‘অসমাপ্ত গানে’ – (1830) – পঞ্চদশ পর্ব

‘অসমাপ্ত গানে’ – (1830) – পঞ্চদশ পর্ব

‘উভয়ভারতী’! কবে কথাটি যেন প্রথম শুনেছিলেন ভাবতে চেষ্টা করলেন বিদ্যালঙ্কার। একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। একষট্টি বছরের বলিরেখার তর্জনীসংকেত, তবু সে হাসিতে একফোঁটা মলিনতার আভাস নেই।

আশ্রমপ্রান্তের গোলক-চাঁপা গাছটি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। ‘আয় বোস মা’। বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন রূপমঞ্জরী। আঃ, চম্পক সৌরভ। সেই চেনা ফুলের সুবাস হাত ধরে নিয়ে এল বহুদিন আগের ফেলে-আসা সোঞাই গ্রামের ছোট্ট কুটিরটিতে। যেখানে তাঁর শৈশব কেটেছে। কেটেছে কৈশোর।

মাতৃহীন গৃহে বিধবা সোনা-মা—যিনি তাঁকে বুকে করে লালন করতেন—মনে পড়ল তাঁর কথা। মনে পড়ল স্নেহাতুর পিতৃদেবের অমূল্য সঙ্গ-সাহচর্য। ভেসে উঠল পিতৃদেবের গল্পবলা অবসরগুলি। অঙ্গনপ্রান্তের ছোট্ট মাটির ঘরটি। সামনে ঐ তো সোনা-মা মাদুর পেতে দিলেন। ঘটির জলে চরণ মার্জনা করে বসলেন এসে একপ্রান্তে। আর ওরা? শুভদা আর সে? মেতেছিল চপল খেলায়।

না হুটোপুটি নয়, অর্থহীন তর্কযুদ্ধ খেলা। শুভদা বলেছিল—তোর মাথায় গোবর পোড়া। রূপমঞ্জরীও ছাড়েনি। উত্তর দিয়েছিল—আর তোমার মস্তকে বুঝি অশ্বডিম্ব?

স্মৃতির মণিমঞ্জুষা সব কিছুই মেলে ধরে। এতগুলি বছরের আড়াল, তবু মনের গভীরে সবই জ্বলজ্বল করে। নিবিড় অন্ধকার রাত্রে আকাশের চেনা তারাদের মতো। কতই বা বয়স তখন তাঁর? সাত কিংবা আট?

কী আশ্চর্য, পিতৃদেব সেদিন শোনাচ্ছিলেন ঐ একই গল্প। উভয়ভারতীর কথা আর মহাপণ্ডিত শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতমত। কুমারিল ভট্ট, মণ্ডনমিশ্র, উভয়ভারতী,… কামশাস্ত্র … শব্দগুলি সেদিনই প্রথম ধরা দেয় শ্রুতিতে। তারপর কী আশ্চর্য প্রকারে শঙ্করাচার্য তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন মণ্ডন মিশ্রের সম্মুখে। জয়ী হলেন শঙ্করাচার্য, কিন্তু জয়ধ্বজা উড্ডীন করা আর সম্ভব হল না তাঁর। পরাজয় স্বীকার করতে হল প্রতিদ্বন্দ্বী মণ্ডনমিশ্রের অর্ধাঙ্গিনী উভয়ভারতীর কাছে। পারলেন না তাঁর যুক্তি খণ্ডন করতে। পেলেন না উপযুক্ত প্রত্যুত্তর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। তখন উভয়ভারতীর শেষ বিধান—ও পথ কেবল সন্ন্যাসীর পথ, গৃহীর গ্রাহ্য পন্থা হতে পারে না—আর্য, সংসারের অর্ধেক যে নারী সে কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত আপনি। ‘

একটি একটি প্রলেপ উন্মোচিত হয়ে ফুটে উঠতে লাগল স্মৃতির পট জুড়ে।

কামশাস্ত্র। শব্দটি সেদিনই প্রথম কর্ণগোচর হয় রূপমঞ্জরীর। শ্রবণমাত্র অন্যান্য সকলের কপোল রক্তিম-রাতুল হয়ে উঠতে দেখেছে সে। নিষ্পাপ বালিকার বোধগম্য হয়নি কিছুই। ও কেবল অবাক হয়েছে। কিন্তু মননের কোষে উপ্ত হয়েছে বীজ তৎক্ষণাৎ।

সব কথা মনে পড়ে রূপমঞ্জরীর। স…ব। সোনা-মাকে হারানো… পিতৃহীন দিনগুলির শূন্যতা … আর শুভদা।

শুভদার আরক্তিম সেই মুখখানা—বাৎস্যায়ন, কামশাস্ত্রের উল্লেখমাত্র ওর মুঠি ছেড়ে দ্রুত পলায়ন।

আজ একা-একাই হাসলেন বৃদ্ধা। পরক্ষণে একই ভাবনার সূত্র কণ্ঠ অবরুদ্ধ করে তুলল তাঁর। মনে পড়ল শুভদার সঙ্গে শেষ বিদায় দিনটির কথা। বৃদ্ধা চোখ মুছলেন। সে সব তো কত কত দিন আগের কথা। তবু কেন এমন স্ফটিকস্বচ্ছ, জীবন্ত?

কোলের ওপর রাখা নিজেরই হাত দুটির ওপর চোখ পড়ল। শিরাসর্বস্ব লোলচর্মসার আজ। এই সেই হাত যা কিশোর শুভদাকে সরিয়ে দিয়েছিল। আঙুল দশটি নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে কপালে বলিরেখা ফুটে উঠল।

উদাস দুটি চোখ দূরে মেলে ভাবতে থাকলেন বিদ্যালঙ্কার। অন্তরাত্মা—তাকে কি জরা গ্রাস করতে পারে না? না হলে চোখে জল আসে কী করে? সেখানে কেমন করে তবে এই সন্ন্যাসিনীর নির্মোকে আজও বন্দী থাকে কিশোরী রূপমঞ্জরীর অভিমানী অশ্রুবিন্দু—শুক্তির মাঝে নিটোল মুক্তাবিন্দুটির মতো?

*

আশ্রমে আজ ভারি ব্যস্ততা। আশ্রমপ্রান্তর সাজিয়েগুজিয়ে সুন্দর করার কাজে লেগেছে ওরা। মহামানী অতিথি, যোশীমঠের আচার্যের নিমন্ত্রণ—বিদ্যার্ণব নিয়ে আসবেন তাঁকে স্বয়ং। আর দুদিন মাত্র সময় বাকি। অভ্যর্থনার যেন কোনো ত্রুটি না হয়। তাই কেউ লেগেছে আগাছা নিষ্কাশনের কার্যে। কেউ বা আশ্রমপ্রাঙ্গণটি গঙ্গাজলে ধৌত করে পরিমার্জনায় ব্যস্ত। পিতলের বৃহৎ পিলসুজ প্রদীপগুলি এনে রেখেছে রোহিণী। বসেছে তিন্তিলী-অম্লিকা সহযোগে মার্জনায়। দুপুরের রৌদ্রে সেগুলি উজ্জ্বল, স্বর্ণাভ।

মধুনক্তমুতোষসো মধুমৎ পার্থিবং রজঃ
মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা।

গাছপালা, ওষধিসকল মধুময় হয়ে উঠুক। দিবস-যামিনী নিয়ে এই যে পৃথিবীলোক, তা মধুময় হয়ে উঠুক। পিতৃস্থানীয় দ্যুলোক আমাদের নিকট মধুময় হোন। হাতের কাজ থামিয়ে রোহিণী মুখ তুলে চেয়ে রইল। কী যে অং-বং বলেন আশ্রম-মা, বোধগম্য হয় না রোহিণীর। কিন্তু মাঝেমাঝে যখন এমন করে বুঝিয়ে দেন, কী সুন্দর কথাগুলি—ভাবে সে।

দুপুরের অবসরে এই নীরব গৃহপ্রাঙ্গণে সেই কথাগুলি কেবল ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। বাজতে থাকে পাতার রিমঝিম নূপুর নিক্কণে, বাজতে থাকে ঘুঘুপাখির একটানা ডাকে—উম্…উ-উ-ম্..উ উ উ ম্।

কদিন হল এই পাখিজোড়া ওদের উঠোন প্রাঙ্গণে প্রায়ই আসছে। মাঝেমাঝে রোহিণী তাদের গমের দানা, চাল-ডাল ছুঁড়ে দেয়, টুকিয়ে টুকিয়ে খায় ওরা—তারই লোভে বুঝি আসে। একজন এলেই কোথা থেকে আরেকজনও এসে উপস্থিত হয় ঠিক। তারপর ঠোটে ঠোটে খেলা-আদর। একটু পরে সঙ্গীটি চড়ে বসল সঙ্গিনীর ওপর।

কী কাণ্ড! নির্লজ্জ-বেহায়া। একেবারে আশ্রম-মার চোখের সামনে! রোহিণী চেঁচিয়ে ওঠে—হুশ্ হুশ্। তাড়াতে যায়। কিন্তু পাখি দুটির কাছে তখন বিশ্বচরাচর লুপ্ত। ওরা আপনাতে-আপনি বিভোর। ‘এই হুশ্ হুশ’ রোহিণী উঠে ছুটে যায়।

বিদ্যালঙ্কার বাধা দেন ওকে। অঙ্গুলি রাখেন ওষ্ঠে। ইঙ্গিত করেন—স্থির, নিশ্চুপ হতে। প্রকৃতির সাথে মিলে যেতে ধীরে, খুব ধীরে।

একটু পরেই পাখি দুটি উড়ে যায়। বৃদ্ধা হেসে বলেন—

—এই যে নিয়ম রোহিণী। এ-ই রীতি প্রকৃতির, জীবনের। এতে বাধ সাধতে নেই।

—তাই বলে ঠাকুরঘরের সামনে?

—স বৈ নৈব রেমে। তস্মাদেকাকী ন রমতে স দ্বিতীয়মৈচ্ছৎ। এমন কী তিনিও (ব্রহ্মও) আনন্দলাভ করতে পারেন না একাকিত্বে। কারণ একাকী থেকে কেউ আনন্দ লাভ কতে পারে না। তখন তিনি দ্বিতীয় সত্তায় নিজেকে রূপান্তরিত করতে চাইলেন, বুঝলি, রোহিণী—তাই যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন—

স হৈতাবানাস যথা স্ত্রীপুমাংসৌ
সংপরিম্বক্তৌ স ইমমেবাত্মানং–দ্বেধাপাতয়ত্ততঃ।।

আলিঙ্গনাবদ্ধ স্ত্রী-পুরুষ যে আনন্দলাভ করে, তিনিও সে আনন্দলাভ করলেন। তিনি স্বীয় সত্তাকে দ্বিধাবিভক্ত করলেন। এইরূপে পতি ও পত্নী সৃষ্ট হল।

পতিশ্চ পত্নী চাভবতং তস্মাদিদমর্ধবৃগলমিব। তাং সমভবত্ততে—-মনুষ্যা অজায়ন্ত।—এইভাবে উৎপন্ন হল মনুষ্য জাতি।

রোহিণী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এসব তত্ত্বকথার কিছুই তার মাথায় ঢুকল না। সে কেবল মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল।

বিদ্যালঙ্কারেরও লক্ষ্য রইল না যে তাঁর একমাত্র শ্রোতাটি নিরক্ষরা গ্রাম্য রোহিণী, যে বিশ্বাস করে অক্ষরপরিচয়ই বৈধব্যের কারণ। ঘরভরা বিদগ্ধ গুণিজনের জন্য যে সম্ভ্রম প্রযোজ্য সেই একই একাগ্রতায় তিনি নিমগ্ন হলেন।

যেন দেখতে পেলেন এই মঞ্চ সভাস্থ সম্মানিত গুণিজন-আলোকে উদ্ভাসিত। ঐ যেন প্রথম সারিতে বসে আছেন বিদ্যার্ণব, যোশীমঠের আমন্ত্রিত আচার্য, বসে আছেন ভূভারতের মহামানী বিদ্যাবিভূষণ সন্ন্যাসীরা।

ওপারে চিকের আড়ালে যেন এসে বসেছেন রানীমা, মালতী-মা, রোহিণী, আরও কত নোলকপরা কুমারী, সিঁথেয় সিন্দুর-রাঙা সধবা, সাদা থান বিধবা মেয়ের দল। এসে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষ—কালো আদুল গায়ের মঝি-মাল্লা ঈশান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা।

আর তিনি সভার মধ্যে দাঁড়িয়ে, সবার সামনে, অনবগুণ্ঠিতা।

ঘৃতপ্রদীপ জ্বলে হু-হু করে, ধূপের গন্ধে চারিদিক আমোদিত। মাঙ্গলিক শঙ্খধ্বনি বাজায় পুরকামিনীরা।

উদাত্ত গলায় বলে ওঠেন বিদ্যালঙ্কার—

‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা’-এ কেবল মুক্তিকামী সন্ন্যাসীর মন্ত্র হতে পারে। সংসারে খাটে না। এই বিশ্বপ্রপঞ্চ যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই দিয়েছেন রোগ, জরা, মৃত্যু। দিয়েছেন রূপ, যৌবন, জন্ম। চিনিয়েছেন সেবা, মায়া, হাসি-কান্না। তিনি অসীম দূরদর্শী। কিংবা দূরদর্শিনী! হয়ত আমাদের প্রণিধানের অনেক ঊর্ধ্বে।

সেই কথাই তো উভয়ভারতী বুঝিয়েছিলেন। নারী পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী। এ প্রপঞ্চে, এ নিত্যখেলায় প্রকৃতি ভিন্ন পুরুষ অচল, পুরুষ ভিন্ন প্রকৃতি অচল। এ জীবন অচল।

তারপর রোহিণীর খুব কাছে এসে বলেন-

—অথচ দ্যাখ্ মা, আপন রক্ত-মাংস দিয়ে যে মা জন্ম দেয় তার সন্তানকে, সব প্রজাতির মধ্যে চেয়ে দ্যাখ, পুরুষ প্রকৃতিকে মিটিয়ে দেয় সে প্রাপ্য মর্যাদা। পুরুষ ময়ূর রঙবাহার পেখম মেলে নেচে সাদামাটা ময়ূরীর মন জয় করে। পুরুষ সিংহ সিংহীর তুলনায় কত আকর্ষণীয়, উজ্জ্বল। তারা জননী জাতিকে ভোলে না সে সপ্রশংস মূল্য জানাতে। একমাত্র ব্যতিক্রম মানুষ সমাজে। আমাদের সভ্য পুরুষমানুষ সবচেয়ে কৃপণ, হৃদয়হীন ও স্বার্থপর।

রোহিণী এসবের কী বুঝল তা সে-ই জানে। ওর সরল হৃদয় কেমন একটা অজানা গা-ছমছম ভয় ও অপরিসীম গর্বে ভরে গেল। মনে মনে সে যেন দেখতে পেল, এই তীব্র বুদ্ধি ও শক্তির কাছে, জ্ঞান ও রূপের আলোয় উজ্জ্বল ঐ মানুষটির সামনে বুঝি আর কেউ দাঁড়াতে পারে না। তিনি নিঃসন্দেহে বিজয়িনী প্রথমা এবং তিনি ওদের প্রতিভূ।

কী ভেবে সে খুব কাছে এসে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে দিল আশ্রম-মার পায়ে। বিদ্যালঙ্কার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

*

কাজল নদীর কালো জলে তখন দুটি আলোর বিন্দু টলমল করে এগিয়ে চলেছে স্রোতের টানে। দুটি ছিপছিপে ছোটো মেয়ে, গাছ-কোমর ডুরে শাড়ি পরা হেসে, ভেঙে পড়ছিল এ ওর গায়ে। পাতার ভেলায় ওরা আকাশ-প্রদীপ ভাসিয়েছে যে।

শুভপ্রসন্ন এই রঙ্গ দেখছিলেন। হঠাৎ চমক ভাঙল। দেখলেন, একটি অল্পবয়সী কিশোরী, বয়স চোদ্দ কি পনের, সাদা থানের ঘোমটায় ঢাকা মুখখানি। কাজলকালো দীঘল চোখদুটি মেলে তাঁর দিকে চেয়ে আছে।

—বাবা, আমায় দয়া করো বাবা। আমার কেউ নেই। বিশ্বনাথের চরণে ঠাঁই পাবো বলে পালিয়ে এসেচি।…ভিক্ষা করে খাই, বাবা।… দু-দিন কিছু পেটে পড়েনি, আমাকে দয়া করো … তুমি তো সন্ন্যাসীঠাকুর, বাবা…।

শুভপ্রসন্ন চমকে উঠলেন। এ মুখ যে তাঁর চেনা। বহুদিন আগের ফেলে আসা সোঞাই গ্রামের সেই কাজলকালো চোখ। অস্ফুটে ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল তাঁর—’মঞ্জু!’

পরক্ষণেই সম্বিত ফিরে পেলেন শুভপ্রসন্ন। মঞ্জু? তা কী করে হবে? সে তো পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। আত্মস্থ হলেন সন্ন্যাসী। নিজেকে সামলে নিলেন। মনে করিয়ে দিলেন নিজেকে তিনি সন্ন্যাসী। তাঁকে থাকতে হবে দুঃখেম্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ’।

এমন সময় মিশকালো আদুল গা, কাঁচা-পাকা দাড়ি এক মাঝি এসে তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানাল।

—পেন্নাম হই, ঠাকুর, মুই ঈশেন মাঝি এজ্ঞে। জেতে কৈবত্য। আপনাকো এই ঘাটে পৌঁছে বাসায় নে যাবার কাজটা পড়িচে এই অধমের উপর

হাত কচলিয়ে, গলার গামছাটি টেনে সে মাথাটি প্রায় বুকের কাছে ঠেকিয়ে ফেললে। করজোড়ে আবার নমস্কার জানালে।

—ছি চরণদুটি এই নৌকায় রাখেন দ্যাক্তা। এই যে ধরেন আমার হাত। এ্যাঃ এ্যাই। জল-অচ্ছুৎ নই গো মোরা, জেতে কৈবত্য হই ঠাকুর।

যোশীমঠের সন্ন্যাসীঠাকুর ওর সাহায্যে উঠে এলেন নৌকায়। কাশীর গঙ্গাবক্ষে ছিপ-নৌকাখানি ছলাৎ ছলাৎ শব্দে এগিয়ে চলল। মাথার ওপর একফালি দ্বিতীয়ার চাঁদ। খানিক আগেই সূর্যাস্ত হয়েছে। এখন হালকা নীল আকাশে সন্ধ্যাতারাটি ঝিকমিক করছে। অপরূপ মৌনতার মাঝে সারা চরাচর জুড়ে যেন পূরবীর তান শুনতে পেলেন সন্ন্যাসী ঠাকুর।

কিন্তু বেশীক্ষণ সইল না। একটু পরেই—কাঁসর-ঘণ্টার ধাতব নিনাদে খানখান হয়ে ভেঙে পড়ল নিখিল নিস্তব্ধতা। দেখা গেল একটি ঘাটের কাছে যেন বেশ কয়েকটি মশাল জ্বলছে। শব্দও আসছে সেখান থেকেই।

—ঐ মণিকর্ণিকা ঘাট, ঠাকুর। কোনো সতী-নখ্যি সহমরণে চললেন বুঝি। তাই এই জাঁকজমক।

—পৈশাচিক উল্লাস!

সন্নাসী ঠাকুরের মুখে এই কথাটির অর্থ ঈশান মাঝি বুঝল কিনা বোঝা গেল না। ভ্রূ-কুঁচকে চেয়ে রইল খানিক। কিন্তু কথাটি তার বহুদিন আগের একটি অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়িয়ে দিল। প্রৌঢ় মাঝি বলে উঠল :

—আপনের ঐ কতাটো আমারে এক কতা মনে পড়িয়ে দিল, কত্তা। আমাদের গাঁয়ের কতা। বদ্দমান জিলায় সোঞাই গ্রাম—হোথায় আমাগো দেশ। মা নখ্যি, অমন রাজপুত্তুরের মতো সোয়ামী পেলে, কিন্তু ভোগ করতি পারলে না গো। বাপ তার ছেল কোবরেজ। কারও কোনো অসুক-বিসুক করিচে তো কোবরেজ ঠাকুর ঠিক এসি হাজির হইচেন। মোদের কত জনের যে পেরাণ বাঁচাইচেন। তিনি ছিলেন দ্যাক্তা, ঠাকুর!

একটু থেমে সে বললে,—অথচ নিজের অমন একমাত্র কন্যেটির বেলায় কিচ্ছুটি করত্যালেন না। জ্যান্ত কন্যা অজ্ঞান অবস্থায় পাল্কিতে তুলে নিল, তিনি পাথরডার মতো হইয়ে গেলেন।

—কী বলছ ঈশান, খুলে বল।

—সেই তো বলি কত্তা, মা ঠাকরুণের অমন বিয়ে দিলেন বাপ, কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই … সব ফাঁকি … সব ফাঁকি। এ্যামন ম্যাঘ হইল, এ্যামন বাজ পইড়ল, আর পইড়ল কিনা ঠিক ত্যানার মাথার উপর! অমন সোয়ামী, পরানটা দিলেন মাঠের মাঝে বজ্রাহত হইয়ে। মুহুত্তে ছাই হইয়ে গ্যালেন।

তখন মা-জননীর শ্বশুরবাড়ি থেকে ওরা পাল্কি আনলে। আনলে গ্রামশুদ্দু লোক, গয়নাগাটি সমেত বৌমাকে নিয়ে যাতি। সহমরণে নে যাবে। এ্যামনকি সঙ্গে আনলে একদল লাঠিয়ালও।

কিন্তুক আমাগো সঙ্গে পারবে কেনি? আমরাও দেখিয়ে দিন। ভীমা বাগদীর চেলা মুই—ঈশান বাগ্দীর নামে তখন বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়। তখন আমার হেই চেহারা, কত্তা, এই এখনকার পারা নয়।

আমাগো দলেও ছিল সাতটি ধানুকী। ওরা যেমন লাঠি তোলে আমরাও মারলাম ভিল-ধনুর ছিলায় জোর টান। বুক চিতাইয়া ডাঁড়াইলাম। ওরা পা-পা কইরা পেছু হটল। পলাইবার পথ পাইল না। এ কলিজায় পরান থাকতি মা ঠাকরুণরে নি যাবে? সোঞাই গেরাম থিক্যে? সে হবিনি। যে দ্যারতা আমাদের কতজনার সন্তানের পরান ফেরায়ে দেছে কতবার, আমরা হেটুক করব না, তেনার পাশে ডাঁড়াইতে?

ঈশানের রোষ-ক্রুদ্ধ আবেশ ছড়িয়ে পড়ল হাতের দাঁড় বাওয়ার ছন্দে। কালো মানুষটার পেশিবহুল গায়ে স্বেদবিন্দু চিকচিক ফুটে উঠল, জলে শব্দ উঠল—ছলাৎ ছলাৎ।

খানিক চুপ থেকে ঈশান আবার বলে উঠল—

—আমার খুড়ো ভীমা বাগদি তো কোবরেজ ঠাকুরের পা জড়াইয়ে কেঁদে পড়ছিল—কোবরেজ ঠাকুর, আমরা তো মরি যাইনি। আমরা থাকতি দিদি ঠাকরুণকে কেউ ছুঁতি পারবা না। হেডা তুমি জেনো। এখন তুমি অমন পাথর হইয়ে গেলে কেনে? তুমি অমন হলি আমরা কুথায় যাবো গো?

—এমনই কপাল ঠাকুর, ঘাটে ঘাটে ঘুইরে ঠিক এসে পড়িচি মা-ঠাকরুণের যখনই বিপদ এসিচে।

মাথার উপর ঈশ্বরের উদ্দেশে চোখ তুলে বললে—ভগমান ঠিক আমাদের এনে দিছেন। ঘুরে ঘুরে সেই কাশীতে। মা-ঠাকরুণ বাপের মতোই ধন্বন্তরী—কতজনকে যে প্রাণে বাঁচাইছেন। এখন তেনার চরণেই মুই ঠাঁই পেইচি। ডাকাইতি আর করি না ঠাকুর। কত পাপ করিচি। এখন তেনার সেবাতেই শেষ দিন কটি পার করি দিতে চাই।

কথায় কথায় অনেক কথাই বলে ফেলে ঈশান।

তখন কাশীনরেশের সিংহাসন দখল করে পুরন্দর ক্ষেত্রী নিজহস্তে শাসনভার তুলে নিয়েছে। কাশীর সাধারণ মানুষ তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ। অত্যাচারী পুরন্দরের ব্যভিচার, হটি বিদ্যালঙ্কারের প্রতি তার পৈশাচিক নির্যাতনের হুকুমনামা জারি, অশালীন ব্যবহার—সবই বললে। অথচ এ রাজার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারার মতো কেউ নেই।

ঈশান তার নিজের জলদস্যু সত্তার কথা, তার বিচিত্র বৃত্তি ও ক্ষমতার কথা, কিছুই গোপন করল না। বললে—বজ্রধরের সঙ্গে সংযুক্তভাবে সে সুকৌশলে পুরন্দরের প্রমোদকানন আক্রমণ করে ও তাকে হত্যা করে। অবশেষে কাশীধামের সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

—তাই তো বলি কত্তা, ভগমান আমায় ঠিক সময়মতো জুটিয়ে দেছেন মা-ঠাকরুণের ছিচরণে।

খানিকক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ তার খেয়াল হয় যে তার শ্রোতা মহামান্য সন্ন্যাসীঠাকুর। তাঁর সম্মুখে এত কথা এমন করে বলাটা ঠিক শোভন হয়নি। হয়ত অত্যন্ত বাচালতা ও গুরুতর অপরাধই হয়েছে।

দাঁড় দুটি নৌকার গায়ে আটকে হাত জোড় করলে সে।

—আমায় আপনি মাফ করো কত্তা। নিজগুণে ক্ষমা করে দ্যান দ্যাবতা। আমি যে কার সুমুখে কী বলি ফেলিচি খেয়াল পারিনি। ছি, ছি। এই তোমার পায়ে পড়ি ঠাকুর, আমাকে আপনি ক্ষমা করো।

নৌকা দুলে ওঠে ভারসাম্যের অভাবে। কিন্তু সন্ন্যাসীঠাকুর সেদিকে খেয়াল করেন না, বলে ওঠেন—

—ঈশান, তোমার ভাদুড়ীমশাইকে মনে পড়ে, সোঞাই গ্রামের জমিদার তারাপ্রসন্ন ভাদুড়ী? তিনি আমার ৺পিতাঠাকুর।

ঈশানের চোয়ালদুটি ঝুলে পড়ে।

—শুভদাদা? যিনি নিরুদ্দেশ হইছিলেন?

অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পায় না। ঘোর ভাঙে জোর ধাক্কায়। নৌকা তীরে এসে ভিড়েছে।

*

ওঁ বাঙ্ মে মনসি প্রতিষ্ঠাতা, মনো মে বাচি প্রতিষ্ঠিত;
আবীরাবীম্ এধি; বেদস্য ম আণীস্থঃ;
শ্রুতং মে মা প্রহাসীঃ অনেনাধীতেনাহোরাত্রান্ সংদধামি;
ঋতং বদিষ্যামি, সত্যং বদিষ্যামি; তস্মামবতু, তদ্বক্তারমবতু
অবতু মাম্, অবতু বক্তারম্, অবতু বক্তারম্
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।

দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম জানালেন সন্ন্যাসীঠাকুর। গঙ্গাবক্ষে আধবুক জলে দাঁড়িয়ে। আচমন করলেন। মন্ত্রপাঠের সুরের রেশটা রয়ে গেল। আহা, কী সুন্দর—ঋতং বদিষ্যামি, সত্যং বদিষ্যামি। মানসিক সত্য বলিব, বাচনিক সত্য বলিব। ব্রহ্ম আমাকে রক্ষা করুন, ব্রহ্ম আচার্যকে রক্ষা করুন…

সেই ভাবনার সূত্র ধরে মনে পড়ল তাঁর আচার্য রূপেন্দ্র ভেষগাচার্যের কথা। মনে পড়ল সোঞাই গাঁয়ে তাঁর ছেলেবেলার দিনগুলি। রূপমঞ্জরী আজ তাঁর এতো কাছে, তাকে একবারটি দেখবার জন্য মন কেমন করে উঠল। পরক্ষণেই সংযত হলেন সন্ন্যাসী। নিজেকে মনে করিয়ে দিলেন, তিনি সন্ন্যাসী। এই সকল মানসিক চপলতা তাঁকে শোভা পায় না। বোঝালেন নিজেকে, তাঁদের পরস্পরের দেখা না হওয়াই বোধহয় ভালো।

কিন্তু তাঁর আরেকটি সত্তা বিরহবিধুর প্রার্থনায় গেয়ে উঠল :

দৃতে দৃংহ মা মিত্রস্য মা চক্ষুষা
সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষন্তাম্‌
মিত্রস্যাহং চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষে
মিত্রস্য চক্ষুষা সমীক্ষামহে।।

হে পরমেশ্বর, আমাকে এরূপ দৃঢ় কর যেন সকল প্রাণী আমাকে মিত্রের দৃষ্টিতে দর্শন করে, আমিও যেন মিত্রের দৃষ্টিতে তাদের দর্শন করি, আমরা যেন পরস্পরকে বন্ধুভাবে দর্শন করি।

এমন সময় খুব কাছে আওয়াজ উঠল গুব-গুব-গুবুক। একটি পূর্ণকুম্ভ কাঁখে তুলে শ্যামলা ছিপছিপে একটি মেয়ে বলে উঠল—বেলা যে পড়ে এল ঠাকুর। আপনার পূজার ফুল, হবিষ্যির সরঞ্জাম সব উঠানের ওপর গুছিয়ে রেখে এসেছি।

এর নাম রোহিণী। এখন সে আশ্রমের সেবিকা প্রধান। বেশ হাসিখুশি চটপটে মেয়েটি, ভাবলেন শুভপ্রসন্ন। গতকালই এদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাঁর—রোহিণী, রমারঞ্জন, আরও কে কে। পরে জেনেছিলেন শুভপ্রসন্ন, আজ রোহিণী আশ্রমের সেবিকা প্রধান, কিন্তু সে-ও চিতাভ্রষ্টা। আশ্রমমায়ের তৎপরতাতেই রক্ষা পেয়েছে। মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে।

একে দেখে তাঁর হঠাৎ আরেকটি মুখ মনে পড়ে গেল। ঘাটের পাশে সন্ধ্যেবেলায় দেখা সেই সদ্যবিধবা, কিশোরী ভিখারিণীর কথা। অথচ তার জন্য কিছুই কি তিনি করতে পারতেন না? এমনকি ফিরে দুটো কথা বলা, দুটো পয়সা দেওয়া—তাও কি পারতেন না?

কানে বাজতে লাগল ওর বিশ্বাস ভরা কণ্ঠস্বর-তুমি তো সন্ন্যাসীঠাকুর বাবা, তুমি আমায় দয়া করো।

চৌষট্টি ঘাটের চৌষট্টিটা সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে মনে পড়ল তাঁর—তিনি অস্থি-মাংস-সর্বস্ব একজন সামান্য মানুষ মাত্র। তার বেশি কিছু নন। গাঁটে গাঁটে ব্যথা মনে পড়িয়ে দিল জাগতিক, শারীরিক সীমানায় বাঁধা সেই সত্তাটির কথা।

এতক্ষণে সকালের কোলাহল শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে পসারিনিদের বিকি-কিনি, পূজার্থীর ভীড়। লোটাকম্বল গুটিয়ে পঙ্গু, বৃদ্ধ ভিখিরির দল গুছিয়ে নিয়ে এসে বসেছে আপন আপন জায়গায়। একটি চোঙা নিয়ে কে যেন কী ঘোষণা করছে। কোন্ রাজা আসছেন বুঝি। অমুক জায়গায়, এত ঘটিকা সময়ে।

—কোন্ রাজা?

—আজ্ঞে রাজা রামমোহন রায়।

কোথা থেকে এসে উপস্থিত হয় রমারঞ্জন। সন্ন্যাসীঠাকুরের পদধুলি মাথায় ঠেকিয়ে বলে :

—আপনারও নিমন্ত্রণ সে সভায়, ঠাকুর। সেই কথাই বলতে এসেছি, আজ্ঞে। তাহলে, আজ আপরাহ্ণে এসে নিয়ে যাবো আপনাকে।

*

সভাগৃহ উপবিষ্ট সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, অধ্যক্ষ ও বৈয়াকরণ সমাবেশে প্রায় পরিপূর্ণ। আরেকদিকে কয়েকজন কালো ফেজ পরিহিত আলেম-উলেমা। দরমা ও মাদুরের পর্দাটির ওপারে চোখ রাখলে দেখা যাবে কিছু চাষাভুষো, মাঝিমাল্লা গোছের লোকও এসে দাঁড়িয়েছে।

রমারঞ্জন পাশের সঙ্গীর কানে কানে বললে :

—ঐ হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী। পূর্বাশ্রমের নাম ছিল নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার। রামমোহনের শিক্ষকবিশেষ।

ইনি নাকি ছিলেন তাঁর তন্ত্রশিক্ষার গুরু। পরবর্তীকালে ‘ইন্ডিয়া গেজেটে’ সহমরণের উপর একটি রচনাও প্রকাশ করেন। অবশ্য অনেকে সন্দেহ করেন হরিহরানন্দের ছদ্মনামে এর আসল লেখক নাকি রামমোহন স্বয়ং।

এই সেই পীঠস্থান যেখানে প্রায় একযুগ আগে কিশোর রামমোহন প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন হিন্দু পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে। প্রথম গ্রন্থ রচনা করে রুখে দাঁড়ান। ষোলো বছরের ছেলেটির ঔদ্ধত্য দেখে নাসিকা কুঞ্চিত হয়েছিল অনেক অকফলাসমৃদ্ধ ব্রাহ্মণদলের। এমনকি তাঁর পিতৃদেবেরও!

—ও ছেলে বয়ে একেবারে গোল্লায় গ্যাচে।

রামমোহন যেমন কাশীর টোলে বেদাভ্যাস করেন তেমনি পাটনায় আরবি-ফারসী শিক্ষারও তালিম নেন। তাঁর মননে তাই ইসলামধর্মের একেশ্বরবাদ এবং হিন্দুশাস্ত্রের ব্রহ্মজ্ঞান নিরাকার একেশ্বরবাদের বীজ বপন করে।

রমারঞ্জনের সঙ্গীটি বলে ওঠে—

আচ্ছা, উনি ‘তুফাৎ উল মুবাহ্হিদ্দীন’ নামেও একটা বই লিখেছিলেন না?

–ঠিক জানিনা ভাই, তবে শুনেছি মুসলমান শাস্ত্রাদি এত বেশি চর্চা করেছেন যে মৌলবীরা নাকি তাঁকে ‘জবরদস্ত মৌলবী’ বলে। ঠিক তেমনি করেই একদিন দেখা গেল খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিও তিনি সমান আগ্রহী। মৌলবীদের সব গুলিয়ে গেল।

পাদরীরা যেই না ভাবলে তবে বুঝি উনি আমাদের দলের লোক, ধর্মান্তরিত হলেন বুঝি–অমনি খ্রিস্টান মিশনারীদের সঙ্গে তাঁর ঘোর সংঘাত বাধল।

রামমোহন লিখে, বক্তৃতা দিয়ে প্রমাণ করলেন হিন্দুধর্ম আর হিন্দু দর্শনের তুলনা পৃথিবীতে নেই। হিন্দু পণ্ডিতেরা রামমোহনকে বিধর্মী বলেছিলেন, কিন্তু ‘বিধর্মী’ রামমোহনই হিন্দুধর্মকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেন!

অল্পবয়সী সঙ্গীটি রমারঞ্জনের কানে কানে বলল :

—মানুষটি নাকি হিব্রু, গ্রীক, ল্যাটিন ইত্যাদি আট-নয়টি ভাষায় পারদর্শী। তার একটা প্রভাব পড়বে না? আসলে তিনি এদের ধ্যান-ধারণা-চিন্তার অনেক ওপরে।

*

এইসময়ে যেন অমানিশার অন্ধকার বিদূরিত করে হল নবসূর্যোদয়। দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ পৌরুষদীপ্ত এক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হল। তাঁর চোখ দুটিতে যেন প্রমিথিউসের আগুন, নাসিকা শাণিত খঙ্গের মতো। ইস্পাতকঠিন ওষ্ঠাধরে বিষাদম্লান হাসি—যেন মেঘাবৃত সূর্যকিরণের লাবণ্য। তাঁর চলাফেরা রাজার মতোই আভিজাত্যমণ্ডিত। কথায় হীরকের দ্যুতি।

সভা যেন সহস্র আলোকে প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। সভাস্থ সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি যে সুগম্ভীর বক্তব্য রাখলেন তাতে মোহাবিষ্ট হল শ্রোতার দল।

কতো কথাই যে বললেন তিনি, কিন্তু কটি কথা যেন ধ্রুপদের মূল তানের মতো ঘুরে ঘুরে বাজতে লাগল—

শুধু সংস্কৃত শাস্ত্র ও ব্রহ্মবিদ্যায় পারদর্শী হলেই শিক্ষা সুসম্পূর্ণ হয় না। শিখতে হবে বিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোর্তিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা। mens sana in corpore sano*—তাই জানতে হবে দৈহিক গঠনতন্ত্র। না হলে মানুষকে সুস্থ করবে কেমন করে?

[* বলিষ্ঠ মনের জন্য প্রয়োজন বলিষ্ঠ দেহ]

বাংলায় সহজ গদ্য ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে হবে। সে ভাষায় গদ্য লিখতে হবে। না হলে সাধারণ মানুষ বুঝবে কেমন করে?

তেমনই, ইংরেজি শিক্ষা বর্জন করলে চলবে না, তাতেও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের নিজেদের। ইংরাজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বর্জন করলে তা বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকার সামিল হবে। সতীদাহ আইনত বন্ধ হয়েছে মাত্র আজ। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের মন থেকে এই ধরনের কুসংস্কার, এ রকম যতো কুৎসিৎ ধ্যান-ধারণা আছে, সব সমূলে উৎপাটন ও ভস্মীভূত করতে হবে।

এ যজ্ঞে নারী পুরুষের সমান দায় ও দায়িত্ব। পশ্চিমে আজ নারী তার লজ্জা, ভয়, সংস্কারের নির্মোক ভেঙে বিস্ফোরিত হচ্ছে সংগ্রামে। উল্লেখ করলেন মেরী উলস্টোনক্রাফ্টের নাম। ফরাসী বিপ্লবের মূলমন্ত্র—স্বাধীনতা-সাম্য-ভ্রাতৃত্বের চেতনায় তিনি অনুপ্রাণিত। সে স্বপ্ন কেমন করে সম্ভব নারীর ভূমিকা ব্যতিরেকে? নারী যে সংসারের, সমাজের, দেশের অর্ধাঙ্গিনী।

এ স্বাধীনতা, এ সাম্য নারী-পুরুষ নির্বিচারে প্রযোজ্য। উলস্টোনক্রাষ্টের ব্যক্তিত্ব, তাঁর জীবন-সংগ্রাম যেন তাঁকে আলো দেখায়।

জলদগম্ভীর স্বর বেজে উঠল বীণার নিষাদে :

“স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন্ কালে লইয়াছেন যে অনায়াসেই তাহারদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? আপনারা বিদ্যাশিক্ষা, জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই, তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয়, ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন? বরঞ্চ লীলাবতী, ভানুমতী, কর্ণাটরাজার পত্নী, কালিদাসের পত্নী প্রভৃতি যাহাকে যাহাকে বিদ্যাভ্যাস করাইয়াছিলেন তাহারা সর্বশাস্ত্রের পারগরূপে বিখ্যাত আছে। বিশেষত বৃহদারণ্যক উপনিষদে ব্যক্তই প্রমাণ আছে যে, অত্যন্ত দুরূহ্ ব্রহ্মজ্ঞান তাহা যাজ্ঞবল্ক্য আপন স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে উপদেশ করিয়াছেন, মৈত্রেয়ীও তাহার গ্রহণপূর্বক কৃতার্থ হয়েন।

“দ্বিতীয়ত তাহারদিগকে অস্থিরান্তঃকরণ কহিয়া থাকেন, ইহাতে আশ্চর্য জ্ঞান করি; কারণ যে দেশের পুরুষ মৃত্যুর নাম শুনিলে মৃতপ্রায় হয়, তথাকার স্ত্রীলোক অন্তঃকরণের স্থৈর্য্যদ্বারা স্বামীর উদ্দেশে অগ্নিপ্রবেশ করিতে উদ্যত হয়, ইহা প্রত্যক্ষ দেখেন, তথাচ কহেন, যে তাহারদের অন্তঃকরণের স্থৈর্য্য নাই!…”

*

রূপমঞ্জরী, রূপমঞ্জরী, তুমি কোথায়? শুভপ্রসন্ন চারদিকে তাঁকে খুঁজে বেড়ালেন। রূপমঞ্জরী তাঁর সতীর্থ, তাঁর প্রথম বন্ধু। আজ এতদিন পরে এ মুহূর্তে এইসব কথা, এই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে ইচ্ছা হয় তার সঙ্গে।

রূপমঞ্জরী তো অসূর্যম্পশ্যরূপা, অন্তরালচারিণী নয়। তবে সে কেন এল না এ সভায়? বিদ্যালঙ্কার কি সভায় যোগদানের চেয়ে কর্মযজ্ঞেই বেশি বিশ্বাসী? সে হয়ত এখন কোন দুঃস্থ আতুরের সেবায় মগ্ন-ভাবলেন সন্ন্যাসীঠাকুর।

তারপর চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলেন যে যদিও মাঝিমাল্লা আপামর মানুষের জন্য এ সভার দ্বার উন্মুক্ত, নারীর স্থান নেই কিন্তু সেখানে। মেয়েমানুষের এসে বসার কথা এই সভাতেও কেউ ভাবেনি।

আগামীকাল বিদ্যালঙ্কারের সঙ্গে তাঁর তর্কযুদ্ধের দিন ধার্য হয়েছে—মনে মনে ভাবলেন সন্ন্যাসী।

তারপর ঘরে ফিরে শুভপ্রসন্ন একটি প্রদীপ জ্বাললেন। বার করলেন দোয়াত, কালি কলম। দুটি চিঠি লিখলেন। তারপর লেফাফা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে দিলেন।

গত কদিন হল বিদ্যালঙ্কার এক আশ্চর্য তন্দ্রাচ্ছন্নতা বোধ করছেন মাঝেমাঝে। কখনো এক বিবশ ভাব, কখনো এক মায়াঘোর যেন তাঁকে আপ্লুত করে। এক ধরনের বিবমিষা—আবার এক ধরনের চিত্তচাঞ্চল্যও বলা যায়। বিদ্যালঙ্কার বিব্রত বোধ করেন। বুঝে উঠতে পারেন না, কী হচ্ছে তাঁর মধ্যে? এ কি শারীরিক, না মানসিক? তিনি কি আসন্ন তর্কযুদ্ধ-সভার জন্য মনে মনে অস্থির বোধ করছেন? কিন্তু তিনি তো জানেন

ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিৎ
নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোভয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।

জ্ঞানীর যে জন্ম নাই, মৃত্যুও নাই, এই আত্মা কোনো কারণ হইতে উৎপন্ন হন নাই, আত্মা হইতেও কেহ উৎপন্ন হন নাই; তিনি অজ নিত্য শাশ্বত ও পুরাণ; শরীরের আঘাতে তিনি তো আহত হন না।

তবে? তবে কেন এমন হয়? জয়-পরাজয়, চিত্তচাঞ্চল্যের তো প্রশ্নই হয় না।

এমন সময় রোহিণী এসে বিদ্যালঙ্কারের হাতে দুটি চিঠির খাম দিয়ে গেল। বললে :

—রমারঞ্জন দাদা এসেছিলেন মা। জানো, সতীদাহ নাকি আইন কইরে বন্ধ হয়ে গেছে। আর সহমরণের নামে পুড়িয়ে মারা চলবে না।

*

প্রথম চিঠিটি বিদ্যার্ণব তর্কপঞ্চাননের কাছ থেকে। বিদ্যার্ণব লিখেছেন—তর্কসভার আর প্রয়োজন নাই। যোশীমঠের মহাচার্য জানিয়েছেন যে উপস্থিত বিদ্যার্ণব ও বিদ্যালঙ্কারের সঙ্গে তাঁর মতের কোন অমিল নেই। যদ্যপি তিনি আদি শঙ্করাচার্যের পন্থায় বিশ্বাসী সন্ন্যাসী, তদাপি বিদ্যালঙ্কারের অভিমত তিনি সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করেন। চিঠির শেষে জানিয়েছেন বস্তুত জীবনের প্রথম পাঠ তাঁদের একই আচার্যের সান্নিধ্যে—সেই একই মননে, একই মন্ত্রে তাঁরা দুজনেই দীক্ষিত। সেই হিসাবে তাঁরা সতীর্থ। কাজেই সর্বসমক্ষে তর্কযুদ্ধের প্রয়োজন অর্থহীন। আগামী বুধবার, শুভদিন—সেদিন পূর্বাহ্ণেই তিনি যাত্রা করবেন যোশীমঠে।

দ্বিতীয় চিঠিটি :

হটী বিদ্যালঙ্কার শ্রদ্ধাস্পদেষু

কল্যাণীয়া প্রিয় মঞ্জু,

বহুদিন পর বহু ঘাটে ঘুরিয়া ঘুরিয়া আজ তোমার খুব কাছে আসিয়া পৌঁছিয়াছি। তুমিও এই শহরেই এত কাছে আছো ভাবিতে রোমাঞ্চ বোধ করিতেছি। অথচ লোকারণ্যে তোমার সঙ্গে দেখা হয়, এমন ইচ্ছা করি না। তোমার ইচ্ছা না হইলে না হয় না-ই বা সাক্ষাৎ হইল।

আজ তোমাকে যাহা লিখিতেছি তাহা না জানাইয়া গেলে মনে একটি শূন্যতা লইয়া মরিব, তাই না লিখিয়া পারিলাম না।

তুমিই জয়ী হইয়াছ, মঞ্জু। জীবনযুদ্ধের এ কঠিন খেলায় শত প্রতিকূলতা তোমাকে পরাস্ত করিতে পারে নাই। নিজে আপনি জ্বলিয়া তুমি শত শত প্রাণে দীপালি জ্বালাইয়াছ। তোমার কথা রোহিণী, ঈশান, রমারঞ্জনের কাছে শুনিয়া আনন্দ-গর্বে আমার বুক ভাসিয়া গিয়াছে।

জ্ঞানের আলো দশদিক আলোকিত করে সত্য, কিন্তু প্রেমের আলো আপন অন্তরের দীপশিখাটি প্রজ্বলিত করে। সেই দীপশিখা আমাদের একার পথচলায় আলো দেখায়। হাজার মনে দীপিকা জ্বালায়। তোমার স্মরণ হয়, আচার্য বলিতেন—’আত্মদীপো ভব’?

তুমি ‘আত্মদীপ’ হইয়াছ মঞ্জু। তুমি সংসারের মাঝে আপন জীবন সফল করিয়াছ।

তুমি আমার কনিষ্ঠা। তবু আজ ইচ্ছা হয় শ্রদ্ধায় তোমাকে প্রণাম করি। ইচ্ছা হয়, বন্ধুর মতো অভিনন্দন-আলিঙ্গন জানাই।

ইতি-
তোমার শুভদা

*

আশ্রমে আজ বহুলোকের সমাগম। যে মানুষটি তাদের অসুস্থতার খবরে সর্বাগ্রে ছুটে এসেছেন, আপন চেষ্টায় ভালো করে তুলেছেন, আজ তিনি শেষশয্যায় শায়িতা। আর ওরা আসবে না?

সাধারণ মানুষ আনে পূজার ফুল, প্রসাদ, প্রার্থনার অশ্রুজল তাঁর আরোগ্য- কামনার্থে। আসেন অধ্যাপক, অধ্যক্ষ, বিদ্যার্ণব, বিদ্যাচঞ্চু—জ্ঞানী-গুণীর দল।

একসময়ে, দিনশেষে, বিদ্যালঙ্কার বলেন :

—রোহিণী-মা, একবার তাঁকে আসতে বল?

—কার কথা বলছ মা?

—শুভদা।

–তিনি কে?

—আমার গুরু, পরম গুরু। আমার আবাল্যের বন্ধু। যোশীমঠের সন্ন্যাসীঠাকুর। তাঁকে একবার খবর দে।

শুভপ্রসন্ন শয্যাপার্শ্বে এসে দাঁড়ালেন। রূপমঞ্জরী তাঁর হাতটি নিজ করতলে তুলে নিলেন। আপন ললাটে, কপোলে, অধরে নিয়ে ঠেকালেন। বললেন :

—আজ আমার বড় সুখের দিন, শুভদা। বড় শান্তির দিন। এমন শান্তি আমি জীবনে পাইনি। তাই আর দেরী করতে চাই না। আসি।

একটু থেমে আবার বললেন,

—এতদিন পরে তুমি এলে, একটু সেবা করতেও পারলাম না। দাও, তোমার পায়ের ধুলো দাও। উঠে যে নেব সে ক্ষমতাও নেই আর আজ। আমি তো আর আগের মতো নেই। দেখছ তো অবস্থা।

শুভপ্রসন্ন তাঁর মুখে, চোখের পাতায়, আঙুল বুলিয়ে দিলেন সস্নেহে।

—মঞ্জু, তুমি সুন্দর। এখনও সুন্দর।

রূপমঞ্জরী ক্ষীণ হেসে বললেন :

–মনে আছে, তুমি আশীর্বাদ করেছিলে—মঞ্জুভাষিণী! মাতৃদেবং ক্ষণমপি চ তে সুন্দরাৎ বিপ্রয়োগঃ।

(হে মঞ্জুভাষিণী! আশীর্বাদ করি সারাজীবনে ক্ষণকালের জন্যও তুমি যা কিছু ‘সুন্দর’ তা থেকে বিচ্যুত হয়ো না।” )

শুভপ্রসন্ন চোখ মুছলেন।

—একটা কথা শুভদা, এদের তুমি দেখো। আর দেখো, যদি পারো, ঘরে ঘরে মেয়েরা যেন সুশিক্ষার সুযোগ পায়। যদি পারো সোঞাই গ্রামে একটা মেয়েদের বিদ্যালয় খুলো। যেমন করে পারো ওদের উৎসাহ দিয়ো।

শুভপ্রসন্ন ওঁর জরাজীর্ণ হাতখানি তুলে নিলেন আপন মুঠিতে।

—কাল এক অদ্ভুত মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, মঞ্জু। কী তাঁর বক্তৃতা, কী ব্যক্তিত্ব! স্ত্রীজাতির শিক্ষা, স্বাধীনতা, তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি, মেধার কথাই বলছিলেন তিনি। আহা, তোমার সঙ্গে যদি একবারটি দেখা হতো।

রূপমঞ্জরী চোখ তুলে চাইলেন।

—সতীদাহ আইনত বন্ধ হয়েছে।

অন্ধকার রাত্রে এক পলকের জন্য যেন দিগন্তজুড়ে বিদ্যুৎ-আলোক ঝলসে উঠল। পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল।

রূপমঞ্জরী পরম নিশ্চিন্তে চোখের পাতা বুজলেন।

সাঁঝের আলো নিভে আসে। অন্ধকারের মাঝে ফুটে উঠতে থাকে একটি একটি আলো। প্রদীপের আলো। প্রদীপ হাতে এগিয়ে আসে ওরা কারা? রূপমতী, সত্যবতী, চন্দ্রাবতীর দল।

—চিনতে পারলে না, কবি? আমি রূপমতী। স্বর্ণালী অবগুণ্ঠন সরিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়ন মেলে সে চেয়ে রইল।

—রূপই যে আমার কাল হয়েছিল, মনে নেই? মা আমাদের নিজে হাতে বিষ খাইয়েছিলেন ইজ্জত বাঁচাতে। লিখেছ তো তোমার বইয়ে, আর এখন ভুলে গেলে?

এগিয়ে এল আগুনের ফুলঝুরি নিয়ে সত্যবতী। সর্পিল বেণী দুলিয়ে ঘাগরায় রামধনুর ঝিলিক তুলে নীবিবন্ধ থেকে এক ঝলকে উৎসারিত করল ক্ষুরধার ছুরিকা। এলিয়ে দিল গা।

—আমি সত্যবতী গো। অত সহজে প্রাণ দিইনি। খুন কা বদলা খুন! বেশরম লম্পটটার গর্দান নিয়ে তবেই দিয়েছি বেণির সঙ্গে মাথা। হাসির জলতরঙ্গে ভেঙে পড়ল খানখান।

আর ঐ চন্দ্রাবতী। ‘ময়মনসিংহগীতিকা’র কবি হিসাবেই ছিল যাঁর খ্যাতি। পিতা কবি বংশীদাস ভট্টাচার্যের চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়নকালে কিশোরী চন্দ্রাবতীর রূপেগুণে মুগ্ধ এক ভ্রমর জয়চন্দ্র প্রেমে পাগল হয়েছিল। পরস্পর বিবাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল ওরা। তারপর কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল! এক যবনীর প্রতি আকৃষ্ট হয় জয়চন্দ্র। স্বগ্রাম ত্যাগ করে, ধর্মান্তরিত হল, বিবাহ করলো ঐ মুসলমান রমণীকে।

এমনই ভাগ্যের পরিহাস যে কিছুদিন পরেই যবনীর মৃত্যু হয়। তখন জয়চন্দ্ৰ প্রত্যাবর্তন করে জানায় যে এখন সে চন্দ্রাবতীর পাণিপ্রার্থী। প্রয়োজনে নাথপন্থী হয়ে, অথবা বৈষ্ণব। চৈতন্যদেবের তিরোধানের কয়েক দশকও অতিক্রান্ত হয়নি তখন। কিন্তু চন্দ্রাবতী জানান যে চিরকুমারী থেকে গৃহদেবতার পূজাঅর্চনা আর সাহিত্যসেবায় জীবন কাটিয়ে দেবেন তিনি।

জয়চন্দ্র স্তম্ভিত হয়ে জানতে চাইলেন, তুমি আমাকে আর ভালোবাস না?

চন্দ্রাবতী ম্লান হেসে বললেন, সেটাই তো সব চেয়ে বেদনার। বাসি!

—তাহলে কোথায় তোমার আপত্তি? ‘ধর্ম’ ত্যাগ করতে?

—হ্যাঁ। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের কথা বলছি না। আমার ‘নারীত্ব ধর্মের’। সেটা ত্যাগ করতে পারব না।

জনশ্রুতি, জয়চন্দ্র আত্মহত্যা করেন এবং সেই নিদারুণ সংবাদ শ্রবণমাত্র মূর্ছিতা হয়ে ভূলুণ্ঠিতা হন চন্দ্রাবতী। সে মূর্ছা তাঁর আর ভাঙেনি।

*

এরা সবাই আমার পূর্বসূরি গো। এদের নির্যাসেই তো গড়লে আমায়। আর আজ ভুলে গেলে? রূপমঞ্জরী অভিমানাহত।

কথাকোবিদের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

এরা আসে বারবার। দীপালি জ্বালাতে। এ মহাঅমানিশার অন্ধকার দূর করতে। যুগে যুগে। কিন্তু এ আঁধার যে বড় বিকট।

*

রূপমঞ্জরী ঘনিয়ে আসে। সোঞাই গ্রামের সেই কাজল-নয়না মেয়েটি, ঘুম-না-আসা রাতে যে শোনাতে আসত তার হাসি-কান্নার গাথা। কথাকোবিদের চিবুক তুলে ধরে

—ওগো ওঠো। আমি তোমার মানসকন্যা। শোনো, চেয়ে দেখো।

কিন্তু কথাকোবিদের চোখ ঘুমে ঢলে আসে।

*

রূপমঞ্জরীর গল্প শেষ হয় না। এ গল্প যে শেষ হবার নয়। এ সংগ্রাম যে অনন্তকালের। এ সংঘাত যে বিপুলা পৃথ্বী জুড়ে।

নিষ্প্রভাত রাত্রি নেই। পুব দিগন্তে ফুটে ওঠে ঊষারানীর আঁচলবিছানো রক্তিম প্রতিশ্রুতি। সেইক্ষণে চেয়ে দেখো, আকাশে চোখ মেলে। এ গল্পের নায়কের দেখা মিলবে। সেই একক বিহঙ্গ—যে বিশ্বাস করে ‘আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ অঙ্গন’।

সমাপ্ত

তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা

1. রূপমঞ্জরী ১ম ও ২য় খণ্ড—নারায়ণ সান্যাল

2. রূপমঞ্জরী–নবকল্লোল ১৪১১ বৈশাখ-ফাল্গুন সংখ্যা।

3. স্তবকুসুমাঞ্জলি—স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত, উদ্বোধন।

4. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান—সাহিত্য সংসদ

5. বৃহৎ বঙ্গ—দীনেশচন্দ্র সেন—দে’জ পাবলিশিং

6. রামমোহন রচনাবলী—দে’জ পাবলিশিং

7. আমরা বাঙালি—শিশু সাহিত্য সংসদ

8. A Vindication of the Rights of Women: With Structures on Politi—cal and Moral Subjects–Mary Wollstonecraft, London, J. Johnson, and Boston, Thomas & Andrews, 1792, second edition, London, J. Johnson, 1792.

9. শ্রী প্রদীপ দত্ত—যিনি স্থিরনির্দিষ্ট করেন যে লেখক শ্রী নারায়ণ সান্যাল শেষ অংশ নিজে হাতে লিখে যাননি।

10. শ্রী প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত—গল্পটির শেষাংশ তিনি যেমন শুনছিলেন স্বয়ং লেখকের মুখ থেকে, মিলিয়ে নিতে আমাকে সাহায্য করেন ও Mary: Wollstonecraft সম্বন্ধে তথ্যসংগ্রহে সাহায্য করেন।

11. শ্রী সুবাস মৈত্র—যাঁর সাহচর্য ও উৎসাহ না পেলে এই লেখাটি শুরু ও শেষ করার সাহস বা উদ্যম সম্ভব হত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *