অশ্রুসিক্ত সিন্ধুবারি

অশ্রুসিক্ত সিন্ধুবারি

এই ক্ষুদ্র রচনাটির অবতরণিকাতেই আমার একটি সামান্য কৈফিয়ত নিবেদন করার আছে। যদিও বহু বৎসর ধরে আমার লেখা কেউ বড় একটা পড়ে না, তবুও বেতার বাংলার সম্পাদকমণ্ডলীতে দু একজন নিতান্তই অকালবৃদ্ধ সজ্জন, তথা তাদের বড় কর্তা আমার প্রতি নিতান্ত অকারণ সদয়। বেতার বাংলাই স্বাধীনতার পর এই অনারারি পেনশনপ্রাপ্ত অস্তমিত লেখকের কাছ থেকে সসম্মানে দাক্ষিণ্যসহ একটি রচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমারও স্পর্ধা বেড়ে গেল। জীবনে যা কখনও করিনি, সেই নিবেদন জানালুম; আসছে শ্রাবণের ১০ তারিখ (২৯ জুলাই) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুদিবস। তার সম্বন্ধে সামান্য কিছু নিবেদন করতে চাই। তারা সম্মত হয়েছেন।

নিঃসঙ্কোচে বলব, চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর হিন্দু সমাজের ইনিই সর্বোত্তম মহাপুরুষ। রবীন্দ্রনাথ যেসব মহাত্মাদের জীবনী লিখেছেন তার মধ্যে সর্বাধিক বিস্তীর্ণ স্থান দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্রকে। তিনি বলেছেন, বিদ্যাসাগর নিজের চরিত্রকে মনুষ্যত্বের আদর্শরূপে। প্রস্ফুট করিয়া যে এক অসামান্য অনন্যতন্ত্রত্ব প্রকাশ করিয়াছেন তাহা বাংলার ইতিহাসে অতিশয় বিরল; এত বিরল যে, এক শতাব্দীর মধ্যে কেবল আর দুই-একজনের নাম মনে পড়ে এবং তাহাদের মধ্যে রামমোহন রায় সর্বশ্রেষ্ঠ।

আমার সবিনয় নিবেদন, আমি গুরুর সঙ্গে একমত নই। অবশ্য আর দুই একজন বলতে গিয়ে গুরু যদি ঈশ্বরচন্দ্রকে বাদ দিয়ে রামমোহনকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে থাকেন তা হলে সে অভিমত সম্বন্ধে আমার কোনও বক্তব্য নেই।

গত দুই শতাব্দীতে যেসব মহাপুরুষ বঙ্গদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন রামমোহন থেকে বিবেকানন্দ– তাঁরা সকলেই হিন্দুধর্মের মূর্তমান প্রতীক। ঈশ্বরচন্দ্র তা নন। হিন্দুশাস্ত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের জ্ঞান গত আড়াই শতাব্দীর কারও চাইতে কণামাত্র কম ছিল না। বরঞ্চ হিন্দুশাস্ত্রে আমার যে নগণ্য যৎসামান্য জ্ঞান আছে তার পথপ্রদর্শক ঈশ্বরচন্দ্র। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, শাস্ত্রাধ্যয়ন-লব্ধ পাণ্ডিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র অতুলনীয়। বঙ্গদেশ বাদ দিন, সব ভারতের হিন্দু শাস্ত্রাধ্যয়নের কেন্দ্রভূমি কাশীর শাস্ত্রীরা তাঁকে সমীহ করে চলতেন; ঈশ্বর যখন বিধবা-বিবাহ হিন্দুশাস্ত্রসম্মত বলে বিধান দিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন, কাশীর শাস্ত্রীরা মল্লভূমিতে নামতে সাহস পাননি।

অথচ, পাঠক বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন ঈশ্বরচন্দ্র শাস্ত্র মানতেন না। তার ঋজু, সত্যশীল, দৈনন্দিন আচার-আচরণ সর্বধর্ম, বিশ্ব ধর্মসম্মত ছিল হিন্দু শাস্ত্রের বিধান তিনি সর্বজন সমক্ষে পুনঃ পুনঃ লঙ্ঘন করেছেন– অথচ সে যুগের হিন্দু সমাজপতিরা হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞ বিধবা-বিবাহ বিরোধী সমাজপতিগণ তাঁকে সমাজচ্যুত করার দুরাশা স্বপ্নেও স্থান দেবার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারেননি। তিনি তাঁর অন্নত্রে ভোজনকারিণী মুচি হাড়ি ডোম প্রভৃতি অপকৃষ্ট ও অস্পৃশ্য স্ত্রীলোকদের মাথায় তৈলাভাবে বিরূপ কেশগুলিতে স্বহস্তে তৈল মাখাইয়া দিতেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখছেন বর্ধমান-বাস-কালে তিনি তাহার প্রতিবেশী দরিদ্র মুসলমানগণকে আত্মীয়-নির্বিশেষে যত্ন করিয়াছিলেন। এস্থলে রবীন্দ্রনাথ ভাবোচ্ছাসে আত্মহারা হয়ে আত্মীয়-নির্বিশেষে বাক্য প্রয়োগ করেননি করেছেন সজ্ঞানে সসম্মানে শব্দার্থে। বঙ্কিমচন্দ্র বিধবা-বিবাহ বিরোধী ছিলেন। তার এক উপন্যাসে তিনি ওই নিয়ে কিঞ্চিৎ কৌতুক করেছেন। অথচ ঠিক ওই সময়ই বঙ্কিমের অগ্রজ সদানন্দ, সাম্প্রদায়িক হীনমন্যতামুক্ত সঞ্জীবচন্দ্র অনুজ বঙ্কিমকে নিয়ে বর্ধমানে ঈশ্বর সকাশে উপস্থিত হয়ে কুশলাদির পর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভোজনেচ্ছু হন। ঈশ্বরচন্দ্র মোগলাই পদ্ধতিতে উত্তম মাংসরন্ধনে সুপটু ছিলেন। সঞ্জীব আহারের সময় বিদ্যাসাগরের রন্ধননৈপুণ্যের প্রশংসা করে বলেন, তিনি যে বহুগুণধারী, সে তথ্য সঞ্জীব জানতেন, কিন্তু রন্ধনেও যে তিনি সুপটু সে তত্ত্ব তাকে বিস্মিত করেছে। বার্ধক্যে স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ছলনাময়ী। তারই ওপর নির্ভ করে সঠিক বলতে পারছি না, বিদ্যাসাগর কিন্তু আপনার ভায়া তো ভাবেন, আমি– বলার পর মূর্খ না ঠিক ঠিক কোন বিশেষণটি প্রয়োগ করেছিলেন। এর কিছুদিন পূর্বে বঙ্কিম ঈশ্বরচন্দ্রকে যে পত্র লেখেন তার সারমর্ম এই যে, আপনি শাস্ত্র-দ্বারা কেন প্রমাণ করতে গেলেন, বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন করা উচিত! ঈশ্বরচন্দ্র আত্মম্ভরী বা স্ত্রী ছিলেন না, কিন্তু তিনি আত্মদ্রষ্টা ছিলেন, তাই বিলক্ষণ অবগত ছিলেন, বঙ্কিম প্রভৃতি নব হিন্দুধর্মের প্রবর্তকগণ কি ব্যক্তিগত জীবন যাপন পদ্ধতিতে, কি শাস্ত্রজ্ঞানে, কি প্রকৃত ধর্মতত্ত্বানুশীলনে তাঁর বহু বহু পশ্চাতে। ঈশ্বরচন্দ্র সে পত্রের উত্তর দিয়ে বঙ্কিমকে অহেতুক সম্মান দেখাবার প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু এর প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পর ঈশ্বর ও বঙ্কিম উভয়ই যখন পরলোকে তখন রবীন্দ্রনাথ মল্লভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে লিখেছিলেন, “অনেকে বলেন, তিনি (ঈশ্বরচন্দ্র) শাস্ত্র দিয়েই শাস্ত্রকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু শাস্ত্র উপলক্ষ মাত্র ছিল; তিনি অন্যায়ের বেদনায় যে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সে তো শাস্ত্রবচনের প্রভাব নয়। এ যে কী মোক্ষম সত্য আমার গুরু আপ্তবাক্যপ্রায় বলেছেন, সে আমার অক্ষম লেখনী কী করে প্রকাশ করবে! প্রকৃত গুণী, মোহমুক্ত সত্যদ্রষ্টাই শাস্ত্রের এই জটিল তর্কজাল ছিন্ন করে মানুষকে ইঙ্গিত দেন, শেষ সত্যের উত্সস্থল কোথায়? কবি বলছেন, তিনি (ঈশ্বরচন্দ্র) তাঁর করুণার ঔদার্যে মানুষকে মানুষরূপে অনুভব করতে পেরেছিলেন, তাকে কেবল শাস্ত্রবচনের বাহকরূপে দেখেননি। শাস্ত্র মানুষকে সত্যের দিকে পথনির্দেশ করে, হয়তো-বা অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে উপদেশ দেয়, কিন্তু শাস্ত্র কবে কোন মানুষের পাষাণ-হৃদয়কে করুণা ধারায় প্লাবিত করতে পেরেছে?

***

এতক্ষণ অবধি যারা আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন তারা হয়তো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। শাস্ত্র, তা-ও হিন্দুশাস্ত্র, সে-ও গত শতাব্দীর পুরনো এক সমস্যা নিয়ে এত কচকচানি শুনে কীই-বা এমন চরম মাক্ষ লাভ হবে? কিচ্ছুটি না। তবে শুধু স্মরণে এনে দিতে চাই, মাত্র দুটি বত্সর আগে স্বৈরাচারী নরঘাতক সম্প্রদায় আমাদের মুসলিম শাস্ত্র নিয়ে পেশাওয়ার থেকে সিলেট অবধি কী প্রতারণাই না করেছিল। আমাদের জনপ্রিয় নেতা, মুক্তি ফৌজের আত্মোৎসর্গ, জনপদবাসীর বিদ্রোহ এর সবই নাকি ছিল ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ! আমরা ইংরেজি পঞ্জিকার ওপর নির্ভর করে দিবারাত্রির নামকরণ করাতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে এখনও বলি ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার রাত্রি এগারোটার সময় অভূতপূর্ব তাণ্ডবনৃত্য আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম পঞ্জিকানুযায়ী বৃহস্পতিবারের সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয়েছিল পবিত্র জুম্মাবার, শুক্রবারের রাত্রি। তার পর এল শুক্রবারের দিন। আল্লাতালার আদেশ :

ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু, ইজা নুদিয়া লিস্সলাতি মিনি-ইয়োমিল জুমুয়া (তি), ফাস্ আও ইলা জিরিপ্লাহ (ই)

হে ইমানদারগণ, যখন জুমার (সম্মিলন দিবসের) নমাজের জন্য তোমাদের প্রতি আহ্বান (আজান) ধ্বনিত হয় তখন আল্লাকে স্মরণ করার জন্য ধাবমান হও।

শব্দার্থে ধাবমান হয়েছিলেন আমার এক বন্ধুর পরহেজগার প্রতিবেশী ২৬ মার্চ জুমার নমাজের দিনে। তিনি জানতেন যে পুরোদিনের তরে কারফু। তাঁর স্ত্রী তাকে বারবার মানা করেছিলেন। বাড়ির সামনের রাস্তা জনশূন্য। অপর ফুটের হাত পাঁচেক ডাইনে মসজিদ। তিনি বিবিকে বললেন, আমি এক দৌড়ে মসজিদে পৌঁছে যাব। রাস্তা যখন প্রায় ক্রস করে ফেলেছেন তখন তীর বেগে এল মিলিটারি গাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে গুলির শব্দ। আরেকটি শহীদ। ইনি অতিশয় উচ্চপর্যায়ের শহীদ। কারণ আল্লার আদেশ অনুযায়ী শব্দে শব্দে ধাবমান হয়েছিলেন তিনি আল্লার নাম জির করতে। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করে, আল্লার আদেশ পালন করতে যে বাধা দেয় (কারফু জারি করে), যে মানুষের আদেশে আল্লার আদেশ লজ্ঞান করে তাকে খুন করে সে মানুষ শহীদহন্তারূপে কী খেতাব পায়! এবং এই ইয়াহিয়াই ডিসেম্বর মাসে পরাজয় আসন্ন জেনে আপন শিয়া ধর্মকে জলাঞ্জলি দিয়ে সুন্নিদের মসজিদে গেলেন জুম্মার নমাজ পড়তে। সুন্নিদের ভিতর তখন গুঞ্জরণ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, এই শিয়াটাই যত নষ্টের গোড়া যেন হুজুররা অ্যাদিন ধরে জানতেন না ইয়াহিয়া খান পুরো পাক্কা কিজিল পাশ শিয়া।

বিশ্বধর্মে দীক্ষিত ঈশ্বরচন্দ্র আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি উদাসীন ছিলেন কিন্তু ধর্ম নিয়ে প্রতারণার প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম ঘৃণা। তাই একদা তিক্ত কণ্ঠে তিনি ব্যঙ্গ করেছিলেন,

প্রতারণাসমৰ্থে বিদ্যয়া কিং প্রয়োজন?
প্রতারণাসমৰ্থে বিদ্যমা কিং প্রয়োজন?

পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, দুটি ছত্রই হুবহু একই বানানে লেখা, কিন্তু অর্থে আসমান-জমিন ফারাক, এবং দুই ছত্রে মিলে একই সত্য নির্ধারণ করে।

প্রতারণা-সমর্থ জনে, যে প্রতারণা করতে সমর্থ তার (শাস্ত্র) বিদ্যার কী প্রয়োজন? প্রতারণা দ্বারাই সে সবকিছু গুছিয়ে নেবে। দ্বিতীয় ছত্রে কিন্তু পড়তে হবে প্রতারণা অসমর্থ। এখানে সন্ধি করলে পূর্ব ছত্রের মতোই প্রতারণাসমর্থ রূপ নেয়। অর্থ : প্রতারণা করতে যে জন অসমর্থ কোনও বিদ্যাই তার কোনও কাজে লাগবে না। অর্থাৎ বিদ্যা কোনও অবস্থাতেই কারও কোনও কাজেই লাগে না। কাজ হাসিল হবে প্রতারণা মারফত। বড্ড সিনি-এর মতো তত্ত্বটি প্রকাশ করলেন বিদ্যাসাগর। বিশেষ করে বোধহয় এই কারণে যে তাকে বিদ্যার সাগর উপাধি দেওয়া হয়েছিল। এবং হয়তো-বা ওই সময়েই মাইকেল তার প্রশস্তি আরম্ভ করেন। বিদ্যার সাগর তুমি, বিখ্যাত ভারতে শ্রীমধুর মধুময় ছত্রটি বিদ্যার সাগর দিয়ে আরম্ভ হয়। সর্বশেষে এ তথ্যটিও প্রাতঃস্মরণীয় যে, বহুলোক বহু উপাধি পায় কিন্তু সেগুলো এ রকম টায় টায় খাপ খায় না বলে লোকে উপাধিধারী কাউকে কখনও তার পদবি যেমন বাড়য্যে কখনও কালীকৃষ্ণ কখনও ন্যায়রত্ন বলে উল্লেখ করে। কিন্তু বিদ্যাসাগরকে কখনও বড়য্যে মশাই (যতদূর মনে পড়ে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ দু জনাই বন্দ্যোপাধ্যায়, সংক্ষেপে বাড়য্যে, হয়তোবা রামমোহনও) বা ঈশ্বরচন্দ্র বলে উল্লেখ করেনি। প্রবন্ধ লেখার সময় আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ বলে উল্লেখ করি ভাষার অনুপ্রাস, কবিতার ছন্দ শ্রুতিমাধুর্য বা অর্থগৌরব অনুযায়ী যখন যেরকম মণিকাঞ্চন্ন সংযোগ হয়–হয়তো-বা কিঞ্চিৎ হার্দিক নৈকট্যের ইঙ্গিতসহ। কিন্তু বিদ্যাসাগর নিত্যদিনের চিরন্তন বিদ্যাসাগর। শুনেছি বিধবা-বিবাহ আইন পাস হবার পর ফরেসডাঙ্গার (চন্দননগর) তাঁতিরা কাপড়ের পাড়ে বোনে বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে তুমি। এবং এ উপাধি যে কত সত্য কত গভীর তার চরম স্বীকৃতি দিয়েছেন সে-যুগের অন্যতম ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংস। তিনি স্বয়ং এসেছিলেন বিদ্যেসাগরের দর্শন লাভার্থে তার ভবনে। উভয়ের পন্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। রামকৃষ্ণ সাধক, আর বিদ্যাসাগর ছিলেন মোক্ষ, মুক্তি, বৈকুণ্ঠলাভ বা শিবত্ব প্রাপ্তি বাবদে নিরঙ্কুশ উদাসীন। বিদ্যাসাগর অতিশয় সযত্নে রামকৃষ্ণকে সম্মুখের আসনে বসালেন। রামকৃষ্ণ মুগ্ধ নয়নে এক দৃষ্টিতে দীর্ঘকাল তার দিকে

তাকিয়ে শেষটায় ভাবোদ্বেল কণ্ঠে বললেন, এতদিন দেখেছি শুধু খাল বিল ডোবা; এইবারে সত্যই সাগর দর্শন হল। রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর না দয়ার সাগর–শ্রীমধুর মধুর ভাষায় করুণার সিন্ধু তুমি!–বা উভয়ার্থে বলেছিলেন সেটা পরিষ্কার হয়নি; আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস উভয়ার্থে। বলা নিতান্তই অনাবশ্যক যে, রামকৃষ্ণ স্পষ্টভাষী ছিলেন। সে যুগের বহুজন সম্মানিত বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত্র তথা নব-হিন্দু ধর্মব্যাখ্যান মাসের পর মাস লিখে যাচ্ছেন তখন তিনি প্রায়ই রামকৃষ্ণের সঙ্গে তত্ত্বালোচনা বা যাই হোক, সে সন্ধানে যেতেন তার আশ্রয়স্থলে বিদ্যাসাগর কখনও যাননি। একদিন রামকৃষ্ণ হঠাৎ বঙ্কিমচন্দ্রকে বললেন, আপনার নাম যেরকম বঙ্কিম, আপনি ভিতরেও বাঁকা বটে। সম্পূর্ণ মন্তব্যটি আমার মনে নেই। তবে সেটা যে অতিশয় শ্রুতিমধুর ছিল না তা আমার স্পষ্ট মনে আছে।

বিদ্যেসাগর অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্রকণ্ঠে ব্যত্যয়হীন বিরোধিতা প্রকাশ করতেন বলে তাকে অজ্ঞজন রূঢ়স্বভাবের লোক বলে কখনও কখনও মনে মনে সন্দেহ করেছে। এ স্থলে কবি ভর্তৃহরির দুটি ছত্র তুলে দিলেই বিষয় সরল হবে :

আচারনিষ্ঠ ভণ্ড বলেছে,
ধীরজনে ভীরু, সরলে মূঢ়
প্রিয়ভাষীজনে ধনহীন গোণে,
বীরেরে নির্দয়, তেজীরে রূঢ়।

(সত্যেন দত্তের অনুবাদ)

এই ব্যর্থশক্তি নিরানন্দ জীবনধনদীন যুগে একথা স্মরণে এনে বড় আনন্দ পাই যে বিদ্যাসাগরের মতো রূঢ়তাবর্জিত তেজিজন এদেশে জন্ম নিয়েছিলেন। আমি বিদ্যাসাগরচরিত্র যদি কণামাত্র চিনে থাকি তবে রূঢ়তম কণ্ঠে রূঢ়তার প্রতিবাদ জানিয়ে বলব, তার মতো বিনয়ী লোক ইহসংসারে হয় না।

রামকৃষ্ণের মুগ্ধ মন্তব্যের উত্তরে বিদ্যাসাগর হেসে বলেছিলেন, সাগরেই যখন এসেছেন তখন খানিকটে লোনা জল নিয়ে যান। রামকৃষ্ণ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সুস্পষ্টভাষায় প্রতিবাদ করেছিলেন।

পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বৎসর ধরে দেশে-বিদেশে যখনই আমি কাউকে চোখের জল ফেলতে দেখেছি তখনই আমার মনে জেগেছে প্রথম দিনের প্রশ্নটা, করুণাসাগর লোনা জল বলতে সেদিন কী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?

তবে কি বলতে চেয়েছিলেন, তার সর্বসত্তাতে আছে শুধু চোখের জল, অশ্রুধারা লোনাজল?

বেতার বাংলা, জুলাই ১৯৭৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *