প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

অষ্টম অধ্যায় : আব্বাসীয় যুগের শাসনব্যবস্থা, সমাজ ও সভ্যতা

অষ্টম অধ্যায় – আব্বাসীয় যুগের শাসন ব্যবস্থা, সমাজ ও সভ্যতা 

(ক) আব্বাসীয় প্রশাসন ব্যবস্থা 

কেন্দ্রীয় প্রশাসন 

বৈশিষ্ট্য : ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে জাবের যুদ্ধে উমাইয়া বংশের সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ানের পরাজয়ে উমাইয়া আধিপত্য চিরতরে বিলুপ্ত হয়। উমাইয়া শাসনকে ‘আরব রাজত্ব’ এবং আব্বাসীয় খিলাফতকে ‘ইসলামী সাম্রাজ্য’ বলে বার্নার্ড লুইস অভিমত ব্যক্ত করেন। উমাইয়াদের উত্তরাধিকারী হিসেবে আব্বাসীয়গণ ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সুদীর্ঘ প্রায় পাঁচশত বছর (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.) বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেন। আব্বাসীয়দের সাম্রাজ্য আটলান্টিক মহাসাগর হতে সিন্ধু নদ এবং কাস্পিয়ান সাগর হতে নীলনদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই বিশাল অঞ্চলে বহু জাতি, গোষ্ঠী, ভাষা-ভাষী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল এবং স্বাভাবিক কারণেই উমাইয়া যুগের ‘আরব নেতৃত্ব’ বা আধিপত্যবাদের পরিবর্তে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে আব্বাসীয়গণ সার্বজনীন ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। হিট্টির ভাষায় (উমাইয়া আমলে), ইসলামের ইতিহাসের প্রকৃত আরব অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। আব্বাসীয় সরকার ‘দৌউলা’ নামে একটি নতুন যুগের সূচনা করে। উমাইয়াদের ‘মূলক’-এর সঙ্গে আব্বাসীয়দের ‘দৌউলার’ প্রধান পার্থক্য হচ্ছে যে, উমাইয়াদের খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয় কুরাইশ বংশোদ্ভূত উমাইয়া গোত্রের সদস্যদের উপর ভিত্তি করে। প্রশাসন সামরিক বাহিনী ও সরকারের প্রতি স্তরে উমাইয়া খলিফাগণ স্বগোত্রীয়দের অন্তর্ভুক্ত করেন। এমনকি খলিফা ওসমানের সময় তাঁর জামাতা ও চাচাত ভাই মারওয়ানও উমাইয়া গোত্রভুক্ত ছিলেন। উমাইয়াদের সংকীর্ণ আরববাদী (Arabism) নীতির প্রতিবাদে ইরাকী মাওয়ালী আবু মুসলিম খোরাসানে উমাইয়া বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। উমাইয়াদের এই নীতিই তাদের পতনের কারণ হয় এবং পক্ষান্তরে হাশেমী বংশোদ্ভূত মুহম্মদ-বিন-আলী আব্বাসীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে খারিজী-মাওয়ালী-শিয়া সমর্থকদের একত্রীকরণ করতে সমর্থ হন। আব্বাসীয়গণ ক্ষমতালাভ করে উদার নীতি অনুসরণ করেন এবং তাদের প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে আনারব ব্যক্তিদের সহযোগিতা কামনা করেন। এর ফলে হারুন-আর-রশীদের খিলাফতে পারস্যের বিধর্মী বার্মেকী উজির বংশের আধিপত্য বিস্তৃতি লাভ করে। 

অন্য কথায়, উমাইয়া খিলাফতের পতনে আরবিবাদের পতন ঘটে এবং আব্বাসীয় যুগে পারস্য প্রভাবের ফলে ইসলাম সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করে। আব্বাসীয়গণই প্রকৃত ইসলামী শাসন কায়েম করেন। এ সময় থেকেই আব্বাসীয় দরবারে পারস্য মদ, পত্নী, উপ-পত্নী, সংগীত, নৃত্য, ভাবধারা, পদবী ও শাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এমনকি আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর সিরিয়া ভূখণ্ড দামেস্ক হতে মেসোপটেমিয়-পারস্য অঞ্চলের বাগদাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। এর ফলে উমাইয়া আমলে প্রবাহিত পশ্চিমা বায়জানটাইন প্রভাবের ধারা পূর্ব দিকে ধাবিত হয়। মরিস গডফ্রে ডিমজবিনিস বলেন যে, উমাইয়া মালিকগণ কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি উদাসীন হলেও তারা ক্ষমতাশীল শাসক ছিলেন এবং তাদের মধ্যে জনকল্যাণকর ভাবধারা (‘মাসলাহা’) বিদ্যমান ছিল। অপরদিকে আব্বাসীয়গণ দাবি করেন যে, তারা রাসূলে করীমের প্রকৃত সুন্নাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং ক্ষমতার সঙ্গে ইমামের (আমির-উল-মুমেনীন) ধর্মীয় মর্যাদা সংযোগ করেন। আব্বাসীয় খলিফাগণ সাসানীয় সম্রাটদের অনুকরণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। এজন্য তাকে কেবল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীই (Sovereign ruler) বলা যাবে না, সে সঙ্গে তিনি মুসলিম জাতির একচ্ছত্র ধর্মীয় নেতা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, আব্বাসীয় খলিফাদের নিকট হতে অন্যান্য মুসলিম রাজ্যের সুলতানগণ স্বীকৃতি (Investiture) লাভ করতেন; যেমন— ভারতের দাস বংশের ইলতুৎমিশ, মিসরের মামলুক বংশ ও তুর্কী সুলতান। আব্বাসীয়দের আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব বিশেষ ফলপ্রসূ ছিল। উমাইয়া খিলাফতে দ্বিতীয় ওমর ব্যতীত অপরাপর উমাইয়া খলিফাগণ স্বৈরাচারী ও অধর্মে নিমজ্জিত ছিলেন। ফলে তারা সহজেই জনপ্রিয়তা হারান। তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) চরমে উঠে এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর (ফকিহ) মতামতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। ব্যক্তিগত জীবনে উমাইয়া খলিফাগণ পাপাচারে লিপ্ত থাকতেন। এমনকি মুয়াবিয়ার পুত্র ও উত্তরাধিকারী প্রথম ইয়াজিদের উপাধি ছিল মদাসক্ত (ইয়াজিদ আল-খুমার)। আব্বাসীয় আমলে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি বর্জন করে ওলামাদের প্রভাবে ধর্মভিত্তিক শাসন প্রবর্তনের প্রচেষ্টা হয়। হারুন-আর- রশীদ প্রখ্যাত ইসলামী আলেম হানাফী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফাকে যথেষ্ট সম্মান করতেন। তার আমলে হাদিসের উৎকর্ষ সাধিত হয়। এর ফলে আব্বাসীয় খিলাফতের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। স্পুলার বলেন, “শিয়া সম্প্রদায়ের পরিবর্তে তারাই (আব্বাসীয়গণ) রাসূলের প্রকৃত হাদিস সংরক্ষণের পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং মুসলিম সমাজের রীতিনীতিকে (আহল-আল-সুন্নী ওয়াল জামা) ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করেন।” আব্বাসীয় খলিফাগণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, ওলামা- ফকিহাদের পৃষ্ঠপোষকতা, শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধের জন্য মুহতাসিব নিয়োগ, বিধর্মী ও শরীয়ত পরিপন্থী মতবাদ (মনসুরের আমলে রাওয়ান্দিয়া, মাহদীর আমলে মাজদাক সম্প্রদায়) দমনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। 

খিলাফত : পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিচার করলে প্রতীয়মান হবে যে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আল্লাহর একচ্ছত্র আধিপত্য বা সার্বভৌমত্ব রয়েছে; আল্লাহ ‘রাব্বুল আলামীন’ বা বিশ্ব জগতের প্রভু। তিনি কোন বিশেষ দেশ, জাতি, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা বর্ণের প্রভু নহেন; কেবল মানুষের প্রভু নহেন, সমগ্র সৃষ্টজগতের প্রতিপালক। এই মর্মবাণীতেই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নিহিত আছে। উপরন্তু, রাসূলে করীম (স) বলেন, “পরলোকে আল্লাহর নিকট লোকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক ক্রোধগ্রস্ত ও সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট সে ব্যক্তি যার রাজাধিকার নাম রাখা হয়। আল্লাহ ভিন্ন কোন রাজা নেই। আল্লাহ -রাসূলদের তাঁর প্রতিনিধি করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।” “হে দাউদ, আমি তোমাকে পৃথিবীর প্রতিনিধি (খলিফা) করেছি।” মহানবী হযরত মুহম্মদ (স)-এর প্রতিনিধি ছিলেন আদর্শ খলিফাগণ, যিনি ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন। ইবন- খালদুনের ভাষায়, “খিলাফত হচ্ছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা মহানবী মুহম্মদ (স)-এর ধর্মীয় কার্যকলাপের (ধর্ম প্রচার) প্রতিনিধিত্ব করে।” খোলাফায়ে রাশেদূন ও উমাইয়া খিলাফতের পর আব্বাসীয়গণ ক্ষমতায় অধিষ্টিত থেকে খিলাফতকে সুদূরপ্রসারী করেন। দীর্ঘ প্রায় পাঁচশত বছর খিলাফত অব্যাহত থাকে। আবুল মনসুরকে আব্বাসীয় খিলাফতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় এবং তিনি আলেম সম্প্রদায় ও ফকিহদের নিকট থেকে ধর্মীয় সমর্থন লাভ করেন। এর ফলে খিলাফতের বৈধতা ও যথার্থতার ব্যাপারে কোন দ্বিমত বা বিরোধিতা রইল না। উপরন্তু, খলিফাগণ বিভিন্ন উপাধি ধারণ করতেন এবং মহানবীর সঙ্গে নৈকট্য প্রমাণের জন্য বানু হাশেমের গোত্রভুক্ত হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেন। উমাইয়া যুগের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পরিবর্তে আব্বাসীয় খলিফাগণ ধর্মীয় কার্যকলাপের উপর গুরুত্ব দিতেন। 

বলাই বাহুল্য যে, আব্বাসীয় খিলাফতের প্রশাসনিক কাঠামোর শীর্ষস্থানে ছিলেন খলিফাগণ। আব্বাসীয় শাসননীতি সাম্য ও যোগ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, গোত্ৰ কৌলীন্য ও সম্প্রীতির বিশেষ কার্যকারিতা ছিল না। খলিফা ছিলেন একাধারে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও সকল ক্ষমতার উৎস। ধর্মীয় ক্ষেত্রে ‘আমির-উল-মুমেনীন’ হিসেবে তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় বিধান জারি করতেন, শরীয়ত রক্ষা করতেন, অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিহত করতেন। বিধর্মী গোষ্ঠীদের মূলে কুঠারাঘাত করতেন। তার নামে জুমার নামাজের খুৎবা পাঠ করা হত। তিনি রাজধানীর প্রধান মসজিদে ইমামতী করতেন। তিনি ইসলামের পবিত্র দুই স্থান মক্কা ও মদিনা রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। হজ্জ্বে তিনি অথবা তার কোন মনোনীত ব্যক্তি নেতৃত্ব দিতেন। ধর্মীয় মর্যাদার প্রভাব প্রকাশের জন্য তারা বিভিন্ন উপাধি ধারণ করতেন। খলিফা আল-মামুনের মৃত্যুর পর তার ভাই আবু ইসহাক ‘মুহাম্মদ আল-মুতাসিমবিল্লাহ’ (৮৩৩-৪২ খ্রি.) উপাধি ধারণ করেন। কোন কোন খলিফা ‘খলিফাত আল্লাহ’ অথবা ‘যিল আল্লাহ আলা-আল-আবদ’ অর্থাৎ ‘পৃথিবীতে আল্লাহর ছায়া’ উপাধি ধারণ করেন। 

খলিফার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে দুভাগে ভাগ করা যায় : সামরিক ও বেসামরিক সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে তিনি সমর পরিচালনা, সামরিক কর্মচারী নিয়োগ ও সামরিক ব্যবস্থার সুষ্ঠু বিন্যাস করতেন। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে প্রশাসনিক কাঠামোর প্রধান কর্মকর্তার ও ক্ষমতার (ফরমান-আইন) উৎস হিসেবে তিনি প্রত্যেক বিভাগের কার্যকলাপে প্রত্যক্ষ নজর রাখতেন। বেসামরিক কর্মচারী নিয়োগ, বদলী, পদচ্যুতি, পদোন্নতি, বেতন কাঠামো নির্ধারন, রাজস্ব বিভাগের হিসাব-নিকাশ ও রক্ষণাবেক্ষণ তার ব্যক্তিগত নির্দেশে সম্পন্ন হত। উজির, হাজিব, প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ সম্পূর্ণরূপে তার মুখাপেক্ষী ছিলেন। বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন, রাষ্ট্রদূত নিয়োগ ও বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনে খলিফা বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, খলিফা হারুন- আর-রশীদ বায়জানটাইনদের সঙ্গে সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করেন। ফ্রান্সের নৃপতি শার্লিমেনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং চীন ও ভারতবর্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক আদান- প্রদান সম্পন্ন করেন; রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে টাকশাল থেকে মুদ্রিত মুদ্রায় অবশ্যই তার নাম অঙ্কিত থাকত। প্রধান বিচারপতির দায়িত্বও তিনি পালন করতেন। 

ইবন আল-আসীরের তথ্য হতে আল-মনসুরের দৈনন্দিন কার্যকলাপের চিত্র পাওয়া যায়, “তিনি পূর্বাহ্নের অধিক সময় ফরমান জারি, কর্মচারী নিয়োগ ও পদচ্যুতি, সৈন্য ও সীমান্ত সংরক্ষণের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ, রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা বিধানের পন্থা নির্ণয়, প্রজাদের অবস্থা ও বাসস্থানের উন্নতি বিধান, আয়-ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষা ইত্যাদি কাজে অতিবাহিত করতেন। অপরাহ্নে তিনি পরিবার ও সন্তান-সন্তুতি নিয়ে কাটাতেন। মাগরিবের নামাজের পর তিন দিনের সংবাদাদি শ্রবণ ও মন্ত্রিবর্গের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। রাতের তৃতীয়াংশ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কাজে নিমগ্ন থেকে বিশ্রাম নিতেন। ফজরের নামাজের জন্য তিনি অতি প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ করতেন। তিনি স্বয়ং সেনাবাহিনী পরিদর্শন করতেন এবং প্রয়োজনবোধে সীমান্ত দুর্গগুলো পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি হিসাব-নিকাশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করতেন বলে তার উপাধি ছিল ‘আদ-দাওয়ানিকী’ অর্থাৎ হিসাবরক্ষক।” 

উমাইয়া রাজবংশের মত আব্বাসীয় খিলাফতেও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মৃত্যুর পূর্বে খলিফা তার পুত্র বা ভ্রাতাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যেতেন। অনেক ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারিগণ এই মনোনয়নের বিরোধিতা করতেন এবং সিংহাসনকে উপলক্ষ্য করে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ সংঘটিত হত; যেমন- হারুন-আর-রশীদের মৃত্যুর পর আল-আমীন ও মামুনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ! আবুল আব্বাস প্রতিষ্ঠাতা হলেও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আল-মনসুর কৃতিত্ব অর্জন করেন। মৃত্যুর পূর্বে আবুল আব্বাস তদীয় ভ্রাতা মনসুরকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। আব্বাসীয় খিলাফতকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তার পুত্র মাহদীকে মনোনীত করেন। মাহদীর পর তার দুই পুত্র হাদী ও হারুন-আর-রশীদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। বস্তুত আল-মনসুরকে ‘রাজেন্দ্র’ বলা যায়; কারণ, তার উত্তরাধিকারিগণ বাগদাদে বহু বছর খিলাফতের মর্যাদা রক্ষা করেন। হিট্টির ভাষায়, “আস-সাফফার স্থলে তিনিই নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। যে পঁয়ত্রিশ জন আব্বাসীয় তাঁর উত্তরাধিকারী হন তাঁরা প্রত্যক্ষ বংশধর ছিলেন।” 

উজির : কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোর শীর্ষে অবস্থানকারী খলিফার পরেই গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন ছিলেন উজির। উল্লেখ্য যে, নবী করীম, খোলাফায়ে রাশেদূন এবং উমাইয়া খিলাফতের আমলে উজিরের কোন পদ ছিল না। আব্বাসীয় যুগে সাসানীয় রাজবংশের প্রভাবে সর্বপ্রথম ইসলামী শাসন-ব্যবস্থায় উজিরের পদ সৃষ্টি হয়। শুধু পারস্যবাসীদের সন্তুষ্ট করার জন্যই নহে বরং বিশাল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসন সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠার জন্য খলিফার সহকারী হিসেবে উজির নিযুক্ত করা হয়। উজিরের পদমর্যাদা সম্বন্ধে নানা প্রকার মতামত রয়েছে। আল-ফাখরীর মতে, উজির খলিফা এবং তার প্রজাদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেন। উজিরের পদের যথার্থতা সম্পর্কে আল-মাওয়ার্দী বলেন, “রাজনীতির ক্ষেত্রে সবকিছুর মূলে একজনের (খলিফা) একচ্ছত্র প্রতিপত্তি অপেক্ষা তার সহকারী থাকা বাঞ্ছনীয়।” খলিফার সঙ্গে জনগণের সরাসরি যোগাযোগ সম্ভবপর না হওয়ায় তাদের অভাব-অভিযোগ উজিরের মাধ্যমে পেশ করা হত। খলিফার পরেই প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বা উজির প্রশাসনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। তিনি খলিফার সাক্ষাৎ প্রতিভূ ছিলেন এবং প্রশাসনের সর্বস্তরে খলিফাকে সহযোগিতা করতেন, কারণ খলিফার একার পক্ষে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ফরমান জারি, প্রশাসনিক কার্যাবলি তদারক প্রভৃতি কাজ করা সম্ভবপর হত না। 

সাংবিধানিক পদ্ধতিতে খলিফাই ছিলেন সকল ক্ষমতার উৎস। তিনিই উজির নিযুক্ত করতেন এবং তাঁরা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। রাজনৈতিক আইনজ্ঞগণ, বিশেষ করে মাওয়ার্দী বলেন, উজির দুই ধরনের ছিল; প্রথমত, অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন উজির (Vizier with unlimited power বা tafwid) এবং দ্বিতীয়ত, অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন উজির (Vizier with limited power বা tanfid)। অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন উজির খলিফার পূর্ব অনুমোদন ব্যতীত কর্মচারী নিয়োগ অথবা বরখাস্ত করতে পারতেন। অবশ্য খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত কর্মচারীদের তিনি বরখাস্ত করতে পারতেন না। হিট্টি বলেন, “অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন উজির কেবল উত্তরাধিকারী মনোনয়ন ব্যতীত সকল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।” তিনি রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ, রাষ্ট্রের প্রশাসনের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, প্রাদেশিক গভর্নর, বিচারক, এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতি ও পদচ্যুত করবার ক্ষমতা রাখতেন। এমনকি খলিফার মত তিনি বিচারালয়ের প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করতেন। এ ছাড়া আপীল কোর্টের (নজর-আল-মাযালিম) সভাপতিও হতেন। তিনি স্বয়ং অথবা তার মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা সামরিক অভিযান পরিচালনা করতেন। রাজস্ব প্রশাসনে অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন উজির বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। কর আদায়, কর ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস, রাজস্ব কর্মচারীদের উপর কর্তৃত্ব, আয়-ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এতদসত্ত্বেও খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত উজিরের মেয়াদ তার ইচ্ছানুসারে হত। কিন্তু একথা নিশ্চিত যে, খলিফার সমতুল্য ক্ষমতার অধিকারী উজিরের প্রভাব-প্রতিপত্তি আব্বাসীয় খিলাফতের শেষভাগ পরিলক্ষিত হয়। এই ক্ষেত্রে খলিফা যেন একজন সাংবিধানিক রাষ্ট্রপ্রধান (Consititutional head) এবং সমস্ত নির্বাহী ক্ষমতা (Executive head) গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মত অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন উজিরের হাতে থাকত। এ ধরনের উজির ব্যবস্থার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হারুন-আর-রশীদের খিলাফতের বার্মেকী উজির পরিবার। সীমিত ক্ষমতার উজির, হিট্টির ভাষায়, “প্রশাসনিক ব্যাপারে কোন নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা প্রকাশ না করে কেবল খলিফার নির্দেশ এবং ফরমান কার্যকর করার প্রয়াস পান।” তিনি রাষ্ট্রীয় কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতেন না অথবা খলিফার অগোচরে কোন কাজ সম্পন্ন করতে পারতেন না। এই সমস্ত উজির কেন্দ্ৰ ও প্রদেশের মধ্যে শাসনতান্ত্রিক যোগসূত্র রক্ষা করতেন। 

আব্বাসীয় খিলাফতের প্রশাসনে উজিরদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আল- মাওয়ার্দী এবং আরনল্ড উজিরদের পদমর্যাদা, যোগ্যতা ও অধিক সুযোগ-সুবিধার বিশেষ বিবরণ দেন। একমাত্র অভিজ্ঞ, প্রতিভাবান ও নিষ্কলুষ চরিত্রের ব্যক্তিগণই উজিরের পদমর্যাদা লাভ করতেন। যোগ্যতার বিচারে তাকে সর্বগুণে গুণান্বিত হতে হত; সুপণ্ডিত হতে হত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন অঙ্কশাস্ত্র, ব্যাকরণ, কাব্য, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ইতিহাসে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হত। তাকে মন্ত্রণাসভায় সভাপতিত্ব করতে হত এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান প্রদানের জন্য তার জ্ঞানের পরিধি হতে হত অপরিসীম। উজিরদের ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ, দায়িত্বশীল, মার্জিত-রুচিসম্পন্ন, কোমল, স্থিরমস্তিষ্ক এবং গোপনীয়তা রক্ষা করার ক্ষমতা থাকতে হত। আত্মমর্যাদা, নিৰ্ভীকতা, সন্তুষ্টচিত্ত, ধীর স্বভাব তাঁর দ্বিধাগ্রস্ততা থাকত না। যুদ্ধ-কৌশল ও অর্থনীতিতে তাকে পারদর্শী হতে হত। লোভ-লালসা তাকে বর্জন করতে হত। এভাবে একমাত্র সর্বগুণে গুণান্বিত ব্যক্তিই যোগ্যতার ভিত্তিতে আব্বাসীয় খিলাফতে খলিফার পর দ্বিতীয় দায়িত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন পদে সমাসীন হতেন। 

আব্বাসীয় খিলাফতে প্রবর্তিত উজির পরিবার বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আবুল আব্বাস আবু সালমা আল-খাল্লালকে সর্বপ্রথম উজির নিযুক্ত করেন। কিন্তু সন্দেহ- পরায়ণ আব্বাস শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল আবু সালমাকে পদচ্যুত ও হত্যা করেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন আবু জাহান। তিনিও বিষ প্রয়োগে নিহত হলে আবুল আব্বাস পারস্যের জাফর-বিন-বার্মাককে উজির নিয়োগ করেন। গিলমানের মতে, “আবুল আব্বাসের খিলাফতে সুদূর খোরাসান হতে জাফর নামে বার্মেকী পরিবারের একজন প্রতিনিধি দরবারে আসেন। জাফর বলখের একজন বার্মেকী বা বৌদ্ধ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন এবং মুসলিম সেনাপতি কুতাইবা কর্তৃক স্ত্রী ও পুত্র খালিদসহ বন্দী হন।” খালিদ-বিন-বার্মাকী আবুল আব্বাসের খিলাফতে কর্মকুশলতার জন্য যথেষ্ট প্রভাব ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন এবং রাজস্ব বিভাগে প্রধান কোষাধ্যক্ষের পদ লাভ করেন। খলিফা আল-মনসুর সর্বপ্রথম খালিদ-বিন-বার্মাককে উজির নিযুক্ত করেন এবং এভাবে পারস্যের উজির বংশ আব্বাসীয় প্রশাসনে বিশেষ অবদান রাখে। প্রকৃতপক্ষে খালিদ-বিন-বার্মাকই প্রখ্যাত পারস্যের উজির পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। খালিদের পুত্র ইয়াহিয়া হারুন-আর-রশীদের গৃহশিক্ষক ছিলেন এবং খলিফার মর্যাদা লাভের পর তিনি তাকে উজির নিযুক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, আবুল আব্বাস ও মনসুরের শাসনামলে উজিরদের সীমিত ক্ষমতা ছিল। কিন্তু খলিফা মাহদী, হাদী ও হারুনের রাজত্বকালে উজিরদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বস্তুত হারুনের খিলাফতে ইয়াহিয়া ও তদীয় পুত্র জাফর খলিফার নামে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেন। উজির কর্মচারী নিয়োগ, পদচ্যুতি, ফৌজদারী আপীল, আদালতে (নজর-আল-মাযালিম) বিচারকার্যসহ সকল দফতরের কার্যাবলির তদারক করতেন। এমনকি খলিফার ব্যক্তিগত সীলমোহর (খাতাম) ব্যবহারের দায়িত্বও ইয়াহিয়ার উপর অর্পিত হয়। ইয়াহিয়ার চারজন পুত্র ফজল, জাফর, মুসা ও মুহাম্মদ খলিফা হারুনের রাজত্বের দীর্ঘ সতর বছর (৭৮৬-৮০৩ খ্রি.) দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে আব্বাসীয় প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করেন। হারুনের নিত্য সহচর হিসেবে জাফর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন এবং তিনি উজির থাকাকালীন সময়ে বার্মেকী উজির পরিবার ক্ষমতার শীর্ষ আরোহণ করেন। প্রকৃত অর্থে তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং হারুনের ভগ্নী আব্বাসার সঙ্গে তার তথাকথিত গোপন প্রণয়ের অভিযোগে খলিফার নির্দেশে তাঁকে হত্যা করা হয়। বার্মেকী বংশের অপর দুজন সদস্য মুসা ও মুহাম্মদ হারুন-আর-রশীদের বিভিন্ন প্রদেশে দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে মাত্রাধিকভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত এবং আর্থিক অপচয়ের দায়েই বার্মেকী উজির পরিবারের উচ্ছেদ করা হয়। হারুন প্রত্যক্ষ শাসনের সুযোগ পান এবং শিয়া বার্মেকীদের ক্ষমতা ধূলিসাৎ করে দেন। খলিফা মামুনের রাজত্বে উজির ফজল-বিন-সহল সমুদয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর উপাধি ছিল ‘যুর- রিয়াসাতায়িন’ (Dhur Riyasatayn)। ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য মামুন ফজলকে পদচ্যুত করেন এবং পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। মামুনের দুজন উত্তরাধিকারী খলিফা মুতাসিম ও ওয়াসিকের শাসনামলে উজিরগণ খলিফার নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। 

দশম শতাব্দীর পর আব্বাসীয় খিলাফতের পতন শুরু হয় এবং ৮৬১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ আল-মুতাওয়াক্কিলের মৃত্যু হতে আল-মুসতানসির পর্যন্ত মোট ছাব্বিশ জন খলিফা রাজত্ব করেন। এই গোলযোগপূর্ণ সময়ে উজিরগণ অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং ইচ্ছামত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতেন। খলিফার দুর্বলতা উজিরদের দুর্নীতি ও অকর্মণ্যতার ফলে শাসনযন্ত্র ভেঙ্গে পড়ে। খলিফা আল- মুকতাদিরের (৯০৭-৯৩২ খ্রি.) চব্বিশ বছরের শাসনামলে পনেরো জন উজির নিযুক্ত ও পদচ্যুত হন। ফলে খলিফা উজিরের পদ বিলুপ্ত করে তাঁর দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান মুনিস-আল-মুজাফফরকে ‘আমীর-উল-উমরাহ’ উপাধিতে ভূষিত করে রাষ্ট্রের সমবময় ক্ষমতা অর্পণ করেন। আল-মুকতাদিরের উত্তরাধিকারী আল-কাহির সিংহাসন লাভ করার (৯৩২-৯৩৪ খ্রি.) অল্প দিন পর তাঁকে স্বৈরাচারী ও ক্ষমতালোভী উজির মুনীস সিংহাসনচ্যুত করেন। তাঁকে অন্ধ করে দেয়া হয় এবং তাঁকে বাগদাদের রাজপথে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। আল-কাহিরের দুজন উত্তরাধিকারী আল-মুত্তাকী (৯৪০-৪৪ খ্রি.) এবং আল-মুসতাকফীকেও (৯৪৪-৪৪ খ্রি.) নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আল-রাজীর (৯৩৪-৪০ খ্রি.) রাজত্বে আমীর-আল-উমরাহ মুহম্মদ-ইবন-রাইখের ঔদ্ধত্যের সীমা অতিক্রম করে এবং খুৎবায় খলিফার নামের সাথে তাঁর নামও পঠিত হয়। হিট্টি বলেন, “জেনারেলিসিম আমীর-উল-উমরাহ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসকরূপে প্রতিষ্ঠিত হন।” উজিরের পদমর্যাদার হানি হয় এবং তিনি খলিফার ব্যক্তিগত সচিব (Private Secretary) (রাইস-আল-রোয়াসা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। শিয়া বুয়াইয়া আমীরদের শাসনামলে তাঁদের নাম জুমার খুৎবায় খলিফার সঙ্গে উচ্চারিত হত। উচ্চাভিলাসী বুয়াইয়া শাসক আজাদ-উদ-দৌলাহ (৯৬৭-৮৩ খ্রি.) ‘সুলতান’ এবং ‘শাহানাসা’ উভয় উপাধি গ্রহণ করেন। শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত বুয়াইয়া আমীরদের আধিপত্য বিনষ্ট করে সুন্নী সেলজুক গোষ্ঠী আব্বাসীয় খিলাফতে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে। গ্রুনিবাম বলেন, “সংঘবদ্ধ সেলজুক রাষ্ট্র চল্লিশ বছর যাবৎ রাজত্ব করে; সেলজুক রাজত্বে শাসন- ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়; এ রাজত্ব সুন্নী ইসলামকে সুংসহত করার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।” এ যুগেই সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও শাসন সংস্কারক নিজাম-আল-মূলকের আবির্ভাব হয়। নিজাম-আল-মূলকের (‘সিয়াসতনামা’র লেখক) রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও প্রশাসনিক মেধায় সন্তুষ্ট হয়ে মালিক শাহ তাকে ‘আতাবেগ’ (আমীরের শাসনকর্তা) উপাধি প্রদান করেন। হিট্টির ভাষায়, “ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি অলঙ্কারস্বরূপ।” বুয়াইয়াদের মত সেলজুক শাসকবর্গ ‘সুলতান’ উপাধিতে ভূষিত হন। সেলজুকদের (১০৫৫-১১৯৪ খ্রি.) ক্ষমতা হ্রাস পেলে আব্বাসীয় খলিফাগণ তাঁদের পূর্ব প্রভাব ও প্রতিপত্তি পুনরুদ্ধারের প্রয়াস পান। কিন্তু আব্বাসীয় খিলাফতের শেষভাগে উজির প্রশাসনে বিশেষ অবদান রাখেন এবং এ পদ সর্বশেষ খলিফা আল-মুসতাসিমের (১২৪২-৫৮ খ্রি.) শাসনামল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ‘খোদার গজব’ (Scourge of God) হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণের সময় উজির ইবন-আল-কামী মোঙ্গল আক্রমণকারীর সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করার প্রস্তাব দেন, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। 

পদমর্যাদা অনুযায়ী উজিরগণ বেতন ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি পেতেন। দশম শতাব্দীতে খলিফা হারুন-আর-রশীদের আমলে ক্ষমতাসম্পন্ন ও প্রভাবশালী বার্মেকী উজির পরিবার পর্যন্ত বেতন ছাড়াও নানারকম ভাতা ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা লাভ করতেন। কথিত আছে যে, বার্মেকী বংশের সদস্যগণ ২৫০টি দায়িত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন এবং তাঁরা এরূপ জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন যে, তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সময় প্রাসাদসমূহ ও খামার বাড়ির মূল্য ব্যতীত সম্পদের মোট মূল্য দাঁড়ায় নগদ ৩,০৬,৭৬,০০০ দিনার। 

খলিফা-আল-মুতামিদের (৮৭০-৯২ খ্রি.) শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর বেতন ছিল, ১,০০০ দিনার। পরবর্তী পর্যায়ে উজিরের বেতন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫,০০০ হতে ৭,০০০ দিনারে। বেতন ছাড়াও উজিরদের পারিবারিক ভাতা দেওয়া হত। উপঢৌকন, উৎকোচ, নজরানাও তারা লাভ করতেন। সুতরাং বলা যায় যে, উজিরের প্রভাব ও প্রতিপত্তি আব্বাসীয় আমলে অপ্রতিহত থাকলেও তাঁদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ঈর্ষা, কোন্দল ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের অন্যতম কারণ। 

উজিরের মত হাজিব বা খলিফার রাজ পরিবারের গৃহাধ্যক্ষ পারস্য শাসনব্যবস্থা হতে গ্রহণ করা হয়। প্রথম দিকে উজির হাজিবের দায়িত্ব পালন করতেন, কিন্তু উজিরের কার্যাবলি বৃদ্ধি পেলে হাজিব পদটি সৃষ্টি করা হয়। হাজিবের কর্তব্য ছিল বিদেশী দূতবর্গকে দরবারে আমন্ত্রণ ও পরিচয় করিয়ে দেয়া। খলিফা এবং জনগণের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করতেন হাজিব। তিনি সুবিচারের জন্য তাদের অভাব-অভিযোগ খলিফার নিকট পেশ করতেন। কখনও কখনও খলিফার ব্যস্ততার জন্য হাজিব মজলুম জনতার অভিযোগ শ্রবণ করে স্বয়ং সেগুলো নিষ্পত্তি করতেন। রাজদরবারে ‘জল্লাদ’ এবং ‘জ্যোতিষী’ নামীয় দুজন কর্মকর্তার প্রভাব দেখা যায়। আরবের ইতিহাসে সর্বপ্রথম রাজপ্রাসাদের গুপ্ত কক্ষে বিদ্রোহী ও সমাজদ্রোহীদের শাস্তি দেয়ার প্রথা প্রচলিত হয়। বস্তুত, হাজিব খলিফার নিত্যসহচর ছিলেন। 

কেন্দ্রীয় দফতরসমূহ 

আব্বাসীয় খিলাফতের কেন্দ্রীয় প্রশাসন-ব্যবস্থা পরিচালিত করার জন্য বিভিন্ন দফতর সৃষ্টি করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হত। এই মন্ত্রিপরিষদের নাম ছিল ‘দিওয়ান আল-আজীজ’। এই মন্ত্রিপরিষদের অধীনে কেন্দ্রীয় শাসন-ব্যবস্থার সুষ্ঠু বিন্যাস করা হয়। 

দিওয়ান-আল-খারাজ : কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দফতর ছিল ‘দিওয়ান-আল-খারাজ’ বা রাজস্ব বিভাগ। এ বিভাগের প্রধান দায়িত্ব ছিল রাজস্ব নীতি প্রণয়ন, রাজস্ব ধার্য ও আদায়, হিসাব রক্ষা ও নিরীক্ষণ, যাবতীয় ব্যয় বহন ও সরকারি কর্মচারী বেতন ও ভাতা বণ্টন এবং জনকল্যাণকর কাজে অর্থ যোগান দেয়া। মন্ত্রিপরিষদের একজন দায়িত্বশীল ও প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন ‘সাহিব-আল-খারাজ’ বা প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা। তাকে ‘রাজস্ব প্রভু’ (Master of taxes) বলা হত; কারণ তিনি বিভিন্ন খাতে জনগণের নিকট থেকে কর-রাজস্ব আদায় করে কোষাগারে (বায়ত-আল- মাল) জমা দিতেন। রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল খারাজ, যাকাত, জিজিয়া, আল-ফে, আমদানি কর, বিজিত অঞ্চলের প্রদত্ত অর্থ, গোচারণ কর ইত্যাদি। যাকাত হতে প্রাপ্ত অর্থ দুঃস্থ, বিকলাঙ্গ, মুসাফির, দাস মুক্তকরণ ও জেহাদে অংশগ্রহণকারীদের জন্য খরচ করা হত। ‘আল-ফে’ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব রাস্তাঘাট নির্মাণ, পুল তৈরি, সৈন্যদের বেতন এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর মঙ্গলার্থে ব্যয় করা হত। রাজস্ব সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব পালনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তাকে সাহায্য করতেন ‘খাজিন’ (কোষাধ্যক্ষ), ‘কাতিব’ (সচিব) এবং ‘মুশরিফ’ (পরিদর্শক)। 

আব্বাসীয় যুগের ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধির নজির পাওয়া যাবে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ে। হিট্টি বলেন, “আব্বাসীয় শাসনামলে রাজস্ব আদায়ের যে তথ্য পাওয়া যায় তা হতে প্রতীয়মান হয় যে তাঁদের রাজত্বের প্রথম যুগে ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধি এমন চরম শিখরে পৌঁছায় যে খলিফাগণ জাঁকজমকের সাথে বসবাস করতে পারতেন।” এই তথ্যাবলি প্রসঙ্গে বলা যায়, ইবন খালদুন মামুনের সময়ের রাজস্ব ব্যবস্থা আদায়, কুদামা আল- মুতাসিমের সময়ে এবং ইবন খুরদাদবী হিজরীর তৃতীয় শতাব্দীর রাজস্ব ব্যবস্থা ও কর আদায় সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেন। 

আব্বাসীয় যুগে ‘আল-সাওয়াদ’ নামে পরিচিত ইরাকের নিম্নাঞ্চল হতে রাজস্ব আদায়ের পরিমান ছিল ২,৭৮,০০,০০০ দিরহাম; খোরাসান থেকে ২৮,০০,০০০ দিরহাম; মিসর থেকে ২,৩০,৪০,০০০ দিরহাম; সমগ্র প্রদেশ থেকে নগদ আদায়ের পরিমাণ ছিল ৩৩,১৯২৯,০০৮ দিরহাম। আল-মুতাসিমের রাজত্বকালে রাজস্বের পরিমাণ কেবল ‘আল-সাওয়াদ’ থেকে নগদ ও মালামালসহ সর্বমোট ১৩,০২,০০,০০০ দিরহাম; খোরসানি থেকে ৩,৭০,০০,০০০ দিরহাম; মিসর থেকে ৩,৭৫,০০,০০০; সিরিয়া- প্যালেস্টাইন থেকে ১,৫৮,৬০,০০০ দিরহাম। বস্তুত আল-মুতাসিমের খিলাফতে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮,৮২,৯১,৩৫০ দিরহামে। ইবন খুরদাদবিহ উল্লেখ করেন যে, দশম শতাব্দী (হিজরী তৃতীয়) কেবল ‘আল-সাওয়াদ’ থেকেই রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২,৭৮,০০,০০০ থেকে ৭,৮৩,১৯,৩০০ দিরহামে; সিরিয়া-প্যালেস্টাইনে ২,৯৮,৫০,০০০ এবং খোরাসানে ৪,৪৮,৪৬,০০০ দিরহামে। রাজস্ব আদায়ের সঠিক হিসাব উল্লেখ থাকলেও ব্যয়ের প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না। আব্বাসীয় খিলাফতের প্রাচুর্য সর্বজনবিদিত এবং এর সমৃদ্ধি পারস্যের রাজবংশের সমতুল্য ছিল। আল-মনসুরের মৃত্যুর পূর্বে রাজকোষে ৬,০০,০০,০০০ দিরহাম এবং ১,৪০,০০,০০০ দিনার মওজুদ ছিল। খলিফা হারুন-আর-রশীদের মৃত্যুর সময় আব্বাসীয় সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯০,০০,০০,০০০ দিরহাম; আল-মুতাফীর (৯০২-৯০৭ খ্রি.) শাসনামলে স্বর্ণালঙ্কার ও অস্থাবর সম্পত্তিসহ সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০,০০,০০,০০০ দিনার 

‘দিওয়ান-আল-খারাজের’ অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে “দিওয়ান-আল-জিমাম’ আয় ব্যয়ের নির্ভুল তথ্য রক্ষণাবেক্ষণের বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আল-মাহদী এই বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, মুসলিম প্রশাসন-ব্যবস্থায় আব্বাসীয় খিলাফতের অবদান অপরিসীম। মূলার বলেন, “পারস্য প্রথার ভিত্তিতে পৃথক বিভাগ (দিওয়ান) বিশেষভাবে সৈন্যবাহিনী, রাজস্ব এবং আয়কর, ডাক এবং প্রদেশসমূহ নিয়ে একটি সুপরিকল্পিত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নবম ও দশম শতাব্দীতে এটি ক্রমশ সম্প্রসারিত হতে থাকে।” 

দিওয়ান-আল-জুনদ : উমাইয়া সেনাবাহিনী মূলত ছিল গোত্রভিত্তিক। কিন্তু আব্বাসীয় যুগে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষা ও গোষ্ঠীর পৃথক পৃথক সামরিক বাহিনী বা রেজিমেন্ট ছিল; যেমন- আরব রেজিমেন্ট, খোরাসানী রেজিমেন্ট, খলিফা মুতাসিমের সময়ে তুর্কী ও আফ্রিকীয় রেজিমেন্ট। এ জন্য আব্বাসীয় বাহিনীকে আন্তর্জাতিক বাহিনী বলা যায়। দ্বিতীয়ত, উমাইয়া শাসনামলে নিয়মিত বেতন-ভুক্ত সৈন্যের সংখ্যা ছিল স্বল্প; কেবল দেহরক্ষী ও সামরিক ঘাঁটিতে অবস্থানরত বাহিনীই ছিল স্থায়ী; কারণ যুদ্ধের সময় গোত্র ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তলব করা হত। কিন্তু আব্বাসীয় যুগে সাম্রাজ্যের বিশালতার জন্য এক একটি ‘জুনদ’ বা সামরিক ছাউনী সৃষ্টি করে নিয়মিত বেতনভুক সৈন্যবাহিনী গঠন করা হয়। আব্বাসীয় খলিফা সর্বাধিনায়ক ছিলেন এবং তিনি সামরিক পদে নিয়োগ দান করতেন। একজন সামরিক অধিনায়কের অধীনে সামরিক বিভাগ পরিচালিত হত। তাঁর প্রধান দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনী গঠন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা, বেতনদান, যুদ্ধ-কৌশল নির্ণয়, রসদ সরবরাহ, সেনা বিভাগের বিন্যাসের দ্বারা সদাসতর্ক অবস্থায় বিভিন্ন শাখাকে প্রস্তুত রাখা। এ ছাড়া অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত ও সরবরাহ দ্বারা যুদ্ধকালীন অবস্থায় নেতৃত্ব দানও তাঁর কর্তব্য ছিল। তাঁর তত্ত্বাবধানে যে সমস্ত সামরিক কর্মচারী বিভিন্ন কর্তব্য পালন করতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন, ‘মজলিস আল-মুকবাহ’ সৈন্য নিয়োগে, ‘মজলিস আল-তাকবীর’ সৈন্যদের বেতন-ভাতা বণ্টনে ‘দিওয়ান-আল- আরয’ সামরিক বাহিনীর সাজসরঞ্জাম পরীক্ষা ও সরবরাহে, ‘মুশরিফ-আল-সানাত বিন মাখজাম’ অস্ত্রাগারে তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিলেন। 

আব্বাসীয় খিলাফতে বাগদাদ, রাক্কা, উখাইদির, সামাররা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়। গোলাকার বাগদাদ নগরী ‘মদিনাত-আল-মুদাওয়ার’ দুটি বেষ্টনী প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। সীমান্ত দুর্গ নির্মাণ দ্বারা আব্বাসীয় খলিফাগণ বহিঃশত্রু, বিশেষ করে বায়জানটাইনের আক্রমণ হতে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন। আল- মনসুর এশিয়া মাইনর, মালাতীয়া, মারাস ও আদানায় সৈন্য ছাউনী প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া সিলিসিয়া ও ক্যাপাডোসিয়াতে সীমান্ত দুর্গ প্রতিষ্ঠা করা হয়। হারুন-আর-রশীদ সীমান্ত পাহারার জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করে। এই ঘাঁটিগুলো একটি প্রতিরক্ষাব্যূহ (বা Protectorate) সৃষ্টি করে, যা ‘আল-আওয়াসিম’ নামে পরিচিত ছিল। তারসুস, আদানা, হারুনিয়া এবং হারুনের সম্রাজ্ঞী যোবায়দা কর্তৃক ইসকান্দরুনে সীমান্ত দুর্গ শহর নির্মিত হয়। 

আব্বাসীয় খিলাফতের শেষের দিকে সৈন্যসংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে আল মুতাসিমের নতুন রাজধানী সামাররা সেনানিবাসে ২,৫০,০০০ সৈন্য বসবাস করত এবং ১,৬০,০০০ অশ্ব রাখার উপযুক্ত আস্তাবল ছিল। 

আব্বাসীয় খিলাফতে স্থায়ী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কেবল খলিফার দেহরক্ষী বাহিনী বা ‘হারাস’ ছিল স্থায়ী এবং অপরাপর বাহিনী দুই ধরনের ছিল; যথা- সরকারি ভাতাপ্রাপ্ত ‘জুনদ’ (নিয়মিত) বাহিনী, যা ‘মুতাজিকা’ নামে পরিচিত ছিল; অপরটি ছিল অনিয়মিত বাহিনী বা ‘মুতাতাউইয়া’। উমাইয়া যুগে কেবল আরবগণই সামরিক বাহিনীতে যোগাদান করতে পারত। কিন্তু আব্বাসীয় খিলাফতে বিভিন্ন জাতির লোক সেনাবাহিনীর সদস্য হতে পারত। সিরিয়া, মিসর, আফ্রিকা, ইরাক, পারস্য এবং ট্রান্সঅক্সিয়ানার বহু নব-দীক্ষিত মুসলমান আব্বাসীয় বাহিনীতে যোগদান করে। 

উমাইয়া যুগের তুলনায় আব্বাসীয় খিলাফতে সৈন্যসংখ্যা ছিল অধিক। ১,২৫,০০০ হতে আব্বাসীয়দের সময়ে সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৫০ হাজারে। গ্রীক সম্রাট নাইসিফোরাসের বিরুদ্ধে হারুন-আর-রশীদ ১,৩৫,০০০ বেতনভোগী ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীসহ যুদ্ধাভিযান করেন। খলিফা মুকতাদীরের রাজত্বকালে বায়জানটাইন দূতের সম্মানার্থে আয়োজিত কুচকাওয়াজে বাগদাদে ১ লক্ষ ৬০ হাজার অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য অংশগ্রহণ করে। 

আব্বাসীয় বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা আল-মনসুর জাতীয় সৈন্যবাহিনী গঠন করেন এবং এই বাহিনী তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল; যথা- (ক) হিমারীয়, (খ) মুদারীয়, (গ) খোরাসানীয়। উপরন্তু, খলিফা মুতাসিম এশিয়া মাইনরের মামলুকদের সমন্বয়ে একটি তুর্কী বাহিনী গঠন করেন। সেনাবাহিনী প্রধানত নিয়মিত এবং অনিয়মিত স্বেচ্ছাবাহিনীতে বিভক্ত ছিল। আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথম যুগে নিয়মিত বাহিনী তিনভাগে বিভক্ত ছিল; যথা- অশ্বারোহী (ফূরসান), পদাতিক (হাববিয়া) এবং তীরন্দাজ (রামিয়া)। এ ছাড়া অগ্নিশিখা নিক্ষেপকারী খন্দক, প্রস্তুককারক এবং শ্রমিক শ্রেণীও (আল-সাফফা) সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। আব্বাসীয় যুগের প্রথম দিকে একজন পদাতিক আহার্য ও ভাতা ব্যতীত বাৎসরিক ৯৬০ দিরহাম বেতন পেত এবং অশ্বারোহী এর দ্বিগুণ পেত। আল-মামুনের রাজত্বে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি বৃদ্ধি পায় এবং সে সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ইরাকী বাহিনীর একজন পদাতিক ২৪০ দিরহাম বেতন পেত এবং অশ্বারোহী সৈন্য হলে দ্বিগুণ পেত। 

আব্বাসীয় যুগে রোমীয় বায়জানটাইন প্রথা অনুযায়ী আল-মামুন, আল-মুসতাইন এবং অন্যান্য আব্বাসীয় খলিফাদের রাজত্বে একজন ‘আরীফের’ নেতৃত্বে দশজন সৈন্য থাকত। প্রতি পঞ্চাশজনের অধিকর্তা থাকত একজন ‘খলিফা’। ‘কাযেদ’ একশত সৈন্য পরিচালনায় নিয়োজিত থাকতেন। ‘আমীর’ এক হাজার সৈন্য দ্বারা গঠিত বাহিনী পরিচালনা করতেন এবং সৈন্যদের কতিপয় দল নিয়ে গঠিত হত একটি ‘কোম্পানি’ এবং কয়েকটি ‘কোম্পানি’ নিয়ে গঠিত হত ‘কুরদুস’। আমীরকে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে হত। পদাতিক বাহিনী বর্শা, তীর, ধনুক ও তরবারি ব্যবহার করত। অশ্বারোহী সৈন্যগণ বর্শা, তীর ও ধনুক, লম্বা-চওড়া ও সোজা তরবারি এবং ঢাল ব্যবহারে পারদর্শী ছিল। অগ্নিনিক্ষেপকারী সৈন্যগণ (নাফাতুন) অগ্নিনির্বাপক পোশাক পরত এবং শত্রুপক্ষের দিকে ‘নাফতা’ অর্থাৎ অগ্নিশর নিক্ষেপ করত। সেনাবাহিনীর সঙ্গে থাকত অবরোধ যন্ত্রের প্রকৌশলী। ‘মানজানিক’ অর্থাৎ পাথর নিক্ষেপ যন্ত্রের সাহায্যে দুর্গের ফটক ও দেয়ালে আক্রমণকারীরা প্রস্তর দ্বারা আঘাত এবং অবরোধ করত। এরূপ কার্যে নিয়োজিত প্রকৌশলী ছিলেন ইবন সাবির আল-মানজানিকি। তিনি আল-নাসিরের (১১৮০-১২২৬ খ্রি.) রাজত্বের সময় আরব যুদ্ধবিদ্যা সম্বন্ধে একটি প্রামাণ্য এবং অসম্পূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। সেনাবাহিনীতে সাধারণ চিকিৎসক ও অস্ত্র চিকিৎসক থাকত এবং আহত সৈন্যদের সেবাশুশ্রূষার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে শিবির খোলা হত। উপরন্তু, গোয়েন্দারা শত্রু পক্ষের খবরাখবর সংগ্রহ করত। ইসলামের বিধান অনুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে লব্ধ মাল-ই-গনিমার হিসাব রাখার এবং সৈন্যদের মধ্যে তাদের অংশ বিতরণের জন্য একজন ‘কাজী’ নিযুক্ত হত। সেনাবাহিনীর অগ্রগতির মূলে ছিল উন্নত ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা। উট, ঘোড়া, খচ্চর, ষাঁড়, নৌকা প্রভৃতি সেনাবাহিনীর পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হত। বলা বাহুল্য যে, আব্বাসীয় খিলাফতের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল ছিল একটি বিশাল এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনীর উপর। আব্বাসীয় বাহিনীর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে একজন লেখক বলেন, “দশম শতাব্দীতে সারাসিনগণ দুটি কারণে মারাত্মক শত্রুতে (বায়জানটাইনদের নিকট) পরিণত হয়েছিল- (১) তাদের অগণিত সৈন্যসংখ্যা এবং (২) অসাধারণ ক্ষিপ্ৰতা।” 

উমাইয়া যুগের ন্যায় আব্বাসীয় খিলাফতের নৌ-বাহিনী খুবই শক্তিশালী ছিল। কৃষ্ণ সাগর, পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর ছাড়াও ভারত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরে আব্বাসীয় নৌ-বাহিনী মোতায়েন থাকত। নৌ-বাহিনীর সাফল্যের প্রমাণ পাওয়া যায় ক্রীট ও সিসিলি ছাড়া ভূমধ্যসাগরের কতিপয় দ্বীপাঞ্চল অধিকারে। 

দিওয়ান-আল-রাসায়েল : আব্বাসীয় যুগে প্রশাসনিক কাঠামোর অন্যতম স্তম্ভ ছিল ‘দিওয়ান-আল-রাসায়েল’ অর্থাৎ সরকারি পত্র বিনিময় বিভাগ। সাম্রাজ্যের বিশালতা ও শাসন-ব্যবস্থার বিকেন্দ্রিকরণের ফলে এই বিভাগের দায়িত্ব পূর্ববর্তী শাসনামল অপেক্ষা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ফরমান বা রাজকীয় আদেশ-নির্দেশ ‘হুকুমনামা’ উপাধিপত্র, চিঠিপত্র লিখন, সীলমোহরকৃত চিঠি বিতরণ, দলিল-দস্তাবেশ রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতির দায়িত্ব অর্পিত হয় এই বিভাগের উপর। খলিফা অথবা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনামা লিপিবদ্ধ করে যথাস্থানে পৌঁছানোর দায়িত্ব ছিল ‘দিওয়ান-আল-রাসায়েলের’ প্রধান কর্মকর্তার উপর। তিনি অবশ্যই খলিফার বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁকে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হত। এ কারণে প্রধান কর্মকর্তার বিচক্ষণতা, পারদর্শিতা ও উচ্চশিক্ষার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখেই তাঁকে নিয়োগ করা হত। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য চিঠিপত্র লিখা হত অতি সন্তর্পণে এবং এর জন্য ‘দিওয়ানের’ মধ্যে উপ-বিভাগ সৃষ্টি করা হয়, যা ‘দিওয়ান-আল- সির’ নামে পরিচিত ছিল। ফাতেমীয়দের মধ্যে মিসরে এবং ভারত উপমহাদেশে ‘দিওয়ান-আল-রাসায়েল’, ‘দিওয়ান-আল-ইনসা’ নামে পরিচিত ছিল। 

দিওয়ান-আল-বারিদ : উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রবর্তিত ‘দিওয়ান আল- বারিদ’ বা ডাক বিভাগ আব্বাসীয় আমলে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত এই বিভাগের প্রধান কর্তব্য ছিল প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দ্রুত রাজধানীতে সংবাদ প্রেরণ করা। খলিফা হারুন-আর-রশীদের শাসনামলে বাৰ্মেকী উপদেষ্টা ইয়াহিয়া ডাক বিভাগকে সম্প্রসারণ ও সুষ্ঠু বিন্যাস করেন। কেন্দ্রের সঙ্গে প্রদেশের যোগসূত্র স্থাপনের জন্য প্রতিটি প্রদেশে একটি করে ডাকঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রাদেশিক গভর্নর ডাক বিভাগের মাধ্যমে দ্রুত খলিফার নিকট গোপনীয় রিপোর্ট পাঠাতেন এবং অনুরূপভাবে কেন্দ্রীয় দফতরের নির্দেশনামা দ্রুত প্রদেশে পাঠান হত। ডাক বিভাগের প্রধান বাহন ছিল ঘোড়া ও উট। পারস্যে সাধারণত ঘোড়া এবং মরু- অঞ্চল আরব দেশে উটের সাহায্যে ডাক বিতরণ করা হত। প্রতিটি ডাক-গাড়ি এক সঙ্গে ৫০ হতে ১০০ জন লোককে বহন করতে পারত। রাজধানী হতে দূর-দূরাঞ্চলে ডাক বিতরণের জন্য ঘোড়ার রিলের ব্যবস্থা ছিল। আব্বাসীয় যুগে সমগ্র রাজ্যে সর্বমোট ৯৫০ রিলে কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। চিঠিপত্র আদান-প্রদানের সুবিধার্থে ঘোড়া-উটের ডাক বাহন দ্রুত যাতায়াতের জন্য রাস্তাঘাট নির্মিত হয়। এ আমলে বিভিন্ন রাজপথ নির্মিত হয়; যেমন- বাগদাদ থেকে খোরাসান হয়ে চীন পর্যন্ত বিখ্যাত খোরাসান রাজপথ। এ ছাড়া বাগদাদ হতে সিরাজ, বাগদাদ হতে সিরিয়া, বাগদাদ হতে মক্কা হয়ে ইয়েমেন পর্যন্ত রাজপথ নির্মিত হয়। এ সমস্ত রাজপথের রিলে স্টেশনে ডাক-চৌকি থাকত এবং এই চৌকিতে ঘোড়া-উট-খচ্চর মওজুদ থাকত। এ ছাড়া ডাক বিভাগের কর্মচারীগণ সদা প্রস্তুত থাকতেন। মাইল ফলক রাস্তার দূরত্ব নির্ধারণ করত। ডাক বিভাগের সুবিধার্থে প্রতি চৌকিতে রাস্তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল এবং সেখানে পথিক ও কর্মচারীবৃন্দ বিশ্রাম করতে পারতেন। সেখানে কূপ, সরাইখানা ও পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। আল-মাহদী এরূপ ব্যবস্থা করেন। 

আব্বাসীয় খিলাফতে চিঠিপত্র আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কবুতর ব্যবহৃত হত। তারা অত্যন্ত গোপনীয় ও জরুরী সংবাদ খলিফা বা উজিরের নিকট দ্রুত পৌঁছিয়ে দিত। কবুতরের মাধ্যমে বারকা ও মৌসল হতে কুফা, বসরা, বাগদাদ ও ওয়াসিতে খবর পৌঁছতে সময় লাগত ২৪ ঘণ্টা। ৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-মুতাসিমের রাজত্বকালে খোরাসানের বিদ্রোহী নেতা বাবেকের পরাজয় ও গৃহবন্দীর খবর কবুতরের মাধ্যমে রাজধানীতে পৌঁছান হয়। সংকেত প্রদানের অভিনব পন্থাও আব্বাসীয় আমলে উদ্ভাবিত হয়। তারা বায়জানটাইনদের নিকট থেকে অগ্নি সংকেতের মাধ্যমে খবর প্রেরণের পন্থা গ্রহণ করেন। বিশেষ করে আফ্রিকার উপকূল অঞ্চলে এ ব্যবস্থা বিশেষ কার্যকরী ছিল। সিউটা থেকে আলেকজান্দ্রিয়া অগ্নি সংকেতের মাধ্যমে সংবাদ প্রেরণে সময় লাগত একরাত। ডাক বিভাগ কেবল চিঠিপত্র আদান-প্রদানের ব্যবস্থা নহে, তারা মালামাল ও পাঠাত; যেমন- আব্বাসীয় খলিফা মিসরে গভর্নর আহম্মদ ইবন তুলনের নিকট একটি শাল প্রেরণ করেন। লেভী উল্লেখ করেন যে, ডাক বিভাগের মাধ্যমে মিসরের মামলুক সুলতানগণ দামেস্ক থেকে রাজধানী কায়রোতে বরফ সরবরাহ করতেন। ডাক বিভাগের মাধ্যমে জনসাধারণের চিঠিপত্রও অর্থের বিনিময়ে বিতরণের ব্যবস্থা ছিল। 

ডাক বিভাগের প্রধান কর্মকর্তাকে বলা হত ‘সাহিব আল-বারিদ’। এ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বশীল, বিশ্বস্ত ও কর্মঠ ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হত। তিনি সমগ্র রাজ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ডাক বিভাগের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। তাঁর অধীনে প্রাদেশিক ডাক বিভাগের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারী সরকারি কার্য নির্বাহ করতেন। ‘সাহিব আল-বারিদ’ উচ্চহারে বেতন পেতেন, যাতে তিনি নিষ্ঠা ও সততার সাথে কর্মসম্পাদন করতে পারেন। ডাক বিভাগের স্বাভাবিক কার্যক্রম ছাড়াও তিনি প্রদেশ বা দূর-দূরাঞ্চল হতে কেন্দ্রে গোপনীয় সংবাদাদি প্রেরণের ব্যবস্থা করতেন। এ কারণে তাঁর প্রকৃত উপাধি ছিল “সাহিব-আল-বারিদ-ওয়া আল-আখবার”। মূলত তিনি গোয়েন্দা বিভাগেরও প্রধান ছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই খলিফার প্রকৃত ও বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন। খলিফা হারুনের সময়ে গোয়েন্দা বিভাগের সম্প্রসারণ হয় এবং তিনি গোপন সূত্রে তার ভগ্নী আব্বাসার সঙ্গে বার্মেকী উজির জাফরের গুপ্ত প্রণয়ের সংবাদ পান। এই গোয়েন্দা বিভাগে কেবল পুরুষ কর্মরতই ছিল না, মহিলারাও নিয়োজিত ছিল। মামুনের সময়ে বাগদাদে কমপক্ষে ১৭০০ জন বয়স্ক ও বুদ্ধিমতী মহিলা গোয়েন্দা বিভাগের কর্মরত ছিলেন। 

দিওয়ান আল-খাতাম : উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রবর্তিত ‘দিওয়ান-আল- খাতাম’ আব্বাসীয় যুগেও বলবৎ ছিল। খলিফাদের সীলমোহরকৃত আদেশাবলী অথবা ফরমান সংরক্ষিত থাকত এ বিভাগে। রাজকীয় ফরমান যাতে জাল হতে না পারে সেজন্য খলিফার সীল দেওয়া হত এবং পরে সেগুলো যথাস্থানে পাঠান হতো। রাষ্ট্রীয় রেজিস্ট্রেশন বিভাগের অন্যতম দায়িত্ব ছিল মূল চিঠির অনুলিপি সংরক্ষণ করা। খলিফা আল-আমিনের শাসনামল পর্যন্ত ‘দিওয়ান-আল-খাতাম’ কার্যকরী ছিল এবং পরবর্তীকালে এই বিভাগের কার্যাবলি দিওয়ান-আল-তাওকী’ নামে অপর একটি দফতর পরিচালনা করে। 

দিওয়ান-আল-তাওকী : বিভিন্ন অভাব-অভিযোগ সম্বলিত জনগণের আবেদন পত্র খলিফার সুবিচারের জন্য পেশ করা হত এবং খলিফার এই সমস্ত আবেদন পত্রে সিদ্ধান্ত দিতেন। জনমঙ্গলকর এই দফতরের প্রধান কাজ ছিল দরখাস্ত-আবেদন পত্র গ্রহণ করা। যা ‘দিওয়ান-আল-তাওকী’ নামে পরিচিত ছিল। খলিফার নির্দেশ সংবলিত আবেদন পত্রটি কার্যকরী ব্যবস্থার জন্য এই বিভাগে প্রেরিত হত এবং অনুলিপি রেখে সীলমোহরকৃত মূলপত্রটি দরখাস্তকারীকে ফেরত দেওয়া হত। ৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মুতাজিদের রাজত্বে খারাজ পরিশোধের তারিখ দুমাস পিছাইবার অনুরোধ আসলে কৃষকদের সুবিধার্থে তাদের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। 

দিওয়ান-আল-গুরতা : পুলিশ বিভাগ ‘দিওয়ান-আল-শুরতা’ নামে পরিচিত ছিল এবং এই বিভাগের প্রধান ছিলেন ‘সাহিব-আল-শুরতা’। তিনি সাম্রাজ্যের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন এবং খলিফার দেহরক্ষী বাহিনীরও প্রধান ছিলেন। খলিফা আলী সর্বপ্রথম পুলিশ বিভাগ চালু করেন এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য উমাইয়া এবং আব্বাসীয় যুগে এই বিভাগ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অবশ্য সাম্রাজ্যের বিশালতার জন্য আব্বাসীয় খিলাফতে পুলিশ বিভাগের সম্প্রসারণ হয়; এই যুগে পুলিশ বাহিনীতে চারটি শাখা ছিল : (১) সাধারণ শান্তিরক্ষাকারী বাহিনী বা ‘শুরতা’, (২) সামরিক পুলিশ বা ‘মাউনা’, (৩) দেহরক্ষী বাহিনী বা ‘হারাস’, (৪) বিশেষ পুলিশ বাহিনী বা ‘আহদাস’। পুলিশ বিভাগের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ‘সাহিব-আল-শুরতা’ এবং তারাই তত্ত্বাবধানে পুলিশ প্রশাসন দায়িত্ব পালন করতেন। সাম্রাজ্যের রাজধানী বাগদাদ এবং প্রদেশে কোন প্রকার বিদ্রোহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হলে তা দমন করত ‘মাউনা’ বা সামরিক পুলিশ বাহিনী। তাবারিস্তান ও মিসরে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে এবাহিনী প্রেরিত হত। অপরাধীদের অনুসন্ধান করে গ্রেফতার করে আইনের শাসনে আনার দায়িত্ব ছিল ‘হারাস’ বা প্রহরী পুলিশ বাহিনীর। তাছাড়া রাজকীয় অনুষ্ঠানে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় এবং সীমান্তের ফাঁড়ি পাহারার কাজেও তাদের নিয়োজিত করা হত। খলিফার দেহরক্ষী বাহিনী হিসেবে ‘হারাসের’ বিশেষ ভূমিকা ছিল। বিশেষ পুলিশ বাহিনী ‘আহদাস’ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকত। রাজস্ব আদায়ে সহায়তা, হজ্ব মওসুমে মক্কার রাজপথে নিরাপত্তা বিধান, হজ্বযাত্রীদের নিকট হতে যাকাত আদায় প্রভৃতি কর্তব্য পালন করত ‘আহাদাস’। ‘সাহিব-আল-গুরতার’ পদমর্যাদা ছিল মন্ত্রীর সমতুল্য। 

দিওয়ান-আল-হিসবাহ : সাধারণ পুলিশ বিভাগের পাশাপাশি আর একটি বিশেষ আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকারী বা ‘দিওয়ান-আল-হিসবাহ’ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তৃতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল-মাহদী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই বিশেষ পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব ছিল ধর্ম ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করা। মরিস গডফ্রে ডিমমবিনিস বলেন, “সাধারণ অপরাধসমূহ প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার আওতাধীন থাকলেও অন্যান্য অপরাধসমূহ, বিশেষ করে ধর্মীয় বিধি (শরীয়ত) লংঘনকারীর কার্যকলাপ একজন বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের কর্তৃত্বাধীন ছিল, যার পদবী ছিল ‘মুহতাসিব’।” অষ্টম শতাব্দীতে সৃষ্ট এই ‘মুহতাসিবের’ পদটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘দিওয়ান-আল-হিসবাহ’-এর প্রধান কর্মকর্তা মুহতাসিব খলিফা বা উজির কর্তৃক সরাসরি নিযুক্ত হতেন। সৎ, ধার্মিক ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে ‘মুহতাসিব’ নিযুক্ত করা হত এবং তাঁকে ‘সাহিব-আর-শুরতা’র ন্যায় পর্যাপ্ত বেতন দেওয়া হত। ‘মুহতাসিবে’র কর্মপ্রণালীকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : (১) ধর্মীয়, (২) নৈতিক, (৩) জনকল্যাণকর। কুরআনে বর্ণিত আছে, “আল-আমল-বিল- মা’-রুফ-ওয়া-নাহিয়ান আল-মুনকার” অর্থাৎ “ভাল ও সৎ কাজ কর এবং পাপ কাজ থেকে দূরে থাক।” কুরআনের এই আদর্শের প্রকৃত বাস্তবায়নে ‘মুহতাসিব’ শরীয়ত পরিপন্থী কার্যকলাপ প্রতিহত ও নির্মূল করার চেষ্টা করেন। ধর্মীয় কার্যকলাপের উপর তাঁকে দৃষ্টি রাখতে হত; যেমন- রমজান মাসে রোজা পালন, পবিত্র মাসে প্রকাশ্য দিবালোকে পানাহার না করা, শুক্রবারে জামাতে নামাজ আদায়, সরকারি খরচে মসজিদ নির্মাণের তদারক, অথবা খুতবায় ইমাম কর্তৃক অধিক সময় ব্যয়, মুসলমান কর্তৃক অমুসলমানদের বেইজ্জতি না করা, নির্বিঘ্নে অমুসলমানদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পালন, ইসলাম প্রচার ও শরীয়তের প্রকৃত ব্যাখ্যা প্রদান ইত্যাদি। 

‘মুহতাসিব’কে Censor of Public Moral অর্থাৎ জনগণের নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের পর্যবেক্ষক বলা হয়। ‘মুহতাসিবে’র কার্যকলাপের সঙ্গে রোমীয় Curule Aedile বা বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মচারী Agnarome-এর সাথে তুলনা করা যায়। সম্ভবত আল-মাহদী বায়জানটাইন প্রভাবে সর্বপ্রথম এই পদের সৃষ্টি করেন। হিট্টি তাঁকে মিউনিসিপ্যাল বাজারের তদারককারী (Overseer) বলেছেন। এই পর্যায়ে তাঁর প্রধান কর্তব্য ছিল হাটবাজার পর্যবেক্ষণ করা, সরবরাহকৃত খাদ্যদ্রব্যের মান যাচাই ও ওজন নিরীক্ষা করা। প্রকাশ্যে মদ্যপান, জুয়াখেলা, নারী-পুরুষের অবৈধ মেলামেশা, অশালীন পোশাক পরিধান প্রভৃতি শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ তিনি বন্ধ এবং অপরাধীদের বেত্রাঘাত ও জরিমানা করতে পারতেন। দাস-দাসী, চাকর-চাকরানী ও গৃহপালিত পশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিও তাঁর সজাগ দৃষ্টি থাকত। এমনকি শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের মাত্রাধিক শাস্তি দিলে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন। হিট্টি বলেন যে, যদি কোন পুরুষ দাড়িতে মেহদী লাগিয়ে নারীর মন জয় করার চেষ্টা করে তা হলে মুহতাসিব তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতেন। মরিস বলেন যে, “পতিতাবৃত্তি নিরসনে তাঁর বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। এই পতিতাবৃত্তি পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অস্বাভাবিক যৌনাচারের জন্য কঠোর শাস্তি দেওয়া হত।” 

জনমঙ্গলকর কাজেও ‘মুহতাসিব’ নিজেকে ব্যাপৃত করেন; যেমন- শহরের পানীয় জলের অভাব দূরীকরণ, ধ্বংসোন্মুখ পুরাতন গৃহাদি জনগণের জীবনের প্রতি হুমকি হলে তা ভেঙ্গে মেরামত করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে নাগরিকদের মুক্ত করা, রাস্তায় দ্রব্যসামগ্রী স্তূপীকৃত হলে তা অন্যত্র সরানোর ব্যবস্থা করা, সঙ্কীর্ণ রাস্তা সম্প্রসারণ করে যাতায়াতের সুব্যবস্থা করা, রাস্তা দিয়ে দুর্গন্ধময় জিনিসপত্র বহনে নিষেধাজ্ঞা, রাস্তা-ঘাট, পয়ঃপ্রণালী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা, খেলার মাঠ, দালান-কোঠা, পার্ক, হাট- বাজার, শৌচাগার, রাস্তা-ঘাট রক্ষণাবেক্ষণ পৌরসভার কর্মকর্তাদের বিশেষ দায়িত্ব ছিল। ঘরবাড়ি এমনকি মসজিদ রাস্তার অংশে নির্মিত হলে তা ভেঙ্গে দেওয়ার ক্ষমতা ‘মুহতাসিবের’ ছিল। তিনি লক্ষ্য রাখতেন যেন কোন ইহুদী বা খ্রিস্টান পরিবার তাদের বাড়ির ছাদ উঁচু করে নির্মাণের ফলে পার্শ্ববর্তী মুসলমান প্রতিবেশীর আব্রু নষ্ট না করে। একাদশ শতাব্দীতে ‘মুহতাসিব’ বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকতায় পরিণত হন। মূলত তিনি ‘হিসবা’ (Hisba) বা জনগণের নৈতিক ও শালীনতা বিরোধী কার্যকলাপের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনকারী ছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ‘কাজী’ বা ‘সাহিব-আল-শুরতা’ বা পুলিশ কর্মকর্তার কোন সাদৃশ্য ছিল না। কারণ তিনি অভিযোগ আদালতে পেশ করতে বা বিচারের জন্য ‘কাজীর’ দরবারে অভিযুক্ত বা অপরাধীকে প্রেরণ করতে পারতেন না। তাঁর কাজ ছিল তাৎক্ষণিক ও প্রতিরোধমূলক (Preventive); অবশ্য তিনি বেত্রাঘাত, সামান্য ক্ষতিপূরণ দাবি, অর্থদণ্ড দিতে পারতেন। ‘মুহতাসিব’ দুই প্রকারের ছিল : (১) বেতনভুক, (২) স্বেচ্ছাসেবী। রাষ্ট্রীয় বেতনভুক কর্মচারী কেন্দ্রীয় প্রশাসনের একটি অঙ্গ ছিলেন এবং স্বেচ্ছাসেবী অবৈতনিকভাবে রাজ্যের অনৈসলামিক কার্যকলাপ সম্বন্ধে প্রশাসনকে গোচরীভূত করতে পারতেন। 

দিওয়ান-আল-কাযা : বিচার বিভাগকে ‘দিওয়ান-আল-কাযা’ বলা হত এবং খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ছিলেন ‘কাযী-উল-কুযাত’। কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী বাগদাদে ‘কাযী-উল-কুযাত’ এবং প্রদেশসমূহে কাযী বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। উল্লেখ্য যে, খলিফাই ছিলেন সর্বোচ্চ প্রধান বিচারপতি এবং ‘কাযী-উল-কুযাত’ তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে ন্যায়বিচার করতেন। ইসলামে ন্যায়বিচারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এ কারণে বিচার বিভাগের দায়িত্ব অর্পিত হয় ধর্মবেত্তাদের উপর। আল- মাহদী, হাদী এবং হারুনের রাজত্বে প্রখ্যাত ধর্মবেত্তা হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফার শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ ‘কাযী-উল-কুযাতের’ পদ অলঙ্কৃত করেন। একজন বযঙ্ক, সৎ, দায়িত্বশীল, মুক্ত, শারীরিক ও মানসিক দিক হতে সুস্থ মুসলমানকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করা হত। তাঁদের অবশ্যই ফিকাহ-এর উপর সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হত, যাতে তাঁরা ন্যায়বিচার করতে পারেন। তিনি বিচার ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও পালন করতেন। খলিফার অনুপস্থিতিতে তিনি জুমার নামাজে খুৎবা পাঠ এবং ইমামতী করতেন। বিচার সংক্রান্ত পরামর্শ এবং ‘কাযী’ নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর মতামত দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। চতুর্থ হিজরী হতে তিনি প্রদেশের ‘কাযী’ নিযুক্ত করতে পারতেন। ‘কাযী’ বা বিচার ব্যবস্থায় সম্ভবত সাসানীয় শাসনামলের প্রভাব দেখা যায়। ধর্ম ও বিচার ব্যবস্থায় উভয়েরই বিশেষ ভূমিকা ছিল। আল-মাওয়ার্দী দুই ধরনের বিচারকের উল্লেখ করেন : (১) অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন বিচারক বা ‘আম্মামুতলাকা’ এবং (২) সসীম ক্ষমতাসম্পন্ন বিচারক বা ‘খাসা’। প্রথম স্তরের ‘কাযীর’ প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল মামলার নিষ্পত্তি করা, অনাথ, এতিম, মস্তিষ্ক বিকৃত এবং নাবালকদের তরফ হতে সুবিচার করা, ধর্মীয় বা ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণ বা পরিচালনা, শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপের জন্য শাস্তি প্রদান, উপ-বিচারক বা নায়েব নিয়োগ করা। কাযী-উল-কুযাতের পদমর্যাদা ছিল খলিফার পরেই এবং তাঁরা সম্মানজনক মাসোহারা পেতেন। খলিফা আল-মামুনের রাজত্বে মিসরের বিচারপতি মাসিক ৪,০০০ দিরহাম বেতন পেতেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর বিচারকগণ ‘কাযী-উল- কুযাত’ কর্তৃক নিযুক্ত হতেন এবং তাঁরা প্রদেশে প্রধান বিচারপতির তত্ত্বাবধানে বিচারকার্য সমাধান করতেন। 

অন্যান্য দফতরসমূহ : ন্যায়বিচার করা ও অরাজকতা দূরকরণের উদ্দেশ্য ‘দিওয়ান-আর-নজর-ফিল মাজালিম’ অর্থাৎ দুঃস্থ ও নিপীড়িত মজলুমদের উপর নজর রাখবার জন্য এই বিভাগ গঠিত হয়। দুর্নীতি, তহবিল তসরূফ, অসদাচরণ, অন্যায়ভাবে জনগণের মাল দখল প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই বিভাগ যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারত। অন্যায় ও পক্ষপাতিত্বমূলক রায়ের বিরুদ্ধে আপীল এবং বিভাগে করা হত। আল-মাওয়ার্দীর মতে, উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক সর্বপ্রথম এই সর্বোচ্চ আপীল আদালত প্রতিষ্ঠা করেন এবং রায়ের বিরুদ্ধে জনগণের অভিযোগ শ্রবণের জন্য খলিফা একটি বিশেষ দিন ধার্য করতেন। খলিফা উজির বা প্রধান বিচারপতি ‘মাযালিম’ বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করতেন। উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ওমর এই বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতা করেন, যাতে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি সাজা না পায়। আব্বাসীয় খিলাফতে আল-মাহদী এই বিভাগ সর্বপ্রথম চালু করেন। তাঁর উত্তরাধিকারিগণ আল-হাদী, হারুন এবং মামুন জনগণের অভিযোগ শ্রবণের জন্য দিন নির্ধারিত করেন। ‘আল-মুকতাদিরের’ (৯০৮- ৩২ খ্রি.) শাসনামল পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বলবৎ ছিল এবং রাজমাতার পোশাক-পরিচ্ছদের তত্ত্বাবধায়িকা ছুমালকে ‘মাযালিম’ বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। আব্বাসীয় খিলাফতের অনুসরণে ‘দিওয়ান-আল-মাযালিম’ বিভাগ ফাতেমী খিলাফত, স্পেনের উমাইয়া শাসন এবং ভারত উপ-মহাদেশের সুলতানী আমলে প্রবর্তিত হয়। এই আপীল ব্যবস্থার কার্যকারিতা ছিল সুদূরপ্রসারী, কারণ মুসলিম শাসনের রীতির অনুকরণে সিসিলির রাজা দ্বিতীয় রজার (১১৩০-৫৪ খ্রি.) ‘মাযালিম’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে সিসিলি থেকে ইউরোপে এই ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়। 

‘দিওয়ান-আল-সাওয়াফী’ বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ ‘মাল-ই-গণিমত’- এর বা যুদ্ধলব্ধ পরিত্যক্ত ভূসম্পত্তি, যুদ্ধে নিহতদের জমি-জমা, দেবালয়ে উৎসর্গীকৃত ভূমি প্রভৃতি রাষ্ট্রীয়করণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করত। এই সমস্ত ভূসম্পত্তি হতে অর্জিত রাজস্বের হিসাব রক্ষাও এই বিভাগরে দায়িত্ব ছিল। খলিফার ব্যক্তিগত ধন-সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য ‘দিওয়ান-আল-দিয়া’ প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে রাজ্যের সর্বত্র খলিফার ব্যক্তিগত ভূ-সম্পত্তি এই বিভাগ তদারক করত। ‘দিওয়ান আল-জিমাম’ কেন্দ্র ও প্রদেশসমূহের আয়-ব্যয়ের হিসাব পরিচালনা করত। আল-মাহদী এই বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং যাবতীয় হিসাবপত্র রক্ষার ব্যবস্থা করেন। রাজপ্রাসাদের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, রেশন, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ, আস্তাবলের ঘোড়া ও অন্যান্য প্রাণীর হিসাব রাখার দায়িত্ব ছিল ‘দিওয়ান-আল-নাফকাতের’ উপর। এ ছাড়া অপরাপর সে সমস্ত বিভাগ কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আওতায় ছিল সেগুলো ‘দিওয়ান-আল-আতা’ অর্থাৎ দান-খয়রাত বিষয়ক বিভাগ, ‘দিওয়ান-আল-সির’ অর্থাৎ গোয়েন্দা বিভাগ এবং ‘দিওয়ান- আল-আকরিহা’ অর্থাৎ কৃষিকার্য সম্পর্কিত বিভাগ। 

প্রাদেশিক শাসন-ব্যবস্থা 

পারস্য–বায়জানটাইন নীতির অনুসরণে উমাইয়া রাজত্বে সমগ্র দেশে সুষ্ঠু শাসন- ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য যে প্রদেশের সৃষ্টি হয়েছিল আব্বাসীয় আমলে তার কোন পরিবর্তন সাধিত হয় নি। ইসতাখরি, হওকাল এবং ইবন আল-ফাকিরের বর্ণনা হতে জানা যায় যে, আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথম যুগে সমগ্র সাম্রাজ্য ২৪টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। মতান্তরে ৩৫টি প্রদেশ ছিল। এইগুলো হচ্ছে- (১) পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল ও সিসিলি, (২) মিসর, (৩) সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন, (৪) আল-হেজাজ এবং ইয়ামামা অর্থাৎ মধ্য-আরব-ভূমি, (৫) আল-ইয়েমেন অথবা দক্ষিণ আরবভূমি, (৬) আল- বাহরাইন এবং ওমান, (৭) আল-সাওয়াদ অথবা ইরাক, (৮) আল-জাজিরা : রাজধানী মসূল, (৯) আজারবাইজান, (১০) আল-জাবল অথবা পারস্য-ইরাক, (১১) খুজিস্তান, (১২) ফারস্ (১৩) কারমান, (১৪) মাকরান, (১৫) সিজিস্তান, (১৬) কুহীস্তান, (১৭) কুমিস, (১৮) তাবারিস্তান, (১৯) জুরজান, (২০) আরমেনিয়া, (২১) খোরাসান, (২২) খাওয়ারিজম, (২৩) আল-শুগদ্ ও (২৪) ফারগানা। 

প্রদেশের প্রধান শাসনকর্তা ছিলেন আমীর। খলিফা তাঁকে নিযুক্ত করতেন। কৃতকর্মের জন্য আমীর খলিফার নিকট দায়ী থাকতেন। শাসন-ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্য এক প্রদেশ হতে অন্য প্রদেশে আমীরদের বদলী করা হত। ধর্মীয় কার্যকলাপ পরিচালনা এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা আমীরের প্রধান কর্তব্য ছিল। আয়-ব্যয়ের তদারক ও হিসাব রক্ষার দায়িত্বও তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল। প্রত্যেক প্রদেশে শাসন-ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ৫টি বিভাগ ছিল : (১) দিওয়ান-আল-খারাজ, (২) দিওয়ান আল- রাসায়েল, (৩) দিওয়ান-আল-জিমাম, (৪) দিওয়ান-আল-বারিদ, (৫) দিওয়ান-আল- দিয়া। এ ছাড়া বিচারকার্যের জন্য কাযী নিযুক্ত করা হত। 

(খ) সামাজিক অবস্থা 

গোত্রভিত্তিক প্রাচীন আরব সমাজের কাঠামো আব্বাসীয় খিলাফতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। কৌলীন্য-আভিজাত্যের দম্ভ উমাইয়া যুগে প্রকট আকারে দেখা দেয়। কিন্তু আব্বাসীয়দের আমলে এর অবসান ঘটে। আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে আস-সাফফাহ্, আল-মাহদী এবং আল-আমীন ব্যতীত কেহই আরব রক্তের কৌলীন্যের দাবি করতে পারেন নি। অপরাপর খলিফাগণ অনারব মাতৃগর্ভজাত ছিলেন। আল-মনসুরের মাতা ছিলেন বার্বার, আল-মামুনের মাতা পারস্য দেশীয়, আল-ওয়াসিক ও আল-মুহতাদীরের মাতা ছিলেন গ্রীক। কেবলমাত্র খলিফাগণই নহেন, আরব মুসলিমগণ বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে স্বীয় স্বাতন্ত্র্য ও বংশকৌলীন্য হারিয়ে ফেলেন। এর ফলে মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়। 

আব্বাসীয় যুগে নারীগণ পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা ভোগ করতেন। আব্বাসীয় যুগে বিদুষী নারী রাজকার্যেও প্রভাব বিস্তার করতেন। খলিফা মাহদীর মহিষী খাইজুরান, মাহদীর কন্যা উলাইয়া, হারুন-আর-রশীদের স্ত্রী জুবাইদা রাজকার্য এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। উলাইয়া একটি অভিনব শিরাবরণ প্রবর্তন করেন। 

৬২৮ 

আব্বাসীয় সাম্রাজ্য [৭৫০-১২৫৮ খ্রি.] 

মামুনের স্ত্রী বুরানও বিদূষী মহিলা ছিলেন। আব্বাসীয় দরবারে সঙ্গীত ও কবিতার কদর ছিল এবং উবাইদা আল-তুনবুরিয়া মুতাসিমের খিলাফতে সৌন্দর্য ও সঙ্গীতচর্চার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। উপপত্নী প্রথা আব্বাসীয় সমাজকে কলুষিত করে ফেলে এবং ফলে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। দাসপ্রথা প্রচলিত থাকলেও তাদের প্রতি সদয় ও উদার মনোভাব প্রকাশ করা হত। 

আব্বাসীয় যুগে পুরুষদের পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল সাধারণত জামা, ফতুয়া, জ্যাকেট, কাল টুপী, পাজামা এবং আলখাল্লা ধরনের বহিরাবরণ। বিচারপতি আবু ইউসুফের নির্দেশক্রমে হারুন-আল-রশীদের আমলের ধর্মবেত্তাগণ কালরংয়ের পাগড়ি এবং ঢিলা জামা পরিধান করতেন। আল-নুয়াইরী আব্বাসীয় আমলের সুন্দরী মহিলাদের বর্ণনা দিয়েছেন। মাহদীর কন্যা আল-উলাইয়া মহিলাদের জন্য একটি রত্নখচিত মুখাবরণ ও শিরাবরণের উদ্ভাবন করেন। এটি তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে সমাদৃত হয়। মামুনের সঙ্গে বুরানের বিবাহ উৎসবে যে জাঁকজমক হয়েছিল তা তাবারী লিপিবদ্ধ করেন। আমোদ-প্রমোদ, বিলাস-ব্যাসনে আব্বাসীয়গণ প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। আরব্য উপন্যাস খ্যাত বাগদাদ নগরী তৎকালীন বিশ্বে ছিল অতুলনীয় এবং হারুন-আর-রশীদের সময় বাগদাদের খ্যাতি চরম শিখরে উপনীত হয়। হারুন-আর-রশীদের স্ত্রী জুবাইদা স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত তৈজসপত্রে আহার করতেন এবং রত্নখচিত জুতা ব্যবহার করে একটি অভিনব সৌখিন দ্রব্যের প্রচলন করেন। আব্বাসীয় খলিফাগণ উপহার দিতে কুণ্ঠিত হতেন না। ইব্রাহিম ইবন-আল-মাহদীর সঙ্গীতে বিমোহিত হয়ে খলিফা আল-আমীন তাঁকে ৩,০০,০০০ দিনার উপহার দেন। তিনি জন্তুর আকৃতিতে পাঁচটি বজরা নির্মাণ করেন এবং এগুলোর এক একটি তৈরি করতে খরচ পড়ে ৩০,০০,০০০ দিরহাম। 

আব্বাসীয় খিলাফতে উমাইয়া যুগের মত মদ্যপান অব্যাহত ছিল। প্রকাশ্যে অথবা হেরেমে খলিফাগণ যে মদ্যপান করতেন তা ‘খামীর’ অর্থাৎ খেজুরের রস হতে প্রস্তুত। অবশ্য ইবন-খালদূন বলেন যে, হারুন ও মামুন আঙ্গুর হতে প্রস্তুত ‘নাবিদ’ পান করতেন। মদ্যপানের সময় নৃত্য পরিবেশন করত দরবারের নর্তকিগণ। ‘কিতাব আল- আঘানী’তে বর্ণিত আছে যে, খলিফা আল-আমীনের দরবারে সমস্ত রাত্রিব্যাপী একটি ব্যালে নৃত্য পরিবেশিত হয় এবং খলিফা স্বয়ং এই নৃত্য পরিচালনা করতেন। আল- আমীন মহিলা পরিচারিকাবৃন্দ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। আল-মামুনের দরবারেও গ্রীক নর্তকিগণ নৃত্য পরিবেশন করতেন। বিলাস-বাসন আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ এবং উপপত্নী প্রথা আব্বাসীয়দের নৈতিক চরিত্রকে কলুষিত করে। আব্বাসীয়দের দরবারে গ্রীক, বার্বার, আর্মেনীয়, স্লাভ, নিগ্রো, তুর্কী দাস ছিল। এরা নপুংসক ছিল এবং তাদের গিলমান বলা হত। দরবারে দাসিগণ ছিল নর্তকী, গায়িকা অথবা উপপত্নী। হারুনের দরবারে তাওয়াদুদ নামে একজন বিদূষী দাসী বাস করতেন। তাঁকে ১,০০,০০০ দিনারে ক্রয় করা হয় এবং তিনি আইনশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, দর্শন, সংগীত, অঙ্ক, চিকিৎসাশাস্ত্র, ইতিহাস, কাব্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ক্রমশ আব্বাসীয়দের দাস ও উপপত্নীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আল-মুকতাদিরের (৯০৭-৩২ খ্রি.) রাজদরবারে ১১,০০০ গ্রীক ও সুদানী দাস ছিল। আল-মুতাওয়াক্কিলের ৪,০০০ উপপত্নী ছিল। 

মধ্য-ইউরোপে স্নানকে যখন ঘৃণা করা হত তখন ইসলাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে ধর্মের অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করে এবং এর ফলে সমগ্র আরব দেশে সাধারণের ব্যবহারযোগ্য স্নানাগার নির্মিত হয়। কেবলমাত্র পুরুষদের জন্যই নহে, মহিলাদের জন্যও বিশেষ স্নানাগারের ব্যবস্থা ছিল। আল-খাতিবের বর্ণনা অনুযায়ী আল- মুকতাদিরের রাজত্বে বাগদাদে ২৭,০০০ স্নানাগার ছিল। খলিফাদের বিনোদনের বিভিন্ন ব্যবস্থা ছিল; যেমন— কুস্তি, হকি, পোলো, ঘোড়দৌড়, অসি চালনা, দাবা খেলা ইত্যাদি। আরব দেশে পারস্যদেশের রাজপক্ষী দ্বারা শিকার প্রচলিত হয়। 

(গ) অর্থনৈতিক অবস্থা 

আব্বাসীয় খিলাফতে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা সন্তোষজনক ছিল। ব্যবসা- বাণিজ্য ও কৃষি-কার্যের প্রভূত উন্নতির ফলে আব্বাসীয়গণ সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষের চরম শিখরে উপনীত হয়। এ সময় মুসলিম সাম্রাজ্য আটলান্টিক মহাসাগর হতে সুদূর সিন্ধু এবং কাস্পিয়ান সাগর থেকে নীলনদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিপুল ঐশ্বর্য ও ভৈবব সংগৃহীত হয়ে বাগদাদ একটি সমৃদ্ধশালী ও অনিন্দ্যসুন্দর রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়। খলিফা আল-মনসুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাগদাদ নগরী ‘মদিনা আল-সালাম’ অর্থাৎ শান্তির নগরীরূপেই পরিচিত ছিল। টাইগ্রীস নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত প্রাচ্যের এই সুরম্য নগরী অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল এবং এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ‘কুব্বাত আল-খাদরা’ অর্থাৎ সবুজ গম্বুজবিশিষ্ট একটি অতুলনীয় কারুকার্য খচিত প্রাসাদ ও তৎসংলগ্ন একটি মসজিদ নির্মিত হয়। ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বাগদাদ অতি অল্প সময়ের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বাগদাদের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। খলিফা হারুন-আর-রশীদের সময় ঐশ্বর্য ও বৈভবের দিক হতে বাগদাদ শহর ছিল আরব্য উপন্যাসের প্রসিদ্ধ নগরী। হিট্টির মতে, “হারুন-আর-রশীদের খিলাফতে বাগদাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে সমুজ্জ্বল করবার জন্য ইতিহাস ও রূপকথার সমন্বয় ঘটে।” 

আব্বাসীয় খিলাফতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় এবং আরব ব্যবসায়ী ছাড়াও খ্রিস্টান-ইহুদী এবং জরথুস্ত্রগণ ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল। ইসলামের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি বৃদ্ধি পায় এবং বাগদাদসহ বসরা, সিরিয়া, কায়রো এবং আলেকজান্দ্রিয়া সামুদ্রিক বাণিজ্য-বন্দরে পরিণত হয়। পূর্বদিকে মুসলিম বণিকগণ ভারতবর্ষ ও চীনে দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে সমুদ্রাভিযান করে এবং এ ব্যাপারে সুলায়মান আল-তাজিরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্থলপথেও চীনের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত থাকে এবং সর্বপ্রথম মুসলমানগণ সিল্ক আমদানি করে। সম্ভবত এর ফলেই সিল্ক কাপড়ের উদ্ভব হয়। চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং হারুনের খিলাফতে চীনা বাণিজিক জাহাজ টাইগ্রীস নদীতে নোঙ্গর করা অবস্থায় দেখা যেত। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য ফার্ডিনান্ড দি লেসেন্সের এক হাজার বছর পূর্বে হারুন সুয়েজখাল খননের পরিকল্পনা করেন। মুসলিম বণিকগণ খেজুর, চিনি, তুলা, কাচের এবং স্টীলের তৈজসপত্র বিদেশে নিয়ে যেত এবং দূরপ্রাচ্য থেকে মসলা, সিল্ক, কর্পূর এবং আফ্রিকা হতে হাতির দাঁত এবং নিগ্রো দাস আমদানি করত। আব্বাসীয় আমলে বিশেষ করে আল-মুকতাদিরের রাজত্বে বাগদাদের একজন ব্যবসায়ীর সম্পত্তির মূল্য ছিল ১,৬০,০০০,০০০ দিনার। 

আব্বাসীয় আমলে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির মূলে ছিল শিল্প ও কৃষিকার্যের সম্প্রসারণ। পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে কম্বল, সিল্ক ও পশমী কাপড়, সার্টিন, ব্রোকেড, আবসাবপত্র ও তৈজসপত্র উৎপাদিত হত। ইরাকের কার্পেট, বাগদাদের ডোরা-কাটা কাপড় (আতাবী), যা পরবর্তীকালে ফ্রান্সে ‘তাবী’ নামে প্রচলিত হয়, কুফার সিল্ক ও সুতির রুমাল, ফারসের কিনখাব ও ব্রোকেডের পোশাক তিরাজ প্রভৃতি খুবই বিখ্যাত ছিল। ‘দিময়াতি’, ‘তিনিসি’ নামক মিসরীয় কাপড় পৃথিবী বিখ্যাত ছিল। সিডন, টাইর এবং অন্যান্য সিরীয় শহরে মৃৎপাত্র উৎপাদিত হত এবং এনামেলের মৃৎপাত্র ক্রসেডারগণ পরবর্তীকালে ইউরোপে প্রচলন করেন। 

মুসলিম সভ্যতার অন্যতম অবদান হচ্ছে কাগজের প্রচলন। আব্বাসীয় আমলের গোড়ার দিকে চীনাদের দ্বারা পরিচালিত সমরকন্দে একটি কাগজের কল ছিল। ৭৯৪- ৯৫ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে প্রথম কাগজের কল স্থাপিত হয় এবং সরকারি দলিল-দস্তাবেজে কাগজের প্রচলন হয়। পরবর্তীকালে ইরাক, ইরান, মিসর এবং স্পেনে কাগজের কল স্থাপিত হয়। অর্থনৈতিক অবস্থার উল্লেখ করে ফিশার বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের পণ্যদ্রব্যসমূহের মান ছিল অত্যন্ত উন্নত এবং তা এত মূল্যবান ছিল যে, ইউরোপের দেশসমূহও তাদের বিনিময়ে তেমন উন্নতমানের পণ্যদ্রব্য দিতে অক্ষম ছিল।” 

আব্বাসীয় যুগে কৃষিকার্যের উন্নতি সাধিত হয়। ইরাকের ভূখণ্ড ছিল খুবই উর্বর এবং এটি ‘আল-সাওয়াদ’ নামে পরিচিত ছিল। টাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় উর্বর মেসোপটেমিয়া কৃষিকার্যের জন্য খুবই উপযোগী ছিল। মনসুর ‘নহর ঈশা’, ‘নহর সারগার’ ও ‘নহর আল-মালিক’ নামে তিনটি প্রধান পানিসেচের খাল কাটেন এবং এর ফলে কৃষিকার্যের প্রভূত উন্নতি হয়। জমি জরিপ, খাল খনন ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ফলে উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। উৎপাদিত দ্রব্যের মধ্যে ছিল বার্লি, গম, চাল, খেজুর, তুলা, নানা ধরনের ফল-মূল ইত্যাদি। হিট্টির মতে, বাংলাদেশে উৎপাদিত ইক্ষু পরবর্তীকালে ফাস ও আহওয়াজে প্রচলিত হয় এবং এর ফলে চিনির ব্যবহার ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। 

(ঘ) শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা 

আব্বাসীয় যুগে মুসলমানদের কৃষ্টি, সভ্যতা ও জ্ঞানানুশীলন বিশ্ব-সভ্যতার শীর্ষদেশের উন্নীত হয়েছিল। নিঃসন্দেহে আব্বাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমানদের শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও শিক্ষা-দীক্ষার প্রসারতা ও উৎকর্ষতা চরম শিখরে উপনীত হয়। এই কারণেই এই যুগকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্নযুগ বলা হয়। উমাইয়া যুগকে সম্প্রসারণের যুগ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আব্বাসীয়গণ যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সম্প্রসারণ নীতির স্থলে জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান আহরণের নীতি অনুসরণ করেন। প্রাচীন সভ্যতার বিলুপ্ত উপকরণ সংরক্ষণে তারা প্রয়াসী ছিলেন। ইরাক, মিসর, পারস্য ও গ্রীসের প্রাচীন সাহিত্য, সভ্যতা ও কৃষ্টিকে তাঁরা কেবল রক্ষাই করেন নি বরং এর পুনর্জাগরণে তারা ব্রতী হন। আব্বাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভূগোল, ইতিহাস, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব, স্থাপত্য, চারুশিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানগণ গবেষণা পরিচালিত করেন এবং বিশ্ব সভ্যতার অনবদ্য অবদান রাখতে সক্ষম হন। 

ভূগোল : কিবলা নির্ধারণ, পবিত্র হজ্ব পালন প্রভৃতি ধর্মীয় কারণে মুসলমানগণ ভূগোলশাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণার জন্য সকল স্থানের অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমা নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা এর সাথে যুক্ত হয়েছিল। সপ্তম হতে নবম শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে মুসলিম বণিকগণ পূর্বদিকে জল ও স্থলপথে চীন, দক্ষিণে জাঞ্জিবার ও আফ্রিকার উপকূল, উত্তরে রাশিয়া এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত বাণিজ্য যাত্রা করে। এই সমস্ত অঞ্চল হতে প্রত্যাগত বণিকদের বর্ণনায় উৎসাহিত হয়ে তারা দূর-দূরাঞ্চলে বাণিজ্য যাত্রা করে। সিরাফ নগরীর বিখ্যাত বণিক সুলায়মান আত-তাজির দূর-প্রাচ্যের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেন। এছাড়া সিন্দাবাদ ও আহমদ- বিন-ফজলান-বিন-হাম্মাদের নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

হজ্বযাত্রা, নৌ-বাণিজ্য ও বিভিন্ন কারণে সমুদ্র পাড়ি দিবার প্রয়োজনেই মুসলমানগণ ভূগোল চর্চায় আত্মনিয়োগ করে। তারা সর্বপ্রথম দিগ-দর্শন ও দূরবীন যন্ত্রের আবিষ্কার করে কৃতিত্ব অর্জন করে। দশম শতকের শেষার্ধে গ্রীক মনীষী টলেমীর ভূগোল সম্বন্ধে লিখিত এক প্রামাণ্য ভূগোল গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনূদিত হয়। এদের মধ্যে ইয়াকুত- ইবন-ইসহাক, আল-কিন্দি এবং সাবিত-ইবন-কোরাহর অনুবাদই বিশেষভাবে নির্ভরযোগ্য। এ সমস্ত গ্রন্থের সাহায্যে খলিফা আল-মামুনের রাজত্বে আল-খাওয়ারিজমী ‘যুবদাত আল-আরদ’ নামে পৃথিবীর একটি মানচিত্র প্রণয়ন করেন। পৃথিবীর এই মানচিত্র ৬৯ জন পণ্ডিতের সহযোগিতায় প্রণীত হয়। ইসলামের সর্বপ্রথম এই মানচিত্র চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম ভৌগোলিকগণ ব্যবহার করেন। ইউরোপীয় ভৌগোলিকগণ যখন পৃথিবী চেপ্টা বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তখন মুসলমান ভৌগোলিকগণ পৃথিবীর গোলত্ব প্রমাণ করেন। 

মুসলিম ভৌগোলিকগণ ভূপর্যটক ছিলেন। তাঁরা দীর্ঘকাল দেশ-বিদেশে, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, হ্রদ, উপত্যকাগুলো পর্যবেক্ষণ করে বৃত্তান্ত লিখেছেন। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে লিখিত ভূগোল বৃত্তান্ত প্রমাণ্য গ্রন্থরূপে সমাদৃত হয়। আরবদের প্রথম ভূগোল গ্রন্থাবলি ছিল সাধারণত পথ-বৃত্তান্ত। পারস্যের খুরদাদবিহ্ ছিলেন সর্বপ্রথম ভূগোল বিবরণবেত্তা এবং ৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘আল-মাসালিক ওয়াল-মামালিক’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে ইবন-উল-ফাকীহ, ইবন হাওকাল, আল-মাকদিসী এই গ্রন্থ ব্যবহার করেন। ৮৯১ খ্রিস্টাব্দে আল-ইয়াকুবী ‘কিতাব-আল-বুলদান’, ৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ইব্‌ন-রুশতাহ ‘আল- আলাক-আল-নাফিসাহ’, ৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কুদামা ‘আল-খারাজ’ গ্রন্থ রচনা করেন। খ্রিস্ট্রীয় দশম শতাব্দীতে স্বনামধন্য মাসুদী সমগ্র এশিয়া মহাদেশ, জানজিবার এবং উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ এলাকা পর্যটন করে ৩০ খণ্ডে ‘মুরুয যাহাব’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। আল-ইস্তাখারী প্রত্যেক দেশের রঙিন মানচিত্র সম্বলিত তাঁর গ্রন্থ ‘মাসালিক-আল- মামালিক’ দশম শতাব্দীতে প্রণয়ন করেন। তাঁর অনুরোধে ভূ-পর্যটনকারী ইবন্-হাওকাল তাঁর মানচিত্র এবং ভূগোল গ্রন্থকে পরিবর্ধন করেন। মাকদিসী ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ‘আহসান- উত-তাকাসিম-ফি মারিফাত-উল-আকালিম’ এবং আল-হামদানি ‘আল-ইকলীল’ ও ‘সিফাত জাজিরাত উল-আরব’ রচনা করেন। 

আল-বেরুনী ‘কিতাব-উল-হিন্দ’ গ্রন্থে ভারতবর্ষের সমাজ, ধর্ম, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাতকরেন। এই যুগের অন্যান্য প্রখ্যাত ভূগোলবিদ ছিলেন ভূ- পর্যটক ইবন-বতুতা, আল-ইদ্রিসী, আল-ইয়াকুত প্রমুখ। ইবন-বতুতা ছত্রিশ বছর দেশ ভ্রমণ করে আরব, চীন, সিংহল, ইস্তাম্বুল, বাংলাদেশ, আসাম, দিল্লী ও মধ্য আফ্রিকা, মালদ্বীপ সম্বন্ধে একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত (‘রিহলা’) লিপিবদ্ধ করেন। 

ইতিহাস : ইতিহাস চর্চা মূলত উমাইয়া খিলাফতে শুরু হলেও আব্বাসীয় যুগে এটি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে উৎকর্ষতা লাভ করে। লৌকিক উপাখ্যান, প্রাক-ইসলামী আরবের কাহিনী এবং রাসূলুল্লাহর জীবনী আরব ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিষয়বস্তু হিসাবে সমাদৃত ছিল। প্রাক-মুসলিম আরবের ইতিহাস রচনায় হিশাম-আল-কালবী প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর ১২৯টি গ্রন্থের মধ্যে মাত্র তিনটি ‘আল-ফিহরিস্ত’ গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে। রাসূলে করীমের জীবনের উপর ভিত্তি করে প্রথম ইতিহাস রচনা করেন মুহাম্মদ-বিন-ইসহাক। এ ছাড়া ইবন হিশাম, মুসা-ইবন-উকবা এবং আল-ওয়াকিদীর নামও রাসূলের জীবন বৃত্তান্তকারী হিসেবে সুপরিচিত। ইবন-সা’দ রাসূল ও তাঁর সাহাবীদের জীবন বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। মিসরের ইবন আবদুল হাকামের রচিত ‘ফুতুহ মিসর-ওয়া- আখবারুহা’ গ্রন্থ মিসর, উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেন বিজয়ের সর্বপ্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ ইতিহাস রচনায় পারস্যবাসী বালাজুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ‘ফুতুহ- উল-বুলদান’ এবং ‘আনসাব-উল-আশরাফ’ নামে দুটি প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। বালাজুরী যুদ্ধাভিযানের একটি ধারাবাহিক কাহিনী বর্ণনা করেন। 

বলা বাহুল্য যে, গ্রীক ঐতিহাসিক হিরোডোটাসের পর আরবগণই ইতিহাস রচনার অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। প্রাচীন উপাখ্যান, লোকগাথা, জীবনালেখ্য, বংশতালিকা প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে পারস্যরীতিতে প্রকৃত ইতিহাস রচনা শুরু হয়। ইবন-উল-মুকাফফা সর্বপ্রথম পাহলবী ভাষায় রচিত ‘কুদায়-নামা’ গ্রন্থটি ‘সিয়ার উল- মুলুক-উল-আজম’ নামে আরবিতে অনুবাদ করেন। রাজদরবারে খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস রচনা করা হত। পেশাদার ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইবন কুতাইবা। তিনি ‘কিতাব-উল-মা’ আরিফ’ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাঁর সমসাময়িক ছিলেন দিনাওয়ারী। তাঁদের গ্রন্থ ‘আল-আখবার-উত-তিওয়াল’ বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। দশম শতাব্দীতে হামজা-আল-ইস্পাহানী প্রথম সমালোচনামূলক ইতিহাস রচনা করেন। আরবি ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন আত-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খ্রি.)। তাঁর খ্যাতির মূলে ছিল ‘তারীখ-উল-রসূল- ওয়াল-মুলুক” শীর্ষক ইতিহাস ও কুরআন ভিত্তিক একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। তিনি ইতিহাসের ঘটনাপঞ্জী কালক্রম অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করেন। পৃথিবীর সৃষ্টি হতে ৯১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের জন্য তিনি পারস্য, মিসর, সিরিয়া ও ইরাক ভ্রমণ করেন এবং সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর যাবৎ প্রতিদিন চব্বিশ পৃষ্ঠা করে লিখতেন। আল-মাসুদীকে ‘আরবদের হিরোডোটাস’ বলা হত এবং তিনি ঘটনাবলী তাবারীর মত বছর পরম্পরায় লিপিবদ্ধ না করে রাজবংশের কাহিনীভিত্তিক ইতিহাস রচনা করেন। তাঁর উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি পরবর্তীকালে ইবন-খালদুন ও অপরাপর ঐতিহাসকিগণ অনুসরণ করেন। তাঁরা ত্রিশ খণ্ডে ‘মুরুজ-উজ্‌জ্-জাহাব-ওয়া-মা’দিন-উজ্-জাওহার’ নামে একটি মূল্যবান ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়া ইবন-আল-আসীর ‘আল-কামিল ফিত-তারীখ’ ও আজ-জাওজী ‘মিরাত উজ-জামান ফি তারীখ-উল আইয়াম’ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। ইতিহাস রচনায় ইবন-খাল্লিকান ও ইব্‌-খালদূন সমধিক পরিচিত ছিলেন। 

আরব জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ছিলেন ইবন খালদূন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রি)। ‘কিতাবুল ইবার’ রচনা করে তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। এই ইতিহাস গ্রন্থের মুখবন্ধ ‘মুকাদ্দামা’ বিশ্ববিশ্রুত। তিনি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ক্রমবিবর্তন দ্বারা মানব সভ্যতার ইতিহাস রচনা করেন। সভ্যতার উত্থান-পতনের কারণসমূহ, মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক প্রভাব, খাদ্য ও আহার্যের প্রভাব, আবহাওয়ার প্রভাবের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। প্রতীচ্যেও খালদূন বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। রবার্ট ফ্রিন্ট বলেন, “হবস, লক এবং রুশো তাঁর পথিকৃৎই ছিলেন না, বরং তাঁর নামের সঙ্গে তাঁদের নাম উল্লেখ করা উচিত হবে না।” হিট্টি বলেন, “ইবন খালদূন ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক-দার্শনিক হিসেবে সমাদৃত।” মার্টিন বলেন, “মানব সমাজের প্রধান কাজ মুসলমানগণ সম্পন্ন করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক আল-ফারাবী ছিলেন মুসলমান; সর্বশ্রেষ্ঠ অঙ্কবিদ আবু কামিল এবং ইব্রাহিম-বিন-সিনান ছিলেন মুসলমান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ এবং বিশ্ব-কোষ রচয়িতা আল-মাসুদী ছিলেন মুসলমান এবং ঐতিহাসিক আত-তাবারীও ছিলেন মুসলমান।” 

দর্শনশাস্ত্র : আব্বাসীয় যুগে দর্শনশাস্ত্র চর্চা একটি নব-দিগন্তের সূচনা করে। মানব মনীষার প্রয়োগে জড়জগতের সৃষ্টির প্রকৃত কারণ নির্ণয়ই আরব দর্শন-শাস্ত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল। দর্শন হচ্ছে যৌক্তিক পদ্ধতিতে সত্যে উপনীত হবার পন্থা। গ্রীক চিন্তাধারায় প্রাচ্যের প্রভাব মুসলমানদের মনে পরিশুদ্ধি লাভ করে এবং আরবি ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আরবি দর্শনের সৃষ্টি হয়। আরবি দর্শন মূলত কুরআন ও হাদীসভিত্তিক থাকলেও পরবর্তী পর্যায়ে গ্রীক ও পারস্য দর্শন দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। মুসলমানদের মতে, কুরআন এবং ইসলাম-ধর্মতত্ত্বই সমস্ত ধর্মীয় আইনের সমষ্টি। এর জন্য দর্শন, ধর্মতত্ত্ব এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর আরবগণ মৌলিক চিন্তার খোরাক পান। পরবর্তী পর্যায়ে ঐশ্বরিক ধর্মের উপর ভিত্তি করে তারা মৌলিক চিন্তাকে প্রসারিত করেন। এ কারণে মুসলমান দার্শনিকগণ দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম গোষ্ঠীতে রয়েছেন ইসলামী দার্শনিক; যেমন- হযরত আলী, আবদুল্লাহ, ইবন আব্বাস, জাফর আস-সাদেক, ইমাম আল-রাজী, ইমাম গাজ্জালী প্রমুখ; দ্বিতীয় গোষ্ঠীতে এরিস্টটলীয় পন্থী রয়েছে; যেমন- আল-কিন্দি, আল-ফারাবী, ইবন-সিনা, ইবন-রুশদ প্রমুখ। 

এরিস্টটলের একজন একনিষ্ঠ শিষ্য ছিলেন আল-কিন্দি। তিনি আরবদের দার্শনিক উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি এরিস্টটল এবং প্লেটোর দর্শনের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন এবং পীথাগোরাসের অঙ্কশাস্ত্রকেই সকল বিজ্ঞানের উৎস বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি ছিলেন একজন সার্বজনীন যুক্তিবাদী এবং একাধারে জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, চক্ষু-চিকিৎসা, সঙ্গীত প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলির সংখ্যা ছিল ২৬৫ এবং বিশ্বের সত্তরটি ভাষা তাঁর জানা ছিল। ইউক্লিডের ‘অপটিকস্’ গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে রচিত গ্রন্থটি ইবন-উল-হিশামের গ্রন্থ প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে সমাদৃত ছিল। এই গ্রন্থ রজার বেকনকেও প্রভাবান্বিত করে এবং তাঁর গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হবার ফলে সংরক্ষিত হয়েছে। সঙ্গীতের উপর তিনি বারটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং এতে গ্রীকদের প্রভাব ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। পাশ্চাত্যের প্রচলিত হবার পূর্বে মুসলমানগণ সঙ্গীতে ছন্দের ব্যবহার প্রচলন করে। 

হিট্টি যথার্থই বলেন, “ইসলামের সংগে গ্রীক দর্শনের যে সমন্বয় আরববাসী আল- কিন্দি শুরু করেন তা তুর্কী আল-ফারাবী এবং পারস্যবাসী ইবন-সিনা সুদূরপ্রসারী করেন। দর্শনশাস্ত্র ছাড়াও ফারাবী মনস্তত্ত্ব ও রাজনীতির উপর মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রিসালাত ফুসুল-উল-হিকমা’ এবং ‘রিসালাত ফি-আরা-আহল-উল-মদিনা উল-ফাজিলা’। বলা বাহুল্য যে, তিনি এরিস্টটলের ‘পলিটিক্স’ এবং ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। সংগীত বিশারদ হিসেবেও আল-ফারাবী বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। সঙ্গীতের উপর লিখিত সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হচ্ছে ‘কিতাব-উল-মুসিকি আল-কবির। কথিত আছে যে, তিনি বীণা বাজিয়ে শ্রোতাদের হাসাতে, কাঁদাতে এবং ঘুম পাড়াতে পারতেন। তাঁর রচিত ভক্তিমূলক গীত এখন মাওলাবীয়া গোষ্ঠীর নিকট খুবই প্রিয়। ইবন-খাল্লিকান বলেন, “দর্শনশাস্ত্রে আল- ফারাবীর মত অপর কোন মুসলিম সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হতে পারেন নি।” পরবর্তী পর্যায়ে ইবন-সিনা আল-ফারাবীর দর্শন ও চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। 

পিথাগোরাসের মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইখওয়ান- উস-সাফা নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। শিয়া মতবাদের ছায়াতলে গঠিত এই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দলের প্রকৃত অবদান হচ্ছে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা অংক, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, সঙ্গীত প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনা করেন এবং এর একটি সংকলন ‘রাসাইল’ নামে পরিচিত। ইমাম আল-গাজ্জালী ইখওয়ান-উস-সাফা সম্প্রদায়ের মতবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। 

চিকিৎসাশাস্ত্র : আব্বাসীয় যুগে চিকিৎসাশাস্ত্রে যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধিত হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রের মত চিকিৎসাশাস্ত্রের মৌলিক গ্রন্থ প্রণয়ন ও গ্রীক গ্রন্থ থেকে অনুবাদের ফলে একটি নব-দিগন্তের সূচনা হয়। অনেক অনুবাদকই মৌলিক গ্রন্থ রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। এ সমস্ত পণ্ডিতদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মুহান্না-বিন-মাসাওয়াহ এবং হুনায়েন বিন-ইসহাক। শব-ব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ হওয়ায় মানুষের দেহ নিয়ে গবেষণা করা সম্ভবপর না হলেও বানরের দেহ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অবশ্য চক্ষু রোগের উপর গবেষণা অব্যাহত থাকে এবং মাসাওয়াহ এবং তাঁর শিস্য হুনায়েন-বিন- ইসহাক চক্ষু শাস্ত্রের উপর প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাঁর ঔষধপত্রের বিধান (Pharmacopia) সমধিক পরিচিত ছিল। 

মুসলমানগণ হাদীস থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণায় অনুপ্রাণিত হয়। এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সমাজে সমাদর ছিল। তাঁদের সাধারণত ‘হাকিম’ বলা হত। খলিফা হারুন, আল-মামুন এবং বার্মেকীদের চিকিৎসক জিব্রিল-বিন-বখতিয়ার প্রখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন এবং তাঁরা পারিবারিক চিকিৎসা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। 

ঔষধ প্রস্তুতকরণ পদ্ধতি মুসলমানগণ বহু পূর্ব থেকেই জানতেন এবং এ বিষয়ে পুস্তক প্রণয়ন করে তাঁরা ঔষধ প্রস্তুত প্রণালীকে একটি বিশেষ শাস্ত্রে পরিণত করেন। আরবি রসায়নশাস্ত্রের জনক বিশ্ববিখ্যাত জাবির ইবন-হাইয়ান হতে শুরু করে বহু পণ্ডিত এই শাস্ত্রের উপর অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। আল-মামুন এবং মুতাসিমের খিলাফতে ঔষধ প্রস্তুতকারক এবং চিকিৎসাবিদগণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতেন পারতেন। খলিফা আল-মুকতাদীর ৯৩১ খ্রিস্টাব্দে সিনান-বিন-সাবিত- বিন-কুররাহকে সমস্ত চিকিৎসকদের পেশাগত যোগ্যতা পরীক্ষার নির্দেশ দেন এবং উল্লেখ আছে যে, এই পরীক্ষায় ৮৬০ জন লোক উত্তীর্ণ হন। সিনান সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যের সর্বত্র পীড়িত লোকদের চিকিৎসার জন্য ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দল গঠন করেন। এমনকি বন্দীদের চিকিৎসারও সুবন্দোবস্ত ছিল। আব্বাসীয় আমলে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। পারশ্যের অনুকরণে হারুন বাগদাদে বিমারিস্তান অথবা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ইবন-তুলুন কায়রোতে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। হাসপাতালে গবেষণার জন্য গ্রন্থাগার ছিল এবং নারীদের চিকিৎসার পৃথক ব্যবস্থা ছিল। 

আব্বাসীয় যুগে যে সমস্ত চিকিৎসক উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হন তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আলী-ইবন-উল-আব্বাস, আল-মাসুদী এবং আলী- আত-তাবারী, আর-রাজী, ইবন সিনা প্রমুখ। খলিফা মুতাওয়াক্কিলের আমলে আত- তাবারী ইসলামে দীক্ষা লাভ করেন এবং ‘ফিরদৌস-উল-হিকমা’ নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ প্রনয়ণ করেন। এই গ্রন্থ গ্রীক ও হিন্দু চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়। আর-রাজী নিঃসন্দেহে মুসলমান চিকিৎসকদের মধ্যে মৌলিক অবদান রাখতে সক্ষম হন। পারস্যবাসী রাজী (৮৬৫-৯২৫ খ্রি.) সর্বপ্রথম শরীরে সুতা ব্যবহার প্রচলন করে। ফিরিশতার বর্ণনা অনুযাযী, আর-রাজী ১১৩টি বড় এবং ২৮টি ছোট গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। রসায়নশাস্ত্রের উপর লিখিত ‘কিতাব-উল-আসরার’ গ্রন্থটি ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে জিরার্ড ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন এবং চতুর্দশ শতাব্দীতে জাবিরের গ্রন্থ প্রকাশিত হবার পূর্ব পর্যন্ত রসায়নশাস্ত্রের এটিই একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ ছিল। আল-রাজী দশম খণ্ডে ‘কিতাব- আল-মনসুরী’ রচনা করেন এবং এর একটিতে সর্বপ্রথম বসন্ত ও হামের উপর বিশদ বর্ণনা রয়েছে। তাঁর গ্রন্থাবলি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হলে তৎকালীন বিশ্বে তাঁর তত্ত্ব ও ব্যবস্থাপনা বহুল প্রচারিত হয়। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘আল-হাওয়ী’ ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম চার্লসের সময় সিসিলীর ইহুদী চিকিৎসাবিদ ফারাজ বিন-সেলিম কর্তৃক ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে এর পঞ্চম সংস্করণ ভেনিসে পাওয়া গিয়েছিল। 

বলা বাহুল্য যে, আরব চিকিৎসাশাস্ত্রে গ্রীক, পারস্য এবং ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের সংমিশ্রণ ঘটে এবং মৌলিক গবেষণাপ্রসূত বিষয়াদি সংযোজিত হয়ে এটি একটি বিশ্বকোষে পরিণত হয়। আলী-বিন-আল-আব্বাস বুয়াইয়া সুলতান আজদু-উদ-দৌলাহর জন্য বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল কিতাব-উল-মালিকী’ রচনা করেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে ইবন-সিনার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি মূলত দার্শনিক হলেও চিকিৎসাবিদ্যায় তাঁর সমধিক অবদান ছিল। ‘আল-কানুন-ফিত-তিব’ গ্রন্থটি গ্রীক এবং আরবীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি সমন্বয়। ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘কানুন’ সর্বপ্রথম রোমে মুদ্রিত হয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে এই গ্রন্থটি ক্রিমনার জেরার্ড কর্তৃক অনূদিত হয় এবং এর ফলে চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর প্রভাব বৃদ্ধি পায়। গ্যালেন, আর-রাজী এবং আল-মাজুসীর গ্রন্থের পরিবর্তে ইবন-সিনার ‘কানুন’ ইউরোপীয় চিকিৎসা বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকরূপে সমাদৃত হয়। এই গ্রন্থে ক্ষয়-রোগের সংক্রামক প্রতিক্রিয়ার ব্যাখ্যা ছাড়াও ৭৬০ প্রকারের ঔষধ প্রস্তুতির নিয়মাবলি ছিল। চক্ষু চিকিৎসক হিসেবে আলী-বিন-ঈশা সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেন। একাদশ শতাব্দীতে বাগদাদে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং চক্ষু চিকিৎসার উপর ৩২টি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এদের মধ্যে ‘তাজকিরাত-আল-কাহালিন সর্বাপেক্ষা মূল্যবান। ১৩০টি চক্ষুরোগের বর্ণনাসহ এই গ্রন্থখানা হিব্রু এবং ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। 

জ্যোতিষশাস্ত্র : জ্যোতিষশাস্ত্রে মুসলমান বিজ্ঞানিগণ প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। মূলত ভারতের ‘সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থের প্রভাবে ইসলামে প্রথম জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা শুরু হয়। খলিফা আল-মনসুরের সময় ‘সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থটি আরবিতে অনুবাদ করেন মুহম্মদ-ইবন-ইব্রাহিম-আল- ফাজারী। পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য এতে গ্রীক জ্যোতির্বিদ্যার প্রভাব অনুপ্রবেশ করে এবং বিশেষভাবে গ্রীক টলেমীর ‘আল-মাজেস্ট’ গ্রন্থের অনুবাদের ফলে। এই অনুবাদ সম্পাদিত করেন হাজ্জাজ-বিন-মাতার এবং হুনাইন-বিন-ইসহাক। জ্যোতিষশাস্ত্রের উৎকর্ষতার মূলে ছিল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে মানমন্দির নির্মাণ। নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে জুন্দেশাহপুরে প্রথম বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনার জন্য একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। সিনদ-বিন-আলী এবং ইয়াহিয়া-বিন-আবি মনসুরের তত্ত্বাবধানে খলিফা আল-মামুনের সময় বাগদাদে একটি মানমন্দির নির্মিত হয়। রাজ জ্যোতিষীগণ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন এবং ক্রান্তিবৃত্তের বক্রতা, বিষুবের সঠিক সময়কাল নির্ধারণ ও সৌর বৎসরের দীর্ঘতা সম্বন্ধে ‘আল-ম্যাজেস্টে’ বর্ণিত তত্ত্বাবলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। আল- মামুন দামেস্কের নিকট কাসিয়ূনেও একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন। গ্রীক আদর্শে ইব্রাহিম আল-ফাজারীই প্রথম এ্যাসট্রোলেব (দিক নির্ণয় যন্ত্র) তৈরি করেন। এছাড়া অপরাপর যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে ডায়াল, কোয়াড্রান্ট এবং ভূ-চিত্র। 

আল-মামুনের খিলাফতে মুসা-ইবন-সাবেরের পুত্রগণ এবং আল-খাওয়ারিজমী, পালমিরা এবং ইউফ্রেটিসের নিকটবর্তী সিনজার সমতলভূমিতে ভূমণ্ডলে দৈর্ঘ্যের পরিমাপ নির্ণয়ের প্রচেষ্টা চালান। পরবর্তীকালে স্পেনের জ্যোতির্বিদ মাসলামা আল- মাজরিতি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত সারণি (‘সীজ’) বিশোধিত করেন। এটি ল্যাটন ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায় ব্যবহৃত হত। আব্বাসীয় খিলাফতের অন্যতম প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ আবু আল-আব্বাস আহমদ-আল-ফারগনী মুতাওয়াক্কিলের আমলে ফুসতাতে একটি নিলোমিটার (পানির উচ্চতা মাপবার যন্ত্র) প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রধান গ্রন্থ আল মুদখিল-ইলা-ইল্ম- হাযা’ত-উল-আফলাক’ ল্যাটিন এবং হিব্রু ভাষায় অনূদিত হয়। বুয়াইয়া আমলে বাগদাদে যে মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে আবদুর রহমান আল-সুফী, আহমদ-আস-সাগানী এবং আবু আল- ওয়াফা গবেষণাকার্য পরিচালিত করেন। আল-খাজিন ক্রান্তিবৃত্তের বক্রতা সম্পর্কে নির্ভুল তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। 

ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ আল-বাত্তানী (৮৭৭-৯১৮ খ্রি.) রাক্কায় জ্যোতিষশাস্ত্র গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। মৌলিক গবেষণায় তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। টলেমির সূত্রের পরিবর্তন করে তিনি চন্দ্র এবং বিভিন্ন গ্রহের কক্ষপথ সম্পর্কে অভিনব মত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কৃতিত্বের সাথে সূর্যের আংশিক গ্রহণ, ক্রান্তিবৃত্তের বক্রতা, বছর এবং ঋতুর দীর্ঘতা এবং সূর্যের কক্ষপথ সম্পর্কে গবেষণা করেন। জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে অপর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন আল-বেরুনী। সুলতান মাহমুদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রের সমসাময়িক তত্ত্বাবলির সমন্বয়ে ‘আল- কানুন উল-মা’সুদী ফিল-হাইওয়ান নজুম’ শীর্ষক একটি গবেষণাপ্রসূত গ্রন্থ ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রণয়ন করেন। ঐ বছরেই তিনি ‘আত-তাহফীম-লী আওয়াইল-সিনা’ত-উত- তনজীমম’ নামক একটি তথ্যবহুল জ্যামিতি-জ্যোতির্বিদ্যা এবং অঙ্কশাস্ত্রের নির্ভুল প্রশ্নোত্তরমালা রচনা করেন। তিনি বহুদিন ভারতবর্ষে অবস্থান করে “কিতাব-উল-হিন্দ’ রচনা করেন। তিনি অক্ষরেখা, দ্রাঘিমারেখা নির্ণয় করে পৃথিবীর কক্ষপথ সম্বন্ধে বিতর্কিত তত্ত্বের উপর নির্ভুল মন্তব্য করেন। 

সেলজুক সুলতান মালিক শাহের রাজত্বে ওমর খৈয়াম নিশাপুরে নির্মিত মানমন্দিরে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। কবি ও দার্শনিক হিসেবেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব ছিল তিনি প্রাচীন ফারসি পঞ্জিকার সংশোধন করেন। তাঁর উদ্ভাবিত পঞ্জিকা, গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা থেকেও নির্ভুল বলে এটি সর্বজনগ্রাহ্য। এটি ‘আত- তারিখ-উজ-জালালী’ নামে পরিচিত। 

১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার পর হালাকু খান উরমিয়া হ্রদের নিকট বিখ্যাত মারাগা মানমন্দির নির্মাণ করেন। নাসিরউদ্দিন আত-তুসী (১২৭৪ খ্রি.) এই মানমন্দিরের পরিচালক ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ। তাঁর প্রনীত সারণি ‘আজ-যীজ-উল-ইলখানী’ নামে পরিচিত ছিল। এই মানমন্দিরে ৪,০০,০০০ গ্রন্থ সম্বলিত একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। জ্যোতিষশাস্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছিলেন আবু আল-মাশার। তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে চারটি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। তিনি সর্বপ্রথম চন্দ্র-সূর্যের প্রভাবে জোয়ার-ভাটার কারণ নির্ণয় করেন। জ্যোতিষশাস্ত্রে ব্যবহৃত Zenith, Azimath, Nadir প্রভৃতি শব্দ মুসলমানদের দান। 

গণিতশাস্ত্র : জ্ঞান-বিজ্ঞানের অপরাপর ক্ষেত্রের মত গণিতশাস্ত্রে মুসলমানগণ অসামান্য অবদান রেখেছেন। ‘সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থটি অনুবাদের ফলে মুসলমানগণ হিন্দু অংকশাস্ত্র, ভারতীয় সংখ্যাতত্ত্ব এবং শূন্য সম্বন্ধে সম্যক ধারণা লাভ করেন। আল-ফারাজী এই গ্রন্থ অনুবাদ করেন। আল-খাওয়ারিজমী এবং হাবাস-আল হাসিবের সারণির মাধ্যমেই এই সংখ্যা চিহ্নগুলো ব্যাপক প্রচারিত হয়। কিন্তু আরব বৈজ্ঞানিকগণ হিন্দুদের জ্ঞানভাণ্ডার ব্যবহারে খুব উৎসাহী ছিলেন না। একাদশ শতাব্দীতে আল-ফারাজী তাঁর ‘আল-কাফি-ফিল হিসাব’ নামক গ্রন্থেও সংখ্যাচিহ্নগুলোকে শব্দের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু অপরাপর পণ্ডিতগণ সেমিটিক এবং গ্রীকদের অনুকরণে বর্ণমালার অক্ষর ব্যবহার করতেন। বলা বাহুল্য যে, আল-খাওয়ারিজমীই ছিলেন প্রথম যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ আরব অঙ্কশাস্ত্রবিদ। 

প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্রীয় সারণি প্রস্তুত ছাড়া আল-খাওয়ারিজমী প্রাচীন অংক এবং বীজগণিতের সুত্রগুলোকেও সুসমন্বিত করেন। তাঁর রচিত হিসাব-উল-জাবর-ওয়াল মুকাবালা’ আরবি ভাষায় লিখিত বীজগণিতের উপর প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এটি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে ষষ্ঠদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে সমাদৃত হয়। আল-খাওয়ারিজমীর প্রভাব পরে অপরাপর অঙ্কশাস্ত্রবিদদের উপরও পড়ে; যেমন ওমর খৈয়াম, লিওনার্ডো ফিবোনাসি এবং মাস্টার জ্যাকোব। গণিতজ্ঞ আল-ওয়াফাও জ্যোতির্বিদ্যা ও ত্রিকোণমিতিতে অপরিসীম অবদান রেখেছেন। 

রসায়নশাস্ত্র : রসায়নশাস্ত্রে মুসলিম মনীষিগণ অসামান্য অবদান রেখেছেন। রসায়নশাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা জাবির-ইবন-হাইয়ান অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে আবির্ভূত হন ^বং আল-রাজীর পরে তিনিই সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন। গ্রীক ও মিসরীয় পণ্ডিতদের মত তিনিও মনে করতেন যে, অজ্ঞাত পদার্থের সাহায্যে টিন, লৌহ, সীসা ও তামা প্রভৃতি নিকৃষ্ট পদার্থগুলো স্বর্ণ ও রৌপ্যে রূপান্তরিত হয়। তার মৃত্যুর দুশত বছর পরে আবিষ্কৃত গবেষনাগারে একটি সোনার পাত পাওয়া গিয়েছে। জাবির-ইবন-হাইয়ান তাঁর বাইশখানা গ্রন্থে রসায়নশাস্ত্রের সকল বিষয়ের গবেষণামূলক আলোচনা করেন। এদের মধ্যে ‘কিতাব আল-রহমা’, ‘কিতাব-আল তাজমী’ এবং ‘আল-জি বাক্-আল-সরকী’ প্রকাশিত হয়। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ একবাক্যে স্বীকার করেন যে, জাবির ইবন-হাইয়ান অনেক রাসায়ানিক যৌগিক পদার্থ তৈরি করেন। রসায়নশাস্ত্রের প্রধান দুটি সূত্র উষ্মীকরণ (Calcination) এবং লঘুকরণ (Reduction) সম্বন্ধে তিনি বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন। এ ছাড়া বাষ্পীকরণ (Evaporation), ঊর্ধ্বপাতন (Sublimation), তরলীকরণ (Melting) এবং স্ফটিকীকরণ (Crystallization) প্রভৃতি সূত্রেরও তিনি উৎকর্ষতা বিধান করেন। তাঁর নিঃসন্দেহে আধুনিক রসায়নশাস্ত্রের জনক বলা হয়। ঐতিহাসিক হামবুলট বলেন, “আধুনিক রসায়নশাস্ত্র মুসলমানদেরই আবিষ্কার বলা যায় এবং এই দিক দিয়ে তাঁদের কৃতিত্ব অতুলনীয়। “ 

প্রাণিতত্ত্ব ও খনিজ বিজ্ঞান : প্রাণিবিদ্যায় আরবগণ গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন এবং প্রাণিতত্ত্বের বহু রহস্য তারা উদ্ঘাটন করেন। কিন্তু ঘোড়া সম্বন্ধে তাদের গবেষণা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পরিচালিত হয়। আরব প্রাণিতত্ত্ব এবং নৃতত্ত্ববিদদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন আবু-উসমান-আমর-ইবন-বাহর-আল-জাহিজ। তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাবুল হায়ওয়ান’-এ গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলের অনেক উদ্ধৃতি রয়েছে এবং একেই বিবর্তনবাদ ও প্রাণী-মনস্তত্ত্বের উৎস বলে মনে করা হয়। পারস্যের আল-কাযউইনী এবং মিসরের আদ-দামিরী আল-জাহিজের গবেষণালব্ধ জ্ঞান দ্বারা তিনি প্রভাবান্বিত হন। প্রাণিতত্ত্বের মত খনিজ বিজ্ঞানে আরবগণ যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত করেন। পঞ্চাশের অধিক আরবি গ্রন্থে খনিজ পদার্থ এবং মণি-মাণিক্য সম্বন্ধে বর্ণনা পাওয়া যায়। এদের মধ্যে উতারিদ-ইবন-মুহম্মদ আল-হাসিবের গ্রন্থ সর্বাধিক পুরাতন। এ ছাড়া শিহাব-উদ- দীন-আত-তিফাশী প্রণীত ‘আজহার-উল-আফকার-ফি-জাওয়াহির-উল-আত্জাব’ বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। আত-তিফাশী ২৪টি এবং আল-বেরুনী ১৮টি মূল্যবান পাথর ও ধাতুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। 

ধর্মশাস্ত্র : জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র ছাড়াও মুসলমানগণ ধর্মতত্ত্ব, হাদিসশাস্ত্র, আইনশাস্ত্র এবং ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা করেন এবং তাদের গবেষনালব্ধ উপাদান গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। কুরআন শরীফ ব্যতীত হাদিস একটি বিজ্ঞানসম্মত বিষয়ে পরিণত হয়। হাদিস সংগ্রহে হাদিসকার আত্মনিয়োগ করেন এবং বলাই বাহুল্য যে ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক সমস্যাবলি সমাধানের জন্য হাদিসের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। হাদিসের সত্যতা যাচাই করে সংরক্ষণের জন্য বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহৃত হত। আবু হুরায়রা ৫,৩০০টি, হযরত আয়েশা ২,২১০টি, আনাস ইবন মালিক ২,২৮৬টি এবং ওমর ইবন-খাত্তাব ১,৬৩০টি হাদিস বর্ণনা করেন। হাদিস সংরক্ষণে ‘সিহাহ সিত্তা’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে ছয়খানা প্রামাণ্য গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হাদিসগুলো অদ্যাবধি প্রামাণ্য হাদিস গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। আল-বুখারী ৬০,০০,০০০টি হাদিস সংগ্রহ করেন এবং এর মধ্যে ৭,২৭৫টি নির্ভুল প্রমাণ করে বিষয়বস্তু অনুযায়ী শ্রেণীবিভাগ করেন। মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, মাজাহ এবং আল-নাসাইও বিশুদ্ধ প্রামাণ্য হাদিস সংগ্রহকারক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। 

আইনশাস্ত্র : আইনশাস্ত্র মূলত ‘ফিকহ’ নামে পরিচিত এবং এটি প্রধানত কুরআন ও হাদিসভিত্তিক ছিল। গ্রীক ও রোমান আইন দ্বারা প্রভাবান্বিত হলেও মুসলিম আইনের নিজস্বতা ও মৌলিকত্ব রয়েছে। মনে করা হয় যে, কুরআন শরীফের প্রায় ছয় হাজার আয়াতের মধ্যে দুশত আয়াত বিশেষ করে দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সূরা মুসলিম আইনশাস্ত্রের উৎস। পরবর্তীকালে ইসলামের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে জটিল সমস্যা দেখা দিলে ‘ইজমা’ ও ‘কিয়াসের’ উদ্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে আইনজ্ঞ ও চিন্তাবিদ ইমাম আবু হানিফার অবদান ছিল অসামান্য। তাঁর শিষ্য আবু ইউসুফ ‘কিতাব-উল-খারাজ’ নামক গ্রন্থে তাঁর শিক্ষকদের মতবাদ লিপিবদ্ধ করেন। তিনি কিয়াসকে প্রাধান্য দেন। মদিনায় মালিক বিন-আনাসের ‘আল-মুয়াত্তা’ গ্রন্থ ইসলামী আইনশাস্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তিনি ‘ইজমা’র ব্যবহারকে গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া আশ’শাফী এবং হাম্বলীও সুন্নী ইসলামের দুটি শাখার প্রতিষ্ঠাতা। 

সাহিত্য : কাব্যচর্চা ও সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে আব্বাসীয় খিলাফতে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। তখন আরবি ও ফারসি সাহিত্যের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। আরবি সাহিত্যে আবুল ফারাজ, ইবনে খাল্লিকান, আবু নুওয়াস, উতবী এবং আবু তাম্মাম বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। আব্বাসীয় যুগে আরবি কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধে পারস্যবাসী যে আন্দোলন শুরু করেন তা ‘শূরী’য়াহ’ নামে পরিচিত। সাহিত্যচর্চাই ছিল এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। আরব অপেক্ষা পারস্যদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ছিলেন আল-বেরুনী ও হামজা-আল-ইস্পাহানী। অপরদিকে সাহিত্যে আরবদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে সোচ্চার ছিলেন আরব ও পারস্যবাসী আজ-জাহিজ, ইবন-ই- দুরায়েদ, ইবন-ই-কুতাইবা এবং আল-বালাজুরী। মুসলিম সাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব, কাব্য যে কেবল আরবি ভাষাসম্ভূত ছিল তা কখনই বলা যায় না। বলা বাহুল্য যে, ভাষাতত্ত্ব, ব্যাকরণ, অভিধান প্রণয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে আরবগণের মৌলিক চিন্তায় অনারব প্রভাব ছিল। অভিধান রচয়িতা আজ-জাওহারী ছিলেন তুর্কী। তাঁর সমসাময়িক আলেপ্পোর হামদানী রাজদরবারে ইবন জিন্নী ভাষাতত্ত্বের উপর গ্রন্থ রচনা করেন। 

আল-জাহিজের রচনা থেকেই আরবি সুকুমার সাহিত্যের (Belles letters) উদ্ভব হয়। এর উৎকর্ষতা সাধিত হয় হিজরী চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীর বদি-উজ-জামান – আল-হামদানী, আল-সা’লিবী এবং আল-হারিরির রচনায়। হামদানীর গ্রন্থের অনুকরণে আল-হারিরি ‘মাকামাহ’ রচনা করেন। এটি পূর্ব প্রচলিত ছন্দময় গদ্যের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। সাত শত বছর ধরে সমাদৃত ‘মাকামাহ’ নাটকীয় ভঙ্গিতে বর্ণিত প্রাচীন উপাখ্যান। আল-ইস্পাহানী রচিত ‘কিতাব আল-আঘানী’ আরবি সাহিত্য ও মুসলিম সভ্যতার উপর গবেষণামূলক গ্রন্থ। ইবন্ খালদূন একে ‘আরবদের রেজিস্ট্রার’ বলে অভিহিত করেন। আরবি সাহিত্যে আরব্য উপন্যাস একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে। দশম শতাব্দীর মধ্যভাগে ইরাকে ‘আলিফ লায়লা-ওয়া-লায়লা’ প্রণীত হয়। আল-জাহশিয়ারী ভারতের বিভিন্ন গল্প অবলম্বনে ‘হাজার আফসানা’ নামে যে গ্রন্থ প্রণয়ন করেন তার উপর ভিত্তি করে ‘আলিফ লায়লা-ওয়া-লায়লা’ অর্থাৎ সহস্র রজনী রচিত হয়। ভারতীয় উপকরণ ব্যতীত হিব্রু, গ্রীক ও মিসরীয় উপাদান এতে সংযোজিত হয়। হারুন-অর-রশীদের আমলে কতিপয় কৌতুকপূর্ণ ও রোমাঞ্জকর প্রেমের উপন্যাস এতে সংযুক্ত করা হয়। গ্যালা (Galland) সর্বপ্রথম এটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে উইলিয়াম লেন এবং জন পাইন এর ইংরেজি অনুবাদ করেন। 

আব্বাসীয় খিলাফতে কাব্যচর্চায় প্রাক-ইসলামী যুগের আদর্শ পরিত্যক্ত হয় এবং বিদেশী সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রভাব এতে পরিলক্ষিত হয়। আব্বাসীয় কাব্যে পারস্য প্রভাব ছিল প্রকট। জোসেফ হেল বলেন, যখন পাশ্চাত্যে প্রেমকাব্য অপরিচিত ছিল তখন আরবদেশে এটি চরম উৎকর্ষতা লাভ করে।” কাব্যচর্চার পুরোধা ছিলেন বাশশার ইবন- বুর্দ। তিনি অন্ধ ছিলেন এবং ‘জিন্দিকদের’ প্রতি তাঁর দুর্বলতা থাকায় তাঁকে হত্যা করা হয়। কাব্য রচনায় নতুন ধারার অপর একজন পথিকৃত ছিলেন আবু নুওয়াস। খলিফা হারুন ও আমীনের দরবারের সভাকবি আবু নুওয়াস প্রেমের কবিতা রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। অপর একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন আবু-আল আতাহিয়া। তিনি সর্বপ্রথম নীতি ও আদর্শভিত্তিক কাব্য রচনা করেন। কাব্যচর্চায় যারা সুখ্যাতি অর্জন করেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মুতান্নবী, ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, নিযামী, সাদী, রুমী, ফরিদুদ্দীন, আত্তার ও হাফিজ। 

স্থাপত্যশিল্প : আব্বাসীয় স্থাপত্যকলা উমাইয়া স্থাপত্যশিল্প হতে বৈশিষ্ট্যগত বিচারে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। বায়জানটাইন স্থাপত্যের প্রভাব ছিল উমাইয়া ইমারতসমূহে কিন্তু আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে স্থাপত্যশিল্পে একটি অভিনব যুগের সুচনা হয় এবং পারস্য স্থাপত্যরীতির প্রভাব প্রকট আকারে দেখা দেয়। মার্বেলের পরিবর্তে ইটের ব্যবহার মেসোপটেমীয় স্থাপত্যে বিশেষ করে ব্যবিলনীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ছিল এবং খিলান, ভল্ট, অলঙ্করণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আব্বাসীয় স্থাপতিগণ পারস্য ও মেসোপটেমীয় স্থাপত্য কীর্তির অনুকরণ করে। বাগদাদ নগরী স্থাপনে খলিফা আল- মনসুর দূরদর্শিতার পরিচয় দেন এবং এই গোলাকার সংরক্ষিত প্রাসাদ দুর্গটি তৎকালীন বিশ্বের একটি বিস্ময় ছিল। বাগদাদ দুর্গের অভ্যন্তরে ‘কুব্বাত-আল-খাদরা’ অর্থাৎ সবুজ গম্বুজবিশিষ্ট একটি রাজপ্রাসাদ ও তৎসংলগ্ন একটি জুমা মসজিদ নির্মিত হয়। উপরন্তু, মনসুর রাক্কায় অপর একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। আব্বাসীয় আমলে রাজপ্রাসাদ নির্মিত হয় বিভিন্ন সময়ে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল শামমাশিয়ার বার্মেকীদের প্রাসাদ, মুতাসিমের সামাররার বুলকাওয়ারা প্রাসাদ, মুতাজিদের তাজ প্রাসাদ, মুক্তাদীরের দার-উস-শাজারাহ প্রাসাদ এবং বুয়াইয়াদের আল-মুইয়িা প্রাসাদ। 

আব্বাসীয় স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করছে অসংখ্য মসজিদ। আল-মনসুরের বাগদাদ দুর্গে নির্মিত জুমা মসজিদ ছাড়াও বিভিন্ন খলিফা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ নির্মাণ করেন। ৭৬২ – ৬৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত বাগদাদের মসজিদটি কুফা মসজিদকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ৭৭২ খ্রিস্টাব্দে রাক্কায় যে মসজিদটি নির্মিত হয় তাতেও পারস্য রীতির প্রভাব রয়েছে। ক্রেসওয়েল যথার্থই বলেন, “আব্বাসীয় আমলে সিরিয়ান হেলেনিস্টিক প্রভাব পারস্যের সাসানীয় প্রভাবের চাপে দূরীভূত হয়।” বাগদাদ হতে সামারারায় রাজধানী স্থানান্তরিত হলে পারস্য প্রভাব প্রকট আকার ধারণ করে। খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের রাজত্বে ৮৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দে সামাররার জামে মসজিদ ও আবু দুলাফে যে মসজিদ নির্মিত হয় তা নিঃসন্দেহে পারস্য স্থাপত্যের ঐতিহ্য বহন করছে। প্রাচীন ব্যবিলনীয়দের জিগুরাতের অনুকরণে সামারারার মসজিদের বহিঃপার্শ্বে একটি মিনার স্থাপিত হয়। এটি গোলাকৃতি এবং শীর্ষে উঠার জন্য বাহির হতে ঘোরানো সিঁড়ি ব্যবহৃত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, এই মিনারকে অনুকরণ করে ইবন-তুলুন কায়রোতে তাঁর মসজিদ সংলগ্ন একটি মিনার নির্মাণ করেন। আব্বাসীয় স্থাপত্য শিল্পের প্রধান উপকরণ গোলাকার গম্বুজ, অর্ধবৃত্তাকার খিলান, বক্রাকার খিলান, ভল্ট, খাঁজকাটা কঙ্গুরা (Battlement, Squinch), ইটের নক্সা, মিনা করা টালি প্রভৃতি। 

সুকুমার শিল্প : তথাকথিত ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মুসলমানেরা চিত্রকলায় পারদর্শিতা প্রদর্শন করে। আব্বাসীয় যুগে মুসলিম চিত্রকলার উন্মেষ হয় এবং বাগদাদে প্রথম মেসোপটেমিীয় চিত্রকলা প্রদর্শিত হয়। খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মে চিত্রকলা ধর্মপ্রচারের নিমিত্ত ব্যবহৃত হত। কিন্তু ইসলামে চিত্রকলা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বহির্ভুত। একজন আরব পরিব্রাজক নবম শতাব্দীর শেষভাগে চীন দরবারে রাসূলুল্লাহর সর্বপ্রাচীন ছবিটি দেখান। সম্ভবত নেস্টোরিয়ান শিল্পী এই প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করেন। মুসলিম চিত্রকলা প্রধানত পাণ্ডুলিপিভিত্তিক ছিল এবং বিভিন্ন বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় বিভিন্ন রেখা ও রঙের প্রয়োগে চিত্র অঙ্কন করা হত। মাকরিজী মুসলিম চিত্রকলার একটি নির্ভরযোগ্য ইতিহাস প্রণয়ন করেন। কতিপয় পাণ্ডুলিপিকে কেন্দ্র করে মুসলিম চিত্রকলার আদিযুগ শুরু হয়; যেমন- গ্রীক লেখক ডায়স্করাইডসের ‘মেটিরিয়া মেডিকা’, হারীরীর ‘মাকামাহ’, ‘কালিলা-ওয়া-দিমনা, ‘কিতাব-উল-আঘানী’। সম্ভবত খ্রিস্টান নেস্টোরিয়ান ও জাকোবীন শিল্পীদের দ্বারা অথবা তাদের প্রভাবে এই একক পাণ্ডুলিপিগুলো চিত্রায়িত হয়। পারস্যে সর্বপ্রথম মুসলিম চিত্রশিল্পের উদ্ভব হয়। 

চিত্রকলা ব্যতীত রাজপ্রাসাদে অলঙ্করণের ব্যবহার ছিল খুবই জনপ্রিয়। বাগদাদের প্রাসাদের গম্বুজের উপর দিক-নির্নয়কারী একটি অশ্বারোহীর প্রতিমূর্তি ছিল। আল- আমীন টাইগ্রীস নদীতে পশু-পক্ষীর আকারে প্রমোদতরী নির্মাণ করেন। আল- মুকতাদীরের প্রাসাদের মধ্যবর্তী পুকুরে কয়েকটি শাখাবিশিষ্ট একটি স্বর্ণ ও রৌপ্যের বৃক্ষ ছিল এবং পুকুরের উভয় তীরে বর্শাধারী ও সচলমান যুদ্ধরত পনেরটি অশ্বারোহীর মূর্তি বিদ্যমান ছিল। সামাররা প্রাসাদের দেওয়ালে নগ্ন নারীচিত্র ও মৃগয়ার দৃশ্য দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কিত হয়। এ ছাড়া কার্পেটে জীবন্ত প্রাণীর নক্সাও বোনা হত। কম্বলে শিকারের চিত্র ও উদ্যানের নক্সা খুবই জনপ্রিয় ছিল। মৃৎশিল্পেও আব্বাসীয় শিল্পীগণ খ্যাতি অর্জন করেন। ‘কাশী’ ছিল এক ধরনের রঙ্গীন নক্সাকৃত ছবি, যার উৎপত্তিস্থল ছিল পারস্যের কাশান। এন্টিওক, আলেপ্পো এবং দামেস্কের এনামেল ও গিল্টির কাজ প্রসিদ্ধ ছিল। কায়রোর আরব মিউজিয়াম ও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত সামারা ও ফুসতাতের অসংখ্য মৃৎপাত্র, রঙিন থালা, পাত্র, কলসী, ফুলদানি, বাতি আব্বাসীয় চারুশিল্পের স্বাক্ষর বহন করে। 

ইসলামে মূর্তি সম্বন্ধে তথাকথিত নিষেধাজ্ঞা এবং ঐশ্বরিক বাণীর মর্যাদাদানের প্রবণতার জন্য মুসলিম শিল্পীগণ হস্তলিখনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। সুলতান নাসিরউদ্দীন এবং বাদশাহ আওরঙ্গজেব কুরআন শরীফের সুন্দর অক্ষর নকল করা পূণ্য কাজ বলে বিবেচনা করতেন। খলিফা আল-মামুনের রাজত্বে আর-রায়হান আরবি হস্তলিখন রীতি ‘রায়হানী’ প্রবর্তন করেন। আব্বাসীয় মন্ত্রী ইবনে মুকলাহর ডান হাত কর্তিত হলেও তিনি বাম হাতে এমনকি কর্তিত হাতের মধ্যভাগে কলম ধরে দ্রুত লিখতে পারতেন। ইবন-উল-বাওয়াব ‘মুহক্কাফ্’ পদ্ধতির প্রচলন করেন। লিখনশিল্প ব্যতীত পুস্তক বাঁধাই ও অলঙ্করণ শিল্পও উৎকর্ষতা লাভ করে। 

উমাইয়া যুগ অপেক্ষা আব্বাসীয় যুগে সংগীত চর্চা ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং মুসলমানগণ সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। আল-মাহদী মক্কার সংগীত-শিল্পী সিয়াত এবং তাঁর শিষ্য ইব্রাহিম আল-মাউসিলীকে রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানান। কথিত আছে যে, পারস্যবাসী ইব্রাহিম ষষ্টির আঘাতে সুর-হিল্লোল সৃষ্টি করতে পারতেন। তিনি ত্রিশটি বীনার সুরের মধ্যে পার্থক্য অথবা ত্রুটি সহজেই অনুধাবন করতে পারতেন। খলিফা হারুন-আর-রশীদ তাকে ১,৫০,০০০ দিরহাম উপঢৌকন দেন। আরব্য উপন্যাসের নায়ক হারুনের দরবার ছিল সংগীত চর্চার উপযুক্ত কেন্দ্র এবং সংগীতের মজলিসে কখনও কখনও দুই হাজার কণ্ঠশিল্পী অংশগ্রহণ করতেন। আল-আমীনের দরবারেও কণ্ঠশিল্পীদের সমাদর ছিল। আল-মামুন এবং আল-মুতাওয়াক্কিলের সভাকবি ছিলেন সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীত শিল্পী ইসহাক-বিন-ইব্রাহিম আল-মাউসিলী। খলিফা আল- ওয়াসিক স্বয়ং সংগীত চর্চা করতেন এবং প্রায় একশত গান রচনা করেন। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে খলিফা আল-মুতাদীর সমধিক পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর দরবারে ভূগোলবিদ খুরদাদবিহ নৃত্য এবং সংগীতের উপর একটি সুচিন্তিত ও সারগর্ভ বক্তৃতা দেন। আল- কিন্দী গানের সুর সম্বন্ধীয় একটি এবং আল ফারাবী ‘কিতাব উল-মিউজিকি আল-কবীর’ নামক সংগীতের উপর তথ্য সম্বলিত একটি গ্রন্থ রচনা করেন। 

শিক্ষা ব্যবস্থা : মসজিদ ছিল ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষার কেন্দ্র এবং এ শিক্ষা ছিল মূলত ধর্মীয় শিক্ষা। কুরআনের বাণী নয়, কবিতা দ্বারাই লিখন পদ্ধতি শুরু হয়; কারণ কুরআনের পবিত্র বাণী শিক্ষা করা ধর্মের কাজ ছিল। এই লিখন পদ্ধতি আয়ত্ত করবার জন্য ছাত্রদিগকে আরবি ব্যাকরণ, রাসূলের জীবনী, প্রাথমিক অংক এবং ধর্মীয় কবিতা শিক্ষা দেওয়া হত। বাগদাদে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল এবং প্রাথমিক শিক্ষায়তনের শিক্ষকদের বলা হত মুয়াল্লিম। নির্ধারিত বিষয়বস্তু অনুযায়ী পরীক্ষা হত এবং সাফল্যের পর সার্টিফিকেট দেওয়া হত। আব্বাসীয় খিলাফতে শিক্ষা-দীক্ষার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় এবং খলিফা মামুনের সময়ে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ পাদপীঠ ছিল ‘বায়ত-উল-হিকমা’। ইসলামী আমলে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বাগদাদের নিযামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। সেলজুকদের শাসনকালে মালিক শাহের প্রধানমন্ত্রী নিযাম-উল-মূলক ১০৬৫ খ্রিস্টাব্দে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণ করেন। এই শিক্ষায়তনে শাফী ও আশ’আরী পদ্ধতি সম্পর্কে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। কুরআন ও প্রাচীন কবিতাই ছিল পাঠ্য তালিকার প্রধান বিষয়বস্তু। ছাত্ররা মাদ্রাসায় বসবাস করত এবং মেধা অনুযায়ী বৃত্তি পেত। উল্লেখযোগ্য যে, নিযামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসরণে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। আল-গাজ্জালী নিযামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর শিক্ষকতা করেন। নিযামিয়া ছাড়াও ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে আল-মুসতানসির তাঁর নামানুসারে বাগদাদে মুসতানসারিয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোসলখানা, পাকঘর, হাসপাতাল ও পাঠাগার ছিল এবং প্রবেশ পথে একটি বড় ঘড়ি ছিল। এর ধ্বংসাবশেষ বাগদাদে এখনও দেখা যায়। ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে ইবনে-বতুতা এই প্রতিষ্ঠানের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষায়তন ছিল। নিজাম- উল-মূলক উক্ত শিক্ষায়তনগুলোর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং খোরাসান, সিরিয়া এবং ইরাকে বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ইবনে জুবাইর বাগদাদে ৩০টি, দামেস্কে ২০টি, মসুলে ৬টি এবং হিমসে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমস্ত শিক্ষালয়ে ধনী ও দরিদ্র, পুরুষ ও মহিলা একত্রে শিক্ষা লাভ করতে পারত। শিক্ষকগণ স্বাধীনভাবে নিজেদের পছন্দমত বক্তৃতা দিতে পারতেন এবং এ বক্তৃতায় জনসাধারণ ও শিক্ষিত ব্যক্তিগণ যোগদান করতেন। বক্তৃতা লিখে রাখবার ব্যবস্থা ছিল; যেমন নিশাপুর মসজিদের সংলগ্ন মাদ্রাসায় ৫০০টি দোয়াতদানি ছিল। শিক্ষকদের প্রশ্ন করা যেত এবং শিক্ষকগণ সানন্দে তার জবাব দিতেন। বলা বাহুল্য, একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শিক্ষা-ব্যবস্থা জনসাধারণের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হত এবং শিক্ষকগণের বেতন বহন করত জনসাধারণ। একাদশ শতাব্দীতে নিযামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সরকার কর্তৃক পরিচালিত হতে থাকে। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রন্থাগারের সম্পর্ক ছিল খুবই নিবিড়। মাদ্রাসায় বহু গ্রন্থ সংরক্ষিত হত। বিত্তশালী ব্যক্তিদের অণুপ্রেরণায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। সিরাজ নগরীতে বুয়াইয়া সুলতান আজদু-উদ-দৌলাহ্ দশম শতাব্দীতে যে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন তাতে একটি সুসংবদ্ধ গ্রন্থ-তালিকা ছিল। বসরায় প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারে গবেষণার জন্য বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। মার্ভ ও খাওয়ারিজমের গ্রন্থাগার থেকে ইয়াকুবও তাঁর প্রখ্যাত ভৌগোলিক গ্রন্থের উপাদান সংগ্রহ করেন। ইয়াকুবের ভাষ্য অনুযায়ী, বাগদাদের রাস্তার উভয় পার্শ্বে বইয়ের দোকান ছিল। মুসলমান সম্প্রদায় চর্মনির্মিত কাগজ ও প্যাপিরাসের পরিবর্তে চীন দেশ হতে কাগজ প্রচলন করেন। বার্মেকীদের সময় বাগদাদে কাগজ প্রস্তুতের কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর ফলে বিজ্ঞানচর্চা সম্প্রসারিত হয়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *