সতেরো
সেই রাতের কথা কানাঘুষোয় উড়ছিল। বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। সুভদ্রা ধর্ষিতা হয়েছিল, আরও কয়েকজন চাষা বউ বে-আব্রু হয়েছিল সেই রাতে। তাদের কাউকে কাউকে দে-পাল ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল এক-দুদিনের মধ্যে। আত্মীয় ঘরে, আশপাশের গ্রামে, ভীমাপুর, মহাপাত্রপুর, কুসমাড়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল চাষারা। পাণ্ডবকুমারও পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল সুভদ্রাকে তার বাপের ঘরে। সুভদ্রা যায়নি। কী খাবে সেখানে গিয়ে? আর সে ছাড়তে চাইছিল না পাণ্ডবকুমারকে। আরও আঁকড়ে ধরতে চাইছিল স্বামীকে। বাপ-মা না থাকলে বাপের ঘরও যে থাকে না তা বলছিল পাণ্ডবকুমারকে। তার ভয় হচ্ছিল বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে পাণ্ডবকুমার যদি তাকে না আনে। দে-পালের ভিটে তো যায় যায়। দে-পাল ছেড়ে চলে যায় এর ভিতরে পাণ্ডবকুমার, যদি যেতে হয় তাকে, তবে সে কোথায় খুঁজবে তার স্বামীকে তখন? তার বাপের ঘর অনেক দূর, বালিমুণ্ডা পেরিয়ে বালেশ্বরের পথে সেই গ্রাম। কী ভয় না পেয়েছিল সে? পাণ্ডবকুমার কি তাকে ত্যাগ করতে চাইছে বাপের ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে?
সেই রাতে যে কিছু হয়েছিল সেই খবর মহাপাত্রপুর, ভীমাপুর, কুসমাড় হয়ে আবার ফিরে আসছিল দে-পালে। ওই সব গ্রামে যেসব চাষাবউরা পালিয়ে গিয়েছিল ভয়ে, আশ্রয় নিয়েছিল ভয়ে, তারা ওখানে গিয়ে বর্ণনা করছিল সেই রাতের কথা। চাপা, ফিসফিসে গলায়, কাঁদতে কাঁদতে তারা বলছিল সেই ভয়ানক রাতের কথা। বলছিল ওই সব গ্রামের বধূ, কন্যাদের। লুকিয়ে বলেছিল। না বলে উপায় ছিল না। তারা স্বস্তি পাচ্ছিল না। তাদের কথা শুনে, তাদের কান্না শুনে মহাপাত্রপুর, কুসমাড়ের বধূরা কাঁদছিল। তারা কথাগুলো তাদের স্বামী-পুত্রদের বলেছিল। না বলে তারাও স্বস্তি পাচ্ছিল না। এইভাবে ওই সব গ্রামের পুরুষরা কথাগুলো জানলে তারা তা নিয়ে শোরগোল তুলছিল। চাপা শোরগোল ক্রমশ বড় হয়ে যেতে থাকে। জলের বৃত্তের মতো তা বাড়তে থাকে ক্রমশ। বালেশ্বরের একটি দৈনিক খবরটি ছেপে দিতেই, ভুবনেশ্বরের দৈনিক তা নিয়ে হইচই বাধিয়ে দেয়। এসব যখন হচ্ছিল, মহাপাত্রপুর, কুসমাড়ে গড়ে উঠেছিল দে-পাল রক্ষা সমিতি, তারা ধর্ষণ আর শ্লীলতাহানি নিয়ে যখন অভিযোগ পেশ করছে, সেই সময় পাণ্ডবকুমার বদলে যাচ্ছিল সুভদ্রার সামনে। পাণ্ডবকুমার তাকে বলছিল, একেবারে চুপ করে যেতে, যারা ওসব নিয়ে কথা তুলছে তাদের বিপদ আসন্ন। পুলিশ আর ঠিকাদারের লোকেদের সঙ্গে কথা হয়েছে তার। তারা বলছে পাণ্ডবকুমার যদি ওসব নিয়ে হইচই করে তাহলে পাণ্ডবকুমারকে ছেড়ে দেবে না তারা। পুলিশ কী না পারে। পাণ্ডবকুমার চুপ করে থাকলে তারই লাভ। ঠিকেদার বলেছে, পুলিশ বলেছে এখন নিশ্চিন্তে থাকতে পারে পাণ্ডবকুমার, তার ভিটে ভাঙবে না পুলিশ ঠিকেদার। কাজ হতে তো সময় লাগে।
পাণ্ডবকুমারের সঙ্গে তখন সেই রাতের রক্তপায়ী শৃগালদের একটিকে দেখে ভীতা হংসীর মতো গুটিয়ে গিয়েছিল সুভদ্রা, উ কে?
ঠিকেদার সরকারের লক।
উ লক সি রাতে আসছিলা।
পাণ্ডবকুমার চমকে উঠেছিল। সুভদ্রা আঁকড়ে ধরেছিল স্বামীকে, সি লক, হা জগন্নাথ। উ লকই মুকে থিকে ঘর উঠানে লিয়ে যায়, টানি লিয়ে যায় উ লক।
পাণ্ডবকুমার বলে, উ লকের নাম মহান্তিবাবু, মহান্তিবাবু খুউব ভালো লক, তু কীসব বলিস, তুর মাথা খারাপ হুঁই গিছে।
না, উ সি লক।
তুরে কহিছি বিস্মরণ হ সব, উ লক সি লক লয়। পরদিন ঘুরে এসে বলল পাণ্ডবকুমার, মহান্তিবাবু কত বড় লক, বালেশ্বরে উয়ার কত বড় দালান!
সুভদ্রা জিজ্ঞেস করে, কে কহিল উ সি লক লয়?
মহান্তিবাবু নিজই কহিলা।
তুমি উয়ারে কহিছিলা মুর কথা?
হাঁ। পাণ্ডবকুমার বলল, সব বিস্মরণ হ, ইজ্জত তো ফিরা পাবিনি, উ লক কহিছে নোতন ভিটা দিবে বালিমঁড়ায়, টঙ্কা দিবে জমির, গাছের দাম দিবে বেশি, ঠিকাদার, পুলুশ, গরমিনের সার্বিয়ার সবার সঙ্গে আলাপ হইছে মুর, উয়ারা কহিছে চুপ করি রহিতে।
তখন কেঁদে উঠেছিল সুভদ্রা, কী কহ গো? উ মোরে ছিঁড়া খাঁইছে, উ লক মোরে পেখম ধরে, মোর সব্বনাশ করে উ লক।
ধমকে উঠেছিল পাণ্ডবকুমার, তুর লাজ নাই ছিনাল মাগি, ইসব কী কহিস? কী না কী করিছিল সি রাতে, মহান্তিবাবু লক ভালো।
অবাক হয়ে পাণ্ডবকুমারকে দেখেছিল সুভদ্রা। তার মাথায় তখন আগুন। পাণ্ডবকুমার যে লোভে পড়ে গেছে তা বুঝতে পারছিল সুভদ্রা। পাণ্ডবকুমারকে চেনা যাচ্ছিল না। সুভদ্রা পাগলিনীর মতো ঘরের মেটে দেয়ালে মাথা ঠোকে।
পরদিন লোকটা আবার এলো। এসে বসল উঠোনে পাতা খাটিয়ায়। পাণ্ডবকুমার উবু হয়ে তার সামনে, মাটিতে বসেছিল। লোকটা সিগারেট ধরাতে পাঁচটা কাঠি নষ্ট করেছিল। পোড়া কাঠি ধুলোয় ছড়িয়ে গিয়েছিল। সুভদ্রা ঘরের ভিতরে লুকিয়ে দেখছিল লোকটাকে। লোকটা হ্যা হ্যা করে হাসছিল, পাণ্ডবকুমার হাত কচলাচ্ছিল। পাণ্ডবকুমার আগের দিনই বলেছিল ঠিকেদারের কাছে কাজ পায় যদি, তবেই থাকতে পারবে নিজের ভিটেতে, এ ভিটে পরে ভাঙবে।
সেদিন রাতে পাণ্ডবকুমারকে আবার জিজ্ঞেস করেছিল সুভদ্রা, তুমি মোর কথা বিশ্বাস করছনি, উ লক যদি আসে ই ভিটায় মু গলায় রশি দিব।
পাণ্ডবকুমার থাবা মেরেছিল তার ঘাড়ে, নিলাজ মাগি, মোর সাথে তুই কীসব কহিস, বিস্মরণ হ।
না, মু বিস্মরণ হবনি।
পরদিন লোকটা আবার এসেছিল। সুভদ্রার মনে হয়েছিল লোকটা বোধহয় তার খোঁজ করতেই পাণ্ডবকুমারকে ধরেছে। কী সব্বোনাশ! তার স্বামী সব কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে। মিথ্যে কথা বলছে। নাকি তার ভুল হচ্ছে। হয়তো ওই লোকটা নয়। ওর মতো অন্য কোনো লোক। কিন্তু গলার স্বর মিলে যাচ্ছে। সিগারেটের গন্ধটা পর্যন্ত মিলে যাচ্ছে। কী যে হচ্ছিল তার! তখন বাইরে থেকে পাণ্ডবকুমার ডাকে, পানিহ্ দিবে?
জল! জল দিতে তো বেরোতে হয় তাকে। ওই লোকটার সামনে দাঁড়াতে হয়। কী করে যাবে সে? তার বুক হিম হয়ে যাচ্ছিল পাণ্ডবকুমারের পুনঃ পুনঃ ডাকে। শেষ পর্যন্ত সে সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারে না। তার তো ইজ্জত গেছে। কিন্তু তার হয়ে বলার কেউ নেই। স্বামীও বিপক্ষে। লুটেরার সঙ্গে হাসছে। তাকে সাহসী হতেই হবে। সে মাথায় কাপড় টেনে বেরোল কাঁপতে কাঁপতে। পাণ্ডবকুমারের কণ্ঠস্বর ক্রমশ উঁচুতে উঠে যাচ্ছিল। একমাথা ঘোমটা টেনে মুখ লুকিয়ে সে বেরোয়। জলের ঘটি আর গেলাস রেখে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল কয়েক দণ্ডের জন্য। ঘোমটার ভিতর থেকে লোকটাকে দেখে। পরিষ্কার দেখে। বাদামি চোখের মণি কি সে ভুলতে পারবে? লোকটা যেন কুঁকড়ে গেল এক পলকের জন্য, তারপর ঘাড় তুলল। ঘাড় তুলে তাকে দেখল। চোখে কি চোখ পড়ল? ঘোমটার নিচেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছে সুভদ্রা। চেনায় কোনো ভুল নেই। সেই রাতের কথা কি ভুলে যাবে? যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন মনে থাকবে। এ্যস্ত পায়ে সুভদ্রা ফিরে আসে ঘরে। ঘরে ঢুকে কাঁপতে থাকে, সেই লক!
পাণ্ডবকুমার বলল, না সি লক না।
হাঁ, সি লক।
পাণ্ডবকুমার আচমকা ক্রুদ্ধস্বরে বলে ওঠে, মু কহি সি লক না যখন সি লক না, আর যদি হয় সি লক, কী কঁইরব?
কী কঁইরবা, সি তুমার কত্ত বড় সব্বোনাশ! গলা বুজে যায় সুভদ্রার, তুমি কি চিনো নাই সত্য, হাঁ তুমি কী কহ, উ লক কেনে ই উঠানে আসে?
চুপ কর, লকে সন্দেহ কঁইরবে।
কী সন্দেহ?
তুই অশুদ্ধ হঁই গিছিস, মেয়্যামানুষ অশুদ্ধ হিলে এত কথা কহে?
সুভদ্রা বলে, উ লক যেন ই ভিটায় না আসে।
কেনে ভিটা কি তুর? পাণ্ডবকুমার তার হাত টেনে ধরে, চোখ বনবন করছে লোকটার, খুব রেগে গেছে, গর্জন করে ওঠে, উ ঠিকাদারের লক, কাজ দিবে, তুর যা হবার তো হইছে, ই লিয়ে কথা কহি যদি ভিটা ছাড়ি দিতে কহিবে, কামকাজও দিবে না, টঙ্কা মিলিবে না।
বিনবিন করে কাঁদছিল সুভদ্রা। সেই প্রলয়ংকর রাতের পর সে ঘর থেকে বেরোয় না। ঘরের অন্ধকারে প্রায় লুকিয়ে থাকে। সে জানে যতই চাপুক পাণ্ডবকুমার, কথাটা রটে যাচ্ছে। মহাপাত্রপুরের লোক কজন খোঁজ করতে এসেছিল, পাণ্ডবকুমার তাদের রাস্তা থেকে বিদায় করেছে কিছু হয়নি বলে। কিন্তু মহাপাত্রপুরের লোকজন বিশ্বাস করেনি। শোরগোল উঠেছে। পাণ্ডবকুমার বদলে গেছে সেই রাতের পর। এ লোক সে লোক না যে তাকে সোহাগ করেছে কদিন আগেও। ধর্ষণের রাতের পর তাকে ছোঁয়নি পাণ্ডবকুমার, উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে সবসময়। কথাটা রটলে বড়ই বিপদ। না রটলে সুবিধে। ঠিকাদারের লোক, পুলিশ বলছে এ নিয়ে শোরগোল না তুলে চুপ করে থাকলে আখেরে লাভই হবে। শোরগোল তুললে মেয়েমানুষের ইজ্জত কি বাড়বে? বরং আবার যাবে। মেয়েমানুষের ইজ্জত নেয়া কি কঠিন? দরকারে পুলিশ থানা হাজতে ঢুকিয়ে দেবে পাণ্ডবকুমারকে, তারপর ইজ্জত লুট করাবে মেয়েমানুষের। কী হবে শোরগোল তুলে? যে ইজ্জত গেছে তা কি ফেরত আসবে শোরগোল করলে? ঠিকাদার, পুলিশ এসব করে। পুলিশ না করলে ঠিকাদারের লোক করে। পুলিশ কখনো ঠিকাদারের বিপক্ষে যায় না, ঠিকাদার পুলিশকে মাসোহারা দেয়।
সেই লোকটা এলো আর একদিন। সেদিন পাণ্ডবকুমার ঘরে ছিল। লোকটা তাকে ডাকতে পাণ্ডবকুমার হাত জোড় করে, ‘আসুন সীতারাম বাবু’ বলে বেরিয়ে গেল। খাটিয়া টেনে তাকে বসিয়ে সে ধুলোমাটিতে হাঁটু গেড়ে বসল। হেসে হেসে কথা বলতে লাগল। আবার তেষ্টা পেল লোকটার। পাণ্ডবকুমার ডাকল সুভদ্রাকে, পানিহ্ দিবে?
সুভদ্রা চুপচাপ বসে থাকল। নড়েনি। পাণ্ডবকুমার ডাকল আরও দুবার, তারপর নিজে ঢুকে এলো ঘরের ভিতর। সুভদ্রাকে দেখল আগুন ভরা চোখে। নিজে ঘটি ভরা জল নিয়ে যেতে যেতে বলল, তুর তো ইজ্জতই নাই, কী ইজ্জতের ভড়ং করিস, মেয়্যামানুষ মেয়্যামানুষের মতো রহিবি, পানি দিতা কহিছি না, কহি নাই?
পাণ্ডবকুমার লোকটাকে জল খাইয়ে তাকে নিয়েই বেরিয়ে গেল। ফিরতে সেই বেলা দুপুর। সুভদ্রার ভয় হচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল না বছর পাঁচের চেনা স্বামীকে। তাদের সন্তান হয়নি। কেন হয়নি বুঝতে পারছিল না, মানত করেছিল হেথা হোথা, লঙ্কেশ্বরী ঠাকুরানের কাছে, দূর চন্দনেশ্বরেও। কিন্তু সন্তানহীনতার জন্য পাণ্ডবকুমারের সোহাগ যে ছিল না তা নয়। আগের মতো না থাকলেও পাণ্ডবকুমার তার স্বামী হয়েই আছে তো। সে লোক বদলে গেল কবে? পাণ্ডবকুমারকে চেনা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল এ তার স্বামী নয়, অন্য কেউ। অন্য কেউ তার স্বামী হয়ে ঘুরঘুর করছে চারপাশে। হায়! সেই পাণ্ডবকুমার গেল কোথায় যাকে নিয়ে সে মানত করতে গিয়েছিল চন্দনেশ্বর মন্দিরে?
দুপুরে পাণ্ডবকুমারের অন্য মূর্তি। সে বলল, সুভদ্রার বড় ভুল হচ্ছে নিশ্চয়।
না, মু ঠিক চিনিছি।
পাণ্ডবকুমার বলে, উ লক তো জিজ্ঞেস করছিলা সি রাতে কী হইছিলা তাহলে কি উয়ার স্মরণ নাই কী হঁইছিলা?
সুভদ্রা চুপ করে শুনছিল পাণ্ডবকুমারের কথা।
পাণ্ডবকুমার বলছিল, উ লক, সীতারাম মহান্তি, কত ভালো লক, তুর প্রশংসা করছিলা।
বুক হিম হয়ে যায় সুভদ্রার, কী কহ?
উ কহিছিলা গেরস্তর বউ, মেয়্যামানুষের মাথার উর’ম কাপড় থাকা দরকার, তা হিলে তাহার বিপদ হতোনি।
কী কহ?
হাঁ, তুর সরম ছিলা কম! পাণ্ডবকুমার নির্লিপ্ত মুখে বলল, ইখন সরম হইছে, ইটা আগে হিলে অমন হতোনি।
কী কহ! আর্তনাদ বেরিয়ে আসে সুভদ্রার মুখ দিয়ে।
ঠিকই কহি, পানি যাচে লকে, পানি যে না দেয়, উয়ার পাপ হয়।
উ তো শয়তান!
তুর ভুল হইছে।
না, কুনো ভুল নাই। সুভদ্রা ফুঁসে উঠেছে, তুমি টঙ্কা খাইছো, তুমি কি অমানুষ, তুমার মান নাই, তুমার পরিবারের সব্বনাশ হিলা, তুমি কিনা—
চুপ কর। তার মুখ চেপে ধরেছিল পাণ্ডবকুমার।
সুভদ্রা ছিটকে সরে গিয়েছিল। সে আর সহ্য করতে পারছিল না। বাদামি চোখের মণিটিকে সে ভুলতে পারছিল না। জোছনা রাতে খুব স্পষ্ট করে দেখেছিল সে লোকটাকে। তার কোনো ভুল হয়নি। গলার স্বর, কথা বলা সব মিলে গেছে। তার সব্বোনাশ করল যে লোক তাকে সে চিনতে পারবে না? কঠিন আঁধার থাকলেও চিনতে পারত। ঘোর অমাবস্যাতেও চিনতে পারত। তারার আলোতে চিনত। পৃথিবীর গায়ের আলোতেও চিনত। তাও যদি না থাকত নিজের চোখের আলোতে চিনত। নাক দিয়ে চিনত। গন্ধটা চিনে রাখত। সেই গন্ধই তাকে চিনিয়ে দিত। গন্ধ চিনিয়ে দিয়েছে। সুভদ্রা চিৎকার করে উঠেছিল, মোর সব্বনাশ করিছে, মুর ইজ্জত লিইছে, তুমি অরে ভিটায় লিয়ে আসো কেনে?
চুপ কর।
না, চুপ করিবনি। সুভদ্রা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। লাফ দিয়ে উঠোনে নামে, উ লক মোর ইজ্জত নিল, উ কিনা ভিটায় ফের আসে, উ লক ফের মোর ইজ্জত লিবে, তুমি কি পুরুষমানুষ, তুমি কি সেই লক, মোর সোয়ামি?
থাম সুভদরা, অসত্য কহিসনি।
অসত্য কহিব কেনে, হা হা তুমি কি অন্ধ। মু মেয়্যামানুষ, কী কহিব তুমারে?
থাম। গর্জন করে উঠেছিল পাণ্ডবকুমার, তুর সরম নাই মাগি, তুর ইজ্জত নাই, কীসব কহিস, পাঁচকান হিলে তুই সমাজে রহিতে পারিবি?
থোও তুমার সমাজ! গরগর করে উঠেছিল সুভদ্রা, তুমি উ লকেরে ই ভিটায় লিয়া আসো কেনে?
মোর ভিটা মোর ইচ্ছা। পাণ্ডবকুমার তাকে ঠেলে ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। সুভদ্রা চিৎকার করে উঠেছিল, হা জগন্নাথ মুর কী হিবে?
সুভদ্রার চিৎকারে একটি দুটি লোক দাঁড়িয়ে পড়েছিল ভিটের সামনে। উঠোনেও এসে দাঁড়িয়েছিল কারা যেন। সেই মহাপাত্রপুরের মানুষ, ‘দে-পাল রক্ষা সমিতি’র লোক। তারা খোঁজ নিয়ে বেড়াচ্ছিল কী হয়েছে সেই রাতে। তাদের একজন এগিয়ে এসেছিল, কী হইছে?
কিছু হয় নাই। পাণ্ডবকুমার বলেছে।
না হইছিলা। চিৎকার করে এগিয়ে এসেছিল সুভদ্রা, কী হইছে কহ।
পাণ্ডবকুমার আর চাপা দিতে পারেনি। আর পাণ্ডবকুমারের বউ সুভদ্রা যখন কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, তার ক্রন্দনধ্বনি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সেই ধ্বনি তখন দে-পালে থাকা অন্য চাষাবউদের সাহস ফেরাল। তারা ঘর থেকে বেরিয়ে বলতে লাগল লাঞ্ছনার কথা। ঠিকাদার না পুলিশ, জানে না, তারা মেয়েমানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। টর্চ ফেলে ফেলে দেখছিল। তারা কি তাহলে সুভদ্রাকে খুঁজছিল? তারা বলেছিল, এ মেয়েছেলে নয়। তার মানে তারা বিশেষ কোনো মেয়েমানুষ খুঁজছিল সেই রাতে। সেই মেয়েমানুষ কি তাহলে সুভদ্রা? চাষিবউরা বলছিল, তাদের গায়ে হাত দিয়েছিল তারা। লাথি মেরেছিল, অশ্রাব্য ভাষা বলেছিল। চাষিবউরা নিশ্চিন্ত হয়েছিল যে সম্ভ্রম যায়নি কারও। তারা এসে ভিড় করল সুভদ্রার চারপাশে। তারা সুভদ্রার পাশে বসে কাঁদতে লাগল। একসঙ্গে কাঁদতে লাগল। সেই কান্নায় ভিটে জমি হারাতে হচ্ছে তার জন্য, নাকি ধর্ষিতা সুভদ্রার জন্য তা বোঝা না গেলেও তাদের কান্নায় শোক ছিল। গভীর শোক। বেদনা ছিল। গভীর বেদনা। তারা কাঁদতে কাঁদতে সুভদ্রার গায়ে মমতার হাত বোলাতে লাগল। তারা সুভদ্রার রুখু চুলে খোঁপা করতে করতে কাঁদতে লাগল। সুভদ্রার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে কাঁদছিল সেই রাতের কথা স্মরণ করে। পুলিশ ছিল আর ছিল কটা মানুষ। তারা পুলিশ হতেও পারে, না হতেও পারে। তারা নেশাচ্ছন্ন হয়ে পুলিশের মোটা টর্চের আলোয় মেয়েমানুষ পছন্দ করছিল। হায়! সমস্ত পল্লিটা সেদিন যেন বারবনিতা পল্লির মতো ভেবে বসেছিল পুলিশ আর ঠিকাদারের লোক। শেষ পর্যন্ত সুভদ্রাকে পছন্দ করেছিল। হায়! চাষিবউরা বিলাপ করতে লাগল। বিলাপ করতে করতে সুভদ্রাকে বলতে লাগল, ছাড়বিনি, লক যদি চিনে ফেলিস তো ছাড়বিনি সুভদরা, পাণ্ডবকুমার কী কহে?
পাণ্ডবকুমার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর পুলিশ সুপারের সামনে নির্লিপ্ত মুখে বলল হুজুর কুছু দেখি নাই, বালেশ্বর গিইছিলাম, ফিরতে পারিনি।
কখন বাড়ি ফিরলে?
আঁজ্ঞা ভোরবেলা!
কী দেখলে।
কুছু না, পরিবার নিদ যাইছিলা, নিদ থিকে উঠি খিল খুলি দিলা।
তবে যে বউটি অভিযোগ জানিয়েছে?
পাণ্ডবকুমার বলল, উ বড় লকের বেপার, উসব মিছিলউয়ালারা অসত্য কথা কহিছে, মোর পরিবার কহে নাই।
কোথায় সে? ‘মানবাধিকার সংঘ’, ‘দে-পাল রক্ষা সমিতি’র লোক বলল।
সে বাপ-ঘরে।
ডাকো উহারে, বাপ-ঘর ঘিরে লিয়া আসো।
মোর পরিবার ইত লোকের সুমুখে আসিবেনি।
তুমি মিথ্যে বলছ।
না সত্য কহিছি, ইসব বানাইছেন আপুনারা, মিছিলউয়ালারা, মেয়্যাছেলের ইজ্জত লিয়ে ইসব কী কথা!
প্রমাণ হলো না। বারো দিন কেটে গিয়েছিল। ডাক্তারি পরীক্ষায় কিছুই মিলবে না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশকে জানানো হয়নি। আর ধর্ষিতার স্বামীই যখন না বলছে, ডায়েরি করছে না, তখন প্রমাণ তো হবেই না। ধর্ষিতা যে বয়ান দিয়েছিল মানবাধিকার সংঘ আর ‘দে-পাল রক্ষা সমিতি’র কাছে, তার সঙ্গে ধর্ষিতার স্বামীর বয়ান মিলছে না। না মিললে হবে কী করে? চাষিবউরা শুনে আবার কাঁদল যে যার ভিটের উঠোনে বসে।