অষ্টম অধ্যায়। মধ্যরাত্রের মাতা-পিতা
৪২
এই প্রধান চরিত্রগুলো ছেড়ে দিয়ে আমরা একটু অন্যদের দিকে তাকাব। রাজনীতিবিদদের স্ত্রী এবং পুত্রদের জীবনযাপন নিয়ে তেমন কিছু লেখা হয় না। তা বলে তাদের উপেক্ষা করার কোনও মানে নেই। পাণ্ডুর পরিবারের কথাই ধরা যাক। কুন্তি এবং মাদ্রী মিলে কী সুন্দর পাঁচটি ছেলেকে মানুষ করে ফেলল।
তাদের দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত গণপতি। যুধিষ্ঠির ভগবানদত্ত মেধা নিয়ে জন্মেছিল। লেখাপড়ায় অসম্ভব ভালো ছিল। ক্লাসে কখনও দ্বিতীয় হয়নি। সে মাড় দেওয়া শার্ট এবং এনসাইক্লোপিডিয়া নিয়ে খুব মাথা ঘামাত। সবাই বলত যে যুধিষ্ঠির উকিল হবে। ভীম অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠল। তার পেশি দেখে ভয় পেত না এমন কেউ ছিল না। সে তার ভাইদের বড় আশ্রয় ছিল। ধীরে ধীরে সে যখন হেঁটে আসত তখন সব থেকে মারকুটে ছেলেটাও ভয় পেয়ে যেত। অর্জুন যেন সব দিক থেকে সম্পূর্ণ ছিল। কায়িক শক্তি অথচ মানসিক জোর, স্পষ্ট বক্তা অথচ স্পর্শকাতর মন, একহারা গড়ন অথচ ইস্পাতকঠিন শক্তি, অর্জুন ছিল অদ্বিতীয়। সে ছিল একাধারে রাজপুত্র এবং প্রজা, বুদ্ধিমত্তা এবং পৌরুষ, পুরুষ এবং প্রকৃতির সমন্বয়। যমজ নকুল-সহদেব ছিল তাদের বড় ভাইদের উপযুক্ত সঙ্গী—ভদ্র, মার্জিত, সৎ।
পাঁচভাই আস্তে আস্তে বেড়ে উঠল। বেশিরভাগ লোকই তাদের পঞ্চপাণ্ডব বা শুধুই পাণ্ডব বলে থাকতেন। রাজপ্রাসাদের যেদিকটা ধৃতরাষ্ট্রের অংশ, সেখানে প্রিয়া দুর্যোধনী তার জ্ঞাতি ভাইদের থেকে আলাদা হয়ে, একা একাই বড় হচ্ছিল।
সে ছিল রোগা কেঠো চেহারার একটি মেয়ে। তার মুখ দেখলে আমের আঁটির কথা মনে পড়ে যেত। দুটো কালো জোড়া ভুরুর, লম্বা খাড়া নাক, সব মিলিয়ে যেন একজন প্রাজ্ঞ মাস্টারনি। অথচ তার স্কুলে যাওয়ার বয়স তখনও হয়নি। তাকে দেখতে খারাপই বলা হত যদি না অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি সদয় হয়ে ভগবান ওই দুটো অসাধারণ চোখ তার মেয়েকে না দিত। ঝকঝকে চোখ দুটো যেন সর্বদা জ্বলজ্বল করত, তার মনের গভীরে থাকা অভিব্যক্তি ফুটে বেরোত তাতে। কথার তেমন ধার ধারত না প্রিয়া। তার খ্যানখ্যানে সরু উঁচু পরদার আওয়াজ সম্বলিত গলায় কিছু শুনতে ভালোও লাগত না। কিন্তু দুর্বলতাকে তুচ্ছ করে দিত তার চোখ দুটো, গণপতি। ওই মেয়েটির তেজ, জেদ এবং মানসিক জোর কতখানি ছিল, তা ওর ওই চোখ দুটি বুঝিয়ে দিত। গান্ধারী কিন্তু কোনওদিনই তার এই কন্যাটিকে মেনে নিতে পারেনি। বাড়ির এককোণে সে তার অন্ধকার জীবন কাটাতে লাগল। যে স্বামীর জন্য সে স্বেচ্ছায় আঁধারকে বেছে নিয়েছিল, সে তার পাশে থাকার সময় পেল কই?
গান্ধারী শেষ মুহূর্ত অবধি বিশ্বাস করতে চায়নি যে সে বৃথাই অন্ধত্বকে বেছে নিয়েছে। একজন পতিব্রতা স্ত্রীর আত্মত্যাগ কোনওদিন বৃথা যেতে পারে না। শেষে তার স্বাস্থ্য ভেঙে গেল। আঁধারকে অবলম্বন করে সে গান্ধারী আরও গুটিয়ে গেল। ধৃতরাষ্ট্র জেল থেকে সমস্ত চিঠি, কন্যা প্রিয়া দুর্যোধনীকে লিখত। ছোট মেয়ে সে চিঠির মানে সবসময় বুঝতও না। গান্ধারীকে কোনও চিঠি তার স্বামী লিখত না। মেয়ে প্রসব করা তার অপরাধ হয়েছিল।
অনেকেই মনে করেন, ধৃতরাষ্ট্র তার মেয়েকে হাতে ধরে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তার পরবর্তী কাজকর্মে বাবার ছাপ যথেষ্ট পাওয়া যায়। আমি কিন্তু ব্যাপারটাকে অন্যভাবে দেখতে চাই। দিনের পর দিন সে তার মায়ের অসুস্থ বিছানার পাশে কাটাতে কাটাতে বুঝেছে, তার মায়ের করুণ আত্মত্যাগ পরিণতি পায়নি। ছোট্ট বয়সেই সে তার নিজের একাকিত্বের মোকাবিলা করতে শিখে গেছে। সর্বোপরি, প্রিয়া শৈশবে যা দেখেছে, তাতে আর কোনও মানুষকে বিশ্বাস করা তার পক্ষে অসম্ভব। সে তার বাবাকেও বিশ্বাস করত না।
খুব ছোটবেলা থেকেই বোঝা গিয়েছিল, প্রিয়ার স্বভাব কী রকম হবে। সে প্রথমেই নিজের রাস্তা থেকে ভীমকে সরাতে চেয়েছিল।
৪৩
ভীমের ছোটবেলা থেকেই গায়ে অসম্ভব জোর ছিল। সবসময় একটা হইচই বাঁধিয়ে রাখত। তার সঙ্গে এঁটে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। ভীমের সঙ্গে যারা বড় হচ্ছিল তাদের প্রচুর অত্যাচার সহ্য করতে হত। কখনও সে চোখে বালি ঢুকিয়ে দিত, কখনও নদীতে বন্ধুদের জামাকাপড় ভাসিয়ে দিত, কখনও কাউকে তুলে কাদায় ফেলে দিত—তার দুষ্টুবুদ্ধিতে কখন কোনটা খেলে কেউ জানত না। হাসিমুখে সবাই সব সহ্য করত। এই যেমন ইংল্যান্ডের ক্রিকেট টিমের অন্যরা ইয়ান বথামকে সহ্য করত, সেইরকম আর কী। ছেলেরা গাছে উঠে ফল পাড়ছে, ভীম এমন গাছ ধরে নাড়িয়ে দেবে যেন সেটা একটা চারা মাত্র। দুর্যোধনী সারাদিন ব্যাজার মুখে ঘুরে বেড়াত আর ভীমের এইসব কীর্তিকলাপে যথেষ্ট বিরক্তি হত। তাই সে একদিন ভীষণ একটা দাওয়াই দেওয়ার কথা ভাবল।
মাকড়সার ভয় কাটিয়ে, কাদার দাগ-টাগ মুছে, বাবার ভিজে চিঠি শুকোতে দিয়ে সে ভাবতে লাগল কী করে ভীমকে শায়েস্তা করা যায়। ঠিক বারো বছরের জন্মদিনটা পেরিয়ে যাওয়ার পরেই দুর্যোধনী তার পাণ্ডব ভাইদের ফার্মানাকোটিতে পিকনিক করার জন্য আমন্ত্রণ জানাল।
এই আমন্ত্রণের পিছনে যে একটা গোপন উদ্দেশ্য ছিল তা কেউ ভাবতে পারেনি। সবাই ভাবল প্রিয়া বড় হচ্ছে। তাই তার শুভ বুদ্ধিও জাগছে আস্তে আস্তে।
প্রিয়া করল কী, তার মায়ের ওষুধের আলমারি থেকে বিষের বোতল লেস-এ মুড়ে নিয়ে এল চুপিচুপি। তুমি দৃশ্যটা ভাবো গণপতি! রোদ ঝলমলে ছবির মতো নীল আকাশ। তার নীচে নরম সবুজ গালচের মতো ঘাসের ওপর রাজপুত্ররা খেলছে হুড়োহুড়ি করে। প্রিয়ার এসবে কোনও উৎসাহ নেই। সে আস্তে আস্তে ভিড়ের বাইরে বেরিয়ে গেল। কেউ লক্ষ করল না। চাকরবাকররা বাচ্চাদের পিকনিকের খাবারগুলো সাজিয়ে রেখেছিল যেখানে, প্রিয়া সেখানে গিয়ে হাজির হল। ‘সব ঠিক আছে, তোমরা যেতে পারো। দু-ঘণ্টা পরে ফিরে এসো। ততক্ষণে সব শেষ হয়ে যাবে।’ প্রিয়া বলেছিল। গভীর অর্থপূর্ণ কথা। লক্ষ করো গণপতি।
ছেলেরা অনেক দূরে খেলছিল। চাকরবাকররা সবাই সরে গেল। খাবার সাজানো ছিল। একজায়গায় নিয়মমতো একজনের তুলনায় অনেক বেশি খাবার রাখা হয়েছিল। বলা বাহুল্য, সেটা ভীমের জন্যে। প্রিয়া দুর্যোধনী সেখানে বসে পড়ল। তারপর হাতব্যাগ ঘেঁটে বইপত্রের মাঝখানে লেসে মোড়া সেই বিষের শিশিটা বের করে আনল। তারপর সেটা খাবারের ওপর ভালোমতো ছিটিয়ে দিল। তারপর শিশিটাকে ফের লেস দিয়ে মুড়ে ব্যাগে চালান করে দিয়ে, পায়ের ওপর পা তুলে বসে বই পড়তে লাগল।
গণপতি, তুমি ভাবছ, যা বললাম তার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও ফাঁক আছে, আমাদের নেত্রী কি আর খুনের দোষে দোষী হবেন? হয়তো শিশিতে বিষ দিল না বা যথেষ্ট পরিমাণে তা মেশাতে পারেনি প্রিয়া বা হয়তো ভুল প্লেটে সেটা মেশানো হয়েছিল। কিন্তু গণপতি, জেনে নাও যে ঠিক পোলাওতেই প্রিয়া বিষ যথেষ্ট পরিমাণে মিশিয়েছিল আর ভীম যথেষ্ট পরিমাণে সেটা খেয়েছিল। তারপর আর কী! যা হওয়ার তাই হল!
ভীমের চোখের সামনে সূর্যটা নাচতে লাগল তারার ঝড়ের মধ্যে! সে বারবার বলতে লাগল যে তার ঘুম পাচ্ছে, মাথা ঘুরছে।
‘বেশি খেয়ে ফেলেছ।’ দুর্যোধনী বলল। দূরের কুণ্ডলী পাকানো কুয়াশার মধ্যে থেকে যেন সে প্রিয়ার গলা শুনতে পেল। তাকে নদীর ধারে শুয়ে ঘুমিয়ে নিতে বলছে। তারপর সে জ্ঞান হারাল।
বাকি ছেলেরা অতশত না বুঝে, দূরে খেলছিল। দুর্যোধনী চুপিচুপি ভীমের কাছে গিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল যে সে কতটা ধরাশায়ী হয়েছে। প্রথমে তার বুকের ওপর একটা ছোট পাথর ফেলল। তারপর একটা বড় পাথর। তাতেও ভীম নড়াচড়া করছে না দেখে এবার আরও বড় আর খোঁচাওলা একটা পাথর দিয়ে আঘাত করল। তাতেও ভীম নড়ল না। এবারে ভীমের পিঠের নীচে একটা ছাতা রেখে, সেটার ওপর কায়দা করে ওই বিশাল শরীরে সঠিক ভারসাম্য রেখে সে ভীমকে নদীর জলে ফেলে দিল।
গণপতি ওই রোগা, সুতির জামা পরা মেয়েটার হিম্মৎ আর জিঘাংসা তোমাকে ১৯২০ সালের নির্বাক ছবির কথা মনে করিয়ে দেবে। তখনও জলের ওপর গোল করে তরঙ্গ উঠছিল। তারপর চারিদিকে সাবধানে একবার দেখে নিয়ে প্রিয়া খুব তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে গেল। মেয়েটা একবারে ছবির মতো নিখুঁতভাবে কাজটা করেছিল। ভীম একটা ভারী পাথরের মতো ডুবে গেল, তার শরীরের মধ্যে বিষক্রিয়াও চালু হয়ে গেল। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই প্রিয়া বাকিদের মধ্যে ফিরে এল। তার মুখ দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। অনেক পরে এক আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট বলেছিলেন যে প্রিয়া দুর্যোধনীর রাজনৈতিক সাফল্য পোকার-এর জগৎ থেকে একজন পাকা খেলোয়াড়কে কেড়ে নিয়েছিল।
কিন্তু প্রিয়া ব্যাপারটা যত সহজ ভেবেছিল, পাণ্ডবরা অত সহজে ধরাশায়ী হওয়ার নয়, গণপতি।
দেখি, সেদিন কী হয়েছিল। ভীম জলে গিয়ে পড়ল। খানিকক্ষণের মধ্যে তাকে একটা বিষাক্ত সাপ এসে কামড়ে দিল। ভগবানের খেলাটা ভাবো, প্রিয়া খাবারে যে বিষ মিশিয়েছিল, সেটা সাপের কামড় থেকে বাঁচতে মানুষকে দেওয়া হয়। ছোবলটার এতই তেজ ছিল যে ভীম জেগে উঠল। সাপের বিষ শরীরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে বর্তমান প্রিয়ার দেওয়া বিষ মিশে গিয়ে পরস্পরকে নিস্তেজ করে দিল। ভীম-এর শরীর হঠাৎ সুস্থ হল। সে সাঁতার কেটে পাড়ে উঠে এল। এটা যদি একটা ছায়াছবির দৃশ্য হত তাহলে হাততালি আর সিটিতে ভীম এতক্ষণে হিরো হয়ে যেত।
বারো বছরের ছোট্ট প্রিয়া দুর্যোধনী ভীমকে দেখে এতটুকু বিচলিত হল না। ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভয় পেয়েছিল সে। বুঝি ভীম সব দেখেছে আর এই বুঝি সব ফাঁস হবে। কিন্তু ওপরে এতটুকু বুঝতে দিল না মনের অবস্থাটা। ‘তুমি কি সাঁতার কাটতে গিয়েছিলে, ভাই?’ সে হেসে ভীমকে জিগ্যেস করল।
ভীম হা হা করে হেসে উঠল। যেমন হেসে থাকে। ‘কে জানে! ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বোধহয়। তাই খেয়াল করিনি কখন যেন জলের মধ্যে গড়িয়ে পড়ে গেছি।’ ভীম চুল থেকে জল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল। ভাইদের খানিকটা দূরে দেখতে পেয়ে ভীম হাসতে হাসতে সেদিকে এগিয়ে গেল।
গণপতি তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে প্রিয়া দুর্যোধনী কেমন ঠান্ডা মাথায় খুন করবার সাহস রাখত ওইটুকু বয়স থেকে!
হয়তো ধৃতরাষ্ট্র নিজে ওর পিছনে কিছুটা সময় দিলে ভালো করত। খালি চিঠি দিয়ে কি বাপের কর্তব্য সারা যায়? যদি সে দায়িত্ব পালন করত তাহলে কী হত তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তার চেয়ে ইতিহাসকে ভবিতব্য বলে ধরে নেওয়া ভালো।
৪৪
পাণ্ডবদেরও অবস্থা একই প্রায়। তাদের বাবাও বেশিরভাগ সময়টা জেলেই কাটাত। কুন্তি তাদের জন্য শিক্ষকের খোঁজ করতে লাগল। কুন্তি বেছে বেছে বিএ পাশ মাস্টার ধরে আনত। কিন্তু এদের পছন্দ হত না আর মাস্টারও টিকত না।
একদিন পাণ্ডবরা তাদের সব থেকে প্রিয় খেলা ক্রিকেট, তাই নিয়ে ব্যস্ত ছিল। গণপতি, এই ক্রিকেট খেলাটা ভারতীয়দের এত প্রিয় কেন জানো? এর মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত মানে আছে। যাই হোক, ভীমের ব্যাটে লেগে বল খুব উঁচুতে উঠে মাঠ পেরিয়ে একেবারে একটা পরিত্যক্ত কুয়োর মধ্যে গিয়ে ঝপাং করে পড়ল। পাঁচটা মাথা জড়ো হয়ে দেখল, প্রায় কুড়ি ফুট নীচে জলের মধ্যে বলটা হাবুডুবু খাচ্ছে। অত নীচ থেকে বল তুলে আনা অসম্ভব! তার ওপর আবার কুয়োর দেওয়ালে শ্যাওলার আস্তরণ পড়ে আছে। কেউ যে কুয়োর গা বেয়ে নামবে, তাও সম্ভব নয়।
‘হস্তিনাপুরের রাজপুত্রেরা, কী হারিয়েছে?’ একটা মোটা খসখসে গলা শুনে তারা চমকে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, যে একজন গেরুয়া পরা সাধু তাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এক মুখে কাঁচা পাকা দাড়ি, এক হাতে লাঠি আরেক হাতে ভিক্ষাপাত্র।
‘আমাদের বলটা পড়ে গেছে। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন আমরা কে?’
‘আমি আরও অনেক কিছু জানি। একটা সামান্য বল হারিয়েছে। ক্ষত্রিয় হয়ে তোমরা তুলে আনতে পারছ না?’
‘আমরা নিজেদের ক্ষত্রিয় বলি না। আমাদের পরিবার জাতপাতে বিশ্বাস করে না।’ যুধিষ্ঠির বলল।
‘আপনি যদি মনে করেন আমরা এতই বোকা, আপনি বলটা তুলে দিন না!’ ভীম স্বভাবসিদ্ধ ঔদ্ধত্যে বলে উঠল।
‘নিশ্চয়ই দেব। তার বিনিময়ে তোমরা আজ রাত্রের খাবারটা আমায় দেবে।’ সাধু বলল।
‘শুধু এইটুকু?’
‘নৈশভোজই আমার মতো ক্ষুধার্ত সাধুর জন্য যথেষ্ট।’
সাধুটি তখন পাতকুয়োর ওপরে টাঙানো পুরনো দড়িটার দিকে হাত বাড়ালেন।
‘ওঃ! এই আপনার কৌশল?’ অর্জুন বলে উঠল, ‘ওই পচা দড়ি আমাদেরই ওজন নিতে পারে না, আর আপনি তো কত বড়!’
সাধুটি আড়চোখে তার দিকে অপাঙ্গে দেখে দড়িটায় একটা ফাঁস লাগালেন। তারপর সেটা জলের ওপরে ছুড়ে দিয়ে বাকি অংশটা দিয়ে এমন কায়দায় টান দিলেন, বলটা সেই ফাঁসের মধ্যে আটকে গেল।
ছেলেগুলো হাঁ করে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে। সাধুটি যুধিষ্ঠিরের দিকে বলটা ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘এবার থেকে সাবধানে খেলবে।’
‘অসাধারণ! আমাদের শিখিয়ে দিন না, স্যার!’ যমজ দুজন বলল।
‘চুপ করো তোমরা।’ যুধিষ্ঠির তাদের থামাল, ‘স্যার, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’
‘আমি তোমাদের আরও অনেক কিছু শেখাতে পারি। যদি তোমাদের আগ্রহ থাকে।’ সাধুটি বললেন।
‘ও শূন্য রানে আউট হয়ে যায়, ওকে ব্যাট করা শিখিয়ে দেবেন?’ নকুল সহদেবকে দেখিয়ে বলল।
‘শূন্য! ইংরেজদের ক্রিকেট জন্মাতোই না যদি ভারত শূন্য সংখ্যাটা আবিষ্কার না করত।’ সাধু বোঝালেন।
‘তার মানে?’ অর্জুন জিগ্যেস করল।
‘খুব সোজা। ভারতের কিছু আবিষ্কার পৃথিবী মেনে নেয়। যেমন ভারত শূন্য সংখ্যাটিকে আবিষ্কার করেছে। তার আগে আরব আর চিন দেশের পণ্ডিতরা খালি অংশ রেখে দিয়ে অঙ্ক করত। ভারত পৃথিবীকে শিখিয়েছে, আপাতভাবে শূন্যের কোনও ওজন না থাকলেও সে কতটা ওজনদার হতে পারে।
‘কিন্তু শূন্য তো সেই শূন্য।’ নকুল বলে উঠল।
সাধু হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘ঠিক তা নয়। ভারতীয় বোধের আধার এই শূন্য। সে স্থির। তার চারধারে যতই ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাক না কেন। সংখ্যাতত্বে তার ওজন না থাকলেও দর্শনে আছে। শূন্য থেকেই সব সৃষ্টির উৎপত্তি! বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।’ সাধু বলতে বলতে দেখলেন যে যুধিষ্ঠির আর অর্জুন গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
‘আপনি ওকে ব্যাট করতে শিখিয়ে দিন না!’ নকুলের কথায় সবাই হেসে উঠল।
‘শেখাব, শেখাব। এখন আমার খাবার ব্যবস্থা করো।’
৪৫
ওরা সাধুকে বাড়ি নিয়ে গেল। তাঁকে ঘিরে বসে থেকে তাঁর বহুদিনের অতৃপ্ত রসনায় তৃপ্তি দিল। শেষে কুন্তি আর পাণ্ডবরা ওঁর গল্প শুনল।
‘আমার নাম জয়প্রকাশ দ্রোণ।’ তিনি বললেন, ‘আমি ব্রাহ্মণ সন্তান। ছোটবেলা থেকেই একজন ধার্মিক ব্রাহ্মণের মতো পড়াশোনা করেছি। বড় হয়ে, আমার পরিবারের অনুমতি নিয়ে, গেরুয়া ধারণ করে বেরিয়ে পড়েছি। আমার শিক্ষাগুরু হিমালয়ের এক ঋষি। যখনই খিদে পেয়েছে, ভিক্ষের বাটিটা বাড়িয়ে দিয়েছি, কেউ না করেনি। আমি পুরাকালের মতো আজও বিশ্বাস করি যে একজন ব্রাহ্মণের জীবনধারণের দায়িত্ব সমাজের। আমার গুরুর আদেশে আমি লোকালয়ে এসে মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার করছি। তার বদলে একটু ভাত-ডাল পেলেই আমি খুশি।’
‘ঘুরতে ঘুরতে একবার একজন ইংরেজ আমলার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। সে কী একটা জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে ন্যায় বিচার করতে বেরিয়েছিল। ওই আমলাটি কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিল। সেই সময়ে আমার সঙ্গে তার দেখা হয়। সে আমাদের ভাষা কিছুটা জানত। আমাদের সভ্যতা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল ছিল। আমার কথা শুনতে সে খুব আগ্রহী ছিল। প্রায় এক ঘণ্টা আমার সঙ্গে কাটিয়ে এ দেশের সম্বন্ধে সে এত জ্ঞান আহরণ করেছিল যে যাওয়ার সময়ে তার কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলে ভবিষ্যতে আমার যে-কোনও দরকারে আমি যেন তার খোঁজ করি।’
‘এর পর এক মহিলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়। আমার একটি ছেলে জন্মায়। অশ্বত্থামা। অগত্যা একটা বাসস্থান জোগাড় করতে হল। আমার ছেলে আমার জীবনের অনেকটাই অধিকার করে নিল।’
‘প্রথমে ভেবেছিলাম অশ্বত্থামাকে শিক্ষিত করে তুলব। আমার খাবারটাই ভাগ করে খাব। আর জামাকাপড়? আমাদের তো পৈতেই যথেষ্ট। কিন্তু সাধুরা সব বোঝে না!’
‘ভাবতাম, বাবারাই ছেলেদের মধ্যে চাহিদাগুলো ঢুকিয়ে দেয়। আমার চাহিদা ছিল না, তাই ভেবেছিলাম, আমার ছেলেরও থাকবে না। কিন্তু একদিন সে আমার কাছে এক গ্লাস দুধ চাইল। বড়লোক বাচ্চাদের সে সাদা পানীয়টা খেতে দেখেছে। তাই তারও ইচ্ছে হয়েছে।
‘বোন কুন্তি, আমি কোথায় দুধ পাব? দুধ থেকে চা, মিষ্টি, মাখন হয়। ওসব তো বড়লোকেদের খাবার! কিন্তু ছেলেকে বলতে পারলাম না সেকথা।’
‘তাকে বললাম যে তার জন্য দুধ নিয়ে আসব। কিন্তু ভাত-ডাল দিলেও এক সাধুকে মহার্ঘ দুধ কে দেবে? আগেকার দিন হলে সাধুকে গরু অবধি মানুষ দিয়ে দিত। আজ এক গ্লাস দুধ অবধি পেলাম না দিনের শেষে। কেউ বলল, ‘এখন আবার ভিখিরিরা দুধ চায়! কী দিনকাল!’ আবার কোথাও শুনলাম, ‘দুধ! এর পর সোনা চাইবে!’ শেষে যখন পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম, দেখলাম অশ্বত্থামা একটা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে খুশির ঝলক।
‘বাবা, বাবা! আমি দুধ খেয়েছি!’ সে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ‘আমার বন্ধুরা দিয়েছে।’
আমি গ্লাসটা ওর হাত থেকে নিয়ে দেখলাম যে দুধ নয়। তাকে জল দিয়ে আটা গুলে কেউ দিয়েছে। অবোধ শিশুর তাতেই খুশি মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
‘আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। ব্যথায় আমার গলা বুঁজে আসছিল। আমার জ্ঞান আহরণের প্রচেষ্টায় আমি জাগতিক সব সুখস্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছিলাম, কিন্তু আর নয়। আমার ছেলেকে আমি কিছুতেই এই দুঃখ ভোগ করতে দেব না। আমি ঠিক করলাম, ভিক্ষাবৃত্তি আর করব না। তার চেয়ে একজন পয়সাওয়ালা লোকের অধীনে থেকে কাজ করব। আমার ছেলেকে সুস্থ সুন্দর একটা জীবন দিতেই হবে।’
‘সেই ইংরেজের কথা আমার মনে পড়ল। সে ততদিনে একটা বড় পদে উত্তীর্ণ হয়েছে। ছেলেকে নিয়ে তার বাড়ি পৌঁছে গেলাম। প্রথমে তো গার্ডরা ভেতরেই ঢুকতে দিচ্ছিল না। সাহেবের সেই পুরোনো ভিজিটিং কার্ডটা বার করতে ঢুকতে পেলাম। রোনাল্ড হিসলপ পোর্টিকোতে নেমে এসেছিলেন সিল্কের ড্রেসিং গাউন পরে। তাঁর হাতে পানীয়ের গেলাস।
‘হ্যাঁ, বলো? আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’
তাঁর কথা বলার ভঙ্গি আমার ভালো লাগল না।
আমি মাথা ঘামালাম না। কারণ ইংরেজরা নিজেদের প্রভু মনে করত। সব সময়তেই রূঢ়ভাবে কথা বলাটা তারা একটা অভ্যাসে পরিণত করেছিল।
‘আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমাকে এই কার্ডটা আপনিই দিয়েছিলেন।’
তিনি ছিনিয়ে নিলেন সেটা, ‘তাতে কী হয়েছে? আমি শয়ে শয়ে লোককে কার্ড দিয়ে থাকি। কে জানে তুমি এটা কুড়িয়ে পেয়েছ কিনা!’
‘আমার রাগ হচ্ছিল বোন। কিন্তু এতদূরে এসে ফিরে যেতে চাইছিলাম না। বললাম, ‘আপনিই আমায় কার্ডটা দিয়েছিলেন। সেই দেবীগড়ের কথা মনে পড়ে? প্রায় ছয়-সাত বছর আগের কথা। তখন ভারতীয় সভ্যতা আর শাস্ত্র নিয়ে আপনাকে অনেক কথা বলতাম।’
‘ভারতীয় শাস্ত্র? জ্ঞান? তোমার নিজের শিক্ষা আছে যে তুমি আমার সঙ্গে জ্ঞান-শাস্ত্র এই সব নিয়ে কথা বলবে? হ্যাঁ, আমার মনে পড়েছে। তুমি যত কুসংস্কার নিয়ে কথা বলতে। আমার তখন বয়স কম ছিল, এসব শুনে মজা পেতাম। আজ ওসব করার আমার সময় নেই।’
আমি খুব আঘাত পেয়েছিলাম। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম যে ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়ে যাব না। ‘আমি একটু প্রয়োজনে পড়ে আপনার কাছে, আমাদের পুরনো বন্ধুত্বের কথা মনে করে—’
‘বন্ধুত্ব!’ সে আমাকে থামিয়ে দিল। ‘কালা আদমি! তোমার সঙ্গে আবার আমার বন্ধুত্ব কীসের? আমরা এদেশে তোমাদের ওপর প্রভুত্ব করতে এসেছি। তোমার কোনও প্রয়োজনে আমি আর লাগব না। দাঁড়াও—গৌস মহম্মদ! আমার টাকার ব্যাগটা আনো তো!’
‘আমি সেই মুহূর্তে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু রাগ আর অপমান আমার পা দুটোকে পাথর করে দিয়েছিল। সাহেবটা একটা থলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে, কিছু খুচরো পয়সা তুলে আনল। কোনও বন্ধুত্বের বা পূর্ব পরিচয়ের জন্য নয়, শুধুমাত্র মনিব-চাকর সম্পর্কের জন্য। আমি তাও নড়তে পারলাম না। ছোট্ট অশ্বত্থামা আমার পা আঁকড়ে ভয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপর সাহেবটা আমার মুখের ওপর পয়সাগুলো ছুড়ে দিল।
‘রাগে আমার শরীর জ্বলছিল। তা স্তিমিত করতেই বোধহয় ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামল। হিসলপ মদের ঘোরে কেমন টলতে টলতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। ছোট্ট অশ্বত্থামা পয়সা ক’টা কুড়োতে মাটিতে বসে পড়েছিল।
রাগে মনে হচ্ছিল স্নায়ু ছিঁড়ে যাবে। ‘না!’ আমি চিৎকার করে উঠে, ঘাড় ধরে বাচ্চাটাকে তুলে ঝাঁকাতে থাকলাম। তার ছোট্ট মুঠো থেকে পয়সাগুলো ঝরে পড়ল। কয়েকটা ছোট পয়সা আর টাকা ছিল তার মধ্যে। ওই টাকায় এক গেলাস দুধ কেনা যেত। আমার ছেলেকে ওই সাহেবটার করুণার পয়সায় দুধ কিনে দিতে কিছুতেই পারিনি।
ছেলেটাকে নিয়ে কম্পাউন্ডের বাইরে চলে এলাম। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল। গৌস মহম্মদ নিচু হয়ে পয়সাগুলো তুলে নিচ্ছিল।
হাঁটতে হাঁটতে একটা নতুন শপথ নিলাম। এত প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতি এত পাণ্ডিত্য আমাদের! আমরা কিনা হিসলপের মতো লোকের পায়ের তলায় ক্রীতদাসের মতো থাকব? আমি শপথ নিলাম, হিসলপের সরকারকে দেশ ছাড়া করবই। আমি ঠিক করেছি কৌরব পার্টিতে যোগ দিয়ে সাধ্যমতো সাহায্য করব। যদি অনুমতি পাই শিক্ষা প্রদান করতে পারি পার্টির কর্মীদের।’
‘আপনি আমাদের প্রশিক্ষণ দেবেন দ্রোণজি?’ যুধিষ্ঠির জিগ্যেস করল।
‘আমি খুব খুশি হব।’ কুন্তী বলল।
‘নিশ্চই! আপনারা নিজে থেকে না বললে আমি খুব লজ্জা বোধ করতাম। গঙ্গাজি আমাকে এই কাজে গত সপ্তাহ থেকে নিযুক্ত করেছেন।’
৪৬
একদিন পার্টির এক তরুণ কর্মীর বাড়ি গেছি কাজে। কখন যেন তার ছেলে, সাত বছর বয়স হবে, এসে আমার পা ঘেঁষে গালে হাত দিয়ে বসে পড়েছিল। তারপর মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার কাজকর্ম লক্ষ করে যাচ্ছিল। বড়রা ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলে সে বলল, ‘দাদু, আমায় গল্প বলো না!’
আমার নিজের কোনও নাতি ছিল না। ভিতরে স্নেহ উথলে উঠল। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে হিতোপদেশের গল্প শোনাতে বসলাম। শেষে বাচ্চাটি বলল, ‘কিন্তু দাদু, শেষে কী হল?’
আমি থামলাম। সত্যি শেষে কী হল, তা তো আমি জানি না! বলার আনন্দে বলে চলেছি। হিতোপদেশ বা পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলো খোলস ছাড়ানোর মতো চলতেই থাকে, একটা চরিত্র যেখানে শেষ করে, আরেকজন এসে সেখান থেকে ধরে নেয়। তারপর কী হল, আমি বলতে পারি। কিন্তু শেষে কী হল, তা তো আমি জানি না!
ভারতীয় সভ্যতায় শেষ নিয়ে আগে কেউ মাথা ঘামাত না, কিন্তু ইদানীং সব কিছুরই পরিণতির দিকে আমরা সর্বদা তাকিয়ে থাকি। কিন্তু শেষ বলে সত্যি কি কিছু আছে? হলিউডের ছবিতে নায়ক-নায়িকা শেষে গিয়ে যখন চুম্বন করে মিলিত হচ্ছে, নীচে লেখা থাকে, ‘সমাপ্ত।’
কিন্তু সত্যিই কি সমাপ্তি ঘটে? এরপর বিয়ে, আরও কত চুম্বন, ঝগড়া, প্রাতঃরাশ, কাপড় কাচা ইত্যাদি বাকি থেকে গেল! বাচ্চার জন্ম দেওয়া, বড় করা, ঢেকুর তোলা, অম্বলে কষ্ট পাওয়া, সর্দিতে কাবু হওয়া, রোজনামচার সবটাই তো বাকি। ‘তারপর তারা সুখে কাল কাটাতে লাগল’ বলে ইতি টেনে দেওয়া যায় নাকি?
মৃত্যুতেও সব শেষ হয় না। মৃত ব্যক্তির বিধবা বউ বেঁচে থাকে কষ্ট ভোগ করার জন্য বা আনন্দে আত্মহারা হওয়ার জন্য। ছেলেটি বড় হয়ে নেশাখোরও তৈরি হতে পারে, বা প্রতিহিংসাপরায়ণ। গল্প শেষ হয় না, চলতেই থাকে অবিরত।
বাচ্চাটির মা এসে তাকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেল। আমি তাকে গল্পের শেষ কোনওদিন বলার সুযোগ পাইনি।
তবে বড় হয়ে নিশ্চয়ই সে বুঝেছিল যে ভারতীয় সংস্কৃতিতে জীবনের গল্প প্রবহমান, তার শেষ বা শুরু হয় না। আমরা সবাই মহাকালের বর্তমানে বাস করি, ভারতীয় জীবনদর্শন এটাই বিশ্বাস করে।
তুমি অধৈর্য হয়ে পড়ছ গণপতি? ভাবছ বুড়োটা কী সব দার্শনিক কথাবার্তা বলছে! জানো তো সত্যিকারের প্রাজ্ঞ লোকেরাই দার্শনিক হওয়ার যোগ্যতা রাখে। জ্ঞান যদি জাগতিক হয়, দর্শন তবে আধ্যাত্মিক।
আমি তো শুধু ঘটনাপ্রবাহ লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছি। আগামী প্রজন্মের জন্য।
আমার ভবিতব্য আমি জানি
নদী যে সাগরে যায় তা তো মানি
তোমাকে বলে যাই যা সত্যি
মিথ্যে নেই এতে এক রত্তি
কোনও কিছুই আমার হাতে নেই
পুলিশ কি পায় জনতার খেই
একটি ছোট খনন
তুলে আনে যখন
অমূল্য রতন!
আমি কি গাই গদ্য না পদ্য
মালির হাতে কাঁটা ফুটলে সদ্য
সে জানে হায়
আমার আছে দায়
ইতিহাসের রায় সত্য
যার আদি নেই, নেই অন্ত
কেন ঝড়ে নুয়ে পড়ে সে পান্থ
যে ছবিটা যায় দেখা
মহাকালের নকসার-ই ছোট রেখা
এ আমার বহুকালের শেখা
আমি শিল্পী নই, নই বিধাতা
বুদ্ধবাবু কি জানে কেন হারা কেন জেতা
আমি নই আগুন, নই হাত বা তুলি
শুধু বলে যাই, যাতে কিছু না ভুলি।
ভারতের আকাশে দুটি নক্ষত্রের উদয় হল। গঙ্গাজির সত্য হল ইংরেজকে তাড়িয়ে ভারতের স্বশাসন আর কর্ণর সত্য হল ইংরেজ এবং হিন্দু দুটিকেই উৎখাত করা!…গল্পে ফিরি।
৪৭
কোন গল্পে ফিরব বলো তো? কর্ণের নাটকীয় আবির্ভাব এবং ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার গল্পে? সে যে মিটিংগুলো করত সেগুলো দেখবার মতো। একজন স্যুট পরা সুপুরুষ যুবা অনর্গল বক্তৃতা দিচ্ছে দাড়িওয়ালা মৌলবীদের সঙ্গে নিয়ে। যাদের জন্যে এই বক্তৃতা, তারা ভাইসরয়েরই প্রতিচ্ছবি দেখত কর্ণের পোশাকে এবং আচরণে। কিন্তু তাও তাকেই নিজেদের নেতা বলে মেনে নিয়েছিল।
নাকি গঙ্গাজির কথা বলব, যিনি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আরও বেশি তাঁর স্কটিশ বোনের কাঁধে ভর দিয়ে প্রার্থনা সভায় যেতে লাগলেন আর প্রেম এবং ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে এমন সব বক্তৃতা দিতে লাগলেন, সারা পৃথিবীর রিপোর্টাররা তাঁকে ঘিরে থাকত।
ধৃতরাষ্ট্রের কথাও বলতে পারি, যার হাতে কৌরব পার্টিকে সঁপে দিয়ে মহাগুরু ন্যায় এবং সত্যের প্রতি আরও একনিষ্ঠ হলেন। ধৃতরাষ্ট্র এমন একজন মানুষের অনুমোদন পেল যার জীবনদর্শন সে মেনে চলত না।
নাকি, আমার বিদ্রোহী ছেলে পাণ্ডুর কথা বলব যার জয় ভারতবর্ষের ইতিহাস বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত!
সে শান্ত রাজনীতিবিদ ছিল না। রাজনৈতিক পণ্ডিতদের আলোচনা সভায় যাওয়াটাকে সে সময় নষ্ট বলে মনে করত। বাম-ডান, ভুল-ঠিক এসব নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই বলে সে মনে করত। সে স্পষ্ট বলত যে গঙ্গাজির পদ্ধতিতে দেশ স্বাধীন হওয়া কঠিন ব্যাপার। গঙ্গাজি যখন ধৃতরাষ্ট্রকে তাঁর উত্তরাধিকার ঘোষণা করলেন তখন পাণ্ডু গভীরভাবে আহত হয়েছিল। কিন্তু মহাগুরু যখন আম সত্যাগ্রহ মাঝপথে বন্ধ করে দিলেন, তখন পাণ্ডু ইচ্ছাকৃতভাবে পার্টির অনুশাসন ভেঙে নিজেকে কৌরব পার্টির প্রেসিডেন্টপদের প্রার্থী ঘোষণা করলেন।
‘এবার কী হবে?’ ধৃতরাষ্ট্র মহাগুরুকে বলল।
‘আমি ভেবেছিলাম এবারও আমায় কেউ থামাতে পারবে না।’ ধৃতরাষ্ট্র মুখের পাতলা গালদুটো কামড়ে ধরল।
‘খুবই দুঃখের ব্যাপার। তুমি ঘাবড়িও না।’
‘ঘাবড়াব না? ও হইচই বাঁধিয়ে কত সমর্থক জোগাড় করতে পারে জানেন? আমি হেরেও যেতে পারি!’
‘হতেও পারে।’ মহাগুরু বললেন।
‘সেটা তো হতে দেওয়া যায় না। আপনি ওর সঙ্গে কথা বলুন!’
‘চেষ্টা করেছি।’
‘তাই?’
‘হ্যাঁ। ও শুনবে না। আমার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল থেকে সে বিনম্র হয়েই বলেছে, সে প্রার্থীপদ থেকে সরবে না।’
‘কেন?’
আমি ছিলাম ওখানে। বললাম, ‘বদলানোর সময় তো এসেছে। পার্টিতেও কিছু বদল আনতে হবে। ওর স্লোগান, ‘কথা নয় কাজ’, লোকের মনে বেশ ধরেছে।’
‘বেজন্মা!’ ধৃতরাষ্ট্র চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
‘সে তো তুমিও। তবে তোমায় ছোট হতে দেব না এ যাত্রায়। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।’ গঙ্গাজি প্রলেপ লাগালেন।
‘তাহলে আপনি আমার হয়ে নেতাদের কাছে ভোট প্রার্থনা করবেন?’
‘তাতে যে আমি ছোট হয়ে যাব!’
‘তাহলে কী হবে গঙ্গাজি?’
‘তুমি লড়বে না, বিরত থাকবে।’
মনে হল, ধৃতরাষ্ট্র নিজের ছড়ির আঘাত খেল সপাটে।
‘তুমি এমন ভাব করবে, যেন তোমার নির্বাচনের প্রতি কোনও আগ্রহ নেই। তুমি বলবে পার্টি নেতৃত্বে বদল আনা একান্ত জরুরি। পার্টি প্রেসিডেন্ট বছর বছর নির্বাচিত হওয়া উচিত। তোমার তো তিন বছর হয়ে গেছে। নতুন প্রার্থীকে তুমিই আমন্ত্রণ জানাচ্ছ।’
‘আপনি আমাকে হেরে যেতে বলছেন।’
গঙ্গাজি শুনেও শুনলেন না, ‘আমি বলব, এবারের নতুন প্রার্থী হরিজনদের মধ্যে থেকে একজনকে করা হবে। সেটাই হবে ছোঁয়াছুয়ির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই-এর প্রতীক। এটাই আমার রায়।’ ধৃতরাষ্ট্রের মুখটা এবার উজ্জ্বল দেখাল।
‘বুঝেছি! আপনি পাণ্ডুকে জিততে দেবেন না!’
‘পার্টির শীর্ষ স্থানে আঘাত হানার জন্য এই জবাবই পাণ্ডুর জন্য যথেষ্ট। আমি জানি না হরিজনটিকে সমর্থন করলে পাণ্ডু হারবে কিনা। কিন্তু সে যদি জেতেও তাহলে আমার মানসপুত্রের হার অন্তত হবে না।’
‘যদি ওই হরিজনটি জিতে যায়?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
‘তাহলে আমাদের একজন প্রতীক জিতবে! পার্টির প্রেসিডেন্ট হওয়া মানেই কি ক্ষমতার শীর্ষে আসীন হওয়া? তাহলে তো ইংল্যান্ডের রাজাও সে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ হতেন!’
‘ঠিক, ঠিক।’ এবার ধৃতরাষ্ট্রকে ধাতস্থ দেখাল।
‘যেই জিতুক, পার্টিকে পরিবর্তনের জন্য তৈরি হতে হবে। সাংবিধানিক বদল হতে চলেছে। ভাইসরয়ের সঙ্গে আমার শেষ যা কথা হয়েছিল, তার ভিত্তিতে একটা নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা শুরু হতে চলেছে। সম্পূর্ণ গণতন্ত্র এখনও পাব না ঠিকই। তবে আমাদের আমলারা দারুণ কাজ করেছে। বিদুরকেও যথেষ্ট প্রশংসা করা উচিত।
ইংরেজরা জানে, আমাদের ওপর ইচ্ছামতো লাঠি চালানো যাবে না বা গ্রেপ্তার করা যাবে না। তাদের শাসনের ভাগ আমাদের দিতে হবে। এবার মনে হচ্ছে ব্রিটিশ সংসদের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পাশ হয়ে যাবে।’
আমরা এসব জানতাম। তবু গঙ্গাজি মনে করিয়ে দিলেন। ‘আমরা অঞ্চলগুলিতে যে সরকার গড়ব তার দিকে বরং মনোযোগ দিই। এগুলোই হবে ভারতের নিজস্ব সরকার গড়ার প্রথম পদক্ষেপ। সেই সরকার যে ভারতীয়রা গড়বে, ব্রিটিশরা তাদের সঙ্গেই কথাবার্তা চালাবে। পার্টিতে তাদের কী পদ, তাই নিয়ে মাথা ঘামাবে না ইংরেজরা। পার্টির প্রেসিডেন্টের চেয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অনেক বড়!
‘নিশ্চয়ই, গঙ্গাজি।’ ধৃতরাষ্ট্র বিনীত হয়ে বলল।