অশ্বত্থমা

দ্রোণ ও কৃপীর একমাত্র পুত্র। জন্মমাত্র ওঁর মুখ থেকে অশ্বের হ্রেষার মত আওয়াজ হয়েছিল বলে,ওঁর এই নামকরণ হয়। চিরকুমার অশ্বত্থমা পিতার কাছে ধনুর্বিদ্যা ও বেদশাস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন। দিব্যাস্ত্রবিদ ও বীরপুরুষ হওয়া সত্বেও ভীষ্ম ওঁকে মহারথ হিসেবে গণ্য করেছেন, অতিরথ বলে নয়। নিজের প্রাণের প্রতি অত্যাধিক মায়া বশত মাঝে মাঝেই প্রাণভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ওঁকে পালাতে দেখা গেছে। কিন্তু যখন তেজের সঙ্গে উনি যুদ্ধ করেছেন তখন তাঁকে অর্জুন-তুল্যই মনে হয়েছে। দ্রোণহত্যার পর অশ্বত্থমার দুর্দম্য আক্রমণে অসংখ্য পাণ্ডব-সৈন্য নিহত হয়েছে। কিন্তু বহু দিব্যাস্ত্র ব্যবহার করেও তিনি যখন কৃষ্ণার্জুনকে অতিক্রম করে পিতৃহন্তা ধৃষ্টদ্যুম্নকে আঘাত করতে পারলেন না, তখন নিজের অস্ত্রশক্তির বীতশ্রদ্ধ হয়ে রণক্ষেত্র ত্যাগ করেছিলেন। পরে অবশ্য ব্যসদেবের কাছে জেনেছিলেন যে, পূর্বজন্মের তপস্যার ফলে কৃষ্ণার্জুন অজেয়। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের শেষে ভগ্ন-উরু মৃত্যুপথযাত্রী দুর্যোধনকে দেখে অশ্বত্থমার ক্রোধ আবার প্রজ্জ্বলিত হল। সেই রাত্রে তিনি স্থির করলেন, যেহেতু সন্মুখ সমরে পাণ্ডবদের পরাজিত করা অসম্ভব, নিদ্রিত অবস্থায় তাঁদের হত্যা করতে হবে। তিনি কৃপ ও কৃতবর্মাকে পাণ্ডবশিবিরের বাইরে পাহারায় রেখে নিজে সেখানে প্রবেশ করে প্রথমেই ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করলেন, তারপর একে একে দ্রৌপদীর পুত্রদের ও শিখণ্ডী সহ অন্যান পাঞ্চালদের বধ করলেন। পঞ্চপাণ্ডব সেই শিবিরে ছিলেন না। অশ্বত্থমার এই নারকীয় আচরণের সংবাদ ধৃষ্টদ্যুম্নের এক সারথি কোনও ক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে পাণ্ডবদের দিলেন। পুত্র ও ভ্রাতাদের এই রকম নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে শুনে দ্রৌপদী প্রতিজ্ঞা করলেন, অশ্বত্থমাকে বধ করে তাঁর মাথার সহজাত মণিটি যদি যুধিষ্ঠির ধারণ করেন, শুধু তাহলেই তিনি প্রাণ-বিসর্জন দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। সেই শুনে প্রথমে ভীম ও তাঁর সঙ্গে অন্য পাণ্ডবরা অশ্বত্থমার খোঁজে বার হলেন। অশ্বত্থমা পাণ্ডবদের দেখে তাঁদের বধ করার উদ্দেশ্যে ব্রহ্মশির নামে এক দিব্যাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। কৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুনও সেই মহাস্ত্রকে প্রতিহত করার জন্য অনুরূপ দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। দুই অস্ত্রের প্রভাবে এক অগ্নি প্রলয়ের সূচনা হল। দেবর্ষি নারদ ও মহর্ষি ব্যাস দুই অস্ত্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে দুজনকেই অস্ত্র প্রত্যাহার করতে বললেন। অর্জুন সক্ষম হলেন, কিন্তু অশ্বত্থমা তাঁর অস্ত্র পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে পারলেন না। তিনি তাঁর অস্ত্র উত্তরার গর্ভস্থিত সন্তানের ওপর নিক্ষেপ করলেন। ব্যাসদেবের নির্দেশে নিজের মস্তকের মণিটি অনিচ্ছা সত্বেও পাণ্ডবদের তিনি দিলেন। কৃষ্ণের বরে উত্তরার অস্ত্রদগ্ধ মৃত সন্তান ভুমিষ্ঠ হয়েই পুনর্জীবন পেল, কিন্তু অশ্বত্থমার এই ক্রুর আচরণের জন্য কৃষ্ণ তাঁকে অভিশাপ দিলেন যে, তিন হাজার বছর ধরে সঙ্গহীন অবস্থায় ব্যধিযুক্ত হয়ে ওঁকে ঘুরে বেড়াতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *