আটচল্লিশ
রামচন্দ্র বলল, বাবু কহিলা ধান কাটার পর উসব কথা শুনিবে, হুটেলে ঠাকুরানির বদলে সুভদরা কাম করিবে, বাবুর মায়া হইছে।
তুমি কী বললে? ভানু জিজ্ঞেস করে।
আঁজ্ঞা মু কী কহিব, বাবুর উপরে মু কহিতে পারি, মু কাল বাদ পরশু সকালা ভীমাপুর চলি যাবু, সুভদরা ইখেনে রহি যাবে।
সুভদ্রা কী বলছে?
চুপ করি রহিছে, কুনো কথাই কহিছে না।
বিয়ে কবে হবে?
আঁজ্ঞা ধান কাটার পর, ইটা তো কাত্তিক মাস, মৌসির মাস ছাড়া তো বিয়া হিবে না, কাত্তিক মাসে বিয়া হয়নি।
তাহলে সুভদ্রা এখেনে থেকে যাবে?
আঁজ্ঞা বাবু ইটাই কহিলা, বিয়া হয় নাই, উয়াকে কাছারিবাড়ি রাখা তো ‘রিকস’ হঁই যাবু, উটা ঠিকওনি, তবে কিনা উ তো একজনার বউ ছিলা, মাথায় সিঁদুরও পরে, মু বাবুর কথাই শুনিব, সুভদরা রহি যাক।
রামচন্দ্রর কথার সময় সুভদ্রা মুখ নামিয়ে—স্থির, নিস্পন্দ। ভানু এতক্ষণে বুঝল ঠাকুরানিকে কেন বিদায় দিচ্ছে মাইতিমশাই। রামচন্দ্র তাকে টানল, শুনো ভানুবাবু, বাবু কহিছে ধান কাটার পর সত্যিই যদি গরমিন জমিন ঘিরি দেয়, দখল করি নেয়, তখন মুকে হুটেলের ঠাকুর করি দিবে, ঠাকুর বটে মানিজারও বটে, সুভদরা ঠাকুরানি, ই ঠাকুরকে বিদায় দিবে সি সময়!
যদি জমিন থেকে যায়?
সিটা তো জানিনি, সি কথা তো কহেনি বাবু, কিন্তু জমিন রহিবেনি, বাতাসে কথা উড়ছ্যা, ধান কাটার পর তারকাঁটা দিয়া ঘিরি লিবে, জমিনের টঙ্কা বালেশ্বর থিকে দিয়া দিবে।
ভানু চুপ করে যায়। শ্রীপতি মাইতি তার কর্মচারীকে নিয়ে কী করবে তা তার ব্যাপার। সে নিজে শ্রীপতির কর্মচারী কি না তা জানে না। শ্রীপতি খেয়ালি মানুষ, পয়সাওয়ালা মানুষ, সে শ্রীপতির ঘোড়ার দেখভাল করত। দীঘায় নেমে শ্রীপতির সঙ্গেই আলাপ হয়েছিল প্রথমে। শ্রীপতি তাকে চিনেছিল। ভবঘুরেকে হোটেলের কাজে বন্দি করেছিল। ঘোড়ার পরিচর্যা ঠাকুর করত না। ঠাকুরের অত সময় কোথায়? পয়সা মারার ধান্দা করবে, না ঘোড়াটাকে দেখবে? শ্রীপতি সব জানে। কিন্তু এও জানে ঠাকুর আর কত মারতে পারবে পয়সা, বরং ঘোড়টাকে না দেখলে ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই ভানু এলো ঘোড়ার পরিচারক হয়ে। ভানু জীবনে কখনো ঘোড়ার গায়ে হাত দেয়নি তার আগে, কিন্তু আশ্চর্য, পক্ষিরাজ তাকে চিনে গেল ঠিক! ভানু এসেছিল বোশেখ মাসে, আশ্বিনে আবিষ্কার করল ঘোড়াটাও ভবঘুরে। পালায়, ফিরে আসে, আবার পালায়, তো এখন ঘোড়াটা নেই, ঘোড়া নেই যখন ভানু কী করতে আছে শ্রীপতি মাইতির কাছে? কিন্তু ঘোড়া যখন পালিয়েছে, আগের মতো ফিরেও আসতে পারে। তখন তো আবার কাজে বহাল হয়ে যাবে ভানু। এখনও অবশ্য বহালই আছে। তার কাজ যায়নি, ঘোড়াটাকে খুঁজে বের করাও তো কাজ। যতদিন না পাবে তা ততদিন খোঁজ। সবে তো কটা মাস হয়েছে, সময় তো ফুরিয়ে যায়নি! চাঁদ উঠছে, সূর্য উঠছে, মেঘ, বৃষ্টি, আলো-অন্ধকার, সব রয়েছে। সমুদ্র রয়েছে, আকাশ রয়েছে, জ্যোৎস্না রাত্রি রয়েছে, হিম পড়তে শুরু করেছে, আকাশের যত তারা সব আছে, কোনো তারা সন্ধ্যায় অস্ত যাচ্ছে, কোনোটি মধ্যরাতে জেগে উঠছে। ওই যে মাথার ওপরে ছায়াপথটি, আকাশগঙ্গা, যেমন ছিল তেমনই রয়েছে। ওই আলোর নদীর পশ্চিম ঘেঁষে অভিজিৎ নামের একটি নক্ষত্র আছে। ভানু তাকে চিনেছিল, এখন ধরতে পারে না, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আরও কত চিনত সে, একেবারে পূর্বদিগন্ত ছুঁয়ে প্রায, আকাশগঙ্গার শেষে ব্রহ্মহৃদয় ভেসে থাকে এই সময়। ভানু চিনতে পারে না। চেনে শুধু উত্তরাকাশের ওই ধ্রুব নক্ষত্রটিকে! যে বৈশাখে কন্থক পালিয়েছিল, তখন ব্রহ্মহৃদয়টি পশ্চিম দিগন্তের কাছে ছিল। সরতে সরতে অস্ত গিয়েছিল জ্যৈষ্ঠের শেষে। তারপর আবার ফিরে এসেছে আকাশমণ্ডলে। আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের শৃঙ্খলা একটুও ভাঙেনি। বৈশাখে ছিলেন সপ্তঋষি, উত্তর আকাশে, প্রায় মাথায় মাথায়, এখন সপ্তঋষিরা বিশ্রামে গেছেন। এই কদিন আগে তাঁরা অস্ত গেছেন পশ্চিম দিগন্তে, মাঘে আবার ফিরে আসতে আরম্ভ করবেন। ফাল্গুনে আকাশে জ্বলজ্বল করবে সাতটি ভাই। ঘোড়াটা কি জানে না এসব? যেখানেই থাকুক সে মাথার পরে আকাশ আছে। সেই আকাশে তার চেনা তারারা রয়েছে। সবই যখন আছে, সে ফিরবে না কেন? গাছগাছালি, বনবনান্তর, পাহাড়, নদী সব যদি থাকে সে যাবে কোথায়? কেন ফিরবে না? ফিরতে তাকে হবেই, আর ভানুকে খুঁজে যেতে হবে ঘোড়াটিকে। না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কখনো পথের ধারে, কখনো নদীর কূলে, কখনো বনের পাশে, হাটে, মাঠে, অশ্বত্থতলায়—যেখানে যেখানে কেউ কারও জন্য অপেক্ষা করতে পারে, সেখানেই অপেক্ষা করবে ভানু।
পরদিন ঠাকুরানি খুব চোখের জল ফেলল। ঠাকুর ভোরবেলা ছুটে তার জন্য একটা কাজ ঠিক করে ফেলেছে নতুন দীঘার দিকে, কিন্তু থাকার জায়গা তো পাবে না সেখানে। আচমকা যে তার চাকরি চলে যাবে তা ভাবতেই পারেনি ঠাকুরানি। ঠাকুরানির বোনের বাড়ি আছে বালিসাই। সেখানে যাবে, না মাইতিবাবুর জন্য বসে থাকবে, সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। মাইতিবাবু আদেশ দিয়ে কাল রাতেই ফিরে গিয়েছিল সাঁতরাপুর। সকালে আসেনি, উদ্বিগ্ন দেখেছিল ভানু। ঠাকুরানি চোখের জল ফেলতে ফেলতে কাজ করছে। সমুদ্রপাখি হোটেলে থাকার জায়গা পেয়েছিল সে, জায়গা সমেত কাজ পাবেই বা কোথায় স্বামী-স্ত্রী? স্বামী-স্ত্রী কি? ধরা যায় না ঠিক। ভানুর কখনো সন্দেহ হয়, কখনো ভাবে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই।
ভানু জিজ্ঞেস করল, তোমার কাজে গোলমাল হয়েছিল?
ঠাকুরানি মাথা নাড়ে, জানিনি।
তাহরে ঠাকুরের জন্য কাজ গেল?
জানিনি।
রামচন্দ্র আর সুভদ্রা শিবমন্দিরে গেল। সমুদ্রের কাছে গিয়ে সকালটা বসে থাকল। ভানুর কাজ দেখা। ভানু দেখছে দুটিতে মিল হয়েছে খুব। পক্ষী আর পক্ষিণীর মতো দুজনে মুখোমুখি সমুদ্রের ধারে ঝাউয়ের ছায়ায় বসে আলাপ করছে। ভানুর আজ কোথাও যাওয়ার নেই। তার মনের ভিতরে কোথাও কোনো অন্ধকারে কাঁকর ঢুকে গেছে যেন। অস্বস্তি একটা রয়ে গেছে। ঠাকুরানির চাকরি আচমকা খেয়ে নিল মাইতিবাবু, ঠাকুরকে রেখে দিল! অপরাধ তো ঠাকুরের, ঠাকুরানি কী করল? ভানু টের পাচ্ছে, কিন্তু ভাবতে ভয় পাচ্ছে। সুভদ্রাকে রেখেই দিল শ্রীপতি মাইতি? রেখেই দিল ঠাকুরানির জায়গায়। রামচন্দ্রকে পাঠিয়ে দিল বালিমুণ্ডা—ভীমাপুর। পাঠিয়েই দিল।
বিকেল বিকেল এলো শ্রীপতি। ঠাকুরানি উসখুস করতে লাগল। দুদ্দাড় করে নেমে এলো নিচে, কিচেনে গিয়ে ঢুকল! ঠাকুর বেঞ্চে চুপ করে বসে ছিল। ঠাকুরানি চাপা গলায় তাকে শ্রীপতির আসার খবর দিতে ঠাকুর বলল, কুছু হবেনি, তুই যা।
কাই যাবু?
তার আমি কি জানি?
তুমি ইটা কী বলো ঠাকুরমশায়?
মোর ভিটায় তো তুরে লিয়ে যাবনি। ঠাকুরমশায়, মু তুমার আশরয়ে ছিলাম।
ঠাকুর মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ঠাকুরানির কালো চকচকে দুটি চোখের কোণ চিকচিক করে উঠেছে। ঠাকুর ইঙ্গিত করল মাইতিমশায়ের কাছে যেতে। ঠাকুরানি কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো আঁচলের খুঁটে চোখের জল মুছতে মুছতে। বেরিয়ে ভানুকে পায়, ভানুদাদা!
ভানু বলল, যাও বাবুর কাছে।
তুমি যাও ভানুদাদা, মু কী করিছি কুছুই জানিনি।
ভানু ঢুকে গেল শ্রীপতির ঘরে। শ্রীপতি চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল। ভানুকে দেখেও শুয়ে থাকল। ভানু টেবিলের লাগোয়া চেয়ারটিতে বসল। বসেই থাকল। শ্রীপতি উঠে বসল আচমকা, মেয়েছেলেটা যায়নি?
ঠাকুরানি সমস্ত দিন চোখের জল ফেলছে।
আমি কী করব? আমি তো ওর ঠিকা নিয়ে বসে নেই।
ভানু বলল, রাখা যায় না?
না, ওকে তো আমি রাখিনি, রেখেছিল ঠাকুর, ঠাকুরের জন্য ওকে ছাড়লাম, ও ঠাকুরের রাখনি, বিয়ে করা বউ তো না।
আগে তো শুনিনি।
দরকার হয়নি তাই শোনোনি, আর শুনবে কেন, কথাটা কি বলার মতো, ঠাকুরের এত আস্পদ্দা, আমার হোটেলে খায়, কাজ করে, আড়কাঠিগিরি করবে, আর আমি তা জানব না, তুমিও বলোনি ভানুবাবু, কিছুই বলোনি
আঁজ্ঞে আমি বলার কে, আমি জানতাম আপনি জেনে যাবেন।
তুমি তো ভীমাপুরের কথাও…। শেষ করে না শ্ৰীপতি।
ভানু চুপ করে থাকল। কথটা কাল রাতেই শেষ হয়ে গেছে ধারণা ছিল, কিন্তু তা নয়। শ্রীপতি ভোলেনি, শ্রীপতি ফুসছে। বলছে, ও বেটা আমার নায়েব ও একটা মেয়েমানুষ তুলেছে কাছারিতে, কাছারি ওর বাপের?
ভানু চুপ করে থাকে। মাইতিবাবুর কর্মচারী, বাবুর যেমন শাসন করার অধিকার আছে, তেমনি আছে যে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার। শ্রীপতি বলছে, সুভদ্রাকে রেখে দিতে সুবিধা হলো ঠাকুরানিকে ছাড়া। ঠাকুরানি হলো ঠাকুরের পোষা মেয়েমানুষ। ঠাকুরের বউ ছেলেমেয়ে সব আছে গাঁয়ে, দীঘার ঠাকুরানি তার সেবা করে। ঠাকুরানিকে ঠাকুরই এনেছিল। ঠাকুর খুব চালাক। মেয়েমানুষটাকে বউ পরিচয়ে কাজে ঢুকিয়ে নিল অথচ ওর বউ যে ঠাকুরানি নয় তা টের পেতে প্রায় মাস ছয়েক লেগেছিল শ্রীপতির, যখন গাঁ থেকে ঠাকুরমশায়ের সমন্ধি এলো চন্দনেশ্বর মন্দিরে মানত পালন করার জন্য। ঠাকুরকে জব্দ করা এটা একটা উপায় হলো। ঠাকুরানির জন্যই ঠাকুর তার কাজ ছাড়বে ঠিক।
ভানু বলল, ঠাকুরকে ছাড়লেই তো হতো।
উঁহু, তাহলে ঠাকুরের কাজ করবে কে? ভানুর দ্বারা ও কাজ হবে না, রামচন্দ্রও পারবে না। আর রামচন্দ্রকেও তো বুঝিয়ে দেয়া দরকার সে যে কাজটা করেছে তা ঠিক নয়। সুভদ্রাকে রেখে দিয়ে রামচন্দ্রকে একা ভীমাপুর পাঠানোর জন্যও ঠাকুরানিকে ছাড়ানো হয়েছে। রামচন্দ্রর সঙ্গে সুভদ্রাকে ভীমাপুর ফেরত পাঠানো যায় না। কাছারির একটা মেয়েমানুষ নিয়ে থাকবে নায়েব, তা তো হতে পারে না। তাতে মাইতিবাবুর কাছারির বদনাম হবে। কাছারিটা হিসেব রাখার, মেয়েমানুষ নিয়ে থাকার জন্য নয়। নায়েব এসব করলে জমিজমা রক্ষাই দায় হবে। পুলিশের নজর পড়বে কাছারির ওপর। তার কাছারিতে ওভাবে পুলিশের আনাগোনা হলে কাছারির মান থাকবে না। কাছারির পবিত্রতা নষ্ট হবে। সুভদ্রা মেয়েমানুষটি স্বামী ত্যাগ দেয়া। শ্রীপতি দেখেই বুঝতে পারছে ওর স্বভাবও ভালো নয়। হতে পারে না। জেনেশুনে ওকে যেতে দেয়া মানে রামচন্দ্রর ফুর্তির ব্যবস্থা করা।
ভানু বলল, ঠাকুরানি কাঁদছে।
কাঁদুক। শ্রীপতি নির্মম। ঠাকুর ওকে বাঁচাক। আর ঠাকুরও বুঝুক কাজটা সে ভালো করেনি। ঠাকুরানিকে নিয়ে খুব সুখে ছিল ঠাকুর। সেই সুখ ভাঙা দরকার। শ্রীপতি বলছে, রামচন্দ্র তো কাল ভীমাপুর যাবে, আজই সন্ধের পর ওকে সাঁতরাপুর পাঠিয়ে দেবে, এক জায়গায় থেকেও আলাদা হয়ে যাবে সে সুভদ্রার কাছ থেকে। সেই কাজটাই করা দরকার। ভানুকে গাঁজা সাজতে বলে শ্ৰীপতি।
ঠিক সন্ধের সময় দুটিতে ফিরল। রামচন্দ্র আর সুভদ্রা। ঠাকুর গেছে ঠাকুরানিকে বালিসাইয়ের বাসে তুলে দিতে। শ্রীপতি রামচন্দ্রকে ডেকে সাঁতরাপুর যেতে বলে। ওদিক থেকে ভ্যান রিকশা ধরে রামনগর গিয়ে বাস ধরে যেন রামচন্দ্র। একটু খরচ বেশি হবে।
রামচন্দ্র হাত কচলায়, এতক্ষণে সে টের পেল সুভদ্রা বউকে রেখে তাকে চলে যেতে হবে এখনই। বাবু বলছে, বাবু যাবে, রামচন্দ্র না বলে যেন ভীমাপুর ছেড়ে এদিকে না আসে, আসতে হবে না।
আঁজ্ঞা আঘুন মাসে?
চোপ, যা বলছি তাই করবি।
আঁজ্ঞা তাই হিবে, কিন্তু সুভদরা?
আমার কাছে থাকল।
আঁজ্ঞা! রামচন্দ্রর চোখমুখ বিপন্ন হয়ে উঠল। বিমর্ষতার ছায়া পড়ল। এতক্ষণে সে ধরতে পারছে সুভদ্রা দীঘায় থাকবে, সে থাকবে ভীমাপুরের কাছারিতে। কাছারি ত্যাগ করতে মানা করছে বাবু। ধান কাটার পরে ওরা আসবে। এখন সরকার জমি যদি নিয়ে নেয়, কত জমি নিচ্ছে সরকার তার হিসেব নেয়া দরকার। নায়েব কাছারিতে থাকবে না, অথচ সমস্ত স্থাবর সম্পত্তি সরকার ঘিরে নেবে তা তো হয় না। শ্রীপতি বোঝাতে লাগল, এই সমস্ত অধিগ্রহণের কোনো হিসেব থাকে না, সরকারি সার্ভেয়ার যেমন বলবে তেমন হবে। এমন যদি হয় একশ বিঘে নিয়ে সার্ভেয়ার বলল, সত্তর বিঘে নিয়েছে, সেইভাবে যদি হিসেব দাখিল করে কালেক্টরের কাছে, তবে কালেক্টর সায়েব তাই মেনে নেবে। আবার সার্ভেয়ার যদি বিশ বিঘে নিয়ে, কুড়িটা-তিরিশটা দাগ দখল করে বলে পঞ্চাশ বিঘে নিয়েছে, পঁয়ষট্টিটা দাগ নিয়েছে, কালেক্টর তাও মেনে নেবে। সুতরাং সার্ভেয়ারকে বশ করতে হবে। সার্ভেয়ারকে দিয়ে কাছারিবাড়ির এরিয়া বেশি লেখাতে হবে, লেখাতে হবে হাজারটা নারকেল গাছ আছে, সেই সবের দাম সার্ভেয়ারের হিসেবমতো কালেক্টর দেবে। রামচন্দ্রের এখন ওই কাজ করা উচিত কাছারিতে পড়ে থেকে। ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে খুঁজে বের করা উচিত অধিগ্রহণ দপ্তরের সার্ভেয়ারকে, ছোটবড় অফিসারদের। কত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নায়েবের।
রামচন্দ্র বাধ্য ছেলের মতো সব শুনল, তারপর জিজ্ঞেস করল, বাবু কবে যাবে? বাবু গেলে তো খবর সব পাবে রামচন্দ্র। কোন খবর? তা কি আর খোলসা করে বলে সে? শ্রীপতি ভানু দুজনেই বুঝে নিল। শ্রীপতি হাসতে লাগল। নেশাটা ধরেছে তার, বলে, যাবে শিগগির, এ মাসেই ধান কাটা হয়ে গেলে যাবে খবর নিতে, তবে নিজে না গিয়ে ভানুকেও পাঠাতে পারে।
রামচন্দ্র বলে, ভানুবাবুর অশ্ব উদিকে নাই।
নাই! কী করে বুঝল রামচন্দ্র? থাকতেও তো পারে। ঘোড়াটা যে সমুদ্র উপকূল ধরে ছুটে যায়নি তা জানবে কী করে রামচন্দ্র? আকাট রামচন্দ্র! নির্বোধ রামচন্দ্র! শ্রীপতি বলল, এখনই যেন রামচন্দ্র সাঁতরাপুরে চলে যায়, তার মা দেখতে চেয়েছে তাকে। ভানুর আর ভালো লাগছিল না। আচমকা সে উঠে পড়ল। বেরিয়ে এসে দেখল সুভদ্রা বসে আছে কিচেনের ভিতরে, চেয়ারে আধময়লা আলোর ভিতরে। ভানুকে দেখে অন্ধকার মুখ নামায়।
রামচন্দ্র বেরিয়ে এসে ভানুকে ধরল, ভানুবাবু, তুমি কুছু কহিবে না?
কী! ভানু ঘাড় ঘোরায়। দেখল মস্ত চেহারার লোকটা নুয়ে গেছে, কোনো রকমে উদ্গত অশ্রু চেপে রয়েছে। ধুস! ভানু ঠেলে দিল রামচন্দ্রকে, বলল, আমি কী বলব, আমি কি তোর বাবু, যা না বাবুর পা ধর গিয়ে।
রামচন্দ্র দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই রামচন্দ্র আর কাছারিবাড়ির রামচন্দ্র এক নয়। কাছারিবাড়ির রামচন্দ্র অন্য লোক। তার অন্য রূপ, অন্য চেহারা। ভানু বলল, কে তোকে নিয়ে আসতে বলেছিল সুভদ্রাকে?
সুভদ্রা কহিছে রহিবেনি।
তা কি আর হয়। ভানু মাথা ঝাঁকায়।
রামচন্দ্র বলে, মোর ডর লাগিছে ভানুবাবু, তুমি কুছু কহ।
ভানু হাসতে থাকে, কী কহিব রে, কী কহিব, যা কাছারিতে গিয়ে সার্ভেয়ারকে খুঁজে বের কর, সুভদ্রা বাবুর কাছে থাকুক।