অষ্টম গর্ভ ১ – প্রথম স্কন্ধ

প্রথম স্কন্ধ

পূর্বরঙ্গ

নীলকান্তমণির ন্যায় গাত্রবর্ণের পেশল হ্যান্ডসম পুরুষ তিনি। বিরাট বিশাল। উঁকিঝুঁকি মারিলাম। আশেপাশে কিছুই দেখিতে পাইলাম না। ভূর্ভুবঃস্বঃ আড়াল করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। আকাশে ডান হাতের তর্জনী তুলিয়া শঙ্খনাদে বলিলেন, ‘আমি কি অবতীর্ণ হইব?’

তাঁহার শূন্য তর্জনীর দিকে চাহিয়া দুশ্চিন্তিত হইয়া বলিলাম, ‘প্রভু আপনার চক্র কোথায়?’

—‘দুষ্কৃতীদের বিনাশের জন্য পাঠাইয়াছিলাম, যুগ ঘুরিতে চলিল, ফিরে নাই।’

—‘সর্বনাশ! হইলটা কী? গেল কোথায়?’

—‘টুকরাটুকরাটুকরাটুকরাটুকরাটুকরা হইয়া পৃথিবীময় ছড়াইয়া গিয়াছে শুনিতেছি। নিউট্রন বোমা হইতে চকোলেট বম্ পর্যন্ত বিচিত্র রূপে।’

—‘তাহা হইলে আর আপনি যাইয়া কী করিবেন?’—হতাশ হইয়া বলিলাম। এই চক্রই তো শিশুপালবধ করিয়াছিল। চক্রহস্তে ছুটিয়া আসিতেছেন দেখিলে তবেই তো লোকের কাপড়ে-চোপড়ে হইয়া যাইত!

নীলকান্ত পুরুষ চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া তর্জনী ঘূর্ণিত করিলেন। অর্থাৎ চক্র নাই তো কী হইল? তর্জনী তো রহিয়াছে! তাহাতে কমান্ডও আছে। চক্ষু আছে, তাহাতে রাইচাস ইনডিগনেশনের অগ্নিশিখা জ্বলিতেছে না কী? মস্তক আছে, মস্তিষ্কে ডিপ্লোম্যাসি কি নাই? আশা করিয়াছিলেন বলিব—

ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণস্তমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্।

বেত্তাসি বেদ্যঞ্চ পরঞ্চ ধাম, ত্বয়া ত্বং বিশ্বমনন্তরূপ।

[তুমিই আদিদেব, পুরাণ পুরুষ, তুমিই বিশ্বের লয়স্থান! জ্ঞাতাও তুমি, জ্ঞেয়ও তুমি, চৈতন্যও তুমি, হে অনন্তরূপ, বিশ্বকে ব্যাপ্ত করিয়া আছ তুমিই। ]

একদা তৃতীয় পাণ্ডব চমৎকার দেখিয়া, চমৎকার শুনিয়া ভুলিয়া ছিলেন। কিন্তু ভবি ভুলিল না। ভবি অনেক মেগালোমেনিয়াক দেখিয়াছে।

বলিলাম, ‘চক্রটি তাহা হইলে এখন দুঃশাসনের হাতে? শকুনির হাতে? কী হইবে?’

অট্টহাস্য করিলেন, ‘কুরুবংশ ধ্বংস করিয়াছি, যদুবংশ ধ্বংস করিয়াছি। যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

মনে মনে বলিলাম—ধ্বংসই যদি সমাধান হইত তো কয়েকটি সুপার-পাওয়ারের ভাঁড়ার হইতে গুটিকতক বোমা কব্জা করা আর এমন কি কঠিন কাজ হইত! চারিদিকে এত প্রতিভাশালী স্মাগলার রহিয়াছেন! বাঁচিয়া থাকিতে চাওয়াই যে জীবের স্বভাব! সকলেই চায় অন্যরা মরিয়া যাক, আমরা বাঁচিয়া থাকি। সেটি সম্ভব নয় বলিয়াই ক্রমাগত পাঁয়তাড়াই কষিয়া যাইতেছে, পাঁয়তাড়াই কষিয়া যাইতেছে। রণক্ষেত্রের সম্মুখসমর ছাড়িয়া বাণিজ্যক্ষেত্রের গেরিলা ট্যাকটিক্স ধরিয়াছে। না হইলে সাদ্দাম-বুশের স্কাড-পেট্রিয়ট দ্বৈরথ কি মুষলপর্ব হইতে কোনও অংশে কম?

মুখে বলিলাম, ‘ধ্বংস করিতে কি সত্যই পারিয়াছেন? এত দুঃশাসন কোথা হইতে আসিল? এত শকুনি!’

সহসা তাঁহার চক্ষু হইতে অগ্নি অন্তর্ধান করিল। গাত্রবর্ণ ফেকাশে হইতে লাগিল। তিনি এক হাত কনুই ভাঙিয়া ফণার মতো উপরে তুলিয়া আর এক হাত শস্য ঝাড়িবার কুলার মতো নিম্নমুখী করিয়া বরাভয় মুদ্রায় দাঁড়াইলেন। কুঞ্চিত কেশ সদ্য গজাইয়া মস্তকময় পাকাইয়া পাকাইয়া রহিয়াছে। মস্তকের শীর্ষভাগ সামান্য উঁচু। রক্ত গৈরিক ত্রিচীবর তাঁহার পদ্মপলাশবর্ণ গাত্রে বড়ই মানাইয়াছে।

কেশবধৃত বুদ্ধশরীর জয় জগদীশ হরে!

দেখিলাম ইনি পুরাপুরি গান্ধার আর্টের নহেন। আবার পুরাপুরি মোঙ্গলীয় ধাঁচেরও নহেন। অজন্তার এক নং গুহার উপবিষ্ট মূর্তিটিরই মতো উদাসে কোমলে মুখরুচি।

সবিনয়ে বলিলাম, ‘ভন্তে, আপনি আবার কেন? সভ্যজগৎ অর্থাৎ পশ্চিম-গোলার্ধ এমনিতেই ভেজ হইয়া যাইতেছে। পূর্বাঞ্চলে আবার মাংসাদিও ঘাসের ন্যায় স্বাদযুক্ত। আপনিই ত্যাগ হইয়া যাইবে।’

—‘তথাগত তো পৃথিবীকে ভেজ করিতে আইসেন নাই!’

—‘শুনিয়াছি বটে, ভিক্ষান্নে মৎস্য-মাংসাদিতে আপনি আপত্তি করিতেন না। যাহা হউক আপনার বিশেষ বিশেষ সম্বাদ কী?’

—‘দরিদ্র সুন্দর। দারিদ্র্য সুন্দর। ভোগ সুখ ত্যাগই একমাত্র পথ।’

—‘শুনিয়াছিলাম যেন আপনি মধ্যপস্থার সুপারিশ করিয়াছিলেন?’

ভগবান বলিলেন, ‘ওই হইল আর কি!’

দেখিলাম ইনি নিজবাণী ছাড়িয়া ‘সিসটার্স অফ চ্যারিটি’র বাণীই গ্রহণ করিয়াছেন। হইবে না কেন? যস্মিন যুগে যদাচার। মাদার টেরিজা এখন তাঁহাকে সুপারসীড করিয়াছেন।

করুণা হইল। গোপন করিয়া বলিলাম, ‘তাহা হইলে আপনাকে আগে বিজ্ঞাপনদাতাদিকে কনভিন্‌স্‌ করিতে হইবে ভন্তে। ইঁহারা বাচ্চাদের বলিতেছেন—“অহে বাচ্চা, আঁস্তাকুড় হইতে নিমাইয়ের মতো উঠিয়া আইস। নিমাই শচীমাতাকে অস্পৃশ্যতার সংজ্ঞা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। কদাপি ওরূপ করিও না। মাতা স্বাস্থ্যবিধি বুঝাইতে জীববিদ্যার ব্যাকটিরিয়া-ভাইরাসাদির অধ্যায় হইতে শুরু করিবেন। তুমি শুধু ঠোঁট ফুলাইয়া মাম্মিকে জানাইয়া দাও একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের সাবান ছাড়া স্নানই করিবে না।” ইঁহাদের যুবক পথপার্শ্বের দোকানেই পাওয়া যায় এমন একটি পানীয়র বোতলের জন্য পর্বতশীর্ষ হইতে দড়ি পায়ে বাঁধিয়া ঝাঁপ খাইতেছে, ছুটন্ত ট্রাক হইতে বোতল তুলিয়া লইতেছে। অর্থাৎ এক বোতল সাড়ে সাত টাকা দামের পানীয়র জন্য যুবক জান-মান সকলই বিপন্ন করিল। মর‍্যাল ক্যারেক্টারের আর রহিল কী? একটি দুর্গত যুবক যদি একই কার্য করিত, তাহাকে কি চোর বলিয়া গণপ্রহার খাইতে হইত না?’

শীর্ণ হইয়া যাইতেছেন। আর কত রোগা হইবেন ভন্তে? আরও ফেকাশে। ওমা সুমুণ্ডিত মুখে সোনালি দাড়ি গজাইল যে! চুলগুলিও বড় বড় হইয়া যাইতেছে। ত্রিচীবর ফেলিয়া কখন যে আলখাল্লা পরিয়া ফেলিয়াছেন বুঝিতেই পারি নাই। দুর্বোধ্য ভাষায় হাত নাড়িয়া নাড়িয়া কী বলিতেছেন। বোধ হইল উহা অ্যারামাইক ভাষা। উনি সার্মন অন দি মাউন্ট বলিতেছেন।

কেশবধৃত খ্রিস্টশরীর জয় জগদীশ হরে।

বলিলাম, লর্ড, আপনি আর হাসাইবেন না।

ঝোঁকে ছিলেন। সার্মনগুলি শেষ করিয়া ‘আ য়্যাম দা রেজারেকশন অ্যান্ড দা লাইফ’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলিয়া যাইতে থাকিলেন। তাহার পর সহসা চমকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হাসির কথা হইতেছিল কেন? কে হাসিবে?’

—‘আজ্ঞা, গুড়ায় হাইস্যা দিব।’

—‘গুড়া? অর্থাৎ ঘোড়া? উহা ওয়র-লাইক অ্যানিমল। হাসিবে কেন?’

—‘“আঁখ মারে, ও লড়কি আঁখ মারে” —গান শুনিয়াছেন?’

—‘ইহা কী ভাষা? গানটি কি psalm গান?’

—‘ইহা ফিলমি হিন্দি লর্ড, গানটি ফিলমি হিন্দি গানা, তা একরূপ সাম গান বইকি! ইহাতে কোনও লড়কির চোখ মারার আনন্দসংবাদ জারি করা হইয়াছে।’

—‘লড়কি? অর্থাৎ বালিকা? ল্যাস? চোখ মারিতেছে? ইয়ে, মানে বিশেষ পল্লী?’

—‘না লর্ড। সত্য-সত্য মারে নাই। পল্লী-টল্লীও নহে। ভদ্রঘরের কালেজে পড়া বালিকা। ইহাদের প্রকৃত স্মার্ট করিবার চেষ্টা চলিতেছে। “এগজাম্পল ইজ বেটার দ্যান প্রিসেপ্ট” আপ্তবাক্য স্মরণ করিয়া ইহাদের ফিলমের সাহায্যে বোঝানো হইতেছে যে, চোখ মারা ভালো। নিত্যকর্মপদ্ধতির অঙ্গবিশেষ। এই পরিস্থিতিতে “ইফ দাই রাইট আই অফেন্ড দী, প্লাক ইট আউট অ্যান্ড কাস্ট ইট ফ্রম দী”, আওড়াইলে হাস্যম্পদ হইবেন না?’

লর্ড কথাটি কহিলেন না। আকাশপটে ক্রুশবিদ্ধ হইয়া ঝুলিতে থাকিলেন। এত অল্পেই যদি ইনি ভড়কাইয়া যান তো ঝুলুন। কী আর করিব? অন্তত একটি ভালো ওয়ল-ডেকোরেশন তো হইয়াছে! একটি খাজুরাহোর যক্ষী আর একটি ক্রুসিফিক্স থাকিলে ঘরের চেহারা পাল্টাইয়া যায়, যায় না?

এই সময়ে মহম্মদীয়গণের নবীসংক্রান্ত কিছু ভিসুয়ালও অ্যান্টেনায় ঠেলাঠেলি করিতেছিল। উৎসুক হইয়া গুছাইয়া বসিতেছি। আকাশবাণী হইল :

‘ওয়ান টু থ্রি

সলমন রুশ্‌দি।

ইলেভন, টুয়েলভ থার্টিন

তসলিমা নাসরিন।’

আমি দুই হাতে চক্ষু ঢাকিলাম।

প্রথম অধ্যায় : আবির্ভাব

শুনেছি, আমি যখন গর্ভে তখন মা-বাবা কাকভোরে উঠে গীতা পড়তেন। রোজ এক অধ্যায় করে। তার চেয়ে বেশি পড়ার সময় হত না। গোয়াল কাঁড়া, জাবনা দেওয়া, মেঝে নিকোনো, উনুনে গোবর-ন্যাতা দেওয়া—দুটি মুনিষসুদ্ধু এত বড় সংসারের চারবেলার অন্নসংস্থান করা এ সমস্তই তো মাকে করতে হত! সকাল ছটা থেকে আটটা বাবার ইস্কুল বা পাঠশাল বসত একটা চৌচালা ঘরে। আটটা থেকে বারোটা কখনও একটা পর্যন্ত তাঁর ডাক্তারখানা। তারপর চান করে একটু বিশ্রাম করে বাবা পড়ন্তবেলায় মাঠের কাজ দেখতে যেতেন। চারটে থেকে ছটা আবার ডাক্তারখানা। তারপর লণ্ঠনের আলোয় ছেলে-মেয়েদের পড়ানো। শুধু গীতাই নয়, বাবার আকর্ষণ ছিল সবরকম মহামানববাণীর ওপরে। এদিক থেকে তাঁকে রামমোহনীয় বলা যায়। মথি-লিখিত, লুক-লিখিত সুসমাচারগুলিরও সুতরাং বাড়িতে সে সময়ে একটু প্রাদুর্ভাবই ঘটে। লাল লাল ছোট ছোট পুতুলের বইয়ের মতো বই সব। এখনও আমাদের বাড়িতে আছে। ‘ধম্মপদ’-এর কোনও বাংলা বা ইংরেজি অনুবাদ বাবা পাননি। তবে ঈশানচন্দ্র ঘোষের জাতকগুলি তখন বেরিয়েছে। সেগুলো স-বই তিনি কলকাতা থেকে কিনে আনিয়েছিলেন। ‘স্ত্রী-জাতক’ প্রমুখ কয়েকটি কাহিনী ছাড়া প্রায় সবই তাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পড়ে মনে রেখেছিলেন। ‘কথামৃত’ তো ছিলই। ‘রাজযোগ’ ও ‘স্বামি-শিষ্য সংবাদ’ও ছিল বাবার বিশেষ প্রিয় বই। তবে মায়ের এত খিদে পেত যে ইচ্ছে সত্ত্বেও মা এত কিছু পড়ে উঠতে পারতেন না। শোবার সময়ে বালিশের নিচে বই নিয়ে শুতেন, বাঁ হাতটা বালিশের তলায় গলিয়ে বইটাকে ছুঁয়ে। সে সময়ে সের দেড়েক দুধ নাকি মা অনায়াসে চোঁ চোঁ করে খেয়ে নিতেন। তা ছাড়াও ভাত, তরি-তরকারি, সময়ের ফল, মাছ—এ সব মায়ের ভাষায় মুনিষদের মতো খেয়েও মায়ের খিদে মিটত না। মাথা ঝিমঝিম করত সব সময়ে, সে এক ‘আকাশ খাই পাতাল খাই’ খিদে। এই খেয়ে উঠলেন আবার খিদে পেয়ে গেল। ভাগ্যিস খেয়েছিলেন! না হলে পৃথিবীর এমন আলো কি দেখতে পেতুম। তা, প্রতিবেশিনীরা নাকি একদিন মায়ের খাওয়া দেখে ফেলেছিল, তারা বলে আকাল আসছে। গর্ভিণীর খাওয়ার পরিমাণ যখন সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন নাকি গর্ভস্থ শিশু আকাল নিয়ে আসে। গর্ভাবস্থায় প্রথম দিকে সমস্ত পৃথিবীর বাতাস মায়ের কাছে যেন বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। তীব্র কটু গন্ধ পেতেন সব সময়ে। তেল, সাবান ইত্যাদির সুগন্ধও সহ্য করতে পারতেন না। এক মাইল দূরে কাঠকুটো জ্বালালেও মা ধোঁয়ার গন্ধে দম-বন্ধ করা কষ্ট পেতেন। ভাবতেন সত্যিই, এ কি আকালেরই গন্ধ? পৃথিবী কি পচে গেল? কিন্তু বাবা এ সব আমল দেননি। পঞ্চম মাসে পঞ্চামৃত অর্থাৎ দধিদুগ্ধঘৃতশর্করা ও মধুসহ সাধভক্ষণ করবার পর থেকে না কি মায়ের জন্য হাওয়ায় খালি চন্দনের গন্ধই ভাসতো।

—‘দিন-দুপুরে কে আবার ধূপ জ্বাললি রে?’

—‘জ্বালিনি তো মা!’

—‘আমি যে ভুরভুর করে গন্ধ পাচ্ছি।’

বাবা শুনতে পেলে ফিসফিস করে বলতেন, ‘জ্বলছেন, জ্বলছেন, ভেতরে ভেতরে জ্বলছেন।’

মা নাকি ঝিঁঝির আওয়াজের মতো দূরাগত একটা নূপুরের ধ্বনিও শুনতেন।

—‘কোথায় নূপুর বাজছে গো?’

বাবা বলতেন, ‘বাজছেন, বাজছেন, ভেতরে ভেতরে বাজছেন।’

সে সময়ে বাবারা বীরভূমের সুরুলে থাকতেন। বোমাতঙ্কে শহরের লোক সেখানে সদলবলে গিয়ে ভিড় করলে বাবা চটপট সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন। বস্তুত অন্যরা যা করে তিনি সর্বদাই তার উল্টোটা করতেন। ঠাকুর্দাদা থাকতেন শ’ বাজারের ভাড়াবাড়িতে। বাবাকে দুম করে এসে পড়তে দেখে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘এভাবে চলে আসাটা তোমার ঠিক হয়নি দুগ্‌গি।’

বাস। বাবার রাগ হয়ে গেল। কয়েকদিনের মধ্যেই কাছাকাছি একটা ভাল বাড়ি সস্তায় পেয়ে বুক ফুলিয়ে পরিবার নিয়ে সেখানে গিয়ে উঠলেন। কারো কোনও কথায় কর্ণপাত করলেন না। বাড়িটা বাবা বড় ভাল পেয়েছিলেন। শুধু বড় সুন্দর এবং সস্তাই নয়, কিছুটা ফার্নিশ্‌ডও ছিল বাড়িটা। ছয় ড্রয়ার-অলা বিরাট ভারী দেরাজ, লতাপাতার কাজ-করা পালঙ্ক, সিলিং থেকে মশারি-টাঙানোর ফ্রেম, তক্তপোষ, টেবিল চেয়ার, দেওয়ালে আয়না-দেওয়া দেওয়াল-আলমারি। লাল সিমেন্টের চকচকে মেঝে মাছি-পিছলোনো-মসৃণ। রান্নাঘরটাই কত বড়! বিরাট উঠোন। তার একদিকে চওড়া রোয়াক। উঠোনের শেষ দিকে বড় কলঘর, চৌবাচ্চা, বাইরের লোকেদের জন্য। ভেতরে আর একটা কলঘর। এমনকী দোতলাতেও এক সেট ছোট্ট মিনি কলঘর ছিল। তার ভেতরে ঔ কারের মতন দেখতে একটা গাড়ু না কমণ্ডলু না কী, ঝকঝকে পেতলের। শিশুকালে এটাই আমার সবচেয়ে আকর্ষণের বস্তু ছিল। হাসিখুশির ‘ঔষধ খেতে মিছে বলা’ পর্যন্ত পৌঁছে আমি নাকি বলতুম ‘ঔষধ খেতে কমোণ্ডোলা।’

বিজয়গর্বে নিজের বাবাকে বাড়িটা দেখাতে আনলেন বাবা। দেখেশুনে ঠাকুর্দা বললেন, ‘বোমার হুজুগে সব পালিয়েছে। দু’ দিন পরেই যখন এসে পড়বে তখন তোমার আম্বা কোথায় থাকে দেখব।’

—‘সে দেখা যাবে’—বাবার নিশ্চিন্ত জবাব।

এই বাড়িতেই, বাবা ও ঠাকুর্দাদার তত্ত্বাবধানে আমি জন্মাই।

আমার জন্মের সময়ে মা যখন প্রাণান্তকর যাতনায় চিৎকার করছিলেন তখন নাকি আমার ডাক্তার ঠাকুর্দাদা পরনে পট্টবস্ত্র, কপালে চন্দন, সারাদিন উপবাসী, নিবিষ্টমনে ভাগবত পাঠ শুনছিলেন। বাড়িতেই ভাগবত পাঠের আয়োজন হয়েছিল, পাঠ করছিলেন তাঁর বন্ধু পণ্ডিত কালিকামোহন শাস্ত্রী ন্যায়সাংখ্যবেদান্ততীর্থ মশায়। ধূপধুনোগুগগুলের ভারী ধোঁয়ায় সারা বাড়ি আচ্ছন্ন। ভাদ্র মাসের গুমোট গরম। রাত এগারোটা সওয়া এগারোটা নাগাদ হঠাৎ কড়কড় করে বাজ ডেকে তুমুল বৃষ্টি নামল। ঠাকুর্দাদার চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। তিনি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালেন। দু’জনে পরস্পরের চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ নিষ্পলক। ভাদ্র মাস, ধুন্ধুমার বৃষ্টি, ঘড়ি টিকটিক করে মধ্য রাতের দিকে চলেছে…। সূতিকাগার থেকে তীব্র আর্তনাদ ছুটে আসছে। সারাদিন ধরেই মা কষ্ট পাচ্ছিলেন। সাত সন্তানের জননীর সেবার তিন দিন ধরে লেবর চলছিল। এই যন্ত্রণা উপশম হয়ে সুপ্রসব হয়ে যাবার অব্যর্থ মহৌষধ নাকি বাবার জানা ছিল। কিন্তু তিনি দেননি। এই জন্মের কোনও পর্যায়ে কোনওরকম বৈজ্ঞানিক ইন্টারফিয়ারেন্স চলবে না—ঠাকুর্দাদার এমনটাই ছিল মত। যদিও অন্য সময়ে হোমিওপ্যাথিকে তিনি বিজ্ঞান বলে মানতেনই না। বাবা, ঠাকুর্দার সচরাচর বিদ্রোহী সন্তান এই একটা ব্যাপারে ঠাকুর্দার হুকুম মেনে নিয়েছিলেন। কারণ, এক কানে প্রসূতির চিৎকার, আর-এক কানে ভাগবতের ‘সত্যং পরং ধীমহি’ বাবাও দেখছিলেন পৃথিবী আর্তনাদ করছে, সেই আর্তনাদ তাঁর কানে গেছে। চল্লিশ লক্ষ প্রেতের আশি লক্ষ হাত ধেয়ে যাচ্ছে তাঁর দিকে, আসন টলেছে। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী তিনি আসছেন, নেমে আসছেন। কারাগারের লোহার দরজা ওই ঝনঝন শব্দে খুলে গেল। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে মাকে ঘর্মসিক্ত করে আমি সড়াক করে অবতীর্ণ হলুম। কারিয়াপিরেত বা। রোমশ, কুৎসিত, লোলচর্ম বাঁদর-বাচ্চা এক।

ধাত্রী বললেন—‘মেয়ে হয়েচে গো ডাক্তারবাবু। বাপরে, কী কালো কুচ্ছিৎ মেয়ে গো!’ সে সময়ে ধাত্রীরা একটু স্পষ্টবক্তাই হতেন।

পিসিমা শাঁখ নিয়ে রেডি ছিলেন। থতমত খেয়ে গেলেন। পণ্ডিত কালিকামোহন একবার গোঁত্তা খেয়ে আবার পড়তে শুরু করলেন। বহু শ্রাদ্ধবাড়িতে তুমুল হট্টগোল, মন্ত্রোচ্চারণ ও কীর্তনের মধ্য দিয়েও একমনে গীতা পাঠ, উপনিষদ পাঠ তাঁর অভ্যেস আছে। ঠিক আড়াই মিনিটের মাথায় আবার আমি হড়কে এলুম। ধাত্রী বললেন, ‘যমক গো কর্তা, এবার ব্যাটাছেলে এয়েচে। কী সোন্দর।’ এবার আমি ফর্সা টুকটুকে হয়েছি, ঠিক আমার মায়ের মতো। দুরন্ত দমে শাঁখ বাজতে লাগল।

—কিন্তু এখনও তো ফুল পড়ল না?

শুনে হঠাৎ বাবা ও ঠাকুর্দা একসঙ্গে লাফিয়ে উঠলেন।

ভেতর থেকে ধাত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন—‘আর একটা আচে, আরেকটা, ও ডাক্তারবাবু নাড়ি জড়িয়ে গেছে। শীগগির আসুন।

বাবা তীরবেগে সূতিকাগারে ঢুকে গেলেন।

এবার আমি কৃষ্ণ-কানহাইয়ার মতো নীলবর্ণ। কিন্তু বাবা তখন প্রাণপণে আমার গলার হার আলগা করছেন। ডানহাতে আমার ছোট্ট ছোট্ট পায়ের পাতা মুঠো করে মুণ্ড ঝুলিয়ে দিয়েছেন নিচের দিকে, পাছায় চাপড় মারছেন। আঙুলে গজ জড়িয়ে বাবা ছোট্ট মুখের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছেন, ক্লেদ পরিষ্কার করছেন, মুখে মুখ দিয়ে আলতো ফুঁ দিচ্ছেন এবং অবশেষে আমি পিঁ করে কেঁদে উঠেছি।

বিধ্বস্ত জননী ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিন দিনের নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ের পর প্রথম সুযোগেই নিবিড় ঘুম এসে তাঁকে অধিকার করেছে। স্বপ্নহীন ঘুম। মৃত্যুপম, কিন্তু মৃত্যু নয়। শরীরের প্রতিটি কোষ ঘুমোচ্ছে। তিনি জানেন না তিনি কে, কোথায়! জানেন না তাঁর সাতটি সন্তান আছে এবং এক দফায় আজ তিনি তিন সন্তানের মোট দশ সন্তানের দশভূজা জননী হয়ে গেলেন। আরও জানলেন না বত্রিশ বছর বয়সে নিরবচ্ছিন্ন সন্তান প্রসবের পর এই আজকের লড়াইয়ে তিনি আর সন্তানধারণের ক্ষমতা হারালেন। এই অকল্পনীয় মুক্তির কথা জানলে হয়তো তিনি আরও আরও আরও ঘুমোতে পারতেন।

যেখানে একজনের ব্যবস্থা হয়েছিল সেখানে তিনজনের আবির্ভাব হলে গণ্ডগোল হতেই পারে। তার ওপর একটি অসুস্থ। তার জন্যে তুলোর বিছানা, তুলোর পলতে। রাশিরাশি পরিষ্কার ছেঁড়া কাপড় চাই, রাশি রাশি কাঁথা, সরষের বালিশ একটা ছিল, আর-একটা, আংটার আগুন, সেঁকতাপ, মালিশ, বোতল, ফুটন্ত জল, ঢাকনা মশারি, আর তুলো তুলো তুলো।

ইতিমধ্যে ভাগবত গুটিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে ঝোলায় পুরে ফেলেছেন কালিকামোহন। দশম একাদশ স্কন্ধ পুরো পাঠ হয়ে গেছে। বেরোতে বেরোতে প্রায় ভোর-রাত্তির। মুখ চোখে জল দিয়ে চা সেবনান্তে ঠাকুর্দাদা বললেন, ‘কী বুঝলে কালী?’

কালিকামোহন চায়ে শেষ চুমুকটা দিচ্ছিলেন, বিষম খেয়ে বললেন, ‘প্রথমটিই তোমার ঠিকঠাক অষ্টমগর্ভ শিবু, মনকে চোখ ঠেরে লাভ কী?’

ঠাকুর্দাদা বললেন, ‘যোগমায়া?’

—‘তাই বলো তো তাই। সুভদ্রা-বলদেব-জগন্নাথ বলো তো তাতেও আপত্তি করব না। অর্ডার কি আর সবসময়ে ঠিক থাকে? থাকে না! যুগটা তো পাল্টাচ্ছে হে!’

শুঁড়তোলা তালতলার চটিতে পা গলালেন কালিকামোহন। শিবপ্রসাদ বললেন, ‘তা বটে!’

আসলে আমার বাপ-ঠাকুর্দারা সব স্বপ্ন-দেখা মানুষ ছিলেন। ঘোরে ঘুরতেন, ঘোরে ফিরতেন। ওঠা-বসা, খাওয়া-শোওয়া দিব্যি করছেন কিন্তু বাকি আর সব ঘোরে। উচ্চশিক্ষায়, বিজ্ঞান বিদ্যায় তাঁদের এই স্বপ্ন-দিদৃক্ষার কোনও হেরফের করতে পারেনি। এ এক ধরনের আশ্চর্য সহাবস্থান। তাত্ত্বিক বাঙালির সঙ্গে ব্যবহারিক বাঙালির এই সহাবস্থানের ব্যাপারটা নীরদ.সি. ঠিকই বুঝেছিলেন। এঁরা দৈত্যকুলে প্রহ্লাদে বিশ্বাস করতেন, ধ্রুবর মধুসূদনদাদায় বিশ্বাস করতেন, মা ভবতারিণী সশরীরে এসে শ্রীরামকৃষ্ণের হাত থেকে আত্মহত্যার খাঁড়া কেড়ে নিয়েছিলেন বিশ্বাস করতেন, রণে বনে জলে জঙ্গলে মহাপুরুষের সর্বত্র অবাধ গতি বিশ্বাস করতেন, বিশ্বাস করতেন শ্রীঅরবিন্দ অমর এবং সিদ্ধিলাভের পর দৈবীদেহ লাভ করবেন। মহাপুরুষ স্পর্শ করলে কুষ্ঠ সেরে যায়, টিউমর উবে যায়, অন্ধ দৃষ্টি পায়, বোবায় কথা কয়, পঙ্গুতে গিরি লঙঘন করে—এ সমস্তই আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করতেন। অথচ শিবপ্রসাদ ছিলেন ডাক্তার, শল্যচিকিৎসায় তাঁর হাত নাকি ছিল অব্যর্থ। ইনি আবার অভাবীদের বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা করতেন, অনেক সময় নিজে পথ্য পর্যন্ত কিনে দিতেন। কিন্তু ভিখারি দেখলেই কড়া গলায় বলতেন—‘মাফ করো’ বা ‘এগিয়ে যাও’। শুধু ভিখারি নয়, ভেকধারী সবাইকে। কাক চরিত্র, গেরুয়া-পরা সন্ন্যাসী, মুশকিল-আসান, পীর ফকির…সব। এই ঠাকুর্দাই একাদিক্রমে তিনটি বিবাহ করেছিলেন। প্রথমজন নিষ্পুত্ৰক মারা যাওয়ার পর পরিবারই তাঁর পুনর্বিবাহ দিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়া একটি পুত্রসন্তান অর্থাৎ আমার বাবাকে বছর পাঁচেকের রেখে মারা গেলে, বিয়ের উদ্যোগ আর হচ্ছে না দেখে ছ’ মাসের মধ্যে নিজে উদ্যোগী হয়ে তৃতীয়াকে বিয়ে করে এনেছিলেন প্রথমা পত্নীর চোদ্দ বছরের সদ্য বিধবা কন্যাকে রাগিয়ে এবং কাঁদিয়ে। আত্মীয়স্বজন কেউ কেউ ছি ছি করলে তিনি বলেন…। নাঃ, কী বলেন বলব না। তিনি গৃহস্থধর্ম এবং প্রথম রিপুর প্রপার চ্যানেলিংয়ের কথা অকপটে বলেছিলেন। অকপটে এবং অকাতরে। প্রতিহিংসায় আমার পিসিমা নতুন মাকে সারাজীবন নেহাৎ বাধ্য না হলে কিছু বলেই ডাকতেন না। বেশিরভাগ সময়েই ভাববাচ্যে কথা বলতেন। ছোটভাই অর্থাৎ বাবাকে তিনি সৎমাকে সেজমা ডাকতে শিখিয়েছিলেন। সেজমা কেন জিজ্ঞেস করলে তিনি যা বলেন তার অর্থ হল মায়েদের এই লম্বা কিউ তো শেষ না-ও হয়ে থাকতে পারে! সেজমা মারা গেলে ন’মা, তারপরে কনে-মা তারপর নতুন মা, তারপর ফুলমা…।

শিবপ্রসাদের বাবার নাম ছিল গুরুপ্রসাদ। সত্যিই নাকি ইনি গুরুদেবের প্রসাদে জন্মেছিলেন। কী ধরনের প্রসাদ তা নিয়ে মডার্ন গুরুদ্বেষীরা অনেকরকম জল্পনা-কল্পনা করতে পারেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই গুরুবাবু একটু নালা-খ্যাপা প্রকৃতির লোক ছিলেন। হেটো-মেঠোও বটে। ধানজমি, পুকুর, বাগান, মাঠকোঠা ইত্যাদি ভালই ছিল বর্ধমানের সুকুমার সেন-খ্যাত গোতান গ্রামে। ইনি নাকি হ্যা হ্যা করে হাসতেন, আর পুকুরে ছিপ ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। হরিদাসী নামে কোনও অভাগিনীর সঙ্গে এঁর বিয়ে হয়, তাঁরই সন্তান শিবপ্রসাদ সিংহরায় শ’বাজারের ডাক্তারবাবু দেবীপ্রসাদ সিংহ রায় থার্ড মাস্টার নিস্তারিণী মেমোরিয়াল হাইস্কুল, ফুলতলা খুলনা, রমাপ্রসাদ সিংহরায় করণিক মিলিটারি অ্যাকাউন্টস, পোস্টেড ইন রেঙ্গুন এবং শক্তিপ্রসাদ সিংহরায় দেরাদুনের মোহান্তর এস্টেটের ম্যানেজার। গুরুপ্রসাদ ও হরিদাসীর ছেলেরা কীভাবে গ্রাম থেকে বেরিয়ে—চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেলেন সে নিশ্চয়ই এক চিত্তাকর্ষক ইতিহাস। শিবপ্রসাদ ছাড়া আর কারওরটাই আমি তেমন জানি না। পরে জানতে পারলে নিশ্চয়ই আপনাদের কৌতূহল নিরসন করব।

গুরুপ্রসাদের পিতার নাম ছিল হরিনারায়ণ। নারায়ণ থেকে এঁরা প্রসাদে অবতরণ করেছিলেন দেখা যাচ্ছে। তা সে যাই হোক, হরিনারায়ণ বারাণসীতে বাস করতেন। কী কাজ করতেন তা আমাদের জানা নেই। কর্ম যখন করতেন তখনই নিজগ্রাম গোতানে কিছু জমি-জমা বাড়ান। হরিনারায়ণ সম্ভবত আধ্যাত্মিক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, প্রসাদের গুরু তিনিই আমদানি করেন, কিন্তু সবকিছু ছেড়েছুড়ে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তাঁর পত্নী ছেলেকে নিয়ে গোতানে বসবাস করতে থাকেন। এই ধরনের অঘটন ঘটায় দিশেহারা হয়ে ছেলেকে লেখাপড়া শেখানো, জমিজমা সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোও অন্তত একটু বোঝানো—এ সব তিনি করেননি বা পারেননি। তবু সেগুলো টিকে গিয়েছিল। অর্থাৎ জ্ঞাতিরা খুব খারাপ লোক ছিলেন না।

তা হরিনারায়ণের আগে যে কে ছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ তা আমরা জানি না। হরিনারায়ণ অবধিই যে জানি সেটাই একটা আশ্চর্য ব্যাপার। নয় কী? শ্রাদ্ধশান্তিতে আমরা পূর্বতন চারপুরুষ পর্যন্ত নাম বলতে পারব। বংশাভিমান আমার পিসিমারই সবচেয়ে বেশি ছিল। তিনি বলতেন, ‘আমরা হরিবংশ’।

আমার বাবা দুর্গাপ্রসাদ ওরফে দুগ্‌গি ছিলেন ভারি মজার মানুষ। বি.এ পাশ করে মেডিক্যাল পড়তে পড়তে ফাইনাল ইয়ারে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা আন্দোলনে ঢুকে পড়েন, দেশের কাজ করতে করতে কাব্য ও ব্যাকরণের আদ্য ও মধ্য পাশ করে ফেলেন, জেল খাটতে খাটতে আইন পড়তে থাকেন, আইন পড়তে পড়তে হোমিওপ্যাথি শিখতে ঢুকে যান। ইতিমধ্যে কী কারণে কে জানে, হয়তো গা ঢাকা দিয়ে থাকতে থাকতে তিতিবিরক্ত হয়ে বিপ্লব ছেড়ে মাসতুতো বউদির খুড়তুতো বোনকে বিয়ে করে ফেলেন। লভ-ম্যারেজই বলব, কেন না বউদির বাড়ি তদীয় খুড়তুতো বোনের (বয়স বারো) হাতে পান খাওয়ার পরই সম্ভবত তাঁর বিপ্লবে বিতৃষ্ণা জাগে। সেই দ্বাদশীও ডাফ স্কুলের পরিধেয় টিউনিক ছেড়ে ধনেখালি ধরতে দ্বিধা করেন না। সেকালের দিনে বাবা মধুচন্দ্রিমা করতে দেরাদুন যান। শোনা যায়, ট্রেনে এক গোয়েন্দাকে শনাক্ত করতে পেরে তিনি এক কামরা লোকের মাঝখানে ফট করে মায়ের ঘোমটা খুলে ফেলে বলে ওঠেন, ‘দূর মশাই, এই দেখুন আমার নতুন বউ, বিয়ে করে বেড়াতে যাচ্ছি। দেশ উদ্ধার এবার আপনি করুন গিয়ে। একটা বার্ডসাই খাবেন? ভয় নেই, তামাকে বিষ-ফিষ নেই।’ এরপরই বাবা হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করতে থাকেন এবং সিদ্ধান্তে আসেন অ্যালোপ্যাথি আসুরিক, হোমিওপ্যাথি ঐশ্বরিক। এ বাবদে একমাত্র পুত্রের সঙ্গে একমাত্র পিতার কী রকম তুলকালাম লাগত সহজেই অনুমেয়।

এঁদের মধ্যে কী ধরনের স্ববিরোধ ছিল তা আমার পিসিমার কেসটা বললেই বুঝতে পারবেন। বালবিধবা পিসিমাকে ঠাকুর্দাদা লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিলেন। পিসিমা কিছুতেই তাঁর ‘কালা-মুখ’ নিয়ে ‘ধিঙ্গি’র মতো স্কুলে যেতে চাননি। তাঁর বিয়ে দেবার জন্যেও ঠাকুর্দা অনেক চেষ্টা করেছিলেন, যিনি বিধবা-বিবাহ দিতে উদ্যোগী হন তিনি আদৌ যে কেন আট বছরের কন্যাকে গৌরীদান করেছিলেন তা বোঝা যায় না। পিসিমা পুনর্বিবাহের কথা শুনে বলেছিলেন ‘মরণ আর কী!’ বাড়িতে বসে লেখাপড়াতেও পিসিমার কোনও উৎসাহ ছিল না, সেলাই-ফোঁড়াই, গান-বাজনা কিছুতেই না। ঠাকুর্দাদা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। বিষ্ণুপুরী ঘরানার সুবিখ্যাত রাধিকামোহন গোস্বামীর কোনও শিষ্যর সঙ্গে তাঁর খাতির ছিল, পিসিমার স্বাভাবিক সুকণ্ঠ শুনে তিনি আগ্রহীও ছিলেন। কিন্তু পিসিমা দিনকতক শিখে নিজেই গুরুকে ছুটি দিয়ে দেন। অথচ পিসিমা স্বামীর ঘর করার সুযোগই পাননি। পিসেমশাইও ছিলেন (ছবিতে যেমন) ঝোপের মতো গোঁফওয়ালা, কটকটে চোখ, কেমন রাগী মতন, পিসিমাও বলতেন, ‘ধুর, আমার পছন্দই হয়নি। কাঠখোট্টা।’ অল্পবয়সী দম্পতির মধ্যে যে ধরনের রোম্যান্টিক প্রেম আশা করা যায়, তাঁদের মধ্যে তা ছিল বলে মনে হয় না। এই পিসিমাকেই যখন তাঁর নতুন মা এসে বৈধব্যপালনের কঠোরতা থেকে মুক্ত করতে চাইলেন, অর্থাৎ পেড়ে শাড়ি, মৎস্যভক্ষণ ধরাতে চাইলেন, একাদশী বন্ধ করতে চাইলেন তখন ঠাকুর্দাদাই বলেছিলেন—‘শী শুড রাদার ডাই।’ নতুন-ঠাকুমা কুড়ি-একুশ বছরের গাছের মতো-ঢ্যাঙা-বলে-তেজ-বরে-সদ্য বিবাহিতা সেই কন্যে তখন নিজেই মাছ খাওয়া ছেড়ে দেন, সাদা ছাড়া পরতেন না। ঠাকুর্দাদা বলতেন— ‘মাছ খাচ্ছো না আমাকে মারবার ইচ্ছে হয়েছে নাকি?’ অর্থাৎ পাশ করা ডাক্তার, যশস্বী শল্যচিকিৎসক বিশ্বাস করতেন স্ত্রী মাছ না খেলে স্বামীর বেঁচে থাকা শক্ত। নতুন ঠাকুমা এয়ো-নাম রাখতে একাদশীর দিন মাছ খেতেন। আশ্চর্যের কথা, তাঁর এই আত্মত্যাগ কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি। এর মধ্যে যে কোনও বাহাদুরি, মনের জোরের, স্বাধীন চিন্তার দৃষ্টান্ত আছে, অনম্য সংকল্প আছে সেটা কেউ মনেই করেনি।

আমার বাবা আবার এক কাঠি বাড়া। তিনি পিসিমাকে দিদিমণি বলতেন, কিন্তু আসলে মায়ের মতোই দেখতেন। ঠোঁটের ওপর ভালো করে গোঁফ গজাবার পরই নাকি তিনি ঠাকুর্দার সঙ্গে তর্ক জুড়তেন দিদিমণির আপত্তি কানে না তুলে, তাঁর আবার বিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেই পিসিমারই যখন বোনটিবি ধরল, যথেষ্ট প্রোটিন খাবার ব্যাপারে মাংসের জুস ছোট মাছের ঝোল ইত্যাদি খাওয়াবার কথা ঠাকুর্দা বললে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাবা বলেছিলেন, —‘শী শুড রাদার ডাই।’ পিসিমা স্বয়ং কিন্তু নিমরাজি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ওষুধ খাচ্ছি মনে করে নাক টিপে খেয়ে নেবো’খন।’ মৃত্যুকে খুব ভয় পেতেন পিসিমা। তাঁর ধারণাই ছিল না তিনি মরেই আছেন।

তাই বলে কেউ যেন মনে করবেন না মৎস্যভক্ষণকেই আমি জীবনের সমার্থক বলে মনে করছি। বালবিধবা পিসিমাদের আশ্রয় থাকতো ঠিকই, কিন্তু ঘর কি থাকতো? করুণা পেতেন, শ্রদ্ধা পেতেন, অধিকার পেতেন না। দজ্জাল অথবা মাটির মাটি জুতোর সুকতলা হবার সুযোগ পেতেন, স্বাভাবিক হবার সুযোগ থাকত না। রন্ধন-পটীয়সী হতেন কিন্তু চিন্তাপটীয়ান কত মানুষ যে কত আনন্দের, উপভোগের খোরাক বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে ভরে দিয়ে গেছেন, জানতেন না। ভাতের সকড়ি, রুটির সকড়ি, আঁশ-নির্মিষ্যি খেঁটের কাপড়, মঙ্গলবারে নো মোচা, ছেলেদের জন্মবারে নো তেতো, নো পোড়া, কুমড়ো, লাউ, বেগুন সম্পর্কিত হরেক নিয়ম, জাতাশৌচ, মৃতাশৌচ, চতুর্থী, বিছ্‌ছুচ্ছুগ্‌গু ইত্যাদি হরেক জিনিস তাঁদের জানা ছিল। কিন্তু এই পৃথিবীটা কত সুন্দর, কত বড়, কত তার রং চং ঢং তা জানতেই পারতেন না। তাই-ই ওঁকে জীবন্মৃত মনে করছিলাম। তবে আমার এই মনে করা হয়তো ঠিক না-ও হতে পারে। জীবনের থেকে কোনও রস হয়তো তিনি পেতেন ঠিকই, আমাদের বীক্ষণে তা’ ধরা পড়ছে না এই আর কি!

আমি যখন জন্মাই অর্থাৎ চারের দশকে তখন আমাদের মতো পরিবারের (মধ্যবিত্ত লিখলুম না কেননা বিত্ত দিয়ে মানুষ মাপার অভ্যাস একটা মর্ডান থিয়োরি মাত্র। গবেষণার জন্যে দরকার হয়, অর্থনীতি, সমাজনীতি, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। আদতে প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা, প্রত্যেকটা পরিবার আলাদা, আঙুলের ছাপের যেমন দ্বিতীয় হয় না, একটা মানুষেরও তেমন আর দ্বিতীয় হয় না। ওপর ওপর মানুষের ল.সা.গু গ.সা.গু বার করা হয়তো সম্ভব। একটু ভেতরে গেলেই কিন্তু মানুষ মৌলিক সংখ্যা।) সূতিকাগারে পুং ডাক্তারের প্রবেশ সচরাচর ঘটত না। খুব জটিল কেস হলে আলাদা কথা। পাশ করা ধাত্রীরা পরিষ্কার সাদা শেমিজ শাড়ি/ধুতি/থান পরে কালো একটা ব্যাগ নিয়ে সময়মতো এসে উপস্থিত হতেন। আমার বাবা যাঁর ক্রমে নিজ-রুগিমহলে ধন্বন্তরী খ্যাতি হয়, তাঁর কিন্তু বোঝা উচিত ছিল যে মায়ের গর্ভে যমজ বা ‘তেমজ’ আছে। পেটে হাত দিলেই তো বোঝা যেত একাধিক মুণ্ডু ডাংগুলি খেলছে। দুটো ষণ্ডা একটা ঠাণ্ডা। গাণ্ডে-পিণ্ডে গিলছে দুটো আর একটা নিরীহ ডুণ্ডুভের মতো এলিয়ে আছে। যমজ না হয়ে জরায়ু বা ডিম্বকোষের টিউমরও তো হতে পারত। আমরা তিনে-এক একে-তিন একসঙ্গে গোঁত্তা মারতে গিয়ে মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে যেতে পারত। একজন হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ নেমে এলো, আর এক জন দিব্যি গর্ভজলে অনন্তশয়ান শুয়ে রইল, আর একজন হেঁটপদ ঊর্ধ্বমুণ্ড হয়ে রইল এরকমও তো হতে পারতো! সেসব থেকে জননীর প্রাণসংশয় হত। সংশয় কেন, প্রাণটি যেতই। মায়ের কাছে শুনেছি টিউমর থেকে ট্রান্সভার্স ফিট্যাল পোজিশন, লকিং সব কিছুরই হোমিওপ্যাথিক নিদান আছে। অর্থাৎ একটি মহৌষধের মহাফোঁটা, ব্যস তৎক্ষণাৎ জাতকের ত্যাড়া ঘাড় সোজা হয়ে যাবে, সে উল্টে গিয়ে মাথা হেঁট করে নামতে থাকবে, বা ভাইটি বোনটির সঙ্গে অনর্থক মাথা ঠোকাঠুকি না করে লক্ষ্মী ছেলেটির মতো গুটগুট করে কিউয়ে এসে অপেক্ষা করবে। কিন্তু সে ওষুধটা দিলে তো? অষ্টমবার গর্ভাধন হলে বাবা-ঠাকুর্দা ধরেই নিয়েছিলেন তিনি আসছেন। সময় কী হয়নি? চল্লিশ লাখ মানুষ মাঠে, ময়দানে, ফুটপাতে, জাঙ্গালে জাঙ্গালে না খেয়ে শুকিয়ে মরে গেছে, সুভাষচন্দ্র অন্তর্হিত। মাঝে মাঝে রেডিওতে নাকি তাঁর ভৌতিক কণ্ঠস্বর শোনা যায়, নেহরুজিকে এডুইনার সঙ্গে সাঁতারে নামিয়ে দিয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেন অর্ধনগ্ন ফকিরটির ওপর তাঁর যাবতীয় কূটনীতি প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। জিন্না সাহেব, বিশ্বের রোগাতম লিডার লাঙে ফুটো লুকিয়ে বিলিতি ধরনে হাসছেন (প্রসঙ্গত বাবা, মিঃ জিন্নার ছবি-ছাবা দেখেই বিধান রায়ী কায়দায় ডায়াগনোজ করেছিলেন, ইনি ক্ষয়রোগে সম্ভবত কর্কট রোগেও ভুগছেন, বেশিদিন ইহলোক নেই), জার্মানিতে হিটলারের গোঁফে তা, ইতালিতে মুসোলিনির ছাঁ, জাপানে তোম্বামুখ তোজো, রাশিয়ায় স্ট্যালিনগ্রাড, আমেরিকায় শ্রীমান সত্যসুন্দর অর্থাৎ ট্রুম্যান এবং ইংল্যান্ডে চার্চিল, যাত্রাদলের অমুক-তমুক-তুসুক এবং স্বপনকুমার-এর বিজ্ঞাপনের মতো। এই তো সেই লৌহ কারাগার? এবং কী আশ্চর্য দুগ্গি কি একজন বসুদেবোপম ব্যর্থ বিপ্লবী নন, যিনি বিবাহের প্রথম উল্লাস কেটে যাবার পর থেকেই বুঝতে পারছেন তাঁর হাতে শেকল, পায়ে শেকল (মধুর শেকলই), দেশের জন্য প্রত্যক্ষভাবে তিনি আর কিছুই করে উঠতে পারবেন না। এবং আশ্চর্যেরও আশ্চর্য। তার চেয়েও আশ্চর্য তদীয় পত্নীর নামও যে দেবহূতি, দেবকী আর দেবহূতিতে কী-ই বা তফাত? তা ছাড়া দেবহূতি স্বায়ম্ভূব মনুর কন্যা, মহর্ষি কর্দমের পত্নী, সপ্তর্ষি অর্থাৎ মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু এবং বশিষ্ঠর শাশুড়ি, ওদিকে আবার স্বয়ং নারায়ণের অবতার কপিল ঋষিরও মা, পুত্রের কাছে যোগ সম্বন্ধীয় উপদেশ শুনে, জগতের কার্য-কারণ উপলব্ধি করে ইনি কঠিন তপস্যার পর নদী হয়ে বয়ে যান, যে নদীতে অবগাহন করেন সিদ্ধ পুরুষরা। দেবহূতির মতোই রূপসী, অথচ নিরভিমান, পবিত্র অথচ পার্থিব, দয়িতা অথচ দশভুজা এই নারী! সাতটি সন্তান, সাতে আর সাত কোটিতে কতটুকু তফাত জননীরাই জানেন। রাশভারী শ্বশুরমশায়, বাতে ভোগা রুগ্‌ণ শাশুড়ি, জিদ্দি সোয়ামি, ক্ষণে-হাতে-দড়ি-ক্ষণেকে-চাঁদ বালবিধবা ননদিনী নিয়ে আর্যাবর্তের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল ঘুরে ঘুরে সংসার করেন যিনি, দু-এক বছর অন্তর অন্তর রাঁধতে রাঁধতে যিনি আঁতুড় ঘরে ঢুকে যাচ্ছেন আবার বেরিয়েই খুন্তি ধরছেন তিনি অসামান্যা ছাড়া কী? স্থান-কাল-পাত্র প্রস্তুত। এখনও তিনি আসবেন না এ কি হতে পারে?

বস্তুত আমার বাবা দুর্গাপ্রসাদ সিংহরায়ের সবটাই ছিল উল্টো রকম। যেমন জেদি, তেমনি আদর্শবাদী, তেমনি খামখেয়ালি। কলকাতায় স্থিত হবার ঠিক আগে বাবা ছিলেন সুরুলে। সেখানে দিব্যি একটি খামার করেছিলেন। গোরু, ছাগল, হাঁস, ধান জমি, পুকুর, তরি-তরকারি ফল-পাকুড়ের বাগান এই সব। সেখানে মাটির বাড়িতে নিজের অকালমৃত মায়ের নামে করেছিলেন মাতঙ্গমোহিনী হোমিও হল। ভালোই চলছিল। শুধু বাবা-মা দুজনেরই মন খুঁতখুঁত করতো— ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো তেমন জুতের হচ্ছে না। হাতের কাছেই যে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামে একটি আবাসিক বিদ্যালয় রয়েছে যার সর্বময় বিশ্ববিখ্যাত ননাবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাতেও বাবার কিছু এসে যায়নি। আমার বাবা-ঠার্কুদারা রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করতেন না, তিনি বড়লোকের লম্পট ছেলে, সব সময়ে সুন্দরীপরিবৃত হয়ে থাকেন। শান্তিনিকেতনে পড়তে গেলে ছেলেমেয়েরা আর চরিত্র নিয়ে ফিরতে পারবে কি না এ সন্দেহ তাঁদের ছিল। তবে বাবা রবি ঠাকুরের লেখার খুব ভক্ত ছিলেন, ঠার্কুদাদা সেখানেও ছিলেন অনমনীয়। বলতেন— “মাথা নত করে দাও হে,” কেন রে বাবা উনি নিজে থেকে নত করবেন না? ঘাড় ধরে হেঁট করিয়ে দিতে হবে?”

বাবার আগের পোস্টিং ছিল ভাগলপুর। ভাগলপুরে দুটো প্র্যাকটিসই খুব জমেছিল। চিকিৎসা বাবা যে পেশাতেই থাকুন না কেন, করতেনই। ভাগলপুরের বাঙালি এমনকি বিহারি-রাজপুত-জাঠ মহলেও তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ছিল। কিন্তু ভাগ্য-খারাপ, এরপরেই হল সেই ভয়াবহ ভূমিকম্প। প্রায় উজাড় হয়ে গেল বাবাদের বন্ধুকুল। বন্ধু এবং কী রকম এক কাজিনের একেবারে অনাথ ছেলে পুলকদাদাকে নিয়ে বাবা কলকাতা হয়ে সুরুলে চলে গেলেন। খুব সম্ভব এই সময়েই গোতানের সম্পত্তি বেচা হয়। তাই দিয়েই সুরুলে বাবার লড়াই নতুন করে শুরু হল।

ভাগলপুরের আগে বাবা ছিলেন রেলওয়ে সার্ভিসে। নানান জংশনে ঘুরে ঘুরে তাঁর পোস্টিং হত। দাদা-দিদিরা কেউই কলকাতায় জন্মায়নি। শিবপ্রসাদের আশা ছিল, পুত্র একজন ভারতীয়র পক্ষে যত দূর ওঠা সম্ভব উঠবে। কিন্তু হা হতোস্মি! বাবার বিপ্লবী জীবনের কাহিনী তো পুলিসের খাতায় গুপ্ত ছিল না! কোনও প্রমোশনের সময়ে থলির ভেতর থেকে সেই বেরাল বেরিয়ে পড়ে। তাঁকে একটি মুচলেকা দিতে বলা হয়, তিনি তৎক্ষণাৎ চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ঠাকুর্দার ভাড়াবাড়িতে এসে গাট হয়ে বসেন। এখানেই তাঁর চাকরি জীবনের ইতি। স্বাধীন পেশা ছাড়া অন্য কোনও দিকে যাওয়ার পথ তাঁর ওখানেই বন্ধ হয়ে যায়।

আমার জন্মের পর আমার এক পাঁচ ছ’ বছরের মামা মহাবিরক্ত হয়ে তাঁর মা অর্থাৎ আমাদের দিদিভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘দিদির কি প্রতি মাসে একটা করে মেয়ে হবে?’

দিদিভাই, যিনি বেশ কয়েকবারই মেয়ের সঙ্গে গর্ভবতী হয়েছেন, ছেলেকে আদর করে বলেন, ‘একটা নয় রে, এবার তিনটে।’

তৎক্ষণাৎ মামা জিজ্ঞেস করেন, ‘লেত্তির মতো?’ লেত্তি বাড়ির ম্যাও-পুষি। বলা বাহুল্য এবম্বিধ তুলনায় দিদিভাই খুব খুশি হননি।

দ্বিতীয় অধ্যায় : অষ্টোত্তর শতনাম

বাঙালিরা বরাবরই নাম বিষয়ে বড্ড খুঁতখুঁতে। যেখানে ইংরেজ বাবা-মা ছেলেমেয়েদের নামের জন্যে বেশি না হাতড়ে দাদু ঠাকুমা দিদিমা মামা এঁদেরই নামের আগমার্কা লাগিয়ে দেন এবং একই পরিবারে যথেষ্ট উইলিয়ম, মেরি, হেনরি, এলিজাবেথ থেকে যায়, যেখানে উত্তর ভারতে পিঙ্কি, কুসুম, নেহা, রাকেশ, রাজিন্দর, সুরিন্দরের ছড়াছড়ি, সেখানে বাঙালি মা-বাবাদের নামকরণ একটি পর্ব। ইংল্যান্ডের রাজবংশেই ধরুন এডওয়ার্ড হলেন অষ্টম পর্যন্ত। জর্জ হলেন ষষ্ঠ পর্যন্ত, কটিই বা রানী! তা তাঁদের নামের মধ্যে কী রকম পুনরাবৃত্তি! রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। শুধু তাই-ই নয়। তাঁর মায়ের নামও এলিজাবেথ। কুইন মাদার আর কুইন। মায়ের নামও উমা, মেয়ের নামও উমা এমনটা কি আমরা ভাবতে পারি? প্রিন্সেস ডায়নার বড় ছেলে যদি রাজা হয় তো সে হবে উইলিয়ম দা ফিফথ্‌, ছোট ছেলে রাজা হলে হবে নবম হেনরি। কেন রে বাবা? আর নাম পায় না এরা? উইলিয়াম, হেনরি, এডওয়ার্ড, জর্জ ছাড়া কি আর নাম নেই? এ যেন ক্লোজ্‌ড্‌ সার্কিট টি.ভির খেল। আমাদের দেশ হলে অষ্টম হেনরির কীর্তিকলাপের পর ওই হেনরি নাম দশ হাত লম্বা লাঠির ডগা দিয়েও ছুঁতো না কেউ। আমরা কি সাধ করে কখনও ছেলের নাম শকুনি বা রাবণ রাখবো? অজাতশত্রু রাখবো? এঁরা সব পৌরাণিক ঐতিহাসিক ভিলেন। ব্লাডি মেরি, মেরি অফ স্কট্‌স্‌, মারি আঁতোয়ানেতের পরে মেরি নামটাকেও অপয়া বলে গণ্য করতুম আমরা হলে। সীতা যেমন, নায়িকার নাম হতে পারে, কিন্তু অপয়া নাম। রাখেন কেউ কেউ সীতা-চরিত্রের মহিমার কথা, তাঁর সতীন কাঁটারহিত হওয়ার সৌভাগ্যের কথা স্মরণ করে, কিন্তু রেখে নির্ঘাৎ ভয়ে ভয়ে থাকেন।

ইউরোপীয় দেশগুলোতেও এই একই ব্যাপার। মাসিও গার্ট্রুড, বোনঝিও গার্ট্রুড, কাকাও স্টিফেন, ভাইপোও স্টিফেন। এমনটাই নাকি এঁদের দেশীয় রীতি। গুরুজনের নামে নাম রাখাটা নাকি গুরুজনের গুরুত্ব স্বীকার করা। আর আমাদের এদিকে? হরি যদি শ্বশুর-ভাসুরের নামের সঙ্গে জুড়ে রইল, তো আর হরিনাম করা যাবে না। ফরিনাম করতে হবে। ভুলেও কখনও ‘ও হরি’ বলে ফেলেছ কি মরেছ। ‘ও ফরি’ বলতে হবে মনে করে করে। আমার দিদিশাশুড়ি খুব ভালো গান গাইতে পারতেন। বিশেষত তাঁর শ্যামাসঙ্গীতের খুব আদর ছিল। ‘শ্যামাপদ আকাশেতে মন ঘুড়ি খান উড়তেছিল’ গাইতে গেলে তাঁকে বলতে হত ‘বাবাপদ আকাশেতে’, কেননা তাঁর শ্বশুরের নাম ছিল শ্যামাকান্ত। গানটা তিনি উপযুক্ত ভাবাবেগ সহ গাইতেই পারতেন না, তাঁর হাসি পেয়ে যেত। এই দিদিশাশুড়ির মেয়ে অর্থাৎ আমার পিস শাশুড়িও খুব ভালো গাইতেন। রেডিওর অডিশন দিতে গেলে তাঁকে ‘অমলধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’ গানটি গাইতে বলা হয়। তিনি বিমলধবল পালে’ গেয়েছিলেন, কেননা অমল তাঁর স্বামীর নাম। বিমল বলতেও তিনি প্রত্যেকবারই লজ্জায় অধোবদন হয়েছিলেন। তিনি অডিশনে ফেল করে যান। বিচারকরা বলেন— ‘আমরা ওঁকে অমলধবল গাইতে বলেছিলাম। বিমলধবল তো গাইতে বলিনি। যিনি গানের বাণী ঠিক রাখতে পারেন না তাঁর আবার…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমাদের দক্ষিণেই বা তেমন নামের বাহার কই? ভুল বললুম, বাহার খুব আছে তবে তা অন্যের নামের বাহার। কত পুরুষের নাম যে এঁরা নিজনামের সঙ্গে জুড়ে নেন, তার হিসেব জানি না তবে নামগুলো তো ওই সীতা, সীতালক্ষ্মী, জয়া, বিজয়া, সাবিত্রী এই সবের মধ্যেই থাকে। খুবই গুলিয়ে যায়। তামিলনাড়র ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার বান্ধবী শশিকলাকে আমি দীর্ঘদিন বোকার মতো কোন কালের অভিনেত্রী শশিকলা ভেবে এসেছি। সেটা অবশ্য আমার দোষ হতে পারে। আমার ব্যক্তিগত অজ্ঞতা হতে পারে। এটা দৈবাতের ব্যাপার। ইংরেজদের মতো ছক কষে কষে একই নামকে, একই কুমির ছানাকে সাতবার দেখানোর মতো ব্যাপার নয়। তা সে যাইহোক, আমাদের মতো নামবিলাসী আর কেউ নয় ভূ-ভারতে। আরে বাবা, কোনও না কোনও বিষয়ে তো আমাদের ফার্স্ট হতে হবে!

ধরুন তেজেন্দ্রনারায়ণ। একবার ফ্যামিলিতে ইন্দ্রনারায়ণ প্রবেশ করলেন তো হয়ে গেল। চলতে থাকবে। গজেন্দ্রনারায়ণ, ব্রজেন্দ্রনারায়ণ, বিজয়েন্দ্রনারায়ণ, মণীন্দ্রনারায়ণ, ফণীন্দ্রনারায়ণ, গুণীন্দ্রনারায়ণ…। মধ্যনাম হিসেবে ইন্দ্র, প্রসাদ, নাথ। এ সব আমাদেরই আছে। নাম, মধ্যনাম, পদবি। পদবিটিই খালি বারোয়ারি। বাকি সব নিজস্ব। ভারতেরই অন্য প্রদেশের সেলিব্রিটিদের দিকে চেয়ে দেখুন! ভেঙ্কটেশ প্রসাদ! যাব্বাবা, কবে থেকে অপেক্ষা করছি প্রসাদের পরে কী জানতে পারব, কাকস্য পরিবেদনা! ভেঙ্কটেশ প্রসাদ যেন বিষম খেয়ে থেমে গেল। কৃষ্ণকান্ত্‌? কৃষ্ণকান্ত কী? জবাব নেই। পদবি-টবি নেই। বালাই চুকে গেছে।

নাম-বিলাসী তো বটেই। নাম নিয়ে আমাদের বেশ আদিখ্যেতা। আমার মায়ের তিন বন্ধুর নাম ছিল মালতীমালা, মিলনাকুলা, বিরহজ্বালা। এঁদের বাবার কবিত্বের বহরটা একবার দেখুন। মালতীমালাকে না হয় মালতী বা মালা বলে ডাকা গেল, কিন্তু মিলনাকুলার কী লজ্জা? কুমারী মিলনাকুলা পাত্র, ব্রাহ্মবালিকার দিদিমণি চশমার ওপর দিয়ে চেয়ে বললেন পাত্র? না পাত্রী? ফিক করে হেসে ফেলেই তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। বৃত্তি পরীক্ষার ঠিক আগেই যখন তার বিয়ে হয়ে গেল, দিদিমণিদের সে কী উদ্‌ভাসিত হাসিমুখ! সকলেই বললেন, ‘আমরা জানতুম, জানতুম তোমার তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে!’ কেন দিদিমণিরা এ কথা বলেছিলেন সে বোধাদয় যখন বেচারির হল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর বিরহজ্বালা? তাকে তো সবাই জালা বলেই ডাকতো। বর্গীয় জ-এ ব-য় আকার জ্বালাই হোক, আর শুধু বৰ্গীয় জ-য় আকার জালাই হোক, কোনটাই কি তার আত্মসম্মানরক্ষার উপযুক্ত? তারপরে সে, নাঃ বাচ্চা হলেও মায়ের বন্ধু তো, তিনি বলাই উচিত, তিনি একটু গোলগাল ছিলেন, একটু বেশিই, তা তাঁকে জালা বলে ডাকলে কেমন শোনায়? আপনারা আশাপূর্ণা দেবী না সুনির্মল বসুর সেই মজার কবিতাটা কি পড়েছেন? এক পরিবারে পতি মধ্যনাম দিয়ে নাম রাখা হত, শেষকালে আর কিছু না পেয়ে নবজাত বাচ্চার নাম রাখা হল ভগ্নীপতি। কী ভয়ানক নামবিলাস! এ রকম গল্প আমিও দু একটা জানি। এক পরিবারে পাল দিয়ে নাম রাখা হত। নেপাল, ভূপাল, গোপাল, মহীপাল ইত্যাদির পরেও যখন আবার নাম-সমস্যা নিয়ে এক ছেলে জন্মালো বাবার মাথায় হাত, নাম রাখলেন কপাল। এইভাবেই জিতের মামলায় হেরে হেরে নাজেহাল হয়ে এক বিশাল জিত-পরিবারের কর্তা কনিষ্ঠের নাম রাখেন হারজিত। হারজিত আমাদের সঙ্গেই পড়ত। কায়দা করে নামটা বলত যাতে মনে হয় হরজিৎ, প্রথমে নামটা শুনে আমরা মনে করি এ নিশ্চয়ই পঞ্জাবি। হারজিৎ ডাট। ও হরি, দেখি ছোটখাটো এক বাঙালি তনয় ঢুকছে। উত্তর মেরুতে বলগা হরিণ, ক্যারিবু আর পোলার বেয়ারদের সঙ্গে দেখলেও তাকে বঙ্গসন্তান বলে চেনা যাবে।

আর রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকতে লক্ষ লোকের নাম দিয়ে গেছেন, প্রয়াণের পরও লক্ষ লক্ষ নাম সাপ্লাই দিচ্ছেন। কিন্তু ওঁর নায়িকাদের অনেকের নাম শুধু আমি কেন বেশির ভাগ পাঠকেরই পছন্দ হবে না। বিনোদ বৌঠান কীরকম জাঁহাবাজ জাঁহাবাজ লাগে না? দামিনী যত আবেগ, যত স্পর্শকাতরতা, যত বেদনা দিয়েই গড়া হোক না কেন, নামের জন্য স্থূল-স্থূল মনে হয় যেন কাপড় কাচা আর ঘর মোছা ছাড়া কিছু জানে না। ‘ঘরে বাইরে’র বিমলা-ই বা কী? যে-নাম সাধারণত ছেলেদের হয় সে-নামে আকার দিলেই যে সেটা নারী-নাম হয়ে যায় না, স্ত্রী-লোকের নামই হয় শুধু, যেমন অজিতা, অনিলা, সমীরা, সুধীরা, সলিলা…— এটা রবীন্দ্রনাথের মতো কবির বোঝা উচিত ছিল। তখনকার প্রচলিত নাম তো তিনি ব্যবহার করবেনই করতেই হবে, কিন্তু তার মধ্যেও একটু বেছে-বুছে নেওয়া তো যেত! মৃণাল, কুমু, এলা, চারু, এগুলো ঠিক আছে। অচিরা, রণিতা, তনিকা এসব তো খুবই আধুনিক স্মার্ট নাম। যদিও সত্যি কথা বলছি, চারু যে কতটা চারু তা সত্যজিৎ-মাধবীর রূপায়িত চারুকে দেখার আগে যেন পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করিনি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তো ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’য় মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তিকে তাঁর করুণার পরিধি থেকে বাদ দিয়েছেন স্রেফ নামের জন্য। তা তাঁর দামিনী আর বিমলা সম্পর্কেও আমাদের একই বক্তব্য। মানুষ দুজনকে বুঝতে হলে তাদের নাম বাদ দিয়ে বুঝতে হয়।

আর পুং চরিত্রদের নাম? আমাকে মিলিয়ন ডলার দিলেও আমি বেহারী বা শ্রীবিলাসের প্রেমে পড়তে পারবো না। উপন্যাসেও এঁরা ব্যর্থ হলেন সম্ভবত এই কারণেই।

মাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, ‘সুরুলে থাকতে রবীন্দ্রনাথের কাছে নাম চাইতে পারতে তো?’

মা বলেছিলেন, বিপদ ছিল।’

—‘কেন?’

—‘প্রথমত উনি রাখলে সে নাম তো পাল্টাতে পারতুম না। কিন্তু যদি নলিনী দিতেন? নলিনী বললেই নলেন গুড় আর নলিদির কথা মনে পড়ে।’

নলিদি ছিল মায়েদের বাড়ির এক পুরনো দাসী, শুধু আমি কেন, মা-ও নাকি তাকে কখনও দন্তবতী দেখেননি। পাকলে পাকলে ছেঁচা পান খেত নলিদি আচার আর বড়ি তৈরি করত দেবভোগ্য, কিন্তু কাউকে দিতে চাইত না। অনেক সাধাসাধি করলে, সুতির কাপড় ছেড়ে, খেঁটের কাপড় পরে আস্তে আস্তে তিনতলার চিলে কুঠুরিতে সে উঠে যেত, তারপর বাটিতে অত্যন্ত পরিমিত কুলের আচার বা ছড়া তেঁতুল এনে ভাত-পাতে ফোঁটা কয়েক দিত। কুলের আচার বা ছড়া-তেঁতুল কেউ ভাতের সঙ্গে খায়? এক চামচ দু চামচ খায়? আপনারাই বলুন। কাজেই আমাদের ছেড়ে মায়ের পর্যন্ত নলিনীর ইমেজ নলিদির ইমেজে মিশে গিয়েছিল। যতই নলিনী তড়খড়কে স্মরণ করে রবি ঠাকুর নলিনী নলিনী করুন, আমাদের তো নলিদিকেই স্মরণে আসে কি না!

আমি বলি, ‘বলতে পারতে নলিনী বাদ দিয়ে অন্য নাম দিন।’

মা বলেন, ‘উনি হয়তো নাম দেবেন অমলিনা, সেটা হয়ে যাবে অমলি, হয়তো দেবেন কমলিকা সেটা হয়ে যাবে কম্‌লি, তার চেয়ে আমি তোদের যা নাম দিয়েছি কেউ সেগুলো বিকৃত করতে পারবে না। একদিন বুঝবি তখন আমায় ধন্যবাদ দিবি। তাছাড়া নিজের ছেলে-মেয়েরই বা কী নাম দিয়েছেন উনি? মাধুরীলতা তবু যদি বা দাঁড়ায়, রেণুকা? মীরা? এত সাধারণ নাম অমন অসাধারণ বাবার মেয়েদের? রথীন্দ্রনাথ শমীন্দ্রনাথই বা কী আহামরি নাম! রথী-শমী করে তবু একটু শ্রুতিমধুর হয়েছে। অর্থেরও একটা গভীরত্ব থাকবে তো?’

মোট কথা রবীন্দ্রনাথের নামাবলি মায়ের একেবারে পছন্দ ছিল না। নামকরণ ছিল মা বাবার প্যাশন। তার অনেক কার্যকারণ থাকত। তার পেছনে ধ্যান-ধারণা, আদর্শ, দর্শন এবং তর্ক-বিতর্কের একটা করে সুবিশাল পটভূমি থাকত। যেমন আমার বড় দাদার নাম প্রথমে হয়েছিল লক্ষ্মীন্দ্রপ্রসাদ। দিয়েছিলেন দাদামশাই অর্থাৎ মায়ের বাবা। মা কোনও আপত্তি করেননি, শুধু তাকে ‘ইন্দ্র ইন্দ্র’ বলে ডাকতেন, বাবাকে চুপি চুপি বলেও ছিলেন ছেলেকে নিশ্চয়ই তোমরা ‘লক্ষ্মী লক্ষ্মী’ বলে ডাকবে। ওভাবে ডেকো না দুষ্টু ছেলেদের লক্ষ্মী বলে লাভ নেই। তাছাড়া পরে যখন বড় হলে লোকে লক্ষ্মীদা, লক্ষ্মীবাবু বলে ডাকবে ছেলেই তোমাদের কাছে কৈফিয়ত চাইবে। ব্যস দাদার নাম ইন্দ্র হয়ে গেল। সকলে অর্থাৎ গুরুজনরা জানতেন এ ছেলের নাম ইন্দ্রপ্রসাদ, কিন্তু স্কুল ভর্তির সময়ে সুদূর মোগলসরাইয়ে কে অত খোঁজ রাখতে যাচ্ছেন। ইন্দ্র নাম পাক্কা হয়ে গেল। এর পরে ঋদ্ধিময়ী। বাবা রেখেছিলেন ঋদ্ধি। প্রথম দু-এক সন্তানের বেলায় মা বাবার প্রসপারিটির আকাঙক্ষাই সবচেয়ে বেশি থাকে, টাকা-পয়সার প্রয়োজনটা সে সময়েই তাঁরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে শুরু করেন তো! তাই ইন্দ্র, তাই ঋদ্ধি, কিন্তু ময়ীটুকু আমার ঠাকুমার দান। ঋদ্ধিও তাঁর স্বভাবতই পছন্দ হয়নি। তিনি ‘আভা’ নাম রাখতে ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু কন্যার পিতার ওপর আর তিনি কী বলতে পারেন? ক্রমশ বুঝতে পারলেন ঋদ্ধি নাম হলে ছেলের বাড়-বাড়ন্ত হবে, বাড়-বাড়ন্ত যদি খুব না-ও হয় অন্তত ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। ‘ময়ী’টুকু তিনি যোগ করে দিয়েছিলেন। সেটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। বড় ছেলে-মেয়ের নামকরণই প্রথম পরীক্ষা। এই গণ্ডি পার হতে পারলে বাকিগুলো সহজ হয়ে যায়। ইন্দ্র ঋদ্ধি উৎরে গেলে গড়গড় করে নাম আসতে লাগল। ইন্দ্রর পরে সূর্য, তার পরে অংশু, সর্বশেষে ‘তেমজ’-এর দুজন পাবন, বরুণ। এঁরা প্রত্যেকেই প্রসাদ ছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রসাদ যে কণিকামাত্র ভোগ্য, এই বাণী স্মরণ করেই আর প্রসাদে যাননি। এখানে চুপিচুপি বলি, শেষ দুটির নাম বলরাম ও কৃষ্ণ রাখতে বাবা আদিষ্ট হয়েছিলেন তদীয় পিতার দ্বারা। এতে মায়ের একটু সুবিধেই হয়ে যায়। বাবা তাঁর বাবার কথার প্রতিবাদ করবেনই। ঠিক তাই। করলেনও। বললেন

—‘আপনি কী ভেবেছেন বলুন তো!’

—‘কী আবার ভাববো, কালী বলে গেছে ওদের বলরাম জগন্নাথের অংশে জন্ম।’ মা আধঘোমটা দিয়ে চা আনছিলেন, তখনও শরীর ভালো সারেনি। তিনি শীর্ণশী। মৃদুকণ্ঠে বলেন, ‘এ সব কথা কি লোককে জানতে দেওয়া ভালো?’

মাকে ঠাকুর্দাদা অত্যন্ত স্নেহ করতেন, বললেন, ‘ন্যায্য বলেছ বউমা। এ কথাটা তো আমার মনে আসেনি! গুহ্য ব্যাপার কখনই সাধারণের গোচরে আনতে নেই।’ বাবা সঙ্কর্ষণ ও কৃষ্ণরূপ-এর পক্ষপাতী ছিলেন। মা আস্তে বলেন, শঙ্কু আর কেষ্টা? বাবা ইঙ্গিতটা তক্ষুণি বুঝে নিলেন। তখনও প্রোফেসর শঙ্কুর জন্ম হয়নি। হলে হয়তো নামটা মায়ের পছন্দ হলেও হতে পারত।

ঠাকুর্দাদা বললেন, ‘না, না, না। সঙ্কর্ষণ, কৃষ্ণরূপের তো একই সমস্যা থেকে যাচ্ছে। কোনক্রমেই এটা প্রকাশ…না, না। বউমা, তুমি আর একটু ভাবো।’ মায়ের আর একটু ভাবনারই ফল পাবন ও বরুণ।

আমার অন্য দিদিদের নাম শ্রদ্ধা, ভক্তি, ঋতি,— অধীনার নাম বিদ্যা। সকলেই আমরা ‘ময়ী’। সকলেরই ‘ময়ী’ মা যথাসময়ে কেটে দিয়েছেন।

নামের বিকৃতি মায়ের একেবারে সহ্য হত না। তাঁর নিজের অতো সুন্দর নাম দেবহূতি, কেউ কি ডাকত? কেউ না। দেবু, সবাই বলত দেবু। এবং মায়েদের ফ্যামিলিতে দেবুমামা, দেবুকাকা, দেবুদাদার কোনও অভাব ছিল না। বাড়িতে বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি উৎসবে কেউ একবার দেবু বলে ডাকলে হল। দেবুমামা তাঁর পালোয়ানি গোঁফ, মিলিটারি কাঁধ, কদমছাঁট চুল নিয়ে—‘জামাইবাবু ডাকছিলেন?’ বলতে বলতে হাজির হয়ে যাবেন, দেবুকাকা নাকের নস্যি মুছে দুবার হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে হেঁচে নিয়ে বলবেন—‘এঁই যেঁ, এঁলুম দাঁদাঁ, দুঁ মিনিট সবুঁর করোঁ।’ দেবুদাদার সবে গোঁফ গজিয়েছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হবার ইচ্ছে। সেও একবার টেরি ঠিক করে, একবার চশমা খুলে, আবার চশমা পরে—‘পিসেমশাই, দেবু ইজ অলওয়েজ রেডি’, বলে আসতে থাকবে। দাদু তিনজনের দিকে দফায় দফায় তাকিয়ে আকাশ হাতড়াতে থাকবেন, এদের কাউকেই তো তিনি ডাকছিলেন না, খুঁজছিলেন না। তাহলে তিনি কাকে চান? খুব কঠিন প্রশ্ন। ঈশ্বরের কৃপায় অবশেষে তাঁর মনে পড়বে, তিনি বলবেন—‘দেবো, আমি দেবহূতিকে ডাকছিলুম।’ দেবুও এসেছে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে তিনি বলতেন—‘মা, আমাকে একটু জল খাওয়াতে পারিস?’

এই ধরনের বিভ্রান্তি মায়ের খুব অপছন্দ ছিল বোঝাই যাচ্ছে। তিনি এমন নাম খুঁজতেন যার জোড়া চট করে পাওয়া যাবে না। যাকে চট করে ভাঙা যাবে না। নাম ভাঙতে পিসিমার জোড়া ছিল না। তাঁর নিজের নাম মনোরমা, নিজেই নিজেকে ‘মনো’ বলে উল্লেখ করতেন। করুণা নামধারী একজনকে তিনি বলতেন, ‘কনু’, রাধাপ্রসাদকে ‘রাধি’, গায়ত্রীকে বলতেন ‘গাই’, মৈত্রেয়ীকে ‘মিউ’, সর্বাণীকে ‘সরু’, শিবাণীকে ‘শিবি’, গুরুচরণকে ‘গুচুং’, ভবেন্দ্রনাথকে ‘ভুচুং’ কত আর বলব! রবিকে অনেকেই ‘রবু’ করে কিন্তু পিসিমা করতেন ‘রেবো’—এর কোনও শব্দতাত্ত্বিক যুক্তি আছে? রামকে রাম বলে ডাকতে কিসের অসুবিধে! কিন্তু তিনি বলবেন রেমো। আমাদের ভাই-বোনেদের নাম নিয়ে তিনি বিশেষ কিছু করতে পারেননি বলে বোধহয় ভেতরে ভেতরে একটু দমে গিয়েছিলেন, কিংবা ক্ষেপে গিয়েছিলেন। মায়ের সঙ্গে তাঁর একটা শীতল চালাকির লড়াই চলত। ঋদ্ধি, ভক্তি, শ্রদ্ধা, ঋতিকে তিনি কীভাবে বদলাতে পারেন? নাম ভাঙাও একটা আর্ট, তারও কতকগুলো রীত-নিয়ম আছে। জিনিসটা লাগসই হতে হবে। পঞ্চানন থেকে যেমন পঞ্চু, পাঁচু, পঞ্চা পর্যন্ত করা যায়, কিন্তু পোচি এমন কি প্যাঁচাও তেমন চলে না। ঋদ্ধিকে ঋধু করে কী লাভ? ভক্তিকে ভুকি বানানো যায় কিন্তু প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর তাতে থাকে না, শ্রদ্ধাকে সিধু বা সাধু করলেও ইডিয়মেটিক হয় না বদলটা। শব্দ বোধ বা ধ্বনিবোধ পিসিমার খুবই প্রবল ছিল। একমাত্র ঋতিকে তিনি ঋতু করতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু ‘ঋতু’ বলতে তাঁরা ঠিক ‘সীজন’ বুঝতেন না, অন্য অর্থটাই বেশি চলিত ছিল, তাই ‘ঋতু ঋতু’ বলে ডাকাডাকি করা থেকে স্রেফ লজ্জায় বিরত হন।

ভাইপোদের ব্যাপারে কিন্তু তাঁকে আটকানো যায়নি। ইন্দ্রকে পিসিমা ইন্দু ডাকতেন, অনেকেই বাবাকে জিজ্ঞেস করে তাঁর পুত্রের নাম ইন্দুভূষণ না ইন্দুকিরণ! বাবা রাগ করে বলেন ইন্দুমতী। সূর্যকে সুজ্জি বানাতে পিসিমার কোনই অসুবিধে হয়নি। পাবনকে তিনি পোনু এবং বরুণকে বিনু করেছিলেন। অংশুর ব্যাপারে তাঁর মাথা খোলেনি, তাই অংশু ছিল সেজখোকা। বাবা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘দিদিমণি তুমি সে-জ-খো-কা এতখানি বলতে পারছ, আর সামান্য অংশুটুকু বলে উঠতে পারছ না?’ পিসিমা তাতে বলেন, তিনি সমস্কৃত, বিশেষ করে মন্তর পড়তে পারবেন না সব সময়ে। অংশুর অনুস্বারেই তিনি মন্ত্রর গন্ধ পান। বৃথা মন্ত্র উচ্চারণ করতে নেই, এই মহাজনবাণী অনুসরণ করে চলতেন বলেই তিনি আর সেজ ভাইপোর নামটা উচ্চারণ করলেন না। সংস্কৃত কীভাবে প্রাকৃতে রূপান্তরিত হল, বা তৎসম থেকে তদ্ভবে আসার পদ্ধতিগুলো ঠিক কী কী তার একটি জীবন্ত লেস্‌ন্‌ ছিলেন পিসিমা মনোরমা মিত্র।

ভাইঝিদের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত রঙের তাস দিয়ে পিসিমা মায়ের সব সাহেব, টেক্কা জিতে নেন। শুভনাম নিয়ে কিছু করতে না পেরে তিনি ভাইঝিদের রাশনামে হাত বাড়ান। তিনি জানতেন রাশনাম একটু ভারিভুরি, জগদ্দল গোছের হয়। সেখানে ভাই-ভাজ অতটা হালকা হতে পারবে না। তাই অন্নপ্রাশনের সময়ে রাশনামকরণে তিনি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন। ছোট্ট মাথাটি মটকার থানে ঢেকে, গলায় আঁচল দিয়ে ভালোমানুষটির মতন গুঁড়িসুঁড়ি মেরে বসে আছেন যেন কিচ্ছুটি জানেন না। অক্ষর বেরোলো ‘ন,’ নাম দেওয়া হল নিরুপমা, পিসিমা ডাকলেন পম। এইভাবেই ভক্তির নাম তিলোত্তমা, পিসিমা ডাকলেন টম, শ্রদ্ধার নাম ব্রজেশ্বরী, পিসিমা ডাকলেন বুজি, ঋতির নাম পত্রলেখা, পিসিমা ডাকলেন পটলি। আমার নাম ভবতারিণী, পিসিমার খুব সুবিধে হয়ে গেল, পিসিমা অষ্টোত্তর শতনাম বানাতে থাকলেন। ভবানী, ভবসুন্দরী, ভবশংকরী, ভবি, ভবরানি, শেষে ভুবু হয়ে ডুবু-ডুবু ডুবতে-ডুবতে বুবু।

এইভাবেই পিসিমা মনো এবং মা দেবুর মধ্যে একটা অলিখিত রক্ষা হয়ে যায়। পিসিমাও অর্ধেক জিতেছেন, মা-ও অর্ধেক জিতেছেন। বিপদের সময়ে মানুষ অর্ধেক ত্যাগ করে, মা-ও তাই করেছিলেন। পিসিমা যে অন্ততপক্ষে খেঁদি, বুঁচি, টেঁপি, নেড়া, নেড়ি, ভুততা, হাঁদা, পচা এই সব নাম থেকে আমাদের রেহাই দিয়েছিলেন এতেই মা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

এ বিষয়ে আমি ছিলুম পিসিমার যথার্থ উত্তরাধিকারী। দাদা দিদিদের আমি এইভাবে ডাকতে থাকি। পমপম, টমটম, বুজবুজ, পুটপুট, দাদাদের ই-দাদা, সু-দাদা, অংদাদা, পাবনকে পুনপুন এবং বরুণকে বিনবিন বা বুনবুন। পুলকদাদাকে আমি পালক বলে ডাকি, কোনও দাদা যোগ করি না। এর জন্যে যথেষ্ট শাস্তি আমি খাই। অভ্যেস একটু আধটু পাল্টায়ও। তবে ক্রমশ ক্রমশ।

তৃতীয় অধ্যায় : গোকুলে বাড়িছে সে

আমি একটা ফুল। জলজ ফুল। পদ্মই হব। কিংবা শালুক। ফুলও নয় এখন। কুঁড়ি। পদ্মকুঁড়ি কিংবা শালুককুঁড়ি। লম্বা নালের ওপর জলে মুখ ভাসিয়ে রেখেছি। পাপড়িগুলো এখন সব মুদে আছে। আরামে। কেন না এখন জন্ম নয়, মৃত্যু নয়, নিদ্রা নয়, জাগরণ নয়। আমি বলতে পারব না এখন কী! শুধু হর্ষ, তরলিত হর্ষ আমার চারপাশে খেলা করে বেড়াচ্ছে। আমি শিউরে শিউরে উঠছি। কিন্তু বড্ড ছোট্ট এই পৃথিবী। মাটি নেই তবু প্রোথিত আছি। কী করে শিহরণ ছড়াব? সঙ্কুচিত হয়ে আছি। খুব সঙ্কুচিত এবং পুঁটলিকৃত হয়ে অবস্থান করছি। হে ইতিহাস, হে বিজ্ঞান, হে দর্শন, তোমরা আমাকে এই আমি দিয়েছ। অনেক অভিজ্ঞা, অনেক অভীপ্সা, অনেক চিন্তায়, ধ্যানে, মননে দিয়েছ, গড়েছ এই আমি। জায়মান, স্ফুটমান। আমি শেষ পর্যন্ত হব তো? পারব তো? ধনুকের মতো বক্র, বৃদ্ধের মতো ন্যুব্জ, ঝুমকো ফুলের মতো নতশির, গিরগিটির মতো কুঞ্চিতচর্ম, হস্তীর মতো লোল, কোমাগ্রস্ত রোগীর মতো নলভুক, পাষাণের মতো পঙ্গু, অর্কিডের মতো পরজীবী, প্রদীপের মতো ক্ষীণপ্রভ এই আমি। জানি না কী ছিলাম, ছিলাম কি না, জানি না কেমন করে হলাম। হলাম কি না। শুধু ধুকধুক করছে-আমি-বোধ, হবো-এই আশা, আছি ‘এই আনন্দ, কেন’ এই প্রশ্ন…

কে যে আমার শিকড় ধরে টান দেয় থেকে থেকে! কেন যে আমি ঘুরি? একটা বলের মতো আমায় নিয়ে লোফালুফি করে কে সে? একটা সর্পিল ক্ষান্তিপিপাসা থেকে থেকে আমার কণ্ঠ রোধ করতে চায়। কেন? ইতি ঘটাতে চাইছি কেন? আমি চাইছি, না এই তরঙ্গহীন জলধির অন্তরে কোনও অলক্ষ্য বন্ধু শত্রু শত্রুবন্ধু আছে যে এই ক্ষান্তি চায়? না কি এ শুধুই চান্স! অতর্কিত? দৈবাৎ? অকস্মাৎ? এর কি কোনও মানে আছে? না, নেই!

এ কী? এত স্রোত কেন? প্রপতমান জলধির এই নায়াগ্রা কালনাগিনীর মারণপ্যাঁচ সহ আমায় হঠাৎ কোথায় নিয়ে চলল? আমার কোনও শক্তি নেই হে পৃথিবী। যদি চাও তবে মুক্ত করো। যদি চাও। দু-একটি মুহূর্ত, তার মধ্যে ভেবে নাও, চাও কি না।

উত্তুঙ্গ শিখর থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে প্রপাতের প্রতিটি ফোঁটা বেরিয়ে যায়। অন্ধকার, শুকনো, কালো শঙ্কু পথের ওপর ঢলে পড়ছি, মাথা ঠুকছি বন্ধ কপাটে। পৃ…থি…বী…ভে…বে…ছো?

নীলপদ্ম পাপড়ি মেলছে। জ্যোতির্ময় এক পৃথিবীর দিকে মুখ, জ্যোতিষ্মান এক আকাশের দিকে পা, আমি শাঁখ বাজাচ্ছি। যুদ্ধ জিত হয়েছে। পঞ্চজনের থেকে প্রাপ্ত এই শাঁখ। বাজাচ্ছি। আমি আমি আমি এই আমি।

সেই গর্ভগৃহ ছোট ছিল। অন্ধকার ছিল। এই অলৌকিক আলোর পৃথিবী কী বিরাট! নিজেকে হালকা, বুদ্বুদের মতো মনে হয়। কী লড়াই এখানে! এই আলোর সঙ্গে এই বিরাট ফাঁকা শূন্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কী ভীষণ লড়াই। চেষ্টায় যেন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছি। মূত্রে, পূরীষে, লালায় আমি আমার থেকে শতধা হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। শতধা সহস্রধা। আমি এত কেন? এত কেন? আমি উদর, আমি জানু, আমি উপস্থ, আমি পায়ু। আমি পিঠ, আমি বুক, আমি হাত, আমি পা, আমি চোখ, আমি কান, আমি নাক…আমি এত কেন? এক ছিলাম। পৃথিবী তুমি আমায় ভেঙে চুরে দিলে?

কোথা থেকে গর্জন শোনা যায়। কে ওই ভীষণ গর্জন করছে? ও কি ইন্-দ্র? যেহোভা? জিব্রাইল? আহুর মাজদা? কে? কে ও?

—‘নিয়ে যাও, ওকে নিয়ে যাও, বারো নম্বরে দিয়ে এসো…’

প্রতিধ্বনি গমগম করে বাজতে থাকে। বারো নম্বরে…। ওকে বারো…। নিয়ে যাও…। ওকে দিয়ে এসো…ও…ও…ও।

হাতুড়ি পিটছে বুকের মধ্যে।

—মা ছাড়া ও বাঁচবে কী করে?

—সে নিজেই যেতে বসেছে। যে দুজন সুস্থ তাদের বাঁচান। তাদেরই আগে।

—হানিম্যান সাহেব এই বলেছেন না কি? আমরা তো জানি যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণই আশ, চেষ্টারই নাম চিকিৎসা…

—এ সময়ে তর্ক করবো না। পারলে ওর দিদিভাই-ই ওকে বাঁচাতে পারেন। এখানে সেজমা পারবেন না। দিদিমণির প্রশ্নই ওঠে না। এত বড় সংসার। ওকে বারো নম্বরে নিয়ে যান, আপনি নিজে যান।

অজ্ঞান মায়ের পাশ থেকে ওরা তাহলে আমায় নিয়ে যাবে? মা, মা, মা কে? কী? জানি না। মা মানে মা মানে মা। একটা আশ্বাস। একটা মৃদু আলো মৃদু বায়ুময় গহ্বর যার মধ্যে ‘অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদে’র মতন আমি আরামে পড়ে থাকি। সেই গহ্বর আর নেই, সেই জল অপসৃত। তবু ছিলাম, লগ্ন ছিলাম, ওরা আমাকে ছিঁড়ে নিল। এখন নিয়ে চলেছে দূরে আরও দূরে। আমি কি ত্যক্ত হলাম? মা। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি বলে কি মুখ ফিরিয়ে নিলে? না কি এ ত্যাগ নয়, আরক্ষা? আরক্ষার দিকে চলেছি! কে সে যে চালনা করল? ভূমিকাময় অথচ নিষ্ক্রিয়, জনয়িতা তবু উদাসীন,…

যশোমতী তাঁর বক্ষ দু হাতে টিপে ধরছেন আর তেষ্টার জল সো-জা আমি মুখ, আমাতে পড়ছে। চেষ্টা করতে হচ্ছে না। অর্জুন যেন শুয়ে আছেন শরশয্যায়, পিতামহ তাঁর পিপাসা মেটাচ্ছেন। অর্জুন আর ভীষ্মর ভূমিকা উল্টে গেছে। আমার সমস্তটাই এখন মুখ, কখনও উদর, কখনও শিশ্ন, কখনও পায়ু। আমি কি আবার অখণ্ড হওয়ার দিকে চলেছি? সেই গর্ভের মতন? না, না, আলো-অন্ধকারের সেই মৃদুতা আর নেই। এ বার যদি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জড়ো করে এক হতে পারি সে তা হলে অন্যরকম অখণ্ডতা। আমি এখন মাতৃক্রোড়ে। মা নয়, তবু মা-ই। দেবকীনন্দন নই আর, এখন যশোদা-দুলাল।

দিদিভাই বুকের দুধ গেলে গেলে পলতে ভিজিয়ে আমাকে খাওয়াচ্ছেন। মাথার ওপর বালব জ্বলছে। তুলোর পাঁজে অঙ্গ ঢাকা। পাখির মলমূত্রের মতো সামান্য শরীরমল আমার তুলো ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। গায়ে হাত লাগছে না। তুলোর শয্যা থেকে আমাকে নড়ানো চড়ানো যাচ্ছে না অন্তত একমাস। তার পরেও দিদিভাই ছাড়া কারও হাত ছুঁচ্ছে না আমায়। হাঁটু মুড়ে বুকের কাছে দু হাত জড়ো, তলতলে মাথার চামড়ার তলায় করোটির জোড় দেখা যাচ্ছে, নাড়ির ধুকধুকুনি দেখা যাচ্ছে। চোখ খোলে না, মুখ খোলে না, আঁটো মুঠি, গুটিসুটি। কেউ ভাবেনি আমি বাঁচবো, কেউ আমায় দেখতে আসেন না, বাবা না, ঠাকুর্দা না, মা না কি জানেনই না আমি হয়েছি। জীবনে মরণে দড়ি টানাটানি চলছে তখন। ও দিকে। এ দিকে। দিদিভাই জানতে চাইলেন না মেয়ে কেমন আছে। তার আর দুটি সন্তান কেমন আছে। হয়তো যে মুহূর্তে ঠাকুর্দা তুলোয় মোড়া সেই জ্যান্ত আকাল তাঁর হাতে তুলে দেন তখনই তিনি ভেবে নিয়েছিলেন আর কেউ নেই, এই শেষ। তার সমস্ত জগৎ তখন ছোট্ট সেই প্রাণপিণ্ডে সমাহৃত, সমর্পিত। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন প্রসবশ্রান্ত মুমূর্ষু জ্যেষ্ঠার দিক থেকে, যে থাকতেও পারে না-ও পারে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন পাঁচটি মৃত সন্তানের স্মৃতি-বিষাদের দিক থেকে। সাতটি নাতি নাতনি এখন তাঁর কেউ না। দৃটি নবজাতক যারা থাকতেও পারে, না-ও পারে তারাও তাঁর কেউ না। তিনি তদ্‌গত, তন্ময়। একটি মাত্র মুখগহ্বরে তিনি এখন স্থাণু বিশ্ব ও চলৎ বিশ্ব, অদ্রি দ্বীপাদি, খ-গোল, জল, অগ্নি, মন ইত্যাদি দশ ইন্দ্রিয়, সত্ত্বঃ রজঃ ইত্যাদি তিন গুণ, উত্তর দক্ষিণ ইত্যাদি চার দিক সমন্বিত এই বিশাল ভূ গোলক প্রত্যক্ষ করছেন। আর কিছু স্মরণে নেই।

দ্বিতীয় মাসেই আমি স্তনের বৃন্তে মুখ রাখতে পারলাম। টানতে পারছি। আমি পারছি! টানছি আর আমার মুখের মধ্যে চলে যাচ্ছে কবোষ্ণ মধুর রস, জিভ, খাদ্যনালী বেয়ে নেমে যাচ্ছে পাকযন্ত্রে। সঞ্জীবিত হয়ে উঠছি। আপাদমস্তক। তৃতীয় মাসে আমাকে শরবতি লেবুর রস, আর ডিমের কুসুম খেতে দেওয়া হচ্ছে।

আমার মামার বাড়িতে মুরগির ডিম ছেড়ে পাঁঠার মাংস পর্যন্ত ঢুকত না। একমাত্র কালীঘাটের প্রসাদী মাংস পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করে খাওয়া হত বছরে একবার। সেই মাংস রান্নার ও খাওয়ার আলাদা বাসনকোশন ছিল। কিন্তু আমার বেলা ডাক্তার ঠাকুর্দাদা যখন বিশেষভাবে মুরগির ডিমের কুসুমেরই বিধান দিলেন, তখন কুলসুম বলে এক বুড়ি নিকাশিপাড়া থেকে প্রত্যহ একটি করে টাটকা মুরগির ডিম দিয়ে গেলে দিদিভাই সন্তর্পণে তাকে সেই পাম্প দেওয়া স্টোভে সেদ্ধ করে, সিকি চামচ ফোটোনো জল দিয়ে মেড়ে আমায় খাইয়ে দিতেন। তারপর চান করে, মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে আবার ঘরে ঢুকতেন, কিন্তু আমি সেই ডিম-খাওয়া জিভ, ডিম খেগো জামাকাপড়, চামড়া-নখ-চুল নিয়েই বহাল তবিয়তে দিদিভাইয়ের খাটে, আমার নিজের বিছানায় অবস্থান করতাম। আমাকে চান করাতে, জামাকাপড় ছাড়াতে, পরাতে, খাওয়াতে দিদিভাইয়ের শুচিতা যেত না। এবং সব চাইতে অদ্ভুত কথা, আমার পরম বৈষ্ণব দাদাভাই যিনি মুরগির নাম শুনলেও কান ধুতেন, তিনি ‘আতুরে নিয়মো নাস্তি’ বলে দোরগোড়া থেকে উঁকি মেরে রোজ আমার ডিম্বভক্ষণ দেখে যেতেন।

চতুর্থ মাসে ঠাকুর্দা আমার ঘরে ঢুকলেন।

—‘অসাধ্যসাধন তাহলে করলেন বেয়ান?’

—‘উনি করার কে?’—দাদাভাই বললেন, ‘যিনি করার তিনিই করেছেন।’

—‘তা অবশ্য’, ঠাকুর্দা হেসে বললেন, ‘কালীয়দমন যিনি করতে করতেই অবতীর্ণ হয়েছেন, থাকবেন কিনা তিনি নিজেই স্থির করবেন। তবু বলি বেয়ান পিঠে-পায়সেও যেমন, নার্সিংএ-ও তেমনি আপনার তুলনা নেই।’

দাদাভাই দু হাত জোড় করে বললেন—

‘রূপং যত্ তত্‌ প্ৰাহুরব্যক্তমাদ্যং ব্রহ্ম জ্যোতির্নিগুণং নির্বিকারম।

সত্তামাত্রং নির্বিশেষং নিরীহং স ধং সাক্ষাদ বিষ্ণুরধ্যাত্মদীপঃ।’

—‘কার স্তব করছেন মশায়? মাতার না শিশুর?’

দাদাভাই জিভ কেটে বললেন, ‘ও কথা বলতে নেই দাদা, যিনি অব্যক্ত, আদি নির্গুণ, নির্বিকার সেই সত্তামাত্র ব্রহ্মজ্যোতিস্বরূপ সাক্ষাৎ বিষ্ণু যখন আমাদের জন্য রূপ ধারণই করেছেন তখন তাঁর ছাড়া আর কার স্তুতি করব?’

ঠাকুর্দা বললেন, ‘ওরে বাবা, একেবারে সাক্ষাৎ বিষ্ণু?’

—‘সাক্ষাৎ বিষ্ণুই তো কৃষ্ণ হয়ে ব্রজে অবতীর্ণ হয়েছিলেন দাদা!’

—‘আপনারা কায়েত ঘোষই জানতাম, গোয়ালার পো তা তো আগে বলেননি বেয়াইমশাই! ভেবেছিলুম একমাত্তর ছেলে কুলীনে কাজ করছি। একেবারে দধি দধীনি বানিয়ে ছাড়লেন যে!’

দাদাভাই এমন একটা তদগত ভোলেভালা হাসি হাসলেন, যার পর আর তামাশা চলে না, বললেন—‘সে ভাগ্য কি আর করেছি?…কী গো? দেখাও না, দাদাকে দেখাও।’

—‘কী দেখাবেন?’

—‘দেখুনই না, দেখুন, বলুন।’

দিদিভাই বললেন, ‘কী যে পাগলামি করো!’

—‘তুমি দেখাওই না!’

ঠাকুর্দার উৎসুক দৃষ্টির সামনে আমাকে উল্টে ধরলেন দিদিভাই। কোমর আর পাছার মাঝামাঝি জায়গাটা নীল।

—‘ও হো হো’—ঠাকুর্দা হাসতে হাসতে বললেন—‘ও সব বার্থ ট্রমা। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে।’

দিদিভাই আমাকে চিত করলেন। বুকের ওপর আবছা খয়েরি মতো দাগ। ঠাকুর্দা হাসলেন—‘জড়ুল। জড়ুল দেখেননি?’

—‘সোনালি জড়ুল হয়?’

—‘হয়, হয়, সাদা, সোনালি, খয়েরি কত রঙের হয় বেয়াই!’

দাদাভাই আবার সেই হাসিটা হাসলেন। আপন মনে। কারও কোনও কথায় নয়। কোনও পূর্ব প্রসঙ্গ মনে করেই যেন বা এই প্রসন্ন হাসি।

ওঁদের দুজনের মধ্যে একটা খেলা চলছে। ঠাকুর্দা বল ছুঁড়ছেন, দাদাভাই ধরে নিচ্ছেন, আবার ছুঁড়ছেন, এ বার দাদাভাই ধরে নিচ্ছেন। বল লোফালুফির এক ছেলেমানুষি খেলা, যে ছেলেমানুষি একমাত্র বুড়োমানুষেরাই করতে পারেন। ঠাকুর্দাদা বিজ্ঞান পড়েছেন, চিকিৎসাশাস্ত্র তো শুধু বিজ্ঞানই নয়, প্রয়োগ-বিজ্ঞান! তিনি জানেন কী থেকে কী হয়, গর্ভদ্বারের কেমন আঘাতে কেমন দাগ হয়, তিনি জানেন পিগমেন্টেশনের তত্ত্ব। কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে এক প্রতীক্ষা। এই প্রতীক্ষা তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। বৈজ্ঞানিক যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বেরিয়ে আসছে এই প্রতীক্ষার সত্য। তিনি শুনতে চাইছেন, আশ্বাস চাইছেন। বিশ্বাস-অবিশ্বাস আশা-নৈরাশ্যের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। তিনি একজন রেফারি চাইছেন। দাদাভাই তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান নিয়ে কি সেই রেফারি হতে পারবেন? দাদাভাইয়ের বিশ্বাসও নিছক অন্ধবিশ্বাস নয়। তাঁরও এক বিজ্ঞান আছে। শাস্ত্রবিজ্ঞান। সেখানে মাথার ওপর দেবভূমি। তারও ওপর গোলোক। তলায় মর্ত্য, তারও তলায় সপ্ততল পাতাল। স্বর্গ মর্ত্য পাতালের মধ্যে অনবরত এক দেওয়া-নেওয়া চলেছে। পুরাণ অনুসারে। বিষ্ণুপুরাণ, মার্কণ্ডেয়পুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বায়ুপুরাণ…এবং অবশ্যই ভাগবতপুরাণ। তিনি পুরাণ মিলিয়ে মহাপুরুষলক্ষণ বিচার করেন, চিহ্ন দেখেন, ‘দা সাইন’, যার জন্যে য়িহুদি ঋষিরা মত্ত হয়ে উঠেছিলেন, বুকের খয়েরি-হলুদ-সোনালি জড়ুল সেই লক্ষণ, দেবতার বুকে যা দক্ষিণাবর্ত রোমরাজি। মানুষ-দেবতার বুকে তা-ই জড়ুল চিহ্ন, দেবতার ত্বকে যা নবজল ভারাক্রান্ত মেঘের মতো বর্ণ। মানুষ-দেবতার ত্বকে তা-ই অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপের মতো নীল ছাপ।

দাদাভাই অনাদিপ্রকাশ ঘোষ আমার ঠাকুর্দাদা শিবপ্রসাদ সিংহ রায়ের থেকে বয়সে বেশ ছোটই ছিলেন। দিদিভাই তরুবালা তো আমার পিসিমার থেকেও সামান্য ছোট। দাদাভাইদের পৈতৃক জমিজমা প্রচুর ছিল, সে সব দেখাশোনা করতেন তাঁর ভাই অনন্তপ্রকাশ। হরিপাল তাঁদের আদি ভূমি। অনন্তপ্রকাশ সপরিবারে সেখানেই থাকতেন। দাদাভাই ভুলো স্বভাবের জন্য কোনও চাকরিতে টিকতে পারতেন না। কলকাতার সম্পত্তি দেখবার কথা তাঁর। তিনি নিজে একটি বাড়িতে থাকতেন, আরও তিনটি বাড়ি ভাড়া দেওয়া ছিল। এ সব দেখাশোনা দিদিভাই-ই করতেন। দাদাভাই কিছুই দেখতেন না। কেন না তাঁর চোখ থাকত অন্যত্র। শোনা যায়, যুদ্ধের ডামাডোলে তিনি একদিন টোলে বেরিয়েছেন। টোলে পণ্ডিতদের সহায়তায় তিনি একটার পর একটা ‘শাস্ত্র’ পড়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময়ে সাইরেন বাজে, দাদাভাই আকাশে চোখ তুলে দেখেন গর্জন করে বিমানের ঝাঁক আসছে। ব্যস তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, এবং শূন্যে আঙুল তুলে আঁকিবুঁকি কাটতে থাকলেন। এই অবস্থায় এ আর পি তাঁকে ধরে এবং একটি এয়ার-রেইড শেলটারের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। ইতিমধ্যে পুলিসের গাড়িতে তিনি থানায় চালান হন। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি এরোপ্লেনের ঝাঁকটি পার্ফেক্ট প্যারাবোলায় যাচ্ছে কি না দেখছিলেন। তাঁকে স্পাই সন্দেহে আটক রাখা হয়। পরে তাঁর ঝোলা তন্ন তন্ন করে সার্চ করে যখন পতঞ্জলির মহাভাষ্য ও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না, তখন থানার বড়বাবু সার্জেন্টটিকে ধমকা ধমকি করতে থাকেন সে খ্যাপা পাগলের থেকে স্পাই আলাদা করতে পারে না বলে। এ গল্প অজানাই থেকে যেত কারণ দাদাভাই অল-ক্লিয়ার বাজার দু ঘণ্টা পর বাড়ি ফেরেন। যথা সময়ে। দিদিভাইয়ের ধারণা ছিল তিনি সংস্কৃত কলেজেই ছিলেন। তিনি হাতের কাজ সারতে সারতে এমনিই জিজ্ঞেস করেন—‘সংস্কৃত কলেজের এয়ার রেইড শেল্টারটা কোথায়?’

দাদাভাইয়ের জবাব—‘কে জানে?’

দিদিভাই—‘সে কী? আধঘণ্টা পরে আজ অিল-ক্লিয়ার দিয়েছে। এতক্ষণ ছিলে অথচ শেল্টারটা কোথায় জানো না?’

—‘শেলটারে তো ছিলুম না!’

—‘যাওনি? তোমার পণ্ডিতমশাইও কি তোমার মতো?’

—‘পণ্ডিতমশায়? হ্যাঁ তা বটে, আমার থেকে ইঞ্চি দুয়েক ছোট হবেন।’

—‘আমি জিজ্ঞেস করছি তিনি কেন শেলটারে যাননি!’

—‘গিয়ে থাকতে পারেন, তবে আমি জানি না।’

—‘মানে?’

—‘আমি তো ওখানে ছিলুম না।’

—‘কোথায় ছিলে!’

—‘হাজতে।’

এরপর আস্তে আস্তে কাহিনীর ডিটেইলস বেরিয়ে আসতে থাকে। দাদাভাইয়ের নেশা ছিল অঙ্কশাস্ত্র আর সংস্কৃত শাস্ত্র। “অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‌”, “কুমারসম্ভবম্”, “মৃচ্ছকটিকম্‌”, কিংবা “কাদম্বরী” সবই তিনি শাস্ত্রজ্ঞানে পড়তেন। একমাত্র বাৎসায়ন আর কৌটিল্যের অংশবিশেষ পড়েই নাকি তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠেছিলেন —‘এ হে হে হে হে।’ এই ব্যাপারে পারলে আরও আলোকপাত করবো। এখন ক্ষান্ত হই। কেন না, নন্দ বংশের বংশলতিকা আমায় পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছে। পাইথনের মতো চাপ দিচ্ছে। যতক্ষণ না প্রকাশ করছি, মুক্তি নেই।

অনাদিপ্রকাশ ছিলেন যতটা ভোলেভালা, অনন্তপ্রকাশ ঠিক ততটাই বিষয়ী। আরও তিন ভাই ছিলেন এঁদের। চিন্তামণি, যদুমণি ও নীলমণি। প্রকাশ থেকে হঠাৎ মণিতে চলে যাওয়ার একমাত্র কারণ হিসেবে অনুমান করা যায়, মণিরা ভিন্ন মায়ের সন্তান ছিলেন। সৎপুত্রদের থেকে আপন পেটের সন্তানদের তিনি হয়তো আলাদা করতে চেয়েছিলেন। এঁদের একটি মাত্রই বোন ছিলেন। তিনটি বোন হয়ে হয়ে মারা গিয়ে একমাত্র এই একটি বোনই জীবিত ছিলেন। এঁর নাম ছিল হারামণি। ইনি ভাইয়েদের খুব আদরের ছিলেন। এঁর আঠারটি সন্তান হয়। এই হারাদিদিমাকে আমি আমাদের বাড়িতে অর্থাৎ মামার বাড়িতে দেখেছি। ইনি ভীষণ মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন। মিষ্টির ওপরই থাকতেন। বিশেষ করে গুড়। ভেলি গুড় তো তাই সই। হারাদিদিমা আসবার কথা হলেই দেখেছি মামার বাড়িতে ছুটোছুটি পড়ে যেত। গুড়, বাতাসা, কদমা সংগ্রহের জন্য দাদাভাই কলকাতার সব বাজার ওলোট-পালোট করে ফেলতেন। যদিও হারাদিদিমা সঙ্গে করে থান থান পাটালি নিয়েই আসতেন। হারাদিদিমার যে-ছবি আমার সর্বপ্রথম স্মরণে আসে, তা তাঁর দুই ছেলেমেয়ের স্তন্যপানের দৃশ্য। এক বছরের ছোট-বড় এই মামা-মাসি তখন বোধহয় সাত, আট। আমার মামার সঙ্গে এরা যত রকম শয়তানি সবই করে বেড়াতে। কিন্তু রাতে শোবার আগে বাঘের বাচ্চার মতো হারাদিদিমার কাছ ঘেঁষে বসে পড়ত। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গায়ের কাপড় খুলে দিতেন। দিদিমার কোল ও স্তন্য নিয়ে দুজনের মারপিট আরম্ভ হয়ে যেত। অবশেষে হারাদিদিমা বলতেন —‘রও। তিনি তাঁর প্রলম্বিত স্তন্যের একটিকে কাঁধের ওপর লাঠির আগায় বাঁধা পুঁটলির মতো ঝপাং করে পেছনে ফেলে দিতেন। একজন পেছন দিকে চলে গিয়ে স্তন্য পান করত, আর একজন করতো সামনে বসে। নির্বিকার মুখে পান সাজতেন হারাদিদিমা।

এই দৃশ্য আমার কাছে এমন আশ্চর্যজনক ব্যাপার ছিল যে আমাকে সেখান থেকে নড়ানো যেত না, ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা মুখে পুরে আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতুম, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বসে পড়তুম, বসে থাকতে থাকতে শুয়ে পড়তুম, তখন কেউ আমায় চ্যাংদোলা করে বিছানায় নিয়ে যেতে গেলে আমি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে ঘুমগলায় চেঁচাতুম—‘হারাদিদিমার মিনা খাওয়া দেখবো-ও।’

এই দৃশ্য দেখেশুনেই বোধহয় স্তন্য সম্পর্কে আমার এক ধরনের গবেষকের কৌতূহল জন্মে যায়। ছোটবেলায় ধারণা ছিল মানুষ যেমন এক রকমের জীব, স্তনও তেমনি। জীবের সব রকম প্রপার্টিই তাদের আছে। দুঃখের বিষয়, এরা কথা বলতে পারে না, পারবে না-ই বা কেন? এই নিয়ে কত জল্পনা কল্পনা করতে করতে আমরা মামা-মাসি-ভাগ্নে হারাদিদিমার দুই স্তনের বিয়ে-থা দিয়েছি কিন্তু তারা কোনও সন্তান প্রসব না করায় বেদনা পেয়েছি, আশ্চর্য হয়েছি! লেত্তির ছানা হয়, গঙ্গু (মুলতানি গাই)-র ছানা হয়, হারাদিদিমার মিনারই বা হবে না কেন? কী অবিচার?

হারাদিদিমার এই প্রত্যঙ্গের কোনও তুলনা আমি আজ পর্যন্ত পাইনি। চামড়ার সেই আলগা লম্বা থলি, যার তলদেশে জেলিজাতীয় কোনও পদার্থ ভেতরে থলথল করছে। বুড়ো আঙুলের মতো বোঁটা, কুচকুচে কালো এবং কুঞ্চিত। তাকে ঘিরে সমকেন্দ্রিক বৃত্তসকল। প্রথমটি কুচকুচে কালো, তার পরেরটি খয়েরি, ক্রমশ আবছা হতে হতে অবশেষে ফিকে গোলাপি। এই স্মৃতি এমনই স্পষ্ট ও গভীর যে আজ পর্যন্ত নারীর স্তনকে কোনও সুন্দর, উত্তেজক ব্যাপার বলে আমি মনে করতেই পারি না। বায়োলজিস্ট কি তার গিনিপিগের ওপর কোনও করুণা অনুভব করে? বৈজ্ঞানিক নিস্পৃহা আমার নারীর এই প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে। পূতনা সুতরাং ওইখানেই কতকটা বধ হয়ে যায়।

ষষ্ঠ মাসে যখন আমাদের অন্নপ্রাশনের আয়োজন হচ্ছে তখন দিদিভাইয়ের হঠাৎ স্মরণ হয় তাঁর একটি নিজস্ব ছোটছেলে আছে। বয়স পাঁচ কি ছয়। সে-ও স্তন্যপায়ী। এতদিন তার ধনেই তার খাদ্যে বা পেয়-তেই তার ভাগ্নে ভাগ বসিয়েছে। যে ভাগ বসায় সে-ই ভাগ-নে তো? তিনি আমার ফুলমামুকে ডাকতে থাকেন। —‘ছোটকুলোনা, ছোটকুমণি, এসো।’ যতই তিনি ডাকেন ফুলমামু ততই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যেতে থাকেন। অবশেষে তিনতলার ছাদের দরজার কাছ থেকে কচি কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে—‘মা। আমি আর খামখাম খাবো না।’

—‘কেন রে?’— দিদিমাও অনুশোচনায় প্রায় গলদশ্রু হয়ে ওপরে উঠতে থাকেন। অবশেষে মা ও ছেলে মুখোমুখি হন। ছেলে গোলাপি বেনারসির পাঞ্জাবি ও ছোট্ট কোঁচানো ধুতি (ভাগ্নে-ভাগ্নীত্রয়ের অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে) পরে সিঁড়ির সবচেয়ে ওপরের ধাপে, যার পরই খোলা ছাদ ও রোদে-ভেসে-যাওয়া নীলাভ আকাশ, নীচের ধাপে মুখোমুখি আলগা খোঁপা বাঁধা, চওড়া-পাড়-শাড়ি ও শঙ্খকঙ্কণে সজ্জিতা মা। গায়ে আলগা সেমিজ যার ফাঁস খোলবার জন্যে তিনি প্রস্তুত।

ছেলে সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন শুনছে।

—‘কেন রে?’

সে তখন সেই কঠিন জবাব দেয় যা এতো তা-বড় তা-বড় পদস্থ সব মানুষও তাঁদের খোকামি সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়া হলেও বলে বা বুঝে উঠতেও পারেন না।

—‘আমি এখম বড় হয়ে গিছি।’

ব্যস। বৎস বড় হয়ে গেলে গাভীমাতার বাঁট যেমন শুকিয়ে যায়, দিদিভাইয়ের অমৃতপ্রস্রবণও সেই মুহূর্তে শুকিয়ে গেল। শুধু ফুলমামুই নয়, অন্নপ্রাশনের দিন থেকে আমিও আর খামখাম খেতে পাইনি। গল্প শুনেছি, আমাকে ছাগল দুধ ধরানো হয়, হাত পা ছুঁড়ে কী রকম কাঁদতুম আমি সেই দুধ ঝিনুকে করে খেতে এবং দুগ্ধের প্রতি অভিমানবশতই কীভাবে আমি চটপট কঠিন খাদ্য ধরে ফেলি এ গল্পও শুনেছি। প্রশ্ন উঠতেই পারে কোন টানে দিদিভাই ছেচল্লিশ বছর বয়সেও দুগ্ধবতী থেকে একটি শিশুর প্রাণরক্ষা করতে পেরেছিলেন! বৈষ্ণবী মায়া? না নেহাত জৈব নিয়মেই? কার প্রতি বেশি টান ছিল দিদিভাইয়ের? পেটের ছেলে না অর্জন করা পুত্র?— আরও অনেক প্রশ্নের মতো এ প্রশ্নেরও জবাব নেই।

ভাগ্নেতে সমর্পিত-প্রাণ মাকে জীবন-মরণের লড়াইয়ে চারমাস আদ্যন্ত দেখে যাঁর ম্যাচুরিটি হয়, আমার সেই মামুর নাম কানাই, কানু। কানু বিনে আমার জীবনে গীত নাই, গতিও নাই। সে সব কথা পরে। আপাতত আমি জলাধিপতি পসাইডন, জিউসের আপন ভাই, যাঁকে কিছুতেই বঞ্চিত করতে না পেরে অবশেষে পৃথিবীব্যাপী নদী-প্রস্রবণ-সমুদ্রের অধিকার তাঁকে দিতেই হয়েছিল, যিনি রেগে উঠলেই কেঁপে উঠত পৃথিবীর সব জলাধার; কিংবা আমি মিত্রাবরুণৌ-এর সেই অন্ধকারের সূর্য, যিনি মিত্রর সঙ্গে মিলিয়েও আছেন, আলাদাও আছেন, ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র বেদেও আছেন, আবার ঊরুবণরূপে প্রাচীন আনাতোলিয়ার মিতান্নি লিপিতেও আছেন।

আসলে আমার অভিভাবকরা জানেনই না আমি যম না যমুনা। গিরি গোবর্ধন ধারণ করব, না প্লাবনে পৃথিবী ভাসিয়ে দেবো। তাঁদের অনন্ত আশা মৃত্যুর সঙ্গে কঠিন লড়াই করে যে বেঁচেছে তার ভবিষ্যৎও অনন্ত।

চতুর্থ অধ্যায় : ‘Heaven lies about us…’

কী যেন একটা দুলছে। আশে নয়, পাশে নয়, একেবারে মাথার ওপরে। তা-ও। আমার আওতার বাইরে। ওটা আমায় ভাল করে দেখতে হবে। আগে দেখে নিই, তারপর ঠিক করব নেব কি না। চিত হয়ে শুয়ে আছি। কড়িকাঠ দেখতে পাচ্ছি। লম্বা লম্বা লাইন, মোটা মোটা, আবার সরু সরু। রং? কী রং? কী জানি কী? চোখে লাগে না, চেয়ে থাকতে কষ্ট হয় না। সাদাটা আমি চিনি। আশে পাশে চারিভিতে শুধু সাদা সাদা আর সাদা। এটাই তা হলে পৃথিবীর রঙ! কিন্তু ওই দুলদুলে ঝুলঝুলে জিনিসটা সাদা নয়। ওইটা দেখতে হলে আমাকে শিবনেত্র হতে হবে। কিংবা চিবুক উঁচু করে মাথাটাকে একটু হেলিয়ে দিতে হবে পেছন দিকে। তাই করছি। ভারি উজ্জ্বল জিনিসটা। আবার জোঁ-ও-ও মতো শব্দ করে ঘোরে। তখন আমার ভীষণ ভী-ষণ আহ্লাদ হয়। আমি প্রবল বেগে হাত পা ছুড়তে থাকি। হাসিতে আমার মুখ ভরে যায়, গলার মধ্যে হাঁসের ডাকের মতো একটা আওয়াজ করি আমি। আর অমনি আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে একটা না একটা অনিন্দ্যসুন্দর মুখ। এরকম দুটো মুখ আছে আমার। একটা একটু বড়সড়, আর একটা ছোট। বড় মুখটায় একটা সূর্য আছে। দুটো দিঘি আছে। তাতে কতরকম আলো ঝলকায়। একটা সাঁকো আছে। হাত বাড়িয়ে আমি সাঁকো ছুঁতে পারি। যখন মুখটা আমার ওপর খুব খু-উব ঝুঁকে পড়ে। মুখটায় একটা গুহাও আছে। সেই আদি গুহার মতো নয়। এ গুহাটার দু’ দিকে, ওপরে-নীচে উজ্জ্বল রঙের পাড়। ফাঁক হলেই গুহাটা ঝিকিয়ে ওঠে। তখন আমারও ভেতরে কে যেন কাতাকুতু দেয়। আমি কিলবিল করে উঠি, আহ্লাদে।

—‘দেখ, দেখ, ও কেমন পিঠটা তুলে দিচ্ছে। কোলে উঠতে চায়।’

—‘তুমি ওকে নাও, কোলে নাও না মা।’

—‘উহু ওকে কোলে নেওয়া বারণ। ডাক্তার মেসসা বারণ করেছেন। মানুষের গায়ে নুন থাকে। তাতে বাচ্চার ক্ষতি হয়।’

—‘তুমি কি মানুষ না কি?’

—‘মানুষ নয়? তবে আমি কী?’

—‘তুমি তো মা!’

—‘মা, মা’—আমি প্রাণপণে ডাকতে চেষ্টা করি। মা! মা! মা! ও মা! আমায় নাও মা। আমায় কোলে তুলে নাও। তোমার সংসার-মাখা মায়ামোহ আশ্রয়মাখা কোলে আমায় তুলে নাও। এই বিচ্ছেদ, এই বিরহ আমি সইতে পারছি না মা। যতই তুমি আমার দু দিকে পাশবালিশ ঠেসে দাও, যতই তুমি আমার বুকের ওপর হালকা বালিশ রাখো, আমি বুঝতে পারি ওটা মোটেই তোমার হাত নয়, বালিশ, একটা নিষ্প্রাণ বস্তু, বস্তুগুণে যার মধ্যে কিছুটা যান্ত্রিক উষ্ণতা আছে। তোমার হাতের ওম্ ও কোথায় পাবে? তোমার হাতের প্রাণ, মমতা তুলো কী করে পাবে? আমি ঠি-ক বুঝতে পারি। ‘মা মা’ আমি ডাকতে চেষ্টা করি। ম্‌ম্‌ম্‌ম্‌ম্ মতো একটা আওয়াজ বেরোয়।

—‘ও তোমাকে ডাকছে।’

—‘ডাকুক।’

—‘মা ও ঠোঁট ফোলাচ্ছে, দেখো!’

—‘ফোলাক।’

—‘নেবে না?’

—‘উহুহ্‌।’

আমার মুখটা ভেঙেচুরে যায় যেন একটা গোল আয়নার ওপর কেউ পাথর ছুড়ে মেরেছে।

‘হো-ও-অ্যা-অ্যা, হো-অ্যা, হো-অ্যা’— আয়না ফেটে যাওয়ার আওয়াজে ঘর ভরে যায়।

—‘বা বা, বেশ তো গলা বেরিয়েছে। কাঁদো একটু কাঁদো দাদা। বুক ভরুক। জোর বাড়ুক। কাঁদো কাঁদো।’

—‘ও বড্ড কাঁদছে মা।’

—‘কাঁদুক।’

ছোট মুখটা এবার ঝুঁকে পড়েছে। যেন লাফ দিয়ে চলে এসেছে সামনে। ভা-রি চিকণ এই মুখটা। এ মুখটায় ফুল, ফুল, খালি ফুল। নীল নীল অপরাজিতার ভেতর থেকে জল চিকচিক করে। নরম একটা কলকে ফুল লম্বা হয়ে ঝুলে থাকে দো-পাটির নরম নরম আলগা-বোঁটা পাপড়ির ওপর। এই মুখটায় হাত বোলাতে আমার ভী-ষণ ভাল লাগবে। ‘হো-ও-অ্যা’ ভুলে আমি আমার বাঁ হাতটা মুঠো করে বাড়িয়ে দিই। বাঁ কাঁধটা উঠে যায়। মুঠো দিয়ে ওই চিকণকে আমি ধরতে যাই।

—‘মা, ও মা, ও আমায় খিমচোচ্ছে।’

—‘খিমচোক। তুমি কেন ওকে বিরক্ত করছ?’

ম্‌ম্‌ম্‌ম্‌ম্‌ম্‌ম—আমি বিরক্ত হইনি তো! আমার শরীরে বিরক্তি বলে কিছু আছে নাকি? নেই। খুব কম সময়ে আমি বিরক্ত হই। যখন তুমি চোখ ফাঁক করে কাজল পরাও। যখন তুমি সেই টক-টক মিষ্টি-মিষ্টি জিনিসটা আমায় দিতে দেরি করো, যখন তোমার ঝিনুক আমার জিভে লেগে যায়, যখন ঘুম ভাঙিয়ে আমায় চান করাও বা যখন সময়মতো চান করাও না, যখন তপতপে মতো জিনিসটা আমায় খাওয়াও, যেটা আমার ভাল লাগে কিন্তু গিলতে অসুবিধা হয়, যখন তুমি আমার কাঁথা বদলাতে দেরি করো, যখন তুমি আমায় পরিষ্কার করো, যখন… আর যখন এই ঘর-পৃথিবীতে অন্য বাতাস বয়, অন্য গন্ধ পাই—ভারী বাতাস, অশুদ্ধ গন্ধ, অচেনা শব্দ, তখন…একমাত্র তখনই।

ঘরের বাইরে, অন্যত্র, অন্য পৃথিবীতে অনেক শব্দ আছে, তাদেরও আমি চিনে গেছি। তাদের কাউকে কাউকে তো ভালইবাসি। কাউকে কাউকে ভয় পাই। কিন্তু তারা ফিরে ফিরে আসে। ফিরে ফিরে চলে যায়। তাই ভয় পেলেও আমার কিছু করার নেই। ভাল লাগলেও না।

খ্‌লপ্‌-খ্‌লপ্‌- খ্‌লপ্‌চাল দুলকি; তিন তাল কী?
গাঁ গাঁ গাঁ গাঁ-আঁ-আঁচমকে উঠি পাকাই মুঠি
টুন টুন ঠুন, টুন-ঠুন-ঠুনশব্দখানি কান লোভানি
‘আমি অন্ধ বাবা অন্ধ’ভালো লাগেনি ভালো লাগেনি।
‘হেই মা দুটো অন্ন মুঠো’বড় জব্দ খুব জব্দ খোকা জব্দ
গং-টং-ঠং টং-ঠং-ডংংনয় মন্দ পচ্‌ছন্দ? পচ্‌ছন্দ?

চমকেই উঠি আর জব্দই হই এই সব শব্দের সঙ্গে আমার একটা সমঝোতা হয়ে গেছে।

কিন্তু হঠাৎ যদি বোমা ফেটে যায়—‘কী হে নেপোলিয়ান? আছো কেমন?’ আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠি। ওই হেঁড়ে গলাটা যত উঁচুতে আমাকে তার চেয়েও উঁচুতে উঠতে হবে।

—‘ওরে ব্বাপ্‌! এ তো দেখি গর্জন করছে!’

—‘তা আপনি ওইরকম এক গুরুগম্ভীর লোককে নিয়ে তামাশা করবেন, সে মুখ বুজে মেনে নেবে?’

—‘বেড়ে আছো দাদা, লোকে কোথায় হা-অন্ন জো-অন্ন করে ঘুরছে, আর তুমি? ভগবান যাকে দেন, ছপ্পড় ফুঁড়ে দেন, কী বলেন বৌঠান?’

—‘একটু আস্তে ঠাকুরপো, ঘুমটা আসছিল। চমকে গেল…’

—‘ঠিক আছে, আপনি পুঁতুল খেলুন। আজ মণখানেক দিয়ে গেলুম। কমলা নেবুগুলো ভাল কিনেছেন। হগ মার্কেটের?’

—‘না, না। হাতিবাগানই বোধহয়। আপনার দাদা তো বেশি দূরে যেতে চান না।’

—‘হ্যাঃ, দাদাকে বরং একটা বাক্স করে দিন। কাঁচের বাক্স। আমরা জানব তিনি আছেন। খানকতক বই ঢুকিয়ে দিলেই হাঙ্গামা চুকে গেল।’

অন্য পৃথিবী থেকে অনেক গন্ধও আসে। যতক্ষণ তারা বাইরে ঘোরাঘুরি করছে, আমি কিচ্ছু বলি না। কিন্তু তারা যখন হেঁটে হেঁটে ঘরে ঢুকে পড়ে আমি নাকমুখ কুঁচকে কেঁদে উঠি। ধোঁয়ার গন্ধে এক-একদিন ওঁর শাড়ি ভারী হয়ে থাকে। হয়তো কাঁচা কয়লা ছিল অনেক। বহুক্ষণ পাখা করেছেন। সেদিন উনি কাছে এলেই আমি উল্টে যাবার চেষ্টা করি। পালাচ্ছি। ধোঁয়া-পূতনার কাছ থেকে পালাচ্ছি। কোনও কোনওদিন ভীষণ মেছো-মেছো গন্ধ থাকে হাতে। হয়তো কুচো মাছ বেছেছেন, অনেকক্ষণ ধরে। আমি হাতটা ঠেলে ঠেলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করি। আঁশ-পূতনার হাত থেকে পালাচ্ছি।

—‘দাঁড়া, দাঁড়া, তেলটা মাখাতে দে’…

প্রচণ্ড ঝাঁঝে চোখমুখ দিয়ে আমার ঝুঁঝিয়ে জল পড়ে যায়। নাকমুখ রগড়াই, চিকরে উঠে ঠেলে দিই তেলের শিশি। তেল-পূতনার কাছ থেকে পালাচ্ছি।

—‘মা, ওর চোখ দিয়ে জল পড়ছে।’

—‘পড়ুক। ময়লা কেটে যাবে।’

তামুক-গন্ধও এক-একদিন ঢুকে পড়ে। চার নম্বর থেকে কর্তা এসেছেন। তামাকের কড়া গন্ধে বাতাস বিষাক্ত হয়ে যায়। আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। নাক সড়সড় করে। হিঁচ্চু করে হেঁচে ফেলি আমি। তারপরে কাঁদি। তারস্বরে কাঁদি।

—‘আমি এলেই ও কাঁদে। দেখেছেন?’

—‘ও অনেক সময়েই ওরকম সৃষ্টিছাড়া কাঁদে, আপনার জন্যে নয়।’

—‘না না বেয়ান, আমি লক্ষ্য করেছি। আমি ঘরে ঢুকব, কয়েক সেকেন্ড যাবে, ব্যস্, তারপরেই চ্যাঁ।’

—‘আপনিই ভাল বলতে পারবেন, কেন মাঝে মাঝে এমন কারণে অকারণে কাঁদে।’

—‘পেট ফাঁপছে না?’

—‘চুনের জল তো আমার তৈরিই থাকে। তেমন বুঝলেই দিয়ে দিই।’

গন্ধটা আরও এগিয়ে আসে। আর সহ্য করতে পারি না। হাত-পা ছুড়ে, শরীর এঁকিয়ে বেঁকিয়ে কাঁদতে থাকি।

—‘ওরে বাপরে, এ তো বেশ আপত্তি দেখছি! এত ছোটতে চেনা অচেনা!’

—‘হবে না? অজ্ঞাতে-অজ্ঞানে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছেন। এখন আপত্তি করলে চলবে কেন?’

—‘আপত্তি আপনারও ষোলআনা আছে মনে হচ্ছে!’

হাসির শব্দ, তারপর দীর্ঘশ্বাস।

—‘যাবার যখন হয় তখন ওরা গোকুল ছেড়েই যায়। সময় বুঝে আপনার অক্রূর পাঠাবেন…’

—‘সে কী বেয়ান ক্রূর আমি নই ঠিকই, তা বলে অক্রুরও নই। আপনি ওকে রাখুন, যদ্দিন পারেন রাখুন। আমার দিক থেকে সব দাবি তুলে নিচ্ছি।’

—‘তুলে নিচ্ছি বললেই কি আর ভোলা হয়? দুলাল নামেই যশোদাদুলাল, জানেন না?’ এই সময়ে তৃতীয় গলা প্রবেশ করে। দাদাভাইয়ের কোনও নেশা নেই। কিন্তু গন্ধ? গন্ধ যাবে কোথায়? পুরনো বইয়ের গন্ধ, ক্যালকুলাস আর সলিড জোমেট্রির গন্ধ ভুরভুর করে তাঁর গা থেকে বেরোয়। আমি কুঁকড়ে যাই।

—‘আরে দাদা যে! কতক্ষণ?’

—‘এই তো! বেয়ানের বড্ড মান হয়েছে, আপনিও নেই। করি কী? মানভঞ্জন করছি।’

—‘কী যে বলেন!’ জিভ আর দাঁত মিলিয়ে লজ্জার একটা ম্লিচ ম্লিচ শব্দ, ‘হ্যাঁ গো দাদাকে চা-টা খাইয়েছো?’

—‘আমি আর কী খাওয়াব? উনিই তো খাওয়াচ্ছেন।’

—‘আমি আবার কখন খাওয়াতে গেলুম!’

—‘ওই যে যখন তখন ঝুড়িঝোড়া ভর্তি করে পাঠাচ্ছেন!’

—‘ও তো শ্রীহরির ভোগের জন্যে।’

—‘আপনার শ্রীহরি বুঝি ভেটকি মাছও খান! রুই-কাতলার মুড়োও খান! জানা ছিল না তো!’

দড়াম করে একটা শব্দ হয়, আমি চমকে উঠি।

দাদাভাই পড়ে গেছেন।

—‘দেখি দেখি! কী কাণ্ড! কিছুর মধ্যে কিছু না শুকনো ডাঙায় আছাড় খেলেন যে!’

—‘উনি তো ওইরকমই!’

—‘খুব লেগেছে?’

—‘না, না, তেমন কিছু…মানে দরজার পাল্লটা ইয়ে ঠেস দিয়েছি—আর…’

আমি উল্টে গেছি। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিলুম। তামুক-গন্ধ থেকে পালাবার জন্য। বাঁ হাতটা বুকের বাঁদিকে, শরীরের তলায় চলে গিয়েছিল কিছুতেই সেটা মুক্ত করতে পারছিলুম না। এখন এই ধড়াম শব্দে চমকে গিয়ে উল্টে যাবার এই কঠিন কাজটা আমি করে ফেলেছি। করে ফেলিনি ঠিক, হয়ে গেছে। উপুড় হয়ে রবার ক্লথের ওপর পদ্মকাঁথা, তার ওপরে পদ্মপত্রে জলের ফোটার মতো টলটল করছি। এঁরা নিজেদের কথাবার্তায় মশগুল, খেয়াল করেননি। এইবার…এইবার করছেন।

—‘মা, ও মা, ও উপুড় হয়েছে দেখো!’ —কচি গলাটা কিচকিচ করে ওঠে।

—‘তাই তো, ওমা, তাই তো!’

—‘ওরে নেপোলিয়ন, ওয়াটার্লু তো জিতে ফেললি! বা! বা! বা!’ —হাততালির শব্দ —‘অনাদিবাবু ঠিক করে বলুন, খচখচ করছে না তো! একটু শুয়ে পড়ন তো দেখি, চোট সীরিয়াস হয়ে গেলে বৃথা কষ্ট পাবেন।’

এতদিন নীচে থেকে চোখ তুলে পৃথিবীর কড়িকাঠ দেখতুম। সব কিছুই দেখতুম নীচে থেকে, কেঁচোর মতো। এখন দেখছি ওপর থেকে। পাখি, প্রজাপতি, গাছের ডালে কাঠবেড়ালি যেমনটা দেখে। দেখছি মেটে মেটে রঙের রবার ক্লথ। বালিশটা একটু গড়িয়ে গেছে, সরষের বালিশ। সামান্য একটু টলটল করে দক্ষিণের জানলার হদিশ পাই। এইখান থেকেই অত আলো আসে, আমার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ওপর থেকে পৃথিবী দেখার নেশায় আমায় পেয়ে বসে। পৃথিবীর মেঝে দেখি। সাদা-কালো চৌকো-চৌকো শতরঞ্জি মেঝে। গামলায় চানের জল দেখি, জলের ওপর রোদের ঢেউ, আরও ওপরে রোদের ফিতে, ফিতেয় ধুলোর ফুলকি, ফুলকিতে পরমাণুদের ঘোরা-ফেরা। পা দেখি কতরকম। আলতা-পরা, ফর্সা ফর্সা, আঙুল-ক্ষয়া পা, কচি কচি নরম পাটিসাপটার মতো পা— তাতে বেলকুঁড়ির মতো আঙুল, কেঠো-কেঠো আনমনা যখন-তখন-হড়কে-যাওয়া-পা দেখি, শুকনোশাকনা ধুলোমাখা ফাটাচটা খাটাখোটা পা তা-ও দেখি। দেখতে দেখতে আপনমনে হেসে কুটোপাটি হয়ে যাই। হাসির ঝোঁকে মুখটা বারবার রবার ক্লথে ঠুকে ঠুকে যায়। নাক লাল হয়ে ওঠে। পৃথিবী জানো না, তোমার মেঝে কী মজার! কী মজার। তোমার ছাদের দিকটা শুধু কৌতূহলের, সেখানে কড়ি-বরগা আছে, টিকটিকি আছে, পোকাপুকি আছে, পোকাদের অনবরত উড়ে যাওয়া, গুড়গুড়িয়ে যাওয়া আর টিকটিকির ওত পাতা, তীরের মতো হড়কে আসা, পুঁটকে জিভ ফিচিক করে বেরোনো-আর ঢোকানো আছে। আছে আলো-ছায়ার খেলা, কিন্তু পৃথিবী তোমার মেঝেটা খালি কৌতুকের। পা দেখে দেখে বলতে পারো কোনটা কে? আমি বলতে পারি। আলতা-পরা পা দেখলেই আমি হৃষ্ট, পাটি-সাপটা পা দেখলেই কলকলাই, কেঠো পা দেখলেই কান খাড়া করে থাকি, আর খাটাখোটা পা দেখলেও আমি ভারী খুশি। নিজেকে তুলতে চেষ্টা করি আমি সারাক্ষণ। লালায় আমার মুঠি দুটো মাখামাখি হয়ে যায়। আমার চোখ সুড়সুড় করে। চোখ রগড়াই আচ্ছা করে। কেউ আমার পিঠে হাত রাখে। কী চিকণ ছোঁয়া! এ নিশ্চয়ই সেই চিকণ মুখের চিকণ হাত। আহ্লাদে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকে আমি দেখতে যাই। কিন্তু আমার ঘাড় নেই। কী ঘোরাবো? তাই এই চেষ্টার ফলে আমি খামোখা আবার চিত হয়ে যাই। আর এই চিত-উপুড় উপুড়-চিত খেলা অবিরত চলতে থাকে তার সঙ্গে আমার। গায়ে তেল মেখে দক্ষিণের জানলা দিয়ে আসা রোদুরের মাদুরে আমি উপুড় হয়ে যাবো। সে এসে সন্তর্পণে আমার পিঠে হাত রাখবে। সে যে কী ছোঁয়া! কী ছোঁয়া। ফুলের গায়ে যখন শিশির পড়ে, যদি সত্যিই পড়তো, তা হলে? তা হলে বোধহয় তার তুলনা পাওয়া যেত। আহ্লাদে আটখানা হয়ে আমি সেই চিকণ কালাকে চোখের দেখা দেখবার জন্যে ঘাড়হীন ঘাড় ফেরাতে থাকবো, আর ঢিপ করে চিত হয়ে যাব। চিত হতে গেলে, মাথাটা ঢিপ হয়ে গেলে আমার কখনও কখনও লাগবে। তেমন কিছু লাগেনি তবু আমি ঠোঁট ফোলাবো। ইচ্ছে করে নয়। যখন ব্যথা চাপতে চাই অথচ ব্যথা বাগ মানে না, তখনই ঠোঁট ফোলে, নদী যেমন ফুলে ওঠে ভেতর থেকে সমুদ্র থেকে ছুটে আসা ভেতর-জলের আমদানিতে, তেমনি ঠোঁট ফোলে। কোথা থেকে জানা-অজানা কোন কষ্টের সমুদ্র থেকে জোয়ার ছুটে আসে, ঠোঁট চেপে রাখি। আমার মুখে জিভে ঠোঁটে তো আর জায়গা নেই, কোথায় রাখবো এই চাপা কষ্ট? আর তখনই নাকের মধ্যে দিয়ে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ বেরোয়। ফুলে ওঠে ঠোঁটের কূল। সে খুব মজা পায়। হাততালি দেয়। ভীষণ সুন্দর শব্দ ওই চিকণ হাতের হাত তালির। তখুনি আমার ব্যথা ভ্যানিশ। আমি হেসে দিই। কিন্তু সে শুনলে তো? তার ঠোঁট ফোলানোটাই ভালো লেগেছে। সে চোখ পাকিয়ে আমায় ধমক মারে— ‘অ-অ-অ মা-আ।’ প্রথম অ থেকে তৃতীয় অ পর্যন্ত গলাটা ধাপে ধাপে চড়ে, মা-তে শীর্ষে উঠে যায়। তারপর ছোট্ট একটু আত্মীয় শ্রুতি স্পর্শ করেই সে থেমে যায়। এ তো ধমক নয়। কোথায় যেন মন-কেমন করা-বাঁশি বেজেছে। কোথায় যেন আমার কত কী ছিল। হারিয়ে ফেলেছি। সব আমার হারিয়ে গেছে। কোথায় আমার আপনজন, আপন ধন কিছু মনে করতে পারছি না। শুধু মনে পড়ছে তারা ছিল, হয়তো আছে, কোথাও আছে, কিন্তু আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। ব্যথার জোয়ার ফণা তুলে ছুটে আসে। ঠোঁট ফোলানো দেখতে চাও? কত দেখবে, দেখো! দেখো! ফুলেছে? তোমার। পছন্দমতো ফুলেছে? জলের ফোঁস ফোঁস শব্দ আমার দু নাক দিয়ে বেরোচ্ছে। চোখে ফিট করা আয়না। দু’এক ফোঁটা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। থাকতে থাকতে তার ভেতরেও জোয়ার আসে। আমার ব্যথা তাকে ছোঁয়, তার ব্যথা চেতিয়ে তোলে, তারও যে এক আপন ঘর আছে, নিবার্সন আছে। সেই সব তার আবছা আবছা মনে পড়ে বোধহয়। তার কচি ঠোঁটও ফুলে ওঠে। ফুলে ফুলে ওঠে। তারও নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ বেরোয়। চোখের পরিষ্কার আয়না দিয়ে দু’এক কুচি, তারপর তিন চার কুচি হিরের গুঁড়ো খসে যায়।

দিদিভাই ঘরে এসেছেন। অবাক কাণ্ড। দুই শিশু মুখোমুখি ঠোঁট ফুলিয়ে ফুঁপোচ্ছে।

—‘ওমা, ছোটকু,— তাই শুনি সব চুপচাপ। কী হল দেখি তো! বাচ্ছাকে ভ্যাংচাচ্ছিস না কি রে ছটকু? এ কী খেলা!’

‘ম্‌ম আঁ—’ ছোটকু কেঁদে ফেলে জানিয়ে দেয় এ খেলা নয়। খেলা ছিল না।

—‘মা, তুমি কোথায় ছিলে? আমার মন কেমন করছিল।’

আমি তখন দাপিয়ে দাপিয়ে কাঁদছি। ‘হো-ও-অ্যা হো অ্যা।’ কেউ জানে না কখন আমার কূল ছাপিয়ে গেছে।

সেই কূলে কূলে ভরা যমুনা। বেণীর একটা গুছির মতো সে আকাশ থেকে নেমে পাহাড়ের বিস্তীর্ণ সাদা মাঠে পড়ে ভরাট তুষার হয়ে জমেছিল। তারপর কবে কার টানে সে গলে টলটলে হয়ে আকুল ছুটে গেল, ক্রমশ তার তীব্র আকুলতা, তার নীল ব্যথা সে মিশিয়ে দিল গঙ্গার গৈরিকে। কিন্তু তার আগেও সে তার পুলিনে কত বাঁশি শুনেছে, কত জ্যোৎস্না, কত তারা, কত ঝাঁপাঝাঁপি পারাপারি, কত গোধূলির লালচে-কমলা ছায়ায় সে অঙ্গে মেখেছে সেই কমলা-নীল। সেই শুভ্রজ্যোৎস্না পুলকিত যামিনীম্‌ উধাও হয়ে রয়েছে তার বিস্মৃতিতে তাই কান্না আর থামতেই চায় না, থামতেই চায় না।

তিনি তুলে নিয়েছেন শিশুকে।

—‘ও রে আমার সোনা, কী হয়েছে? কে বকেছে কে মেরেছে? না না না, কাঁদে না, কাঁদে না।’ প্রৌঢ় মুখে প্রৌঢ় গলায় তরুণীর আকুলতা।

মুখে পানের গন্ধ, বুকে দুধের গন্ধ, গালে গাল, বুকে বুক যশোমতীর স্নেহের গন্ধ গলে গলে পড়ছে। আস্তে আস্তে শান্ত হই। মুছে যায় সেই নীল, সেই সাদা, সেই বাঁশি, সেই গোঠ। এখন রোদের ঘর। জল থেকে ডাঙায় উঠে এসেছি। স্পষ্ট হয়ে উঠছে দেরাজ, আলমারি, খাট, টেবিল, টেবিলে নানামতো বস্তুনিচয়। একটু একটু ফুঁপিয়ে উঠতে থাকি। ফোঁপাতে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ফোঁপাতে চুপ। দু চোখ জুড়ে আসতে থাকে। ঘুম চোখেই চান করি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাউডার মাখি, কাজল পরি, চুল আঁচড়াই। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খাই। একটু খেতে না খেতে আলগা ঠোঁট থেকে দুধ খসে পড়ে। একটা খুব মোহন আকৃতির ফাঁক নিয়ে ঠোঁট দুটো স্থির হয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠি।

যশোমতী বলে বাছা কান্দিলি এমন
উথালিল বক্ষ মোর পাথালিল মন
মন চলে নিজমনে নন্দ নিকেতনে
সুধায় তিতিল বক্ষ সে স্মৃতি মন্থনে
কত ক্ষীর থরে থরে পরমান্ন রান্ধি
তাহারে তুষিতে আমি কত ফান্দ ফান্দি।
ফান্দিয়া শিকায় বাছা বান্ধিয়া ছান্দিয়া
দিবা-দ্বিপ্রহরে যশো পড়ে ঘুমাইয়া
কখন আসিলি বাছা যাইলি কখন
টের না পায়িল যশো অঞ্চলরতন
যত ননী চাও সোনা খাইও ছড়ায়ো
যশোমতী মাতা ফেলি কোথা না যাইও
এই ব্রজ এই গোষ্ঠ এই বৃন্দাবন
এই চুমা এহি কোরে হে নন্দ নন্দন
এই খেলা এই ধুলা গোকুল ব্যাপিয়া
ভুলিও না বাপা কভু দিও না ভুলায়্যা।

পঞ্চম অধ্যায় : দুহুঁ করে দুহুঁ

আমি যেই কাঁদব অমনই ও-ও কাঁদবে। আমার খিদে পেলে ওরও খিদে পাবে। আমি যখন মায়ের কাছে খাই, ওর মুখে তখন দিদি বোতল ধরে। যখন ও মায়ের কাছে খায় তখন দিদি আমার মুখে বোতল ধরে। ও খেলা করলেই, আমিও খেলা করি, ও কোঁকোর কোঁ করে ডাকলে আমিও ডেকে উঠি। ওই মেয়েটা যার নাম মা, সে বলে— ‘কোত্থেকে এত মোরগ ডাকছে রে! ভোর বুঝি হয়ে গেল?’

ভোর কাকে বলে গো মা? আমার ওই রকম ডাকই পাচ্ছে যে, ভেতরটা খুশিতে গলে যাচ্ছে। চান করেছি, শরীরটা কী সুন্দর ঠাণ্ডা। পাউডার মেখেছি, কী সুন্দর গন্ধ। নরম নরম জামাকাপড় পরেছি, কী আরাম লাগছে। ঠাণ্ডাও না, গরমও না। আমি ভিজে যাইনি। শুকনো আছি। পেটটি ভরে খেয়েছি। পেটের ভেতরটা কী শা-ন্ত। তাই আমি আহ্লাদে ডাকছি।

আমি একটা দোলনায় শুই, ও তক্তপোশে শোয়। মায়ের পাশে। আমার দোলনায় অভ্যেস হয়ে গেছে, একটু দুলিয়ে দিলেই আমার চোখের পাতায় বাতাস লাগে, একবার-দুবার কাঁপে পাতা। তারপরই টপ করে বুজে যায়। ওই মেয়েটা যার নাম ঋদ্ধি, যাকে আরেকটা ছেলে আরেকটা মেয়ে দিদি বলে ডাকে, সে বলে— ‘কী লক্ষ্মী ছেলে, কী লক্ষ্মী?’ আমি লক্ষ্মী, ও কিন্তু লক্ষ্মী না। রোজ মায়ের পাশে শুয়ে ওর ঘুমনো চাই, তবু কাঁদবে। ছিঁচকাদুনি। ওই ছেলেটা, যার নাম সুযযি, সে বলে—

ছিঁচকাঁদুনি ছি ছি

পড়ল পাড়ায় ঢিঢি

একটা মেয়ে দেখে যা

কাক-চিল বসতে দেবে না।

এইটে শুনলেই বোকাটা খিলখিল করে হাসে। বুঝতে পারে না এটা হাসির কথা নয়। এটা ওর নিন্দে করা হচ্ছে। আমি কিন্তু বুঝতে পারি, আমি ভুরু কুঁচকে তাকাই। ওর নিন্দে হলে আমার ভাল লাগে না। সত্যি বলছি।

আমি কেমন আপনি আপনি ঘুমিয়ে পড়ি, আপনি খেলা করি। আমি লক্ষ্মী, আমি সোনা। ওর সব সময়ে লোক চাই, যত লোক, তত মজা, দাদা বলে দিদি বলে লোকগুলো যত আসবে, তত ওর হাত-পা ছোঁড়া বেড়ে যাবে। পিসিমা বলে লোকটা বলে— ‘ভিরকুট্টি।’ কখনও বলে— ‘শ্যায়না। খুব শ্যায়না, মন-ভোলানোর কায়দা কত শিকেচে।’ বাবা বলে লোকটা বলে— ‘তুমিও কতকগুলো শিখে নাও না দিদিমণি, কাজ দেবে।’ ঠাকুর্দা বলে লোকটা বলে— ‘ঠিক ঠিক। মনো তুই পাঁজি ছেড়ে এইগুলো মুখস্থ কর। কাজে দেবে।’ ঠাকুমা বলে লোকটা বলে— ‘তোমরা কেউ খোকাকে দেখচো না। কী যে সুন্দর দেয়ালা করে। আপন খেয়ালে থাকে। ওই কেল্টি মেয়েটির দিকে তোমাদের সবার মন।’ ‘কা-লো, জগতের আ-লো।’ ঠাকুর্দা বলে লোকটা বলে। বাবা বলে লোকটা আমায় তুলে নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়। লুফে নেয়। আবার ছোঁড়ে আবার লোফে। প্রথমটা আমি ভয়ে কাঠ হয়ে যাই, তারপর খেলাটা বুঝতে পারি। বুকের ভেতরটা একটু গুরগুর করতেই থাকে বটে, কিন্তু কাঁদি না। বাবা বলে— ‘কী জানো তো সেজ মা, মেয়ে হয়ে জন্মেছে, তার ওপর তোমার মতো কেল্টি, কেড়েকুড়ে না নিলে তো পাবে না, তাই এমন নেই-আঁকুড়ে। তোমার মতো “হলেও হল, না হলেও হল” ফিলসফি তো আর সবার জন্যে নয়!’

ওরা যা যা বলে আমি সব শুনতে পাই। বুঝতে পারি। কেন বলছে, কোন কথার কী মানে অতশত বুঝি না। কিন্তু শব্দগুলো আমি ধরতে পারি। আমি যেন একটা খোলা জায়গায় আছি, ওরা একটা গুহার মধ্যে আছে। ওরা কথা বলাবলি করছে, কথাগুলো মানে শব্দগুলো ধ্বনিগুলো গুহার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, গমগম করছে গুহাটা। আমার কাছে পুরোপুরি পৌঁছচ্ছে না। তা ছাড়াও আমার চারপাশে আরও অনেক শব্দ। বৃষ্টি পড়ছে কোথাও ঝরঝর করে, হিম ফুটছে সিরসির করে, ইঁদুরেরা দৌড়ে চলে গেল, পিঁপড়েরা বাসা বাঁধছে, ফড়িং-এর পাখা কাঁপছে, ধানের শিষের মধ্যে দুধ জমছে, পাখি উড়ে যাচ্ছে, রামধনু উঠছে, মেঘেরা হাসছে, বাজ ধমক দিল, ছাগলছানা জন্মাল, কেঁচো মাটি খুঁড়ছে, এই সমস্ত শব্দ আমার কানে ভোঁ ভোঁ করছে, কী করে ওদের কথা সব মানেসুদ্ধু শুনতে পাব! ‘কেল্টি’ একটা শব্দ ওলটপালট খেতে খেতে কাটা ঘুড়ির মতো গোঁত্তা খেয়ে এসে পড়ল। বা রে, বেশ তো, বেশ তো! ‘ছিঁচকাঁদুনি, ছিঁচকাঁদুনি, ছিঁচকাঁদুনি ছি-ছি।’ ধ্বনিটা শুনলেই বোঝা যায় এটা ছি-ছি শব্দ, ভালো-কথা বলছে না, মায়ের বিছানায় যে পুঁচকিটা শুয়ে এখন খেলা করছে সে এই ছিছিক্কারটা ধরতে পারছে না, তাই আরও খেলছে। জোরে জোরে খেলছে, একেবারে আহাম্মক পুঁচকিটা। আমাকে বলুক দিকি, আমি রেগে উঠব, চেঁচাব, তাতেও না থামলে আমি কাঁদব। তখন সাদা চুল লোকটা এসে কালো চুল লোকটাকে বকবে। বেশ হবে।

কালো চুল লোকটাকে কিন্তু আমার ভাল লাগে। ওকে একজন ‘সুয-যি সুয্‌যি’ করে ডাকছিল। ছি-ছির খুব কাছাকাছি হলেও ‘সুয-যি’ কথাটা আমার খারাপ লাগে না। আমি নিজের মনে বলি ‘যি, যি, যি, যি।’ তার মানে যে ‘সুয-যি’ এটা এই বোকারামগুলো বোঝে না। একটা বোকা বলল— একেবারে “জি”-তে চলে গেলি? আর একটা বোকা বলল— ‘বাংলাতেও জ ম এর আগে, ইংরেজিতেও জি এম-এর আগে। ও তো ব্যাকরণগত কোনও ভুল করেনি বাপু।’ আরেকটা বোকা বলল— ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে দেখিস অপু-ও জে-জে-জে, জে-এ-এ, গীত দিয়ে লাইফ আরম্ভ করেছিল।’ ‘ইনফ্যান্ট স্টেজ থেকেই টুকতে শুরু করলি?’ —আরেকটা বোকা বলল। এতগুলো বোকাকে একসঙ্গে আগড়োম বাগড়োম বকতে দেখে আমার শেষ পর্যন্ত ভা-রি হাসি পেয়ে গেল। আমি হাসছি। খিলখিল করে হাসছি।

—গলার মধ্যে গার্গল করার মতো কী রকম আওয়াজ করছে দেখেছ? সরু গলার একটা লোক বলল। এই লোকটা আলাদামতন, এটা বোধহয় মেয়ে। ‘যি-যি-যি’—আমি প্রাণপণে চেঁচাই। সেই লোকটা আসছে না কেন? ঝাঁকড়াচুলো সেই লোকটা? সেই ছেলেটা? কী রকম যে হাসে, মুখটা যেন আকাশ, হাসিটা যেন বিদ্যুৎ, কিংবা মুখটা যেন জল, হাসিটা এক টুকরো ঢিল। টুপ করে পড়ল, অমনই ঠোঁটের ভাঁজে, চিবুকে, গালে, নাকের পাটায়, চোখের পাতায়, ভুরুতে কপালে হাসি ছড়িয়ে গেল। কেমন অঙ্গভঙ্গি করে ছেলেটা? আমার চিবুকের ওপর আঙুল রেখে টিপ্‌ করে টিপে দেয়— আমি হেসে উঠি। খুব হাসি পেয়ে যায় আমার। এই ছেলেটাকে, লোকটাকে আমি আলাদা করে চিনতে পারি। যেমন মা বলে লোকটাকে, বাবা বলে লোকটাকে, সাদা চুল লোকটাকে দেখলেই চিনতে পারি! তেমনই সুয-যিকে আমি চিনি। অন্য ছেলেমেয়েগুলো কে কোনটা আমার গুলিয়ে যায়। কতগুলো বাব্‌বাঃ। একটা পল্টনবিশেষ! সবগুলো যখন ঘরে ঢুকে আসে! আমার তো একটু ভয়ই করে। কী রে বাবা, মারবে নাকি? বকবে নাকি? আমায় টুক করে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাবে না কি? অনেক সময়ে খুব বিরক্তও লাগে, অতগুলো লোক ঘরে এলে হাওয়া বন্ধ হয়ে যায় না? গুমোট ঘরে নিশ্বাস নিতে আমার কষ্ট হবে না বুঝি? তা ছাড়াও সুয্‌যি ছেলেটাকে আমার কেমন চেনা-চেনা লাগে। ওকে আমি আগে কোথাও দেখেছি। আগে? আগে মানে কী? আগে আমি ছিলুম? কোথাও? কোনওভাবে? জানি না তো! তবে কি আকাশ থেকে সুযযিকে অনেক দিন ধরেই লক্ষ করছি? ওর কাছে কি তখনই আসতে ইচ্ছে হয়েছিল? কিছুই জানি না। খালি সুয্‌যিকে আমার চেনা লাগে, ভাল লাগে, ওকে দেখলে ভরসা পাই।

এই লোকগুলো চেঁচামেচি করছে। ঝগড়াঝাঁটি করছে না কি? না, না, একজন আরেকজনের পিঠ চাপড়ে দিল। উঃ! হাসছে। যাক হাসছে। ওই যে ওই যে, এসেছে। সুয-যি এসেছে। ‘যি-যি-যি। যি-যি-যি।’ কত কী বলতে চাই, কিছুই ছাই বেরোয় না যে মুখ দিয়ে। ‘যি-যি-যি।’

—‘তোমরা এসে হইচই করছ কেন বলো তো, এমন করছ যেন বাড়িতে যমজ হয়েছে! …এইদ্‌ দেখো তোমাদের গোলমালে খোকাটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। দাদা দেখো।’

দাদা—‘একা চোরা ন্যাকা বোকা ভ্যাবাচ্যাকা গোবেচারা’

সুযযি—‘ডাকাবুকো, ন্যাজামুড়ো, বোকাসোকা ম্যাদামারা’

দাদা— ‘হাবাগোবা ফুটিফাটা নেটিপেটি হারাকিরি’

সুযযি— ‘ন্যাড়াবোঁচা, খিটিমিটি, হাবিজাবি, গড়াগড়ি’

দাদা— ‘তুমি হেরে গেছ। হারাকিরি, গড়াগড়ি মেলে না।’

সুযযি— ‘মেলে, অবশ্যই মেলে, কানে শুনতে একটুও খারাপ লাগছে না। কী শ্রদ্ধা, পুলকদা, দিদি, তোমরাই বলো, খারাপ লাগছে?’

পুলকদা— ‘গড়াগড়ি না বলে যদি গুরুগিরি বলতিস, তাহলে কিন্তু খাপে খাপে বসে যেত।

হাবাগোবা ফুটিফাটা নেটিপেটি হারাকিরি

ন্যাড়াবোঁচা, হাবিজাবি, খিটিমিটি গুরুগিরি।’

সবাই মিলে হাততালি দিয়ে উঠল। একটা লম্বা-চুল গম্ভীরমুখো লোক, বোধহয় মেয়ে, এসে বলল— ‘বাচ্চার ঘরে তোমরা এত গোলমাল কোরো না। ওকে ঘুম পাড়াতে অসুবিধে হবে।’

‘পুরুত বামুন রেগে আগুন তেলে বেগুন’ —দাদা।

‘বেগুন ভাজুন চাকুম চুকুম দাদা আসুন’ —সুযযি

‘আসুন মশাই বসুন খাটে পিঠ ভাঙব চ্যালা কাঠে’ —শ্রদ্ধা

‘কাঠ কি অত সস্তা? ভুসিমালের বস্তা?’ —পুলকদা

‘বস্তা এখন খা-লি ভেলি-গুড়ে বা-লি’—অংশু

‘বালির মধ্যে চি-নি চিনির মধ্যে সিদ্ধি’ —ভক্তি

‘ঋদ্ধি মহা গিন্নি ঋদ্ধি বড় জিদ্দি’ —দাদা

—‘হয়নি হয়নি, দাদা তুমি হেরো’ —সুযযি চেঁচিয়ে উঠল।

—‘ঠিক আছে, ঋদ্ধি গিন্নিকে জিজ্ঞেস করো।’

—‘জিজ্ঞেস করার কী আছে? এ তো সামনে পড়ে আছে। সিদ্ধি দিয়ে শুরু করতে হবে তোমাকে…’

—‘আরে বাবা সে কি আমি জানি না?’

—‘নিজেই খেলার রুল তৈরি করবে। নিজেই ভাঙবে।’

—‘যে গড়ে ভাঙবার রাইট তারই আছে। এটা একটা নতুন খেলা হয়ে গেল। কেউ কি ভাবতে পেরেছিল শেষ লাইনে সব ব্যাপারে বিধানদাত্রী ঋদ্ধিগিন্নিকে এনে হাজির করতে পারব?’

খেলা? তার মানে ওরা আমাকে আদর করছে না? খেলছে? বা রে! আমি বেশ ভাবছিলুম আমাকেই ডাকছে হাবাগোবা, একাচোরা, নেটিপেটি বলে। আমাকেই আদর করছে ন্যাড়াবোঁচা হাবিজাবি বলে! ও হরি, এগুলো ওদের খেলা? এত বড় বড় লোকগুলো খেলছে? এ মা! খেলবার আর জায়গা পাননি বুঝি আপনারা! আমি ঠোঁট ফোলাই।

ঋদ্ধি—‘ওমা, ওই দেখো পাবন ঠোঁট ফোলাচ্ছে। তোমরা এত গোলমাল করছ। সরো, জলদি সরো। দেখি ও কী করছে!’

‘যি-যি-যি-ই-ই’, আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলি।

ঋদ্ধি— ‘বাচ্চা কাঁদছে। জলদি সরো।’

ইন্দ্র— ‘তখন থেকে “যি-যি” করে কাঁদছে। সূর্য, কাছে এগিয়ে যা তো! সূর্য লাফিয়ে এগিয়ে এসে তুলে নেয় আমাকে। —রাইট, দাদা ও আমাকেই ডাকছে।’

আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে চুপ করে যাই।

সূর্য— ‘এই দেখো চুপ করে গেল!’

ঋদ্ধি— ‘ওইটুকু ছেলে তোকে চিনেছে, তোকে ডাকছে। কী কাণ্ড রে! দেখিস ও মস্ত কিছু হবে।’

মস্ত কী? আমি মস্তো হব? ব্যস্ত-সমস্তর মতো কিছু নাকি ব্যাপারটা? তারই বা মানে কী? আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। তলার ঠোঁটটা কী রকম বোকার মতো এক দিকে ঝুলে যায়।

সুযযি আমাকে নিয়ে সারা ঘরে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়। মায়ের বিছানা থেকে বোকারামটা হাঁ করে দেখে। আমি কেমন বেড়াচ্ছি, লাফাচ্ছি, আদর খাচ্ছি, তুই শুয়ে আছিস, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায়। বড্ড জোর একটু উপুড় হতে পারিস। তুই ভারী, আমি হালকা। আমি সুযযির কোলে উঠে-এ ছি। যি যি যি যি-ই।

বোকারামটা হাসছে। ও সবেতেই হাসে। কী বোকা, না? মাকে বেশিক্ষণ না দেখতে পেলেই বোকাটা কাঁদবে। একেবারে হাঁদা। কাঁদার কী আছে? মা বলে লোকটাও তো মানুষ? তার কাজকম্মো নেই? খাওয়া-দাওয়া নেই? কলঘরে যেতে হবে না তাকে? বড়রা কি তোর আমার মতো বিছানা ভেজায়? কিন্তু বোকাটা যতই বোকা হোক, যতই ওকে টেক্কা দিই আমি, বোকাটাকে আমি বড্ড ভালবাসি। একেক সময়ে ওর জন্যে আমার বুকটা কেমন হু-হু করতে থাকে। যেমন এখন। ব্‌বু-বু-ব্বু-উ। আমি আওয়াজ করছি। সুযযিটা বুঝছে না। আমি হাত বাড়াচ্ছি ওর দিকে। তবুও বুঝছে না। আরেক গাধা এই সুযযি ঠাকুর। আমি চেঁচাই রেগে। গলা ফুলিয়ে আমি চেঁচাই। সুযযির নাকটা কামড়ে দিই আমি।

—‘অ্যাঁ?’

সুযযি আমাকে আমার দোলনায় শুইয়ে দিয়েছে।

আমি চেঁচাচ্ছি।

—‘রেগে গেছে কেন বল তো!’

—‘তুই দেড়ো, দেড়ে গাল ঘষেছিস বোধহয় ওর গালে।’

মায়ের বিছানা থেকে বোকাটা ডাকছে— ‘ক-অ-অ, ক-অ-অ, বব্বব্বব্ব।’

মানে— ‘তুই কই? বাচ্চা!’

আমি বলি—‘বু-বু-বু-উ-উ, যি-যি-যি।

মানে—‘বুবু। সুযযি!’ অর্থাৎ সুযযি আমাকে বুবুর কাছে নিয়ে চলো। কেউই কিছু বোঝে না। আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকি।

‘হো-ও-অ্যা, হো-ও-অ্যা, হো-অ্যা’

কে যেন বলে—‘কী আশ্চর্য! কান্নার আওয়াজটা পর্যন্ত এক রকমের। অথচ একজন রামরতন বোসের লেনে আর একজন শিবশঙ্কর মল্লিক লেনে।’

কে যেন বললে—‘তুই কি মনে করিস দেখে দেখে শেখে? ওসব ভেতর থেকে আসে।’

কে যেন বললে—‘মেয়ে-ছানাটাও তো যমজ। কিন্তু আলাদা! কেন এমন হয় কে জানে!’

লোকগুলো মানে দাদা দিদিগুলো এক এক করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি কখন চুপ করে গেছি কে জানে! হাজার চেঁচালেও তো বুবুর কাছে যেতে পারব না। চুপ করে নিজের কাজে মন দেওয়াই ভাল। নিজের কাজ কী বলো তো? আঙুল চোষা।

চুক চুক করে আঙুল চুষতে চুষতে আমার চোখ জুড়ে ঘুম নামে। ঘুমের মাসি ঘুমের পিসি আমায় ঘুমের দেশে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আমার বিছানার চারটে কোণ ধরে চারটে মাসিপিসি হাওয়ায় উড়ে উড়ে যায়। যেতে যেতে একটা বাড়ির মাথায় দাঁড়ায় ওরা। ইশারা করে আমায় বলে—দেখো, দেখো, দেখো তো খোকা কিছু দেখতে পাও কি না!

আমি বাড়িটার জানলা দিয়ে দেখি। দেখি আমি ঘুমোচ্ছি। একটা পালঙ্কে, ধবধবে বিছানার মধ্যে ফুলের মতো আরও একটা বিছানা। তার মধ্যে আমি শুয়ে ঘুমচ্ছি। গোল মতো মশারি টাঙানো রয়েছে। মশারির গোলাপি রঙের কুয়াশার মধ্যে দিয়ে আমার মুখটা ফুটে আছে। পাশে বসে দিদিভাই, আর ফুলমামু। দেখেই বুঝতে পারি।

মামু বলে—‘ও হঠাৎ অমন ঘুমিয়ে পড়ল কেন মা?’

দিদিভাই বললেন—‘কেন আর? ওর ভাইটা আছে চার নম্বরে। সে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই এনারও ঘুম পেয়ে গেল।’

মামু—‘সত্যি, মা? দুজনে আলাদা আলাদা জায়গায় আছে, তা-ও ওরা সব কিছু একসঙ্গে করে?’

দিদিভাই—‘যতই আলাদা থাক! ওরা সব একসঙ্গে করবে চিরকাল। যদি ওর হাসি পায় তো এ শুধু শুধু হেসে ফেলবে। এর কান্না পেলে ওরও কান্না পেয়ে যাবে।’

মামু—‘বড় হয়ে গেলে তো আর কান্না পাবে না, তখন?’

—‘তখন? ধর বরুণ আছে এসকিমোদের দেশে, আর পাবন আছে জুলুদের দেশে। বরুণ ঠিক যখন এসকিমোদের সঙ্গে সিল মাছের মাংস খাবে, পাবনও তখন জুলুদের সঙ্গে সিংহর মাংস খাবে।’

—‘যদি পাবনদের তখন রাত আর বরুণদের তখন দিন হয়?’

—‘তখন? মাঝরাতে পাবনের খিদেয় ঘুম ভেঙে যাবে। তার মনে হবে আকাশ খাই, পাতাল খাই। যতক্ষণ বরুণ খাবে ততক্ষণ পাবন খিদেয় ছটফট করবে। বরুণের খাওয়া হয়ে গেলেই পাবনের পেট ভরে যাবে। সে ঘুমিয়ে পড়বে।’

—‘তাহলে তো ওদের একজনকে খাওয়ালেই হয় মা।’ দিদিভাই তো-তো করছেন, বিপদে পড়ে গেছেন।

—‘শরীরগুলো তো আলাদা, ছোটকু। শরীরটা তো না খেলে বাড়বে না।’

—‘শরীর আলাদা হলে পেট কী করে এক হবে মা।’

—‘পেট এক বলিনি তো!’

—‘এই যে পেট ভরে যাওয়ার কথা বললে!’

—‘পেট নয়, মন, আসলে আমি মনে হওয়ার কথা বলেছি, বলতে একটু ভুল হয়ে গেছে বাবা!’

—‘ওদের মন এক?’

বরুণ গোলাপি মশারির ঢাকা ফুঁড়ে ওপরে উঠে এল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বলল— ‘কোথায় তুই থাকিস পাবন? আমি মন খারাপ করতে গিয়ে ভাল করে মন-খারাপ করতে পারি না। আধখানা মন হারিয়ে থাকে! আমার কান্না আধখানা। আমার হাসি আধখানা।’

আমি বলি—‘ও মা তুই বুঝি তুই? আমি ভেবেছিলুম তুই আসলে আমি। আমার কিন্তু গোটা মন খারাপ করে, গোটা মন-ভাল হয়, যখনই হাসি আমার সঙ্গে সঙ্গে তুইও হাসছিস বুঝতে পারি। আমার হাসির মধ্যে তোর হাসি মিশিয়ে থাকে তাই হাসিটা বিরা-ট। কান্নাটাও বিরা-ট। একদম উপছে যায়। ধর আমি হাসছি, ঘরের মধ্যে হাসিটা উপছে পড়ছে, হাওয়ায় কিলবিল করছে হাসি, মেঝেতে খিলখিল করছে হাসি। তখন যদি দাদা-দিদি বলে লোকগুলো ঘরে আসে তো ওদের কাতুকুতু লাগে। ওরাও হাসতে থাকে। হাসিটা তারপর জানলা দিয়ে বেরিয়ে যায়, যেখান দিয়ে হাসির হাওয়া বয়, সব্বার মুখ হাসি-হাসি হয়ে যায়।’

বরুণ বলে—‘কান্না? আর কান্না?’

আমি বলি—‘কান্না পেলে সব থই-থই। লোনা জলে থই-থই, হই-হই। বিষ্টি পড়ে। পুকুর বাড়ে, জোয়ার আসে। বান আসে। সব ভেস্যে যায়।’

বরুণ বলে—‘তোর কেন বেশি-বেশি আমার কেন কম-কম রে?’

পাবন বলে—‘আমার বুব্বু আছে।’

বরুণ বলে—‘আমারও কানু আছে।’

পাবন বলে—‘আমার মা আছে।’

বরুণ বলে—‘আমারও দিদিভাই আছে।’

পাবন বলে—‘আমার দোলনা আছে।’

বরুণ বলে—‘আমার পালং আছে।’

বলতে বলতে, থাকা-না-থাকার হিসেব দেওয়া-নেওয়া করতে করতে, কান্না-হাসির, মা-দিদিমার বখরা বাঁটাবাঁটি করতে করতে পাবন-বরুণের শরীর-মন-আত্মা সব কিছু সব, ক্ষিতি-অপ্‌-তেজ-মরুত-ব্যোম বাষ্পীভূত হতে থাকে। আকাশে হালকা মেঘের মতো ভেসে থাকে একে দুই, দুয়ে এক, দুহুঁ-কোরে-দুহুঁ- কাঁদে-বিচ্ছেদ-ভাবিয়া চিরবিরহী অস্তিত্ব এক। পাশাপাশি হাসাহাসি, তবু বুক হু হু, তবু ভুবন ধু-ধু। বারোমেসে বিচ্ছেদ-কোকিল সেই ভুবন জুড়ে ডাকতে থাকে।

ষষ্ঠ অধ্যায় : হরিবংশ-১ এবং লঙ্কাকাণ্ড

কিছু কিছু মহিলা আছেন যাঁদের দেখে মনে হয় তাঁরা বয়সকালে খুব সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, আদপেই তাঁরা কোনওদিন সে রকম কিছু ছিলেন না। এখনও যেমন আগেও তেমনই ছিলেন এঁরা। নিমসুন্দরী। আমাদের পিসিমা মনোরমা ছিলেন এই জাতীয়। ফুটফুটে রং। পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনের প্রকৃতই প্রকৃত গৌরবর্ণা। সেই গৌরে বেশ ভাল রকম হলুদের মিশেল ছিল। অমন চম্পকগৌরী আমি সারা জীবনে কমই দেখেছি। লম্বা নয় একেবারেই। কিন্তু বেঁটে তাকে কখনওই বলা যাবে না। কারণ অনুপাত। হাত পা মুণ্ড ধড় ইত্যাদির সুসামঞ্জস্যের জন্যে তাঁকে কখনওই বেঁটেখাটো মনে হত না। বরং তাঁর পাশে লম্বা কেউ দাঁড়ালে মনে হত কী তালঢ্যাঙা রে বাবা! পিসিমা একটি মিনিয়েচার লক্ষ্মী। যাঁকে বেঁটে প্রমাণ করতে হলে তাঁর পাশে লম্বা কাউকে দাঁড়াতে হবে এবং তাতেও তাঁর বেঁটেত্ব প্রমাণ না হয়ে অন্য জনের ঢ্যাঙাত্বই প্রমাণ হয়ে যাবে। পিসিমার পায়ের পাতাগুলো ছিল অদ্ভুত। তুলো ভরা ছোট ছোট বালিশের মতো। আঙুলগুলো যেন মাটির প্রতিমার আঙুল, পরস্পরের গায়ে গায়ে লাগা। মাঝখানে ফাঁক আছে কিনা বোঝা যায় না। হাতগুলোও তেমনই। মিনি বেরালের থাবার মতো। হাতের তেলোর ঢিবিগুলো বেশ উঁচু এবং স্পষ্ট, বেশ মাংসল থাবাটে-থাবাটে হাত যার আঙুলগুলো প্রায় গাঁটহীন, এবং পায়ের আঙুলের মতোই গায়ে গায়ে লাগা। আমি খুব লক্ষ করে দেখেছি পিসিমা যখন খেতেন ডান হাতের চার আঙুল পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে থাকত। যেন একটা মোম-সোনার বড় চামচ। বুড়ো আঙুলটা অবশ্য আলাদা হয়ে থাকত এবং সেটা এমন নমনীয় ছিল যে উল্টো দিকে যথেচ্ছ বাঁকানো যেত। চলিত বিশ্বাসকে ভুল প্রতিপন্ন করে অবশ্য পিসিমা নিজে ছিলেন অনমনীয়। খাবার সময়ে তিনি যদি হাত চাটতেন তো মনে হয় চারটে আঙুলের চামচ একসঙ্গে মুখে ঢুকিয়ে দিতেন, আর নয়তো সেই মাথা-পেছনে-হেলানো বুড়ো আঙুলটা মুখে ঢুকে যেত। প্রসঙ্গত হাত-চাটা সিঙ্গি বাড়ির মেয়েদের একটা জিন-ঘটিত বা জৈন অভ্যেস। মা ঘোষ-বাড়ির মেয়ে, তিনি হাত চাটা পছন্দ করতেন না। ঠাকুমা দত্ত-বাড়ির মেয়ে, তিনিও হাত চাটাতে বাদ সাধতেন। তা সত্ত্বেও, পিসিমা মনোরমা থেকে শুরু করে পমপম-টমটম পার হয়ে বিদ্যা পর্যন্ত একটি হাতচাটা পাতচাটা নারীকুল সৃষ্টি হয়েছিল সিঙ্গি বাড়িতে। ‘পা-চাটা যে নয়, এটাই রক্ষে’ বলতেন ঠাকুর্দাদা।

যাই হোক, পিসিমার আঙুলের ফাঁক সম্পর্কে খুব ছোটবেলাতেই আমার কৌতূহল জাগে। কৌতূহল নিরসন করবার জন্যে আমি পিসিমা-বেচারির ঘুমের সময়টাই নির্বাচন করি। রাত্তিরে তিনি কখন ঘুমোতেন আমাদের জানবার কথা নয়, কারণ তার অনেক আগেই আমরা যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়েছি এবং কোনও-না-কোনও দাদা বা বাবার দ্বারা স্বস্থানে বাহিত হয়ে গেছি। বস্তুত এই ঘুম, মানে আমার আর পাবনের ঘুম বাড়িতে একটা সন্ত্রাসের ব্যাপার ছিল। কখন কোথায় আমাদের ঘুম পাবে কেউ আগে থেকে অনুমান করতে পারবে না। ধরুন আমরা ছোটরা খেতে বসেছি। সবাইকার সব পদ খাওয়া হয়ে গেল, পাবন বা পুনপুন দেখা গেল এগোতে পারেনি।

‘কী রে, খা!’

পুনপুন গরস মুখে তুলছে। তুলতে তুলতে শিথিল হাত থেকে গরস পড়ে গেল। পুনপুন ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাল দিয়ে ভাত মাখা। সরু সরু আলুভাজা দিয়ে গরস পাকিয়েছে। মুখ আর পাতের মাঝখানে শূন্যে হাত নিরলম্ব রেখে পুনপুন ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়তো পুনপুন কলঘরে গেছে। আসে আর না। আসে আর না। মায়ের খেয়াল হল। মা বললেন—‘দ্যাখ তো নিশ্চয়ই ও ঘুমিয়ে পড়েছে।’ ঠিক। পেন্টুলের দড়ি হাতের মুঠোয়, উবু হয়ে বসা, ছোট্ট চুটকিটি বেরিয়ে আছে, পুনপুন উবু হয়ে বসে ঘুমোচ্ছে। যদি সে প্যানের মধ্যে পড়ে যেত? পুনপুনের মাথা বেশ শক্ত। প্যান নির্ঘাত ভেঙে যেত। সেই কাঁচ ভাঙা নোংরার মধ্যে পুনপুনের মাথা, বুঝুন! মেথর-মিস্ত্রি ডাকতে হত, পুনপুনকে কী ধরনের চান ও শুদ্ধিকরণ করানো হলে সে আবার গ্রহণযোগ্য হত ভাবতে গেলেও হৃদকম্প হয়।

ওর ঘুম ছিল যেমন নিঃশব্দ, বেরালের চলাফেরার মতো, টের পাওয়া যায় না, বুবুরটা আবার তেমনই সশব্দ। দাদা-দিদিরা মাঝের বড় ঘরে তক্তপোশের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে হয়তো আড্ডা দিচ্ছে, বুবু কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে এল। সব্বাইকার মাঝখানে একে ঠেলে ওকে ঠেলে খানিকটা জায়গা বার করে নিল, তার পরেই উপুড়। ঝাঁকড়া চুল মাথার চারপাশে ছড়িয়ে আছে, পিঠটা উঠছে নামছে, উঠছে নামছে।

পালক হয়তো বলল—‘মাটি করেছে। কাঁদছে-টাঁদছে না কী?’

ইন্দ্র বলল—‘কাঁদবার আর জায়গা পেল না?’

ভক্তি বলল—‘কী হয়েছে বুবু, কাঁদছিস কেন? কে বকেছে?’

আর কে? বুবু নিথর। ঘুমিয়ে পড়েছে।

ঠাকুমা সন্ধেবেলায় জপ করছেন। কম্বলের আসনে বসা, সামনে কোশাকুশি, হাতে মালা ঘুরছে। হঠাৎ কনুইয়ের কাছে একটা গোঁত্তা খেলেন, কনুই আর কোলের মাঝখানের জায়গাটা যেন গুহার মতো, তার মধ্যে গুঁড়ি মেরে সিংহ কিংবা বাঘ ঢুকছে। ঢুকে গেল। মাথাটাকে ঠাকুমার কোলে কোনওক্রমে ঢুকিয়ে দিয়েই বুবু ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকি ধড়টা মেঝেতে পড়ে আছে।

সে যাক। যে কথা বলছিলুম। পিসিমাকে রাতের ঘুমের সময়ে ধরা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। এদিকে পিসিমা দুপুরে ঘুমোতেন না। কিছু করার না থাকলে হাঁটু দুটো বুকের কাছে জড়ো করে বসে থাকতেন। থাকতে থাকতে ঢুল আসত। ঘুমোব না ঘুমোব না করেও একটু ঘুমিয়েই পড়তেন পিসিমা। সেই বিরল মুহূর্ত, কখন স্বাতী নক্ষত্র উঠবে তার থেকে জল পড়বে, ঝিনুকের বুক খোলা থাকবে তাতে সেই জলের ফোঁটা পড়বে! তক্কে তক্কে আছি। পিসিমা বেশ কিছুক্ষণ নট নড়নচড়ন হয়ে আছেন। আমি পিসিমার পায়ের আঙুলের ফাঁকে আমার আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছি। পিসিমা একটু শিউরে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমার আঙুল চটচট করছে। আঠা। ভগবান পিসিমার আঙুলে আঠা লাগিয়ে দিয়েছেন। ভগবানের আঠা, ভাবি একটু শুঁকে দেখি। নাঃ, ভাল গন্ধ তো নেই-ই, আমাদের গঁদের আঠার চেয়েও গদগদে মতো গন্ধটা। তবু যদি সেই আঠায় আমার আঙুলও জোড়ে। ছ্যাতরানো আঙুলগুলো, সবাই বলে হাঁসের পা। আগে আঠাসুদ্ধ আঙুল মাথায় ঠেকিয়ে নমো নমো করে নিই। ভগবানের আঠা তো! ভাগ্যবান ছাড়া কে-ই বা পায়। আমার পাপীর আঙুল জুড়ল না। আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন জিনিসটা কী! আমি অনেক পরে বুঝেছিলুম ওটা হাজা। তখন আর হাত ধুয়ে লাভ নেই।

ছোট্ট মাথা-ভর্তি একঝাঁক চুলও ছিল পিসিমার। আমি যখন দেখেছি তখন পিসিমা উত্তর-পঞ্চাশ, কিন্তু চুল কমেওনি, বেশি পাকেওনি, অথচ আমার মায়ের চুল মধ্য-তিরিশেই রীতিমতো কাঁচাপাকা। কিন্তু এত সত্ত্বেও পিসিমা ছিলেন নিমসুন্দরী। আমি পরে মাকে জিজ্ঞেস করেছি— ‘মা, ছোটবেলায় পিসিমা খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন, না?’ মা বলেন—‘অত রং, অত চুল, অমন গড়ন, রূপসী বইকি! এখনও তো তাই।’ ব্যাস আমি পিসিমার রূপের মধ্যে ওই নিম-এর অস্তিত্বটা তখনই বুঝে গিয়েছিলাম। রং, চুল, ফিগার সবই ছিল, তবু পিসিমা সুন্দরী ছিলেন না। পিসিমা খুব কঠোর বৈধব্য পালন করতেন। খুব সকালবেলায় পিসিমা নীচের কলতলা থেকে চান করে বেরোতেন, তখন প্রায় কেউই ওঠেনি। পিসিমা খুব নিশ্চিন্তে একটি গামছা স্কার্ট করে পরে আর একটি গামছা ওড়না করে গায়ে জড়িয়ে কলতলা থেকে বেরোতেন। সে সময়ে তাঁকে দেখে ফেলেছি বলেই বলছি তিনি বেশ পীনপয়োধরাই ছিলেন। এবং আমি তাঁর এই প্রত্যঙ্গ আবিষ্কার করে টেলিফোনযন্ত্র আবিষ্কারক গ্রাহাম বেল-এর মতোই আশ্চর্য ও উল্লসিত হয়েছিলাম। কেননা আমার ধারণা ছিল পিসিমার যেহেতু সন্তান নেই তাই ও বস্তুও নেই। আমার উল্লাসের আর একটা কারণ হল এই আবিষ্কারের পেছনে আসল অর্থ আবিষ্কার। অর্থাৎ পিসিমার সন্তান নেই তা হতে পারে না, কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই আছে। মাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি—‘মা পিসিমার ছেলেমেয়ে কোথায়?’

—‘নেই।’

—‘হয়ে মারা গেছে? রাধু পিসির ছেলের মতো?’

—‘না রে বাবা। হয়নি।’

কিছুদিন পরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই প্রশ্ন। মা তিতিবিরক্ত হয়ে যেতেন। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারতেন না কেন আমি বুঝতে চাইছি না, তাঁর কথায় অনাস্থার মূলটা আমার কোথায়! এই সমস্যার সমাধান করতে না পেরে অবশেষে আমি আরেকটা আবিষ্কার করি, সেটা হল—আমাদের মধ্যেই কেউ-কেউ নিশ্চয়ই পিসিমার ছেলেমেয়ে। কোনও কারণে সেটা গোপন করে যাওয়া হচ্ছে। কে পিসিমার সন্তান হতে পারে ভেবে আমার শৈশবের অনেক নিঘুম দুপুর কেটেছে। তার পর যেদিন সেই গুপ্ত সন্তানকে বার করতে পারলাম সেদিন উত্তেজনায় আমার এত গা-বমি করতে থাকে যে আমি খেতে পারি না। উত্তরটা হাতের কাছেই রয়েছে! পালক! পালকই সেই পিসতুতো। আমাদের বলা হয়েছে পালক আমাদের দূর সম্পর্কের দাদা। পালকের পদবি রায়, পিসিমার পদবিও রায়, শ্ৰীযুক্তা মনোরমা রায়ের নামেই মাঝে মাঝে কোন দূরদেশ থেকে মনি অর্ডার আসে। কিন্তু পালকের সত্য পরিচয় না দেবার কারণই বা কী হতে পারে? পালক কি ছোটবেলায় কোনও গুরুতর অপরাধ করেছিল? সেই কারণেই পিসিমা তাকে ত্যাগ করেন? এবং আজও পালককে দেখতে পারেন না? মায়েরা কি এমনই নির্মম হন? সেই থেকে অপরাধ ব্যাপারে আমার বেশ ভয়ই জন্মে যায়। কোন অপরাধের জন্যে যে মা আমাকে ত্যাগ করতে পারেন, ভেবে কূল পেতাম না। তবে তা সত্ত্বেও অপরাধপ্রবণতা বা অপরাধের মাত্রা কমেনি। অপরাধটা করার পরে দুশ্চিন্তা হত। ইতিমধ্যে পালক ও পিসিমার ওপর আমি নজরদারি করতাম।

পালক—‘টম্‌ চা দে।’

ভক্তি ওরফে টম্‌—‘ভিজিয়েছি।’

পিসিমা—‘সাতসকালে যে চা-চা করচো, দাঁত মেজেচো?’ পালক পিসিমার কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে হাঃ করে একটা ভাপ ছাড়ল। পিসিমা—‘ম্যাগে। নিঘ্‌ঘিন্নে, ছুঁয়ে দিলি, নংকাপোড়া!’

পালক—‘এক হাত তফাতে দাঁড়িয়ে আছি পিসিমা মেপে দেখুন, ফিতে দেব?’

পিসিমা—‘দূর হ। বাসি জামাকাপড় ছেড়েচিস?’

পালক—‘বাসি? বাসি কাকে বলে পিসিমা?’

—‘যা যা বেশি বকাস নি, রাত পোয়ালেই জামাকাপড় বাসি হয়। ছেলেমানুষেও জানে।’

—‘তাই বলুন,’ পালক উঠোনের ওপর তারে মেলা শুকনো কাপড়গুলো পটাপট তুলতে থাকে।

—‘কী করচিস, কী করচিস!’

—‘রাত পুইয়েছে পিসিমা, বাসি হয়ে গেছে কাপড়গুলো, ভিজিয়ে দিই। টম কেচে দেবে এখন।’

—‘দূর হ, দূর হ নংকাপোড়া, কাপড়চোপড় সব অ্যাড়া বাসি করে দিলে গা!’

অর্থাৎ পালকে পিসিমায় অহিনকুল সম্পর্ক।

এইসব প্রাত্যহিক দ্বৈরথের থেকে পিসিমার তিক্ততার মূল কারণ বার করার চেষ্টা করতে করতেই আমার মনস্তত্ত্বে হাতে-খড়ি হয়ে যায়।

পিসিমা ডবল গামছা পরে কলঘর থেকে বার হয়ে ঠাকুরঘরে যেতেন, সেখানেই একটি দেয়াল-আলনায় তাঁর শুদ্ধ কাপড় থাকত। সেটি পরিধান করে দরজা খোলা রেখেই তিনি পুজোয় বসতেন। পিসিমার পুজো বা জপ এই ধরনের হত :

—‘পম উঠলি? টমকে ডেকে দিয়েচিস তো? ইন্দু এখনও ওঠেনি নিশ্চয়। গায়ে জল ঢেলে দে। পাশবালিশেও জল ঢেলে দিস। বাপের সঙ্গে বাজারে যাবে কে?’

আধ মিনিট।

—‘চললে কোথায়, অ সেজ মা, খবদ্দার গায়ে চৌবাচ্চার বাসি জল ঢালবে না। একটু রও, আমি গরম জল করে দিচ্চি।’

কোয়ার্টার মিনিট।

—‘আসার সময় তা হলে হল মা অন্নর? অন্নদা! অন্নপূর্ণা! তুমিই আজ ভাত দিও মা, আমি তোমার কাচে হেরে গেলুম। কুটনো বাটনা ছত্তিশ কাজ বাকি, এখনও রান্নাঘর মোক্ত হল না। বাসনে যেন এক ফোঁটা জল না থাকে বলে দিচ্চি, নইলে তোরই এক দিন কি আমারই এক দিন। দু মিনিটের মধ্যে ঝাড়াঝ্‌ঝড় সব সেরে দিয়ে যে নাম কিনবে সেটি হবে না।’

এ সময়ে অন্ন বাণী দেবে—‘আচ্ছা পিসিমা, আপনি না পুজো কচ্চো? মুখের কামাই নেই গা! আশ্চয্যি!’

গল্পকথা হলে এইখানটায় উভয়ের মধ্যে একটা তুমুল ঝগড়া হয়ে যেত। তা কিন্তু মোটেই হবে না। পিসিমা হঠাৎ তুষ্ণীভাব অবলম্বন করবেন এবং অন্ন বাসনপত্রে জল ঢেলে রান্নাঘরে উনুন নিকোতে ঢুকবে।

বাবাকে মাঝে-মধ্যেই বলতে শুনেছি—‘দিদিমণি তোমার ওই জপতপের নাটকটা করবার দরকার কি বলো তো? ছেড়ে দাও না, ছেড়ে দাও…’

পিসিমা তার উত্তরে বলতেন—‘গুরুর দেওয়া নাম ছেড়ে দিতে বলছিস? ব্রহ্মহত্যার পাপ হয় অমন কথা বললে, তা জানিস? কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ আধখানা বুজে তিনি ভোলাগিরি গুরু মহারাজের উদ্দেশে নমস্কার করতেন।’

মেজাজ খারাপ থাকলে অবশ্য পিসিমার উত্তরটা আর একটু কড়া হত :

—‘দু হাতে করে গু-মুত ঘেঁটে মানুষ করলুম, এখন উনি জপতপ শেখাতে আসচেন।’

পিসিমা সাবান মাখতেন না, তেল মাখতেন না, ঘুঁটের ছাই দিয়ে দাঁত মাজতেন, দিনে আতপ চালের ভাত আর রাত্তিরে রুটি খেতেন। খাওয়ার পরিমাণ এত কম ছিল যে অত খাটতেন কী করে ওই খেয়ে সেটাই একটা আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল। পিসিমা পান খেতেন না, মুসুর ডাল, গাজর, লাল নটে, কলমি শাক আরও কী কী যেন আমিষ বলে মানতেন। পিসিমার ভাত খাওয়ার কালো (শ্বেত নয়) পাথরের কানা-উঁচু থালা ছিল। কালো পাথরের গেলাস ছিল, বাটি কখনও নিতেন না, বাটি নেওয়াও বোধহয় বিধবাদের নিষিদ্ধ ছিল। আমাদের ভাঁড়ারঘরে ঝুলকালিগ্রস্ত একটি বাংলা ক্যালেন্ডার সব সময়ে শোভা পেত, তাতে উদ্যত খাঁড়া-হাতে করালবদনী লোলজিহ্বা মা কালীর একটি ছবি থাকত। কোনও দোকানী, সম্ভবত মুদির দোকানের দোকানী বছরের পর বছর আমাদের এই কালিকামূর্তি-সংবলিত, লাল-কালি-দাগানো অমাবস্যা-পূর্ণিমা-একাদশী চিহ্নিত ক্যালেন্ডারটি সাপ্লাই দিতেন। এই ক্যালেন্ডারটি আমার বিশেষ মনোযোগের কারণ ছিল। কারণ নম্বর এক— কাটা হাতের স্কার্টের নীচে মা কালীর নিম্নাঙ্গের কিছু দর্শন করা যায় কি না, কারণ নম্বর দুই— মুণ্ডমালার মুণ্ডুগুলো গণনা করা এবং হাতের সংখ্যার সঙ্গে তার সামঞ্জস্য আছে কি না অর্থাৎ যত মুণ্ডু তার দ্বিগুণ হাত আছে কি না গণনা করা। এই মুণ্ডুগুলোর মধ্যে আমার পরিচিত কারুর আদল পাই কি না ক্ষীণালোক ভাঁড়ার ঘরে এটাও আমার আবিষ্কর্তব্য ছিল, তৃতীয়ত— মা কালী জাগ্রত কি না খেয়াল রাখা। জাগ্রত তো নিশ্চয়ই কিন্তু পলক ফেলার মুহূর্তে, পা মুড়ে বসার সময়ে যদি তাঁকে কখনও ধরে ফেলা যায়। (আমি নিজে ওইভাবে দাঁড়িয়ে দেখেছি, বেশিক্ষণ পারা যায় না, বস্তুত পাড়ার নাটকে একবার আমার রং ও চুলের জন্যে কালী সাজতে হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরেই আমি নড়ে যাই, তাতে দর্শক মহলে হাসির হররা ওঠে।) আর একটা জিনিস আমার খুব আনজাস্ট মনে হত। কালীমা নগ্ন, অথচ শিবের কেন নিম্নাঙ্গ ঢাকা থাকবে? আমরা চারধারে যা দেখি, এ তো ঠিক তার উল্টো? নয় কী? মেয়েরা সবসময়েই সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখেন, কিন্তু পুরুষরা তো রাস্তাঘাটেও অত্যন্ত স্বল্পবাসে বেরিয়ে যেতে দ্বিধা করেন না! আমাদের পাশের বাড়ির জ্যাঠামশাই ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরে খালি গায়ে বাজার যেতেন, কেশব জ্যাঠা ও ওতুল কাকা যখন তদীয় রকে বসে বাবার সঙ্গে গল্প করতেন, তিনজনেরই গা খালি থাকত, অথচ গোপনযোগ্য প্রত্যঙ্গ তাঁদের তিনজনেরই ছিল। ওতুল কাকা ও বাবা অস্ফুটস্তনী হলেও কেশব জ্যাঠা তো বেশ গুরুস্তনীই ছিলেন। তবে? ঠাকুর্দা যখন আরাম-চেয়ারের হাতলে দুই পা মাঝে মাঝে তুলে দিতেন তখন তাঁর তৃতীয় পদ বা থার্ড লেগও আমি চকিতে দর্শন করেছি। তা হলে ছবিতে এই বিপরীত আচরণ কেন? আমার ইচ্ছে হত শিবের কোমর সংলগ্ন শ্বেতবস্ত্র টেনে খুলে দিই। কিন্তু হায় ছবির শিবের কাপড় খোলা যায় না!

পিসিমার থেকে খালি খালি দূরে সরে যাচ্ছি। এই ক্যালেন্ডারটি ছিল পিসিমার প্রাণ মান ধ্যান সব। কুমড়ো খেতে হলে তিথিটা প্রতিপদ কি না, পটল এলে তৃতীয়া কি না, মুলো এলে চতুর্থী বলে বাবার সঙ্গে রাগারাগি নিত্যকার ঘটনা। ঠাকুর্দাদা রোজ বেল খেতেন, কিন্তু পঞ্চমী তিথিতে পিসিমা তাঁকে কিছুতেই বেল খেতে দেবেন না, ‘পঞ্চমীতে বিল্বে কলঙ্ক’ জানেন না না কি?’ —পিসিমা উত্তেজিত।

ঠার্কুদা বলতেন— ‘আরে বাবা। তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে, এখন আর কী কলঙ্ক হবে? সে সব আগে যা-যা হবার হয়ে গেছে রে!’

পিসিমা—‘কলঙ্ক কি শুধু এক রকমেরই হয়?’

ঠাকুর্দা তাতেও অকুতোভয়, বলতেন, ‘হলে, কাঁচকলা। তুই আমায় বেলটা দে। নইলে আমার পেট খোলোসা হয় না।’

এ ছাড়াও ষষ্ঠীতে পিসিমা নিম-বেগুন করবেন না, চিংড়ি মাছের মালাইকারি করার আয়োজন হলে তিনি দেখে নেবেন তিথিটা অষ্টমী কি না, অষ্টমী হলেই মালাইকারি ভণ্ডুল, কেননা অষ্টমীতে নারকোলে মূর্খতা প্রাপ্তি। এরকম একটা উপলক্ষে আমি দাদাদের পিসিমার সঙ্গে তর্ক করতে দেখেছি।

ইন্দু—‘বাবা আর আমি দেখে-শুনে কত করে নারকোলটা আনলুম, আর আপনি বলছেন মালাইকারি হবে না?’

পিসিমা—‘তালে শরীরনাশ স্‌স্যান্নারিকেলে চ মূর্খতা জানিস না?’

ইন্দু—‘হলে আমরা মূর্খ হব, আপনার তো আর সে ভয় নেই।’

পালক—(ফিক করে হেসে) ‘পিসিমা তো মুখখু-ই আছেন, আর কত মুখখু হবেন?’

পিসিমা—‘দূর হ নংকাপোড়া, তুই কেন আমাদের মাঝখানে প্যাঁকপ্যাঁক করছিস? মালাইকারি আজ হবে না যা!’

ইন্দু—‘আমিও আপনার লাউ কাটব না যান।’

লাউ বা কুমড়ো গোটা এলে সেটাকে কাটতে কোনও পুরুষের দরকার হত। কেন না কুষ্মাণ্ডঘাতিনী নারী ও দীপনির্বাপক পুরুষ থেকে বংশ নাশ হয়।

সাবান না মাখা তেল না মাখা সত্ত্বেও কিন্তু পিসিমার মুখটুকু তেল চুকচুকে প্রতিমার মুখের মতন চকচক করত। হাতও আদপেই শক্ত ছিল না। হাত পা ধুয়ে তিনি কক্ষনো মুছতেন না। সেই ভিজে থেকেই সম্ভবত তাঁর হাতে পায়ে হাজা হত। এবং ওই একই কারণে বোধহয় তাঁর কখনও সর্দি হত না। পিসিমা পৃথিবীর একমাত্র মানুষ যাঁর কখনও সর্দি হয়নি। সব সময়ে হাত-পা ভিজে থাকার ফলেই সম্ভবত তিনি সর্দি থেকে ইমিউনিটি অর্জন করেছিলেন। তবে পিসিমার গা আস্তে আস্তে কালো খসখসে হয়ে যেতে থাকে। তেল না মাখার ফলেই সম্ভবত পিসিমার চুলেরও খুব ক্ষতি হয়েছিল। চিরুনি দিয়ে ভাল করে চুল আঁচড়ানোতেও বোধহয় তাঁর বৈধব্যের কঠোরতা নষ্ট হত। কোনরকমে দুবার চিরুনি চালিয়েই তিনি চুলটাকে একটা আঁটসাঁট গিঁটখোঁপা করে নিতেন। ভিজে অবস্থাতেই। ফলে চুলে বোদা একটা গন্ধ হত। মাথা ধরত সন্ধে হলেই। শীতের দিনে তিনি রোদে পিঠ দিয়ে বসে চুল মেলে দিতেন। এই সময়ে তাঁর একমাত্র বিলাসিতা ছিল আমাদের দিয়ে পাকা চুল তোলানো। পাকা চুল থাকা না থাকাতে তাঁর কিছু এসে যেত বলে মনে হয় না। আসলে মাথায় কচি আঙুলের নড়াচড়ায় তিনি আরাম পেতেন। এই চুল তোলার সময়েই আমি আর পুনপুন তাঁর মাথায় একটি কালো আব আবিষ্কার করি। আমাদের ধারণা ছিল, ওইটে টিপে দিলেই একটা মির‍্যাকল্‌ হবে, ওটাই সেই মির‍্যাকলের বোতাম। মির‍্যাকলটা কী ধরনের হতে পারে এ নিয়ে পুনপুনের সঙ্গে আমার খুবই মতভেদ হত। পুনপুন যদি বলত যে ওই বোতাম টিপে দিলেই পিসিমা টিয়ে পাখি হয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ করে উড়ে যাবেন, তো আমি বলতুম— না ওটা টিপলে পিসিমার আসল রূপ বেরিয়ে পড়বে। পুনপুন এটা মেনে নিত, ওর মতে পিসিমা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র সেই রাক্কুসীটা হয়ে যাবেন, যে বন্দিনী রাজকুমারীকে দিয়ে পা টেপাত, আমার মতে পিসিমা নিশ্চয়ই অপ্সরী হয়ে যাবেন, আকাশে মিলিয়ে যাবেন। তিনটে সম্ভাবনাকেই আমরা যথেষ্ট ভয় পেতুম বলে বোতামটা কখনও টেপা হয়নি। ওটাকে আমরা সাবধানে এড়িয়ে যেতুম।

তবে আমাদের ছোটবেলাতেই পিসিমা একবার আমাদেরই সঙ্গে ন্যাড়া হয়ে গেলেন। তিনি যে ন্যাড়া হবেন তা বাড়ির কেউ বুঝতে পারেনি। খুব হাত পা ছোঁড়া কান্নাকাটির মধ্যে দিয়ে আমাদের ন্যাড়াকরণ সমাপ্ত হলে পিসিমা হঠাৎ বললেন— ও বেজা, একটু সবুর কর তো!

চোখ মুছতে মুছতে ভেতর-বাড়িতে যাচ্ছি, পিসিমা বেজার কাছে এসে বসে পড়লেন— ‘দে আমার মাথাটাতেও খুর বুলিয়ে দে।’

আমার অবাক চোখের সামনে মাথার বোতাম না টেপা সত্ত্বেও পিসিমা একটি ছোট্ট রুপী বাঁদরীতে পরিণত হয়ে গেলেন। ফর্সা রং, ছোট্ট মুখ, বাঁ দিকের দাঁত একটু উঁচু—এক্কেবারে রুপিনী।

সব্বাই পিসিমাকে ঘিরে ধরে হাসছি। আমার চুলের শোক আমি ভুলে গেছি। পালক হঠাৎ পিসিমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে নাচতে লাগল— ‘নেড়ি, তেলকামড়ি, তেলে ভাজা বড়া। নেড়ি তেলকামড়ি তেলেভাজা ব-ড়া।’

—‘দূর হ নংকা পোড়া’, পিসিমা পালকের কোলে ছটফট করছেন। মা এসে বললেন— ‘ও কি দিদিমণি, এ কী করেছেন?’ পিসিমা বললেন —‘ধুর, রোজ মোছরে, আঁচড়াও রে, বাঁধো রে, পাপ ঘুচিয়ে দিলুম একেবারে!’

এর পরে পিসিমার যে চুল গজায় তা সব খাড়া খাড়া। দু ইঞ্চি সমান খাড়া খাড়া হয়ে মাথার ওপরে চুলগুলো দাঁড়িয়ে থাকত। কিছুদিন আগে বহুকাল আমেরিকা প্রবাসিনী আমার এক বন্ধু এসেছিল। তার দেখি ওইরকম চুল। চুলগুলোকে সজারুর কাঁটার মতো দাঁড় করিয়ে রাখার জন্যে নিশ্চয় কিছু ব্যবহারও করে। বুঝলুম ফ্যাশন বিষয়ে সময়ের অনেক আগে জন্মেছিলেন পিসিমা।

যাই হোক, তখনও জনসাধারণের চোখ তৈরি হয়নি। কাজেই পিসিমার এই নতুন ফ্যাশনের সমঝদার তো কাউকে পাওয়া যায়ই নি, আমার বাবা পর্যন্ত তাঁকে খ্যাপাতে আরম্ভ করেন। পিসিমার ন্যাড়া মাথায় চুল একটু একটু গজাতে শুরু করলেই বাবা নাচতে শুরু করে দিতেন— ‘উচ্ছে গাছে নতুন পাতা বেরুচ্ছেন বেরুচ্ছেন।’ হাতে তালি দিয়ে তালে তালে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচ। পিসিমা বা পিসিমার মাথা যে কেন উচ্ছে গাছের সঙ্গে তুলিত হয়েছিল তা আজও বুঝতে পারিনি। কিন্তু বাবার নাচের সেই ছন্দ ছোটবেলার ছন্দের সঙ্গে এক হয়ে রয়ে গেছে।

‘উচ্ছে গাছে নতুন পাতা বেরুচ্ছেন বেরুচ্ছেন।’ বাবাই যদি এই করেন তাহলে পালক কী করবে বা করতে পারে বোঝাই যায়। পালক নানারকম ধাঁধা তৈরি করত। তার একটা হল—

আগে ‘চু-চু’ পরে ‘অ্যাল্!’

চেয়ে থাকে ফ্যাল-ফ্যাল,

কাশ নয় বাঁশ নয় তবু খাড়া দাঁড়িয়ে

সব বাঁশ ছাড়িয়ে।

ফ্যালো কড়ি মাখো তেল

পেয়ে যাবে কৎ-বেল।

এটা সে বেশ অঙ্গভঙ্গি সহকারে পেশ করত। ‘চু-চু’টা কুকুর ডাকার মতো। ‘অ্যাল’টা জিভ কেটে, ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে থাকার ভঙ্গি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য বোকামির সঙ্গে, ‘খাড়া দাঁড়িয়ে’র খাড়াত্ব, বাঁশের লম্বাত্ব, কৎ-বেলের গোলত্ব সব কিছুতে বেশ ভাল করে ঝোঁক দিয়ে, যাতে চুল এবং মাথার ব্যাপারটা কিছুতেই আন্দাজ করা না যায়।

এটাতে কেন জানি না পিসিমা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন না। শুধু নিজের কাজে যেতে যেতে বলে যেতেন— ‘নংকাপোড়া!’

‘নংকাপোড়া’ শব্দটা বিশেষণ না অনুজ্ঞা এটা আমি বহু দিন বুঝতে পারিনি। শব্দটা উচ্চারিত হলেই আমি কান পেতে থাকতুম। ইনটোনেশন বলত ওটা বিশেষণ, অর্থাৎ পালক একটি নংকাপোড়া, কিন্তু শব্দটার গঠন আমায় বলত ওটা অনুজ্ঞাই হবে (বিশেষণ, অনুজ্ঞা এ সব বিয়াকরণগত শব্দ স্বভাবতই তখন জানতুম না)। পিসিমা লংকা পোড়াতেই বলছেন, এবং সেটি বেশ গর্হিত কর্ম এই আমার ধারণা।

লংকা পোড়ানো কতদূর গর্হিত কর্ম হতে পারে সেটা হাতে-কলমে পরীক্ষা করার জন্য আমি তৎপর হলুম। তারপর এক দিন সুবিধে বুঝে পিসিমার সেই অভিনব জপ তপের সময়ে অন্নর নবপ্রজ্বলিত উনুনের লকলকে শিখার মধ্যে আমি আগে থেকে সরিয়ে রাখা কয়েকটি শুকনো লংকা আহুতি দিই। পিসিমা হাঁচতে হাঁচতে তাঁর কম্বলের আসন কোশাকুশি ইত্যাদি ভেক গুটিয়ে ফেললেন, এত হাঁচির মধ্যে কি আর ঈশ্বরের নাম করা যায়? ঈশ্বরকে হাঁচি দিয়ে দূষিত করাই কি ঠিক? অন্ন হাঁচতে হাঁচতে বাসন-মাজার পার্ট-টাইম কাজে প্রায় ইস্তফা দিয়ে ফেলল, ‘তোমাদের বাড়িতে বড্ড হাঁচি হয়, সে ঘোষণা করল—‘এত হাঁচতে হাঁচতে কাজ করা যায়? আপনিই বলো পিসিমা।’ একদিনের হাঁচিকে সে রোজের হাঁচিতে পরিণত করল অনায়াসে। পালক, যে আসল নংকাপোড়া, সে যখন হাঁচতে হাঁচতে পশ্চাদপসরণ করছে— ‘নস্যটারে ভস্ম করি করেছ এ কি পিসিমাতা/কৌটো হতে দিয়েছ তারে ছড়ায়ে,’ বলতে বলতে এবং পিসিমা এত রেগে গেছেন যে প্রায় তাকে মারতে ছুটেছেন, তখন আমি নিশ্চিত হয়ে যাই লংকা পোড়ানো অতিশায় গর্হিত কাজ, এবং শব্দটি দিয়ে পিসিমা কাউকে লংকা পোড়াতে বলেননি, লংকা যে পোড়ায় তাকেই শনাক্ত করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আমিই নংকাপোড়া। এই ভাবেই ‘নংকা পোড়া’র অর্থ বিশ্লেষণ ও এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে দিয়ে শিখি। এ নংকা যে সে নংকা নয়, রাবণের লংকা এবং সেই লংকা পোড়ানো হনুমানই যে পিসিমার লক্ষ্য এ কথা আমার ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি। আর একটি অন্তর্নিহিত গুপ্তকথাও আমি বুঝতে পারিনি, পিসিমার সেদিনকার প্রচণ্ড রাগের কারণ যে তাঁর গোপনে নস্যভক্ষণ, এবং সেই নেশার বার্তাই পালক পাবলিক করে দিয়েছিল সেদিন এই কেচ্ছা কেচ্ছাভক্ত বুবুর বুঝতে সময় লাগে।

যাই হোক, লংকাগুলো পুড়ে কালো হয়ে গিয়ে এক সময়ে তাদের ঝাঁঝ ও হাঁচি উদ্রেক করার ক্ষমতা সম্পূর্ণ হারাল, প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর হাড়গোড়ের মতো তারা কয়লার ফাঁকে-ফোকরে আশ্রয় নিল এবং উনুন অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্যে জ্বলতে লাগল। পিসিমা মন্তব্য করলেন ‘আজ আঁচটা খুব ভালো উঠেছে রে অন্ন!’ বলে উনুনের ওপর দু তিন চিমটি নুন অর্পণ করলেন, অগ্নিকে কিছু খেতে না দিয়ে রান্না শুরু করতে হয় না বলেই না কি এই নিয়ম। প্রশংসায় বিগলিত এবং গৌরবান্বিত হয়ে শ্রীমতী অন্ন বললেন— ‘অন্নর কাজে গাফিলতি পাবে না পিসিমা, কাজ আপনি দেখে নাও আগেই বলেচি কি না, আর আট আনা মাইনে বাড়িয়ে দাও বাবুকে বলে।’

আমার কৃতিত্ব অন্ন আত্মসাৎ করল দেখে খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে আমি আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু অনেক কষ্টে সামলেও নিলুম। সাত সকালে কানে প্যাঁচ পড়াটা ঠিক নয়। তবে আমার দুষ্কর্মের ফলে বাবা-ঠাকুর্দাদার আট আনা মাসিক খরচ বেড়ে গেল। যে অত ভালো আঁচ দিতে পারে এবং অত হাঁচির পরেও কাজে বহাল থাকে? আট আনা স্যালারি-রেজ যেত তার প্রতি অবশ্যকর্তব্য সুবিচার— এটা অন্ন পিসিমার মারফত তাঁদের বুঝিয়েই ছাড়ে।

সপ্তম অধ্যায় : হরিবংশ-২—কালো কুমু

ঠাকুমা যে আমাদের আপন ঠাকুমা নন, এ কথা আমরা জানতুম না। পিসিমা জানাতে খুব উৎসুক ছিলেন। কবে এক চোদ্দো বছরের সদ্য-বিধবা বালিকা বাবার বিয়ে দেখার অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল, মা মারা গেছেন বছরও ঘোরেনি, নিজের স্বামী মারা গেছেন দেশান্তরে, ঘনিষ্ঠতা তো দূরের কথা, ভালো করে আলাপ-পরিচয় পর্যন্ত হল না, চোদ্দো বছরের মেয়ে ডুরে শাড়ি, চুড়ি বালা হার কানের রিং খুলে ফেলতে হল, কালো পাথরের থালায় আতপ চালের পিণ্ড নির্দিষ্ট হল। সেই মেয়ে বাবার নতুন বউকে দুধে-আলতায় পা দিয়ে হাতের মুঠোয় লেঠা মাছ সামলাতে দেখেছে অন্তরাল থেকে। এ ট্রমা বেচারি কাটিয়ে উঠতে পারেনি সারা জীবন। এবং পৃথিবীর সব অবিচারের মতোই কোপটাও পড়েছিল নির্দোষ বেচারি ঠাকুমারই ওপর। বুড়ো বয়সে এই রাগের আর ধার ছিল না তেমন। কিন্তু একটা ভোঁতা বিস্বাদ-বিরাগ থেকেই গিয়েছিল। এর সামনে ঠাকুমা ছিলেন একেবারেই অসহায়। এটা তাঁর প্রাপ্য শাস্তি এটা যেন তিনি মেনেই নিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মা কতকগুলো ব্যাপারে ছিলেন খুব কঠোর। তিনি পিসিমাকে বলে দিয়েছিলেন আমরা যেন কোনওদিন এই সম্পর্ক জানতে না পারি। আমরা কেউ জানতুম না ঠাকুমা আমাদের নিজের ঠাকুমা নন। বাবাও খুব সম্ভব ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই পারিবারিক সম্পর্কের হু’জ-হু বানাবার ব্যাপারে কতকগুলো লুপ-হোল বা ছিদ্র থেকে যায়। পিসিমা আর বাবা ঠাকুমাকে সেজমা বলতেন, মা কিন্তু মা-ই বলতেন শাশুড়িকে।

আমার জ্ঞানোন্মেষ খুব অল্প বয়সেই হয়। অন্যদের কথা বলতে পারি না, আমার মনে প্রশ্নগুলো কীভাবে জাগে এবং কীভাবে তাদের সমাধান হয়, বলি। প্রথমে আমার মনে কোনও প্রশ্নই জাগেনি। ছোটরা চারপাশে যা দেখে সেটাকেই রীতি বলে ধরে নেয়। ঠাকুমাদের বাবারা সেজমা বলেই ডাকেন, এই ধারণার চিড় খেলো যখন দেখলুম পাশের বাড়িতেই জ্যাঠামশাই তাঁর মাকে ‘মা’ বলছেন। অতএব মায়ের প্রতি প্রশ্নবাণ—‘ও বাড়ির জ্যাঠামশাই কেন মাকে “সেজমা” বলেন না মা?’

মা প্রথমটায় খারাপ ছাত্রীদের মতো প্রশ্নটা ধরতেই পারেননি। একটু পরে বুঝে বললেন— ‘অনেকে অনেক রকম বলে মা-বাবাকে—মা-মণি, বড়মা, শোননি? এ-ও সেই রকম।’ আমি এটাকে পরিষ্কার ধাপ্পা বলে বুঝতে পারি। কেননা সেজ একটা আদরবাচক বাচক শব্দ নয় ক্রমবাচক শব্দ। এভাবে তো বুঝিনি! মা-মণির মণি আর সেজমার সেজ মোটেই এক জাতীয় নয় এটুকুই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে বুঝেছিলুম। আর খুব সামান্য লোকে মাকে বড়মা, কাকিমাকে ছোটমা বলে বটে। কিন্তু বেশির ভাগই বড়মা জেঠিমাকে বলে থাকে। এই উদাহরণগুলো আমার মাথায় চক্কর খেয়ে উড়ে গেল। মা এড়িয়ে গেলেন ব্যাপারটা। বেশ নিরাপদ একটা সময় পার হয়ে গেলে মাকে জিজ্ঞেস করি

—‘ঠাকুমার নাম কী মা?’

—‘মনোমোহিনী দেবী!’ দেবী কথাটা লক্ষ করুন। এ সম্পর্কে পরে আমার কিছু বক্তব্য আছে।

—‘তা হলে বাবার চেম্বারের নাম কেন মাতঙ্গমোহিনী হোমিও হল?’ মা একেবারে থতমত খেয়ে গেলেন। মিথ্যে কথা মা বলতে পারতেন না। এড়িয়ে যাওয়া, ধাপ্পা দেওয়ার হাজারও কৌশল তাঁর জানা ছিল, কিন্তু সোজাসুজি মিথ্যে কথা বলা মায়ের পক্ষে শক্ত ছিল। তবে প্রত্যুৎপন্নমতিত্বও তো তাঁর কম নয়। একটু সামলে নিয়ে বললেন—‘বাবাকে জিজ্ঞেস করো।’

মার ধারণা ছিল বাবাকে জিজ্ঞেস করার সাহস আমার হবে না। ঠিকই ভেবেছিলেন। তাই আমি সোজাসুজি ঠাকুমাকেই জিজ্ঞেস করি।

ঠাকুমা বললেন—‘ওমা! মাতঙ্গমোহিনী আর মনোমোহিনীতে তফাত কী রে! মাতঙ্গমোহিনী কেটেছেঁটে মনোমোহিনী তো আমিই করে নিয়েছি। মাতঙ্গ যেন কেমন জবরজং নাম, নয়?’

আমি বলি—‘মনোমোহিনীও জবরজং নাম। বিচ্ছিরি!’

—‘ঠিক বলেছিস’, ঠাকুমা বলেন, ‘তবে আগে তো সেটা ভালো বুঝতে পারিনি, এখন তুইই বল কী নাম হলে তোর ভালো লাগবে?’

তখন আমি বলি—‘কাননবালা।’

ব্যাস ঠাকুমার মুখ হাঁড়ি। বেগতিক দেখে আমি সেবারের মতো প্রশ্নোত্তরের আসর থেকে সরে পড়ি। কাননবালা নামটা চারধারে শুনতুম, পোস্টার-টোস্টারও দেখে থাকব, ভারি সুন্দর। তাই নামটাও পছন্দসই। এই নাম সাজেস্ট করতে ঠাকুমা যে কেন গম্ভীর হয়ে গেলেন বুঝতে পারিনি।

ঠাকুমা একই সঙ্গে খুব দুর্বল এবং খুব সবল ছিলেন। দুটোরই উৎস বোধহয় তাঁর সততা ও বিবেক। লম্বা, ময়লা রং, একটু ঝুঁকে-পড়া ঠাকুমা দেখতে সুন্দর ছিলেন না। কিন্তু হাসলেই মুখটা অদ্ভুত সুন্দর হয়ে যেত। মাঝখানে সিঁথি কাটা পাকা-মাথায় অল্প-সিঁদুর ঠাকুমা কারুকে কষ্ট দিতে পারতেন না। পিসিমার জন্যে মাছ, রঙিন শাড়ি ত্যাগ ইত্যাদির কথা আগেই বলেছি। কতটা মনের জোর থাকলে একটি উনিশ-কুড়ি-বছরের সদ্য-বিবাহিতা মেয়ে বিমুখ সতীনকন্যার জন্যে এতটা ত্যাগ করতে পারে ভাবলে অবাক লাগে। আপনারা বলবেন প্রথমটায় সতীন-কন্যাকে তুষ্ট করবার জন্যে এটা করেছিলেন, পরে যখন তাতে ফল হল না আর অভ্যাসটা ত্যাগ করতে লজ্জা পেয়েছেন। আমার কিন্তু মনে হয় আন্তরিক সমব্যথার জন্যেই তিনি এমনটা করেছিলেন, পিসিমার কষ্টটা তিনি পুরোপুরি বুঝেছিলেন, একজন বঞ্চিত বালিকার সামনে জীবন উপভোগ করতে তিনি প্রকৃতই লজ্জা ও কষ্ট পেয়েছিলেন। সে হিসেবে ঠাকুমাই আমাদের বংশের প্রথম বিদ্রোহিণী। তার জন্য কোনও স্বীকৃতি অবশ্য তিনি পাননি, বরং সারা পরিবারের বিমুখতাই পেয়েছেন। তবে নিজের স্বভাবগুণে সবাইকেই তিনি জয় করেছিলেন, পিসিমাকে ছাড়া। এখন ভাবলে আমার মনে হয় তাঁর যে নিজস্ব সন্তান হয়নি, সেটাও ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত। ঠাকুর্দাদা তো ডাক্তারই ছিলেন। দুটি স্ত্রীর মৃত্যুতে এবং কন্যার দুরবস্থায়, সাংসারিক জটিলতায় হয়তো তাঁর চৈতন্য হয়েছিল। ঠাকুমার বিদ্রোহের আরও নিশানী আছে। ওই দেবী। তাঁর মা মারা যেতে পুরুতমশায় তাঁকে চতুর্থী করাচ্ছেন। —‘আপনার নাম কী মা?’ —‘মনোমোহিনী দেবী’ উত্তর হল। দেবীটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পুরুতমশায় মনোমোহিনী দাস্যাঃ বলে মন্ত্র পড়তে লাগলেন, কায়স্থ তো! অব্রাহ্মণ মাত্রেই শুদ্দুর, দেবী একমাত্র ব্রাহ্মণ কন্যাদেরই বলা যাবে। ঠাকুমাও পুরুতমশায়কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দাসীর জায়গায় দেবী দিয়ে যেতে থাকলেন। মনোমোহিনী দেব্যাঃ তস্যা মাতা পঙ্কজিনী দেব্যাঃ…। কিছুক্ষণ পর পুরোহিতমশায় বিনীত গলায় বললেন ‘দেবী বলবেন না মা, এসব পারলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ড, অপরাধ হয়ে যাবে।’

ঠাকুমা নিচু গলায় বললেন— ‘অপরাধ হলে আপনার হবে ঠাকুরমশাই, আমি আপনার মায়ের তুল্য, আমাকে আমার মরা মাকে আপনি তখন থেকে দাসী বলছেন।’

ঠাকুমার পুরোটা আমি স্বভাবতই ছোটবেলায় বুঝতে পারিনি। এইখানে একটু ডাইগ্রেস করি, কিছু মনে করবেন না পাঠক। নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন একই জিনিস বোঝাতে যে-সব প্রতিশব্দ আছে, এক এক পরিবার তার এক একটা ব্যবহার করেন। আমরা, পশ্চিমবঙ্গীয় শহুরে মানুষ বলি ‘ছোটবেলা’। রবীন্দ্রনাথ বললেন ‘ছেলেবেলা’, পরে আমার বন্ধুদের মা-ঠাকুমাদের মুখে শুনেছি ‘ছোটকাল’। প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ পড়ি, বেশ ছোটবেলাতেই, তখন কী রকম একটা অস্বস্তি হতে শুরু করে। ‘ছেলেবেলা’ ‘ছেলেবেলা’ ‘ছেলেবেলা’, ভেতরে কথাটা যেন কামড়াতে থাকে। ক্ষীণভাবে মনে হয় আমি যদি কোনওদিন আমার ছোটবেলার কথা লিখি তাহলে কি ‘মেয়েবেলা’ লিখব? ‘মেয়েছেলে’ কথাটা যেমন অস্বস্তিকর ‘ছেলেবেলা’টাও তেমনই। রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’কে আমি ভালো মনে নিতে পারিনি। আপনারা নিশ্চয়ই আমার বোকামিতে হাসছেন। আরে বাবা, ‘ছেলে’ হল এমন একটা শব্দ যা কখনও কখনও শিশুকে বোঝায়, কেউ অন্তঃসত্ত্বা হলে আগে কী বলা হত? এখন শি’জ ক্যারিয়িং, শি হ্যাজ কনসিভ্‌ড্‌, শি’জ ইন দা ফ্যামিলি ওয়ে, ইত্যাদি সভ্যতর ভাষা ব্যবহার হয়, কিন্তু আগে কী বলা হত?—‘ছেলে হবে।’ সোজাসুজি ‘ছেলে হবে’। এর থেকেই মানে বেরিয়ে আসে। ‘ছেলে’ বলতে অবশ্যই যে কোনও বাচ্চাকে বোঝায়। তার লিঙ্গটা ইমপর্ট্যান্ট নয়, যেমন ‘আহা ছেলেমানুষ’-এর ছেলে, বা হিন্দিতে বাচ্চাকে ‘বেটা বেটা’ বলে আদর লিঙ্গনির্বিশেষে। আসল কথা, আমি শুধু আমার ছেলেমানুষি চিন্তাটাই রেকর্ড করলুম। তবে আর একটা মানেও কিন্তু হয়। একটা পুরো পরিবারের পুরো জাতির মনে প্রোথিত আশা যে শিশু যে আসছে সে ছেলে অর্থাৎ পুংলিঙ্গ হয়েই আসবে। মনস্তত্ত্ববিদরা বলুন আমার বিশ্লেষণ ঠিক কিনা। এই জায়গায় মিনু মাসানির ‘উইমেন স্প্র্যাং ফার্দার’, অর্থাৎ মেয়েরা ‘জৈব প্রগতির মাপকাঠিতে আরও উন্নত জীব’ পড়ে আমরা ক্লাসসুদ্ধু মেয়ে কী রকম হৃষ্ট হতুম সে কথা আজও মনে আছে। আমরা ঠিক যতটা হৃষ্ট আমাদের মাস্টারমশাই করুণাবাবু হতেন ঠিক ততটাই ইনভার্স প্রপোর্শনে অর্থাৎ রুষ্ট হতেন। বলতেন, ‘আরে! হোয়াট ইজ দ্যায়ার টু লাফ অ্যাবাওট। স্প্রিং মানে জানস? স্প্রিং মিনস জাম্প। জাম্পিং জাম্পিং ক্লাইম্বিং ট্রিজ। যত্ত সব বান্দরী জুইট্যাছে।’

ঠাকুমার কথায় ফিরে আসি। খু-উ-ব নির্লিপ্ত ছিলেন মানুষটি। সারা বাড়িতে একটি ছায়া বা কোণঠাসা ভূতের মতো, যিনি প্রায় কখনই অবয়ব ধারণ করতেন না। ঘর-সংসার ছেড়ে দিয়েছিলেন কন্যার হাতে। কখনও কোনও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতেন না। মায়েরা যখন সুরুল ছেড়ে কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করলেন এবং ক্রমে ক্রমে ঠাকুর্দা ঠাকুমা পিসিমা সবাই আমাদের বাড়িতে চলে এলেন, মা, তখন গর্ভভারে প্রপীড়িতা, প্রথম সকালেই ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন— ‘আজ কী কী রান্না হবে মা?’

ঠাকুমা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন—‘মনোকে জিজ্ঞেস করো মা।’

মনোকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে মা দেখলেন দুটি পাতা উনুন আঁচে জ্বলজ্বল করছে, একটিতে ভাতের হাঁড়ি বগ্‌বগ্‌ করে ফুটছে, আর একটিতে মাছের ঝোল কলকল করে ফুটছে। জিরে লংকা হলুদের পিণ্ড বাটতে বাটতে অন্নতে মনোতে বিশ্রম্ভালাপ হচ্ছে।

পিঁড়িতে উপবিষ্ট মনো, উনুনদ্বয়ের দিকে পাশ ফিরে বসে বৃহৎ বঁটিতে চচ্চড়ির আনাজ কুটছেন। অপরদিকে অন্নদাদেবী আর একটি পিঁড়িতে উপবিষ্ট হয়ে দুই বাহু এবং হাতের তেলোর বুড়ো আঙুলের তলার মাংসল ও জোরদার অংশটির সহযোগে বল প্রয়োগ করে হলুদের ত্যাড়া ঘাড় সোজা করছেন। জিরের খুদে শয়তানি জব্দ করছেন, এবং খ্যাসখেসে শুষ্কং কাষ্ঠং লংকার থেকে তরল লাভা পেস্ট বার করছেন। দুজনেরই মুখ চলছে।

মনো—‘কী জেত?’

অন্ন —‘যদি বলি বাউন তো বিশ্বেস যাবে পিসিমা? পইতে তো নি।’

মনো—‘তুই বলই না। বিশ্বেস অবিশ্বেস পরের কথা।

অন্ন—‘মাহিষ্য পিসিমা, মিথ্যে বলবনি, মাথার ওপরে ভগমান আচেন কি নি?’

মনো—‘তাতে কী হয়েছে? মাহিষ্য সৎ-শূদ্র। কুটনো-বাটনার দোষ নেই। ভাতের হাঁড়ি না ছুঁলেই হল। আচার-বিচার ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা মানবে তোদের পিসিমা, তাই বলে অবিচার পাবিনি। তবে জল খেতে যখন দোব, আলগোছে দোব মা, মনে কিচু করো না, বেধবা মানুষ, বোঝই তো!’

অন্ন—‘অমনি আমি মনে করতে গেলুম আর কি! বেধবা মানুষ দেবীর তুল্যি। আলগোছই দিক, কি যা করেই দিক, যা দেবে পেসাদ।’

এই জায়গায় অন্ন লংকামাখা হাত কপালে ঠেকায়।

অন্ন—‘তোমাদের একটু চন্নামিত্তির পেলে বর্তে যাব।’

সেই হাজাওলা পায়ের চরণামৃত! বুঝুন!

মনো—‘তা যেন হল, কিন্তু কটা বাড়িতে কাজ ধরিচিস? যতি বল কেন, পাঁচটা মানুষের পাঁচ জেত মা, ছত্তিশ বিচার, এঁটো কাঁটা, মাংস ডিম, ক্যাঁকড়া…বাসি হেগো, একেক্কার দেখচি তো চাদ্দিকে!’

অন্ন—‘এক বাড়িতে আচো পিসিমা, ছত্তিশ বাড়ির খপরে আপনার কাজ কী! যে জেতেই কাজ করি না কেন (ঘসর ঘসর আওয়াজ), তোমার মশলা তো কাপড় ছেড়ে শুদ্ধু হয়েই করচি! অন্য বাড়ির জেতের কতা তুললে তাঁরা কি ভালো মনে নেবে?’ অন্নর দাবড়ানিটা অতর্কিতে এসেছে।

মনো (মিইয়ে গিয়ে) —‘না তাই বলছিলুম।’

আমার মা কতকগুলো ব্যাপারে খুব সাবধান ছিলেন। এই সংলাপের কনটেন্ট সম্পর্কে তিনি বিশেষ কিছু আপত্তির কারণ খুঁজে পাননি! কিন্তু ফর্ম? শিলের ওপর উপুড় হয়ে কথার স্রোত? এ তিনি কখনই বরদাস্ত করতে পারবেন না। কিন্তু যা করবেন প্রপার চ্যানেলে করবেন। অতএব তিনি সোজা চলে গেলেন শাশুড়ির কাছে।

—‘মা!’

—‘কী বউমা?’

—‘অন্ন বাটনা বাটতে বাটতে ভীষণ কথা বলছে। একটু বারণ করুন না মা!’

—‘মনো আছে?’

—‘হ্যাঁ-অ্যা! দিদিমণির সঙ্গেই তো কথা বলছে।’

—‘জানিনি বাপু! এদিকে এত বিচার, তত বিচার, আর ওদিকে… তা বউমা বলো না, তুমিই বলো না মা।’

—‘সেটা কি ঠিক হবে?’

—‘হওয়ালেই হবে! আমরা কি তাই বলে বাড়িসুদ্ধু অন্নর মুখামৃত খাব?’

—‘আপনি বললেই ঠিক হত না?’

—‘আমার মেয়েকে আমি যতটা চিনি বউমা, তুমি তো তত চেনো না? আমি বললে, এর পর ও অন্নকে লেকচার দিতে শিখিয়ে দেবে। এখন তবু কথাবাত্রার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া আমি কোনও দিন গিন্নি নই। যা বলার তুমি বলো মা, কিচ্ছু অন্যায্য হবে না।’

মা অগত্যা যেন হঠাৎই রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। ঢুকেই ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন।

—‘ও কি অন্ন? বাটনা বাটতে বাটতে তুমি কথা বলছো? ছি! ছি! দেখেছেন দিদিমণি!’

পিসিমা—‘কী অনাছিস্টি কাণ্ড। আশ্চয্যি! অত যদি কথার শক তো মুখে কাপড় বেঁদে নিবি এবার থেকে। ছি… ছি ছিছি…ছিঃ। আজ যা কল্লে কল্লে বলে দিলুম অন্ন।’

অন্ন (নুয়ে পড়ে)—‘বাটা মশলাগুলো কি ফেলে দোব বউদি?’

মা—‘নাঃ, তার দরকার নেই। তবে এরপর থেকে সাবধান হবে। রান্নাবান্নার কাজ করার সময়ে কথা বলতে নেই, এটুকু জানো না?’

পিসিমা—‘মশলা করতে করতে কথা কইলে ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়, বুজলে?’

ঠাকুর্দাদার দেখাশোনাও বেশির ভাগ পিসিমাই করতেন। তামাক সাজাটা ঠাকুমার হাতে ছিল, কিন্তু ঠাকুর্দাদার যে সে-সাজা পছন্দ হত না, এটাও বেশ প্রচারিত ছিল। পিসিমা রান্নাঘরে মুখ জুবড়ে আছেন অতএব এটুকু ঠাকুমাকে করতেই হত। ঠাকুমা ঘরদোর গুছিয়ে রাখতেন, বিছানাপত্র ফিটফাট, কিন্তু তার পর? পুজো-আচ্চাও করতেন একেবারে দেশাচার হিসেবে, যেমন মানুষ দাঁত মাজে, মুখ ধোয় তেমন। ঠাকুমা অনবরত বই পড়তেন। দুটো লাইব্রেরি থেকে বই আসত। দাদা-দিদিদের দিয়ে আনাতেন। বাড়িতেও প্রচুর বই ছিল ঠাকুমার কেনা। এবং এই সমস্তই উপন্যাস। সন্ধেবেলা রুগি দেখে ফেরবার পথে ঠাকুর্দাদা হয়তো রুগির বাড়ি থেকেই হাতিয়ে আনা কোনও বই নিয়ে ঘরে ঢুকলেন—‘এই নাও ছোটগিন্নি, তোমার নবেল।’

ঠাকুমা লজ্জাশীলা ষোড়শীর মতো লালচে হয়ে বইটি গ্রহণ করবেন, হয়তো পাতা উল্টে দেখে বলবেন—‘ও মা, এ যে “যোগাযোগ” গো! এ তো আমার পড়া! বাড়িতেই রয়েছে।’

—‘ও হো, মলাটটা তো পাল্টে গেছে কি না, বইটা বাঁধিয়েছে। তাই বুঝতে পারিনি।’ ঠাকুমা ছিলেন যাকে বলে ভোরেশাস রিডার। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র সব মুখস্থ ছিল। গড়গড় করে উদ্ধৃতি দিয়ে পরে কতবার আমাকে অবাক করে দিয়েছেন। চোখে চশমা লাগিয়ে রোদে পিঠ দিয়ে ঠাকুমা বসে আছেন শীতের দিনে, হাতে বই। ঠাকুমা আপনমনে হাসছেন, কখনও আঁচলের খুঁট দিয়ে একটু চোখ-নাক মুছে নিলেন অর্থাৎ একটু কেঁদে ফেলেছেন—এই দৃশ্য ঠাকুমার উল্লেখ হলেই আমার মনে পড়ে। মাথায় পাকা চুল অতিরিক্ত লম্বা বলে একটু ঝোঁকা, ময়লা রং, অন্যমনস্ক হাসি-ভরা-মুখ মনোমোহিনী দেবীকে কোন ক্যাটিগরিতে ফেলব আমার শিশু চোখ বুঝতে পারত না। প্রৌঢ়া! যুবতী! তরুণী! বাবার মা! পিসিমার মা! অথচ ওঁদের চেয়ে ছোট! ছোট না কি? কত রহস্যই না ছিল ছোটবেলার জীবনে। উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল বলে ঠাকুমা একটু বেশিদিন স্কুলে পড়তে পেরেছিলেন। ম্যাট্রিকুলেশন তিনি পাস করেন বেথুন স্কুল থেকে। বিবাহের সময়ে নাকি এ কথাটি চেপে যাওয়া হয়েছিল। একে মেয়ে ঢ্যাঙা, তায় কালো, তায় কুড়িতে বুড়ির দিকে পা-টি বাড়িয়েছে, এর ওপর ম্যাট্রিকুলেশনের কথা জানাজানি হয়ে গেলে তেজবরও যদি ফসকে যায়? মনোমোহিনী দেবী আমার পরিণত চেতনায় একজন কুমু। কালো রজনীগন্ধা। সুগন্ধি, শুভ্র, রুচিশীল তাঁর হৃদয়, বিদ্রোহী কিন্তু কোনও কিছু অস্বীকার করার বিদ্রোহ সে নয়। পরিচিত সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিতে দিতে তিনি নিজের তৈরি জগতে বেঁচে থাকতেন। যেমন, কন্যা ছিল তাঁর সম্ভ্রম, সমীহ ও অশেষ করুণার পাত্রী, এক ধরনের শাশুড়ি। স্বামীর সঙ্গে এমন একটা ব্যবধান তাঁর ছিল, যা ঠাকুর্দাদা কিছুতেই পার হতে পারতেন না। প্রথম জীবনে বোধহয় বুঝতেই পারেননি যে, এরকম ব্যাবধান হয়, থাকতে পারে মানুষের সঙ্গে মানুষের। যার হাতে তামাক খাচ্ছি, যার সঙ্গে এক বিছানায় শুচ্ছি, যে আমার জামাকাপড়, কাজের জিনিস, বিছানাপত্র পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখছে, নিত্য মৃদু হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করছে, আমার ছেলেমেয়ে মানুষ করছে, তার সঙ্গে আবার দূরত্ব কিসের? ক্রমে ক্রমে যত বয়স বাড়ে ততই বোধহয় তিনি এই ব্যাপারটা আবছাভাবে বুঝতে পারেন। ফলে কালো রজনীগন্ধা ফর্সা মধুসূদনের কাছ থেকে মৃত্যুর আগে রোম্যান্টিক প্রেম আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। বোধহয় সাহিত্যের যোগাযোগের থেকে একদিন প্রতিদিনের যোগাযোগে এইটুকুই যা তফাত।

আসল কথা, ঠাকুমা ছিলেন ভা-রি বুদ্ধিমতী। তিনি দেখলেন তথাকথিত রূপের অভাবে তাঁর সব সঞ্চয়ই অচল পয়সা হয়ে গেল। বয়স্ক স্বামী, দুই স্ত্রীতে অভিজ্ঞ, রীতিমতো কামুক। একটি ছোট বোনের মতো সাবালিকা কন্যা যে ইতিমধ্যেই জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে গেছে। একটি নাবালক পুত্র যার পুরোপুরি ভার তাঁকে দিয়েও দেওয়া হবে না। এবং চারদিকে খালি ইস্ আর ছি ছি। তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী, তবু তার সঙ্গে পূর্ববর্তিনীদের তুলনা প্রতি-তুলনা উঠতে বসতে। ‘আহা, মাতুর পা দু’টি কেমন ছোট্ট ছোট্ট ছিল যেন লক্ষ্মীর পা (বলা বাহুল্য মাতু তাঁর জীবৎকালে এবংবিধ শংসা শুনে যাননি), আর এর দেখো, খড়ম-পেয়ে একেবারে।’ কিংবা ‘অ মনো, তোর মায়ের ছিল জগদ্ধাত্রীর রূপ, তোর কি আর মনে আচে? তা মনে রাখবার উপায় এবার একেবারে ঘুচে গেল।’ বুদ্ধিমতী মনোমোহিনী যখন দেখলেন সংসার এই মতো, তখন তিনি জীবনের থেকে যতটুকু পেয়েছিলেন তাঁর সেই মূলধন, পড়বার এবং পড়ে উপভোগ করবার ক্ষমতা, তাকেই তিনি কাজে লাগালেন। তিনি ঘুরে বেড়াতেন এক দ্বিতীয় পৃথিবীতে, তৃতীয় সংসারে, চতুর্থ লোকে যেখানে তিনি সুচরিতা হয়ে গোরার প্রেমে পড়ছেন, অথবা রাজলক্ষ্মী হয়ে শ্রীকান্তর, সাবিত্রী হয়ে যেখানে তিনি মুখে কাপড় গুঁজিয়া মূৰ্ছিত হইয়া পড়িতেছেন, সূর্যমুখী হইয়া একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করিয়া যাইতেছেন, অথবা দেবী হইয়া একটু একটু কাঁদিতেছেন, চঞ্চলকুমারী হয়ে কোনও অতুলনীয় চরণের অতুলনীয় আঙুলের আঘাতে ঔরঙ্গজেবের ছবির নাক ভাঙছেন, আয়েষা হয়ে গর্বিত বচনে বলছেন ‘বন্দি আমার প্রাণেশ্বর’, ভ্রমর হয়ে যিনি ফিরিয়ে দিচ্ছেন গোবিন্দলালকে, বিজয়া হয়ে নরেনকে। যিনি আনন্দময়ী, ভুবনেশ্বরী, যোগমায়া আবার লাবণ্যও অর্থাৎ যাঁকে পাঠিকা হিসাবে পেয়ে উপন্যাস ধন্য হয়েছে, কেননা এই জন্যেই উপন্যাস লিখিত হয়েছিল, বিকল্প জীবনে দেওয়ার জন্য, এক জীবনে মানুষকে বহু বিকল্প জীবনের স্বাদ দেওয়ার জন্য এবং বহু-আরাধনা করি-প্রাপ্ত তিল তিল সঞ্চয় দিয়ে তিলোত্তম হবার জন্য।

মনোমোহিনীর চোখ দু’টি সব সময়ে অন্যমনস্ক, ভাবালু মুখের হাসিটি আনমনা। ইন্দ্রর বি এসসি-র রেজাল্ট বেরিয়েছে। ঠাকুমাকে প্রণাম করতে এসেছে।

—‘ও ঠাকুমা, পা দুটো কই আপনার?’—চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি যেন।

—‘ঠাকুমা! ও ঠাকুমা!’

—‘মা! ইন্দ্র আপনাকে প্রণাম করতে এসেছে।’

—‘কে? অ্যাঁ? অ—ইন্দ্র? কী ব্যাপার ভাই?’

ঠাকুমা চিনতেই পারছেন না বড় নাতিকে। ভালো করে দেখতেও পাচ্ছেন না। চোখ দুটো জলের কুয়াশায় আচ্ছন্ন। সর্বজয়া দুগ্‌গাকে বড্ড মেরেছে। মেরে বাড়ির বার করে দিয়েছে। মেয়েকে মার দেওয়ার দুঃখ, মায়ের হাতে চোরের মার খাবার দুঃখ আবার ছোট্ট ছেলের চোখে দিদির মায়ের হাতে মার খাওয়া দেখবার দুঃখ, সবরকমই বাষ্প হয়ে জমে আছে মনোমোহিনীর চোখে, বুকে। তিনি সহসা সেই কুয়াশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না।

আবার হয়তো আশেপাশেই কোথাও কান্নার রোল উঠেছে। কোনও প্রতিবেশীর বাড়ি কোনও মৃত্যু ঘটেছে, হয়ত ঠাকুমা বা ঠাকুর্দারই বয়সী কোনও মানুষের। ঠাকুমা আপনমনে হেসে খুন হয়ে যাচ্ছেন। ত্রৈলোক্যনাথ পড়ছেন। কীভাবে ভূতের তেল বার করা হল, তারপর তেলহীন ছিবড়ে ভূতের কী চেহারা হল তার বিশদ বিবরণ ঠাকুমা বারেবারে পড়ছেন। ডমরুধর কী করিয়া হঠাৎ কিছু টাকা পাইয়া গেল বা কীভাবে মৃত কুমিরের পেটে সাঁওতাল মাগী তখনও বসিয়া বেগুন বেচিতেছে পড়তে পড়তে ঠাকুমা হেসে জেরবার।

কন্যা মনে এসে দাঁড়িয়েছে—‘কী যে হাসো রাতদিন বুঝতে পারি না বাপু, লোকের বাড়ি সব্বোনাশ এ দিকে ইনি হাসছেন। বলি অ সেজমা।’

—‘অ্যাঁ? কী? কে? মনো? কী বলছিস?’

—‘বলব আবার কী! গঙ্গামাসিমা তো গঙ্গা পেল, শুনতে পাচ্চো না, অবিনাশবাবু তাঁর বোন সব হাহাকার কচ্চে যে!’

—‘কে? কী বলছিস রে? গঙ্গা পেল, মানে?’

ডমরুধরের ধনপ্রাপ্তির অকুস্থল থেকে অবিনাশবাবুর বাড়ি ফিরতে মনোমোহিনীর বেশ দেরি হয়।

মনোরমা ঝংকার দেন—‘যাও না, বইটা রেখে একটু যাও। এ সময়ে মানুষকে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, যতি বলো কেন, তো অমন দিন তোমার আমার ঘরেও একদিন না একদিন আসবে, তখন পাঁচজনকে দরকার হবে।’

—তাই তো, তাই তো! মনোমোহিনী ধড়মড়িয়ে উঠে পড়েন। গঙ্গাদেবী তো তাঁর সখীস্থানীয়াই ছিলেন, যদিও সখিত্ব তেমন গড়ে ওঠেনি। মনোমোহিনীর সঙ্গে কে-ই বা সখিত্ব করবে। তৃতীয় পক্ষের বউ, সতীন কন্যার হাতে সংসার, তবু যার মুখে-চোখে নালিশ নেই, গলার স্বর শোনা যায় না, নিজস্ব সন্তান নেই, সন্তান কামনাও নেই, কোনও খেদও যার নেই, সে মানুষের চারদিক ঘিরে একটা বলয় গজিয়েই যায়।

মা মনো এবং মেয়ে মনোর জীবন বইছিল এইরকম সমান্তরাল ধারায়।

অষ্টম অধ্যায় : হরিবংশ-৩ এবং হরধনুর্ভঙ্গ

রেমব্রান্টের ‘নাইট-ওয়চ’ ছবিটা দেখছি। আবছা আবছা সব মুখ, ভালো করে চেনা যায় না। আলোর ফোকাস যার মুখে পড়েছে, সে মুহূর্তে সে যা, তার মুখ যা, হতভম্ব, সতর্ক, মনোযোগী, অমনোযোগী সেটাই তার সম্পর্কে নিত্য বর্তমান হয়ে যাচ্ছে। নিত্য সত্য। পমপমদিদি আসছে, পায়ের তলায় পদ্ম ফুটে উঠছে। চারদিকে অগুরু ধূপের গন্ধ। পমপমদিদির চুলে কালী, চোখে দুর্গা, ঠোঁটে নিবেদিতা, অঙ্গে মা শ্রীশ্রীসারদাময়ী। পমপমদিদির ধবধবে শাড়ি, দুই, সওয়া দুই ইঞ্চি কমলালেবু বা সবুজ পাড়ের মিলের শাড়ি। পমপমদিদির লম্বা চুলে গিট। চাউনি থেকে ছুটে যাচ্ছে তীরের মতো হোমের আগুন, যেখানে পড়ছে যার ওপর পড়ছে সব পাপ-তাপ, নোংরা-ঝোংরা, ময়লা-টয়লা পুড়ে সেখানটায় শুধু সোনা পড়ে থাকছে। সোনা। পমপমদিদি মার চেয়েও বড়। মেয়ে কী করে মায়ের চেয়েও বড় হয় আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আমি বলতে পারব না। তবে কথাটা সত্যি। মা পমপমদিদিকে শ্রদ্ধা করেন, সমীহ করেন। বাবাও। আমি? আমি সমীহ করি কী? উঁহুহ্‌। কিন্তু সমীহ-সমীহ ভাব দেখাই। আমি জানি পমপমদিদি শাপগ্রস্ত দেবী, হয়তো সরস্বতী কিংবা দুর্গা। পৃথিবীর অসুরদের খুব খারাপ সময় আসছে। পমপমদিদি যেদিন রেগে যাবে, সত্যি সত্যি একটা কুটো তুলে নিয়ে শোঁ-ও-ও করে ছুড়ে দেবে তোমাদের দিকে অমনই তোমরা সব অসুর-বধ হয়ে যাবে। প্রথমেই বধ হবে না অবশ্য। লাগবে, চেঁচাবে। রক্ত পড়বে ঝুঁঝিয়ে! আচ্ছা অত কি নিষ্ঠুর পমপমদিদি? অসুর হলেও মানুষই তো? তার বুকে বর্শা বিঁধিয়ে দেবে? সিঙ্গি দিয়ে খাওয়াবে তাদের? কী আর করবে? অসুর যদি অসুরই হয়, যদি পাপ করে তখন তো দেবতারা সব ব্রহ্মাকে ধরবেনই, ব্রহ্মাকেও তপস্যায় বসতেই হবে, বসলেই দেবীকে তৈরি হয়ে যেতে হবে। একেবারে শাড়ি-টাড়ি গয়না-টয়না পরা ফুল ফ্লেজেড দেবী, তখন তাঁর হাতে প্রহরণ দিয়ে দেবতাদের সাজিয়ে দিতে হবে। দেবীই বা তখন কী করবেন, অসুর-বধ ছাড়া? এ সমস্তই সুতো দিয়ে পরপর বাঁধা, ঘটে যাবে। পমপমদিদির কিচ্ছু করবার নেই। পমপমদিদির এই সমস্ত মহিমা জেনেও আমি তাকে ভয় করি না। জ্বালাতন করি, সময়ে সময়ে আঁচড়ে কমড়েও দিই। কেন সে আমাকে মায়ের কাছে যেতে দেবে না, পুনপুনের কাছে যেতে দেবে না? পুনপুনের কেন অসুখ করবে? মা কেন পুনপুনের কাছ থেকে নড়বেন না, আমাকে কোলে নেবেন না। অসুখ না আরও কিছু। বাজে, বাজে কথা। এই ‘মিথ্যে কথা’ বলিসনি তো বুবু? ‘মিথ্যে কথা’ বলতে নেই, খারাপ কথা। না, ‘মিথ্যে’ বলিনি, ‘বাজে’ বলেছি। ‘বাজে’ আমি পালককে বলতে শুনেছি, বাজে মানে বাজে মানে মিথ্যে। যা বলছিলুম। এ সবই পমপমদিদির ষড়যন্ত্র, যাতে আমি মায়ের কাছে, পুনপুনের কাছে না যেতে পারি। আমি তো বলেছিলুম পিসিমার খেঁটের কাপড়টা পরে, কিংবা সিল্কের ফ্রকটা পরে ও ঘরে যাব, আবার সিল্কের ফ্রক খুলে রেখে বাইরে চলে আসব, একটিবার যাই! তা পমপমদিদি আমাকে গল্প বলার লোভ দেখাল। ডাল দিয়ে সরু সরু আলুভাজা দিয়ে ভাত খাব, মাছভাজা খাব, আর গল্প শুনব। একটা, দুটো, তিনটে গল্প। প্রথম গল্পটা ওই অসুরদের সম্পর্কে। শুম্ভ নিশুম্ভ অসুর কেমন বধ হয়ে গেল। মহিষাসুর কেমন বধ হয়ে গেল দেবীর হাতে সেই গল্প। বিষ্ণু দিলেন চক্র, চক্রের ছবি আমি দেখেছি একটা বইয়ের মধ্যে। রথের মধ্যে ভীষ্ম বলে একটা বুড়োমতন লোক হাতজোড় করে বসে আছে আর নীল রঙের কৃষ্ণ চোখ পাকিয়ে রে রে করে ছুটে যাচ্ছেন। কৃষ্ণের আঙুলের মাথায় চক্র, বাঁই-বাঁই করে একবার ঘুরিয়ে ছেড়ে দিলেই চক্র ঘুরতে ঘুরতে চলে যাবে, ভীষ্মর মাথা কেটে দিয়ে আবার কৃষ্ণের আঙুলে ফিরে আসবে। আমি আমার খেঁল্লার জাঁতা দিয়ে চক্র ঘোরাই তো! একদিন ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলুম, পুনপুনের মাথায় লেগে টেঁপারির মতো ফুলে গেল। হ্যাঁ তারপর? পবন দিলেন গদা। গদা আমার নেই। হামানদিস্তের ডাঁটিটা দিয়ে গদা করা যায় কিংবা শিলনোড়ার নোড়া দিয়ে। কিন্তু গদার দুটো অংশ, একটা হ্যান্ডেল আর একটা গোদা মতন ঝুঁটি। সেই ঝুঁটিটা না থাকলে গদার গদাত্ব থাকে না। গদা বেশ গাবদাগোবদা জিনিস হলেও তার বেশ একটা আকার আছে। তা ছাড়া ভাঁড়ারঘর থেকে নোড়া সরানো বা হামানদিস্তের ডাঁটিতে হাত দেওয়া পিসিমার চোখ এড়িয়ে ও ভীষণ শক্ত ব্যাপার। বরুণ দিলেন পাশ। পাশ কী? পাশবালিশ? আই এ পাশ? বি-এ পাশ? হ্যাঁ বরুণ দিলেন পাশ।

দিলেন নয়, দিলো। কেন বলো তো? বরণ দেবতাই হোক আর যাই হোক, ও তো আমার ভাই, বুনবুন। বুনবুন দেবীকে পাশ দিয়েছে। বুনবুনের এত ক্ষমতা? হবে না কেন? ছদ্মবেশী দেবতা তো!

—‘বরুণ পাশ দিয়েছিল? পমপম?’

—‘দিয়েছিল বলতে নেই, দিয়েছিলেন।’

—‘না। দিয়েছিল।’

—‘দিয়েছিল নয়, দিয়েছিলেন।’

—‘দিয়েছিল, দিয়েছিল, দিয়েছিল।’

পমপমের চোখের দৃষ্টি রাগত। কেন বুঝতে চাইছ না পমপম! বরুণ দেবতা হলেও আমার ভাই, আমার থেকে চার মিনিটের ছোট। কেন তাকে আমি ‘আপনি’ করে বলব? বলব না তো, যতই কেন দেবী হও! আমারও তো একটা ইজ্জত আছে।

পরের গরসটা মুখের মধ্যে ঠেলে ঢুকে এল। একটা অতিরিক্ত বড় গরস। তার ভেতরে ওই গদার মতোই পমপমের আঙুল। আমি কটাং করে কামড়ে দিয়েছি। উঃ! আমার মুখ থেকে ভাত ঝরে পড়ছে, চোখ থেকে জল, পমপমের আঙুল থেকে রক্ত। আমার দাঁতের দাগ বসে গেছে। গদা তো নয়! আঙুলটা কী ভীষণ নিরীহ, মাঝের আঙুলটার দৈর্ঘ্যের পাশে বেঁটে হয়ে যাওয়া একটা তর্জনী আঙুল, যে আঙুল দিয়ে ‘পা-আ-প্‌’ করে।

—‘ও মা! কী শয়তান মেয়ে গো! রক্ত বার করে দিয়েচে যে রে! দে দু’ ঘা দে।’ পিসিমা ওদিক থেকে চিকরে উঠেছেন, ‘দু ঘা দে না।’

আমি মাথাটা সরিয়ে বুকটা কুঁকড়ে, ধড়ের দু’ পাশে হাত দুটো সেঁটে পাশের দিকে হেলে যাই। দু’ ঘা নামবে এবার, আমার শরীর এখন ডিফেন্সের প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিচ্ছে কেন, নিয়ে ফেলেছে। এ সব কি কেউ ভেবেচিন্তে করে নাকি?

কিন্তু দু’ ঘা নামে না।

—‘পিসিমা, শয়তান-টয়তান বলবেন না।’

—‘হ্যাঁ, বলবে না। শয়তানকে শয়তান বলব না তো কী বলব, ধো, হাতটা ধো।’ আমি উঠে পালাতে চাই। আর খাব না। ভাতও না মারও না।

পমপমের বাঁ-হাত আমাকে চেপে ধরেছে। ডান হাত আহত, কিন্তু বাঁ হাত তৎপর।

—‘বোস।’

—‘ন্‌-না-আ-আ, খাবো না।’

—‘কিলু-বিলুর গল্পটা বলব।’

কী অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য সৌভাগ্য! পমপম আমাকে মাফ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়! কিলু-বিলুর গল্পটাও বলবে! কী অসাধারণ নিপুণতার সঙ্গে পমপম তর্জনীটা বাদ দিয়ে অন্য চার আঙুল দিয়ে গরস তুলছে।

‘এক যে ছিল ছেলে, তার নাম অনিল। অনিল খুব ভাল ছেলে।’ (সুবোধ বালক।) ‘মা, বাবা যা বলেন স-ব কথা শোনে’ (ওর পমপম আছে? পমপমের কথা শোনে?) ‘অনিল খাওয়ার সময়ে লক্ষ্মী হয়ে খেয়ে নেয়’, (আমার মতন না) ‘খেলার সময়ে খেলে, পড়ার সময়ে পড়ে’ (আমি পড়ার সময়ে খেলি, খেলার সময়ে পড়ি—আমার হাঁসিখুশি আছে, বর্ণপরিচয় একম (১ম ভাগ আছে) ‘পরিষ্কার জামাকাপড় পরে। মুখ সবসময়ে সময়ে ধোয়া, চুল আঁচড়ানো’। (কে ওর মুখ ধুইয়ে দেয়? চুল আঁচড়িয়ে দেয়? কোনও পমপমের কথা তো শুনিনি, অনিলের পমপম ব্যাকগ্রাউন্ডে কোথাও না কোথাও আছেই আছে। কোনও নিগূঢ় কারণে আমার পমপম অনিলের পমপমের কথা বলছে না, সে কারণটা কী হতে পারে? এই গল্পের মর‍্যালটা শব্দভেদী বাণের মতো ওই দিক থেকেই আসবে বোধহয়, আমি চিবিয়ে যাচ্ছি, শিঙ্গি মাছের ঝোল, সপসপিয়ে তোল)। ‘অনিল রোজ যখন স্কুলে যায়, বই খাতা পেনসিল স্লেট নিয়ে’ (টিফিন নেয় না? টিফিনের কথা বলছে না কেন পমপম? কী জন্যে তা হলে স্কুলে যায় অনিলটা?) ‘তখন রাস্তায় খেলা করে কিলু আর বিলু’ (পচা আর কুচানের মতো? ওরা রাস্তায় খেলা করে, ওদের জামায়, প্যান্টে ময়লা থাকে, কুচানের ফ্রকে বোতাম থাকে না, কাঁধ থেকে ঝুলে পড়ে, আমার খুব ভাল লাগে, আমিও ওদের সঙ্গে এক্কা-দোক্কা খেলব, ওই রকম কাঁধ থেকে ঝুলে পড়া, বোতামবিহীন ফ্রক কী ভীষণ ফ্যাশনেব্‌ল আমিও ওই রকম পরব-ও)। ‘কিলু-বিলু অনিলকে বলে—কোথায় যাচ্ছিস? যাসনি। আমরা কী সুন্দর খেলছি দেখ। আমাদের সঙ্গে খেল’ (পচা-কুচান কক্ষনও আমায় খেলতে ডাকে না, নিজেরা খেলে, আমি আমাদের রকে দাঁড়িয়ে থাকি, ওরা আড়ে আড়ে আমার দিকে চায়, আমার পাশে টেকন দাঁড়িয়ে থাকে, গার্ড, তার দিকে চায়, কিলু-বিলু-উ, পচা-কুচান আমি তোদের সঙ্গে খেলব-ও-ও-ও।)

—‘খাচ্ছ না কেন? বুবু? খাও, না হলে গল্প আর বলব না।’

—‘খাচ্ছি তো! কাঁটা, মুখে কাঁটা লাগছে।’

—‘কই দেখি! কোথায় কাঁটা, কোথাও কাঁটা-টাঁটা নেই। জলদি করো, জলদি জলদি খাও।’

জলদি। কীরকম জলদগম্ভীর শব্দটা। আবার ই-কার যোগ হওয়াতে তার জলদত্ব অনেকটা কমে গেছে। এই কথাটা পমপম বলে। এটার মানে কী? এটা বললেই খুব তাড়াতাড়ি করতে হয় সব। আমি তাড়াতাড়ি চিবোই। পমপমেরা ভাগলপুরে ছিল তো, মোগলসরাইয়ে ছিল, ওই সব জায়গা বিহার, ওরা হিন্দি বলে, ওইখান থেকেই কি পমপম শব্দটাকে মুখের মধ্যে নিয়ে এসেছে? শব্দটা নিয়ে কুলকুচি করে পমপম। জল্‌দি জল্‌দি। জল্‌দি জল্‌দি করো। জল্‌দি জল্‌দি যাও। জল্‌দি জল্‌দি ঘুমোও। জল্‌দি জল্‌দি হিসি করে নাও। আচ্ছা, জল্‌দি জল্‌দি হিসি কী করে করা যায়? হিসি তো আমার হাতে নয়। আর ঘুম? ঘুমই বা কী করে জলদির আওতার মধ্যে পড়ে? ঘুম কি বুবুর হাতে? ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখন তাদের বুবুর কাছে আসার সময় হবে, ঝুপ করে তারা আকাশ থেকে নামবে? তবে তো! বুবুর কাজ শুধু সিঁড়ি পেতে রাখা।

‘ঘুমিয়ে পড়ছো বুবু! ঘুমিও না, খেয়ে নাও। এতক্ষণে এইটুকুনি খাওয়া হল? শোনো শোনো, এবার রাত্তির হলে অনিলের জানলা দিয়ে ঐরাবত আসবে। সাদা ধবধবে ঐরাবত হাতি। অনিলকে শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে পিঠে তুলে নেবে, সেখানে মখমলের হাওদা আছে’ মখমল কী? ভীষণ নরম, চকচকে, তুলতুলে, মায়ের কালো মখমলের জামা আছে, মা বিয়েবাড়ি পরে যান, আমাকে মখমলের জামা দেওয়া হবে যদি আমি অনিলের মতো লক্ষ্মী হই। পারব কী? অমন হতে? খুব শক্ত কাজটা, হতে আমি চাই কি না আদৌ, সন্দেহ আছে। কিলু-বিলুর খেলা, পচার ময়লা হাত, কুচানের বোতাম ছাড়া ঝুলে পড়া ফ্রক আমাকে টানে, ভী-ষণ টানে যে! এ জন্মে আর অনিল হওয়া হল না। ঐরাবতের পিঠে চড়ে স্বর্গে যাওয়া হল না, কিলু-বিলুর সঙ্গে নরকেই থাকতে হবে আমায়। নরক মানে কী? নরক একটা ঘর, তার একটাই চার পাল্লার জানলা আছে। গরাদে মুখে চেপে কিলু-বিলু দাঁড়িয়ে আছে। গরাদের লম্বা ময়লা ছাপ কিলু-বিলুর মুখে। চোখের জলে বসে গেছে। নরকের ঘরটাতে রাশি রাশি লাল পিঁপড়ে, আরশোলা, ওরে বাবা, মাকড়সা, ই মা, টিকটিকি। বাবা রে, বিছে মা গো! থাকে। আমি আরশোলা দেখলে আর নড়তে পারি না। আরশোলার শুঁড়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের তারা নড়ে। এরই মধ্যে আবার মাঝে মাঝে যমদূত এসে ডাঙস মারে। ডাঙস কী? ভয়ঙ্কর কিছু হবে একটা। বিষ্ণুর চক্র, পবনের গদা, শিবের ত্রিশূল, বরুণের পাশ এ সবের থেকেও অনন্তগুণ কোনও ভয়ঙ্কর! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি ডুকরে কেঁদে উঠি। নরক, ডাঙস, মাকড়সা, টিকটিকি, বিছে, কিলু-বিলুর মুখে গরাদের ময়লা দাগ! কে যেন আমাকে নরম করে জড়িয়ে ধরে। আমার রগের কাছে নরম নরম হাতের থুপথুপ চাপড়। মা, মা, তুমি কি এলে? পুনপুনের অসুখ কি ভালো হয়ে গেছে? মা? ম্যা-অ্যাঁ-অ্যাঁ বুবু কাঁদতে থাকে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, আমি জানি এটা মা নয়, এই থুপ থুপ পমপমদিদির হাতের। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। অগত্যা। অনিল আর এক পা-ও যাচ্ছে না। ঐরাবতের শুঁড় বেয়ে পিঠ থেকে নেমে যাচ্ছে। কিলু-বিলুকে না নিয়ে সে যাবে না স্বর্গে। এইখানেই পমপম দিদির গল্পের আসল মর‍্যাল। ক্ষমাশীল অনিল। করুণহৃদয় অনিল। যত ভালো, যত পরিচ্ছন্ন, যত গুড বয়ই সে হোক না কেন, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর সে নয়, একা একা স্বর্গের মজা সে ভোগ করবে না। সুতরাং, স্বপ্নের মধ্যে কিলু-বিলু চান করে গোলাপ জলে, পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে অবিকল অনিলের মতো, চুল পাট করে আঁচড়ায়। পায়ে শু জুতো, ফিতে বাঁধা টিপটপ। তারপর তিনজন—বুবু, পচা, কুচান স্বর্গের দিকে যেতে থাকে ঐরাবতের পিঠে। হেলে দুলে। হেলতে দুলতে, হেলতে দুলতে। যমদূত সেলাম করে, দেবদূত স্যালুট ঠোকে, স্বর্গের গেটে ফোয়ারা থেকে রামধনু রঙের জল পড়ে, সাদা ধবধবে রাজহাঁস সব জলের মধ্যে ভেসে বেড়ায়, দাঁড়ে বসে কাকাতুয়া ঝটপট ঝটপট ঝটপট করে, সাদা সাদা খরগোশ লম্বা লম্বা কান খাড়া করে মুঠোর মধ্যে থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে পালায়।

—‘খগগোশ, খগগোশ—কোয় যাচ্ছ!’

—‘যাচ্ছি যাচ্ছি, বাড়ি যাচ্ছি।’

—‘বাড়ি কোথায়?’

—‘গোলোকে।’

—‘গোলোক কোথায়?’

—‘ভূলোকে।’

—‘ভূলোক কোথায়?’

—‘ভূগোলে।’

—‘ভূগোল কী?’

—‘পঙ্কজবাবু।’

—‘পঙ্কজবাবুর বেল মাথা

পঙ্কজবাবু যাবেন কোথা?

যাবি কোথা যাবি কোথা

কলকাতা কলকাতা।’

ফোয়ারা কোথা থেকে এলো বলুন তো? ‘হাসিখুশি’ থেকে। ফোয়ারা হতে জল পড়ে, সেই ফোয়ারা, আর খরগোশ?—খরগোশ এসেছে ভেটরিনারি কলেজ থেকে। পালক নিয়ে এসেছে, আমাদের জন্যে। জালের আলমারির মধ্যে খরগোশরা থাকে, বাঁধাকপির পাতা আর গাজর খায়। কী সুন্দর দেখতে, কিন্তু কী বিচ্ছিরি কালো কালো নাদিতে নাদিক্কার করে ফেলেছে, জালের আলমারিটা। পালক বলেছে ওদের রোস্ট করে খেয়ে নেবে। ঋতি মানে পুটপুট বলেছে ওকে না মেরে কেউ তুলতুলি গুলগুলি (খরগোশদ্বয়)কে মারতে পারবে না। কী ভেবেছে পালক? তুলতুলি-গুলগুলির রোস্ট কী জিনিস আমার দেখতে খুব ইচ্ছে করে। টোস্টের মতো? পাঁউরুটি-টোস্ট। কালো জালির মধ্যে তুলতুলিদের আটকে জালিতে ছিটকিনি দিয়ে উনুনের ওপর ধরবে আর রোস্ট-টোস্ট হয়ে যাবে? এর পরেও অবশ্য তুলতুলি-গুলগুলি বেঁচে থাকতে পারবে না, লম্বা লম্বা কান খাড়া করে, পেছনের লম্বা পা ছড়িয়ে সামনের বেঁটে পা বাড়িয়ে লাফিয়ে আসতে পারবে না, কিন্তু কী-ই বা করা যেতে পারে? রোস্টটা যে আমাকে দেখতে-ই হবে। রোস্ট আর তুলতুলি-গুলগুলির কুপকুপ করে বাদাম খাওয়ার মধ্যে যদি কেউ আমাকে বেছে নিতে বলে, আমি রোস্টটাই বেছে নেব, কেননা রোস্টটা আমি দেখিনি, কুপকুপ করে বাদাম খাওয়াটা আমি দেখেছি। তবে, রোস্টটা দেখলেও আমি খাবো না। ছিঃ! তুলতুলিদের খেতে হয়? তা ছাড়া অত লোম, পেটের মধ্যে অত নাদি, সব সুদ্ধই তো রোস্ট হবে। ম্যাগে! পালক একা খাক গিয়ে।

আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ছি, এক ঘুম থেকে আরেক ঘুমে ঢুলে পড়ছি, আমার হাত মায়ের বুক খুঁজছে, মায়ের বুকের উসুম-কুসুম ময়দার তালে হাত না রাখলে আমি শান্তি পাই না। মা, মা, তুমি কোথায়? কে আমার হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়। পমপম, পমপম। পমপমকে মা ভেবে আমি….ঘুমের মধ্যেই আমার কানে প্যাঁচ পড়েছে। কতকগুলো অপরাধ পমপম ক্ষমা করতে পারে যেমন আঙুল কামড়ে রক্ত বার করে দেওয়া। কতকগুলো অপরাধ পমপম ক্ষমা করতে পারে না, যেমন মা ভেবে…ঘুমের মধ্যে…হোক না ঘুম, হোক না অজান্তে অজ্ঞাতে, তবু পমপমের নিভৃতি, পমপমের পবিত্রতা লঙ্ঘন করা একটা পাপ, মহিষাসুরের পাপের চেয়েও বড় পাপ, তার জন্যে শাস্তি খেতেই হবে। ঘুমোই আর যাই করি।

এক কানে দোল-দোল মাকড়ি পরে আমি ঘুমোচ্ছি। মাকড়িটা কিসের বলুন তো? পমপমের হাত, বা আঙুল। আমিও ঘুমের মধ্যে পমপমের…পমপমও ঘুমের মধ্যে আমার…। একবার কান ধরে কান আর ছাড়েনি পমপম। অপরাধ তো আবারও ঘটতে পারে, শাস্তিটা তাই মাকড়ি হয়ে আঁকড়েই রইল। আজও আমার বাঁ কানটা ডান কানের চেয়ে বেশি ঝোলা। বড়ও বোধহয়। একটু নেমে গেছে, অসমান হয়ে গেছে। মাপিনি কখনও। কিন্তু টের পাই। আমার চশমা উল্টে টেবিলে রাখলে একটা দিকের হাতল শূন্যে উঠে থাকে। চশমার সেই ফাঁকাটার দিকে তাকিয়ে দেখি, সেটা ফাঁকা নয় মোটেই, সেখানে পমপমের আঙুল, মাকড়ি হয়ে ঝুলছে।

আচ্ছা, ওই পঙ্কজবাবুটা কে বলুন তো? ঠিক ধরেছেন ঠাকুর্দাদার এক রুগি। ঠাকুর্দাদার চেম্বারে যখন কেউ থাকে না, টেকন সব ঝাড়পোঁছ করে চলে গেছে; ঠাকুর্দাদা এ ঘরে আসার আগে একটু হুঁকো খেয়ে নিচ্ছেন, তখন আমি চেম্বারে ঢুকে পড়ি। টেবিলের তলায় বসে থাকি। গুট করে। কেউ টের পায় না। একটু পরে ঠাকুর্দাদার পা দুটো আমার সামনে এসে বসে, ঠাকুর্দার গলাও আসে, অন্য সব রুগিদের গলাও আসে, কিন্তু সেসব আমি শুনি না ভালো করে। আমি পায়ের জগৎ দেখি। ঠাকুর্দার পা ভীষণ ফর্সা, মুখ-গা অত ফসা নয়, কিন্তু পা ভীষণ ফর্সা। সিল্কের মতো চামড়া দিয়ে ঢাকা, নস্যিরঙের শুঁড়তলা চটি পরা থাকে।

—হ্যাঁ বলুন, কত টেম্পারেচার? দেখেছেন? ওই তো আপনাদের দোষ, দেখি, হাতটা দেখি, ডাক্তারবাবুর নাড়ি টিপলেই জ্বর, জ্বরের রীত-নীত, জ্বরের নিদান স-বই বলে দেবেন, বাঃ। সর্দি তো বেশ দেখছি।

—আজ্ঞে, হয়েছিল বটে, তা এখন তো আর তেমন…

—বসে গেছে। বসে গেছে। —ঠাকুর্দার গলা কী জোর। বাব্‌বাঃ।

এই টেবিলের তলাতেই পঙ্কজবাবুর মোটা ধ্যাবড়া পা দেখি। পঙ্কজবাবুর গিন্নি ভোগেন, গিন্নির বোন ভোগেন, শাউড়ি ভোগেন, ছেলে-মেয়ে সবাই ভোগেন। পঙ্কজবাবু তাদের জন্যে ওষুধ নিয়ে যান।

পঙ্কজবাবুর মুখ আমি দেখিনি। এখনও দেখিনি। কিন্তু একদিন ঠি-কই দেখব। গলা শুনে বেল মাথাটা ধরে নিয়েছি। বেল-মাথা একজন লোককে আমি ডাক্তারখানা থেকে বেরোতেও দেখি, দোতলার জানলা থেকে। সেটাই নিশ্চয় ওই ধ্যাবড়া পায়ের পঙ্কজবাবু।

পঙ্কজবাবুর বেল মাথা

পঙ্কজ যাবেন কলকাতা

রেল কম ঝমাঝম্‌

পঙ্কজবাবু আলুর দম্!

—‘কী বিড়বিড় করছিস? বুবু! ওঠো, ওঠো বলছি, ভোর হয়ে গেছে।’

ভোর হল, দোর খোল। খুক্‌মণি জাগো রে। যাঃ, এরই মধ্যে ভোর হয়ে গেল? পমপমের কাছে শুলে সক্কাল-সক্কাল উঠে পড়তে হয়, জলদি জলদি মাজন দিয়ে দাঁত মেজে নিতে হয়। তারপর হারুর দোকান থেকে চ্যাঙারি করে জিলিপি নিয়ে আসে ই-দাদা কি সু-দাদা। মামার বাড়ি থেকে গঙ্গুর দুধ এসে পৌঁছয়, জ্বাল দেন পিসিমা, জল মিশিয়ে নরম করে। ঢালা-উপুড় করে দেন, সেই দুধ আর জিলিপি দিয়ে আমায় উপবাস ভঙ্গ করতে হবে।

ইতিমধ্যেই পমপমদিদি টঙের ঘরে জলচৌকির ওপর মোটা মোটা বই খুলে বসে গেছে। পমপমদিদি, টমটমদিদি, বুজবুজদিদি, পুটপুটদিদি, আমাকে ওইখানে যেতে হবে। হাঁসিখুশি, আর বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ, আর কাশীর খাঁল্লা নিয়ে ওইখানে বসব। পুঁতুল নিয়ে আসব। যেখানে মোটা মোটা বই থাকে সেই আলমারির তলায় একটা ফাঁকা জায়গা আছে, সেইখানে পর্দা ঢাকা আমার পুঁতুলের ঘর। আসলে পুটপুটদিদির, কিন্তু পুটপুট এখন খেলে না।

তার সম্পত্তি সে সব আমাকে দিয়ে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। তার স্লেট, তারও নয়, এ হয়তো ই-দাদা পমপমদিদিদেরই স্লেট গড়াতে গড়াতে আসছে নীচের দিকে। যার পালা সে লুফে নিচ্ছে, কাজ হয়ে গেলে আবার গড়িয়ে দিচ্ছে নীচে। স্লেটে আমি আঁকিবুঁকি কাটি। একটা তোবড়ানো গোল। একটা ঠ্যাং। কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং।

—‘ঋতি ওকে পাখি আঁকতে শিখিয়ে দে না।’

ঋতি আঁকে আর বলে।

‘দ-এর বড় জ্বর।

বসতে দিল পিঁড়ি,

বাইশটা দিল বড়ি,

মেরে দিল, খোঁচাটি,

হয়ে গেল পেঁচাটি।’

যাঃ, বুবু স্লেট ভেঙে ফেলেছে।

—‘ভাঙলি?’

—‘ভাঙলে?’

কী আশ্চর্য! ষোলো সতেরো বছর ধরে যে স্লেট গড়াতে গড়াতে গড়াতে গড়াতে ঠিক এসে যাচ্ছে রিলে রেসের ব্যাটনের মতো, সেই স্লেট ভেঙে ফেলেছে! বাহাদুরি আছে বলতে হবে, প্যালিওলিথিক এজের ওই স্লেট, এখন কত শক্ত, কত মজবুত, কত জনের বিদ্যের ভার বহন করে করেপোক্ত, কিন্তু বুবু তাকে ভেঙে ফেলেছে।

ঠাকুমা চিলেকোঠার ঘর থেকে এক পা এক পা করে নামছেন।

—‘কী হল রে?’

—‘বুবু স্লেট ভেঙে ফেলেছে।’

ই-দাদা নিচ থেকে চেঁচাচ্ছে—‘কী হল রে?’

—‘বুবু স্লেট ভেঙে ফেলেছে।’

—‘কী করছিল স্লেট নিয়ে?’

—‘আঁকতে গিয়েছিল, দ-এর বড় জ্বর…’

—‘কোন স্টেজে এই যুগান্তকারী দুর্ঘটনাটি ঘটল?’ পালক উড়ে এসে বসে গেছে। হাঁটু মুড়ে, বাবু হয়ে, আমার আর ঋতির সামনে।

—‘দ টা আমি এঁকে দিলুম’—ঋতি বলছে –‘বাইশ আর বড়িও আমিই এঁকে দিলুম।’

—‘পিঁড়ি পিঁড়ি?’—পালক জিজ্ঞেস করছে, পালকের পেছনে উবু হয়ে বসেছে ই-দাদা। পেছন থেকে উঁকি মারছে অং-দাদা।

—‘পিঁড়িটাও তো আমি-ই…’

—‘তাহলে তুই-ই ভেঙেছিস, এখন বুবুর নামে দোষ দিচ্ছিস।’

—‘না-আ-আ’—ঋতি সরু গলায় চিৎকার করে উঠেছে।

—‘আমি ওকে দিলুম, ও নিল, তারপর’—ঋতি একটা মার্ডার কেসের সাক্ষীর মতন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘটনাক্রম বর্ণনা করতে থাকে।

—‘ওকে দিয়েছি দেখতে, তারপরেই ভাঙার শব্দ…’

—‘কী রে? মুড়মুড় করে ভেঙে দিলি? পাঁপর ভাজা ভেবেছিলি?’

ভ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ, আমি তো ‘মেরে দিল খোঁচাটি’র খোঁচাটা মারতে গিয়েছিলুম। এরা বোঝে না কেন? আর, কতজন জড়ো হয়েছে দেখো! একে স্লেট ভেঙেছি, তায় পমপমদিদি দুর্গার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঋতি নিজেকে ডিফেন্ড করতে সমস্ত দোষ আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এর পরে বোধহয় স্লেটটা আমাকে দেওয়ার কথাও অস্বীকার করবে।

ই-দাদা বলল—‘সমস্ত শরীরের চাপ দিয়েছে স্লেটের ওপর, বুঝলি? বডি দেখ, বাচ্চা হাতি, হাতের চেটোগুলো কী! হুলো বেরালের থাবা! কুলোর মতন কান, মুলোর মতন দাঁত, পিঁপড়ের মতো চোখ…’

পালক স্লেটের দুটো টুকরো তুলে নিয়ে সে দুটো সামনে মেলে ধরে বলতে লাগল ‘হে প্রাগৈতিহাসিক স্লেট, কবে কত লক্ষ বৎসর পূর্বে তুমি সমুদ্রতলে কাদা জমিয়া জমিয়া তৈয়ারি হইয়াছিল। তাহার পর কত ডাইনোসর তোমার বক্ষ দিয়া পদভরে তোমাকে প্রকম্পিত করিয়া চলিয়া গিয়াছে, তুমি ভাঙো নাই। তুষার যুগে পর্বতপ্রমাণ হিমবাহের তলায় তুমি চাপা পড়িয়াছিলে, তাহাতেও তোমাতে ফাটল পর্যন্ত ধরে নাই, তুমি অখণ্ডিত অনাঁচড় দেহে সিংহবাড়ির সিংহ-সিংহীদের কাছে আনীত হইয়াছিলে, তাহারাও তোমার বক্ষে কত লীলা করিয়াছে, তখনও তুমি দমো নাই। আজি এই ঘোর কলিতে হস্তিরূপিণী একটি ক্ষুদ্র সিংহী অথবা কল্‌কি অবতার তোমার লীলাখেলা সাঙ্গ করিয়া ছাড়িল।’

‘আমাদের ক্ষমা করিও হে মহীয়ান, ওই ক্ষুদ্র হস্তী-সিংহীকে ক্ষমা করিও, উহার জ্যেষ্ঠা ওই যত নষ্টের গোড়া বাঁশের বাঁশিটিকেও তুমি ক্ষমা করিয়া দাও হে শীতল হৃদয়’ বলতে বলতে হাতের চাপে স্লেটের দুটো বড় টুকরোকে টুকরো টুকরো করে ফেলল পালক।

ঠাকুর্দাদা এসে বললেন—‘স্লেট ভেঙেছে এই তো কথা! রামও তো হরধনু ভেঙেই ফেলেছিলেন। তাঁকে তো কেউ অমন লজ্জা দেয়নি! তোমরা ওকে অমন করো না।’

তা সে যা-ই বলুন আর তাই বলুন।

আমার সারা ছোটবেলা জুড়ে সেই আনাড়ি স্লেটের টুকরো ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে রয়েছে। আজও জড়ো করবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।

নবম অধ্যায় : হরিবংশ-৪—গোপীজনবল্লভ

‘দেখুন দাদা, মায়ের কথা আমায় জিজ্ঞেস করবেন না। মায়ের কথা বলা যায় না।’

—‘কেন?’

—‘এ যে সেই ‘অব্যক্তাদীনি ভূতানি, ব্যক্তমধ্যানি’—এই মধ্যটুকু বললেই মায়ের আদি অন্ত শেষ হয় না। ইনি জগদীশচন্দ্রের ‘অব্যক্ত’, ইনি উপনিষদের ‘অক্ষর’ ইনি গীতার ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’, ইনি ঋক্‌ বেদসংহিতার দশম মণ্ডলের নাসদীয় সূক্ত, ইনি ওয়র্ডসওয়ার্থের ‘ফ্যানটম অফ ডিলাইট’। সবচেয়ে মজার কথা ইনি জানেন না ইনি কে, ইনি কী? ইনি বিভূতিভূষণের ‘মেঘমল্লার’ গল্পের সেই আত্মবিস্মৃতা সরস্বতী। এঁকে কেউ স্বর্গ থেকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে কোনও ইতর অঙ্গীকারের সূত্রে, অথবা মানবশিশুদের দুর্দশা দেখে কাতর হয়ে ইনি নিজেই মনুষ্যরূপ ধরে নেমে এসেছেন। নেমে এসে ভুলে গেছেন নিজের পুরনো পরিচয়।

ওই দেখো উনি রান্নাঘরে কাজ করছেন, উনুনের আলো পড়েছে ওঁর মুখে। ভয়সা ঘিয়ের মতো ওঁর গায়ের রঙ, ঘি বলেই যেন তাতে একটু একটু গলেছে। মাথার চুলগুলি যেন করুণেকোমলে, চোখ মুখ তেমন স্পষ্ট নয়, অর্থাৎ বিশাল বিশাল ডাগর চোখ নেই, তাতে লম্বা-লম্বা বাঁকানো পাপড়ি নেই, টুকটুকে লাল ঢেউ খেলানো ঠোঁট নেই, কিন্তু কী অপূর্ব লাবণ্যে ইনি ঝলমল করছেন। ভুল বললাম—ছলছল করছেন। ঝলমলানো জৌলুস তো এঁর নেই! মুখের ডৌল গ্রিক দেবীদের মতো। হেরা কিংবা এথিনা। নাকটি মুখকে স্পষ্টতা দিয়েছে। সামান্য স্থূলাঙ্গিনী ইনি। ভারতীয়দের সৌন্দর্যের ধারণা অনুযায়ী ইনি সুন্দরী, একটু পৃথুলা না হলে নারীশোভা তো খোলে না ভারতীয় মতে! বাহু এঁর অঙ্গদে শোভিত হবার যোগ্য, আঙুল অঙ্গুরীতে, কণ্ঠ হারে, মাল্যে, প্রকোষ্ঠ কঙ্কণে। কিন্তু এ সকল কিছুই নেই তো আমার মায়ের বরাঙ্গে! বাঁ হাতে তিন-চার রকম লোহার বোঝা, ডান হাতে তিন-চার গাছি ক্ষয়া ক্ষয়া সোনার চুড়ি, বাহুতে মাদুলি, কণ্ঠ আভরণহীন, কানে সোনার তারের ছোট ছোট চাকা। মা সকালবেলায় চান করে সিঁথিতে একটু সিঁদুর ছোঁয়ান, কপালে কড়ে আঙুল সিঁদুরে ডুবিয়ে একটি টিপ পরেন, ব্যাস, ভোরের আলোয় মাঠঘাট বনবাগান শহরবন্দর সব হেসে ওঠে।

‘কেন মা মঙ্গলচণ্ডী এতো হেলা?

হাসতে খেলতে

কাজল কুমকুম পরতে

কেন মা গো তোমার এতো হেলা?’

মা কিচ্ছু কৈফিয়ত দেন না। বস্তুত কৈফিয়ত কেউ চায়নি। কৈফিয়ত চাওয়ার কথাই মনে হয়নি কখনও। আগাগোড়া ঘিয়ে রঙের ওই অপূর্ব দেবীমুর্তির কি অলঙ্কার লাগে না কি? মাকে আমরা ওইরকমই দেখতে অভ্যস্ত। শুধু তাই নয়, ভেবে দেখুন গ্রিক মূর্তিগুলো নাকি অমন সর্বশ্বেত ছিল না, ছিল রঙিন, বসনাবৃত। কালের প্রকোপে সব রঙ গলে গেছে। ভাগ্যিস গিয়েছিল? না হলে কি গ্রীবাভঙ্গের ওই মহিমা দেখতে পেতুম! ওই অপূর্ব দাঁড়ানোর ভঙ্গি? মরাল নয়, মা ছিলেন কম্বুগ্রীব, শঙ্খের আবর্তের মতো দাগ ছিল মুক্তাশুভ্র গলায়, ‘মা!’ ডাকলেই যখন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেন, সেই চিহ্নগুলির স্থির বিন্যাস ভেঙে আলোছায়ার ঢেউ উঠত। স্বর্ণসূত্রে বন্দি হলে সে মহিমা বোধহয় ক্ষুন্ন হত।

স্বায়ম্ভূব মনুর মেয়ে দেবহূতি কর্দম ঋষির প্রেমে পড়েন। রাজার মেয়ে ঋষির প্রেমে পড়লে যা হয় তাই হল। রাজা মনু এবং তাঁর রানি শতরূপা বহু উপহারসামগ্রী যৌতুক দিয়েছিলেন, কিন্তু ঋষির সেবা কি সেভাবে করা যায়? দেবহূতি চুল বাঁধলেন না, প্রসাধন করলেন না, ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করলেন না, দিবারাত্র শুধু সেবা, সেবা আর সেবা। যে মুহূর্তে ঋষি তাঁর অলৌকিক মায়ায়, সোনার তোরণ, হিরের খিলান, মানিক্যের দেয়াল, প্রবালের মেঝে-অলা উড়ন্ত প্রাসাদ সৃষ্টি করবেন, বিলাসে আনন্দে দিন কাটবে, নয় মেয়ে এক ছেলে জন্মাবে অমনি কর্দম ঋষি তপস্যা করতে চলে যাবেন। তাই-ই বোধহয় দেবহূতি অলঙ্কার, বেশভূষার প্রতি উদাসীন, বিলাসপ্রাসাদ চান না…

কিন্তু কত রকমের আজব গপ্পো শুনি যে! আমার বড় মাসিমা, মায়ের কেমন যেন জারতুতো বোন বলেন— ‘কাকাবাবু কত গয়না দিয়েছিলেন। সোনার, জড়োয়ার। মুক্তোর কলার ছিল, হাতের মানতাশা ছিল, কোমরের বিছে ছিল, তোর বাবা-মা মোগলসরাইয়ে চলে গেল শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদের কাছে রেখে, ব্যাস তোর মার গয়না কপ্পুরের মতো উবে গেল। স-ব ওই জটিলে-কুটিলে খেয়েচে।’

—‘মা, সোনার বিছে কেমন হয় মা, দাড়া থাকে? একটা বিছে দিয়েই পুরো কোমরটা বেড় দেওয়া যায়?’

—‘দুর বোকা, বিছে একরকম গয়না, চওড়া হারের মতো, কোমরে পরে।’

—‘তোমার বিছে আছে মা?’

—‘না।’

—‘বড় মাসিমা যে বললেন ছিল।’

—‘বড় মাসিমা জানেন না।’

—‘বড় মাসিমা বলেছেন বিয়ের সময়ে তুমি পরেছিলে। জটিলে-কুটিলে খেয়ে নিয়েছে।’

—‘ক্‌-কী?’

—‘জটিলে-কুটিলে। জটিলে-কুটিলে কী মা?’

—‘কিচ্ছু না। কথার কথা।’

—‘মা, শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ কী মা?’

—‘কেন?’

—‘বলো না।’

—‘স্বামীর মা-বাবাকে শাশুড়ি-শ্বশুর বলে, বোনকে ননদ বলে।’

—‘তোমার শাশুড়ি আছেন?’

—‘বাঃ, আছেন বইকি। তোমাদের ঠাকুমাই তো আমার শাশুড়ি।’

—‘তাহলে ঠাকুর্দা তোমার শ্বশুর? পিসিমা তোমার ননদ? তাহলে বাবা তোমার স্বামী? হি, হি, হি।’

—‘এই সব পাকা-পাকা কথা বলতে হবে না।’

—‘ই মা। ননদ কী অসভ্য কথা? ননদ বিচ্ছিরি, এই পুনপুন, কাউকে বলবি না কিন্তু পিসিমা মায়ের ননদ।’

ব্যাস, আমাদের ড্যাং ড্যাং করে বড় মাসিমার বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। খারাপ কথা শিখে এসেছি ওখান থেকে। ননদ-ভাজ শ্বশুর-শাশুড়ি। তাছাড়া বিছে-টিছে, মানতাশা- টানতাশা এই সব। এর জন্যে বড় মাসিমার বাড়ি যেতে হলে মার সঙ্গে রিকশাগাড়ি চেপে যেতে হয়। মা সারাক্ষণ চোখের আড়াল করেন না। দীনবন্ধুদা কি টেকনের সঙ্গে সারা রাস্তা এক্কা-দোক্কা খেলতে খেলতে মাসির বাড়ি যাওয়া বন্ধ! বন্ধ! বন্ধ।

দিদিভাই বলেন—‘দেশের কাজে দেবু সব দিয়ে দিয়েছে। তোদের বাবা তো দেশের কাজ করত কি না!’

—‘দেশের কাজ কী দিদিভাই?’

—‘এই যে আমাদের দেশ, ভারতবর্ষ, এই সমস্ত গ্রাম, শহর, নদীনালা, গাছপালা, মানুষ, গরু…’

—‘কুকুর বেড়ালও দিদিভাই? পাখি? পাখিও দেশ? আরশুলা? টিকটিকি? মাকড়সা? স-ব দেশ?

—‘স-বই দেশ। তাদের স্বাধীনতার জন্যে চেষ্টা করতে হয়। কাজ করতে হয়।’

—‘স্বাধীনতা চাই না। গয়না কই? কেন মা দেশের কাজে স-ব দিয়ে দেবে। পরব, আমি, পুটপুট, বুজবুজ, টমটমদিদি, পমপমদিদি পরব। মা-ও পরবেন। মুক্তোর লহর, সোনার হার, কঙ্কণ, এই সব পরব-ও-ও।’

আমি কান্নার সুর ধরি।

—‘দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেই পরবে।’

অত বোকা নই আমি।

—‘দেশের কাজে তো দিয়ে দিয়েছেন মা, আর কি দেশ সে-সব ফেরত দেবে না কি? দেশ বাজে, দেশ বিচ্ছিরি, দেশ চোর।’

দিদিভাইয়ের মুখ গম্ভীর।

—‘বলব, বাবাকে? বলে দেব? দেশ চোর! দেশের জন্যে লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ দিচ্ছে, বয়কট করছে, পিকেটিং করছে। দেশ চোর?’

বুনন বললে—‘এই কথাটা বুঝছিস না কেন? দেশ তো আর না বলে নেয়নি! চোর হবে কী করে?’

পুনপুন বললে—‘চেয়ে নিয়েছে।’

আমি বললুম—‘তাহলে ভিখিরি। দেশ ভিখিরি। দুটো গয়না ভিক্ষে দেবে গো! বলে মায়ের কাছ থেকে সব গয়না নিয়ে গেছে।’

দিদিভাই হঠাৎ মুখ নিচু করে, আঁচলটা মুখে চেপে ধরেছেন।

—‘ও দিদিভাই, কী হল? কাঁদছেন?’

—‘কাঁদছি-ই তো?’

—‘তাহলে চোখে জল কই?’

আর পারছেন না। দিদিভাই ডুকরে হেসে উঠেছেন। দাদাভাইকে ডেকে বলছেন— ‘শুনছো। তোমার নাতনি কী বলছে? বলছে দেশ চোর। দেশ ভিখিরি।’

চোখে চশমা লাগিয়ে দাদাভাই অঙ্ক কষছেন। মাথা নেড়ে বিজ্ঞের মতো বললেন— ‘হ্যাঁ। তা একরকম ঠিক বইকি!’

শরৎচন্দ্রের যাদব-গিরীশের অরিজিন্যাল মডেল, আমার মামার বাড়িতে অঙ্ক নিয়ে বসে আছেন।

মায়ের কেরামতি কি কম না কি? আস্তে আস্তে শ্বশুর শাশুড়ি ননদ এসব শব্দ আমাদের কাছে অশ্লীল হয়ে গেল। পুনপুন জিজ্ঞেস করলে— ‘এই বুবু, তুই বিয়ে করবি?’

আমি—‘কক্ষনও না। বিয়ে হলেই তো ননদ হবে। খারাপ কথা। ছিঃ। তুই?’

পুনপুন— ‘আমিও না। আমার ননদ অত খারাপ লাগে না। কিন্তু তুই না করলে আমিও করব না।’

শুধু ননদই নয়। মানতাশা, বিছে, আর্মলেট, মুক্তোর কলার, চিক—এসব শব্দও উচ্চারণের অযোগ্য অশ্লীল ‘চার অক্ষর’ হয়ে গেল আমাদের কাছে। যখন প্রাণভরে খারাপ কথা বলতে ইচ্ছে হত তখন কলঘরে গিয়ে একনিশ্বাসে বলে নিতুম— ‘শ্বশুর শাশুড়ি ননদ ভাজ মানতাসাতাগাকলারবিছে।’

একদিন আমার আর পুনপুনের ভীষণ ঝগড়া হয়ে গেল, পুনপুন রেগেমেগে আমাকে বলল—‘ননদ, ননদ, তুই একটা ননদ!’

আমি বললুম—‘তুই মানতাশা।’

পুনপুন বলল— ‘তুই স্বামী তুই একটা স্বামী।’

আমি বললুম— ‘চূড় তাগা চিক, তুই একটা ভাজ।’

পুনপুন আমার ওপর লাফিয়ে পড়ল। আমি পুনপুনের ওপর লাফিয়ে পড়লুম। দুটো বেড়াল যেমন আঁচড়াআঁচড়ি কামড়াকামড়ি করে সেইরকম দেখতে হল ব্যাপারটা। টমটমদিদি এসে আমাদের ছাড়িয়ে দিল। আমার চোখ রাগে জ্বলছে। জ্বলন্ত কয়লার টুকরো যেন। পুনপুনের নাক হোসপাইপের মতো ফোঁস ফোঁস করে ফুলছে। আমার দাঁত পুনপুনের হাতে বসে গেছে, পুনপুনের দাঁত আমার হাতে বসে গেছে। কিন্তু টমটমদিদি হাজার জেরা করলেও আমরা কেউই মুখ খুলি না। কী এমন গালাগাল আমরা পরস্পরকে দিয়েছি যার জন্য এমন প্রাণান্তকর ডুয়েল টমটম কিছুতেই জানতে পারলো না। ওই কথা কখনও বড়দের সামনে উচ্চারণ করা যায়? টমটমদিদির ধারণা হল সাঙ্ঘাতিক, ভয়ঙ্কর কোনও গালাগালি আমরা দেওয়া-দেওয়ি করেছি। অতএব সে আমাদের দালানের কোণে কান ধরে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে দিল। যাতে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করার সময়ে বিশ্বের তাবৎ প্রাণী আমাদের দেখতে পায়।

প্রথমেই দেখল অংদাদা। সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বক দেখালো। তারপরই পমপমদিদি আসছে দেখে ভালো মানুষের মতো কেটে পড়ল। পমপমদিদি আড়চোখে একটি করে বাজ হেনে গজেন্দ্রগমনে চলে গেল। এরপর গেলেন বাবা। দৃশ্যটি দেখলেন— ‘কী হল! কী দুষ্টুমি করেছ? কে শাস্তি দিয়েছে?’

আমরা ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছি। প্রথম প্রশ্নটার জবাব এড়িয়ে, দ্বিতীয়টার জবাব দিলুম— ‘টমটমদিদি।’

বাবা এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন। বোধহয় ভেবে নিলেন টমটমদিদির দেওয়া শাস্তি তাঁর মকুব করা ঠিক হবে কি না। তারপর বললেন— ‘দিদির কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও।’

দুঃখিত মুখে বাবা চলে গেলেন। পরবর্তী আগন্তুক পালক। অংদাদা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। কেন? মজা দেখতে, আর কী!

পালক—‘খোঁড়া ল্যাং ল্যাং ল্যাং’

অংদাদা— ‘কার বাড়িতে গিসলি খোঁড়া কে ভেঙেছে ঠ্যাং?’

পালক—‘বুবলি পুবলু কাঠের ঠ্যাং।

বুবলি নাচে ড্যাডাং ড্যাং।’

মাকে আসতে দেখে দুজনেই হাওয়া হয়ে যায়। আসল আসামি হলেন এই দেবহূতি সিংহী। তিনিই আমাদের চিত্তে অশ্লীল শব্দের কনসেপ্ট ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তাই সহজাতবোধে আমরা তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ করি।

—‘কী করেছিলে? বিদ্যা?’

—‘কিঁছুঁ কঁরিনি।’

—‘কী করেছিলে, পাবন?’

—‘খারাপ কথা বলেছিলুম।’

—‘কী বলেছিলে?’

—‘ননদ’— লজ্জায় অধোবদন হয়ে পাবন বলে।

—‘কী? ননদ?’ মা হতভম্ব।

—‘বুবুও আমাকে যা-তা বলেছে।’

—‘কী বলেছে?’

—‘মানতাশা, আরও বলেছে ভাজ।’

মা বিমূঢ়। বললুম না আত্মবিস্মৃত! কীর্তিটি যে নিজেই করেছেন, জানেন না।

—‘ঠিক আছে, এবার যাও।’ —বিমূঢ় মা স্থানত্যাগ করেন।

তা সে যাই হোক, এক একটা দিন আসে উৎসবের। নেমন্তন্ন বাড়িতে যাওয়ার উৎসব। বিয়ে বাড়ি। তখন মা সাজেন। কালো ভেলভেটের একটা প্রায় স্লিভলেস ব্লাউজ আছে মায়ের। মা সেইটা পরেন, আর অমনি প্রতিতুলনায় মায়ের গায়ের রঙ ঝলমল করে ওঠে। সোনালি জরি আর কালোয় আশপাঁড় শান্তিপুরী শাড়ি পরেন মা। রুপোর চাবির গোছা পিঠে ঝনাত করে ফেলেন। এ কিন্তু আসল চাবি নয়। সাজের চাবি। মায়ের গলায় চিকচিক করতে থাকে তেঁতুলে-বিছে হার। হাতে ওঠে ঝকঝকে তোলা সোনার চুড়ি, বালা, চুল বেঁধে খোঁপা করে তাতে একটা রুপোর কাঁটা গুঁজে দেন মা। তুলোয় আতর ভিজিয়ে বুকের মধ্যে রাখেন। একটা পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে নেন মা, কানে পরেন মুক্তোর টপ। ট্যালকম পাউডার হাতে মেখে নিয়ে মুখে একটু বুলিয়ে নেন। কালো ভেলভেটের চটি পরেন। ব্যাস নিরাবরণ গ্রিক দেবী কয়েক মিনিটেই অষ্টমীর দুর্গা হয়ে যান। দেখে দেখে দেখে আশ আর মেটে না। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বুকের ভেতরটা কেমন-কেমন করে। আমাদের ওই মা-ই তো? দেবু মা? না কি অন্য কেউ? স্বায়ম্ভূব মনুর কন্যা দেবহূতি কি এবার নিজরূপ ধরলেন? ছদ্মবেশ ঘুচে গেল? শাপমুক্ত হলেন? নিজলোকে চলে যাবেন না কি?

আমার আর পুনপুনের জামাকাপড় বেরোয়। পুনপুনের সেলর স্যুট। আমার থাক-থাক ফ্রক, অর্গ্যান্ডির। এতটা ফুলে থাকে। গোলাপি অর্গ্যান্ডি। পায়ে মোজা জুতো পরে, মস্‌মস্‌ করে আমরা নেমন্তন্‌ন যাই। ফিটন গাড়িতে বসে নিশ্চিন্ত হয়ে পুনপুন বলে— ‘তুই কটা বেগুন ভাজা খাবি রে?

—‘দূর, বেগুনে আমার মুখ কুটকুট করে। আমি ছোলার ডাল দিয়ে কুমড়োর ছক্কা দিয়ে নুচি খাব।’

—‘আর মাংস?’

বৈষ্ণব বাড়ি আমাদের। মাংস হয় না। তবে বাইরে খেতে আমাদের বাধা নেই। কিন্তু খাবো কী করে? অত ভাল খেতে হলে হবে কি, মাটির খুরির মধ্যে মাংসের টুকরো দেখলেই মাংসের দোকানের ছাল-ছাড়ানো ঝুলন্ত পাঁঠার দৃশ্য মনে পড়ে যায়। আমার বমি পেয়ে যায়। কষ্টে, ঘেন্নায় চোখ ভরে জল চলে আসে। মাছের ফ্রাই থাকলে খুব মজা। কিন্তু মোটা ছাল-অলা নেমন্তন্ন বাড়ির মাছের কালিয়াও আমি-পুনপুন খেতে পারি না, যদি চিংড়ি মাছ থাকে তো আলাদা কথা। এত বড় বড় গলদা চিংড়ি বেশ। তবে শেষ পর্যন্ত কুমড়োর ছককার পরই আমরা চাটনিতে চলে যাই। পাঁপরভাজা লজ্জায় খেতে পারি না। কুড়ুর-মুড়ুর করে শব্দ হবে। লোকে সবাই বুঝতে পারবে এই ছেলে-মেয়ে দুটো পাঁপর খাচ্ছে। অথচ পাঁপরভাজা ফেলে চলে আসাও যায় না। অবশেষে দু’জনে পরামর্শ করি সবাই যখন খাবে, তখন আমরাও খাব। পাঁপরভাজা খাওয়ার সমবেত অর্কেস্ট্রায় আমাদের অবদান বোঝা যাবে না। অধ্যবসায় সহকারে বসে থাকি। তা ছাড়াও লেডিকেনি আসবে। হয়তো রাবড়িও।

কিন্তু খাদ্যাখাদ্যের গল্প আরম্ভ করবামাত্র পুটপুটদিদি ধমক মেরে থামিয়ে দেয়—‘অ্যাই খেতে যাচ্ছিস না কি লোকের বাড়ি? একদম হ্যাংলাপনা করবি না।’ কী আশ্চর্য! খেতেই তো যাচ্ছি।

মামার বাড়ি থেকে বুনবুনকে তুলে নেওয়া হয়। সে ছোট্ট ধুতি আর লাল বেনারসীর পাঞ্জাবি পরেছে। এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে আমাদের খুব হিংসে হয়। বিয়েবাড়িতে বুনবুনকে নিয়ে লোফালুফি, গাল টেপাটেপি। তখন আবার আমাদের খুব গর্ব হয়। বুনবুন দিদিভাইয়ের কাছে একা থাকে, খুবই আদর যত্নে মানুষ হয়। ওকে একটা আপেলের মতো দেখায়। তার ওপরে লাল পাঞ্জাবি। কার্তিক ঠাকুরটি। মা আর দিদিভাই, মেয়ে-মা হলে কী হবে, দুজনের রুচি একদম আলাদা। আমরা এজমালি সংসারে মানুষ হই আমাদের জন্য কোনও আলাদা আদর-যত্ন নেই। পুনপুনের চুল, বিশেষ করে মাথার পেছন দিকে গোল ঘূর্ণিমত জায়গাটায় চুলগুলো খাড়া-খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুতেই তাদের শোয়ানো যায় না। বুনবুনের ওই একই চুল তো? অথচ চমৎকার পোষ মেনে গেছে। পুনপুনকে মা শার্ট প্যান্ট পরাবেন। স্ট্রাইপ দেওয়া শার্ট, খাঁকি প্যান্ট। বুনবুনকে দিদিভাই এমব্রয়ডারির নকশা করা পপলিনের, সিল্কের জামা পরাবেন, জাঙিয়াটা তলায় ফুলে গোল হয়ে থাকবে। আমাদের জন্যে মা গোলাপি, হালকা নীল, ফ্যাকাসে কমলা, সাদা এই সব রঙ বাছবেন, পুনপুনের তো খাঁকি আর কালো ছাড়া পেন্টুলই নেই। ওদিকে বুনবুন পরে আগুনের মতো লাল, টিয়েপাখির মতো সবুজ, শীতের বেগুনের মতো ঘোর বেগুনি সব জামা। আমাদের তিনজনের মধ্যে বুনবুন হিরো। বুনবুনকে আমরা পুজো করি বললেই ঠিক বলা হয়।

কিন্তু নেমন্তন্নবাড়িতে শেষ পর্যন্ত আমাদের নিয়ে এমন হট্টগোল হয় যে আমরা অত্যন্ত বিরক্ত হই।

—‘দিদি এসেছো? হ্যাঁ গো তোমার সেই যমজ তিনটে!’

—‘এই তো! এই তো!’

—‘ও মা! ছেলে দুটো একদম এক রকম দেখতে!’

—‘এক রকম জামা পরিয়ে রাখ না কেন? আমি হলে তাই করতুম।’

—‘গুলিয়ে যাবে, বুঝলি না, একে খাওয়াতে ওকে খাইয়ে দেব।’

—‘মাসি, ও মাসি, তোমার কোলেরগুলো কই?’

এই ‘কোলের’ কথাটায় আমাদের তিনজনেরই প্রভূত আপত্তি। আমরা মোটেই ‘কোলের’ নই। গটগট করে হাঁটি, নিজে নিজে খাই, নিজে নিজে কলঘরে যাই, যদিও ছিটকিনিটা উঁচুতে বলে নাগাল পাই না বলে কলঘরের দরজা বন্ধ করতে পারি না বলে পাছে দুষ্টুমি করে আটকে যাই বলে কোনও না কোনও দাদা বা দিদি পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা মায়ের কোলে উঠি না তো! আমাকে তো পালক ছাড়া কেউই কোলে নিতে পারে না, আমি ভীষণ ভারী। তবে? ‘কোলের’ কেন বলবে? ভীষণ অপমানজনক। নিজেদের মধ্যে আমরা বলাবলি করি—‘বিয়েবাড়ি বিচ্ছিরি, খালি যমজ যমজ, খালি কোলের কোলের, কী নাম কী নাম, কার মেয়ে, কার ছেলে—বিচ্ছিরি।’

এরই মধ্যে আবার একটা পরী উড়ে এসে বলে—‘দেবুদি, ও দেবুদি তোমার মেয়েটাকে আমায় দেবে? দাও না গো, একটা মেয়ের কী যে শখ আমার। তিনটে ধ্যাধ্‌ধেড়ে ছেলে, গুণ্ডামি করে করে আমার মাথা খারাপ করে দিলে। দাও না গো!’

পরীটা আমায় কাছে টেনে নিতে যায়। আমি শক্ত কাঠ হয়ে মার আঁচল মুঠো করে পাকিয়ে ধরে থাকি। পারলে মায়ের গায়ের চামড়াসুদ্ধু মুঠো করে ধরে থাকতুম। নিয়ে নেবে না কি?

—‘কী নাম? বিদ্যা? ও মা, ও রকম নামে ডাকা যায় না কি? তুই একটা বাবলি। এই বাবলি, আমার সঙ্গে যাবি? কী সুন্দর পাখি দেব।’

চোখের জল কোনওমতে চেপে ধরা-ধরা গলায় বলি—‘আমার খগ্‌গোশ আছে।’

—‘ওমা, খরগোশ আছে, তোর খগ্‌গোশ আছে?’

পরী হেসে খুন হয়ে যেতে থাকে। আশেপাশে আরও সবাই যোগ দেয়।

পাগল না কি এরা। ‘খগগোশ আছে’-তে হাসির কী হল? এত হাসি?

—‘আমিও খরগোশ দেব তোমাকে বাবলি, আমাদের বাড়ি হরিণ আছে।’

‘বুবু আমি বলি। দু হাতে বুড়ো আঙুলের ওপর মাঝের দুটো আঙুলের মাথা চেপে ধরে, তর্জনী আর কড়ে আঙুল খাড়া রেখে আমি হরিণ তৈরি করি। অটোমেটিক হয়ে যায়।

পরী এবং তার সঙ্গীসাথীরা পাগলের মতো হাসতে থাকে।

—‘কী মিষ্টি, কী মজার, দাওনা গো দেবুদি। তোমার বুবুকে দাও না।’

—‘নে না, আমি কি বারণ করেছি?’

—‘আয় বাবলি, ও না না বুবু, বুবু না বললে তো আবার…’

ভ্যাঁ-ভ্যাঁ। আমি একা নই। পুনপুনও আমার ফ্রক মুঠো করে ধরেছে।

—‘না-আ, ও যাবে না’, বলতে বলতে সে ফোঁপাতে থাকে। আমি তো মায়ের ওপর অভিমানে একবারে গরম জলের ফুট ধরার মতো ফুটতে থাকি! মা আমাকে দিয়ে দেবেন? অনায়াসে? এমন অনায়াসে? পরী আমাকে নিয়ে যাক না-যাক, মায়ের এই দানপত্র আমাকে এত ব্যথা দেয় যে বুকের ভেতরটা হু-হু করতে থাকে।

বুনবুন আমাদের সঙ্গে বাড়ি আসে সেদিন। রাত্তিরে শোয়া কী রকম হবে? আমি আর পুনপুন মায়ের দু পাশে শুই। মা আজকে বিধান দিলেন, পুনপুন এক দিকে বুনবুন আর এক দিকে, আমি মাথার কাছে শোবো। টেবিলে কাঁটা ছুরি চামচ সাজানো হয় দেখেছেন তো? সেই চামচের জায়গায় আমি। মা প্লেট, পুনপুন বুনবুন কাঁটা ছুরি। বাঃ! কী নিষ্ঠুর।

‘রে মোহিনী রে নিষ্ঠুরা ওরে রক্তলোভাতুরা

কঠোর স্বামিনী

দিন মোর দিনু তোরে শেষে নিতে চাস হরে

আমার যামিনী!’

প্রথম দফার ঘুমটা আটকানো যায় না। কিন্তু আধোরাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়? সন্তর্পণে বুনবুনকে টেনে সরিয়ে দিই। আমার গায়ে খুব জোর তো! যে ফাঁকটুকু তৈরি হয় তার মধ্যে আমি নিজেকে ঢুকিয়ে দিই, মায়ের গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যাই। মাকে আমার দিকে আকর্ষণ করি। ঘুমের মধ্যে মা আমার দিকে পাশ ফিরে যান। পুনপুন আর বুনবুনকে বঞ্চিত করার বিপুল দুঃখ বুকে নিয়ে আমি মাকে একা অধিকার করে থাকি। তবু বিরহবোধ ফুরোয় না। পাশে শুয়ে, মায়ের হাত আমাকে জড়িয়ে, মায়ের বুকের ওম আমার শরীরে তবু ভেতরটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, ‘মা, ওমা, এসো, মা আমাকে কোলে নাও, নাও না মা-আ!’

দশম অধ্যায় : আকালাসুর

কাকে বলে মন্বন্তর, আকাল কী—এসব প্রশ্ন আমাদের মনে কখনও ওঠেনি। কেননা কথাগুলো আমরা আদৌ শুনিনি। যে কথাটা শুনতুম সেটা হল ‘যুদ্ধের বাজার’, ‘জিনিসপত্র মাগগি/ আক্রা’ কিংবা ‘চালের দর চল্লিশ টাকা’। দেখেছিলুম যেটা সেটা হল— নানা শ্রেণীর ভিখারি। এরা আমাদের মনে তেমন করুণা জাগাত না। কেননা মনে হত নাটক দেখছি। যদিও নাটক কী তা জানতুমই না। আমাদের শৈশব-চেতনা থেকে সহস্র যোজন দূরে ছিল অভাববোধ, উৎপীড়ন ও দয়া-দাক্ষিণ্য ইত্যাদি সব কিছু মানবিকতা। আমরা সব এক-একটি ছোটখাটো সেলফিশ জায়ান্ট ছিলুম। জেনেশুনে নয়, অজ্ঞাতে অজ্ঞানে।

সুরুল ছাড়ার পর মায়েদের জীবনে দারুণ অর্থসঙ্কট যায়। সুরুলে অন্নের অভাব ছিল না। কিন্তু কলকাতায় আসার পর সুরুল থেকে চালের স্রোত আসা ক্রমে বন্ধ হয়ে গেল। লিগ সরকার সম্ভবত লেভি করে চাল কিনতে আরম্ভ করল, বোমার ভয়ে যারা ওখানে ভিড় করেছিল তারা রীতিমতো গোলা আটক করল, কোনও চাল বাইরে যেতে দেবে না। নতুন জায়গায় এসেই বাবার পসার জমে যাবে এটা তো আশা করাও বাতুলতা। এখানে আবার প্রাইভেট কোচিং বা পাঠশালেরও তেমন সুবিধে হল না। ফলে শ’বাজারের ডাক্তারবাবু শ্যামপুকুরের গলিতে চলে এলেন। চেম্বার দুটো রইল। ক্রমে শ’বাজারেরটা উঠিয়ে দিলেন। আমরা ষোল আনা না হলেও দশ আনা ঠাকুর্দাদার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লুম। এই সময়ে ন্যায্য মূল্যে চাল দিয়ে আমাদের যাঁরা বাঁচিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে পয়লা নম্বর আমাদের মামার বাড়ি। হরিপালের জমি-জমা যক্ষের মতন আগলাতেন মেজদাদাভাই অনন্তপ্রকাশ, তিনিই বীরবিক্রমে চাল আনতেন কলকাতায় পরিবারের জন্য। সেই চালেরই ভাগ পেতুম আমরা। মেজদাদাভাইয়ের কীর্তির কথা বলি। টিনের পেল্লাই ট্রাঙ্কে চাল ভরে তার ওপর চেপে বসে আসছেন, হাতেও দুটি বোঁচকা, ভর্তি চাল।

ট্রেনে এক ধরনের ঠোঁটকাটা খ্যাঁকখেঁকে মতো যাত্রী থাকে না! সেই লোকটি বাড়ানো হাঁটুর ওপর চ্যাটালো হাত রেখে এগিয়ে বসে সোজাসুজি মেজদাদাভাইকে আক্রমণ করে— ‘লজ্জা করে না মশাই! দেশ থেকে দেশবাসীর মুখের চাল নিয়ে গিয়ে শহরের বাজারে বেচছেন! মানুষ আপনারা, না কসাই!’

—‘কসাই ঠিকই, তবে আমি নয়, আজ্ঞে, আপনি।’ এইটুকু বলে মেজদাদাভাই চুপ।

—‘অর্থ? অর্থ কি এর? অমনি আমাকে একটা যা-নয়-তাই বলে দিলেন?’

—‘যা-নয়-তাই-ই যদি হয়, তবে সেটা আমি বলিনি, আপনি বলেছেন, ট্রেনের দাদারা সাক্ষী আছেন।’

এইভাবে আসল ইস্যু গুলিয়ে যাবার অনেক পরে মেজদাদাভাই প্রকাশ করেন, তিনি একজন স্বজনবিরহিত চিরদুঃখী প্রবাসী। তাঁর পুরো একান্নবর্তী সংসার কর্ম এবং স্কুল-কলেজ উপলক্ষে কলকাতায় বাস করছে, তিনি একা হরিপালের জমিজমা সমস্ত সামলান, আর হপ্তায় হপ্তায় বিরাট ফ্যামিলির অন্ন নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেন।

—‘শুধু কি চাল? ডাল, মুগ, পাটালি, সর্ষের তেল, নারকেল তেল, কী নয়? এই যে ট্রাঙ্ক দেখছেন? জামাকাপড় ভেবেছেন? রাম বলো! ওসব পাটালি। ছয় ভাইয়ের সংসার। ছেলে-পিলে মা ষষ্ঠীর কৃপায়… পাটালি নইলে হয়? আপনারাই বলুন। ভগবানেরই বা কী বিচার আর দাদাদেরই বা কী?

বাঙালি ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে ফাজিল ফক্কড় মিচকে পটাশরা তো সংখ্যায় নেহাত কম নয়। তেমনই একজন খ্যাঁক করে হেসে বলল, ‘ট্রাঙ্ক ভর্তি পাটালি? তো একখান ভাঙুন না দাদা, কামরাসুদ্ধ লোকে প্রসাদ পাক।’

— ‘ও গুড়ে বালি দাদা।’ মেজদাদাভাই দেঁতো হেসে বললেন। ‘দেশে থাকি আমি আর আমার পরিবার। তা পরিবার ট্রাঙ্ক গুছিয়ে, চাবি দিয়েই, চাবি নুকিয়ে রাখেন। ডুপ্লিকেট আছে কলকাতায় বউদিদির কাছে। তিনি ছাড়া কেউ খুলতে পারবেন না। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? আমার পুঁটলিতে আছে দু একখান, ধরুন বার করছি।’

পুঁটলি থেকে পাটালি বেরোয়। সাগ্রহে সব হাত পাতে। মুহূর্তে পাটালি লোকেদের জিভস্থ হয়। পরস্পরে চোখ-চাওয়া-চাওয়ি চলতে থাকে।

—‘কেমন, বলুন?’ গর্বের হাসি চিকচিক করছে মেজদাদাভাইয়ের চোখে।

—‘তোয়ের করেছে কে?’ একজন পাটালিখাদক প্রশ্ন করেন।

—‘সম্বচ্ছরের পাটালি আমার পরিবার মানে আপনাদের বউঠাকরুন তোয়ের করেন। জোগাড়ে দু-একজন আছে কিন্তু উনিই সব। ওঁর হাতের তারই আলাদা।’

—‘তা আর বলতে!’ গোপনে মুখের পাটালির কুচি থুথু করে ফেলতে ফেলতে সহযাত্রীরা বলেন, ‘বউঠাকরুনের হাতের তারই আলাদা।’

পাটালি হাকুচ তেতো।

কলকাতা এসে যেতে কুলির মাথায় পেল্লাই ট্রাঙ্ক তুলে দিয়ে মেজদাদাভাই যখন বাড়ির পথ ধরেন, তখন সহযাত্রীরা গা-টেপাটেপি করে হাসিতে ফেটে পড়ে।

—‘সাবধানে দাদা।’

—‘সামলিয়ে, ট্রাঙ্ক সামলিয়ে।’

—‘বউঠাকরুনের নিজের হাতের জিনিস কি না!’

নানাবিধ মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে গৌরবের হাসি হাসতে হাসতে মেজদাদাভাই ছ্যাকরা গাড়িতে ওঠেন। মুখ গম্ভীর হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। বলেন— ‘ছপ্‌টি চালা। তুরন্ত যাওয়া চাই।’

চালের দ্বিতীয় জোগানদার ছিলেন আমাদের পাড়ার পাকুমা। ইনি এক অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু পরিবারের গৃহিণী। বাবা এঁর বহুদিনের সায়াটিকার ব্যথা আরাম করে দেওয়ায় ইনি বাবাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতে আরম্ভ করেন। কলকাতায় বাবার প্রথম কংকোয়েস্ট ইনিই, এবং ইনিই বাবাকে ধন্বন্তরী নাম/ উপাধি দেন। পাকুমা জিজ্ঞাসাবাদ করবারও ধার ধারতেন না। যখন-তখনই চাল, ডাল, ফলফুলুরি, দুধ ইত্যাদির সিধে সাজিয়ে তিনি আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন।

— ‘ধন্বন্তরীর সিধে এয়েচে গো!’ ওঁদের বাড়ির মোক্ষদা হাঁকত। ‘ও টেকন তাড়াতাড়ি ধর না, মাথাটা যে গেল।’

বাবা এতে আপত্তি করলে পাকুমা বলতেন, ‘আপনি আমার গৃহ-চিকিৎসক। ঈশ্বরতুল্যও বটে, পুত্রতুল্যও বটে। চিকিৎসক, শিক্ষক, পুরোহিত এঁদের গুরুবারে সিধে দেওয়া আমাদের কুলপ্রথা যে।’

তবে এতৎসত্ত্বেও শুনেছি, আমাদের দাদা-দিদিদের অনেক সময়ে রাঙালু সেদ্ধ, আলুসেদ্ধ, এসব খেয়ে দিন গেছে। আমরা যখন একটু বড় হয়ে গেছি তখনও প্রতি সকালে ই-দাদার তত্ত্বাবধানে ভাতের ফেন পরিষ্কার ডেকচিতে গালা হত। কিছুক্ষণ পরই তাতে মোটা সর পড়ত। সেই সর তুলে ফেলে দিয়ে, চিনি, নুন ও লেবু মিশিয়ে সরবত করা হত। ফেনের সেই সরবত এক চুমুকে শেষ করে, তবে দাদা-দিদিদের সারা দিনের কাজ আরম্ভ হত। এতে পিসিমার খুব আপত্তি ছিল। তাঁর নানা ধরনের সংস্কারের একটা ছিল—

ফেন খায় ছেলে

ঘ্যানঘ্যানে কেলে।

তাই আমাদের ফেন খাওয়াতে তাঁর প্রভূত আপত্তি ছিল। আর একটা সংস্কার ছিল

ফেন খায়

তো সব যায়।

অর্থাৎ ফেন খেলে চিরনিঃস্ব হবার ঝুঁকি থেকে যায়। ই-দাদা এসব বলা বাহুল্য মানত না। সে আমাদের রান্নাঘরের সামনে লম্বা কিউ করে দাঁড় করিয়ে দিত। পালক দিয়ে আরম্ভ, পুনপুন দিয়ে শেষ। পুনপুন আর আমি হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকতুম। কিছুতেই হাত ছাড়তুম না। এই বিশাল কিউয়ের মধ্যে যদি কোনওমতে একবার হারিয়ে যাই, কিছুতেই আর পরস্পরকে খুঁজে পাব না, এমনি ছিল আমাদের ধারণা। সেই প্রতিদিনের দেখা রান্নাঘর। প্রতিদিনের ই-দাদা, সু-দাদা, পমপম-টমটম, বুজবুজ-পুটপুট দিদিরা সেদিন আমাদের কাছে বিশাল জনগণেশ হয়ে দাঁড়াত।

কিছুতেই ই-দাদার সঙ্গে না পেরে অবশেষে পিসিমা বিদ্রোহ করেন। — ‘তোর নজ্জা নেই রে ইন্দু, ভিখিরিগুলো একটু ফেন চায়, তাতেও বাদ সাধছিস?’

—‘আপনাকে নজ্জা পেতে হবে না পিসিমা, আমি ওদের জানিয়ে দেব, এ-বাড়িতে ফেন সকালবেলার জলখাবার, দেওয়া যাবে না। সেই সঙ্গে ঠাকুর্দাকেও ডেকে আনব।’

ঠাকুর্দা ভিখারি দু’চক্ষে দেখতে পারেন না, তাই ঠাকুর্দার অবতারণা।

সঙ্গে সঙ্গে পিসিমা বলবেন— ‘ভিরকুট্টি, ভিখিরিকে চাল দেবে না, ফেন দেবে না, পয়সা দেবে না, সে বাঁচবে কী করে?’

—‘বেঁচে কাজ নেই, বেঁচে কাজ নেই,’ ঠাকুর্দা হুঁকো হাতে সশরীরে এসে উপস্থিত। সুগন্ধ তামাকের গন্ধে দালান ভরপুর। আমি আর পুনপুন বেশি করে প্রশ্বাস টানছি। আমাদের ভেতরে হুঁকো সম্পৰ্কীয় কোনও গোপন সংকল্প জন্ম নিচ্ছে।

— ‘স্পার্টার নাম শুনিছিস?’ ঠাকুর্দা পিসিমাকে বলছেন। স্পার্টা! স্পার্টা! স্পার্টা! কী সুন্দর! আমি পুনপুনকে বলি— ‘আমি বেশ স্পার্টা, হ্যাঁ?’ পুনপুন ঠোঁট ফুলিয়ে বলে— ‘সবই তুই হবি, না? সেদিন যে তুই কাননবালা হলি? আমি বলি— ‘ঠিক আছে, কাননবালাটা আমি তোকে ছেড়ে দিচ্ছি। তুই স্পার্টাটা আমাকে দে।’ কিন্তু কাননবালার ওপর থেকে আমার যেমন, পুনপুনেরও তেমন মন সরে গেছে। আমরা দু’জনেই মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে থাকি। এই সময়ে একটি নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয় আমাদের সামনে। পিসিমা তদীয় পিতাকে বলছেন —‘যা করছেন, তাতে বাড়িসুদ্ধ সব্বাইকে কুম্ভীপাকে নিয়ে যাচ্ছেন।’ এই নতুন ভ্রমণের সম্ভাবনায় আমরা দু’জনেই খুব খুশি হয়ে যাই। স্পার্টা বা কাননবালা না হতে পারার দুঃখ পুরোপুরি ভুলে গিয়ে আমরা কুম্ভীপাকে যাবার জন্যে কী কী নেব, তার তালিকা করতে থাকি।

পুনপুন—‘টেকনের বিড়ির বাকসোটা আমি নেব। আর গুণ্ডির বটুয়াটা তুই।’

আমি— ‘রাসমণির গোলাপ ফুল দেওয়া সুটকেসে তোর জামা থাকবে, আমারটা যাবে ঠাকুদ্দার গ্ল্যাসটোন ব্যাগে।’

রাসমণির গোলাপ ফুল দেওয়া সুটকেসে জামা-কাপড় নিয়ে কুম্ভীপাকে যাবার সম্ভাবনায় পুনপুন বেশ খুশি হয়ে ওঠে। আর গ্ল্যাসটোন ব্যাগ তো আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। যদিও দু’জনেই জানি রাসমণির সুটকেস এবং ঠাকুর্দার ব্যাগ হাতানো মোটেই সোজা কাজ হবে না। টেকনের বিড়ির বাকসো আর গুণ্ডির বটুয়া সম্পর্কেও ওই একই কথা। তবু, স্বপ্নে পোলাও খেলে তো মানুষ ঘি বেশি করেই ঢালে। যে আমরা আজ পর্যন্ত সজ্ঞানে লিলুয়া-দর্শনও করিনি, কুম্ভীপাকের মতো একটি সুদূর জায়গায় ঠাকুর্দা সেই আমাদের সত্যিই যে শেষপর্যন্ত পাঠাবেন এ বিষয়ে যথেষ্টই সন্দেহ আছে। তবু…।

আলোচনা বেশ চমৎকারই চলছিল। আমাদের কোনও মতবিরোধ ছিল না। দু’জনেই রেডি, যাব কুম্ভীপাক। এই সময়ে কুম্ভীপাকের অবস্থান নিয়ে আমাদের চুলোচুলি বেধে যায়। অপরাধের মধ্যে আমি বলেছিলুম কুম্ভীপাকটা যখন যাচ্ছিই, তখন স্পার্টা যেতেই বা ক্ষতি কী? জায়গা দুটো তো পাশাপাশি, যেমন কলকাতা-হাওড়া। সুরুল-বোলপুর। কিন্তু পুনপুন এইখানে বেঁকে বসে। তার কথায় যথেষ্ট যুক্তি ছিল। পুনপুন বলে স্পার্টা তো কোন জায়গা নয়, মানুষের নাম। সে আমাকে মনে করিয়েও দেয় যে কিছুক্ষণ আগেই আমি নিজেকে স্পার্টা বলে জাহির করছিলুম। যেহেতু কোনও মানুষের নাম, সেহেতু স্পার্টায় যাওয়াও যায় না। এতে আমি ধৈর্য হারিয়ে পুনপুনের ওপর লাফিয়ে পড়ি। আমার আক্রমণের ধরনই ছিল এরকম। সাধে কি আর মা আমাকে সিংহ-মেয়ে বলতেন! আমার সব কিছু হাতেনাতে। আজকালকার দিনের ‘আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে’ সব কিছু স্থির করার নীতি কখনও আমার ছিল না।

আমাদের ছাড়াবার চেষ্টায় সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের দাসী অন্ন মন্তব্য করে— ‘এই ধুমসিটাই খোকাকে মেরে ফেলবে একদিন’, সে খ্যানখ্যান করে চিৎকার করে বলেছিল কথাটা। আমার চোখের সামনে তৎক্ষণাৎ বিদ্যুদ্‌গতিতে চলচ্চিত্র খেলে যায় ছবি নং এক আমি (ধুমসি) লাফিয়ে পড়ছি পুঁটকে খোকা (পুনপুন)-র ওপর— ছবি নং দুই— পুনপুন (খোকা) মাটিতে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেছে। ছবি নং তিন— ঠাকুর্দাদা প্রাণপণে নাড়ি দেখছেন। ছবি নং চার— চারদিকে হাহাকার। মা, বাবা, দাদারা, দিদিরা। আমি পুনপুনের পায়ের কাছে। ঠাকুর্দা মাথা নেড়ে বলছেন— ‘মরে গেছে।’

আমার হাঁ বোজে না। আমি এক বিকট আর্তনাদ করে মেঝেতে আছড়ে পড়ি — ‘না, আমি পুনপুনকে মেরে ফেলব না আ-আ।’ কাঁদতে কাঁদতে আমি নীল হয়ে যাই। নাকের জলে চোখের জলে এক। পুনপুন স্বয়ং পরিস্থিতির সামাল দিতে সরু গলায় আমায় বলতে থাকে— ‘আমি জানি বুবু, আমি তোকে মেরে ফেলব, তবু তুই আমায় মেরে ফেলবি না।’ এহেন কায়দার বাক্যেও আমার মন মানে না। পালক আমায় তুলে নিয়ে যেতে থাকে এবং বাবা বজ্রগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করেন অন্নর আর পরদিন থেকে আসবার দরকার নেই।

এ ঘটনার পরেও যখন আমি নির্লজ্জভাবে অন্নর উল্লেখ করব, আপনারা বলবেন, এনার কালাতিক্রমণ দোষ ঘটছে। অন্ন তো কবেই বরখাস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু না, আমার কোনও দোষ হয়নি। অন্ন সার্ভাইভ করে। পিসিমা তাঁর সইকে ছাড়বেন কেন! তিনি অন্নকে নাক খত দেওয়ান ছোট ছেলেপিলের মনে আঘাত দেবার জন্যে। কিন্তু পরিশেষে অন্ন আট আনা মাইনে বাড়িয়ে নিয়ে কাজে বহাল থাকে।

এ-দিকে আমি ‘পুনপুনকে মেরে ফেলতে পারি’ এই অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়ে দিনের পর দিন অশ্রুমুখী, মৌনী, খাবারদাবারে নিস্পৃহ হয়ে থাকি। অবশেষে বাবা বালুসাই এনে আমার মান ভাঙান। বাক্স-ভর্তি বালুসাই নিয়ে তিনি অদূরে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে থাকেন :

‘ভুলুবাবু কাঁদছেন তো দাও না গো কাঁদতে

ময়রাকে বলে দাও জিভেগজা আনতে

অং খাবে টং খাবে আর খাবে মিন্তু

ভুলুর তরে জিভেগজা আর নাই কিন্তু,

কি ভুলু, থামালে যে সনাতন-কান্না?

তবে ভাই বালুসাই কিনে তুই আন না।’

ছড়াটি প্রচলিত কোনও মনোমোহন কবির তা মনে পড়ছে না। কিন্তু ‘শিশুভারতী’র পাতায় ভুলুবাবুর কান্নার ফিরোজা গোলাপি ছবি দেখে আমরা মোহিত হয়ে যেতুম এবং গুরুজনরা ইচ্ছেমতো সেই ছড়াকে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বিকৃত করে ব্যবহার করতেন।

যাই হোক, এই ছড়া আমাদের এতই প্রিয় ছিল যে বুবুদিদি থেকে ভুলুবাবু হতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করতুম না। এবং হাতেনাতে বালুসাই পেয়ে তখন ভুলুবাবু এমনই খুশি যে কান্নার মধ্যে দিয়ে ফিকফিক করে হেসে ফেলেছে।

সঙ্গে সঙ্গে বাবার দ্বিতীয় ছড়া : ‘মেঘলা ভেঙে সুয্‌যিমামা বেরুচ্ছেন বেরুচ্ছেন।’ ঘুরে ঘুরে হাতে তালি দিয়ে নাচ এবং গান ‘মেঘলা ভেঙে সুয্‌যিমামা বেরুচ্ছেন বেরুচ্ছেন।’

অতঃপর সকলে মিলে বালুসাই ভক্ষণ। আমি গোটা বালুসাই পাই। বাকিরা আধখানা, সিকিখানা। ফুটবল টিমের মতন-পরিবার। তেমন তেমন দিনে তিন-চারখানা হাঁসের ডিম ভেঙে বাড়িসুদ্ধ সবাই খাওয়া হয়েছে, তবু কেউ বাদ যায়নি। আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখি পুনপুনের আধখানা শেষ। সে করুণ চোখে আমারটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি নিষ্করুণভাবে আমার অতিরিক্ত আধখানা শেষ করি। ওকে এক কুচিও না দিয়ে। যদিও দুঃখে বুক ভেঙে যায়, এবং বহুদিন স্বপ্নে আমি পুনপুনকে— ‘আধখানা বালুসাই দেবে গো’ বলে ভিক্ষে করতে দেখি। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে একটা সময়ে আমাদের ভোরবেলায় ঘুম ভেঙেই খিদে পেত বলে মা একটি অ্যালুমিনিয়মের টিফিন কৌটোয় দু’জনের জন্যে দুটো গজা, কী পেঁড়া, কী চমচম বা অন্য কিছু শুকনো মিষ্টি রেখে দিতেন। পুনপুন আগে উঠলে নিজের ভাগেরটা খেয়ে খেলতে বসে যেত। আমি আগে উঠলে দুটোই খেয়ে নিবিড়ভাবে ঘুমিয়ে পড়তুম। পুনপুনের রাগত কান্নায় আমার ঘুম ভাঙবার অনেক আগেই মা বেচারি তৃতীয় গজা সাপ্লাই দিয়ে দিয়েছেন। ঘুমও ছিল আমার এমনি গভীর। এখন রাতের পর রাত নিঘুম চোখে আকাশের দিকে চেয়ে বলি— আকাশ আকাশ, তুমি কি আমার পুনপুন? তুমি কি আমার বুনবুন? গজা খেয়ে নেওয়ার শোধ নিতে আমাকে জাগিয়ে রেখে তুমি কি ঘুমোচ্ছ? আকাশ আকাশ, তুমি কি আমার পমপম দিদি, টমটম দিদি নও? আমাকে ঘুম পাড়াবে না? আকাশ, আকাশ, ও আকাশ তুমি কি আমার সু-দাদা ই-দাদা নও? কাঁধে করে বেড়াবে না?

যাই হোক, এমনি আত্মমগ্ন, পরিবারমগ্ন, পরস্পরমগ্ন আত্মপর না কি আত্মস্থ ছিলুম আমরা ছোটরা যে রাঙালু-সেদ্ধ খাওয়ার, সামনের বাড়ি থেকে সিধে আসার, মামাবাড়ি থেকে চাল-দুধ আসার ছোটবেলাকে আমরা আকাল বা যুদ্ধের বাজার বলে বুঝতেই পারিনি। কিংবা বুঝতে পেরেও আমাদের আত্মা-পুরুষ ধ্বংস করেছিল তাকে বেঁচে থাকার প্রবল আগ্রহে ও আনন্দে।

মার্কসিস্টরা বলবেন পাতিবুর্জোয়া, টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত মেন্টালিটি। নিজেরটি হলেই হল। অন্যান্য শ্রেণী সম্পর্কে অচেতন। দ্বারে ভিখারি কেঁদে যাচ্ছে, শিশু এমনই যে তার মনেও রেখাপাত করছে না। মধ্যবিত্ত শিশুও এইরকমই পাতিশিশু।

পাতিকাক পাতিহাঁস পাতিলেবুর মতো আমরা পাতিশিশুরা যেখান থেকে যা পারি খুঁটে খেয়ে মেখে দিব্যি চিকন-চাকন হয়ে উঠছিলুম এবং হাতে পয়সা পেলেই এক ছুট্টে চিনেবাদাম, কিংবা মৌরি লজেন্স বা হার্সেস চকলেট কিনতে ছুটছিলুম। মৌরি লজেন্সকে আমরা মুড়ি লজেন্স বলতুম। সম্ভবত ধ্বনিসাদৃশ্য ও গোল গোল মুড়ির আকারের সঙ্গে সাদৃশ্যের জন্যে। ভেতরের মৌরির জন্য যে এদের মৌরি লজেন্স নাম এ কথা পরে জেনে বিশেষ শান্তি পাইনি। মুড়ি লজেন্স যদি হঠাৎ মৌরি লজেন্স হয়ে যায় আর চার্ম থাকে?

সত্যি কথা বলতে কি, শিশুকালের সেই ভুখা-মিছিল আমাদের দেখার কথা নয়। কিন্তু আকাল তো আমরা নিয়েই এসেছিলুম। তাই প্রকৃত আকালের পরেও প্রায় প্রায়ই আমরা আকাল দেখতুম। ‘এক মুঠো ভাত দাও মা’ বলতে বলতে ক্লান্তপদ খরচক্ষু ভিখারিরা দিনযাপনের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। পৃথিবী মানে যেমন সকালবেলার ফুটন্ত এবং বিকেলবেলার পড়ন্ত রোদ, পৃথিবী মানে যেমন তিন-চার গাছি সুপুরি গাছের আমূল দোলন, পৃথিবী মানে তেমনই ভিখারিও। ছেঁড়া ন্যাকড়া-কানি পরা, হাতে-লাঠি, পায়ে ব্যান্ডেজ, টিনের-মগ-ঠনঠনানো ভিখিরি সব। মাঝেমধ্যেই একখানা বড় চাদরের চার খুঁট চারজনে ধরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ফর্সা-কাপড় পরা অন্যরকম ভিখিরারাও বেরিয়ে পড়ত।

‘দান করো মা, দান করো মা, দান করো মা, করো মা, বাবার নামে দান, দান করিলে অসৎ পথে যাবে না।’

মেঠো সুরে গাইতে গাইতে যেত তারা। সব বাড়ির দোতলা থেকে কাপড়-জামা পয়সা চাল ঝুপঝাপ ঝরঝর করে পড়ত চাদরের ওপর। আমরা আমাদের টঙের জানলা থেকে দেখতুম সোজা-পথ, বাঁকা-পথ পায়ে-চলা পথের মতো একরকম পথ, অসৎ পথে যাতে না যেতে হয় তাই সবাই কেমন দান করছে। পুনপুন পরামর্শ দিত— ‘চল রে বুবু, আমরাও বাবার নামে দান করি। তা’লে আর অসৎ পথে যেতে হবে না।’ তখন, যে ফ্রকটা আমার দু’চক্ষের বিষ ছিল সেই ফ্রক আর বাবার পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ফুটো পয়সা বার করে আমরা ছুট্টে গিয়ে টঙের জানলা থেকে দান করতুম।

—‘আমাদের বাবার নাম দুগ্‌গি, দুগ্‌গির নামে দান করলুম।’ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতুম আমরা, নিজেদের বদান্যতায় নিজেরাই মুগ্ধ হয়ে।

এইরকমই ছিল আমাদের আকালের সঙ্গে মোকাবিলা।

একাদশ অধ্যায় : ছদ্মবেশী অসুর-অসুরিণী

ভিখিরিদের প্রতি সদয় না হবার একটা মস্ত বড় কৈফিয়ৎ আছে অবশ্য আমাদের। রাবণ তো ভিক্ষে নিতে এসেই সীতাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল কিনা। শূর্পণখাও তো ভিখারিণীই। প্রেমভিখারিণী অবশ্য। কিন্তু অতশত তো আমরা বুঝতুম না। আমাদের চেতনায় শূর্পণখা একটি ভালোমানুষের মেয়ে সেজে আসা রাক্ষসী, যে রামের কাছে রাম-ভিক্ষে এবং লক্ষ্মণের কাছে লক্ষ্মণ-ভিক্ষে চাইতে এসেছিল। পমপমদিদি গল্পটা যেভাবে কায়দা করে বেঁকিয়ে চুরিয়ে আমাদের বলে তাতে এই ভিক্ষের ব্যাপারটাই প্রাধান্য পায়। এই কায়দাটা পমপমদিদির কাছে শিখে নিতে পারিনি বলে নিজের ছেলেপুলেদের বেলায় প্রয়োগ করে উঠতে পারিনি। বিয়ের কথা বলে ব্যাপারটা চাপা দেবার চেষ্টা করি, কিন্তু ছেলেমেয়ে দুজনেই সঘৃণায় প্রতিবাদ করে—‘রাম লক্ষ্মণের তো সীতা-ঊর্মিলার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে, আবার শূর্পণখার সঙ্গে বিয়ে কী করে হবে?’ এটা বলেই তারা বিজ্ঞের মতো হেসেছিল, অর্থাৎ ‘এ ম্যা, শূর্পণখাটা কী বোকা!’ হায় শিশু তোমরা একস্ট্রা-ম্যারিটালের রহস্য সম্পর্কে কিছুই জানিলে না, সরলমতি তোমরা বহুবিবাহের মহিমা তো প্রত্যক্ষই করো নাই।

শুধু রাবণ-শূর্পণখা কেন? ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র রূপতরাসী ভর্তি যে রাক্ষস-রাক্ষুসী, খোক্কস-খোক্কসী? কে সুন্দরী মেয়ে সেজে, কে দুঃখিনী মেয়ে সেজে রাজা-রাজকুমারকে ভুলিয়ে রানি হয়ে বসছে, তারপর চুল ছুঁড়ে গায়ে মারতেই ‘রাজা বোকা হইয়া যাইতেছেন, নিত্যই রাজার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে!’ কাজেই আমরা রাস্তা ভর্তি রাবণ শূর্পণখা আর রূপতরাসী দেখতে পেতুম।

খুব ভোরবেলায় গলায় খোল ঝুলিয়ে গান গাইতে গাইতে যেত উঁচু দরের বোষ্টম ভিখারি।

‘হরে মুরারে মধু কৈটভারে

গোপা-লো গো-বিন্দ মুকুন্দ শৌরে…।’

এই গানটা আমাদের খুব খারাপ লাগত। লোকটার খনখনে গলা। নস্যির গুঁড়ো, বিড়ির গন্ধ সব কিছু বেরোত গানটা থেকে। ‘কৈটভারে’ আর ‘মুকন্দ শৌরে’ কথাগুলোকে কেন জানি না আমাদের বিচ্ছিরি বুড়োটে-বুড়োটে লাগত। ‘শৌরে’টা তো রীতিমতো পাকা অসভ্য কথা বলে ভাবতুম। পরে যখন ‘শৌরি বাসুদেব’ এই শব্দদ্বয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলুম তখন ভাবতুম এই মহাজাগতিক ধ্বনিনিচয়কে কী করে দুটি অবোধ শিশু অশ্লীল ভেবেছিল! শিশুকাল আর পরিণত কালের মধ্যে কি কোনও উপাদানগত পার্থক্যই আছে তা হলে?

লোকটি আরও গাইত—

‘যদি গৌরাঙ্গ না হত কেমন বা হত কেমনে ধরিত দে’

রাধার মহিমা প্রেমগুণসীমা জগতে জানাত কে!’

এটা হলেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমার কান খাড়া হয়ে যেত। টমটমদিদি খুব ফর্সা ছিল বলে বাবা তাকে ‘গৌরাঙ্গ’ বলে আদর করতেন। আমার ধারণা ছিল গানের গৌরাঙ্গ আমার টমটমদিদি। টমটমদিদির উল্লেখ থাকায় গানটা আমার বিশেষ প্রিয় ছিল। ‘কেমনে ধরিত দে’র রহস্যময় উচ্চারণ শোনামাত্র আমার গায়ে কাঁটা দিত, তারপরে যখন ‘রাধার মহিমা প্রেমগুণসীমার’ সুর সামান্য মুড়কি কাজ দিয়ে গাওয়া হত আমি অমনি লেঠা মাছের মতো উল্টে গিয়ে দু হাতে মুখ ঢাকতুম আর পুনপুন সঙ্গে সঙ্গে আমায় এক ঠেলা মেরে বলত ‘কী রে কাঁদছিস?’ এতক্ষণ কাঁদছিলুম না, একটা ঘোর ছিল, এবার কিন্তু সত্যি সত্যি চোখে জল ভেসে উঠত। মনটা হু হু করত। রাধার মহিমা প্রেমগুণসীমা সে যে কী মন কেমন করা জিনিস! ছোট্ট বুকের ভেতরটা উথালপাথাল করত। সেই কান্নাকাটি দেখলে বড়রা সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত হয়ে যেতেন আমার বুনবুনের জন্যে মন কেমন করছে। বুনবুনকে অবিলম্বে তলব পাঠানো হত। এবং সে ‘রেমো’র কাঁধে চড়ে এসে উপস্থিত হলে আমাদের খেঁল্লাবাটি খুব জমত।

‘ভজো গৌরাঙ্গ কহো গৌরাঙ্গ লহো গৌরাঙ্গের নাম রে,

যে জনা গৌরাঙ্গ ভজে সে হয় আমার প্রাণ রে!’

এ গানটাও খুব ভালো লাগত। গৌরাঙ্গের উল্লেখ থাকায়। ‘ভজো’ কথার মানে আমরা মায়ের পেট থেকে পড়েই জানতুম, কেননা আমাদের বাড়িতে খুব ভজন হত। টমটমদিদিই গৌরাঙ্গ, তাকে ভজনা অর্থাৎ পুজো করলে কারুর প্রাণপ্রিয় হওয়া যাবে এই আইডিয়াটা আমাদের প্রাণ স্পর্শ করত। সত্যিই তো টমটমদিদি তো পুজো করবারই জিনিস। কী সুন্দর ঠাকুরের মতো ফর্সা, কোঁচকা কোঁচকা ঠাকুরের মতো চুল, জলচৌকি পেতে দিবারাত্র পড়াশোনা করে, পমপমদিদি, ই-দাদা, সু-দাদা এরা তো টমটমদিদিকে পুজোই করে প্রায়!

আর একজন যেত একটু বেলায় সে যেন চটের বা জুটের বিজ্ঞাপন। মাথায় চটের ফেট্টি বাঁধা, শতচ্ছিন্ন হাফ-প্যান্টে চটের তাপ্পি মারা, নীল রঙের একটা মোটা জামাতেও তাই। কাঁধ থেকে ঝুলত একটা মস্ত চটের থলে, থলের তলার দিকটা বেশ ভারী এবং ফুলো। একে আমরা বলতুম ঝোল্লাবুড়ো। ঝোল্লাবুড়ো নামটা সম্ভবত বুনবুন কিংবা কানুমামার দেওয়া। বুনবুন প্রায়ই আসত। একদিন এসে বিনা ভূমিকায় বলল— ‘তোদের গলি দিয়ে ঝোল্লাবুড়ো গিয়েছিল?’

পুনপুন সঙ্গে সঙ্গে বলল-‘রোজই তো যায়!’

কে যে ঝোল্লাবুড়ো তা আমাদের বুঝিয়েও দিতে হল না। দেখা গেল ঝোল্লাবুড়ো প্রথমে বারো নম্বরের গলি দিয়ে যায়, পরে আমাদের গলিতে আসে। এতে আমাদের খানিকটা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স জাগে। আমরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করি যে ঝোল্লাবুডোর ভ্রমণসূচি এক এক দিন এক এক রকম। কিন্তু সফল হই না। দেখা যায় ঝোল্লাবুড়োর বারো নম্বরের ওপর পক্ষপাত দিনের পর দিন বজায় থাকছে। ঝোল্লাবুড়ো বাসি রুটির ভক্ত ছিল, লোকে আর যা ভিক্ষে দিত— চাল, পয়সা, সে সবের জন্য সে তার ঝোলা বাড়িয়ে দিত। ভাত ডাল দিলে গাঁউ গাঁউ করে খেয়ে নিত, খালি রুটিগুলি সযত্নে হাত পেতে নিয়ে ঝেড়েঝুড়ে খবরের কাগজে মুড়ে ঝোলার মধ্যে রেখে দিত। ঝোল্লাবুড়ো যে রাবণের তুতো ভাই এ সম্বন্ধে আমাদের কোনও সন্দেহই ছিল না। আমাদের উঠোনে বড় বড় চৌকো সিমেন্টের স্ল্যাব লাগানো ছিল। তার চারপাশের রেখাগুলোকে আমরা ভারি ভক্তি করতুম। ঝোল্লাবুড়োকে রুটি দেবার সময়ে মা বা পিসিমা বা দিদিরা যাতে এই গণ্ডির ভেতরে থাকেন সেটা আমরা খেয়াল রাখতুম। ঝোল্লাবুড়োর রুটিপ্রীতি একটা অতি রহস্যময় ব্যাপার ছিল আমাদের কাছে। কিন্তু কোনওদিন সে রহস্য ভেদ করবার চেষ্টা আমরা করিনি। বড়রাও করেননি। এখন বুঝতে পারি, এই রুটি শুকিয়ে গুঁড়ো করে সে নিশ্চয়ই রাস্তার ধারের চপ কাটলেটের দোকানে বিক্রি করত। এখন এটা খুবই পরিচিত ব্যবসা। কিন্তু আমার মনে হয় এই ব্যবসার আইডিয়ার প্রথম উদ্ভাবক প্রতিভাবান শ্রীল শ্রীযুক্ত ঝোল্লাবুড়ো। রুটির গুঁড়োর লগ্নিবিহীন ব্যবসাদারদের লম্বা বংশের আদি জনক আমাদের ঝোল্লাবুড়ো। অনেকে অনেক বড় বড় মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন বলে গর্ব করেন। কে গান্ধী, কে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন, আমরাও বুক ফুলিয়ে বলতে পারি আমরা ঝোল্লাবুড়ো নামক মহাপ্রতিভার সংস্পর্শে এসেছি।

ঝোল্লাবুড়ো সম্পর্কে আর একটা সন্দেহও অবশ্য আমাদের ছিল। তার অত বড় ঝোলার সবটাতেই কি রুটি থাকে? সে নিশ্চয়ই ছেলেধরা। কিংবা কিংবদন্তির সেই একানড়ে।

‘কানদুটো তার নোটা নোটা

চোখদুটো আ-গুনের ভাঁটা

কোমরে বি-চুলির দড়ি

বেড়ায় লোকের বাড়ি বাড়ি

যে ছেলেটা কাঁ-দে

তাকে ঝুলির ভেতর বাঁ-ধে

গাছের ওপর চ-ড়ে

আর তুলে আছাড় মা-রে।’

এই একানড়ে সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেন পিসিমা। মা একদিন হঠাৎ আমাদের একানড়ে ভীতির কথা জেনে ফেলেন এবং তাদের অনস্তিত্ব বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু যেটুকু ইতিমধ্যেই আমাদের কানে ঢুকেছিল সেটুকুই বেশ ভালো করে মরমে পশেছিল। একানড়েকে আমরা ভয় করতুম আবার করতুমও না। কোলরিজের সেই ‘টেম্পোরারি সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ’ আরকি! ভয় করতে ভালো লাগত তাই অবিশ্বাসটাকে সাময়িকভাবে মুলতুবি রেখে দিতুম।

আমাদের তৃতীয় ভিখারি একটি জোড়া। একজন ঠেলাগাড়িতে বসে থাকত, তার হাত পা সব ব্যান্ডেজ বাঁধা, মুখেরও চারপাশে ব্যান্ডেজ। সবই যে কতটা ময়লা তা আর কহতব্য নয়। অন্য জন গাড়িটা ঠেলত। এর একটা চোখ ছিল লিচুর শাঁসের মতো। অন্য চোখটা দুঃখী, কাতর। এরা পাড়ায় ঢুকলেই দূর থেকে পয়সা ছোঁড়া শুরু হয়ে যেত। ফুটো পয়সা, তামাটে রঙের। ডবল পয়সা আজকালকার পাঁচ পয়সার মতো দেখতে, যাকে আমি বলতুম ‘ডবলি’। এই-ই পড়ত সাধারণত। এদের সবাই কুঠে বলত।

একদিন কুঠেরা গড়গড় করে যাচ্ছে, আমরা ‘রকে দাঁড়িয়ে দেখছি, হঠাৎ আমাদের বন্ধু মানিকের পিসতুত দাদা দীপুদা চালিয়াতের মতো বলে উঠল—‘সব সাজা কুঠে। আসল কুঠে আর হতে হচ্ছে না।’ যেন কুঠে হওয়াটা খুব বাহাদুরির ব্যাপার।

কথাটা দীপুদা বেশ জোরেই বলেছিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা কাণ্ড ঘটল। যে লোকটা গাড়ি চালাচ্ছিল, তার দুঃখী দুঃখী চোখটা হঠাৎ একটা জ্বলন্ত কয়লার টুকরো হয়ে গেল। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল— ‘কী-ই? সাজা কুঠে? নিতে! দেখা তো!’ অমনি গাড়িতে বসে-থাকা লোকটা তার ব্যান্ডেজ-অলা হাত বাড়িয়ে দিল, গাড়ি-ঠেলা লোকটা ব্যান্ডেজ খুলতে লাগল। একটা ব্যান্ডেজের তলায় আরেকটা, তার তলায় আরেকটা, তার তলায় আরেকটা, তার তলায় আরেকটা। লোক জমে গেছে রাস্তায়, লোকটা ব্যান্ডেজ খুলেই যাচ্ছে। শেষকালে দেখা গেল ব্যান্ডেজের তলায় কিছুই নেই। হাতের জায়গাটা ফাঁকা। কনুইয়ের শেষ প্রান্তে ধক ধক করছে ঘা।

দেখে সবাই পালাতে লাগল। চিৎকার করতে লাগল কেউ কেউ। জ্বলন্ত কয়লার টুকরো আমাদের দিকে ছুঁড়ে লোকটা গড়গড় গড়গড় করে গাড়ি ঠেলে চলে যেতে থাকল। এরই মধ্যে কাণ্ড করল বুনবুন। সে হঠাৎ তীরবেগে রক থেকে ছুটে নেমে গিয়ে পড়ে-থাকা সেই স্তূপীকৃত ব্যান্ডেজ দু হাতে তুলে নিয়ে বলল— ‘তোমার ব্যান্ডেজ, ও কুঠে তোমার ব্যান্ডেজ নিলে না?’

—‘ফেলে দে ফেলে দে’— আমাদের বাড়ি থেকে পিসিমা চেঁচাচ্ছেন।

—‘ফেলে দে, ফেলে দে’ —অবিনাশ জেঠু চেঁচাচ্ছেন।

বিমূঢ় জনতা দাঁড়িয়ে আছে, আগুন-নেবা-ছাই চোখে কুঠেরা চলে যাচ্ছে, বুনবুন হাত থেকে ব্যান্ডেজ ফেলে দিয়ে, বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে, সাদা চুল ধবধবে ফর্সা ঠাকুর্দাদা আমাদের সদর দিয়ে বেরিয়ে বুনবুনকে কোলে তুলে নিলেন, সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও ডাক্তার হবে।’

ডাক্তার পরিবারের ছেলে তো ডাক্তার হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ঠাকুর্দাদা এমন করে বললেন যেন এটা একটা রেভিলেশন। জন দা ব্যাপটিস্ট যেন উটের লোমের পোশাক পরে, চামড়ার কৌপীন পরে বলছেন— ‘আমার চেয়েও শক্তিমান একজন, সেই একজন আসছেন।’ যোগমায়া যেন আকাশ থেকে তর্জনী শাসিয়ে পৃথিবীর তাবৎ কংসকে বলছেন—‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’

রবিঠাকুর যেন চোখ বুজিয়ে গাইছেন—

‘মহারাজো, এ কি সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে,

চরণতলে কোটি শশী সূর্য মরে লাজে॥

মহারাজো!’

পিসিমা নিজের বাবাকে এবং বুনবুনকে তেড়ে মারতে এলে, ঠাকুর্দাদা শান্তভাবে বললেন,— ‘ঘাবড়াসনি। লোকটা সত্যিই সাজা কুঠে। হাতটা বোধহয় কোনও কারণে অ্যাকসিডেন্টে-টেন্টে গেছে, কনুইয়ে রঙ-চঙ লাগিয়ে ওইভাবে ভিক্ষে করে। দে বরুণকে শুদ্ধ করে দে।’ একটু থেমে ঠাকুর্দাদা বললেন— ‘আর কুঠে হলেই বা কী!’

ভিখারি-খেদানো ঠাকুর্দাদা আর ভিখারির ব্যান্ডেজ ঘাঁটা বুনবুনের মাথার পেছনে জ্যোতির্বৃত্ত এঁকে-দেওয়া ঠাকুর্দাদাকে এতদিনে বোধহয় খানিকটা মেলানো গেল, তাই না? আসল কথা, প্রত্যেক প্রাণীরই প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও বাঁচবার দুরন্ত তাগিদ থাকে। চল্লিশ লাখের ওপর লোক যাতে মারা গিয়েছিল সেই পঞ্চাশের মন্বন্তরে করুণাকে প্রশ্রয় দিলে তলিয়ে যেতে হবে এ কথা বোধহয় শিব-ডাক্তারবাবুর ভেতরের প্রাণীটা মোক্ষম বুঝেছিল; তাঁর ভেতরের পুরুষটা নিজেকে নিজে গড়েছিল বলে ভিক্ষাবৃত্তিকে মর্মান্তিক ঘৃণা করত, তাঁর ভেতরের মানুষটা ভেক ধারণ ও প্রবঞ্চনাকে মেনে নিতে পারত না; আর তাঁর ভেতরের ডাক্তারটা চিকিৎসাকেই পরমধর্ম জ্ঞান করত, তার কাছে কুঠে আর অ-কুঠের কোনও তফাত ছিল না।

নিজের ঠাকুর্দাদার সাফাই গাইছি? হবেও বা। পিতৃপুরুষের প্রতি কিছু কর্তব্য তো আমাদের থাকেই!

আমাদের চতুর্থ ভিখারিও এক যুগল। পুরুষটি অন্ধ। অমোঘভাবে বন্ধ চোখ নিয়ে সে হাতড়ে হাতড়ে পথ হাঁটত। তাকে হাঁটাত তার স্ত্রী। স্ত্রীটি বেশ বুড়ি। তুলনায় অন্ধ স্বামী সবল। তারা এই ভাবে ভিক্ষা চাইত :

অন্ধ— (গুঙিয়ে) বাব্বা!

বুড়ি— (ক্যানকেনে গলায়) বাব্বা গো!

অন্ধ— (গুঙিয়ে গুঙিয়ে) আমি অন্ধ-অ।

বুড়ি— (দোহারকি দিয়ে) অন্ধ-অ।

দুজনে একত্রে— অন্ধকে একটু দয়া। একটু দয়া…বাব্বা অন্ধ-অ।

‘দয়া তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে’ গানটি যখন প্রথম শুনি, মনে হয়েছিল কোথায় যেন ‘দয়া’র এমনি পুনরাবৃত্তি এমনি গোঁত্তা খাওয়া শুনেছি। সেই ভিখারিযুগলের উচ্চারণের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব গানটির মূল নকশা লুকিয়ে ছিল। তবে সাধারণত আগে একটা সৃষ্টিকর্ম হয় তার পরে তার ক্যারিকেচার হয়। এক্ষেত্রে ক্যারিকেচার বা প্যারডিটাই আগে হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ কি এই ঘরানার কোনও ভিখারি-স্লোগান শুনেছিলেন? হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-লতা মঙ্গেশকরের প্রথম দ্বৈত সঙ্গীত ‘তোমার হল শুরু আমার হল সারা’ শুনেও মনে হয়েছিল কোথায় যেন এই এফেক্ট শুনেছি। আবারও বলি, শুনেছিলুম সেই ভিখারি-দম্পতির দ্বৈত উচ্চারণে। অন্ধ স্বামীর গলা মোটা, ভারী, বুড়ি স্ত্রীর গলা সরু ফিনফিনে বা ক্যানকেনে। ফলে দুজনের উচ্চারণই পরিষ্কার আলাদা আলাদা ভাবে শোনা যেত। এবারেও, প্যারডিটাই আগে হয়ে গিয়েছিল, বলা বাহুল্য।

তবে এবার ‘স্বামী-স্ত্রী’ ধারণার সংশোধন করতেই হয়। একদিন আমরা আবিষ্কার করি এরা আদৌ স্বামী-স্ত্রী ছিল না। টঙের জানলা থেকে তেঁতুলের আচার খেতে খেতে একদিন আমি আর পুটপুটদিদি দেখে ফেলি অন্ধ আর তার তথাকথিত স্ত্রী প্রবল ঝগড়া করছে। বুড়ি বলছে—‘নিয্যস পয়সা সরিয়েচিস। কাল থেকে অন্য স্যাঙাত ধরবি। কড়ার ছিল আদ্দেক দিবি তবে তোর মাগ সাজবো।’ অন্ধ তখন রীতিমতো চক্ষুষ্মান হয়ে বুড়িকে এই মারছে তো সেই মারছে। —‘আদ্দেক তো সরিয়েই রেখেচিস, আবার কিসের আদ্দেক?”

তখন আমরা খানিকটা বড় হয়ে গেছি। ‘মাগ’ শব্দটার মানে স্বভাবতই বুঝতে পারিনি। তবে পুটপুটদিদি আন্দাজ করেছিল এবং বলেছিল—‘এ মা, বউ নয়, সেজেছে।’ আমিও বলি—‘অন্ধ নয়, সেজেছে।’ তখন আমাদের তেঁতুলের আচারের কাঁইবিচি রাস্তার ওপর টুকটাক পড়তে থাকে এবং ওরা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েই চট করে চোখ বুজে বলতে থাকে— ‘অন্ধ বাব্বা অন্ধ’। বোধ হয় চমকে গিয়ে দুজনেই চোখ বুজে ফেলেছিল, তাই ওরা বেশ হোঁচট খায়, আমরা হেসে উঠি এবং ওরা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দুপুরের ভাত-ঘুমন্ত-গলি পগারপার হয়ে যায়। ঠিক যেন সুর তাল ফসকে আর তালে ফিরতে না পেরে আনাড়ি গাইয়ে স্টেজ ছেড়ে পালাচ্ছে।

পঞ্চম ভিখারিটি ছিল দুর্দান্ত। এ প্রতিদিন স্টেজে অ্যাপিয়ার হত না। বড় বড় অ্যাক্টর-অ্যাকট্রেসদের মতো এ ছিল খেয়ালি বা খেয়ালিনী। এ একটি দশাসই জবরদস্ত বিধবা মহিলা। ফর্সা রঙ, ফর্সা থান পরা। মাথার অল্পসল্প কয়েকগাছি চুল চুড়ো করে বেঁধে রাখত। বাহুতে তারকেশ্বরের মাদুলি ছিল। পূজারিণীর ভঙ্গিতে একটা কানা উঁচু কাঁসা বা ভরনের পরাত এ ডান হাতে ধরে থাকত এবং দুপুর দেড়টা-দুটোর সময়ে গলির মোড়ে আবির্ভূতা হত। বাজখাঁই গলার চিৎকারে সমস্ত পাড়া ধড়ফড়িয়ে উঠে বসত।

—‘তুই মর, তোর পুত মরুক, তোর ভাতার মরুক, তোর চোদ্দো পুরুষ মরুক, ভাতারখাকি, শত্খোয়ারি মরুঞ্চে বেহায়া বেবুশ্যে মেয়ে মা-নুষ…।’

এর অর্থ হল, বাড়িতে নিরামিষ ঘরে যা যা রান্না হয়েছে চচ্চড়ি, শুকত, ডালনা সব কিছু ওর জন্যে রেডি রাখতে হবে। ও পাড়ায় ঢুকলেই ডেকে বসিয়ে ওর পরাতটিতে সব বেড়েটেড়ে ঠিকঠাক করে দিতে হবে। না দিলে, দিতে দেরি করলে, অর্ঘ্য পছন্দ না হলে… সব ক্ষেত্রেই ও শাপশাপান্ত দিয়ে সবার চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করে দেবে। এই ভিখারিণী থামত না। একই ছন্দে বিশাল নিতম্ব দোলাতে দোলাতে চলে যেত। অর্থাৎ একে ভিক্ষে দেওয়ার জন্যে মানুষকে জ্যোতিষ, অঙ্ক এবং নাচ তিনটেই জানতে হত। স্কিপিং দড়ি লাফানোর খেলা দেখেছেন নিশ্চয়! একজন দড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লাফাচ্ছে, আর একজন বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাল ঠুকছে, ঠুকতে ঠুকতে ঢুকে পড়ল স্কিপিং দড়ির ঘেরের মধ্যে। এই খেলা অভ্যেস থাকলেই ওকে ভিক্ষে দেওয়া সম্ভব। সুতরাং পাড়াসুদ্ধ লোককে গালিগালাজ খেতেই হত। আসার সময়টিও ছিল চমৎকার! ঠিক যখন বাড়ির গিন্নিরা হাঁড়ি চেঁছে খেয়ে-দেয়ে ঢেঁকুর তুলছেন। ও হ্যাঁ বলতে ভুলেছি, ওর থালায় বা পরাতে বেশ খানিকটা ভাতডাল থাকতই। না হলে থালা হাতে বসবে কী করে? ভাবটা, যেন ভিন পাড়া ভালো পাড়া। সেখান থেকে ভাত ডাল নিয়ে ও এই পোড়ারমুখো পাড়ায় ঢুকেছে তরি-তরকারি নিতে। কিন্তু যেমন আবাগী, নি-মুরুদে পাড়া! কিছুই দিচ্ছে না। ফলে ও-ই গালাগালির ছড়া দিতে দিতে চলেছে। এই ভিখারিণী ছিল একটি ফেনোমেনন। এ চলে গেলে পাড়া শ্মশানের মতো চুপচাপ হয়ে যেত। মায়েরা বাচ্চাদের চিবুক ছুঁয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতেন—‘ষেটের বাছা ষাট ষাট। বাছার বালাই দূরে যাক।’

খালি আমার ঠাকুমা-পিসিমাকে ও ভয় দেখাতেও পারত না, জব্দ করতেও পারত না। ওর আওয়াজ শুনতে পেলেই ঠাকুমা বই বুকে তাঁর বাত-শয্যায় উঠে বসতেন—‘মনো, অ মনো।’

পিসিমা জবাব দিতেন— ‘শুনতে পাচ্চি, চেঁচিও না।’

ঠাকুমা— ‘একটি ফোঁটাও দিবিনি বলে দিচ্চি ওই তাড়কা রাক্কুসিকে।’

পিসিমা— ‘তুমি বললেই দিচ্চি আরকি!’

পিসিমা-ঠাকুমার এই মতের মিল ও সাময়িক সখিত্বের সম্ভাবনায় বাজখাঁই ভিখারিণী পাড়ায় ঢুকলেই আমরা পুলকিত হয়ে উঠতুম।

এরাই আমাদের ধেনুকাসুর, শকটাসুর, অঘাসুর, বকাসুর…. কোনও না কোনওভাবে হয় ছদ্মবেশ ভেদ করে, নয় মজা পেয়ে, নয় রোমাঞ্চিত হয়ে, অর্থাৎ ভয় না পেয়ে আমরা এদের জয় করেছিলুম। তবে ভয় যে একেবারে কাউকেই পেতুম না তা নয়। পেতুম একজনকে। সে হল হীরেমোতি।

হীরেমোতিকে দেখা যেত কোনও কোনও শীতসন্ধের ঝুঁঝকো আঁধারে রামরতন বোসের লেনের মামারবাড়ির চারপাল্লার কাটা দরজা ঠেলে ঝুমঝুম শব্দে ঢুকতে। পরনে তার ভয়ংকর কালো শাড়ি। গায়ে হাতে মুখে কালো রঙ মাখা, ঠোঁট দুটো টকটকে লাল, কালো মুখের মধ্যে চোখের সাদা যেন শাঁকালুর মতো ডেলা পাকিয়ে আছে। নাকে ইয়া রুপোর নথ, গলায় হাঁসুলি হাতে বাউটি, কানময় মাকড়ি। পায়ে ঝমর ঝমর মল বাজিয়ে সে নাচত। হাত দুটো তার লম্বা লোহার হাত। আমি পুনপুন বুনবুন মা-দিদিভাইয়ের আঁচল শক্ত করে ধরে দাওয়ার ওপর কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে তার কিম্ভুত নাচ দেখতুম।

একদিন মা বললেন— ‘ও মা, বিদ্যা পাবন বরুণ তোরা ভয় পাচ্ছিস বুঝি, ও তো দুলারি! দুলারি তুমি দেখাও তো তুমি কে!’

তখন হীরেমোতি লোহার হাত খুলে উঠোনের কল থেকে মুখ-টুখ ধুয়ে এলো। কাজলের মতো কালো ধুয়ে সাঁঝের আকাশের মতো একটা স্নিগ্ধ কালো ফুটে উঠল, ঠোঁটের লাল মুছে অপ্রস্তুত, লাজুক হাসি। টপটপ করে মুখ-ধোয়া জল আর ঠোঁট-ধোয়া হাসি ঝরে পড়ছে বুকের কালো কাপড়ে।

পুনপুন তীক্ষ্ণ স্বরে বলল— ‘ওই কাপড়ের তলায় কী আছে দেখবো!’ (সর্বনাশ! প্রায় ‘চোলি কী পিছে’র মতো!)

দিদিভাই বললেন—‘দেখবি?’ বলে হীরেমোতিকে ডেকে নিয়ে গেলেন। একটু পরে দিদিভাইয়ের লালপাড়-কোরা মিলের শাড়ি পরে হীরেমোতি পুরোপুরি দুলারি হয়ে হাসতে হাসতে এসে বলল—‘গোড় লাগে মায়ি, গোড় লাগে।’

ব্যস, শেষ রাক্ষসীটি বধ হয়ে গেল।

দ্বাদশ অধ্যায় : হরিবংশ-৫—টমদিদি

পুনপুন, বুনবুন, তোরা বাবার কথা বলিস, ঠাকুর্দার কথা বলিস, দাদাদের কথা, দাদাভাইদের কথা বলিস। দ্যাখ, আমাদের তো হরিবংশ? আর সেই হরিবংশের হরিষে বিষাদ আমি বুবু একজন হরি-ণী। আমার বংশ চলে এসেছে বৃদ্ধ প্রপিতামহী, প্রপিতামহী, পিতামহী, বৃদ্ধ প্রমাতামহী, প্রমাতামহী, মাতামহী, মা, দিদিরা…এই প্রমীলা ধারায়। বংশ বলতে এঁদের কথা তো কেউ বলে না! আমার প্রকৃত কুল মাতৃকুল। মায়ের মা শুধু নয়, বংশের যেখানে যিনি স্ত্রীলিঙ্গে আছেন, সব্বাইকে নিয়ে আমার হরি-ণী বংশ। বাবা, ঠাকুর্দা, দাদা, দাদাভাইদের আমি অস্বীকার করছি না, কিন্তু ওই যে বললুম হে মাতঃ, তোমার কুলের কথা যে কেউ বলে না!

পমদিদির কথা বলেছি। এবার টমটমদিদি অথবা তিলোত্তমা অথবা ভক্তি অথবা গৌরাঙ্গদিদির কথা বলি। আগেই উল্লেখ করেছি টমদিদিকে সবাই পুজো করত! টমদিদির ছোটরাও, টমদিদির বড়রাও। কেন? টমদিদি যে সত্যি-সরস্বতী, আবার কেন?

টমদিদি হল আমাদের বাড়ির বিস্ময় বালিকা। প্রডিজি। একদিন মা পূর্ণিমার রাতে দুধ-ধোয়া ছাতে মাদুর পেতে বসে শুক্ল রাতে চাঁদের তরণী বেয়ে যাওয়া দেখছিলেন। বাবা ছিলেন তাঁর মনের মধ্যে। কী জানি কী ইচ্ছে হল মায়ের। চাঁদের তরণী থেকে একটি আলোর মেয়ে হাউইবাজির ফানুসের মতো দুলতে দুলতে দুলতে দুলতে হঠাৎ যেন জ্বালানি ফুরিয়ে টুপ করে মায়ের কোলে খসে পড়ল। মা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মেয়ে দেখলেন, তারা খসার মতো খসে পড়লেও এ তো বাপু উল্কা নয়? ছোট্ট মেয়ের চিবুকে মা চুমো রাখলেন, ডাকলেন ‘ভক্তি! ভক্তি!’ অমনি সেই মেয়ে উঠে বসে মায়ের গলা জড়িয়ে বলল—‘আছি আছি!’

—‘কোথায় আছিস?’

—‘আছি এই ছাতে, বাগানে, পুষ্পে, কাননে, হাওয়ায়, গাওয়ায়, শূন্যে, পুণ্যে সর্বত্র আছি মা।’

মা বললেন—‘তাই যদি হয় মা, তাহলে যাও, ভাণ্ডারে তৈল আছে, ক্ষার-খৈল আছে মেখে এসো, কলঘরে তোলা বালতিতে জল আছে, হুকে গামছা কাপড় আছে, নেয়ে ধুয়ে পরে এসো, আর রান্নাঘরে বেঁধে-বেড়ে রেখে এসেছি যা ইচ্ছে খেয়ে এসো।’

পলক ফেলতে না-ফেলতে মেয়ের নাওয়া-ধোওয়া শেষ, চিতল হরিণের গায়ের রঙের ফ্রক পরে, চাঁচর চুল সোজা করে আঁচড়িয়ে, মেয়ে এসে মায়ের কোলে বসল। এক হাতে দুটি চাটিম কলা, আর এক হাতে “ক্ষীরের পুতুল”।

মা বললেন—‘লাল টুকটুকে ফ্রক রেখেছি মা, পরনি কেন?’

মেয়ে বলল—‘রূপ যে রূপ! লুকিয়ে রাখব! জাজ্জ্বল্য হব না।’

মা বললেন—‘গন্ধ তেল ঢেলে এসেছি মা, মাখোনি কেন?’

—‘মাছি আসবে, পিঁপড়ে আসবে, ভোমরা আসবে মা, ডাঙশ আমি খাব না।’

মা বললেন—‘পিঠে-পায়েস, সুরুয়া-দমপোক্ত, বিরিয়ানি-বাকরখানি… খেলে না কেন?’

—‘রাজসিক খেলে যদি রানি হই, মা-ধরণীর ছোঁয়া তো আর পাব না মা, তাই

চাটিম কলা চাটিম

হটর হটর হাঁটিম

গোলাবাড়ি ছাদনদড়ি কুটুম কাটুম লাটিম।’

মা বললেন—‘বেশ। তা “ক্ষীরের পুতুল” কেন?’

মেয়ে বলল—

‘ক্ষীরের পুঁতুল ক্ষীরের পুঁতুল করছো তুমি কি?

এই দেখো না আমি কেমন পড়তে শিখেছি।

ঢোল ডগর ঢোল ডগর ঢোলে দিলে ঘা।

কে বলেছে তোমার খুকু লিখতে জানে না?

ঘটর ঘটর পবনের না’

হট্টমালার দেশে যা—’

ও মা! মায়ের গালে হাত, মা দেখলেন ছোট্ট খুকু, খুকু তো নয়, যেন বাছুর। জন্মাতে না-জন্মাতেই সে এখান থেকে ছিটকে ওখানে, ওখান থেকে ছিটকে সেখানে চলে যাচ্ছে। দুধের বাটি উলটে, কাজললতা লেপটে খলবল খলবল করে হামা টানছে।

কোথায় গেলি রে? কোথায় গেলি রে?

তক্তপোশের তলায়।

কোথায় গেলি রে? কোথায় গেলি রে?

ধানের আড়ায়, চালের বাতায়, চৌকাঠ-মৌকাঠ চোদ্দঘাট পেরিয়ে দেখতে দেখতে খিড়কি! এ যে ম্যাজিক মেয়ে!

হাঁ করলে কথা বোঝে, বানান করলে দ্রব্য খোঁজে,

স্বরে অ স্বরে আ আমায় এখন ডেকো না

ব্যঞ্জন বন্ন, বিসগ্গ সন্ধি, তদ্ধিত পেত্যয়, উৎপাত তৎপুরুষ সমস্ত দেখতে দেখতে শেষমেশ করে ছানা তখনও লাল ঠোঁট হাঁ করে রয়েছে। খিদে আর মেটে না খিদে আর মেটে না।

এ কি মানুষের ছানা না গরুড়ের ছানা?

‘তরুণ গরুড়সম কী মহৎ ক্ষুধার আবেশ!’

আকাশ ঘোরঘটা করে এসেছে। মা কাজে আছেন। ছেলেমেয়েরা কে কোথায় খেয়াল নেই। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে বজ্রপাত হল। কী প্রকাণ্ড আওয়াজ! যে যেখানে আছে আছড়ে পড়ে কাঁপতে লেগেছে। মা দৌড়চ্ছেন, দৌড়চ্ছেন। ছোট্ট খুকু কোথায় গেল? দাঁতকপাটি লেগে গেল না কী? জানলার ধারে খুকু চুপটি করে বসে রয়েছে, হাতে সেলেট, সেলেটে অক্ষর, খুকু শোলোক লিখছে। মা ধড়ফড়িয়ে কোলে তুলে নেন—‘শব্দ শুনতে পাসনি? আওয়াজ?’

—‘ওই তো!’ খুকু হাত বাড়িয়ে দেখায়। দূরে একটা তালগাছ দাউদাউ করে জ্বলে যাচ্ছে। মা ভয়ে কাঠ।

—‘ভয় করেনি মা?’

—‘না তো, দেখলুম আকাশটা ফেটে গেল। ভেতরের আগুন শোঁ-ও-ও করে নেমে এসে তালগাছটাকে বিঁধে মাটি ফুঁড়ে চলে গেল।’

খুকু কোলে নিয়ে মা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকেন। কী বাঁচা বেঁচেছে! অবোধ মেয়ে! কিন্তু এক ফোঁট্টা ভয় নেই?

এ তো মেয়ে মেয়ে নয়!

সাতসক্কালে সব্বার আগে পমদিদি টমদিদি চান করে, তার পরে পিসিমা, তার পরে মা, ঠাকুমা •…এই অর্ডার। পম-টম জোড়া -দিদি। সারা পিত্থিমিতে তাদের জুড়ি নেই। সব সময়ে সদ্যস্নাত, বিশাল চুলের তলায় গিঁট, সেইখানে এক ফোঁটা দু ফোঁটা জল টুলটুল করছে। ওরা ভোরবেলায় ওদের ঘর ঝাঁট দেয়, পোঁছে, ধূপ জ্বালে, জলচৌকির ওপর মোটা মোটা বই থাকে। ঝাড়া পোঁছা। এক ফোঁটা ধুলো পাবে না। বই তো নয়, সব দেবতা। অগ্নি, সোম, বরুণ, সূর্য, নাসত্য, অশ্বিনীদ্বয়, মরুৎ, উষা, পর্জন্য, পৃথিবী…| বই নয়, সব ঋষি। বিশ্বামিত্র, বসিষ্ঠ, মধুচ্ছন্দা, কুত্‌স, অত্রি, অর্যমা, সুহোত্র, পুলস্ত্য, ক্রতু, অঙ্গিরা…অপালা, মৈত্রেয়ী, গার্গী, বাক্‌…| জলচৌকির একধারে শ্বেতপাথরের গ্লাসে রেকাবিতে ফুল থাকে, ছাত-বাগানের মাত-করা সব ফুল। সপ্তমুখী জবা, ডবল যুঁই, বেলী, দোপাটি, সূর্যমুখী, রজনীগন্ধা, স্থলপদ্ম আর সবার সেরা, সবাই রাজা, তবু রাজাধিরাজ-গন্ধরাজ। একটি আড়াই ফুট টবের গাছে অজস্র গন্ধরাজ, কখনও কখনও মনে হয় ফুল? না গাছময় সদ্য-ডিমফোটা বকের ছানা? এই সমস্ত ফুলগাছ— গ্লোব নার্সারির বাহাদুরি। কলমের গাছ সব। বাবা-মা গাছ ছাড়া ফুল ছাড়া থাকতে পারেন না। কলকাতায় এসে বৃক্ষশূন্যতায় পুষ্পশূন্যতায় আতুর হয়ে হন্যে হয়ে অবশেষে ছাত-বাগান তো ছাত-বাগানই সই। কলমের গাছ শুনে বুবু ভাবল—কিসের কলম? খাগের কলম? না নিবের কলম? কলম থেকে গাছ জন্মায়? অমন ফুলে-ফুলে ভরা গাছ? আমার কলম তো আমি চিবিয়ে চিবিয়ে সারা, রোজ সকালে উঠে চুপি চুপি দেখি গাছ গজাচ্ছে কি না। না তো? শেষকালে মাথায় বুদ্ধি খেলল। কী বোকা? কী। বোকা! মাটি লাগবে তো? মাটি ছাড়া কি গাছ হয়? গরমকালে দোপাটির টব খালি; কলমটি তার মধ্যে আমূল পুঁতে দেয়। রোজ একটু একটু করে জল দেয়।

—‘খালি টবে জল দিচ্ছিস কেন রে?’

—‘দিচ্ছি!’

ফাঁস করে না আসল কথা। বোকা হলেও এটুকু বুদ্ধি আছে যে ফাঁস করা চলবে না। কে জানে কখন বোকা বনে যেতে হয়!

—‘খালি টবে জল দিচ্ছিস কেন রে?’

—‘বা রে খালি-টবের বুঝি জল-তেষ্টা পায় না?’

তা সেই ছাতের গাছ, গাছের ছাত, ছাতের ঘর, ঘরের ছাতে পমপম-টমটমের আসন। দিদি বলতে বোন অজ্ঞান, বোন বলতে দিদি অজ্ঞান। ঋদ্ধি যেন ভক্তির দিদি নয়, মা; মা নয়, গার্জেন এঞ্জেল, অধিদেবতা।

ঋদ্ধি পড়ে—‘ঈশা বাস্যম্‌ ইদং সর্বং…। ঈশ্বরের দ্বারা সবই আবিষ্ট…’

ভক্তি পড়ে—‘পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদম্‌…। ইহাও পূর্ণ উহাও পূর্ণ।’

ঋদ্ধি পড়ে—

‘তুমি যেথা আমাদের আত্মার আকাশ

অপার সঞ্চার ক্ষেত্র— সেথা শুভ্র ভাস—

দিন নাই, রাত্রি নাই, নাই জনপ্রাণী।

বর্ণ নাই, গন্ধ নাই, নাই নাই বাণী॥’

ভক্তি পড়ে—

‘আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে,

কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে

বিপুল অঞ্চলতলে। ওগো মা মৃন্ময়ী,

তোমার মৃত্তিকা-মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই,’—

বুবু পড়ে—‘ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকরি চামে কাটা মজুমদার’

পুনপুন পড়ে—‘ধেয়ে এলো দামোদার’

বুনবুন পড়ে—‘দামোদারের হাঁড়ি কুঁড়ি’

—‘তুই চুপ কর না। আমি বলব—গোয়ালে বসে চাল কাঁড়ি,’

সব্বাই মিলে—

‘চাল কাঁড়তে হল বেলা

খেতে বসলো জামাই-শালা’

হি-হি-হি-হি, শালা খারাপ কথা, ছড়া বলার ছলে বেশ বলে নিচ্ছি,

‘খেতে বসলো জামাই-শালা’

পাতে পড়ল মা-ছি

কোদাল দিয়ে চাঁ-চি।

কোদাল হল ভোঁ-তা।

খ্যাঁক শেয়ালের মা-থা।’

—‘অত হাসছো কেন বিদ্যা, বরুণ? পাবন অত হাসছো কেন?’—

এই রে পমপমদিদি টমটমদিদিকে কী সব সূত্র-টুত্র পড়াচ্ছিল, তার কানে গেছে।

আমরা ভয়ে চুপ। জামাইকে শালা, শালাজামাই বলতে পেরে মহা খুশি হয়ে হাসছিলুম, পালে বাঘ পড়ল।

—‘শালা মানে কী বলো তো? শালা মানে স্ত্রীর ভাই। আমাদের বড়মামা বাবার শালা। বাবা আর বড়মামা যদি একসঙ্গে খেতে বসেন তো সেটা হবে “খেতে বসল জামাই-শালা” —বুঝেছ?’

—‘হ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ’, তিনটে মাথা নড়ে। মনটা খারাপ হয়ে যায়, শালা মানে যদি বড়মামা দাঁড়ায়, তাহলে আর ইঁকড়ি-মিকড়ির মজা কী রইল?

—‘এখন ইঁকড়ি-মিকড়ি করছে, প্রথম ভাগ দ্বিতীয় ভাগ কোথায়?’

বুনবুন দ্বিতীয় ভাগের ‘ঐক্য-বাক্য-মাণিক্য’ ধরে ফেলেছে। আমি আর পুনপুন ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’র থেকে এখনও বেরোতে পারছি না। বুনবুন তার দ্বিতীয় ভাগ প্রোডিউস করে।

—‘পাবন, বিদ্যা তোমাদের প্রথম ভাগ?’

কাঁচুমাচু মুখে জানাই—‘হারিয়ে গেছে।’

—‘আবার হারিয়েছো? এই নিয়ে কবার হল রে ভক্তি!’

—‘পাঁচ-ছবার তো বটেই।’

—‘প্রথম ভাগ বাড়ি থেকে কোথায় হারাবে? কে নেবে? কেউ না!’

পমপম দিদি ভারি অবাক।

এই সময়ে বুনবুন বিশ্বাসঘাতকতা করে, ছোট্ট গলায় বলে—‘আমি জানি।’

—‘কী জানিস?’

—‘কোথায় হারিয়েছে।’

—‘কোথায়?’

—‘এসো।’

বুনবুন বিভীষণের মতো পথ দেখিয়ে দেখিয়ে পমদিদি টমদিদিকে বড় শোয়ার ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে জোড়া তক্তপোশ পাতা। তক্তপোশের ওপরের তোশকের খুঁট নিয়ে বুনবুন টানাটানি করতে থাকে। দুই দিদি তোশক উল্টে দেয়। বুনবুন মীরজাফরের মতো নিশ্চেষ্ট হয়ে রণক্ষেত্র থেকে সরে থাকে। জুডাস ইসক্যারিয়টের মতো অঙ্গুলিনির্দেশ করে। তোশকের তলার ছ-সাতটা প্রথম ভাগ, গোলাপি মলাট সহ অক্ষত অটুট অবস্থায় চেপ্টে রয়েছে। ফলে দুপুরবেলা রুগি দেখে ফেরবার পথে বাবা আমাদের জন্যে ‘হাসিখুশি’ নিয়ে ফেরেন। গম্ভীর মুখে বলেন—‘একটা বই-ই দুজনকে পড়তে হবে কিন্তু। মারামারি করা চলবে না।’

মারামারির কথায় আমি আর পুনপুন ভারি ব্যথা পাই। ‘মারামারি?’ সে আবার কী? আমরা দুজন হরিহর আত্মা। মা-রা-মা-রি? তবে সে যাই হোক। হাসিখুশি পেয়ে আমরা দুজনেই ভারি হাঁসিখুঁশি। ছোট্ট থেকে এই সমস্ত ‘অয় অজগর আসছে তেড়ে’-টেড়ে শুনে আসছি। কী সুন্দর সুন্দর ছড়া-ছবি,—এবার থেকে আর আমাদের বই হারাবে না। তবে হ্যাঁ যদি প্রত্যাশা করো, ‘হাসিখুশি’ থেকে সব জ্ঞান উজাড় করে নিয়ে আমরা ‘বোধোদয়’-এর পথে সত্বর এগিয়ে যাব, তো একটু বেশি-বেশি হয়ে যায় প্রত্যাশাটা। ‘হাসিখুশি’টা আমাদের অভিনয়শিক্ষা, চিত্রাঙ্কনশিক্ষা, এবং আরও অনেক দুরূহ তত্ত্ব শিক্ষার আকর গ্রন্থই হয়ে থাকে মূলত। পুনপুন ইঁদুরছানা হয়ে গুটলি পাকিয়ে শুয়ে থাকে। আমি ঈগল পাখি হয়ে তাকে ছোঁ মারি। আমার হাতের নখ পুনপুনের পিঠে লেগে আঁচড়ে যায়, তাতে পুনপুন বিদ্রোহ করবার উপক্রম করে, ওর দাবি এবার ও ঈগল হবে আমি ইঁদুরছানা হব। তবে, আমার সঙ্গে ও পেরে ওঠে না, আমি ‘ঊর্ধ্ববাহু আছেন ঝুলে’র দিকে ওর মন ফেরাতে সমর্থ হই। দুজনেরই একত্রে ঊর্ধ্ববাহু হওয়ার পথে তেমন কোনও বাধা আসে না। তবে ‘ঔষধ খেতে মিছে বলা’য় পৌঁছে আমাদের মুখে বক্ৰহাসি ফুটে ওঠে, লেখকদের অজ্ঞতা আবিষ্কার করে। ঔষধ খেতে তো আমরা দারুণ পছন্দ করি। বস্তুত খাদ্য-পানীয়র চেয়ে ঔষধেই আমাদের আসক্তি বেশি। ছোট্ট ছোট্ট ওষুধের শিশি হাতের কাছে পেলেই আমরা কর্ক খুলে পুরোটা আধাআধি করে খেয়ে নিই। পুনপুন হালকা বলে টিকটিকির মতো সড়সড়িয়ে জানলা বেয়ে উঠে গিয়ে হাত বাড়িয়ে তাক থেকে ওষুধ পাড়ে, অনুগত লক্ষ্মণ ভাইটির মতো শিশি আমার হাতে অর্পণ করে, তারপরে আমরা খাই। একবার এমনি ওষুধ খেয়ে আমাদের গায়ে চাকা চাকা সব ঘা মতো বেরিয়েছিল। তখনই বাবা ব্যাপারটা ধরে ফেলেন।

—‘আবার ওষুধ খেয়েছো?’

মাকে বললেন—‘সালফার খেয়েছে।’

—‘কী হবে?’ —মায়ের কাঁদো-কাঁদো জিজ্ঞাসা।

—‘কী আবার হবে। অ্যান্টি-ডোট দিয়ে দিচ্ছি।’

তবে, সেই থেকে বাবা রোজ দিনের একটা সময়ে ডাকেন—‘বিদ্যা, বিদ্যাধরী! পাবন বনবন্‌ন্‌ন্‌…’

ঘড়ির ডিং ডং-এর মতো সেই ডাক বাজতেই থাকে, বাজতেই থাকে যতক্ষণ আমরা ছুটতে ছুটতে গিয়ে উপস্থিত না হই।

বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার ওপরে সবুজ চামড়ার বাঁধাই। হাতলঅলা গদি-মোড়া চেয়ারে বাবা বসে আছেন। সামনে মস্ত শিশিতে সুগার অফ মিল্ক, গ্লোবিউল… পেছনে বাবার বিরাট ওষুধের ক্যাবিনেট তাতে চাবি ঝুলছে।

ছোট্ট ছোট্ট দুটো কাচের পুতুল, পাখির ছানা, কাঠবেড়ালি, কিচিরমিচির, কিচিরমিচির।

—‘ওষুধ খাবে তো?’

—হ্যাঁ-অ্যা-অ্যা।’

—‘তবে হাঁ করো।’

কোনওদিন গুঁড়ো ওষুধ, কোনওদিন গুলি ওষুধ খাই আমরা।

বাবা সুর করে বলেন— ‘ওষুধ খেয়ে-ছো?’

—‘হ্যাঁ-অ্যা-অ্যা।’

—‘তবে আর চুপিচুপি খাবে না?’

—‘না-আ-আ।’

—‘ওষুধ খাবার ইচ্ছে হলেই আমার কাছে চলে আসবে, কেমন?’

মাথা নাড়ি আমরা। পরের দিনই পুনপুন হাতে-নাতে ধরা পড়ে যায়।

বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমাশীল টমটমদিদি। টমটমদিদি আমাদের বিপত্তারণ মধুসুদন। টমদিদি সেলেটে সুন্দর করে অক্ষর লিখে দেয়। আমরা দাগা বুলোই। টমদিদি আমাদের বিকেলবেলায় সাজিয়ে দেয়, ফিঁতের ফুল করে, জুতোর ফিঁতে বেঁধে, পেন্টুলে বেল্ট বেঁধে, টমদিদি আমাদের পুঁতুল তৈরি করে দেয়, ছেঁড়া কাপড় আর তুলো দিয়ে, যখন আমরা পড়তে চাই না সেলেটে ‘আপিসের বাবু’ এঁকে আমাদের ভোলায়। আপিসের বাবু জানেন তো? বাবু একা-একা থাকেন। আপিস থেকে এসে তিনি উনুন জ্বেলে উনুনে কড়া বসালেন। তাতে তেল ঢাললেন। তারপরে দুটো আলু, একটা পটল আর এক ফালি কুমড়ো ভাজতে দিলেন। তারপরে কড়ায় একটা ঢাকা দিয়ে দিলেন। এবার আঁচটা জোর করবার জন্যে উনুনের মধ্যে কয়েকটা লম্বা লম্বা কাঠ গুঁজে দিলেন। ব্যাস হাস্যমুখ অফিসের বাবুকে অমনি স্বশরীরে সেলেটের ওপর দেখা যেতে লাগল। বুনবুনটা বেরসিক কম না। টমদিদির এহেন অঙ্কন শিক্ষাপদ্ধতির উদ্যোগে জল ঢেলে সে বলে ওঠে—‘ভাত খাবে না? আপিসের বাবু ভাত খাবে না? নুচি খাবে না? বা রে!’

ভাগ্যিস সে আলুকুমড়ো কাটার পদ্ধতি নিয়েও তর্কাতর্কি করেনি। বুনবুন আসলে এসব ব্যাপারে বেশি বিশেষজ্ঞ ছিল। সব সময়ে সে দিদিভাইয়ের পায়ে পায়ে ঘুরত। তাই কুটনো-বাটনা সম্পর্কে তার বেশ ভালোই ধারণা ছিল। আমাদের মনেও যে কুটনোপদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি তা নয়। আলু তো গোটা গোটা তেলে ছাড়া হয় না! গোল গোল করে কাটা হয়। নরম-নরম সাদা-সাদা আলুভাজা, কিংবা কাঠি আলুভাজা, কুমড়োও তো চৌকো চৌকো করেই কাটা হয়। কিন্তু প্রশ্ন বা সংশয়গুলোকে আমরা ভালো করে গজিয়ে ওঠবার আগেই গিলে নিতুম, নিত্যকর্মপদ্ধতির মধ্যে দিয়ে আপিসবাবু স্বয়ং এইভাবে শরীর ধারণ করায় (হোক তা জগন্নাথের মতো শরীর) চমৎকৃত হয়ে। আবার ওই ‘সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ’ আরকি!

যাই হোক, টমটমদিদি আমাদের শিক্ষার চার্জে। পমদিদি আর ই-দাদা বড্ড উঁচুতে, ধরা যায় না, ছোয়া যায় না। কিন্তু টম আমাদের নাগালের মধ্যে। বা, তা-ও নয়। আকাশের চাঁদ নিজে নেমে এসে আমাদের হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে। টম পরীক্ষা দিলেই ফার্স্ট হয়। সব কিছুতে। আমার আর পুনপুনের ধারণা পরীক্ষা দিলেই ফার্স্ট। ওটাই রেওয়াজ। ইনফ্যান্ট ক্লাসের প্রথম পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরছি। হাতে কালি মুখে কালি। ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরছি। ঠাকুর্দাদা বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছেন—‘কী রকম পরীক্ষা দিলে?’

—‘ফাঠ, ঠাকুর্দাদা’— আমি উজ্জ্বল হাসি মুখে ওপরে চেয়ে বলছি।

—‘পাবন? পুনপুন?’

—‘ফাঠ্‌।’

—‘দুজনেই ফাঠ্‌।’

—‘দুজনেই ফাঠ্‌।’

পরীক্ষার ফল বার হলে দুজনে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরি। রোয়াকে বাবা অবিনাশজেঠুর সঙ্গে কথা বলছেন।

—‘কেমন হল রে?’

—‘ভালো বাবা, খু-উ-ব ভালো।’

—কে ফাঠ্‌?’

পুনপুন (সরু গলায়)— ‘কিন্নগোপাল (কৃষ্ণগোপাল)’

—‘সেকেন্ড কে?’

—‘সরুজ শোভন (সরোজ শোভন)’

—‘থার্ড কে রে?’

—‘ইনন্ময় (হিরন্ময়)’

—‘তার পরে?’

তারপরে মথুরেশ, নবনীতা, বনবাণী, রুচিরা, অনিমেষ, পার্থসারথি, বিষ্ণুপ্রিয়া, টুলটুল… এরকম দশ এগারোজনের নামতা বলার পরে বাবা হাল ছেড়ে দেন। বিদ্যা বা পাবন কোত্থাও নেই।

—‘পাস করেছিস তো?’

পাস করার নিদর্শন হিসেবে সবুজ কার্ড এগিয়ে দেয় দুজনে। বৃন্দহাসির মধ্যে দিয়ে বিজয়গর্বে প্রবেশ করে তারপরে বন্ধুদের ফার্স্ট সেকেন্ড ইত্যাদি হওয়ার গৌরবে, আনন্দে টমটমদিদির কোলে মুখ লুকোয়।

এর পরে অবশ্য স্কুলেও আমাদের নিয়ে হাসাহাসি হতে থাকে। কারণ গোরুর সম্পর্কে রচনায় আমি লিখেছি ‘গোরুর হাড় থেকে চিনি হয়,’ কুকুরের রচনায় পুনপুন লিখেছে ‘কুকুর ছাই খায়।’ অনেক ভেবে-চিন্তে দিদিমণিরা বার করেন কুকুরকে আঁস্তাকুড়ে মুখ ডুবিয়ে খাবার খুঁজতে দেখা যায়, আঁস্তাকুড়ে ছাইয়ের গাদায় হতভাগ্য কুকুরকে এই অবস্থায় দেখে পুনপুনের ধারণা হয়েছে কুকুরের প্রধান খাদ্য ছাই। কিন্তু গোরুর হাড় থেকে চিনি হওয়ার ব্যাপারটা কোথা থেকে এল! স্কুলের দিদিমণিরা নয়। টমটমদিদিই শেষ পর্যন্ত অনেক মাথা খাটিয়ে গোরুর হাড়ের সঙ্গে চিনির সম্পর্কটা বার করে। এমন কিছু সম্পর্ক নয়। স্রেফ অন্ধকারে ঢিল। গোরু আপাদমস্তক উপকারী। তার শিঙ, তার চামড়া, তার লেজ, গোময়, গোমূত্র, গোমাংস, গোদুগ্ধ। তাহলে হাড়ের উপকারিতাটি কী? হঠাৎ আঁধারে আলোর মতো গোরুর হাড়ের সাদাত্ব আর চিনির সাদাত্ব আমার কাছে এক জাতীয় বলে মনে হতে থাকে। বিবেকানন্দর মুখে শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বাণী জুগিয়েছিলেন, বুবুর কলমকেও তেমনি মা সরস্বতী আইডিয়া জোগান। গোরুর হাড় থেকে চিনি হয়।

আমাদের এই সমস্ত মৌলিকতার সমঝদার ছিল টমদিদি।

ত্রয়োদশ অধ্যায় : হরিবংশ ৬—বুজবুজদিদি

একদিন ইন্দ্রের সভা বসেছে। ঊর্বশী নাচছেন, গন্ধর্ব বিশ্বাবসু গাইছেন, গন্ধর্ব মিত্রাবসু তালবাদ্য বাজাচ্ছেন। সভা নিৰ্ণিমেষে নাচ দেখছে,

তা-তা-থেই-তা

তৎ-তৎ-থেই

তেরে-কেটে-তাতা-থুন-দে-মা

এ-বার রে-হেই।

তৎ-তৎ-থুন-থুন-ভালো-লাগে-না

রোজ-রোজ-কান-ধরে-ধর-তাই তাল-লয়-সুরের তে-হেই।

যত বড় গাইয়ে-বাজিয়ে-নাচিয়ে-লিখিয়েই তুমি হও, ক্রমাগত ফরমাশি কাজ করতে করতে তোমার বিরক্তি আসবেই। তখন মনে হবে ধুর বাঁ হাত দিয়ে কোনওমতে বাজিয়ে দিই। দে মা এ বার রে হেই। সেই একই লোককে তার খেয়াল তার মেজাজমর্জিমতো কাজ করতে দাও, সে ভা-রি খুশিমুশি হয়ে তান ধরবে—তুম তুম তেরে নেরে নুম-তা-আ-আ-আ…|

এখন পুরন্দর ইন্দ্র রাজার তো কোনও অভ্যেসটাই ভালো না! বর সেজে পরের বউয়ের কাছে যান। পিতৃহত্যা করেন, নিরপরাধ ত্রিশিরা মুনিকে কিছুতেই তপস্যাচ্যুত করতে না পেরে তাঁকে বজ্রাঘাতে নিষ্ঠুরভাবে বধ করেন, সগর রাজার যজ্ঞাশ্ব চুরি করে কপিলমুনির আশ্রমে নুকিয়ে রেখে আসেন ফলে সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে (প্রজার) কপিল মুনিকে চোর ঠাওরায় এবং তাঁর অভিশাপে ভস্মীভূত হয়ে যায়। লম্পট, পিতৃঘাতক, নিরপরাধ-হন্তা, চোর এই দেবতাটি সভায় বসে ঊর্বশীর মতো মহানাচিয়েকে লাস্যনৃত্য করতে বলেন, যখন হয়তো ঊর্বশীর তাণ্ডব নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে, বিশ্বাবসুকে মলহার গাইতে বলেন, যখন হয়তো তাঁর সাহানা গাইতে ইচ্ছে হচ্ছে। আর মিত্রাবসুর তো কথা-ই নেই। তাই মিত্রাবসু অন্যমনা হয়ে তাল ভঙ্গ করলেন। দাদাভাই বিশ্বাবসুর মাথা নিচু, ঊর্বশীর চোখে জল, ইন্দ্রের হাজার চোখে হাজার আগুন।

—‘যাও, নারী হয়ে পৃথিবীতে সঙ্গীত সাধনা করো গে যাও।’

ব্যাস, মিত্রাবসু ডিগবাজি খেতে খেতে নামছেন।

হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মা দু হাত মেলে, কোল পেতে রয়েছেন, দেবহূতি-মায়ের কপালেই শিকে ছিঁড়ল। মিত্রাবসু বুজবুজদিদি হয়ে জন্ম নিলেন।

আর সব বাচ্চা জন্মে-টন্মে ভ্যাঁ করে, চ্যাঁ করে, প্যাঁ করে, কিন্তু বুজবুজ কেঁদেছিল শুদ্ধ গান্ধার থেকে শুদ্ধ নিখাদ পর্যন্ত একটি দীর্ঘ সুরেলা মিড়ে। সে আপন মনেই গায়, দাদা বিশ্বাবসু তাকে ভোলেননি। আপন মনেই নাচে, ঊর্বশীও তাকে ভোলেননি। তালে তালে গায়, তালে তালে নাচে, তার সর্বাঙ্গে সর্ব-অস্তিত্বে ওতপ্রোত লয়। মিত্রাবসুর লয়।

বুজবুজ, তুমি গাইছো আমি শুনতে পাচ্ছি।

‘পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণগগন অঙ্গনে শোন শোন রে/মন রে আ মার।’

অঙ্গনে শোন শুনতে শুনতে আমার হৃদয় ময়ূরের মতো নাচে রে হৃদয় নাচে রে।

‘ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মা-দল

নিম্নে উতলা ধরণী ত-ল

অরুণ প্রাতের তরুণ দ-ল

চল রে চল রে চল।’

ধরণীতল কেন বুজবুজ? ওটা তো ধরুণীতল হবে! যেমন অরুণ, তরুণ, তেমনি ধরুণী। আমি ‘ধরুণীতল’ই গাইব। গাইবোই। যতই বকো।

‘বঁধুয়া-আ-আ

নিদ নাহি আঁখি পা-তে

তুমিও একাকী আমিও একাকী আজি এ শ্রাবণ রা-আ-আ-আ-আ- আ-আ-আ আতে।’

কে এই বঁধুয়া? কার জন্যে গান বেঁধেছো বুজবুজ? কে সে যার জন্যে একাকী হয়ে রয়েছো?

বাবা দাঁড়িয়ে গেছেন দরজার বাইরে। বাবার চোখ ছলছল করছে।

—ও বুজি বুজি, তোর বাবাকে কাঁদাসনি আর। কে জানে কী দিতে পারেনি তোর বাপ। তাই চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মেয়ের ‘তুমিও একাকী আমিও একাকী’ শুনতে শুনতে তার বুকের মধ্যে না-দিতে-পারার বেদনা হু-হু করছে। হয়তো না-পেতে-পারার বেদনাও।

কত আশা কত সংকল্প নিয়েই তো মানুষ জীবন শুরু করে আহা। আমিও ভেবেছিলুম দেবো দেবো এই জননী জন্মভূমিকে শৃঙ্খলমুক্ত সু-উচ্চ বেদিতে বসাব। ধানের শিষে দুধ চিকচিক করবে, মন্দানিলে নুয়ে নুয়ে পড়বে সোনালি ফসলে আনত গোধূম দল। পুষ্করিণী থেকে উঠে আসবে সুপুষ্ট মাছের ঝাঁক।

মাছে-ভাতে বাঙালির ছেলে

হাপুস-হুপুস খাবে মাংস বংশ অবতংস, পরমান্ন ফেলে।

গাভীর বাঁটের দুধ বৎসের জন্য রেখে তবে আমি নিয়েছি মা ভগবতী। ছাগ-বৎসকে খুন করতে হয় বলে সুস্বাদু মটন ছেড়েছি। আমি জয়সিংহ, হে রঘুপতি জীবনের কতগুলো মূল্যবান বছর বঙ্গ থেকে নেপাল, বিহার থেকে কুমায়ুন, কুমায়ুন থেকে কিন্নরদেশ পদব্রজে ঘুরেছি। ভেদ-বমির মড়কে স্বজনপরিত্যক্ত রোগীকে নুনজল দিয়ে বাঁচালুম সে তো আমিই, আ-চণ্ডাল ভারতবাসীকে মহাজাগরণে জাগাবার জন্য অন্তরীপের জিহ্বা পেরিয়ে শেষ ভূখণ্ডের বোল্ডারে পা রাখি সেও তো আমি, আমিই একদিন এই জন্মভূমির মহাশ্মশান থেকে উড়ে-যাওয়া উপনিষদের পাতা হাতে করে উত্থিত হলুম। আমি রাসবিহারীর ছায়া পেয়েছি, সুভাষচন্দ্রের কায়া দেখেছি, সেই যখন সদ্যতরুণের কাঁধে তিনি ভরসার হাত রেখেছিলেন! আমি চিত্তরঞ্জন আর বাসন্তীর জ্যোৎস্নায় একদিন স্নান করেছি। আকাশ থেকে খসে-পড়া এক দ্বাদশীর চাঁদ দেখে আমার সব ভুল হয়ে গেল। তাই কি আমায় পরিত্যাগ করলে মা? আমার ত্যাগ আর নেবে না? আমার ভোগ, আমার সম্ভোগ তা-ও আর নেবে না না কি মা? দুর্গাপ্রসাদ ঠাকুরঘরে ঢুকে যান। মণিপুরের তলা থেকে নাদ টেনে বার করেন—

‘আর কিছুই মা নাই গো চিতে

চিতার আগুন জ্বলছে চিতে

চিতাভস্ম চারিভিতে

রেখেছি মা আসিস যদি।

শ্মশান ভালোবাসিস বলে শ্মশান করেছি হৃদি

শ্মশানবাসিনী শ্যামা নাচবি বলে নিরবধি।’

বংশের আদিপুরুষ হরিনারায়ণ যাঁর সুবাদে আমরা হরিবংশ, আর বুজবুজের ‘তুমিও একাকী আমিও একাকী’ দুর্গাপ্রসাদের বুকের মধ্যে বিরহের বৈরাগ্যের বীজ সেই যে বপণ করল, তার মাটি ফুঁড়ে তদগত অঙ্কুরিত হওয়াকে আর কেউ কে-উ রোধ করতে পারল না।

বুজবুজদিদি ছিল একটি মিনিয়েচার ছবির মতো। পাঁচ ফুটের বেশি উচ্চতা কক্ষনও নয়। কমও হতে পারে। ফর্সা? ফর্সা বোধহয় নয়। কিন্তু এমন চিকন তার গায়ের ত্বক যেন কেউ আয়নাখানা সদ্য মুছে দিয়ে গেছে। ছোট্ট ভুরু, ছোট্ট বাদামি চোখ, ছোট্ট নাক, আর ছোট্ট এক জোড়া ঠোঁট। বুজবুজের কানগুলি যেন বিধাতা অশেষ যত্নে গড়েছেন। অশেষ যত্নে এঁকেছেন তার চেরা পশমের মতো সরু সিঁথি। হাত পা সব যেন মোমে গড়া।

বুজবুজদিদি বোধহয় আমাদের পিসিমার মতো ছিল। ওই রকমই তুলতুলে, ফুলফুলে, টুকটুকে। তুলো-ভরা হাত পা। বাটালি দিয়ে কোঁদা নাসারন্ধ্র, কর্ণরন্ধ্র। তবে পিসিমার এফেক্টটা ছিল নিম-সুন্দরীর, একদিন-বোধহয়-খুব-সুন্দরী ছিলেন-এর। বুজবুজের এফেক্টটা রাজস্থানি মিনিয়েচারের। অণুচিত্রম্‌।

একটা তরুণী-শালিক পাখির মতো ছটফটে, হালকা, কিচিরমিচির ছিল বুজবুজদিদি।

‘আমারে তুমি অশেষ করেছো’, গাইবার জন্যে সরস্বতী ইনস্টিট্যুশনের মাস্টারমশাইরা তাকে ধরে নিয়ে যান। ‘আমার প্রদীপখানি তোমার পথে আজো রাতে জ্বলে’ গাইবার জন্য বাসর জাগাতে তাকে দরকার হয়। ‘শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে’ গেয়ে সে পাড়া-বেপাড়ার পুজো উদ্বোধন করে। জলসাতেও উদ্বোধনী-গীত বুজবুজের বাঁধা।

বুজবুজদিদি আমাদের চারজনকে—পুটপুট-বুবু-পুনপুন-বুনবুনকে গান শেখায়। তাকে কে কোনদিন শিখিয়েছে তার নেই ঠিক, সে মহা-উৎসাহে আমাদের তাল-লয়-সুর ঠিক করে দেয়। এখন বুঝতে পারি বুজবুজ আমাদের প্রত্যেকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ভুল সুরে শিখিয়েছিল। যেখানে কাজ নেই সেখানে কাজ, যেখানে টান নেই সেখানে টান, শব্দের বিভাগ ভুল। যা-ইচ্ছে-তাই। কিন্তু যাচ্ছেতাই নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বুজবুজের ভুল সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে অখুশি হতেন না।

‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস’-এ বুজবুজ আমাদের ‘এ-এ নে-ছিস’ শিখিয়েছিল, তাকে ‘এনে-এ-ছিস’ করতে আমাদের প্রাণ বেরিয়ে যায়। খালি অভ্যেসে ‘এ-এ নে ছিস’ বেরিয়ে যায় আর সুচিত্রাদির কাছে বকুনি খাই। ‘বজ্র মানিক’ দিয়ে-তে ‘বজ্র মা-নিক’ তুমি মোটেই আমাদের শেখাওনি বুজবুজ। ষষ্ঠীতাল আর দাদরার তফাতও কখনও শেখোনি, তুমি কী করে আমাদের শেখাবে? ‘স্বপ্নে আমার মনে হল’ তুমি তো দাদরাতেই গাইতে। কোনও ক্ষতি হয়নি তাতে। প্রায় কোনও গানই তুমি ফ্ল্যাট গাইতে না, অজস্র ছোট ছোট কাজে ভরিয়ে গাইতে, সেই সব অনেক যত্নে আমাদের গলায় তুলে দিয়েছিলে, তা আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার পথে প্রায় অনপনেয় বাধা হয়ে থাকে। কিন্তু বুজবুজ তুমি ‘ঝরনাতলার নির্জনে’ গাইছ, তোমার বৈতালিক স্বর ‘কোন ক্ষণে’তে হাউইবাজির মতো উর্ধ্ব আকাশে উড়ে গিয়ে আবার ফিরে এলো। আর কলস্বনে ভরে উঠল বিস্ময়ে বড় বিস্ময়ে আমাদের মন প্রাণ, রোমকূপ, সে সব তো ভুলব না! ‘গানের পরশ প্রাণে এলো আপনি তুমি রইলে দূরে?’ সে-ই বা কী! কী গান!

বুজবুজদিদি আমাদের সবাইকে নিয়ে একটা কনসার্ট করেছিল। অং-দাদা তার ভারী গলা নিয়ে লিড করত, সঙ্গে সঙ্গে থাকত বুজবুজদিদি। আমরা সবাই যোগ দিতুম। পম আর ই-দাদা ছাড়া। পালক পর্যন্ত। আমাদের হার্মোনিয়ম, তবলা, তানপুরা এ সব ছিল না। রেডি এক দুই তিন—বলে তিনটে টুসকি দিলেই আমার শুরু করে দিতুম—

সর্বখর্ব তারে দহে তব ক্রোধ দা-হ

হে ভৈ রব শক্তি দা-ও

কিছু মানে বুঝতে পারতুম না। সর্বখর্ব তারেদ হে-তব ক্রোধদা—হ। এই রকম ভাগ। ‘খর্ব’ আর ‘ক্রোধ আর পরের লাইনে ‘শক্তি’ এই কথাগুলো গোটা বোঝা যেত। কিন্তু ‘তা-আ-রেদ’র যে কী মানে হতে পারে ভেবে ভেবে কূল পেতুম না। তবে, বীররসাত্মক গান যে, তাতে কোনও সন্দেহ থাকত না।

আরও কয়েকটা গান নিয়ে এই সমস্যা হত।

সন্ধেবেলা পমদিদির আরতি হয়ে গেলে, সবাই ভজন করত। অদ্ভুত নিপুণতায় করতাল বাজাত ই-দাদা। গাইত সবাই।

‘ভবসা গরকা রণতা রণহে।’ এই অদ্ভুত মাথামুণ্ডুহীন গানে আমাদের কোনও ভক্তি হত না। পুনপুন চুপিচুপি জিজ্ঞেস করত—

—‘ “ভবসা” মানে কী রে?’

আমি (ভেবেচিন্তে)—‘বোধহয় ভ্যাপসার ভালো কথা। তুই “গরকা” মানে জানিস?’

পুনপুন (স্মার্টলি)—‘একরকমের গরাদ। রণতাটা একটা মেয়ের নাম। আর রণহে!’

আমি (প্রত্যয়ের সঙ্গে)—‘হে হে করে ডাকে দেখিস না! বুড়োরা ওমনি করে ডাকে। এমা! বুড়ো বললুম, বুড়ো মানুষ বলতে হয় তো! রণও একজনের নাম, রণতা আর রণ দুজনকেই হে হে করে ডাকছে।’

তা সত্ত্বেও যখন গানটার অর্থ বোধগম্য হত না, তখন আমরা চুপিচুপি ঠিক করতুম বুনবুনকে জিজ্ঞেস করতে হবে। বুনবুনের ওপর আমাদের অগাধ ভরসা। সে দাদাভাইয়ের সংস্পর্শে থাকে। কে না জানে দাদাভাইয়ের চেয়ে জ্ঞানী পুরুষ আর নেই! পমদিদি টমদিদি পর্যন্ত তাঁর কাছে সমস্কৃত পড়তে যায়, ই-দাদা সু-দাদা তাঁর কাছে অঙ্ক কষতে যায়। দিদিভাই-ই কি কম জ্ঞানী নাকি! ভী-ষণ জ্ঞানী। ঠাকুমাও জ্ঞানী। কিন্তু ঠাকুমা সব জ্ঞান নিজের ভেতরে রেখে দেন আর দিদিভাই জ্ঞান বিতরণ করেন। বুনবুন কত জানে? পলতা পাতা বেটে মটর ডাল নামক একরকম যাচ্ছেতাই ডালের সঙ্গে মিশিয়ে যে জ্বরমুখে খাবার দেবভোগ্য ‘পলতার বড়া’ হয়। পলতা যে পটলের পাতা মাত্র, ডুমুরের ফুল যে ডুমুর কাটলে ভেতরে গুঁড়ি-গুঁড়ি দেখা যায়, আম চুষে খেয়ে যদি টিয়েপাখির ছবি-আঁকা আঁটি পাও, তাহলে যে তুমি সেই আঁটি হাতে যা খুশি করতে পারবে, দই পাথরবাটিতে পাততে হয়, মাছ আর দুধ একসঙ্গে খেলে শ্বেতি হয়, সাহেবরা সব শ্বেতি মানুষ, ভগবান তাঁর উনুনে মানুষের পাঁউরুটি তৈরি করছিলেন, প্রথমে বেশি পুড়ে গেল—তার থেকে এলো আফ্রিকানরা, তারপরে ভগবান তাড়াতাড়ি রুটি বার করলেন তখন হল আধখানা হওয়া ফ্যাকফেকে শ্বেতি-মানবরা, আর তারপরে ভগবান সব ঠিকঠাক বুঝে গিয়ে উল্টে পাল্টে সেঁকে বাদামি মানুষরুটি বার করলেন, চমৎকার হয়েছে, তো তাদের তিনি পাঠিয়ে দিলেন আমাদের এই ভারতবর্ষ আর তার আশেপাশে, —এ সব খবর বুনবুন জানে।

কাজেই ‘ভবসাগর কারণতারণ হে’র মানে জানতে বুনবুনের শরণাগতি ছাড়া পথ কই?

বুজবুজদিদি যেন বাড়ি ছাড়া। ফাঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চুল আঁচড়াবে, চোখে সরু করে কাজল দেবে। চিবুকে বিউটিস্পট না আঁকলে তার সাজুগুজু শেষ হবে না। ঘটিহাতা লাল বেলাউজ পরে সে কটকটে সবুজে লালে খড়কে ডুরে পরে, চুলে দুটো বেণী ঝোলাবে, কিছুতেই বেড়াবিনুনি করবে না, করবে না, করবে না। হাওড়া হাট থেকে এক ঝাঁক শাড়ি এসেছে। পুজোর ঠিক আগেটায়। পম অদূরে দাঁড়িয়ে নিতান্ত অবহেলার সঙ্গে দেখিয়ে দেবে—‘ওইটা’। সাদা খোলের শান্তিপুরী শাড়ি, ঢালা পাড়, কমলা কি সবুজ কি খয়েরি। এমন কি মার শাড়িগুলো, ঠাকুমার শাড়িগুলোও ওর থেকে জমকালো। কী সুন্দর কালো চোখ চোখ পাড় ঠাকুমার শাড়িতে, মায়ের শাড়ির চোখগুলো টুকটুকে লাল, ফরাসডাঙার গোলাপি কোরের, নীল কোরের শাড়ি মা আগে পরে দেবেন, ধোপাবাড়ি থেকে কেচেকুচে নি-বর্ণ হয়ে আসবে তবে পম সে শাড়ি ছোঁবে। টম দেখো বালি বালি রঙ, আকাশ নীল, ফিকে গোলাপি এই সব বেছেছে। বুজবুজ সেখানে ছোঁ মেরে তুলে নেবে সবচেয়ে বর্ণময়, লাল-জরদা-ময়ূরকণ্ঠী ঝকঝকে চকচকেটা।

—‘তুই ছোঁ মারছিস কেন?’ টম বলবে হেসে—‘তোর শাড়ি কেউ নেবে না।’

সেই শাড়ি পরে, চোখে কাজল সুর্মা টেনে, বিনুনির আগায় সবুজ ফিতের ফুল, চিবুকে বিউটি-স্পট বুজবুজ যখন কোথাও গান গাইতে বেরোবে, ঠাকুমা বলবেন —‘ও মা! এ কে যায় গো? অচলা না বিমলা! দেখিস মা কারও আবার গৃহদাহ করিসনি।’

বড় নাতনি পমের মুখ অন্ধকার হয়ে যাবে সেই শুনে। সেদিকে তাকিয়ে ঠাকুমা আবার খোলের মধ্যে ঢুকে পড়বেন। পমপমদিদি আমাদের বাড়ির পোপ।

বুজবুজ বাড়ির মধ্যে বন্দি থাকতে ভালোবাসে না। সে পাড়ার সব্বার সঙ্গে ভাব করবে। সমবয়সী সখীদের নিয়ে নিজের ছাতে, তাদের ছাতে গল্প করবে। সন্ধে পার হয়ে যাবে। পম বলবে— “মা, শ্রদ্ধাকে একটু বকুন! আমাদের বেলায় তো…।’

বুজি বাড়ি ফিরলে মা ডাকবেন—‘শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা, সন্ধের আগে বাড়ি ফিরো। কেমন?’

বুজবুজ কী করে বোঝায়—সন্ধের পর যখন সব আঁধার হয়ে যায়, একটা একটা করে বাতি জ্বেলে যায় বাতিওয়ালা, পাখিরা ঝাঁক বেঁধে ঘরে ফেরে, চামচিকেরা হাজারে হাজারে বেরিয়ে পড়ে তখনই তো মুখ-না-দেখা আলোয় বন্ধুদের সঙ্গে মনের প্রাণের কথা বলার সময়, তার স্বাদই আলাদা। তাই বুজবুজ নিজের ছাতেই বেশির ভাগ থাকে। ছাতের পাঁচিল ধরে ঝুঁকে পড়ে—‘এই মঞ্জু আসিস, গোধূলির সময়ে আসিস, আমাদের ছাতে, ভারতীকে নিয়ে আসিস। ঠিক! ঠিক তো!’

আমাদের ভারি অসুবিধে হয় এতে। কেননা ছাতটা তো আমাদেরও খেলার জায়গা।

বুজবুজদিদি ঠোঁট উল্টে বলে—‘তোরা লেডিজ পার্কে যা না। কত্ত খেলার জায়গা রয়েছে! ঋতিকে বলে দিচ্ছি, নিয়ে যাবে, ঋতি-ই-ই।’

—‘ওখানে যে ছেলেদের ঢুকতে দেয় না!’

—‘পুনপুন বুনবুন আবার ছেলে না কী! ঠিক ঢুকতে দেবে।’

কিন্তু আমাদের দলে যে পুনপুনদের থেকেও বড় ছেলে আছে! আমরা তাই গোঁজ হয়ে থাকি।

—‘বাবা, বাবা, সন্ধেবেলায় একটু ছাতে বেড়াব তারও উপায় নেই।’ বুজবুজ দিদি সরোষে বলবে।

আসলে আমরা লেডিজ পার্কেও খেলি, দেশবন্ধু পার্কেও খেলি। আনি মানি জানি না, ছেলে মেয়ে মানি না। কিন্তু সেখানে আমরা খেলি চু-কিত কিত। বুড়ি-বসন্তী, এইসব। আর সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে ছাতে খেলি নাম পাতাপাতি। ছোটাছুটি নেই। একটু অন্ধকার হলেও অসুবিধে হয় না। ‘আয় তো আমার সূর্যমুখী!’ কিংবা খেলি রুমাল চোর। টুটু পিঠে কী জোর কিল মেরেছে উঃ।

তখন বুজবুজদিদি অগত্যা গাইতে বসে।

‘নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ প্রবাল দিয়ে ঘেরা

শৈলচূড়ায় নীড় বেঁধেছে সাগর বিহঙ্গেরা!

যাবোই আমি যাবোই…’ কোথায় যাবে বুজবুজদিদি?

যেও না! যেও না!

চতুর্দশ অধ্যায় : হরিবংশ ৭—পুটপুটদিদি

‘পটলি-ই, পটলি-ই’—পিসিমা ডাকছেন।

হাঁটুর তলা অবধি ঝুল, বুকে ঝালর দেওয়া বেগনি ভয়েলের প্রচুর কুঁচির ফ্রক পরা পটলি গোলাপি উলের মোজা বুনছে। ইস্কুলের কাজ। শেষ না হলে দিদি স্কেলের বাড়ি মারবেন।

—‘কেন পিসিমা?’

—‘দ্যাখ তো, পম-টমের কলেজের বাস কেন এখনও দোড়গোড়ায় ডাঁড়িয়ে!’

পটলি ছুটে যেতে না-যেতেই বাস থেকে একঝাঁক প্রজাপতি নেমে আসে। লাল নীল বেগনি হলদে। এক বিনুনি, দু বিনুনি, বেড়া বিনুনি, খেজুরছড়ি, হাত খোঁপা, কলেজ খোপা। বিনুনির মধ্যে বিনুনি ঢুকিয়ে প্রজাপতি খোঁপা— ‘এই ঋতি, ঋতি তোদের সেই যমজ দুটো কোথায় গেল, ডাক তো!’

পুনপুন সবেগে পালাচ্ছে। ও এক্ষুনি বাবার সেক্রেটারিয়েটের তলায় ঢুকবে। ভীষণ লাজুক ও। ওকে কেউ দেখতে চাইলেই ওর মুখ লাল হয়ে যায়। পুনপুনের লজ্জা হয়, আর বুবু হয় ভীষণ বিরক্ত। তার লজ্জা-টজ্জা নেই।

—‘ওই তো, ওই তো পালাচ্ছে বুবুটা।’

বুবু ঘাড় বেঁকিয়ে অটল-অচল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

—‘আমি পানাইনি,’ সে ঘোষণা করে।

তার আত্মমর্যাদাবোধ অপমানিত। পালাবে কেন? সে কি কাপুরুষ? ভীরু? বাবাকে আর ই-দাদাকে ছাড়া কাউকে ভয় করে না সে। আর একটু ভয় করে পমকে আর টমকে, আর খাওয়ার সময় পিসিমাকে কুমড়োর ঘ্যাঁট জোর করে খাওয়াবেন বলে। আর পাশের বাড়ির প্রীতিদিদিকে, দেখলেই বলবে—

‘উঁচকপালি চিরণদাঁতি বড় যে ডিঙোলি মোরে

থাক থাক থাক থ্যাবড়া-নাকি ধর্মে রেখেছে তোরে।’

আর সামনের বাড়ির বিশুকাকাকে, কেননা সে বুবুকে বলে ‘বেঁটে বামন’। তার পরে একটা আলমারির ওপরে বসিয়ে দেয়। রেডিও চালিয়ে দেয়। রেডিওর মধ্যে ভূতে কথা বলে। বিশুকাকা ভয় দেখায় ওই ভূতগুলো বাইরে বেরিয়ে এসে বুবুকে নিয়ে রেডিওর মধ্যে ঢুকে যাবে। রেডিওর বাক্সে একবার ঢুকলে আর বেরোনো যাবে না। আর ভয় করে মেজদাদাভাইকে, তিনি তাকে নিয়ে লোফালুফি করেন বলে। হুই শূন্যে ছুঁড়ে দিলেন, তোমার আত্মারাম গুটিয়ে- সুটিয়ে খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম, এই বুঝি মাটিতে আছড়ে পড়লে। এমন সময় মেজদাদাভাই তোমাকে লুফে নিলেন। ফসকে যেতেও তো পারে। অতএব বুবুর ভয়ের লিস্টি এমন কিছু বেশি নয়।

—‘পানাইনি!’ কী মিষ্টি কথা বলে রে তোদের বোনটা! এই দেখো লাল-নীল চক। নেবে? এসো না!

বুবু ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লাল-নীল চকের দিকে আড়ে আড়ে তাকায়। লোভে কম্পমান। কিন্তু লোভ সে দেখাবে না কখনওই। হাতে গুঁজে দিলে অগত্যা নেবে। তখন হলদে প্রজাপতিটা এক ঝটকায় তাকে কোলে তুলে নেয়, টেবিলের ওপর বসিয়ে দেয়।

—‘আমার বাবার সেকেটেবিল।’

—‘তোমার বাবার কী টেবিল?’

বুবু তাচ্ছিল্যে আর উত্তর দেয় না। সেকেটেবিলের মতো সহজ কথা যারা একবারে বুঝতে পারে না, তাদের আর কী বলা যায়?

—‘সেকেটেবিল কী রে, ঋতি?’

—‘সেক্রেটারিয়েট টেবল’—ঋতি মুচকি হেসে জবাব দেয়।

—‘ওমা ওমা!’ প্রজাপতির দল হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে।

—‘বাবা নাগ করবেন—’ বলতে বলতে গম্ভীরভাবে পেছন ঘষটে ঘষটে বুবু নেমে যেতে থাকে।

—‘বাবা নাগ করবেন? তুমি নাগ করনি তো?’

ঋতি বলে—‘বাব্বাঃ মুকুলদি, বুবু যা রাগী না। রাগ হলে আর দেখতে হচ্ছে না। ছোটরানি আছাড় খাইয়া পড়িবেন। ফোঁস ফোঁস করে কী ফোঁপাতেই পারে। সব ফল্‌স। যতক্ষণ না কাউকে মার বা বকুনি খাওয়াচ্ছে ততক্ষণ ভান করেই যাবে, করেই যাবে।’

—‘তোমার ভাই কোথায় গেল? কী যেন বলো? পুনপুন না?’

—‘পুনপুন’, ঘৃণাভরে বুবু বলে। এরা কী! তার পুনপুনকে পুনপুন বানিয়ে দিচ্ছে?

—‘ভুল হয়ে গেছে, নাগ করো না ভাই, তা তোমার পুনপুন-ভাই কোথায়?’

—‘টেবিল-নীচে।’

—‘টেবিল? এই সেকেটেবিল?’

পুনপুনকে টেনে বার করা হয়। সে হাত-পা ছোঁড়ে। প্রজাপতিরা মাথা সরিয়ে, বিনুনি দুলিয়ে আঘাত এড়ায়।

পুনপুনও টেবিলের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার মুখ দু হাতে ঢাকা আঙুল ফাঁক ফাঁক। তার মধ্যে দিয়ে চোখের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে।

—‘পুনপুন, তোমার আরেকটা ভাই আছে না? বুনবুন?’

‘বুনবুন, বুনবুন’—বুবুই জানিয়ে দেয়, তারপরে বলে—‘আমার ভাই।’

—‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরা জানি তো, তোমারও ভাই বইকি!’

পুনপুনের হাতে নীল চক চলে যায়। পুনপুন কথা বলছে না। গোলাপি চক চলে যায়। পুনপুন তবু কথা বলছে না। সবুজ চক চলে যায়। তখন পুনপুন বলে ওঠে—‘ওইটা।’

একটি মাত্র হলুদ চক অবশিষ্ট ছিল, ওরা ভেবেছিল ওইটা বুবুকে দেবে, পুনপুন সেটি হস্তগত করতে চায়। ব্যাগ থেকে শেষ লাল চক বার করে বুবুকে দিতে যায় ওরা। বুবু ঘাঁড় বেঁকিয়ে চুল ঝাঁকিয়ে বলে—‘ও সব যাক গে।’ বলে সে অটল গাম্ভীর্য এবং মহিমার সঙ্গে ভেতর বাড়িতে চলে যেতে থাকে।

আবার হাসি। এ ওকে, ও একে বলে—‘ও সব যাক গে।’

পুনপুনের প্রতি প্রশ্ন—‘বুনবুনের জন্যে মন কেমন করে না তোমার?’

—‘বুনবুন বিকেলবেলা আসবে।’

—‘তাই বুঝি? বাস, তাহলেই আর মন-কেমন করবে না? যমজ না তোমরা?’

—‘বুবু আছে।’

বলতে বলতে পুনপুন এদিক-ওদিক তাকায়। না বুবু নেই। বুবু নিষ্ঠুরের মতো এই প্রজাপতিমহলে তাকে একলা ফেলে রেখে চলে গেছে। সে ঠোঁট ফোলাতে থাকে। সে ছেলে, সহজে কাঁদে না। শুধু ঠোঁট ফোলে।

—‘কী মিষ্টি! কী মিষ্টি! দ্যাখ রাণু। এই শান্তিকে দেখতে দে। মুকুল দেখেছিস?’

পুনপুন ঋতির দিকে দু হাত বাড়িয়ে দেয়, ভীষণ ফোঁস ফোঁস করছে সে। ঋতি অসীম গর্ব এবং দায়িত্ববোধের সঙ্গে পুনপুনকে কোলে নেয়। তার সেই বিখ্যাত, সর্বজনপ্রিয় যমজ ভাই তার কোলে আশ্রয় খুঁজছে। ভালো করে নিতে পারে না, সে-ও বিরাট বড় তো!

দুই ভাই-বোনকে দু হাতে ধরে ঋতি রোজ লেডিজ পার্কে যায়। সেখানে কানুমামা আসে, আর বুনবুন। ঋতি তার নিজের দলের খেলুড়িদের সঙ্গে মিশে যায়। কিন্তু ভাইবোনেদের ওপর ঠিক নজর রাখে।

একদিন দুটো লোক, কলকে ফুলের গাছের ওপাশ দিয়ে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।

—‘শোনো খুকু।’

—‘কী বলছেন।’

—‘তোমরা কী শিবশঙ্কর মল্লিক লেনে থাক? শ্যামপুকুরের ওখানে?’

—‘হ্যাঁ।’

—‘ওখানে দুর্গাপ্রসাদ বলে এক ভদ্রলোক থাকেন?’

—‘আমার বাবা তো!’

—‘তোমার বাবা? বাবার বন্ধুরা খুব আসেন, না?’

—‘হ্যাঁ।’

—‘কে? কে? কেমন দেখতে? চেহারা বলতে পার? আমাদের একজন দুজন চেনা আছে কি না। তাই জিজ্ঞেস করছি।’

ঋতি অবাক হয়ে যায়, ‘বাবাকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করুন না।’ সে বলে। পরে বাড়ি গিয়ে বাবাকে বলে দেয়।

বাবা বলেন— ‘ঠিক আছে। কারও সঙ্গে আর কথা বলতে হবে না।’

—‘জিজ্ঞেস করলে কী বলব?’

—‘চলে যাবে সেখান থেকে।’

বাবার ভুরুতে ছোট ভাঁজ পড়েই মিলিয়ে গেল।

—‘বাবা, ওরা কি ছেলেধরা? বুবু-পুনপুনকে চুরি করবে?’

—‘বলা কিছু যায় না, কথা না বলাই ভালো।’

—‘পুলিসকে বলে দেওয়া যায় না!’

বাবা এবার ভালো করে হাসলেন।

লোকগুলো এবার বুবুকে ধরেছে।

—‘তোমার নাম কি খুকু?’

—‘বিদ্‌ দা।’

—‘বা বা বা। কী সুন্দর নাম!’

—‘তোমার বাবার নাম জানো?’

—‘হ্যাঁ-অ্যাঁ। দুগ্‌গি।’

—‘বা বা বা। চমৎকার। বাবার বন্ধুদের নাম জানো?’

—‘আমার ভোন্দু আছে।’

—‘তোমারও বন্ধু আছে? থাকবেই তো! বাবার বন্ধু কে? চশমা পরা, ফর্সা করে, আসেন না?’

—‘অভিনাশ জেঠু। অখয়কাকু, নুবিমামা…’

—‘না, না আর কেউ নেই? মাঝে মাঝে আসেন? ধরো মাঝরাত্তিরে তোমাদের বাড়ি ফিস্টি হয় না? রান্নাবান্না? বাবার বন্ধুরা খাবে!’

—‘নাতে আম্মা ঘুমুই।’

পুনপুন এসে দাঁড়িয়েছে। সে আরও তথ্য সরবরাহ করে, বলে—‘মার পাশে। বুবু আমার গোজা খেয়ে নেয়।’ হতাশ লোক দুটোকে পুনপুন যেতে দেয় না, বলে—‘তোমার ঝোল্লা কই?’

—‘ঝোলা? আমাদের কেন ঝোলা থাকবে?’

—‘ছেলেধরাদের ঝোল্লা থাকে, একানড়েদের ঝোল্লা থাকে। যে ছেলেটা কাঁ-দে ঝুলির ভেতর বাঁ-ধে—’

—‘তোমাদের বাড়ি ঝোল্লা নেই! তাতে বন্দুক বোমা?’

—‘কালীপুজোয় দোমা ফেটেছিনুম।’

ঋতি এই সময়ে ছুটতে ছুটতে আসে। সে লোক দুটোর দিকে না তাকিয়ে ভাই-বোনকে বলে — ‘চল বাড়ি যাই।’

ভেতরে ভেতরে তার বুক দুর দুর করছে। আরেকটু হলেই হয়েছিল আরকি! কিন্তু সে বাইরে কিছু বুঝতে দেয় না।’

কিন্তু পুনপুনের যে লোক দুটোকে ভারি পছন্দ হয়ে গেছে। সে বলে—‘আমি ছেলেধরাদের কাছে যাব-ও-ও।’

কী অদ্ভুত! সাধ করে কেউ ছেলেধরার কাছে যেতে চায়? আচ্ছা ছেলে তো! লোক দুটো একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। বলছে—‘যাও খোকা বাড়ি যাও।’

—‘তুমি দোমা ফাটতে আসবে?’ পুনপুন জিজ্ঞেস করে।

— ‘তুমি নাতে ফিটটি খেতে আমাদের বাড়ি আসবে?’ বুবু জিজ্ঞেস করে। এ কি জিজ্ঞাসা না নিমন্ত্রণ?

—‘ইলিশ মাছের ঝোল

সপসপিয়ে তোল—’ পুনপুন লোভ দেখাচ্ছে রীতিমতো।

—‘আজই চলো। চলো না!’ বুবু আর পুনপুন দু’দিক থেকে দুজনকে ধরেছে। কী পছন্দ যে হয়েছে লোক দুটোকে ওদের!

‘দিদিভাইয়ের পদ্মকাটা আমসত্ত্ব আছে’ —বুনবুনও হাজির। সে বুবু আর পুনপুনকে টেক্কা দিতে চায়।

—‘আমাদের পিসিমার জারক নেবু আছে’—পুনপুন হারবে কেন?

—‘কাঁইবিচি আছে এতগুনো!’ হাত ফাঁক করে বুনবুন দেখায়।

—‘গুলি আছে, টলগুলি। লাট্টু আছে।’

—‘টেকনের বিড়ি আছে, দুন্ডি আছে’ —বুবু লোভনীয়ের তালিকায় সর্বোত্তম দ্রব্যগুলিকে হাজির করে সবার ওপরে টেক্কা দিতে চায়।

—‘আমি বিড়ি খাই’—পুনপুন গোপন কথা ফাঁস করে।

—‘বিড়ি বিচ্ছি।’ বুবু মত দেয়। তার পরেই বলে ‘বিড়ির বাকসো নিয়ে শ্বশুবাড়ি যাবো, টেকন বনেছে।’ যে বিড়ি বিশ্রী, তাই নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবার সম্ভাবনাতে সে এত উল্লসিত কেন বোঝা যায় না।

একটা লোক পকেট থেকে সিগারেট বার করে। ধরায়। বুবু-পুনপুন-বুনবুন অসীম বিস্ময় আর প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

—‘ল্যাবেঞ্চুস খাবে?’

তিনজোড়া হাত সঙ্গে সঙ্গে প্রসারিত হয়।

আর সঙ্গে সঙ্গে ঋতি বনবেড়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।

—‘ছেলেধরা! ছেলেধরা! আমার ভাইবোনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।’

মুহূর্তে বেশ কিছু লোক, লোক দুটোকে ঘিরে ধরে।

গণপ্রহার তখন এত সুলভ ছিল না। কলার ধরাও না।

লোকগুলো তাই শুধু ঘিরে ধরে।

—‘কী ব্যাপার? কী ব্যাপার? বাচ্চাদের নিয়ে কী হচ্ছে? ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদে দেখোনি?’

—‘আমরা দুগগাপ্রসাদ বাবু মানে ডাক্তারবাবুর চেনা লোক। এই যে এদের বাবা। চেনা বলেই কথা বলছি।’

—‘চেনা লোক? ইয়ার্কি হচ্ছে? এই খুকু তাহলে চেঁচাচ্ছিল কেন?’

—‘ঠিক আছে, চল্ ওঁর কাছে নিয়ে।’

দুর্গাপ্রসাদ চেম্বারে বসে আছেন, একটি সবেধন নীলমণির নাড়ি টিপে ধরেছেন। পাশেই তাঁর বাবার চেম্বারে অনেক বেশি ভিড়। আবির রঙের মিকচারের শিশি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে রুগিরা। লোক দুটিকে নিয়ে হই-চই করতে করতে সবাই গিয়ে দাঁড়ায়। লোক দুটোকে শক্ত করে পাকড়ে কজন। পাশাপাশি বুবু পুনপুন বুনবুনকে আগলাচ্ছে আরও কজন। ঋতি আর কানু একটু পেছনে।

—‘কী ব্যাপার?’

—‘দেখুন তো ডাক্তারবাবু এদের চেনেন কি না, আপনার বাচ্চাদের বিরক্ত করছিল। বলে না কি আপনার চেনা!’

ডাক্তারবাবু এবার মুখ তুলে দেখেন। দেরাদুনগামী ট্রেনের কামরায় এদের শেষ দেখেছিলেন। এখন, এই এত বছর পরেও এরা তাঁর পেছনে লেগে আছে? তিনি রুগির কবজি ধরেই হঠাৎ মুখ তুলে বলেন—‘স্বাধীনতা তো আর এসে গেল বলে। এর পর কার গোলামি করবেন? আপনাদের লজ্জাও নেই!’

লোক দুটো দেঁতো হাসি হাসল।

—‘ছেড়ে দেব? ইনফর্মার বোধহয়!’— জনতা বলে।

—‘ছেড়ে দিন।’

—‘দে শালাকে এক ঝাপড়।’

দুই থাপ্পড় দিয়ে ওদের যেতে দেয় জনতা। বীরদর্পে বাড়ি ঢোকে ঋতি। বুনবুন আর কানুকে পৌঁছতে যায় টেকন। বুবু-পুনপুন বুঝতে পারে না অত সুন্দর লম্বা-বেঁটে ছেলেধরা, যাদের পিঠে ঝোল্লা নেই, যাদের পকেটে চমৎকার সিগারেট থাকে, যারা বন্দুক-বোমা এই সব চমৎকার চমৎকার বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে, পরবর্তী কালীপুজোয় যাদের আসবার শুভ সম্ভাবনা রয়েই গেল, যাদের মধ্যরাতে ইলিশ মাছ আর জারক লেবুর ভোজ খাওয়াবার জন্যে তারা নিমন্ত্রণ করেছে, এবং সর্বোপরি যারা বাবার বন্ধুদের মতো বন্ধুভাবাপন্ন বিষয়ে ইনটারেস্টেড, তাদের কেন পাড়া-বেপড়ার লোকেরা মার দিল? তাদের বৈকালিক আড্ডাটা সম্পূর্ণ মাটি হয়ে গেল।

ঋতি অংশুকে বলে—‘আমাদের ছোট তিনটে না রামবোকা। বুঝলি ছোড়দা? কারুর কাছে মুখ খুলবে না। বড়দি মেজদির বন্ধুরা, মুকুলদি, রাণুদি, শান্তিদি… কত সাধাসাধি। আদর। রঙিন চক দিচ্ছে, লজেন্স দিচ্ছে, কিছুতেই কিছু না— ‘ও সব যাগ্‌ গে।’ বলে বুবুবাবু চলে গেলেন। এদিক দ্যাখ, বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি দুটো লোক, দেখলেই বাজে বলে চেনা যায়, তাদের হাত ধরে, এক গঙ্গা কথা বলে একেক্কার। বাড়িতে কী কী আছে, কে কে আছে, কী কী খাবার হয়, স-ব। আবার বলছে ‘কালীপুজোয় বাজি ফাটাতে আসবে? ইলিশ মাছের ঝোল খেতে আসবে?’ ‘ইলিশ মাছের ঝোল কেমন খেতে হয় তোরা জানিস? খাস তো শিঙ্গি মাছের ঝোল আর মুসুর ডাল, এখনও তো খাবার সময় হলেই মায়ের কোলে গিয়ে বসিস!’

সব কথা শুনে-টুনে ঠাকুর্দাদা ঠাকুমাকে গম্ভীরভাবে বলেন—‘বুঝলে ছোট গিন্নি সুভাষ বোস যে ফিরে আসেননি এরা এখনও সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না। এদের ধারণা উনি এসেছেন, বাঙালিদের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছেন। এদিকে কবে থেকে ক্রিপস মিশন হচ্ছে, অমুক কমিশন হচ্ছে, তমুক কমিশন হচ্ছে, ওয়াভেল-মোহাভেল ইনডিপেন্ডেন্স এরা দিতেও বাধ্য হবে। কিন্তু সুভাষকে ওরা ছাড়বে না। যেনতেনপ্রকারেণ আটক করবে। পাবলিক ওপিনিয়নের জন্যে প্রকাশ্যে মারতে পারবে না, কিন্তু গুমখুন করবে। আমার তো সন্দেহ হয়, আমাদের নেতাদের সঙ্গে ওদের গোপন আন্ডারস্ট্যান্ডিং-ও আছে এ বিষয়ে।

—‘আমাদের নেতা? কার কথা বলছ?’—ঠাকুমা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন।

—‘কার নয়, কাদের। কারা আবার? গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল কে নয়? আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। ওদিকে আবদুল গফফর, আর এদিকে শ্যামাপ্রসাদ— এই দুটি মানুষের মতো মানুষ। বাকি সব ফেক।’

—‘বলছ কি গো? মহাত্মাকেও অবিশ্বাস করো?’

—‘আরে বাবা, দুগ্‌গিকে জিজ্ঞেস করো, গান্ধীর নীতি নন-ভায়লেন্স। সুভাষ একেবারে উল্টো। রক্তের মূল্য ছাড়া স্বাধীনতায় বিশ্বাসই করে না। ইডিয়লজিতে কোনওদিন মিলবে না ওদের। গান্ধীর গোঁ বানিয়ার গোঁ। ইগো কম নাকি? ওরা তো বলতে চাচ্ছে সুভাষ যেহেতু জার্মানি গেছে সে-ও অমনি ফ্যাসিস্ট হয়ে গেল। হিটলার মুসোলিনি তোজোকে এনে ইংরেজের সিংহাসনে বসিয়ে দেবে।’

—‘আরে বাবা, সে লোকটা বিবেকানন্দের চেলা। আই.সি.এস নিলে না। কেরিয়ার কী? ফিরে তাকিয়েছে সে দিকে? নেতৃত্বের জন্যে হ্যাংলামি করেছে? হরিপুরায় গান্ধী যা করল, তারপরে গান্ধীর আর মুখ দেখানো উচিত? ছি ছি ছি। স্যাক্রিফাইস দেখেও লোক চিনলি না, মেরিট দেখেও লোক চিনলি না। ইংরেজের জায়গায় জার্মান-জাপানি ভূত এনে বসাবে সুভাষ? ছি ছি ছি। এখন বাঙালির ঘরে ঘরে আজাদ হিন্দ ফৌজের লোকের খোঁজ করছে? রাবিশ!’

ঠাকুমা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সুযযি সেন গেল, বারীন ঘোষ গেল, বিনয়-বাদল-দীনেশ গেল, টেগরা, ভগৎ, চাপেকররা গেল, আরও কত গেল গো, আহা! আর কি অমন সোনার চাঁদ সব আসবে? ফিরবে? অমন ভাগ্যি কি আর আমরা মায়েরা করতে পারব? একটা মহৎ-মহান যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে গো! কেউ দেখলে না, শুনলে না, জানলে না, অত রক্ত কোনও কাজেই লাগল না, এখন সব গোলটেবিল করছে।’

ঠাকুর্দা রাগত স্বরে বললেন—‘বেনাবনে মুক্তো ছড়ালে এমনই হয়। এই ভারতবর্ষ একটি বৃহৎ বেনাবন। কিংবা বলতে পার একটা লম্বা ন্যাজের বাঁদর। গলায় মুক্তোর মালা ঝুলিয়ে দিলে কি আর বাঁদরে বুঝতে পারে? তার কাছে চাপকানের বোতামও যা মুক্তোও তা। গাছের ডালে বসে বসে ছিঁড়ছে খিঁচোচ্ছে আর ছিঁড়ে গো-ভাগাড়ে ফেলছে। বোগাস।’

ঋতি আর অংশু, সবচেয়ে ছোটদের ঠিক ওপরের দুজন, বড়দের মান-সম্মান-প্রতাপ-প্রতিপত্তি আর ছোটদের আদর-আবদার-যত্ন-আত্তির মধ্যে যারা চেপ্টে গেছে, তারা মন দিয়ে ঠাকুর্দা-ঠাকুমার আলোচনা শোনে। এসব কথা সাধারণত তাদের বাড়িতে কেউ বলে না। বাবা তো নয়ই। কিন্তু ওরা জানে এই একমাত্র প্রসঙ্গ যাতে বাবা-ঠাকুর্দা একমত।

গুপ্তচর? ওই লোকগুলো গুপ্তচর? সুভাষ বোসকে খুঁজতে এসেছিল? আজাদ হিন্দ ফৌজের লোকদের খুঁজতে আসে? তাদের বাড়ি? গান্ধীর আর মুখ দেখানো উচিত না? নেহরু, গান্ধী, প্যাটেল এরা তো সব দেবতা? এদের বিশ্বাস করতে পারছেন না ঠাকুর্দা? ঠাকুমা?

সুভাষ বোস-নেতাজিকে এরা মেরে ফেলবে? গুমখুন? হায় ভগবান! অংশু ঋতির হাতে যদি ক্ষমতা থাকত তো ওরা সেই গুমখুনে লোকগুলোকে ওইরকম ঝাঁপড় দিত। মেরে ধরে ছিঁড়ে খুঁড়ে দিত। ইতিমধ্যে সব ফেক। রাবিশ। বোগাস!

রাবিশ, বোগাস মানে তারা মোটামুটি জানে। কিন্তু ফেক মানে কী? ফেক? ঋতি ডিকশনারি দেখবে ভাবে, অক্সফোর্ড কনসাইজ। দেখা হয়ে ওঠে না। ভুলে যায়। কিন্তু কানের মধ্যে স্মৃতির মধ্যে লেগে থাকে, চূড়ান্ত ঘৃণার আশাভঙ্গের উচ্চারণ, ফেক! ফেক! সব ফেক!

পঞ্চদশ অধ্যায় : প্রলম্বিত ব্যোমাসুর—শেষ আক্রমণ

কংস এবার তার তৃণ থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী তীরটা বার করে। ডেকে পাঠায় ভীষণতম আততায়ীদের। অসুরের পৃথিবীতে মহা সাড়া পড়ে গেছে। কঠিন জন্মজটিলতা, শরীর-ওজন-প্রাণ তিন ভাগ করা ব্যর্থ হল। ব্যর্থ হল আকাল, বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা। কোথা থেকে ও অক্ষয় বল সংগ্রহ করছে? কোন দেবতা একটার পর একটা কাটিয়ে দিচ্ছে সব অস্ত্র? সব বিষ? বেড়ে যাচ্ছে। বড্ড বেড়ে যাচ্ছে ও। ওকে খুন করো। ছলে বলে কৌশলে। পারতেই হবে। না পারলে আর ফেরা চলবে না। যাও প্রলম্ব, যাও ব্যোম, ওর খেলার সঙ্গে মিশে যাও। যাতে ও সতর্ক হতে না পারে। আক্রমণ করো যখন ও সবচেয়ে আনন্দিত, সবচেয়ে অন্যমনা। শোঁ-ও-ও করে ধুলোর ঘূর্ণি ওঠে। প্রলম্ব মিশে যায় ব্যোমেতে, ব্যোম নামতে থাকে দুরন্ত বেগে। এত বেগ যে অসুরের লক্ষাধিক কিলবিলে হাত পা দেখা যায় না। খালি হাওয়া, হাওয়া। সিলিং ফ্যান বাঁই বাঁই চললে যেমন তার ব্লেড দেখা যায় না!

ওরা খেলছে। খেলার আর ওদের শেষ নেই। আদি-অন্ত নেই। জগৎ পারাবারের তীরে শিশুরা এক নিত্য খেলা খেলছে। সাগরে ঢেউ উঠছে ঢেউ পড়ছে, বালি সরছে বালি ভরছে। কত ঝিনুক-শামুক-শঙ্খ-নুড়ি-সী হর্স, আসা-যাওয়া যাওয়া-আসা, ঢেউয়ের মাথায় ফেনার রাশি, ফেনার মালা, ঢেউয়ের পায়ে ফসফরাসের নূপুর-ঝালা, কত পানসি তীরে ফিরছে, কত পানসি ডুব গালছে, কত মাছ রুপো-চিকচিক, কত হাঙর ছুরি ঝিকঝিক, ওদের ভ্রূক্ষেপ নেই।

—কী নিয়ে খেলছ বাবু?

—বালি নিয়ে।

অতি নশ্বর অতি ভঙ্গুর বালি, তাই দিয়েই গড় বানাই, প্রাসাদ বানাই, কুটির বানাই। বাংলো বাড়ি, শহর নগর, পাহাড়-টিলা, খেলার মাঠ, চাঁদের হাট…সকল বানাই। ভেঙে যাবে? যাক, ক্ষতি নেই। আবার গড়ব। বারবার গড়তেই তো মজা! জগদ্দল অচলায়তন গড়ে কী লাভ! ভেঙে যাক। কেমন নতুন নতুন বানানো যায়।

—কী নিয়ে খেলছি? একটা ‘ছুতো’ পেয়েছি।

ছুতো কী? না সুতো। কী আনন্দ! ক্রোশে নয়, রেশম নয়, গুলি সুতো। সুতোতে গিট দেয়, আবার খোলে। সুতো পাকায় আবার তার পাক খোলে, হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়, কাটা ঘুড়ির মাঞ্জা-সুতো ধরবার মতো কান পাকড়ে ধরে আনে। এত ধৈর্য, এত কল্পনা, এত আনন্দ কার? তার। এই পৃথিবীতে একমাত্র তা-রই। যার চোখে এখনও সকালের নিষ্কলুষ আলো। যার মনোযোগ এখনও সূচ্যগ্রে বিঁধে আছে। ওকে, ওই মহাকবি মহাবৈজ্ঞানিক মহাপ্রাযুক্তিক আদি-ঋষিকে বিরক্ত করো না মাতৃগণ। মহার্ঘ খেলনা কার জন্য আনছ হে বিত্তগর্বী পিতর্‌? ও দাম বোঝে না। ওকে এক দাও, ও তাকে বহু করে ফেলবে আপন প্রতিভায়, বহু দাও, ও তাকে এক-একঘেঁয়ে করে ফেলবে, অবহেলায় ফেলে দেবে বহুমূল্য গাড়ি, পুতুল…।

ওই দ্যাখো, ওই শিশুটি নিউ জার্সির বিলাস কামরায় খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ওর ঘর ভর্তি খেলনা। কত? সংখ্যা নেই। সরল খেলনা, জটিল খেলনা। তাহলে খাওয়া ছেড়েছে কেন? অসুখ? মনের অসুখ হে, অসুখের মন। ও চাইছে। নতুন কী যেন একটা পছন্দ হয়েছে, চাইছে। তা বেশ তো! মাতা-পিতা কি দেননি? এতই যদি দিলেন তো আর একটু দিতে বাধা কী? না, না। দিচ্ছেন, নিশ্চয়ই দেবেন। দু দিন দেরি হচ্ছে। দুষ্প্রাপ্য খেলনা। অমন সব পেয়েছির দেশেও তাই দুদিন দেরি হচ্ছে। টেনশনে বালক খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ভূরুতে ভাঁজ। কারও সঙ্গে কথা বলছে না। মাঝে মাঝে শুধু ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম খাচ্ছে। টনসিলের ধাত। এভাবে আইস খাওয়া ঠিক না। কিন্তু ভয়ে মা বাবা বলতে পারছেন না। তার পছন্দ-অপছন্দ, তার ব্যক্তি-স্বাধীনতা…এসবে হস্তক্ষেপ করলে না জানি কী পাপ, কী অঘটন ঘটে যায়!

এ দিকে ফেরো। বেতের ঝাঁপি-ভর্তি কাশীর কাঠের খেলনা। কাঠের ওপর সুন্দর করে সবুজ রঙ করা, ফাগ রঙ করা, লাল রঙ করা। বাটি-ঘটি-থালা-গেলাস-যাঁতা। লোহার খেলনাও আছে, বদ্যিনাথধামের। উনুন, কড়া, হাতা, খন্তি, বেড়ি। যে যেখানে যায় শিশুদের জন্যে এই এথনিক খেলনা নিয়ে আসে। উপরন্তু মদনমোহনতলার রাসের মেলা থেকে কিনে এনেছে মাটির মুড়কি পুতুল, ঘোর গোলাপি রং, অনেকটা জগন্নাথের মতন গড়নের-বেনে পুতুল। ছড়ানো ঘাগরা, ভারী বুক, গাবদা-গোবদা, গেরেম্ভারি। আর আছে কাচের পুতুল। হতে পারে কাচের। কিন্তু সৌখিন কিছু নয়, চোখ মুখের কোনও ছিরি-ছাঁদ নেই। তবু শিশু তাতে কী রূপ যে দেখে! কী রূপ তার সাদা কাচের পুতুলের। আর কী আছে রে বুবু?

—‘ঠাকুদ্দাদা ঠাকুদ্দাদা, একটা চম্মা কিনে দিন না!’

তো চশমা কিনে দিয়েছেন ঠাকুর্দাদা। রঙিন কাগজের রঙিন চশমা। একজনের লাল, একজনের সবুজ, আর বুনবুন? সে তো স্পেশ্যাল গেস্ট, দিদিভাইয়ের বাড়ি থেকে আসে, আবার ফিরে যায়। ওর চশমা সোনালি রঙের। তিনজনেই চোখে চশমা লাগিয়েছে। যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়! তবে কেমন হত তুমি বলো তো?

—‘ঠাম্মা, ঠাম্মা, একটা ঘড়ি কিনে দিন না!’

তো ঘড়িও হয়েছে। তিনজনেরই হাতে ঘড়ি। তার কাঁটা ঘোরে না, চিরদিনের জন্যে বারোটা বেজে আছে। কিন্তু হলে কি হবে? তিনজনেই যখন-তখন হাত আড় করে ঘড়ি দেখছে। খুব সাবধানে সবুজ কাঠের যাঁতার ফুটোর মধ্যে কাঠের ছোট্ট ডাণ্ডা দিয়ে যাঁতা ঘোরাচ্ছে বুবু। যাঁতা কখনও দেখেনি তো, ওটাই সব চেয়ে কৌতূহলের। পুনপুন তার পুরুষত্ব ভুলে লোহার উনুনে ছোট্ট লোহার কড়াই চাপিয়েছে। আলু-পটলের খোসা জোগাড় করে এনেছে। খন্তি দিয়ে নাড়ছে, চাড়ছে, খন্তির হাতল কড়ার চেয়ে লম্বা। দু বার কড়া উল্টে গেল। তা সে যাই হোক। রান্না হচ্ছে। বুনবুন রুগি দেখতে যাবে। খুব তাড়া।

আনি মানি জানি না

ছেলে-মেয়ে মানি না।

বুনবুন বাজার করে আনল। ছেঁড়া পুরনো কাপড় সেলাই করে থলে তৈরি করে দিয়েছেন ঠাকুমা।

—‘দিদিভাই, বাজার এসে গেলেন’ বুনবুন থলি নামিয়ে বলে।

খেঁল্লার ঘরের দিদিভাই হল গিয়ে বুবু। একটা দিদিভাই না হলে তো আর বাড়ি হয় না, সংসারও হয় না। তাই দিদিভাই। বুবুকে দিদিভাই সাজতে হয়েছে। সে গামছা মাথায় জড়িয়ে একটা খোঁপা করেছে। গামছার প্রকণ্ড খোঁপা। মাথাটা বড্ড ভারী লাগছে। কিন্তু দিদিভাই সাজতে হলে অত বড় খোঁপা বাঁধতেই হবে, বাঁধতে হলে এটুকু কষ্ট করতেই হবে। তাই বুবু খোঁপা মাথায়, বুকে কুঁচি বেবি-ফ্রক পরে। কপালে একটা নিষিদ্ধ সিঁদুর-টিপ পরে, তিনটের অসঙ্গতিতে একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে যাঁতা ঘোরাচ্ছে।

আর ‘বাজার এসে গেলেন’ কেন? বড়রা, অর্থাৎ দিদিভাই, মা, পমদিদি, ই-দাদা সব্বাই রাতদিন বলে ‘আপনি’ করে বলবে। ‘আপনি করে বলতে হয়। তাই বুনবুন, বড় লক্ষ্মী ছেলে, বাড়ির ম্যাও পুষি লেত্তির সম্পর্কে বলে—‘লেত্তি গঙ্গুর সব দুধ খেয়ে ফেলেছেন।’ অর্থাৎ কি না চোর অবস্থাতেও লেত্তির শ্রদ্ধেয়ত্ব যায় না। দরজায় ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়ালেও বুনবুন তার ম্যানার্স বিস্মৃত হয় না। বলে— ‘গাড়ি এসেছেন?’ সে যতই ছ্যাকরা গাড়ির ড্যাকরা ঘোড়া হোক। কাজেই বাজারও আসবেন বইকি! বাজারের একটা মান-সম্মান নেই? —‘টেকন বাজার নাও’—বুবু নির্দেশ দেয় পুনপুনকে। একজন দিদিভাই না হলে যেমন সংসার হয় না, একজন টেকনও তেমনি সংসারের পক্ষে অপরিহার্য—গুণ্ডির-বটুয়া-হাতে, পান-লাল-ঠোঁট চাকর টেকন, যে ব্রাহ্মণ বলে জুতো এবং এঁটোয় হাত দেয় না। পুনপুন সেই টেকন আপাতত। বুনবুনের যখন টেকন সাজতে ইচ্ছে হবে, হতেই পারে, তখন কিন্তু পুনপুনকে সরে দাঁড়াতে হবে। সেটা বিনা মারপিটে হয়তো সম্ভবও নয়। কিন্তু আপাতত বুনবুন সেটা সাজতে চাইছে না। এটাই রক্ষা। টেকনের মতো পান-লাল ঠোঁট করার জন্যে পুনপুন চুপিচুপি মায়ের আলতা একটু ঠোঁটে ঘষে নিয়েছে। তার এই আশ্চর্য বুদ্ধির প্রদর্শনীতে বুবু-বুনবুন চমকৃত হয়ে আছে। তাদের আলু পটলের খোসার মিছিমিছি-রান্না মিছিমিছি-খাওয়ার খেঁল্লাবাটি এমন একটা বাস্তবতা পেয়ে গেছে যে বুনবুনের মাথায় ভূমিকা-বদলের আইডিয়াটা আসছেই না, এবং যতক্ষণ না আসে ততক্ষণ পুনপুন তার ক্ষণ-টেকনত্ব উপভোগ করে নিচ্ছে।

ওরা এমনই মশগুল যে দেখতে পাচ্ছে না অসুর মিশে রয়েছে জলে, হাওয়ায়, খেলনায়। তার ভয়াল হাত সে তুলেছে। লক্ষ্য স্থির করতে পারছে না অসুরটা। কোনটা ঠিকঠাক অষ্টম গর্ভ? কোনটাকে শিকার করলে অসুরের পৃথিবী ভয়মুক্ত হবে? কংসের সিংহাসন নিষ্কণ্টক হবে? এক সঙ্গে তিনটেকে বিঁধতে পারলে সবচেয়ে ভালো হত। কিন্তু ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। কিছুতেই এক লাইনে আসছে না। আসছে না।

অধৈর্য অসুর ভাইরাসের চার ফেলে শিকার-ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। এবার সে তার তীক্ষ বঁড়শি ছুঁড়ে দেয়, বিদ্ধ হয় অন্যদের আড়াল করে থাকা বড়সড় মাছটা। লাবণ্যে ভরপুর, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, শ্যাম-চিক্কণ শিশুদেহ, ঝুমকো ঝুমকো চুল মাথা ভরে…। গামছার কবরী উল্টে পড়ে যায় হাঁড়ির মুখের ঢাকনার মতো। বুবু যাঁতার ওপর বক্র হয়ে শুয়ে পড়ে। অষ্টাবক্র। হাত পা খিঁচতে থাকে। তার আজ দুদিন ধরে জ্বর হচ্ছে, কেউ বোঝেনি। এখন সে তো নিজে নিজে চান করে, নিজে নিজে খায়, নিজে নিজেই জামা পরতে পারে কি না! সারা দিন কোনও দ্বিতীয় মানুষের হাত লাগল না দেহে, রাত্রে ক্লান্ত মা শুতে এসে হয়তো আলতো করে হাত রাখলেন কপালে। হয়তো রাখলেন না। বুবু বড্ড পা ছোঁড়ে, বিচ্ছিরি শোওয়া, মা পুনপুনের দিকে পাশ ফিরলেন। কেউ জানে না, বুবু খেতে পারছে না। এমনিতেই খাওয়ার বড় ন্যাটা কিনা! বুবু ঝিমোচ্ছিস কেন? ঘুম পেয়েছে? এমন অসময়ে? তো শুতে যা! বিছানায় গিয়ে শো। খিটখিট করে বুবু, শুধু শুধু বায়না করে, সে কেমন করে বলবে তার মাথাটা কেমন করছে। মাথার যন্ত্রণা কী সে তো জানে না! বমি পাচ্ছে, গা-বমির সংজ্ঞা তো সে জানে না! কখনও হয়েছে কি এসব?

পুনপুন বলল—‘এই বুবু, তুই তো দিদিভাই। শুয়ে পড়লি কেন? আগে মাছ কুটে দে, রান্না করি, খাবি, তবে তো শুবি!’

বুনবুন বলল— ‘দ্যাখ দ্যাখ, কেমন মজা করছে দ্যাখ! এই বুবু, ভয় দেখাচ্ছিস কেন? আমি ভয় পাচ্ছি যে!

পুনপুন তীরবেগে ছুটে যায়, ধাঁই করে এক কিল মারে বুবুর পিঠে, বুবু তখনও ভয় দেখাতে থাকে। তখন দু ভাই ছোটে। হাতের কাছে একমাত্র ঠাকুমা, ‘পল্লীসমাজ’ পড়ছেন এই সহস্রতম বার। তিনি এখন রমা, সপসপে ভিজে কাপড় পরে তারকেশ্বরের দুধপুকুরের পাড়ে রমেশের সামনে পড়ে গেছেন। শরীরে পুলক, আবেশ, লজ্জা, শালীন মহিমা ক্ষুন্ন হওয়ার দরুন খেদও। বড় জটিল অবস্থা। সবটা তো শরৎচন্দ্র বুঝতে পারেননি! সবটা জানে রমা, আর জানেন মনোমোহিনী।

—‘ঠাম্মা ঠাম্মা, বুবু আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।’

—‘আর দেখাবে না, বলো ঠাম্মা বারণ করছেন।’

—‘শুনছে না, ভী-ষণ ভয় দেখাচ্ছে। হাত নাড়িয়ে, আঙুল মুঠো করে, চোখ কেমন উল্টেছে দেখো না এসে।’

—‘বুবু! অমন করে না, ভাইদের ভয় দেখাতে নেই দিদি!’

বলতে বলতে ঠাকুমা রমেশের দিক থেকে মুহূর্তের জন্য অনিচ্ছুক চোখ ফিরিয়ে পেছনে তাকান। লম্বা দালান যেখানে পুবের দিকে বেঁকে গেছে সেই বাঁকের মুখে ঠাকুমা এক অদ্ভুত অস্থির বক্রতা দেখতে পান। বুবু কাটা ছাগলের মতো ধড়ফড় করছে।

—‘মনো, অ মনো-ও-ও, বউমা-আ-আ’—একটা তীব্র আতঙ্কের চিৎকারে খান খান হয়ে যায় দুপুরের বাতাস।

—‘চেচাঁচ্ছ কেন? তে তপ্পর বেলা হল, একটু ঝিমোতেও দেবে না!’ —কোন সুদূর প্রান্ত থেকে মনোর কণ্ঠ ভেসে আসে।

ঠাকুমা এবার পশ্চিমের রোদ থেকে উঠে পড়েন। রমা-রমেশ মাথায় উঠে গেছে। জ্বলজ্বলন্ত বাস্তব সামনে, যে ধরনের বাস্তব নিঃসন্তান বৃদ্ধাকে কখনও সামলাতে হয়নি।

—‘জল আন, পুনপুন, শিগগির জল আন।’

কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি জল থাবড়াতে থাকেন বুবুর মাথায়। মনোর প্রতি তীব্র অভিমানে তাকে আর দ্বিতীয়বার ডাকেন না। করতে হয়ত হয়নি। কিন্তু তিনিও ডাক্তারের বউ, ডাক্তারের মা। সঙ্কটের সামনে পড়ে কোনও একটা বিলি-ব্যবস্থা করতে পারবেন না তিনি মনোমোহিনী দেবী, এ কখনো হয়!

—‘মা, মা’—মনোমোহিনী কাকে ডাকেন? শ্মশানবাসিনী সেই শ্যামাকে? যাঁর জন্য সমগ্র হৃদয়কেই শ্মশান করে ফেলতে হয়?

এইভাবেই, নাতনির-মাথায়-জল থাবড়াতে-থাবড়াতে ‘মা-মা’ ডাকন্ত অবস্থায় তাঁকে আবিষ্কার করেন রুগি-দেখে-শেষ-বেলায় বাড়ি-ফেরা শিবপ্রসাদ।

—‘ধনুষ্টংস্কার হচ্ছে বুবুর, ধনুষ্‌…’ কথা শেষ করতে পারেন না মনোমোহিনী।

দু-হাতে শিশুকে তুলে নিয়ে শিবপ্রসাদ বলেন— ‘এ তো গা পুড়ে যাচ্ছে একেবারে! দুগ্‌গি…দুগ্‌গি…’

—‘কী হয়েছে বাবা? উনি তো এখন…’ বলতে-বলতে ঘোমটা-টানতে-টানতে-আসতে-আসতে প্রচণ্ড শকে দেবহূতি স্থাণু হয়ে যান। স্থির বিদ্যুতের মতো আশিরনখচৈতন্য জেগে থাকে ষোলই আগস্ট, উনিশ শ তেতাল্লিশ। কত কষ্টে, কী যাতনার লৌহকপাটে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মরে-বেঁচে জন্ম দিয়েছিলেন। নিয়ে যাচ্ছে, অত্যাচারী নিষ্ঠুর নিয়ে যাচ্ছে! হে কৃষ্ণ, মধুসুদন, মধুকৈটভারি মুকুন্দশৌরি হে বাসুদেব, রক্ষা করো, রক্ষা করো।

ঘাড় শক্ত, আক্ষেপ হচ্ছে, চোখ চাইতে পারছে না, ফোটোফোবিয়া…। এক্ষুনি লাম্বার পাংচার করতে হবে, শিবপ্রসাদ রেডি হচ্ছেন।

—‘না বাবা, লাম্বার পাংচার না। এখন আর সি.এস.এফ নেবার সময় নেই। দেখতে পাচ্ছি অ্যাকিউট ভাইরাল মেনিনজাইটিস, আমি ওষুধ দিচ্ছি’—ওষুধের ক্যাবিনেটের ড্রয়ার খোলা, দুর্গাপ্রসাদ অকম্পিত হাতে ওষুধ বাছতে বাছতে অকম্প্র কণ্ঠে বললেন।

—‘দুগ্‌গি…’

—‘বলুন’

—‘ক্রিস্ট্যালাইন পেনিসিলিন এসে গেছে বাবা বাজারে। আমি…আমার নাতনিটা…’ শিবপ্রসাদ যেন ভিখারি, ভিক্ষা চাইছেন।

—‘সামান্য দেরি করলেও বাঁচাতে পারবেন না, যা স্টেজ। কথাটা আপনিও জানেন। যমের মুখেই যখন ছেড়ে দিতে হবে, তখন না হয় হোমিওপ্যাথির ওপরই ছাড়লেন!’

ষোড়শ অধ্যায় : কালিন্দীর দহে

একটা প্রবল ঝঞ্ঝাবাত্যা এসে তাকে যেন ঝেঁটিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিল। সে পড়ছে, পড়ছে, মহাশূন্য দিয়ে পড়ছে। নীচে কোনও মেজদাদাভাই নেই যে তাকে লুফে নেবেন। তবে কি সে মাটিতে আছড়ে পড়বে? তা হলে তো ভীষণ লাগবে? কত লাগবে তা তো সে ধারণাও করতে পারে না! উঃ!!! সে প্রাণপণে ওপর দিকে ঠেলে উঠতে থাকে। মাথা দিয়ে ঠেলে শূন্যকে। ভীষণ লাগে মাথায়। মাথা বেড়ে যেন কী একটা জিনিস ভীষণ চাপ দিচ্ছে। সেটাকে গায়ের জোরে টেনে খুলতে যায়। মাথা থেকে সামনে ঝুলে পড়ে একটা চেরা জিভ। হিস হিস শব্দ হয়।

—‘তুমি কে?’ সে গলায় সাহস এনে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে। এবার জিভসুদ্ধু ভোঁতা মুণ্ডুটা তার মুখের সামনে এসে ঝুলতে থাকে। দুলতে থাকে।

—‘আমি কাল, কালনাগ।’

—‘আমার মাথায় উঠেছ কেন?’

—‘উঃ! আকাশে যে একটা কী ভয়ংকর দানো! আমার মুণ্ডু না থেঁতলে, ন্যাজ না ধরে, দু পাক না ঘুরিয়ে শূন্যে হু-উ-শ ছুঁড়ে দিল। পড়ছি, পড়ছি, পড়ছি, তোমার মাথাটা পেলুম, শুধোলুম, —“ঠাঁই দেবে ভাই?” তো মাথা বলল—“বেশ” তো তা-ই কোনওমতে…।’

—‘তোমাকেও ছুঁড়ে দিয়েছে? তা হলে তো তুমিও আমার একটা ভোলু হলে? আমাকেও তো একটা হাওয়া না দানো না কী মেজদাদাভাইয়ের চে’ও উঁচুতে ছুঁ-ড়ে দিল। রান্নাবাটি খেলছিলুম কী মজা করে। আমার যাঁতা আছে, আমি যাঁতা ঘোরাতে পারি। ঘর্‌ ঘর্‌ ঘর্‌ ঘর্‌।’

—‘আঁ? যাঁতা? একা দ্দানোয় রক্ষে নেই। আবার যাঁত্তা?’

কালনাগ ভীষণ ভয়ে তার মাথা থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে সর সর সর সর করে নেবে তাকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরতে লাগল।

উঃ, তার হাড়গোড় যে গুঁড়িয়ে যাবে এবার! সুয়োরানির মতন হাড় মুড়মুড়ির ব্যারাম ধরবে যে তার! চোখের সামনে নীলচে কালো অন্ধকার। তার মধ্যে খুনখারাপি লাল চম্‌কাচ্ছে। ওরা কি পচা, কুচান, নেড়ু, সুদামাদের মতো বাঁদুরে রং নিয়ে দোল খেলছে?

শান্তির জল! শান্তির জল! শান্তির জল!

অন্ধকার ফর্সা হচ্ছে একটু একটু করে! সাপটা মুখ নিচু করে নামছিল তো! তার মুখ থেকে পেটের জমা সমস্ত খাবার ঝুপঝাপ করে পড়ে গেছে! একটা হরিণ! সেই সুন্দর সোনার হরিণটা যেটা সীতা চেয়েছিলেন! সোনারঙের গা, তাতে হিরে-হিরে দাগ! শিং তো নয় যেন পালিশ করা কালো মণি। চকচক চকচক করছে। শিংগুলো নাগের পেটে চুপসে এতটুকুনি হয়ে ছিল, বাইরে আসতেই ফুঁ-দেওয়া বেলুনের মতো ফুলে-ফেঁপে আপন চেহারা ধারণ করল। হরিণটা দিব্যি লাফিয়ে লাফিয়ে পালাচ্ছে।

—‘হরিণ, হরিণ যেও না; যেও না, আমি তোমাকে নেবো ভাই! তোমার সঙ্গে খেলা করব!’

কে শোনে কার কথা, হরিণ পিঠে ঢেউ তুলে তুলে দৌড়চ্ছে। কী আশ্চর্য! দৌড়চ্ছে তবু খুব দূরে যাচ্ছে না তো!

—‘সাবধান, খুব সাবধান, ওটা কিন্তু মায়া হরিণ! ওই সোনা গরল, ওই হিরে খোসপাঁচড়া, ওই মণি তো মণি নয়, ফণী!’

—‘বাব্বাঃ, ওকে নেওয়া যাবে না? আচ্ছা, ও কোথায় থাকে?’

মায়ার দেশে মায়া-কাননে সোনার হরিণ চরে

মায়ার গাছে সোনার ফুল সোনার ফল ধরে

সোনার ঘাসে মায়ার হিম, হিমের বুকে-ফুটো

ফুটোর মধ্যে হাট্টিমাটিম ডিম পেড়েছে দুটো

এক ডিমেতে সোনার ডেলা আরেক ডিমে তা

দুই মিলোলে সোনার হরিণ মায়ার হরিণ না।

—‘কে? কে এ কথা বললে?’

সে দেখল নাগের আলগা মুখ থেকে খসে পড়েছেন এক সন্ন্যাসী। হাতে কমণ্ডলু, মাথায় জটা, গলায় নহরের পর নহর, সাত নহর রুদ্রাক্ষের মালা।

সে তো খুব নমো করতে জানে! তাই সে দু হাত জোড় করে নমো নমো জানায়। তখন সন্ন্যাসী ভারি খুশি হয়ে বলেন—

—‘কাদের কুলের খুকু গো তুমি কাদের ঘরের ঝি?

অনেক দেখি, এমন লক্ষ্মী, এমন মণি, এমন সোনা, কখনও দেখি নি।’

তখন সে বলে— ‘আমি যদি লক্ষ্মী তবে কেন আমার মাথায় কালনাগ? আমি যদি মণি, যদি সোনা তবে কেন আমায় হাওয়া-দানোয় তুলে নিয়ে যায়? কেন আমার…’

—‘কাল রাত্তির কাল পেঁচা আর কাল নাগের কষ

এই তিন কাল যে কাটাতে পারে কাল তাহার বশ।’

এই বলতে বলতে সন্ন্যাসী জটা কমণ্ডলু রুদ্রাক্ষসুন্ধু হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন, আর নাগের মুখ থেকে ফস করে খসে পড়ল এক পক্ষিরাজ। পেট-খালি-হয়ে-যাওয়া রোগা দড়ির মত নাগ ঘুরে এসে তাকে খাবার আগেই বুবু পক্ষিরাজের পিঠে চড়ে শূন্যের ওপর দিয়ে হু হু করে ছুটতে লাগলো।

সারা গায়ে সিরসির, বিড়বিড়, খোলা মুখ জলে ভরে যায়, ননীর দেহ আগুনে গলে যায়, দু পাশে রাক্ষসের পর রাক্ষস, খোক্কসের পর খোক্কস থাকে থাকে থাকে থাকে দাঁড়িয়ে আছে।

রাক্ষসেরা বলে— হম হম হাঃ তোকে খাবো!

খোক্কসেরা বলে— তোঁকে খেঁয়ে দেঁয়ে বাঁড়ি যাঁবো।

রাক্ষসেরা চেঁচায়—

গম গম গাঃ

তোরা খাবি খাঃ।

পিলে নাড়ি ভুড়ি

ফেলে দিস নাঃ।

খোক্কসেরাও কম যায় না—

কুচি কুচি কেটে কেটে

কাঁচা কাঁচা খাবো মেটে

কাটা কাটা ফাটা ফাটা

খেয়ে নেবো কলিজাটা

পিলে টিলে নাড়ি ভুঁড়ি

রেঁধে নেবো চচ্চড়ি।

তোরা চলে যাঃ মোরা কাটিকুটি

মিঠে রক্তটা চাটিচুটি

পেট ভরে গেলে নখ-চুল-দাঁত

নিতে যদি চাস তবে হাত পাত।

রাক্ষসদের তখন খুবই রাগ হয়ে গেল। তারা তো বেশি কিছু চায়নি, মাত্রই একটু পিলে, ভালো পিলের দম হয়, আর একটু নাড়ি ভুঁড়ি, ছেঁচকির জন্যে! তা সত্ত্বেও খোক্কসদের এমনি কিপটেমি! তাচ্ছিল্য! আস্পদ্দা! তারা নখ বাগিয়ে, দাঁত শানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল খোক্কসদের ওপর। খোক্কসদেরও রোঁয়া ফুলে শজারুর কাঁটার মতো হয়ে গেছে, দাঁতের মধ্যে থেকে রক্তচোষা দাঁত বেরিয়ে এসেছে। পক্ষিরাজ ঘোড়ার সাদা, গায়ের ডান পাশে রাক্ষস আর বাঁ পাশে খোক্কস। মহা চুলোচুলি, হুড়োহুড়ি, লড়াই বেধে গেছে।

পক্ষিরাজ বলল—

চিঁহি খুকুসোনা চিঁহি খুকুসোনা

ভালো করে ধরো হাত ফসকোনা।

ঘোড়ার পিঠের উপর দিয়ে, তার পিঠের ওপর দিয়েও রাক্ষসরা কুলোর মতো কান নেড়ে, মুলোর মতো দাঁত কিড়মিড় করে, মাথার শিং চাগিয়ে হাতের নখ বাগিয়ে রোঁয়া-খাড়া দাঁতে-দাড়া খোক্কসদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাতে তার যা ভয়ংকর লাগল তা আর বলার নয়। কুলো কানের ঝাপটায় তার ছোট্ট দেহ একবার এদিকে-কাত একবার ওদিকে-কাত, মুলো দাঁতের কিড়মিড়োনিতে তার কানে তালা ঝালাপালা, শিঙের খোঁচা নখের আঁচড়, রোঁয়ার মোচড়, দাড়ার কামড়—তার সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল, তবু সে পক্ষিরাজের চাঁচর কেশর ছাড়ল না।

‘চিঁহি বুবুসোনা বুবুসোনা চিহি।

ধরো ভালো করে হাত ফসকোনি।’

এইভাবে পক্ষিরাজে আর বুবুতে, বুবুতে আর পক্ষিরাজে সেই রাক্ষস-খোক্কসের প্রকাণ্ড কুরুক্ষেত্তর পার হয়ে গেল।

যা ভাবা গিয়েছিল ঠিক তাই। বিরাট এক ফটক। তার ওপর তিন থাক খিলান, লাল মখমলের গালচে পাতা সাত থাক সিঁড়ি, নয় বাঁক দালান, চলে গেছে ভেতরে, অনেক ভেতরে। মাথার ওপর ঝাড়লণ্ঠনে টুং টাং, দু পাশে মণিমাণিক্যের গাছে চুনি পান্নার ফুল টুপটাপ, কিন্তু কোথাও কোনও প্রাণ নেই, প্রাণী নেই, খালি থরে বিথরে জিনিস, জিনিস আর জিনিস। নয় বাঁকের শেষ বাঁকে দাঁড়ে বসে লাল সবুজ কাকাতুয়া ঘাড় বেঁকিয়ে, ঝুঁটি উঁচিয়ে চুপ। সিঙ্গিমামা হাতের থাবায় মুখ রেখে ঘুমে। সিংহের মামা ভোম্বলদাসও হাত-পা ছেতরিয়ে, চার খুর কেতরিয়ে জ্ঞানে কি অজ্ঞানে বোঝা যায় না। যত সে এগোয় ততই সব আবছা হয়ে আসে; অবশেষে সেই প্রাসাদের গহীন গহ্বর থেকে দলে দলে ভূত বেরিয়ে আসতে থাকে। তার আশে ভূত, পাশে ভূত, কড়িকাঠ থেকে ভূত ঝুলছে, মেঝে ফুঁড়ে ভূত বেরোচ্ছে। তখন সে নিমেষে বুঝতে পারে এটা মোটেই অরুণ বরুণ কিরণমালার সেই প্রাসাদ নয় যেখানে কাকাতুয়া রাজামশাইকে জিজ্ঞেস করবে—‘তা মহারাজ, মানুষের পেটে কি কুকুর বেড়াল হয়? তা মহারাজ, মানুষের পেটে কি কাঠের পুতুল হয়?’— এ হল এক মায়া প্রাসাদ। সে চিৎকার করে কেঁদে উঠল—‘মা!!’

কে যেন তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছে! কে ও? চাঁদের মা বুড়ি?

‘চাঁদের মা বুড়ি

ক খানা কাপড় পেলি?

ছ’ খানা কাপড় পেলাম।

ছ বউকে দিলাম।’

—‘কী হয়েছে দিদি? কিসের কষ্ট!’ উনি মাথায় বরফের হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, হাত তো নয়, বরফের পুঁটলি! আ- হ হ!

সবই তার ভুল হয়ে যাচ্ছে। কিছু মনে পড়ছে না। সে তো মায়ার প্রাসাদে ছিল! পক্ষিরাজ? পক্ষিরাজ কোথায় গেল? পক্ষিরাজের জন্যে কান্না পাচ্ছে যে!

চাঁদের মা বললেন—‘কিসের ভয়? কিসের কান্না! ও তো মায়া!’ তা-ই।

চাঁদের দেশের হিমফল খেতে দেন চাঁদের মা।

আ-হ্‌!

ভেতরটা জুড়িয়ে যায়। টাগরা ছুঁয়ে, জিভের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যতদূর যাচ্ছে। হিমফল ততদূর জুড়িয়ে যাচ্ছে। জুড়িয়ে-এ যাচ্ছে। হিমফল! হিমফালি!! চাই মুমফালি ই-ই!!!

শিবপ্রসাদ দূর্গাপ্রসাদকে বললেন— ক্রাইসিসটা বোধহয় কেটে গেল।’

দুর্গাপ্রসাদ মনোমোহিনীকে বললেন—‘সেজমা এবার শুতে যাও।’

মনোমোহিনী দেবহূতিকে বললেন— ‘কিছু মুখে দাও বউমা,’

দেবহূতি মনোরমাকে বললেন— ‘দিদিমণি এবার আপনিও…’

মনোরমা বললেন— ‘দুগ্‌গা, দুগ্‌গা।’

দুর্গাপ্রসাদ শিবপ্রসাদকে বললেন— ‘বলছেন? কেটে গেল? ঠিক?’

শিবপ্রসাদ বললেন—‘বোধ হয়।’

গহন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সে একা-একা পথ হাঁটতে থাকে। চারদিক স্তব্ধ। ঝিঁঝির ডাক পর্যন্ত শোনা যায় না। পায়ের তলায় বালি, কাঁকর, কাঁটা। দু পাশ থেকে সাপের মতো লতা দোলে, শপাং শপাং করে চাবুক মারে। হাত পা ছড়ে যায়, পিঠে-বুকে কাঁটালতার দাগড়া দাগড়া দাগ, তবু সে চলে চলে আর চলে। পিঠের ওপর বিষপুচ্ছ বাঁকিয়ে দেখো সড়সড় করে কাঁকড়াবিছে যায়।

—‘বিছে! বিছে!’ সে ক্ষীণ গলায় ডাকে!

—‘বিছে শুধু নই, আমি কর্কট বৃশ্চিক।’ দাড়া বাঁকিয়ে বিছে ঘুরে দাঁড়ায়। কার এত সাহস তাকে ডাকে!

—‘একলা একলা যাচ্ছি বিছে, কথা বলবার লোক নাই।

মনের মধ্যে কথা ঘনায়, ব্যথা শানায়, কাকে জানাই? কাকে জানাই!’

—বে-শ। কিন্তু বিষ জমলে কামড়ে দেব।’

—‘দি-ও। ইচ্ছে হলে দিও, নেব।’

নেই-প্রাণীর এই দেশে বিছে তো বিছে, সে-ও বুঝি ভালো। সে বিছেকে মুঠোয় তুলে নেয়।

বিছে—‘মনের মধ্যে বড্ড রিষ তাই তো বিষ তোমার মনে কী?’

বুবু—‘খেতে দেবো নাম পাতাবো বিষ ঢালে না ছিঃ।’

বিছে—‘বিষের নামে দাড়া সুড়সুড় ন্যাজ ফুরফুর ঢোল হল যে গা?’

বুবু—‘বিছে-বুব্বু বুব্বু-বিছে বন্ধু হল না?’

বিছে—‘জেনো, আমার নামটি বিচ্ছু’

বুবু—

‘জানো না তুমি কিচ্ছু

তোমার নামটি আলপনা।’

বিছে—

‘সত্যি বলছি মিথ্যে আমি বলব না, বলব না।

মারছি কামড় ঢালছি বিষ বড্ড যে সুলসুলোচ্ছে।’

বুবু—ঠিক আছে ভাই মারো কামড় অতই যদি ইচ্ছে।’

বিছে দাড়া উঁচিয়েছে কী উঁচোয় নি, শ্যাওড়াগাছের আগডালে এক পেঁচা ছিল, ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু মিনিটে বিছে সাফ।

—‘বু বু! বু বু!’—পেঁচা ডাকছে।

—‘টু ইট টু! টু ইট টু!’ বুবু সাড়া দিচ্ছে।

পেঁচা—‘আমাকে তো কই সঙ্গে যেতে ডাকলে না?’

বুবু—‘তুমিও তো কই আপনা থেকে আমার সঙ্গে আসলে না!’

পেঁচা বলল—‘সামনে আসছে ভোর/ পার করে দাও পার করে দাও লক্ষ্মী বোনটি মোর।’

তখন সে ভালো করে তাকিয়ে দেখল—ওমা! এ তো কালপেঁচা!

কে যেন কবে যেন কোথায় যেন কখন যেন কালপেঁচার কথা বলেছিল!

বলেছে তো বলেছে! মনে না পড়লে সে আর কী করতে পারে?

কালপেঁচা কিন্তু উড়ে এসে বুবুর কাঁধে বসল।

চলে, চলে, চলে। কেবলই চলে।

ক্রমশই আঁধার ফিকে হয়। ঘন জঙ্গলের গাছপালা ভেদ করে ভোরের শুকতারা বেরিয়ে পড়ে। চাঁদ ডুবে যেতে থাকে। সুযযি উঠছে জানান দেয়, পাখি ডাকতে থাকে।

পেঁচাও মুখ লুকিয়ে বুবুর চুলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কেননা সে জঙ্গলের মধ্যে আরেক জঙ্গল। কা কা কা কা চারদিক কাকের ডাকে ভরে যায়। বুবুর চুলের মধ্যে কালপেঁচা থর থর থর থর ডর খায়।

কিন্তু ভোরের সীমানা আর কতটুকু? বড় জোর এক কোশ আর আধ কোশ? জঙ্গলের সেই গঙ্গাজলী ভোর পার হয়ে বুবু দেখে কই, সকাল এলো না তো! এ যে আরেক অমানিশা? ঢুকব কি ঢুকব না ঢুকব কি ঢুকব না ভাবতে ভাবতে পেছনে তাকিয়ে সে দেখল এক কোশ আর আধ কোশ ভোর-সকালের রাজ্যির পরেই সেই অমানিশার রাজ্যপাট। তা হলে? এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চরের মতো একটুখানি ভোরের রাজ্য আর বাকিটুকু সব কূলহীন অতল অচল অন্ধকার? পেছনের কথা সে জানে কিন্তু সামনের কথা তো সে জানে না! তাই পেছনের আঁধার পেরিয়ে সে আর সেখানে ফিরতে চাইল না। সামনে যেতে পা-টি বাড়িয়েছে আর কালপেঁচা বেরিয়ে এসে বলছে— ‘বুবু এবার তবে তোর চোখ খুবলুই?’

—‘সে আবার কী?’ বুবু অবাক হয়ে বলে, ‘এই না তুমি আমার পেঁচা সই?’

—‘আনি মানি জানি না

সই সয়া সব মানি না’ —বলতে বলতে পেঁচা যেই পাখনা মেলে ঝাঁপাতে গেছে অমনি ভোরের রাজ্যির শেষ সীমানার বুড়ো অশথের ডালপালা থেকে হাজার হাজার কাক, কালপেঁচার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দু মিনিটে পেঁচা সাফ।

অত কাকের বাড়াবাড়ি কেলেঙ্কারিতে বুবুর চুলও ছিড়েখুঁড়ে একসা। খুবলে খাবলে ন্যাড়া বেরিয়ে একেক্কার। কিন্তু বুবু বেঁচে যায়।

হাজার কাক কালপেঁচার হাজার পাখ মুখে করে ফিরে যায়, তখন বুবু মিনতি করে—

‘পথ না পাথার পথ না পাথার!

বড্ড আঁধার বড্ড আঁধার।

কাক-কাকিনী কাকের ছাঁ

আঁধারে চোখ চলে না…..’

বলতে না বলতেই হাজার কাক কা কা কা কা না না না না করে চেঁচামেচি করে ওঠে। আঁধারের রাজ্যে না কি তাদের প্রবেশ নিষেধ।

যেতে তো হবেই তাই বুবুরানি সো-জা হেঁটে যায়, সে জানে না, সে একেবারে কালরাত্তিরের লক্ষ যোজন নাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে, সেখানকার মিশমিশে অন্ধকারে কালসাপের কষকুটে কষ দিনরাত্তির হিম ঝরার মতো ঝরছে। একবার যার চোখে পড়বে চোখ হবে কানা, কানে পড়লে শুনতে পাবে না না, হাতে পড়লে হাত নুলো, পায়ে পড়লে পা খুঁতো অর্থাৎ কালরাত্তিরের কোটর থেকে যদি বা বেরোতে পারলে তো শুধু বেরোতেই পারলে, কানা খোঁড়া নুলো বোবা জীয়ন্তে মরন্ত হয়ে থাকবে।

ফুস মন্তর ফুস মন্তর ফুস মন্তর ফুঁসে

জলের মধ্যে কয়েক ফোঁটা ম্যাজিক দিলেম ঠুসে।

ওং শান্তিঃ, ওং শান্তিঃ, শান্তির জল নাও,

অলখ যোজন আঁধার মরণ নিমিষে পেরিয়ে যাও।

বুবু জানে না সেই সন্ন্যাসীঠাকুর সমানে তার পেছনে পেছনে আসছিলেন। সেই যে সে ভক্তিভরে নমো করেছিল! সেই যে সে সাপকে, বিছেকে আর পেঁচাকে আশ্রয় দিয়েছিল, সেই যে সে সোনার হরিণের পেছনে ছোটেনি, পক্ষিরাজের পিঠে-উঠেছে, রাক্ষসদের ভয়ে পটেনি, খোক্কসদের পেরিয়ে ছুটেছে। এই ভক্তি, আর মমতা, বিশ্বাস আর সাহস, আর নির্‌ নাস্তি লোভম…এই জন্যে ম্যাজিক জলে তার আগাগোড়া এমন তেলতেলে হয়ে গেল যে মহাকালনাগের কষ বেশির ভাগটাই তার গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল। অন্ধকার ফুঁড়ে বুবুরানি বেরিয়ে এলো।

বুবু ডাকল—‘মা!’

আওয়াজ কই! আওয়াজ বেরোলো না।

খড়ধারীর মতো করে ডাকো তো বুবু? তো বুবু ডাকলো ‘মাজী!’

আওয়াজ বেরোলো “হাঁ জী”

কাগজওলা, চুড়িওলাদের মতো করে ডাকো বুবু?

বুবু ডাকল—

‘মায়ি!’ আঁই মাঁই কাঁই।’

বুবু কি রাক্ষসী হয়ে গেল? মা মুখে বেদানার রস, আঙুরের রস, কমলার রস ঢেলে দেন, সে গিলতে পারে না। তার দেহের স্নায়ু, তন্তু, কোষ, পেশী সব লক্ষযোজন কালরাত্তির পেরোতে পেরোতে নিজ নিজ কাজকর্ম ভুলে মেরে দিয়েছে।

—‘ফোঁটা ফোঁটা করে দাও ড্রপার দিয়ে দাও।’

সে তাকাচ্ছে। ক্লান্ত চোখ। দিষ্টি অনেক দূরে কোথাও গুটিয়ে সুটিয়ে আছে, সেই যেখানে লাল-সবুজ কাকাতুয়া পাখা ঝটপট করছে, সিঙ্গিমামা থাবার ওপর থেকে ঝাঁকড়া মুখ তুলে তাকিয়েছে, ডোম্বলদাস চার খুরে টলমল টলমল পালাবে পালাবে করছে, সেই যেখানে হিমের মধ্যে ফুটো, ফুটোর মধ্যে হট্টিমাটিম ডিম পেড়েছে দুটো… সেই সেইখানে তার দিষ্টি আটকে আছে। কখন কক্‌ কক্‌ কাকাতুয়া দাঁড় ছেড়ে উড়ে যাবে সিঙ্গিমামা পিঠে সওয়ারী করার জন্যে দুগ্গা-ঠাকুরকে খুঁজে নেবে, ভোম্বলদাস কখন ভোম্বলমামা কম্বলদাস হয়ে সোজা উঠে দাঁড়াবে, আর কখন হট্টিমাটিম টিমের ডিম ফুটে অবাক ছানা ছোট ছোট নলিনলি ঘাড় তুলে ভেতর-লাল ঠোঁট ফাঁক করে গুঁতোগুঁতি করবে, তখন সেই শুভলগ্নে খুলে যাবে বুবুর হাতপায়ের মায়া-শেকল, দিষ্টি তার হট্টিটির ছানা হয়ে সিঙ্গিমামার পিঠে চড়ে ফিরে আসবে মাথার ওপর কাকাতুয়া ডানা ঝাপটাবে…..। তা সে অসম্ভব কি আর কোনওদিন সম্ভব হবে?

তাই বুবু ফিরেও ফেরে না, ডেকেও ডাকে না, দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না।

পুনপুন-বুনবুনের কাছে খবর পৌঁছে গেছে, বুবুর জ্বর ছেড়েছে, বুবু চোখ মেলেছে। গুটিগুটি এসে দু-ভাই ডাকে—‘বুবু! বুবু!’

কে ডাকছে কাকে? বুবু কোন দূরের মায়াকাননের মায়াপ্রাসাদের মহানৈঃশব্দ্যে মগ্ন আছে! বুনবুন-পুনপুন ভয়ে ভয়ে তাকে টিপেটুপে দেখে। তাদের বোনই তো! না কোনও রাক্ষসী তাকে হজম করে নিয়ে একটা ডিম উগরে দিয়ে গেছে! অনেকটা বুবুর মতো, কিন্তু বুবু তো নয়।

নাঃ, মানুষের গা-ই তো! পুনপুন বুনবুনের পরশে সে-গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। নাকের পাটা ফুলছে।

—‘থাক, ওকে বিরক্ত করো না। পাবন, বরুণ তোমরা খেলতে যাও।’

—‘মা, ওর অসুখ সারেনি?’

—‘সেরেছে। আর একটু সারতে দাও।’

—‘গঙ্গাঠাকুমার মতো হয়ে যাবে না তো বুবু?’

—‘ষাট ষাট পাবন, অমন বলো না।’

—‘মা এটা বুবুই তো?’

—‘তা আর কে হবে?’

—‘কেন? ডাইনি বুড়ির চাইনি ছানা! চাই না মা, চাই না এমন বুবু চাই না।’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে দু ভাই ছুটে পালায়, তাদের চোখের জলটুকু মায়ের চোখে ফেলে রেখে।

তাদের খেলাঘরে কাশীর খেলনা, দেওঘরের রান্নাবাটি, রাসের মেলার মুড়কি পুতুল, মাটির বেহালা, কাঠের ঢোলক, রবারের গোলক, টেনিকয়েটের রিং, ট্যামটেমি, ঝুনঝুনি, নতুন সেলেটে হাতের লেখা, পড়তে শেখা, নাচন কোঁদন, বীরমাতুনি, দস্যিপনা, টালবাহানা, আদর-আবদার, বারবার ঘরবার সমস্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে মাড়িয়ে, একবারও পেছন ফিরে না দেখে হৃদয়ের শূন্য ভরাতে দুই ভাই ঘোড়ায় চড়ে। হাতে তলোয়ার, কোমরে গেঁজেয় তিনটি মোহর, লাঠির আগায় এক পুঁটুলি ছোলার চাক, মুড়ির চাক নিয়ে টগবগ টগবগ টগবগ টগবগ করে দেশভ্রমণে বেরিয়ে যায়। সুদ্ধু অরুণ-বরুণ। কিরণমালা নেই। সুদ্ধু এক নেই-সুভদ্রা-দারুভূত জগন্নাথ-বলরাম। হতশ্রী। ছন্নছাড়া। কেউ লক্ষ করে না।

॥ প্রথম স্কন্ধ সমাপ্ত ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *