অষ্টম অধ্যায়: অর্থনীতির অবক্ষয়, না কৃষি অর্থনীতির বিস্তার: ভারতীয সামন্তপ্রথার ধারণা ও সংশ্লিষ্ট বিতর্ক (৬৫০-১২০০ খ্রীঃ)

অষ্টম অধ্যায় – অর্থনীতির অবক্ষয়, না কৃষি অর্থনীতির বিস্তার: ভারতীয় সামন্তপ্রথার ধারণা ও সংশ্লিষ্ট বিতর্ক (৬৫০-১২০০ খ্রীঃ)

অগ্রহার ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটায় সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যে নূতন প্রবণতার জন্ম হয় (৩০০-৬৫০ খ্রীঃ), তার পরিণত রূপ খ্রীঃ ৬৫০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত সাড়ে পাঁচশ বছরের কালসীমায় লক্ষ্য করা যায়। তাম্রশাসন জারী করে নিষ্কর জমি বা গ্রামের রাজস্ব দান করার ঘটনা কার্যত সর্বভারতীয় রূপ নেয়; কিন্তু এই ব্যবস্থা একই সঙ্গে জটিলতর হয়ে ওঠে ও তার স্থানীয় বৈশিষ্ট্যও বাড়তে থাকে। কার্যত আলোচ্য আমলের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে আঞ্চলিকতার প্রভাব যথেষ্ট। আঞ্চলিকতার এত ব্যাপক প্রকাশ আগের পর্বে দেখা যায় না। রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটটিও এই প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সমগ্র উপমহাদেশে এত বেশী রাজনৈতিক শক্তির সহাবস্থান আগে দেখা যায়নি; কিন্তু সর্বভারতীয় শক্তি দূরে থাক, গুপ্ত সাম্রাজ্যের মত প্রায় সমগ্র আর্যাবর্ত বা বাকাটকদের মত সমগ্র দাক্ষিণাত্যের উপর রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের দৃষ্টান্তও বিরল। পরাক্রান্ত রাজনৈতিক শক্তিগুলি কমবেশী পরিমাণে আঞ্চলিকতার দ্বারাই চিহ্নিত: বাংলার পাল ও সেন বংশ, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের গুর্জর প্রতীহারগণ, দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশ ও সুদূর দক্ষিণের চোল সাম্রাজ্য সামরিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিশেষ শক্তিশালী হলেও এলাকাভিত্তিক শক্তি হিসেবেই তাদের শনাক্ত করা যায়। এই প্রধান শক্তিগুলির অধীনে বহু ক্ষুদ্রতর শাসক গোষ্ঠী ছিল, যারা সাম্রাজ্যগুলির আধিপত্য মেনে নিলেও কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযোগে স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করতে তৎপর ছিল; এই অধীনস্থ শক্তিগুলির পারস্পরিক ক্ষমতা দখলের লড়াই-এর কথাও অজানা নয়। উত্তর ভারতের ক্ষেত্রে স্থানীয় শক্তির উত্থানের চিত্রটি হেমচন্দ্র রায়ের লেখনীতে স্পষ্ট; দক্ষিণ ভারতে ও দাক্ষিণাত্যে স্থানীয় শক্তিগুলির পরিচয় পাওয়া যায় নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী ও সদাশিব আলটেকরের রচনায়। শিল্পের ক্ষেত্রেও আঞ্চলিকতা আমাদের নজরে পড়ে; স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় স্থানীয় শিল্পশৈলীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। আঞ্চলিক ভাষাগুলির প্রাথমিক রূপও এই আমলেই জানা যায়। ভারতীয় ইতিহাসের প্রায় সবক্ষেএেই আঞ্চলিকতার এত বেশী প্রভাব পূর্ববর্তী আমলে দেখা যায় না; স্থানীয় বৈচিত্র্য হয়তো সর্বক্ষেত্রেই ছিল, কিন্তু জীবনযাত্রায় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে সাধারণ সর্বভারতীয় ছাপও বিরল ছিল না। সমাজ, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অর্থনীতি, শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতার উদ্ভব ও প্রসার বিষয়ে ঐতিহাসিকরা সচেতন; কিন্তু ইতিহাসের নানা ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতার বৃদ্ধি কেন ও কিভাবে ঘটে থাকতে পারে, তা বিশ্লেষণের জন্য একটি যুক্তিগত কাঠামো প্রস্তুত করার প্রয়াস খুব বেশী দিন শুরু হয়নি। একটি নির্দিষ্ট ছক বা যুক্তিশৃঙ্খলার মাধ্যমে আলোচ্য আমলে আঞ্চলিকতার বিকাশকে বুঝবার জন্য রামশরণ শর্মার গবেষণাকে পথিকৃৎপ্রতিম বলা যায়।

রামশরণ শর্মা ও তাঁর অনুগামীরা সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন বুঝতে চেয়েছেন সমকালীন বস্তুগত সংস্কৃতির ভিত্তিতে শর্মার বিচারে অর্থনীতি তথা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে স্থানীয় ঝোঁক বা আঞ্চলিকতা বৃদ্ধি পাবার মূল কারণ ছিল এক বিকেন্দ্রীকৃত অর্থনৈতিক (তথা রাষ্ট্রীয়) কাঠামোর উদ্ভব ও বিকাশ। বিকেন্দ্রীকরণের এই প্রবণতা আলোচ্য যুগটিকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে; এই বিকেন্দ্রীকরণের ঝোঁকের মধ্যে ভারত ইতিহাসের প্রাচীন পর্ব থেকে আদি-মধ্য যুগে রূপান্তরের সন্ধান শর্মা পেয়েছিলেন। এই বিকেন্দ্রীকৃত অবস্থা ব্যবস্থার বিচার শর্মা করেছেন ‘ভারতীয় সামন্ততন্ত্র’ এর তত্ত্বগত কাঠামোর ভিত্তিতে। বিষয়টি, বলাই বাহুল্য, জটিল ও বিতর্কিত, যে বিতর্ক এখনও সজীব ও অনবসিত।

সামন্ততন্ত্র বা সামন্তপ্রথার আলোচনা করতে গেলে পশ্চিম ইওরোপে এক বিশেষ সামাজিক অবস্থার বিকাশের তুলনা এসে যাবেই। রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর (৪৭৩ খ্রীঃ) থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত সময় ইওরোপীয় ইতিহাসে মধ্যযুগ বলে চিহ্নিত; মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য সামন্তপ্রথা। সামন্ত ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য কি কি তা নিয়ে যেমন বিতর্কের অন্ত নেই, তেমনই এই ব্যবস্থার ব্যাপকতা ও প্রসার নিয়ে প্রায় সমান মতান্তর বর্তমান। ঐতিহাসিক, সমাজবিদ্যাবিশারদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে এক গোষ্ঠী মনে করেন এই ব্যবস্থা সার্বজনীন লক্ষ্মণযুক্ত পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলেই নানা কালে এই ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। সামন্তব্যবস্থাকে যাঁরা সার্বজনীন ঘটনা বলে মনে করেন, তাঁদের বিচারে এই ব্যবস্থার প্রধানতম লক্ষণগুলি সবচেয়ে প্রকট ছিল পশ্চিম ইওরোপে। সেই দিক থেকে বিচার করলে সামন্ততন্ত্রের চরিত্র নিৰ্দ্ধারণ করতে হয় মধ্যযুগীয় পশ্চিম ইওরোপের অবস্থা-ব্যবস্থার মাপকাঠিতে। অপরপক্ষে এই ধারণাও দেখা যায় যে সামন্তব্যবস্থার কোনও নির্দিষ্ট সার্বজনীন ছক নেই, কারণ ধনতন্ত্রের উত্থানের আগে বিশ্বজনীন কোনও ছকের কল্পনা করা যায় না। ফলে সামন্তব্যবস্থার দেশকাল ভেদে ভিন্ন রূপ আছে এবং তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য মেনে নিয়েই বিভিন্ন অঞ্চলে এই ব্যবস্থার স্বরূপ বোঝা উচিত। আর একটি প্রধান বিতর্ক এই ব্যবস্থার মূল চরিত্র নিয়ে দেখা যায়। কার্ল মার্কস সামন্ত ব্যবস্থাকে এক বিশেষ উৎপাদন ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছিলেন, যে ব্যবস্থা প্রাচীন আমলের দাসপ্রথাকে সরিয়ে কায়েম হয়েছিল ও ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির উদ্ভবের ফলে যার বিলয় ঘটেছিল। মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গীতে সামন্তব্যবস্থা তাই উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত; তাঁদের মতে উৎপাদন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পথ সুগম করে। এই মতানুসারে সামন্তপ্রথায় উৎপাদনের মূল উপকরণ ভূমি। যদিও প্রাক-ধনতান্ত্রিক যে কোনও উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষি অর্থনীতির প্রাধান্যই স্বাভাবিক ঘটনা, তবুও সামন্ত ব্যবস্থায় ভূসম্পদের গুরুত্ব স্বতন্ত্র। ভূসম্পদের উপর ভূস্বামীদের দখল ও নিয়ন্ত্রণ এই উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যতম চরিত্র; উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপন্ন সামগ্রীর উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন ভূস্বামীরা। ভূস্বামীগণ অসংখ্য স্তরে বিভক্ত থাকেন; এই স্তরের সর্বনিম্নে ভূমিদাস বা ‘সার্ফ’দের অস্তিত্ব দেখা যায়। ভূমিদাসরা তাদের ভূমিতে আবদ্ধ থাকতেন; জমির উপর মালিকানা তাঁদের ছিল না; উপরন্তু মালিকানা বদল হলে ভূ-সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে ভূমিদাসও হস্তান্তরিত হতেন। রাজস্ব ব্যবস্থা দ্বারা যত বেশী সম্ভব উদ্বৃত্ত আহরণ ও নিয়মবহির্ভূত পীড়নমূলক কর চাপানোর প্রবণতা এই ব্যবস্থায় লক্ষ্যণীয়। ভূমিদাস ও ভূস্বামীর ভিতর আধিপত্য-অধীনতার সম্পর্কও এই উৎপাদন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। উৎপন্ন সামগ্রীর উপর ভূস্বামীর ভোগাধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সামাজিক ধনের উৎপাদন কেবলমাত্র তাৎক্ষণিক ভোগের উদ্দেশ্যেই হতে থাকে; তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটিয়ে যে অতিরিক্ত উৎপাদন বাণিজ্যিক পণ্যের ভূমিকা পালন করে, তার অস্তিত্ব সামন্ত প্রথায় যৎকিঞ্চিৎ। এই কারণে সামন্ত ব্যবস্থায় বাণিজ্যের সংকোচন ঘটে থাকে। সমস্ত অর্থনৈতিক অবস্থাতেই আঞ্চলিক চরিত্র দানা বাঁধতে থাকে। এক একটি এলাকা হয়তো স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। কিন্তু পণ্য বিনিময়ের সুযোগ কম থাকায় এক আবদ্ধ অর্থনীতির জন্ম হয়। এই আবদ্ধ অর্থনীতি এক ধরনের সামাজিক কূপমণ্ডুকতা ও জড়ত্বের শিকার হয়, যা ক্রমাগত সনাতনপন্থী হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে মৃতকল্প অবস্থা বিরাজ করতে থাকে, তা সচরাচর পরিবর্তন ও অভিনবত্বের পরিপন্থী। ভূস্বামীগণ কেবলমাত্র উৎপাদন ও ভোগ ব্যবস্থারই কর্ত্তৃত্বে থাকেন না, স্থানীয় রাজনৈতিক কর্ত্তৃত্বও তাঁদের কুক্ষিগত থাকে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে আঞ্চলিকতার মত রাজনীতিতেও কেন্দ্রীয় শক্তির পরিবর্তে বিকেন্দ্রীকৃ৩ প্রশাসনই কায়েম হয়।

যে সব পণ্ডিত সামন্ত ব্যবস্থাকে মূলতঃ উৎপাদন ব্যবস্থা বলে মনে করেন না, তাঁদের মতে সামন্ততন্ত্র এক রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা পিরামিড সদৃশ; তার চূড়ায় থাকেন রাজা। কিন্তু রাজা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নন; তাঁর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সামন্ত বা অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে বণ্টিত হয়। ভূম্যধিকারীরা কোনও এলাকার উপর প্রশাসনিক অধিকার ও কর্ত্তৃত্ব লাভ করেন শর্তাধীনে: প্রথম শর্ত অনুযায়ী সামন্ত রাজাকে যুদ্ধের সময় সৈন্য ও রসদ সরবরাহ করতে বাধ্য থাকেন; দ্বিতীয় শর্ত অনুযায়ী রাজাকে মন্ত্রণা ও পরামর্শ দেওয়াও তাঁর কর্তব্য। এই শর্তে রাজ্যের ভূখণ্ড রাজার কাছ থেকে প্রধান সামন্ত, প্রধান সামন্ত থেকে মধ্য সামন্ত ও মধ্য সামন্ত থেকে ক্ষুদ্র সামন্তের মধ্যে বিতরিত হয়। যে শর্ত ও আনুগত্যের ভিত্তিতে প্রথম ক্ষেত্রে প্রধান সামন্ত রাজার কাছ থেকে কোনও এলাকার উপর ক্ষমতা লাভ করেন, ঐ একই শর্তে তিনি তাঁর অধস্তন সামন্তকে তাঁর ভূখণ্ড থেকে জমির বিলিব্যবস্থা করেন। এই অবস্থায় মধ্য সামন্তের প্রাথমিক আনুগত্য ও শর্ত থাকবে প্রধান সামন্তের প্রতি, সার্বভৌম রাজার প্রতি নয়। এই একই সম্পর্ক মধ্য ও ক্ষুদ্র সামন্তের ভিতর বিরাজ করে। এই পরিস্থিতিতে রাজার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রায় লোপ পায় বা খণ্ডীকৃত হয়ে যায়; তার ফলে রাষ্ট্রপরিচালনায় কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব ও কর্ত্তৃত্ব বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা থাকে। সংহত রাষ্ট্রশক্তির জায়গায় অনেকগুলি আঞ্চলিক শক্তির জোড়াতালি দেওয়া সহাবস্থান দেখা যেতে থাকে। এই দিক দিয়ে বিচার করলে সামন্ত ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় শক্তির অবনয়ন ও আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটতে থাকে। প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ আঞ্চলিকতার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ও ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্রাভিগ রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিরল হতে থাকে।

সামন্ততন্ত্র বিষয়ে এই গোড়ার কথাগুলি বলে নেওয়ার পর এবার আদি-মধ্য কালীন ভারতের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যাক। আদি মধ্যযুগে সামন্ত প্রথার উদ্ভব ও ব্যাপক প্রসারের যে ছক রামশরণ শর্মা পেশ করেছেন, সেই ছকে তিনি মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সামন্ত প্রথাকে উৎপাদন ব্যবস্থা হিসেবেই দেখেন। রাষ্ট্রকাঠামো ও সাংস্কৃতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বদলের ক্ষেত্রেও শর্মা যথেষ্ট মনোযোগী, কিন্তু এই পরিবর্তনগুলিকে তিনি আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রতিক্রিয়া বলে মনে করেন।

॥ ২ ॥

রামশরণ শর্মা ও তাঁর অনুসরণে বি. এন. এস. যাদব এবং দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝা মনে করেন যে, তাম্রশাসন জারী করে নিষ্কর ভূসম্পদ দানের মাধ্যমে ভারতীয় সামন্ত ব্যবস্থার বীজ বপন করা হয়েছে। অগ্রহার দানের রীতি প্রথমে ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল; ক্রমশঃ তা ব্যাপকতরভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। নিষ্কর জমি ব্রাহ্মণ ছাড়াও মন্দির, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে দান করার ঝোঁক বাড়তে থাকে। দানগ্রহীতারা প্রথম পর্যায়ে পুরোহিত বা ধর্মজগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেও তাম্রশাসনের দ্বারা রাজস্ব হস্তান্তর করার ঘটনা পরবর্তীকালে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হতে থাকে। লৌকিক উদ্দেশ্যে রাজস্ব দানের নীতি চালু হলে, শর্মার বিচারে, তা সামন্ত প্রথাকে বিশেষভাবে মজবুত করে তোলে। রামশরণ শর্মা ভারতে সামন্ত প্রথার উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে কয়েকটি পর্ব ও ধাপ নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে এই ব্যবস্থার উন্মেষ খ্রীঃ ৩০০ থেকে ৬০০-র সময়সীমায়, খ্রীঃ ৬০০-৯০০-তে এই ব্যবস্থার ব্যাপক বিকাশ ও চুড়ান্ত রূপটি ৯০০-১২০০ খ্রীষ্টাব্দে লক্ষিত হয়। তিনি আরও মনে করেন যে শেষতম পর্বে সামন্ত ব্যবস্থার চূড়ান্ত পরিণতি ও ভাঙ্গন যুগপৎ দেখা গিয়েছিল। সামন্ত ব্যবস্থার প্রকোপে অর্থনৈতিক অবস্থার আলোচনা করতে গিয়ে শর্মা উপমহাদেশের তিনটি এলাকায় তার প্রকৃষ্ট নজীর ও লক্ষণগুলি দেখেছিলেন। এই তিন অঞ্চল হল গুর্জর প্রতিহারদের শাসনাধীন উত্তর ও পশ্চিম ভারত, পালদের অধিকারভুক্ত বিহার ও প্রাচীন বাংলার বিস্তৃত ভূখণ্ড ও রাষ্ট্রকূট অধিকৃত দাক্ষিণাত্য।

সামন্তপ্রথার উদ্ভবের ফলে একদিকে ভূমিব্যবস্থায় জটিলতার সৃষ্টি হয়; মধ্যস্বত্বভোগী ভূস্বামীদের আবির্ভাব কৃষকের উপর চাপ সৃষ্টি করে ও রাজকীয় রাজস্বে ভাগ বসাতে থাকে। শর্মার অনুমান এই যে, সামন্তপ্রথার উদ্ভব ও উত্থান এক বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার জন্ম দিয়েছিল। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিচয় শর্মা সন্ধান করেছেন পুরাণে বর্ণিত কলিযুগের বিবরণের মধ্যে। পুরাণের রচনাকাল নিয়ে মতৈক্য না থাকলেও এটুকু বলা চলে যে, প্রধান পুরাণগুলির সংকলন ঘটেছিল গুপ্ত আমলে অর্থাৎ চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে। পুরাণগুলিতে চারটি যুগের যে যুগবৈশিষ্ট্য দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে শেষতম কলিযুগ নিকৃষ্ট বলে বর্ণিত। শেষতম যুগের বর্ণনাটি সম্ভবত পুরাণকারদের অভিজ্ঞতা প্রসূত বলে শর্মা মনে করেন। দ্বাপর যুগের অবসান ও কলির সূচনা যখন ঘটছে সেই যুগান্তরের লক্ষণগুলি পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। কলিযুগের আবির্ভাব পৌরাণিক সাহিত্যে সার্বিক সংকটের কাল বলে চিহ্নিত: এই সময়ে দণ্ডের অভাব, বর্ণাশ্রমধর্মে বিপর্যয়, বহিরাক্রমণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে রাজার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব হ্রাসের উল্লেখ পুরাণের বর্ণনায় উপস্থিত। এই বর্ণনার ঐতিহাসিক সত্যতা হয়তো নেই; আক্ষরিক অর্থে পুরাণের বর্ণনার বাস্তবতা খুঁজতে যাওয়াও বৃথা। কিন্তু পুরাণে সার্বিক সংকটের যে ধারণাটি দেখা যায় তার প্রতি শর্মা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আসন্ন অবক্ষয়ের ইঙ্গিত কলিযুগের বর্ণনায় পাওয়া যাবে। এই অবক্ষয়ের পটভূমিতেই শর্মা ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশকে স্থাপন করেছেন।

এর পূর্ববর্তী অধ্যায়েই বলা হয়েছে, অগ্রহার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে প্রদত্ত ভূখণ্ড বা গ্রামের উপর দানগ্রহীতাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ ঘটে। শর্মা দেখিয়েছেন যে দানগ্রহীতারা কার্যত ভূস্বামীতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁরা কেবলমাত্র ভূসম্পদ ও গ্রাম থেকে সংগৃহীত রাজস্ব ভোগ করতেন না, রাজস্ব আদায় ও আঞ্চলিক আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার অধিকারও তাঁদের হাতে ছিল। এর ফলে সম্ভবত রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা খণ্ডিত হয় ও ভূস্বামীদের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বেড়ে যায়। কলিযুগের বর্ণনা থেকে শর্মা অনুমান করেছেন যে, শাসকদের পক্ষে রাজস্ব আদায় করা যখন কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে তখন রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বও ভূস্বামীদের হাতে বোধ হয় তুলে দেওয়া হয়। গুপ্ত ও বাকাটক আমলে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে ও বৌদ্ধ বিহারের জন্য অগ্রহার সৃষ্টি করার যে ঝোঁক দেখা যায়, খ্রীঃ ৬৫০ থেকে তা বহুগুণে বাড়তে থাকে। তাম্ৰশাসনগুলি বিচার করলে দেখা যায় বৈষ্ণব ও শৈব মন্দিরগুলির উদ্দেশে বহু ভূসম্পদ দান করা হয়েছিল। এর ফলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি ভূম্যধিকারীর চরিত্র লাভ করে। এর অন্যতম প্রকৃষ্ট নজীর পাওয়া যাবে পূর্বভারতের বিখ্যাত বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান নালন্দা মহাবিহারে। খ্রীঃ অষ্টম শতকের মধ্যভাগ থেকে এই এলাকা দীর্ঘদিন পর্যন্ত পাল রাজাদের অধিকারভুক্ত ছিল। দেবপালের আমল শুরু হবার আগে নালন্দা মহাবিহারের ব্যয় নির্বাহ হত সন্নিহিত ২০৯টি গ্রাম থেকে; ঐ গ্রামগুলি বিভিন্ন সময়ে নালন্দা বিহারের উদ্দেশে অগ্রহার ব্যবস্থায় দান করা হয়েছিল। এর সঙ্গে আরও পাঁচটি গ্রাম যুক্ত হয়; দেবপালের কাছে যবদ্বীপের রাজা শৈলেন্দ্রবংশীয় বালপুত্রদেব নালন্দা মহাবিহারের উদ্দেশে পাঁচটি গ্রাম দান করার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন এবং দেবপাল ঐ অনুরোধে সায় দেন (দেবপালের নালন্দা তাম্রশাসন)। ২১৪টি গ্রামের উপর যে প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ভোগের অধিকার ছিল, সেই প্রতিষ্ঠান যে ক্রমশ ভূম্যধিকারীর রূপ ধারণ করবে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। এইভাবে বাংলার চন্দ্র, বর্মণ, দেব প্রভৃতি রাজবংশ সমতট-হরিকেল-বঙ্গাল অঞ্চলে ময়নামতী বিহারের উদ্দেশ্যে ভূমসম্পদ দান করেন। এরই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে যে, পালদের তাম্রশাসনে বহু ব্রাহ্মণকে অগ্রহার ভূসম্পদ দেওয়া হয়েছিল। ব্রাহ্মণদের জমি ও গ্রাম দানের ঝোঁক একাদশ ও দ্বাদশ শতকের বাংলায়–—বিশেষতঃ সেন বংশের শাসনাধীন অঞ্চলে–—আরও বৃদ্ধি পায়। এর অন্যতম উদাহরণ পাওয়া যাবে সেন আমলের অন্যতম প্রধান পণ্ডিত হলায়ুধ শর্মনের ভূসম্পত্তির হিসাব করলে। বিশ্বরূপ সেনের সাহিত্য পরিষৎ তাম্রশাসনে বলা হয়েছে হলায়ুধ শর্মা ৩৩৯image উন্মান বা উয়ান পরিমাণ জমি পেয়েছিলেন। উত্তর ও পশ্চিমভারতে অগ্রহার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে ও জোরদার করতে প্রতিহার শাসকরা প্রায় অনুরূপ ভূমিকা নেন। তবে তাঁদের সৃষ্ট অগ্রহারগুলি এক একজন ব্রাহ্মণের উদ্দেশে প্রদত্ত; কোনও প্রাতিষ্ঠানিক দানের নজীর দেখা যায় না। দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটদের তাম্রশাসনেও অগ্রহারের নীতির ব্যাপক রূপায়ণ ঘটেছিল। একজন রাষ্ট্রকূট রাজা দাবী করেছেন যে তিনি ১৪০০ গ্রাম যা অগ্রহার হিসেবে আগে দান করা হয়েছিল তা আবার দান করেন; ৬০০ টিগ্রাম অগ্রহার ও বাকী ৮০০টি গ্রাম বিভিন্ন মন্দিরে দান করা হয়। সুদূর দক্ষিণ ভারতে ‘ব্রহ্মদেয়’ (ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভূসম্পত্তি) ও ‘দেবদান’ (মন্দিরের উদ্দেশে প্রদত্ত ভূসম্পদ) প্রথার প্রচুর উদাহরণ অসংখ্য লেখামালায় ছড়িয়ে আছে। মন্দিরগুলি ভূসম্পদে এতই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যে একাদশ-দ্বাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতের বিশাল মন্দিরগুলি শুধু ভূস্বামীই নয়, সেগুলি অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপেরও কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিগতভাবে কোনও ব্রাহ্মণ যিনিই অগ্রহার ব্যবস্থার সুবিধা ভোগ করুন, এর দুটি প্রধান অভিঘাত অর্থনৈতিক জীবনে লক্ষ্যণীয়। প্রথমটি হল ভূমিব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যাপক প্রসার ও দ্বিতীয়ত ভূস্বামী ও ভূম্যধিকারীদের ক্ষমতাবৃদ্ধি। ভূম্যধিকারীদের সংখ্যা ও ক্ষমতা বাড়ার ফলে জমির প্রকৃত কর্ষকের অবস্থায় কি পরিবর্তন এসেছিল, তাও এই প্রসঙ্গে বিচার্য। আগেই বলা হয়েছে যে, খ্রীঃ ৩০০-৬৫০-এর সময়সীমায় অগ্রহার ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হলে ভূমিব্যবস্থায় জটিলতা বৃদ্ধি পায় ও মধ্যস্বত্বভোগী ভূস্বামীশ্রেণী মাথা চাড়া দিতে থাকে। এই প্রবণতা আলোচ্য সাড়ে পাঁচশো বছরে স্পষ্টতর ও পরিণত আকার ধারণ করেছিল, এমত ধারণা শর্মা পোষণ করেন।

ধর্মশাস্ত্রে ত্রিস্তর ভূমি ব্যবস্থার উল্লেখ দেখা যায়: মহীপতি (রাজা), স্বামী (জমির মালিক) ও কৰ্ষক (অর্থাৎ প্রকৃত চাষী)। ‘স্বামী’ বা জমির মালিকের ভূসম্পত্তি বৃহদাকার হলে তাঁর পক্ষে সব জমি চাষ করা সম্ভব হত না, ফলে কর্ষক বা চাষীদের নিয়োগ করা হতে থাকে। এই চাষীদের যেহেতু জমির মালিক থেকে আলাদা করা হয়েছে, তাই অনুমান করা যুক্তিযুক্ত যে বড় ভূস্বামীর উত্থানের ফলে মালিকানাবিহীন কৃষি শ্রমিকের উদ্ভব ঘটে। এই জাতীয় স্তরবিন্যাসের ছবি সমতট অঞ্চলের রাজা দেবখড়্গের আসরাফপুর তাম্রশাসনে (৬৭৫ খ্রীঃ) দেখা যাবে: এই তাম্রশাসনে একটি বৌদ্ধ বিহারকে ভূমিদান প্রসঙ্গে রাজকীয় জমি ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির (জমির মালিকের নামে ষষ্ঠী বিভক্তির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়) উল্লেখ রয়েছে; একই সঙ্গে জমির ভোগাধিকারী (‘ভুজ্যমানক’) ও কৃষক (‘কৃষ্যমানক’)-এর কথাও আছে। এর থেকে দেখা যায় যে, ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা ছাড়াও ভোগাধিকারের ধারণা ছিল, যে ভোগাধিকার মালিকানার থেকে আলাদা। আবার জমির ভোগাধিকারী ও কর্ষক যে আলাদা তা-ও বুঝতে অসুবিধে হয় না। কৃষকের জমির উপর ভোগাধিকার এখানে নেই, জমির মালিকও সে নয়। নালন্দা মহাবিহার বা দক্ষিণ ভারতের শৈব বা বৈষ্ণব মন্দিরগুলি অগ্রহার/দেবদান ব্যবস্থার দ্বারা যে পরিমাণ ভূসম্পদের অধিকারী হল, তার আর্থিক উপযোগিতা পাবার জন্য কর্ষক বা চাষীকে নিয়োগ করতেই হত। এই চাষীর মালিকানা ও ভোগাধিকার খুব বেশী ছিল বলে মনে হয় না। এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই তাম্রশাসনের একটি বিশেষ বয়ানের প্রতি মনোযোগ দেওয়া দরকার। দানগ্রহীতাকে ভূসম্পদ দান করার বহুক্ষেত্রেই (বিশেষতঃ রাজস্থান, মালব ও গুর্জরদেশের তাম্রশাসনে) বলা হয়েছে যে দানগ্রহীতা নিজে চাষ করবেন বা কাউকে দিয়ে চাষ করিয়ে নেবেন (‘কৃষতঃ কর্ষাপয়তঃ’), নিজে ভোগ করবেন বা কাউকে দিয়ে ভোগ করাবেন (‘ভুঞ্জতো ভোজাপয়তঃ’) নিজে (কাজ?) করবেন বা করিয়ে নেবেন (‘কুর্যুঃ কারয়েৎ বা’)। ভূসম্পদ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পাবার উদ্দেশ্যে অপর ব্যক্তিকে নিয়োগ করার বিধান এখানে স্পষ্ট। এই ব্যবস্থা কৃষি অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্তরীকরণের গতি ত্বরান্বিত করেছিল; এই ভূমিব্যবস্থায় ভূস্বামীর সুযোগ সুবিধার সঙ্গে প্রকৃত চাষীর সুযোগ সুবিধার ব্যবধান বাড়তে বাধ্য। এ ছাড়া ভূস্বামীর অধস্তন উপস্বত্বভোগীদের উদ্ভব ঘটারও সম্ভাবনা থাকে। ভূস্বামীদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি ও ভূমি ব্যবস্থায় নানা স্তরের প্রকাশ সামন্ততন্ত্রের চরিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়।

ভূস্বামীদের প্রতিপত্তি বাড়ার আরও একটি লক্ষণের উপর রামশরণ শর্মা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাম্রশাসনে যে গ্রামটিকে দান করা হয়, তার অবস্থান বলা হয় এবং গ্রামটির সীমানার উল্লেখ থাকে। সাধারণত তাম্রশাসনের শেষাংশে প্রদত্ত গ্রামের সীমানা বর্ণনা করা হয়। শর্মা তাম্রশাসনগুলি পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন (এই তাম্রশাসনগুলি প্রধানতঃ পাল ও প্রতিহার আমলে উৎকীর্ণ) যে, প্রদত্ত গ্রামের সীমা বহুক্ষেত্রেই যথাযথভাবে বর্ণিত হয়নি; গ্রামের অন্তে তৃণভূমি, বা চারণভূমি পর্যন্ত গ্রামটির সীমা প্রসারিত (‘স্বসীমাতৃণ যুতিগোচর পর্যন্ত’), এই জাতীয় আলগা বর্ণনাই বেশী। গ্রামের উপর যে রাজস্ব চাপানো হত তা যেহেতু দানগ্রহীতার ভোগে লাগত, ফলে দানগ্রহীতা যদি তৃণভূমি চারণভূমিতে কৃষির পত্তন করতেন ও কৃষিজাত অতিরিক্ত রাজস্ব ভোগ করতেন, তাহলে তাঁকে বাধা দেবার বিশেষ উপায় ছিল না। গ্রামের সীমানা নিখুঁতভাবে চিহ্নিত না হওয়ায় কৃষির এলাকার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে আরও বেশী পরিমাণ রাজস্বভোগের সুযোগ দানগ্রহীতার সামনে ছিল; যদিও এই অতিরিক্ত উৎপাদনের কোনও অংশ রাজকোশে প্রত্যর্পণ করার কোনও দায় দানগ্রহীতার উপর বর্তাত না। রাষ্ট্রকূটশাসনে অবশ্য দানগ্রহীতাদের এই বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়নি, কারণ সেখানে গ্রামের সীমা যথেষ্ট খুঁটিয়ে বর্ণিত হয়েছে। পাল-সেন আমলের তাম্রপট্টগুলিতে প্রদত্ত গ্রামের বিভিন্ন সম্পদের উৎসও দানগ্রহীতার ভোগে দেওয়া হয়েছিল বলে শর্মা মনে করেন। গ্রামের উঁচুনীচু জমি (‘সতল সোদ্দেশ’), জলা জমি ও স্থল ভূমি (‘সজলস্থল’), গর্তযুক্ত ও পতিত জমি (‘সগর্তোষর’), আবর্জনা ফেলার আস্তাকুঁড় (‘অবস্কর’), আম কাঁঠাল ও মহুয়া গাছ (‘সাম্রমধূক’ বা ‘সাম্রপনস’–—যে অঞ্চলে যে ফল বেশী ফলে, তা গ্রাম দানের সময় দানগ্রহীতার উদ্দেশে প্রদত্ত; যেমন দঃ পূঃ বাংলায় ও আসামে গ্রামদানের সময় নারিকেল ও সুপুরী গাছ দেওয়া হয়েছে: ‘সগুবাকনারিকেল’; ওড়িষ্যাতে একইভাবে মাছ ও কচ্ছপের ভোগাধিকার দেওয়ার ঘটনা তাম্রশাসনে উল্লিখিত–—‘সমৎস্যসকচ্ছপ’) ভোক্তার উদ্দেশে দান করা হয়েছে। এই জাতীয় জমির ওপর সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয় অধিকার বা সামূহিক তথা যৌথ মালিকানা থাকাই স্বাভাবিক। অগ্রহার ব্যবস্থার দ্বারা, শর্মার যুক্তি অনুযায়ী, জমির উপরে রাষ্ট্রীয় ও যৌথ অধিকারের ক্ষেত্র ক্রমে সঙ্কুচিত হচ্ছিল, তার স্থান নিচ্ছিল ভূস্বামীর অধিকার। পাল-সেন আমলের তাম্রপট্টগুলিতে গ্রামদানের সময় উপস্থিত গ্রামবাসীকে দানগ্রহীতার পরিচয় ও ভূমিদানের কারণ জানানো হত; কারণ গ্রামদানের ফলে হয়তো গ্রামবাসীর যৌথ অধিকারে টান পড়ত। গ্রামবাসীকে গ্রামদানের সিদ্ধান্ত জানাবার পর এই ব্যাপারে তাঁদের অনুমোদন ও সমর্থন আছে বলে ধরে নেওয়া হত (‘মতমস্তু ভবতাম্‌’)। শর্মার ধারণা, গ্রামবাসীর অনুমোদন প্রকৃতপক্ষে দরকারই ছিল না, তা ছিল নিতান্ত আনুষ্ঠানিক এক প্রথা। কারণ সামন্তব্যবস্থায় গ্রামের জমির উপর সামূহিক অধিকারের সঙ্কোচ ঘটা আবশ্যম্ভাবী। শর্মা অবশ্য এ-ও দেখিয়েছেন যে রাষ্ট্রকূটদের শাসনে অনুরূপ গ্রামদানের সময় নিছক আনুষ্ঠানিক প্রথা হিসেবেও গ্রামবাসীকে অবহিত করা ও গ্রামদানের সপক্ষে মত চাওয়া হত না। অতএব রাষ্ট্রকূট আমলে গ্রামের যৌথ অধিকারভুক্ত জমি যে ভূস্বামীর ভোগদখলে পরিণত হচ্ছে, এবিষয়ে কোনও বাধা প্রায় ছিল না বললেই চলে।

গ্রামদান করে বা অগ্রহার ব্যবস্থায় নিষ্কর জমিদানের ফলশ্রুতি দক্ষিণ ভারতেও প্রকট। এ প্রসঙ্গে চোল লেখমালার ভিত্তিতে নোবুরু কারাশিমার গবেষণা বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। কারাশিমা দেখিয়েছেন যে, চোল আমলের গোড়ায় (নবম ও দশম শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত) অ-‘ব্রহ্মদেয়’ গ্রামগুলি (‘উর’ বলে আখ্যাত) কৃষিকাজের পক্ষে বিশেষ অনুকূল ছিল; ‘উর’ অঞ্চলে কৃষকদের সংখ্যাধিক্য থাকলেও জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার চেতনা স্পষ্ট নয়। একটি মন্দিরে জমি দানের এগারোটি ঘটনার কথা কারাশিমা দেখিয়েছেন; এর মধ্যে দশটি ক্ষেত্রেই মন্দিরকে জমি দান করেছিল ‘উর’ অঞ্চলের গ্রামসভা, ‘উর’-এর কোনও ব্যক্তি বিশেষ নয়। দানের অধিকার যেহেতু মালিকানার ইঙ্গিত দেয়, অতএব মনে করা চলে যে গ্রামের জমির উপর গ্রামসভার সামূহিক অধিকারই সক্রিয় ছিল। যৌথ মালিকানার ধারণা যেখানে এত প্রবল সেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার সম্ভাবনা অল্প থাকে। কোনও মন্দিরে যখন ‘উর’ কর্তৃক জমি দান বা বিক্রী করা হয়েছে, তখন তার থেকে উদ্ভূত সুবিধাও কোনও ব্যক্তি বিশেষ পেত না; তা সামগ্রিক ভাবে সকল গ্রামবাসীর উপকারে লাগত। ‘উর’ জমি বিক্রী করলে বিক্রয়লব্ধ অর্থ গ্রামসভার প্রাপ্য ছিল, জমি দান করলে, সাধারণত স্থানীয় ‘উর’ মন্দিরের কাছ থেকে রাস্তাঘাট সংস্কার, পুষ্করিণীর সংস্কার ইত্যাদির সুবিধা পেত। এই ব্যবস্থাতেও গ্রামের সকল বাসিন্দারই উপকৃত হবার সম্ভাবনা। পাশাপাশি ব্রহ্মদেয় গ্রামগুলিতে ব্রাহ্মণ ভূস্বামীদের অস্তিত্ব দেখা যেত। কারাশিমা চোল বংশের শেষ পর্বের পনেরোটি লেখ বিচার করে দেখিয়েছেন যে, চোল সম্রাট তৃতীয় রাজরাজের আমলে উত্তাত্তুর, তিরুপ্পাঞ্জিলী, জম্বুকেশ্বর (শ্রীরঙ্গম) প্রভৃতি অঞ্চলে (এগুলি সবই কাবেরী নদীর নিম্ন উপত্যকায় অবস্থিত) জমি কেনা বেচা হত। এই জমি ক্রয় বিক্রয়ের ঘটনাতে ‘উর’-এর উপস্থিতি চোখে পড়ে না; বরং ব্যক্তিবিশেষ জমি বিক্রী করছেন বিভিন্ন মন্দিরকে, এই ঘটনাই দেখা যায়। ব্যক্তিবিশেষ কর্ত্তৃক জমি হস্তান্তরের ঘটনা জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার ইঙ্গিতবহ। অর্থাৎ দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে দক্ষিণ ভারতেও ব্যক্তিগত মালিকানার প্রসার দেখা যায়; জমিতে আগের আমলের সামূহিক অধিকারের ধারণা এই পর্বে অনেক কমজোরী। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা ভূস্বামীর উত্থানের পক্ষে অনুকূল হয়ে উঠতে থাকে। তাই কিছু ব্যক্তি ‘কানি’ অধিকার পেতে থাকেন; ‘কানি’ বলতে জমির উপর ভোগাধিকার বোঝায়। দুটি লেখমালার ভিত্তিতে কারাশিমা দেখিয়েছেন যে, কোল্লিড়ম নদীর দক্ষিণ দিকের বাসিন্দারা যাতে করে নদীর উত্তরে কীলপালবুর এলাকায় কোনও জমি না কিনতে পারেন, তার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে। নদীর দক্ষিণ দিকের বাসিন্দা যদি ক্ষত্রিয় কুলোদ্ভবও হন (‘ইরাচুকুলবর’), তাহলেও একই রাজকীয় নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হবে। এ ছাড়া আরও বলা হয়েছে যে ‘দেবদান’ (মন্দিরের উদ্দেশে জমি দান) বা ‘পল্লিচ্চন্দ’ (জৈন বা বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে জমি দান)-এর দরুণ যে সব ব্যক্তি ভোগাধিকার থেকে উৎখাত (কুড়িনিক্কি) হয়েছিলেন, সেইসব ব্যক্তিকে তাঁদের ‘কানি’ অধিকার ফেরৎ দিতে হবে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ এখানে চিহ্নিত করা চলে। জমিতে ব্যক্তিগত অধিকারের ধারণা এত বেশী বৃদ্ধি পায় যে, এক অঞ্চলের মানুষ ব্যাপকভাবে অন্য অঞ্চলের জমি কিনে ঐ অঞ্চলের অর্থনীতিতে ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে থাকে। ক্ষত্রিয়বংশীয়রাও (অর্থাৎ চোল সৈন্যবাহিনীর উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারী) যে এইভাবে ভূস্বামী হবার চেষ্টা করছিলেন তাও বোঝা যায়। এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এক অঞ্চলের ভূস্বামীদের অপর একটি অঞ্চলে ব্যাপক জমি ক্রয়ের প্রয়াসকে বাধা দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল। অপর দিকে মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠনের উদ্দেশে ভূসম্পদ দান করার সময় সাধারণ কৃষকের জমির উপর অধিকার যে সঙ্কুচিত হত, তারও স্পষ্ট উল্লেখ এখানে আছে। ‘কানি’ ভোগাধিকারীদের উচ্ছেদের ঘটনাও এর দ্বারা প্রমাণিত। এ প্রসঙ্গে বলা উচিত কারাশিমা অবশ্য শর্মার সামন্ততন্ত্রের ছকে বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে রাজরাজ ও রাজেন্দ্ৰচোলের আমলে (৯৮৫-১০৪৪ খ্রীঃ) চোলরা যে অসামান্য সামরিক সাফল্য লাভ করেন, সেই সামরিক সাফল্য থেকে চোলবাহিনীর বহু পদস্থ আধিকারিকগণ লুণ্ঠনের মারফৎ প্রচুর সম্পদ আহরণ করেছিলেন। এই প্রভূত বিত্ত তাঁরা জমি কেনায় বিনিয়োগ করতে থাকেন। ফলে ব্যক্তিগত মালিকানা দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে। সামন্ত ব্যবস্থার তত্ত্বে নির্ভর না করেও কারাশিমা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন যে, জমিতে ব্যক্তিগত অধিকারের ধারণা বৃহৎ ভূস্বামীদের উদ্ভব ঘটায়, অন্যদিকে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রসারের দরুণ জমিতে সামূহিক অধিকার হ্রাস পায় ও কৃষিজীবী প্রজা অগ্রহার সৃষ্টির স্বার্থে জমি থেকে উৎখাত হতে থাকে।

এ পর্যন্ত যে ভূম্যধিকারীদের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে তাঁরা প্রধানতঃ ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত; অগ্রহারের দ্বারা যে প্রতিষ্ঠানগুলি উপকৃত হয় তারাও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ভূস্বামীরা যথেষ্ট ক্ষমতাবান ছিলেন; কিন্তু ভূস্বামীদের ক্ষমতার ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে যখন কোনও রাজা তাঁর অধীনস্থ সামরিক কর্মচারী বা কোনও প্রশাসককে একটি বৃহৎ ভূখণ্ডের প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিতেন। এর ফলে সামন্তদের অধিকার বিশেষ জোরালো হয়ে ওঠে। শর্মার বিচারে সামন্তদের এক একটি এলাকায় কার্যত স্বাতনন্ত্র্য দেওয়া হত; ঐ এলাকা থেকে প্রাপ্য রাজস্বের একাংশ দিয়ে সামন্তর নিজস্ব ব্যয় নির্বাহ করা হত। সামন্তব্যবস্থার উদ্ভবের আগে প্রশাসক ও সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মচারীরা সরাসরি রাজার বেতনভোগী ছিলেন। শর্মার অনুমান যে, সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় বাণিজ্যের সঙ্কোচ ও মুদ্রা ব্যবহারে হ্রাস হওয়ায় (এ প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা হয়েছে) নগদে বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা রদ হয়। তার পরিবর্তে প্রশাসক বা সামরিক কর্মচারীকে একটি এলাকার প্রশাসনিক ও রাজস্ব ভোগের অধিকার দেওয়া হয়। ফলে এই জাতীয় ব্যবস্থায় অভিজাত ভূস্বামীদের উত্থান ঘটে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এঁরা ধর্মজগতের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নন, কিন্তু বৃহত্তর এলাকার উপর তাঁরাই কর্ত্তৃত্ব করতেন। তবে অগ্রহার ব্যবস্থায় যেমন প্রদত্ত এলাকা থেকে কোনও করই রাজকোশে আসত না, অভিজাত সামন্তরা বোধহয় তাঁদের এলাকা থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর কেন্দ্রীয় শাসককে দিতেন। কিন্তু রাজার প্রাপ্য রাজস্ব নিয়মিত রাজকোশে পাঠালে এই সামন্তরা নিজ নিজ এলাকায় যথেচ্ছ কর সংগ্রহ করে নিজেদের সুযোগ সুবিধা বহু পরিমাণে বাড়াতে পারতেন। সামন্তদের জন্য এক একটি এলাকা বরাদ্দ করে দেবার মধ্যে মধ্যযুগের জাগীর ব্যবস্থার কিছু সাদৃশ্য আছে। গুর্জর প্রতিহারদের রাজ্যে সামন্তরা যে এক একটি এলাকা বংশানুক্রমিক ভাবে ভোগ করতেন (‘বংশপোতকভোগ’), তার নজীরও লেখমালায় পাওয়া যাবে। এর ফলে কি ভূমি ব্যবস্থায় কি আঞ্চলিক ক্ষমতা বিন্যাসে সামন্তদের স্বার্থ ও ক্ষমতা কায়েম হবার প্রশস্ত সুযোগ দেখা যায়। পাল রাজা তৃতীয় বিগ্রহপালের আমলে (১০৫৫-৭০) এক সামন্ত তাঁর ভোগাধিকার থেকে জমি দান করছেন বলে আমগাছি তাম্রশাসনে বলা হয়েছে। রামশরণ শর্মা এই ঘটনার মধ্যে এক সামন্ত দ্বারা উপস্বত্বভোগী ক্ষুদ্রতর বা অধীনস্থ সামন্ত সৃষ্টির নজীর দেখেছেন। এই জাতীয় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কাঠামো, সম্পদ সংগ্রহের ব্যবস্থা ও সম্পদ বিতরণের প্রক্রিয়া–—কোনও ক্ষেত্রেই কেন্দ্রাভিগতা থাকে না; সমস্ত রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকৃত রূপ ধারণ করে। তার দরুন রাজার সার্বভৌম ক্ষমতার হ্রাস ও খণ্ডীকরণ দ্রুত ঘটতে থাকে। এই প্রসঙ্গে সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিতম্‌’ কাব্যের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে (এই কাব্যের প্রতি শ্লোকের দুই অর্থ: প্রথম অর্থে, অযোধ্যার রামচন্দ্রের কাহিনী; দ্বিতীয় অর্থে, তা পাল বংশীয় রামপালের প্রশস্তি)। পালবংশের অন্তিম পর্বে উত্তরবঙ্গে কৈবর্ত্ত বিদ্রোহ ঘটলে উত্তরবঙ্গ বা বরেন্দ্রভূমি (যা পাল সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান অঞ্চল) পালদের অধিকারচ্যুত হয়। পালদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য রামপাল বিশেষভাবে উদ্যোগ নেন। কিন্তু পালদের শক্তি তখন এই পরিস্থিতি সামাল দেবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। তাই রামপাল ‘সামন্তচক্রে’র সাহায্য নিতে বাধ্য হন। এই সামন্তদের নাম রামচরিতে উল্লিখিত। ধর্মপাল ও দেবপালের আমলে যে পাল সাম্রাজ্য পূর্ব ভারতে ক্ষমতার তুঙ্গে উঠেছিল, সেই বংশের রামপালকে যেভাবে বহু ভূসম্পদ ও অন্যান্য সম্পদ দান করে সামন্তরাজাদের সমর্থন যোগাড় করতে হয় তাতে সামন্তদের প্রতিপত্তি সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। রামপাল তাঁর সামগ্রিক রাজকীয় আধিপত্য হয়তো বজায় রাখতে পেরেছিলেন, কিন্তু তার বিনিময়ে বহু সম্পদ ঐ সামন্তদের দিতে হয়। এর ফলে সামন্তদের প্রতিপত্তি ও সম্পত্তি দুই-এরই বৃদ্ধি ঘটা নিতান্ত স্বাভাবিক।

ভূমিব্যবস্থায় অন্তর্বর্তীর উদ্ভব ঘটলে তার প্রতিকূল প্রভাব কৃষকের উপর পড়তে পারে। রামশরণ শর্মা ও যাদব সমকালীন নথিপত্র বিচার করে এই মত দিয়েছেন যে, কৃষকের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। সামন্ত ব্যবস্থার পূর্বে গৃহপতি (‘গহপতি’), কুটুম্বী প্রভৃতি শব্দ দ্বারা কৃষক তথা রায়তকে বোঝানো হত; কৃষকের হাতে কিছু জমির মালিকানা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু আদি মধ্যযুগের তথ্যসূত্রে এই কথাগুলি দেখা যায় না; তার বদলে কৃষকের প্রতিশব্দ ‘হালকর’ বা ‘বদ্ধহল’। এই দুই কথার তাৎপর্য এই যে, কৃষক শুধুমাত্র জমি চাষই করেন, জমির মালিকানা বোধহয় তাঁর ছিল না। পদ্মপুরাণে চাষীদের (‘কৃষিবলজনাঃ’) চূড়ান্ত দারিদ্র্যের বাস্তবানুগ বর্ণনা পাওয়া যায় (১১.৩৫০)। একই গ্রন্থে কৃষকদের (‘ধনোজ্জিতাঃ’) দারিদ্র্য ও সম্পন্ন ভূস্বামীদের (অক্ষীনধনসম্পন্নাঃ) বিলাসবহুল জীবনের মধ্যে দুস্তর ব্যবধানও উল্লিখিত (৩১.৭০)। স্কন্দপুরাণের নাগরখণ্ড (৬.২৭.৯৬) ইঙ্গিত করা হয়েছে যে কলিযুগে রাজারা চাষীদের পীড়ন করবেন (‘ভূপালাঃ পীড়য়িষ্যন্তি কর্ষকান্‌’)। এই পীড়ন মূলতঃ কর ও নানা প্রকার আইনবহির্ভূত উপঢৌকন আদায় করে চলতে থাকে। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের লেখমালায় উল্লিখিত করের সংখ্যাবৃদ্ধি আমাদের নজর এড়ায় না। কারাশিমা ও সুব্বারায়ালু চোল আমলের কর সংক্রান্ত পরিভাষাগুলি পরীক্ষা করেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত করেছেন যে, করের বহর উত্তরোত্তর বাড়ছিল। লেখমালায় করের তালিকায় প্রায়ই ‘আদি’ বা ‘আদিকম্‌’ কথাটি যুক্ত হয়েছে। এর ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর আদায় করেও অতিরিক্ত কর তোলার অধিকার জোরালো হত। এই জাতীয় ব্যবস্থায় কৃষকের আর্থিক দুর্গতি যে ঘটবে, তাতে বিশেষ দ্বিমত নেই। দান গ্রহীতাকে নির্দিষ্ট কর ছাড়াও ‘উচিত অনুচিত’ কর ও ‘বিষ্টি’ (বেগার প্রথা) ব্যবহারের যথেচ্ছ সুযোগ তাম্রশাসনে দেওয়ার রেওয়াজ অজানা নয়। কর আদায় ও ‘সর্বপীড়া’ কথাটি তাম্রশাসনে কার্যতঃ সমার্থক। কৃষকের অবস্থার যে কতটা অবনতি ঘটেছিল তার ইঙ্গিত কলহন বিরচিত কাশ্মীরের ইতিহাস রাজতরঙ্গিণীতে দেখা যাবে। কাশ্মীরের রাজাদের অন্যতম প্রধান নীতি ছিল, ন্যূনতম গ্রাসাচ্ছদনের সংস্থানটুকু রেখে দিয়ে কৃষকের কাছ থেকে বাকী যাবতীয় উদ্বৃত্ত নিয়ে নেওয়া; এর অন্যথা ঘটলে কৃষকরা মাত্র এক বছরের মধ্যেই ক্ষমতাবান হয়ে উঠে রাজকীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। এমন আশঙ্কাও রাজতরঙ্গিণীতে উচ্চারিত (৪.৩৭০ ক্রমশঃ)। তাই পদ্মপুরাণে ‘কীনাশ’ বা চাষীকে এতটাই অবনত অবস্থায় দেখা যায় যে তারা প্রবজ্যা নেবারও অনুপযুক্ত (‘গ্রামক্ষেত্রাদিসক্তস্য প্রব্রজ্যা কা হতাত্মান’:পদ্মপুরাণ ৩.২৯৫ ও ৫.২৩১’)। ক্ষেমেন্দ্র তাঁর নীতিকল্পতরুতে জানিয়েছেন যে ‘কীনাশ’ সাক্ষী হিসাবে বিশ্বাসযোগ্য নয় (‘ন জাতু প্রত্যয়ঃ কাৰ্য্যঃ কীনাশোক্তৌ কথঞ্চন’, পৃঃ ১৪৭)। যাদব দেখিয়েছেন কৃষকের বর্ণনা রয়েছে ‘আশ্রিত হালিক’ হিসেবে; আর বৃহন্নারদীয় পুরাণে কলিযুগের কৃষক যে ‘বদ্ধহল’ (৩৮.৪৩), এই বর্ণনা কৃষকের অবনয়নেরই নজীর। শর্মা ও যাদব ‘আশ্রিতহালিক’ ও ‘বদ্ধহল’ প্রভৃতি শব্দের মধ্যে কৃষকের ভূমিতে আবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা দেখেছেন। সামন্ত উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষকের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ক্রমেই বিপন্ন হয়ে পড়ে। তবে কৃষক, ইওরোপের মধ্যযুগীয় ভূমিদাসের পর্যায়ে পৌঁছেছিল কি না, এ বিষয়ে শর্মা ও যাদবের সন্দেহ আছে। সুভাষিত রত্নকোশের একটি কাহিনী থেকে কোসাম্বী দেখিয়েছিলেন যে এক ভোগপতির পীড়নমূলক করের চাপে ও বিবিধ দমনের ফলে কৃষকরা তাঁদের এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। কর ব্যবস্থা চূড়ান্ত অত্যাচারী হয়ে উঠলে কৃষক যেখানে স্থান ত্যাগ করতে পারতেন, সেখানে ইওরোপীয় ভূমিদাসের মত তিনি পাকাপাকিভাবে জমিতে আবদ্ধ বোধ হয় ছিলেন না।

পীড়ন ও দমনের মাত্রা সীমা ছাড়ালে কৃষক কি ভূম্যধিকারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত? এমন সম্ভাবনার প্রতি যাদব ইঙ্গিত করেছেন। যশস্তিলক চম্পূ (পৃঃ ৪৫৬) তে বলা আছে যে অতিরিক্ত বিষ্টি বা বেগার শ্রম চাপাবার বিরুদ্ধে সামন্ত প্রভুর বিরুদ্ধে প্রজারা প্রতিবাদ জানিয়েছিল; কিন্তু প্রতিবাদকারীরা মৃত্যুবরণ করে। এই বর্ণনায় হয়তো কৃষকদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দুই এরই ইঙ্গিত আছে। পাল আমলে কৈবর্ত্ত বিদ্রোহকে শর্মা ও যাদব কৃষকদের প্রতিরোধ বলে মনে করেন। কৈবর্ত্ত জাতি সাধারণত কৃষিজীবী ছিল; রামচরিতের বর্ণনার উপর ভিত্তি করে শর্মা দেখিয়েছেন যে তারা মহিষের পিঠে চড়ে ও অতি সাধারণ অস্ত্র দিয়ে পালদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। তাদের সংগ্রামের বর্ণনা থেকে শর্মার অনুমান, কৃষকদের তরফ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান ঘটেছিল; কিন্তু অধিকতর সংগঠিত ও পরাক্রান্ত পাল সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয় ও ফলে তাদের পরাজয় অনিবার্য ছিল। এই প্রসঙ্গে অবশ্যই বলা উচিত যে রামচরিতকার সন্ধ্যাকরনন্দী কিন্তু কোথাওই স্পষ্টভাবে কৈবর্ত্ত বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ রূপে অভিহিত বা বর্ণনা করেননি। কৈবর্ত্ত বিদ্রোহের নেতা দিব্য–—যিনি পালদের পদস্থ কর্মচারী ছিলেন–—জাতিতে কৈবর্ত্ত, এই কথা রামচরিতে আছে। কিন্তু তারা দ্বারা প্রমাণ করা শক্ত যে, দিব্য সমস্ত নিপীড়িত কৃষক সমাজের নেতা হিসেবে পাল রাজা ও ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন। বহুকাল পূর্বে রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখিয়েছিলেন দিব্য জাতিতেই কৈবর্ত্ত ছিলেন, কৈবর্ত্ত সমাজের মুখপাত্র ছিলেন না। বরেন্দ্র অঞ্চলে তাঁর ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রদের সাময়িক ক্ষমতা দখলে সাফল্য প্রকৃতপক্ষে এক সুযোগসন্ধানী প্রশাসকের উচ্চাভিলাষকেই চিহ্নিত করে। হেমচন্দ্রের দ্ব্যাশ্রয়কাব্যের উপর অভয়তিলকগণির যে টীকা রচিত হয় (ত্রয়োদশ শতক), সেখানে কর্ষকদের ‘শ্রেণী’ বা বৃত্তিজীবী সংগঠনের কথা বলা হয়েছে; টীকায় আরও দেখানো হয়েছে ঐ সংগঠনের কৃষিজীবী সদস্যগণ কাঠের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করতেন (‘কাষ্ঠময়ং শস্ত্রম্‌’)। এই তথ্যের মধ্যেও কৃষকদের অস্ত্রধারণের প্রবণতা নজর করা যায়। সামন্ত ব্যবস্থা অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার দরুন, শর্মা ও যাদবের যুক্তি অনুযায়ী, কৃষকের উপর করভার ও অন্যান্য দমনমূলক নীতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। কৃষক তার স্বাতন্ত্র্য হারায় ও কার্যত ‘বদ্ধহল’ বা ‘আশ্রিত হল’ কীনাশে পরিণত হয়। অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়ালে নিপীড়িত কৃষক সামন্ত প্রভুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলত।

সামন্ত ব্যবস্থা একান্তভাবে কৃষি অর্থনীতির উপর আশ্রয় করে বিকশিত হয়েছিল বলে শর্মা মনে করেন। কৃষির উপর এতটা প্রাধান্য ও নির্ভরশীলতার দৃষ্টান্ত পূর্ববর্তী আমলে বিশেষ নেই। বৃদ্ধহারীত (৭.১৮৯) বিধান দিয়েছেন যে কৃষিই সর্ববর্ণের পক্ষে শ্রেয় বৃত্তি (‘সামান্য ধর্ম’)। দশম শতকে সোমদেব রচিত নীতিবাক্যামৃতম্‌-এ কৃষির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করা হয়েছে (‘তস্য খলু সংসারসুখং যস্য কৃষি’)। অন্যান্য বৃত্তির তুলনায় কৃষির উপর অত্যধিক গুরুত্ব দান কি শিল্প ও বাণিজ্যের অবক্ষয় সূচনা করে? অন্তত রামশরণ শর্মা ও যাদব এই রকম ইঙ্গিতই করেছেন। বিষ্ণুপুরাণে (৬.১.৩৬) বলা হয়েছে কলিযুগে বৈশ্যদের সামাজিক ও আর্থিক অবনতি ঘটবে, তাঁরা বাণিজ্য ও কৃষিকর্ম ত্যাগ করে দাস ও কারিগরের হীন বৃত্তিতে যুক্ত থাকবেন (‘কারুকর্মোপজীবিনঃ’)। স্কন্দপুরাণে (৩.২.৩৯.২৯১) এই প্রসঙ্গে আরও স্পষ্ট উক্তি আছে: কলিযুগে বৈশ্যরা বাণিজ্য ত্যাগ করে তেলী হবেন (‘তৈলকারাঃ’) ও ধান ঝাড়াই মাড়াই করবেন (‘তণ্ডুলকারিণঃ’)। পুরাণের উক্তিতে বৈশ্যের তথা বাণিজ্যিক অবক্ষয়ের যে আভাস পাওয়া যায় তা, শর্মার মতে বাস্তব পরিস্থিতিকেই বোঝায়। রোম-ভারত বাণিজ্যের অবসান ঘটায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের ভূমিকা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল; এই দুরবস্থার অভিঘাত সামগ্রিকভাবে বাণিজ্যিক ব্যবস্থার উপরই পড়েছিল। খ্রীঃ ৬০০-৯০০ পর্যায়ে শর্মা ও তাঁর অনুগামীরা সমকালীন তথ্যসূত্রে বাণিজ্য ও বণিকের স্বল্পতর উল্লেখ দেখেছেন। অগ্রহার ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশের ফলে যে স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির জন্ম হয়, সেখানে লেনদেন হবার মত পণ্য যথেষ্ট উৎপাদন হত না। গ্রামের উৎপাদন গ্রামেই ভোগ করা হত। এই অবস্থা বাণিজ্যের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে পড়ে। তাই পুরাণগুলিতে বৈশ্যদের অবনতির বর্ণনা পুরাণকারদের বাস্তব দৃষ্টির পরিচায়ক বলে শর্মা মনে করেন। বাণিজ্যিক অবক্ষয়ের সবচেয়ে প্রধান প্রমাণ হিসেবে শর্মা মুদ্রা ব্যবহারে ব্যাপক হ্রাসের ঘটনাকে উপস্থাপিত করেছেন। এর পূর্ববর্তী আমলেই বাকাটক ভূখণ্ডে মুদ্রা রহিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব দেখা গিয়েছিল। আদি মধ্যযুগে পাল সেন রাজারা মুদ্রা প্রস্তুত করেননি; প্রবল প্রতাপান্বিত রাষ্ট্রকূট সম্রাটদের নামাঙ্কিত কোন মুদ্রাও পাওয়া যায়নি। গুর্জর প্রতিহারদের কোনও কোনও রাজা মুদ্রা চালু করেন, কিন্তু এই মুদ্রাগুলির ধাতব বিশুদ্ধি ও ওজনের স্থিরতা অনিশ্চিত; ফলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই মুদ্রাগুলির উপযোগিতা সন্দেহাতীত নয়। শর্মার ধারণা অনুযায়ী মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতি কার্যতঃ ৬০০-১০০০ খ্রীঃ-এর সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিনিময় ব্যবস্থায় মুদ্রার স্থলাভিষিক্ত হয় কড়ি যা তাম্রশাসনে কপর্দক বলে বারবার উল্লিখিত। খ্রীঃ প্রথম তিন শতকে মুদ্রার প্রচলন ব্যাপক ছিল, কারণ আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যথেষ্ট। কড়ি দ্বারা ব্যবসা বাণিজ্য চললে দূর দূরান্তরের দেশের মধ্যে নিয়মিত বাণিজ্য চলা কঠিন বলে শর্মার ধারণা। ফলে যতটুকু বাণিজ্য চলত তা স্থানীয় ভিত্তিতে হত; তার দ্বারা সামন্ত ব্যবস্থায় উদ্ভূত আবদ্ধ স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতির অবসান ঘটানো সম্ভব ছিল না। মুদ্রাশ্রয়ী অর্থনীতি শর্মার ব্যাখ্যা অনুযায়ী রক্তাল্পতার (‘মানিটারী অ্যানিমিয়া’) শিকার হয়। ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন ও লেনদেনে ভাঁটা পড়ছিল।

গ্রামকেন্দ্রিক স্বনির্ভর অর্থনীতিতে ভোগপণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার যেমন কমে যেতে পারে, তেমনই কারিগরী শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে নগরের অস্তিত্ব হয়তো আপেক্ষিকভাবে কম প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিতে পারে। জিনপ্রভসুরির বিবিধার্থকল্পের একটি উদ্ধৃতি (পৃঃ ৩৯) ব্যবহার করে যাদব দেখিয়েছেন যে আদি মধ্যযুগে নগরগুলি গ্রামের আকার নেয় (‘নয়রাণি গামভূ-আণি হোহিন্তি’)। এই সাক্ষ্য নগরায়নের অবক্ষয়ের পরিচয় দেয়। নগরায়নের অবক্ষয় যে খ্রীঃ ৩০০-১০০০-এর সময়সীমায় প্রায় সর্বভারতীয় রূপ নিয়েছিল, সেই বিষয়ে সাম্প্রতিকতম গবেষণা শর্মা করেছেন। শর্মার মতে দ্বিতীয় দফার নগরায়ন তুঙ্গে উঠেছিল খ্রীষ্টীয় প্রথম তিনশতকে। হিউয়েন সাঙ এর বিবরণী ব্যবহার করে তিনি প্রমাণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন যে, গাঙ্গেয় উপত্যকার বহু সমৃদ্ধ নগর নিঃসন্দেহে দ্রুত অবক্ষয়ের পথে চলছিল। এগুলির মধ্যে। কৌশাম্বী, শ্রাবস্তী, কপিলবস্তু, রামগ্রাম, কুশীনগর, বৈশালীর মত বিখ্যাত নগর অন্তর্ভুক্ত। এই সব নগর চীনা পরিব্রাজকের বর্ণনায় কার্যত ধুঁকছিল, কিছু নগর প্রায় পরিত্যক্ত ও কয়েকটি শহর প্রকৃতপক্ষে গ্রামে পরিণত। রামশরণ শর্মা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বহুল ব্যবহার ও পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন, খ্রীঃ চতুর্থ-পঞ্চম শতক থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকার শহরগুলিতে পুরাতন ইঁটের ব্যবহার বেশী মাত্রায় হতে থাকে; নগর পরিকল্পনায় ও বিন্যাসে প্রাণহীনতার ছাপ ফুটে ওঠে এবং অনেকগুলি নগরে খ্রীঃ চতুর্থ পঞ্চম শতকের পর জনবসতির অস্তিত্বই নষ্ট হয়ে যায়। এই জাতীয় নগরে মধ্যযুগের সূচনায় আবার জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। গাঙ্গেয় উপত্যকায় নগরের অবক্ষয়ের যে ছকটি শর্মার লেখনীতে উপস্থাপিত, তারই প্রায় অনুরূপ অবস্থা উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা গিয়েছিল। যে নগরায়ন খ্রীঃ তৃতীয় শতকে সর্বভারতীয় আকার নেয়, সেই নগরায়নের গতি চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে ব্যাহত হয়। অধিকাংশ নগরের পুরাতাত্ত্বিক অবশেষ থেকে শর্মা দেখাতে চেয়েছেন যে, শহরগুলি আদি মধ্যযুগে ক্রমশঃই হতদরিদ্র হতে থাকে এবং অধিকাংশ শহরাঞ্চলে চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের পর থেকে একাদশ দ্বাদশ শতকের আগে পর্যন্ত বসতি বিলুপ্ত হয়ে যায়; অর্থাৎ নগরগুলি কার্যতঃ পরিত্যক্ত হয়েছিল। নগরের এই অবক্ষয়কে শর্মা সামন্ত ব্যবস্থার অন্যতম লক্ষণ হিসেবে বিচার করেন; বাণিজ্যের তিরোধান–—বিশেষত বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্রমহ্রাসমানতা–—নগরের অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে। নগর জীবন যে আদি মধ্যযুগে একেবারে উধাও হয়ে গেল তা নয়। শর্মার বিচাবে আদি মধ্য পর্বের শহরগুলি মূলতঃ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র, অথবা তা স্থায়ী ও অস্থায়ী সামরিক ছাউনিমাত্র (যা সমকালীন তাম্রশাসনে ‘জয়স্কন্ধাবার’ বলে অভিহিত)। তীর্থক্ষেত্রগুলিও নগরের আখ্যা পেতে থাকে। কিন্তু কারিগরী উৎপাদন ও পণ্য বিনিময়ের এলাকা হিসেবে নগরের যে বিশিষ্ট ভূমিকা তার সুযোগ আদি মধ্যযুগে অত্যন্ত অল্প। অর্থাৎ সম্পদের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় নগরের সক্রিয় আর্থিক ভূমিকা, এই আমলে ক্রমক্ষীয়মান। শর্মার ধারণা অনুযায়ী মুদ্রাব্যবস্থার মতই নগরজীবনেও রক্তশূন্যতা (‘আর্বাণ অ্যানিমিয়া’) দেখা দিয়েছিল।

শর্মা ও যাদবের গবেষণায় আদি মধ্যযুগের অর্থনীতির যে লক্ষণগুলি শনাক্ত করা যায় তা নিম্নরূপ: (১) অগ্রহারের অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের দরুন যৌথ মালিকানার বদলে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা, নানা স্তরে বিভক্ত ভূম্যধিকারী শ্রেণীর উদ্ভব; (২) এর দরুন কৃষকের রায়তী অধিকারে ব্যাপক হস্তক্ষেপ ও কৃষকের স্বাতন্ত্র্য বিনাশ, কৃষক কার্যতঃ ‘বদ্ধহল’ বা ‘আশ্রিত হালিক’ পর্যায়ে অবনমিত; (৩) কারিগরী শিল্পের পরিমাণ হ্রাস, কারিগর ও নানা বৃত্তিতে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ ক্রমেই মন্দির বা সামন্তপ্রভুর স্বার্থে ব্যবহৃত; (৪) ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বল্পতা–—বিশেষতঃ বৈদেশিক বাণিজ্যে সংকোচন–— যার ফলশ্রুতি হিসাবে মুদ্রারহিত অর্থনীতির প্রাধান্য; (৫) সামগ্রিকভাবে এক স্বনির্ভর, আবদ্ধ, জড়বৎ গ্রামীণ অর্থনীতির প্রকাশ, যে পরিস্থিতিতে শিল্পোৎপাদন ও বিনিময়ের কেন্দ্ররূপে নগরের তাৎপর্য হ্রাস ও নগরের দ্রুত অবক্ষয়। আগেই বলা হয়েছে শর্মা ও যাদব সামন্ত ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও ভাঙ্গনের নজীর দেখেছেন ১০০০-১২০০ খ্রীষ্টাব্দে। সামন্ততন্ত্রের প্রভাবে শর্মার মতে সমগ্র উপমহাদেশে এক সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবক্ষয় দেখা গিয়েছিল।

॥ ৩ ॥

তথ্য ও তত্ত্বের বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ ঘটিয়ে শর্মা আদি মধ্যকালীন অর্থনৈকি জীবনযাত্রার যে ছক উপস্থাপিত করেছেন, তার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু গোড়াতেই বলা হয়েছে শর্মার অনুমান ও সিদ্ধান্তগুলি সর্বগ্রাহ্য নয়, বরং বিতর্কিত। সামন্তপ্রথার প্রভাবে অর্থনৈতিক জীবনে যে মন্দা বা অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল বলে শর্মা মনে করেন, তার প্রতিবাদে দীনেশচন্দ্র সরকার ও হবরন্স মুখিয়া বিশেষভাবে সোচ্চার। দীনেশচন্দ্র সরকার আদি মধ্যযুগীয় তাম্রশাসনগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে অগ্রহার ব্যবস্থা রাজকীয় প্রতাপহ্রাস ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয় না। অগ্রহার ব্যবস্থায় দানগ্রহীতা কর ভোগের অধিকার নিশ্চয়ই পেতেন; কিন্তু তার দরুণ রাজার অর্থনৈতিক ক্ষয় ক্ষতি হত কিনা, এ ব্যাপারে দীনেশচন্দ্র সরকার সন্দেহ পোষণ করেন। তাঁর যুক্তি এই যে দানগ্রহীতা কেবলমাত্র কর ভোগের অধিকারী ছিলেন, কিন্তু কর সংগ্রহ করার ক্ষমতা ও অধিকার তাঁর ছিল না। সরকারের অভিমত, লেখমালায় এমন কোনও স্পষ্ট প্রমাণ নেই যার দ্বারা দেখানো যায় যে কর সংগ্রহের প্রশাসনিক অধিকারও রাজা দানগ্রহীতার অনুকূলে ত্যাগ করেছিলেন। তিনি এই মতে বিশ্বাসী যে অগ্রহারের ফলে রাজার প্রাপ্য যে রাজস্ব রহিত হত, তার খানিকটা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা ছিল। ভূম্যধিকারী বা ভূম্যধিকারীর পৃষ্ঠপোষক কোন ব্যক্তি রাজকোশে থোক টাকা দান করতেন, তার ভিত্তিতেই কোনও এলাকায় কর মকুব করা হত। এছাড়াও সরকার অনেকগুলি ‘করশাসনের’ নজীর হাজির করেন। ‘করশাসন’ এমন এক রাজকীয় আদেশনামা যার দ্বারা অগ্রহার এলাকা থেকেও কর সংগ্রহ করা হত; ওড়িষ্যাতে এই প্রকার কর শাসনের সংখ্যাধিক্য দেখা যায়। দীনেশচন্দ্র সরকার তাই অগ্রহার সৃষ্টি ও রাজকোশের সঙ্গীন অবস্থার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক মানেন না। প্রকৃতপক্ষে তিনি অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের ব্যাখ্যায় আস্থাবান নন। তাঁর ধারণা খ্রীঃ ৬৫০-১২০০-র অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যবস্থা প্রাক ৬৫০ খ্রীঃ পর্বের থেকে বিশেষ পৃথক ছিল না। তিনি ৬৫০-১২০০ খ্রীঃ-এর সময়সীমায় অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যই দেখেছেন। অগ্রহার ব্যবস্থায় ভূম্যধিকারীরা সরকারের বিচারে, প্রকৃতপক্ষে জমিদারদের সমতুল্য, মধ্যস্বত্ব বা উপস্বত্ব ভোগী ভূস্বামী নন। তবে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের নজীর দেখাতে গিয়ে সরকার বহুক্ষেত্রেই বিভিন্ন রাজবংশের সৈন্যবাহিনীর বিশাল আকার, সম্পন্ন সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধ জীবনের আলেখ্যকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সামন্ত ব্যবস্থায় আর্থিক চাপ রাজা বা ভূস্বামীদের উপর কম পড়েছিল, এই চাপের সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছিল সাধারণ কৃষক। এই বিষয়ে দীনেশচন্দ্র সরকারের মতামত খুব নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট নয়। দীনেশচন্দ্র সরকার যদিও আদি মধ্যযুগে সামন্তপ্রথার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না, তিনি কিন্তু আদি মধ্যযুগের প্রসঙ্গে বহুবার করদ ও অধীনস্থ সামন্ত রাজার বা ‘ফিউডেটরী’র উল্লেখ করেছেন। অভিজাত বংশীয় ব্যক্তিরা যে ‘ইনাম’ হিসেবে ভূখণ্ড পেতেন, তাকেও সরকার ‘ফিফ’ শব্দ দ্বারাই চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু ‘ফিউডেটরী’ ও ‘ফিফ’ জাতীয় পরিভাষাগুলি সামন্ততন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতেই ব্যবহৃত হয়।

দীনেশচন্দ্র সরকারের মতই হরবন্স মুখিয়া রামশরণ শর্মার ভারতীয় সামন্ত ব্যবস্থার তত্ত্ব মানেন না। মুখিয়ার মতে আদি মধ্যযুগ ও মধ্যযুগে কৃষক উৎপাদনের উপকরণগুলির উপর পূর্ণ কর্ত্তৃত্ব বজায় রেখেছিল। উৎপাদনের উপকরণের উপর সামন্ত বা ভূম্যধিকারীর যদি নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা না থাকে তাহলে সামন্ত ব্যবস্থাসুলভ কৃষক পীড়ন ঘটা সম্ভব নয়; তার ফলে ভূস্বামী ও কৃষকের ভিতর আধিপত্য-অধীনতার সম্পর্কও দানা বাঁধতে পারে না। আদি মধ্যযুগের কৃষকের অবস্থা যে ইওরোপের ভূমিদাসের মত ভূমিতে অনড় অটল বদ্ধ হয়ে দেখা দিয়েছিল, তার কোনও প্রমাণ পেশ করা যায় না। কার্যত এই পর্বের উৎপাদন ব্যবস্থায় ‘ভূমিদাস’ শ্রেণীর অস্তিত্ব ও ভূমিকা অনুপস্থিত; ভূমিদাসের উপস্থিতি ও কৃষক ও ভূস্বামীর সম্পর্কে আধিপত্য-অধীনতা না থাকলে সেই উৎপাদন ব্যবস্থাকে সমস্ত অভিধায় চিহ্নিত করতে হরবন্স মুখিয়া রাজী নন। সামন্ত ব্যবস্থায় চুক্তির গুরুত্বও অনস্বীকার্য: চুক্তির দ্বারাই রাজা ও সামন্তপ্রভুর মধ্যে আধিপত্য-আনুগত্যের সম্পর্ক নির্ধারিত হয়; একইভাবে ভূস্বামী ও কৃষকের মধ্যে চুক্তি বলবৎ থাকলে তবে জমির উপর ভূস্বামীর ব্যাপক কর্ত্তৃত্ব ও কৃষকের ‘আশ্রিতহালিক’ সুলভ অবস্থা দেখা দিতে পারে। কিন্তু সামন্ত ব্যবস্থার এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ–—প্রায় অপরিহার্য–—উপাদান আদি মধ্যযুগে প্রায় দেখাই যায় না। কি শর্তে ভূস্বামী ‘আশ্রিতহালিক’ কৰ্ষককে জমি চাষ করতে দেন, কি শর্তে তাকে উৎখাত করা যায় জমি থেকে, কি শর্তেই বা অধিপতি সামন্তের রাজনৈতিক সম্পর্ক সক্রিয় থাকে, এ বিষয়ে সমকালীন তথ্যসূত্রগুলি প্রায় নীরব; বিশেষত এই আলোচনার পক্ষে সবচেয়ে প্রধান তথ্যসূত্র তাম্রশাসনগুলিতে চুক্তি সংক্রান্ত কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। চুক্তি সংক্রান্ত তথ্যের এই বিরলতা কার্যত চুক্তি প্রথার অনুপস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত করে। ভূস্বামী ও কর্ষকের মধ্যে শতাধীন সম্পর্কের তথ্য যেখানে এত সামান্য, যেখানে সামন্ত ও অধিপতির মধ্যে চুক্তির নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই, সেখানে সামন্ত ব্যবস্থার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ থাকা অস্বাভাবিক নয়।

এ কথা আগে বলা হয়েছে যে তাম্রশাসনের মাধ্যমে ভূসম্পদ হস্তান্তরের যে সব নজীর আমাদের জানা আছে, তার অনেকগুলি জমিই অনাবাদী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। প্রাচীন বাংলার তাম্রশাসনগুলিতে (বিশেষত প্রাক-পাল লেখমালায়) অনাবাদী জমি পুরোহিত, ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ বিহারকে হস্তান্তর করার ঘটনা বেশী করে দেখা যায়। সপ্তম শতকে প্রাচীন শ্রীহট্টে (বর্তমান সিলেট, বাংলাদেশ) সামন্ত লোকনাথ দুইশত ব্রাহ্মণকে যে বিশাল অগ্রহার ক্ষেত্র দান করেন, তা অবস্থিত ছিল এক গহন অরণ্যে। লোকনাথের টিপেরা তাম্রশাসনে (সম্ভবত ৬৬৫ খ্রীঃ) কমপক্ষে তিনবার বলা হয়েছে যে ঐ অরণ্য হিংস্র শ্বাপদে পরিপূর্ণ ও ঐ অরণ্যে আদিম ও কৃত্রিমে কোনও প্রভেদ নেই। শেষ বর্ণনার তাৎপর্য এই যে ঐ অরণ্যে ব্রাহ্মণ বসতি গড়ে ওঠার আগে কোনও জনবসতি ও কৃষিকর্ম ছিল না। একইভাবে অষ্টম শতকে সামন্ত মরুণ্ডনাথ ভগবান অনন্তস্বামীর (=বিষ্ণু) উদ্দেশে মন্দির নির্মাণ করান এক জলা ও জঙ্গুলে জায়গায় (‘জলাটবীভূখণ্ড’)। এই রকম আরও নিদর্শন হাজির করা সম্ভব। অরণ্য বা অনাবাদী অঞ্চলে ব্রাহ্মণ বসিয়ে বা মন্দির নির্মাণের জন্য অগ্রহার ক্ষেত্র সৃষ্টি করলে ঐ অঞ্চলে ধর্মজগতের লোকেরাই শুধু আসবেন না; যেহেতু পুরোহিত শ্রেণীর মানুষ সচরাচর কৃষি উৎপাদন বা অন্য কোনও কায়িকশ্রম করেন না, ফলে ঐ অরণ্য বা অনাবাদী এলাকায় ব্রাহ্মণ ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে কর্ষক, নানা বৃত্তিধারী গোষ্ঠীকেও বসাতে হত। এইরকম একটি বিশাল জনবসতি খ্রীষ্টীয় ৯৩০ সালে শ্রীহট্টে চন্দ্ররাজা শ্রীচন্দ্রের আনুকূল্যে গড়ে ওঠে; এই বিশাল ‘ব্রহ্মপুরে’ বা ব্রাহ্মণ বসতিতে ছয় হাজার ব্রাহ্মণ (সংখ্যার ক্ষেত্রে অতিশয়োক্তি থাকার সম্ভাবনা) ও বহু বৃত্তিধারী মানুষকে জমিজমা দিয়ে বসানো হয়। অগ্রহার দানের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অনাবাদী অঞ্চলকে আবাদী অঞ্চলে পরিণত করা হত। কৃষি অর্থনীতির বিস্তারে অগ্রহার ব্যবস্থা সহায়তাই করেছিল। রামশরণ শর্মাও একথা স্বীকার করেন যে, তাম্রশাসনের দ্বারা অগ্রহার সৃষ্টির ফলে বিস্তীর্ণ অনুৎপাদক এলাকা কৃষি অর্থনীতির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছিল। অতএব অগ্রহার সৃষ্টির দ্বারা সম্পদ হ্রাসের বদলে কৃষি অর্থনীতি মজবুত হয়ে ওঠার সম্ভাবনাই অধিকতর বলে মনে হয়। দক্ষিণ ভারতে পল্লব আমলে একই ভাবে অরণ্য ধ্বংস করে বসতি নির্মাণ ও কৃষির প্রসারের ঘটনা জানা যায়।

কৃষির প্রসার ঘটেছিল, এ কথা মেনে নিলে আদি মধ্যযুগে কৃষির ব্যাপক সাফল্যকেই স্বীকার করতে হয়। এই পর্বে রচিত কৃষিপরাশর, কৃষি সূক্তি প্রভৃতি গ্রন্থ কৃষিবিদ্যা সম্বন্ধে রচনা করা হয়। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে কৃষি অর্থনীতির গুরুত্বকেই প্রমাণ করে। শূন্যপুরাণে বলা হয়েছে অন্ততঃ পঞ্চাশ রকমের ধান প্রাচীন বাংলায় উৎপন্ন হত। মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত জবলপুরের কাছে পাওয়া বিলহরি লেখতে (৯৭৫ খ্রীঃ) শাক ও বেগুনের (‘শাকবার্তাকু’) উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলে নারিকেলের ফলন ছিল সুপ্রচুর; লেখমালায় এই ফলের নিয়মিত উল্লেখ দেখা যাবে। দক্ষিণ ভারতে, কোঙ্কন উপকূলে, আসাম ও দঃ পূঃ বাংলায় সুপারি (‘গুবাক’) উৎপাদনের ভূরিপরিমাণ নজীর লেখমালায় উপস্থিত। সুপুরির পাশাপাশি পানের চাষও নিয়মিত দেখা যেতে থাকে। দক্ষিণ ভারতের পানের চাষ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আদি মধ্যযুগে বাংলার একটি লেখতে ‘বারজিক’-এর উল্লেখ আছে, দীনেশচন্দ্র সরকার ‘বারজিক’ শব্দটি ‘বরজ’ বা পানের বরজের চাষী বা মালিক অর্থে গ্রহণ করেছেন। পণ্যশস্যের তালিকায় আরও দুটি নাম অবশ্যই যুক্ত হবে: কার্পাস ও তৈলবীজ। গুজরাট, দাক্ষিণাত্যে কার্পাস উৎপাদনের অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল, কারণ এই অঞ্চলের কৃষ্ণমৃত্তিকা তুলো চাষের পক্ষে বিশেষ সহায়ক। সমকালীন লেখমালা ও বৈদেশিক বিবরণীতে এই এলাকায় তুলো উৎপাদনের প্রমাণ রয়েছে। চীনা রাজকর্মচারী চৌ-জু-কুয়া তাঁর চু-ফান-চি (১২২৫ খ্রীঃ) গ্রন্থে জানিয়েছেন যে পং-কি-লো (অর্থাৎ বঙ্গাল বা দঃ পূঃ বাংলাদেশ) ছিল তু-লো (অর্থাৎ তুলো) উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। কৃষি উৎপাদনের অন্যতম দিক হচ্ছে সমকালীন মশলার চাষ। খ্রীঃ প্রথম শতক থেকেই গোলমরিচ উৎপাদনে মালাবার উপকূলের প্রসিদ্ধি দেখা যায়; আদি মধ্যযুগের লেখমালা এবং চীনা আরবী লেখকদের রচনাতে মরিচ উৎপাদনে মালাবারের অব্যাহত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। রাজতরঙ্গিণীতে কাশ্মীরে জাফরান চাষের উল্লেখ আছে। গুজরাটে দ্বাদশ শতকের একটি লেখমালায় কর্পূর, হিং, অগুরু, জায়ফল, জয়িত্রী, মরিচ ও খেজুরের উল্লেখ আছে; এর মধ্যে কিছু ফসল ও ফল হয়তো সন্নিহিত এলাকায় উৎপন্ন হত; মরিচের মত মশলা গুজরাটের বাইরের থেকে আসত। আদি মধ্য যুগের ফসলের এই তালিকা থেকে কৃষি উৎপাদনের দৃঢ়ভিত্তি, বহুল ফলন ও ফসলের বৈচিত্র্য অনুধাবন করতে কোনও দ্বিধা ও অসুবিধা হয় না।

কৃষি উৎপাদনের বৈচিত্র্য ও প্রসার অনেকটাই সম্ভব হয়েছিল হালভিত্তিক চাষ ব্যাপক এলাকায় প্রচলিত হবার দরুন। চহমান বিগ্রহরাজের হর্ষ লেখতে (৯৭৫) বড় লাঙ্গলের (বৃহদহল) কথা জানা যায়। মঙ্খকোষ গ্রন্থে বলা আছে যে ‘হল’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল কাঠের তৈরী। কৃষিপ্রধান অর্থনৈতিক জীবনের আর একটি লক্ষণ ঢেঁকির ব্যাপক ব্যবহার: দামোদর গুপ্তের কুট্টনীমতম্‌, কলহণের রাজতরঙ্গিণী, সুভাষিত রত্নকোশ ও শ্রীধরদাসের সদুক্তিকর্ণামৃত প্রভৃতি তথ্যসূত্রে ঢেঁকির উল্লেখ নিয়মিত। গৃহস্থ ও কৃষক রমণী ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছেন এই দৃশ্যের লালিত্যময় বর্ণনা সমকালীন কাব্যগুলিতে প্রায়ই পাওয়া যাবে। উদুখলের প্রয়োগও ব্যাপক ছিল। হেমচন্দ্রের দেশীনামমালা-তে শুধু উদুখলের উল্লেখই নেই, তার সঙ্গে সঙ্গে উদুখলের বিভিন্ন দেশী প্রতিশব্দও তিনি জানিয়েছেন, যেমন ‘অবনো’ (১. ২৬), ‘তুম্বিলি’ (৫. ২৩), ‘উখল’ (৫. ২৩)।

কৃষির সঙ্গে যার অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ, সেই সেচ ব্যবস্থার অবস্থা কি রকম ছিল? সমকালীন তথ্যসূত্র থেকে মনে হয় যে কৃষি ব্যবস্থা সমগ্র উপমহাদেশে দৃঢ়মূল হওয়ায় সেচ ব্যবস্থার ব্যাপক ব্যবহার ঘটেছিল। আদি মধ্যযুগে সেচ ব্যবস্থার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি দেখা গিয়েছিল কাশ্মীরে। কহলণের রাজতরঙ্গিণীতে নিখুঁত ও তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ আছে, কি ভাবে কাশ্মীর উপত্যকায় কৃষি অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করত বিতস্তা নদীর খামখেয়ালীপনার উপর। বিতস্তার বন্যার প্রকোপে কৃষির বিপর্যয় ঘটা ছিল কাশ্মীরের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কৃষির বিপর্যয় ঘটলে ধানের দাম ভয়াবহ বাড়ত ও দরিদ্রের দুর্দশার অন্ত থাকত না। কাশ্মীরের রাজা অবন্তীবর্মণের শাসনকালে (৮৩৬-৮৫৫ খ্রীঃ) সূয্য নামক এক প্রযুক্তিবিদ অসামান্য দক্ষতায় ও কৌশলে বিতস্তার গতিপথ পরিবর্তন করেন; তার ফলে বন্যা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়; কাশ্মীরে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় তা অত্যন্ত শস্তা হয়ে যায়। তবে একটি নদীর স্রোত ও গতিপথকে নিয়ন্ত্রণ করে সেচসেবিত এলাকার বৃদ্ধি ঘটানোর বেশী নজীর এই যুগে জানা নেই। সেচের জন্য কূপের ব্যবহার এই আমলেও অব্যাহত ছিল। গভীর ‘বাপী’ খনন এযুগে বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়; গুজরাট রাজস্থানের মত আপেক্ষিক শুষ্ক জলবায়ুর জায়গাতে ‘বাপী’ নির্মাণ বিশেষ উপযোগী হয়েছিল। রামশরণ শর্মা-র মতে ‘বাপী’ শব্দটি ‘বাপ্‌’ ধাতু বা বপন করার থেকে ব্যুৎপন্ন; তাই এই জাতীয় কূপ প্রধানতঃ কৃষিক্ষেত্রের নিকটে ও সেচব্যবস্থার প্রয়োজনে তৈরী করা হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন। রাজস্থান অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থা যে আদি মধ্যযুগে যথেষ্ট প্রসারিত হয়, তার তথ্যনিষ্ঠ পরিচয় ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা থেকে স্পষ্ট।

আদি মধ্যযুগে সেচের অন্যতম যন্ত্র ছিল ‘অরঘট্ট’। ‘অরঘট্ট’কে হলায়ুধ তাঁর ‘অভিধানরত্নমালা’-তে ‘উদঘাটক’ বলে অভিহিত করেছেন; এই যন্ত্রটি ‘ঘটিযন্ত্র’ নামেও পরিচিত। এটি একটি চক্রাকার যন্ত্র, যার গায়ে লাগানো থাকত ছোট ছোট পাত্র; পাত্রগুলি ঘটির আকারের ছিল বলে ‘অরঘট্ট’ ঘটিযন্ত্র নামে উল্লিখিত হত। জলের ভিতর চক্রটি ঘোরালে ঘটি জাতীয় পাত্রগুলিতে জল উঠে আসত; চক্রটি ঘুরতে থাকলে ঘটির জল নীচে জমিতে পড়ত। রাজস্থানের মান্দোরে দশম শতাব্দীর দুটি ভাস্কর্যে এই জাতীয় অরঘট্ট বা ঘটিযন্ত্রের রূপ দেখা যায়। তবে অনেক পণ্ডিত এই সেচ যন্ত্রটিকে ‘পার্সিয়ান হুইল’ বলে মনে করেন; তাদের ধারণা যে ‘পার্সিয়ান হুইল’ কার্যতঃ বিদেশী যন্ত্র নয়, তা ভারতেই উদ্ভূত। কিন্তু ইরফান হাবিবের গবেষণা থেকে সংশয় থাকে না যে ‘পার্সিয়ান হুইল’ আরও জটিলতর এক সেচ যন্ত্র। এই ব্যবস্থায় দুটি চাকা থাকত; একটি চাকা অনুভূমিক ঘুরত; অপর চাকাটি ঘুরত ওপর থেকে নীচে; দুটি চাকার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী একটি ‘গীয়ার’ জাতীয় যন্ত্র থাকত। অনুভূমিক চাকাটি ঘুরলে তাহলেই আর একটি চাকা ওপর থেকে নীচে ঘুরত; দ্বিতীয় চাকায় লাগানো ঘটি বা পাত্রতে যে জল উঠল, তা পরে ক্ষেতে পড়ত। ইরফান হাবিবের মতে এই যন্ত্র তুর্কী অভিযানের আগে ভারতে আসেনি। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় রাজস্থানের ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন যে ‘অরঘট্ট’ কথাটি গভীর কূপ বোঝাতেও ব্যবহৃত হত। ইবন বতুতা যখন চতুর্দশ শতকে বাংলায় ভ্রমণরত (১৩৩৪ খ্রীঃ), তখন তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে কামরূপ যাবার পথে নদীর ধারে অবস্থিত ক্ষেতে নদীর জল তোলার জন্য চক্রাকার যন্ত্র ব্যবহার হতে দেখেছিলেন। এই যন্ত্রটি সম্ভবত ভারতীয় সূত্রের অরঘট্ট এর সমার্থক।

সেচব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত উদ্যোগ সক্রিয় ছিল। কাশ্মীরে সূয্য যে ব্যাপক সেচ প্রকল্প গড়ে তোলেন, তাতে রাজকীয় অনুগ্রহ অবশ্যই ছিল। রাজকীয় উদ্যোগে বড় জলাশয় খননের দৃষ্টান্ত অজানা নয়। সন্ধ্যাকব নন্দীর রামচরিত-এ রামপাল যে বরেন্দ্র অঞ্চলে বিশাল সাগরপ্রতিম দীঘি তৈরি করেছিলেন, তার বর্ণনা আছে। অনুরূপভাবে দক্ষিণ ভারতের লেখতে ‘চোল বারিধি’ নামক যে বৃহৎ জলাশয়ের উল্লেখ আছে, সেটিও বোধ হয় চোলদের আনুকূল্যে তৈরি হয়েছিল। তবে এই আমলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গঠিত জলসেচ প্রকল্পের বেশী নজীর জানা নেই।

জলসেচ ব্যবস্থার একটি বিশেষ চরিত্র দক্ষিণ ভারতে দেখা যায়। জলসেচ প্রকল্পগুলি নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ করার উদ্যোগ ও দায়দায়িত্ব প্রধানত নিত গ্রামসভাগুলি, কোনও ব্যক্তিবিশেষ বা রাজা নয়। গ্রামসভাগুলিতে থাকতেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। এই গ্রামসভার মধ্যে একটি বিশেষ সমিতি ছিল; এই সমিতির সদস্যগণও এক বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন। সেচের জলের যথাযথ ব্যবহার, সুবণ্টন, জল কর আদায় ও জলাশয়গুলির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের সামগ্রিক দায়িত্ব থাকত এই সমিতির ওপর। জলাশয়গুলিকে নিয়মিত পরিষ্কার করা, কাদামাটি তোলা, জলাশয়ের গভীরতা বাড়ানো, এই কাজে শ্রমিক নিয়োগ করা, নৌকো ব্যবহার করা, যাবতীয় খরচ নিবাহ করা–—এই সব কাজই গ্রামসভা ও গ্রামসভার অন্তর্ভুক্ত সেচ সমিতির সদস্যরা দেখতেন। স্থানীয় সেচব্যবস্থার পরিচালনায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের এতটা প্রাধান্য দক্ষিণ ভারতে (বিশেষত চোল ভূখণ্ডে) ছাড়া সমকালীন উপমহাদেশের অন্যত্র দেখা যায় না। দক্ষিণ ভারতীয় লেখমালায় এত পরিমাণে গ্রামসভা ও সেচ ব্যবস্থা পরিচালনায় তার ভূমিকার কথা আছে, যে তার থেকে গ্রামসভার গুরুত্ব সম্বন্ধে কিছুমাত্র সংশয় থাকে না।

॥ ৪ ॥

কৃষি উৎপাদনের আলোচনায় বহু প্রকার পণ্যশস্যের উল্লেখ করা হয়েছিল। এই পণ্যশস্যগুলি অনেকক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট শিল্পের প্রধান উপকরণ হিসাবে বিবেচিত হত। এইভাবে জানা যায় চিনি শিল্পের কথা। আখ মাড়াই করার যন্ত্র দেশীনামমালাতে ‘হস্তযন্ত্র’ বা ‘পীড়নযন্ত্র’ নামে অভিহিত। রাজস্থানের অর্থুনা লেখতে চিনি ও গুড়ের পৃথক শিল্পের কথা বলা হয়েছে। আদি মধ্যযুগে মালবে উৎপন্ন চিনি যে প্রচুর পরিমাণে গুজরাট অঞ্চলে পাঠানো হত, এ বিষয়ে চৌ-জু-কুয়া মন্তব্য করেছেন।

বস্ত্রশিল্পের গুরুত্ব আগের যুগের মতই অব্যাহত ছিল। তুলোপেঁজার (পিঞ্জনম্‌) উল্লেখ করা আছে হেমচন্দ্রের অভিধানচিন্তামণিতে; তুলো পেঁজার জন্য ধনুর ব্যবহারও হেমচন্দ্র জানিয়েছেন (‘তুলাস্ফোটনকার্মূকম্‌, অভিধানচিন্তামণি, ৩. ৫৭)। তবে তুলো পেঁজার জন্য ধনুকের ব্যবহার এর আগের পর্বে অমরকোশেই উল্লিখিত হয়েছে। একাদশ শতকে রচিত মানসোল্লাসে বস্ত্রশিল্পের কেন্দ্রগুলির তালিকা আছে: মূলস্থান (মুলতান), অনহিলপত্তন (অনহিলওয়াড়া), বঙ্গ (দঃ পূঃ বঙ্গদেশ), নাগপট্টন (তাঞ্জোর অঞ্চল), চোলদেশ (কাবেরী নদীর বদ্বীপ অঞ্চল)। রাজতরঙ্গিণীতে পাটানকেও বস্ত্র উৎপাদনের অন্যতম প্রসিদ্ধ এলাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মালব ও গুজরাট অঞ্চলের বস্ত্রশিল্পের প্রসিদ্ধি চৌ-জু-কুয়া-র অজানা ছিল না; গুজরাটের একটি লেখতে (দ্বাদশ শতাব্দীর) ‘কাপড়’ কথাটিই বলা হয়েছে। মার্কো পোলো দাক্ষিণাত্যের পূর্বাংশে বরঙ্গল রাজ্যের বস্ত্রশিল্পের প্রভূত প্রশংসা করেছেন। একই রকম প্রশস্তি করা হয়েছে বাংলার কাপড় সম্বন্ধে; অল মাসুদি (৯১৫), ইবন খোরদাদবা, হুডুড-অল-অলম গ্রন্থের অজ্ঞাতনামা লেখক (৯৮২), অল ইদ্রিসি (১১৬২), চৌ-জু-কুয়া (১২২৫)-বঙ্গাল বা দঃ পূঃ বাংলাদেশের কাপড়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। লক্ষ্যণীয় যে কৌশাম্বী, মগধ ও মথুরার মত বস্ত্রশিল্পের কেন্দ্র–—যা প্রাক-৬০০ খ্রীঃ আমলে অত্যন্ত বিখ্যাত ছিল–—আদি মধ্যযুগের শিল্পের আলোচনায় দেখা যায় না। মনে হয় এই কেন্দ্রগুলি আদি মধ্য পর্বে বোধহয় অবক্ষয়ের পথে যায়, ফলে তাদের গুরুত্ব হ্রাস হয়েছিল। তবে বস্ত্রশিল্পের সামগ্রিক অবক্ষয় এর দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। আদি মধ্যযুগে বস্ত্রশিল্পে প্রসার ঘটেছিল কামরূপের মত পূর্বসীমানায় অবস্থিত রাজ্যেও। ভক্তপ্রসাদ মজুমদার দ্বাদশ শতকের একটি লেখতে (কামরূপ রাজ ধর্মপালের আমলে) তন্তুবায়দের (‘ওরঙ্গীতন্ত্র’) প্রথম উল্লেখ নজর করেছেন।

তৈলবীজের উৎপাদন ব্যাপক হওয়ায় তৈলোৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটেছিল। তৈলিক বা তৈলীর উল্লেখ লেখমালায় প্রচুর পরিমাণে দেখা যাবে। দশম শতকে লিখিত কামসূত্রের টীকা জয়মঙ্গলাতে দুই রকম তেল উৎপাদক যন্ত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথমটি ‘ঔদ্র’, যার দ্বারা তৈলবীজ পেষা হত (‘ঔদ্রা হি পুতিক যন্ত্রেণ পীড়য়ন্তি’); দ্বিতীয়টি ‘চক্রিক’। ‘চক্রিক’ নামটি থেকে বোঝা যায় এই যন্ত্র চক্রাকার ছিল; (‘চক্রিক’ তু চতুর্ষু পার্শ্বেষু চল্যমানেন’)। ‘চক্রিক’ ও ঘানির মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই। ঘানি বা ‘ঘানক’ সমকালীন লেখমালায় দেখা যাবে। একদশ শতকের প্রথম ভাগে উৎকীর্ণ শিলাহার ছিন্তুরাজের চিনচানি তাম্রশাসনে (১০৩৪) একটি ঘানি এক মন্দিরের উদ্দেশে দান করা হয়েছে; লেখটির শেষে বলা হয়েছে ঘানির অপঘাত যিনি ঘটাবেন, তিনি অপরিমিত পাপের ভাগীদার হবেন ও নরকযন্ত্রণা ভোগ করবেন। এই অভিশাপটি পরোক্ষভাবে ঘানির ব্যাপক ব্যবহার ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের অবহিত করে।

শিল্প অর্থনীতির ক্ষেত্রে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ধাতু বিশেষত লোহার ব্যবহারে বৃদ্ধি। রামশরণ শর্মাও লোহার ব্যাপকতর ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি দ্বাদশ শতাব্দীর পর্যায়মুক্তাবলী গ্রন্থে ছয় রকম লোহার উল্লেখ দেখিয়েছেন। ওড়িষ্যার মন্দিরে–—বিশেষতঃ কোনার্কের সূর্যমন্দিরে ও পুরীর গুণ্ডিচাবাড়িতে–—লোহার ব্যবহার লক্ষ্য করার মত। পুরীর গুণ্ডিচাবাড়িতে দ্বাদশ শতকে যে লোহার কড়িবর্গা ব্যবহার করা হয় তা দৈর্ঘ্যে সতের ফুট। ধাতুর মধ্যে তামার ব্যাপক প্রচলনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ অসংখ্য তাম্রশাসন। ব্রোঞ্জ ব্যবহারে অগ্রগতির স্বাক্ষর বহন করছে আদিমধ্যযুগের ধাতবমূর্তিগুলি, যা পূর্ব ও দক্ষিণভারতে সুপ্রচলিত ছিল। ধাতুর ব্যবহারের দরুন অস্ত্র নির্মাণ বিশেষত তরোয়াল তৈরীর ক্ষেত্রে উন্নতি জানা যায়। পূর্বভারতে পাল সাম্রাজ্যের (রুহ্‌মি দেশ) তরোয়ালের প্রশংসা করেছেন অধিকাংশ আরব লেখক। ভোজের যুক্তিকল্পতরুতেও (একাদশ শতক) মগধ ও অঙ্গের (যা নিঃসন্দেহে পাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল) ভালো তরোয়ালের উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তিকল্পতরুতে বারাণসী, সৌরাষ্ট্র ও কলিঙ্গে তৈরি তরোয়ালের খ্যাতি জানা যায়। ধাতুর ব্যবহারে জ্বালানি অপরিহার্য; এই জ্বালানি কাঠ থেকে নিশ্চয়ই পাওয়া যেতে পারে। তবে ভক্তপ্রসাদ মজুমদার দেশীনামমালার ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন যে কাঠকয়লা বা কয়লার ব্যবহার জানা ছিল (২. ৪৯–— ‘কাষ্ঠাঙ্গার’/‘কাটঠাঙ্গার’/ ‘কোইলা’)

শিল্প সংগঠন হিসেবে ‘গিল্ড’ বা ‘শ্ৰেণী’-র অবস্থা কেমন ছিল? সমসাময়িক লেখমালা, ধর্মশাস্ত্রসহ বিভিন্ন তথ্যসূত্রে ‘শ্রেণী’র কথা বলা হয়েছে। তবে ‘শ্রেণী’র গুরুত্ব বা প্রভাব বোধ হয় আলোচ্য আমলে কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। লালনজী গোপাল মনুস্মৃতির উপর মেধাতিথির ভাষ্যতে দেখেছিলেন যে সদস্যদের উপর ‘শ্রেণী’-র প্রভাব বোধ হয় আগের মত অত জোরালো ছিল না। ‘শ্ৰেণী’ যেখানে মূলতঃ সামূহিক ব্যাপারকে আগে সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দিত, সেখানে ‘শ্রেণী’-র সদস্যদের স্বাতন্ত্র্যবৃদ্ধির নজীর দেখলে ‘শ্রেণী’-র সমবায়সুলভ সংগঠনের দুর্বলতার কথাই অনুমান করতে হবে। বহুপূর্বে রমেশচন্দ্র মজুমদার নারদস্মৃতির (১০. ২৭) ভিত্তিতে দেখিয়েছিলেন যে করদানে ফাঁকি, জুয়োখেলার আয়োজন ও বারাঙ্গনা রাখলে রাজা ‘শ্রেণী’-র ক্রিয়াকলাপে হস্তক্ষেপ করতে পারেন। রাজার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেই নারদের পূর্বসূরী স্মৃতিকাররা মত দিয়েছেন। নারদস্মৃতির ভিন্ন মত থেকে অনুমান করা চলে যে ‘শ্রেণী’-র আভ্যন্তরীণ পরিচালন ব্যবস্থার উপর শাসকীয় ক্ষমতা বাড়ছিল ও ‘শ্রেণী’-র স্বাতন্ত্র্য তার ফলে বোধহয় বিঘ্নিত ও ক্ষুন্ন হয়। দ্বাদশ-এয়োদশ শতকে রচিত লেখপদ্ধতিতে ‘শ্রেণীকরণ’-এর উল্লেখ আছে; কথাটির অর্থ একটি বিশেষ প্রশাসনিক দফতর (বা করণ’) যা শ্রেণীর উপর পর্যবেক্ষণ চালাত। এই তথ্যটিও ‘শ্রেণী’র ক্রিয়াকলাপের উপর প্রশাসনিক নজরদারি ও হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়। আদি মধ্যযুগীয় ‘শ্রেণী’গুলিকে বিভিন্ন শাস্ত্রে জাতি অভিধা দেওয়া হয়েছে; কার্যত জাতি ও ‘শ্রেণী’ প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল। বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মাবৈবর্ত্ত নামক দুইটি পুরাণে (ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতক) ‘শ্রেণী’গুলিকে ‘সংকর’ বা ‘মিশ্র জাতি’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। শাস্ত্রকারগণ কখনই মিশ্র বা সংকর জাতিগুলিকে ভালো চোখে দেখতেন না। জম্বুদ্বীপ প্রজ্ঞপ্তি-তে কুম্ভকার, তাঁতী, সুবর্ণকার, রজ্জুকার প্রভৃতি মিশ্র জাতির (অর্থাৎ এই পেশার অন্তর্গত গিল্ডগুলি) ছোঁয়া শুদ্ধ বলে বিধান দেওয়া হয়েছে; আর চর্মকার, তেলী, ইক্ষুপীড়নকারী, রঙ্গকার, কাঁসারী প্রভৃতি মিশ্র জাতিকে অচ্ছুৎ ঘোষণা করা হয়েছে। একইভাবে জিনসেন সূরির দৃষ্টিতে সুবর্ণকার, কুম্ভকার, কর্মকার, কারিগর প্রভৃতির সামাজিক মান অত্যন্ত নীচু ও তারা অধম পর্যায়ভুক্ত (‘শিল্প কর্মকার সমুদয় অধম’)।

‘শ্রেণী’গুলির উল্লেখ লেখমালাতেও আছে। প্রাচীন গোপগিরিতে (আধুনিক গোয়ালিয়র) দুটি লেখতে (৮৭৫ ও ৮৭৬ খ্রীঃ) অন্তত কুড়ি জন তৈলিক প্রধান (‘তৈলিক মহত্তর’) ও চৌদ্দজন মালি বা মালাকারদের গোষ্ঠী প্রধানের উল্লেখ আছে (‘মালিকা মহর’)। এ ছাড়াও সুরা প্রস্তুতকারীরাও বোধ হয় ‘শ্রেণী’ ব্যবস্থা বজায় রেখেছিলেন (‘সমস্তকল্লপালানাম্‌’) একইভাবে পাথরকাটার কারিগরদের (‘শিলাকূট’) সংগঠনেরও উল্লেখ আছে। উপরের তথ্যগুলি ‘শ্রেণী’ সংগঠনের ক্ষেত্রে পরিবর্ত্তনের ইঙ্গিত দেয়। প্রাক-৬৫০ পর্বে একটি বৃত্তিকে ঘিরে কোনও একটি অঞ্চলে একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি সংগঠন ‘শ্রেণী’ বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু গোপগিরিতে তৈলিক ও মালাকারদের মধ্যে বহুসংখ্যক প্রধানকে দেখা যাচ্ছে। তা হলে অনুমান করতে হয় যে, একই বৃত্তির মধ্যে একটি অঞ্চলে একাধিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এই ঘটনা ঘটে থাকলে শ্রেণীর যে দৃঢ়বদ্ধ সংগঠন তাতে চিড় ধরতে বাধ্য। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের অনুসরণে বলা চলে যে আদি মধ্যযুগের ‘শ্রেণী’ কোনও একটি বৃত্তিতে নিযুক্ত সকল কারিগরের একটি সংগঠন হিসেবে আর টিকল না; এগুলি ক্রমশঃ এক একটি পরিবারকে ভিত্তি করে গড়ে উঠতে থাকে; পরিবারগুলি হয়তো একই বৃত্তিতে নিযুক্ত থাকতে পারে। তারই ফলে একই পেশায় অনেক সংগঠন ও একাধিক নেতার উদ্ভব দেখতে পাওয়া যায়। এই দিক দিয়ে বিচার করলেও শ্রেণীর সাংগঠনিক ভাঙ্গন অস্বীকার করা যায় না। ভক্তপ্রসাদ মজুমদার মনে করেন যে আদি মধ্যযুগে ভূস্বামীদের উত্থান ঘটায় শ্রমিকদের এক বড় অংশই ভূস্বামীর এলাকায় নিযুক্ত হয়। ফলে শ্রমের অধিকাংশই কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত হবার সম্ভাবনা। তার দরুন ‘শ্রেণী’-র শিল্পসংক্রান্ত ক্রিয়াকলাপ চালাবার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম ও শ্রমিক অপ্রতুল হয়ে পড়ে। এটিও ‘শ্রেণী’-র অবনতির অন্যতম কারণ। আদি ঐতিহাসিক পর্বে ও গুপ্ত আমলে ‘শ্রেণী’গুলি ব্যাঙ্কের যে ভূমিকা পালন করত, সেখানেও বোধহয় ঘাটতি দেখা যায়। প্রথমত ‘শ্রেণী’তে চিরকালীন ভিত্তিতে আমানত রাখার দৃষ্টান্ত আদি মধ্যপর্বে কম; নজীর এক্ষেত্রে পাওয়া যায় তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থলগ্নী করা হয়েছে ‘শ্রেণী’র প্রধান বা ‘মহত্তর’-এর কাছে। সমগ্র ‘শ্রেণী’-র কাছে সেই অর্থ লগ্নী করা হয়নি। রাজকীয় হস্তক্ষেপ, ‘শ্রেণী’গুলির জাতিতে রূপান্তর ঘটায় তাদের সামাজিক অবনয়ন, ‘শ্রেণী’গুলির ক্রমে পারিবারিক সংগঠনের আকার ধারণ ও ‘শ্রেণী’তে অর্থলগ্নীর বিরলতা সম্ভবতঃ এই যুগের ‘শ্রেণী’ সংগঠনের অবক্ষয়কেই তুলে ধরে।

॥ ৫ ॥

সামন্ত ব্যবস্থার প্রভাবে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের যে ছবি রামশরণ শর্মা ও যাদব তুলে ধরেছিলেন, তার সমর্থনে সন্দেহাতীত সাক্ষ্যপ্রমাণ কৃষি ও শিল্পে উৎপাদনের ক্ষেত্রে হাজির করা কঠিন। কৃষির প্রসার ও শিল্পের বৈচিত্র্য, বিশেষতঃ ধাতব তথা লৌহশিল্পের অগ্রগতির কথা, রামশরণ শর্মাও স্বীকার করেন। সামন্ত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবার কারণ ও ফল দুই হিসেবেই বাণিজ্যের অবক্ষয়ের তত্ত্ব শর্মা পেশ করেছিলেন। বাণিজ্যের অবস্থা কেমন ছিল, এ ব্যাপারে আলোচনা করা যাক।

বাণিজ্য বিশেষত উপমহাদেশের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য লেখমালার তথ্যই সবচেয়ে সুলভ। সমকালীন লেখমালায় নানা প্রকার বিপণন কেন্দ্রের নাম দেখা যায়। বর্তমানে যা হাট (সপ্তাহে এক বা দুইবার যেখানে কেনাবেচা চলে), তা ‘হট্ট’ বা ‘হট্টিকা’ বলে উত্তর ভারতের বিভিন্ন লেখমালায় উল্লিখিত। দক্ষিণ ভারতে ও দাক্ষিণাত্যেও সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে কেনাবেচা হত, সেগুলি ‘সন্থে’ নামে পরিচিত। সপ্তাহের যে দিনে এই জাতীয় হাট বসত সেই দিনের নাম ‘সন্থে’-র সঙ্গে যুক্ত থাকত (যেমন ‘বুধবার সন্থে’)। এক এক সময় এই জাতীয় ‘হাট’ মেলার রূপ নিত; এই প্রকার মেলা অনেক সময়েই জীবজন্তু কেনাবেচার জন্য বসত। নবম শতকে রাজস্থানের কামান লেখতে ‘কম্বলী হট্ট’ ও প্রায় সমসাময়িক পেহোয়া লেখতে ‘ঘোটকযাত্রা’ বা ঘোড়ার মেলার উল্লেখ আছে। এই জাতীয় মেলা সম্ভবত বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কিছুদিন ধরে চলত বলে অনুমান করা যায়।

হাট বা মেলার তুলনায় আরও নিয়মিত বাজার বসত ‘মণ্ডপিকা’-তে। মণ্ডপিকা বা মণ্ডপ বলতে স্তম্ভযুক্ত আচ্ছাদিত এলাকা বোঝায়। কিন্তু আদি মধ্যযুগীয় লেখমালা ও লেখপদ্ধতি গ্রন্থে মণ্ডপিকার নিয়মিত উল্লেখ থেকে কোনও সন্দেহ থাকে না যে, মণ্ডপিকা ছিল উত্তর ভারতের বাণিজ্যকেন্দ্র। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে মণ্ডপিকার উল্লেখ, খ্রীঃ ৬০০-র আগে বিশেষ নেই; তাই মনে হয় এই জাতীয় বাণিজ্যকেন্দ্র একান্তভাবে আদি মধ্যযুগেই বিকশিত হয়। লেখমালা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে কাংরা, গোয়ালিয়র, ভরতপুর, জবলপুর, রাজস্থান ও গুজরাটের নানা অঞ্চলে খ্রীঃ অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে বিভিন্ন আয়তনের মণ্ডপিকা গড়ে ওঠে। রাজস্থানে ও গুজরাটে মণ্ডপিকার সংখ্যাধিক্য লক্ষ্যণীয়। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় রাজস্থানের চব্বিশটি লেখ (৬৪৪-১২৯৬ খ্রীঃ) বিচার করে বারোটি মণ্ডপিকা ও সমসংখ্যক হট্ট বা হাটের সন্ধান পেয়েছেন। এ ছাড়াও আরও চারটি লেখতে (১১৩৮, ১১৪১, ১১৪৫ ও ১২৯৫ খ্রীঃ) বাণিজ্যকেন্দ্রের উল্লেখ আছে, তবে এই বাণিজ্যকেন্দ্রের চরিত্র নির্ধারণ করা কঠিন। মণ্ডপিকাগুলি কখনও কখনও ‘শুল্কমণ্ডপিকা’ নামেও আখ্যাত–—এর থেকে বোঝা যায় যে মণ্ডপিকাতে বাণিজ্যের উপর শুল্ক নেওয়া হত। রাজস্থানের মণ্ডপিকাগুলির মধ্যে কয়েকটি প্রায় গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত ছিল, আবার সীয়াডোনী ও গোয়ালিয়র অঞ্চলের, বিলহরির (জবলপুর এলাকা) মণ্ডপিকা বড় শহরের মধ্যে গড়ে ওঠে (‘পত্তনমণ্ডপিকা’)। এই জাতীয় মণ্ডপিকাই বোধহয় লেখপদ্ধতিতে ‘মহামণ্ডপিকা’ নামে আখ্যাত।

উত্তর ভারতে স্থানীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে মণ্ডপিকা যেমন বিকশিত হয়, দক্ষিণ ভারতে অনুরূপ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ‘নগরম্‌’-এর উল্লেখ লেখমালায় পাওয়া যায়। কেনেথ হল চোল আমলের লেখমালায় এই রকম ৩৩টি ‘নগরম’-এর উল্লেখ পেয়েছেন। তাঁর ধারণা অনুযায়ী কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠত একটি ‘নাড়ু’ বা স্থানীয় আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র, আবার প্রত্যেকটি নাড়ুতে একটি করে নগরম্‌ থাকত। চোল আমলে ‘নাড়ু’র উত্থান ও কৃষি অর্থনীতির সমৃদ্ধির মধ্যে নিকট সম্পর্কের বিষয়ে বার্টন স্টাইন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। হলের গবেষণা থেকে মনে হয় যে ‘নগরম’গুলি একদিকে একটি ‘নাড়ু’তে অবস্থিত বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকার সঙ্গে লেনদেনে লিপ্ত ছিল, আবার অন্যদিকে একই সঙ্গে অন্যান্য ‘নাড়ু’র ‘নগরম্‌’-এর সঙ্গেও বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখত। দক্ষিণ ভারতের ‘নানাদেশী’ নামক বিখ্যাত বণিক সংগঠনের যোগাযোগ যে নগরম্‌-এ ছিল, এই কথা প্রমাণ করতে হল প্রয়াসী হয়েছেন। হলের গবেষণার গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায় যে, তিনি ‘নাড়ু’ পিছু একটি ‘নগরম্‌’-এর অস্তিত্বের যে ছক তৈরি করেছেন, তার সমর্থনে কোনও সাক্ষ্য প্রমাণ দেননি। দক্ষিণ ভারতে চোল আমলে ‘এরিবীরপট্টিনম’ নামক বৃহত্তর স্থলবাণিজ্যেকেন্দ্রের সন্ধানও হল সমকালীন লেখমালায় দেখেছেন।

লেখমালায় শ্রেষ্ঠী, স্বার্থবাহ, বণিকদের উল্লেখ যথেষ্ট পরিমাণে আছে। দক্ষিণ ভারতে কোলহাপুর (১১৩৬), মিরাজ (১১৪৩) ও বেলগাঁও (১২০৫)-তে পাওয়া তিনটি লেখতে বণিকদের সমাবেশ দেখা যায়। বহু বণিকের নামই শুধু আছে তাই নয়, তাঁরা কোন অঞ্চল থেকে আগত তার পরিচয়ও আছে। দাক্ষিণাত্যে লাট বা গুজরাট, রাজস্থান, কোঙ্কন থেকে যে বণিকরা আসতেন, তার নিশ্চিত প্রমাণ এই লেখগুলিতে আছে। উত্তর ভারতে আদি মধ্যযুগে বণিকদের সংগঠন বিশেষ দেখা যায় না; কিন্তু আদি মধ্যযুগে দক্ষিণ ভারতে দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বণিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এই দুটি সংগঠন ‘মণিগ্রামম্‌’ ও ‘নানাদেশী’ নামে পরিচিত। দশম থেকে দ্বাদশ/ত্রয়োদশ শতকের লেখমালায় এই দুই সংগঠনের বহুল উল্লেখ নিঃসন্দেহে তাদের সক্রিয় ভূমিকা প্রমাণ করে। এই সংগঠনের বণিকরা দূর দূরান্তের দেশ থেকে যে নানাবিধ পণ্য (যার ভিতর দুর্মূল্য রত্নরাজি, বিলাসদ্রব্য, সুগন্ধী, কাপড় ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত) নিয়ে আসতেন ও রাজারাও যে তাঁদের নিয়মিত পৃষ্ঠপোষণ করতেন, এর পরিচয় লেখমালায় আছে। কিছু প্রথাগত বর্ণনা ও অতিশয়োক্তি বাদ দিলে এই তথ্যসূত্রের সারবত্তা সম্বন্ধে বিশেষ আপত্তি থাকে না। এই দুই বণিক সংগঠন যে তাঁদের সঙ্গে সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী রাখতেন, তার প্রমাণও লেখমালায় উপস্থিত।

বণিকরা পণ্যসম্ভার নিয়ে এক অঞ্চল থেকে অপর এলাকায় নানাভাবে যাতায়াত করতেন। বণিকদের উপর ‘স্কন্ধক’ জাতীয় কর নেবার উল্লেখ থেকে মনে হয় মালপত্র কাঁধে নিয়ে বিক্রী করার রেওয়াজ ছিল। আবার ‘মার্গনক’ জাতীয় কর নেওয়া হত স্থলপথে বাণিজ্যের উপর। স্থলবাণিজ্যের ক্ষেত্রে যাতায়াত ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লেখমালায় বিশেষ নেই। তবে গুজরাটের মানগ্রোল থেকে পাওয়া ১১৪৪ খ্রীঃ একটি লেখতে বলিবর্দ, রাসভ (গর্দভ) ও উটের পিঠে করে পণ্যসামগ্রীর আনার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় সমসাময়িক রাজস্থান থেকে (১১৩৮ ও ১১৫৪ খ্রীঃ) পাওয়া অপর দুটি লেখতে ভ্রাম্যমান বণিক কর্ত্তৃক বৃষপৃষ্ঠে পণ্য আনার বর্ণনা ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় উপস্থাপন করেছেন (‘বৃষভ-ভারিত’)।

খ্রীষ্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকে আভ্যন্তরীন বাণিজ্যের সজীবতা ও নিয়মিত যোগাযোগ ব্যবস্থার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তার সঙ্গে পথঘাটের কথাও আলোচনা করা দরকার। কিয়াতানের (৭৮৫-৮০৫) চৈনিক বিবরণে কামরূপ থেকে পুণ্ড্র (উত্তরবঙ্গ), কজঙ্গল (রাজমহল পাহাড়ের নিকটবর্তী কাঁকজোল) হয়ে মগধ পৌঁছবার পথের কথা জানা যায়। অষ্টম শতকে অযোধ্যার তিন বণিক ভ্রাতা স্থলপথে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত এসেছিলেন (দুধপানি লেখ); এর দ্বারা গাঙ্গেয় উপত্যকা ও গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের যোগাযোগ প্রমাণ করা যায়। একাদশ শতকে আল বিরুনি কনৌজের সঙ্গে ভারতের নানা অঞ্চলের যোগাযোগ ও পথঘাটের উল্লেখ করেছেন। একটি পথ কান্যকুব্জ থেকে অযোধ্যা, বারাণসী, পাটনা, মুঙ্গের হয়ে গঙ্গাসাগর পৌঁছত। আর একটি পথ কনৌজ থেকে বেরিয়ে প্রয়াগ, ওড়িষ্যা হয়ে সুদূর দক্ষিণ ভারতের কান্যকুব্জ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। কনৌজের সঙ্গে স্থলপথে জেজাহুতি (জেজাকভুক্তি), কাশ্মীর, তিরহুত, কামরূপ ও নেপালের পথসংযোগও আল বিরুণির জানা ছিল। তিনি আরও জানিয়েছেন যে গুজরাটের বিখ্যাত বন্দর সোমনাথ ও মথুরার মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী পথ ছিল; এই পথ মথুরা থেকে উজ্জয়িনী, ধার, বাজানা (জয়পুর এলাকা) হয়ে সোমনাথ পোঁছত।

আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের নানা দিক নিয়ে এ পর্যন্ত যে আলোচনা করা হল তাতে বাণিজ্যিক অবক্ষয়ের তর্কাতীত প্রমাণ খুব বেশী নেই; উল্টোদিকে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের নিয়মিত প্রচলনের ছবিই এই আলোচনায় ফুটে ওঠে। বৈদেশিক বাণিজ্যের রূপটি এই আমলে কেমন ছিল? খেয়াল রাখতে হবে যে, রামশরণ শর্মা, বি. এন. এস. যাদব, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝা, রমেন্দ্রনাথ নন্দী প্রমুখ ঐতিহাসিকরা খ্রীঃ তৃতীয় শতাব্দীর পর রোম-ভারত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-সম্পর্কে সঙ্কোচনকে সামন্তপ্রথার উদ্ভবের অন্যতম উপাদান হিসেবে বিচার করেছিলেন। তাঁদের মতে আঃ একাদশ শতকের আগে ভারত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আর বিশেষ কোনও ভূমিকা নেয়নি। একথা অস্বীকার করা কঠিন হবে যে খ্রীঃ চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে পশ্চিম ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যে বাণিজ্য চলত, তার পরিমাণ ও গুরুত্ব রোম-ভারত বাণিজ্যের সঙ্গে তুলনীয় নয়। কিন্তু সপ্তম শতকে এশীয় ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা অচিরেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মোড় ফিরিয়ে দেয়: এর প্রভাব ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে বিশেষভাবে প্রকট হয়। এই ঘটনা হল ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন ও তার অতি দ্রুত ও ব্যাপক প্রসার। ইসলামের প্রসার কেবলমাত্র একটি নবীন ধর্মমতের বিস্তার নয়, জীবনযাত্রায় নতুন উপাদানও এই সঙ্গে দেখা দিল। ইসলামে নগর ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে নব ধর্মাবলম্বীরা বাণিজ্য ও বিশেষতঃ সমুদ্র বাণিজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক গুরুত্ব দ্রুত বাড়তে থাকে; এই পরিপ্রেক্ষিতে এশীয় সমুদ্র বাণিজ্যে আরবদের অগ্রগতি ও প্রাধান্য অস্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়ে। আরব সমুদ্রবাণিজ্য ও সমুদ্রযাত্রার তথ্যনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণধর্মী পরিচয় পাওয়া যাবে জর্জ. এফ. হৌরানির গবেষণায়। ভারতসাগরে আরব বণিকদের উত্থানের সঙ্গে ভারতের বহির্বাণিজ্য ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। আরব বণিকরা খ্রীঃ অষ্টম শতক থেকে দূরপাল্লার সমুদ্র বাণিজ্য চালিয়ে চীন পর্যন্ত যেতেন। চীনা বিবরণীতে পারসী (পো-সে) ও আরব (তা-শি) জাহাজের ক্যান্টন পর্যন্ত যাত্রার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আরবসাগর ও বঙ্গোপসাগর গাড়ি দিয়ে এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় ভারতীয় উপকূলের বন্দরগুলিতে বিদেশী জাহাজের গমনাগমন অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ বাষ্পীয় সমুদ্রযান আবিষ্কারের আগে নাবিকদের মৌসুমী বায়ুর উপর নির্ভর করতে হতই; পশ্চিম এশিয়া থেকে জাহাজ রওনা হলে ভারতের পশ্চিম উপকূলে জাহাজগুলির পক্ষে আসা প্রায় অবশ্যম্ভাবী ছিল। তারপর জাহাজগুলি চীন পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিত। কীর্তিনারায়ণ চৌধুরী ভারত মহাসাগরে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠার সময় থেকে যে বাণিজ্য ইতিহাসের মূল্যবান গবেষণা করেছেন, তাতে তিনি দেখিয়েছেন যে অষ্টম শতাব্দীর পর থেকে জাহাজ চলাচলে এক তাৎপর্যময় পরিবর্তন আসে। প্রাক অষ্টম শতাব্দীতে একটি জাহাজ পশ্চিম এশিয়া থেকে চীনদেশের খান-ফু বা ক্যান্টন পর্যন্ত যাতায়াত করত। কিন্তু অষ্টম শতক থেকে এই দুই বাণিজ্যিক সীমানার মধ্যে যাতায়াত চলতে থাকে একাধিক জাহাজের সাহায্যে। অর্থাৎ জাহাজগুলি অধিক সংখ্যায় কাজে লাগানো হত; কিন্তু আগের আমলের মত অত দীর্ঘ পথ তারা পাড়ি দিত না। আরব ব্যবসায়ীরা এমতাবস্থায় ভারতের পশ্চিম উপকূলের বিভিন্ন বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে থাকে; মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারতের পশ্চিম উপকূলে পৌঁছন সহজ ও কম সময়সাপেক্ষ। এই ব্যবস্থা অষ্টম শতক থেকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠ হয়। অখ্‌বর আ-সিন ওয়া-ল্‌ হিন্দ্‌ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, পারস্য উপসাগরীয় বন্দর মাসকট থেকে জাহাজ ছাড়লে তা ২৯ বা ৩০ দিনে (চান্দ্র মাস অনুযায়ী) মালাবার উপকূলের প্রসিদ্ধ বন্দর কুলমমালি বা কুইলনে আসত। এই ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ইবন বতুতাও (১৩৩৪) সমর্থন করেছেন। তাঁর বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে কুলম মালি বা কুইলন ও কালিকট পর্যন্ত আরব ‘ধাও’ জাহাজগুলি আসত; চীনা জাহাজ (‘জাঙ্ক’) ভারতীয় বন্দর কালিকট ও কুইলনের বেশী যেত না। আরব জাহাজ থেকে পণ্য নামিয়ে তা চীনা জাহাজে ওঠানো হত (একই ভাবে চীনা পণ্য আরব জাহাজে উঠত)। অর্থাৎ ভারতীয় বন্দরগুলি–—বিশেষতঃ ভারতে পশ্চিম তটরেখার বন্দরগুলি হয়ে ওঠে পশ্চিম দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার জাহাজের সংযোগস্থল। এর ফলে আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্যে ভারত মধ্যবর্তীর ভূমিকা গ্রহণ করে; এর দ্বারা ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কীর্তিনারায়ণ চৌধুরী অনুমান করেছেন যে, প্রাক অষ্টম শতাব্দীতে একটি জাহাজে পশ্চিম এশিয়া থেকে চীন পর্যন্ত বাণিজ্য চালাবার নীতি ছিল ব্যয়সাধ্য ও বাণিজ্যিক সংগঠনের দিক দিয়েও অলাভজনক। তাই একাধিক জাহাজে ক্ষুদ্রতর পাড়ি দেবার নীতি গৃহীত হয়। এর প্রত্যক্ষ সুবিধা ভারত ভোগ করতে থাকে।

গুজরাট কোঙ্কন ও মালাবার উপকূল দূরপাল্লার এশীয় বাণিজ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়। সুলেমান (৮৫১), আবু জায়েদ (৯১৬), ইবন খোরদাদবা (৯১২), অল মাসুদী (৯১৫), অল ইশতাখরি (৯৫১), ইবন হাউকল (৯৪৩-৬৮), অলইদ্রিসি (১১৬২) প্রভৃতি আরব লেখকরা সমকালীন ভারতীয় বন্দর ও তার বিশেষ গুরুত্বের উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে গুজরাটের কানবায়া (ক্যাম্বে), কোঙ্কনের সিনদান (সন্‌জন), সুবারা (সোপারা), সৈমুর (চৌল), সিন্দাবুর (গোয়া), মালাবারের কুলম মালি (কুইলন) বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সমকালীন আরব বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বাসরা ও সিরাফে প্রতিষ্ঠিত ছিল ও সমুদ্র বাণিজ্যে পারস্য উপসাগরের তাৎপর্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। পারস্য উপসাগরীয় কোনও বন্দর থেকে জাহাজ যাত্রা শুরু করলে ভারতীয় উপকূলের মধ্যে গুজরাট ও কোঙ্কনে আসা সহজতর। তাই উপরিউক্ত লেখকরা এই দুই উপকূল সম্বন্ধে বিশেষ সজাগ ছিলেন।

প্রায় সব আরব লেখকই কামকাম/ মাকামকাম / কামকার দেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই অঞ্চলটি কোঙ্কন উপকূল। আরব লেখকদের বিবরণে এই অঞ্চল ‘বালহারা’ শাসকদের অধীনে ছিল। ‘বালহারা’ শব্দটি রাষ্ট্রকূট রাজাদের বংশগত উপাধি বল্লভরাজ শব্দের বিকৃতি। রাষ্ট্রকূটদের কোঙ্কন উপকূলের উপর আধিপত্যও লেখমালার দ্বারা সমর্থিত। আরব লেখকরা ভারতীয় শাসকদের মধ্যে রাষ্ট্রকূটদের সর্বাধিক প্রশংসা করেছেন। অল মাসুদী, যিনি ৯১৫ খ্রীঃ ভারতে এসেছিলেন, চৌল (সৈমুর) বন্দরে কমপক্ষে দশ হাজার মুসলমান বণিকের উপস্থিতি নজর করেন; এদের মধ্যে সিরাফ, ওমান, বাসরা ও বাগদাদের বণিকরাও ছিলেন। অল মাসুদীর বিবরণে দুই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বণিকের নাম পাওয়া যায়; মুসা বেন ইশাক অল সান্দালুনি ও আবু সৈয়দ মারুফ বেন জাকারিয়া। এই বণিকরা কোঙ্কন উপকুলে প্রায় স্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন। আরব বিবরণীর চমকপ্রদ সমর্থন মিলবে রাষ্ট্রকূট লেখমালায়। চিনচানি থেকে পাওয়া রাষ্ট্রকূট তৃতীয় ইন্দ্রের তাম্রশাসনে (৯২৬ খ্রীঃ) বলা হয়েছে যে, তাঁর পিতা দ্বিতীয় কৃষ্ণের রাজত্বকালে (৮৭৮-৯১৫) তাজ্জিক জাতীয় (আরব) সুগতীপ মধুমতি সনজন ও সন্নিহিত উপকূল এলাকায় সমস্ত বন্দরগুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করেন। সুগতীপ মধুমতি শুধু আরব নন, মধুমতি নামটি মহম্মদ নামের সংস্কৃত বিকৃতি। আরব ও রাষ্ট্রকূটরা যুগপৎ কোঙ্কনর বাণিজ্যিক গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন হন ও সনজন এলাকার উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপনে প্রয়াস নেন। রাষ্ট্রকূট ও আরবদের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক না থাকলে এই জাতীয় রাজনৈতিক সহযোগিতা অচিন্ত্যনীয়। আরবদের সঙ্গে রাষ্ট্রকূটদের নিয়মিত রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক দ্বিতীয় কৃষ্ণের পরও অটুট ছিল; তৃতীয় ইন্দ্র ও তৃতীয় কৃষ্ণ (৯৩৯-৯৬৫) যে আরবদের যথেষ্ট মদত দিতেন ও আরব বণিকরা যে কোঙ্কন উপকূলে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক গোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, এ ব্যাপারে চিনচানি থেকে পাওয়া দুটি তাম্রশাসন সাক্ষ্য বহন করে। রাষ্ট্রকূটদের পরে কোঙ্কনে যখন শিলাহার বংশীয় রাজাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনও অন্ততঃ একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত কোঙ্কন উপকূলে আরবদের উপস্থিতি বজায় ছিল। চিনচানি থেকে পাওয়া শিলহার ছিন্তুরাজের একটি তাম্রশাসনে (১০৩৪) তিনজন আরব বণিকের নাম দেখা যায়: অল্লীয় (=আলি), মহব ও মহুমত (=মহম্মদ)।

খ্রীষ্টীয় দশম শতকের মধ্যভাগে মিশরে ফতিমিদ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা (৯৬৯) ও সিরাফ ও বাসরার কিছুটা অবনতির ফলে ভারত মহাসাগরের পশ্চিমাংশে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। পারস্য উপসাগরের তুলনায় ক্রমে লোহিত সাগর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে; লোহিত সাগরের দুই প্রান্তে আলেকজান্দ্রিয়া ও এডেন বন্দর এশীয় সমুদ্র বাণিজ্যে দ্রুত প্রসিদ্ধি লাভ করে। লোহিত সাগরের বাণিজ্যিক তাৎপর্য বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম ফল এই যে ভারত মহাসাগরের সমুদ্র বাণিজ্য ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার বাণিজ্যের সঙ্গে সংযোগের পথ খুঁজে পায়। এর প্রভাবও ভারতের সমুদ্র বাণিজ্যের পক্ষে অনুকূল হয়ে ওঠে। তবে এডেন অঞ্চল থেকে ভারতের পশ্চিম উপকূলে যাতায়াত করার জন্য কোঙ্কনের বন্দরগুলির চেয়েও গুজরাট ও বিশেষ করে মালাবারের বন্দরগুলির উপযোগিতা বৃদ্ধি পায়। ইবন বতুতা ও মার্কো পোলো (১২৯৫) যে সব বন্দরের তালিকা দিয়েছেন তার মধ্যে মালাবার উপকূলের বন্দরের সংখ্যা বেশী। এই তালিকায় উল্লেখযোগ্য বন্দরের মধ্যে ছিল: কাওয়ালাম (কুইলন), কালিকট, ফান্দারিনা (পাণ্ডারাণি), মঞ্জুরুর (ম্যাঙ্গালোর), ফাকানুর (বারকুর), হিরাবুর (হোনাবুর) ও সিন্দাবুর (গোয়া)। এই বন্দরগুলির সঙ্গে এডেনের নিয়মিত বাণিজিক যোগাযোগের কথা ইবন বতুতা ও মার্কো পোলো বিস্তৃতভাবে জানিয়েছেন। এডেনের সঙ্গে থানা ও ক্যাম্বের যোগাযোগও ছিল, তবে এডেনের সঙ্গে মালাবার অঞ্চলের অধিক বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে কিশ ভারতের সঙ্গে–—বিশেষতঃ গুজরাটের বন্দরগুলির সঙ্গে–— নিয়মিত লেনদেন চালাত। দ্বাদশ শতকে লিখিত একটি ব্যবসায়িক চিঠি থেকে এস. ডি. গয়টাইন ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বাণিজ্যে কিশ-এর ভূমিকার সন্দেহাতীত প্রমাণ রেখেছেন। এই ব্যাপক বাণিজ্যিক যোগাযোগের ফলে ভারতের পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলিতে মুসলমান বণিকদের নিয়মিত উপস্থিতি সমকালীন তথ্যসূত্রে বিধৃত। এছাড়াও মালাবার উপকূলে ১১৯২ খ্রীঃ টুডেলার বেঞ্জামিন ইহুদী বণিকদের বসতি লক্ষ্য করেছিলেন। এই বিবরণীর যাথার্থ্য অন্য একটি সূত্রে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। এই সূত্রটি হল ইহুদী বণিকদের চিঠি, যার ঐতিহাসিক তাৎপর্য যথাযথ অনুভব করেছিলেন এস. ডি. গয়টাইন। এই চিঠিগুলিতে এব্রাহাম ইশু নামক এক ইহুদী বণিকের উজ্জ্বল ভূমিকা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। এডেন ও আলেকজান্দ্রিয়াতে নানা পণ্যের চাহিদা, দাম, জাহাজী পরিবহণের নানা দিক, ব্যবসায়ে লাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বণিকদের ভিতর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও সামাজিক সহাবস্থান প্রভৃতি বিষয়ে বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। আদি মধ্যযুগীয় ভারতীয় বাণিজ্যের ইতিহাসে এই চিঠিগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।

দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্যিক গুরুত্বের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কথাও খেয়াল রাখতে হবে। আরব লেখকরা শ্রীলঙ্কাকে সেরেনদিব বা সিলানদিব নামে অভিহিত করেছেন। পশ্চিমদিকে মালদ্বীপ ও পূর্বে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তথা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন থাকায় আরবরা শ্রীলঙ্কার ভূমিকা যথাযথ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।

পূর্বভারতে আরব বাণিজ্যের কি প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়? খ্রীঃ অষ্টম শতাব্দীর পর প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত বন্দর তাম্রলিপ্ত তার গুরুত্ব হারায়। এর ফলে হয়তো সাময়িকভাবে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে বহির্বাণিজ্যের পক্ষে অনুকূল অবস্থা ছিল না। কিন্তু নবম শতকের শেষ ও দশম শতকের গোড়া থেকে আরব বিবরণীতে সমন্দর নামক এক অতি সমৃদ্ধ বন্দরের কথা জানা যায়। আরব বিবরণী বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে এই বন্দর বর্তমান চট্টগ্রামের (বাংলাদেশ) কাছেই অবস্থিত ছিল। হুডুড-অল-আলমের রচয়িতা (৯৮২), ইবন খোরদাদবা ও অল ইদ্রিসির বিবরণে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। অল ইদ্রিসি বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন, এই বন্দরে বাণিজ্যরত বণিকরা যথেষ্ট লাভ করতেন। এই একই বন্দর ইবন বতুতার রচনায় সুদকাওয়ান (=চট্টগ্রাম) নামে অভিহিত। সুদকাওয়ান নামটি অনেক ঐতিহাসিক মধ্যযুগের বিখ্যাত বন্দর সপ্তগ্রামের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন। ইবন বতুতা সুদকাওয়ানকে স্পষ্টতই সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত বলে বর্ণনা করেছেন; কিন্তু সপ্তগ্রামের থেকে বঙ্গোপসাগর অনেক দূরে অবস্থিত। এই বন্দরের উত্থানের ফলে তাম্রলিপ্তির পতনের প্রতিকূল প্রভাব অনেকটাই বোধ হয় প্রশমিত হয়েছিল। বাংলার ক্ষেত্রে সমন্দর বা সুদকাওয়ান আদি মধ্যযুগের প্রধান বন্দর তো বটেই, কামরূপের পণ্যও এই বন্দর দিয়েই রফতানি হত। এই প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় তথ্য অল ইদ্রিসি ও ইবন বতুতার রচনায় পাওয়া যাবে। আরব লেখকরা সমন্দরের সঙ্গে উরানশিন (ওড়িষ্যা) ও কাঞ্জা (কাঞ্জীভরম) দেশের যোগাযোগের কথা জানিয়েছেন। সিলানদিব বা শ্রীলঙ্কা থেকেও সমন্দরে সমুদ্রপথে পৌঁছনোর কথা আরব বিবরণীতে আছে। তাম্রলিপ্ত বন্দর যখন তার সমৃদ্ধি ও গৌরবের শিখরে তখন দঃ পূঃ এশিয়া, সিংহল প্রভৃতি এলাকার সঙ্গে তার বাণিজ্যিক যোগাযোগ অবশ্যই ছিল। কিন্তু আদি মধ্যযুগেই সমন্দর বা সুদকাওয়ানের উত্থান বাংলাকে পশ্চিম এশিয়া ও দঃ পূঃ এশিয়ার সঙ্গে যুগপৎ বাণিজ্যিক লেনদেনে যুক্ত করে দেয়।

দঃ পূঃ এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল দক্ষিণ ভারতের পূর্ব উপকূল। পল্লব বংশীয় রাজাদের সময়েই কাঞ্চীপুরম এলাকা এই বাণিজ্যের পক্ষে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। চোল রাজাদের শাসনকালে করমণ্ডল উপকূল দঃ পূঃ এশিয়া ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রভূত খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করে। রাজরাজ চোলের রাজত্বকালে (৯৮৫-১০১৪) মামল্লপুরম ছিল প্রধান বন্দর; এই বন্দরের সঙ্গে রাজরাজের বিশেষ রাজনৈতিক সম্পর্কের কথা হল আলোচনা করেছেন। সমকালীন দক্ষিণ ভারতের একটি প্রধান বণিক গোষ্ঠী এই বন্দরের কাজকর্ম তদারকির ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। তবে অপর বন্দর নাগপট্টনম্‌-এর দ্রুত উত্থানের ফলে মামল্লপুরম-এর প্রাধান্য কিছুটা কমে যায়। চীনের সুং বংশের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে চু-লিয়েন বা চোল দেশ থেকে ১০১৫ খ্রীঃ রাজা লো-ৎ-সা-লো-ৎ-সা চীনে বাণিজ্যিক দৌত্য পাঠিয়েছিলেন। লো-ৎ-সা-লো-ৎ-সা অবশ্যই রাজরাজ নামের চীনা রূপ। দশম শতকের পূর্বে এশীয় সমুদ্র বাণিজ্যে চীনের সরাসরি অংশগ্রহণ ও উৎসাহ বিশেষ দেখা যায় না। কিন্তু সুং বংশের আবিভার্ব সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই অবস্থায় চীন ও করমণ্ডল উপকূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। এশীয় বাণিজ্যের দুই প্রান্তে আরব ও চীনা বণিকদের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়; ভারতবর্ষ বিশেষতঃ দক্ষিণ ভারত এই বাণিজ্য সম্পর্কে ভৌগোলিক ও বাণিজ্যিক উভয় কারণেই অন্তর্বর্তীর ভূমিকা নেয়।

রাজরাজ চোলের পুত্র ও উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্র চোলের আমলে (১০১২-৪৪) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও নিয়মিত ও ত্বরান্বিত হয়। শ্রীবিজয়ের (সুমাত্রার পালেমবাঙ্গ) রাজা সংগ্ৰামবিজয়োওঙ্গবর্মন নাগপট্টনমে চড়ামণিবিহার তৈরি করে দিয়েছিলেন। এই সাংস্কৃতিক যোগাযোগ কার্যত নিয়মিত আর্থিক ও বাণিজ্যিক যোগসূত্র ব্যতিরেকে গড়ে তোলা অসম্ভব। দুটি লেখমালাতে শ্রীবিজয়ের রাজার প্রতিনিধির নাগপট্টনমে উপস্থিতির স্পষ্ট উল্লেখ আছে। তাঁদের একজন একটি মন্দিরে চীনের সোনা (চীনক্কনকম) দান করেছিলেন। এই ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ: চীনের সামগ্রী যদি শ্রীবিজয়ের মাধ্যমে করমণ্ডলে আসে, তাহলে চীন-করমণ্ডল এলাকার-সমুদ্র বাণিজ্যে শ্রীবিজয়ের মধ্যবর্তী ভূমিকা স্বীকার করে নিতে হবে। হল যথার্থই বলেছেন যে, নানা প্রকার উপহারাদি দান করে ও সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা শ্রীবিজয়রাজ আসলে চোলদের সঙ্গে নিয়মিত বাণিজ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিলেন। আবার একই সময়ে মালয় উপদ্বীপের পশ্চিম উপকূলে কম্বোজ বা কাম্বোডিয়া অঞ্চলের সঙ্গেও চোলদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। রাজেন্দ্র চোলের পট্টুর তাম্রশাসনে (১০২০ খ্রীঃ) কম্বোজ রাজের পাঠানো উপহারের উল্লেখ আছে। এই কম্বোজ রাজা সম্ভবতঃ প্রথম সূর্যবর্মন। এছাড়াও চিদাম্বরমের আর একটি লেখমালায় রাজেন্দ্ৰ চোলকে পাঠানো কম্বোজ রাজের অন্য উপহারের কথা উল্লিখিত হয়েছে। হল মনে করেন অর্থনৈতিক সহযোগিতার কারণেই চোল ও কম্বোজ রাজার মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরী ছিল। পরবর্তী চোল রাজারাও সমুদ্র বাণিজ্যে চোলদের ভূমিকা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা উচিত প্রথম কুলোত্তুঙ্গের কথা (১০৭০-১১২০ খ্রীঃ)। ১০৯৮ ও ১১০২ খ্ৰীষ্টাব্দের দুটি লেখতে তিনি ‘সুঙ্গ’ বা শুল্ক পরিহারের কথা ঘোষণা করেছেন। শুল্ক ছাড় দেবার নীতি নিঃসন্দেহে বিদেশী বণিকদের উৎসাহ দেবার জন্যই নেওয়া হয়েছিল। মোটামুটি ঐ একই সময়ে কুলোত্তুঙ্গ পাগানের (ব্রহ্মদেশ) রাজা প্রথম কায়ানজিত্থার (১০৭৭-১১১২ খ্রীঃ) সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। চৌ-জু-কুয়া তাঁর গ্রন্থে (১২২৫) জানিয়েছেন যে চীন থেকে চু-লিয়েন বা চোল দেশের যাবার অন্যতম পথ গিয়েছিল পু-কান বা পাগান হয়ে। এর থেকে সিদ্ধান্ত করা অনুচিত হবে না যে, পাগানের মাধ্যমে ও সহযোগিতায় চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চালাবার উদ্দেশ্যেই কুলোতুঙ্গ পাগানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। তাঁর রাজত্বকালে নাগপট্টনম ছাড়াও আরও একটি বন্দর বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। এই বন্দর বেঙ্গী উপকূলে অবস্থিত বিশাখাপত্তনম, যা বর্তমানেও একই নামে পরিচিত। ১০৬৮ খ্রীঃ একটি লেখতে প্রথম বিশাখাপত্তনম বন্দরের নাম জানা যায়। ১০৯০ খ্রীঃ কুলোত্তুঙ্গের একটি লেখতে বিশাখাপত্তনম বন্দরের উল্লেখই শুধু নেই, বন্দরটির দ্বিতীয় নামও পাওয়া গিয়েছে। দ্বিতীয় নামটি কুলোত্তুঙ্গচোলপট্টনম। চোল সম্রাট কুলোত্তুঙ্গের নামানুসারেই বন্দরটির নতুন নামকরণ হয়েছিল। ঠিক কোন সময়ে এই নতুন নামটি সরকারিভাবে দেওয়া হয়েছিল তার নির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকলেও, একথা মানতে দ্বিধা নেই যে ১০৬৮ ও ১০৯০-এর মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে নাম বদলের ঘটনাটি ঘটে। চোল রাজারা নগর ও মন্দিরের অনেকক্ষেত্রেই নিজেদের নামানুসারে নামকরণ করতেন, কিন্তু একটি বন্দরের ক্ষেত্রে এই জাতীয় নামকরণের এটি একমাত্র দৃষ্টান্ত। অতএব বিশাখাপত্তনম বন্দরের গুরুত্ব অত্যন্ত দ্রুত বেড়েছিল ও তা স্বয়ং চোল সম্রাটের স্বীকৃতি লাভ করে। কেন করমণ্ডল উপকূলস্থিত বন্দরের পরিবর্তে বেঙ্গী উপকূলের একটি বন্দরের গৌরব এত প্রকট হল তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে আন্দাজ করা যায় কৃষ্ণা গোদাবরী বদ্বীপ অঞ্চলের বন্দর বিশাখাপত্তমন থেকে বঙ্গোপসাগরের পূর্বদিকে পাগান অঞ্চলে যাওয়া সহজতর ছিল। শুল্ক মকুব, পাগানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও বিশাখাপত্তনম বন্দরের নতুন নামকরণ এই তিন ঘটনার কালগত নৈকট্য এত বেশী যে তাদের ভিতর পারস্পরিক সম্পর্ক থাকা বিচিত্র নয়।

খ্রীঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত চোলদের সমুদ্র বাণিজ্যের উৎসাহ নিয়ে দ্বিমত নেই। রাজরাজ ও রাজেন্দ্রের আমলে এরই সঙ্গে চোল নৌবহরের প্রতাপ ব্যাপক আকার ধারণ করে। রাজরাজ শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপে সফল নৌ অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। চোল নৌবহরের আগ্রাসী নীতি রাজেন্দ্রের আমলে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। শ্রীলঙ্কা সম্পূর্ণভাবে চোলদের দ্বারা অধিকৃত হয়। শ্রীবিজয় ও কড়ারম (কটাহ বা কেডা) সহ দঃ পূঃ এশিয়ার বারোটি দ্বীপময় এলাকায় চোল নৌবহর সাফল্য লাভ করে। কিন্তু একমাত্র শ্রীলঙ্কা ছাড়া অন্য কোথাওই চোলরা নৌ অভিযানের সাফল্যকে ভূখণ্ডবিস্তারের সঙ্গে যুক্ত করেননি। ফলে নিছক সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্যই এই নৌ অভিযান চালানো হয়, এ কথা মেনে নেওয়া কঠিন। জর্জ স্পেন্সার মনে করেন যে চোলরা সম্পদ লুণ্ঠনের জন্যই এই জাতীয় বিশাল নৌ অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু লুণ্ঠন মূলত একটি সাময়িক নীতি, যে নীতি কোনও রাজশক্তি আর্থিক চাপে পড়লেই নিয়ে থাকে। কিন্তু রাজরাজ থেকে কুলোত্তুঙ্গ পর্যন্ত (৯৮৫-১১২০) দীর্ঘ ১৩৫ বছর সময় ধরে চোলরা লুণ্ঠনের আকাঙ্ক্ষায় তাঁদের নৌ বহর সক্রিয় রেখেছিলেন, একথা মানা মুশকিল। তদুপরি চোলদের কৃষি অর্থনীতির যে সমৃদ্ধ অবস্থার কথা সমকালীন তথ্যসূত্রে বিধৃত, তাতে রাজকোশের উপর আর্থিক চাপের বিশেষ লক্ষণ চোখে পড়ে না। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলির বাণিজ্যিক গুরুত্ব আরব ও চীনা দুই উপাদানেই স্বীকৃত। দঃ পূঃ এশিয়ার দ্বীপগুলি চীন ও ভারতের মধ্যবর্ত্তীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে থাকতে পারে। চোলদের সমুদ্র বাণিজ্যে চীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই বাণিজ্যে দঃ পূঃ এশিয়ার মধ্যবর্ত্তীর ভূমিকাকে সঙ্কুচিত করার উদ্দেশ্যে যদি চোলরা আগ্রাসী সমুদ্রনীতি গ্রহণ করে থাকেন, তা হলে তা বাণিজ্যিক স্বার্থেই ঘটেছিল। এই অভিযানগুলির দরুণ বঙ্গোপসাগর এলাকা কার্যতঃ ‘চোল হ্রদে’ পরিণত হয়েছিল।

বাণিজ্যের অবক্ষয়–—বিশেষত দূরপাল্লার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের স্বল্পতর ভূমিকা সম্বন্ধে শর্মা ও যাদবের ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গী মেনে নেওয়া শক্ত। যদিও শর্মা ও যাদব খ্ৰীঃ ১০০০-এর পর থেকে বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটেছিল বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় জানিয়েছেন, এই আলোচনায় ব্যবহৃত সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে ১০০০ খ্রীঃ আগেও ব্যবসায়ের সজীব চরিত্র সহজেই দেখা যাবে। এই বিষয়ে আরও একটি নিদর্শন মুদ্রার ব্যবহার। দঃ পূঃ বাংলাদেশের ময়নামতীতে উৎখননের দ্বারা আদি মধ্যযুগীয় পর্বের রৌপ্য মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। বাণিজ্যিক ইতিহাসের উপকরণ হিসেবে মুদ্রাগুলির অবিসংবাদী গুরুত্ব প্রমাণ করেছেন ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর গবেষণার দ্বারা নিঃসন্দেহে দেখানো যায় যে দঃ পূঃ বঙ্গে খ্ৰীষ্টীয় সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে রৌপ্য মুদ্রার ব্যবহার ছিল। এই মুদ্রাগুলির গায়ে হরিকেল (নোয়াখালি, কুমিল্লা অঞ্চল, বাংলাদেশ) পট্টিকের (পাইটকারা, বাংলাদেশ) প্রভৃতি স্থান নাম লিখিত আছে। সপ্তম ও অষ্টম শতক নাগাদ হরিকেলের মুদ্রাগুলির ব্যাস ২.৬ সেঃ মিঃ থেকে ৩.০৭ সেঃ মিঃ; এদের ওজন কখনও .৫ গ্রাম থেকে ১.৮ গ্রাম আবার কোনও ক্ষেত্রে ৫ গ্রাম থেকে ৭.৫ গ্রাম। এই মুদ্রাগুলি রৌপ্য নির্মিত; একদিকে উপবিষ্ট বৃষ মূর্তি ও অপরদিকে ত্রিশূল জাতীয় বস্তুর প্রতিকৃতি আছে। এই পর্বের মুদ্রাগুলি সম্ভবত সন্নিহিত এলাকা আরাকানের মুদ্রার আদলে ও প্রভাবে নির্মিত বলে ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অনুমান করেন। দশম শতকের পর থেকে মুদ্রা ব্যবস্থায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মুদ্রাগুলি আকারে বড় হয় (৪.৮ সেঃমিঃ থেকে ৫.২৫ সেঃ মিঃ); তাদের মাত্র একপিঠে নকশা আঁকা হয়; ওজনও পরিবর্তিত হয়ে ২.৩৮০০ গ্রাম ও ৩.৩৬৬০ গ্রামের মধ্যে স্থাপিত হয়। মুদ্রাগুলি আকারে বড়, পাতলা ও হাল্কা হলেও তাদের ধাতুগত বিশুদ্ধি অটুট ছিল। রাসায়নিক পরীক্ষায় মুদ্রাগুলিতে গড়ে ৯৬% ভাগ রূপোর অস্তিত্ব প্রমাণিত।

দশম শতকে মুদ্রাগুলির আকারে ও ওজনে বদল কেন ঘটল সে বিষয়ে ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। এই সময় উত্তর ভারতে রৌপ্য মুদ্রার প্রচলিত নাম পুরাণ, ধরণ, কার্ষাপণ ও দ্রম্ম। ৩২ রতি বা ৫৭.৫ গ্ৰেণ বিশিষ্ট ওজনের এই মুদ্রাগুলির প্রচুর উল্লেখ লেখমালায় আছে। দশম শতকে হরিকেলীয় মুদ্রা ব্যবস্থার বদল রৌপ্য মুদ্রাগুলিকে সম্ভবত উত্তর ভারতের দ্রম্ম, কার্ষাপণ, পুরাণ প্রভৃতি মুদ্রার সঙ্গে ওজনের দিক দিয়ে বিনিময়যোগ্য করে তোলে। আবার অপরদিকে পশ্চিম এশিয়ার দিরহাম জাতীয় রৌপ্য মুদ্রার ওজনেও (২.৯৭ গ্রাম বা ৩.৯০৬ গ্রাম অর্থাৎ ৪৫.৪৮ গ্রেণ ও ৬০.৩ গ্রেণ) হরিকেলীয় মুদ্রার নতুন ওজনের সঙ্গে সমতা দেখা যায়। ফলে রৌপ্য মুদ্রাগুলির উত্তর ভারতে ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যবহৃত হবার সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না। বিশেষত পাহাড়পুর এলাকা থেকে খলিফা হারুণ-উর রশিদের (৭৮৮ খ্রীঃ) গোলাকৃতি পাতলা রৌপ্য মুদ্রা ও ময়নামতীতে আব্বাসীয় খলিফা আবু আহম্মদ আবদাল্লা অল মুসতাসিম বিল্লা (১২৪২-১২৫৮)-র স্বর্ণমুদ্রার আবিষ্কার হরিকেল অঞ্চলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকার পরিচয় দেয়। মনে রাখা দরকার আরব লেখকের দ্বারা প্রশংসিত সমন্দর বা সুদকাওয়ান বন্দর (চট্টগ্রাম) ছিল এই অঞ্চলেই অবস্থিত।

খ্রীঃ ৬০০ থেকে ১০০০ পর্যন্ত উত্তর ভারতে মুদ্রার অনুপস্থিতি বা স্বল্পতর ব্যবহারের ধারণা উপরিউক্ত তথ্যের দ্বারা একেবারেই সমর্থিত হয় না। সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত মুদ্রার অব্যাহত ব্যবহার বাণিজ্যের গতিময়তাকেই প্রমাণ করে। একথা ঠিক যে দঃ পূঃ বঙ্গে মুদ্রার নিয়মিত উপস্থিতি দেখা যায়, কিন্তু সমকালীন উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গে পাল-সেন আমলের কোনও মুদ্রা পাওয়া যায়নি। যদিও পুরাণ দ্রম্ম প্রভৃতি মুদ্রার নাম পাল সেন তাম্রশাসনে প্রায়ই আছে তবুও একথা মানতে হবে যে, পাল সেন রাজাদের দ্বারা প্রস্তুত কোনও মুদ্রার অস্তিত্ব এখনও জানা নেই। বরং বহু তাম্রশাসনে ‘পুরাণ কপর্দক’ কথাটিই দেখা যায়। কপর্দক বা কড়ি ব্যবহারের এটি অবশ্যই স্পষ্ট প্রমাণ। কিন্তু কড়ির উপস্থিতি দূরপাল্লার বাণিজ্য ব্যবস্থায় বেশী দেখা যায় না এবং কড়ির ব্যাপক ব্যবহার কার্যত ‘বিনিময়’ (বার্টার) প্রথার ইঙ্গিতবাহী, রামশরণ শর্মা ও তাঁর অনুগামীদের এই ধারণা সম্বন্ধে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ কড়ি প্রাচীন বাংলায় পাওয়া যেত না; মা-হুয়ানের চৈনিক বিবরণে (পঞ্চদশ শতকের প্রথমদিকে রচিত) পরিষ্কার উল্লেখ আছে যে কড়ি বাংলায় আমদানী হত মালদ্বীপ থেকে, তার বদলে বাংলা থেকে চাল মালদ্বীপে যেত। অর্থাৎ কড়ি সরাসরি দূরপাল্লার সমুদ্র বাণিজ্যেরই সামগ্রী; তার উপস্থিতি কখনওই আবদ্ধ অর্থনীতির পরিচায়ক নয়, যে আবদ্ধ অর্থনীতিতে ব্যবসায়ের সম্ভাবনা সাধারণতঃ অল্পই থাকে। কড়ির ব্যবহার দিয়ে অন্ততঃ আবদ্ধ অর্থনীতির প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে কড়ি ও পুরাণ জাতীয় রৌপ্য মুদ্রা (যা হরিকেলের মুদ্রার সঙ্গে সমতুল) সহজেই বিনিময় করা যেত: ১২৮০টি কড়িতে একটি রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া যেত, এবং ২০৪৮০টি কড়ির বদলে ১টি স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যেত। ফলে পাল-সেন শাসিত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে মুদ্রা না থাকলেও তা বাণিজ্যের পরিপন্থী ছিল না; ঐ অঞ্চলের ‘পুরাণকপর্দক’ সহজেই হরিকেলের রৌপ্য মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় করা যেত (অনেকটা আজকের দিনে এক টাকাকে একশ পয়সায় ভাঙ্গিয়ে নেবার মত)।

অবশ্য এই কথা মানতে হবে যে ব্যবসায়ের কাজে বিপুল পরিমাণ কড়ি লাগত; বণিক, বিশেষতঃ ভ্রাম্যমান বণিকের পক্ষে, অত পরিমাণ কড়ি নিয়ে ব্যবসায়ের কাজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া নিঃসন্দেহে কষ্টকর ছিল। ফলে কড়ির সহজতর বিকল্প বিশেষ ভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। দ্বাদশ শতকের শেষও ত্রয়োদশফ শতকের গোড়া থেকে একটি নতুন শব্দ কার্ষাপণ ও পুরাণের সঙ্গে সঙ্গে লেখমালায় ব্যবহৃত হতে থাকে: এই কথাটি চূর্ণী। বিশ্বরূপ সেনের মদনপাড়া শাসন ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ শাসন ও দামোদরদে-বের মেহার তাম্রপট্টে পুরাণ ও চূর্ণী কথা দুটি সমার্থক শব্দ হিসেবে প্রযুক্ত। ওড়িষ্যার অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গের অলগুম শাসনে (১১৪১ খ্রীঃ) পুরাণ, কার্ষাপণ ও চূর্ণী শব্দ তিনটি একত্রে সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত। চুর্ণী কি তাহলে কোনও নতুন মুদ্রা? অথচ এই জাতীয় কোনও মুদ্রার চাক্ষুষ পরিচয় জানা নেই। ‘চূর্ণী’ কথার অর্থ যা চূর্ণ (অর্থাৎ টুকরো/গুঁড়ো) করা হয়েছে; যেহেতু মুদ্রা নামের সঙ্গে চূর্ণী কথাটি একত্রে ব্যবহৃত, তাই অনুমান করা যুক্তিযুক্ত যে ‘চূর্ণী’ বলতে ধাতব চূর্ণ বা ক্ষুদ্রক্ষুদ্র খণ্ড বোঝানো হয়েছে। সোনা বা রূপোর গুঁড়ো দিয়ে যে বাণিজ্য চালানো সম্ভব তার পরিচয় আরব বিবরণে আছে। আরব লেখকদের মতে ‘জুজুর বা গুর্জর প্রতিহার ভূখণ্ডে ধাতব চুর্ণ দিয়ে ব্যবসা চলত। এই ব্যবস্থার আর একটি উদাহরণ একটি তিব্বতী বিবরণে পাওয়া যায়। বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে নিয়ে যাবার জন্য যে তিব্বতী সন্ন্যাসী বিক্রমশীলা মহাবিহারে এসেছিলেন, তাঁকে নানাবিধ খরচ মেটাবার জন্য কিছু পরিমাণ সোনা দেওয়া হয়। তিনি ঐ স্বর্ণ চূর্ণ করে, ছোট পুঁটলিতে রাখেন ও সম্ভবত যাবতীয় খরচ মেটান। এই কাহিনীর দ্বারা চূণীকৃত ধাতব খণ্ডের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। এক পুরাণ/ কার্ষাপণ/ দ্রম্ম (অর্থাৎ রৌপ্য মুদ্রা) মুদ্রাতে যে পরিমাণ রূপো থাকার কথা, তার সমান ওজনের বিশুদ্ধ রূপো যদি চূর্ণ করে ছোট পুঁটলিতে ভর্তি করা যায় তাহলে ঐ ধাতব চূর্ণ মুদ্রার মতই বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। ফলে একটি রৌপ্য মুদ্রা সমান ওজনের রৌপ্য চূর্ণের সঙ্গে বিনিময় করা যায়; অতএব এক রৌপ্য মুদ্রায় যদি ১২৮০টি কড়ি পাওয়া যায় তাহলে সমপরিমাণ এক রৌপ্য ‘চূর্ণী’ দিয়েও ১২৮০টি কড়ি পাওয়া যাবে। ‘চূর্ণী’র ব্যবহার শুরু হওয়ায় প্রচুর পরিমাণ কড়ি নিয়ে ব্যবসায়ীর পক্ষে যাতায়াতের অসুবিধা বোধহয় অনেকটাই কমে গিয়েছিল। সমকালীন উত্তর ভারতে যে ধাতব মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তার ধাতব বিশুদ্ধি, ওজন সবসময়ে ঠিক ও নির্ভরযোগ্য নয়। ফলে সন্দেহজনক ধাতব মুদ্রা দিয়ে দূরপাল্লার বাণিজ্য চালানো দুষ্কর হতে পারে; কিন্তু যদি সমপরিমাণ বিশুদ্ধ ধাতব খণ্ড বা চূর্ণকে বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে পাওয়া যায়, তাহলে দূরপাল্লার ব্যবসায়ে সহজেই তাকে ব্যবহার করা যাবে। আদি মধ্যযুগে বাংলার বিনিময়ের মাধ্যম অন্তত তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। এই ত্রিস্তর ব্যবস্থার সর্বনিম্ন পর্যায়ে কড়ি বা কপর্দক; সর্বোচ্চ পর্যায়ে ধাতব মুদ্রা (দ্রম্ম/কার্ষাপণ/পুরাণ জাতীয় রৌপ্য মুদ্রা, যার চাক্ষুষ নিদর্শন দঃ পূঃ বাংলাদেশে পাওয়া যায়) এবং মধ্যবর্তী স্তরে ধাতবচূর্ণ বা চূর্ণী। প্রত্যেকটি বিনিময় মাধ্যমই অপর দুটি মাধ্যমের সঙ্গে সহজে বদলে নেওয়া যেত।

আদি মধ্যপর্বের বাংলার মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে এত কথা বলার কারণ: (১) উপযুক্ত তথ্যের সমাহার ও (২) শর্মা যে তিনটি এলাকায় মুদ্রাবিহীন আবদ্ধ অর্থনীতির (যা সামন্ত ব্যবস্থার দ্যোতক) খাঁটি নজীর দেখিয়েছিলেন, বাংলা তার অন্যতম। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে ধাতবমুদ্রা, চূর্ণী ও কপর্দকের সহাবস্থান ও সহজ বিনিময়যোগ্যতা উত্তর ভারতের অন্যত্র চালু থাকলে বিস্মিত হবার নেই।

আদি মধ্য যুগে সামন্ত ব্যবস্থায় বাণিজ্যের–—বিশেষত বৈদেশিক বাণিজ্যের–—অধোগতির যে ধারণা শর্মা, যাদব প্রমুখ ঐতিহাসিকের লেখনীতে বিধৃত, তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ কম নয়। শর্মা ও যাদব অবশ্য ১০০০ খ্রীঃ-এর পর থেকে বাণিজ্যের উন্নতি হয়েছিল বলে মনে করেন। কিন্তু ৬০০ থেকে ১০০০ খ্রীঃ পর্যন্ত সময়েও (যা তাঁদের মতে সামন্ত প্রথার সক্রিয় যুগ) যে বাণিজ্যের গতিময়তা ও সজীব চরিত্র বজায় ছিল, তা উপরের আলোচনা থেকে অনুধাবন করা যায়। এই বাণিজ্য যে কেবলমাত্র বিলাসদ্রব্যের উপর নির্ভর করত তা নয়। বহু আটপৌরে সামগ্রীর উল্লেখ সমকালীন সূত্রে দেখা যায়। মণ্ডপিকাতে আনীত ও বিক্রয়যোগ্য পণ্যের মধ্যে অনেকগুলিই দৈনন্দিন ব্যবহারে লাগত। এর মধ্যে খাদ্যশস্য ও পণ্যশস্যের লেনদেন ক্রমশই গুরুত্ব পেতে থাকে। নুনের ব্যবসা ও ব্যবসায়ীর পরিচয় সীয়াডোনী লেখতে পাওয়া যায়। সুগন্ধী মশলা, গোলমরিচ, দামী কাপড়, ধনরত্ন ইত্যাদি বিলাসদ্রব্যের বাণিজ্যিক (বিশেষত দূরপাল্লার বাণিজ্যে) গুরুত্ব অস্বীকার করা অসম্ভব। কিন্তু দৈনন্দিন উপকরণের জিনিসও যে দূরপাল্লার বাণিজ্যে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ইহুদী বণিকদের চিঠিতে পাওয়া যাবে। ভারতে আমদানী করা অন্যতম দুর্মূল্য সামগ্রী ছিল যুদ্ধাশ্ব। যেহেতু যুদ্ধের ভালো ঘোড়া ভারতে দুর্লভ ছিল, ফলে আরবী ও পার্সী ঘোড়া বহু দামে সমুদ্রপথে আনতে হত। মার্কো পোলো ও ওয়াসাফের বিবরণ থেকে দেখা যায় কিভাবে ভারতীয় রাজারা প্রচুর পরিমাণ ঘোড়া প্রতি বছর আমদানী করতেন; কিন্তু ঘোড়ার যথাযথ পরিচর্যা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় বহু ঘোড়া অল্প সময়েই মারা যেত, ফলে প্রতি বছর ঘোড়ার চাহিদা লেগেই থাকত। ঘোড়ার ব্যবসা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে উত্তর ভারতে ‘হেড়বিক’ ও দক্ষিণ ভারতে (বিশেষতঃ মালাবারে) ‘কুদির চেট্টী’ (‘কুদির’ = ঘোড়া; ‘চেট্টী’= শ্রেষ্ঠী বা ব্যবসায়ী) নামে ঘোড়ার কারবারীদের দুই স্বতন্ত্র সংগঠন গড়ে ওঠে।

॥ ৬ ॥

কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক প্রসার, কারিগরী শিল্পে বৈচিত্র্য ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণবন্ত চরিত্র আদি মধ্যযুগে যদি দেখা যায়, তাহলে নগরজীবনের উপর তার প্রভাব কি ও কতটা। রামশরণ শৰ্মা আদি মধ্যপর্বে বিশেষতঃ ৬০০-১০০০ খ্রীঃ নগরের সার্বিক অবক্ষয় ও গ্রামীণ আবদ্ধ অর্থনীতির উত্থান দেখেছিলেন; তার সবচেয়ে জোরালো সমালোচনা ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণায় পাওয়া যাবে। প্রধানত আদি মধ্যযুগের লেখমালার ভিত্তিতে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় তাঁর মতামত পেশ করেছেন। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত সময়সীমায় উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত নগর যে অবক্ষয়ের কবলে পড়েছিল, তার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ চট্টোপাধ্যায় অস্বীকার করেন না। কিন্তু অবক্ষয় সার্বিক কি না ও তা কতটা সামন্ত ব্যবস্থার উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছে, এ বিষয়ে তিনি শর্মার সঙ্গে সহমত নন। শর্মা যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের উপর ভিত্তি করে চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে উত্তর ভারতের অনেকগুলি নগরের জরাজীর্ণ অবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন, চট্টোপাধ্যায় অনুরূপ পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য দিয়েই বেশ কিছু নগরের অস্তিত্ব একই সময়ে দেখিয়েছেন। আদি ঐতিহাসিক পর্বের অন্যতম প্রধান নগর অহিচ্ছত্র (বেরিলী জেলা) আদি মধ্যযুগেও একটানা শহরের লক্ষ্মণ বজায় রাখতে পেরেছিল; প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে তা প্রমাণ করা যায়। দিল্লীর পুরানা কিল্লায় উৎখনন থেকেও কুষাণ আমল ও তুর্কী অভিযানের মধ্যবর্তী সময়ে অবক্ষয়ের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না। উত্তর প্রদেশের অত্রঞ্জিখেড়াতে-ও নগরের অবক্ষয়ের কোনও চাক্ষুষ পরিচয় নেই। একইভাবে বারাণসীর নিকটস্থ রাজঘাটের চতুর্থ স্তর ও পঞ্চম স্তরের কাল যথাক্রমে ৩০০-৭০০ খ্রীঃ এবং ৭০০-১২০০; বারাণসী নগরীর অব্যাহত অস্তিত্ব এই দুই পুরাতাত্ত্বিক স্তরে দেখা যাবে। একইভাবে বিহারের চিরন্দ-এও উৎখনন চালিয়ে আদি মধ্যযুগীয় নগরের পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। চট্টোপাধ্যায়ের পেশ করা পুরাতাত্ত্বিক এই সাক্ষ্য প্রমাণগুলি গাঙ্গেয় উপত্যকায় আদি মধ্যযুগে নগরের ধারাবাহিকতার দিকে ইঙ্গিত করে; শর্মা এই পর্বে গাঙ্গেয় উপত্যকাতেই নগরের অবক্ষয়ের সবচেয়ে বেশী দৃষ্টান্ত হাজির করেছিলেন।

চট্টোপাধ্যায় লেখমালার সাক্ষ্যও উপস্থাপিত করেছেন। হরিয়ানার পেহোয়া বা প্রাচীন পৃথুদক-এ একটি অধিষ্ঠান বা নগরের অস্তিত্ব ৮৮২-৮৩-র লেখতে জানা যায়। এই নগর গুর্জর ভূখণ্ডের অন্তর্গত ছিল। এই নগরটি নিগম বলেও লেখতে অভিহিত। এই শহর ছিল উত্তরাপথের প্রধান অশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র; ঘোড়ার মেলা ও সংশ্লিষ্ট বণিকদের পরিচয় লেখতে বলা আছে।

গাঙ্গেয় উপত্যকার অন্যতম নগর ছিল তত্তানন্দপুর, যার অবস্থান বর্তমান বুলন্দশহরের কাছে ছিল। দশটি লেখতে (৮৬৭ থেকে ৯০৭ খ্রীঃ) এই নগরের বিষয়ে তথ্যাদি জানা যায়। এই বসতি যে পুরোদস্তুর নগর ছিল তার প্রমাণ ‘পুর’ ও ‘পত্তন’ শব্দ দুটির প্রয়োগ। লেখমালাতে এই নগরের ছোট ও বড় রাস্তা (‘কুরথ্যা’ ও ‘বৃহদ্রথ্যা’) এবং বাজারে যাবার পথ (‘হট্টমার্গ’), শহরের পূর্ব দিকে অবস্থিত বাজার (‘পূর্বহট্টপ্রদেশ’), বাসগৃহ (‘গৃহ’) ও দোকানের (‘আবরী’) তথ্যনিষ্ঠ বর্ণনা আছে। নগরে ছয়টি মন্দির ছিল বলেও জানা যায়। তত্তানন্দপুর যে নগরসুলভ আকার ও চরিত্র ধারণ করেছিল, আহাড়ের উৎখনন থেকেও তার সমর্থন মিলেছে।

সীয়াডোনীতে পাওয়া নবম শতকের লেখটিতেও নগরায়নের চরিত্র মূর্ত্ত হয়েছে। লেখটিতে ৯০৭-৬৮ খ্রীঃ এর ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে, যে সময় অঞ্চলটি প্রতিহার সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। সীয়াডোনীকে ‘পত্তন’ বা শহর হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এখানে নুনের ব্যাবসায়ী (নেমকবণিজ) সহ, বিভিন্ন কারিগর ও ব্যবসায়ীর বাস ছিল। ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রে যাবার পথ ছিল (‘হট্টরথ্যা’) শহরে; কিছু কিছু রাস্তা ছিল বণিক অধ্যুষিত (‘বণিজোনিজরথ্যা’); একাধিক বিপণন কেন্দ্র ‘হট্ট’ বলে অভিহিত; বসতবাড়ী ছিল নানা রকম: বারান্দা যুক্ত বাড়ী (‘অপরসরক’), সাধারণ বাসগৃহ (‘আবাসনিকা’) ও বসবাসযোগ্য এলাকা (‘বাস্তু’)। এখানে একটি মণ্ডপিকারও অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছাড়াও সীয়াডোনী যে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসাবেও কাজ করত, তারও প্রমাণ লেখটিতে রয়েছে।

গুর্জর প্রতিহারদের ভূখণ্ডে অপর নগর গোপাদ্রি বা আধুনিক গোয়ালিয়র, যার নগর সুলভ চরিত্র ৮৭৫ ও ৮৭৬ খ্রীঃ-এর দুটি লেখতে দেখতে পাওয়া যায়। এখানে শ্ৰেষ্ঠী সার্থবাহ যেমন ছিলেন, তেমনই থাকতেন তৈলোৎপাদকরা (‘তৈলিক’)। দুটি ‘হট্টিকার’ অস্তিত্বও এই নগরে ছিল। এই নগরের চারিপাশে বোধহয় প্রাকার ছিল; তার কারণেই নগরটি ‘কোট্ট’ বা কেল্লা বলে বর্ণিত। দুর্গাধিপ হিসাবে ‘কোট্টপাল’ গুর্জর প্রতিহার শাসকের দ্বারা নিযুক্ত হতেন। ‘বলাধিকৃত’ বা উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারীর উপস্থিতি গোপাদ্রিতে থাকায়, এই নগরের সামরিক গুরুত্ব ও চরিত্র অনুমান করা কঠিন নয়। এই নগরগুলির মধ্যে পৃথুদকের তুলনায় সীয়াডোনী, তত্তানন্দপুর ও গোপাদ্রি অধিকতর বিকশিত ও পরিণত ছিল বলে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় মনে করেন। সীয়াডোনী ও গোপাদ্রি ছিল শহর হিসেবে অগ্রগণ্য; সীয়াডোনী ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র ছাড়াও প্রশাসনিক গুরুত্ব পায়, আর গোপাদ্রি সামরিক সংগঠনের দিক দিয়ে গুরুত্ব লাভ করে।

১০০০ খ্রীঃ-এ আগেই মধ্য প্রদেশে জবলপুরের কাছে কলচুরি রাজ্যে নগরায়নের দিকেও ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। করিতলাই থেকে পাওয়া দশম শতাব্দীতে উৎকীর্ণ দ্বিতীয় লক্ষ্মণরাজের একটি লেখতে ‘পুরপত্তন’-এর কথা জানা যায়। আর বিলহরিতে প্রাপ্ত লেখতে একটি বৃহদায়তন ‘পত্তনমণ্ডপিকা’র অস্তিত্ব জানা গিয়েছে। ‘পত্তনমণ্ডপিকা’ হিসেবে। বিলহরি অঞ্চলের বাণিজ্যিক গুরুত্ব ইতিপূর্বেই আলোচিত হয়েছে। এই দুই নগরে–—বিশেষ করে বিলহরিতে–—বহু পণ্যসামগ্রীর লেনদেন হত এবং তার ওপরে কর ধার্য করার প্রমাণও অপ্রতুল নয়। এই পণ্যসামগ্রীর অনেকগুলিই কৃষিজ সামগ্রী; বোধ হয় বিলহরির পশ্চাদভূমি (বা ‘হিণ্টারল্যাণ্ড’) থেকে কৃষিজ পণ্য নিয়মিত এই শহরে আসত।

কৃষির সমৃদ্ধি কিভাবে নগরায়নের পক্ষে অনুকূল হয়ে ওঠে তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ রাজস্থানের নাডোল নগর। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণায় দেখা যায় যে নড্ডুল ছিল একটি গ্রাম; তবে তার অবস্থান ছিল আরও বারোটি গ্রামের কেন্দ্রস্থলে। এই অবস্থিতির দরুন আলোচ্য অঞ্চলের বাণিজ্যিক লেনদেনের পক্ষে নড্ডুল বিশেষ সহায়ক ও উপযোগী ভূমিকা নেয়। এখানে একটি মণ্ডপিকা গড়ে ওঠায় নড্ডুল আর গ্রাম থাকল না; তা হয়ে ওঠে এক স্থানীয় বাণিজ্যকেন্দ্র। কালক্রমে এটি নাডোলের চহমান রাজাদের শাসনকেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়।

দাক্ষিণাত্যে বাণিজ্যের প্রসার, কৃষির সমৃদ্ধি ও কৃষিপণ্যের লেনদেন সম্ভবত নগরায়নকে ত্বরান্বিত করে। ১২০৪ খ্রীঃ কর্ণাটকের বেলগাঁও বা প্রাচীন বেণুগ্রামে বহু বণিকের সক্রিয় ভূমিকা ও উপস্থিতি চোখে পড়ে। এই বণিকরা কাছে ও দূরের দুই অঞ্চল থেকেই এসেছিলেন। অর্থাৎ বেণুগ্রাম বণিকদের আকর্ষণ করতে পেরেছিল। এই নগরেও কৃষিজাত পণ্যের বিনিময় বিশেষভাবে নজরে পড়ে। দক্ষিণ ভারতেও চোল ভূখণ্ডে কুড়ামুক্কু–—পালাইয়ারাই নামক এক যুগ্ম শহরের উত্থান ও বিকাশের কথা চম্পকলক্ষ্মীর গবেষণার মাধ্যমে জানা গিয়েছে। কাবেরী বদ্বীপে অবস্থিত এই যুগ্ম নগরের বিকাশের ক্ষেত্রে চম্পকলক্ষ্মী নিম্নোক্ত উপাদানগুলি নজর করেছেন: (১) নগরের সন্নিহিত নির্ভরযোগ্য পশ্চাদভূমির অস্তিত্ব যেখান থেকে উদ্বৃত্ত খাদ্যের যোগান নিশ্চিত ছিল, (২) কৃষিজপণ্য ও স্থানীয় উৎপন্ন দ্রব্য এবং বিলাস দ্রব্যের (যা অনেক ক্ষেত্রে দূর দেশ থেকে আনতে হত) লেনদেন, (৩) স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ও ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর ও মন্দিরের প্রয়োজন মেটাবার জন্য নানা পণ্যের চাহিদা যা অনেক ক্ষেত্রে ঐ অঞ্চলে উৎপন্ন হত না; ফলে ভ্রাম্যমান বণিকরা এই চাহিদা মেটাতে পণ্যসমাগ্রী নিয়ে আলোচ্য এলাকায় আসতে থাকে; তার দরুন এলাকাটি বাণিজ্যিক গুরুত্ব পায়; (৪) এই ঘটনার ফলে বহু বণিক ও কারিগর স্বাভাবিক ভাবেই আলোচ্য নগরে বসতি করে ও ক্রমশ তারা স্থানীয় মন্দির ও মন্দির কর্তৃপক্ষের মদত লাভ করে; এই কারণে কুড়ামুক্কু -পালাইয়ারাই সহ আরও বেশ কিছু দক্ষিণ ভারতীয় শহরে নগরায়নের প্রক্রিয়া স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরের মদতে ও মন্দিরে আওতায় বিকশিত হতে থাকে।

নগরায়নের যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে করা হল তার থেকে নগরের অবক্ষয়ের ধারণা মেনে নেওয়া কঠিন। শর্মার সঙ্গে এই অবধি সহমত হওয়া চলে যে খ্রীঃ ১০০০-এর পর থেকে নগরায়ন দ্রুততর হয়। কিন্তু উত্তর ভারতে ও মধ্য ভারতে ১০০০ খ্রীঃ-এর বেশ আগেই পূর্ণাঙ্গ নগরের বিকাশ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করা যায়। ব্ৰজদুলাল চট্টোপাধ্যায় আদি মধ্যযুগের নগরগুলিকে তৃতীয় দফার নগরায়নের অন্তর্গত বলে মনে করেন। ভারত ইতিহাসে নগরায়নের দ্বিতীয় পর্ব দেখা গিয়েছিল খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্ৰীষ্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত। এই পর্বের নগরগুলি অধিকাংশ ছিল (১) রাজনৈতিক প্রশাসনিক কেন্দ্র, (২) বিস্তীর্ণ পশ্চাদভূমিসম্পন্ন, যে পশ্চাদভূমির কৃষি সমৃদ্ধি সুবিদিত, ও (৩) গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের উপর অবস্থিত। দ্বিতীয় দফার নগরায়নের মূল কেন্দ্র ছিল গাঙ্গেয় বা মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকা, যে অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে নগরায়ন সমগ্র উপমহাদেশে পরিব্যাপ্ত হয়। কিন্তু আদি মধ্যযুগে তৃতীয় দফায় যে নগরায়ন দেখা গেল তার কোনও মূল কেন্দ্র নেই; দ্বিতীয় দফায় নগরগুলির তুলনায় তৃতীয় পর্বের নগরগুলি তাদের আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে অনেক বেশী গ্রথিত ছিল। তৃতীয় পর্বের নগরগুলি বেশীরভাগই স্থানীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র রূপে সক্রিয় ছিল। স্থানীয় শক্তির বিকাশ ও স্থানীয় ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর উত্থান বিভিন্ন অঞ্চলে নগর গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। আদি ঐতিহাসিক পর্বের নগরগুলি যেমন অধিকাংশই বৃহদায়তন শক্তির কেন্দ্র, তুলনায় আদি মধ্যযুগের নগর বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নানা স্তরের ও নানা প্রকারের স্থানীয় শক্তির কেন্দ্র রূপেই আবির্ভূত।

॥ ৭ ॥

রামশরণ শর্মা, বি. এন. এস. যাদব, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝা প্রমুখ ঐতিহাসিক সামন্ত ব্যবস্থার যে বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরেছিলেন এবং যে বৈশিষ্ট্যগুলি মূলতঃ আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়েরই ইঙ্গিত দেয়, তার যথার্থ পুনর্বিচার করা বিশেষ জরুরী। সামন্ত প্রথা ছিল কি ছিল না, সে বিতর্কের নিষ্পত্তি হওয়া কঠিন; কারণ সামন্ত প্রথার কালগত কাঠামো সম্বন্ধেই ঐতিহাসিকরা সহমত নন। সামন্ত ব্যবস্থার তুঙ্গদশা ও বিলয় শর্মার মতে দ্বাদশ শতকে দেখা গেল; আবার সৈয়দ নুরুল হাসান মুঘল আমলেও সামন্ত প্রথার বৈশিষ্ট্য নজর করেছেন। কিন্তু ৬৫০-১২০০ খ্রীঃ বা ৬৫০-১০০০ খ্রীঃ-এর কাল যে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের যুগ এই ধারণা সমর্থন করা দুষ্কর। রামশরণ শর্মা ৩০০-১০০০ খ্রষ্টাব্দে নগরের অবক্ষয় সম্বন্ধে যে সাম্প্রতিক গবেষণা করেছেন, তাতেও তিনি সামন্ত প্রথার অস্তিত্বই দেখেছেন; তবে নগরের অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষির ব্যাপক প্রসার যে ঘটেছিল এবং যা পরবর্ত্তীকালে কৃষিপণ্যের বাণিজ্য ও নগরায়নের পথ প্রশস্ত করে তা তিনি স্বীকার করেন। তাঁর মতে এই আমলে ‘আর্বাণ কন্‌ট্রাকশন’ বা নগরজীবনের সংকোচন ‘এ্যাগ্রিকালচারাল এক্সপানশন’ বা কৃষির প্রসার পাশাপাশি চলছিল; ফলে অর্থনীতির সামগ্রিক অবক্ষয়ের ধারণা তিনি নিজেও অনেকটা বদলে নিয়েছেন। ৬৫০-১২০০ খ্রীষ্টাব্দ মূলত কৃষির ব্যাপক প্রসার দ্বারা চিহ্নিত; এই আমলে অর্থনীতির মন্দার চেয়ে তার প্রাণবন্ত প্রকৃতিই বেশী করে প্রতীয়মান হয়। এই কৃষি অর্থনীতির প্রসারই আদি মধ্যযুগে স্থানীয় শক্তিগুলির উত্থান ও সংখ্যাবৃদ্ধির পথ খুলে দেয়। স্থানীয় শক্তির সংখ্যাবৃদ্ধি যে বিকেন্দ্রীকরণের ফল নয়, তা যে কৃষি অর্থনীতির উপর আশ্রিত রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর ব্যাপক বিকাশ ও প্রসারকেই চিহ্নিত করে, এ বিষয়ে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা নূতন পথের সন্ধান দেবে। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, নগরায়ন সব দিক দিয়েই আদি মধ্যযুগ এক সৃজনশীল ও উৎপাদনশীল পর্ব, যার প্রভাব মধ্যযুগের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির উপর বর্তেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *