অষ্টম অধ্যায় – সম্পদ কেন্দ্রীকরণ হ্রাস করা

অষ্টম অধ্যায় – সম্পদ কেন্দ্রীকরণ হ্রাস করা

সর্বোচ্চ মাত্রায় ‘মাকাসিদ’ এর বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোসহ সকল বাজায় অর্থনীতির দেশগুলোতে বিদ্যমান উৎপাদন উপকরণের মালিকানা কেন্দ্রীভূত হওয়া। শরীয়াহর কাঠামোর মধ্যে অনুমোদনযোগ্য কতিপয় বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে যতক্ষণ পর্যন্ত এ অবস্থা পরিশুদ্ধ করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের ন্যায়ভিত্তিক সমাজের বাস্তবায়নে দর্শনীয় অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে ইসলামী কৌশলের সাথে সমাজতন্ত্রের সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সমাজতন্ত্রে বন্টনের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী বৈষম্য দূরীকরণের নামে সকল উৎপাদন উপকরণের সমষ্টিকরণ ও সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়া কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে মানুষকে মজুরি দাসত্বের পর্যায়ে নামিয়ে আনে এবং তাদের উদ্যোগকে বিনষ্ট করে দেয়। মালিকানার ক্রমবর্ধমান বিস্তার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা মর্যাদা, স্বাধীনতা ও উদ্যোগের সাথে সংগতিপূর্ণ এবং তা ‘খলিফা’র ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এরূপ ব্যবস্থার বিস্তার শহরের মতো গ্রামে এবং কৃষির মতো শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ঘটাতে হবে।

ভূমিকা সংস্কার

মুসলিম দেশগুলোর পল্লী অঞ্চলে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক বাস করে, সেখানে স্বল্প সংখ্যক অনুপস্থিত ভূস্বামী বিশাল ভূমিখণ্ড নিয়ন্তণ করে এবং একইভাবে স্বল্প সংখ্যক অর্থলগ্নীকারী মহাজনগোষ্ঠী অর্থের উপর একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এ সকল ভূস্বামী ও মহাজনরা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এবং অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক সেই বিশাল ভূমিখণ্ডের মালিকরা ভূমিহীন বা ক্ষুদ্র এবং কৃষক শ্রেণীর উপর প্রভু সেজে বসে আছে। তারা পুলিশ ও বিচার বিভাগসহ সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠাসমূহের উপর প্রভূত ক্ষমতা প্রয়োগ করে ও এভাবে কৃষকদেরকে তাদের খেয়ালখুশি ও মর্জির দাসত্ব করতে বাধ্য করে। এর ফলে পল্লীর জনগণ শোষণের শিকার পরিণত হয়, তাদের উদ্যোগ বিনষ্ট হয়, উৎপাদন প্রবৃদ্ধি পঙ্গু হয় এবং দারিদ্র্য ও বৈষম্য চিরস্থায়ী হয়।

পল্লীর জনগণ দারিদ্র্যের কারণে অধিকতর উৎপাদনমুখী প্রশিক্ষণ, সার ক্রয়, উন্নতমানের বীজ ও যন্ত্রপাতি বীজ ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহ এবং তাদের স্বল্প আয়ের পরিপূরক ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগ পরিচালনার ক্ষেত্রে সুযোগ লাভ থেকে বঞ্চিত থাকে। কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে তারা চিরস্থায়ী দারিদ্র্য ও বঞ্চনার শিকার হয় এবং কর্মবিমুখ, অসৎ ও উদাসীন হয়ে পড়ে। ফলে পল্লীর যুবকরা কাজের সন্ধানে শহরমুখী হয়। সেখানে তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সম্মুখীন হয় এবং স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে এবং স্বল্প মজুরি ও অন্যান্য হতাশার কারণে অপরাধ ও সামাজিক অস্থিরতার কারণ ঘটায়।

মুসলিম দেশগুলোতে পল্লী এলাকার ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোতে নিষপ্রভ না করে গ্রামীন জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধন অথবা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শক্তিশালীকরণ সম্ভব নয়। এটা হচ্ছে একটি কাজ, তবে ‘মাকাসিক’ হাসিলের লক্ষ্যে যেহেতু অন্য কোনো আর্থ-সামাজিক সংস্কার কর্মসূচির সুদূরপ্রসারী কার্যকারিতা নেই, সেহেতু দৃঢ়প্রত্যয়ী প্রয়াসের প্রয়োজন অপরিহার্য। এখন সকল অর্থনৈতিক কর্মসূচির মূলভিত্তি হওয়া উচিত ভূমি ও আর্থিক সংস্কার। মুসলিম দেশগুলোর যে সকল সরকার সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিবেদিত বলে দাবি করে, কিন্তু তাদের কর্মসূচিতে এ সকল সংস্কার কর্মসূচিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে না, তাতে তাদের সে দাবিকে আন্তরিক বলে বিবেচনা করা যায় না।

ভূমি সংস্কারের বিষয়টি ভূমি মালিকানার আকার ও ভূমিস্বত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট। যতদিন পর্যনত না আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচারের আয়োজনের সাথে সংগতি রেখে এ সকল বিষয় নিষ্পত্তি করা হবে, ততদিন পর্যন্ত ‘মাকাসিদ’ হাসিলের লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধান করা যাবে না।

ভূমি দখলীস্বত্বের আকার

যদি বৈধ উপায়ে ভূমি মালিকানা অর্জিত হয় এবং ভূমি মালিক নিজে অথবা বর্গাচাষী উপযুক্ত শর্তে চাষাবাদ করে এবং বিশ্বস্ততার সাথে ইসলামের উত্তরাধিকার নীতি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে ভূমির দখলীস্বত্ব স্বল্প সংখ্যক পরিবারের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হবে না। যেহেতু শত শত বছর ধরে অবৈধ উপায়ে ভূমির দখলীস্বত্ব অর্জিত হচ্ছে এবং ইসলামের উত্তরাধিকার নীতির প্রতি অবহেলা প্রদর্শিত হচ্ছে, ভূমির দখলীস্বত্ব বৈষম্যমূলকভাবে বণ্টিত হচ্ছে, সেহেতু ফলশ্রুতিতে পল্লীর জনগোষ্ঠী কার্যত দাসত্ব, দারিদ্র্য ও দুর্দশায় নিপতিত হচ্ছে। এরূপ উচ্চমাত্রার বৈষম্যমূলক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ভূমির দখলীস্বত্বের সর্বোচ্চ মাত্রা (সিলিং) নির্ধারণ করা এবং উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে সমতার ভিত্তিতে বণ্টন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাভাবিক অবস্থঅয় শরীয়াহ দৃশ্যত বেসরকারি সম্পদের উপর এরূপ সীমা নির্ধারণ করে না। এর কারণ সঠিক পদ্ধতি যদি কার্যকর হয় ও সমতা বিরাজ করে, তাহলে সীমা নির্ধারণের প্রয়োজন হয় না। অবশ্য বর্তমানে মুসলিম দেশগুলো যে সমস্যা মোকাবিলা করছে, তা হলো বিদ্যমান অত্যধিক মাত্রার সম্পদ ন্দ্রেীভূতকরণের অবস্থা থেকে ইসলামী ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া। এভাবে শরীয়াহ ‘মাকাসিদ’ হাসিলের লক্ষ্যে সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রকে কর্তৃত্ব প্রদান করে। অবশ্য এরূপ পদক্ষেপসমূহ সুনির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি।

বিদ্যমান কেন্দ্রীভূত অবস্থা অব্যাহত রাখা হলে তা দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সম্পদের সুষম বন্টন বাস্তবাস্তবায়িত করার লক্ষ্য স্থায়ীভাবে হতাশাগ্রস্ত হবে। এখন প্রয়োজন হচ্ছে, পরিবার পিছু সর্বোচ্চ ভূমি মালিকানার একটি যুক্তিসংগত সীমা নির্ধারণ করে ভূস্বামীদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অবসান ঘটানো। সীমিত আকারের ভূমির লভ্যতার বিপরীতে পল্লী অঞ্চলে বিশাল জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও মাকাসিদ হাসিলের জন্য এরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ইমাম হাসান আল-বান্না ও সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীসহ বিশিষ্ট পণ্ডিতগণ মালিকানার সুষম ভারসাম্য পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক স্বার্থরক্ষার জন্য এ ধরনের সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। যেহেতু ভূমির প্রকৃত মালিকদেরকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থা শরীয়তে রাখা হয়েছে, সেহেতু তাদের কাছ থেকে বিনামূল্যে জমি নেয়ার প্রয়োজন নেই; বরং এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত মূল্য প্রদান করা উচিত। পুরো মূল্য কুষকের আয় থেকে সরকার কর্তৃক কয়েক বছরের মধ্যে আদায় করা যেতে পারে এবং তার অংশ বিশেষ প্রকৃত মালিককে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং কিছু অংশ পল্লী উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা যেতে পারে।

প্রজাস্বত্বের শর্ত

জমির আকার ছোট করা ছাড়াও প্রজাস্বত্বের শর্তাবলীও সং স্কার করা গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম আইনশাস্ত্রের সকল মতাদর্শের ফকীহগণের কাছে ভূমি মালিক ও প্রজাদের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিতর্কের উর্ধ্বে থাকা সত্ত্বেও ফিকাহশাস্ত্রে ভূমি প্রজাস্বত্বের প্রকৃতি বিতর্কিত বিষয় হিসেবে রয়েই গেছে।

ফিকাহ শাস্ত্রের একটি সংখ্যালঘু অংশ ভাগচাষ বা বর্গাচাষ কিংবা নির্ধারিত ভাড়ায় প্রজাস্বত্ব অনুমোদন করেননি। বরং তারা বলেছেন যে, একজন ভূমি মালিক নিজে যতটুকু পারে ততটকু তার নিজেরই চাষ করা উচিত; অবশিষ্ট জমি অন্যকে চাষ করতে দেয়া উচিত। বৃহৎ অংশ আছেন যারা বর্গাচাষ সমর্থন করেন, কিন্তু নির্ধারিত ভাড়ায় প্রজাস্বত্বব্যবস্থা নিষিদ্ধ করেছেন, তাদের যুক্তি ছিল যে, মহানবী (ﷺ) গোড়ার দিকে ভাগচাষ ও নির্ধারিত ভাড়ায় প্রজাস্বত্ব উভয় ব্যবস্থাকেই নিরুৎসাহিত করলেও পরবর্তীতে ভাগচাষের অনুমতি দেন। মহানবী (ﷺ) এর সাহাবীগণ ও তাদের উত্তরাধিকারীগণ সেটাই অনুসরণ করেছেন। অবশ্য ফকীহগণের প্রধান অংশ ভাগচাষ ও নির্ধারিত ভাড়ায় প্রজাস্বত্ব উভয় ব্যবস্থাকেই নিরুৎসাহিত করলেও পরবর্তীতে ভাগচাষের অনুমতি দেন। মহানবী (ﷺ) এর সাহাবীগণ ও তাদের উত্তরাধিকারীগণ সেটাই অনুসরণ করেছেন। অবশ্য ফজীহগণের প্রধান অংশ ভাগচাষ ও নির্ধারিত ভাড়ায় প্রজাস্বত্ব উভয় ব্যবস্থা অনুমোদন করেছেন এবং তা ‘মুদারাবাহ’ ও শরীয়াহভিত্তিক লিজিং ব্যবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ। এর পিছনে যুক্তি হলো, মাদানী জীবনের অধিকাংশ মুসলিমানের দারিদ্র্য অবস্থার কারণে ধনীদের কাছে তাদের বেশি দাবি ছিল। তখন তিনি ভাগচাষ এবং নির্ধারিত ভাড়ায় প্রজাস্বত্ব উভয় ব্রবস্থাকেই নিরুৎসাহিত করেন এবং ভূমি মালিকরা যা নিজে চাষ করতে পারতো তার অতিরিক্ত জমি কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই অন্য চাষীদের চাষ করতে দেয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। অবশ্য পরবর্তীতে যখন মুসলিমানদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়, তখন তিনি উভয় ব্যবস্থার অনুমতি দেন এবং তা নিছক ভাগচাষ ছিল না, যার পক্ষে দ্বিতীয় গ্রুপের ফকীহরা যুক্তি উত্থাপন করেছেন।

এতদসত্ত্বেও বেশ কিছু ফকীহ মনে করেন যে, যদিও নির্ধারিত ভাড়ায় প্রজাস্বত্ব অনুমোদিত, কিন্তু তা ‘মাকরুহ’। তাদের মতে ভাগচাষই অধিক পছন্দনীয়, কারণ ভূমি মালিক ও প্রজা চাষাবাদের ক্ষেত্রৈ মুনাফা ও ঝুঁকি উভয়েরই দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রৈ নির্ধারিত ভাড়ায় প্রজাস্বত্বের পরিবর্তে এ ব্যবস্থা দু’দিক থেকেই সঠিক। যে সকল আইনবিদ নির্ধারিত ভাড়ায় প্রজাস্বত্বের অনুমতি দিয়েছেন, তারা জমি লিজ প্রদানের বৈধতা সম্পর্কে কতকগুলো শর্তারোপ করে প্রজাদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ ইমাম মালিকের মতে, যদি জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায় অথবা লিজ গ্রহণকারীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনো প্রাকৃতিক কারণে (যেমন খরা, বন্যা) জমি চাষাবাদ করতে সমর্থ না হন, সেক্ষেত্রে লিজ চুক্তি অতিরিক্ত ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার জন্য ভঙ্গ করা যেতে পারে। বিষয়টি সম্পর্কে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু আইনবিদ মনে করেন, বিষয়টি ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধির আওতাভুক্ত বিধায় রাষ্ট্র নির্ধারিত ভাড়ায় দখলীস্বত্ব প্রদান অন্তত সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করতে পারে অথবা ‘মাকসিদ’ হাসিলের লক্ষ্যে এবং জনগণের স্বার্থে তাকে পর্যাপ্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

যেহেতু প্রজা ও ভূমিহীন কৃষকরা দুর্বল ও ক্ষমতাহীন এবং যখন উচ্চ ভাড়া ও উৎপাদন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তখন এভাবেই আরো কিছুকাল থাকার সম্ভাবনা আছে, সেহেতু ভূমিস্বত্বের আকারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, নির্ধারিত ভাড়ায় ভূমির লিজ প্রদান ব্যবস্থা অবিচার ও দারিদ্র্য বজায় রাখার জন্যঅব্যাহত থাকতে পারে। এমতাবস্থায় মুসলিম সরকারগুলোর কাছে এটাই প্রত্যাশা যে, তারা জমি লিজ প্রদানের ক্ষেত্রে ভাগচাষ ব্যবস্থাকে সাধারণ ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করবেন এবং ভূমি মারিক ও প্রজাদের মধ্যে উৎপাদনের ন্যায়সংগত বণ্টন নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন। যতদিন পর্যন্ত পল্লী এলাকায় ক্ষমতার ভিত্তি উল্লেখযোগ্যভাবে সমপ্রসারিত না হবে এবং ভূমি মালিকদের শাসনের হাতকে কার্যকরভাবে নিষ্ক্রিয় করা না যাবে, ততদিন পর্যন্ত এ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকতে পারে। মহানবী (ﷺ) মদীনায় প্রাথমিক জীবনে যে বৈপ্লবিক কার্যক্রম চালু করেছিরেন, তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কৃষক ও ভূমিহীন চাষীদের কল্যাণে এবং মুসলিম সমাজের সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ হ্রাস করার উদ্দেশ্যে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। বলাই বাহুল্য যে, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ইসলাম ভূমি সংস্কারের উপর বিশেষ জোর দিয়েছে। আয়বণ্টন ও দারিদ্র্যের প্রকোপ নিবারণে ভূমিবণ্টন একটি বড় নির্ধারক হিসেবে কাজ করে। জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও কোস্টারিকার মতো যে সকল দেশে ভূমির দখলীস্বত্বের সুষম বণ্টনসহ যৌথ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, সে সকল দেশ আয়ের সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত সাফল্য লাভ করেছে। অপরদিকে যে সকল দেশে ভূমির দখলীস্বত্বের কেন্দ্রীভূতকরণ প্রক্রিয়াকে অনুমতি দেয়া হয়েছে, সে সকল দেশে দারিদ্র্যের প্রাদুর্ভাব এবং আয়বণ্টনে অধিকতর বৈষম্য অব্যাহত থাকবে। ক্ষুদ্র ও স্বাধীন উৎপাদনকারী কৃষকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি পল্লীখাত কৃষি কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের উৎসাহ প্রদানের জন্য সাহায়ক হবে এবং এভাবেই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যাবে। ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প কারখানায় এর সম্মিলিত বিস্তৃতি ঘটলে তা কৃষি সংশ্লিষ্ট জনশক্তির শহর এলাকায় স্থানান্তর হ্রাস করবে এবং এর সাথে নগরের অপরাধ ও হিংসাত্মক কার্যকলাপও কমাবে। আয় ও সম্পদের বণ্টনে বৈষম্য হ্রাস করার মাধ্যমে অধিকাংশ দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমানো এবং ঐ সকল দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুসংহত করা যেতে পারে।

বর্তমানে যে জাজ্বল্যমান বৈষম্য রয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে ভূমি সংস্কার হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা কোনো সরকার কর্তৃক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা না করার কোনো সুযোগ নেই। যদি অর্থবহ ভূমি সংস্কার বাস্তবায়ন করা না হয়, তাহলে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে হিংসাত্মক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হবে। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যখন এ ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হয়, তখন সকল নৈতিক মূল্যবোধ পদদলিত হয়। ভূমি মালিকরা এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে ভূমিই হারাবে না তাদের সহায়সম্বল এমনকি জীবনও হারাতে পারে। এমতাবস্থায় তাদের উচিত নিজেদের বৃহত্তর ও দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থে স্বেচ্ছায় সঠিক ভূমি সংস্কারের চেষ্টা চালানো।

কেউ কেউ যুক্তি দেখিয়ে থাকেন যে, ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে ভূমি দখলীস্বত্বের আকার কমানো হলে তা কৃষিকাজের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। বিভিন্ন দেশে পরিচারিত বেশ কিছু প্রয়োগিত সমীক্ষা থেকে এরূপ ধারণা প্রমাণিত হয়নি; তবে এ সমীক্ষাগুলো নিশ্চিত করেছে, কৃষি জমির আকার ও প্রতি একরে উৎপাদনের হার পরস্পর বিপরীতভাবে সম্পর্কযুক্ত। এর মানে হচ্ছে, ক্ষুদ্র আকারের কৃষি জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃহদাকার জমির চাইতে বেশি। অভিজ্ঞতাসঞ্জাত প্রমাণাদি উল্লিখিত ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ বড় আকারের ভূমিখণ্ডের মালিকরা তাদের সম্পদের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ গ্রহণ করে বৃহদাকার কৃষি ফার্মে বিনিয়োগ (যোমন ভালো বীজ, ঋণ, পানি সরবরাহ ও সার) করার ক্ষমতা রাখে। এমনকি বিশ্ব্যাংকের মতে, ‘ক্ষুদ্র পারিবারিক কৃষি ফার্মে স্থিতিশীলতা ও উৎপাদনশীলতা সারা বিশ্বব্যাপী হুমকির সম্মুখীন’ -বিশেষ করে সেবা, বাজার ও উৎপাদন উপকরণ, যেমন সার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তাদের সীমিত সুযোগ বিদ্যামান। এটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রাখা দরকার যে, ভূমি সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন মানে এই নয় যে, জমির আকার অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে হ্রাস করতেই হবে।

ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশ

শিল্প ও বাণিজ্য খাতে পল্লীর ভূমি সংস্কারের প্রতিরূপ হচ্ছে, পল্লী ও শহর এলাকায় দক্ষ, ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটানো। এ ব্যবস্থা মুসলিম বিশ্বে বিদ্যমান সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ প্রক্রিয়া হ্রাস করে ভূমি সংস্কারের পরিপূরক হবে। ইসলামী মূল্যবোধের কাটামোতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অন্যান্য সুবিধাদিও এ ব্যবস্থায় রয়েছে।

পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে বিরাজমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে বিকাশ সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ হবে। পুঁজিবাদী দেশগুলোতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দৃশ্যপট বড় বড় ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা আরোও বড় ব্রবসায় প্রতি।টানগুলোর অনুকূলে বলেই প্রতীয়মান হয়। ফলশ্যুতিতে ঊনিশ শতকের পূঁজিবাদী বিশ্বে যে প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থা প্রভাবশঅলী ছিল এখন তার অবসান ঘটেছে। এ সমস্যা সামাধানের জন্য সমাজতন্ত্র উৎপাদনের সকল উপকরণ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে নেয়। এ ব্যবস্থা মজুরি দাসত্ব ও বিচ্ছিন্নতাকে জোরদার করে। এর ফলে প্রতিযোগিতা দূরীভূত হয় এবং উৎসাহ ও দক্ষতা হ্রাস পায়। এটা অবশ্য এখনও পরিষ্কার নয় যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায বৃহৎ শিল্প কারখানাগুলো বিরাষ্ট্রীয়করণের ক্ষেত্রে তার আকার কী ধরনের হবে।

যদি বৃহৎ শিল্প-কারখানাগুলো অধিকতর দক্ষ হয় এবং সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণের দিকে ধাবিত না হয়, তাহরে এরূপ বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে মৌলিকভাবে কোনো দোষ নেই। তথাপি এটা প্রতীয়মান হয় যে, ‘মাকাসিদ’ অর্জনের সাথে অধিকতর সংগতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে যতদূর সম্ভব একান্ত অপরিহার্য ক্ষেত্র ছাড়া নীতি হিসেবে সাধারণভাবে বৃহৎ শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা নিরুৎসাহিত করা উচিত। এ ব্যবস্থায় সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ কমানো ছাড়াও বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। ব্যবসার মালিকানা থাকার ফলে মালিকদের মধ্যে স্বাধীনতা, মর্যদা, আত্মসম্মানবোধ বৃদ্ধি করে বিধায় তা সামাজিক স্বাস্থ্যের পক্ষে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এর ফলে ঐ সকল মালিকদের মধ্যে তাদের নিজস্ব ব্যবসার সফলতার জন্য সৃজনশলিতা ও কঠোর পরিশ্রমের চেতনা সৃষ্টি করবে। এ ব্যবস্থা প্রতিযোগিতার সুষ্ঠ পরিবেশ গড়ে তুলবে এবং তা অধিকতর দক্ষতা আনয়নে অবদান রাখবে। এছাড়াও তা দ্রুততর গতিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সমপ্রসারণে সহায়ক হবে যা নবম অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।

সমপ্রসারিত মালিকানা ও কর্পোরেশন নিয়নন্ত্রণ

যেহেতু ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সকল প্রকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য উপযুক্ত হবে না, সেজন্য যেখানে প্রয়োজন সেখানে বৃহদাকার শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্পোরেট ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া যেতে পারে। এতে মালিকানার দ্রুত বিকাশে ইতিবাচক অবদান রাখার ক্ষেত্রে বৃহৎ সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। যাইহোক, পাশ্চাত্য জগতে যে কর্পোরেশনগুলো বিদ্যমান সেগুলো সম্পদ ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণের প্রাথমিক উৎস হিসেবে কাজ করছে। এতদসত্ত্বেও কর্পোরেশনগুলো অর্থনীতির প্রধান খাতের অন্তর্ভুক্ত এবং মৌলিক পণ্য উৎপাদন, মূল্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী এবং তা সমগ্র জাতি তথা বিশ্বকে প্রভাবিত করে থঅকে। তারা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে প্রতিফলিত করে না। কর্পোরেশনগুলো স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়। এর স্টক কতিপয় পরিবার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবার ফলে তার সকল নীতিগত সিদ্ধান্তের উপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা তাদের পক্ষে সম্ভব। এটা হচ্ছে পাশ্চাত্যের সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার স্বাভাবিক পরিণতি যাতে উঁচু-নীচুর পার্থক্য বৃদ্ধি করে এবং কর্পোরেট ক্ষমতাকে শেয়ারের ভিত্তির উপর পিরামিডের ব্যয় সংকীর্ণ কাঠামো গড়ে তোলে। সমপ্রতিক বছরগুলোতে এরূপ উঠানামার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে প্রতীয়মান হয় পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে।

অতএব পাশ্চত্যের কর্পোরেশনগুলো মুসলিম দেশগুলোর জন্য কোনো আদর্শ হতে পারে না। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ কমানোর লক্ষ্যে এ ব্যবস্থার যথাযথ সংস্কার করতেই হবে। ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সংগতি রেখে কর্পোরেশনগুলোর মূলধন কাঠামোতে অংশীদারীত্বের উল্লেখযোগ্য সমপ্রসারণ এবং সুদের বিলোপ সাধন শুধুমাত্র ধনী পরিবারগুলোর প্রভাবকে কমাবে না; বরং তা কর্পোরেট অংশীদারীত্বে মালিকানার সমপ্রসারণ ঘটাবে এবং ক্ষমতার অধিকতর সুষম বণ্টনে সহায়ক হবে। এ ব্যবস্থা যথেষ্ট নাও হতে পারে; কারণ অধিকাংশ শেয়ারহোল্ডার বোর্ড সভায় অংশ গ্রহণ করে না। এমতাবস্থায় বোর্ড পরিচালকদের অবাঞ্ছিত ক্ষমতা কমানোর জন্য অন্যান্য সংস্কারের প্রয়োজন হবে।

যাকাত ব্যবস্থা ও উত্তরাধিকার পদ্ধতির সক্রিয়করণ

আয় ও সম্পদের বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যে উর্পযুক্ত ব্যবস্থাসমূহ অধিকতর সফল হতে পারে, যদি ইসলামের যাকাত ও উত্তরাধিকার ব্যবস্থা সক্রিয় করে সেগুলোকে আরো জোরদার করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক যে, যদিও এ দু’ব্যবস্থার বাস্তবায়ন একজন মুসলিমানের জন্য ধর্মীয়ভাবেই বাধ্যতামূলক, তা সত্ত্বেও সেগুলো দীর্ঘকাল ধরে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে আছে।

যাকাত: সামাজিক আত্মসাহায্য কর্মসূচি

ইসলাম তার বিশ্বাস কাঠামোতে সামাজিক আত্মসাহায্য ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করেছে। এতে প্রত্যেকে ‘আল্লাহর খলিফা’ ও উম্মাহর সদস্য হিসেবে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণেই মর্যাদা ও যত্নের সমন্বয়ে ভ্রাতৃবোধ গড়ে তোলার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য অর্জনের জন্য তার সমর্থ্য অনুযায়ী অবদান রাখবে। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য তার জীবিকা উপার্জন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে; যারা নিজস্ব নিয়ন্ত্রণের বাইরে অবমতার শিকার এবং নিজেদের সাহায্য করতেও অবম তাদের চাহিদা পূরণ করা মুসলিম সমাজের সমাষ্টিক দায়িত্ব। এত বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও প্রাচুর্যের পাশাপাশি যদি দারিদ্র্য বিরাজ করে, তাহলে সে সমাজকে প্রকৃত মুসলিম সমাজ বলা যায় না। মহানবী (ﷺ) ঘোষণা করেছেন, ‘সে ব্যক্তি প্রকৃত মুসলমান নয়, যে তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজের উদরপূর্তি করে’। মহানবী (ﷺ) আরো জোর দিয়ে বলেছেন, ‘যে জনপদে একজন লোক ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমায়, সে জনপদ আল্লাহর হেফাজত থেকে বঞ্চিত হয়’। চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা) একটু ভিন্ন আঙ্গিকে এ বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, ‘গরীবদের জন্য যা পর্যাপ্ত প্রয়োজন, তা তাদেরকে প্রদান করা ধনীদের জন্য আল্লাহ বাধ্যতামূলক করেছেন। যদি গরীবরা অভুক্ত থাকে অথবা বস্ত্রহীন থাকে বা কষ্টভোগ করে তার কারণ ধনীরা তাদের বঞ্চিত করে। এমতাবস্থায় সর্বশক্তিমান ও মহামহিম আল্লাহর জন্য এটাই যথোপযুক্ত যে, তিনি এদের হিসাব নেবেন এবং শাস্তি প্রদান করবেন।

যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলমানদের এ দায়িত্ব পালনের জন্য একটি পন্থা বাতলিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এটা হচ্ছে ইসলামী বিশ্বাসের অলঙ্ঘনীয় অংশ। যাকাতের বিধান হচ্ছে, ঐশী প্রত্যাশার সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন সংকেত এবং তা এটা নিশ্চিত করার জন্য যে যাতে কেউ প্রয়োজনীয পণ্য ও সেবার চাহিদা পূরণের উপায় প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না হয়। শাব্দিক অঢ়ের্থ যাকাত হচ্ছে পরিশুদ্ধতা (তাহারাত), প্রবৃদ্ধি, বরকত এবং স্বীকৃতি এবং পারিভাষিক অর্থে যাকাত হচ্ছে একজন মুসলমানের মোট আয় বা কৃষি উৎপাদন যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার অংশ বিশেষ প্রদান করা তার জন্য আর্থিকভাবে বাধ্যতামূলক এবং অপরিহার্য ধর্মীয় কর্তব্য। এটা হচ্ছে ইসলামের পাঁচ স্তম্বের অন্যতম এবং এর মধ্য দিয়ে সমাজকে পরিশুদ্ধ করার, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং বিত্তবানদের সম্পদ পবিত্রকরণের ক্ষেত্রে ইসলামের দৃঢ় প্রতিফলন ঘটায়। প্রত্যেকের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হলে তা ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে একটি অপরাধ। যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহর রিজিকের প্রতি ব্যক্তির কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং তাঁর রহমতও কামনা করা হয়, যার ফলশ্রুতিতে সকলের কল্যাণ ও সম্পদ বৃদ্ধির কারণ ঘটে। এভাবে সকলের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে মুসলমানদের অপরিহার্য আর্থ-সামাজিক অঙ্গীকারের আর্থিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে এতে সরকারি কোষাগারে কোনো বোঝা আরোপ করা হয় না।

যাকাতের মাধ্যমে যে সামাজিক আত্মসাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়, তা কর প্রদানের মতো নাগরিক দায়িত্ব নয়। এটা হচ্ছে মহান সৃষ্টিকর্তার নিজের পক্ষ থেকে আরোপিত ধর্মীয় দায়িত্ব এবং তার দেয়া যে সম্পদ বান্দার কাছে গচ্ছিত রয়েছে, তা থেকে যারা অস্বচ্ছল তাদে সাথে ভাগ করে নেয়া (আল-কোরআন ৫৮:৭)।

এটা হচ্ছে এক প্রকার নির্ধারিত ইবাদত যা ইসলাম শুধুমাত্র সালাত, সিয়াম বা হজ্জ পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করেনি; এতে একক ও সমপ্রসারিত পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীসহ মানবতার প্রতি দায়িত্ব পালনের উপর জোর দিয়েছে। বিবেকবুদ্ধিসঞ্জাত যাকাত পরিশোধের উপর আল্লাহতায়ালা কর্তৃক তার প্রার্থনা গ্রহণ করার এবং যে পরকালে তার কল্যাণ নির্ভরশীল, সেদিন আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব পালনের চেয়েও অন্য মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতাকে বড় ধরনের ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করা হবে। কর ফাঁকি দেয়ার বিষয়টি হয়ত রাষ্ট্র কর্তৃক উদঘাটিত নাও হতে পারে এবং তার শাস্তি নাও পেতে পারে। কিন্তু যাকাত পরিশোধ না করলে তা হতে পারে না। আল্লাহ সব কিছু দেখেন এবং জানেন। কৌশলে পরিহার করার প্রশ্নই ওঠে না। যদি সে তা করে, তাহলে সে তার নিজ স্বার্থকেই ক্ষুণ্ণ করে।

ধনীদের আয়ায়কৃত যাকাত গরীবদের প্রতি তাদের কোনো আনুকূল্য নয়। ধনীরা তাদের সম্পদের প্রকৃত মালিক নয়, তারা কেবলমাত্র জিম্মাদার (ট্রাস্টি) (আল-কোরআন ৫৭:৭)। তাদেরকে অবশ্যই ট্রাস্টের শর্তানুযায়ী ব্যয় করতে হবে।

ধনীরা যদি যাকাত পরিশোধ করতে যেয়ে গরীবদের প্রতি কোনো আনুকূল্য প্রদর্শনের চেষ্টা করে, তাহলে তা হবে গরীবদের অনুভূতির প্রতি আঘাত করা, তাদের আন্তরিকতার অভাবের পরিচায়ক এবং এর ফলে তারা আখেরাতে তাদের পুরস্কারকে ধ্বংস করবে (আল-কোরআন ২:২৬১-২৭৪)। দরিদ্ররাও যাকাত গ্রহণ করে এটা মনে করবে না যে, তাদের প্রতি ব্যক্তিগত করুণা করা হলো, কারণ তারা কেবল ধনীদের কাছ থেকে আল্লাহ নির্ধারিত প্রাপ্যই গ্রহণ করে মাত্র (আল-কোরআন ৫১:৯ এবং ৭০:২৫)। অধিকন্তু তারা যাকাত গ্রহণেরপর তা কিভাবে ব্যয় করবে, সে বিষয়ে স্বাধীন। এটা তাদের অর্থ এবং তারা তাদের অগ্রাধিকার অনুযায়ী তা ব্যয় করতে পারে, অবশ্য মুসলিম সমাজে তা শরীয়াহ দ্বারা সীমিত। অবশ্য যে ব্যক্তি নিজে ব্যয়সংস্থান করতে পারে এবং যাকাত লাভের উপযুক্ত নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্রহণ করে, তাহলে শেষ বিচারে দিন তাকে জবাবদিহি করতে হবে, কারণ সে অন্যায়ভাবে তা গ্রহণ করেছে এবং অন্যদের অধিকার লঙ্ঘন করেছে। অতএব মর্যাদাহানিকর, ব্যয়বহুল, সময় সাপেক্ষ ও অসুবিধাজনক হতে পারে, এমন কোনো ব্যাপকতর পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রয়োজন হবে না। অবশ্য প্রাথমিক অবস্থায় তহবিলের অপব্যবহার ও বৈষম্য যাতে না হয়, সে জন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নৈতিকতা দ্বারা চালিত মুসলিম সমাজের আনুষ্ঠানিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সীমালঙ্ঘনকারীদের উচ্ছেদ করবে। যারা নিজেরাই নিজেদের ব্যাপারে সচেতন, তারা কার্যকরভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে অভাবী লোকদের জন্য অর্থবহ সহায়তা প্রদানে সমর্থ হবে।

এট আশা করা যায় যে, যে মুসলিমান তার ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সচেতন এবং তার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ তথা পার্থিব সম্পদে আল্লাহর রহমত এবং পরকালীন জীবনে তারই সন্তুষ্টি কামনা করেন, তিনি যাকাত আদায়ে ব্যর্থ হবেন না। মহানবী (ﷺ) বলেছেন যে, ‘যাকাত আদায়ে কোনো ব্যক্তির সম্পদ হ্রাস পায় না’। যাকাতের বিনিময়ে আল্লাহর অনুগ্রহে তার সম্পদ পরিণামে বৃদ্ধি পায়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:

“আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এ কার্পণ্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পণ্য করে, সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও যমীনের পরম স্বত্বাধিকারী, আর যা কিছু তোমরা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন।” (আল-কোরআন ৩:১৮০)।

অবশ্য এতসব শাস্তির বিধান সত্ত্বেও এমন মুসলিমানও রয়েছে, যারা যাকাত আদায় করে না। ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য হবে এমন জবরদস্ত শক্তি প্রয়োগ করা, যাতে তারা যাকাত পরিশোধে বাধ্য হয়। রসূল (ﷺ) এর তিরোধানের পর যারা যাকাত দিতে অস্বীকার করে, হযরত আবুবকর (রা) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। মুসলিমানদের সাধারণ অনুভূতি হচ্ছে যে, ইসলামী মূল্যবোধসঞ্জাত যথাযথ শিক্ষা এবং ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হলে অধিকাংশ মুসলমানই যাকাত আদায় করতে চেষ্টা করবে, উপরন্তু যারা যাকাত আদায় করে না, তাদের কাছ থেকে তা আদায়ের জন্য সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা দেবে।

যাকাতের ভিত্তি সম্পর্কে ফিকাহর বিভিন্ন চিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ে হানাফী মাজহাবের ধারণা হচ্ছে অত্যন্ত ব্যাপক এবং জাহিরিয়া মাজহাবের ধারণা সবচেয়ে সংকীর্ণ। অবশ্যই বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ নিয়ে বড় ধরনের কোনো পার্থক্য হওয়া সমীচীন নয়। এটা এ কারণে যে, জাহিরিয়াসহ অধিকাংশ ফকীহ মনে করেন, যদি শুধু যাকাত দ্বারা দরিদ্রদের অভাবে পূরণ করা সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য অতিরিক্ত লেভি (কর) আরোপ করতে পারবে। সবচেয়ে সংকীর্ণ বলে বিবেচিত ইবন হাযম-আল-জাহিরের এরূপ ধারণাকে যাকাতের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। তিনি বলেন, প্রতিটি দেশের ধনীদের কর্তব্য হচ্ছে দরিদ্রদের চাহিদা পূরণ করা এবং যাকাত যদি এ উদ্দেশ্য পূরণে যথেষ্ট না হয়, তাহলে শাসকের কর্তব্য হলো দরিদ্রদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা, শীত ও গ্রীষ্মে বস্ত্র প্রদান করা এবং রৌদ্র, তাপ ও বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা; এছাড়া তাদেরকে একান্ত পরিবেশ প্রদান করা।

গরীবের চাহিদা পূরণের জন্য ধনীরা যাকাত, নাকি বিশেষ করের (লেভির) মাধ্যমে সম্পদ প্রদান করলো তাতে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। যারা তাদের ধর্মীয়

কর্তব্যের অংশ হিসেবে স্বেচ্ছায় যাকাত আদায় করে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে, অপরদিকে যারা অনিচ্ছায় তা পরিশোধ করে তারা আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার ও তার অুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়। একথা মনে রাখতে হবে যে, আধুনিক সমাজে যেমন কর্মচারীদের বেতন কর্তন ও চাঁদা থেকে বেকারত্ব, দুর্ঘটনা, বৃদ্ধ বয়স ও স্বাস্থ্যের জন্য সামাজিক বীমার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে, যাকাতে সেরূপ কোনো স্বঅর্থায়নের ব্যবস্থা নেই। দুর্যোগের সময় সরকারের ত্রান ও কল্যাণ ও কল্যাণমূলক কাজের জন্য যাকাত থেকে বাজেট বরাদ্ধের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় আয় পুনর্বণ্টন প্রকল্প এবং কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ প্রদানের জন্যও যাকাত তহবিল ব্যবহার করা যাবে না। যাকাত হচ্ছে এমন পূর্ণ ধর্মীয় আঙ্গিকে একটি সামাজিক আত্মসহযোগিতার ব্যবস্থা, যাতে উল্লিখিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরও যারা নিজেদের সাহায্য করতে পারে না সেরূপ গরীব ও দু:স্থদের সাহায্য করা হয়, যাতে মুসলিম সমাজ থেকে দারিদ্র্য ও কৃপণতা দূর হয়। যদি কাতাত আদায়ের পরিমাণ গরীবদের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট না হয়, তাহলে সমাজের অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্য উপায় বের করা।

যেহেতু একজন মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে নিজের উপার্জন নিজে করা, সেহেতু এটাই সমীচীন হবে যে, যাকাত এমনভাবে বিতরণ করতে হবে যাতে দরিদ্ররা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। যাকাত হচ্ছে কেবলমাত্র তাদের জন্যই স্থায়ী ব্যবস্থা, যারা নিজেদের প্রচেষ্টায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে অক্ষম। অন্যদের জন্য যাকাত হবে একটা অস্থাঈ ব্যবস্থা, যা দ্বারা তাদেরকে পর্যপ্ত উপার্জনের জন্য প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সরবরাহ করা হবে। আত্ম-কর্মসংস্থান বৃদ্ধির যে সকল ব্যবস্থা নবম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে, সে সকল ব্যবস্থাসহ যদি এমন এক আর্থ-সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় যেখানে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পের বিকাশে উৎসাহ দেয়া হয়, সেখানে লোকদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য যাকাত ব্যবহৃত হতে পারে। সুতরাং মুসলিম দেশগুলোতে বিরাজমান বেকরত্ব, দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে যাকাত সফল না হওয়ার কোনো কারণ নেই।

মুসলিম সমাজে যাকাতের আরো একটি কল্যাণকর প্রভাব রয়েছে। এতে বিনিয়োগের জন্য তহবিল বৃদ্ধি হয়। স্বর্ণ, রৌপ্য ও অব্যবহৃত অর্থসহ সকল সম্পদের উপর যে যাকাত আরোপিত হয়, তা পরিশোধের সুবিধার্থে ঐ সম্পদের মালিকরা আয় বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট থাকে যাতে যাকাত প্রদানের ফলে তাদের সম্পদ হ্রাস না পায়। এভাবে যে সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ পরিপূর্ণ আত্মীকৃত হয়, সেখানে স্বর্ণ, রৌপ্যও অলস সঞ্চয়ের পরিমাণ কমে যেয়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে এবং ফলশ্রুতিতে অধিকতর অগ্রগতি সাধিত হবে। যাকাত ব্যবস্থা কী যাকাত আদায় এড়ানোর জন্য সীমালঙ্ঘনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করবে, নাকি যাকাত গ্রহীতাদের সংখ্যা কমাবে? যে সমাজে সাদাসিধে জীবনযাপন করাই আদর্শ জীবন হিসেবে গণ্য এবং যেখানে সীমালঙ্ঘনকারী ও মর্যাদা প্রতীকবোধের বরদাশত করা হয় না এবং যে সমাজে নিজ শ্রমের উপর জীবিকা নির্বাহ করা বাধ্যতামূলক, সে সমাজের চিত্র এটা নয়। এতদসত্ত্বেও ‘মাকাসিদ’ হাসিলের লক্ষ্যে যাকাতের কার্যকর পরিপূরক হিসেবে আর্থ-সামাজিক পরিবেশের পুনর্গঠন এবং ইসলামী মূল্যবোধের ব্যাপ্তি লাভের বিষয়ে ইসলামী রাষ্ট্রকে গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

উত্তরাধিকার

ইসলাম অধিকতর ন্যায়পরায়ণতার সাথে সম্পদ বণ্টনের জন্য একটা সুন্দর উত্তরাধিকার ব্যবস্থার বিধান দিয়েছে। আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের ভিত্তিতে শরীয়াহ উত্তরাধিকারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কাউকে বৈধ উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, যদি না সে সম্পদের পূর্ব মারিককে হত্যার দায়ে দোষী হয়। এছাড়া কোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের বেশি উইল করতে পারে না। এরূপ এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি ব্যয় করতে হবে দাতব্য সেবায় অথবা এমন ব্যক্তির জন্য যে ঐ সম্পত্তিতে অংশ পাবে না (অবশ্য যদি সকল উত্তরাধিকারী একমত হয়)।

মৃত ব্যক্তির জীবিত মাতা-পিতার জন্যও নির্ধারিত অংশের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে শুধু তাদের কল্যাণই নিশ্চিত হয় না, মাতা-পিতার মৃত্যুর পর ভাইবোনদের মধ্যে মাতা-পিতার অংশ বিতরণের ব্যবস্থা হয়। স্ত্রীকেও একটি নির্ধারিত অংশ দেয়া হয়। অবশিষ্টাংশ মৃত ব্যক্তির সন্তানদের জন্য নির্ধারণ করা আছে। ইসলামী মূল্যবোধের আওতায় কোনো ব্যক্তি তার সম্পদ অন্যদের বঞ্চিত করে কেবলমাত্র একজন সন্তানকে দিতে পারেন না। যদি মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান না থাকে তাহলে নির্ধারিত নিয়মে সম্পত্তির ব্যাপকভিত্তিক ও সুসম বণ্টন করতে হবে। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির ব্যাপকভিত্তিক বণ্টন ছাড়া ইসলামের উত্তরাধিকার নীতিমালার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। যদি ইসলামী মূল্যবোধ কার্যকর করা হয়, তাহলে মুসলিম সমাজে সম্পদের সুসম বণ্টন নিশ্চিত হয় এবং তা অব্যাহত না থেকে পারে না।

অর্থব্যবস্থার পুনর্গঠন

পুঁজিবাদী দেশগুলোতে সম্পদ ও ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের যে প্রাথমিক উৎস রয়েছে সেগুলো থেকেই মুসলিম বিশ্ব সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা ধার করেছে। সুতরাং এ অধ্যায়ে যে নীতিমালা বাস্তবায়নের কথা আলোচনা করা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিত সামাজিক অর্থব্যবস্থা যদি ইসলামী আদর্শের আলোক পুনর্গঠন করা না হয় তাহলে টেকসই উন্নয়ন, কাঙ্ক্ষিত ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশ অথবা অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে না। এ বিষয়টি পরবর্তী অধ্যায়ে আলাদা শিরোনামে আলো করা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *