অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – প্রান্তরে
ঝাঁকারিয়ার বিশ-ক্রোশী মাঠ ধূ ধূ করিতেছে, বিশ-ক্রোশ জুড়িয়া ধান্যতৃণরাজি অপূর্ব্ব হরিৎশোভা বিস্তার করিয়া বঙ্গবাসীর নয়নানন্দ সম্পাদন করিতেছে—বিশ ক্রোশ-ব্যাপিয়া জগজ্জননী অন্নপূর্ণারূপে বিরাজিত রহিয়াছেন। অষ্টমী পূজার দিন, বেলা তৃতীয় প্রহর সময়ে এই প্রান্তরস্থ একটি বাঁধের উপর দিয়া দুৰ্দ্দম দস্যু রত্নাপাখী একাকী গমন করিতেছিল। সে যাইতে যাইতে দেখিল, একটা বক, এক বিলের ধারে, একপায়ে দাঁড়াইয়া নিশ্চলভাবে জলের দিকে তাকাইয়া আছে। এই দৃশ্যটি দেখিয়া সে একটু হাসিল ও মনে মনে বলিল, “রে তির্য্যক, আমরা মানবদেহ ধারণ করিয়াও তোর মত আচরণ করিতেছি—তুই যাহা করিতেছিস, রাঘব আর আমি তাহাই করিয়া থাকি। আমরা মনুষ্য হইয়াও তির্য্যক—তুই কেবল আপনার স্বার্থ চিন্তা করিস, আমরাও তাহাই করিয়া থাকি। স্বার্থমাত্র চিন্তা ইতর প্রাণীর ধর্ম্ম, স্বার্থসাধন হইলেই ইতর প্রাণীর সুখ; কিন্তু কেবল স্বার্থসাধনে মনুষ্য সুখী হয় না, তাহা যদি হইত, তবে আমিও সুখী হইতাম, কিন্তু আমি ত একদিনের তরেও সুখী হই নাই। বোধ হয়, কজ্জলাকে সুখী করিতে পারিলে আমি সুখী হইব। কলা আমার মঙ্গল খোঁজে, তাই সে আমায় ডাকাতি ত্যাগ করিতে বলে—কজ্জলা আমার সুখে সুখিনী হইবে বলিয়া আমায় দস্যুবৃত্তি পরিত্যাগ করিতে বলে। আজীবন দস্যুবৃত্তি করিয়া আমি নিজে যৎপরোনাস্তি অসুখী হইয়াছি, আর অসংখ্য লোককে অসহ্য যন্ত্রণায় জৰ্জ্জরিত করিয়াছি—কত নরহত্যা করিয়াছি, তাহার ইয়ত্তা নাই। কি কুকৰ্ম্মই করিয়াছি! আমি কেন বুঝিলাম না, পরের সুখ সাধনে —পরোপকারেই প্রকৃত সুখ?” এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে রতন শৰ্ম্মা তালতরুপরিবৃত একটি পুষ্করিণীর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল।
পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে, এই পুষ্করিণীর প্রশস্ত সোপানে, পঞ্চমীর রাত্রি অবসানে কজ্জলার সহিত রত্নার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। রতন দেখিল, জলাশয়ের একপার্শ্বে একজন কৃষ্ণবর্ণ বলিষ্ঠকায় ব্রাহ্মণ ছিপ ফেলিয়া বসিয়া আছে—এ ব্রাহ্মণকেও পাঠক একদিন দেখিয়াছেন, ইহার নাম হরি ঠাকুর। রত্না তাহাকে সম্ভাষণ করিয়া জিজ্ঞাসিল, “কি ঠাকুর, কিছু করতে পেরেছ?”
হরি। না দাদা, কেবল কাদা মাখাই সার।
রত্না। আজকাল আর কিছু হবে না। আজ হ’ল অষ্টমী পূজা, যে যেখানে যাবার সব গিয়ে পড়েছে। উঠে এস, আমার সঙ্গে চল, একটা ভাল রকম জোগাড় আছে।
হরি। কোথা?
রতন। দেওয়ান গোবিন্দরামের বাড়ীতে।
হরি। সে কি, সে বাড়ীতে দুজনে!
রতন। কেন, ব্যাপারটা কি? তুমি কেবল আমার সঙ্গে থাকবে মাত্র, আমি একাই সব কাজ সারব।
এইরূপ কথোপকথন চলিতেছে, এমন সময়ে তাহাদের পশ্চাৎ দিকে কে একজন আর্তস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল। তাহারা পিছু ফিরিয়া দেখিতে পাইল, একব্যক্তি উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া আসিতেছে এবং অপর একব্যক্তি তাহার. অনুসরণ করিতেছে।
অগ্রবর্ত্তী লোক বৃদ্ধ। বৃদ্ধ, “বাবা, আমায় বাঁচাও,” বলিয়া হরি ঠাকুরের পায়ে জড়াইয়া পড়িল।
রতন শর্ম্মা বলিল, “ভয় কি, উঠ—তুমি কোথা যাবে?”
বৃদ্ধ। বাবা, আমি রত্নপুরে যাব।
রতন। রত্নপুরে কার বাড়ী?
বৃদ্ধ। গোবিন্দরামের বাড়ীতে যাব।
রতন। নির্ভয়ে চলে যাও—কার সাধ্য তোমায় মারে, এই আমরা দাঁড়াইলাম; যাও চলে যাও।
পশ্চাদ্দিকে পুনঃপুনঃ দৃষ্টিপাত করিতে করিতে বৃদ্ধ যথাসাধ্য দ্রুতপদে চলিয়া গেল। পশ্চাদ্বর্ত্তী দস্যু নিকটে আসিয়া বলিল, “কি ঠাকুর, বেটাকে ছেড়ে দিলে?”
রতন। ওকে মেরে কি হবে, ওর কাছে আছে কি?
দস্যু। সে কি, ওর কোমরে যে গেঁজে আছে, দেখেননি কি?
রতন। আরে দু-চারটে টাকার তরে, একটা মানুষ মারা কি ভাল?
দস্যু। সে কি ঠাকুর, এ কথা যে তোমার মুখে আজ নূতন শুনছি।
রতন। আমি আর ও কাজ করব না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, দস্যুবৃত্তি আর করব না।
হরি। আর এই যে বলেছিলে, দেওয়ানের বাড়ীতে ডাকাতি করতে যাবে।
রতন। এই ডাকাতিতেই আমার ব্রত প্রতিষ্ঠা হবে। যা সঙ্কল্প করেছি, তা অবশ্যই সমাধা করব, প্রাণ থাকতে রতনের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয় নাই—হবেও না।
দস্যু। আপনারা দুজনে যাচ্ছেন, আর সব কৈ?
রতন। আবার কে? অধিক লোকের দরকার কি? তুইও আমাদের সঙ্গে চল।
এই কথার পর তিনজন দস্যু একত্রে যাত্রা করিল। সমস্ত দিবস আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, কিন্তু বৃষ্টি হয় নাই;এক্ষণে একখানা নিবিড় নীলবর্ণ মেঘ পশ্চিমদিক ব্যাপিয়া ক্রমে উর্দ্ধে উত্থিত হইতে লাগিল, ক্রমে আকাশের অর্দ্ধভাগ ঘেরিয়া ফেলিল, চপলালীলা ও মেঘগর্জ্জন আরম্ভ হইল; শকুনি, গৃধিনী, শ্যেন ও চিল প্রভৃতি গগনমার্গে ঘুরিতে ঘুরিতে ক্রমে ক্রমে নিম্নদেশে অবতরণ করিতে লাগিল।
রত্না বলিল, “ঠাকুর বড় একটা ঝড় উঠছে, একটু চলে এস।”
হরি। তাই ত দাদা, মাঠটা যে পার হতে পারলে হয়।
ক্রমে সমস্ত গগনতল করাল মেঘমালায় আবৃত হইল, চতুৰ্দ্দিক যেন প্রলয়ের অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া গেল। ঘোর গভীরনাদে মেঘদল পুনঃপুনঃ গর্জ্জন করিতে লাগিল, পুনঃপুনঃ জলদবালা বিকট হাসি হাসিতে লাগিল, ঝড় উঠিল, ঝটিকাসহ ঘোরতর শব্দ-সহকারে মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। এই সময়ে দস্যুগণ রত্নপুরে আসিয়া পৌঁছিল।