অষ্টম দৃশ্য – অন্ধকূপের বাসিন্দা

অষ্টম দৃশ্য – অন্ধকূপের বাসিন্দা

শীতের রাত।…

ভারি অরসিক এই শীত, বাবুদের শখের খাতির সে রাখে না। দক্ষিণ হাওয়ার গলা টিপে ইলসেগুঁড়ির বাজার মাটি করে, শনিবারের আমোদে বাজ হেনে বুড়ো শীত শহরের ভেতরে জাঁকিয়ে বসে থাকে— নেটিভদের অভিশাপের কুছ পরোয়া না রেখে। অমন যে রূপ-দীপালির পাড়া সোনাগাছি, রাত ন-টা বাজতে না বাজতেই কেমন যেন নিঝুম হয়ে পড়েছে। দুপুর রাতে সেখানে আর জনমানবেরও টিকি দেখবার জো নেই, কবেকার এক সোনা গাজীর কবরের প্রাচীন স্মৃতি নিয়ে সোনাগাছি এখন কুয়াশায় ঝাপসা নীরবতায় স্তব্ধ হয়ে ঠিক গোরস্থানের মতোই দেখাচ্ছে। শখের বাবুরা ঘরের সমস্ত ছ্যাঁদা সন্তর্পণে বন্ধ করে লেপের ভেতরে ঢুকে ঠান্ডা হাওয়াকে ‘বয়কট’ করছেন, রূপসিরাও শূন্য ঘরে একেশ্বরী হয়ে বসে বসে শীতের মুখে নুড়ো জ্বালবার ব্যবস্থা দিচ্ছে— বাবুর বাজার ভারি আক্রা। ঘরে ঘরে গলা ধাক্কা খেয়ে শীত হু হু করে কনকনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে কলকাতার পথে পথে ছুটে বেড়াচ্ছে, এবং মনের যত ঝাল গরিবদের উপরেই ঝেড়ে নিচ্ছে।

কুয়াশা আর কুয়াশা আর কুয়াশা। যেদিকে চাই খালি কুয়াশা আর ধোঁয়া! কলকাতার দীপ্ত রূপ একেবারে ময়লা হয়ে গেছে। গ্যাসের আলো পর্যন্ত কুয়াশা আর ধোঁয়া মেখে দুঃখীর ম্লান ছলছলে চোখের মতো সকাতরে চেয়ে আছে। দু-পাশের সমস্ত বাড়ির প্রত্যেক জানলা দরজা বন্ধ— জীবনের কোনো লক্ষণ বাইরে প্রকাশ পাচ্ছে না। মাঝে মাঝে দুরন্ত বাতাস জেগে উঠছে— সে আসছে কোনো তুষারের মরুভূমি থেকে এবং যে-অভাগার পথের কাজ সারা হয়নি, বায়বীয় বরফের মতো সেই ভীষণ ঝোড়ো ঝাপটায় তার দেহের প্রত্যেক ধমনীতে রক্ত যেন জমাট বেঁধে যাচ্ছে। আকাশে চাঁদের আবছায়া জেগে আছে বটে, কিন্তু তার মুখ যেন মর-মর রোগীর মতো শীর্ণ ও পাণ্ডু!

হে সুখশয্যায় শায়িত বিলাসী! তোমার তপ্ত নৈশ প্রচ্ছাদনীর অন্তরাল থেকে একবার, এক মুহূর্তের জন্য বাইরে বেরিয়ে এসো। তোমার সুখস্বপ্নের অবকাশে ক্ষণেকের জন্যে বাস্তবের কঠিন মূর্তি দেখে যাও! এতে আনন্দ নেই, কিন্তু নিয়তির নির্দয় উপহাসে সত্য যে কী ব্যথার জনক হয়, অন্তত তারও কিছু কিছু পরিচয় পাবে!…

দেখো! এক বুড়ো চলেছে বুড়ির হাত ধরে— সামনের দিকে দুমড়ে ভেঙে পড়ে। এ বুড়ো অন্ধ— বুড়ির দুটি স্তিমিত চোখের সাহায্যেই সে তার কাজ চালাচ্ছে। তার গায়ে কাপড় নেই, কোমরের সম্বল এক কপনি, তাও ছেঁড়াখোড়া। জুতো, মোজা, সোয়েটার, গলাবন্ধ, ওয়েস্টকোট, কোট, ওভারকোট, অলস্টার, শালদোশালা আর যৌবনের প্রবল উত্তাপেও তোমার শীত ভাঙছে না— কিন্তু এ বুড়ো আর বুড়ি তবু কী করে এমন কঠোর শীতেও বেঁচে আছে? ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে, দাঁতে দাঁত লাগাতে লাগাতে বুড়ো করুণ মিনতিভরা আর্ত রবে সমানে ডেকে চলেছে— ‘একটা পয়সা ভিক্ষে দাও— বাবুগো, একটা পয়সা ভিক্ষে দাও!’ —তুমি শালদোশালার পোষ্যপুত্র, পাশ দিয়ে এক ধাক্কা মেরে চলে যাচ্ছ— পকেট তোমার রুপোর টাকায় ভরতি— কিন্তু তার এক কণাও বুড়ো-বুড়ি পাবে না! কিন্তু তবু তারা সমানে কেঁদে চলেছে, সারাজীবনের হতাশার সঙ্গে যুঝে যুঝেও তবু তারা হতাশ হয়ে পড়েনি, সারাজীবন কেঁদে কেঁদেও তাদের অশ্রুর উৎস শুষ্ক হয়নি, সারাজীবন নিষ্ফল প্রার্থনা জানিয়েও তাদের প্রার্থনা নীরব হয়ে পড়েনি! ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া এদের তো ডাকে না— এরা যে সংসারের বাতিল মাল। তারা ডাকবে তাদের যৌবন যাদের সহায়, পৃথিবী যাদের উৎসব-গৃহ, দুনিয়া যাদের ভালোবাসে।

আরও দু-পা এগিয়ে এসো। পথের ধারে ধারে —অনাবৃত ফুটপাথের উপরে চেয়ে দেখো, সারি সারি নরমূর্তি পাশাপাশি শুয়ে আছে— চারিদিকে শীত আর কুয়াশা আর ঠান্ডা হাওয়া নিয়ে। এদের ঘর নেই— পথের ওপরেই এদের জন্ম ও মৃত্যু! মাঝে মাঝে শীতের বর্ষা নামে, তখন এদের উপভোগের পাত্র সত্য সত্যই কাণায় কাণায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। রাজপথে কুকুর আছে, বিড়াল আছে— কিন্তু এরা মানুষ! তোমার আমার মতোই মানুষ। তোমার আমার মতোই রাজধানীর বাসিন্দা। তোমার আমার মতোই এক রাজার প্রজা, এক ভগবানের সন্তান, এক সুখ-দুঃখের অধীন। তবু তোমার আমার সঙ্গে এদের কী প্রভেদ! মনুষ্যত্বের এই কল্পনাতীত দুর্ভাগ্য, এ হচ্ছে রাজধানী কলকাতারই নিজস্ব। এমন দৃশ্য পল্লিগ্রামে দুর্লভ।

এগিয়ে চলো— এগিয়ে চলো। চোখের সামনে দৃশ্যের পর দৃশ্য বদলে যাচ্ছে। ওই দেখো, পথের ধারের খাবারের দোকানগুলো সাজানো রয়েছে। তাদের প্রকাণ্ড উনুন, তলায় মস্ত বড়ো গর্ত— ছাইভস্ম যেখানে সঞ্চিত হয়। সেই সব গর্তের ভেতরে মাঝে মাঝে দেখবে, শীতার্ত হতভাগ্যেরা দুই পা ঢুকিয়ে দিয়ে পথের ওপরে মরণাহতের মতো ঘুমিয়ে অসাড় হয়ে আছে। সে আগুনের আঁচ তুমি আমি সইতেই পারব না— তাদের কিন্তু সে অনুভূতি নেই! হয়তো শীতে কেঁপে মরার চেয়ে চামড়া ঝলসানো তাপই তাদের কাছে বেশি কাম্য!

এক-একটা নোংরা, অন্ধকার গলির মোড়ে বা ধারে নিম্নস্তরের গণিকারা অনেক রাত পর্যন্ত পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের এই দেহের ব্যবসা যে কতটা কামগন্ধহীন, শীতের রাত্রে তার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। রাত যখন দুপুর, পথ যখন প্রায় নির্জন, শীত যখন প্রচণ্ড, হিম যখন মর্মান্তিক, নেড়ে-কুকুরগুলোও যখন অদৃশ্য, পথের ওপরে তখনও তারা সমানে দাঁড়িয়ে আছে— লোক আসবার সম্ভাবনা নেই, তবু আশার বিরুদ্ধে আশা করেও দাঁড়িয়ে আছে— ধোঁয়া কুয়াশায় দম-বন্ধ হয়ে আসছে, তবু দাঁড়িয়ে আছে— শীতে সর্বাঙ্গ কালিয়ে গেছে, দেহ আর বশ মানছে না, তবু দাঁড়িয়ে আছে। চার আনা, ছ-আনা, আট আনা পয়সা— তাও রোজ তাদের জোটে না। মাঝে মাঝে পুলিশের লোক আসছে, আর তারা প্রাণপণে ছুটে আপনাদের অন্ধকূপের মতো বাসা বা গহ্বরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ছে, যারা পালাতে পারছে না তাদের ওপরে বেত, চড়, ঘুসি বা লাথি-বৃষ্টি হচ্ছে। …খানিক পরেই আবার দেখবে, তারা স্বস্থানে এসে অবস্থান করছে। কিছুকাল আগে একদিন দেখেছিলুম, জোড়াবাগানের পুলিশের আস্তানার এক সাহেব, পথের ধারে এই শ্রেণির এক অভাগীর পেছনে তাড়া করল। খানিক দূর গিয়েই সাহেব তাঁর আঁচল চেপে ধরল— কিন্তু ভীত স্ত্রীলোকটি কিছুমাত্র ইতস্তত না করেই একটানে পরনের কাপড় ফেলে দিয়ে, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় পথ দিয়ে ছুটে পালাতে লাগল। সাহেবের চোখে সে দৃশ্য নতুন, স্তম্ভিতের মতো পথের ওপরে সে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। …অনেক স্ত্রীলোক পাহারাওয়ালা দেখেও পালায় না, পাহারাওয়ালারাই বরং তাদের সঙ্গে ভাঙা ভাঙা বাংলায় ইয়ার্কি করে। কারণ আর কিছু নয়— এ সম্পর্ক প্রেমের সম্পর্ক নয়— পাহারাওয়ালার ট্যাঁক খুঁজে দেখ, এই হতভাগিনীদের কষ্টার্জিত দু-এক খণ্ড তাম্র সেখানে সযত্নে রক্ষিত আছে। এদের দেখলে সত্যই আমার চোখ ভিজে আসে— গণিকা হলেও এরা তো প্রাণহীন নয়। শুনেছি বিদ্যাসাগর মহাশয় পথ দিয়ে যেতে যেতে এই শ্রেণির স্ত্রীলোকদের দেখলে, প্রত্যেকের হাতেই কিছু কিছু অর্থ গুঁজে দিতেন। এদের দুঃখে তাঁর দয়ার প্রাণ সাড়া না দিয়ে পারত না। উচ্চস্তরের গণিকারা বারান্দায় রূপের পসরা সাজিয়ে বসলেও পুলিশ কিছু বলে না, কিন্তু তার যত রোখ এদের ওপরেই। এটা নাকি বেআইনি। বারান্দায় গণিকা দাঁড়ানো বেআইনি নয় কেন? রাজদণ্ড কি গরিবদের জন্যেই?

মোড়ে মোড়ে পানের দোকান— সেসব দোকানে পানওয়ালির সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে উঠেছে পান বেচবার অছিলায় তাদের রূপের ব্যবসাও বেশ ভালোরকমই চলে যায়। এই সব দোকান পাহারাওয়ালাদের বিখ্যাত আড্ডা। শীত বেশি বাড়লে ও প্রাণটা বেশি ঠান্ডা হলে পাহারাওয়ালাজি গোঁফ-দাড়িতে মোচড় দিতে দিতে, ঠোঁটে রসের হাসি মাখিয়ে পায়ে পায়ে পানের দোকানের দিকে অগ্রসর হন— স্যাঁতা প্রাণকে কথঞ্চিৎ তাতিয়ে নেবার জন্য। পানওয়ালি মিষ্টি হাসি হেসে তখনই পাহারাওয়ালাজিকে ভালো করে সেজে একটি বা দুটি পানের খিলি ও গোলাপি বিড়ি উপহার দেয়। তারপর দু-জনের মধ্যে মৃদুস্বরে রসালাপ চলে। এমন রসালাপের মধ্যেও পাহারাওয়ালাজি কিন্তু আত্মহারা হয়ে পড়েন না, দৃষ্টি তার বিলক্ষণ সজাগ থাকে— চোর ধরবার জন্য নয়, অতর্কিতে পাছে কোনো উপরওয়ালা এসে পড়েন, সেই ভয়ে। মরুভূমিতে যেমন ওয়েসিস, কলকাতার রাস্তায় পাহারাওয়ালার কাছে পানওয়ালিরাও তেমনি— বড়ো দুঃখে একটুখানি সুখের ফোঁটা।

শীতের রাত্রে কোনো কোনো রাস্তার মোড়ে গরিব বেহারিরা প্রকাণ্ড আগুন জ্বেলে চারপাশে তারা গোল হয়ে বসে। সারাদিনের খাটুনির পর রাত্রে একটু বিশ্রামের অবকাশ মিলেছে, এ সময়টা তারা শীতে কেঁপে মরতে চায় না। আগুন পোহাতে পোহাতে তারা সমস্বরে গান ধরে— সেই সঙ্গে ঢোল ও করতাল চলে, গান ও বাজনা ক্রমে দুন হয়ে ওঠে— ক্রমে তা একটা দুর্বোধ্য হট্টগোলে পরিণত হয়, সে খচমচ, দুমদাম, হইচই শুনে আশেপাশের পাড়া থেকে ঘুম একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, এবং ধনীরা চটে লাল হয়ে ওঠেন। অনেক রাত পর্যন্ত— যতক্ষণ না গলা ও হাত শ্রান্ত হয়ে পড়ে— এই ব্যাপার সমানভাবে চলতে থাকে। এর মধ্যে উপভোগ্য কী আছে, আমরা তা বুঝব না। গরিবের উপভোগ গরিবেই বোঝে।…

ভিখিরিপাড়ায় কখনো গিয়েছেন? কলকাতার স্থানে স্থানে ভিখিরিপাড়া আছে, আমরা অনেকেই তার অস্তিত্বের কথা জানি না। এখানে তারাই আড্ডা বানিয়ে থাকে, পরের টাকায় যাদের দিন চলে। এইখানেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের প্রভেদ এবং এই পার্থক্যের জন্যই আর পাঁচজনের সঙ্গে তাদের চরিত্র মিশ খায় না। আমরা অনেকে সমাজের ভেতরে জেনেশুনেও চোর-জোচ্চোর বা অসাধুর সঙ্গে প্রকাশ্য সম্বন্ধ রেখে থাকি, কিন্তু ভিখিরির সঙ্গে কোনো সামাজিক সম্পর্ক রাখতে আমরা সকলেই নারাজ— যদিও অনেক ভদ্রবেশী ভিখিরি আমাদের মধ্যে সর্বদাই বিচরণ করে। প্রকাশ্যে যারা ভিক্ষাকে ব্যবসা করে, সাধারণ সমাজের মধ্যে থাকতে না পেলেও তাদের এক নিজস্ব সামাজিক জীবন আছে— সে জীবনের সঙ্গে মনুসংহিতার বিধি নিষেধ কিছুই মেলে না। এই ভিখিরিপাড়ায় আমি মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখে এসেছি। তাদের সুখ-দুঃখের ইতিহাস বাংলা সাহিত্যে এক নতুন সুর জুড়ে দিতে পারে— কিন্তু রাশিয়ার মতো এদেশেও কোনো বাঙালি ম্যাক্সিম গোর্কি জন্মাননি, তাই এই সমাজবহির্ভূত সমাজের বিচিত্র ফোটো সাহিত্যের আসরে দেখতে পাই না।

ভিখিরিপাড়ায় দিনের বেলায় বড়ো কিছু দেখবার থাকে না— কারণ বাসিন্দারা তখন কলকাতার নানা দিকে দৈনিক ব্যবসা করতে যায়। ক্রমে রাতেও অনেকে ফেরে না— জাল অন্ধ ও খোঁড়া প্রভৃতি সে দলে থাকে। চোখ থাকতে যারা কানা, দিনের বেলায় তাদের ব্যবসার সুবিধা হয় না— কারণ দাতারাও তো চোখ থাকতে কানা নয়। সন্ধ্যার মুখে ভিখিরিপাড়ার মজলিশ একটি দেখবার দৃশ্য। সাধারণ শহরের খুব ওঁচা অংশে ভিখিরিরা বাস করে। সরু গলি, ভেতরে আলো আর হাওয়ার যথেষ্ট অভাব, চারিদিকে নোংরা আবর্জনা ছড়ানো, তারই মধ্যে ছোটো ছোটো খোলার চালের মেটে-ঘরের হেলে পড়া দেয়ালের মধ্যে ভিখিরিদের বাস। তাদের অনেকেই বংশানুক্রমে ভিখিরি, চোদ্দো পুরুষেরই এক ব্যবসা। খুব গরিবের ছেলেও কালে রাজা হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয়। কিন্তু ভিক্ষাপুষ্ট রক্তে যার জন্ম, সে বোধ হয় কখনো আর কর্মী হয়ে নাম কিনতে পারে না— ভিখিরির ছেলে তাই ভিখিরিই হয়— অকর্মণ্য, পরান্নভোজী— আলস্য-ব্যাধি এমনই বংশানুক্রমিক। আর আলস্যই বা বলি কেন, ভিক্ষা সংগ্রহের জন্য তাদের অধিকাংশকেই যে কায়িক ও মানসিক পরিশ্রম করতে হয়, তার তুলনায় চাকুরির পরিশ্রম ঢের বেশি সহজ। কিন্তু তবু তারা তা করতে পারে না, কারণ ভিক্ষার মোহ তাদের মজ্জাগত। এ যেন কোকেন বা আফিমের নেশা, অভ্যস্ত হলে আর উপায় নেই।

ভিখারিরা অনেকে সপরিবারে বাস করে, তাদের মা, বোন, বউ, মেয়ে ও ছেলে— সবাই ভিখিরি। ধর্মে তারা হিন্দু হলেও তাদের মধ্যে জাতিভেদের বড়ো বেশি কড়াকড়ি নেই। আমি এমন কোনো কোনো ভিখিরিকে দেখেছি, যারা সর্বনিম্নস্তরের গণিকা বা গণিকার মেয়েকে বিবাহ করেছে। এখানে চরিত্রের দাম খুব কম বা কিছুই নেই। ভিখিরির মেয়ে বা স্ত্রী প্রায়শই প্রকাশ্যভাবে বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করলেও কেউ কিছু বলবে না। সামাজিক কোনো বন্ধনেরই এরা ধার ধারে না— যেন-তেন-প্রকরেণ দেহের সঙ্গে আত্মাকে একত্রে রাখাই এদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

গলির মধ্যে এক একটা গর্তের মতো ঘরে অল্পবয়সি ভিখিরিদের আড্ডা বেশ জমে ওঠে। আমার বাড়িতে আগে এক যুবক ভিখিরি আসত, তাকে ডাকত সবাই ‘পাগলা’ বলে। গান গেয়ে তার দৈনিক রোজগার বড়ো মন্দ হত না। এই পাগলার সঙ্গে ভাব করে বার দুই-তিন আমি ভিখিরিদের আড্ডায় গিয়ে বসেছি। আড্ডার মধ্যে প্রথম দিনে আমার আবির্ভাব সকলেরই মুখ বোবা করে দিলে। অত্যন্ত সন্দেহ ও বিস্ময়ের সঙ্গে বারবার তারা আমার মুখের পানে চেয়ে দেখতে লাগল। কেউ কেউ সে স্থান ছেড়ে পালাবার উপক্রম করলে— বোধ হয়, আমাকে পুলিশের লোক ভেবে। পুলিশকে এরা ভারি ভয় করে— কারণ ভিক্ষা করতে গিয়ে সুবিধা পেলে এরা অনেকে গৃহস্থের ঘটি-বাটি সরাতেও ইতস্তত করে না কিনা।

কিন্তু পাগলা তাদের অভয় দিয়ে বললে, ‘ভয় নেই ভাই, ভয় নেই। ইনি আমার চেনা বাবু, আমাদের আড্ডা দেখতে এসেছেন। তোমরা ফুর্তি করো, যাবার সময়ে বাবু তোমাদের খুশি করে দিয়ে যাবেন।’

আমার খেয়াল দেখে তাদের বিস্ময় কমল না বটে, তবে সকলের ভাব দেখে বোঝা গেল, তারা যেন অনেকটা আশ্বস্ত হল।

ঘরের চারদিকে মাটি ল্যাপা, এবড়ো-খেবড়ো দেয়াল— পথের দিকে দেয়ালের নীচের দিকটায় বৃষ্টির ঝাপটা লেগে, ভিতরকার কঙ্কাল— অর্থাৎ বাঁখারিগুলো বেরিয়ে পড়েছে। দেওয়ালের উপরদিক ‘আলম্যানাকে’র ও সস্তা দরের সিগারেটের অসংখ্য ছবি দিয়ে অলংকৃত। একদিকে একখানা শতছিন্ন মাদুর-বিছানো চৌকি আর গোটা দুই ওয়াড়হীন তৈল-পক্ক ময়লা বালিশ— এত কালো যে, হঠাৎ দেখলে ‘অয়েল-ক্লথে’ তৈরি বলে মনে হয়। আর একদিকে মেটে মেঝের উপরে দু-খানা দর্মা বিছানো। এককোণে একটা তোলা উনুন, ও কতগুলো হাঁড়ির ওপরে হাঁড়ি। বুঝলুম, এই একটা ঘরই সময় বিশেষে বৈঠকখানা, রান্নাঘর ও শয়নাগারে পরিণত হয়।

ঘরের লোকগুলো সব কেউ চৌকির ও কেউ মেঝের ওপরে শুয়ে বা বসে জটলা করছিল। তাদের প্রত্যেকেরই চেহারা ঝোড়ো কাকের মতো। কেউ কেউ যে কতদিন অস্নাত আছে, তার হিসেব জানেন একমাত্র ভগবান। সকলেরই পরনের কাপড় ময়লা, ছেঁড়া বা তালি-মারা। ঘরের ভিতরে এমন একটা মিশ্র দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল যে, ক্ষণকালের মধ্যেই নাসিকা অস্থির হয়ে উঠল। তার ওপরে আবার গাঁজার ধোঁয়ার গন্ধ। প্রায় সকলেরই হাতে পালাক্রমে গাঁজার কলকে ঘুরে যাচ্ছে। একটা টিকটিকির মতো রোগা লোক, এককোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে একটা লম্বা মুখনলওয়ালা ছোটো হুঁকা নিয়ে বসে আছে। খানিক পরেই দেখলুম, সে লোকটা নলে টান মারলে ও ফুড়ুক করে একটা আগুনের ছিটে তার কলকে থেকে ঠিকরে পড়ল। সে গুলিখোর আর একটা রোগা লোক ট্যাঁক থেকে একটা মোড়ক বার করে, মোড়কটা খুলে দু-হাতে মুখের সামনে ধরলে ও জিভ দিয়ে খানিকটা সাদা গুড়ো সাবধানে চেখে নিলে। সে কোকেনখোর! …একটু পরে একটা স্ত্রীলোক এসে ঘরে ঢুকল। বয়স বোধ হয় তার চব্বিশ-পঁচিশের বেশি হবে না, কিন্তু চেহারা এমনই পাকিয়ে গেছে যে, তাকে প্রৌঢ়া বললেও চলে। দেহের রং কুচকুচে কালো, পরনের কাপড়খানাও যেন দেহের রঙেই ছুপিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঘরের ভিতরে এতগুলো পুরুষ, আর সে যে স্ত্রীলোক, এজন্য তার কিছুমাত্র সংকোচ নেই— কারণ তার বুকের ওপরে স্ত্রী-চিহ্ন দুটি সম্পূর্ণ বেপরোয়ারই মতো অনাবৃত অবস্থায় আত্মপ্রকাশ করে আছে।

ঘরের ভিতরের একজন তাকে দেখে বললে, ‘কী গো পটলির মা, এখানে কী মনে করে?’

পটলির মা বললে, ‘হ্যাঁরে বিশে, তোর কাছে ভাই পুরিয়া টুরিয়া কিছু আছে?’

বিশে বললে, ‘হুঁ, গোটা দুই আছে। কী দরকার তোর?’

পটলির মা বললে, ‘দে না ভাই আমায় একটা।’

‘মাইরি! আমার রসদ কমলে আমি খাব কী?’

‘তোর পায়ে পড়ি, লক্ষ্মীটি। আমি দাম দিচ্চি। না দিলে আমি মরে যাব, তাই কি তুই চাস?’

‘কেন, পুরিয়া ফুরিয়েচে তো আলুগুর আড্ডায় যা না!’

‘তা কি আর যাইনি? কিন্তু আড্ডা বন্ধ! শুনলুম আজ পুলিশ এসেছিল!’

বিশে চোখ কপালে তুলে বললে, ‘অ্যাঁ, আড্ডা বন্ধ! তাহলে তোকে পুরিয়া দিলে আমাকে দেখবে কে?’

‘দিবি না তাহলে, কেমন?’

বিশে প্রবলভাবে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলে— না!

‘আচ্ছা রে মড়িপোড়া মিনসে, মনে রইল। এবার তোর পুরিয়া কম পড়লে যেদিন আমার পায়ে ধরতে যাবি, সেদিন খ্যাংরা মেরে বিষ ঝেড়ে দেব। পটলির মা আরও কীসব বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ পাগলা তাকে সাবধান করে দিলে— ‘চুপ কর পটলির মা! দেখচিস না, ঘরের ভেতর বাবু রয়েচে!’

এতক্ষণে পটলির মায়ের চোখ আমার উপরে পড়ল। এক মুহূর্ত হতভম্বের মতো আমার মুখের পানে চেয়ে থেকে, তাড়াতাড়ি বুকের কাপড় টেনে ঘর থেকে সে বেরিয়ে গেল। তাহলে তার লজ্জা আছে।

আমি বললুম, ‘হ্যাঁ রে পাগলা, পটলির মা কী চাইছিল?’

‘ওর কোকেন ফুরিয়ে গেছে বাবু, তাই হন্যে হয়ে এখানে ছুটে এসেচে… আর, তুইও তো আচ্ছা মানুষ, বিশে! দেখচিস পটলির মা কষ্ট পাচ্চে, ওকে একটা পুরিয়া দিলে কী হত?

‘কী কথাই বললি ইয়ার! তারপর আমি কার পায়ে মাথা খুঁড়তুম? শুনলি তো আলগুর আড্ডা বন্ধ!’

‘তবু একটা পুরিয়া দেওয়া উচিত ছিল।’

বিশে এবার রেগে গিয়ে বললে, ‘দিইনি, আমার খুশি। এই যে তোরা সেদিন একটা পাঁইট কিনলি, আমাকে একফোঁটা দিয়েছিলি কি? নিজের পানে তাকিয়ে কথা ক!’

পাগলা একবার আমার দিকে তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে অপ্রতিভের মতো বসে রইল। সে যে মদ খায়, আমি তাই জানতে পারলুম বলেই তার এই সংকোচ।

কলকাতার ভিখিরিদের আংশিক চিত্র এইরকম। এই হচ্ছে দীন ভিখিরির দল, যাদের কাতর মুখ, করুণ চাহনি আর আর্ত স্বর আমাদের প্রাণ-মন গলিয়ে দেয়। আমরা এদেরই ভিক্ষা দিই। কিন্তু সে পয়সা যায় নেশার পূজায়। খালি রাজেন মল্লিকের বাড়িতে নয়, কলকাতার আরও কোনো কোনো ধনীর বাড়িতে দৈনিক ভিখিরি খাওয়ানোর ব্যবস্থা আছে। অনেকে সেইখানেই খেয়ে নেয়, আর আমাদের দানের পয়সা মদ, গাঁজা, চরস, গুলি বা কোকেন কেনবার জন্য তুলে রাখে— অর্থাৎ আমরাই তাদের নেশার খরচ জোগাই। এইভাবে অধঃপতনের অন্ধকূপের নিম্নতম স্তরে বসে এরা পশু-জীবন দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়।

কলকাতার অন্ধকূপের আরও অনেক বৈচিত্র্য আছে। ‘অন্ধকূপ’ বলতে আমি বোঝাতে চাই সেইসব স্থান, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’। এখানকার বাসিন্দা হচ্ছে চোর, ডাকাত, খুনে ও নিম্নশ্রেণির গরিবের দল। নিম্নশ্রেণি বা ছোটোলোকদের মধ্যে দারিদ্র্য বরাবরই পাপের অগ্রদূত।

একদিন রাত তিনটের সময় আমি ঘুরতে ঘুরতে জোড়াবাগান অঞ্চল দিয়ে ফিরছি। সঙ্গে একজন বন্ধুও ছিলেন— তিনি নাম-করা সাহিত্যিক।

হঠাৎ পথের পাশে এক জায়গায় অনেক লোকের গলা ও নাচ-গান বাজনার আওয়াজ পেলুম। পাশেই একটা গলি। সেখানে একপাশে খানিকটা খোলা জমি— তার ওপরে শামিয়ানা খাটানো। একটু এগিয়ে উঁকি মেরে দেখি, চাঁদোয়ার তলায় মস্ত আসর বসেছে। বাইজি গান ধরেছে, আর প্রায় দেড়-শো লোক বসে বসে তাই শুনছে। শ্রোতারা প্রায় সকলেই পশ্চিমের লোক এবং তাদের মধ্যে অনেকেই গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান— যারা দিনের বেলায় চালায় গোরুর গাড়ি আর রাত্রিবেলায় করে গুন্ডামি। গোরুর গাড়ির গাড়োয়ানদের অনেকেই যে কী ভীষণ চরিত্রের লোক, কলকাতার অধিকাংশ বাসিন্দাই তা জানেন না। আমি চোখের ওপরে দেখেছি, এরা পথিকদের মেরে-ধরে টাকাকড়ি কেড়ে নিচ্ছে। কলকাতার অনেক বিখ্যাত গুন্ডা গোরুর গাড়ির আস্তানার মালিক বা গাড়োয়ান। এই কিছুকাল আগেই নিমতলা ঘাটের কাছে এই শ্রেণির গুন্ডারা প্রকাশ্য দিনের বেলায়, জোড়াবাগান৮.১ পুলিশ কোর্টের ঠিক পাশেই, একটি দেশি মদের দোকানের ওপরে চড়াও হয়ে বিনামূল্যে মদ খেতে চায়। দোকানের মালিকরা রাজি না হওয়াতে তারা একজনকে খুন ও দু-জনকে সাংঘাতিকরকম জখম করে যায়। কিন্তু ইংরেজ আইন এমন প্যাঁচালো যে, তারা ধরা পড়লেও শাস্তিলাভ করলে না।

এমন সব ঠ্যাঙাড়ে ও খুনেদের প্রাণেও শখ আছে। তারা আজ কেমন ভালোমানুষ সেজে বাইজির গান শুনছে। আমারও হঠাৎ সাধ হল, বিনা নিমন্ত্রণেই তাদের আসরে গিয়ে বসে খানিকক্ষণ সকলের হালচাল পর্যবেক্ষণ করতে। বন্ধুকে মনের কথা খুলে বললুম, তিনি তো ভয়ানক নারাজ। বললেন, ‘বল কী হে! যেচে হাঁড়িকাঠে মাথা গলানো! এ হতেই পারে না।’

বঙ্কিমচন্দ্রই বোধ হয় বলে গেছেন— এক-একটা ছেলেকে জুজুর ভয় দেখালে ভয় পায় না, উলটে জুজুকে দেখতে চায়। ছেলেবেলা থেকেই আমারও স্বভাব অনেকটাই এইরকম।

এইজন্য কতবার কত বিপদে পড়েছি বটে, কিন্তু সেসব বিপদ থেকে আমি এমন সব নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি ও নর-চরিত্রের এতরকম অপূর্ব বৈচিত্র্য দেখবার সুযোগ পেয়েছি, সাধারণ বাঙালি জীবনে যা দুর্লভ। আমি জীবন দেখতে চাই, জীবন। বিছানায় শুয়ে বা কেতাব পড়ে তা দেখা যায় না।

বন্ধুকে প্রবোধ দিয়ে বললুম, ‘মাভৈ! দুর্গা বলে ঢুকে তো পড়ি, দেখবে কোনো বিপদই হবে না।’

আমি গুন্ডাদের জানি। বাইরে থেকে দেখতে যতটা ভয়ানক, আসলে তাদের ভেতরকার চেহারা ঠিক ততটা নয়। দরকার হলে তারা খুব সহজেই এক ফুঁয়ে মানুষের জীবন-দীপ নিভিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সে হচ্ছে তাদের ব্যবসা এবং সে নির্মমতা সাময়িক। সাধারণ জীবনে তারা তোমার আমার মতোই মানুষ। তখন তোমার আমার মতোই তারা ভালোবাসে, স্নেহ করে, আমোদ-আহ্লাদ নিয়ে মেতে থাকে। দয়া ধর্মেও তারা বঞ্চিত নয়। মহাদেও বলে এক প্রচণ্ড গুন্ডাকে জানি, তাকে আমি প্রায়ই দেখেছি কানা-খোঁড়াকে পয়সা দিতে। বন্ধুত্বে তারা ঢের ভদ্রলোকের চেয়েও বড়ো। যাকে বন্ধু বলে জানে, তার জন্য হাসতে হাসতে প্রাণ দিতে পারে। আবার যারা বিশ্বাস করে তাদের আশ্রয় নেয়, তাদের পায়ে তারা কুশাঙ্কুর বিঁধতে দেয় না। আমি কলকাতার যেখানে থাকি, সেখানে গুন্ডার সংখ্যা অগুনতি। তাই আমি গুন্ডাদের চরিত্র উলটে-পালটে অধ্যয়ন করবার সুবিধা পেয়েছি। কোনো মানুষেরই সবটা খারাপ নয়।

আমি বিলক্ষণই জানতুম, গুন্ডারা যখন আনন্দে মেতে আছে, তখন তারা অশান্তির কথা মনেও আনবে না। বিশেষ, আমরা যেচে তাদেরই আশ্রয়ে গিয়ে আত্মসমর্পণ করছি— তাদের বিশ্বাস করছি। আমাদের এ নির্ভরতার মর্যাদা তারা রাখবেই রাখবে। অতএব বন্ধুকে টেনে নিয়ে, একটা বাঁশের বেড়া টপকে, আমি হাসতে হাসতে একেবারে আসরের মধ্যে গিয়ে বসলুম।

ভারি অবাক হয়ে তারা আমাদের মুখের পানে তাকিয়ে রইল। এত রাত্রে, আমাদের মতো দুটি নিরীহ ভদ্র চেহারা যে অনাহূত হয়ে তাদেরই আসরে গিয়ে বসতে পারে, এটা বোধ হয় তাদের কাছে অসম্ভব বোধ হচ্ছিল। কিন্তু তার পরেই আমাদের আবির্ভাবকে তারা খুব সহজভাবেই নিলে। যাতে ঘেঁষাঘেঁষি না হয়, সেজন্য জন কয়েক লোক সসম্ভ্রমে সরে গিয়ে আমাদের চারপাশে যথেষ্ট জায়গা করে দিলে। তারপর নাচ-গান-বাজনা আবার অবাধে চলল— কেউ প্রশ্নও করলে না, আমরা কে, এত রাত্রে কেন এখানে এসেছি? যা ভেবেছিলুম তাই— তাদের চরিত্র আমি ভুল বুঝিনি।

বাইজি দুটি বাঙালি এবং একটিকে দেখতে শুনতেও বেশ। গানও গাইছিল ভালো। এদের পছন্দ আছে। নতুন নতুন গানের সঙ্গে তবলা-বাঁয়া দুটো বার বার হাত বদলে যাচ্ছিল— এখানে বাজিয়ের সংখ্যা তো কম নয়। এরা খালি ছোরা ধরতেই শেখেনি, আর্টেরও চর্চা করে দেখছি। বাস্তবিক, তারা সকলেই খুব ভালো বাজাচ্ছিল। এতগুলো তৈরি হাত ভদ্রলোকের আসরেও বড়ো একটা দেখা যায় না।

বাইজিদের হাবভাব দেখে বুঝলুম, এই দলে দলে অপ্রিয়দর্শন বিদেশি লোকগুলির মধ্যে আমাদের পেয়ে তারাও যেন বেশ খুশি হয়েছে। আমাদের দেখবার আগে তারা এদিকে পেছন ফিরেছিল, কিন্তু তারপর আমাদের দিকেই মুখোমুখি বসে গান ধরলে। তারা দু-জনেই এক গা গয়না পরে এসেছে— বায়নার সময়ে নিশ্চয়ই টের পায়নি, আজ তাদের বাঘের গর্তে ঢুকতে হবে। মনে মনে অবশ্যই তারা ভয় পেয়েছে— যদিও অকারণে। বাঘরা আজ শুধু খেলতে চায়, গয়নার দিকে তাদের চোখ নেই।

সত্য, এখানকার শ্রোতারা অত্যন্ত সমঝদার। একেবারে শান্তশিষ্টের মতো বসে তারা একাগ্রমনে গীতসুধা পান করছে এবং মাঝে মাঝে যথাস্থানে বাহবা দিচ্ছে। ভদ্রের আসরেও আমি এত সমঝদার শ্রোতা দেখিনি। বাগানবাড়ির গানের আসরে দেখেছি, সে কী হুল্লোড়, কী দাপাদাপি— কার সাধ্য সেখানে গান জমায়। সে মাতামাতির আসল কারণ, মদ। কিন্তু এখানে সুরাদেবীর মহিমা না থাকলেও, প্রায় সকলেই যে ভাঙের নেশায় মশগুল হয়ে আছে, শ্রোতাদের মুখ দেখলেই তা বুঝতে আর দেরি লাগে না।

খানিকক্ষণ পরেই জন কয়েক লোক এসে ধরে বসল, আজ আমাদের এখানে খেয়ে যেতে হবে— এ যে দেখছি জামাইআদর। অনেক করে তবে তাদের বুঝিয়ে দিলুম, রাত চারটের সময় আমাদের খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস নেই, আমরা বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি— ইত্যাদি। তারপর আমরা বিদায় নিলুম— কারণ বন্ধুবরের মুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল, এত আদরযত্নেও তাঁর মন মোটেই প্রবোধ মানছে না— তিনি জলের মাঝ ডাঙায় এসে পড়েছেন। …এই হল গিয়ে আমাদের গুন্ডার আড্ডায় বাইজির গান শোনা। শয়তানের রং যে ছবিতে আঁকার মতো অতটা কালো নয়, আশা করি আপনারা এতক্ষণে তা বুঝতে পেরেছেন।

***

টীকা

৮.১ জোড়াবাগান— জোড়াবাগান পুরোনো সুতানুটি জনপদের অংশ ছিল। ১৬৯০ সালে এখানকার সুতানুটির ঘাটে জোব চার্নক পদার্পণ করেছিলেন। বেনিয়াটোলা ও শোভাবাজার ঘাটের মাঝে মোহনটনের সেই ঘাটটি এখন আর নেই। এখানে একটি বিরাট গাছের তলায় জোব চার্নক বিশ্রাম করেছিলেন বলে মনে করা হয়। জোড়াবাগান অঞ্চলের নিমতলা মহাশ্মশান কলকাতার অন্যতম প্রধান শ্মশানঘাট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *