1 of 2

অশ্বচরিত – ৩৩

তেত্রিশ

অনন্ত অবাক হয়ে তার মেয়েকে দেখেছিল দোতলা বাংলোর উঠোন থেকে। চিনতেই পারেনি, কী আশ্চর্য! এক ঝলমলে সাতরঙা ঘাঘরা চোলি পরে তার মেয়ে ব্যালকনিতে ঘুরছিল। ও যে তার মেয়ে তা সে বুঝবে কীভাবে? অত রং! মেয়ে কি অত সুন্দর! তার মানে তো কুন্তি, মানে তেলহীন রুক্ষ চুল, চুলের গোড়ায় কাপড়ের পাড় বাঁধা, মলিন মুখ, ময়লা শাড়ি জামা, হা-হুতাশে ভরা চেহারা। ব্যালকনিতে যে ঘুরছিল সে বড় সুন্দর! অত সুন্দর মেয়ে সমুদ্রতীরে দেখতে পাওয়া যায় সিজন টাইমে। চমৎকার সব গাড়ির ভিতর থেকে নেমে আসে তারা। হাসতে হাসতে দৌড়য়, ঘাঘরা তুলে, রং ছড়িয়ে। অনন্তর চোখ সরছিল না, ওই কি তার কুন্তি? না অন্য কেউ? ঘুম পাড়িয়ে তাকে এত বদলে দিয়েছে প্রেম সায়েব?

তখন আকাশে মেঘের আস্তরণ ছিল। তা ভেঙে আচমকা সূর্যরশ্মি বেরিয়ে এসে পড়েছিল ঘাঘরা চোলির সাত রঙের ভিতরে বসানো চুমকি, আয়নায়। ঝলমল করে উঠেছিল মেয়ে। ঝিলমিল করছিল রং। ঠাকুরের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল প্রেম সায়েব। নেমে এসে তাদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল ঝাউবনের দিকে। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছিল না আর খোলা ব্যালকনিটিকে। তবু অনন্ত আচমকা ডেকে উঠেছিল, কুন্তি মা!

কুন্তি কি শুনেছিল? মনে হয় শুনেছিল। অনন্ত সাড়া পায়নি কোনো, কিন্তু মনে হয়েছিল কুন্তি তাকিয়ে আছে ঝাউবনের দিকে। কী স্তব্ধ সেই দৃষ্টি! জাহাজওয়ালা প্রেম সায়েব ধমকে উঠেছিল তাকে, আগে ডিল শেষ হোক।

কিছুই বোঝেনি অনন্ত। তার ভিতরে ভয় জেগে উঠেছিল। কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে। জাহাজওয়ালার অদ্ভুত চেহারা। মাথার ফুরফুরে সাদা চুল ঝাউবনের বাতাসে উড়ছিল, ভাসছিল। মুখখানিতে কত যে প্রাচীনতা তার থই পাওয়া যায় না। চোখের চাহনিতে ছিল বরফ কঠিন শীতলতা। স্লিপিং গাউনের পকেটে হাত, মুখে চুরুট ধোঁয়া উড়ছিল। ঠাকুর তাকে প্রায় কুর্নিশ করতে করতে চলেছিল। জাহাজওয়ালা তার কাঁধে হাত দিয়েছিল। কী ঠাণ্ডা! ধীর গলায় বলছিল, বেবিকে সে কলকাতায় নিয়ে যাবে, সুইট বেবি, মেয়েটা খুব ভালো কাজ করে, তার এমন মেইডসার্ভেন্ট চাই, মেয়েটার সব ভার নিয়ে নিচ্ছে সে, মেয়ে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না অনন্তকে, মেয়ে খুব সুখে থাকবে, মেয়ে যদি শান্ত হয়ে থাকে তবে সে তাকে রানি করে দেবে, টাকাপয়সা তার কম নেই, একা মানুষ, তার ছেলেরা সব দেশ-বিদেশে থাকে, তার সঙ্গে কেউ থাকে না, সবাই তাকে ভুলে গেছে, তার বউ বেঁচে নেই, অনন্ত কত টাকা নেবে?

কী বলেছিল তখন অনন্ত? কিছুই বলেনি। বলতে পারেনি। সে ধরতে পারছিল না কী হতে যাচ্ছে। সে ঘুরে ঘুরে পিছনে ফিরছিল। ঝাউবনের আড়াল থেকে বাংলোর এক এক বিন্দু ঝিলমিল করে ভেসে উঠছিল, রঙের চিহ্ন জেগে উঠছিল মনে মনে ভাবছিল কত না সুন্দর তার মেয়েটি। অভাবী বাপ জানেই না তার মেয়ে কত রূপবতী! আহা! দেবীর মতো রূপ কুন্তির। কী ডাগর তার চোখদুটি! কীভাবে দূরে তাকিয়ে ছিল।

ঠাকুর ডাকছিল তাকে, শুনছিস, সায়েব পনেরো হাজার দিচ্ছে।

কেন? হতবাক হয়ে গিয়েছিল সে।

কেন তা বুঝছে না কেন অনন্ত? মেয়েটাকে পছন্দ করেছে বুড়ো সায়েব, জাহাজে নিয়ে ঘুরবে। পঞ্চম ঠাকুর ভানুর কানের কাছে বিনবিন করছিল মশার ডাকের মতো। মেয়ের হিল্লে হয়ে যাবে সমস্ত জীবনের মতো। মেয়ে সৌভাগ্যবতী। এমন ভাগ্যবতী আর কখনো দেখেনি পঞ্চম ঠাকুর। অনন্তর হাতে টাকার দুটি বান্ডিল, একটি একশ, অন্যটি পঞ্চাশের, তুলে দিতে দিতে ঠাকুর বলছিল, আরও পাবে অনন্ত, পরে পাবে, মেয়ে রাজকন্যার মতো থাকবে।

হাঁ হাঁ, মাথা দোলাচ্ছিল প্রেম মদনানি, রুপয়া যত নিবে হামি দিব।

অনন্তর লোভ বাড়ছিল টাকার বান্ডিল হাতে নিয়ে। টাকার বান্ডিল নিয়ে তার বিশ্বাস হচ্ছিল না ওই টাকা তার। টাকার লোভ হচ্ছিল যেমন, তেমনি মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। আহা, মেয়েটাকে বুকে আঁকড়ে ধরবে সে। কিন্তু মেয়েকে দেখলই না ফেরার সময়। ব্যালকনিতে সে ছিল না।

মেয়ের সঙ্গে কথা হলো? হলো। হয়েছিল তাই তো জানে কুন্তির মা। আসলে তো হয়নি। হয়নি যে সে কথা বলে কী করে অনন্ত? মদনানি সায়েব বলেছিল, পরে কথা হবে, মেয়ে নাকি আবার ঘুমোতে গেছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মেয়ে সুন্দর হয়ে উঠছে। মেয়েকে নিয়ে যাবার আগে কথা কইয়ে দেবে। কিন্তু সে কথা মেয়ের মাকে বলেনি অনন্ত। টাকা দুই পকেটে নিয়ে সে ফিরছিল হাঁটতে হাঁটতে। তার কাছে আর কোনো টাকাই ছিল না যে ভ্যান রিকশায় উঠে ফিরবে। পঞ্চম ঠাকুর তো উলটো পথে কিয়াগেড়িয়ার দিকে চলে গেল

মেয়ের মা, সরস্বতী বিনবিনিয়ে কাঁদছে ভানুর সামনে বসে। বলছে কী ভয় না পেয়েছিল সে সেই সকালে। যেন গন্ধ পেয়েছিল নাকে। খুব খারাপ গন্ধ! মায়ের মন! মা যেন কী আশঙ্কা করে বেরিয়ে পড়েছিল ঘরে তালা মেরে। তারপর অলঙ্কারপুর থেকে কোনাকুনি হাঁটতে আরম্ভ করেছিল। সি-ডাইকে উঠে দৌড়তে আরম্ভ করেছিল। আঁচল লুটোচ্ছিল, মাথার খোঁপা ভেঙে চুল উড়ছিল। কুন্তির মা বলে, কী তরাস না লেগেছিল ভানুদাদা, তরাসে ছুটছিলাম, টের পাচ্ছিলাম খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে, পঞ্চম ঠাকুর সব্বোনাশ করতেই সক্কালে হাজির হইছে, ঠাকুর যেন যমদূত, উ যেন আন্ধার, মরণ, মরণের দিকে মোর ছাটিরে ঠেলে দিল রে। দীঘায় ঢুকতেই দেখি মেয়ের বাপ ফিরতেছে। সরস্বতী হামলে পড়েছিল স্বামীর ওপর, মেয়্যা কোনঠে?

মেয়্যা ঘুমায়।

দ্যাখো নাই?

তখন অনন্তর খেয়াল হয়েছিল, সে সিধে হয়ে বলতে চেষ্টা করেছিল, দেখা তো হয়েছে, কথাও হয়েছে, ভালো আছে কুন্তি, খুব হাসছিল, খুব আনন্দে আছে ঘুড়ার নিকট।

ঘুড়া মানে?

অনন্ত বলেছিল, বুড়া জাহাজওয়ালাকে ঘুড়া মনে করেছিল তো কুন্তি, মাইতিবাবুর ঘোড়া।

কীসব কও, মেয়্যা কী বলল?

অনন্ত চুপ করে গিয়েছিল। দুই পকেটে দুটি বান্ডিল, নতুন নোট, খুব চকচকে মসৃণ। অনন্ত নোটের গায়ে গোপনে হাত বোলাচ্ছিল। তার দুই পকেটই ঝুলে পড়েছিল টাকার ভারে। অনন্ত তখন চাপা গলায় সরস্বতীকে বলেছিল তার পকেটে হাত দিয়ে দেখতে। একটা নয়, দুটো নয়, পনেরো হাজার। অনন্ত টাকার ভারে যেন বেঁকে গিয়েছিল, বউকে বলেছিল, টঙ্কা রাখি আগে, তারপর কথা বলব, রাখি কোথায় টঙ্কা, এত টঙ্কা দিল জাহাজওয়ালা!

অত টঙ্কা কেনে দিল ভানুদাদা?

ভানু জিজ্ঞেস করে, টাকা রেখেছ কোথায়?

ঘরে, এমন থানে লুকাইছি, কেহ খুঁজ পাবেনি, জানেই বা কেডা?

ভানু চাপা গলায় বলল, পঞ্চম ঠাকুর?

সে তো পলাইছে।

ঠাকুরানি?

উ জানেনি, বেংকে রাখলি কথা উঠবে, আর মোর তো পাশবই নাই, পাশবই খুলতে গেলে সবু লকে জানি যাবে। বলল অনন্ত।

ভানু বলে, কী হলো তারপর, বলে যাও।

কী বলবে অনন্ত? অনন্তর বউ কপালে করাঘাত করে। সেই বা কী বলবে? টাকাই হলো সর্বনাশী। পকেটে হাত দিয়ে দুই বান্ডিল স্পর্শ করে শিহরিত হয়েছিল কুন্তির মা। অনন্ত তাকে পথ থেকেই ফিরিয়েছিল। ঘরে ফিরে টাকা লুকানোর জায়গা খুঁজতে কত সময় গেল। তারপর মনে পড়ল মেয়ের কথা! দুপুর গড়ালে হাঁড়িতে টাকা রেখে সেই হাঁড়ির মুখ সরা দিয়ে বেঁধে মাটিতে গর্ত করে রেখে মাটি চাপা দিয়ে বেরোল দুজনে মেয়ের খোঁজে। যত যায় দীঘার দিকে, টাকা টানে অনন্তকে। মাঝপথে গিয়ে অনন্ত বলে, কুন্তির মাকে একা যেতে। ঘর ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। কুন্তির মা সরস্বতী ভেবেছিল ফিরবে। তাকেও তো টানছিল টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়ের টান বেশি হলো। টাকার টানে অনন্ত সি-ডাইক থেকে নেমে আবার গৃহাভিমুখী হলো। আর মেয়ের টানে ছুটল তার মা দীঘার দিকে। কী সেই টান! চাঁদের যে টানে সমুদ্রের জল স্ফীত হয়, তেমনই টানল যেন অভাগী মেয়েটা। কপালে হাত রাখে সরস্বতী। সে ছুটেছিল বাংলো পর্যন্ত। গিয়ে দেখে সব শূন্য!

মেয়েরে দ্যাখোনি?

দুচোখ জলে ভিজে গেল, কুন্তির মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মাথা নাড়ে। চলে গেছে তারা। কালঘুম ধরেছিল মেয়েটারে। শুধুই নাকি ঘুমোচ্ছিল কদিন ধরে, ঘুমন্ত মেয়েকে নিয়ে জাহাজগুলা চলে গেছে। সরস্বতী দেখেছিল সব জানালা বন্ধ, ব্যালকনি শূন্য, নিচের দরজায় বাইরে থেকে তালা। নেপালি দারোয়ানটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঝাউবনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, তাকে দেখে অবাক হয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিল, কেয়া?

জাহাজওয়ালা বাবু?

চলে গেছে শুনে রোখ ছেড়ে কেঁদে উঠেছিল সরস্বতী। টের পেয়েছিল পনেরো হাজার টাকার রহস্যটি। তার কান্না শুনে দারোয়ান বিব্রত হয়ে বলেছিল, তুম রোঁতা কিঁউ, বাবুকা আড্রেস লাও, কলকাত্তা যাও।

দারোয়ান একটা কার্ড দিয়েছিল। সেই কার্ডটি হাতে করে সন্ধে পর্যন্ত বাংলোর সামনের রাস্তায় বসেছিল সরস্বতী। তারপর অন্ধকারে ফিরেছিল একা। কী ছিল সেই অন্ধকার! কী ঘন, কী গম্ভীর, অতলস্পর্শী! টলতে টলতে একা একা ফিরেছিল সে। কী একাই না হয়েছিল! কেউ কোথাও ছিল না। মস্ত সমুদ্রবাঁধটিতে একটিও মানুষ ছিল না। একটা সময়ে সে বসে পড়েছিল বাঁধের ওপর। বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। মেয়েটাকে গর্ভের ভিতরে বাঁচিয়ে রাখার দিনগুলোকে মনে করছিল। আর তো কোনো সন্তানই বাঁচেনি, বেঁচে ছিল কুন্তি। হায় কুন্তি মা! বাঁধের মাটিতে মাথা ঠুকছিল সে একা একা। তারপর একসময় তার কান্না থেমেছিল। কত আর কাঁদতে পারে মানুষ! কান্নার শক্তিও তো চাই। নিঝুম অন্ধকারে একা বসে আকাশ পানে চেয়েছিল। তাকিয়ে দেখেছিল উত্তর-পুব আকাশ থেকে তারা খসে যেতে। মধ্যগগন থেকে আলোকপিণ্ড আকাশ চিরে যেন নেমে গেল দিগন্তে, ঝাউয়ের গভীর অন্ধকারে, আরও অন্ধকারে। চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল সরস্বতী। তারা খসা শুভ নয়। অশুভ আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল সে।

মেয়েটা নেই। নেই-ই তো। ঘরে গেলে দেখবে মেয়ে নেই। দীঘার বাজারে গিয়ে দেখবে মেয়ে নেই। নতুন দীঘার বাংলোয় গিয়ে দেখবে মেয়ে নেই। নুনের খালারিতে গিয়ে দেখবে নেই মেয়েটা। বুক হা হা করছিল। চোখের ভিতরে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। মুছে গিয়েছিল তারা ভরা আকাশ, মুছে গিয়েছিল জগৎ, অন্ধকারের পৃথিবী। মেয়েটার সঙ্গে সবই যেন তার অস্তিত্ব থেকে মুছে যাচ্ছিল।

ভানু বলে, চোখের দেখাও দেখতে পেলে না?

না! ক্রন্দন ভরা গলায় ফুঁসে উঠল মেয়ের মা, বিচে দিঁইছে তো উয়ার বাপ।

উ কথা কহিসনি কুন্তির মা।

কেনে কহিবনি? ফোঁস ফোঁস করে মেয়ের মা।

অনন্তর মাথা নেমে গেছে। সে কথা বলল না আর। টাকার লোভ কুন্তির মার হয়নি? হয়েছিল বলেই পনেরো হাজার টাকার সঙ্গে সে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। মেয়েকে তখন যদি দেখতে যেত, দেখা হতো। আর দেখা হলে হয়তো মা ধরে রাখতে পারত মেয়েকে। মা তো পেটে ওই মেয়ের ভার বয়েছিল।

ভানু জিজ্ঞেস করে, কলকাতা যাবে?

যাব। কুন্তির মা কেঁদে ওঠে, ঘুরায়ে লিয়ে আসব মোর কুন্তিরে।

অনন্ত তার জামার বুক পকেট থেকে কার্ড বের করে। ভানুর হাতে দেয়। ভানু কার্ডটি উলটে-পালটে দেখে। আচমকা টেলিফোন নম্বরটা আবিষ্কার করে কার্ডের কোণে। দেখেই তার ভিতরে উত্তেজনা তৈরি হয়, ফোন নম্বর রয়েছে, কলকাতায় ফোন করি।

ফোন করা যাবে! অনন্ত অবাক, মোরা তো ফোন করতি পারবনি।

বুথে গেলে ওরাই লাইন ধরে দেবে, আচ্ছা চলো আমি যাব।

তুমি তো যাবে ভানুবাবু, নাহলে কী করে হবে? অনন্ত বলে।

ফোনে কথা বলা যাবে? জিজ্ঞেস করে মেয়ের মা।

যাবে।

কুন্তি কথা বঁইলবে?

বলবে।

তাহলে চলো ভানুদাদা। সরস্বতী উঠে দাঁড়ায়।

তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে ফোন বুথে এলো। সন্ধের পর অনেকটা পার হয়ে গেছে। অফ-সিজন, ট্যুরিস্ট কম। বুথে কোনো লোক ছিল না। ভানু কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে লাইনটা ধরে দিতে বলে। লাইন পেতে সময় লাগে অনেক। তারপর বাজল ওদিকের ফোন। ভানুর হাতে রিসিভার দিয়ে বুথের ছেলেটি বাইরে গিয়ে সিগারেট ধরায়। ভানুর কানে বেজে যাচ্ছিল ফোনের শব্দ। কেউ ধরছে না। ভানু অনন্তকে ইঙ্গিত করে। অনন্ত মাথা ঝাঁকায়। ভানু দেখে অনন্তর মুখখানি ভয়ে ছোট হয়ে গেছে। মরা মাছের মতো চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার বউ সরস্বতী।

ধাতব শব্দ বেজে যাচ্ছিল বহুদূরে। কটা নদী পেরিয়ে, কালিনগরের নদী, নরঘাটের হলদি নদী, কোলাঘাটের রূপনারায়ণ নদী, তারপর দামোদর, তারপর হুগলি নদী, এর ভিতর কত গঞ্জ, কত জনপদ, মাঠ, পুকুর, শস্যক্ষেত্র, কালো পিচঢালা হাইওয়ে—সব পেরিয়ে কলকাতার শত কলরোলের ভিতর থেকেও নিজেকে আড়াল করে ভানুর ডাক গিয়ে পৌঁছেছে জাহাজওয়ালার ঘরে। জাহাজের মতো কোনো বাড়িতে হয়তো। নতুবা কোনো জাহাজেই বোধহয়। একি খিদিরপুর ডকের জাহাজ, নাকি বজবজের গঙ্গায় ভাসা জাহাজ! একটাও মানুষ নেই! কেউ ধরবে না ফোন?

কী হলো? অনন্ত দম আটকে জিজ্ঞেস করে।

কেউ নাই।

ও বাড়িতে ফোন গেছে?

ও বাড়িতে কুন্তি রয়েছে?

তাই তো থাকার কথা। বলতে বলতে ভানু টের পায় ফোনটি কেউ তুলল। ফোন তুলতেই, ভানু চাপা গলায় বলে ওঠে, হ্যালো, দীঘা থেকে বলছি, কুন্তি আছে, কুন্তিরে চাই, হ্যালো, হ্যালো…।

ফোনটি কেটে গেল। লাইনটি কেউ রেখে দিল যেন একটি কথাও না বলে। লাইন যে কেউ তুলেছিল তা ধরা গেল ফোনের চার্জটি মুদ্রিত অক্ষরে আর একটি যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসায়।

ধরল না কেউ? অনন্ত জিজ্ঞেস করে।

বুথের ছেলেটি ভিতরে এসে বিলটি ছিঁড়ে ভানুর হাতে দিতে দিতে বলে, কল হয়েছে, ওদিকে রিসিভ করেছিল।

কথা বলল না তো! টাকা মিটিয়ে বিড়বিড় করতে করতে ভানু বেরিয়ে আসে। তাহলে ফোনটা কি মদনানি সায়েব নিজে তুলেছিল? নাকি কুন্তি? ভানু দেখছিল স্বামী-স্ত্রী তার দিকে চেয়ে আছে অধীর আগ্রহে। ভানু বলল, কাল সকালে কলকাতা যাব।

যাবে? অনন্ত ভানুর হাত ধরে ফেলে।

হ্যাঁ যাব, তুমি যাবে সঙ্গে?

মেয়ের মা বলে, মুও যাব।

ভানু না করল না। ঠিক হলো টাকা থাকবে ঘরে। মাটির নিচে যখন আছে, থাকুক। তারা কলকাতায় গিয়ে মেয়েকে নিয়ে এসে তারপর টাকা ফেরত দেবে। অত টাকা নিয়ে কলকাতা শহরে যাওয়া ঠিক হবে না। স্বামী-স্ত্রী আর অলঙ্কারপুরে ফিরল না। শুয়ে থাকল মাইতিবাবুর হোটেলের বারান্দায়। মাইতিবাবু ফিরল না। ভানুর ঘুম এলো না অনেক রাত্রি পর্যন্ত। ভানু কেন, কুন্তির মা-বাবাও ঘুমোল না। তারা বসে বসে কথা বলছিল। ঠাকুরানির কোনো সাড়া নেই। ভোর রাতে তিনজন বেরিয়ে পড়ল। বাসে কলকাতা শহরের দরজায়। হাওড়া স্টেশনে বাস এসে পৌঁছল বেলা বারোটা নাগাদ। শেষ ভাদ্রর রোদে শহর ঝাঁ ঝাঁ করছে। ট্যাক্সি নিল তিনজনে, নিউ আলিপুর চলো।

ট্যাক্সি চলতে আরম্ভ করলে কাঁদতে লাগল কুন্তির মা, মেয়েটা বেঁচে আছে তো ও ভানুদাদা, হা ভগবান, পঞ্চম ঠাকুর কী সব্বনাশ করল মোর! কী হবে, ও ভানুদাদা?

ট্যাক্সি ধীরে ধীরে গড়িয়ে যাচ্ছিল। চোখের সামনে শহরটা ফুটে উঠছিল। ব্রিজের নিচের নদীকে প্রণাম করল ভানু। নদীটা টানছে তাই এতবার দেখা হয়ে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *