1 of 2

অশ্বচরিত – ৪৭

সাতচল্লিশ

তোমার নাম?

রামচন্দ্র বলল, আঁজ্ঞা বাবু, ওর নাম সুভদরা, জমি নিলা গরমেন, উয়াতে ভিখিরি হঁই গিছে, অনাথিনী, মোর নিকট আশরয় নিইছে, কাছারিতে কাম করে, ভানুবাবু সবু জানে, ভানুবাবু কহেনি, ও ভানুবাবু, কহনি তুমি?

ভানু ঘাড় কাত করল, সে বলেছিল, কিন্তু বাবু শ্রীপতি মাইতি নানা কাজের মানুষ, তার কি সব মনে থাকে? নাকি তিনি সব কানে নেন? বাবু কতদিক থেকে বিব্রত। বাবুর মেয়েমানুষটিতে আর মন নাই, আবার যাকে মনে ধরেছে সেই কোকিলা বধূর কাছে পৌঁছতে পারছে না বাবু, এর সঙ্গে বাবুর ঘোড়াটি তো রয়েছেই। এখনও ফিরল না। হিম পড়ে গেল, কাশফুল ঝরে গেল, রাতের দিকে ঠাণ্ডা পড়ছে, এমন সময়ে কি সে বাইরে থাকতে পারে? কিন্তু রয়েছে তো! আরও কত ব্যাপার : সতীশ গিরির কথাটি তো বাবু এখনও জানে না। জানলে কি বাবুর মতি স্থির থাকবে? শোক পাবে তো! পক্ষিরাজের ভালোবাসার ঘুড়ীটা, যার টানে সে ছুটে যেত চোদ্দবেড়িয়ার চরে, তাকে কিনা বিষ দিয়ে মেরে ফেলল গিরিমশায়ের ছেলে সতীশ।

শ্রীপতি জিজ্ঞেস করে, স্বামী কোথায়?

আঁজ্ঞা বাবু, কেহ জানেনি, সোয়ামি তো উকে বিচে দিইছিলা অই ঠিকাদার পুলুশের নিকট, বড় দুঃখী, অভাগী।

তুই থাম তো, জিজ্ঞেস করছি তো ওকে। শ্রীপতি ধমকে ওঠে রামচন্দ্রকে।

সুভদ্রা মাথার কাপড় টানল। বড় বড় চোখদুটি বিস্তার করে তাকিয়ে দেখল রামচন্দ্রর মালিক শ্রীপতি মাইতিকে। এই মানুষটার কাছারিবাড়ি, এরই জমিজমা, হোটেল, এই মানুষটাই ছিল হারানো ঘোড়াটির মালিক, এই মানুষই নায়েব রামচন্দ্রর মালিক। সুভদ্রা মাথা নিচু করে গড় করল শ্রীপতি মাইতিকে। আগেও একবার মেঝেতে মাথা ঠেকিয়েছিল। এই দ্বিতীয়বারে গড় করে তাকে কথা বলতে হবে। কী বলবে সে? মাথা নামিয়ে নিম্নস্বরে বলল, কী কহিব বাবু, নায়েব সবু জানে।

শ্রীপতি জিজ্ঞেস করে, কী জানে?

আঁজ্ঞা গরমিন জমিন সবু লিয়ে লিবে ভীমাপুরের, কাছারিবাড়ি ধান কাটার পর উঠি যাবে।

ভানু মাথা গলায় কথার ভিতরে, কে বলেছে?

শুনা যাইছে। রামচন্দ্র জবাব দেয়।

ফের তুই কথা বলছিস! শ্রীপতি ধমকে ওঠে রামচন্দ্রকে।

নায়েব কুথায় যাবে? সুভদ্রা বিনবিনিয়ে বলে।

রামচন্দ্র অন্যদিকে ফিরে মাথা নামিয়ে নিল। শ্রীপতি বিড়বিড় করে, নিতে দেরি আছে, টাকা দিয়ে তো নেবে, নতুন আইনে টাকা না দিয়ে নিতে পারবে না, কিন্তু তোমার কী হে? আমার যাবে।

নায়েব কোথায় যাবে তা জেনে তোমার কী হবে? শ্রীপতি জিজ্ঞেস করে।

আঁজ্ঞা বাবু! রামচন্দ্র ঘুরে তাকায়, আঁজ্ঞা মু আপনার চাকর, আপুনি যা করিবা তাই হিবে, কথা উটা লয় বাবু, অন্য কথা রহিছে, উ কহিতে পারিবেনি।

শ্রীপতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। কথাটা কী? রামচন্দ্র এমন একটি মেয়েমানুষ নিয়ে এলো কেন আচমকা? এখন তো ধানকাটার সিজন। এ সময়ে রামচন্দ্রের আসার কথা নয়। কাছারি ছেড়ে চলে এলো? এ সময়ে যদি জমির ধান কেটে নিয়ে যায় দুষ্ট লোকে? শ্রীপতি ধমকে ওঠে, ফের তুই কথা বলছিস, এখন কাছারি ছেড়ে এলি কেন?

আঁজ্ঞা বাবু। ঘাড় ঝুলে পড়ে রামচন্দ্রর।

শ্রীপতি বলল, কালই ভোর ভোর ভীমাপুর রওনা হবি।

আঁজ্ঞা! রামচন্দ্র চোখ পিটপিট করতে থাকে।

পঞ্চম ঠাকুর বলে, কাল বরং থাকুক।

কেন? শ্রীপতি রাঙা চোখে ঠাকুরকে দেখে।

আঁজ্ঞা বাবু, কষ্ট করে এলো, একটা দিন থাকবেনি!

শ্রীপতি বলল, তুমি কাজে যাও দেখি।

ভানু অবাক হয়ে যাচ্ছিল। শ্রীপতি আচমকা রুক্ষ হয়ে উঠেছে কেন? তুলকালাম হয়ে গেছে নার্সদিদির ঘরে, সেই জন্য? মেজাজ তো খারাপই রয়েছে বাবুর। মা বউ কিছুক্ষণ আগে বাড়ি গেছে ঝগড়াঝাটি করে। রামচন্দ্রর কপালই খারাপ, এলো এমন দিনে যে বাবুর মেজাজই খারাপ। চাকরিটা না যায় ওর। তারপর বাবু যদি বলে, যা ভানু যা, ভীমাপুরের কাছারিবাড়িতে নায়েব হয়ে থাক গিয়ে, ভানু কি থাকবে? ইস! ভাবতেই লজ্জা হচ্ছে ভানুর। নায়েব রামচন্দ্র কেন এসেছে তা ঠিক ভানু জানে না। এসে তাকেই তো ধরে পড়েছে রামচন্দ্র, বাবুর অনুমতিটা চাই, সে আর সুভদ্রা বিয়ে করে কাছারিবাড়িতে থাকবে। তারপর কাছারিবাড়ি যদি উঠে যায়, বাবুর কাছে এসে পড়বে, বাবু যা হয় ব্যবস্থা করবে। বিয়ে না করে সুভদ্রাকে রাখতে পারছে না সে। আশপাশের লোক উঁকি মারছে, বেওয়ারিশ মেয়েমানুষ হয়ে গেছে কি না সুভদ্রা। সুভদ্রাকে বাঁচাতেই তাকে বিয়ে করতে হবে রামচন্দ্রকে। আর!

ভানু দেখেছে কী শক্ত সমর্থ পুরুষমানুষ এই রামচন্দ্র! কী স্বাস্থ্য! কী রোষ লোকটার! একা ওই কাছারিতে বসে অত জমি রক্ষা করছে। বাবু শ্রীপতি মাইতির কাছে তার ব্যক্তিত্ব মুছে গেলেও, ভীমাপুরের কাছারিবাড়িতে এই রামচন্দ্রই তো বাঘ। আশপাশের চাষাভুষোরা কেমন হীন, দীন হয়ে বসে থাকে কাছারির উঠোনে। এমন একটা জলজ্যান্ত পুরুষমানুষের একটা মেয়েমানুষ তো চাই নিশ্চয়। তার পক্ষিরাজ যেমন চৌদ্দবেড়িয়ার চরে গিয়ে গিরিমশায়ের ঘুড়ীটাকে খুঁজে পেয়েছিল! আচমকা বুকের রক্ত যেন চলকে ওঠে ভানুর। কেমনভাবে বসে আছে রামচন্দ্র? ঠিক যেন বাবুর পোষা ঘোড়া। সেই পক্ষিরাজ। সে তো তবু আশ্বিনে দড়ি ছিঁড়ত, পালাত ঘুড়ীটার জন্য, পালাত চৌদ্দবেড়িয়ার চরের জন্য, পালাত আর সব ঘোড়াদের সঙ্গে খেলার জন্য, রামচন্দ্র করে কী? পোষা মানুষই হয়ে থাকল।

বাবু শ্রীপতি বলল, তোরা বাইরে গিয়ে বস, ঠিক আছে কাল থেকে যা।

রামচন্দ্র যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সুভদ্রা আর সে উঠে ঘরের বাইরে যেতে ভানুকে পাশে বসতে বলল শ্রীপতি, জিজ্ঞেস করল, ঠাকুর কী করেছে?

কী করেছে মানে?

অনন্তর মেয়েটা কই?

আঁজ্ঞে, অনন্তকে জিজ্ঞেস করবেন বাবু।

অনন্ত আমাকে বলেছে। শ্রীপতি পকেট থেকে সিগারেট বের করে। ধরিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে দেয় ঘরের সিলিংয়ের দিকে। ধীরে ধীরে পাখাটা ঘুরছে। ক্লান্ত পাখির মতো ডানা কাঁপাচ্ছে যেন। শ্রীপতি বলল, তুমি তো বলোনি কিছু আমাকে।

কী বলব, আমি তখন তো ছিলাম না।

এসে তো জেনেছিলি ভানু বাবু, জানাসনি কেন?

ভানু চুপ করে থাকে। বাবুকে কেন জানাবে তা ভেবে পাচ্ছে না। আর বাবু তো দেরি হলেও জেনেছে এখন, বাবু কী করবে করুক। করার কী আছে, অনন্ত টাকা নিয়ে বসে আছে, কত টাকা নিয়েছে তা ভানু ভালোভাবে জানে না। ও বিষয়ে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করেনি এ পর্যন্ত। টাকা নিয়ে এখন মেয়েটাকে ফেরত আনবে কীভাবে, বা ঠাকুরকে অভিযুক্ত করবে কোন পথে?

শ্রীপতি বলে, সে তো জানতই না এত কিছু। ভানু যে ওদের সঙ্গে কলকাতা পর্যন্ত গেছে তাও জানত না। অনেক দিন অনন্তর মেয়েটাকে দেখেনি। মেয়েটা বেশ ছিমছাম, ভদ্রলোকের মেয়ের মতোই চালচলন, কথাবার্তা। কী সুন্দর বলেছিল ঘোড়া দেখেছে রং দেখেনি, বর্ণহীন ঘোড়া। তো আচমকা মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করে ওর বাবার কাছ থেকে জানতে পারল সব। বলতে বলতে অনন্ত প্ৰায় কেঁদে ফেলে আরকি। পঞ্চম ঠাকুরকে দোষ দিল। পঞ্চম ঠাকুর আসলে আড়কাঠি। এ কাজ তো ভয়ানক কাজ। ধনে প্রাণে মারা পড়বে শ্রীপতি অমন লোককে আশ্রয় দেয়ার জন্য। ভানু চুপচাপ শুনে যায়। শ্রীপতি তার কাছে মতামত চাইছে বটে, কিন্তু তা না দিলেই বা কী, সিদ্ধান্ত তো বাবুর নিজের। বাবু কি তার কথায় সিদ্ধান্ত নেবে, না বদলাবে?

শ্রীপতি বলল, ওদের তাড়াতে হবে।

ভানু বলল, আমাকে বলে কী হবে বাবু, হোটেল আপনার, বিজনেস আপনার, আপনার কর্মচারী সব।

শ্রীপতি বলে, রামচন্দ্র এ কাকে এনেছে সঙ্গে করে?

শুনলেন তো জমি ভিটে সব চলে গেছে গরমেন্টের হাতে, মিলিটারি নিয়ে নিল সব, নিয়ে নিল স্বামী সংসার সব।

সে তো শুনলাম, মেয়েটা রামচন্দ্রর সঙ্গে কেন?

তা কি বুঝায়ে বলতে হবে বাবু? ভানু হাসতে চেষ্টা করে।

আচমকা শ্রীপতি ক্ষেপে ওঠে, ওর এত বড় সাহস, ও জায়গা থেকে একটা মেয়েমানুষ নিয়ে এলো এখেনে, কেন এলো?

ওকে জিজ্ঞেস করুন।

তুমি জানো না ভানুবাবু? আঁজ্ঞে, কী বলব?

ওরা কি একসঙ্গে থাকে, রামচন্দ্র আর সুভদ্রা?

ভানু চুপ করে থাকে। তার মৌনতায় যা বোঝায় বুঝে নিক শ্ৰীপতি মাইতি। ভানু মনে মনে বিরক্ত হয়। মাইতিবাবু তার কাছে জানতে চাইছে কেন? মাইতিবাবু নিজে বুঝে নিক সব। কিন্তু মাইতিবাবু তো তাকেই দোষ দিতে আরম্ভ করল। ভানু এসে এই মেয়ে মানুষের খবরটা বলেনি, তার পোষ্য হলো রামচন্দ্র, পোষা ঘোড়া পালাতে পারে, রামচন্দ্রর সেই সাহস নেই। ওর শুধু শরীরখানা রয়েছে, মাথা তো নিরেট। নিজের কোনো মতামতই নেই। বাবু যা বলে দিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করে ভীমাপুরের কাছারিবাড়িতে বসে। সেই লোক কিনা আস্ত একটা মেয়েমানুষ সঙ্গে করে এতদূর এলো! তার চেয়ে বড় কথা মেয়েমানুষটা তার কাছারিবাড়িতে থাকে রামচন্দ্রর আশ্রয়ে। রামচন্দ্রর এই আচরণ তো শ্রীপতির কাছে ভয়ের। রামচন্দ্রর এত সাহস হলো কী করে? ভানু তার পয়সায় ভীমাপুর গেল, ঘুরে এলো, কিন্তু কোনো খবরই আনতে পারল না! ভানু কি দেখেনি এই মেয়েমানুষটাকে তখন?

ভানু বলল, দেখেছিলাম, কিন্তু কথাটা কি বলার মতন?

শ্রীপতি রেগে গেল, বলার মতন নয় কেন? ভানুর মাথাটিও কি ওই রামচন্দ্রর মতো নিরেট! কী আশ্চর্য! তার পোষা নায়েব কাছারিবাড়িতে একটা মেয়েমানুষ এনে তুলেছে সেটা কোনো খবর নয়? সেই খবরটা দেবে না ভানু? ভানুও কি ভীমাপুর, বালিমুণ্ডায় গিয়ে ফুর্তি মেরে এসেছিল? ভানু কেন খবরই দেয়নি তা সন্দেহজনক মনে হচ্ছে শ্রীপতির কাছে। ভানু তো কোনো খবরই দেয়নি, অনন্ত সারের মেয়েটা যে বিক্রি হয়ে গেছে সে খবরটা জেনেও চেপে ছিল ভানু। শ্রীপতি কি বিশ-পঁচিশ হাজার খরচ করতে পারত না। মেয়েটা বাইরে চলে গেল?

ভানু বিড়বিড় করে, আমি তো ওই দালালি করি না বাবু।

শ্রীপতি এবার গলার স্বর নিম্নখাদে নামিয়ে আনে, আহা, সে কথা বলছ কেন ভানুবাবু। খবরটা তো দেবে। তার হোটেলের পঞ্চম ঠাকুর এমন একটা কাজ করল। তার কর্মচারী গোপনে আড়কাঠি হয়ে গেছে, তা শ্রীপতি নিজে জানবে না? না জানলে কোন দিন ব্যবসা লাটে উঠবে তা কি জানে না ভানুবাবু?

ভানু চুপ করে থাকে। শেষের কথাগুলোয় যুক্তি আছে। তার বলা উচিত ছিল মাইতিবাবুকে। ভানু মাথা নামিয়ে থাকে। আর রামচন্দ্রর কথাটাও তার রিপোর্ট করা উচিত ছিল বোধহয়। কিন্তু কেন করবে? সে কি চুকলিবাজ? সে কি শ্রীপতি মাইতির খোঁচড়। তার কাজ কি খবর বয়ে আনা? কিন্তু তা যদি না হয়, তাহলে তার কাজ কী? ভানু ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকে মাইতিবাবুর দিকে। কী বলবে? কিছুই বলার নেই। সে তো শ্রীপতির কথামতো গৌরমোহন মদরঞ্জিওয়ালার বউটাকে পটাতে পারল না। শ্রীপতি মাইতির কোন কাজটা করেছে ভানু? ঘোড়াটি কি সে রাত্তিরে ছেড়ে দিয়েছিল? এখন শ্রীপতির যদি সেই সন্দেহ হয়, ভানু কি না বলতে পারবে? ভানুর মুখখানি অন্ধকার হয়ে গেছে। বুঝতে পারছে শ্রীপতি তার ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। আজ সমস্ত দিন, তারপর সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনা শ্রীপতির মানসিক শৃঙ্খলা ভেঙে দিয়েছে। ভানু টের পাচ্ছে সে তোপের মুখে পড়েছে। সে বুঝতে পারছে শ্রীপতি তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। কিন্তু কেন? ভানুর তো হাসি পাচ্ছে। পক্ষিরাজকে সে ছেড়ে দেবে, কেন দেবে? কী লাভ? আর অতদিনের পোষা প্রাণী, ছেড়ে দিলেই চলে যাবে, ফেরত আসবে না? পোষা প্রাণী কি পালায়, না পালিয়ে থাকে? মাইতিবাবু কি ধরতে পারছে না কেন পালিয়েছে? সে তো টের পেয়েছিল ধরিত্রী-গর্ভে বিস্ফোরণের কথা। মাইতিবাবু যদি নগেন গিরির সঙ্গে কথা বলতে বসত, তাহলে জানতে পারত সব।

শ্রীপতি ডাকে, চুপ করে আছিস যে ভানুবাবু?

ভানু বলে, যদি সন্দেহ করেন আর থাকা যায় না, আর ঘোড়াটা যখন নেই, আমি কী করে থাকি, শূন্যপৃষ্ঠ নিয়ে ফিরল সে, বিবিক্ত পৃষ্ঠং চ নিশাম্য বাজিন পুনর্গবাক্ষাণি পিধায় চুক্র শুঃ, তার শূন্যপৃষ্ঠ দেখে অন্তঃপুরবাসিনীরা গবাক্ষ রুদ্ধ করে কাঁদতে লাগল!

এসব কথা কেন বলো, এসবের মানে কী, ঘোড়াটার নাম ছিল পক্ষিরাজ, তুমি কন্থক করে দিলে।

আমি যতবার গেছি, ঘোড়াটাকে আনতে পারিনি, শূন্য হাতে ফেরা কি কম কষ্টের, কুমারকে না নিয়ে কন্থক ফিরেছিল, আমি কন্থককে না নিয়ে …।

ভানুবাবু, আপনি কে বলুন দেখি, আমি তো এসব বুঝিনে কিছুই।

বিষণ্ণ ভানু বেরিয়ে আসতে আসতে শুনল শ্রীপতি ডাকছে ঠাকুর-ঠাকুরানিকে।

ভানু বাইরে এসে দুজনকে ডাকতেই দেখল ঠাকুরের মুখখানি ফ্যাকাসে। তার চেয়ে বেশি ফ্যাকাসে ঠাকুরানি। সুভদ্রা বসে আছে কিচেনের বেঞ্চিতে। তার মুখখানি নত, হাতে এককাপ চা। ঠাকুরানি জেরা করছিল বোধহয়। ভানু জিজ্ঞেস করে, কী বললে ওদের?

কুছু না, কী হিবে ভানুদাদা?

ভানু কিচেন থেকে বেরিয়ে দেখল বালিয়াড়িতে উবু হয়ে বসে রামচন্দ্র বিড়ি টানছে অন্ধকারে। ঠিক অন্ধকার নেই, হোটেলের জানালা থেকে এক স্তবক আলো গিয়ে পড়েছে বালিয়াড়ির ওপর, আর সেই আলোর বিভায় অন্ধকার অনেকটা হালকা হয়ে গেছে। ঘোড়াটি ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকত, বালিয়াড়িকে পিছনে রেখে সমস্ত রাত। ভানু উঠে এলো আবার বারান্দায়। কিন্তু ঠাকুর-ঠাকুরানির সঙ্গে কী কথা হচ্ছে মাইতিবাবুর তা কি গোপনে শোনা উচিত? আড়াল করতেই তো মাইতিবাবু ঘর থেকে সরিয়ে দিয়েছে তাকে।

ভানু নেমে এলো আবার। কিচেনে ঠিক সেইভাবে বসে আছে সুভদ্রা। ভানু গিয়ে তার মুখোমুখি বসে, বিয়ে করেছ তোমরা?

মোর তো আগের বিয়ার সিঁদুর রহিছে ভানুদাদা।

ঠাকুরানি কী বলছিল?

ভয় দিখাইছিলা কহিছিল চলি যাই যেনে।

ভানু এবার গলা শুনতে পায় ঠাকুরের, দুজনে বেরিয়ে এসেছে বারান্দায়। ঠাকুর তাকে ডাকল, ও ভানুবাবু, বাবুর কী হইছে?

কী হয়েছে তুমি জানো না?

যদি দোষ হুঁই থাকে মোর হইছে, শালো অনন্ত তার মেয়্যাটিকে জাহাজওয়ালার ঘরে কাজ করতি পাঠাল, মু হঁই গিলা আড়কাঠি, আর তার জন্য ঠাকুরানির কাম যাবে, ই কেমন হিলা?

ভানু অবাক, সেকি, ঠাকুরানি কী দোষ করল?

কী বলি কহ দেখি। বিড়বিড় করে ঠাকুর।

ভানু দেখে ঠাকুরানি চোখ মুছছে আঁচলে। ভানু বুঝতে পারছে না কেমন হলো ব্যাপারটা। ঠাকুরানির তো কোনো ভূমিকাই নেই, তার কাজ গেল আর ঠাকুর বহাল থাকল? মাইতিবাবুর কি মাথা খারাপ?

তখন শ্রীপতি মাইতি বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, গম্ভীর গলায় ডাক দেয় রামচন্দ্রকে, অ্যাই রামা, শুনি যা হারামজাদা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *