সকাল রোগী আবার ডাক্তারবাবুর বাড়িতে এল।
ডাক্তারবাবুকে অনেক রাত পর্যন্ত রোগী দেখতে হয়, তাই সেই পরিশ্রমটা পুষিয়ে যেন সকালের দিকে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে। আজ রোগী যখন ডাক্তারবাবুর বাড়িতে এসেছে তখনও ডাক্তারবাবু শুয়ে আছেন। অনেক হাঁকাহাঁকি, চেঁচামেচির পর বিছানা ছেড়ে তিনি ঘরের বাইরে এলেন।
তাঁকে দেখতে পেয়েই রোগী বলল, ‘ডাক্তারবাবু আপনি যেভাবে ওষুধ খেতে বলেছিলেন তা মোটেই সম্ভব নয়।’
ঘুম জড়ানো চোখ কচলাতে কচলাতে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘কীভাবে ওষুধ খেতে বলেছিলাম?’
রোগী বলল, ‘আপনি বলেছিলেন দুটো ওষুধের বড়ি খালি পেটে খেতে।’
ডাক্তারবাবু বললেন, খুব অবাক হয়েই বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে?’
রোগী বলল, ‘দেখুন ডাক্তারবাবু, আজ সকালে একটা বড়ি খাওয়ার পরে খেয়াল হল, এরপরে তো আর খালি পেট রইল না। এবার দ্বিতীয় বড়িটা খালিপেটে খাই কী করে?’
এই অসম্ভব সমস্যার কী সমাধান ডাক্তারবাবু করেছিলেন, তা আমরা জানি না।
মহাবীর নেপোলিয়ন নাকি বলেছিলেন, ‘একমাত্র মূর্খের অভিধানেই অসম্ভব শব্দটি পাওয়া যায়।’
মহাবীর নেপোলিয়ন মূর্খ ছিলেন না অবশ্যই। কিন্তু তাঁর এই উক্তিটি তাঁর নিজের জীবনেই খাটেনি।
অন্য এক ব্যক্তি একটু অন্যরকম কথা বলেছিলেন, কথাটার মূল্য আছে। কথাটা হল, ‘কোনও কিছুই অসম্ভব নয় সেই লোেকটির কাছে, যাকে এই কাজটি নিজেকে সমাধান করতে হবে না।’
তবে কিছু জিনিস তো অসম্ভব থাকবেই। সেই কত যুগ আগে, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনেস পরিষ্কার বলেছিলেন, ‘কাঁকড়ার পক্ষে কি আর সোজা হয়ে হাঁটা সম্ভব?’
অর্থাৎ কাঁকড়ার পক্ষে সোজা হয়ে হাঁটা প্রাকৃতিক নিয়মের বিরোধী, তার শারীরিক গঠনের বিরোধী। সে চেষ্টা করলেও সোজা হয়ে হাঁটতে পারবে না।
যে যা পারে তার পক্ষে সেটাই সম্ভব।
আমার পক্ষে হাজার চেষ্টা করেও শ্যামকুমারবাবুর বা ভবদুলালবাবুর মতো লেখা সম্ভব নয়।
এবং এও নিশ্চয়ই শ্যামকুমারবাবু বা ভবদুলালবাবু প্রাণপাত করেও আমার মতো লিখতে পারবেন না। শ্যামকুমারবাবু-শ্যামকুমারবাবুর মতো, ভবদুলালবাবু-ভবদুলালবাবুর মতো এবং আমি তারাপদবাবু-তারাপদবাবুর মতো লিখতে পারব।
বাজে কথা নয়, গল্প বলি।
অসম্ভবের শেষ গল্পটা একটু অন্যরকম।
একদিন সকালবেলা রাস্তায় দেখি একটি খবরের কাগজের হকার, খুবই অল্পবয়সি ছেলে, নানারকম দৈনিক পত্রিকার বিশাল বোঝা কাঁধে করে বিলি করতে বেরিয়েছে।
আমার একটু মায়া হল। ছেলেটিকে ডেকে বললাম, ‘এ তো অসম্ভব কথা। এত ভারী কাগজের বোঝা বইতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না।’
ছেলেটি অমায়িক হেসে বলল, ‘আমার কেন কষ্ট হবে স্যার? আমাকে তো আর এই খবরের কাগজগুলো পড়তে হয় না। আমি শুধু বিলি করি।’
পুনশ্চ:
এটি এক গাঁজাখোরের গল্প।
সে এক গাঁজার আড্ডা থেকে প্রভূত নেশা করে বাড়ি ফিরছিল।
এই ফেরার পথে সে একদিন একটা অসম্ভব সমস্যায় পড়েছিল। আমাদের কাছে অসম্ভব মনে হলেও, বলাবাহুল্য গাঁজাখোরেরা প্রায়শই এ রকম সমস্যায় পড়ে থাকে।
এই গাঁজাখোরের বাড়ি এবং গাঁজা খাওয়ার আড্ডাটা একই রাস্তার দুই প্রান্তে। শুধু রাস্তার এপার আর ওপার। পূর্ব-পশ্চিম রাস্তার এপাশের ফুটপাতের শেষ মাথায় গাঁজাখোরের উত্তরমুখী বাড়ি আর অন্য মাথায় বিপরীত ফুটপাতে গাঁজার আড্ডা।
গাঁজার আড্ডা থেকে বাড়ি ফেরার পথে কীরকম সব ঘুলিয়ে গেল গঞ্জিকাসেবীর, সে একবার একজনকে জিজ্ঞাসা করে, ‘দাদা, রাস্তার ওপারটা কোথায়?’ পথচারী উলটোদিকের ফুটপাত দেখিয়ে দেয়।
এরপর উলটোদিকে ওই একই প্রশ্ন করাতে ওদিকের পথচারী এপাশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
সেদিন আর গঞ্জিকাসেবীর বাড়ি ফেরা সম্ভব হল না। সারারাত ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাথা চুলকে গেল আর বলতে থাকল, ‘এ তো অসম্ভব ঝামেলা। সবাই মিলে আমাকে পাগল পেয়েছে নাকি। বাজার এদিকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, এপার এদিকে আবার ওপারে গেলেই এদিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, এপার এদিকে। ওপার যে কোনদিকে বাবা কে জানে?’
অনুমান করি এবং আশা করি যথাসময়ে নেশা কাটলে এই গঞ্জিকাসেবী ভদ্রলোক রাস্তার এপার এবং ওপারের তারতম্য ধরতে পেরেছিলেন এবং স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করতে পেরেছিলেন।
পুনশ্চের গল্পটি এবারে বড় হয়ে গেল। সুতরাং যথোচিত এক ক্ষুদ্র পুনশ্চ জুড়ে দিয়ে শেষ করি।
পুনশ্চ: একটি অসম্ভব বিবাহ-বিচ্ছেদ।
এ রকম বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ফরাসি দেশ ছাড়া আর কোথায়ই-বা সম্ভব।
এক ফরাসি রমণী খুব গোয়েন্দা গল্পের ভক্ত। অনেক খুঁজে খুঁজে সে একটা নতুন রহস্যকাহিনী কিনে এনেছে। এদিকে হয়েছে কী তার ফাজিল স্বামীর বইটা আগেই পড়া। সে টেবিল থেকে স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে বইটা তুলে নিয়ে মলাটে লিখে রাখল সেই খুনের কাহিনীর অপরাধীর নাম। ফলে গল্প পড়ার সমস্ত উত্তেজনাই মাটি।
নিষ্ঠুরতার দায়ে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করলেন স্ত্রী এবং মামলাটা জিতলেন। ফরাসি আদালত কিনা।