অষ্টম পরিচ্ছেদ – রাঘব সেনের বাটী
পাঠক, পাখীর বাগানে রাঘব সেনকে একদিন দেখিয়াছেন। তিনি একজন অতিবড় সম্ভ্রান্ত জমিদার ছিলেন। তাঁহার অগাধ বিষয়, বিপুল ঐশ্বর্য্য ও অসীম ক্ষমতা। হুগলী জেলায় তত বড় লোক তৎকালে ছিল না। রাঘব সেন দাতা, ভৰ্ত্তা, ক্রিয়াবান। সকল তীর্থস্থানেই তাঁহার দেবালয়, সকল প্রসিদ্ধ শহরেই তাঁহার কুঠী ও কারখানা ছিল। তিনি গঙ্গাপুর গ্রামে বাস করিতেন। তিনি যাঁহার সহিত একবার আলাপ করিতেন, সে ইহজীবনে তাঁহাকে আর ভুলিতে পারিত না। তাঁহার সহাস্য বাক্য-প্রণালীর এমনি আশ্চর্য্য মোহিনী শক্তি ছিল যে, সে মোহন মন্ত্রে মুগ্ধ হয় নাই, তৎকালে এমন সাহেব, সুবা ও সম্ভ্রান্ত লোক অল্পই দেখা যাইত।
তিনি প্রতিদিন প্রত্যূষে গঙ্গাস্নান যাইবার সময়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করিতেন, ও প্রত্যেক পল্লির প্রত্যেক বাটীর কুশল সংবাদ লইয়া নিরন্নের অন্ন, পীড়িতের চিকিৎসা ও বিপন্নের উদ্ধারোপায় করিয়া দিতেন। তাঁহার বদান্যতা ও অমায়িকতায় গঙ্গাপুরের সমস্ত লোকই তাঁহার অনুগত ও বশীভূত হইয়াছিল। তাঁহার অনুমতি না লইয়া গ্রামে কোন কাৰ্য্যই হইত না, এবং তাঁহার মতের বিরুদ্ধে কোন কার্য্য করিতে কেহ সাহস করিত না।
রাঘব সেনের প্রকাণ্ড অট্টালিকা। সেরূপ বৃহৎ অট্টালিকা তৎকালে প্রায় দেখা যাইত না; অট্টালিকার সম্মুখে ফুল-বাগান, ফটক ও নহবৎখানা। রাত্রি একপ্রহর অতীত হইয়াছে, পঞ্চমীর চন্দ্ৰ অস্ত গিয়াছে, নহবৎখানায় হলা মুচি রৌসন-চৌকিতে কানেড়া আলাপ করিতেছে।
বাগানের দিকে পুরীর দ্বিতীয়তলে সুপ্রশস্ত নাচঘর উজ্জ্বলতর আলোকমালায় প্রভাসিত ও পুষ্পহারে সুশোভিত হইয়াছে। তথায় দুগ্ধফেননিভ সুকোমল আসনে শত শত সম্ভ্রান্ত লোক সুখে সমাসীন রহিয়াছেন। রজত ও সুবর্ণ নির্ম্মিত আলবোলার সুগন্ধি খাম্বিরা ধূমিত ও গোলাপজল মুহুর্মুহুঃ সিঞ্চিত হইতেছে। ঘন ঘন তাম্বুল ও আতরদান হস্ত হইতে হস্তান্তরে ফিরিতেছে এবং পরমরূপবতী প্রখ্যাতনামা জুলিয়া বাইজী কোকিল-বিনিন্দিত স্বর-লহরীতে শ্রোতৃবর্গকে বিমোহিত করিতেছে। এই সভায় জনাই নিবাসী দেওয়ান জগন্মোহন মুখোপাধ্যায় ও কুমারটুলি নিবাসী নিধুবাবু উপস্থিত ছিলেন। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময়ে এই দুইজন মাননীয় ব্যক্তি বড়ই মলিসী ও সমজদার লোক বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইঁহারা যে মজলিসে উপস্থিত না থাকিতেন, সে মজলিস, মলিস বলিয়াই পরিগণিত হইত না। রাঘব সেন কখন হাসিতেছেন, কখন করযোড় করিতেছেন, কাহার হাত ধরিয়া বসাইতেছেন, কাহাকে স্বহস্তে ব্যজন করিতেছেন, কাহাকেও বা তাম্বুল ও তোড়া দিতেছেন, কাহারও গাত্রে গোলাপজল ছিটাইতেছেন, সংক্ষেপতঃ তিনি সকলকেই যথাযোগ্য সম্মান করিয়া, সকলের সহিত সমান আদর সম্ভাষণ করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। গান শুনিবার অবসর তাঁহার নাই, গানও তাঁহার ভাল লাগিতেছিল না। তাঁহার মন বিষয়ান্তরে নিবিষ্ট ছিল। কিন্তু তাঁহার কার্য্য ও বচন-প্রণালীতে কাহার সাধ্য তাঁহার হৃদয়ের বিপরীত ভাব অনুভব করে? পাঠক, বোধ হয়, জিজ্ঞাসা করিবেন, এ সময়ে রাঘব সেনের বাড়ীতে এ উৎসব কিসের? পূজার এখনও যে দুইদিন বিলম্ব আছে, তবে এ মহাসমারোহের কারণ কি?
রাঘব সেনের বাটীতে শারদীয়োৎসবোপলক্ষে অতিশয় জাঁকজমক হইত। পূজার একপক্ষ পূর্ব্বে বোধন বসিত এবং সেইদিন হইতে বিজয়া দশমী পৰ্য্যন্ত অবিশ্রান্ত নানাপ্রকার আমোদ- প্রমোদ ও নাচ-তামাসা চলিত। বিশেষতঃ প্রতিবৎসর পঞ্চমীর দিনে তাঁহার জন্মতিথি উপলক্ষে বিশেষ সমারোহ হইত। আজি সেই উপলক্ষে সকলেই আমোদ-আহ্লাদ করিতেছেন। সকলেই প্রফুল্ল, কিন্তু রাঘব সেনের এরূপ চিত্ত-চাঞ্চল্যের কারণ কি? সকলেই দেখিতেছেন, তিনি হাসিতেছেন, আমোদ-আহ্লাদ করিতেছেন, কিন্তু সেই সকল আমোদ-আহ্লাদ বস্তুতঃ তাঁহার হৃদয়ে কিছুমাত্র স্থান পাইতেছিল না। রত্নার কি হইল? সমস্ত দিন গেল, এত রাত্রি হইল, এখনও সে আসিল না কেন? রত্না মারা পড়ে, তাহাতে দুঃখ নাই, পাছে সে ধরা পড়ে, ইহাই তাঁহার ভয়।
জুলিয়া দেওয়ান জগন্মোহনের অনুরোধে একটি বাঙ্গালা টপ্পা ধরিল। টপ্পাটি সেই মজলিসে উপস্থিত নিধুবাবু বাঁধিয়াছিলেন। একে সুপ্রসিদ্ধ নিধুবাবুর টপ্পা, তাহাতে অদ্বিতীয়া গায়িকা জুলিয়া সেই টপ্পা গান করিতে লাগিল, আসর আগুন হইয়া উঠিল। কবিহৃদয়ে অনির্ব্বচনীয় আনন্দের উদয় হইল। বহুদীপসমুজ্জ্বল, বহুলোকসমাকীর্ণ আসরে বসিয়া নিধুবাবু, সে সময়ে যে কি আনন্দ অনুভব করিয়াছিলেন, তাহা সাধারণের উপভোগ্য নহে।
গায়িকা গাইল;
“দুখ দিলে বলে কি প্রেম ত্যজিব?
দুঃখ, সুখ জ্ঞান করি যতনে তায় তুষিব।
না থাকে তাহার মন,
করিবে না আলাপন
তবু সে বিধুবদন দূরে থেকে দেখিব।”
যদিও গায়িকা, রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে, বেহাগের সময়ে ভৈরবী গাইয়াছিল, তথাপি সেই গীতের হৃদয়গ্রাহী কবিত্বে ও গায়িকার অপূর্ব্ব রূপলাবণ্য, মনোহর ভাব-ভঙ্গি ও নববসন্তপ্রেরিত কোকিলঝঙ্কারবৎ চমৎকার স্বর- লালিত্যে শ্রোতৃবর্গ এতদূর বিমুগ্ধ হইয়াছিলেন যে, তখন কেহই সে দোষ অনুভব করিতে পারেন নাই। সকলেই বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়া চিত্রিত পুত্তলির ন্যায় বসিয়াছিলেন। জুলিয়া এইরূপ যাদুগিরী করিতেছে, সকলে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাহার মুখপানে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে, এমন সময়ে একজন দ্বারবান্ নৃত্যশালার অন্যতর দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার প্রতি রাঘব সেনের দৃষ্টি পড়িলে, সে প্রণাম করিয়া বলিল, “হুজুর, ভট্টাচার্য্য মহাশয় নীচে দাঁড়াইয়া আছেন।”
এই কথা শুনিবামাত্র রাঘব সেন, তাঁহার পুত্র সতীশচন্দ্রের উপর অভ্যাগতদিগের পরিচর্য্যার ভারার্পণ করিয়া দ্বারবানের সহিত প্রস্থান করিলেন।
তিনি নিম্নতলে আসিয়া দেখিলেন, রত্নাপাখী দাঁড়াইয়া আছে। তিনি দ্বারবানকে যথাস্থানে যাইতে বলিয়া রত্নার হাত ধরিয়া ঠাকুর দালানে উঠিলেন। দালানে একটিমাত্র প্রদীপ জ্বলিতেছিল। এবং সম্মুখে দশভূজা-মূৰ্ত্তি অস্পষ্ট দেখা যাইতেছিল। তাঁহারা দালানের পার্শ্ববর্তী একটি গৃহের দ্বারে উপনীত হইয়া সেই দ্বার উদ্ঘাটনপূর্ব্বক গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং ভিতর হইতে দ্বাররুদ্ধ করিয়া দিলেন।
গৃহমধ্যে প্রগাঢ় অন্ধকার, আলোকের লেশমাত্র নাই, হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া দুইজনে আর একটি দ্বারের নিকট পৌঁছিলেন। রাঘব সেন সেই দ্বারের চাবি খুলিলেন এবং এক অতি সংকীর্ণ সোপান দ্বারা অবতরণপূর্ব্বক এক প্রশস্ত গৃহমধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই রসাতলস্থ গৃহে নিরন্তর এক গম্ভীর শব্দ স্বতঃ উৎপন্ন হইতেছিল এবং তাহার বিবর্ণ প্রাচীরে ঢাল, করবাল, টাঙ্গী, খাঁড়া, তীর, ধনু প্রভৃতি বিবিধ বধাস্ত্র সকল স্তরে স্তরে ঝুলিতেছিল; গৃহের এক পার্শ্বে হাপর, হাতুড়ী, মূচী, সাঁড়াশী প্রভৃতি স্বর্ণকারের যন্ত্র ও অপরপার্শ্বে কতকগুলো মোটা মোটা মশাল ও তৈলভাণ্ড পড়িয়াছিল। প্রদীপের ক্ষীণালোকে দেখা যাইতেছিল—গৃহের প্রান্তভাগে শবের মত কি যেন একটা পড়িয়া রহিয়াছে এবং তাহার পার্শ্বে একটা বিকটাকার মূর্ত্তি নিশ্চলভাবে বসিয়া আছে। এই অপ্রীতিকর স্থানে রাঘব সেন রত্নাপাখীকে জিজ্ঞাসিলেন, “কি গো ঠাকুর-মহাশয়, ব্যাপারখানা কি? আজ সমস্ত দিন কোথা থাকা হয়েছিল—সমস্ত দিনে একবারও দর্শন পেলেম না, কারণটা কি?”
রতন অপ্রসন্ন বদনে মৌনাবলম্বন করিয়া রহিল, কোন উত্তর দিল না।
ঠাকুর মহাশয় বলিয়াছি বলিয়াই বা রতন রাগ করিল, এই ভাবিয়া, রাঘব সেন কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইয়া পুনরপি বলিলেন, “কেন রতন, আজ তোর এমন বিমর্ষ ভাব কেন?”
রত্না। না, আমি আর এ কাজ করব না, এ কাজে লাভ কি? সুখ কি?
রাঘব। লাভ টাকা—টাকা হলে সুখের অভাব কি?
রত্না। টাকায় তোমার সুখ হতে পারে, আমার সুখ টাকায় হবে না, টাকা আমি ঢের রোজকার করেছি, কিন্তু একদিনের তরে আমি সুখী হতে পারি নাই। নিশ্চয় এ কাজে কোন সুখ নাই।
রাঘব সেন উচ্চ হাসিয়া বলিলেন, “তুই ত ভারি নির্ব্বোধ দেখছি, এ কাজে যদি সুখ না থাকবে, তবে এ কাজ করব কেন? আর তোকেই বা করতে বলব কেন? বোধ হচ্ছে, তোর আজ সমস্ত দিন খাওয়া হয়নি; আয়, আগে খাবি আয়, এইখানেই তোর খাবার প্রস্তুত করে রেখেছি, আগে ঠান্ডা হ, তারপর তোর সঙ্গে কথাবার্তা; তোর যা হয়েছে, তা সব আমি বুঝেছি।”
এই বলিয়া রাঘব সেন, রতনের হস্তধারণ পূর্ব্বক প্রদীপের নিকট লইয়া আসিলেন এবং তথায় তাহাকে বসাইয়া নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য তাহার নিকটে, ধরিয়া দিলেন। সম্মুখে বিবিধ প্রকার লোভনীয় সামগ্রী দেখিয়া রতনের বদনমণ্ডল অপেক্ষাকৃত প্রসন্ন হইল; রতন দ্বিরুক্তি না করিয়া আহারে বসিয়া গেল এবং গোগ্রাসে দুই-তিন সের লুচি-মণ্ডার ঘাড় ভাঙ্গিয়া এক হাঁড়ি ক্ষীর খাইয়া আচমন করিয়া বসিল।
রতন যখন জলযোগ করে, রাঘব সেন সেই অবসরে স্বহস্তে একছিলিম গাঁজা প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন। ভোজন সমাপ্ত হইলে দুই-চারিখানি সুপারী ও সেই গাঁজা ছিলিমটি তাহার হস্তে প্রদান করিলেন। ত্বরিতানন্দ প্রাপ্ত হইয়া রতন শর্মার পরমানন্দ উপজিল, সে হস্তে যেন স্বর্গ পাইল, সব ভুলিয়া গেল এবং হৃদয় ভরিয়া ধূমপান করিয়া প্রসাদী কলিকাটি সেনজীকে দিল, তখন দুইজনে পার্শ্বাপার্শ্বি বসিলেন; পুনর্ব্বার কাজের কথা চলিল।
প্রথমেই ঠাকুর মহাশয় কথা পাড়িল। সে বলিল, “সেন মহাশয়, আপনি বলছিলেন—আমার যা হয়েছে, সব বুঝতে পেরেছেন; আচ্ছা বলুন দেখি, আমার কি হয়েছে।”
রত্নাপাখী যখন এই কথা জিজ্ঞাসা করিল, তখন কজ্জলার তীব্র তিরস্কার ও কঠোর ব্যবহার তাহার স্মৃতিপথে আরূঢ় হইয়াছিল, সে ভাবিতেছিল, “কর্তা কি কলার কথা জানিতে পারিয়াছেন?”
রাঘব সেন উত্তর করিলেন, “আরে ভূত, তাই যদি না বুঝতে পারব, তবে তোদের উপরে সর্দ্দারী করছি কেমন করে?”
রত্না। আচ্ছা বলুন না কেন, কি বুঝেছেন
রাঘব। বাপু, কার্য্যে নিষ্ফল ও দর্পচূর্ণ হলে কাহার চিত্ত প্রকৃতিস্থ থাকে? তোমার যে সম্প্রতি এই দশা ঘটেছে, তা কি আমার জানতে বাকী আছে।
রতন মনে মনে শিহরিয়া উঠিল। ভাবিল, “কর্তা এ সকল কথা কেমন করে জানিতে পারিলেন? আমার যে অভীষ্টসিদ্ধ হয় নাই, কজ্জলা যে আমার দর্পচূর্ণ করিয়াছে, এ কথা কৰ্ত্তা কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন?”
কিন্তু রাঘব সেন যখন বলিলেন, “বাপু, বৃদ্ধের কথা না শুনলে, এইরূপই ঘটে থাকে, তখনই বলেছিলাম, গোবিন্দরাম সহজ লোক নয়,” তখন রতনের চৈতন্য হইল—তখন তাহার বিরহ ছুটিয়া পলাইল। গাঁজার ধূমের সহিত তাহার ক্রোধানল প্রকাশ পাইল, তাহার দুই চক্ষু করঞ্জের ন্যায় রক্তবর্ণ হইল।
রতন তখন রুক্ষভাবে বলিল, “আপনি গোবিন্দরামকে কি মনে করেন?”
রাঘব। আমি তাকে যাই কেন মনে করি না, কিন্তু তুই তার কি করতে পেরেছিস? তুই যে তার দশহাজার টাকা মেরে আনতে গেলি, সে দশহাজার টাকা কৈ? কৈ? মাধা কৈ? ঝোড়ো কোথা? রতন কোন উত্তর করিল না, কেবল কট্ট্ করিয়া একদৃষ্টে রাঘবের মুখপানে চাহিয়া রহিল। রাঘব সেন তাহাকে মৌনী দেখিয়া পুনরপি বলিলেন, “কিরে কথা কচ্ছিস না যে, চুপ করে রৈলি যে?”
রত্না। হুঁ।
রা। কিরে?
রত্না। তুমি চুপ কর।
রা। চুপ করব কি? তুই ঝোড়োর লাস্টা সেখানে কি বলে ফেলে এলি, বল দেখি। তোর যত সাহস, যত বিক্রম, তা বুঝা গেছে, তুই আর মুখ নেড়ে কথা কসনে?
রত্না। এখনও বলছি, চুপ কর।
রা। কি! তোর এত বড় স্পর্দ্ধা; আমায় তুই চোখরাঙ্গিয়ে কথা কোস্?
রত্না। কেন, তুই কি? রাঘব সেন—আমি তোকে তৃণজ্ঞান করি। কি বলব, তুই বুড়া হয়েছিস, কি বলব, তোর অনেক নিমক খেয়েছি—
রা। (বাধা দিয়া) তা না হলে তুই আমায় মারতিস্ নাকি? বামুন, কি বলব, তুই অবধ্য ব্রাক্ষ্ম, তা না হলে এই বুড়ার বিক্রম আজ একবার দেখতিস।
গৃহের প্রান্তভাগে যে বিকটাকার মূর্তি নিশ্চলভাবে বসিয়াছিল, সেই মূর্ত্তি এক্ষণে অগ্রসর হইল। সে মূৰ্ত্তি পাঠকের পরিচিত, সেই হাতকাটা কালা ডাকাইত। সে আসিয়া বামহস্তে রতনের পদদ্বয় জড়াইয়া ধরিল।
রত্না। ছেড়ে দে, ছেড়ে দে—
কালা। ঠাকুর, ঠান্ডা হও, তুমি রাগ করলে কাহারও নিস্তার নাই; কর্তা দুকথা বলেছেন বলে কি, এতই রাগ করতে হয়? দোষ-ঘাট হলে মা বাপে বকে না ত কি অপরে দুকথা বলতে আসে?
রত্না। আমার দোষ কি?
রাঘব। তোর সহস্র দোষ, তুই আমার কথা শুনলিনি কেন?
রত্না। আমি পারি কি না, তোমায় দেখাব, রতন শর্ম্মার একখানা হাড় থাকতে, গোবিন্দরামের নিস্তার নাই।
রাঘব। ঢের হয়েছে, আর কথায় কাজ নাই, তোর উপরে নির্ভর করে নিশ্চিন্ত থাকলেই প্রতুল হয়েছিল আর কি!
কালা। সে কথা যথার্থ, কর্তার বুদ্ধিবলেই আমরা এ যাত্রা বেঁচে গেছি। উনি আমাদের পিছু পিছু না গেলে নিশ্চয়ই সৰ্ব্বনাশ হ’ত। উনি সন্ন্যাসী সেজে নানা কৌশলে আমাদের বাঁচিয়েছেন। ঠাকুর খামাখা, রাগ করে কি আত্মবিচ্ছেদ করতে আছে; এখন বস।
রত্না। না, আমি আর বসব না।
রাঘব। নে বস, এখন কোথা যাবি?
রত্না। না, আমার মনটা খারাপ হয়েছে, আমি এখন যাই।
রাঘব। আরে না—না, আয় গান শুনবি আয়। দেখ কালা, ঐখানে একটা গর্ত খোঁড়া আছে, জানিস্?
কালা প্রকাশ্যে বলিল, “আজ্ঞা, আপনি যান।” পরে মনে মনে বলিল, “যেমন কৰ্ম্ম তেমনি —হিন্দু হইলেও মাধার গোর হইল। আমার অদৃষ্টেই বা কি আছে, কে বলিতে পারে?”