চৌত্রিশ
কী নির্জন, নিঝুম জায়গা। প্রাচীরটা জেলখানার মতো উঁচু। সাদা প্রাচীরের গায়ে মস্ত লোহার ফটক। দেয়ালে লেখা মদনানি হাউস। ভানু নম্বরটাও মিলিয়ে নেয় ট্যাক্সিতে বসে।
এখানে কোনো মানুষ পায়ে হাঁটে বলে মনে হয় না। প্রাচীরের গা ঘেঁষে, ভিতরে পরপর গাছের সারি। গাছের কুচি কুচি হলুদ পাতা ভিতরে না ঝরে বাইরের সরু ফুটপাতে ঝরে পড়েছে। অচেনা এক ফুলের পাপড়িও পড়ে আছে বাইরে। ভানু দেখছিল সেসব। হলুদ, লাল রং শুকিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে, তাদের ওপর কোনো মানুষের পা পড়েনি বাইরে। যে ফুল শুকিয়ে মরেছে ভিতরে, বাইরে তার সম্পর্কে কার আর কৌতূহল!
ট্যাক্সি চলে গেছে। তিনজন লোহার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। কুন্তির মা গেট দেখে ভয়ে কুঁকড়ে স্বামীর পিছনে তার জামার কোণ ধরে দাঁড়িয়েছে। ভানু বন্ধ গেটের ওপারে বন্দুক কাঁধে নেপালি দারোয়ানকে দেখে ডাকল, বাহাদুর ভাই, সায়েব কাঁহা, মদনানি সায়েব জাহাজওয়ালা?
কেয়া? ভ্রু কুঁচকে আবার শুনতে চায় বাহাদুর।
ভানু ফের বলতে বাহাদুর হেঁকে উঠল, ভাগো হিয়াসে।
কিঁউ, ভাগেগা কিঁউ?
সায়েব কা হুকুম।
মেরা লেড়কি হায়, সায়েব তাকে নিয়ে এসেছে দীঘা থেকে, এই তো মেয়ের মা-বাপ।
হুকুম নেহি, ভাগো।
ভানু বুঝতে পারে দারোয়ান খুব ঢেঁটিয়া। সহজে গেট খুলবে না। না খুললে কুন্তির সন্ধান করবে কীভাবে? দারোয়ান ভাবলেশহীন মুখে আবার বন্দুক কাঁধে দাঁড়িয়ে গেছে নিজের জায়গায়। ভানু দুহাতে লোহার ফটকের শিক ধরে ভিতরে তাকায়। ফটক থেকে গেরুয়া মোরাম রাস্তা অনেক দূর হাঁসের মতো সাদা বাংলোটির সামনে গিয়ে থেমেছে। দুপাশে বাগান, বাগানে ফুল আর গাছ। বাংলোটি দোতলা। কিছু ধরা যাচ্ছিল না দূর থেকে। কুন্তির মা আর বাবা বসে পড়েছে ফুটপাতের কোণে। তারা আকুল হয়ে তাকিয়ে আছে ভানুর দিকে।
ভানু আবার ডাকল, সায়েব কো বোলাও।
হুকুম নেহি।
ধ্যাত্তেরি নিকুচি করেছে হুকুমের, আমাদের মেয়ে নিয়ে এসেছে দীঘা থেকে, ও ভাই বাহাদুর, দরোয়াজা খুলো।
বাহাদুর বলল, হুকুম নেহি, হট যাও, গোলি মার দেগা।
মার না গুলি। ভানু ক্ষেপে ওঠে, মার গুলি, আমার পক্ষিরাজটারে…। ভানু সামলায় নিজেকে, মেয়েটারে নিয়ে এলো জাহাজওয়ালা, মার বেটা গুলি।
বাহুদুর এবার বিব্রত বোধ করে। ভানু লোহার ফটকে করাঘাত করতে থাকে। কুন্তির মা-বাপ একসঙ্গে কেঁদে ওঠে, মেয়্যাটারে ঘুরাই দাও গো বুড়াবাবু জাহাজওয়ালা।
একসঙ্গে দুজনের কান্না শুরু হতেই আলিপুরের এই নির্জন পথ যেন সরব হয়ে ওঠে। রাস্তা দিয়ে হুসহাস করে যে লাল, হলুদ পাখির মতো গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছিল অনির্দেশ্য গন্তব্যে, তাদের গতি মন্থর হয়ে আসছিল। ভানু বলে ওঠে, আরও জোরে কাঁদ কুন্তির মা, মেয়ে আছে ভিতরে।
দারোয়ান ঢুকে গেছে তার ঘরে। ভানু তার ঘাড় লম্বা করে দেখতে চেষ্টা করছিল দারোয়ানের ঘরটিকে। কুন্তির মা জোরে কাঁদতে পারছে না। কান্নার সাহসই হারিয়ে ফেলেছে বোধহয়। হকচকিত হয়ে লোহার ফটকের ওপারের পৃথিবী দেখছে, বিনবিন করে কাঁদতে কাঁদতে, ঘাড় ছোট করে ভিতরে চোখ মেলে দিচ্ছে। মদনানি হাউসের ভিতরটা তার পরিচিত জগৎ থেকে আলাদা। এত শান্ত, নিস্তব্ধ যে কাঁদতে ভয় পাচ্ছে কুন্তির মা। অনন্ত উঠে দাঁড়িয়েছে। দেখছে ভিতরের গাছগাছালি, বাগান, সবুজ পাতা, দুধ সাদা বাংলোটিকে। বাংলোর গায়ে রোদ থইথই করছে। অনন্তর মনে হলো জাহাজ। একেবারে জাহাজের মতো বাড়িটা। দারোয়ান ফিরে এলো ঘর থেকে, জিজ্ঞেস করল, কতজন রয়েছে?
তিনজন, মেয়ের মা-বাপ আর ঘোড়াওয়ালা।
ঘোড়াওয়ালা! দারোয়ান বিস্মিত হলো।
হাঁ, ঘোড়া চোট হয়ে গেছে, এটা তো মদনানি সায়েবের বাড়ি?
হাঁ, সায়েব বলছে গোল করবে না, ফোনে কথা বলা হলো।
সায়েব আছে?
আছে, হল্লা করবে না, চুপচাপ ঢুকে যাবে। বলতে বলতে দারোয়ান আবার চলে যায় তার ঘরে। চাবি আনতে গেল বোধহয়। কুন্তির মা উঠে দাঁড়িয়েছে। তিনজনে এখন লোহার ফটক ধরে দাঁড়িয়ে। দারোয়ান এলো। এলো কিন্তু ফটকটি খুলল না। ফটকের গায়ের ছোট দরজাটি খুলে ডাকল ওদের। ভানু আর দুজনকে নিয়ে নিচু হয়ে ভিতরে ঢুকল। ঢুকতে গিয়ে ভানুর পিঠে ঠোকা লাগে। ভানু ভিতরে দাঁড়িয়ে দারোয়ানকে বলল, বাবু যে মেয়েটারে এনেছে, তার মা-বাপ
দারোয়ান নির্বিকার। ফটকে তালা দিয়ে ওদের আগে আগে হাঁটে। ভানুরা দারোয়ানকে অনুসরণ করে। দারোয়ান একটু এগিয়ে দাঁড়ায়, একদম চুপচাপ থাকবে, সায়েবের মেজাজ ঠিক নেই, লেকিন তুমাদের লেড়কি বহুত পসন্দ হয়েছে, সমুন্দরের ধার থেকে আনল তো?
হাঁ, হাঁ। এতক্ষণে যেন নিশ্চিন্ত হলো কুন্তির মা। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না কুন্তি এখানে আছে। এই পৃথিবীর সঙ্গে তার কোনো পরিচয় নেই। চারধারে কত উঁচু পাঁচিল, কত গাছপালা, ওপাশে সাঁতারের পুকুর। সিনেমায় যেমন দেখেছে কুন্তির মা. ঠিক সেই রকম।
এই সময় নির্জনতা ভেঙে খুব গম্ভীর স্বর শোনা গেল একটি কুকুরের। একটি নয়, আরও গোটা দুয়েকের গর্জন শুনতে পায় তিনজন। ভয় জাগানো হিংস্র ডাক। তিনজনে পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। ভানুর গা ছমছম করে ওঠে, কোথায় এলো? কুকুরগুলোকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ডাক শুনে মনে হচ্ছে খুব কাছেই রয়েছে। গাছের আড়ালে আবডালে। দারোয়ান চাপা গলায় বলল, চুপচাপ থাকবে, সায়েব রেগে গেলে কুত্তা ছেড়ে দেয়।
ভানু নিজ্ঞেস করে, বাঁধা আছে তো?
হাঁ, লেকিন সায়েব যা বলবে তাই করবে, সমঝতা?
কুন্তির মা ঘাড় কাত করল। তার মুখখানি রক্তহীন, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। অনন্তর হাত ধরে আছে সে। অনন্তও ঘাবড়ে গেছে, বিড়বিড় করছে, এসব কুকুর খুব খারাপ হয়, বাঘের মতন, খুব রাগী |
দারোয়ান বলে, একটা চোর ঢুকেছিল রাত্তিরে পাঁচিল টপকে, তিনটে কুত্তা তাকে ছিঁড়ে খেয়েছিল।
মানুষ খায়? ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর কুন্তির মার।
দারোয়ান গম্ভীর স্বরে বলল, হাঁ হাঁ, মাংস খায়, বেলাড খায়, বেলাড মতলব খুন, চেটে চেটে খেয়েছিল, তারপর ওদের লোভ হয়ে গেছে খুব, তবে চেনা আদমিকে কুছু করে না।
আমরা তো অচেনা।
সাবধান থাকো, হল্লা করবে না।
বাঁধা আছে তো? এবার জিজ্ঞেস করল কুন্তির মা।
হাঁ, মোটা চেনে বাঁধা আছে, লেকিন, চেন ছিঁড়ে দেয়, কুত্তা তো বাঘ আছে, ডেইলি ছ’কেজি মটন খায় তিনটায় মিলে।
কুন্তির মা বলল, আমার মেয়েরে তো চেনে না।
একদিনেই চিনে গেছে, কুত্তা ঠিক ধরতে পারে সায়েব কিসকো প্যার করতা, সায়েব যাকে পসন্দ করবে, কুত্তাও পসন্দ করবে।
কুন্তির মা বলল, কী করব বাপ বাহাদুর, মেয়্যাটারে যে পেটে ধরেছিলাম, তাই আসতি হলো।
রোও মাত, তিন কুত্তা মিলে ঘিরে ধরে চোরটাকে, বাগানে তো ঐ রাতে চাঁদনি ছিল কুছু করতে পারল না চোরটা, পালাতে পারল না, তিনটা নাকড়া খেয়ে নিল।
নাকড়া! অনন্তর গলা ভয়ে বুজে যায়।
হাঁ, কুত্তা তিনটে নাকড়ার মতো।
রোদ ঝলসে যাচ্ছে গায়ের ওপর। কিন্তু তা টেরই পাচ্ছে না তিনজন। গা শিউরে উঠছিল কুকুরগুলোর ক্রমাগত গর্জনে। বাহাদুর বলছে ভয়ংকর কথা। তার সায়েব একবার একটা লেড়কি এনেছিল পাহাড় থেকে। পাহাড়িয়া লেড়কি। বহুত খুবসুরত। সে লেড়কি পালাতে গিয়েছিল। বহুত বেগড়বাই করেছিল। সায়েব তার মা-বাপকে বহুত দিয়ে তা খরিদ করেছিল। কিছুতেই যখন বশে আনতে পারল না সায়েব, তখন কুত্তার সামনে ছেড়ে দিল।
এ কী বলো! রোদের ভিতরে কুন্তির মা বসে পড়েছে।
আরে রোও মাত, এ লেড়কি বাবুর বহুত পসন্দ, লেড়কি বহুত আচ্ছি হায়। তিনজনে পা ঘষটে ঘষটে পোর্টিকোর নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানটায় খুব ছায়া। ঘন, শীতল। ছায়ায় এসে তারা বুঝল রোদটা কী কঠিন না ছিল! দারোয়ান বারান্দায় উঠে মস্ত দরজা ঠেলে ধরল, অন্দর মে ঘুসো।
কুত্তা? অনন্তর ভয় হয়ে গেছে।
বাগানে বাঁধা আছে।
ভিতরটা কেমন আলো-আঁধারি। তিনজনে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে চোখে সইয়ে নেয় অন্ধকারটা। বুঝল তেমন অন্ধকার নয়, চড়া রোদে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। মস্ত ঘরটিতে বড় বড় সোফা সেট। আর যে কী কী আছে তা তারা কেউ চেনে না। নরম কার্পেটের ওপর বসে পড়ে তিনজনে। বসে হাঁপাচ্ছিল সবাই।
আচমকা আলো জ্বলে ওঠে! ভানু অবাক হয়ে দেখল সেই লোকটা। তাদের দিকে তাকিয়ে আছে ওপাশের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে। ভানুর মাথা নেমে গেল। সহ্য করতে পারছিল না হিম-চাহনি।
রুপয়া মাংতা? গর্জন শুনল কুন্তির মা। তরাসে স্বামীকে আঁকড়ে ধরে। ভানু চমকে উঠেছিল। মনে হলো একটা কুকুর যেন মদনানি সায়েবের পিছনে। ভানু তার ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ভানু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কুঁকড়ে বসে আছে কুন্তির মা-বাবা।
কিতনা রুপয়া মাংতা?
না সায়েব, মেয়ের মা-বাপ এয়েচে।
মালুম আছে, পন্দেরো হাজার রুপয়া হামে দিয়া।
সায়েব, মেয়েটারে চায় ওরা।
ভ্রু কুঁচকে মদনানি সায়েব তাকিয়ে থাকে ভানুর চোখে। ভানু মাথা নামাতে পারে না। চোখের পলক ফেলে না। মনে হচ্ছিল চোখের পাতা ফেললেই নেকড়ের মতো একটা কুকুর দাঁত নখ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর।
অনন্ত সাহস সঞ্চয় করল, বলে, টঙ্কা দিয়ে দেব সায়েব?
কেয়া? সায়েব রেগে গেছে টের পায় ভানু।
কুন্তির মা বিনবিনিয়ে কাঁদছে, পেটে ধরা মেয়্যা, সায়েব গো!
রোও মাত, কিতনা রুপয়া চাহিয়ে?
ভানু বলে, মেয়ে চায় সায়েব, মেয়েরে নিয়ে যাবে।
তুম চুপ রহো। গর্জন করে ওঠে প্রেম মদনানি। গাঢ় নীল রঙের স্লিপিং গাউনের দড়িটাকে আলগা করে দেয় প্রৌঢ়। ভানু দেখল কালো শর্টস আর হলুদ টি-শার্ট। মুক্ত ঊরুতে চামড়া থলথল করছে। গায়ের সমস্ত চুল সাদা। স্লিপিং গাউনের পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালে বুড়ো, বলল, একদম চুপ, হল্লা করবে তো কুত্তা ছেড়ে দেব।
আমার মেয়্যা? কুন্তি ডাকল সায়েবকে, ও সায়েব।
লেড়কি আছে, ভালো আছে।
মেয়্যারে লিয়ে যাব সায়েব।
সায়েব চলে গেল আচমকা। ঘরটা নিঝুম। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের তাপমাত্রা যেন আরও কমে যায়। ভানুর শীত করতে থাকে। ভানু দেখল কুন্তির মা-বাবাও কুঁকড়ে গেছে ঠাণ্ডায়। অনেকটা চুপচাপ। তারপর! ভানু দেখল ভারী নীল পর্দা নড়ল। ও কে? কুন্তি! দরজায় কুন্তি, তার পিছন পর্দা, পর্দার পিছনে আর কেউ যে আছে তা যেন ধরা যায়।
কুন্তিকে দেখে চিৎকার করবে কী, তার মা বোবা হয়ে গেছে। তিনজনের কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। একি সেই নুনমারার মেয়ে? এ তো অন্য দেশের কোনো মেয়ে। কড় বড় নীল ঘাঘরা, নীল রঙের চোলি, মাথায় নীল রঙের রিবন, হাতে মোটা বালা। মুখখানিও আগের মতো নেই, শুধু চোখদুটি দেখে চেনা যাচ্ছে। আর চেনার কোনো উপায় নেই। ঝিগিরি করাতে এনে এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছে মেয়েটাকে!
ভানু ডাকল প্রথমে, কুন্তি মা, ও কুন্তি!
কুন্তি ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে মানুষগুলোর দিকে।
উঠতে যায় কুন্তির মা, বিনবিনিয়ে কেঁদে ওঠে, ও মা, কথা বলিসনে কেনে?
বসো, উঠো না। কুন্তি হাত তুলল।
বাড়ি যাবি মা? অনন্ত ডাকল।
পরে যাব, তোমরা যাও, টাকা নিয়ে যাও।
ও কুন্তি। কেঁদে ওঠে ভানু। কতদিন বাদে তার চোখে জল এলো যে। মনে পড়ে যাচ্ছে ফুলরানির কোলের বাচ্চাটিকে। আহা রে, তারা কোথায় আছে, কী করছে! ভোজপুরের কোন গাঁয়ে ঘর? সব লেখা আছে ভানুর কাছে। কাগজটা কি থাকবে হোটেলে? মাইতিবাবুর কাছে রাখা ছিল সব। কুন্তি তাকে ডাকছে। কী বলছে নুনমারার মেয়েটা? ভানুকে জিজ্ঞেস করল, ঘোড়া মিলল, তুমার কন্থক?
ভানু বলল, তুই বাড়ি যাবিনে?
পরে, তোমরা এসো না, ইচ্ছে হলে আমি যাব।
তোরে ফোন করেছিলাম।
কুন্তি চুপ করে থাকে। কুন্তির মার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ মুছছে অনন্ত। ঘরে শীত বাড়ছে। কুন্তি ছুড়ে দিল একটা বান্ডিল, মুঠোর ভিতরে ছিল, বলল, পথে খেয়ে নিয়ো, হাজার টাকা আছে।
তারপর! ভানুর মনে হয় সব যেন ভোজবাজি। অলৌকিক কিছু ঘটে গেল। আর কেউ নেই। পর্দার আড়ালে চলে গেছে কুন্তি। কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। এক বুড়ি ঢুকল, নিকালো, সায়েব রুপয়া দিল এই পাঁচ হাজার, লেড়কি এক হাজার দিল, খুশি মনে চলে যাও।
মেয়্যাটারে পাব না? আচমকা সেই কঠিন নৈঃশব্দ্য ফালাফালা করে কেঁদে ওঠে কুন্তির মা, টঙ্কা চাইনে, মেয়্যাটারে দাও।
অশীতিপর লোলচর্মধারিণী বুড়ি এসে একটা খাম দিল অনন্তর হাতে, বলল, কুত্তা ছেড়ে দিবে বাবু, ভাগো, মেয়ে সুখে আছে, মেয়ে যাবে না।
যাবে। কুন্তির মা ফুঁসে ওঠে।
নেহি যায়েগি, জাহাজ ছাড়বে বাবুর, লেড়কি বাবুর সঙ্গে যাবে জাহাজে।
কোন জাহাজে? ভানু জিজ্ঞেস করল।
বুড়ি হাসে, উড়াজাহাজ, ভাগো আভি।
ওরা উঠল। অনন্ত তার বউকে ধরে। তিনজনে দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসতেই অসহ্য উত্তাপ আর আলোয় দিকহারা হয়ে পড়ে যেন। তিনজনেই পোর্টিকোর পিলারে গিয়ে ধাক্কা খায়।
দারোয়ান ছিল, ভানুকে বলে, চলে যাও, সায়েবের হুকুম।
মেয়েটাকে নিয়ে নিল! ভানু আর্তনাদ করে ওঠে। যেন তারই মেয়ে গেল। ভানু বিলাপ করতে থাকে, নুনমারার মেয়েটারে কুহক করেছে।
পোর্টিকো থেকে লোহার ফটক পর্যন্ত হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে একবার ভানু ঘুরে তাকায়। ভানু কেন, তিনজনেই, যেন তারা কোনো ডাক শুনছিল। ডেকে উঠেছিল কেউ। তারা অবাক হয়ে দেখল দোতলার সবুজ জানালার একটি পাল্লা খোলা। খোলাই রয়েছে। যাওয়ার সময় দেখেছিল সব বন্ধ। খোলা জানালায় কেউ ছিল যেন। ছিল তা ধরা যাচ্ছে, এখন কেউ নেই, হয়তো আছে, তারা দেখতে পাচ্ছে না। ঘর থেকে দেখছে তাদের।
কুন্তির মা বলল, মেয়্যাটা দাঁড়াই ছিল উখেনে।
দেখেছ তুমি? জিজ্ঞেস করে অনন্ত।
না, কিন্তু ছিল।
তিনজনে আবার ফিরতে থাকে। ফিরতে ফিরতে লোহার গেট, হাওড়া স্টেশন, বাস, দীঘা। কত রাত তখন! জেগে আছে ধ্রুবতারাটি উত্তরে মীরগোদার সমুদ্রের দিক। সেই সমুদ্র ছাড়িয়ে আরও উত্তরে, কত দূরে! কত দূর! বুক হু হু করে ওঠে ভানুর। তারাগুলোও যেন অনেক কাছে, যত দূরে গেল নুনমারা মেয়েটি, তার চেয়ে।