1 of 2

অশ্বচরিত – ২৩

তেইশ

ফ্রেদরিক সায়েবকে থানা ডেকে পাঠিয়েছিল। ফ্রেদরিকের বাড়ি কোথায়? ফ্রেদরিক শুধু হেসেছে, বলেছে, হাম ইনডিয়াকা আদমি, ইনডিয়ান, হরে কৃষ্ণা হরে রাম!

থানার অফিসার এতে ভোলেনি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেরা করেছে। কবে এসেছে এই দেশে, কবে যাবে? দীঘায় বসে কী করছে? জেলেপাড়ায় থাকে কেন? ফ্রেদরিকের সব জবাবই হরে কৃষ্ণা…। থানায় বসে নাম জপ করেছে সে। শেষে দামি জাপানি লাইটারটি থানায় দান করে আপাতত রেহাই। থানা তাকে ওয়াচে রেখেছে। দুপুরে পান্তা খেয়ে আরাম ঘুম দিয়ে বিকেলে ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টি পেল ফ্রেদরিক। বেঙাকে ডাকল বৃষ্টি দেখতে দেখতে। বেঙা তার ঘর থেকে বেরিয়ে একবার বৃষ্টিতে ভিজে ফ্রেদরিকের ঘরের দাওয়ায় উঠল। ফ্রেদরিক তখন ঘনকালো আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃঝুম।

ফ্রেদরিককে ডাকল বেঙা, ও সায়েব!

বেঙ্গা, টুমার বিবি কাঁহা?

বিবিরে কী দরকার?

ফ্রেদরিক বলল, হামার কুছু বলবে।

আমারে বললে হবে না?

ফ্রেদরিক মাথা নাড়ে, নাহি বেঙ্গা, পুলিশ হামাকে কী বলল শুনবে না?

বেঙা বলল, তুই চলে যাবি নাকি সায়েব?

ফ্রেদরিক দেখছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টি কমে এলো। বেঙার বউ ছাতা মাথায় থলে হাতে ফিরছে। থলের ভিতরে চাল, তেল, নুন। স্বামীর সঙ্গে সায়েবকে অন্তরঙ্গ হয়ে কথা বলতে দেখে পরী বলল, মরণ, এরপরে তো ঝগড়া লাগাবি দুটোয়।

ফ্রেদরিক বলল, হামি যদি ইনডিয়ার সিটিজেন হই বেঙ্গা?

বেঙা বলল, তার মানে?

হামি যদি না চলে যাই?

বেঙা বলল, সে তুমার বেপার, থাকো না কেনে, লেকিন রুপয়া তো বাড়াতে হবে সায়েব, দাম দেখেছ জিনিসপত্তরের।

ফ্রেদরিক বলে, হামাকে ফিশিং নিয়া যাবে বেঙ্গা?

বেঙা হি হি করে হাসে, সমুদ্দুরে যাবা?

হাঁ, কাম করিতে হোবে তো বেঙ্গা।

কাম করবা?

হাঁ, হামি কুছু করিব বেঙ্গা।

কী করবে, করছ তো হরে কেষ্ট নাম, বেঙা হাত পাতল, কটা টঙ্কা ছাড় সায়েব, ফিশিং তুই পারবিনে।

কিঁউ, পারবে না কেন?

বেঙা বলে, তোর কী ফসা গা।

মতলব?

বেঙার বউ এসে বসল দাওয়ার একপাশে, দুটোয় মিলে কী হচ্ছে?

ফ্রেদরিক সায়েব বেঙার বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘনকালো রং, ব্ল্যাক বিউটি। মুখখানি ঢলো ঢলো, শরীরখানি কী সুন্দর। সায়েব বলে, রাঢ়িকে। রাটিকেকে টাচ করলেই কৃষ্ণ নাম বেজে ওঠে কানের কাছে।

সায়েব বলে, রাঢিকে হামি ফিশিং যাব।

মরণ, মরতে জলে যাবা কেনে?

ইনকাম তো হোবে।

বেঙা বলে, তুমারে নেবে না সায়েব, তুমি ফসসা।

মতলব?

বেঙা হবে, ধলা মানুষ, তায় সায়েব, তুমি কেনে ফিশিং যাবা?

তো হামি কী করবে?

হরে কৃষ্ণ করো, পরী বলল, তুমি বাড়ি যাবা না সায়েব?

হোম! মাথা নাড়ে সায়েব, ইন্ডিয়া ইজ মাই কানট্রি।

তার মানে?

সায়েব বলল. হামি যাবে না।

যাবে না মানে, চেরকাল থাকবে? বেঙার বউ জিজ্ঞেস করে।

হাঁ, থাকিব। সায়েব হাসে। সায়েবের কোমরে একখানা আধময়লা গেরুয়া ধুতি, গায়ে গেরুয়া ফতুয়া, মাথায় রেশমের মতো বাবরি চুল, কাঁধ ছুয়ে দুলছে সবসময়। সাদা কেষ্ট ঠাকুর। কখনো মনে হয় যিশুবাবা। সায়েব চোখ বুজে যুক্ত করে বিনবিন করছে, হরে কৃষ্ণা, হরে রাম।

পরী জিজ্ঞেস করে, সায়েব, তুমার বাড়ি তো সাগরের ওপারে?

ইয়াস সাগরের পারে।

অনেক দূর?

সায়েব ঘাড় কাত করে, হাঁ, বহুত।

তারপর? বেঙা জিজ্ঞেস করে।

সায়েব হাসে, বেঙ্গা টুমি বহুত ইডিয়ট আছে, কুছু বোঝে না।

বেঙা বলল, ইংরিজিতে গাল দিলি সায়েবের পো?

হোয়াট?

খিস্তি দিলি? বেঙা বলে।

পরী বলল, তুমি থামো দেকি, ওকি কিছু বোঝে, কোনটা গালি কোনটা আদর সে বুঝার বুদ্ধি ওর আছে?

বেঙা চুপ করে গেল। ফ্রেদরিক সায়েব আকাশে তাকিয়ে বলল, দেখো রাটিকে, ব্ল্যাক মতলব কালা রং আচ্ছা হায়।

পরী বলে ওঠে, আমারে রাটিকে বলবা না তো।

হি হি করে হাসে ফ্রেদরিক, এ বেঙ্গা তেরা বিবি কী বোলে?

বেঙা বলে, কেন রাধিকে তো ভগবান, বললি কী হয়েচে?

তুমি থামো দেকি, যেমন তুমার মাথা, সায়েব তো ঠিকই বলেচে, তুমি হলে মাথামোটা, ও সায়েব কও কী বলছিলে।

সায়েব আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। পুঞ্জীভূত ঘন মেঘ আকাশকে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। কী কালো সেই মেঘ। সমুদ্রটিও কালো, গভীর কালো, জল খলখল করছে জোয়ারে। ঢেউ এসে ভাঙছে সৈকতভূমিতে। তরঙ্গমালা আজ কী উত্তাল! সায়েব বিড়বিড় করে, এই মেঘ তার নিজের দেশেও রয়েছে, সে দেশেও বর্ষার মেঘ কালো, ই বেঙ্গা, হামার দেশ, ফ্রেনচ কানট্রি, সেখেনেও ক্লাউড, মেঘ ব্ল্যাক, কালা।

তা তো হবেই, বর্ষার মেঘ তো কালো হয় সায়েব।

সায়েব দোলে আপন মনে, এ বেঙ্গা, ঝাউবন, ফরেস্ট ভি ব্ল্যাক দেখায়।

বেঙা বলে, হাঁ জঙ্গল তো কালোই দেখায়, তোর দেশে সাদা জঙ্গল?

সায়েব চুপ করে আছে।

পরী বলে, সাদা মানুষ, সাদা জঙ্গল।

বেঙা মাথা দোলায়, হবে তা, ও সায়েব তোর দেশে সাগর আছে?

সায়েব বলে, হাঁ।

সাদা জল সেই সমুদ্দুরে?

ফ্রেদরিকের মুখে আশ্চর্য হাসি জেগে ওঠে।

তোর দেশের মেঘ সাদা রঙের, তাতে জল হয়?

সায়েব আকাশে তাকিয়ে আছে।

আজ খুব দুর্যোগ। আজ সমুদ্র পাগলা হবে। নৌকো নিয়ে বেরোনো যাবে না। কী আলিস্যিই না লাগছে! গাঁজা সাজবে নাকি বেঙা? নাকি সায়েব মদ খাওয়াবে? সায়েবের কত টাকা! ফুরোল না। বেড়ানোর জন্য অঢেল টাকা নিয়ে বেরিয়েছে সায়েব। ব্যাংকে গিয়ে চেক ভাঙায় আর টাকা আনে। সায়েবের কী কপাল!

পরী বলে, ও সায়েব, তোর মন খারাপ?

সায়েব বলে, রাঢিকে, হামি কী করবে?

কী করবে মানে?

পোলিস বহুত ডাকবে, পোলিস ডেনজারাস আছে।

পরী বলে, দেখো বাবা মোদের না বিপদ হয়।

সায়েব বলে, হামি ইনডিয়ায় থেকে যাবে রাঢ়িকে।

বেঙা বলে, থাকিস, এখন টঙ্কা দে, পাঁইট আনি।

পরী ধমকে ওঠে, না, এখন না, মদ খেলিই দুটোর একটা মোর পরে ঝাঁপাবা, মু কী করি!

বেঙা আচমকা ক্ষেপে ওঠে, গনগনে চোখে পরীর দিকে তাকায়।

পরী কুঁকরে যায়, বিড়বিড় করে বলে, তুমার খুব হাত চলে।

সায়েবরে এখান থেকে তাড়ায়ে দেব। বেঙা গর্জে ওঠে।

তাড়াও না, কে রাখতি কয়েচে। পরী পাল্লা দিয়ে গলা তোলে।

সায়েব বলে, চুপ করিবে, এ বেঙ্গা, আজ ফিশিং হোবে?

নেহি, দেখছ না সমুদ্র পাগলা হয়েচে।

এ বেঙ্গা, হামার খোঁজ করিতে পোলিস যদি আসে?

বেঙা বলে, পোষ্কার করে কও দেখি সায়েব কী হয়েচে?

পোলিস হামাকে চলিয়া যাবে অডার করিয়াছে।

বেঙার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়, চলে যাবে?

যাক না, যাক সায়েব, তালে তো তুমার হাড়ে বাতাস লাগে।

বেঙা বলে, সত্যি চলে যাবে?

সায়েব বলে, এ বেঙ্গা, তুই ফিশিংয়ে যাবে না?

না বলছি তো, কোনো নৌকো বেরোবে না, দেখছ না কেমন হাওয়া উঠেচে, ঝড় হচ্চে।

সায়েব বলে, হামার যে বক্স হায়, ও বক্স লুকানে হোগা?

কেয়া?

বক্স হায় না, বক্স মে যে মাল হায়, এ বেঙ্গা সমঝতা? কী মাল আছে?

সায়েব বলে, মেরা পাসপোর্ট হায়, পেপারস হায়। আর কী আছে?

টেপ হায়, ক্যামেরা হায়।

আউর কেয়া হায়?

সায়েব বলে, টুম রাখদো গুপ্ত ইস্থানে।

এখন যাব কী করে, এই বিষ্টি!

সায়েব বলল, পোলিস যদি আসে?

পরী এবার ভয় পায়। পরী কেন, বেঙাও। বারবার পুলিশের কথা বলছে সায়েব। কী বাঁধিয়ে এসেছে কে জানে? বেঙা সায়েবের মুখের দিকে তাকায়। মুখ দেখলে তো কিছু ধরা যায় না। একেবারে জলের মতন। জলের ওপর দেখে কি ধরা যায় কত নিচে তার তল? সায়েবের গায়ের রং সাদা, সায়েবের দেশের সব সাদা, সায়েব তবু কালো কালো করে বেড়ায়। সায়েবের নিজের ঠাকুর যিশুবাবা সাদা, তবু সায়েব কালো ঠাকুর কৃষ্ণ কৃষ্ণ করে বেড়ায়। সায়েবের সঙ্গে মেম এসেছিল দীঘায়, তারা এখন নেই, কিন্তু সেই মেমসায়েবের গায়ের রংও খুব সাদা, ফ্যাকফেকে সাদা, তবু সায়েব কালো মেয়েমানুষের জন্য পাগল। বেঙা কি জানে না সায়েব কেন আছে তার ঘরে অতিথি হয়ে, কেন টাকা চাইলেই টাকা পায় তা কি জানে না বেঙা? সায়েব কীরকম হাঁ করে পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় বেঙার মাথা গরম হয়ে ওঠে, তখন সে পরীকে লাগায় দু-চার ঘা, খুব ঝগড়া লাগে দুজনের। সায়েব এসে বেঙার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে পাঁইট আনতে বললে, মাংস আনতে বললে তবে সে ঝগড়া থামে। আহা, সায়েবের কী কপাল! সাদা মেম থাকতেও কালো মেয়েমানুষ খুঁজে বেড়ায়, আবার তা পেয়েও যায়। কোথায়, কতদূর, কোন সাগরের ধারে সায়েবের দেশ, সেখানে বর্ষার মেঘ, গাছের রং, মাথার কেশ, সবই সাদা, অত সাদা ছেড়ে কালোর খোঁজে সায়েব এসে বসে আছে বেঙা জেলের ঘরে। বেঙা ডাকে, এই পরী, সায়েবের সামনে থেকে সর।

কেনে?

সায়েব তোকে কেমন করে দ্যাখে জানিসনে?

পরী বলে, সাদা কেষ্টো ঠাকুর কী দ্যাখে আর!

সায়েব কালো মেয়েমানুষ দ্যাখে।

খিলখিল করে হাসে পরী, এই নিয়ে মাথা খারাপ করো কেনে?

ও বেটা খুব হারামি। বেঙা গর্জে ওঠে।

বেঙা বলে, সাদা দেশের লোক, কালো দেশে কেনে আসে?

তুমারে টাকা দিতে।

তার মানে?

তুমারে ও টঙ্কা দেয় কি না?

দেয় তো, সে খাবার খরচা।

খাবার খরচা! পরী বলে, টঙ্কার লোভে না রেকেচো ওরে?

বেঙা চুপ করে যায়। পরী ধরেছে ঠিক। সাদা মানুষটা এমন টাকা দেয় যে বেঙার কিছু বলার উপায় থাকে না। বেটাকে নিয়ে গেলে হয় ফিশিংয়ে। মাঝ সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে বেঙা। তাতে বেঙার লাভ? সোনার হাঁসটা মরে যাবে। সায়েবের কত টাকা। পরের জন্মে বেঙা সায়েব হবে। একেবারে ধবধবে সাদা। সাদা হাঁসের মতো সাদা। আর সায়েব তো বলেছে কালো মানুষ হবে। জেলে হবে। জেলে হয়ে মাছ ধরতে যাবে সমুদ্রে। বেঙা তখন জেলের ঘরে বসে জেলে বউ-এর কাছে বসে সমুদ্দুরে মাছ ধরার গল্প শুনবে। পরী বলে, সায়েব ওই কথাই নাকি জিজ্ঞেস করে।

বেঙা বলল, এই সায়েব, পরের জন্মে তুই জেলে হবি?

পরের জম্মো মতলব?

বেঙা বলল, পরের জন্ম মানে পরের জন্ম, একবার মরলি, আবার জন্মালি সায়েব, একবার মরে কবরে গেলি তুই, ফের জন্মালি।

সায়েব বলে, রি-বার্থ?

পরের জন্ম।

সায়েব বলে, পরের জম্মে হামি ফিশারম্যান হবে।

আমি সায়েব হবো।

পরী বলে, তালে আমি কেনে জেলেবউ থাকব, আমি মেম হব।

বেঙা বলল, সায়েব, পালটাপালটি করবি?

কেয়া?

তুই জেলে হ, আমি সায়েব।

হামি তো ইচ্ছা করে, হামি এদেশ থেকে যাবে না।

বেঙা চিৎকার করে বলে ওঠে, আমি এ দেশে থাকবই না, হি-হি-হি, আমি একবার সায়েব হতে পারলে বাপের জন্মে আর আসব না এ দেশে, শালা সায়েবের বাচ্চা টাকা দিয়ে মুখ মেরে রাখে, এই পরী, গাঁজা নিয়ে কলকে সাজ।

পরী ওঠে। সায়েবের ঘরে ঢোকে। মাঝারি আকারের বাক্সটা তালা দেয়া রয়েছে। সায়েব যে এত সোহাগ করে তাকে, সায়েব বাক্সটা কোনো দিন খুলে দেখায়নি। পরী বাক্সটা ধরে নাড়া দিল। কী আছে? কিছুই না যেন।

বাইরে থেকে বেঙা হাঁক মারে, এলি?

বৃষ্টি জোর আরম্ভ হয়েছে। পরী দেখল, সায়েবের ঘরের একধারটা আকাশের জলে কাদা থুকথুকে। হায় রে সায়েব! রাজার বেটা হয়ে মরতে এলি এই ঘরে! পরীর চোখে জল এসে যায়। আজ সায়েবটাকে রাখবে কোথায় সমস্ত রাত যদি বৃষ্টি চলে? পরী ঘরের কোণ থেকে টিনের কৌটো নিয়ে বেরোয় চোখ মুছতে মুছতে।

কী হলো রে? বেঙা অবাক।

কানচি।

কেনে?

ও মুখপোড়া সায়েব এলো কেনে এই দেশে, ঘরখানি দ্যাখো।

সায়েব হাসে। নিঃশব্দে হাসে ফ্রেদরিক সাহেব। পরী কৌটো খুলে কলকে বের করে। সাহেব বলল. বিগ বক্সটা দেখা হলো?

হলো।

কী আছে উহার ভিতরে?

পরী বলল, কী থাকবে, মনে হয় নিশা, নিশার বাতাস, সায়েব তুই কেনে এলি আমার গোবিন্দ, কেষ্টো ঠাকুর! নিশার বাতাস বাক্স ভর্তি করে আনলি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *