অষ্টম গর্ভ ৩ – তৃতীয় স্কন্ধ

তৃতীয় স্কন্ধ

প্রারম্ভিক

দুর্গাপ্রসাদ আজিকালি সকালের দিকে চেম্বারে বসেন না। কী এক প্রয়োজনে বাহির হইয়া যান। দুপুর গড়াইয়া যায় ফিরিতে। খাইয়া সামান্য একটু বিশ্রাম করিয়াই রোগী দেখিতে শুরু করেন। ইহাতে বেশ কিছুটা আর্থিক ক্ষতি হয়; কিন্তু দুর্গাপ্রসাদ গ্রাহ্য করেন বলিয়া মনে হয় না। সকালে কোথায় যান কাহাকেও বলিয়া যান না। পত্নী জানেন কি না বলিতে পারি না।

বর্মার দাদার উপস্থিতি কি তাঁহাকে কিছুটা নিশ্চিন্ত করিয়াছে? হইতে পারে। মণিমোহন বর্মায় স্ত্রী হারাইয়া আসিয়াছেন, এই গৃহে কাকিমা, দিদি, ভ্রাতা, ভ্রাতৃবধূ ও ইহাদের সন্তানগুলির সান্নিধ্যে, আদরে, যত্নে তিনি যেন নূতন জীবন ফিরিয়া পাইয়াছেন। কর্তার মৃত্যুর পর হইতেই তিনি সমানে ভ্রাতাকে আশ্বস্ত করিতেছেন। ইঁহারা ব্যতীত তাঁহার আর আছেটা কে? দুর্গাপ্রসাদ তাঁহার উপর নির্ভর করিতে পারেন। সাংসারিক যে-সকল বিষয়ে দুর্গাপ্রসাদ পূর্বে পিতার সহিত পরামর্শ করিতেন, এখন সে স্থলে তিনি দাদার পরামর্শ লইতেছেন। নিজ সন্তানগুলির উপর দুর্গাপ্রসাদের অগাধ আস্থা। উহারা ঠিকই নিজ নিজ পথ খুঁজিয়া বাহির করিবে। দাদা বলিতেছেন ইন্দ্র ব্যারিস্টারি পড়িতে বিলেত যাক। তিনি ব্যয়ভার বহন করিবেন। একটি ছেলে অন্তত ডাক্তারি পড়ুক। ঋদ্ধি-ভক্তির বিবাহের ব্যাপারে তিনি উদ্যোগী। মেয়েদের এখনই বিবাহ করিবার ইচ্ছা নাই, দুর্গাপ্রসাদও ইহাদের বিবাহের কথা ভাবেন নাই। ছেলেমেয়েগুলি কেহ পড়িতেছে, কেহ রিসার্চ করিতেছে, সন্ধ্যা হইলেই ঘর ভরিয়া উঠে তাহাদের কলরবে, এইরূই যেন অনন্তকাল চলিবে। কিন্তু মণিমোহন তাঁহার মাথায় ঢুকাইয়াছেন এই রূপ চলে না, ছেলেমেয়েদের বিবাহের কথা ভাবিতে হয়। তিনি থাকিয়া থাকিয়াই সম্বন্ধ আনিতেছেন।

দুর্গাপ্রসাদের বয়সে পিতৃশোকে মুহ্যমান হওয়া মানায় না। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর দুর্গাপ্রসাদের সকল লম্ফঝম্প বন্ধ হইয়া গিয়াছে। জোরে কথা বলিতে শুনা যায় না তাঁহাকে। মুখের চেহারায় যেন বাজে-পোড়া ভাব।

কালো চামড়ার ডাক্তারি ব্যাগটি লইয়া দুর্গাপ্রসাদ সকাল নয়টা নাগাদ রওনা হইলেন। তাঁহাদের রাস্তা যেখানে শ্যামপুকুর স্ট্রিটে মিশিয়াছে, সামনে একটি শিবমন্দির, এবং তাহার পরেই শ্রীরামকৃষ্ণের অবস্থানপূত সেই বিখ্যাত বাড়িটি, সেইস্থলে পাঁচ-ছয়জনের একটি দলের সঙ্গে তাঁহার দেখা হইল। দুইটি শিশু, একটি বালক, দুইটি মহিলা ও একটি বয়স্ক পুরুষ। ইঁহাদের রুক্ষ চুল, বসন মলিন, হাতে বড় বড় জুটের ব্যাগ। পুরুষটি একটি টিনের তোরঙ্গ বহিতেছেন। ইহারা চিরকুটে লেখা একটি ঠিকানা দেখাইয়া ঠিকানাটির হদিশ চাহিলেন। সামান্য ভুল থাকিলেও ঠিকানাটি রায়চৌধুরী বাড়ির মনে হইল। দুর্গাপ্রসাদের আজ সামান্য দেরি হইয়া গেল। তিনি ইঁহাদের রায়চৌধুরী বাড়ির দেউড়ি অবধি পৌঁছাইয়া দিলেন। কথায় কথায় প্রকাশ পাইল ইঁহারা কয়েকমাস পূর্বে বরিশাল ছাড়িয়া আসিয়াছেন, বনগাঁয় রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় পাইয়াছিলেন, এক্ষণে কুটুম্বদের সন্ধান মিলিয়াছে।

এইরূপে দুর্গাপ্রসাদের হাত ধরিয়া দাঙ্গাবিধ্বস্ত বরিশাল ক্ষয়িষ্ণু কলিকাতার অন্দরমহলে, উত্তরমহলে ঢুকিয়া পড়িল।

খ্রিস্টীয় পঞ্চাশ সনের ফেব্রুয়ারি হইতে পুর্ববঙ্গের বাগের হাট, খুলনা, বরিশাল পাবনা রাজসাহী ইত্যাদি অঞ্চলে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে তাহার ফলে অবশিষ্ট হিন্দু জনতা, যাঁহাদের অধিকাংশই ছিলেন কৃষিনির্ভর, যাঁহারা এতকাল পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরী, কীর্তনখোলা- মধুমতী বিধৌত এই বিশাল উর্বর-ভূমির বৃক্ষলতা পুষ্পশোভিত জনয়িত্রী প্রকৃতির মায়া কাটাইতে পারেন নাই, মাটি কামড়াইয়া পড়িয়াছিলেন, সেই তাঁহারাও দলে দলে দেশ ছাড়িলেন। ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় ফরিদপুর ও বরিশালে যে-পনেরটি যাত্রী স্টিমার পাঠাইয়াছিলেন, ঢাকায় যে-ষোলোটি যাত্রী বিমান পাঠাইয়াছিলেন, সেগুলিতে তিলধারণের স্থান ছিল না। একান্ন সনের মধ্যে এই উৎখাত উদভ্রান্ত জনগণের সংখ্যা দাঁড়াইল সাড়ে তিন লক্ষ। বনগাঁ, দর্শনা, ধুবুলিয়া, ফুলিয়া, রানাঘাট হাবড়া ইত্যাদি স্থলে সরকারি রিফিউজি ক্যাম্পে ইঁহাদের মধ্যে বহুজনের আশ্রয় মিলিল। অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবানরা আত্মীয়-কুটুম্বের সাহায্যে কোনও না কোনও স্থান খুঁজিয়া লইলেন, অপেক্ষাকৃত জেদী যাঁহারা, তাঁহারা পশ্চিমবাংলার, বিশেষ কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের যেখানে এতটুকু ফাঁকা জমি অথবা বাসগৃহ পাইলেন, দখল করিয়া লইলেন। পশ্চিমবঙ্গে ধূলিমলিন, দুঃস্থ, ক্ষুধার্ত জনতার এক স্রোত বহিতে লাগিল।

আসল কথা, দুর্গাপ্রসাদ প্রতিদিন শিয়ালদহ স্টেশনে যাইতেন। সেখানে প্ল্যাটফর্মে প্ল্যাটফর্মে অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়িয়া আছে একটি মানবগোষ্ঠী, এই সেদিনও যাঁহাদের ঘর ছিল, ভূমি ছিল, দেশ ছিল, প্রতিবেশী ছিল। এখন কিছু নাই। পাশ দিয়া নির্বিকার মানবস্রোত বহিয়া চলিয়াছে, নাকে কাপড় দিয়া স্থানত্যাগ করিতেছে কলিকাতার মানুষ। কিছু সেবাপ্রতিষ্ঠান, কিছু সরকারি লোক এবং অসংখ্য সুযোগলিপ্সু জুয়াচোর এই শ্মশানভূমিতে নামিয়াছে। কেহ চাহিতেছে বর্ডার স্লিপ নামে সরকার প্রদত্ত পরিচয়পত্রটি, কেহ চাহিতেছে লুকানো স্বর্ণালঙ্কার, কেহ শিশুর খোঁজে আসিয়াছে নানাপ্রকার ব্যবসায়ের কাজে লাগিবে, কেহ আসিয়াছে নারীমাংসের সন্ধানে।

দুর্গাপ্রসাদ দেশের জন্য কিছু করিতে পারেন নাই। তাঁহার নেতা নিরুদ্দিষ্ট। দল নাই। সামর্থ্য নাই। কিন্তু এখনও সংকল্প আছে। বিবেক আছে। নিজ সংসারের গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকিবার মানুষই তিনি নহেন। পিতার বিষয়বুদ্ধি এবং সাংসারিক কর্তব্যবোধের পরিমণ্ডলে থাকিয়া কিছুকাল তিনি যেন আত্মবিস্মৃত ছিলেন। প্রত্যহ বাজার করিয়াছেন, বাড়ির রোয়াক ও নর্দমা নিজ হাতে পরিষ্কার করা তাঁহার একটি বাতিক। তাহাও তিনি নিয়মমাফিক করিয়া গিয়াছেন। স্বহস্তে কাচা নীলাভ হাফ পাঞ্জাবি পরিয়া নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়াছেন। অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা করিয়াছেন। পিতা তাঁহাকে পাকে প্রকারে বুঝাইয়া ছিলেন চিকিৎসাকর্ম একটি মানবসেবা বিশেষ। পিতার প্রয়াণের পর দুর্গাপ্রসাদ একদা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে সার যদুনাথের বক্তৃতা শুনিতে গিয়াছিলেন। ইহার পরই দেশ আবার তাহার মধ্যে চাগাড় দিল। সার যদুনাথ বলিলেন:

“পূর্ব বাংলা হইতে উৎখাত হইয়া যাঁহারা আসিতেছেন, তৃতীয় শ্রেণীর কামরা হইতে ওয়াগান হইতে তাঁহারা যখন শিয়ালদহ স্টেশন ইয়ার্ডে খালাস হইতেছেন তখন তাঁহাদের যতই বিধ্বস্ত বিভ্রান্ত দেখাক, হে পশ্চিমবঙ্গবাসী জানিবেন তাঁহারা পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কী বুদ্ধিতে কী বিত্তে, কী সংগঠন শক্তিতে, কী দুর্দমনীয় সাহসে। ঢাকা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ইঁহাদের আজ হারাইতেছে, পরবর্তী প্রজন্মে ঈশ্বর ইহার বিচার করিবেন। কিন্তু আপনারা ইহাদের প্রত্যাখ্যান করিবেন না।

“আমি আপনাদের সতর্ক করিতেছি আপনাদের দুয়ারে আশ্রয়প্রার্থী এই গুণীজাতিকে ফিরাইবেন না। এই মানবসম্পদ একদিন আপনাদের প্রকৃত মহৎ করিবে।”

মহামান্য পণ্ডিতজন এ বিষয়ে কী বলেন তাহাই শুনিতে দুর্গা গিয়াছিলেন। দেশভাগের জ্বালায় ও পূর্ববঙ্গবাসীদের সহিত কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্ব্যবহারের দরুন ক্রোধে তিনি জ্বলিতেছিলেন। সার যদুনাথ ও রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁহার মত তো সমর্থন করিলেন-ই অদূর ভবিষ্যৎ এই জনগোষ্ঠীর মূল্য সর্ম্পকেও নতুন কথা যোগ করিলেন। প্রথম হইতেই তিনি শিয়ালদহে যাইতেছিলেন। এখন নিয়মিত, তাঁহার ডাক্তারি ব্যাগটি লইয়া যাইতে লাগিলেন। তাঁহার হৃদয়ের মধ্যে আবাল্য যে-বৃহৎ আমি ক্ষুধিত হইয়াছিল, এক্ষণে এইভাবে তাহা সামান্য হইলেও তৃপ্তি পাইল। হৃদয় জুড়িয়া সত্তা ভরিয়া এক হাহাকারবোধ সর্বদা মাথা কুটিতেছে। সরল, সাহসী, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অবিরত তাহার স্বপ্নের রূপরেখা আঁকিয়া যাইতেছে। ভাবিতেছে বিদেশি শক্তি উত্ত্যক্ত হইয়া নিঃশর্ত স্বরাজ দিতে বাধ্য হইবে। ভাবিতেছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকার গঠিত হইবে, তাহার মূল লক্ষ হইবে ক্ষুধার অন্ন, শুভবুদ্ধির জন্য শিক্ষা, সামগ্রিক উৎকর্ষের জন্য স্বাস্থ্য। ভাবিতেছে কঠোর উদাহরণমূলক শাস্তি দিয়া যাবতীয় সুযোগসন্ধানী, জুয়াচোর, সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন বিপথগামীগুলিকে বুঝাইতে হইবে এরূপে চলিবে না, চলিবে না। কিন্তু রাজনীতির কুটিল হাত, স্বার্থান্বেষীর ক্লিন্ন অঙ্গুলি সকল ব্লু-প্রিন্টই মুছিয়া দেয়। এই বাস্তবকে চোখের সম্মুখে দেখিয়াও বিশ্বাস করিতে পারেন না দুর্গাপ্রসাদ। মানিয়া লইতে পারেন না। মনে হয় এ বুঝি এক কালস্বপ্ন। সহসা জাগিয়া দেখিবেন দেশময় শঙ্খ বাজিতেছে। সুভাষ আসিয়া গিয়াছেন। তাঁহার হস্তে বরাভয়, চক্ষে স্নেহ, ওষ্ঠে সংকল্প, সর্বাঙ্গ দিয়া শক্তি তেজ সাহস বিচ্ছুরিত হইতেছে। সমগ্র দেশ মাথা পাতিয়া তাঁহার নেতৃত্ব মানিয়া লইয়াছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী। নেহরু, প্যাটেল, জিন্নাহ্‌ আবুল কালাম, শ্যামাপ্রসাদ প্রমুখ ক্যাবিনেট গড়িয়াছেন। শহীদ সোরাবর্দি প্রমুখের ফাঁসি হইয়াছে। এবং পন্ডিচেরি হইতে বার্তা আসিয়াছে অরবিন্দ ঘোষ ভারতের রাষ্ট্রপতি হইতে শেষ পর্যন্ত সম্মত হইয়াছেন।

বাস্তববোধ নাই? হইবে হয়তো। কিন্তু আপামর সাধারণ পাঠক বুকে হাত দিয়া বলুন তো মন বলিতেছে কিনা, ‘এমন কেন সত্য হয়না আহা!’ বলুন তো সাধারণ নির্দোষ নাগরিকদের শোচনীয় মৃত্যুর পরিবর্তে যদি ল্যাম্পপোস্ট হইতে কালোবাজারিদের, ঔষধ ও খাদ্যে ভেজাল প্রদানকারীদের মৃতদেহ ঝুলিতে দেখিতে পাইতেন তৃপ্ত হইতেন কি না! যদি স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই শহর হইতে গ্রামে, গ্রাম হইতে গ্রামে, রাজ্য হইতে রাজ্যান্তরের পথগুলি প্রস্তুত হইত, যদি নির্ভেজাল দুগ্ধ ও অন্ন পরিমিত হইলেও সুলভে পাইতেন, যদি বৈদ্যুতীকরণের কাজগুলি হইতে শুরু করিত, শিশুগুলিকে বিদ্যালয়ে পাঠাইতে পারিতেন, তাহারা প্রথম হইতেই মাতৃভাষা ইংরাজি ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা শিখিত, আপন দেশের ইতিহাস ভূগোল ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করিত, ইংরাজি পড়াইবার জন্য সাধারণ ভদ্রতা ও শৃঙ্খলা শিখাইবার জন্য যদি তাহাদের আকাশচুম্বী বেতনের বিদ্যালয়ে পাঠাইতে না হইত, খ্রিস্টান মুসলমান হিন্দু শিখ নির্বিশেষে যদি সকলেই একই আইনের অনুবর্তী হইত, রাজনৈতিক দলে ও ব্যবসায়ীতে যদি গোপন কোলাকুলি না থাকিত, যদি ছেলেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি আর রাজনীতিতে জুয়াচুরি না শিখিত, কর্মস্থলে আড্ডার ও গৃহ হইতে কাজের নাম করিয়া পলাতক না হইত, তাহা হইলে আপনি পাঠক সুখী হইতেন না? তখনও কি আপনারা দলে দলে দেশ ছাড়িয়া পলাইতেন? কথায় কথায় উৎকোচ লইতেন? ট্রাম বাস পোড়াইতেন? স্বাধীনতার নামে যথেচ্ছ তাণ্ডব করিতেন? করিতে পারিতেন? না। আমি বলিতেছি আপনারা তখন সামান্য কৃচ্ছ্রসাধন মাইন্ড করিতেন না। জন্মনিয়ন্ত্রণের তত্ত্বটি স্থিরমস্তিষ্ক হইয়া বুঝিতেন, আপনার অতিরিক্ত কপর্দকটি সাধারণের কল্যাণে ব্যয় করিতেও কুণ্ঠিত হইতেন না।

জনসাধারণ কৃচ্ছ্র করিবে আর নেতৃগণ পুষ্পকে চড়িয়া স্বর্ণলংকায় বিহার করিতে যাইবেন, গণতন্ত্রে এরূপ হয় না। নিঃস্ব ভূমিশ্রমিকদের যে কোনও সময়ে হত্যা করিয়া ছারখার করিয়া দিবে আর নেতৃগণ কমান্ডো লইয়া টয়লেট যাইবেন ইহাও গণতন্ত্রে হয় না। রাজতন্ত্র চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু অভ্যাসটি মজ্জাগত হইয়া রহিয়াছে। গদিতে বসিবার আগে পর্যন্ত আমি তোমাদের আজ্ঞাবহ, দাসানুদাস। বসিবার যা অপেক্ষা। বসিলেই আর মনে থাকে না আমাকে তুমিই তোমার কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়া পুষিয়াছ। বেতন দিয়াছ, পার্কস দিয়াছ। তখন আমিই বা কে আর রাজাধিরাজই বা কে? তখন আস্ফালন করিব, বাহ্বাস্ফোট করিব, তলে তলে লুটিয়া পুটিয়া খাইব। আর বেগতিক দেখিলেই কুঁইকুঁই করিব।

কে আপনি ফ্যাকফ্যাক করিয়া হাসিতেছেন? সিনিক, নয়? সিনিক মহোদয়ের কোনও শুভতেই বিশ্বাস নাই। উনি অশুভ অমঙ্গল কুশ্রীতা, কদর্যতা কৃতঘ্নতা, হিংসা লোভ এইগুলিকেই জীবনের বেসিক প্রিন্সিপ্‌ল্‌ বলিয়া মানিয়া লইয়াছেন। এইগুলিই না কি বাস্তব। এই বাস্তবে তিনি কোনও সক্রিয় ভূমিকা লয়েন না। তফাৎ হইয়া থাকেন এবং বক্র হাসি হাসেন। ভাবখানা—হে শিশুগণ, অপরিণত বুদ্ধি বাল্যখিল্যগণ কর কী করিবে, কিছুই হইবে না। কিস্যুই করিতে পারিবে না।

বলি সিনিক মহোদয়—কিস্যুই না হইলেই কি আপনি সুখী? মন্দকে মন্দ বলিয়া চিনিতে তো পারেন! তাহা হইলে আঁতেলগিরিকে দুদণ্ডের ছুটি দিয়া অন্তপক্ষে ‘ইহা মন্দ, ইহা মন্দ’ বলিয়া দুইটা গাল পাড়িয়াও আমাদের সুসার করুন না।

মনুষ্যজাতিকে চারিটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। নিখাদ ভাল, নিখাদ মন্দ, ভাল মন্দে মিশ্রিত আর সিনিক। নিখাদ ভাল। নিখাদ মন্দ লইয়া কোনও গোল নাই। বাকি দুইটি শ্রেণীতেই যত গন্ডগোল। মিশ্রিত গুলিকে ভালো পথেই চালাইতে পার, মন্দ পথেও চালাইতে পার। আর সিনিক? উচ্চাঙ্গের তিক্ত হাসি লইয়া সিনিক ওই যাইতেছে, সহজ মনুষ্য উহার ছায়া মাড়াইও না। মন্দকে মন্দ জানিয়াও সে মানিয়া লয়। অপরিবর্তনীয় বলিয়া মনে করে, এবং এই জ্ঞানের বলে আপনাকে অপরসাধারণ হইতে শ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে করে, তাহাকে দূর হইতে সেলাম বাজাইতে হয় বাজাও, কিন্তু সান্নিধ্যের ঝুঁকি লইও না।

আমাদের দুর্গা ডাক্তারটি মন্দ শ্রেণীতে পড়েন না। মিশ্র শ্রেণীতে পড়েন না, সিনিক তো নহেনই। কিন্তু তাঁহাকে কি নিখাদ ভালর দলেই ফেলা যায়? সংস্থান করিতে পারেন না। অথচ একটি বৃহৎ পরিবারের সৃষ্টি করিয়াছেন, আচরণে সমতা নাই, পিতা না থাকায় বৃহৎ সংসারটির দায় তাঁহারই স্কন্ধে অথচ সকালের প্র্যাকটিস ত্যাগ করিয়া আর্থিক ক্ষতিসাধন করিতে পরাঙ্মুখ হইতেছেন না। সংসারের প্রতি কর্তব্যের অবহেলা হইল না? পিতা জীবিত থাকিতে তাঁহার সহিত প্রতিনিয়ত খটামটি লাগিত। ব্রজেশ্বরের ন্যায় আনুগত্য তো তিনি পিতাকে কখনই দেখাইতে পারেন নাই। এখন আবার পিতার মৃত্যুতে মলিন, গম্ভীর হইয়াছেন। মানুষটিকে কি ভাল বলা যায়?

পাঠক, নৈতিক ভালোমন্দের প্রশ্নের বাহিরেও মনুষ্যচরিত্রে বহু জটিল গোলকধাঁধা, বহু ছায়াময় অববাহিকালোক থাকিয়া যায়, সেখানে রিপু বা প্রবৃত্তিরা লীলা করে, প্রশিক্ষণ ও সংস্কার কাজ করে, সঙ্গ ও পরিবেশের প্রভাব কাজ করে। ভাল তাহাকেই বলি যাহাকে নষ্ট করা যায় না। দুর্গা ডাক্তার ইনকরাপ্টিবল। কিন্তু তাই বলিয়া কি তাঁহার স্বভাবে জটিলতা নাই? দ্বন্দ্ব নাই! কখনও দেশ কখনও পরিবারের প্রতি কর্তব্যবোধ উথলাইয়া উঠিবার প্রবণতা নাই? কাম এবং ক্রোধ তিনি সর্বসময়ে সংযত করিতে পারেন নাই। কিন্তু লক্ষ টাকা দিলেও তিনি হাতে রাখিয়া কাহারও চিকিৎসা করিতে পারিবেন না। মারিয়া ফেলিলেও কাহারও সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিবেন না। প্রাণ থাকিতে কাহারও ক্ষতি হইতে দিবেন না।

এইগুলি ভালত্বের মৌলিক লক্ষণ। ইহার উপর শিক্ষা, সুযোগ, সঙ্গ পরিবেশ দিয়া ভালত্বের সৌধ গড় না কেন! ভাল যখন সুসমঞ্জস, উপায় কুশল, কর্মপটু, প্রাজ্ঞ হইয়া উঠিবে তখন তাহা হইবে ইহলোকে মনুষ্যত্বের পরোৎকর্ষ।

প্রথম অধ্যায় : বাসুদেব

দাদাভাই বলেন—আমাদের কানুবাবু হল গজ, সোজা যাবে না, কোনাকুনি যাবে, আর বুনটু হল গিয়ে ঘোড়া, আড়াই লাফে চলে।

চার নম্বরে ট্র্যাফিক জ্যাম। সিঁড়ির মাথা থেকে মাঝ সিঁড়ির চাতালে হবে তোমার প্রথম লাফ। তা এইটুকু পথের মধ্যে যদি—‘দূর নংকাপোড়া ফেলে দিবি নাকি’ বলতে বলতে পিসিমা, ‘বীর হনুমানের ন্যাজ কই’ বলতে বলতে বর্মার জ্যাঠাবাবু, ‘বুনবুন, সক্কাল সক্কাল উঠে পড়তে বসতে হয়’ বলতে বলতে পমপম দিদি ঢুকে পড়ে তা হলে টগবগ টগবগ করে আর তোমার লাভ কী? বারো নম্বরে সে যশোদার ননীচোরা গোপাল। তাকে কেউ বকুক তো? আর পড়তে বসা? দাদাভাই বলবেন, বুনবুন শুনবে না। কারণ দাদাভাই তারপর নিজেরই পড়াশোনার মধ্যে ডুবে গেছেন। দিদিভাইও বলবেন, বুনবুন শুনবে না, কেননা ততক্ষণে দিদিভাই নিজের কাজে গেছেন। বুনবুন তো বই খাতা খুলে বসেছে! তারপর সে কী বলছে আর কী করছে কে দেখতে যাচ্ছে? তার আর কানুমামুর সব রকমের প্রতিযোগিতাই সিঁড়ির ওপর হয়। কানুমামু অবশ্য বড় হয়ে গেছে। মাস্টামশাইয়ের কাছে পড়ে। প্রতিযোগিতায় সে আজকাল সব সময়ে অংশগ্রহণও করে না। কিন্তু জাজ তো হয়। বুনবুন তোমার প্রতিযোগিতা তা হলে কার সঙ্গে?—নিজেরই সঙ্গে। আজকে বুনবুনকে চার সিঁড়ি টপকাতে হবে, দালানের বড় ঘড়িতে আবার সময় দেখবে কানুমামু।

চাতাল অবধি এক লাফে পৌঁছে বুনবুন সিঁড়ির জানলা দিয়ে সিধে বাবার মাথাটা দেখতে পেল। বাবা নীচে এসেছিলেন? এখন বেরিয়ে যাচ্ছেন? কোথায় যাচ্ছেন বাবা? বাকি দেড় লাফে সে সদরে পৌঁছে যায়।

—বাবা আমায় নিয়ে চলো।

—কোথায় যাবে?

—চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম। ট্রামে চড়ব, বাবা। যাব।

—স্কুল নেই!

—পরীক্ষা হয়ে গেছে তো!

—আমি চিড়িয়াখানা যাচ্ছি না বরুণ। যেতে পারব না।

—যেখানে যাচ্ছ, সেখানেই যাব—

বুনবুন বাবার পকেট ধরে ঝুলতে থাকে।

সে তো ইদানীং আর বাবাকে ভয় পাচ্ছে না কিনা। ঠাকুর্দাদার মৃত্যুতে সে বুঝতে পেরেছে, বাবাও শুধু বাবা নয়, তারই মতো একটা ছেলে।

সেই যে বাবার মুখচোখ কেমন হয়ে গিয়েছিল! বাবা ভয় পেয়েছিলেন। বুনবুন বুঝতে পারে ঠাকুর্দার মৃত্যু নিয়ে তার মনে যেমন বাবার মনেও তেমন অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

—দিদিভাইকে জিজ্ঞেস করে এসো।

—তুমি চলে যাবে না তো?

সব দাদা-দিদিরা বাবা-মাকে আপনি বলে, শুধু পুনপুন-বুনবুন-বুবুকে কিছুতেই আপনি শেখানো যায়নি। বাবা-মা পিসিমা ঠাকুমা সব গুরুজনদেরই ওরা অবলীলায় তুমি বলে। দাদা-দিদিদের কাউকে কাউকে নাম ধরে ডাকে, তুই বলে। বড়রা সব হার মেনে গেছে ওদের কাছে।

—তোমার সঙ্গে যাবে! দিদিভাই বললেন—তবে জায়গাটা তো ছোটদের যাবার মতো নয়! না-ই গেল। কিংবা আজ তুমিই না হয় অন্য কোথাও…

—তা হয় না মা, এক মহিলার খুব জ্বর দেখে এসেছি। টাইফয়েড হতে পারে। বুনবুনের কাঁধের ওপর দিদিভাইয়ের হাত শক্ত হল।

—যায় না বুনবুন।

—আসতে চায় আসুক মা, ভয় নেই। হোমিওপ্যাথিতে টাইফয়েড একবার সারলে আর হয় না।

—তুমি তা হলে ফিরে এখানেই খেও। আজ আমি লোক দিয়ে ও বাড়ি খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। হ্যাঁ, আর কানুকেও নিয়ে যাও। ওকে সামলাবে এখন।

বুনবুন ট্রামে চড়েছে। কানু ট্রামে চড়ে থাকে, কিন্তু বুনবুন তো ঘনঘন চড়ে না।

—বাবা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

—শেয়ালদা।

—ইস্টিশন?—কানু বলল।

—হ্যাঁ।

—আমরা ট্রেনে চড়ব?

—না, ট্রেনে কিন্তু চড়ব না। দেখোই না কী করি।

এ কী! একে স্টেশন বলে? এত ভিড়! বাক্স-পেঁটরা পুঁটলি-পেঁটলা নিয়ে অসংখ্য মানুষ বসে আছে, শুয়ে আছে।

—বাবা, এরা কোথায় যাবে?

—যাবে না। এসেছে।

—বাড়ি যাবে না?

—বাড়ি নেই বাবা।

—কেন?

কানু বলল—জানিস না, দেশ ভাগ হয়ে গেছে এরা রিফিউজি।

বাবা বললেন—ওরা এখানে আশ্রয় নিতে এসেছে। নিজের মনেই বাবা গজগজ করতে লাগলেন নেহরু নিজের গদি দেখল, গান্ধী নিজের ধর্ম দেখল। পাঞ্জাব ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে। এক্সচেঞ্জ অফ পপুলেশন অ্যান্ড প্রপার্টি হচ্ছে দিব্যি। আর বাংলার বেলায় বলে দিল ওদের ঠেকাও। ওদের জায়গা হবে না…

এই সময়ে আধময়লা জামা পরা একটি মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে এসে বলল—‘ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু এট্টু দ্যাহেন আমার মা গ’ কী হইল, কেমন করতাসে।’

প্ল্যাটফর্মের একধারে কাঁথা জড়িয়ে এক মহিলা ঠকঠক করে কাঁপছেন, পাশে কালো তোরঙ্গ। তার ওপর পুঁটলি বসানো। চোখ বুজিয়ে বুজিয়েই উনি দুলছেন আর চ্যাঁচাচ্ছেন—‘কাইট্যা ফ্যালাইসে, সব কাইট্যা ফ্যালাইসে। অরে অ গপাল, যাস কই? আমার মানুষডারে ফেইল্যা যাস না। মিনু, মিনু, আমার মাইয়াডা কই?’

মেয়েটি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল—‘এই তো আমি, মা অ মা, মা গ।’

বাবা ব্যাগ থেকে ওষুধ বার করলেন, মহিলাকে খাইয়ে দিলেন। চটপট পুরিয়া বাঁধলেন। মেয়েটির হাতে দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। দুজনে মিলে ওঁকে কাঁথা পেতে শুইয়ে দিলেন। তারপর স্টেশনের কল থেকে একটা গামছা ভিজিয়ে মহিলার মাথা জবজবে করে ভিজিয়ে দিতে লাগলেন।

ঘুরে ঘুরে রোগী দেখতে লাগলেন বাবা।

—আজ কেমন আছেন?

—প্যাটটা এখন ব্যাটার, কিন্তু ব্যাথাটা যায় কই?

—যাবে, পুরিয়াগুলো রাখুন। জলটা কিন্তু ফুটিয়ে খাবেন।

বুনবুন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল—মামুফুল এদের রান্নাঘর কই?

—নেই।

—তা হলে কোথায় জল ফোটাবে?

—ওই তো ইঁটের মধ্যে কাঠকুটো জ্বেলে…

—ভিখারিদের মতন?

—ভিখারিই তো!

—কি বললে খোকা! ভিখারি! —ওধার থেকে একজন খেকিয়ে উঠলেন।

—ভিখারি কইর‍্যা রাখছে। ভিখারি নই, বুঝলা? জমি-জায়গা ছিল, তোমাদের মতন পোলা ছিল তিনটা, হালার বদ্যিরে পায়ে ধরলাম, কাউরে পালাম না। সব শ্যাষ হইয়া গেল। আর তুমরা এখন ছুট ছুট ছেলে বাপের বয়সী ভদ্রলোকেরে ভিখারি কইছ?

বাবা হাত জোড় করে বললেন—আপনি উত্তেজিত হবেন না। ছোট ছেলে, অত কি বোঝে? মাফ করে দিন।

—কারে মাফ করব কন? হালার সরকাররে, না দ্যাশের পিশাচগুলারে, না ভগবানেরে? থুঃ, থুঃ স্বাধীনতার গায়ে থুঃ।

এই যে ডাক্তারবাবু এসে গেছেন? —ঝোলা গোঁফঅলা একজন ভদ্রলোক পেছন থেকে বললেন—উঃ এমন গেরোতেও মানুষ পড়ে!

কলেরার টিকে এরা কিছুতেই নেবে না। আসতে দেখলেই পালাবে। আর কী নোংরা। এত চিকিচ্ছে করে বেড়াচ্ছেন ডাক্তারবাবু এদের একটু হাইজিন শেখাতে পারেন না? যেখানে হাগছে সেখানেই খাচ্ছে।

রাগী লোকটি এবার মারমুখী হয়ে তেড়ে এলেন।

—কয়ডা দালান দিসেন? ইয়েস, খাওয়া হাগা আমাগ এক হইয়া গেছে। কার পাপে! কন তো দেখি কার পাপে? সাত পুরুষ্যা ঘর, বাগান, জমি-জিরাত, পুকুর, দালান ছাইড়া পুঁটলি কাঁধে ফকির‍্যার মতন বাইরাইছি। আপনাগর লাথি ঝ্যাঁটা গালমুন্দ খাইত্যে?…

—ক্ষ্যামা দিন দাদা, আপনাদের ভালর জন্যই বলি—ঝোলা-গোঁফ হাত নেড়ে বললেন। আশপাশের লোকেরা রাগি লোকটিকে বকাঝকা করতে লাগল।

—সরকারের লোক ক্ষ্যাপাইতাসেন?

—ডোল না জুটলি যাবা কোথা? অ খুড়া?

কেউ ক্লান্ত গলায় বললে—আরে যাইতে দিন না। যাইতে দিন।

ঝোলা-গোঁফ তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বাবার সঙ্গে চলতে চলতে নিচু গলায় বলতে থাকলেন—শুনলেন তো? সবাই জমিদার। সব্বারই জমি-জিরেত দালান-কোঠা ছিল। এদিকে মুখের ভাষা শুনুন—ভিখিরিরও অধম।

বাবা বললেন—জলেরই তো দেশ। চাষবাসই প্রধান জীবিকা। অল্পবিস্তর জমি অনেকেরই ছিল। সেই হিসেবে জমির মালিক, জমিদার এই আর কী! আর সত্যি কথাই। এমন দুরবস্থায় কে-ই বা পরিচ্ছন্নতা রাখতে পারে বলুন! মাথাগুলো যে ঠিক আছে এখনও এই ঢের। এর চেয়ে অনেক কম দুর্বিপাকেও মানুষ পাগল হয়ে যায়।

ঝোলা গোঁফ বললেন—তঞ্চক নেই নাকি? ভান, ভড়ং, ভেক! ধরুন এখানকার মতো ওখানেও তো ভিখিরি, ভ্যাগাবন্ড, বেজন্মা কিছু কম ছিল না।

চারপাশে একঝলক তাকিয়ে ঝোলা-গোঁফ একটু নিচু গলায় আবার বললেন, এই সুযোগে তারাও সব এপারে এসে এটা সেটা ক্লেইম করতে লেগেছে। দেশটাই না জবরদখল করে নেয়। দেশটাই না রিফিউজি করে দেয়।

—সন্দেহ আছে নাকি আপনার তাতে? —বাবা বুনবুন কানুকে সাপটে ধরে বললেন, আপনি কি ভেবেছিলেন দেশটা জবরদখল হয়ে যাবে না? উদ্বাস্তু কলোনি হয়ে যাবে না?

—বলেন কি মশাই, আপনি যেন সব জেনে বলছেন মনে হচ্ছে।

—আন্দাজ! অনুমান বলেও তো একটা জিনিস আছে। এই অদ্ভুত বেআক্কিলে স্বাধীনতার ফলে দেশখানা যে অতিরিক্ত মানুষের ভারে টলমল করছে এ তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছেন। ডুবতে ডুবতেও হয়তো কোনওক্রমে ভেসে থাকব। এ আপনি গিলতে পারবেন না, ওগরাতেও পারবেন না।

—তা হলে উপায়?

—উপায় নেই। সমস্ত ছারখার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। সমাজসংস্কৃতি বলে আর কিছু থাকবে না। এতদিনের লালিত ভ্যালুজ সব পাল্টে যাবে। একটা মাতাল, করাপ্ট, ভায়োলেন্ট সসাসাইটি তৈরি হবে। নিজবাস থেকে বিতাড়িত হয়েছি, গোরু ছাগলের চেয়েও খারাপ অবস্থায় সহায়সম্বলহীন ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল আমাকে জলে। এবার বলুন আমি সামনে যা পাই আঁকড়ে ধরব কি না। জলে ডোবা মানুষ কী করে জানেন? কেউ বাঁচাতে এলে তাকেই এমনভাবে জাপটে ধরে যে দুজনেই ডুবে মরে।

—উঃ, আপনি বলতেও পারেন, ডাক্তারবাবু।

—কারও দুরবস্থা বুঝতে হলে তার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করাতে তো হবে।

—আমরা চাকরি করি মশাই, এই আমাদের চাকরি। অতশত বুঝি না। জানেন আমার শালার একখানা দোতালা বাগানবাড়ি ছিল দমদমায়। থাকত শুধু একটা চাকর। দেখাশোনা করত। জবরদখল করে নিয়েছে। বাগানটাতে টিন দিয়ে খড় দিয়ে ছাউনি খাড়া করেছে। ঘরে ঘরে এক একখানা ফ্যামিলি। পরের সম্পত্তি, দখল করে নিতে এতটুকু বাধল না। কী এরা?

—শুনুন, বাবা বললেন, ঠিক এইরকম সম্পত্তি এদেরও ছিল, বাড়িঘর জোত জমা, বাগান পুকুর। সবাইকার একরকম নয়, কিন্তু ছিল। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের শহুরে মানুষের মধ্যে ভদ্রাসনের আকাঙক্ষাটা কম, আমরা ভাড়াবাড়িতে আমরণ থাকতে পারি। এদের কিছু না হোক একটা মাটির ঘরও ছিল। সঙ্গে একটু জমি, খানিকটা খাল, কি পুকুর, তেমন তেমন জলা জায়গায় একটা নৌকো। ওয়ান ফাইন মরনিং এরা শুনল এদের দেশ পাকিস্তানে পড়েছে। আর সেই থেকেই শুরু হল মারদাঙ্গা, ঘর জ্বালানো, জবরদখল। যার সব ছিল তার কিছু নেই। নিঃস্ব হয়ে গেছে। খোলা আকাশের তলায় মেয়েদের নিয়ে, বাচ্চা নিয়ে কতদিন থাকবে গৃহস্থ মানুষ? আব্রুর জন্যে জবরদখল করবে। দু মুঠো অন্নের জন্যে চুরি, জোচ্চুরি, বেশ্যাবৃত্তি সবই করবে দাদা।

—ওঃ ডাক্তারবাবু আপনি এমন করে বলেন না! ঝোলা-গোঁফ যেন পালিয়ে বাঁচলেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বুনবুন বলল—জবরদখল কী বাবা?

—জবর মানে জোর। জোর করে কোনও কিছু নিয়ে নেওয়াকে জবরদখল বলে।

—তার মানে চুরি?

—চুরি তো মানুষ চুপিচুপি করে। আর জবরদখল সোরগোল করেও করতে পারে।

কানু বলল জামাইবাবু, উদ্বাস্তুরা কি চিরকালই এই শেয়ালদা স্টেশনে থাকবে?

—তা কি আর থাকবে? যার আশ্রয় জুটবে চলে যাবে আস্তে আস্তে। তারপর আবার স্টেশন ভর্তি হয়ে যাবে। আবার চলে যাবে, আবার ভর্তি হয়ে যাবে। পা চালিয়ে চলো এবার।

খেতে বসে বাবা দাদাভাইকে বলছিলেন—সামান্য একটা সম্পত্তির পার্টিশান হলেও একটা বিলিব্যবস্থা করে মানুষ। ধরুন কোথাও একটা সিঁড়ি তুলল, কোথাও একটা দরজা ফোটাল, রান্নাঘর ছিল না এক পার্টির রান্নাঘর উঠল। তবে পাঁচিল উঠবে। আর এ দেখুন একটা সাব কন্টিনেন্ট। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘরসংসার, জমিজায়গা, কাজকারবার, অভ্যেস, বংশধারা, কত পুরুষের বসবাস, একবার ভাবলে না, দায়িত্ব নিলে না, ট্যারাব্যাকা একটা লাইন টেনে দিয়ে বললে দেশ ভাগ হয়ে গেল?

দাদাভাই বিশ্বাসের মানুষ, তর্ক-বিতর্কের মানুষই নন। বললেন ভগবানের এ কী লীলা, তিনিই জানেন, দুগ্‌গা, তুমি আমি কি এর তল পাব? দিদিভাই হেসে বললেন—করল মানুষ আর তুমি এর মধ্যে ভগবানের লীলা দেখছ? ওকি দুগ্‌গা, ডালের ওপর অম্বল মাখছ কেন? ওঁর ওপর রাগঝাল করে কোনও লাভ নেই। ওই এক রকমের মানুষ।

বাবা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন—না না রাগ করব কেন? তলিয়ে দেখতে গেলে শেষ পর্যন্ত সবই তো ঈশ্বরের বিধান। কিন্তু ঈশ্বরের বিধান বলে আমরা নিজের সন্তানের অসুখের সময়ে কি হাত পা ছেড়ে বসে থাকি? আমার বাড়ির রান্নাঘর কোথায় হবে, কলঘর কোথায় হবে সে ব্যাপারে তো আমিই মাথা ঘামাই, ঈশ্বরকে তো ডাকি না। দেখুন মা, স্বাভাবিকভাবেই একটা পপুলেশন অ্যান্ড প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ হতে শুরু করেছিল। লার্জ স্কেলে সেটা হয়ে গেলে তো এত সমস্যা হত না। আপনাদের নেড়ু তো দিল্লি প্যাক্ট করে সেটা বন্ধ করে দিলে। বন্ধ মানে কি? ওয়ান ওয়ে। এদিক থেকে মুসলিম পপুলেশন যা ওদিকে গিয়েছিল ফেরত এল। সম্পত্তি ফিরে পেল, হিন্দুরা ফিরে যেতে সাহসই করলে না। বাগেরহাটের দাঙ্গার পর ওখানে যা শুরু হল, তাতে কি তাদের দোষ দেওয়া যায়?

দাদাভাই বললেন—পাসপোর্ট চালু করতে গিয়েই বোধ হয় আরও সর্বনাশ হল।

এই সময়ে কানু বলল—মা দেখো বুনবুন ভাতগুলো থালার তলায় ফেলে দিচ্ছে, বুনবুন অমনি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।

দিদিভাই বললেন—কী হল বুনবুন, কাঁটা গিলেছ?

বুনবুন কোনওমতে ঘাড় নেড়ে বলল—খাব না।

—কেন? দেখি—দিদিভাই তার গায়ে হাত দিয়ে দেখতে লাগলেন জ্বর এসেছে কি না।

বুনবুন বলল—ওই মে’টার মায়ের জ্বর আর সারবে না। ওদের সবাইকে কেটে ফেলেছে…

দিদিভাই বললেন—তখনই বলেছিলুম দুগ্‌গা, ছোট ছেলে ওসব জায়গায় নিয়ে যেতে আছে! দেখো তো!

বুনবুন ঠোঁট ফুলিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল—ওই মে’টার মা রাঁধতে পারবে না। ও কী খাবে-এ-এ।

বাবা বললেন—ও এই কথা! ওদের তো একটু পরেই খিচুড়ি দেবে, জানিস না বুঝি? দেখেছিস কানু, তুই জানিস আর ও জানে না। বোকা ছেলে।

—মিনু খাবে?—

—নিশ্চয়ই। খাবে না তো কী?

—মিনুর মা?

—জ্বর সেরে গেলেই খাবে।

—মিনুর মায়ের জ্বর সারবে না-আ-আ…

বুনবুন কাঁদতেই লাগল, কাঁদতেই লাগল। একটু পরেই বমি করে ফেলল। দুপুরে দেখা গেল তার ঘোর জ্বর এসেছে।

বাবা নীচের ঠোঁটটা কামড়ে পায়চারি করছিলেন, আপনি মনেই বললেন— এত দুর্বলচিত্ত হলে যুঝবে কী করে এরা?

দিদিভাই অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন—সব কিছুরই একটা বয়স আছে দুগ্‌গা!

বাবা বললেন—লাইফ ইজ গেটিং ভেরি টাফ, মা বুঝলেন? ওর টিকে নেওয়া হয়ে গেছে। এ জ্বর টিকে ওঠার জ্বর। এরপর দেখবেন ইমিউনিটি এসে যাবে। দেখুন—এই ব্রাহ্মধর্ম, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবি ঠাকুর ওদিকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশ বোস এইসব দিয়ে আমরা একটা কালচার, মানবিকতার এক ধরনের মাপকাঠি তৈরি করেছিলুম। দীর্ঘদিন তারই ছায়ায় লালিত হয়েছি। আজ আমাদের নেতারা যে অপরাধ করলেন তাতে করে তাঁদের শেষ পর্যন্ত কী হবে জানি না। কিন্তু আমরা শেষ হয়ে গেলুম।

—আগুন নিয়ে খেলা হচ্ছে বাবা, বুঝলেন? আগুন নিয়ে খেলা। এই আগুনে ঝলসে পুড়ে যে নতুন সমাজ বেরোবে তার চেহারা আন্দাজ করতেও ভয় হয়। হিংসে, বিদ্বেষ, হতাশা, আক্রোশ দিয়ে তৈরি হবে দেশের হাওয়া। সেখানে আপনার আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হবে। কিন্তু এই কানুর, এই বরুণের কষ্ট হলে তো চলবে না। কিন্তু আমরা শেষ হয়ে গেলুম।

বাবা ঠিকই বলেছিলেন। জ্বরটা আমার টিকের জ্বর। তারপর থেকে কত দুর্ঘটনা, দুর্বিপাক, দুর্ভোগই তো দেখলুম, কই আর কখনও তো ভয় পাইনি। কখনও না।

দ্বিতীয় অধ্যায় : দেবকীনন্দন

ঠাকুর্দাদা মারা যাবার পর থেকে বারো নম্বরে বাবার যাতায়াত বেড়ে গিয়েছিল। আগে আগে ঠাকুর্দাদাই ছিলেন দুই বাড়ির মধ্যে সেতু। চার নম্বরে তাঁর যত কাজ, আর বারো নম্বরে তাঁর যত আড্ডা। ঠাকুর্দাদা হঠাৎ সেই সেতুটা তুলে নিয়ে ‘সে- তু চা-ই একটা সে তু’ বলে কোথায় চলে গেলেন, আমার যেটুকু সেই সেতুতে উঠে পড়তে পেরেছিল, সেই অংশটুকুও কেমন ঠিকানাহীন হয়ে ঘুরতে লাগল। ও বাড়ি গিয়ে আমি আগেই যাঁর খোঁজ করতুম তিনি হলেন ঠাকুর্দাদা। বারো নম্বরের এক টুকরো। বারো নম্বরের হাওয়ার একটা স্রোত। নিজেদের মধ্যে চলিত ঠাট্টার সুতো ধরে ঠাকুর্দাকে সম্ভাষণ করে তবে আমি চার নম্বরের মণ্ডলে প্রবেশ করতুম।

চার নম্বরের একটা মস্ত টান অবশ্য ছিল, মায়ের টান। সেটা কিন্তু চোরা চুপিচুপি টান, প্রেমিকার প্রতি কিশোর প্রেমিকের যেমন থাকে। প্রকাশ করতে কেমন লজ্জা হত। বুবু পুনপুন যেমন অবলীলায় মায়ের পাশে শোওয়ার জন্য লড়ালড়ি করত, আমি কোনওদিনই সেটা করতে পারতুম না। মাকে পাশে না-ই পাওয়া যাক, মা খালি ঘুরে ঘুরে কাজ করুন, কিন্তু মায়ের দিক থেকে একটা বাতাস বইবে, বুনবুন যেখানেই যাক, ছাতে বা চিলেকোঠার ঘরে বা উঠোনে বা দালানে বা কোণের ঘরে সেই মা-মা- বাতাস তাকে ছোঁবেই। বুনবুন কখনও বুক চিতিয়ে, কখনও ডিগবাজি খেতে খেতে সেই বাতাস গায়ে মেখে নেবে। মাঝে মাঝে বুনবুন দেখতে পাবে সবুজ পাড় মিলের শাড়িতে ঘেরা মায়ের পাশমুখ, আধখানা ধ্যাবড়া সিঁদুর টিপ, কখনও দেখবে একখানা ক্ষয়া ক্ষয়া চুড়ি নোয়াশোভিত সাদা হাত, চাবির গুচ্ছ ফেলার ঝনাৎ শব্দ, বুনবুন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠবে।

আর রাত্তিরবেলা মায়ের পাশে ঘুম? হয়তো তুমি যখন শুলে তখন মা আসেননি। মাঝরাত্তিরে পাশ ফিরতে গিয়ে তুমি সেই নিবিড় মা-মা- গন্ধটা পেলে, পানের গন্ধ, ধোপাবাড়ির শাড়ির গন্ধ। ধোপাবাড়ির কাপড় না ধুয়ে বউয়েরা তো রান্নাঘরের কাজ করতেই পারবেন না। তাই মা এই উপায়টা বার করেছেন। রাত্রে পরে শোবেন, সকালে জলকাচা হয়ে গেল। পাটভাঙা কাপড় পরাও হল, আবার রান্নাঘরে ঢোকার জন্যে কাপড় শুদ্ধু করে নেওয়াও হল। ফলে শনি রবিবার রাতে মায়ের কাছে শুতে দুদিনের দুটো পাটভাঙা শাড়ির গন্ধ, পানের গন্ধ, মাতৃদেহের সুরভির সঙ্গে মিশে তোমার ইন্দ্রিয় রোমাঞ্চক স্পর্শ বুলিয়ে দেবে। তুমি নাক দিয়ে তাকে ছোঁবে। ত্বক দিয়ে, প্রতি রোমকূপ দিয়ে তার ঘ্রাণ নেবে।

—বরুণ, বরুণ ওঠো, একবার কলতলায় যাও মা আমাকে ঠেলে তুলে দেবেন। বুবু পুনপুনকেও। কলতলার দিকে যেতে যেতে আমি জোরে শ্বাস টানব। কতকগুলো জিনিস আমি বুবু পুনপুনের থেকে কিছুতেই লুকোতে পারি না। আমরা তিনজনে তো আসলে এক। তাই।

পুনপুন বলবে—নাক টানছিস কেন?

আমি আস্তে বলব— মায়ের গন্ধ, কাউকে বলবি না কিন্তু।

পুনপুন সরু গলায় বলবে— তুইও? আমি তো গন্ধটা সবসময়ে পাই। বুবু তার ঘুম ভাঙা খসকা গলায় বলবে— আমি পাচ্ছি না, সে কাঁদো কাঁদো হয়ে যাবে। তক্ষুনি তক্ষুনি মায়ের গন্ধ খুঁজতে সে মায়ের কাছে চলে যেতে চাইবে, তার যেন বাথরুম করবারও আর তর সইছে না।

কিন্তু এ সব তো একটু আগেরই কথা। এখন তো আমি বড় হয়ে গেছি। বড় হয়ে গেলে মে’দের পাশে শুতে হয় নাকি? পুনপুন বলে ‘দিদিভাইয়ের কাছে শুস যে?’ ‘দিদিভাই আবার মে’ নাকি!’ এই জবাব ঠোঁটের আগা থেকে ভেতরে পাঠিয়ে দিই আমি শেষ মুহূর্তে বুঝে ফেলে যে দিদিভাইও মে’ই। কিন্তু দিদিভাই যেমন মে’নয় আমার কাছে, মা-ও তেমন পুনপুনের কাছে মে’ নয়। তবে দিদিভাইয়ের কাছেও তো আমি শুই না আজকাল। দিদিভাইয়ের পাশের ঘরে, শাদা কালো চৌকো পাথরের ঘরে তক্তপোশ আছে আমার আর মামুফুলের। আমাদের পড়ার টেবিল, বইয়ের তাক, আমাদের ক্রিকেট ব্যাট, ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট স-ব।

চার নম্বরের তৃতীয় আকর্ষণ আমার অবশ্যই বুবু পুনপুন। ওদের সঙ্গে বিশেষ করে পুনপুনের সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া তো আছেই। বুবু এ পর্যন্ত আমার সঙ্গে দুবার আড়ি করেছে। একবার যখন কলঘরে গামছা দিয়ে পুকুর তৈরি করে সাঁতার কাটছিলুম, তখন আমি আর পুনপুন দেখে ফেলি বুবুর পেছনে কোনও শুঁড় নেই, তখন দুয়ো দিয়ে তাকে আমরা পুকুর থেকে বার করে দিই। ছিঁচকাঁদুনি বুবু যথারীতি কেঁদেকেটে হাঙ্গামা বাধায় এবং আমরা দু ভাই মায়ের কাছ থেকে ঠাস ঠাস গালে চড় খাই। সেবার বুবু অনেক দিন আড়ি করেছিল। আর একবার অসুখের পর অনেক দিন কোনও কারণ ছাড়াই আড়িটা করে। সেবার আমি দিদিভাইয়ের পরামর্শ নিই। দিদিভাইয়ের কথাতেই আমি আড়ির পরোয়া না করে বুবুকে হাসিয়ে দেবার চেষ্টা করতে থাকি। তাতে কাজ দিয়েছিল।

সারা শীতের ছুটি খেলা থাকে চার নম্বরের উঠোনে। সকালের দিকে আজকাল চার নম্বরও ফাঁকা ফাঁকা। ই-দাদা, সু-দাদা, পালক কেউ নেই। পম টম ওপরে কোথায় কে জানে! বুজবুজও নেই। আমি পুনপুনকে জিজ্ঞেস করি—বড়রা কোথায় যায় রে? পুনপুন বলে ড্রপ দিতে দিতে ঠোঁট উল্টোয়। বড়দের কাজ-কারবার অদ্ভুত। এই হয়তো সেধে সেধে হয়রান হয়ে গেছি, তবু কেউ খেলতে এলো না। আবার দেখো কোনওদিন ফট করে মালকোঁচা মেরে নেমে পড়বে। আর খেলতে একবার নামল তো হয়ে গেল। ক্যারমে বসল তো প্রথম স্ট্রাইক পেলেই শটাশট, শটাশট, বাস বোর্ড ফাঁকা। আর ক্রিকেটে যদি ব্যাট ধরে তো ডাবল সেঞ্চুরি করে নিজেরাই হয়রান হয়ে ছেড়ে দেবে। একমাত্র মামুফুল যদি বল ধরে তাহলে ওদের আউট করা যায়। আর বুবু যদি গুগলি দিতে রাজি হয়, তবে। বুবু আমাদের গুপ্তে। ওর গুগলি কেমন বলুন তো? বাঁ দিকে কোনাকুনি ছুটে গিয়ে ও ডান দিকে বলটা ছুঁড়ে দেবে। ব্যাস আউট। মামুফুল বলবে আনতাবড়ি দা গ্রেট। জ্যাঠাবাবু হাততালি দেবেন ঠোঁটে চুরুট কামড়ে। আর হাততালির বাড়াবাড়িতে বুবু লজ্জা পেয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে ভেতরে চলে যাবে।

আমরা ব্যাডমিন্টন খেলছি। ককটা পাঁচিল টপকে রাস্তায় পড়ে গেছে। তুলতে গিয়ে দেখি সিংগিবাড়ির দোতলার জানলা দিয়ে মানিক চেয়ে আছে। আমি বলি— ‘পুনপুন ওই দ্যাখ মানিক।’ আমরা দুজনে ওকে ডাকি। মানিক ইশারা করে ভেতর দিকে দেখায়। ওকে আসতে দেবে না। আমি টানি পুনপুনকে— চল মানিকদের উঠোনে যাই, নেট দরকার নেই। শুধু র‍্যাকেট নিয়েই খেলব। পুনপুন কিন্তু উৎসাহ দেখায় না। তবু ওকে টানতে টানতে নিয়ে যাই। আমরা আসছি দেখে মানিকের মুখ অদৃশ্য হয়ে গেছে। ও ছুটতে ছুটতে নীচে নামছে।

দেউড়িতে একজন রোগামতো বুড়োমতো লোক তেল মাখছেন। বললেন— কার পোলা, কোথায় যাবা? অ, ডাক্তারবাবুর না? বা বা তুমার একখান জুড়ি আছে কও নাই তো পুনু!

উনিও তেলের কৌটো নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন, মানিকের জ্যাঠামশাইও ভেতর থেকে বেরোচ্ছেন দেখা গেল। ওঁর পেছনে মানিক, মানিকের বাবাও। এতজন বড়কে দেখে পুনপুন ঘাবড়ে যায়। আমি ওকে টেনে নিয়ে মানিকের সঙ্গে ভেতরে ঢুকি। ও হরি, এখানে কোথায় খেলব?

সেই সময়ে জ্যাঠামশাইয়ের তীক্ষ্ণ গলা কানে এসে লাগল— আপনি যে দেখি দলকে দল এনে বসাচ্ছেন ঘোষালকাকা।

তেলমাখা মানুষটি মাথায় হাত বুলোতে বুলাতে বললেন— করি কি কও কাতু। এরা তো কেউ আমার পর না।

—আমাদের একটা অনুমতি নেওয়ারও দরকার মনে করলেন না?

—অনুমতি? নিষিদ্ধ এলাকা নাকি? পারমিট লাগব? আমারে যে দুইটা ঘর দিয়াছ তাতেই তো উয়াদের জায়গা দিয়াছি। এত রয়্যাছে তোমাদের!

—বাঃ, চমৎকার। এত রয়েছে? তাই আপনি গ্রাম সুবাদে যে যেখানে আছে এনে বসাচ্ছেন!

—তুলবা নাকি? মারবা? তেলমাখা- চেঁচিয়ে উঠলেন— তোমার অন্ন তো খাই নাই! জুটসে তো শুদু মাথার উপর একটু ছাদ। এটুকও কাড়বা?

—আপনি তো দেখি হয়কেও নয় করতে পারেন। তুলবার কথা কখন বললুম? বিনা অনুমতিতে রাশি রাশি লোক এনে ঢোকানোটা বন্ধ করতে বলেছি। কী নোংরা করে রেখেছেন সব! উঠোনময় কাপড় শুকোচ্ছে। এখানে বাচ্চারা ইয়ে করে রেখেছে। ছি! ছি!

ভেতর থেকে এক মহিলা অগ্নিমূর্তি হয়ে বেরিয়ে এসে বললেন— এখনই কী দ্যাখতাসো? নোংরা কারে কয় দেখাইয়া দিমু। গুরুজনের উপর চোপা? দুইটা ঘর হাওলাত দিয়া মাথা কিনবা নাকি?

জ্যাঠামশাই শিহরিত হয়ে বললেন— ঘোষালকাকা ওঁকে ভেতরে যেতে বলুন। আপনার সঙ্গে কথা বলছি… মাঝখান থেকে স্ত্রীলোক…

—স্ত্রী লোক! মাইয়া বইলা আর মানুষ না, না? বুড়া মানুষটার লগে তখন থিকা ক্যাচর ক্যাচর ক্যাচর ক্যাচর…

জ্যাঠামশাই রাগে লাল হয়ে ভেতরে উঠোনের দিকে গেলেন। মানিকের বাবা বললেন— তখনই আপনাকে বারণ করেছিলুম দাদা। আপনি তখন শুনলেন না। কে পিসিমার মামাশ্বশুরের ছেলে, পিসিমা বললেন আর অমনি আপনি…

পুনপুন আমার হাত ধরে এক টান দিল— বাড়ি চল।

মানিক আর এক হাত ধরে বলল— চল না বাগানে যাব।

ভেতর-উঠোনে ঢুকতেই রান্নাবাড়ির দাওয়া থেকে কর্তামা বললেন— আমার ঘাট হয়েছে বাবা। আমি তোমাদের কাছে মাফ চাইছি। তোমাদের পিসেমশাই যখন বেঁচেছিলেন তখন এর বাড়ি, আমার খুড়তুত মামাশ্বশুরবাড়ি কত খেয়েছি, মেখেছি। তাদের যে এরকম হা-ভাতে হা-ঘরে অবস্থা হবে তা কি স্বপ্নেও ভেবেছি? এই মদন তখন আমার পায়ে পায়ে ঘুরত, বউরানি বউরানি করে কত কাঁচা আম, কামরাঙা, চালতা এনে দিয়েছে…

রাঙাজেঠু মাথা নেড়ে বললেন— আসলে কাতু হয়েছে কী জানেনা, অত বিষয়-সম্পত্তি তো, অনেককাল মনস্থির করতেই পারেননি। নিজের দেশ, বাড়িঘর, বাগান জমি-জায়গা নেহাত কারে না পড়লে কে-ই বা বেচতে চায়! তারপর তো ক্রমশই বিষয় বেদখল হয়ে যেতে লাগল। এক কাকা গেলেন ঢাকার দাঙ্গায়, আর এক কাকাকে বাগানের মধ্যে কে কুপিয়ে রেখে গেল। শেষ খাঁড়ার ঘা পড়ল সমর্থ জোয়ান ছেলেটা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায়।

কর্তামা বললেন— বউটা পুকুরে গেলেই চারদিক থেকে সব জোয়ানমদ্দ ঘিরে ধরত, টিটকিরি দিত।

—শোকে দুঃখে মদন কাকার মাথাটাই বিগড়ে গেছে ধরে নাও। ও কাকিরও তাই। ওই ছোট দুটি নাতি আর নিজে এই হল গিয়ে বাড়িতে পুরুষ মানুষ।

কর্তামা বললেন— তা হোক, তাড়িয়ে দাও। সব ঝেঁটিয়ে বিদেয় করো। সত্যিই তো গুচ্ছের লোক জড়ো করছে। এর কুটুম তার কুটুম। মজা পেয়েছে যেন। বসতে পেলে শুতে চায়।

এই সমস্ত কথাবার্তার মধ্যে আমি পুনপুন মানিক আর বাচ্চা নেট ছাড়া ব্যাডমিন্টন খেলে যাচ্ছিলুম। ওরা কী করছিল জানি না। আমি কিন্তু কান পেতে সমস্ত কথা শুনছিলুম। কেননা এরা তো সেই শিয়ালদা স্টেশনের মিনুদের মতো। বাবা বলছিলেন না কেউ কেউ আত্মীয়দের বাড়ি জায়গা পেয়েছে, টিকে দেওয়ার লোকটিকে বাবা বোঝাচ্ছিলেন না, ওদের সব কেটে ফেলেছে, সব কেড়েকুড়ে নিয়েছে তাই ওরা পরিষ্কার থাকতে ভুলে গেছে!

জেঠিমা এই সময়ে বলে উঠলেন— বসতে পেলে শুতে আর কে না চায় পিসিমা!

ভাঙা গলায় কর্তামা বললেন—তুমি কি কথাটা আমাকে বললে বউমা? শুনলি রাঙা! শুনলি তো?

জেঠিমা— আপনি তো পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করছেন, আমি কখন ও কথা আপনাকে বললুম?

মানিকের বাবা— আহা হা হা। একটা বাইরের উটকো সমস্যা নিয়ে কথা হচ্ছে এর মধ্যে বউদি তুমি আবার কেন?

কর্তামা মুখ থমথমে করে দক্ষিণের ঘরে ঢুকে গেলেন। জেঠিমা বললেন—এখনও সময় আছে, বেনোজল সামলাও এই বলে দিলুম।

ঝনাত করে পিঠে চাবি ফেলে জেঠিমা কুটনো-ঘরে ঢুকে গেলেন। কুটনো ঘরটাই এখন ওঁদের রান্নাঘর হয়েছে।

জ্যাঠামশাই মানিকের বাবাকে কী একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। হেঁকে বললেন— মানিক, এখান থেকে যাও। এই খোকা এখন খেলতে হবে না, যাও বাড়ি যাও।

পুনপুনের মুখটা শাদা হয়ে গেল। আমি পুনপুনকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনলুম জ্যাঠামশাই বলছেন— যত্তস্‌সব জ্যাঠা ছেলে।

পুনপুন আমার দিকে তাকাল না। আমিও পুনপুনের দিকে তাকালুম না। আমরা কেউই আর মানিকের দিকে তাকালুম না।

তৃতীয় অধ্যায় : পিতৃব্য

বুনবুন এখন রোজ চার নম্বরে যায়। স্কুল থেকে ফিরে বইখাতাগুলো টেবিলের ওপর রেখেই সে দৌড়োয়। দিদিভাই পেছু ডেকে বলেন—‘খেয়ে যাও বুনবুন, খেয়ে যাও।’ সে কথা সে প্রায়ই শোনে না। চেঁচিয়ে বলে ‘পিসিমার কাছে খাব।’ আবার কোনও কোনও দিন শুনতেই হয়। ঢকঢক করে এক গ্লাস দুধ, বাড়িতে তৈরি লেবু-গন্ধ-অলা সন্দেশ তাকে খেতেই হয়। তারপরেই সে ছুট্টে বেরিয়ে যায়। তার এক হাতে ব্যাট আর এক হাতে টেনিস বল। সার্কুলার রোড পেরিয়ে যায় সে এক দৌড়ে, ফড়েপুকুরে ঢোকে। টকি শো হাউসের পাশ দিয়ে লাফাতে লাফাতে সে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে পড়ে। এবার কোন দিকে যাবে বলুন তো? সিনেমা হল, স্টেশনারি দোকানের পাশের ফুটপাথ দিয়ে সে এখন মোটেই হাঁটবে না। কী হবে অত মে’দের ছবি দেখে, মে’দের জিনিস দেখে? সে এখন উল্টোদিকের বলরাম ঘোষের স্ট্রিটে ঢুকে পড়বে। এই রাস্তাটা এঁকে বেঁকে ডাফ স্কুল, সরস্বতী বালিকা বিদ্যালয় পেরিয়ে রামধন মিত্তির লেনে পড়েছে। ওখান দিয়ে বেরিয়ে শ্যামপুকুর স্ট্রিটে পড়বে, তারপরে তো শিবশংকর মল্লিক কয়েক দৌড়ের রাস্তা। এই রাস্তাটা দিয়ে কেন সে যায় জানেন? খেলতে খেলতে যাওয়া যায় বেশ। ব্যাটের আগা দিয়ে বলটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়। আবার, আবার। এই খেলাটা খেলবার সময়ে একবার গলির এদিক, একবার ওদিক এইরকমভাবে এগোতে হয়, চোখ ওপরের দিকে। উল্টোদিক থেকে লোক এসে পড়লে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কারুর সঙ্গে ধাক্কাটাক্কা লাগলে ‘ওপ্‌ফ, এই ছোঁড়াগুলোকে নিয়ে আর…এই খোকা, রাস্তাটা কি খেলবার জায়গা?’ ঠুনঠুন করে রিকশা এসে গেলে দূর থেকে বলতে বলতে আসবে ‘খবর্দার খবর্দার।’ সাইক্‌ল ঘন্টি বাজাবে ক্রিং ট্রিং। সে ফুট করে ধারের দিকে সরে যাবে, বল তখনও শূন্যে, ব্যাট তখনও তার হাতে চিৎপাত। শুধু ঘন্টিটা বাজিও, তাহলেই হবে। খেলাটা ধারের দিকে সরে যাবে।

চার নম্বরের সদরে পুনপুন কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কী যে দোষ ও করেছে, কিসের যে ওর অত ভয় কে জানে। কিন্তু ও আজকাল সবসময়ে কাঁচুমাচু থাকে। ও মুখে কিছু বলছে না, চোখে বলছে ‘এত দেরি করলি কেন?’

সিঁড়ির মাঝের ধাপে সাটিনের ড্রেসিং গাউন পরে চুরুট মুখে বর্মার জ্যাঠাবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। গাউনের পাল্লা দিয়ে বুবুকে সাপটে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। বুবুর গোল গোল চোখ, গোল্লা-গোল্লা চুল। গোল গোল গাল, বুবু বলছে ‘লু লু লু…।’ জ্যাঠাবাবুর হাতে লুডোর বোর্ড। উনিও বলছেন ‘হবে নাকি? লু?’

তারা চারজনে লু খেলে এবার। জ্যাঠাবাবু কুচকুচ করে তাদের ঘুঁটিগুলো কাটেন। কী করে যে ওঁর সবসময়ে পছন্দসই দান পড়ে, কে জানে!

গেলাসের মধ্যে ছক্কা ঢুকিয়ে তিন চারবার ঝাঁকালেন। খট্‌খট্‌ খটাখট আওয়াজ হল মুখে বলছেন ‘পো, পো, পো,’ মানে ‘এক’। দান ফেললেন, কুড় কুড় কুড় কুড় করে ছুটে গেল ছক্কা। ফুট করে উল্টে গেল ঠিক পো পড়েছে। সে, পুনপুন ঠিক অমনি করে ঝাঁকিয়ে দেখেছে পড়ে না। পুটপুটদিদি বলে জ্যাঠাবাবু শকুনি। জ্যাঠাবাবুর ছক্কা ওঁর কথা শোনে। আবার বুবুর ওপর ওঁর এমন দয়া যে বুবুকে কাটবার দান পড়লেও উনি মানবেন না। বলবেন “উঁহু, হল না, বোর্ডে লেগে গেছে, আবার চালো।’ ঘুঁটি হোমে উঠে গেল, সেখান থেকে নেমে এসে উনি ওদের কুচকুচ কাটবেন। ভী-ষণ রাগ হয়। কিন্তু আবার যেই সাটিনের জোব্বা পরে, মুখে চুরুট, বোর্ড নাচাবেন, অমনি ওরা তিনজনে লু খেলতে বসে যাবে।

জ্যাঠাবাবু নাকি ক্যারামে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। চকচকে ক্যারাম বোর্ড পেতে যখন বসবেন, বোর্ডকে পাউডার মাখাবেন, তখন ছোটরা ওঁর কাছে পাত্তাই পাবে না, খেলবে পালক, ই-দাদা, সু-দাদা, অং-দাদা কখনও কখনও, কিন্তু ছোটরা কক্ষনো না। একমাত্র সুযযির কাছে উনি জব্দ। সুযযি প্রথম দান পেলেই ফটাস করে একটা মারে চার দিক থেকে চারটে ঘুঁটি পকেটে পাঠিয়ে দেবে। তারপর একটা অ্যাঙ্গল-এ দুদিকে দুটো। রিবাউন্ড করে গোটা চারেক…এইভাবে বোর্ড ফাঁকা করে দেবে। জ্যাঠাবাবু হেরে গেলেই তিন ছোট বলবে ‘হেরো, হেরো।’ বুবু বলবে ‘হোরে হোরে।’ ‘হেরো’ বলতে ও যে কেন পারে না সে ওর মেনিনজাইটিসই জানে। জ্যাঠাবাবু ‘হেরো’ বললে ভীষণ রেগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকেন ‘দাঁড়াও তোমাদের মাকে বলে দিচ্ছি। বউমা, বউমা, এই দ্যাখো, এরা আমাকে হ্যাটা করছে।’ মা দূর থেকে একবার তাদের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙাবেন। ব্যাস, তারা হিম।

রোববারে বুনবুন তো ঘুম থেকে উঠেই ছুটছে। কেন বলুন তো? বর্মার জ্যাঠাবাবু ওদের চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবেন।

—বউমা, আমাদের নুচি তরকারি গুছিয়ে দাও—মা বাক্সে লুচি তরকারি দিলেন।

—দুগগি কমলালেবু ভুলিসনি তো? —বাবা বাজার থেকে কমলালেবু এনেছেন, সব ঝোলায় ভরা হল।

—অংশু চট করে হরিবাবুর দোকান থেকে গোটা ষোলো টফি এনে দাও তো! পয়সাটা বাবার ঠেঁয়ে নিয়ে নিও।

বাবার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে অংশু গোটা ষোলো টফি এনে দিলে ওরা বেরিয়ে পড়ে। প্রথমে সেকেণ্ড ক্লাস ট্রামে চড়ে এসপ্লানেড, এসপ্লানেড থেকে বাস ধরে চিড়িয়াখানা, কী মজা! বাঁদরদের দেওয়ার জন্যে এক ঠোঙা ছোলাবাদাম কেনেন জ্যাঠাবাবু।

সারা দিন বাঘ, সিংগি, উট, উটপাখি, জিরাফ, জেব্রা, নীলগাই, হনুমান, বনমানুষ, পাখি সব প্রাণভরে দেখার পর ওরা আব্দার ধরে, ট্যাকসি চড়ে বাড়ি যাবে। জ্যাঠাবাবু বলেন একটা কথা ভাবছিলুম।

—কী জ্যাঠাবাবু? কী?

—ট্যাকসি চড়ে বাড়ি যেয়ে কী হবে? তার চেয়ে প্রাইজ পাওয়াটা ভাল না?

—প্রাইজ পাওয়াই ভাল— ওরা সমস্বরে বলে৷

—ঠিক আছে। এখান থেকে ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত কে আগে পৌঁছোতে পারে দেখি। ব্যাস মুখের কথা খসতে না খসতে ওয়াকিং রেস শুরু হয়ে গেল। বুবু হাঁটছে নোদল গোদল, পুনপুন হাঁটছে খুরখুর তুরতুর, বুনপুন হাঁটছে লেফ্‌ট রাইট, লেফ্‌ট রাইট, লেফ্‌ট।

হ্যাণ্ডিক্যাপ, হ্যাণ্ডিক্যাপ—জ্যাঠাবাবু চেঁচাচ্ছেন মাঝে মাঝে। তার মানে দু ভাইকে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে, বুবু ধুপধাপ করে ছুটে ছুটে খানিকটা এগিয়ে যাবে। তারপর আবার ভাইয়েরা হাঁটা শুরু করবে।

ভিক্টোরিয়ায় পৌঁছে ওরা একটা করে কমলালেবু, দুটো করে টফি পায়। তারপর জ্যাঠাবাবু বললেন ‘মনুমেন্ট পর্যন্ত কে আগে যেতে পারো, এবার দেখি।’

খুড়োর কল সামনে ঝুলিয়ে আবার ছোট ছোট ছোট। মনুমেন্ট অবধি একই কায়দায় পৌঁছে আর একটা করে কমলালেবু, আর একটা করে টফি পাওয়া যায়। ময়দানে বসে বসে অবশ্য ওরা গপ্পো শোনে। জ্যাঠাবাবুর ছেলে ছিল যেমন বীরপুরুষ তেমনি দেশভক্ত। আজাদ হিন্দ ফৌজে সে যোগ দেবেই দেবে। জ্যাঠাবাবুর জ্যাঠাইমাও যেতে দেবেন না। সে-ও যাবেই। তারপরে?

তারপরে আর কি? রেঙ্গুনে এয়ার-রেইড। দলে দলে লোক পালাচ্ছে। জ্যাঠাবাবুরাও পালালেন। ঘন জঙ্গলে পথ ধরে, ঘন কাদাজলা ভর্তি আরাকান পাহাড় পার হতে হতে পায়ে কাঁটা, কাদা, খাবার নেই, জল নেই, জ্যাঠাবাবুর জ্যাঠাইমা আর পারলেন না। মারা গেলেন। আবার চল্‌, আবার চল্‌, জ্যাঠাবাবুর ছেলেও মারা গেলেন। তারপর জ্যাঠাবাবু কোনওমতে ভারতবর্ষের মাটিতে পা দিয়েই— বন্দে মাতরম জয়হিন্দ্‌ বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। চার খিলি নকুলদানা কেনা হল।

এইবার ট্যাকসি। একে বলে বেবি-ট্যাকসি৷ ততক্ষণে ওরা প্রাইজের কথা ভুলে মেরে দিয়েছে। একেবারে বাড়ির কাছে এসে মনে পড়েছে।

—জ্যাঠাবাবু আমাদের প্রাইজ?

—ওইয্‌ যাঃ—জ্যাঠাবাবু বললেন—ট্যাকসি করে আসা হল যে!

ট্যাকসিতে এলে যে প্রাইজ পাওয়া যেতে পারে না এটা একটা আইন, কিংবা একটা অলঙ্ঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। জ্যাঠাবাবুকে সেই বাবদ অসহায় দেখে ওরা চুপ। মনে বড়ই অনুশোচনা। কী হতে পারত প্রাইজটা?

পুনপুনের ধারণা ওটা একটা লুডো। লুডোর ঊর্ধ্বে কিছু ও কল্পনা করতে পারত না।

বুবু বলল—আকাশ থেকে পড়ল একটা বই।

বুনবুন—কী বই?

পুনপুন– রঘু ডাকাত, আরও ডাকাতের গল্প নিশ্চই।

বুবু—হযোবরল্‌।

ভাইয়েরা দুজন হিহি হাহা। ‘হযোবরল্‌’ বলে কিছু হয় না, কথাটা হ য ব র ল। বুবুর কান্না। মা কিংবা পমপমের আবির্ভাব। বকুনি। ওরা চুপ।

জ্যাঠাবাবুকে সে বীরপুরুষ ভাবতে চায়। কিন্তু পারে না। ওঁর পিস্তল আছে, কত বীরত্বের গল্প জানা আছে, উনি নেতাজিকে নিজের চোখে দেখেছেন, আরাকান পাহাড় পার হয়ে দেশে ফিরেছেন। তবুও না। ঠাকুরদাদাকে সে বীরপুরুষ ভাবে। ফর্সা ধবধবে ঠাকুর্দা, মাথায় ধবধবে চুল, গায়ে ধবধবে ধুতি ফতুয়া, তালতলার শুঁড়তোলা চটি পরে গটগট করে হেঁটে যেতেন, গমগমে গলায় ডাকতেন— ‘টে-কন, টে-কন৷’ দিদিভাই-দাদাভাইয়ের সঙ্গে গল্প করবার সময়ে কি রকম হাসতেন ঠাকুর্দা। হা-হা-হা। ঠাকুর্দা ভাঙা হাড় জোড়া দিয়ে দিতে পারতেন, কত লোকের কত অসুখ ফটফট করে ভালো করে দিতেন, এমন কি পুলিশের সঙ্গেও হেসে হেসে কথা বলতে দেখা গেছে ঠাকুর্দাকে। একবার যখন সে কুঠেদের জিনিস তুলে নিয়েছিল, সব্বাই ভয় পেয়েছিল, ঠাকুর্দা একাই তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। পুলিশ, ভূত, অসুখ, কিছুকেই ভয় পেতেন না ঠাকুর্দা। দাদাভাইকে দেখলে মনে হয় না, কিন্তু সে জানে উনিও বীরপুরুষ৷ দাঙ্গার সময়ে উনি মুসলমান দর্জিকে নিকাশিপাড়ায় পৌঁছতে গিয়েছিলেন। একদিন দাদাভাইয়ের সঙ্গে সে বেরিয়েছে। একটা সরু গলি দিয়ে ওরা আসছে, দেখছে খুব ঝগড়া হচ্ছে। একজন ফটাস করে একটা ছুরি বার করে তেড়ে গেল উল্টোদিকে। দাদাভাই তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসছিলেন— ‘বুঝলে বুনটু, ওই যে দেখলে আমার বন্ধুকে, ওঁর নাম অশোকনাথ শাস্ত্রী, মহা পণ্ডিত লোক। কত যে জানেন… সে আর।’ বলতে বলতে লোকটার ছুরিসুদ্ধু হাত উনি ডান হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন— ‘ধ্যাত, হচ্ছেটা কী? রাস্তার মাঝখানে…?’ লোকটা সরে গেল, ছুরিটাও নামিয়ে ফেলল। দাদাভাই আর সে যেমন চলছিল, চলতে লাগল। অথচ দাদাভাইয়ের ঠাকুর্দার মতন গলাও নেই, রাগও নেই।

আর দিদিভাইয়ের তো কথাই নেই। তার আর কানুমামুর যখন পানবসন্ত হল, তাদের সব কিছুই একসঙ্গে হয় তো! রাত্তিরে তখন তাদের বিছানার কাছে সাদা কাপড় পরা, ঘোমটা দেওয়া একজন ভূত আসত, বড়মামা বলেছিলেন— ওটা শেতলা মা, দিদিভাই কিন্তু বললেন ওটা কিছুই না, মনের ভুল। মাথা গরম হয়ে গেলে মানুষ ওরকম ভুল দেখে। ওরা ভয় পেলে সে দিদিভাইকে বাবাকে বলতে শুনেছে— ‘সিমটম অনুযায়ী তো তোমরা ওষুধ দাও দুগগা, এটা একটা সিমটম না?’ —বাবা বলেছিলেন ‘নাইনটি নাইন পার্সেন্ট লোক এ সবে ভয় পায় মা, আপনি পেলেন না? হ্যাঁ, এটা এক ধরনের হ্যালুসিনেশন— সিমটম অনুযায়ী ওষুধ দিই বইকি!’

জ্যাঠাবাবু খুব লম্বা-চওড়া। বেশ ষণ্ডামার্কা। আর বাবা তো মোটেই লম্বা-চওড়া নন। কিন্তু যেদিন রাত্তিরে চার নম্বরে চোর এলো, বাবা তো সব্বার আগে মেথরের গলিতে ঢুকে গিয়েছিলেন। পালক যত বলছে ‘দাঁড়ান কাকাবাবু, আমি আগে টর্চ মারি’, বাবা ততই এগিয়ে যাচ্ছেন, দেরি করলে নাকি চোর পালিয়ে যাবে। সব্বাই বেরিয়েছে, চোরেরা ঠাকুরঘরের ট্রাঙ্ক ফেলে রেখে পালিয়েছে, তখন জ্যাঠাবাবু দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন।

—কী হল? চোর ধরা পড়ল?

ঠাকুমা যেদিন ভোররাতে ধনুষ্টংকারে মারা গেলেন, সেদিন নাকি জ্যাঠাবাবু বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। বুনবুনকে যেতে দেওয়া হয়নি। পুনপুন, বুবু, পুটপুটদিদি সব দিদিভাইয়ের বাড়ি চলে এসেছিল। দু তিনদিন ধরে বাড়ি পরিষ্কার হল। ঠাকুমার জামাকাপড় বিছানা সব নাকি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছাতে কোথা থেকে পেরেক পড়েছিল কে জানে, ঠাকুমার পায়ে সেই পেরেক ফুটে যায়, কাউকে বলেনওনি, কিছুই না। নিজে নিজেই মারকুরোক্রোম লাগিয়ে নিয়েছিলেন। মাঝরাতে গোঁ গোঁ শুনে বাবা মা ছুটে যান, গিয়ে দেখেন ঠাকুমা একেবারে বেঁকে মাটিতে পড়ে রয়েছেন। জ্যাঠাবাবুও অসুখ-বিসুখ শুনে বেরিয়ে এসেছিলেন, তারপর তো ঠাকুমাকে ওষুধ দেওয়া হল, বাবা সুযযিকে বললেন সব্বাইকে ওষুধ দিয়ে দিতে, ঠাকুমা মারা গেলেন, বিছানাপত্রসুদ্ধ বেঁধেছেঁদে ঠাকুমাকে নিয়ে গিয়ে কাশী মিত্তিরের শ্মশানে পুড়িয়ে আসা হল, বাড়িতে সব কিছু ডেটল জলে ডোবানো হয়েছে, সারা বাড়ি মোছা হচ্ছে, পিসিমাই প্রথম খেয়াল করলেন— তোদের জ্যাঠাবাবু কোথায় গেল, অ ইন্দু! ‘আ-র জ্যাঠাবাবু!’ ই-দাদা সারা বাড়ি খুঁজে এসে বলল— ‘জ্যাঠাবাবু ভোঁ কাট্টা।’

অত দুঃখের মধ্যেও কেউ কেউ নাকি একটু একটু হেসে ফেলেছিল।

দিন সাতেক পরে ওইরকমই এক ভোররাতে জ্যাঠাবাবু একটা নতুন চামড়ার স্যুটকেস নিয়ে ফিরে এলেন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি, অত বড় একজন জ্যাঠাবাবু যে কিছুর মধ্যে কিছু না হারিয়ে যেতে পারেন না সেটা সবাই-ই বুঝতে পেরেছিল, তাই ব্যস্ত হয়নি। জ্যাঠাবাবু নিজেই বললেন— বর্মার পরিচিত একজনের খুব বিপদ, ডেকে পাঠিয়েছিল, তাই গিয়েছিলেন। ‘সে কি কেলেঙ্কারি কাণ্ড তুমি ধারণা করতে পারবে না দুগগা।’ বাবা কিছু বললেন না। পালক বলল— ‘একটু বলে গেলে পারতেন জ্যাঠাবাবু। সবাইকে এত চিন্তা করতে হত না।’

তো সেই থেকে ‘কেলেঙ্কারি কাণ্ড’ কথাটা তাদের পারিবারিক তামাশা হয়ে দাঁড়াল। ‘কেলেঙ্কারি কাণ্ড’ কেউ বলবে, অমনি বাকিরা হাসতে শুরু করবে। খালি পমপমদিদি টমটমদিদি এই হাসাহাসির মধ্যে চুপ করে থাকত, যেন শুনতে পাচ্ছে না। নিজের কাজ করছে, শুধু ভুরু কুঁচকে উঠেছে। সামান্য, খুব সামান্য। কেন কে জানে? গুরুজনদের কথা নিয়ে হাসাহাসি করা উচিত নয় বলে? কে জানে! তা মনে হত না। জ্যাঠাবাবু-সংক্রান্ত ব্যাপারে দিদিরা কোনও কথা বলত না। তবে তারা তিনজনে যখন-তখন কথাগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত। দিদিভাই বুনবুনকে নিয়ে হয়তো চার নম্বরে এলেন, বুবু অমনি চুল দুলিয়ে বলল— ‘দিদিভাই এসেছেন, কী কেলেঙ্কারি!’

—‘কেন রে, আমি এলে কেলেঙ্কারি হবে কেন?’ —দিদিভাই জিজ্ঞেস করছেন, বুবু হাওয়া। বিশেষ করে, কোনও অতিথি বাড়িতে এলেই বুবু কথাটা প্রয়োগ করত। আচার শুকোতে দিয়ে পুনপুনকে পাহারা দিতে বলা হয়েছে, পুনপুন বলে ফেলল— ‘কেলেঙ্কারি!’ মা বিরক্ত হয়ে বললেন— ‘কী যে পাকা পাকা কথা শিখেছো!’

এক রবিবারে চার নম্বরে এসে বুনবুন শোনে পিসিমাকে পাওয়া যাচ্ছে না, মানে পিসিমা তাঁর রান্নাঘরে বা ঠাকুরঘরে কোথাও নেই। মা বললেন— ‘দেখ তো বরুণ, অংশু, পাবন… দিদিমণি কোথায় গেলেন।’ ওরা লাফাতে লাফাতে সারা বাড়ি খুঁজছে, আর বলছে ‘পিসিমাকে পাওয়া যাচ্ছে না, কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড! পিসিমাকে পাওয়া যাচ্ছে না কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড, কী কেলেঙ্কারি কা—’ কথা তাদের মুখে আটকে গেছে, কেন না পিসিমাকে পাওয়া গেছে, ঠাকুমার ঘরের মেঝেয় বসে পিসিমা হাপুস নয়নে কাঁদছেন। কাঁদছেন আর ক্ষমা ভিক্ষা করছেন সেজমার ফটোর কাছে। সিপিয়ায় সেই ফটো পালক তুলেছিল। জানলার পাশে ঠাকুমা বসে আছেন জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ঠাকুমার মুখে, গায়ের আলোয়ানে— হাতে ‘সঞ্চয়িতা’। ভেতরের পৃষ্ঠায় আঙুল রেখে বইটা মুড়েছেন ঠাকুমা, গোল গোল সোনা ফ্রেমের চশমার মধ্যে দিয়ে অন্যমনস্ক হাসছেন। আরও দশ বছর আগের গ্রুপ ফটো থেকে ঠাকুর্দার পাশে বসা ঠাকুমার ছবি একটা তৈরি করে নেওয়াই যেত। কিন্তু বাবা বললেন— ‘না, এই ফটোটাই ঠিক ফটো। এইটাই শ্রাদ্ধের ঘরে মালা পরিয়ে রাখা হবে।’ তাই রয়েছে। আজও।

চতুর্থ অধ্যায় : শরণাগত

একটা মহা সমস্যা হয়েছিল বুনবুনের। তার ভাই পুনপুন থাকত আলো-ছায়ার জগতে। সে পরশমণি, ত্রিশূলেশ্বর, য়্যালিস, লীলাময়ী এইসব আজগুবি জিনিসে বিশ্বাস করত। সে ভালবাসত স্মৃতিদের, আদর্শদের, গল্পের মানুষদের। আর বুবুর তো কথাই নেই। সে পুরোপুরিই ছায়ালোকের শিশু। সে বুঝি কোনওদিন বড় হবে না। কোনওদিন হেঁয়ালিতে ছাড়া কথা বলবে না, কী যে তার মনে ঘটছে তার দিশা কেউ কোনওদিন পাবে না। কিন্তু বুনবুন তো তা নয়। সে পুরোপুরি আলোয় থাকে। সব কিছু সোজাসুজি বুঝে নিতে চায়। এটা এরকম, ওটা ওরকম। সিং-বাড়ির সেই তেলমাখাকে বা তার ব্যবহারকে সে ঠিক সমর্থন করতে পারছিল না, আবার শেয়ালদার সেই ঝোলা-গোঁফকেও তার ভাল লাগছিল না। আর সবকিছুর মধ্যে খালি ঘুরে ঘুরে তার মনে আসছিল মিনু আর মিনুর মায়ের কথা। কয়েক দিন পর শেয়ালদা গিয়ে ওরা আর মিনুদের দেখতে পায়নি। দুর্গাপ্রসাদ তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন—ওরা ট্রানজিট ক্যাম্পে গেছে, সেখান থেকে ওদের ব্যবস্থা হবে। বুনবুনের কিন্তু দৃঢ় ধারণা মিনুর মা মারা গেছেন আর মিনু এই শহরের জনারণ্যে ভয়ার্ত চোখ মেলে, মুখ শুকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার জামার পেছনের বোতাম নেই। কাঁধ থেকে জামা খসে খসে পড়ছে, চুলে জট, মাটি মাখা। চোখ-ভর্তি জল। জল শুকিয়ে রয়েছে গালে। ভিক্ষে চাইতে মিনুর লজ্জা করে, কাউকে কিছু বলতে সাহস হয় না। সে এত গাড়িঘোড়ার রাস্তা পার হতে ভয় পায়, কোথায় যাবে জানে না। ফুটপাতে বসলে পুলিশ এসে তাড়া দেয়, অফিস-যাত্রী ভদ্রলোকদের গায়ে ধাক্কা লেগে গেলে তারাও গাল দিয়ে ওঠে। একমাত্র যদি বুনবুন ও দুর্গাপ্রসাদের চোখে সে পড়ে যায়, তবে মিনু বাঁচতে পারে। নইলে তার আর রক্ষা নেই। তর্জনী আর মধ্যমা দুটো আঙুল সে কানুমামুর সামনে জোরে জোরে নাড়ে। তর্জনী ধরলে বুঝতে হবে মিনুরা আর নেই, মধ্যমা ধরলে—আছে। কানুমামু বারেবারে মধ্যমাটাই ধরে। তবুও বুনবুনের বিশ্বাস হতে চায় না।

মিনুকে না পারলেও হারানকে উদ্ধার করবার কৃতিত্ব খানিকটা বুনবুনকে দিতেই হয়। শেয়ালদায় নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে দুর্গাপ্রসাদের আলাপ হত। নবীনবাবু এই রকমই ভদ্রলোক। নাদা পেট, মাথার টাক ঢেকে এক দিকের চুল উল্টোদিকে পাট করে আঁচড়ানো। ইনিই একদিন দুর্গাপ্রসাদকে বললেন—‘আপনি বুদ্ধিমান হৃদয়বান মানুষ, একটা সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন?’

—কী ব্যাপার?

—ঢাকায় আমার এক বন্ধু থাকেন। উনি ওঁর ওয়াইফ আর ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন এদিকে, নিজে জমি-জমার ব্যবস্থা করে হয়তো মাসখানেক পর আসবেন। অতি সজ্জন, ব্রাহ্মণ, আপিসে চাকরি ছাড়াও পুজো-আচ্চার কাজ করতেন। আমার ওপর নির্ভর করছেন। এদিকে আমি তো থাকি মেসে, চালচুলো নেই। সে মহিলাকে তুলি কোথায় বলুন তো?

দুর্গাপ্রসাদ বললেন—মেসে থাকলেও, একটা দেশঘর কিছু তো আপনার আছে?

—কিচ্ছু নেই ডাক্তারবাবু, মা যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন দেশে একটা মাটির ঘর ছিল, মা যেতে সে পাট তুলে দিয়েছি। মহা মুশকিলে পড়েছি। ছোট ছেলে নিয়ে ভদ্রমহিলা…

বুনবুন অমনি বলে উঠল—আমাদের বাড়িতে জায়গা আছে।

নবীনবাবু বললেন—বাঃ, এটা তো ভাল কথা। খোকা ভাল কথা বলেছে।

বুনবুন ভাবছিল মিনু আর তার মাকে রিক্‌শায় করে সে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। মিনুর মা বড্ড রোগা, দিদিভাই কিন্তু সব্বাইকে গঙ্গুর দুধ খাইয়ে মোটা করে দিতে পারেন। আর মিনু? মিনুর জন্যে সে বুবুর ফ্রক এনে দেবে এখন…

দুর্গাপ্রসাদ বললেন—ছোট ছেলে ওর কথা ছেড়ে দিন। আমার বিরাট পরিবার, নিজেদেরই ভালভাবে জায়গা হয় না।

বুনবুন বলল—বারো নম্বরে। বারো নম্বরে অনেক জায়গা আছে…

বাবা একবার চোখ রাঙাবার চেষ্টা করলেন, বুনবুন অবধি সে দৃষ্টি পৌঁছল না।

নবীনবাবু বললেন—আহা ছোট ছেলে, ভাল মনে বলেছে, ওকে বকাঝকা করবেন না। কটা তো দিনের ব্যাপার। তারাপদদার যদি আসতে দেরি হয় আমি যেমন করে পারি একটা ব্যবস্থা করব।

হারানকে সঙ্গে নিয়ে সেই রানি মাসিমার বারো নম্বরে আবির্ভাব। মাথায় ঘোমটা। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দিদিভাই জিজ্ঞেস করলেন—নাম কি তোমার মা?

—রানি—তখনই বুনবুন দেখল একেবারে গঙ্গুর মতন চোখ মাসিমার। এমনি বড় বড়, করুণ।

—স্বামীর নাম?

চুপ করে রইলেন।

নবীনবাবু তড়বড় করে কী বলতে যাচ্ছিলেন। তরুবালা ধমকের গলায় বললেন— আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করেছি?

হারানের মা বললেন—‘ফারাপদ চক্রবর্তী, শ্বশুর ঈশ্বর ফালীপদ চক্রবর্তী।’

নবীনবাবু তাড়াতাড়ি একটা চিরকুটে নিজের মেসের ঠিকানা, তারাপদ চক্রবর্তীর ঢাকার বাড়ির ঠিকানা সব লিখে দিলেন।

—মাসখানেক, তার বেশি লাগবে না। আমি দু-চারদিন অন্তর খোঁজ নিয়ে যাব মাসিমা, যা উপকার করলেন না, এই খোকা যা উপকার করল….

রানিমাসিমা বা তাঁর ছেলে হারান কেউই বিশেষ কথা বলত না। সকালবেলায় উঠেই উনুনে আঁচ দিয়ে দিলেন রানিমাসিমা। তরকারির ঝুড়ি নিয়ে বঁটি পেতে বসে বললেন— কয় পদ রান্না হবে, বইলা যান মা, আমি কাইটা রাখি।

কটা দিন এরকম দেখে তরুবালা বললেন—তুমি এরকম করছ কেন মা, আমি কি তোমাকে রান্নার লোক রেখেছি?

—রান্না তো আপনেই করতাসেন মা,—বিনীত গলায় উনি বললেন। দুপুরবেলা সারাদিনের খাটাখাটুনির পর তরুবালা একটু শুলেই রানি এসে নিঃশব্দে তাঁর পা দুটি কোলে তুলে নেবেন।

তরুবালার বাতের ধাত। টিপেটুপে দিলে ভাল লাগে। কিছুক্ষণ পর তিনি যদি বলেন— থাক আর দিতে হবে না।

রানি বলবেন—কেন মা? ভাল লাগতাসে না?

—ভাল আবার লাগছে না? —তরুবালা চোখ বুজিয়ে হেসে বলবেন—খুব ভাল লাগছে। কিন্তু তুমি আর কত দেবে?

—সারা রাত দিলে যদি আপনের ভাল লাগে, তাই-ই দিতে পারুম, আমার কুনো কষ্ট হইব না। খুব মৃদু গলায় উনি বলবেন।

নবীনবাবু দু-তিনদিন অন্তর আসতে লাগলেন, একদিন আনলেন হারান আর বুনবুনের জন্যে মৌরি লজেন্স। আর একদিন আনলেন তরুবালার জন্যে এক গোছা মিঠে পান আর দুটো নারকোল।

কিন্তু তারপর আর নবীনবাবুর দেখাই পাওয়া ভার। খেয়াল ছিল না, হঠাৎ মনে পড়তে তরুবালা একদিন বললেন—রানি, সেই নবীনবাবু তো অনেকদিন আসেন না, কী হল বলো তো!

রানি মুখ নিচু করে বললেন—উনি আর আইসবেন না মা।

—তার মানে?

—আমার স্বামী হারায়্যা গেছেন গিয়া সেই ছেচল্লিশ সনের দাঙ্গায়। এক সাথে বাইরাই ছিলাম। তো রাতের আন্ধারে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে… আমার কপাল মা, ভাইগ্য, এতগুলান বৎসর ভাইস্যা বেড়াইছি, ওই নবীনবাবুর বাসায় ছিলাম।

—নবীনবাবুর বাড়িতে! উনি যে বললেন উনি মেসে থাকেন।

—না, উনি বাসায় থাকেন।

—মিথ্যে কথা বলেছেন?

—হ্যাঁ।

—তুমি জেনেশুনেও চুপ করে ছিলে?

চুপ করে রইলেন হারানের মা। তারপর পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন— কী বা করি কন, দমদমের ক্যাম্প থাইক্যা আমার স্বামীর নাম কইর‍্যা আমারে লইয়া নিজের বাসায় তুইললেন। কোথা যাই, কী করি মা, থিক থিক করে কুম্ভীর কামট, মাথার ঠিক রাইখতে পারি নাই। কুনটা ভাল কুনটা মন্দ কে তখন আমারে কইয়া দিবে। বৎসরখানেক পর মেদিনীপুর থিক্যা এঁর স্ত্রী খবর পাইয়া আইলেন, আমারে তাড়াইয়া দিলেন। নবীনবাবু আমারে আপনার কাছে গছাইয়া দিয়া গেছেন। এখানে একটু ঠাঁই পাইয়া বাঁইচা গেছি মা, একটু দয়া করেন।

দুর্গাপ্রসাদ নবীনবাবুর দেওয়া ঠিকানায় খোঁজ করলেন। মেস ঠিকই, কিন্তু নবীন সমাদ্দার বলে কেউ সেখানে থাকে না, কোনওদিন থাকেনি। দুর্গাপ্রসাদের বর্মার দাদা মণিমোহন বললেন— তখনই তোমায় বলেছিলুম বাঙালকে বিশ্বাস করো না।

দুর্গাপ্রসাদ গম্ভীর বিষন্ন মুখে বললেন—ঘটিকেই বা বিশ্বাস করতে পারছি কই! তিনি শ্বশুর-শাশুড়িকে আর মুখ দেখাতে পারেন না। শেষে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে একদিন তিনি তরুবালার কাছে গেলেন— ব্যবস্থা হয়ে গেল মা, বুঝলেন!

—কিসের ব্যবস্থা দুগগা?

—ওই হারান আর তার মায়ের বন্দোবস্ত।

—কী রকম?

—আমাদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

—তাই নাকি? থাকবে কোথায়?

—সেজমার ঘরে তো আজকাল দিদিমণি একাই থাকছে, ওখানেই…

হয়ে যাবে…।

—তুমি তাঁর সঙ্গে কথা বলেছ?

—না, তা অবশ্য, তবে আমি আর আপনার মেয়ে মিলে…

—শোনো দুগগা, মনোর নানারকম আচার-বিচার আছে, সে এর ইতিবৃত্ত জানলে বাড়ি ছেড়ে কাশীটাশী চলে যাবে।

—আচার-বিচার তো আপনারও আছে মা!

তরুবালা বললেন—আচার-বিচার কখন খাটে, কখন খাটে না, সেই তফাতটা ভগবানের আশীর্বাদে আমি করতে পারি দুগগা। ‘আতুরে নিয়মো নাস্তি’ বলে একটা কথা আছে না! এ মেয়েটি এমন আতুর যে-কোনও নিয়মই এর বেলা আর খাটবে না বাবা।

দুর্গাপ্রসাদ মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপরে বললেন—আমি আপনাকে বিপদে ফেললুম।

—তুমি আমাকে বিপদে ফেলনি দুগগা। আমাকে যিনি বিপদে ফেলেছেন তিনি হলেন স্বয়ং মধুসূদন। তিনি আমাকে পরীক্ষা করছেন। উনি তো সেদিন নিজে চেয়ে রানির হাতের জল খেলেন।

অনাদিপ্রকাশ এই সময়ে বললেন—মধুসূদন স্বয়ং যার হাত ধরে বাড়ি এনেছেন তিনি সর্বশুদ্ধা সর্বশুক্লা মাতৃস্বরূপিণী কন্যা। দুগগা, তাঁর হাতের জল আর গঙ্গাজলে কোনও তফাত নেই। হতে পারে না। ত্রেতায় তিনি অহল্যাকে উদ্ধার করেছিলেন, দ্বাপরে কুব্জাকে মুক্তি দিলেন, কলিতে সেই তিনিই নবদ্বীপচন্দ্র হয়ে পতিতাকে সন্ন্যাসিনী করলেন…..এ হল তাঁর লীলা।

ইতিমধ্যে প্রচণ্ড বর্ষায় স্কুল যেতে না পারলে বুনবুন হারানের সঙ্গে কাগজের নৌকা ভাসায়, হারান ডাংগুলি ছাড়া আর বিশেষ কিছু খেলতে পারে না, বুনবুন তাকে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন শেখায়। বর্মার জ্যাঠাবাবু ছাড়াই তারা চারজনে বেশ লুডো খেলতে পারে। বুবু, বুনবুন, পুনপুন আর হারান। হারান জানলার গরাদে দুই পা রেখে হুপহাপ করে উঁচুতে উঠে যায়—টিকটিকি ধরে জানলা দিয়ে ফেলে দেয়, মুঠোয় করে আরশুলা নাচায়, পিচিস করে বড় বড় মাকড়সা মেরে দেয়, দেশবন্ধু পার্কের পুকুরে গিয়ে সে সত্যি সাঁতার দেখায় ওদের। খালি পড়াশোনার বেলায় হারান চুপ। পড়ার কথা উঠলেই তার বড় বড় চোখ দুটো শঙ্কায় ভরে যায়। নীচের ঠোঁটে একটা গোঁয়ার্তুমির রেখা ফুটে ওঠে। অথচ বুনবুনের হারানকে নিয়ে প্রচুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। হারানকে বিদ্যাদিগ্‌গজ করে জজ ব্যারিস্টার করে বুনবুন আর কানুমামু দেখিয়ে দেবে সবাইকে। তারা নিজেরা কী হবে যদিও ঠিক নেই। তাছাড়া হারান যে রকম অকুতোভয় ও ঘেন্নাপিত্তিহীন তাতে তাকে ডাক্তার কিংবা সৈনিকও করা যেতেই পারে।

কানুমামু বলে—উত্তাল জল বুঝলি হারান, কলাগাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি তোর শালতি, ঢেউয়ের মাথায় মাথায় এগিয়ে যেতে হবে, পারবি?

হারান বলে—পারুম।

—আর যদি কুমির আসে? —বুনবুন বলে

—কুম্ভীররে আমায় ডর নাই। পিঠে বইসা চোখগুলান গাউলিয়া দিলেই বাস।

পাহাড়েও চড়তে হবে, নর্থ ইস্টে বারো হাজার ফুট পর্যন্ত পাহাড় ধর, সোলজার হতে হলে পিঠে অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে হ্যাভারস্যাকে নিজের মালপত্র নিয়ে খাড়া পাহাড়ের গায়ে হুক গেঁথে গেঁথে দড়ি ধরে উঠে যেতে হবে।

—পারুম। শিখাইলেই পারুম।

—পারুম নয় বল পারব।

—পারব।

—পারবো।

এইভাবে হারানের শিক্ষা এগোতে থাকে। কানু আর বুনবুন স্বপ্ন দেখে দূরভবিষ্যতে জেনারল হারান চক্রবর্তী কোনও এক আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে জার্মানি, তার পর ইংল্যান্ড, তারপর আমেরিকা সব জয় করে ফেলেছে।

—রাশিয়াটা পারবে না, বুঝলি বুনবুন। —কানু বলে।

—কেন?

—রাশিয়ার ভীষণ শক্তি। তা ছাড়া সোভিয়েট রাশিয়া আমাদের বন্ধু, ওরাও কম্যুনিস্ট, আমরাও কম্যুনিস্ট হয়ে যাব, মাস্টারমশাই বলেছেন।

এগুলো সব দূরের স্বপ্ন। কিন্তু হাত বাড়ালেই ধরা যায় এরকম উচ্চাকাঙ্ক্ষাও বুনবুনের আছে। তার ইচ্ছে করে হারানকে বানান লিখতে দিতে—মুমূর্ষু, নূপুর, মধুসূদন, শ্মশান— এইসব। হারান স্বভাবতই পারবে না, তখন সে আচ্ছা করে হারানের মাথায় গাঁট্টা কষবে ঠিক নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই হরিহর সারের মতন খটাস করে। সে তক্কে তক্কে থাকে, কিন্তু কানুমামুর চোখ ফাঁকি দেওয়া শক্ত। হারানের কান্নাতেও তার ভয় আছে অবশ্য। অবলীলায় যে হারান টিকটিকি ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে সেই হারানই সামান্য টেবিলের কোনায় লেগে গেলে বা চিমটি খেলে এমনি হাঁউ হাঁউ করে কাঁদতে পারে যে বাড়িসুষ্ঠু যে যেখানে আছে কী হল কী হল করে ছুটে আসবে। মাসিমা, অর্থাৎ হারানের মা অবশ্য তাকে খুবই উৎসাহিত করেন। বলেন —‘অ বুনবুন। হারানরে একটুক পরাও না। না পারলে কান মুইল্যা গালে দুই চড় কষাইবে। কিস্যু কইমু না।’ তা সত্ত্বেও বুনবুনের ব্যাপারটা সাহসে কুলোয় না। সে আলমারির মাথা থেকে ঝাঁপ খেতে পারে, বলে ড্রপ দিতে দিতে রাস্তা দিয়ে চলতে পারে, পাঁচিলহীন ছাতে ঘুড়ি ওড়াতে পারে, কিন্তু অপরাধ করে দিদিভাইয়ের ধমক খাওয়া? নাঃ, এটা সে বরদাস্ত করতে পারবে না।

দিদিভাই এক ধরনের দেবী যিনি তাকে প্রচুর প্রশ্রয় দিয়ে মানুষ করেছেন। তাতে বুনবুন বেচারির দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। সে আর কানুমামু দুজনে হয়তো একই অন্যায় করেছে, কিন্তু শাস্তি খেলো কানুমামু। কানু যদি বলে—‘বুনবুনও তো করেছে।’ তার উত্তর হবে— ‘তুমি তো বড়, তুমি করলে, ও-ও করবে, তোমার ওকে বোঝানো উচিত। তুমি মামা না?’ এই শাস্তি না-পাওয়াটাও যথেষ্ট শাস্তি বুনবুনের কাছে। তার যেন নিজের কোনও মন নেই, তার হাত-পা যেন কানুমামার নির্দেশে চলে, সে একটা পুতুলের চেয়েও উপেক্ষার বস্তু।

তবে যেবার সে পাশের বাড়ির ফুটুসকে ঠেঙিয়েছিল, সেবার কানুমামু ধারেকাছে ছিল না। দিদিভাই কী করেন? এদিকে ফুটুসের মা রোরুদ্যমান ফুটুসকে নিয়ে বিচার চাইতে দিদিভাইয়ের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সুতরাং বুনবুন শাস্তি পায়।

—মেরেছ?

—হ্যাঁ। কিন্তু ও….

—ওসব শুনতে চাই না। মেরেছ?

—হ্যাঁ।

—মারো, নিজের গালে দুটো চড় মারো, জোরে মারো। নিজের কান মোলো। আর কখোনও যেন এমন না হয়। ‘কখোনও’র সে কী উচ্চারণ! বাপরে!

পঞ্চম অধ্যায় : নষ্ট ভ্রষ্ট দষ্ট ব্রজ

বছর আষ্টেকের নয়েকের একটা ছোট ছেলে কৈশোরের দিকে এগোচ্ছে, তার চারপাশে আদর, আবদার, ভালোবাসার শাসন, তার চারপাশে সদ্য উন্মোচিত খেলাধুলোর পৃথিবী, ইস্কুল্যা বন্ধুদের নষ্টামি-দুষ্টামি জিভে-জল-আনা খাবার-দাবারের অবিরাম সরবরাহ, দুর্গাপুজোর অষ্টমী বিজয়া, নবান্ন পৌষপার্বণ, সরস্বতী পুজোর অফুরন্ত কুল, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ের আম্রোৎসব, অথচ শেয়ালদা স্টেশন তার চেতনা থেকে কিছুতেই সরছে না। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না, কেননা সে খুব সতর্ক থাকে, পাছে কেউ তাকে ‘জ্যাঠা ছেলে’ বলে, পাছে বর্মার জ্যাঠাবাবুর মতো কেউ বলে ওঠে ‘নিজের চরকায় তেল দাও।’ তা ছাড়া এটাও সত্যি কথা যে সে ভুলেও যায়, তার মনের ওপরের স্তর যেটা গঙ্গুর দুধের সরের মতো মোটা, সেই স্তর থেকে ব্যাপারটা চলে যায় সরের স্তরের তলায় ছলছলে তরল দুধের গভীরে। তখন হয়তো সে পরপর তিনখানা ছক্কা মারার আনন্দে ফুলে ফেঁপে ত্রিগুণ হয়ে গেছে, কিংবা হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘মানুষ পিশাচ’ পড়ে ভয়ের শিহরনে সজারুপ্রতিম, কিংবা হয়তো সে একটা লম্বা সরলের অঙ্ক মেলাতে পেরে গর্বের আহ্লাদে আটখানা। কিন্তু অন্য সময়ে আশ্চর্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে শেয়ালদা ফিরে ফিরে আসতে থাকে তার স্মৃতিতে, মিনু ও মিনুর মা জাগরূক থাকে, জুতোয় ওঠা পেরেকের মতো খচখচখচখচ করতে থাকে মিনুসম্পর্কীয় যাবতীয় প্রসঙ্গ।

ব্যাপারটা এইরকম হয়:

প্রথম বসন্তের সকালে তাদের বাড়ির উঠোনের আমগাছটা মুকুলে মুকুলে ভরে গেছে। সবুজ সবুজ কোঁকড়া পাতার মধ্যে থেকে এগিয়ে এসে এলিয়ে পড়েছে এক একটা তামার কোষাকুষির মতো পাতার গুচ্ছ, হারানের মা রান্নাঘর থেকে হাতে একটা খন্তি নিয়ে বেরিয়ে এলেন—আমের বকুল আইসে না? আহ্‌ কী সুবাস! —জোরে প্রশ্বাস টেনে সুবাস নিলেন তিনি— কত আম, কত্ত আমগাছ আমাগ বাগানে, জম্বুরাগুলান লইয়া ফুটবল খেলা হইবার পারত! জাম, জামরুল… হঠাৎ তিনি হুঁশ ফিরে পান, চকিতে আবার ঢুকে যান রান্নাঘরে উনি ‘জ’ ‘য’গুলোকে ইংরেজি ‘z’ উচ্চারণ করেন। খুব ভালো লাগে বুনবুনের। সে যখন একা থাকে, চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে উচ্চারণ করে Zাম, Zামরুল, Zম্বুরা… জম্বুরাটা কী রহস্যময় জিনিস কে জানে! তম্বুরার মতন কিছু হতে পারত, কিন্তু গাছে ফলে যখন তখন তম্বুরা তো নয়। —জম্বুরা কী না জানার লজ্জায় অধোবদন হয়ে যায় বুনবুন, আর অমনি তার কোলের ওপর বিছিয়ে যায় ঘন নিবিড় সবুজ গাছে গাছে গাছাগাছি আম্রমুকুলের গন্ধে সুবাসিত এক কানন, যার শেষ নেই, বিঘার পর বিঘা সে চলেছেই, চলেছেই, সেই ছায়ায় খেলা করছে তার মতো, তার চেয়েও ছোট শিশুরা, কেউ গাছে চড়ে, কেউ ডালে বসে দুলছে, কেউ ফল কুড়োচ্ছে। এই ছবির আদলটা সে জানে না, সে নেয় খানিকটা সেলফিশ জায়ান্টের গল্প থেকে, খানিকটা তাদের হরিপালের সমৃদ্ধ প্রকৃতি থেকে, অথচ তার মনে হয় এ এক অন্য দেশ, অন্য সবুজ, আরও হাজার গুণ সবুজ, যেখানে ফলে থাকে Zম্বুরা, যা লইয়া ফুটবল খেলা হইবার পারত।

হয়তো ভাদ্রের দারুণ রোদে সে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। কখনও কানুমামা, কখনও হারান, কখনও সে সুতো ধরছে, লাটাই ধরছে একজন, সুতো ছাড়তে ছাড়তে নিপুণ হাতে টান দিচ্ছে, কখনও আলগা দিচ্ছে, ঘুড়ি সড়সড় করে শিথিলভাবে নিচু আকাশ পরিক্রমা করছে, এই বুঝি গোঁত্তা খেলো, এই বুঝি… না, চমৎকার শাঁ শাঁ করে উঠে যাচ্ছে তাদের ঘয়লা। তাদের ঘয়লার সঙ্গে পশ্চিম দিক থেকে উঠে-আসা বামনাটার প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে, সুতো ছাড় সুতো ছাড়—বুনবুন, টান দিসনি, যাঃ টানলি তো? ঘয়লা কেটে যাচ্ছে, সাদা-সবুজ ঘয়লা। আকাশ নয়, পদ্মার জল বইছে, সেই আকাশপদ্মার জল দিয়ে অসহায়ের মতো ভেসে চলেছে ঘয়লা, একটা ঘয়লা। না তো! ঘয়লা নয়, একটা ছোট মেয়ের মুখ, মিনু কী? হতে পারে মিনু নয়, কিন্তু মিনুর মতো।

শীতের সন্ধে যখন গুঁড়ি মেরে মেরে বসে উঠোনে আমগাছের তলায়, বাসন মাজার জায়গাটার আশেপাশে, একতলার কলঘরে যাবার পথে, তখন আকাশ বাতাস ফাটিয়ে কে চিৎকার করে ওঠে— ‘কাইটা ফ্যালাইসে, স-ব কাইট্যা ফ্যালাইসে রে-এ-এ।’ কে ও? মুখ দেখা যায় না, খড়খড়ে চুলে, রক্তে, ময়লায় জমাট বাঁধা একটা পরিচয়হীন মুখ, কিন্তু তার তলায় একটা ধড়, আধা ফর্সা ধড়টা, —তাতে একটা স্তন ঊর্ধ্ববৃন্ত হয়ে কার দোয়া চাইছে, অন্য দিকটা শূন্য। একস্তনী এক মা। হারানের মা, রাণিমাসিমা। আর কেউ জানে কি না, দেখেছে কি না বুনবুন জানে না, কিন্তু সে দেখেছে, দেখে ফেলেছে। তার চোখ খুব, নজর তীক্ষ্ণ, তীব্র, কুতূহলী, বিশেষত নারীদের স্তন সম্পর্কে, তার ভীষণ কৌতূহল। সেই যে হারাদিদিমার আলগা চামড়ার থলির মতো স্তন সে দেখেছিল, তার পর থেকে সে কতরকম দেখেছে দেখছে, মায়ের ময়দার পুঁটলির মতো, পিসিমার শাঁখের মতো, দিদিভাইয়ের কুলি বেগুনের মতো, কিন্তু একস্তনী কাউকে সে কখনও দেখেনি। বাঁদিকে রয়েছে, ডান দিকে চামড়াটা কুঁচকে, কালো হয়ে বিকট হয়ে আছে, মাসিমা ব্লাউজের মধ্যে একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ার বল সেলাই করে নিয়ে পরেন, রোজ। গরমের দিনের দুপুরবেলায় কোত্থাও কেউ নেই ভেবে তিনি ব্লাউজ খুলে ফেলেছিলেন, তখন বুনবুন, সর্বত্রসঞ্চারী দুপুরবিহারী বুনবুন দেখে ফেলে, মাসিমা আতঙ্কে কাপড়-ঢাকা দিয়ে দিলেন বুকে। তারপর বললেন—ভয় পাইসস্‌? জন্ম হইতে তুমার মাসিমা এমুন নয় বুনবুন, উরা কাইটা দিসে।

এ কী আতঙ্ক? এ কী বিকট ত্রাসের করাল ভয়াল মূর্তি! কাটা মুণ্ড সে কল্পনা করতে পারে, কেন না মা কালীর গলায় থাকে মুণ্ডমালা, হাতে চুল ধরে একটা কাটা মুণ্ড ঝুলিয়ে রাখেন তিনি। ডাকাতের বইতে, ইতিহাসের বইতে সে এ-ও পড়ে থাকে— ঘ্যাঁচ করে তরোয়াল চালিয়ে মুণ্ডু কেটে ফেললো কেউ কারণ, শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে মুণ্ডু রণক্ষেত্রে গড়াগড়ি খাচ্ছে— এমনটাও সে কল্পনা করতে পারে। কিন্তু স্তন? নারীর, মায়ের স্তন? কে কাটল? কেন কাটল? কেন? কেন? কেন? অসাবধানে মুণ্ডু কাটতে গিয়েই কী? নাঃ স্তন খুব সুরক্ষিত, নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে, বুনবুনের মতো কৌতূহলী পাকা ছেলে ছাড়া আর কেউ তাদের দেখতেই পায় না, তা হলে? তা ছাড়া ‘উরা কাইটা দিসে’, এর থেকে কী বোঝায়? ইচ্ছে করে, সাভিপ্রায়ে, কাটবে বলেই কেটেছে।

অতএব ঘুমের মধ্যে বুকে হাত পড়ামাত্র বুনবুন মাসিমা হয়ে যায়, হারানের মা। রুদ্রমূর্তি কোনও আতঙ্ক এসে তার ডান দিকের স্তন কেটে দেয়। স্তন নয়, স্তনরাজি। হাজার হাজার মেয়ে, লক্ষ লক্ষ, সংখ্যা করা যায় না এত একস্তনী নারী। তার মধ্যে তার দিদিভাই, মা, পিসিমা, দিদিরাও কি নেই? আছে। একরকম দেখতে নয়, কিন্তু কেউ বলে দেয় ওই তো ওই তো পমদিদি, ওই যাচ্ছেন দিদিভাই, মা, মা গো! ওই যে মা তার হৃদয়ের অধিশ্বরী মা যাচ্ছেন, সবাই, সব্বাইকার স্তন কাটা গেছে। —‘শুনো বুনবুন, কাউরে বলবা না, হ্যাঁ?’ —মাসিমা বলেছিলেন। সে ছোট ছেলে, যুক্তি তো গুছিয়ে বলতে পারে না, কিন্তু তার ছোট্ট করে মনে হয় কেন? কেন? কোনও পাপে তো মাসিমার এমন হয়নি! তবে কেন তিনি সব্বাইকে বলে দেবেন না? কারও ওপর কেউ অন্যায় অত্যাচার করলে কাউকে বলে দিতে হয়, নালিশ করতে হয়। মাসিমা কেন তার অন্যথা করছেন? —‘বলব না তো?’ —সে কিছু বলেনি, খুব সম্ভব তার চোখের জিজ্ঞাসাটা পড়তে পেরেই গঙ্গুর মতো নিষ্পাপ করুণ বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন— ‘নিজেরে অপয়া অমনিষ্যি লাগে বাবা, তুমি ছুট ছেলে বুঝবা না।’

বুবুও ছোট মেয়ে। যারা কিছুই না বোঝার দলে। কিন্তু না বুঝলেও তাকে বইতে হয়, অনেক ভার অনেক বোঝা। কতটা সেটা বড়রাও তো বোঝেন না। সকলেই বলে জ্যাঠাবাবু বুবুকে বড্ড ভালোবাসেন। যখনই কোথাও বেড়াতে যাবেন মণিমোহন বুবুকে নিয়ে যাবেন। সেইসব বর্মা প্রত্যাগত বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায়। বুবু কিছুক্ষণ গল্প শোনে, তারপর সে আশেপাশে বইয়ের র‍্যাক খুঁজতে থাকে। কারও কারও বাড়ি চমৎকার চমৎকার বই থাকে। অনেক ছবিঅলা। সেই বই নিয়ে সে কোনও একটা কোণে বসে থাকে। ইংরেজি তাকে খানিকটা বানান করে করে পড়তে হয়। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’তে সে পড়ে ক রাজা। তাঁর সাত রানী। বড় রানী, মেজরানী, সেজরানী…। ক রাজাটা কী ব্যাপার কৌতূহল সামলাতে না পেরে সে একদিন পুটপুটদিদিকে জিজ্ঞেস করেছিল— ‘কী আশ্চর্য। তুই এখনও এক ভুল করেছিস? আরও ছোটবেলায়ও তুই ক রাজা পড়তিস৷ এটা ‘ক’ নয় ‘এক’। এই দেখ ‘এ’টা বড় করে ছবির মধ্যে লুকোনো আছে। অর্থাৎ কিনা বুবুকে একটা পথ দুবার পার হতে হচ্ছে। তা সে যাই হোক, জ্যাঠাবাবুর বন্ধুদের বাড়িতে বেশির ভাগই ছোটদের বই থাকে না, থাকে ইংরেজি বুক অফ নলেজ। তাতে ছবি আছে। কিন্তু অত মোটা বই বুবু ঠিক কায়দা করতে পারে না। কিছুক্ষণ ওলট-পালট করবার পর তার ঘুম এসে যায়। কেউ তাকে কোলে নিয়ে কোথাও শুইয়ে দেয়। ঘুমের মধ্যে তার গায়ে মাকড়সা হেঁটে যায়। তাকে সাপে ছোবল মারে, ভয়ের চোটে চটকা ভেঙে গেলে দেখে জ্যাঠাবাবু বসে আছেন, —কী হল বুবু? ভয় পেলে? এই তো আমি পাশে বসে রয়েছি।

জ্যাঠাবাবু বুবুকে নিয়ে থাকেন বলে বাড়ির সবাই ভারি নিশ্চিন্ত। বুবুকে নিয়ে যে কী করা যায় তা তো কেউ ভেবেই পায় না। বুনবুন পুনপুনের ভাগে পড়াশুনো, খেলাধুলো, দাদা-দিদিদের ভাগে কত কাজ, কতবার বাইরে যাওয়া, কতবার ক্লান্ত হয়ে বাড়ি আসা, বুবুর ভাগে শুধু অকারণ ছেলে ভুলানো আদর আর প্রশ্রয়। সে তো ভগ্নাংশ বুঝতে পারে না, যুক্তাক্ষর নিয়ে সমস্যায় পড়ে, গান গাইতে সে ভালবাসে কিন্তু তার অসামান্য হেঁড়ে গলা, সুর থাকলেও তালজ্ঞান তার আর কিছুতেই হচ্ছে না। কে তাকে অত সময় দেবে? তার চেয়ে জ্যাঠাবাবু তাকে গল্প বলেন—অস্ট্রেলিয়ান ভূতের গল্প, কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের গল্প, লক্ষ্মী স্বামীনাথন আর ক্যাপটেন সায়গলের গল্প, নজরুলের গান, শিশির ভাদুড়ির অভিনয়—আরও কত কত কত। জ্যাঠাবাবুর মাথা ধরে ভীষণ, বুবু তার ছোট ছোট হাতে সেই ধরা কপাল টিপে দেয়, টিপতে টিপতে হাত ব্যথা হয়ে যায়, তখনও জ্যাঠাবাবু ‘আর দিতে হবে না’ বলেন না। জ্যাঠাবাবুর পা-ও তাকে টিপতে হয়। শক্ত শক্ত মোটা মোটা পা, খুব লোমঅলা।

—তোমার জ্যাঠাইমা আমার পা টিপে দিতেন বুঝলে বুবু? রোজ। এটা আমার একটা অভ্যেস। তবে জ্যাঠাইমা তোমার থেকে অনেক ভাল দিতেন। সে হাতের তারই আলাদা। সতী, সাবিত্রী, সাধ্বী ছিলেন তিনি, মাথায় ডগডগে সিঁদুর নিয়ে চলে গেলেন, বলে জ্যাঠাবাবু দেয়ালে টাঙানো জ্যাঠাইমার অয়েলপেন্টিং-এর দিকে তাকান। —বুবুও তাকায়। সাবিত্রী-সত্যবানের ছবি সে মামারবাড়িতে দেখেছে, সেই সাবিত্রীর সঙ্গে জ্যাঠাইমাকে ঠিক মেলাতে পারে না সে, আর সতীকে তো শিব কাঁধে নিয়ে দেদার ছুটছেন, এই জ্যাঠাইমা যে বড্ড মোটা, বড্ড ভারী, শিব তো ওঁকে… কিন্তু জ্যাঠাবাবু বলেন— তুমি বুঝলে বুবু পুরোপুরি না হলেও জ্যাঠাইমার মতো খানিকটা; —জ্যাঠাবাবু তাকে এত চটকান যে বুবুর কষ্ট হয়। সে বলে ‘উঃ।’

—লাগল? —জ্যাঠাবাবু তাকে এক খিলি নকুলদানা দেন।

মা খোঁজ নেন না, দিদিরা খোঁজ নেয় না, বাবা খোঁজ নেন না। বুনবুন-পুনপুন মাঝে মাঝে নেয়। সব সময়ে তাদের সঙ্গে খেলতে যেতেও সে পারে না। ছোট্ট বুবু বর্মার জ্যাঠাবাবুর ক্রীতদাসী। ছোট্ট, অবোধ ক্রীতদাসী এক।

কড়া চুরুটের গন্ধ। চাপ চাপ কাঁচাপাকা বাবরি চুলে জবাকুসুমের কড়া গন্ধ, ড্রেসিং গাউনটা কতদিন কাচা হয় না, তার শুঁটকে গন্ধ… বুবু সইতে পারে না, কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা যে তার জানা নেই। নেই কী? সত্যিই নেই?

সবাই খেতে বসেছে। জ্যাঠাবাবু বাবা থেকে পুনপুন বুনবুন পর্যন্ত। মা, পিসিমা, পরিবেশন করছেন মস্ত মস্ত গলদা চিংড়ি সবার পাতে। বুবু দু হাতে চিংড়ির মাথার খোলা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল— ‘এই জ্যাঠাবাবুর টিনের কোট ছাড়ালুম।’ দাড়াগুলোকে সাপটে ধরে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে— ‘এই জ্যাঠাবাবুর গোঁফ ছিঁড়ছি, চুল ছিঁড়ছি।’ তারপর চিংড়ির ল্যাজের দিকটা তুলে ধরে বলে—‘এই জ্যাঠাবাবুর ন্যাজ বেরিয়ে গেছে।’

—বুবু কী হচ্ছে? মা ধমক দেন।

—আরও আদর দাও! —পিসিমা বলেন,

—বুবু অমন বলতে নেই। বাবা বিধান দেন।

জ্যাঠাবাবুর খাওয়া আজ তাড়াতাড়ি চুকে যায়। কোনটা আরও তরিবত করে রান্না উচিত ছিল, কোনটা উতরে গেছে, কোনটার ‘তা তাঁর’ স্বৰ্গত স্ত্রীর মতন হয়নি, সেই মন্তব্যগুলো অসমাপ্ত রেখে তিনি উঠে যান। তার আধ-খাওয়া পাতের দিকে তাকিয়ে বাবা, চুক চুক করে আক্ষেপের শব্দ করেন জিভে। বুবু এসব কিছুই দেখে না। সে ততক্ষণে চিংড়ির ল্যাজের খোলটা ছাড়িয়ে ফেলেছে। ‘খোলস ছেড়ে জ্যাঠাবাবুর আসল ন্যাজ এইবার তোমার দিকে তেড়ে আসবে বুবু বলে দিচ্ছি কিন্তু।’ আপন উপকথায় আপনি মগ্ন বুবু।

এইবার দেবহূতি কেমন অদ্ভুত ভয়-পাওয়া চোখে চেয়ে থাকেন বুবুর দিকে। পমপমদিদি খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে, সে কড়া চোখে বুবুকে দেখছে।

খাওয়ার শেষে বাড়ির পুরুষদের অলক্ষ্যে, অজান্তে পমপমদিদিদের তিনতলার ঘরে দেবহূতি আর তাঁর বড় দুই মেয়ে মিলে ছোট মেয়ের বিচারসভা বসান। দরজার অন্তরালে কী সওয়াল জবাব চলে কেউ জানে না। কিন্তু দেবহূতি সেদিন খান না। রাত্তির থেকে বড় দুই মেয়েও খায় না। বুবুকে নিয়ে বুজবুজদিদি মামারবাড়ি চলে যায়।

দুদিন লাগাতার উপবাসের পর মনোরমা দুগ্‌গিকে জানাতে বাধ্য হন দেবু এবং পম, টম খাচ্ছে না।

—সে কী? কেন?

—ওরা বলছে, মণি এ বাড়িতে থাকলে ওরা জলগ্রহণ করবে না।

দুর্গাপ্রসাদ এত ধাক্কা কখনও খাননি। এ কী প্রহেলিকা! কিন্তু তাঁর স্ত্রী কোনও কথারই জবাব দেন না।

—খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বড্ড খিচির-মিচির করে বলে?

—না।

—যা টাকা দিচ্ছে কুলুতে পারছ না তাতে?

—ছিঃ।

—না, সত্যিই ওর খাঁই বড্ড বেশি। কিপটেও খুব।

—ও সব না।

—তবে?

—আমি উচ্চারণ করতে পারব না সে কথা, আমার মেয়েরাও পারবে না। তুমি আর দিদিমণি ঠিক করো কী করবে।

মনোরমা বললেন, বলতে লজ্জা করে ঘেন্নাও করে দুগ্‌গি ও মণির একটু বাথরুমে, জানলায় উঁকিঝুঁকি দেওয়া অব্যেস আছে, পাশের বাড়ির অবিনাশবাবুর পরিবারও রাগ করছিলেন। তো সে তো আমিই মেয়েদের কবেই সাবধান করে দিয়েচি। আমাদের বুবুমণিকে ওরা মায়ে-ঝিয়ে ঘর বন্ধ করে কী যে মারধর করল, তার পর বারো নম্বরে বেয়ানের কাছে… বলতে বলতে মনোরমা চুপ হয়ে হয়ে গেলেন। তাঁর মুখ নিচু হয়ে গেল, ঠোঁট বেঁকে গেল। শুদ্ধান্তঃপুরচারিণী, জন্মশুদ্ধা তিনি তাঁর নিজেরই বিবেচনায়। এখন বৃদ্ধ, কিন্তু একদিন অল্পবয়স্কা কিশোরী ছিলেন, ছিলেন সেজমার অনন্ত পাহারায়, যা কুটিল, কুৎসিত, বিকৃত তা সহসা বুঝতে তাঁর একটু অসুবিধে হয়। কিন্তু সত্যটা এখন লোহার ফলার মতো বিঁধে গেল তাঁর বুকে। তিনি বলে উঠলেন— ‘তাড়া দুগগি, এখ্‌খুনি তাড়া ওই মুখপোড়া মিনসেকে। নইলে আমি ওবাড়ির পাকুমার মতো প্রায়োপবেশনে বসব।’

দুর্গাপ্রসাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনিও বুঝেছেন। তাঁর বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। তাঁর ছোট মেয়েটা, অবোধ, অবোলা…ইসস্‌স্‌। মেজদা বলে এই লোকটা যখন বর্মা থেকে আসে সেজমা বলেছিলেন— সংসারে তৃতীয় ব্যক্তির অধিষ্ঠান ভাল নয় দুগ্‌গি।

শিবপ্রসাদ প্রতিবাদ করেন— মেয়েমানুষ মানেই বড্ড ছোট মনের হয়। ছোটগিন্নি তোমার থেকে এটা আশা করিনি কিন্তু। এত পড়াশুনো করো…

—পড়াশুনো করি বলেই চোখ কান বুজে সংসারে থাকি মনে করো নাকি? তা ছাড়া হয়তো পড়াশুনো করি বলেই একটু জ্ঞানগম্যি হয়েছে। মণিমোহনের কতটুকু-বা আমরা জানি। এক বংশ হলেও এক পরিবার নয়। তা ছাড়া ওর তো পয়সাকড়ির অভাব নেই শুনছি। একটা বাড়ি ভাড়া করে ঝি-চাকর রেখে থাক না। তোমরা খোঁজখবর রাখবে।

সেজমার কথা শিবপ্রসাদ বা তাঁর ছেলে কারওই ভাল লাগেনি। দুর্গাপ্রসাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কৃতঘ্নতার কোনও বাঙাল-ঘটি নেই। অপ্রিয় কর্মটি তাঁকেই করতে হবে। কী ভাবে করবেন?

ষষ্ট অধ্যায় : ডার্ক নাইট অফ দা সোল-১

শূন্যতার ধারণা আছে আপনাদের? একটা বিশাল ঘুরন্ত শুন্যতা! যত দূর চাও ধু-ধু করছে কিছু নেই। অনেক অনেক দূরে কিছু ধূমল উচ্চাবচ রেখা দেখা যায় বটে, কিন্তু তা-ও সম্পূর্ণ ন্যাড়া, অস্পষ্ট। আহ্বান করে না তেমন। কোনও আশ্রয়ের সন্ধানও দেয় না। মেনিনজাইটিসের জ্বরের ভীষণ ঘোরেও সে একা ছিল না কিন্তু। পক্ষীরাজ ঘোড়া ছিল, সন্ন্যাসীঠাকুর ছিলেন, কালপেঁচা বিছে এরা দুশমন তবু তো চেতন প্রাণী, —ছিল রাক্ষস খোক্কস দৈত্য দানা, তাদের সঙ্গে প্রাণপণ সংগ্রাম ছিল। কিন্তু এখন নিঃশব্দ নিশ্চল নির্জন নিশ্চৈতন্য দিয়ে তৈরি এক মহাশূন্যে সে একা। মামারবাড়িতে সে তো কতই এসেছে, এসেছে থেকেছে, সে তো খুব ভালবাসে মামারবাড়ি আসতে, কিন্তু এ আসা তো আসা নয়, নির্বাসন। ছোট্ট বুবু বুঝতে পারছে না তার হাওয়া-বদল করা হয়েছে। অপ্রীতিকর অনেক কিছুর থেকে আড়াল করবার জন্যেই তাকে মামারবাড়িতে পাঠানো হয়েছে। জীবনে একবার মাত্র পুনপুনের সঙ্গে কোনও খেলনার অধিকার নিয়ে মারামারি করায় বাবা তাকে তুলে আছাড় মেরেছিলেন। ‘তুলে আছাড়’ বাবা কথায় কথায় বলতেন। কিন্তু সত্যি সত্যি কি আর আছাড় মারা সম্ভব? সে এক কংসরাই পারে। বাবা একবার শূন্যে তুলে, শোঁ করে মাটিতে নামিয়ে দিতেন, দাঁত কিড়মিড় করছেন এদিকে। এই হল গিয়ে তুলে আছাড়। কান ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকারও প্রচুর অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। কিন্তু দরজা বন্ধ করে মা এবং দিদিরা তাকে নানা খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করবেন, সে কেন এসব কথা আগে বলে দেয়নি বলে ভীষণ ধমকাবেন, চুলের ঝুঁটি ধরে পিঠে দুই থাপ্পড় দেবেন মা, পমপমদিদি কান মুলে দেবে কড়কড়িয়ে, টমটমদিদি যে তার শেষ আশ্রয় এমন কি সে-ও তাকে নিষ্ফল ক্রোধে মারবে, এসব তো সে কল্পনাও করতে পারে না। সে তো বুঝতে পারেনি থাপ্পড়টা মা নিজের গালেই মারছেন। পমপমদিদি টমটমদিদি মারছে কোনও এক ভিলেনকে, কুচি-কুচি করে যাকে কাটলেও তাদের রাগ যাবে না—এত কিছু তার অপরিণত মগজে ঢোকা তো সম্ভব নয়। সে সুতরাং পরিত্যক্ত। আর কোনওদিন মাতৃমুখ দেখবে না, আর কোনওদিন সেই প্রিয় পরিচিত সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করবে না, পিতৃপরিচয় নেই তার।

বুজবুজদিদি তাকে পৌঁছে দিয়ে সে-রাতটা থেকেছে। তার পাশে শুয়ে শুয়ে গান করেছে—‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ বুবুর মনে হল বুজবুজদিদি কথাগুলো তাকেই বলছে। সে ডাকবে, কেউ আসবে না। বুনবুন-পুনপুনও না, তাকে একলা চলতে হবে। কেউ ফিরে চাইবে না। সব্বাই মুখ ফিরিয়ে নেবে, কাঁটাঅলা পথে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, তার পা কেটে যাবে তবুও তাকে চলতেই হবে, চলতেই হবে। চলে যাবে সে দূরে তার পরিচিত প্রিয়জনদের কক্ষপথ ছেড়ে কোন দূর নীহারিকায়… ‘তবে বজ্ৰানলে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলো রে…’ এ গান তুমি কেন গাইলে বুজবুজদিদি? কেন গাইলে? পিসিমা বলেন খুব পাপ করলে তবে বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়। বজ্র যদি বুকের পাঁজরের ওপর পড়ে তখন তো বুবু মরেই যাবে? নাকি সে পাপী বলেই তার পাঁজরগুলো জ্বলবে, আর সেই জ্বলন্ত পাঁজর নিয়ে তাকে চলতে হবে আমৃত্যু?

তুমি? তুমিই বা কেন এ গান লিখলে রবি ঠাকুর। তুমি অতদিন আগে জানতে পেরেছিলে একটা ছোট্ট মেয়েকে তার জীবনের সারসত্য শোনাতে হবে, জানাতে হবে, এক নির্মম দিকশূন্য মুহূর্তে? তুমি, একমাত্র তুমিই তবে গেছ ওইরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে? তুমিও একটা ছোট মেয়ে যার চুরুট-খাওয়া, জবাকুসুম মাখা, নকুলদানা-দেওয়া, কেঁচে-খেলা একটা বর্মার জ্যাঠাবাবু ছিল যে তোমাকে অকথ্য পাপে লিপ্ত করেছিল, আর তুমি পিতা-মাতা দাদা-দিদি কর্তৃক পরিত্যক্ত, নির্বাসিত হয়েছিলে? তাহলে তো রবি ঠাকুর তুমিই একমাত্র আমার বন্ধু হতে পার! রবি ঠাকুরের খোঁজে তখন বুবু যাত্রা করল। আগেই সে চলে এসেছে তার পরিচিত পৃথিবী থেকে অনেক অনে-ক দূরে। বুক ভাঙা এক গান মনে মনে গাইতে গাইতে সে ছুটে চলেছে—‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা, আমি যে পথ জানি না।’ গাইছে আসলে বুজবুজদিদি, একটার পর একটা গেয়ে যাচ্ছে। গাইছে তার আপন মনের কী এক শরণাগতির তাগিদে, কিন্তু প্রত্যেকটা গান তার এক বিশেষ অর্থ নিয়ে ধরা পড়ছে বুবুর শ্রবণে, আধ-ঘুমন্ত চেতনায়। সত্যিই কি সে ঘুমোচ্ছে? সত্যিই কি সে ঘুমোচ্ছে না?

ওই দেখো সে চুপচাপ চোখ বুজিয়ে শুয়ে আছে তার বুজবুজদিদির পাশে। তার বোজানো চোখের তলায় শুকনো জলের দাগ। ঘুম নয়, ঘোর। এই ঘোরের মধ্যে বুজবুজদিদির গান তার নিজের গাওয়া গান বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে তার কাছে। কী অপরূপ টান যে সে দিচ্ছে গলার। এ রকম কণ্ঠ সে কোথায় পেল? এমন করে সে কী করে ডাকতে পারছে তাকে? কাকে ডাকছে? রবি ঠাকুরকে ডাকা দিয়েই হয়তো তার ডাক শুরু হয়েছিল। কিন্তু রবি ঠাকুরের পুরো চেহারাটা চেতনায় ধরা দিতেই তার অন্তর কেমন গুটিয়ে যায়। জোব্বা পরলে সব মানুষকেই কেমন একরকমের দেখায়। চিলিবিলি জোব্বার মতন অত খারাপ না দেখালেও ভাল না, ভাল না একদম। সেই যে ছবি আছে রবি ঠাকুরের রুপোলি দাড়ি, রুপোলি চুল, চোখের তলায় একটু দুঃখী-দুঃখী কালি? সেই মুখটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে বুবু কিন্তু দেহকাণ্ডহীন মুণ্ড কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবে, কুয়াশায় মিলিয়ে যায়। তারপর ভেসে ওঠেন একজন সোনালি চুলের সোনালি দাড়ির মানুষ, কিন্তু হায়! তাঁর মুখ বুকের ওপর নত হয়ে পড়েছে, চোখ দুটি দেখা যায় না, টপটপ করে রক্ত পড়ছে তাঁর টান-করে বাঁধা দুই হাতের তালু থেকে, জড়ো করা দুই পায়ের পাতা ফুঁড়ে। এই মানুষ, বড় মানুষ হয়েও যিনি বালকের মতো অসহায়, তাঁকে তো তাকেই আশ্রয় দিতে হবে, উনি আর বুনবুন-পুনপুন তো একই? পুনপুন-বুনবুনের হাত পায়ের রক্ত সে ছাড়া কে মোছাবে আর? ঠাকুমার টেবিলের বেলেপাথরের বুদ্ধমূর্তি দশ মানুষ সমান উঁচু হয়ে এবার দূরে দেখা দেয়। ছোট মেয়েটি সেই কোলে আশ্রয় নেবার জন্য তাঁর পাদপীঠ বেয়ে উঠতে থাকে, উঠতে থাকে, রক্তমাংসের স্পর্শ পায় না। হিম-ঠাণ্ডায় তার অন্তরাত্মা জমে যেতে থাকে, আর সেই পাথরের দেবতার কোলে সে যখন পৌঁছয় তখন সে বুঝতেই পারে না সেটাকে কোল বলে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কতকগুলো বিরাট পাথরের ভাঁজ, তার মধ্যে একটা পিঁপড়ের মতো হারিয়ে যায় সে|

আর ঠিক সেই সময়ে বুজবুজদিদি রিনরিন করে গেয়ে ওঠে—‘শুধাই আমি পথের লোকে/এই বাঁশিটি বাজালো কে/নানান নামে ভোলায় তারা, নানান দ্বারে বেড়াই ঘুরে।’… ঘোরের মধ্যে তখন নীল নীল ঝলক আসে। নীলাভ দ্যুতির ঢেউ। আকার নিতে নিতেও নেয় না, নীল মেঘের মতন, নীল কুয়াশার মতন, নীল জলের ফোয়ারার মতন ভেসে যায় জমাট বেঁধে যায়, উৎসারিত হয়। অদ্ভুত সুর ছড়িয়ে পড়ে সে নীলের মধ্যে থেকে। তখন সে আর দৌড়য় না, ওড়ে। নীচে পড়ে থাকে তার ঘাটা আঘাটা নিয়ে আকাট পৃথিবী। সে শূন্য দিয়ে পাল উড়িয়ে দাঁড় বেয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে সেই নীল মেঘের বুকে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।

এখন, বুবু যে সত্যি-সত্যিই কাউকে চিনতে পারছে না, এটা অনেকক্ষণ কেউ বোঝেনি। প্রথমত সে সকালে অনেক বেলা করে উঠল। তাদের বাড়িতে সবাই ভোরে ওঠে। একমাত্র সুযযির একটু গড়িমসি করা অভ্যেস। অনেক সময়ে তার দিদিরা বোনেরা তার কানের কাছে কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে তাকে ঘুম থেকে তোলে। কেউ জানে না সে রাত জেগে তার ল্যাবরেটরি ঘরে পড়ে আর দিনের বেলায় চাকরি করে। তাই তার বেলা হয়। বুবু পুনপুন যদি সাতটা বাজিয়ে ফেলল উঠতে তো টমটমদিদি তুলতে এলে পমপমদিদি রাগ করে বলবে ‘ঘুমোক, দেখা যাক কত ঘুমোতে পারে। আটটা অবধি ঘুমোক।’ সেই বুবু যখন বেলা নটাতেও পাশ ফিরে শুলো, দিদিভাই বললেন—‘ওকে এবার ডেকে দে তো শ্রদ্ধা, খাবেদাবে না?’

ঘুম থেকে উঠল বটে বুবু কিন্তু বসে রইল এক কোণে জড়সড় হয়ে। বুনবুন মাজনের কৌটো হাতে করে তাকে সাধতে লাগল—‘যা বুবু মুখ ধুয়ে আয়।’ একটু পরে সে অনিচ্ছুকভাবে উঠল, নীচে কলতলার দিকে না গিয়ে সদরের দিকে যেতে লাগল। বুনবুন সঙ্গে ছিল, বলল—‘কোথায় যাচ্ছিস, এই বুবু। এখনই কি বাড়ি যাবি নাকি?’

দিদিভাই আদর করে বললেন—‘যাও দিদিভাই মুখ ধুয়ে এসো, চান করে এসো।’ বুনবুন সঙ্গে করে তাকে কলতলায় নিয়ে যায়। চান করে এসে সে অবশ্য চুপচাপ খেয়ে নিল। তারপর সিঁড়ির তলার ধাপে বসে রইল।

রানিমাসিমা বললেন,— ‘যাও বুবু মা, বুনবুনদের ঘরে যাও।’

সে সংক্ষেপে বলল—আমি তোমাদের বাড়ি চিনি না।

দু দিন ধরে সবাই ভাবছে বুবুর বড্ড অভিমান হয়েছে, তাই এমন চিনি না জানি না করছে, ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না, তৃতীয় দিনে যখন দাদাভাইয়ের ডাকেও সে সাড়া দিল না, তার চোখের শান্ত শূন্য দৃষ্টি দেখে দিদিভাই বললেন—‘কানু শিগগিরই একবার ওবাড়ি গিয়ে তোর জামাইবাবুকে ডেকে আন তো।’

বাবা দেখে শুনে কানুকে আবার পাঠালেন—মাকে ডেকে আনতে। এমনিতেই দেবহূতি ছোট মেয়েকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারেন না। আজকে আসবেনই ভেবেছিলেন। বুবু মাকে চিনতে পারল না।

বুবু কে সে জানে না। যিনি বলছেন তিনি তার মা, তাঁকে তার খুব চেনা-চেনা লাগছে, কিন্তু সে ঠিক মনে করতে পারছে না। বাবাকে, দাদাভাইকে দেখলে সে ভয় পাচ্ছে।

শীত চলে যেতে শুরু করেছে এখন। হাওয়ায় একটা সিরসিরোনি। শীতের ধুলোর পরত গাছে গাছে, পাঁচিলে, জানলার কার্নিশে জমে জমে কেমন মলিন করে দিয়েছিল সব। এইবার উড়ে যেতে শুরু করেছে। ফাল্গুনের গোড়ায় একদিন বেশ ভারি বৃষ্টি হল। বৃষ্টিটা পাঠানো হয়েছিল ধুলো-ময়লা সাফ করবার জন্য, হাওয়ায় মিশে থাকা ধোঁয়া কালি কয়লার গুঁড়ো সব এক এক ঝাপটে মাটিতে ফেলে স্রোতের বেগে সব ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। গুঁড়ি গুঁড়ি পাতা বেরোচ্ছে গাছে গাছে। সারাদিন একটা মন-কেমন-করা রোদ, মন-কেমন-করা হাওয়ায় পৃথিবীর যতেক প্রাণীর মন হুহু করতে থাকে। কেউ যেন কারও নয়। আসল আপনজন, ভালবাসার নির্ভরের মানুষ কোথায়, কত দূরে, কিসের যেন আড়ালে হারিয়ে আছে। তোমার আসল বাড়ি, আসল জায়গা এখানে নয়। সন্ধের অন্ধকারে তার ভয় করে না। ছাতে উঠে সে রুপোর গুঁড়ো-ছড়ানো আকাশটার দিকে চায়। চেয়েই থাকে, চেয়েই থাকে। ওই আকাশই যেন তার একমাত্র চেনা। তাকে বলে দিতে পারবে সব হারানো কথা, লুকোনো কথা।

তুমি কি বলে দেবে আমি কে? কে আমি? কোথা থেকে এসেছি? কেন এখানে আছি? এই যে আমার চারপাশের মানুষরা… ওরা কারা? কোথায় ছিল? হঠাৎ কেন হাজির হল আমার চোখের সামনে? ওরা কেউ আমাকে বলছে বুবু, কেউ বলছে বিদ্যা। সেই যে একজন কপালে সিঁদুর-টিপ পরা, মাথায় ঘোমটা মানুষ এসেছিলেন! কত সুন্দর, অথচ তাঁকে দেখে তার কেমন ভয়-ভয় করছিল। উনি ওকে ডাকছিলেন বিদ দা! বিদ-দা! কী অদ্ভুত ডাক! আমি বিদ্‌দা নই। বিদ দা হতে চাই না। উনি কত করে বিদ দাকে নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু সে তো বিদদা নয়, কেন যাবে? তার চেয়ে এই মাসিমা বলে মানুষটি, দিদিভাই বলে মানুষটি, ওই দুটি ছোট ছোট ছেলে গৌর নিতাই দুই ভাই আবার যেন দেখা পাই। হারান বলে ওই খোকাটা… এরা তাকে আশ্রয় দিয়েছে, আত্মবিস্তৃত একটা মানুষকে, এই আশ্রয় আঁকড়ে পড়ে থাকা ভাল। তবে সে যাবে, চলে যাবে, নিজের নামটা মনে পড়লে, নিজের বাড়ির ঠিকানাটা মনে পড়লেই সে চলে যাবে। তেমন তেমন হলে, পুলিশকে বলবে পৌঁছে দিতে। পুলিসরা সব জানে।

ঋতি আর শ্রদ্ধা, তার পুটপুটদিদি ও বুজবুজদিদি পালা করে তার ওপর নজর রাখে। দুপুর বেলাটায় অবশ্য তারা থাকে না। রানিমাসিমা তার সঙ্গে গল্প করেন।

—ধলেশ্বরীর নাম শুনছ, খুকু?

—ধলেশ্বরী? সে কে?— সে মাথা নাড়ে।

—সে এক নদী আছিল। সেই নদী আমার বাপের ঘরের নদী। কথা কয়। ফিসফিস কইরা খলবল কইরা কত্ত কথা, আমি যখন তুমার মতো ছুট্ট তহন হইতে ধলেশ্বরীর লগে লগে ঘুরি। বরো ভাব ছিল দুই জনার। এমুন ফাল্গুনের বেলায় ডুরি শারি জরাইয়া, আঁজলা-ভইরা কুল, ছম ছম ঝুম ঝুম কইরা নদীর পারে পারে ছুইটা সারা হইতাম।

—বর্ষা আইলে ম্যাঘে জলে এক্কেরে এক হইয়া যাইত। গুমুর গুমুর ম্যাঘের ডাক। ভয়-ডর কারে কয় জানতাম না খুকু। হামা দিয়া দিয়া জল ঘরের গলিতে ঢুইক্যা পরত, তহন আমার সোনাদাদা নাও ভাসাইত….

পুনপুন থাকলে অমনি বলে—আমি এই গল্প শুনেছি মাসিমা। পাকুমাদের দেশ। আপনি পাকুমাকে চেনেন? সুভগা, না না ধরিত্রী দেবী?

—আমাদের দ্যাশের? ধরিত্রী? দুইটা ভাই আছিল কি?

—হ্যাঁ হ্যাঁ।

—চার বুন, বরোটি ধরিত্রী, বাপের দুই বিয়া…

—না না, পুনপুন হতাশ হয়ে বলে— পাকুমার খালি দুই ভাই সরল আর সুন্দর।

আমি কি তবে সুভগা? —সে ভাবে। আমার দুই ভাই সরল-সুন্দর এরা দুজন? এরা বলছে এরা নাকি আমার ভাই। তা হলে এমন হেঁয়ালি করছে কেন? সরল সুন্দর তো ওদেরই নাম। কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারে না।

রানিমাসিমা বলেন—বুঝলা খুকু, আমাগ উঠানখান এত্ত বরো যে ছুটকালে উয়ারে আমরা তেপান্তরের মাঠ বানাইতাম। উঠানের তিন দিকে কত্ত ঘর, কত্ত ঘর, হেঁশেলঘর আছিল দুইখানা। ঠাকুমা, খুড়িমা আঁশ হেঁশেলে খাইতেন না। বামুনের বিধবার বরো বিচার। নারকেল চিরা বানাইতেন, পাটিসাপটা, পাটিজরা অত ভাল আমরা পারি না। পিঠার দিনে শুধু পিঠা-পায়স শুধু পিঠা-পায়স। প্রথম পিঠাখান কাকরে দেওয়া হইত। কত উৎসব! কত খাওন-দাওন। ঘরের মইধ্যে ইট দিয়া উঁচু করা পালং। তলে হাঁড়ি কুড়ি বাকসো। ঘর ভইরা কী বাস, আজও সেই বাসে মন উতলা হয়।

সে অমনি দেখতে পায় ধলেশ্বরী নদী বয়ে যাচ্ছে, জলের ওপর রোদ চিকচিক সে ছুটে যাচ্ছে। ডুরি শাড়ি কিন্তু পরেনি সে। পরেছে একটা ফ্রক, সাদার ওপর লাল ফুটি ফুটি দেওয়া ফ্রক। ওই তো সে দৌড়ে ঢুকলো বাঁশের ফটক খুলে, ভেতরে কত্ত বড় উঠোন। একদিকে মোরগঝুঁটি ফুলগাছ। একটা সাদা বেরাল লাফিয়ে পালিয়ে গেল। তা হলে কি এইটাই তার বাড়ি? তার মা, তার বাবা কখন সেই ঘরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসবেন ভেবে সে উদগ্র হয়ে অপেক্ষা করে। কিন্তু কোনও মানুষজন সেই বাড়ি থেকে বার হন না। তারও আর আপনজনদের চেনা হয় না।

মাসিমা বলেন— কী জিগাইলা? আমার মা? মা খুব রোগা ছিল। গোরাও খুব। নাকে একখান লাল পাথরের নাকছাবি। বাপে ছিলেন হাট্টাকাট্টা। তিনখানা গাঁয়ের পূজা-অর্চন, জমি-জিরাত দেখাশুনা সকলই একলা করতেন। খুড়ামশায় গত হন তো!

নাঃ খুব রোগা, নাকছাবি পরা কোনও মা, কিংবা হাট্টাকাট্টা জোয়ান কোনও বাপের কথা সে মনে করতে পারে না।

তবে শেষ দুপুরের দিকে রানিমাসিমার বিছানায় সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন ঘুম ভাঙে তখন সূর্য ডুবে গেছে শাঁখ বাজতে শুরু করেছে। বুজবুজদিদি কলেজ থেকে সোজা বারো নম্বরে চলে এসেছে। সুইচ টিপে ঘরের আলোটা সে জ্বালিয়ে দিতেই বুবু বলে উঠল— বুজবুজদিদি, আমার লাল ফুটি ফুটি ফ্রকটা?

সে দেখল বুজবুজদিদির শুকনো মুখটা হঠাৎ জ্বলজ্বলে হয়ে গেল, চোখগুলো বড় বড়, সে প্রায় এক লাফে বুবুর কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে তাকে চুমো দিতে থাকল, চুমো দিতে থাকল, চুমো দিতে থাকল।

সাদার ওপর লাল ফুটকি-ফুটকি ফ্রকটা যেন জীবনবৃক্ষের একটা শেকড়। অচেতনার জলে যে-ই সেটা তার কাছাকাছি এসে পৌঁছলো, বুবু অমনি তাকে ধরে ছেঁচড়ে-মেচড়ে তীরে উঠেছে। ক্ষারের দ্রবণের ভেতর থেকে এখন ফুটে উঠছে একটা স্পষ্ট ছবি—ওই, ওই তো তার মা, ওই তার বাবা, ওই সব দাদা-দিদিরা, পিসিমা, পালক পেছনে একটু অস্পষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে, ঠাকুমা-ঠাকুর্দা, মায়ের কোলের কাছটিতে বুবু-বুনবুন-পুনপুন।

বুনবুন-পুনপুন নাচছে—উচ্ছেগাছে নতুন পাতা বেরুচ্ছেন, বেরুচ্ছেন। একদম বাবার স্টাইলে।

সপ্তম অধ্যায় : ডার্ক নাইট অফ দা সোল-২

এই কি বুজবুজদিদির সঙ্গে বুবুর শেষ দেখা? সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিতেই হেসে উঠেছিল বুজবুজের কমলা রঙের ধনেখালি শাড়ি। তাতে সরু কালো দাঁত দেওয়া পাড়। কালো ব্লাউজ। দু বিনুনি দু দিকে ঝুলছে। শুকনো মুখ হঠাৎ হাসিতে ঝলসে উঠেছিল। তারপরেই চুমো চুমো চুমো।

এমন করে আদর করতে এক বুজবুজদিদিই পারে। আর কারও চুমো খাওয়ার অভ্যেসই নেই। টমটমদিদি পমপমদিদির আদর থাকে চোখে, মায়ের আদর ছোঁয়ায়, পিসিমা আদর করবেন ডাক দিয়ে— ভবি, ভবতারিণী, ভবশংকর! একমাত্র বুজবুজদিদিই হঠাৎ পাখির মতো উড়ে এসে চুমো দিয়ে যায়।

—কী করছিস রে বুবু। আপনমনে কী বলছিলি রে তুই! হাত নাড়াচ্ছিলি কেন? বুবুর বাড়িতে বুবুর বন্ধু এসেছে তো। বন্ধুও বটে, প্রতিবেশীও বটে, যেমন মায়ের কাছে আসেন। বসতে দিয়ে পান দিয়েছে সে পাশের বাড়ির গিন্নিকে, তার পরে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা কইছে।

—তা যা বলেছেন! হ্যাঁ-অ্যা। আমারও তো বাসন মাজার লোক নেই। কী কামাই! কী কামাই! … তাই তো… ছেলেরা এলো জল খেতে দিই… ওই আরকি! আপনার ছেলে পাস করেছে? আমার ছেলেরা তো পাস করেনি।

ছেলেরা পাস না করার গর্বে সে মুখটাকে ঘুরিয়ে একটু মুচকি হেসেছে, কী বুজবুজ দিদি দেখে ফেলেছে।

—কী এত বকছিস রে বুবু? নাঃ তুই আর বড় হবি না।

চুমো চুমো চুমো।

চার নম্বরে এসে প্রথমটা তার লজ্জা লজ্জা করে। অনেক অনে-ক দিন পর বাড়ি আসছে কি না! এত লজ্জা করে যে চোখ মাটির থেকে তুলতে পারে না সে।

সঙ্গে এসেছেন দিদিভাই; কানুমামা, বুনবুন।

মা দিদিভাইয়ের সঙ্গে একটা দুটো কথা বলেই কেঁদে ফেললেন। দিদিভাই বললেন— কাজটা ঠিক হল না দেবু। মোটেই ঠিক হল না।

মা তাকিয়ে আছেন দিদিভাইয়ের দিকে। দুজনেরই মুখ থমথম করছে। বুবু মাকে জড়িয়ে ধরে। মায়ের কোমর একটু ছাড়িয়ে তার মাথা। সে বলে— মা, এই তো আমি এসেছি!

সে এসে গেছে অথচ মা কেন কাঁদবেন তা সে বুঝতে পারে না।

—ওঁকে তো জানো! যা গোঁয়ার! মা বললেন।

—ডাক দুগ্‌গাকে —দিদিভাই বেশ কড়া গলায় বললেন।

মা বললেন— কানু যা তো এদের নিয়ে। যা ছাতে যা। জামাইবাবুকে ডেকে দিয়ে যাস।

ছাতে তখন গোধূলি। পুটপুট একলা দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচিলের ধারে। অথচ গোধূলি হল বুজবুজের, একমাত্র বুজুবুজের। এই সময় থেকেই সে আঁচল দুলিয়ে চুলের বেণী উড়িয়ে গুনগুন করতে আরম্ভ করবে। ‘আকাশে পঞ্চদশীর চাঁদ’, গাইবে সে, ‘বাতাসে বেতসফুলের গন্ধ ভেসে আসে/ কিছুখন বসবে এসো আজ এখানে এই বিজনে একটু আমার পাশে।’ গাইতে গাইতে হয়তো একটু দাঁড়াল পাঁচিলের পাশে, হাতের কাচের চুড়িগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল, পাঁচিল থেকে ঝুঁকে দেখল একটু রাস্তা, আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে সব। বাতিওয়ালা কাঁধে মই নিয়ে বাতি জ্বালতে জ্বালতে আসছে। ওদিকে র‍্যাশনবাবুদের বাড়িতে ঠাঁই ঠাঁই মার আর চিল-চিৎকারের আওয়াজ শোনা গেল। বুজবুজ বিরক্ত হয়ে ডাকে ঋতি এই ঋতি-ই!

—কী বলছ!

—পুঁচকেগুলোকে নিয়ে আয় তো একবার।

বুবু-পুনপুন-বুনবুন-কানু সব হাজির।

—এই গা তো গা, জোরে গাইবি— ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার। মার্চ কর, মার্চ করতে করতে গা।

বুজবুজদিদিকে দেখা যাচ্ছে না। নিজের অজান্তেই বুবু সন্ধে হলে বুজবুজের গানের জন্যে কান পেতে রাখে। আজকে বুজবুজ গাইছে না। আছে কোথাও। কী করছে কে জানে!

টমটম একবার এসে দাঁড়াল। বুবুর দিকে চেয়ে দেখল— বুবু, দিদিভাইয়ের কাছে কী খেলি রে?

পমপম শাঁখ হাতে করে উঠে আসছে।

বুবু বলল— মাসিমা করেছিলেন— নারকেল-চিরা, গোকুল পিট্‌ঠা, পাটি জরা…

—ওমা কী সুন্দর বাঙাল কথা বলছে দেখো, —ঋতি বলল। একটু হাসি উঠল। তারপরেই সব চুপচাপ। শাঁখের শব্দ। ঠাকুরঘরে আরতির ঘণ্টা বেজে উঠল, ঠাকুরঘরের সামনের দালানে হাত জোড় করে ছোটরা সবাই দাঁড়িয়ে যায়। অংশুও আসে। ইন্দ্র, পুলক, সুযযি এখনও হয়তো বাড়ি আসেনি। কিন্তু মা আসেন না, বাবা আসেন না, পিসিমা বোধহয় আজকাল আর সিঁড়ি বেয়ে এসে উঠতে পারেন না। আর আসে না বুজবুজদিদি।

পমপমদিদি হরির লুঠ দেয় আর সবাই মিলে গায় :

হরির লুঠ পড়েছে আনন্দের আর সীমা নাই

চাঁদ বদনে হরি বলো ভাই।

হরির লুঠ পড়েছে…

বাতাসার মধ্যে থেকে একটা লাল পিঁপড়ে পুনপুনের জিভে কামড়ায়। সে উঃ করে একটা আওয়াজ দিয়েই চুপ হয়ে যায়।

—বুবু, কী খুঁজছিস রে?

—বুজবুজদিদি কোথায় গেল?

—ও মা জানিস না বুঝি, বুজবুজদিদি বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গেছে।

—কোথায়?

—কোথায়? হাজারিবাগে বোধহয়।

বোধহয়? টমটমদিদি জানে না ঠিকঠাক?

—বন্ধুর বাড়ি আবার কেউ থাকে নাকি? তবে সুদূর হাজারিবাগ হলে তো থাকতেই হয়!

বুজবুজদিদি তাকে সেদিন একবারও বলল না তো কথাটা?

ঋতি স্কুলে যায়, অংশু কলেজ যায়, সুদাদা নাইট কলেজে যায়, টমদিদি ইউনিভার্সিটি যায়। বুজবুজদিদির কলেজ কী করে ছুটি দিল?

—মা, বুজবুজের কলেজ নেই?

—না। ও হ্যাঁ, আছে তো!

মায়ের কী কাজের কথা মনে পড়ে যায়। মা তাড়াহুড়ো করে চলে যান।

বুবু একটা চিঠি লেখে :

বুজবুজদিদি,

তুমি কবে আসবে? তোমার কলেজ বন্ধ হয়নি কিন্তু। হাজারিবাঘে কি বাঘ থাকে? পুনপুনের জিবে পিঁপড়ে কামড়েছিল। পমপমদিদির শরীর খারাপ হয়েছে তাই টমদিদি পূজা করছে। হারমোনিয়ামের বাক্সের ওপর অংদাদা আবার ওর জার্সি রেখেছিল। রেশনবাবু রোজ ছেলেমেয়েদের মারেন। বাবার, মার, পিসিমার, ইদাদার, সুদাদার, পুটপুটের, অংদাদার, পুনপুনের, বুনবুনের, টেকনের— সবাইকার তোমার জন্যে মন কেমন করছে। আমার তিনটে বই এসেছে— রাজকাহিনী, বুড়ো আংলা আর আবার যখেন ধন। পুনপুনের আম আটির ভেঁপু আর বুনবুনের ভোম্বল সর্দার। তুমি আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম নিও। আজ ৮০।

ইতি

তোমারই বুবু (বিদ্যা)

চিঠিটা সুদাদাকে দেয় সে।

—খামে ভরে দিও। ঠিকানা লিখতে ভুলো না যেন।

বুবু গেরেম্ভারি চালে চলে যায়।

সুযযি চিঠিটা পড়ে তারপর নিজের সবুজ টিনের সুটকেসে রেখে দেয়।

—অংদাদা, পালক কি আবার ছবি আঁকতে গেছে?

—আমি জানি না যা। বড্ড বিরক্ত করিস।

অংদাদা পরীক্ষার পড়া করছে। তার কোনও কথা শুনতে চায় না।

পালক প্রায়ই ছবি আঁকতে কলকাতার আশেপাশে যায়। বিষ্ণুপুরে গিয়েছিল। সেখান থেকে মাটির ঘোড়া কিনে আনে, যে ঘোড়ারা ঘোড়ার মতন দেখতে নয় অথচ ঘোড়ার মতন। পালক গিয়েছিল পালামউ। কত রকম গাছের পাতা এনে দিয়েছিল পুটপুটকে, বুজবুজকে, অংদাদাকে। পালক ফিরলে তাকেই পাঠাতে হবে হাজারিবাঘে বুজবুজদিদিকে আনতে।

এই পরামর্শটাই সে ইদাদাকে দিতে গিয়েছিল। ইদাদা এক ঝটকায় সামনে ফিরে বিরাট একটা চড় তুলল। নামছে নামছে চড়টা, বুবু আবাক হয়ে তাকিয়ে আছে… টমটম ঝট করে চড়সুদ্ধ হাতটা ধরে ফেলল।

—দাদা করছ কী?

কেমন বোকা বনে গেছে বুবু। কাঁদতেও ভুলে গেছে।

ছাতের কোণে বুবুকে ডেকে নিয়ে গেছে ঋতি। চারদিকে তাকিয়ে নিচ্ছে। না ধারে-কাছে কেউ নেই।

ঋতি বলল— বুবু, সেজদি আর আসবে না। কাঁদিসনি।

বুবুর হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যায়।

—মরে গেছে, বুজবুজদিদি? কোনওরকমে তার মুখ দিয়ে বেরোয়।

—না। সেজদি আর পুলকদা বিয়ে করে চলে গেছে।

পালক? বিয়ে? বুজবুজ? পালক তো বুবুকে বিয়ে করবে! বুবুকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না, তখন পালকই তো তাকে বিয়ে করে নেবে বলেছিল!

হ্যাঁ শোন, আর কাউকে কক্ষনও বোকার মতো ওদের কথা জিজ্ঞেস করবি না। পুলকদা কোথায় যেন আঁকার মাস্টারমশাইয়ের চাকরি পেয়েছে, পেয়ে বাবাকে এসে বলে— সেজদিকে বিয়ে করবে। বাবা বললেন— কী বললে? এখখুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। তখন সেজদি বলে—বাবা আমি ওকেই বিয়ে করব। বাবা সেজদিকে এক ভীষণ চড় মারলেন।—চুপ করো। একসঙ্গে ভাইবোনের মতো মানুষ হয়েছ, বিয়ে? ছি ছি ছি! বলছ কী করে? বেরিয়ে যাও পুলক। এখখুনি।

মা বললেন—শোনো, একটু চুপ করো, শ্রদ্ধা বলছে ওরা সিভিল ম্যারেজ করে এসেছে।

বাবা বসে পড়লেন যেন পাথর হয়ে গেছেন। চোখগুলো আগুনের গোলা। —দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি? মানসম্মান বলে কিছু রাখলে না? —পুলকদা বলল—এ কী বলছেন কাকাবাবু, এতদিনের সম্পর্ক সব মিথ্যে হয়ে গেল? আমি কি কোনওদিন আপনাদের কষ্ট দিয়েছি? কোনওদিন মানমর্যাদা নষ্ট করেছি? আমি শ্রদ্ধাকে ভালবাসি এতে খারাপ কী আছে।

—জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব তোমার। নাটুকে কথা বলতে শিখেছ? বায়োস্কোপ করছ, বায়োস্কোপ?

—সেজদি কাঁদছিল, বলছিল—ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না মা। তোমরা একটু বোঝো, বোঝবার চেষ্টা করো একটু।

বাবা বললেন—কোথায় ম্যারেজ সার্টিফিকেট? ছিঁড়ে ফেলো ওটা। কাজিনে কাজিনে বিয়ে হয় না। তোমার আমি খুব ভাল বিয়ে দেব শ্রদ্ধা।

বাবা গর্জন করছিলেন। সেজদি বলল—তা হয় না বাবা, তা হয় না। আমরা এক। আমাদের আলাদা করা যাবে না।

—তবে বেরিয়ে যাও বুবু, বাবা ওদের এক কাপড়ে বার করে দিলেন। বলতে বলতে ঋতি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

তার বুকের মধ্যে কথাগুলো জমাট বেঁধেছিল। ঠিক যেমন-যেমন শুনেছিল তেমন-তেমন। বলতে পেরে ঋতি হয়তো হালকা হল। বুবু কতটা বুঝবে না-বুঝবে সে সম্পর্কে তার কোনও ভাবনা ছিল না। যতবার বুবু বুজবুজদিদির কথা বলে ততবার সমস্ত বাড়ির শরীরের পেশী শক্ত হয়ে যায়, কোনওরকমে সেই অস্বস্তি, ভয়ের অবসান ঘটানো দরকার। এমনটাই তার মনে হয়েছিল হয়তো। হয়তো বা!

কিন্তু বুবুর পৃথিবীর হাওয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার চারিদিকে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সেই অন্ধকারে। পালক…বুজবুজ…বিয়ে…আমি শ্রদ্ধাকে ভালবাসি…দুধকলা দিয়ে কালসাপ…সিভিল ম্যারেজ। বুজবুজদিদি আর আসবে না। কোনওদিন আসবে না। বুজবুজদিদির আর কোনও কাপড় নেই। সবুজ, নীল, কালো, লাল সমস্ত কাপড় পড়ে রয়েছে। সেই কমলা রঙের শাড়ি পরে, কালো ব্লাউজ, দুদিকে দুটো কালো বিনুনি বুজবুজদিদি কোথায় চলে গেছে। তার কাপড়, হারমোনিয়াম, বইখাতা…। পালক…পালক তুমি কোথায় গেলে? আর তুমি ‘কেয়া’ কাগজ বার করবে না? আর আমাদের সভা হবে না? ইদাদার সঙ্গে তুমি আর বায়োস্কোপ দেখতে যাবে না? বাবা, বাবা, ওদের কে রেঁধে দেবে? কোথা থেকে বুজবুজ আর কাপড় পাবে? পাঁকুদিদির যখন বিয়ে হয়েছিল তখন কত শাড়ি, কত গয়না, কত খাট বিছানা আলমারি সব পাঁকুদিদির বাবা দিয়েছিলেন, নইলে সে পরবে কী? শোবে কিসে? শ্বশুরবাড়িতে তো আর খাট থাকে না, শাড়ি থাকে না। বুজবুজের তো শ্বশুরবাড়িও নেই। কোনও বাড়িই নেই। কোথায় যাবে পালক? কোথায় যাবে বুজবুজ? প্রচণ্ড শব্দে একটা বাজ পড়ল। বুজবুজদিদির পাঁজরে আগুন লেগে গেল। জ্বলছে। সেই আলোয় পথ দেখে দেখে বুজবুজ পথ চলেছে। ‘তবে বজ্ৰানলে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলো রে।’ বুজবুজের পাঁজরের আগুন লাফিয়ে এসে বুবুর পাঁজরে পড়ে। জ্বলতে থাকে বুকের খাঁচা। লকলকিয়ে ওঠে সে আগুন—বাবা, ও বাবা, তুমি ওদের তাড়িয়ে দিলে কেন? বাবা তুমি ভাল নও, আমি বুঝতে পেরেছি তুমি একদম ভাল লোক নও। যতই আদর করো আমায়, তোমার রাগ হলেই তুমি আমাকে তাড়িয়ে দেবে। বাবা, তোমাকে আমি ভালবাসি না। কোনওদিন ভালবাসব না। কোনওদিন না। তুমি চলে যেতে পার। একলা একলা চলে যাও কোথাও, আমার মন কেমন করবে না। তুমি মরে গেলেও আমার কোনও দুঃখ হবে না। কাঁদব না, তখনও আমি কাঁদব না। ও বাবা শুনছ?

বাবা শুনতে পান না। কারো কথা না, নিষেধ না। অনুরোধ-উপরোধ না, সারা সকাল শিয়ালদা স্টেশনে, সারা বিকেল-সন্ধে চেম্বারে, শনি-রবিবারে রানাঘাটে চলে যান, সেখানে নাকি বাস্তুহারাদের ক্যাম্প আছে, সেসব দিনে বাবার চেম্বারে বসাও হয় না। রাতে তারা ফার্স্ট ব্যাচ যখন খেতে বসে, তখন বাবা ঠাকুরঘরে বসে বসে গান করেন,

‘ডুব দেরে মন কালী বলে

হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।

রত্নাকর নয় শূন্য কখন দু চার ডুবে ধন না পেলে

রত্নাকর নয় শূন্য কখ…ন…

শব্দ ঊর্ধ্বগামী। তেতলার ঠাকুরঘরের গর্ভগৃহ থেকে হাওয়া সে-গান উড়িয়ে নিয়ে যায় আকাশের দিকে। দু-একটা শব্দ, দু-এক কলি সুরের মূৰ্ছনা হঠাৎ লাট খেয়ে নেমে আসে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে, একতলার দালান দিয়ে দিশেহারা স্রোতের মতো ঢুকে পড়ে একবার এঘরে একবার ওঘরে, ‘রত্নাকর নয় শূন্য কখন’… আবার ভিন্ন সুরে— ‘রত্নাকর নয় শূন্য কখন’—একটা লুটন্ত আত্মবিশ্বাস যেন জোর গলায় অস্তিত্ব ঘোষণা করতে চাইছে। তাঁর দিদিমণি উনুনের সামনে বসে রুটি সেঁকতে সেঁকতে কেঁপে ওঠেন, পত্নী ছেলেমেয়েদের পরিবেশন করতে করতে কেঁপে ওঠেন, ছেলেমেয়েরা মুখে গ্রাস তুলতে গিয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে। গান তো নয়, যেন পৃথিবীর বুকের ভেতরকার ফুটন্ত লাভার হুহুঙ্কার, কিংবা আকাশের অনন্ত শূন্যতার হাহাকার।

স্বভাবে তিনি শাক্ত। শক্তি-উপাসক। পারিবারিক আচারে বৈষ্ণব। বজ্রভৈরব এবং কান্তকোমল প্রেমের দেবতা তাঁর মানসপটে অবিরাম অধিকার-রক্ষার কূটযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এঁর দামামার সঙ্গে ওঁর বাঁশি যায় না। তাই যে মানুষ বাস্তুহারাদের জুতোয় পা গলিয়ে তাদের দুর্গতিনাশক হয়ে ওঠেন, সেই একই মানুষ আপন সন্তানকে উদ্বাস্তু করেন। সমগ্র দেশের প্রতিনিধি হয়ে যিনি গৃহহারাদের আশ্রয় দিতে উন্মুখ, সেই তিনিই আপন পালিত পুত্রর কাছ থেকে কেড়ে নেন আশ্রয়। আর সেই কেড়ে নেওয়ার কষ্টে তিনি যখন গলায় ডমরু বাজান—‘রত্নাকর নয় শূন্য কখন দু চার ডুবে ধন না পেলে…’ তখন তীক্ষ্ণ প্রাণচেরা এক বাঁশির আওয়াজ সে ডম্বরুর গুরুগুরুতে মিশে থাকে।

তাঁর গলার স্বভাববলিষ্ঠ গান যে সহজসুন্দরী হয়ে সেই সেজমেয়ের গলাতেই আশ্রয় নিয়েছিল। গানের ভিতর দিয়েই তো এই পিতা-পুত্রীর আসল চেনাশোনা। তিনি গাইছেন—

‘সব ঘুচালি জ্বালা কালী কালী

ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি

কালী!’

বুজি এসে বসেছে। —বাবা এ গানটা আমায় তুলে দেবেন?

বড় তিন ছেলে মেয়ে—ইন্দ্র, ঋদ্ধি, ভক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব বন্ধুত্বপূর্ণ, নিবিড়, প্রয়োজনে তিনি এদের পরামর্শ নেন। সূর্যও মোটামুটি এই শ্রেণীতে পড়ে। ছোট কজন— বিদ্যা, পাবন, বরুণ তাঁর আদরের, অগাধ প্রশ্রয় এদের জন্য তাঁর হৃদয়ে। মাঝেরগুলি— অর্থাৎ—শ্রদ্ধা, অংশু, ঋতি—এদের সঙ্গেই তাঁর সম্পর্কটা অস্পষ্ট। এরা তাঁর সঙ্গে সহজে মেলামেশা করতে পারে না। বাবা এদের কাছে দূরের মানুষ। কিন্তু বুজি যখন গান গাইত, তিনি তো দূরেও থাকতে পারতেন না, অস্পষ্ট হয়েও থাকতে পারতেন না।

একা মোর গানের তরী ভাসিয়ে ছিলেম নয়ন জলে—গান এসে ধাক্কা দিত তাঁকে চেম্বারে। ‘হ্যাঁ বলুন, নোনতা ভালবাসেন না মিষ্টি?’

—এই যে বললুম ডাক্তারবাবু, মিষ্টি মিষ্টি

ক্ষণিকের জন্যে হলেও তাঁর চিত্ত গানে লয় পেয়ে গিয়েছিল। রোগীর কথা শুনতে পাননি।

‘মহাকালের কোলে এসে গৌরী হল মহাকালী।

শ্মশানচিতার ভস্ম মেখে ম্লান হল মার রূপের ডালি॥’

দুজনে গাইছেন, একটু পরেই বাজি-পোড়ানো শুরু হবে, নিজেদের বাজি শেষ হয়ে গেলে আকাশে চোখ মেলে রাখতে হবে। ছাতুবাবুদের অজস্র হাউই উঠবে আকাশে, একটার পর একটা বিস্ময় ছড়াবে, তার আগে মায়ের বন্দনা সেরে নিচ্ছেন।

আর পুলক? বারো তেরো বছর বয়স থেকে অনাথ ছেলেটাকে বড় করে তুলেছেন তাঁরা। সে তো তাঁর পরিবারের সঙ্গে মিশে এক হয়ে গিয়েছিল! কী ভাব! কী ভাব ইন্দ্রর সঙ্গে! কোনওদিন তো বেয়াদপি করেনি! কিন্তু এখন! এখন! এত বড় সামাজিক অপরাধ করলে তিনি তো নিরুপায়! ভালবাসা! ছিঃ। লোকে কী বলবে, এক বাড়িতে ছোট্ট থেকে মিলেমিশে বড় হয়েছে! লোকে তো অনেক অনাচারের কথাই স্রেফ ভেবে নেবে!

প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা করল তাঁর মেজদা, দ্বিতীয়টা করল এই পুলক। পরিবারের পবিত্রতার ভেতরে ভাঙন ধরিয়ে দিল। অহরহ এখন আগুন জ্বলছে তাঁর বুকে। গানে গানে তার কতটুকুই বা নেভে!

অষ্টম অধ্যায় : ‘লেট দেয়ার বি লাইট’

সিংহবাড়ির সব্বাই যে যার মতো বেরিয়ে গেছে, পিসিমা ঝিমোচ্ছেন, মায়ের বুকের ওপর খবরের কাগজ উপুড়, মা ঘুমিয়ে গেছেন। যখন বুজবুজ ছিল সবাই বেরিয়ে গেলেও বাড়িটা ভরা থাকত। কেননা আমাদের চারপাশের আবহমণ্ডল আমাদের কথাবার্তা, আওয়াজ সব নিয়ে সর্বক্ষণ নাড়াচাড়া করে। হয়তো ইন্দ্র আর ঋদ্ধি দালানের এক কোণে দাঁড়িয়ে কোনও তর্ক-বিতর্ক করেছিল, সেইখানটা দিয়ে গেলেই সেই শব্দের রণন তুমি শুনতে পাবে। শ্রদ্ধা গান করত, তাই বাড়ির প্রতিটি কোণ গানে গানে সুরে সুরে ভরা থাকত। হয়তো অংশু-ঋতি ঝগড়া করেছে কোনও তুচ্ছ বিষয় নিয়ে, অংশু ঋতিকে লাগিয়েছে একটা থাপ্পড়, ঋতি অংশুকে একটা গাঁট্টা। সেখান দিয়ে যাও তুমি ‘ঠাস’ ‘খট্‌’ প্রভৃতি শব্দের ভূত শুনতে পার। কিন্তু এখন সিংহবাড়ির মধ্যে একটা ভ্যাকুয়াম বিরাজ করে। সেখান দিয়ে হাওয়া বয় না বলে কোনও শব্দেরই ভূত অর্থাৎ অতীত স্পর্শ করা যায় না। তা ছাড়া, এখন শব্দের তেমন কোনও বর্তমানও নেই আর। যে যার কাজ করে, কাজের কথা বলে, বাস, আবার কি? শব্দ নেই, কথা নেই, ভাবনা আছে চিন্তা আছে কিন্তু তাদের অবয়ব আরও সূক্ষ্ম। তাই তাদের রেশ বাড়ির হাওয়ায় থাকে কি থাকে না বলা মুশকিল।

সারা সকাল বুবু মায়ের পায়ে পায়ে ঘোরে। ছোট ছোট মাছ এলে সে বাছতে বসে। পুট পুট করে মৌরলা পুঁটির পেট টিপে ভেতরের পোঁটা বার করে দিতে ভারি মজা। চিংড়ির মাঝের খোলাটা রাখবে বুবু, পিঠ চিরে সরু মতন কালো সুতো বার করে দাও। মটরশুঁটি ছাড়াতে বলো, এক বাটি ছাড়িয়ে ফেলবে সে। কুমড়োর বিচি জড়ো করে শুকিয়ে রাখবে। কাঁঠালের বিচি জমাবে, কাঁঠাল বিচি চচ্চড়িতে পড়বে, ডালে পড়বে, মা আনাজ কুটে রাখবেন আর সে জামবাটিতে জল নিয়ে ধোবে। ধুয়ে ধুয়ে সাদা করে ফেলবে সব। তারপরে হবে লাউ কোরা, নারকোল কোরা, চাল বাছা, আটা চালা, সুজি চালা।

টমটমদিদি ডাকবে— বুবু, বুবু।

—এসেছি এই যে।

—এই অঙ্কগুলো করে রেখো।

তা টমটমদিদির টাসক্‌গুলো যথাসাধ্য করে সে। বাস, তারপর গল্পের বই নিয়ে বসে যায়। টঙের জানলার পাশটা তার খুব পছন্দ। চার পাল্লার জানলা। ওপরের পাল্লা দুটো বন্ধ করে নীচের পাল্লা দুটো খোলা রাখে সে, তারপর জয়ন্ত-মানিক বিমলকুমার অপু-দুর্গা রিদয়-খোঁড়া হাঁস, গায়েব-গায়েবীদের পাড়ায় গিয়ে গায়েব হয়ে যায়। পড়তে পড়তে এক সময়ে ঢুল এসে যায়, বইয়ের পাতার ভেতর আঙুল, দেওয়ালে ঠেস, ঘুমিয়ে পড়েছে বুবু।

কিন্তু ঘুমিয়ে টুমিয়ে আবার যখন উঠে পড়ে, তখন তো চোখ তাজা, মাথা পরিষ্কার, হাতে-পায়ে আর আলস্য তো নেই! যখের ধন গুহার ভেতরের অন্ধকূপে পড়ে গেছে, সেই যখের ধন বিমল কুমারের হাতে এলে তারা তা বুবু বুনবুন পুনপুনকে দিত কি না, দিলে কীভাবে সেগুলোর সদ্ব্যবহার হতে পারত : এই সব ভাবতে ভাবতে বুবুকে উঠে পড়তে হবে, এবার চলো, ঘোরো সমস্ত বাড়ি। ঠন্‌ন্‌ ঠন্‌ন্‌ বাসন বাজাতে বাজাতে বাসনআলা চলেছে, কাদের বাড়িতে এখনই রান্নাঘরে ঝাঁটা চলেছে, সামনের বাড়ির কার্নিশে পায়রারা বুকে মুখ গুঁজে বকুম বকুম করেই যাচ্ছে… অতএব বুবু একতলায় নেমে নিঝুম রান্নাঘরের নিভন্ত উনুনের গরমে গোটা দুই আলু পুরে দেয়। কিছুক্ষণ পর সাদা হয়ে-আসা ওপর-কয়লা সরিয়ে ভেতর থেকে সে আলুগুলো বের করে। আলুপোড়া তেল নুন দিয়ে খেতে ভারি মজা। আলুপোড়া খেতে খেতে সে উঠোন পেরিয়ে সদর দরজার খিল খোলে। বাড়ির বাইরে রক। রকে বসে বসে আলুপোড়া খেতে খেতে সে শেষ দুপুরকে রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা করতে দেখবে। শেষ দুপুর আসলে এক ক্লান্ত যাযাবরী-ইরানি বাসনওয়ালি। তার লাল-সবুজ ছাপের কাপড়, হাতের সবুজ-হলুদ কাচের চুড়ি, তার পিঠে পুরনো কাপড়ের বোঝা। মাথার ওপর পদ্ম করে সাজানো থালাবাসনের ঝুড়ির টাল সামলাতে সামলাতে সে ছন্দে হাঁটছে— বা-সন লিবে গো… বা…সন। তার কণ্ঠ এখন ক্লান্ত, ঝিমন্ত। কিংবা শেষ দুপুর কাঁধ-থেকে হারমোনিয়াম ঝোলানো মাথায় পাগড়ি এক মজার মানুষ, খানিকটা প্যাঁ পোঁ হারমোনিয়াম বাজিয়েই যে উচ্চগ্রামে গান ধরে ফেলে, গানের কলি তার সঙ্গিনীর গলায় ফেলে দিয়ে তবে তার ছুটি, তখন সে আবারও প্যাঁ পোঁ করে তুরন্ত সুরের ঘোড়া তার যন্ত্রে ছুটিয়ে দেবে। সঙ্গিনীর গলা ভাঙা কিন্তু কী যে জাদু সেই দেহাতি গানে, শেষ দুপুর বাড়িগুলোর মাথায় মাথায় চল্লিশ ওয়াটের রোদ, রাস্তার ওপর নামতে নামতে যা চব্বিশ ওয়াট হয়ে আসে। সেই ফিকে রোদে তার বড় একা লাগে। মন কেমন করতে থাকে। বুজবুজের জন্য, পালকের জন্য, নিজের জন্য, এক হারিয়ে যেতে থাকা বুবুর জন্য। সে রোজ দেখে এক মেয়ে এই সময়ে রাস্তার এক দিক দিয়ে ঢুকে আর এক দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। দেখে দেখে মনে হয় এ নিশ্চয় অন্য কোনও পাড়ার। এ জানে না সে স্কুলে যায় না, অঙ্ক না পেরে অংদাদার কাছে গাঁট্টা খায়। এ জানে না সুযোগ পেলেই পাড়ার মেয়েরা তাকে ঠকায়। সে সাহস সঞ্চয় করে বলে— তোমার নাম কি ভাই? তুমি এখান দিয়ে রোজ রোজ কোথায় যাও? আশ্চর্য! সে কিন্তু ‘ডাকঘর’-এর অমলের থেকে এই জিজ্ঞাসা টোকেনি। মেয়েটি থেমে যায়, হাতের বই আঁকড়ে, ভিতু চোখ তুলে বলে— চাঁপা। আমি পাঠশালে যাই।

—তুমি আমার বন্ধু হবে? —চাঁপা বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে থাকে।

—এসো না, এখানে এসো।

অনেক কষ্টে চাঁপার ভয় ভাঙিয়ে সাধাসাধি করে তাকে রকে বসায় বুবু। তাকে ভয় করে, সমীহ করে, তার সঙ্গে সসঙ্কোচে কথা বলে— এমন মানুষও আছে তা হলে? ভারি একটা সন্তোষ হয় বুবুর।

ভালো করে বিকেল হতে না-হতেই সে চাঁপাকে নিয়ে দোতলায় উঠে যায়।

—মা, ও মা, মা। —মাদুর পেতে ঘুমোচ্ছিলেন মা।

—কী হল? শ্রদ্ধা এলো না কি? ধড়মড় করে উঠে বসেন, উঠে দেখেন জটপাকানো চুল, কাঁচা কয়লার মতো কালো, ময়লা ফ্রক পরা একটি মেয়ে।

—মা এই দেখো চাঁপা, আমার বন্ধু।

মেয়েটি এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে থাকে। বুবু হাত ধরে থামায়।

—এই যাচ্ছিস কোথায়? এখন আমরা খেলব—মা, সে ফিসফিস করে মার কানে কানে বলে কথাটা, —কচুরি আলুর দম করে দিও আমার বন্ধুকে।

হাসি চেপে মা বেরিয়ে যান। পিসিমা বলেন— তাড়া তাড়া, ও দেবু, ও কোথাকার কোন বস্তির মেয়ে রে, হেগে ছোঁচায় না ওরা, ছি ছি সব ছুঁয়ে নেপে একেক্কার করে দিলে।

মাকে ভর করেন বুদ্ধ এবং যিশু এবং গান্ধী। আরও ভর করে ছোট মেয়ের জন্য করুণা বলেন— থাক দিদিমণি, নিজে ডেকে এনেছে, অবোধ মেয়ে, ওরও তো একটা মান আছে। তা ছাড়া মানুষকে অমন দূর দূর করতে নেই।

—হ্যাঁ দূর দূর করবে না! কোলে বসিয়ে আদিখ্যেতা করবে! গজগজ করতে করতে তিনি কচুরি আলুর দম করতে বসেন। এ সব খাবারদাবারে তিনি এক্সপার্ট। প্রায় প্রতিদিনই কিছু না-কিছু জলখাবার করেন।

তার পুতুলের বাক্স খুলে দেখায় বুবু। আজকাল অবশ্য সে আর তত পুতুল খেলে না। বাক্সর মধ্যে পুতুলেরা সব ঘুমিয়ে আছে। মাটির পুতুল, কাচের পুতুল, সাদা পুতুল, লাল পুতুল, কড়ি পুতুল, সব যে যার মতো পরিষ্কার জামা কাপড় পরে ফিটফাট, চোখ চেয়ে চেয়ে কাঠের মতো শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। পুঁতির গয়না কত! থোকা থোকা হার, তারা-তারা হার, মাথার টায়রা, নীল পুঁতি, সোনালি পুঁতি, সাদা পুঁতি। চোখ বিস্ফারিত করে দেখে চাঁপা। এ কী ঐশ্বর্য! এ তো সে কল্পনাও করতে পারে না! আলতা-পাতা, কালির বড়ি, একই পেন্সিলের এক দিকে লাল, এক দিকে নীল, কাচের গোল ঢিবি, তার ভেতর নীল সোনালি লাল সবুজ ফুলের গোছা, যতই চেষ্টা করো সে ফুল তুমি বার করতে পারবে না; একরত্তি একটা কাচের পুতুল, তার গোছা গোছা জামা, ছোট্ট ছোট্ট রঙিন কাপড়ের টুকরো। তার মাঝখানে একটা করে গোল ফুটো। ফুটো মাথায় গলিয়ে দিলেই ছোট্ট পুতুল-খোকার জামা পরা হয়ে গেল। ছিটের জামা, সিল্কের জামা, নেটের জামা। দেখতে দেখতে চাঁপার নেশা লেগে যায়।

—আমি জামা পরাব? —সে পরম সংকোচে অনুমতি চায়।

—হ্যাঁ-অ্যাঁ, না হলে খেলবি কী করে?

দেবহূতি যখন কচুরি আলুর দমের রেকাবি হাতে করে উদয় হলেন, তখন চাঁপা আর বুবু প্রায় এক মাথা হয়ে গেছে খেলার নেশায়। কাঠের পুতুল-সুবল, মাটির পুতুল শেফালি, কাচের পুতুল নিবারণবাবু, কড়ি পুতুল কাঁচু সবাই তাদের হাতে অনবরত হৃতবস্ত্র আর ধৃতবস্ত্র হয়ে চলেছে।

পিসিমা বলেছিলেন— ও মেথরের মেয়ে, শালপাতায় করে খেতে দে।

দেবহূতি কিছুতেই রাজি হলেন না। ছোট মেয়ের জীবনের প্রথম স্বয়ংবৃত সখী! একে কি অসম্মান করা যায়!

অবাক হয়ে খেলো চাঁপা। এসব কী? কী অপরূপ গন্ধ? স্বর্গীয় স্বাদ? এই পৃথিবীতেই এসব আছে?

বিস্ময়ের ধাক্কায় সে প্রায় যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটছে। খাওয়া-দাওয়ার পর তার হুঁশ হল। বলল— বাবা মারবে, এখন গিয়ে রাঁধতে হবে।

রাঁধবে? এই চাঁপা বুবুর মতো একটা মেয়ে সে মা-পিসিমার মতো রাঁধবে?

—তোর পিসিমা নেই?

—না।

—তোর মা?

—মা আঁতুড়ে? আমি তো অনেক দিন থে’ই রাঁধি।

আর বেশি কথা খরচ করে না চাঁপা।

—আবার আসবি ভাই, রোজ। আসবি তো?

চাঁপা ঘাড় হেলায়। সে আসবে।

পুতুল গুছিয়ে তুলতে গিয়ে বুবু আবিষ্কার করে—তার আলতা পাতা নেই, লাল-নীল পেন্সিল নেই। আর নেই কাঁচু, সেই ছোট্ট কড়ে আঙুলের মতো কড়ি পুতুল। সে বারবার সব বার করে, বারবার তোলে, উস্তম-খুস্তম হয়ে যায়। কিছুতেই খুঁজে পায় না।

—কী করছ বিদ্যা, অনেক তো খেলা হল, এবার ওঠো।

—খেলিনি তো খুঁজছি।

—কী খুঁজছ?

—আমার আলতা পাতা,…আমার কাঁচু।

অংদাদা বলল—তোর কাঁচু কাঁচুমাচু হয়ে গেছে রে মেয়েটা।

পিসিমা বললেন—চুরি। চুরি করে নিয়ে গেছে। চোট্টা একটা বস্তির মেয়েকে বাড়ি ঢুকিয়েছে। এ মেয়ের কোনওকালে বুদ্ধি হবে না।

তারপর আরও আবিষ্কৃত হল—কদিন পরে, যে বুবুর চুল সব উকুনে ভরে গেছে, উঠোনে ইঁট পেতে বসে সাশ্রুনয়নে তাকে আবার ন্যাড়া হতে হয়। সেই থোকা থোকা, থলো থলো চুল আর ওঠে না। এবার সব ঝাঁটার কাঠির মতো সোজা সোজা।

বুবু অক্লান্ত রকে বসে থাকে চাঁপাকে ধরবার জন্যে। কিন্তু চাঁপা তার পাঠশালে যাবার জন্য অন্য রাস্তা খুঁজে নিয়েছে।

প্রথমবার চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ, তবু এ পথেই বুবুরামের ক্রমমুক্তি, বন্ধুপ্রাপ্তি হয়। এই পথ দিয়েই মিনু আসে। দুধে-আলতা রঙের, কুচকুচে কালো চুলের টুকটুকে মিনু এই পথ দিয়েই যাচ্ছিল। তাকে খুঁজেছিল বুনবুন, পেয়ে গেল বুবু।

এখন, পাঠক-পাঠিকারা, আপনাদের মধ্যে যাঁরা কালো, তাঁরা কিন্তু কখনওই মনে করবেন না আমি কৃষ্ণবর্ণের সঙ্গে নোংরামি, চৌর্যবৃত্তি, এবং গৌরবর্ণের সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা ও সদ্‌ভাবনার সমীকরণ করছি। বুবু নিজেও তো কালো, কালী কালো, কৃষ্ণ কালো, অর্জুন কালো, রাম কালো, দ্রৌপদী কালো। উপাসিত কালো, আদর্শায়িত কালো, সৌন্দর্যের বীরত্বের বুদ্ধিবৃত্তির পরাকাষ্ঠা কালোর তো অভাব নেই আমাদের পুরাণে, মহাকাব্যে, লোককথায়, লোকমানসে। বেচারি চাঁপা সত্যি কালো ছিল, আর মিনু সত্যিই ফর্সা ছিল। সেই তথ্যগুলোকেই এখানে পরিবেশন করা হয়েছে মাত্র। উপরন্তু, বুবুর সৌন্দর্যচেতনায় চাঁপা মিনুর থেকে বিন্দুমাত্র ন্যূন ছিল না। দুজনে দুরকম। মিনু যদি হয় ফলসা, চাঁপা তবে বৈঁচি। দুটোই বুবু দারুণ ভালবাসে। তা ছাড়া চাঁপা ছিল যাকে বলে লক্ষ্মী-ট্যারা, ওইটুকু মেয়ের নাকে ছিল নাকছাবি, তার গায়ে খড়ি উঠেছিল—এই সমস্তই মুগ্ধ বিস্ময়ে বুবু লক্ষ করে। একমাত্র চাঁপার নখের ময়লা এবং চুলের দুর্গন্ধ তাকে একটু বিরূপ করে; এ ছাড়া চাঁপার সব বৈশিষ্ট্যই বুবুর চোখে আকর্ষণীয়। এরপর থেকে সারা জীবন বুবু লক্ষ্মী-ট্যারাদের প্রেমে পড়বে, চাঁপা না এলে, চাঁপাকে ভাল না লাগলে কি আর তা সম্ভব হত? আর একটা জিনিস বুবুকে বিস্মিত করেছিল,—চাঁপার অপূর্ব কৌশলে হাত সাফাই। সারাক্ষণ দুজনে পাশাপাশি বসে খেলল, পাশাপাশি বসে খেলো। এক মুহূর্তের জন্যেও চাঁপা একা ছিল না, অথচ চাঁপা চলে যাওয়ার পর থেকেই তার আলতা-পাতা নেই, কাঁচু নেই! এখনও সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না যে চাঁপাই জিনিসগুলো নিয়েছে। ভূতেই নিয়েছে বোধহয়। চাঁপা চোর? চাঁপার লক্ষ্মী-ট্যারা চোখের সেই ভীত সংকুচিত দৃষ্টি, তার ভড়কে-যাওয়া হাবভাব! চোরেরা হয় সাহসী, দুর্বিনীত, চালাক-চালাক! কাঁচুকে হারিয়ে তার কষ্ট হয়েছে ভীষণ কারণ ঠিক ওই রকম কাচের কড়ি পুতুল, যার চোখমুখ পোঁছা পোঁছা, একটি চোখ একেবারেই লোপ পেয়েছে, কোমর থেকে তলা পর্যন্ত যার হালকা সবুজ ক্রমশই ফিকে আরও ফিকে হয়ে যাচ্ছে, এমনটি আর পাওয়া যাবে না, যদি পাওয়া যায়ও সে তো হবে অন্য কাঁচু। কাঁচু নাম্বার টু, তার ভালবাসা আর যত্ন যার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই কাঁচু চিরদিনের মতো কোথায় হারিয়ে গেল, কিন্তু চাঁপার হাত- সাফাইয়ের অপূর্বতা যেন এই কাঁচু-বিরহের যন্ত্রণাকে ডুবিয়ে দিয়েছে। এই সময়ে সে মিনুর দেখা পেল।

কিন্তু এখন সে ন্যাড়া-মাথা। মাথায় রুমাল বাঁধা, মুখের চেহারায় একটা ভোঁতা কষ্ট আর বিস্ময়ের ভাব, লোভ হলেও সে মিনুকে ডাকে না। এক দিন দেখে, দু দিন দেখে, তৃতীয় দিন সেই আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটে।

মিনু নিজেই তার দিকে এগিয়ে আসে:

—এই, তুমি গুল্লাছুট খেলবার পার?

—আমি এক্কা-দোক্কা খেলি।

—কোর্ট কাইটবার ঢ্যালা আছে?

—আমাদের কোর্ট আছে।

—কই?

তখন উঠোনে ঢুকে বুবু তাদের এক্কা-দোক্কার কোর্ট দেখায়। উঠোনটা সিমেন্টের স্ল্যাব দিয়ে তৈরি। চৌকো চৌকো স্ল্যাব। বিনা ভূমিকায় দুজনে এক্কা-দোক্কা খেলতে আরম্ভ করে তখন। মিনু তার ‘পেন্ট’-এর ভেতর থেকে একটি রিং-এ তিন-চারটি চাবির একটি রোগা গোছা বার করে; ‘এক্কা-দোক্কা-তেক্কা-চৌকো জিরেন পঞ্জা হিরেন’ খেলা চমৎকার চলতে থাকে। বেশির ভাগই মিনু জিতছে, বুবুও জিতছে। অন্তত ক্ষোভের কোনও কারণ থাকছে না। পুনপুন-বুনবুন দরজা ঠেলে ঢুকল।

—আলু-কাবলি-অলা এসেছে—তাদের ঘোষণা।

চার পাতা আলু-কাবলি কেনা হয়। পাতা চাটতে চাটতে বুবু বলে—এই দ্যাখ, মিনু।

চমকে মুখ তুলে তাকায় বুনবুন। —মিনু? এ তো মিনু নয়? এ কেন মিনু হবে?

মিনুর বাড়ি খুব কাছেই। তিনজনে তার সঙ্গে দৌড়ে-দৌড়ে তাদের বাড়ি যায়। গায়ে গায়ে সব বাড়ি। মাঝখানে কোনওখানে হয়তো সরু একটা মেথরের গলি আছে। বেশির ভাগই নেই। সেইরকম একটা রং-ওঠা পলকা দোতলা বাড়ির অন্ধকার একতলায় থাকেন মিনুর বাবা পতিসর ইস্কুলের প্রাক্তন হেডমাস্টারমশাই, তাঁর স্ত্রী মেয়েদের স্কুলের আঁকার টিচার।

একজন মা, মাথায় ঘোমটা, হাতে শাঁখা রুলি, সাধারণ করে কাপড় পরা। হাতে হাতপাখা, ফাটা পায়ে আলতা এরকম একজন মা আবার টিচার হন? এই আশ্চর্য ব্যাপার এই প্রথম প্রত্যক্ষ করল বুবু-বুনবুন-পুনপুন। আর কী ফর্সা! কী ফর্সা! মিনুর মা মিনুর চেয়েও ফর্সা, মিনুর বাবা মিনুর মায়ের চেয়েও ফর্সা! কাঁসিতে করে বাতাসা খেতে দিলেন মিনুর মা।

—অ খুকন, তোমাগ’ বাবা ডাক্তার? কায়স্থ তুমরা? আইস, বইস।

মিনুর বাবা বললেন—একদিন তুমার বাবার সাথে সাক্ষাৎ হইলে বালো অয়। ঘুষঘুষা জ্বর আর কাশি যাইতে চায় না।

বুনবুন বলল—চলুন না, আজই চলুন—আমার বাবা সন্ধে ছটার সময়ে চেম্বারে বসেন।

মিনুর মা বললেন—এতটুকুন ছেল্যা, কী সুন্দর কথা কয়। কী মিষ্ট! কান যেন জুড়াইয়া যায়। আইসবে বাবা, আবার আইসবে মা, কী নাম কইলা?—বিদ্যা! বাঃ—বাণী বিদ্যাদায়িনী নমামি ত্বং।

বুনবুন বারো নম্বরে ফিরতে ফিরতে ভাবে কালো মিনু তবে কোথায় গেল? কত মিনু আছে বাস্তুহারাদের মধ্যে? আর একটা পাবন আর একটা বিদ্যা আর একটা বরুণ তো সে আজও দেখেনি। অথচ বাস্তুহারাদের মধ্যে এত মিনু? শেয়ালদা স্টেশনের মিনুকে সে কোথায় খুঁজে পাবে? কেমন করে তাকে উদ্ধার করবে? এদের উদ্ধার করার দায়িত্ব তার আর তার বাবার। মিনু কুপার্স ক্যাম্পে যায় এটা তার ইচ্ছে নয়। একটা ছোট্ট মেয়ে যাদের সবাইকে কেটে ফেলেছে, যার মা ভারতে পৌঁছেও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না, শেয়ালদা স্টেশনেই মারা গেলেন, সে ক্যাম্পের ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা, জঘন্য খাবার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কেমন করে বাঁচবে? আজ যে অন্ধকার একতলার ঘরে সে মিনুকে দেখে এলো, সেখানেও তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মাসিমার কাছে সে শুনেছে, আজ মিনুর বাবার কাছেও শুনলো তাঁদের ওখানে কত আলো, কত হাওয়া, হাওয়ায় কী সুগন্ধ, কত শস্য, কত জল! তা হলে?

মিনুর বাবা সারদাবাবু যেদিন বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলেন, বুনবুন তাঁদের অলক্ষে পেছন দিকে চুপ করে বসে রইল।

সারদাবাবু বলছিলেন: আপনি জানবেন ডাক্তারবাবু আমাগ’ নাইন্টি পার্সেন্ট ভদ্রঘরের কেউ না কেউ স্বরাজের জইন্য আন্দোলন করছে। খাল বিল জলের দ্যাশ আমাগ’, পুলিসরে নাকানি-চুবানি খাওয়াইছে। লাভ হইল কী? —অশ্বডিম্ব। বাংলা আর পাঞ্জাব সবথিক্যা বেশি স্যাক্রিফাইস করল। এই দুইটারেই কাটল। বাংলার তো যা সর্বনাশ হইল—সারদাবাবু কপাল চাপড়াতে লাগলেন—ডক্টর প্রফুল্ল ঘোষ সভা কইরা কইরা কী কন জানেন? —হিন্দুরা দ্যাশ ছাড়বেন না, এ আপনাগ’ দ্যাশ, ছাইড়বেন কেন? কিছু হইব না। সভায় তো এই। এ দিকে সতীন স্যানরে কইলেন—কী? কবে যাইবেন? ও বাংলায়?

সতীন স্যান তো বাইক্যহারা—বলেন কি ডক্টর ঘোষ। এ বাংলার জিলায় জিলায় ঘুইরা আপনি ইয়াদের দ্যাশ ছাড়তে নিষেধ করলেন। আর আমায় কইছেন কি চলেন? ফাস্ট থিং আপনারে কমু কি আপনি স্বয়ং চইলা যান, আমাগ লিডারি আপনারে করতে হইব না।

দুর্গাপ্রসাদ বললেন—ডক্টর ঘোষ এই কথা বললেন?

—তয়ে আর কইছি কী?

—আপনাদের ওদিককার নেতারা যদি ওখানে থাকতেন, আপনাদের সবাইকে নিয়ে একটা রেজিস্ট্যান্স গ্রুপ তৈরি করতে পারতেন, তা হলে হয়তো এ দুর্দশা রোখা যেত।

—দ্যাহেন ডাক্তারবাবু, আমি কই কি শরৎ বসু মহাশয়ের অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব বেটার ছিল।

দুর্গাপ্রসাদ বললেন—এঁরা ভয় পেলেন অখণ্ড বাংলায় মুসলিম মেজরিটি হয়ে যাবে, স্লাইট হলেও তো মেজরিটি বটে! যে কোনও সময়ে পাকিস্তানে যোগ দিতে পারে।

—সইত্য, সে কথা সইত্য। কিন্তু এইটাই বা কী হইল? হিস্ট্রিতে এমুন আর একটি এক্সোডাস পাইবেন না। ইহুদিগ’ দশা হইল। উয়াদের একটা মোজেস আছিল, আমাগ’ তা-ও নাই। লোহিত সাগর, রক্তের সাগর আমরা পার হইত্যাছি বাপের, মায়ের, মাইয়ার, ছেল্যার, বউর, কার রক্ত নয়, কন? পার হইয়া যদি বা আইলাম, এই কইলকাতা এই পশ্চিমবঙ্গ, এইডা কি আমাগ’ স্বপ্নের দ্যাশ? যেখানে যাই, দূর দূর, যেখানে যাই দূর দূর! গোরু-ছাগলেরও অধম কইরা রাখছে।

দুর্গাপ্রসাদ বললেন— কিছু মনে করবেন না মাস্টারমশাই, নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। এমনিতেই কী অবস্থা এ বঙ্গের! খরা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ এ তো লেগেই আছে, এর ওপর যখন-তখন দাঙ্গা। আর এখন? সেন্টার কিচ্ছু করলে না, স্ট্যাস্টিসটিক্‌স্ যা শুনছি তিন লাখের কাছাকাছি লোক অলরেডি এসে গেছে, খালি বাড়ি, জমি, সব দখল নিয়ে নিচ্ছে। আপনাদেরও অস্তিত্ব বিপন্ন, আপনারাও মরিয়া অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছেন। এই কামড়াকামড়ি, এই ঘৃণা, এটাই রিয়্যালিটি, হিউম্যান রিয়্যালিটি, এই রিয়্যালিটিকে মেনে জেনেই আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে। এই আর কি!

—আমাগ’ প্রয়োজন এখন একটি কৃষ্ণ-অবতারের —সারদাবাবু বললেন, সেই তিনি ইন্দ্র-ভজনা বন্ধ কইরলেন। বাস ইন্দ্র কুপিত হইয়া বৃষ্টি পাঠাইলেন, বৃষ্টিতে ব্রজ ভাইসা যায়। তখন তিনি গিরিগোবর্ধন এক আঙুলে তুইলা ছাতার মুতন ধইরলেন ব্রজবাসীর মাথার উপর…

—আমরাও ব্রিটিশ-ভজনা বন্ধ করেছি বলছেন? দুর্গাপ্রসাদ স্মিত মুখে বললেন, —আর তাই ব্রিটিশ এই দেশভাগ দাঙ্গার রক্তের বন্যায় আমাদের ভাসিয়ে দিচ্ছে? কে ছাতা ধরবে সারদাবাবু! ছিলেন একজন, তাঁকে তো গুম করে রেখেছে।

—সুভাষবাবুর কথা কইছেন তো? সারদাবাবু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন—তিনি থাকলে তো এ সঙ্কট হইতই না। দেশভাগ তিনি কখনও মাইনতেন না। ইনটেনশনের কথা যদি বইলতে হয় তো তিনি কৃষ্ণরও বাড়া; স্বার্থ দেখেন নাই, ব্যক্তিগত লাভের জইন্য লালায়িত হন নাই, কিন্তু ক্ষমতার কথা যদি বইলতে হয়, তিনি তো অলৌকিক শক্তিধর ছিলেন না ডাক্তারবাবু। মানুষের পক্ষে যা সম্ভব তিনি তারও অধিক করলেন, কিন্তু মির‍্যাক্‌ল্‌, তিনি কি কইরা ঘটাইবেন! কলি কালে অবতার পুরুষেরও মির‍্যাকুলাস পাওয়ার থাকে না।

নবম অধ্যায় : জেনেসিস

মির‍্যাকুলাস পাওয়ার কী মাস্টারমশাই? —কানুমামুর মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেস করে বুনবুন।

মাস্টারমশাইয়ের বয়স মোটেই বেশি নয়। কিন্তু তিনি একটু ভারিক্কি৷ বিজ্ঞ সাজতে চেষ্টা করেন।

—মির‍্যাকুলাস-টুলাস জানি না খোকা, ক্যালকুলাসের কথা বলতে পারি তবে সে তো তুমি এখন বুঝবে না। মানুষ যদি হতে চাও তবে ওইসব মির‍্যাক্‌লট্‌ল নিয়ে মাথা ঘামিও না। উচ্ছন্নে যাবে।

কানুমামু চোখের ইশারা করে— মাস্টারমশাই রেগেছেন, ভাগ্‌ এখান থেকে। কানুমামুর ঠোঁটের ওপর কচি ঘাস, কানুমামুর চোখ চকচক নাক চকচক। সে এখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাস্টারমশাইয়ের পাঠ্যসূচীবহির্ভূত বক্তৃতার ইন্দ্রজাল শুনবে। জার্মানি-ইংল্যান্ড-রাশিয়া, মার্কস-এঙ্গেলস, ক্লাস-ওয়র, ক্লাস-এনিমি, প্রোলেটারিয়েট….।

বুনবুন খপখপ করে তুলে নেয় তার বইখাতা। শব্দ করে চলে যায়। মাস্টারমশাই চশমা খুলে কাচ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করেন—কী হল? ও কি রাগ করলো না কি?

কানুমামু অপ্রস্তুত মুখে বলে— ও একটু মেজাজি ছেলে, জানেনই তো!— ভাল ভাল, মেজাজি হওয়া ভাল— মাস্টারমশাই চশমাটা পরে ফেলে ওপর নীচে দেখে নেন- ওই সব বিনয়-টিনয়….বিদ্যা বিনয়ং দদাতি, শ্রদ্ধয়া দেয়ম্‌ অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম—সব অবসলিট, বোগাস। বিনয় আবার কী? কেনই বা? আই হ্যাভ এ কোয়েশ্চন। পারো তো জবাব দাও, নেহি তো ভাগো হিঁয়াসে। আরে বাবা শ্রদ্ধায় কেউ দেয়? দেয় বাধ্য হয়ে। কেড়েকুড়ে নিতে হয়। নিয়ে নেবে এই ভয়ে চালাকরা আগে থেকে দিয়ে দেয়, বুঝলে? দাবি করতে শেখো, ডিমান্ড, মাথা উঁচু করে চাও, প্রতিবাদ করো, দলবদ্ধ হও, না দিলে ভাঙো চোরো, তছনছ করো। মেরে পাট করে দাও। লাট করে দাও সব।

চারিদিকে সাম্রাজ্য পতনের শব্দ হয়। ধ্বংসস্তূপের ওপর ধিকি ধিকি আগুন জ্বলে। সেই আগুনের ওপর দিয়ে গাজনের সন্ন্যাসীদের মতো খালি পায়ে ছুটতে থাকে উন্মত্ত জনতা। কামান গর্জে ওঠে, ট্যাঙ্ক গড়ায়, ঝাঁকে ঝাঁকে বম্বার উড়ে যায়। জলপাইগুড়ি-পশ্চিম দিনাজপুর-দার্জিলিং থেকে যাদবপুর-বেহালা-বালি নদিয়া-হাওড়া-হুগলি-বর্ধমান সর্বত্র মাটি ফুঁড়ে বাঁশের কেল্লা উঠতে থাকে অরবিন্দনগর, আজাদগড়, বাঘাযতীন। বিজয়নগর, ঠাকুরপুকুর, পল্লীমঙ্গল, মাহেশ উদ্বাস্তু শিবির, সেবা গ্রাম, শহীদ কলোনি, মুক্তিনগর, খুদিরাম পল্লী— অজস্র অজস্র, ছিন্নমূল ক্ষুধিত আশাহত, মরিয়া মানুষের নতুন উপনিবেশ, নতুন উপনিবেশবাদ। আর সব সংগঠনকে একত্র করে উঠে দাঁড়ায় ইউনাইটেড সেন্ট্রাল রিফিউজি কাউন্সিল। মিছিল মিছিলে ক্রমে কণ্ঠরোধ হয়ে যেতে থাকে শহরের। ঘৃণা, পুলিশের লাঠি, জনতার ইঁট-পাটকেল, মার, পাল্টা মার সমস্ত মানবীয় অনুভূতির গলা টিপে ধরে। জল ঘোলা হয়ে যায়। ঘোলা জলে চমৎকার মাছ ধরে চতুর চালাক।

বরুণ অনাদিপ্রকাশকে জিজ্ঞেস করে— দাদাভাই, অবতারপুরুষ কী? কে?

—কেন? আমি যে দশাবতার স্তোত্র গাই, শোননি?

প্রলয় পয়োধি জলে ধৃত বানসি বেদম্‌

বিহিত বহিত্র চরিত্রমখেদম

কেশব ধৃত মীন শরীর জয়জগদীশ হরে…

—ও তো সেই মীন, কূর্ম, বরাহ, বামনদের রূপকথা।

—রূপকথা? তা বোধহয় নয় বুনটু। বড় হয়ে যখন প্রাণীর বিবর্তনের কথা পড়বে তখন এগুলো আর রূপকথা মনে হবে না। রূপক হয়তো, রূপকথা নয়।

ভারি বিরক্ত হয় বরুণ,— মাছ, কচ্ছপ, বরাহ (‘শুয়োর’ কথাটা বলা চলে না) —এরা আবার কিছু করতে পারে না কি?

—পেরেছিল হয়তো। সেই সময়ে। তবে মাছ-কচ্ছপদের যদি তোমার মনে না ধরে তো রাম, বুদ্ধ এঁরাও তো ছিলেন।

—ওঁরা কী করেছেন?

—রাম মানে পরশুরাম একুশবার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন। আর আমাদের অযোধ্যার রামও তো দুর্বৃত্ত রাবণ কুম্ভকর্ণকে ধ্বংস করলেন।

—পরশুরাম সব রাজাদের মেরে শেষ করেছিলেন? বাঃ। এটা কি ভাল কাজ নাকি? উনিই তো বাবার কথায় মাকে মেরে ফেলেছিলেন। উনিই তো কর্ণকে রথ বসে যাবার শাপ দিলেন শুধু শুধু।

—রাজারা হয়তো অত্যাচারী হয়ে গিয়েছিলেন।

—আর কর্ণ? কর্ণ ওঁর ঘুম যাতে না ভাঙে তাই বজ্রকীটের দংশন সহ্য করলেন আর উনি শাপ দিলেন। রামও তো সীতা বিসর্জন দিয়েছিলেন। ধ্বংস করা আর শাপ দেওয়া ছাড়া এঁরা কি কিছু জানেন না?

—তা যদি বলো বুনটু তো বুদ্ধ আছেন। কেশবধৃত বুদ্ধশরীর। তা ছাড়া খ্রিস্ট? খ্রিস্টকেও তো আমরা অবতারই ধরি।

—ধুর, বুদ্ধ তো খালি সন্ন্যাসী হতে বলেন। আর মাছ-মাংস খেতে বারণ করেন। খালি লড়াই করো না। হিংসা করো না। আর খ্রিস্ট তো আরও বোকা। ক্রুসে ওকে গেঁথে দিল। উনিও গেঁথে গেলেন। এক গালে চড় মারলে আর এক গাল ফিরিয়ে দাও। ধুত্‌।

দাদাভাই বলেন— তা হলে তো ভারি মুশকিল বুনটু, মেরে শেষ করা, ধ্বংস করা তা-ও তোমার বরদাস্ত হচ্ছে না। আবার অহিংসা, সন্ন্যাস, ক্ষমা, সহনশীলতা তা-ও তুমি পছন্দ করতে পারছ না। কী করি এখন? কী করেন বেচারি আবতারেরা?

—সব অবতারের বেলাতেই যে আপনি কেশবধৃত কেশবধৃত করছেন, কেশব কে?

—যাঁরা এই অবতারদের কথা লিখেছেন তাঁরা ঈশ্বর অর্থাৎ জগৎকারণ আর কেশব কৃষ্ণকে এক দেখতেন।

—আর আপনি? আপনি কী দেখেন?

দাদাভাই হেসে বলেন— আমি? আমি এই বুনটুকে দেখি। কেশবধৃত বালশরীর জয় জগদীশ হরে।

তখন বরুণের মনে পড়ে যায় তারা তিনজন অষ্টমগর্ভ। অষ্টমগর্ভে শ্রীকৃষ্ণ জন্মেছিলেন, এ কথা তারা সারা ছোটবেলা জুড়ে কতবার শুনেছে। দাদাভাই কি ঠাট্টা করতে পারেন তার সঙ্গে? কখনই না। দাদাভাই কি ভুল করতে পারেন? যে দাদাভাই ই-দাদার চেয়েও ভাল অঙ্ক জানেন, পমদিদির থেকেও ভাল সংস্কৃত জানেন, তিনি করবেন ভুল?

ভুল সে-ই করেছে। তারা-ই করেছে। ভুলে গেছে তারা কে। সে সংকল্প করে প্রাণপণে মনে করবার চেষ্টা করবে তার মধ্যে কেথায় লুকিয়ে আছে সেই নীলাভ শরীর, সেই বিশ্ব জনমোহন বাঁশি, সেই কালভৈরব চক্র। তখন সে যা ইচ্ছে করতে পারবে।

শনিবার সন্ধেবেলায় চার নম্বরে গিয়ে সে পুনপুন আর বুবুকে চুপিচুপি কথাটা বলে। ওরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না।

—আমরা তিনজন এক এটা তো বিশ্বাস করিস? বুনবুন বলে।

—আগে বিশ্বাস করতুম, এখন করি না— বুবু সখেদে বলে— কেন জানিস? তোরা এখন অ্যালজেব্রা কষছিস, আর আমি দশমিকই পারছি না, তোরা এক, আমি আলাদা।

পুনপুন বলে—এ কথাটার কোনও মানেই হয় না। আমরা কি তোর মতো আটা মাখতে পারি? রুটি বেলতে পারি? মাছ বাছতে পারি?

বুনবুন বলে— সবাই মিলে সব পারব।

বুবু বলে— আমার অনেক দিনই মনে হত, আমি একজন পরী৷ কে শাপ দিয়েছে তাই তোদের কাছে জন্মেছি। একদিন ঠিক হুশ করে উড়ে যাব।

রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনজনে ঠাকুমার একহারা মাদুরটা নিয়ে ছাতে যায়। হাওয়ার স্রোত বইছে এখন। হাওয়া তো নয়, যেন সাগর, ঢেউয়ে ঢেউয়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

—সেই যে চুপ করে বসে থাকা খেলাটা বুজবুজদিদি খেলাত, সেইরকম করব? মাথায় বুরুশের মতো চুল, বোতামের মতো চকচকে চোখ, লাল ফুটি-ফুটি ফ্রক পরা বুবু জিজ্ঞেস করে।

পুনপুনের রোগা কোমর থেকে কালো ঝলমলে পেন্টুল ঝুলছে, মাথার পেছন দিকের কয়েক গাছি চুল খাড়া-খাড়া, সে বলে—আমি জানি, পাকুমার পরশমানিক যখন হারিয়ে যায় তখন রোজ আমি ছাতে বসে পদ্মগোখরোকে ডাকতুম—হে গোখরোঠাকুর, হে গোখরো ঠাকুর, হে গোখরোঠাকুর পরশমানিকটা আমায় পাইয়ে দাও।

বুনবুন খুব অসহায় বোধ করে। ব্যাপারটা এরকম নয়। চোখ বুজিয়ে চুপ করে তো রাজ্যের খেলনাপাতি, চকোলেট-লজেন্সের কথাও ভাবা যায় তাতে কী করে কাজ হবে! নিজের ভেতরে তলিয়ে যেতে হবে। দেখতে হবে। আর প্রার্থনার কোনও প্রশ্নই নেই। কারণ সে, সম্মিলিতভাবে তারা নিজেরাই তো সেই অবতারপুরুষ যাঁর জন্য সারদাবাবুদের, দুর্গাপ্রসাদদের আরও কত কোটি কোটি মানুষ, দুর্গত মানুষ, অন্যায় অবিচারে ক্ষত-বিক্ষত মানুষের প্রার্থনা। এত কথা সে বোঝাবার মতো করে ভাবতেও তো পারছে না। খালি অস্পষ্টভাবে বুঝছে।

তাই কিছু বলতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত সে কিছুই বলে না। চুপ করে বসে থাকা খেলাটাই শুরু হয়ে যায় অতঃপর। খুব হাওয়া দেয়, সুপুরি গাছগুলো খুব দোলে। সিংবাড়ির ছাতের আলসেতে একটা প্রকাণ্ড অশথ গাছ আর একটা পাকুড় গাছ গজিয়েছে, তাতে ঝর ঝর থর থর শব্দ হয়, চাঁদ ক্রমশ মাঝ আকাশে ওঠে, তারাদের ঝেঁটিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। আকাশ থেকে এক অন্ধকার পুরুষ নেমে আসতে থাকেন, পৃথিবীব্যাপী এক মহাজলধিতে ডুব গালেন তারপর দিক-বিদিক আড়াল করে উঠে দাঁড়ান, বরুণের হাতে ফিরিয়ে দেন লক্ষ লক্ষ শিশুর, নারীর, পুরুষের সঞ্জীবিত প্রাণকোষ। অজস্র শিশু তাঁর হাতের মুঠো থেকে, নিশ্বাস বায়ু থেকে, নেত্র থেকে জ্যোতির্বিন্দুর মতো ঝরে ঝরে পড়ে। সেইসব মিনুদের প্রত্যেককে বাবা-মা-ঘর খুঁজে দিতে থাকে বরুণ। সে মুঠো করে তুলে আনে মাতৃস্তন, নারীদের শূন্য বুকে স্তন যোজনা করে, পুরুষদের কুক্ষিতলে লিঙ্গযোজনা করে দিগবিসারী মাঠে মাঠে সোনালি শস্য দোলায়, নদীতে নদীতে মঙ্গলবারি বওয়ায়, আকাশে আকাশে ভাসিয়ে দিতে থাকে কল্যাণমেঘ। দিতে দিতে সে দেখে পাবন গানঘরে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দিল, সেই প্রদীপ ক্রমে অধূমক অগ্নি হয়ে জ্বলে, তাতে পুড়ে যেতে থাকেন রাঙাজেঠু, নতুন কাকু, বর্মার জেঠু, কর্তামা, ছবিরানির বাবা-মা, ছোট ঠাকুর্দা, জিনাকাকিমা, এক সিং-বাড়ি থেকে আরও অনেক সিং-বাড়ির জ্যাঠা-কাকা জেঠিমা-কাকিমা-পিসিমা এবং ঝাঁটাগোফ, ফাঁকা চুল, তেলমাখা চটচটে দুর্মুখ দুর্ভাগা মানুষ সব। ক্রমে আগুনের ভেতর থেকে স্বর্ণাভ এক পিতামহী স্বর্ণাভ পরিজনেদের কোলে কাঁখে করে হেসে কেঁদে বেরিয়ে আসেন। পাবন জিজ্ঞেস করে—তুমি কি তা হলে পরশমানিক পেয়েছো?

—এই তো—সোনারঙের মানুষগুলি দেখিয়ে তিনি বলেন। ছবিরানি আসতে থাকে। তার ভুরু গজিয়েছে, শরীর থেকে থলো থলো চর্বি সব ঝরে গেছে, ছবিরানির পেছন পেছন আসতে থাকে তার অকালমৃত বোনেরা। লীলাময়ী এসে তাকে কোলে তুলে নেন, অ্যালিস খুলে দেন তাঁর স্বর্ণভাণ্ডার, মানিক হাসতে হাসতে হাসতে বলে—যাকে ইচ্ছে তাকেই এ সোনা দিতে পারিস। কিন্তু হাজার দিলেও দরকারের বেশি কেউ পাবে না। কেউ না।

বরুণ বলে—বিদ্যা এবার তোর দান। —মনে মনে বলে, এখন সবাইকার মন এক হয়ে আছে বলে সবাই সবাইকার কথা শুনতে পায়।

বিদ্যা কী জানে? কী পারে? সে তার ছোট্ট জীবনে যত মানুষ দেখেছে, যত স্বভাব, যত আচার, আচরণ এবং যা দেখেনি সেইসব মানুষ, ভাষা, ধর্ম, বিশ্বাস সব আটা ময়দার মতো মিশিয়ে চালতে থাকে। তারপর তাতে স্নেহপদার্থের ময়ান দিয়ে ঠেসে ঠেসে মাখে, মাখতে মাখতে এমন মাখে যে এতটুকু খিঁচ থাকে না। পিসিমা বলেন—ময়দার পাটে এ মেয়েকে কেউ হারাতে পারবে না। মা প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকান। সে কৃতার্থ হয়ে যায়। ভীষণ আহ্লাদে সে লেচি কেটে কেটে বরুণ-পাবনের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয়। দেখা যায় ঐ সমস্ত মানুষ, সমস্ত আচার, সমস্ত অভ্যাসের অবস্থান পাল্টে গেছে, একটা লেচিতে যদি পিসিমা-ঠাকুমা দুই মনো, তবে আর একটা লেচিতে গলাগলি করে দুর্গাপ্রসাদ পুলক শ্রদ্ধা, একটাতে যদি প্যাটেল জিনাহ তো আর একটাতে সুভাষ নেহরু, একটাতে যদি টলস্টয়ের পায়ের তলায় হিটলার, তো আরেকটাতে লেনিনের সঙ্গে গান্ধীজি। নিবেদিতার পায়ের তলায় এডুইনা মাউন্টব্যাটেনকে এনে ফেলে ওরা, সারদামায়ের পরিবেশনে খেতে থাকেন চার্চিল-ট্রুম্যান-স্ট্যালিন, বিবেকানন্দর সঙ্গে ভিড়ে যান রাসেল, আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কামাল আতাতুর্ক। এইসব মানুষদের অধিকাংশকেই যে ওরা চেনে না তাতে কিছু এসে যায় না কারণ মানব অস্তিত্বের মূল উপাদানগুলোকেই ওরা মিলিয়ে মিশিয়ে নিয়েছে। মানুষের পাট সেরে তারপর গোটা পৃথিবীটার ভূগোল এবং ইতিহাস নিয়ে টানাটানি করতে থাকে তিন জোড়া অপটু হাত, বুঝি এই পৃথিবী, এই সভ্যতার উপকরণগুলোর বিন্যাস অদলবদল করে দিয়েই গড়ে ফেলতে চাইছে এক চতুর্থ পৃথিবী।

রাত এগারোটা বেজে গেছে। দেবহূতি শুতে এসে দেখেন তিন মূর্তি নেই। এত রাত তাঁর হয় না। বাসন মাজার লোক আসছে না। রাতে সবার খাওয়ার পর রান্নাঘর ধুয়ে, উনুন নিকিয়ে, সমস্ত বাসন মেজে উঠেছেন। তারপরে বেশ করে সাবান মেখে চান করেছেন, আরও একটা বিলাসিতা করেছেন, উষসী পাউডার ছড়িয়েছেন গায়ে, তারপর ধোপার বাড়ির পাট ভেঙে একটি ভোমরাপাড় শাড়ি পরে শুতে এসেছেন। এসে দেখেন এই।

কোথায় গেল? কদিন ধরেই ছেলে দুটোকে সূর্য-অংশুর ঘরে পাঠাবার চেষ্টা করছিলেন, তাই গেল না কি? মেয়েটাও নিশ্চয় ট্যাং ট্যাং করে গেছে। কই না তো? ইন্দ্র-পুলকের ঘর ফাঁকা, ইন্দ্র গেছে কানপুরে, ইনটারভিউ দিতে। দুর্গাপ্রসাদ ওপাশে তক্তপোষে নাক ডাকাচ্ছিলেন। দেবহূতি ডাকেন— শুনছো? ছোট তিনটে কোথায় গেল বলো তো?

—কোথায় যাবে? দেখো ভালো করে।

—সব দেখেছি।

—মেয়েদের ঘরে?

—ও ঘর তো ওরা কখনই খিল দিয়ে দিয়েছে। ঢুকতেই দেবে না ওদের।

—ছাতে দেখেছো?

—ছাতে? এত রাত্তিরে? ভিতুর অবতার তো এক একটি।

দুজনে ছাতে যান। হু হু হাওয়া দিচ্ছে। বেলফুলের গন্ধে সব ছমছম করছে।

দেখেন নিভন্ত জ্যোৎস্নার ছাতে, এক চিলতে মাদুরের ওপর, হাত পা ছড়িয়ে তিনজনে ঘুমিয়ে আছে।

…আর সপ্তম দিনে ঈশ্বর তাঁর যা-কিছু গড়ার কাজ সব শেষ করে ফেললেন— আলো-আঁধার আকাশ মাটি। গাছপালা, মানুষজন, মন মেজাজ সভ্যতা-সংস্কৃতি। চারদিকে চেয়ে দেখলেন আহা সব বেশ তৃপ্তিকর, চমৎকার। আগেকার ভুলগুলো শুধরে নেওয়া গেছে। তখন তিনি সমস্ত, সমস্ত, সমস্ত কাজ থেকে বিরত হয়ে নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেলেন।

॥ তৃতীয় স্কন্ধ-প্রথম খণ্ড সমাপ্ত ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *