অষ্টমে মঙ্গল

অষ্টমে মঙ্গল

আমি যখন বিহারে বাস করিতাম, তখন আমার এক বন্ধু ছিল বৈজনাথ প্রসাদ। সে শহর হইতে ত্রিশ মাইল দূরে একটি বড় গ্রামে ডাক্তারি করিত। স্কুলে বৈজনাথের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়িয়াছিলাম, তারপর বড় হইয়া আমি যখন উকিল হইলাম এবং সে ডাক্তার হইয়া নিজের গ্রামে গিয়া বসিল, তখনও বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ রহিল। সদরে কাজ পড়িলে সে আমার বাড়িতে আসিয়া উঠিত এবং শীতকালে যখন আমার শিকারের বাতিক চাগাড় দিত, তখন আমি তাহার গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইতাম।

বৈজনাথ ডাক্তার ছিল বটে, কিন্তু ডাক্তারি তাহার পেশা ছিল না। গ্রামে তাহার বিস্তর জমি-জমা ছিল; তাহাই দেখাশুনা করিত এবং অবসরমত অবৈতনিকভাবে গ্রামবাসীদেরঔষধ দিত। তাহার ডাক্তারখানার চালাঘরাট প্রকৃতপক্ষে ইয়ার-বন্ধুদের আড্ডাঘর ছিল।

সেবারে হেমন্তের শেষে বৈজনাথের গ্রামে গিয়াছি। বৈজনাথ জাতিতে কায়স্থ, সুতরাং ঘোর মাংসাশী; আমি যাইতেই একটা খাসি কাটিয়া ফেলিল। তারপর রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া, একটু-আধটু বিলাতি মদ্য—চিরদিনের কর্মসূচীর ব্যতিক্রম হইল না।

সে-রাত্রে এগারোটার সময় চন্দ্রোদয়, পাঁজিতে দেখিয়া আসিয়াছিলাম। চাঁদ উঠিলে ধানের ক্ষেতে হরিণ শূকর শস্য খাইতে আসে, তখনই তাহাদের বধ করিবার উপযুক্ত সময়। এই বধকাৰ্য অমেধ্য নয়। আমাদের রোপিতশস্য খাইয়া তাহারা মোটা হয়, আমরা তাহাদের খাইয়া মোটা হই, এইভাবে প্রবর্তিত চক্র ঘুরিতে থাকে। এই প্রবর্তিত চক্র যে অনুবর্তন না করে, হে পার্থ, সে বৃথাই জন্মিয়াছে।

আমাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হইতে সাড়ে দশটা বাজিয়া গেল। অতঃপর আমরা বন্দুক ঘাড়ে বাহির হইলাম।

কিন্তু এটা শিকারের গল্প নয়, মংলু মুশহরের করুণ কাহিনী। শিকারের কথা লিখিবার লোভ হইলেও লোভ সংবরণ করিতে হইতেছে। চাঁদের আলোয় যখন দূরপ্রসারী শস্যশীর্ষ কাঁপিতে থাকে এবং নিকটস্থ বনের ছায়াতল হইতে হরিণের দল সারি দিয়া বাহির হইয়া আসে, সে দৃশ্য ভুলিবার নয়। কিন্তু থাক।

শিকার মন্দ হইল না; দুটা হরিণ, একটা শূকর, একটা শজারু। শেষ রাত্রে ফিরিয়া আসিয়া হৃষ্টমনে শয্যা আশ্রয় করিলাম। বৈজনাথের ডাক্তারখানার একটা ঘরে চারপাই পাতিয়া আমার শয়নের ব্যবস্থা হইয়াছিল।

ঘুম ভাঙিল অনেক বেলায়। ডাক্তারখানার সম্মুখে মনুষ্য কণ্ঠের কলরব, অনেক রুগী জড়ো হইয়াছে। আমি উঠিয়া গিয়া বাহিরের বারান্দায় তক্তপোশে বসিলাম। চাকর গুড়ের চা ও কদ্দুর মোরব্বা দিয়া গেল, তাহা সেবন করিতে করিতে সিগারেট ধরাইলাম।

বৈজনাথের ডাক্তারি দেখিতেছি। চিরপরিচিত দৃশ্য। রুগী বা রুগীর আত্মীয় শিশি-হাতে বারান্দার নীচে বসিয়াছে। স্ত্রীলোক আছে, পুরুষ আছে, বালক-বালিকা আছে। বৈজনাথ একে একে তাহাদের ডাকিতেছে, প্রশ্ন করিতেছে। কাহারও দম্‌মা, কাহারও পিল্‌হী, কাহারও বোখারা। বৈজু হাই তুলিতে তুলিতে তাহাদের গালিগালাজ করিতেছে এবং ঔষধ দিতেছে।

ক্রমে রুগীর দল ঔষধ লইয়া বিদায় হইল, অঙ্গন শূন্য হইয়া গেল। বৈজনাথ আমার পাশে বসিয়া চায়ের বাটি তুলিয়া লইল।

এই সময় লক্ষ্য করিলাম, সম্মুখের বিস্তৃত মাঠের অন্য প্রান্ত হইতে একটা লোক আসিতেছে। লোকটার প্রকাণ্ড কাল দেহ, পিঠে কি-একটা গুরুভার বস্তু বহন করিয়া আসিতেছে।

বৈজনাথকে প্রশ্ন করিলাম—‘ওটা কে? এদিকেই আসছে মনে হচ্ছে।’

বৈজনাথ একবার চোখ তুলিয়া বলিল—‘মংলু মুশহর বৌ নিয়ে আসছে।’

‘বৌ কোথায়?’

‘ওই যে ওর পিঠে। মুশহরদের গ্রাম এখান থেকে মাইল তিনেক দূরে। বৌ হেঁটে আসতে পারে না, তাই তাকে পিঠে করে আনে।’

‘রোজ আনে?’

‘রোজ নয়, হপ্তায় দু’-তিন দিন।’

‘রোগটা কি?’

‘জটিল স্ত্রীরোগ । বছর দুই ধরে ভুগছে, বেজায় কাহিল হয়ে পড়েছে। তবে মুশহরদের কঠিন প্রাণ, সহজে মরে না।’

মুশহর জাতি বিহারের অন্ত্যজ পর্যায়ের জাতি। ইহারা ইঁদুর খায়, শুয়োর খায়; অসাধারণ কায়িক পরিশ্রম করিতে পারে। বিহারে যত পাকা সড়ক আছে, সমস্তই এই মুশহরদের তৈরি। ইহারাই পাথর ভাঙে, ইহারাই পথ গড়ে। খর রৌদ্রে সারাদিন কাজ করার ফলে ইহারা অধিকাংশই রাতকানা। দিনের কাজের শেষে এক বোতল ধেনো মদ এবং একটি সঙ্গিনী—ইহাই তাহাদের কাম্য, আর কিছু চায় না।

মংলু মুশহর আমাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, বৈজনাথের পানে চাহিয়া সসম্ভ্রমে হাসিল। তাহার পিঠে ময়লা কাপড়ে ঢাকা বৌটা চামচিকার মতো আঁকড়াইয়া ছিল; মংলুর গলায় রূপোর বালা-পরা দুটা হাত এবং কোমরে রূপার কড়া-পরা দুটা পা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাইতেছিল না। মংলু অতি যত্নে বৌকে পিঠ হইতে নামাইয়া মাটিতে বসাইল। নোংরা কাপড়ের আড়ালে বৌয়ের মুখ দেখিতে পাইলাম না।

কিন্তু মংলুর দিক হইতে চোখ ফেরানো যায় না। বয়স পঁচিশ হইতে ত্রিশের মধ্যে, পাথর-কোঁদা চেহারা। ছ’ ফুট লম্বা, মুখশ্রী আদিম মানুষের মতো কুৎসিত নয়, হাসিটি বড় মিষ্টি। কোমর হইতে জানু পর্যন্ত কাপড় দিয়া ঢাকা, বাকি অঙ্গ উন্মুক্ত। প্রাচীন গ্রীক ভাস্কর হাতের কাছে কষ্টিপাথর পাইলে বোধ করি এমনি একটি মূর্তি গড়িতে পারিতেন।

বৈজনাথ বলিল—‘কিরে মংলু, বৌয়ের খবর কি?’

মংলু হাসিমুখে বলিল—‘আর বলবেন না সরকার, বৌয়ের জন্য মরে গেলাম। কাজকর্ম শিবে উঠেছে, রোজগার বন্ধ। মরেও না নিঙোড়ি, ম’লে আমি ছুটি পাই। সরকার একটা উপায় করুন।

‘কি উপায় করব? বিষ খাইয়ে মেরে ফেলব?’

মংলুর মুখের হাসিটি করুণ হইয়া গেল—‘তাই কি বলেছি হুজুর? ওকে ভাল করে দিন!’

‘ভাল করা ভগবানের হাত। ভেতরে নিয়ে আয়, দেখি।’

মংলু কাপড়ের পুঁটুলি দুই হাতে তুলিয়া লইয়া ভিতরে গেল।

পনেরো মিনিট পরে বৌকে পিঠে লইয়া মংলু আবার বাহির হইল।

বৈজনাথ বলিল—‘ওষুধটা নিয়ম করে খাওয়াস্। আর শোন্, কাল রাত্রে শূয়োর মেরেছি, সেটা তুই নিয়ে যা। তোরা নিজেরা খাস আর গাঁয়ের লোককে বিলোস্।’

শূয়োর দেখিয়া মংলু একগাল হাসিল—‘কাউকে বিলোতে পারব না হুজুর, আমরা নিজেরাই খাব। আমার এখন রোজগার নেই।’

পিঠে বৌ এবং হাতে আধ মণ ওজনের শূয়োরটাকে ঝুলাইয়া মংলু অবলীলাক্রমে চলিয়া গেল।

মংলু অন্তর্হিত হইলে বৈজনাথ বলিল—‘মংলু বৌটাকে ভালবাসে। মুশহরদের মধ্যে একনিষ্ঠতার বালাই নেই, মংলুটা কেমন ছটকে বেরিয়ে গেছে। বৌ নিয়েই আছে। ছোটলোকদের মধ্যে এমন দেখা যায় না।’

জিজ্ঞাসা করিলাম—‘বাঁচবে বৌটা?’

বৈজনাথ হাত উল্টাইয়া বলিল—‘কিছুই বলা যায় না। এমনি ভুগে ভুগেই জীবনটা কাটিয়ে দেবে। মংলুর জন্যে দুঃখ হয়।’

সে যাত্রা আরও দু’দিন থাকিয়া আরও অনেকগুলা হরিণ-শূয়োর মারিয়া ফিরিয়া আসিলাম। তারপর কয়েক বছর নানা পাকচক্রে বৈজুর গ্রামে আর যাইতে পারি নাই। কিন্তু যখনই মুশহরদের গাঁইতি হাতে রাস্তায় কাজ করিতে দেখিয়াছি, তখনই মংলুকে মনে পড়িয়াছে। মংলুর বৌটা এখনও বাঁচিয়া আছে কি না, কে জানে। হয়তো টিকিয়া আছে, মংলু এখনও তাহাকে পিঠে করিয়া ডাক্তার দেখাইতে আসিতেছে। বৈজু বলিয়াছিল, ছোটলোকদের মধ্যে এমন দেখা যায় না। ভদ্রলোকদের মধ্যেও আজ পর্যন্ত কাহাকেও স্ত্রীকে পিঠে করিয়া ডাক্তারের কাছে যাইতে দেখিতে নাই।

চার বছর পরে আবার একদিন বৈজুর গ্রামের উপস্থিত হইলাম। তেমনি খাসি কাটা রান্নাবান্না পানভোজন চলিল। চাঁদনী রাত ছিল, মধ্য রাত্রে দু’জনে শিকারে গেলাম।

পরদিন সকালে ডাক্তারখানার সামনে তেমনি রুগীর ভিড়। দম্‌মা, পিল্‌হী, বোখারা। বৈজু রুগীদের পরীক্ষা করিতেছে, গ্রাম্য ভাষায় গালাগালি দিতেছে, ঔষধ বিতরণ করিতেছে। মাঝে চার বছর কাটিয়া গিয়াছে বোঝা যায় না।

এক সময় চোখ তুলিয়া দেখি, চার বছরের পুরানো চিত্রটি সব দিক দিয়া পূর্ণাঙ্গ হইয়া গিয়াছে। মাঠ ভাঙিয়া মংলু আসিতেছে। পিঠে ময়লা কাপড়-ঢাকা বৌটা চামচিকার মতো আঁকড়াইয়া আছে।

রুগীরা তখনও সব বিদায় হয় নাই। মংলু বৌকে সযত্নে নামাইয়া পাশে বসাইল। এই কয় বছরে মংলুর চেহারার কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় নাই; তেমনি নিরেট নিটোল কষ্টিপাথরের মূর্তি, মুখে তেমনি মিষ্টি হাসি।

বৌটা এখনও বাঁচিয়া আছে।

বৈজনাথের পুত্র বানারসী ওরফে বন্নু আসিয়া বলিল—‘চাচা, দাদি তোমাকে ডাকছেন, হাত দেখাবেন।’

বন্নুর অনুসরণ করিয়া হাবেলিতে গেলাম। বৈজনাথের মা আমাকে স্নেহ করেন, কি করিয়া খবর পাইয়াছেন আমি হাত দেখিতে জানি। প্রত্যেক বারই তাঁহার করকোষ্ঠী দেখিতে হয়।

আধ ঘন্টা পরে ফিরিয়া আসিয়া দেখি রুগীরা প্রস্থান করিয়াছে, মংলুও বৌকে পিঠে ঝুলাইয়া মাঠের উপর দিয়া ঘরে ফিরিয়া যাইতেছে।

বৈজু তক্তপোশে বসিয়া গড়গড়া টানিতেছিল, আমার হাতে নল দিয়া বিমনাভাবে বলিল—‘গ্রামের জীবনে ওঠা নামা নেই, আজও যেমন, কালও তেমনি। সেই একই মানুষ, একই ব্যারাম, একই জীবনযাত্রা। তুমি চার বছর আগে যা দেখেছিলে, আজও তাই দেখছ, আবার দশ বছর পরে যখন আসবে তখনও তাই দেখবে।’

মংলুর মূর্তি তখন দূরে মিলাইয়া যাইতেছে। আমি বলিলাম—‘হয়তো মংলুর বৌটা তখনও বেঁচে থাকবে।’

বৈজু চকিতে আমার পানে চাহিল, তারপর হঠাৎ হাসিয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিলাম—‘হাসলে যে!’

বৈজু বলিল—‘তুমি চার বছর আছে যাকে দেখেছিলে, এ সে বৌ নয়। সে বৌটা সেই শীতেই মারা গেছে। তারপর আবার মংলু বিয়ে করেছে; কিন্তু এমন ব্যাটার কপাল, এবারও ঠিক তাই। এখন এটা কদ্দিন টেকে দেখ।’

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম—‘এ বৌকে মংলু ভালবাসে?’

বৈজু বলিল—‘ঠিক আগের মতই। বিয়ের পর মাস কয়েক বৌটা ভাল ছিল, তারপর রোগে ধরেছে। মংলুর দাম্পত্য-জীবনে সুখ নেই। হয়তো গ্রহ-নক্ষত্রের দোষ আছে। তোমার জ্যোতিষ শাস্ত্রে কি বলে?’

বলিলাম—‘হয়তো মংলুর অষ্টমে মঙ্গল।’

৭ বৈশাখ ১৩৬১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *