1 of 2

অশ্বচরিত – ৩৯

ঊনচল্লিশ

বেঙা ফেরেনি। সশরীরে ফেরেনি, লাশ হয়েও ফেরেনি। চার দিনেও না। না মানে বেঙার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। কিন্তু এই সম্ভাবনা খুব ঝুঁকির। বেঙা যদি না ফেরে, তখন? তখন তো বেঙার মৃত্যুর একটি সম্ভাবনাও তৈরি হয়ে যায়। বেঙা মরেছে হয়তো, কিন্তু তার লাশ ফেরত দেয়নি সমুদ্র। এমন তো হতে পারে। অথচ সমুদ্র যা নেয় তা তো ফেরত দেয়ই, তাহলে বেঙাকে কেন ফেরত দেবে না? দিয়েছে হয়তো, কোনো দূর সমুদ্রতীরে। সমুদ্র তো কম বড় নয়। সমুদ্র যে কত বড় তার কোনো আন্দাজই নেই জেলেপাড়ার কোনো মানুষের। তারা সমুদ্রের গভীরে গিয়ে, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েও সমুদ্রের কোনো পরিমাপ করতে পারে না। সমুদ্রের অকূল বিস্তার তাদের কাছে অসীম, অনন্ত, মাথার ওপরের আকাশের মতো। তার চেয়েও বেশি। এমন সমুদ্রের ভিতরে কত কত দ্বীপ, দীর্ঘ উপকূল জুড়ে কত বসতি! কোথায় গিয়ে বেঙার লাশ আটকেছে তারই বা ঠিক কী। সুতরাং লাশ না ফেরা, লাশ না উদ্ধার মানে বেঙার মৃত্যু যে নয়, তা নয়। আবার তা যে বেঙার মৃত্যুর ইঙ্গিত, তাও তো নয়। ছটা নিখোঁজ মানুষের পাঁচটা লাশ পাওয়া গেলে, ষষ্ঠ দেহটি নিয়ে নানা রহস্য তৈরি হয়। সে জীবিত অথবা মৃত তা জানা যায় না। কেউ তাকে জীবিত কল্পনা করে, কেউ মৃত। আবার নিখোঁজ যদি হয়ে থাকে ধীবর, তবে তাকে নিয়ে নানা কল্পনা বাসা বাঁধে।

বেঙার বউ পরীর কখনো মনে হচ্ছে লোকটা বেঁচে নেই। সমুদ্রে লঞ্চডুবির পর যে কজন বেঁচে ছিল, দুজন না তিনজন তারা ফিরে এসেছে। যারা ফেরেনি তারা মরেছে। মরাটাই স্বাভাবিক, তাই বেঙা মরেছেই, বাঁচেনি। কিন্তু মরলে তো বেঙার বডি পাওয়া যেত, যে বডি—লাশ দিয়ে প্রমাণ হতো যে সে মরেছে এবং তার জন্য দুর্ঘটনা বীমার যাবতীয় পাওনা পরীর হাতে এসে পড়ত। দুর্ঘটনা বীমা আছে, বিডিও অফিসের অনুদান আছে, সেসব পাওয়া যেত লাশ দেখিয়ে। বেঙা মরে যদি না ফেরে তবে পরীর কপাল আরও ভাঙবে। সে কী দিয়ে প্রমাণ করে তার স্বামী বেঁচে নেই? সে মৃত বেঙা ধীবরের স্ত্রী, দুর্ঘটনা—লঞ্চডুবিতে মরেছে বেঙা, বীমার টাকাটা তার হাতে আসুক—এই সব কথা সে দরখাস্তে বর্ণনা করাবে কী করে মুহুরিকে দিয়ে, তারপর কীভাবে সেই দরখাস্তে টিপ ছাপ দেবে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে? তখন তো তাকে নিজের কাছেই জিজ্ঞেস করতে হবে বেঙা যদি ফিরে আসে নদীরামের মতো? নদীরাম ধীবর পাঁচ বছর বাদে ফিরেছিল। আশ্চর্য! নদীরামের বউ এই পাঁচ বছর প্রতিটি দিন সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছে, শাঁখাতে সিঁদুর ছুঁইয়েছে, বিডিও পঞ্চায়েত যায়নি দুর্ঘটনা—মৃত্যু বীমার টাকার জন্য। কোনো দরখাস্ত করেনি। সে যেন খুব ভালো করেই জানত নদীরাম ফিরবে। নদীরাম যে দূর সমুদ্রের পারে চট্টগ্রামে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গিয়ে বাংলাদেশের জেলখানায় আটক ছিল অনেকজন এ দেশি ধীবরের সঙ্গে তা যেন টের পেয়েছিল নদীরামের বউ। সে বলেছিল সে নাকি স্বপ্নের ভিতরে জেনেছিল নিখোঁজ স্বামী বেঁচে আছে। নদীরামের নিখোঁজ হয়ে পাঁচ বছর পরে ফিরে আসা এবং এই পাঁচ বছরে তার বউ, সরলার শাঁখা সিঁদুরে সধবা হয়ে থাকা—সব কেমন গল্পের মতো হয়ে গেছে জেলেপাড়ার মানুষের কাছে। সে কাহিনি কে না জানে, পরীও জানে। নদীরাম এখন বেঁচে নেই। বছর চারেক আগে বরফকল বন্ধ হয়ে গেল দুদিন বিদ্যুৎ না থাকায়, সেই গোনে ইলিশ পড়ল প্রচুর। সেই ইলিশ বরফ না পেয়ে চকচকে রুপোলি বরণ থেকে লালচে হয়ে শেষে পচতে আরম্ভ করল। পচন ধরা ইলিশ ঝাউবনে পুঁতে ফেলা হয়েছিল অনেক। আর সেই পচন থেকে জেলেপাড়ায় আন্ত্রিক রোগ ঢোকে গাধার পিঠে চেপে, রক্তমাখা ঠোঁট নিয়ে। মা শীতলা কত বাঁচাবে? নদীরাম আর তার বউ পরপর মরেছিল। নদীরামের ছেলে চাঁদভূষণ বেঁচে গিয়েছিল মরতে মরতে। এখন নদীরাম, সরলা বেঁচে থাকলে পরী আবার তাদের কথা শুনতে পেত। তারা বলতই বেঙা বেঁচে আছে। তারা, নদীরাম, সরলা বললে পরীর বিশ্বাস হতো। সে সরলার মতো স্বপ্ন দেখত বেঙাকে নিয়ে।

নদীরামের বউ নাকি পাহাড় ঘেরা সমুদ্রকে স্বপ্নে দেখেছিল। নদীরামের বউ স্বপ্নের ভিতরে তার স্বামীকে কখনো পাহাড়-সমুদ্রের গায়ে দেখত, সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে নড়তে দেখত, কখনো দেখত জেলখানায়। জেনেছিল, সব দেখেছিল নাকি সে, দেখেছিল বলেই বুক চেপে বসে ছিল স্বামীর জন্য। যতদিন নদীরাম না ফিরছে, সে বলেওনি কাউকে স্বপ্নের কথা। এমনকি তার ছেলে চাঁদভূষণও জানত না। চাঁদভূষণ অবশ্য তখন ছোট ছিল, বছর পাঁচের। সে জানত তার বাবা সমুদ্রেই গেছে, ফিরবে মস্ত এক মাছ ধরে সেই মাছের পিঠে চেপে বেঙার বউয়ের এই সব কথা জানা। সে স্বপ্নে দেখতে চাইছে বেঙাকে। বেঙা স্বপ্নের ভিতরে আসছে না। আসছে নানা অদ্ভুত দৃশ্য, যার সঙ্গে বেঙার অজ্ঞাতবাসের কোনো সম্পর্ক আছে বলে জানে না পরী।

পরী সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করছে খবরের জন্য। জেলেপাড়ার কেউ এসে খবর দেবে যে বেঙার বডি পাওয়া গেছে। শেষ রাতের জোয়ারে বডি ফিরে এসেছে। জল সরে যাওয়ার পর বোল্ডারে আটকে রয়েছে আগের পাঁচজনের মতো। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করে পরী অন্ধকারে নিজে বেরোচ্ছে ঘর থেকে। তার হাতে একটা ছয় সেলের টর্চ। টর্চটি সায়েবকে দিয়ে কেনানো হয়েছিল। বিকেলের জোয়ার কেটে যাবে সন্ধের পর, তখন যদি লাশ এসে যায়? সেই লাশকে খুঁজে না বের করতে পারলে পরের জোয়ার তাকে আবার ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অন্ধকারে। একবার এসে ফিরে গেলে বেঙার বডি আর ফিরবে না। আর না ফেরা মানে বেঙার মৃত্যু অপ্রমাণিত থাকা। বেঙার মৃত্যু অপ্রমাণিত থাকা মানে পরীর কপাল সত্যি অর্থে ভাঙা। কোনো টাকাই মিলবে না। নিরুদ্দিষ্ট মানুষকে কে ঘোষণা করবে মৃত? উদাহরণ তো সামনে রয়েছেই, নদীরাম পাঁচ বছর বাদে ফিরেছিল।

বেঙার জন্য পরী বসে আছে সমুদ্রসৈকতের গায়ে, ঝাউবনের সীমানায়। জোয়ার সরছে। আর একটু বাদে সে নেমে যাবে অন্ধকার সৈকতে। খুঁজতে থাকবে বেঙাকে। বেঙার লাশ না ফিরলে বৈধব্য নেয়ার কোনো উপায় নেই পরীর। বৈধব্য নিয়ে মলিন মুখে বিডিও পঞ্চায়েতে দাঁড়ালেই নানা রকম টাকা জুটবে। এখন অনিশ্চিত অবস্থায় কোনো কিছুই করার উপায় নেই পরীর। রোখ ছেড়ে কাঁদতেও পারছে না। বেঙা যদি বেঁচে থাকে, তবে সেই কান্না তার অমঙ্গল করবে, অথচ বুক ফাটিয়ে যদি না কাঁদে সে তবে কীভাবে প্রমাণ হবে সে স্বামীহারা হয়েছে। বেঙার বডি যদি ফেরে, সে কাঁদতে কাঁদতে মাথা ফাটিয়ে ফেলবে। বেঙার লাশ ফিরলে সে এই সমুদ্রসৈকতে অনেক লোকের সমুখে শাঁখা ভাঙত, বালিতে ঘষে ঘষে পায়ের আলতা তুলত, কপালে বালি ঘষে ঘষে সিঁদুর তুলে কপাল রক্তাক্ত করে ফেলত। বেঙা হয় ফিরুক সশরীরে, নতুবা তার লাশ ফিরুক। নিরুদ্দিষ্ট জেলের বউ হয়ে থাকতে পারবে না পরী। পেটে খাবে কী? একটা সায়েব জুটেছিল বলে আর একটা জুটবে এমন কোনো কথা নেই। আর একটা জুটলেও তাকে নিয়ে থাকতে পারবে না পরী। কাউকে নিয়েই থাকতে পারবে না সে। সেটা অন্যায্য হবে। জেলেপাড়ার লোক তাকে পাড়া ছাড়া করবে। কিছু না থাক বেঙার ভিটেখানি তো আছে। আর সম্ভাবনা আছে অনেক টাকা পাওয়ার। সেই টাকা পেতে হলে পঞ্চায়েত দিয়ে প্রমাণ করাতে হবে, ঘোষণা করতে হবে বেঙা মরে গেছে, বেঙা বেঁচে নেই। পরী অন্য কারও রাখনি হয়ে গেলে ওই টাকা পাওয়ার সম্ভাবনাই থাকবে না। বেঙা থাকতে সায়েব ছিল, কেন ছিল? না তাকে রেখেছিল বেঙা, তাই ছিল। বেঙা না থাকলে পরীর সঙ্গে কেউ থাকতে পারবে না। সায়েব যদি ফিরে আসে জেলেপাড়ার লোক তাকে মেরে তাড়াবে। পরীর দুচোখ দিয়ে হু হু করে জল নেমে এলো। বেঙা তাকে কম ভালোবাসত না। বেঙা তাকে কম বিশ্বাস করত না, মরে গেলেও বেঙার অনুপস্থিতিতে পরী আর কারও দিকে মুখ তুলে চাইতে পারবে না। সে তাহলে মহাপাতকী হবে, নরকেও তার স্থান হবে না।

বেঙার না ফেরা মানে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে থাকার সম্ভাবনা যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনি বেঙার মৃত্যু সম্ভাবনাও ক্রমশ বাড়ছে। বেঙার না ফেরা মানে সে নদীরামের মতো অন্য কোনো দেশে চলে গেছে যে এমন কোনো কথা নেই। জেলেপাড়ার মধ্যে একমাত্র নদীরামই ভাসতে ভাসতে গিয়ে উঠেছিল বাংলাদেশি ট্রলারে। তারা তাকে নিয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রামে। সে কোন দিকে, কত দূরে তা জানে না পরী। নদীরামের ভাগ্য যে বেঙার হবে সে কথা কে বলবে জোর দিয়ে? বেঙার লাশ এখানে ফেরেনি, অন্য কোথাও, সমুদ্রের অচেনা কোনো তীরে তো ফিরতে পারে। ওড়িশার উপকূলে ফিরতে পারে। তালসারি, চাঁদবালি, চাঁদিপুরের দিকে ফিরতে পারে, জুনপুট, খেজুরির দিকে ফিরতে পারে। আবার না ফিরতেও পারে। সমুদ্রের মাছেরা, হাঙরেরা হয়তো সবটাই খেয়ে নিয়েছে তার। ভাবতেই পরীর বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। রোখ ছেড়ে, চিৎকার করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তাতে যদি জীবিত বেঙা ধীবরের অমঙ্গল হয়? মৃত স্বামীর জন্য শোক যদি জীবিত স্বামীর ক্ষতি করে? বেঙা একসঙ্গে জীবিত ও মৃত হয়ে আছে। যে লোকের মৃত্যুর জন্য শোক করবে তার বউ, সেই লোক জীবিতও তো রয়েছে। পরীর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ভাবতে ভাবতে।

এমন হতে পারে বেঙার লাশ ওড়িশার কোনো জায়গায় গিয়ে আটকেছে। সেখানকার লোক পচা লাশের গন্ধ সহ্য না করতে পেরে আবার জলে ঠেলে দিতে পারে। আবার পুলিশকে খবরও দিতে পারে। পুলিশ বেওয়ারিশ লাশের দায়িত্ব নিতে চায় না। এখানেও তো দেখেছে পরী তা। লাশ তুললে পুলিশের আঠারো সমস্যা। পুলিশই তখন জোয়ারের অপেক্ষায় থাকে। লাশ পাহারা দেয় কুকুরের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। মাছ খেয়ে খেয়ে এজায়গার কুকুরগুলো রীতিমতো মাংসাশী, আমিষলোভী। জোয়ারে লাশ ঠেলে দেয়ার পর পুলিশ নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে যায়। বেঙার ভাগ্য এমন হতে পারে। ঘাটে ঘাটে তার লাশ হয়তো ঘুরছে।

আর বেঁচে থেকে নদীরামের মতো অন্য দেশে না গিয়েও বেঙা না ফিরতে পারে হয়তো। নদীরাম ফিরেছিল। নদীরামের বউ ছিল, ছেলে চাঁদভূষণ ছিল, ভিটে ছাড়াও বিঘেটাক জমি ছিল, সেই জমিতে তরমুজ হতো। জমি, ভিটে, সংসারের টানে পাঁচ বছর বাদেও ছাড়া পেয়ে ফিরেছিল নদীরাম, কিন্তু বেঙা কীসের মায়ায় ফিরবে? বেঙা তো জানে ঘরে সায়েব আছে। সায়েব তার বউয়ের সঙ্গে লীলা করে, যেমন লীলা ছিল কৃষ্ণ-রাধিকায়। ভগবান আর মানুষের লীলা কি এক হতে পারে? বেঙা তার মনকে প্রবোধ দিত, কিন্তু ভিতরে ভিতরে কষ্ট পায়নি কে বলবে? বেঙা যে কোনো গোপন মুহূর্তে তাদের দেখে ফেলেনি তাই বা কে জানে? সায়েব টাকা দিয়ে বশ করেছিল তাদের। অভাবী সংসারে কুগ্রহের মতো এসে ঢুকেছিল। সায়েব নিজেই গেছে না বেঁচেছে পরী। এখন বেঙা ফিরলে তারা মন দিয়ে সংসার করবে। পেটে না খেয়েও সংসার করবে। আর বেঙা যদি না ফেরে, তার লাশ ফিরলে যে টাকা পাবে। পরী তা নিয়ে পুরী চলে যাবে। জগন্নাথদেবের মন্দিরে পড়ে থাকবে সমস্ত জীবন।

বেঙা না ফিরলে বেঙার মৃত্যু একশ ভাগ সত্যি হবে না। তার বেঁচে থাকাও একশ ভাগ নিশ্চিত হবে না। বেঙা যদি বেঁচে থাকে, বেঁচে থেকে ভাসতে ভাসতে চাটগাঁ না গিয়ে সায়েবের দেশেও তো চলে যেতে পারে। সব সমুদ্রের সঙ্গে সব সমুদ্রের তো যোগ আছে। বেঙা তো বলত পরের জন্মে সায়েব হবে। ধলা রং হবে গায়ের, সোনালি চুল হবে তার, চোখের মণি নীল হবে, আর সেই সঙ্গে অনেক টাকা হবে। ইচ্ছে হলেই সে হরেকৃষ্ণ হরেরাম গেয়ে নাচবে, না ইচ্ছে হলে মেয়েমানুষ নিয়ে শুয়ে থাকবে। বেঙা নেশার ঘোরে এই সব বলত। তারও একটা রাধিকা হবে। ‘রাধিকা’! হায়! ‘রাধিকা’ এখন সমুদ্রের ধারে বসে কাঁদছে নিঃশব্দে। কদিন ধরে নিঃশব্দেই কাঁদছে পরী। এমনভাবে কাঁদছে যে কেউ টেরই পাচ্ছে না কাঁদছে সে। লঞ্চডুবির পরদিন সকালে যত বউ মেয়ে ছিল তাকে ঘিরে, তারা এখন কেউ নেই। তার শোকের অংশীদারি কতদিন নেবে প্রতিবেশীরা? তাও যদি নিরুদ্দিষ্টের জন্য সে গলা তুলে কাঁদত তার মঙ্গলামঙ্গলের কথা না ভেবে, তখন প্রতিবেশীরা তার পাশে এসে কান্না থামাতে চাইত। কান্না থামাতে এসে তার সহমর্মী হয়ে তারাও চোখ মুছত। জেলেপাড়ার মেয়েমানুষ, যাদের স্বামীরা লঞ্চডুবিতে নিখোঁজ হয়, মরে যায়, তারা কান্না চাপে না। নদীরামের বউ চুপ করে ছিল। আর এই পরী। নদীরামের বউ তো গোপনে স্বপ্ন দেখে সব সত্য জেনে গিয়েছিল, পরী কি তা জেনেছে? যদি জেনে থাকে তবে সে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে আছে কেন? সে কেন অন্ধকারে টর্চ হাতে সমুদ্র-সৈকত ধরে হাঁটে বেঙার লাশ ফিরে পাওয়ার জন্য? নদীরামের বউ কী করত তা কারও মনে নেই। তবে কিনা সেও তো কাঁদত, কাঁদত না কি? হ্যাঁ কাঁদত। পরে বলেছিল উদ্বেগে কাঁদত। জেলখানা থেকে কবে বেরোতে পারবে তার স্বামী সেই দূরদেশে, তা ভেবে কাঁদত। পরী তেমন কান্না কাঁদছে না। এভাবে কাঁদে না। যার স্বমী হারিয়েছে সে বুক চাপড়ে কাঁদুক। জেলেপাড়ার পথ চলতি লোক, ঘরে বসা লোক যে যার জায়গা থেকে সেই কান্না শুনুক। ঠিক দুপুরে চিলের মতো কেঁদে কেঁদে নিঃস্ব হোক বেঙার বউ। লোকে তাদের কথা থামিয়ে শুনুক তার কান্না, বিলাপ। সেই বিলাপে পরী নিজের পাপগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিক। তার আর সায়েবের পাপে যে বেঙা হারিয়ে গেল সমুদ্রের ভিতরে তা বলুক। জেলেপাড়ার লোকের যদি মাঝ রাতে স্বামী হারানো বউয়ের বিলাপ শুনে ঘুম না ভাঙে তাহলে পরীর শোকের মাত্রা টের পাবে কী করে তারা? পরীর কান্নার সঙ্গে মধ্যরাতের সমুদ্রের কান্না মিশে গেলে না শোক ছড়িয়ে যাবে ঝাউবনে, বাতাসে, বালিতে |

পরী এখন অন্ধকার সৈকত ধরে টর্চ জ্বালাতে জ্বালাতে চলেছে পুব দিকে। টর্টের আলো বোল্ডারের খাঁজগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে। চাপা গলায় ডাকছে পরী, এলে নাকি, ওগো তুমি এলে, আসো যদি কহি দাও।

পরী ভাবছে মৃতদেহটি তাকে ডাকবে। না ডাকলে অন্ধকারে সে না খুঁজেও পেতে পারে। পরী জানে আজকালের ভিতরে দেহটি ফিরে না এলে আর আসবে না। এখনই আসার সম্ভাবনা কমে গেছে অনেক। চার দিন ধরে মাছেরা কি খেয়ে ফেলেনি বেঙা ধীবরের দেহখানি? হাঙরে যদি টের পায়, কত সময় লাগবে খেয়ে ফেলতে? পরী কাঁদতে লাগল। পরী কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতে লাগল, যদি বেঙার দেহ হাঙরেরা সব খেয়ে নেয়, স্বামীহারা হয়েও স্বামীর অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে তাকে। বিধবা হয়ে সধবার মতো পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। যদি লোকটা নদীরামের মতো ফেরে? সমুদ্রে গেল, কিন্তু পথে পথে ফিরল। যে লোক সমুদ্রে নিখোঁজ হয়, সে আবার সমুদ্র পথেই ফেরে না। কবছর আগে লঞ্চডুবির জেলেরা উঠেছিল সাগরদ্বীপে। তারপর ফিরেছিল পথে পথে। বেঙা সেভাবে ফিরতে পারে ভেবে অভুক্ত থাকতে হবে পরীকে। কিন্তু বেঙা ফিরছে না। দুবছর,

পাঁচ বছর কেন, দশ বছর বারো বছরেও ফিরবে না। বারো বছর কাটালে তবে না প্রমাণ হবে বেঙা মরেছে। তার শ্রাদ্ধ হবে তখন, পরী বিধবা হবে তখন। কিন্তু বেঙার পাওনাগণ্ডা তখন আর মিলবে না। কে হিসেব করে দেখবে তখন? লোকে তো ভুলেই যাবে লঞ্চডুবির কথা। বেঙা ধীবরের কথা। এই বারো বছরে আরও কত লঞ্চডুবি হবে, কতজন নিরুদ্দেশ যাবে তার ঠিক নেই। সেই হিসেবে বেঙার হিসেব মিশে যাবে। পার্টি, পঞ্চায়েত কিছুতেই বেঙারে মৃত ঘোষণা করবে না তার লাশ না পেলে। তাদের সামনে নদীরাম ধীবর যে রয়েছে। না থেকেও রয়েছে। সে যদি পাঁচ বছর বাদে ফিরতে পারে, বেঙাও পারবে। হায়! পরী কাঁদতে কাঁদতে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। তার আঁচল লুটোচ্ছে ভিজে বালিতে, খোলা চুল অন্ধকারে উড়ছে নরম হয়ে আসা সমুদ্র বাতাসে। বাতাস এখন একটু একটু একটু করে ফিরে যেতে আরম্ভ করেছে। দখিন থেকে যে বাতাসের স্রোত আসে তা প্রায় মিলিয়ে যাওয়ার মুখে! পরী পুব দিকে মোহনার পথে হাঁটছে। ওদিকে রামনগরের খাল এসে সমুদ্রে পড়েছে। ওই খাল দিয়েও বেঙার লাশ উত্তর দিকে চলে যেতে পারে জোয়ারের সময়, তারপর চড়ায় পড়ে থাকবে কোনো এক নির্জন জায়গায়। আকাশের শকুন ছাড়া কারও নজরে পড়বে না। এরকম তো হয়েছিল। পরীরা দেখতে গিয়েছিল সেই অজ্ঞাত পরিচয় মৃতের দেহ। তারপর তা আবার খালের জলেই ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। তেমন যদি হয়ে থাকে? পরীকে এখন খালপাড় ধরে টর্চ জ্বেলে উত্তরে রামনগরের পথে হাঁটতে হবে। কিন্তু সে তো হবে এক অনির্দিষ্ট যাত্রা। সমুদ্রের বিপরীতে, স্থলভূমির দিকে।

ভানু দাস এসেছিল খোঁজ নিতে। খোঁজ নিতে আসার সময় সে দেখেছিল অন্ধকারে টর্চ জ্বালিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কেউ। সে যে বেঙার বউ তা জেলেপাড়ায় এসে শুনল ভানু। বেঙার লাশ খুঁজছে মেয়েমানুষটা। যদি মরে গিয়ে থাকে তো খুঁজতে হবেই। কিন্তু না মরে থাকলে? পরী কি ভালোভাবে জানে যে বেঙা মরেছে। বেঙা যদি না মরে থাকে তাহলে ও তো মরবে এবার পরীর খোঁজাখুঁজিতে।

বুড়ো কুঁড়োরাম অন্ধকারে পাঁচজনকে নিয়ে বসে ছিল, ভানুকে সে বলল, কালো জল অনেক সময় খেয়ে নেয়, খেয়েই নিয়েছে বেঙারে।

ভানু বলল, সেই মরুভূমির পাখির কিছু হলো?

ওটা পাহাড়ের পাখিও হতে পারে। বুড়ো বলল।

কেন?

আমি পাহাড় দেখি নাই, মরুভূমিও না, পাখিটা অচেনা ছিল বটে।

ভানু বলল, এখনও সেই কথা হচ্ছে?

হবে তো, বেঙারে সমুদ্দুরে নিল, ও ছিল চাষা, হলো ধীবর। বিড়বিড় করে কুঁড়োরাম, শুনো ভানুরাম, তুমার কথাটা কি ঠিক?

কী কথা?

মরুভূমির নিচে বোশাখী পুন্নিমায় বোমা ফাটল, তারপর ঘুড়াটা পলাল?

হ্যাঁ, তা তো সত্যি।

বেঙাও কি তাই পলাল?

ভানু বলল, কী জানি, আচমকা ঝড়বিষ্টি তো হয়েই যাচ্ছে, একটা লোক এসেছিল, দাঁতনে ঘর, এক দুপুরে ঝড় এসে সব উড়ায়ে নিয়ে গেল, আগুনের গোলার মতো ঝড়

হাঁ, শুনিছিলাম বটে সি কথা।

ভানু বলল, সুবর্ণরেখা নদী পর্যন্ত আকাশে উঠে গিয়েছিল।

কী সব্বোনাশ!

বেঙা যদি না ফেরে! ভানু বিড়বিড় করতে থাকে। আর তখন অন্ধকারে একজন গর্জন করে ওঠে, তুমি কী বলতে এলে কহ দেখি ভানুবাবু?

ভানু বলে, পৃথিবীর কোথায় যে কী করছে মানুষ, কিছুই ধরা যাচ্ছে না, কীর’ম রোদ হচ্ছে বলো, কী তাপ, এসবের সঙ্গে বেঙার মরণের যোগ থাকতে পারে, নাও পারে, তবে কিনা মরণটা বড় বেদনার, তাকে আমরা চিনতাম কিনা।

হাঁ, হাঁ! অন্ধকারে বেদনা করে পড়তে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *