অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ – রাঘবের বাটী
রজনী প্রভাত হইল, কিন্তু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, প্রকৃতি হাসিল না, কোকিল ডাকিল না, পাপিয়া ডাকিল না; ডাকিল, কেবল কর্কশ নির্ঘোষে কাককুল, ডাকিল কেবল পৈশাচিক চীৎকারে মৎস্যরঙ্গ। রাঘব সেনের সিংহদ্বারে গম্ভীর হরিধ্বনি হইল, অন্তঃপুরে পুরবাসিনীগণ কাঁদিয়া উঠিল।
পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে—আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি, সতীশচন্দ্র নামে রাঘব সেনের একটিমাত্র পুত্র ছিল। পুত্রটি বলবান, রূপবান, বুদ্ধিমান, সুশীল ও শান্ত-স্বভাব; তাহার ষোড়শবর্ষ বয়ঃক্রম হইয়াছিল, বিবাহ হয় নাই, বিবাহের উদ্যোগ হইতেছিল। সে কলিকাতায় থাকিয়া ইংরাজী ও পারস্য ভাষা অভ্যাস করিত, সম্প্রতি পূজা উপলক্ষে বাটীতে আসিয়াছিল। পূৰ্ব্ব দিবস সন্ধ্যার পর তাহার সামান্য শিরঃপীড়া হয়, সে তাহা পীড়া বলিয়া গ্রাহ্য না করিয়া অসামান্য যত্ন ও আগ্রহাতিশয় সহকারে আমন্ত্রিতদিগের সৎকার ও পরিচর্য্যা করিয়া আহারান্তে প্রেমচাদের কীর্ত্তন শুনিতেছিল; ক্রমে তাহার শরীর অধিকতর অসুস্থ হইল, গীতবাদ্য ভাল লাগিল না,
নিজ গৃহে আসিয়া শয়ন করিল—ঘাম হইতে লাগিল—সে ঘাম ব্যজনে থামিল না, মার্জ্জনে থামিল না, ঔষধেও থামিল না—ক্রমশঃ বলহীন ও ক্ষীণ হইয়া রাত্রি তৃতীয় প্রহরে রাঘবের একমাত্র বংশধর সতীশচন্দ্র প্রাণত্যাগ করিল। পূর্ণিমার রজনীতেও হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া প্রলয় ঘটিয়া যায়—নবমীর উৎসবময়ী নিশাতে দোৰ্দ্দণ্ড প্রতাপ, প্রভূত বলশালী রাঘব নিৰ্ব্বংশ হইল।
রজনী প্রভাত হইলে আত্মীয়-স্বজনেরা সতীশ্চন্দ্রের সৎকার করিয়া ফিরিয়া আসিলেন, তাই সিংহদ্বারে হরিধ্বনি হইল, অন্তঃপুরে পুরবালাগণ কাঁদিয়া উঠিল। একটিমাত্র বাতী জ্বলিতেছিল, তাহাও নিবিয়া গেল—পুরী অন্ধকার হইল।
সতীশ নাই—রাঘব অন্ধকার দেখিল—যেন সহস্র বৃশ্চিক যুগপৎ তাঁহার হৃদয়ে দংশন করিল। ক্ষণকালের জন্য রাঘব অরুন্তুদ অন্তর্জালায় অচেতন প্রায় হইয়া রহিল, পরে সে মনে মনে বলিল, “আমি কি মূর্খ, অকারণ এ যন্ত্রণা ভোগ করি কেন? পরের জন্য আপনার শান্তি নষ্ট করি কেন? ষোড়শ বর্ষ পূর্ব্বে আমি ছিলাম, কিন্তু সে ত ছিল না; এখন আমি রহিলাম, সে ত চলিয়া গেল— পথে দেখা হইল, পথেই বিদায় হইল, সে আমার কে? তাহার বিচ্ছেদে কাতর হইব কেন? তাহার কাছে আমি কি সাহায্য পাইয়াছি। তাহার দ্বারা আমার সৌভাগ্যের কি উন্নতি হইয়াছে। এবং তাহার বিচ্ছেদেই বা আমার কি ক্ষতি হইবে? যাহারা পুত্রের সাহায্য প্রত্যাশা করে, তাহারা পুত্র-বিয়োগে কাতর হইতে পারে, আমি হইব কেন? পরের তরে কাতর হইয়া আপনার শান্তি নষ্ট করিব কেন? সুখই মনুষ্য-জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য—আমি সুখে বঞ্চিত হইব কেন? আহা! কে কাঁদিতেছে? কে করুণস্বরে বলিতেছে, ‘মা বলিতে আর যে আমার নাই রে যাদু, বাছা আমার রে।’ অহো! সতীশ-জননী কাঁদিতেছে—পুত্রগতপ্রাণা—প্রাণের জ্বালায় আকুল হইয়া কাঁদিতেছে। আর যে সহ্য হয় না, আর যে ধৈর্য্য ধরিয়া থাকিতে পারি না—আমি নিজে অবিচলিতভাবে তুষানলে দগ্ধ হইতে পারি, কিন্তু এ পুত্রশোকাতুরার হৃদয়-বিদারক করুণ-ক্রন্দন আমার অসহ্য—সূর্যতাপ সহ্য হয়, কিন্তু সেই তাপ যখন সূৰ্য্যকান্তমণি ভেদ করিয়া আইসে, তখনই আগুন জ্বলিয়া উঠে, তখনই অসহ্য জ্বালা উপস্থিত হয়।”
তৃণ-তরুহীন তুষারমণ্ডিত ধবলপৰ্ব্বতও নিদাঘের অরুণ-কিরণ কথঞ্চিৎ অনুভব করে; সে পাষাণ-হৃদয়ের কঠিন হিমানী কিয়ৎপরিমাণেও বিগলিত হয়; বনিতার করুণ-ক্রন্দনে রাঘবের শীতলহৃদয়ও সন্তপ্ত হইল, কিন্তু সে কাঁদিল না, পাপাত্মার পাপচক্ষে কখনও একবিন্দু অশ্রুপাত হয় নাই, এখনও হইল না।
সে নিজ নিভৃত কক্ষ পরিত্যাগ করিয়া উন্মত্তের ন্যায় দ্রুতবেগে দ্বিতীয়তলে আসিল, আসিয়া পত্নীর কাছে গিয়া বলিল, “তুমি কাঁদিয়া কাঁদিয়া আমায় পাগল করিয়া তুলিবে? সে ত গিয়াছে, এখন আমাকেও মারিবে? আমি তোমায় কাঁদিতে দিব না; তুমি কি জন্য কাঁদিবে? যাহার অর্থ আছে, সামর্থ আছে, তাহার আবার পুত্রশোক কি? নিরন্ন দীন দুঃখী যারা, তারাই পুত্রশোকে আকুল হয়, তুমি এত কাতর হইতেছ কেন? বেশ করে ভেবে দেখ দেখি, সাত বেটার মা-ও পথে বসে কাঁদে, কিন্তু যার অর্থ আছে, সে মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত অনন্তসুখে কাটাইয়া যায়—তোমার কিসের অভাব? তুমি কিসের তরে কাঁদিবে? কাহার তরে কাঁদিবে? যে মরিয়া গেল, তাহার সহিত আর সম্পর্ক কি? তাহার জন্য কাঁদিবে কেন? আর কাঁদিও না।”
স্ত্রীকে এইরূপ বুঝাইয়া রাঘব সেন বহির্বাটীতে প্রস্থান করিল। সেখানে গিয়া দেখিল, উৎসব- প্রাঙ্গণ শ্মশানভূমি হইয়া রহিয়াছে—কয়েকজন ঢুলি ও ভৃত্য মাত্র একপার্শ্বে বিষণ্নভাবে নীরবে বসিয়া আছে। এইরূপ অপ্রসন্ন দৃশ্য দেখিয়া রাঘব হৃদয়ে যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ হইল, সে অকারণ ক্রুদ্ধ হইয়া, যাহাকে সম্মুখে দেখিতে পাইল, তাহাকেই চীৎকার করিয়া গালি দিতে লাগিল। ভৃত্যগণ ভীত হইয়া নানা কার্য্যে নিযুক্ত হইল; ঢুলি—ঢোল কাঁধে লইল, ঢাকি—ঢাক ঘাড়ে করিল, দ্বারবান্ দেউড়ীতে খাড়া হইল এবং নহবৎখানায় দামামায় ঘা পড়িল। এইরূপে পুরী পুনর্ব্বার কথঞ্চিৎ সরগরম হইয়া উঠিল—পুনর্ব্বার মৃতদেহে যেন কথঞ্চিৎ জীবন সঞ্চার হইল।
রাঘব সেন তখন চিত্তবিনোদনার্থ প্রমোদকাননে প্রবেশ করিল, কিন্তু পাপাত্মা সেখানেও শান্তিলাভ করিতে পারিল না—অদূরে ফৌজদারদিগের পটমণ্ডপ দেখিয়া অন্যবিধ দুর্ভাবনা তাহার হৃদয়ে উপস্থিত হইল—সে ভাবিতে লাগিল, “কলিকাতার ফৌজদার আসিল কেন? গঙ্গাপুর ত তাহার এলাকা নয়, তবে সে আসিল কেন? জুলিয়া কি অভিযোগ করিয়াছে? তাহা হইলেই বিপদ। এ বিপদের সময় রত্নাও আমায় পরিত্যাগ করিয়া গেল; তার উপস্থিত-বুদ্ধি, বিপুল-বিক্রম ও অসাধারণ কার্য্যদক্ষতা আমার সৌভাগ্যান্নতির অনেক সহায়তা করিয়াছে। সে যখন গিয়াছে, তখন আমার ভাগ্য-গগন যে গাঢ় মেঘাচ্ছন্ন হইবে, তাহা বেশ বুঝিতে পারিতেছি; কিন্তু কেনই বা এত বিষণ্ণ হইতেছি? চিরদিন কাহার সমভাবে যায়? অধিকাংশ মনুষ্যকেই সময়ে সময়ে সংসার- স্রোতের ভীষণতর আবর্তে পতিত হইতে হয়, কিন্তু সকলেই কি ডুবিয়া যায়? আমি হতাশ হইব কেন? যদি বিপদ ঘটে, আমি কি উত্তীর্ণ হইতে পারিব না? আমার অর্থের অপ্রতুল নাই—অর্থে কি না হয়? অর্থ সর্ব্বশক্তিমান, আর বাঙ্গালার অধিকাংশ বড় লোকেই আমার বাধ্য, তাহারা কি আমার সহায়তা করিবেন না! বিশেষত আমি যাবজ্জীবন দেবতা-ব্রাহ্মণের অর্চ্চনা করিয়া আসিতেছি, আমার অমঙ্গল কখনই হইবে না। অ্যাঁ, তবে আমি নিৰ্ব্বংশ হইলাম কেন? আমার সতীশ চলিয়া গেল কেন? পুত্র-বিয়োগ ও বংশলোপের অপেক্ষা অধিকতর অমঙ্গল আর কি হইতে পারে? কিন্তু কোন্ প্রখ্যাতবংশ বিদ্যমান আছে—পুত্রশোক পায় নাই? এমন লোকই বা কয়জন আছে? না। দেখিতেছি, আমার মন নিতান্ত দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িয়াছে, আমি কি ভাবিতেছি, আমার ভ্রম হইতেছে কেন? বিধাতার নির্ব্বন্ধ, কে খণ্ডন করিতে পারে? সতীশের সময় হইল, সে চলিয়া গেল; সকলেই একা আসে, একা যায়। আমি একা আসিয়াছি, একাই কাৰ্য্য করিব, সময় হইলে একাই চলিয়া যাইব। এখন কাজ করা চাই, বিপদে ধৈর্য্য চাই—উত্তীর্ণ হইবার চেষ্টা করা চাই। জগন্নাথ বলিল, গোবিন্দরাম কলিকাতার ফৌজদারের আত্মীয়, তাই সে এখানে আসিয়াছে। এ কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে ভয়ের বিষয় বড় বেশি নয়, যাহা হউক, নিশ্চিন্ত থাকা হইবে না।” এইরূপ নানা চিন্তা করিতে করিতে দুম্মতি রাঘব সেন উদ্যানমধ্যে বিচরণ করিতে লাগিল; যতই মনে করিতে লাগিল, দুঃখকে হৃদয়ে স্থান দিব না, ততই দুঃখ সর্পের ন্যায় তাহাকে জড়াইয়া ধরিতে লাগিল।