অসমাপ্ত

অসমাপ্ত

ধরুন, আপনি একটি গল্পের বই পড়ছেন৷ ধরুন, বইটা হল একটা ডিটেকটিভ বই৷ ধরুন, পড়তে-পড়তে আপনি বইয়ের একদম ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে গেছেন—কিন্তু তারপর দেখলেন, বইয়ের শেষ কয়েকটা পাতা, নেই৷ আপনার ঠিক কী মনে হবে? প্রথমে বইটা যে বিক্রি করেছিল তার ওপর রাগ হবে৷ তারপর অস্বস্তি হবে৷ তারপর কৌতূহল হবে৷ কৌতূহল মেটাতে আপনি ওই বইয়েরই একটা অন্য কপি জোগাড় করবেন৷ কিন্তু, সেটা বই না হয়ে, যদি হয় ডায়েরি! আর ঘটনাটা—কল্পনার বদলে যদি হয় বাস্তব, তাহলে? তাহলে কী করবেন! আজ যে গল্পটা আপনাদের শোনাব, সেই গল্পটার শেষটাও, লেখক লিখে যেতে পারেননি৷ কিন্তু হতাশ হওয়ার কিছু নেই; সেটা জানার উপায়ও তিনি দিয়ে গেছেন৷ কিন্তু আগে গল্পটা মন দিয়ে পড়ুন৷ এই গল্পের প্রতিটা সত্যকে— অনুভব করুন৷

প্রথম ভাগ—একটি পুরনো ডায়েরি

১৭ই বৈশাখ

আলমারির উপরের তাকটা টেনে বার করতেই ভিতরের পুরনো দলাপাকানো কাগজের ঝাঁক হুড়মুড়িয়ে মাটির উপর ঝরে পড়ল৷ কে জানে কতবছর কাগজগুলো এভাবেই আস্তানা গেড়েছিল আলমারিতে, এতদিন পরে বাইরের আলো তাদের উপর এসে পড়ায় বোধহয় হকচকিয়ে গেছিল, আমি নীচু হয়ে সেগুলো হাতে তুলে নিলাম, একবার চোখ বুলিয়েই বুঝলাম তার বেশিরভাগই দলিল৷ এই নিয়ে এ-বাড়ির ওয়ারিশ তো নেহাত কম হল না, শুনেছি প্রায় দেড়শো বছর আগে আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা নাকি এই বাড়ি বানিয়েছিলেন, ইংরেজ আমল তখন সবে শুরুর পথে৷ তো আমার সেই অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ কোনও এক সাহেবের গোলামি করে মুর্শিদাবাদের একপ্রান্তে এক পেল্লায় জমিদারি বাগিয়েছিলেন, সাথে এই প্রাসাদের মতো বাড়িটা৷ কালে-কালে ২০০ বছরের ইংরেজ আমল শেষ হতে আমার পূর্বপুরুষের সাধের জমিদারিও প্রায় নিভে এল; আর এখন তো এর কঙ্কালটাই খালি পড়ে আছে৷ দলিলগুলোয় আমি ভালো করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম৷ পুরনো হলদেটে শক্ত কাগজ, একটু জোরে চাপ দিলেই পাঁপড়ের মতো ভেঙে যাবে৷ হঠাৎ একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়তেই আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ রাশি-রাশি হিসেবের ভারীক্কি কাগজের মাঝখানে একটা ছোট্ট গোলাপি খাতা উঁকি দিচ্ছে৷ দলিলগুলোকে আবার আলমারিতে চালান করে সেটাকে হাতে নিলাম আমি; খাতাটা লম্বায় ছ’ইঞ্চির বেশি হবে না, উপরে গোটাগোটা হরফে লেখা আছে, ‘সন্ধ্যামণি দত্ত, সন ১২৭০’৷

আমি হিসেব করে দেখলাম খাতাটা এই বাড়ির থেকেও পুরনো৷ হাতের লেখাটা দেখে মনে হয় লেখিকার বয়স দশের বেশি হবে না, অর্থাৎ খাতাটা যারই হোক তিনি অন্তত একশো বছর আগে গত হয়ছেন৷ আমার মনে কেমন জানি কৌতূহল হল, অত বছর আগে একটা বছর দশেকের বাচ্চা মেয়ে খাতায় কী লিখতে পারে কে জানে! উলটে-পালটে দেখে বুঝলাম লেখা তাতে প্রায় নেই বললেই চলে৷ বেশিরভাগই হাতে আঁকা ছবি, আজকালকার দিনের বাচ্চারাও এমন ছবি এঁকে থাকে, জলের উপর মাঝি দাঁড় বাইছে, একদল লোক তলোয়ার নিয়ে মাঠের উপর হাঁটছে এইসব৷ খাতাটা সাথে নিয়ে আমি ভিতরের ঘরে চলে এলাম৷ এ বাড়িতে আসার পর থেকে একটা জিনিসের অভাব হয় না—অবসর৷ কাজ বলতে এখানে প্রায় কিছুই নেই, সকালে একটা ঠিকে ঝি এসে দু-বেলার রান্না করে দিয়ে যায়, সেটা থেকেই আমার পরের দিন সকালের জলখাবার অবধি হয়ে যায়, খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম ছাড়া বাকি সময়টা সারা বাড়িটার এদিক-ওদিক ঘুরেই সময় কেটে যায়, আমার আগে প্রায় বছর পঞ্চাশেক এ বাড়িতে কেউ থাকেনি৷ মনে হয় এই ভাঙাচোরা বাড়িটার প্রতিটা অন্ধকার কোণে কয়েকশো বছরের ইতিহাস লুকিয়ে আছে৷ মাঝে-মাঝে কেমন যেন ভয় লাগে, বিশেষ করে খুব রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কেন জানি না, মনে হয় বাড়ির অন্য কোনওদিকে কে যেন হাঁটাচলা করছে৷ এ শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িতে শুধু ইতিহাস ছাড়া অন্য কিছু লুকিয়ে নেই তো?

২৮শে বৈশাখ

এই ক-দিনে একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করেছি, চারপাশ খুব নিস্তব্ধ হয়ে গেলে খালি মনে হয় বাড়ির কোথা থেকে যেন কারও হেঁটে বেরানোর শব্দ আসে৷ তার সাথে খুব হাল্কা নূপুরের আওয়াজ৷ অর্থাৎ পায়ে নূপুর পরে বাড়ির ভিতর কেউ চলাফেরা করে৷ শব্দটা কিন্তু কখনও কাছে আসে না, যেন পায়ের মালিক আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চায়! আমাকে কি ভয় পায় সে? অথচ কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে আমার নজর বাঁচিয়ে এ বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়৷ এমনিতে আমি ভীতু মানুষ নই, যদি হতাম তাহলে দিন দশেক আগেই এ বাড়ি ছেড়ে চম্পট দিতাম; রান্নার ঝিকে একবার একথা বলতে গিয়েও বলিনি, ছেড়ে দিয়ে যদি চলে যায় তাহলে নতুন ঝি পাওয়া মুশকিল৷

দু-দিন হল দলিলের ভাঁজে পাওয়া সেই খাতাটাও খুঁটিয়ে দেখেছি৷ তাতে ছবি ছাড়াও আরও কিছু লেখা আছে, তবে তার বেশিরভাগই হাবিজাবি অর্থহীন লেখা৷ যেন সদ্য বানান শিখে মকশো করেছে কেউ, যার মধ্যে ‘সন্ধ্যামণি’ শব্দটা বেশ কয়েকবার দেখেছি৷

একটু আগেই ঝমঝমে নূপুরের শব্দটা শুনতে পাচ্ছিলাম, সেটা আসছিল উপরের তলার উত্তর দিকের ঘর থেকে৷ আমি এ ঘরের দরজা খুলে একটু এগোতেই থেমে গেল৷ ব্যাপারটা থেকে কেন জানি না মন সরাতে পারছি না৷ একটা সম্ভাবনার কথা ভেবেছি মনে-মনে, তবে সেটা এখন ডায়েরিতে লিখব না৷ দেখা যাক৷

৭ই জ্যৈষ্ঠ

আগেই লিখেছি যে ভূতে আমি ভয় পাই না; ইদানীং একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি, মনের দরজা খোলা রাখলে ভূতে ভয় পাবার কোনও কারণও নেই৷ মানুষের মরণোত্তর অবস্থাই তো প্রেত৷ মৃত্যুর পর সে অকারণে হিংস্র হয়ে উঠবে কেন? অন্যর ক্ষতি করে বা ভয় দেখিয়ে আনন্দ পাবে কেন? এ বাড়ির আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা নূপুরের অধিকারিণী দিনকতক হল আমার কাছাকাছিই ঘোরাফেরা করছে৷ শুধু তাই নয় এও বুঝতে পারছি যে তার বয়সও অত্যন্ত কম, যদিও তাকে দেখা যায় না, তাও তার উপস্থিতি আমি টের পাই৷ আলমারির উপর থেকে পাওয়া খাতাটাও সম্ভবত তার, অর্থাৎ জীবিতকালে তার নাম ছিল সন্ধ্যামণি দত্ত৷ অবশ্য এত অল্প বয়সে সে যে কী করে মারা গেল তা আমি জানতে পারিনি৷

একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, ঘরে আমি না থাকলে সে তার খাতাটায় কলম দিয়ে আঁচড় কাটে, কখনও ছবি আঁকার চেষ্টা করে, কিন্তু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায় সেগুলো অপরিণত মননের হাবিজাবি কল্পনা নয়৷ দাগ আর ছবি দিয়ে কিছু যেন বলতে চায় সে, হয়তো আমাকেই৷ কিন্তু সেগুলোর কোনও মানে খুঁজে বের করতে পারি না আমি৷ যাই হোক মোটকথা গল্পকাহিনির ভয়ানক ভূতের মতো সে আমার কোনও ক্ষতি এখনও অবধি করেনি, বরঞ্চ একরত্তি অকালে ঝরে যাওয়া মেয়েটার কথা ভাবলে আমার দুঃখই হয়৷ কী করলে যে তার আত্মার শান্তি হবে যদি জানা যেত… হয়তো আঁকিবুঁকি কেটে সেটাই আমাকে বোঝাতে চায় সন্ধ্যামণি৷ কিন্তু কী সেটা?

কাজকর্ম বিশেষ নেই বলে এইসব ভেবেই সময় কাটে৷ অবশ্য এছাড়া আর একটা কাজ আছে আমার৷ বাড়ির ঠিক বাইরেই এককালে মস্ত ফুলের বাগান ছিল, যত্নের অভাবে সেখানে এখন লতাগুল্মের জঙ্গল হয়ছে৷ পুরনো শ্বেতপাথরের ফোয়ারাটাও বুনো ঝোপের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে৷ এক সপ্তাহ হল ভেবেছি বাগানটাকে আবার নতুন করে সাজাব৷ তাতে বাড়িরও খানিকটা শ্রী ফিরবে আর আমারও সময় কাটবে৷ গত শনিবার মুকুন্দকে চারা আনতে বলেছিলাম, আজ নিয়ে আসবে বলেছে৷

ওহ! একটা কথা লিখতেই তো ভুলে গেলাম! আমার অদৃশ্য সহবাসিন্দা সম্ভবত ফুল ভালোবাসে, আজ সকালে বাগানটা দেখতে এসেছিলাম, হঠাৎ দেখি একটা গোলাপি বুনো ফুল বিনা হাওয়াতেই দোল খাচ্ছে৷ আমি সেদিকে এগিয়ে যেতেই একটা ছনছনে নূপুরের শব্দ একদৌড়ে সদর দরজার দিকে মিলিয়ে গেল৷

২৭শে আষাঢ়

এতদিন ডায়েরি লিখিনি, লিখতে ভালো লাগে না৷ আমার সমস্ত সময়টা কেটে যায় সন্ধ্যামণির সাথে; আট-নয় বছরের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে, মৃত্যুর পর থেকে আর বাড়েনি সে, তার সারা বাড়িময় দৌড়ে বেড়ানো, ছাদের দরজা থেকে লাফিয়ে সিঁড়িতে আছড়ে পড়া দেখে মনে হয় না বেঁচে থাকলে তার বয়স হত দেড়শরও বেশি৷ বাড়ির কাজের লোক থাকলে সে চিলেকোঠার ঘরে চুপটি করে বসে থাকে, ছাদের পাঁচিলে নির্ভয়ে পায়চারি করে, তারা চলে গেলে হুড়ুম-দুড়ুম করে লাফাতে-লাফাতে চলে আসে আমার ঘরে৷ আমি এখনও তাকে দেখতে পাই না৷ তবে ঘরে এসেই সে আমার মসলিনের পর্দা ধরে দোল খায়, শূন্যে পর্দাটাকে ঘুরপাক খেতে দেখে বুঝতে পারি সে এসেছে৷ মাঝে-মাঝে তাকে গল্প শোনাই আমি৷ আমার ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা গল্পগুলো৷ বেশিরভাগই রূপকথার, কয়েকটা ভূতেরও; বলতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেলি, মনে-মনে বলি ‘মায়ের কাছে মাসির বেত্তান্ত৷’ বেশ বুঝতে পারি সে গল্পগুলো গোগ্রাসে গেলে, পর্দার ঠিক নীচটায় চুপ করে বসে থাকে৷ এক-একদিন আমার মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি আসে, গল্পের শেষটা না বলে চুপ করে যাই৷ আর সাথে-সাথে আমার আলনা থেকে একটা-একটা করে শাড়ি ছিটকে পরে ঘরের আর একদিকে৷ সন্ধেবেলা আমি সাজতে বসলে সে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে৷ আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে মনে-মনে কল্পনা করার চেষ্টা করি তার পলকহীন বিস্ময় মাখানো চোখদুটো৷ হয়ত ওরও এভাবে সাজতে ইচ্ছা করে৷

এত কিছুর পরেও খাতার লেখাগুলোর মানে কিন্তু এখনও বুঝতে পারিনি আমি৷ খুব জানতে ইচ্ছা করে, এটুকু বয়সে সে মারা গেল কেন৷ এভাবে থাকতে কি ওর কষ্ট হয়? মৃত্যুর পরে আত্মা ঠিক কী অবস্থায় থাকে? পুরনো লোকেদের জিজ্ঞেস করে জানার চেষ্টা করেছি এ বাড়িতে কোনও অল্প বয়সি বাচ্চা মেয়ে কোনওদিন মারা গেছিল কি না; তারা কিছুই বলতে পারেনি, এমনকি সন্ধ্যামণি দত্ত নামটাও তারা শোনেনি কোনওদিন৷ আশ্চর্য! তাহলে খাতাটা এখানে এল কী করে? কী করলে তার অর্থ জানতে পারব? আদৌ কোনওদিন জানতে পারব কি?

আমার পিঠের কাছে কার যেন নিঃশ্বাস পড়ল৷ আমি পিছন ঘুরে কাউকে দেখতে পেলাম না৷ অবশ্য সেটাই আশা করেছিলাম, এবার ডায়েরি লেখা বন্ধ করতে হবে৷

১২ই শ্রাবণ

ভেবেছিলাম আর ডায়েরি লিখব না৷ আগে লিখতাম সময় কাটাতে, এখন তো আর সময়ই পাই না; যেন আবারও একবার ছোটবেলায় ফিরে গেছি আমি, আমার অদৃশ্য সঙ্গিনীর হাত ধরে৷ তাও আজ ডায়েরি লেখার একটা বিশেষ কারণ আছে৷ হয়তো আজ থেকে বহু বছর পরে ডায়েরির এই পাতাগুলো পড়ে কেউ চমকে উঠবে৷ অবশ্য এগুলো কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বিশ্বাস করবে বলে আমার মনে হয় না৷ এমনকি আমিও হয়তো নিজের ছেলেমানুষ বয়সের পাগলামি ভেবে হাসব৷ তাও কাউকে ঘটনাগুলো না জানিয়ে গেলে আমার শান্তি হবে না৷ আমার মৃত্যুর সাথে-সাথে হয়তো এই অলৌকিক ইতিহাসও সাক্ষীর অভাবে মুছে যাবে৷ যাই হোক এবার আজ সকালের ঘটনায় আসা যাক৷

যত দিন যাচ্ছিল সন্ধ্যামণির গল্প শোনার নেশাও উত্তরোত্তর বাড়ছিল৷ ক্রমে তার গল্পের খিদের সাথে আমার স্মৃতির পাল্লা দেওয়া দুষ্কর হয়ে উঠল৷ এদিকে সেও নাছোড়বান্দা, একটা ঘর গুছিয়ে অন্য ঘরে যাওয়া মাত্র ঘরের সমস্ত পরিপাটি করে সাজানো জামাকাপড় লন্ডভন্ড হয়ে যায়৷ বুঝতে পারি সেগুলো আমার গল্পের ঝুলিতে টান পড়ার মাশুল৷ কী করি? দিন কতক ভেবে একটা মতলব করেছি৷ মুকুন্দকে বলেছি সে শহরের দিকে গেলে যেন আমার জন্য একগোছা ইংরেজি-বাংলা গল্পের বই নিয়ে আসে৷ সে গল্পগুলো পড়ে-পড়ে শোনালেও শ্রোতা প্রসন্ন হবেন৷

এমন করে দিন কতক চলছিল৷ আমি চেয়ারে বসে একটার পর একটা গল্প পড়ি আর সেই নির্বাক অশরীরী এক মনে শুনতে থাকে৷ একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, গল্প শুনতে-শুনতে সে যেন একটু-একটু করে পর্দার নীচটা ছেড়ে আমার চেয়ারের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে৷ যেন বইয়ের লেখাগুলো নিজের চোখে দেখতে চায়৷ তার উৎসাহ যেভাবে বাড়ছে তাতে এভাবে বেশিদিন চললে আমার বাড়ির একটা ঘর নিয়ে লাইব্রেরি না বানাতে হয়! প্রেত যে এত গল্পখোর হতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না৷

আজ সকালে একটা ঘটনা ঘটল৷ রাশিয়ার রূপকথা পড়ে শোনাচ্ছিলাম তাকে৷ পড়তে-পড়তে নিজেই এত মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম যে খেয়ালই করিনি আমার অদৃশ্য শ্রোতা এখন আর আগের মতো স্থির নেই৷ অস্থির হয়ে সে যেন ছোটাছুটি করছে আমার চারপাশ ঘিরে৷ তার দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দে আমার সম্বিৎ ফিরল, বুঝলাম, কিছু একটা কথা আমাকে বলার জন্য সে ছটফট করছে৷ হঠাৎ কী হল বুঝতে পারলাম না৷ এরকম সে কখনও করে না! আজ কী হল তার? কী বলতে চায় আমাকে? ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে বইয়ের পাতা ওলটানোর চেষ্টা করলাম আর সাথে-সাথে অবাক হয়ে গেলাম৷ একটা অদৃশ্য হাত চেপে ধরেছে খাতার পাতাটাকে৷ অর্থাৎ সে চায় না আমি পাতা ওলটাই৷ কিন্তু কেন? হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল৷ এই পাতাতেই কিছু একটা আছে৷ কোনও ছবি বা কোনও লেখা, যেটা দিয়ে সে আমাকে কিছু বোঝাতে চায়৷ হয়তো তার মৃত্যুরহস্য! আমি আমার সামনে খোলা বইয়ের পাতার দিকে একবার ভালো করে তাকালাম৷ একটাই ছবি আছে পাতাতে৷ একটা কফিনের, আমি সেটার উপর আঙুল রাখলাম, সাথে-সাথে বুঝলাম নিঃশ্বাসের শব্দ প্রায় হাপরের মতো বেড়ে গেল৷ অর্থাৎ আমি ঠিক দিকেই যাচ্ছি৷ কিন্তু এরপর? শুধু কফিন৷ এর মানে কী? তবে কি একটা কফিনের ভিতর আছে তার মৃতদেহটা? কিন্তু কেন? আর সেটাই বা আছে কোথায়?

একটা দমকা হাওয়ার স্রোতে বুঝতে পারলাম আমার পাশ থেকে দৌড়ে ঘরের দরজার দিকে ছুটে গেল সে, উড়ন্ত পর্দাটাকে ধরে কয়েকবার দোল খেল৷ কী বলতে চায়? আমাকে কি যেতে বলছে কোথাও? আমি বইটা রেখে সেদিকে যেতেই দোল থেমে গেল, বুঝলাম সে ধীরে-ধীরে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে৷ আমিও নেমে এলাম নীচে৷ বাগানে নেমেই সেই দুরন্ত হাওয়ার স্রোতটা উত্তর দিকে ছুটে গেল৷ সেদিকে এখনও কোনও গাছ লাগাইনি আমি৷ বুনো ফুলের আগাছায় ভরে আছে জায়গাটা৷ এবার লক্ষ করলাম শুধু সেদিকটায় যেন ঝড় উঠেছে, বাগানের অন্য সমস্ত গাছপালা স্থির, শান্ত৷ ভয় হল হাওয়ার ধাক্কায় এবার বুঝি শতাব্দীপ্রাচীন গাছগুলো ভেঙে পড়বে৷ কী আছে ওই গাছগুলোতে? আমি সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম৷ কী করব বুঝতে পারছি না৷ হঠাৎ খেয়াল করলাম, এতক্ষণ যে ঘরে বসে আমরা বই পড়ছিলাম তার জানলা থেকে একটা উড়ন্ত কাগজ এসে পড়ল পুরনো গাছগুলোর ঠিক মাঝখানের মাটিতে৷ আমি কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম সেই বইয়ের পাতাটা৷ সেই কফিনের ছবিটা৷ কিন্তু আর একটা জিনিস যোগ হয়েছে তার সাথে৷ কফিনের ঠিক নীচটায় পেন্সিল দিয়ে একটা ছোট্ট খুপরি আঁকা আছে, যেন কফিনের তলায় লুকানো গয়নার বাক্স৷ এটা আগে ছিল না, সদ্য কেউ কাঁচা হাতের আঁচড়ে এঁকে দিয়েছে সেটা৷

১৪ই শ্রাবণ

আজ সকাল থেকে মনটা কিসের যেন আশঙ্কায় ভার হয়ে আছে৷ যে কাজটা আমি করতে চলেছি সেটা ঠিক হবে কি না জানি না৷ তবে কাল সারাটা দিন ভেবে দেখেছি, এ রহস্যের শেষ না দেখে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়৷ রহস্যের খানিকটা আমার কাছে পরিষ্কার, বেশিরভাগটা এখনও ধোঁয়াশা৷ আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে সন্ধ্যামণি দত্ত নামের একটি ছোট্ট মেয়ের কোনওভাবে মৃত্যু হয়৷ সেটা স্বাভাবিক মৃত্যু নাকি অন্য কিছু তা আমি জানি না৷ তবে যে কারণেই হোক তাকে প্রচলিত হিন্দু মতে দাহ করা হয়নি৷ এ বাড়ির লাগোয়া বাগানে কফিনবন্দি করে কবর দেওয়া হয়৷ শুধু তাই নয়৷ কফিনের নীচে রাখা হয় একটা গোপন খুপরি৷ কী আছে তাতে? কফিনের নীচে কি কেউ কিছু লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল? এটা জেনেও যে সে নিজে চাইলেও আর ফেরত পাবে না সেটা? সমস্ত ব্যাপারটায় কেমন যেন অন্ধকার ঘোলাটে ভাব৷ অনেকগুলো প্রশ্ন আমার মনে ভিড় করে আসছে৷ ঠিক কী কারণে মৃত্যু হয়েছিল সন্ধ্যামণির? কেন তাকে দাহ করার বদলে কবর দেওয়া হল? কী আছে ওই খুপরিটায়? অসহ্য অস্থিরতা আমায় কুরে-কুরে খাচ্ছে৷

আজ সকাল থেকে সন্ধামণি আমার ঘরে আসেনি৷ রাতে উত্তেজনায় ঘুম হয়নি, সকালে বিছানায় শুয়ে তন্দ্রা এসে গেছিল৷ ঘুমের ঘোরে দেখলাম আমার ঘরের পর্দাটা নড়ছে৷ তার ঠিক নীচেই দাঁড়িয়ে আছে বছর দশেকের মেয়েটা৷ হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে৷ হাতের ইঙ্গিতে জানলার দিকে নির্দেশ করছে৷ জানলার দিকে তাকাতেই আমার হৃৎপিণ্ডটা এক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে গেল৷ আমার দোতলার জানলায় লোহার শিক ধরে দাঁড়িয়ে একটা খয়েরি হয়ে যাওয়া দেহ, মাংসহীন শুকনো মুখে সেটা যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ আতঙ্কে চমকে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল৷ জানলা ফাঁকা৷ দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম পর্দাটা পাথরের মতো স্থির৷ সে আসেনি৷

বাগানে মাটি কোপানোর কোদালটা মুকুন্দকে বলে আনিয়ে রেখেছি৷ টর্চে ভরে নিয়েছি নতুন ব্যাটারি৷ আজ রাতেই হয়তো সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হয়ে যাবে আমার কাছে৷ বুকের মাঝখানটা কেমন যেন দুরুদুরু করছে৷ কাজটা হয়তো ঠিক হচ্ছে না৷ কিন্তু তাও আমি পিছু হটব না৷ বাগানের একপাশে কফিনটা যেন আমায় টানছে৷ এখন শুধু রাতের প্রতীক্ষা৷

দ্বিতীয় ভাগ—খোঁজ

ডায়েরিটা বন্ধ করে প্রায় দশ মিনিট চুপ করে বসে রইলাম৷ গত কয়েকদিনে এই অংশটা অন্তত কুড়িবার পড়েছি৷ তাও সমস্ত ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢোকেনি৷ আমার মা স্রিজোফেনিয়াক ছিলেন না তার সাক্ষী আমি নিজে৷ যে বিপুল পরিমাণ পাঠক এত বছর ধরে তাঁর লেখার কদর করেছে, প্রকাশিত হবার সাথে-সাথে লাফিয়ে পড়ে তার বই কিনেছে, তারা হয়তো ভাবতেও পারবে না তাদের প্রিয় লেখিকা তার অল্প বয়সে লেখা ডায়েরির পাতায় লিখে গেছেন এই উদ্ভট সাহিত্য৷ সাহিত্য বললাম কারণ তা ছাড়া এ লেখার অন্য কোনও ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে, এটা যদি বাস্তব হয়, তাহলে…

এক সপ্তাহ হল লেখিকা কুসুমিকা চৌধুরী মারা গেছেন৷ সে সময়টা আমি এখানে ছিলাম না৷ শুনেছি মা নাকি বেশ কয়েকবার আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন৷ লন্ডনে ফ্লাইটের অসুবিধা থাকায় আমার এসে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ৷ কলকাতায় পৌঁছাতে দেখলাম বাড়ির সামনে লোকজনের ভিড়৷ প্রেস, মিডিয়া, সাংবাদিক আর শোকার্ত সহকর্মীদের ভিড় ঠেলে মৃতদেহের সামনে এসে পড়লাম৷ বিগত দু-বছর মায়ের সাথে আমার তেমন যোগাযোগই হয়নি৷ তাও বিছানার ওপর শায়িত দেহটা যেন আমার বহুদিনের চেনা৷ তার ঠিক পাশেই পড়ে আছে একটা পুরনো ডায়েরি৷ লেখালিখির ব্যস্ততার মধ্যেও এ অভ্যাসটা থেকেই গেছে৷ তবে মায়ের কোনও ডায়েরি আজ অবধি পড়ার সুযোগ হয়নি৷ সারাদিনের কাজ শেষ করে লেখার ঘরে ঢুকে তিনি ডায়েরি লিখতেন৷ ছোটবেলায় আমি মাঝে-মাঝে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতাম৷ বিছানায় আধশোয়া হয়ে একমনে একটানা লিখে চলেছেন৷ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘অন্য লেখা ভেবেচিন্তে বানিয়ে লিখতে হয়, কিন্তু ডায়েরির বেলা সেটা করতে গেলেই মুশকিল, যা মনে আসে তাই লিখি৷’

আজ কিন্তু তার মৃতদেহের পাশে ডায়েরিটা পড়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলাম৷ সেটা যে নতুন নয় তা তার বাইরের মলাট দেখলেই বোঝা যায়৷ মৃত্যুর আগে মা যে কেন একটা পুরনো ডায়েরি এঘরে নিয়ে এসে শুয়েছিলেন সেটা বুঝলাম না৷ পরে অবশ্য শুনেছিলাম মা নাকি সেটা আমাকেই দিতে চাইছিলেন৷ প্রথমে আমি ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিয়নি৷ এক সপ্তাহ হল সেটা আমার ডেস্কেই পড়ে ছিল, গত পরশু লোকজন নিমন্ত্রণ সেরে বাড়ি ফিরে হঠাৎ মনে হল ডায়েরিটা পড়ে দেখা যাক৷ প্রথম থেকে পাতার পর পাতা একঘেঁয়ে বর্ণনা, কিশোরী মেয়ের অলীক কল্পনা, কখনও স্মৃতি রোমন্থন, পড়তে অবশ্য আমার খারাপ লাগছিল না৷ নিজের মায়ের ছেলেবেলার কথা জানতে কার না ভালো লাগে৷ উনিশ বছর বয়সে মা বাড়ি বদল করে৷ চৌধুরীদের জমিদারি ভাগাভাগি হতে মায়ের ভাগে পড়ল পুরনো জমিদার বাড়িটা৷ মা সেখানে গিয়েই থাকতে লাগলেন৷ ডায়েরিতে তারপর থেকেই শুরু হছে এই আজগুবি উপাখ্যান৷ তাতে শেষ পর্যন্ত বোঝা যায় যে ১৪ই শ্রাবণের রাতে মা বাড়ির সামনের বাগান কুপিয়ে একটা কফিনের ঢাকনা খুলে নীচে কিছু দেখার চেষ্টা করবেন বলে ঠিক করেছিলেন৷ কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ১৪ই শ্রাবণের পর আবার ডায়েরি লেখা হচ্ছে ২রা ভাদ্র তারিখে৷ সেখানে কিন্তু কফিন খুপরি বা সন্ধ্যামণি দত্ত সম্পর্কে একটিও লাইন লেখা নেই৷ মা যেন সমস্ত ব্যাপারটা স্রেফ ভুলে গেছেন৷ অথচ দুটো লেখা যে একই ব্যক্তির তা হাতের লেখা আর লেখার নীচে মায়ের সই দেখেই বোঝা যায়৷ তাহলে হলটা কী? যে ঘটনা তাঁকে এত ভাবিয়ে তুলেছিল, যার শেষ দেখতে তিনি একা হাতে মাটি কুপিয়ে পুরনো কফিন পর্যন্ত তুলে আনতে চেয়েছিলেন, সেই ঘটনার শেষটাই তিনি লিখতেই ভুলে গেলেন? লেখাটা যতবার পড়ছি একটা অমানুষিক কৌতূহল আমাকে চেপে ধরছে৷ মৃত্যুর আগে মা ডায়েরিটা আমাকে দিয়ে যেতে চাইছিলেন কেন? তবে কি কিছু কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে? আমাকে কি সেই কাজের ভার দিয়ে গেলেন তিনি?

হুগলি জেলার একপ্রান্তে পুরনো চৌধুরী বাড়িটা অবশ্য এখনও আছে৷ বছর কুড়ি আগে একবার সেটা রিনোভেসনও করা হয়েছিল৷ একবার ইচ্ছা হল বাড়িটা গিয়ে দেখে আসি; বাগানের উত্তর দিকে বিরাট গাছগুলোর নীচে সেই কফিনটা কি এখন আছে? তার নীচের খুপরিতে যা রাখা আছে সেটা কী? যত ভাবছি আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ অবশ্য তার পাশাপাশি একটা সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ ডায়েরিতে লেখা ঘটনাগুলো সত্যি ঘটেছিল কি না! এমনিতে মা একটু কল্পনাপ্রবণ৷ হতে পারে কয়েকদিনের জন্য একটা পাগলামি ভর করেছিল তাঁর মাথায়৷ সেটা খতিয়ে দেখারও একটা উপায় আছে৷ ডায়েরিতে বেশ কয়েকবার মুকুন্দকাকার কথা বলা হয়েছে৷ তিনি এখনও জীবিত এবং আমার সঙ্গে বেশ আলাপও আছে৷ বয়স অবশ্য প্রায় পঁচাত্তরের কাছাকাছি, তাও কিছু কথা যদি তাঁর থেকে জানা যায়৷

কথাটা মনে হতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম৷ টেবিলের একধারে পড়ে ছিল ল্যান্ডফোনটা, রিসিভারটা তুলে নিয়ে নম্বর ডায়াল করলাম৷ ওপাশ থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের গলা শোনা গেল৷ — হ্যালো৷

—মিনি, তোমার দাদুকে দাও তো৷

—কে বলছ?

—আমি ছোটকুমামা বলছি৷

মিনি ফোনটা নামিয়ে রেখে ঘরের ভিতর ডাকতে গেল৷ আমার বুকটা দুরু দুরু করতে লাগল৷ একটু পরে ওপাশ থেকে মুকুন্দকাকার গলা শোনা গেল… ভাঙা গলা৷

—কুসুকে সেই ছোট থেকে দেখছি, আমি থাকতে থাকতেই চলে গেল৷

—জমিদার বাড়িতে তুমি কতদিন কাজ করেছিলে কাকা?

—তোমার মা যতদিন ছিলেন, মানে ধর বছর পাঁচেক৷

প্রশ্নটা ঠিক কীভাবে করব বুঝতে পারছিলাম না৷ আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনি নিজেই প্রশ্ন করলেন৷ ‘কিছু জানতে চাও ছোটু?’

‘এই পাঁচবছরে মাকে দেখে অন্যরকম কিছু মনে হয়ছে?’

‘অন্যরকম মানে?’

‘মানে এই ধরুন কোনও পাগলামি, বা কোনও অদ্ভুত আচরণ?’

‘এসব তুমি কী বলছ ছোটু?’

‘দেখেননি?’

‘না৷’

বুঝলাম মুকুন্দকাকার গলা আস্তে-আস্তে শক্ত হচ্ছে৷ তাকে এই নিয়ে বেশি প্রশ্ন করা ঠিক হবে না৷ আমি ফোনটা রেখে দিলাম৷ কালকের দিনটা ভাবব৷ বাকি ডায়েরিগুলোও পড়ে দেখতে হবে৷ তাতেও কিছু না পাওয়া গেলে আমাকে ফিরে যেতে হবে ডায়েরির ঘটনাগুলোর শিকড়ে৷ মাটি খুঁড়ে হাতড়াতে হবে ইতিহাসের নিষিদ্ধ অন্ধকূপ৷ অজানা আশঙ্কায় আর কৌতূহলে আমার শরীরটা একবার শিউরে উঠল৷

তৃতীয় ভাগ—পুরনো কফিন

সকালবেলা কী একটা জানোয়ারের ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল৷ এমনিতে বিদেশে থাকতে আমার কাজের চাপে ভালো ঘুম হত না৷ কলকাতায় ফিরেও সারাদিনের উত্তেজনায় রাতে ঘুম আসত না৷ শরীরে অনেক দিনের ক্লান্তি জমে ছিল৷ এই প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িতে প্রথম রাতটা এত গভীর ঘুম হবে ভাবতেই পারিনি৷ এখানকার জল হাওয়াতে ম্যাজিক আছে৷ একটু দূরে একটা কম পয়সার ভাতের হোটেল আছে, কাল রাতে এসে সেখানেই খেয়েছিলাম৷ একটা মজার ব্যাপার হল, এখানে সবাই আমাকে আগে থেকেই চেনে৷ নিজের নামে নয়, কুসুর ছেলে হিসেবে৷ একে তো এই গ্রামেরই মেয়ে তার উপর আবার বড় লেখিকা৷ কয়েকজন তো আমাকে জিজ্ঞেসই করে বসলেন, আমিও লেখালেখি করি কি না৷ বলতেই হল সাহিত্য আর আমার অবস্থান একে অপরের থেকে শতাধিক মাইল দূরে৷ বাংলাটা আমার ভালো আসে কারণ বিদেশেও আমার বেশিরভাগ বন্ধুই বাঙালি৷ কিন্তু তা বলে কাজকর্ম ফেলে রাতদিন কলম পেষা আমার পক্ষে সম্ভব না৷ রাতে এসেছিলাম বলে বাগানটা ভালো করে দেখা হয়নি; আজ সকালে দোতলার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সেটা দেখার চেষ্টা করলাম৷ বছর দশেক আগে এখানে একবার এসেছিলাম৷ তার থেকে বেশি কিছু পালটায়নি, তবে গাছপালা অধিকাংশই শুকিয়ে গেছে৷ একজন কেয়ারটেকার আছে বাড়িটা দেখাশোনা করার জন্য, গাছের দেখভাল হয়তো সে করে না৷ মাকে বলেছিলাম বাড়িটা অন্তত ভাড়া দিতে, মা কিছুতেই রাজি হয়নি…

বাগানের একদিকে বুনো গাছের জঙ্গলটা এখনও আছে৷ জানলায় দাঁড়িয়ে আমার কেমন যেন নস্টালজিক লাগল৷ বছর পঞ্চাশেক আগে হয়তো আমার মাও এভাবে ওই জানলায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকত বাগানের দিকে৷ হঠাৎ কী মনে হতে আমি পিছন ফিরে তাকালাম৷ তারপর নিজের মনেই হেসে ফেললাম, নাঃ, পর্দাটা নড়ছে না৷ ব্যাপারটা ভাবতেই এতদিনের চিন্তাগুলো আবার আমার মাথায় ভর করল৷ সেই বাচ্চা মেয়েটার কী হল? কীভাবে মারা গেছিল সে? তার আত্মা কি এখনও মুক্তি পেয়েছে? নাকি এই বাড়িরই কোথাও এখনও নূপুর পরে দৌড়ে বেড়ায় সে? আমি ভালো করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম৷ কোনও শব্দ নেই৷ আমার ইচ্ছা করল এখনই কোদাল নিয়ে খুঁড়তে শুরু করি বুনো গাছের জঙ্গলের মাঝখানটা৷ কিন্তু না, গ্রামের লোকজন দেখলে কিছু ভাবতে পারে, রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভালো৷ এখন বরঞ্চ একবার জায়গাটা দেখে আসা যেতে পারে, মুখ চোখ ধুয়ে আমি নীচে নেমে এলাম৷

অ্যালার্মের শব্দে তন্দ্রাটা ভেঙে গেল৷ রাতে ঘুমিয়ে পড়ার ভয়ে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়েছিলাম৷ কিন্তু ঘুম আমার আসেনি৷ বিছানার একপাশে মাথাটা একটু ঢুলে পড়েছিল৷ ঘড়ির শব্দে আমি উঠে বসলাম৷ রাত আড়াইটে বাজে৷ এতক্ষণে গ্রামের লোকজন ঘুমিয়ে কাদা৷ আমি বাইরে গেলেও কেউ আমাকে দেখতে পাবে না৷ অবশ্য দেখতে পেলেও আমার কাজ তাতে আটকাবে না৷ আমার পৈতৃক ভিটের মাটি আমি কোপালে কার কী তাতে? কোদালটা ঘরের একপাশে রাখা আছে৷ মোটামুটি হাত পাঁচেক মাটি কোপালেই লোহার কফিনটা পাওয়া যাবে৷ জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম৷ ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ জানলার এককোণে রুপোলি চাঁদের একটা কোনা দেখা যাচ্ছে৷ তারাগুলোর দেখা নেই৷ এ গ্রামে এত বড় বাড়ি আর নেই৷ তাই জানলায় দাঁড়ালে সমস্ত দিগন্তরেখাটা চোখে পড়ে৷ মনে-মনে একবার ভাবলাম, কী থাকতে পারে খুপরিটায়? টাকাপয়সা থাকলে হয়তো খানিকটা হতাশই হব৷ ও জিনিসটার অভাব নেই আমার৷ ডায়েরিটা পরে কিন্তু মনে হয় না কফিনের ভিতর এত খেলো কিছু থাকবে বলে৷ আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ আলমারির পাশ থেকে তুলে নিলাম কোদাল, হাতে নিলাম একটা টর্চ৷ বহুবছর আগে আমার মায়ের হাতে এই দুটো জিনিসই ছিল৷ আত্মা কি সত্যিই আছে? মৃত্যুর পরের অবস্থা কী? মানব সভ্যতার ইতিহাসে চিরচর্চিত এই প্রশ্নের উত্তর থেকে আমি আর মাত্র কয়েক মিনিট দূরে৷

সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে বুঝলাম, আমার বুকের ভিতর উত্তেজনার শব্দ ধীরে-ধীরে বাড়ছে৷ সদর দরজা খুলে বাইরে এলাম৷ বেশ ঠান্ডা একটা হাওয়া দিচ্ছে৷ ঝিঁঝির একটানা একঘেয়ে ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই৷ অন্ধকারের চাদরের মাঝে-মাঝে একটা-দুটো জোনাকির আলোয় চারপাশটা আরও মায়াবি লাগছে৷ ঘাসের উপর দিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম৷ ঠিক কোন জায়গাটা খুঁড়তে হবে তার একটা আন্দাজ করে গেছি সকালেই৷ ঝোপঝাড় ভেঙে খানিকটা এগিয়ে গেলাম৷ পায়ে গাম্বুট আছে বলে রক্ষে৷ অন্ধকারে কোনটা কাঁটা গাছ বোঝার উপায় নেই৷ এই পরিত্যাক্ত গাছ আর পাঁচ হাত মাটির তলায় কত শতাব্দীর অলৌকিক ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা কল্পনাও করা যায় না৷ মাঝখানটায় এসে দাঁড়িয়ে দু-হাত দিয়ে মাটির খানিকটা অংশ পরিষ্কার করে নিলাম আমি৷ উপরে তাকিয়ে অন্ধকার আকাশটা দেখতে পেলাম, গাছপালার ডালগুলো যেন ইচ্ছামতো ছিন্নভিন্ন করেছে সেটাকে৷ মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম রাতেও হয়তো এমনি দেখাত আকাশটা৷ কিন্তু দেখত কে?

প্রায় দেড় হাত মাটি কোপানোর পরে আমার খুব ক্লান্ত লাগল, মনে হল সব কিছু আবার আগের মতো করে ফিরে যাই৷ শুধু ক্লান্তি নয়, কেমন যেন ভয়ও লাগছে৷ গলার কাছটা শুকিয়ে এসেছে, অথচ জল আনতেও ভুলে গেছি৷ আচ্ছা যদি কিছু না থাকে? যদি কোনও কফিন না পাই? আমার হৃৎপিণ্ডটা উত্তেজনায় স্থির হয়ে আছে৷ তাও কেন জানি না মনের কোন গভীরে কে যেন বলে উঠল, কফিনটা না পাওয়া গেলেই ভালো৷ কথাটা মাথায় আসতেই আমি নিজেকে ভর্ৎসনা করলাম৷ আমার মায়ের শেষ ইচ্ছা, আর আমি কিনা তাতেই ভয় পাচ্ছি! কোদালটা শক্ত করে ধরে কোপ দিতে লাগলাম৷ যেভাবেই হোক অন্তত ছয় হাত কাটার আগে আমি থামব না৷

কতক্ষণ পরে জানি না, কিসে যেন একটা কোদাল আটকে গেল৷ নরম মাটি নয়; শক্ত কিছু৷ আমি ঘর্মাক্ত শরীরে একবার লাফিয়ে উঠলাম, আছে, কফিন আছে, অর্থাৎ ডায়েরির বয়ান মিথ্যে নয়৷ কোদালটা ছুঁড়ে ফেলে নীচে নেমে দু-হাত দিয়ে মাটি সরাতে লাগলাম৷ আমার মধ্যে কেমন যেন একটা পাগলামি ভর করেছে৷ খানিকটা মাটি সরাতে কফিনের ডালাতে হাত লাগল৷ শক্ত লোহার কফিন৷ উঠে দাঁড়িয়ে তার উপর আলো ফেললাম৷ হাত দুটো যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়তে চাইছে৷ তাও শক্ত করে ধরলাম টর্চটা৷ ঠান্ডা লোহার ডালাটা জায়গায়-জায়গায় ক্ষয়ে গেছে৷ মাথার দিকে ছোট্ট একটা হাতল দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু এরকম হাতল তো কফিনে থাকে না৷ যাই হোক আমি বেশি ভাবলাম না৷ একটু আগের আশঙ্কাটা মুছে গিয়ে মনের ভিতর এখন কেমন যেন উন্মাদনা জেগে উঠছে৷ টর্চটা পাশে রেখে দু-হাতে হাতলটা ধরে টান দিলাম৷ প্রথমে মনে হল একটা কয়েকশো কেজির পাথরকে টেনে তুলছি৷ হাতটা ছেড়ে বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার টান দিলাম, বিকট শব্দ করে খানিকটা উঠে এল ডালাটা৷ শরীরের সমস্ত জোর একত্র করে ঠেলে সরিয়ে ফেললাম সেটাকে৷ কফিনের ভিতরটা অন্ধকার, টর্চের আলো না ফেললে ভালো করে দেখা যাবে না৷ কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি, ভিতরে শোয়ানো আছে একটা কঙ্কাল৷ কিছু যেন একটা গন্ডগোল লাগছে৷ এরকম তো হওয়ার নয়৷ টর্চটা হাতে নিয়ে আলোটা আমি খোলা কফিনের উপর ফেললাম৷

কিন্তু একি! এটা তো কোনও বাচ্চা মেয়ের কঙ্কাল নয়৷ লম্বায় অন্তত পাঁচ ফুট৷ তা কী করে হয়? এ শরীরটা যদি সন্ধ্যামণি দত্তর না হয় তাহলে কার? হঠাৎ একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়তেই আমার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হয়ে গেল৷ কঙ্কালটার ডান হাতের আঙুলে খয়েরি হয়ে যাওয়া একটা আংটি৷ এ আংটি আমার বহুদিনের চেনা, এত বছর ধরে আমার মায়ের আঙুলেও ঠিক এরকমই একটা আংটি দেখে আসছি৷ তাহলে? যদি আমার হিসাব খুব ভুল না হয়, তাহলে এই কফিনে এতদিন যার মৃতদেহ শোয়ানো ছিল তার নাম কুসুমিকা চৌধুরী৷ তাঁর মৃত্যু হয় আজ থেকে অন্তত পঞ্চাশ বছর আগে৷ আর আমি এতদিন যাকে মা বলে জানতাম, সে? আমি মাথাটা চেপে ধরে কফিনের পাশে বসে পড়লাম৷ সব কিছু আস্তে-আস্তে গুলিয়ে যাচ্ছে৷ মনে হচ্ছে বুনো গাছের শিকড়গুলো এগিয়ে এসে চেপে ধরবে আমার গলা৷ সব কিছু ছাপিয়ে একটা পুরনো কৌতূহল গ্রাস করল আমাকে৷ কফিনের তলার খুপরিটা দেখা হয়নি৷ কী আছে ওর ভিতর? কোদালটা হাতে নিয়ে আবার উঠে দাঁড়ালাম৷ ভীষণ ভয় লাগছে আমার৷ মনের ভিতর থেকে কেউ যেন আটকে রাখতে চাইছে আমার হাত দুটো৷ কিন্তু না, এত দূর এসে ফিরে যাব না, আমাকে জানতেই হবে কী আছে ওর ভিতরে৷ মনস্থির করে নিলাম৷ দু-হাতে ধরে ভারী কঙ্কালটা সরিয়ে ফেললাম৷ টর্চের আলো ফেলে দেখলাম একটা বড় চৌকো দাগ, বুঝলাম ওটাই সেই খুপরিটা৷ কফিনের ভিতর ঝুঁকে পড়ে চাপ দিতেই সেটা ফাঁক হয়ে গেল…

চতুর্থ ভাগ—ফেরা

কলকাতায় ফেরার পর থেকে শরীরটা কেমন চনমনে লাগছে৷ এই কয়েকটা দিন গ্রামে কাটিয়ে আসার সুফল বোধ হয়৷ এদিকে মায়ের কাজকর্ম সব মিটেছে৷ অর্থাৎ ক-টা দিন আর ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট নেই৷ অখণ্ড অবসর৷ এই ক-দিনে একটা নতুন নেশায় পেয়ে বসেছে আমাকে—বই পড়া৷ বাংলা, ইংরেজি, ডিটেকটিভ, প্রেম, ভূত এমনকি রূপকথা পর্যন্ত পড়ছি৷ শুধু তাই নয়, ভাবছি নিজেও একটা লিখে ফেলব৷ লিখলে কিন্তু বেশ হয়৷ একটা ভালো প্লট খুঁজে বের করতে হবে খালি, তারপর তো খালি কলম পেষা…আর কী…

(গল্পটি অসমাপ্ত৷ শেষ করার আগেই লেখকের মৃত্যু হয়৷ যে পাণ্ডুলিপিটি আমরা পেয়েছি তাতে গল্পটির ঠিক নীচে হুগলি জেলার কোনও এক জমিদার বাড়ির ঠিকানা লেখা ছিল৷ কোনও ইচ্ছুক ব্যক্তি যদি ঠিকানাটি সংগ্রহ করতে চান তাহলে আমাদের সাথে সত্বর যোগাযোগ করুন৷ ধন্যবাদ৷)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *