1 of 2

অশ্বচরিত – ১৬

ষোলো

মহাপাত্রপুর, দে-পাল, কুসমাড়ের জমি একসঙ্গে অধিগ্রহণ হয়নি। একটু একটু করে হয়েছে। সমুদ্রতীরের এক অংশ, দে-পালের উত্তর-পশ্চিম সেনাবাহিনীর দখলে তো ছিলই। কাঁটাতারে ঘেরা ছিল। চাঁদমারি ছিল ভিতরে। সমুদ্রে কামানের গোলা গিয়ে পড়ত। ওদিকটায় জেলে নৌকো তার অভ্যাসেই যেত না। এই অভ্যাস তো অনেক কালের। এখন জানা যাচ্ছে দে-পালের বাকি অংশটায় নোটিশ করা ছিল। সরকার তার প্রয়োজনে ভবিষ্যতে নেবে। এখন আরও জানা যাচ্ছে নোটিশ দেয়া ছিল মহাপাত্রপুর এবং কুসমাড়েও। ভীমাপুরেও ছিল নোটিশ। সেই সব নোটিশ প্রায় বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ আগের। ভূমি অধিগ্রহণ দপ্তর বালেশ্বর থেকে নোটিশ পাঠিয়ে জানান দিয়েছিল মানুষকে যে, ওই সব জমি যেকোনো মুহূর্তেই সরকার দখল নেবে। কিন্তু সেই প্রাথমিক নোটিশের পর সরকার চুপচাপ হয়েছিল তো এত বছর। সেই পঁয়ত্রিশ বছর আগে যে উদ্বেগ ছড়িয়েছিল মানুষের ভিতর তা ক্রমে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। তারা জানত সরকারের কখনো মনে হয়েছিল এই সব অঞ্চল অধিগ্রহণ করে কিছু করা যেতে পারে। পরে সরকার ভেবে দেখেছে তা করে লাভ নেই, সুতরাং পকিল্পনা ত্যাগ করেছে সরকার। ভূমি অধিগ্রহণের নোটিশে, ভূমি অধিগ্রহণের কথাই ছিল, তাতে কোন কারণে অধিগ্রহণ তা উল্লেখ করা হয়নি সেই সময়ে, সুতরাং মানুষজন জানতও না কেন নোটিশ পড়েছিল। কেউ কেউ বালেশ্বরে গিয়ে জেনে এসেছিল যে নোটিশটা সেনাবাহিনীর কারণে। আবার যারা তা জানিয়েছিল, তারা এ কথাও বলেছিল ওই রকম বহু জায়গায় বহু কারণে নোটিশ পড়ে, তারপর আর কাজ হয় না। প্রকল্প বাতিল হয়। এগোয় না কাজ, সুতরাং ওই নোটিশও যে উচ্ছেদের তা মনে করার কোনো কারণ নেই। মানুষজন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল সরকার তরফে আর কোনো চাঞ্চল্য না দেখে।

তারপর তো এত বছর কেটে গেছে। এত বছরে পুরনো অনেক মানুষ চলেও গেছে। পঁয়ত্রিশ বছর আগে যারা জমি হারাবার ভয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বালেশ্বর, কটক ছুটোছুটি করেছিল তাদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছে অশক্ত হয়ে, তারাও গতায়ু মানুষের মতো বাকি জীবনটুকু নিরুদ্বেগ হয়েই কাটিয়ে দিতে পারবে ভেবেছিল। কিন্তু তা হয়নি। আচমকা দ্বিতীয় নোটিশ পড়ল এত বছর বাদে। তারপর তৃতীয় নোটিশ। খবরের কাগজে ঘোষিত হলো গ্রামসমূহের দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর। তখন জানা গেল দে-পালের যতটুকু দখলে ছিল সেনাবাহিনীর, তার চেয়ে বেশি অংশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে গেজেট প্রকাশ করে, খবরের কাগজে ঘোষিত করে সরকার কাগজে-কলমে দখল নিয়ে নিয়েছিল। তখন নাকি ক্ষতিপূরণও নিয়েছিল অনেকে বালেশ্বর, ভুবনেশ্বরে গিয়ে। যারা নেয়নি তারা নিতে পারে তা এখনও। টাকা কোর্টে জমা আছে, কিন্তু আশ্চর্যের যে, তখন কাগজে- কলমে ভূমি অধিগ্রহণ দপ্তরের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা দপ্তর জমি বুঝে নিয়ে ফেলে রেখেছিল। ছুঁয়েও দেখেনি। আর তাই পুরনো, আদি বাসিন্দারা ধরে নিয়েছিল সরকার নেবে ভেবেছিল, কিন্তু নেবে না। ক্ষতিপূরণ দিয়েও কত জমি শেষ অবধি নেয় না সরকার, এ কথা তো বালেশ্বর গিয়ে তারা শুনে এসেছে। সরকারের কোনো আমলা হয় মনে করেছিল ওই জমি নিতে হবে, পরে অন্য আমলা ভেবেছে না নিলেও তো হয়। সরকারের টাকা কত দিকে কত ভাবে যায়, সুতরাং ক্ষতিপূরণের টাকাও হয়তো গেছে সেই ভাবে। জনসাধারণ জানে সরকারই মালিক, টাকার মালিক—সুতরাং ও টাকা গেলে কী হবে সরকারের? দে-পাল থাকবে দে-পালের মানুষের কাছেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলো কী?

শেষ পর্যন্ত, তা পঁয়ত্রিশ বছর বাদে হলেও দে-পাল থাকল না দে-পালের মানুষের কাছে। এই ঘটনা থেকে ধরা গেল যে, সরকারি চিঠি এমনি এমনি আসে না। সরকারি নোটিশ ফেলনা নয়। তার ভাষা বিবরণ প্রায় সবটাই অবোধ্য হলেও যে আইন এবং আইনের ধারা মোতাবেক নোটিশ বা চিঠি আসে তার ক্ষমতা অপরিসীম। ওই আইন বা আইনের ধারা বলে একশ-দুশ বছরের প্রাচীন বাসিন্দা, পরিবারকে উচ্ছেদ করা সহজ ব্যাপার। আর নোটিশে যাঁর স্বাক্ষর থাকে, বা যাঁর হয়ে যিনি স্বাক্ষর করেন জেলার সেই কালেক্টর বাহাদুরের ক্ষমতার কোনো শেষ নেই। তিনিই জেলার মাথা। তাঁর কথাই শেষ কথা। আর তিনি এমন কোনো কাগজে স্বাক্ষর করেন না যে কাগজ অগ্রাহ্য করা যায়। যে নোটিশ ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে ফেলা যেতে পারে সেই নোটিশ কালেক্টর বাহাদুর কেন পাঠাবেন?

পঁয়ত্রিশ বছর আগে কালেক্টর বাহাদুর যে নোটিশ পাঠিয়েছিলেন এই গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে, সেই নোটিশ সক্রিয় হলো এতদিন বাদে। এতদিন বাদে ধরা গেল বালেশ্বর গিয়ে পঁয়ত্রিশ বছর আগে যা জেনেছিল দে-পালের মানুষজন, তা অর্ধসত্য। কোনো প্রকল্প সরকার ত্যাগ করে বটে, কিন্তু বেশির ভাগ প্রকল্পই ত্যাগ করা হয় না। প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থ কমে গেলে ফাইল চাপা পড়ে থাকে অন্য ফাইলের নিচে। বরাদ্দ অর্থ এসে গেলে ফাইল জেগে ওঠে। আর একটি সত্য এই যে, প্রকল্প যদি বাতিল হয় তবে পূর্বের নোটিশ বাতিল করে কালেক্টর বাহাদুর নতুন নোটিশ পাঠান। পঁয়ত্রিশ বছর অনধিগ্রহণের কোনো নোটিশ যখন আসেনি, প্রকল্প জীবিতই ছিল। তার বলে দে-পাল চলে গেল সরকারের হাতে আচমকা আবার। আর যে জমি আগে কাগজে-কলমে দখল নিয়েছিল সরকার, যে জমি পঁয়ত্রিশ বছর আগে দখল নিয়ে ফেলে রেখেছিল সেনাবাহিনী সকলের অজ্ঞাতে, সেই জমির বেশির ভাগটাই ছিল সরকারের খাসজমি, তা এক সকালে খুঁটি দিয়ে কাঁটাতার দিয়ে দখলের কাজ আরম্ভ করলে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের সংঘাত শুরু হলো।

লোকে জানল এমনভাবে হয়। কী হয়? না, সরকারি কাজ হয়। পঁয়ত্রিশ বছর আগে কাগজে-কলমে কৃষিজমির দখল নিয়েও তা সরকার ফেলে রাখতে পারে। বিশেষত প্রতিরক্ষা দপ্তর, বিমানবাহিনী, বিমান পরিবহন, স্বাস্থ্য দপ্তর, এমনভাবে ফেলে রাখে। প্রয়োজনে ঘিরে নেয়। অথচ উপকূলের ওই জমির সবটা কিন্তু পঁয়ত্রিশ বছর আগে কৃষিযোগ্য ছিল না। ওই জমির ভিতর বালিয়াড়ি ছিল, কেয়াবন ছিল, বুনোগুল্মে ভর্তি অকৃষি জমি ছিল। জমি তো একভাবে চিরকাল থাকে না। কোনো জমিই না। এই পঁয়ত্রিশ বছরে প্রতিরক্ষা দপ্তরের কাগুজে জমিতে পরিবর্তন হয়েছিল অনেক। বালিয়াড়ি ভেঙে, বালি সরিয়ে সেই জমি কৃষিযোগ্য করে তুলেছিল দখলিকার চাষা। কেয়াবন সাফ করে সেখানে চাষের ব্যবস্থা করেছিল চাষা। কোথাও ধান, কোথাও তরমুজ, কোথাও চিনাবাদাম। জমির রকমে ফসলও নানা রকম। ফসল ফলাতে ফলাতে ওই জমিতে ঘরও বেঁধেছিল কেউ কেউ। ঘর বেঁধে সংসার পেতেছিল। নারকেল গাছ বড় করেছিল, পুকুর কেটেছিল। পঁয়ত্রিশ বছরে বেশ কয়েকটি নারকেলকুঞ্জ তৈরি হয়ে গিয়েছিল দে-পালের ওই অংশে। ওটি ছিল চাষাপাড়া। যারা কোনো দিন নিজস্ব জমির মুখ দেখেনি তারা জমি পেয়েছিল ওখানে। খুব সরেস জমি। দে-পাল, কুসমাড়, মহাপাত্রপুর, ভীমাপুরের সবই পাল জমি। চর জমি। পয়স্থি হয়ে সমুদ্র থেকে ওঠা জমি। আরও পুবদিকে সুবর্ণরেখা থেকে ওঠা চর জমি। এই সমস্ত জমি কুমারী প্রায়। পেটে ফসল ধরল কবে যে জীর্ণ করে ফেলবে গর্ভাশয়? এই সমস্ত জমিতে যে ফসল হোক; ধান, পান, তরমুজ, চিনাবাদাম, যেখানে যেরকমে যা হোক, হয় অঢেল। অফুরন্ত। যেন বাতাসে বীজ উড়ে এলেই আপনা আপনি ফসল হতো। এসব জমির বয়স একশ থেকে দেড়শর বেশি নয়। মাটির পৃথিবীর বয়সের পরিপ্রেক্ষিতে তা আর কতটুকু? শদেড়েক বছর আগের এক প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, বন্যা এই বালিমুণ্ডা, বালিয়াপাল, বালেশ্বরে অনেক জমি তুলেছিল মোটা পলির আস্তরণ ফেলে। সেই জমিতে বানিগাছের জঙ্গল হলো। সেই জঙ্গল সাফ করে এই সমস্ত এলাকায় অনেকটা কৃষিজমির উৎপত্তি। সেই সব জমি পঁয়ত্রিশ বছর আগের নোটিশের সূত্র ধরে যখন দখল করতে এলো সরকারি সার্ভেয়রের দল, দে-পালের মানুষ সংঘাতে গেল। কেননা সংঘাতে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সংঘাতে না গেলে তাদের ঘরবাড়ি, ধানজমি, তরমুজের খেত, চিনাবাদাম খেত, নারকেল বন, বরজ, কাজুবাদামের সামান্য চাষ, কাজু বাদামের হালকা বন, সব রাতারাতি ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছিল। সরকারি আদেশ মানে পুলিশের নির্দেশ। কেমন ছিল তা। দিন কুড়ি সময় দিয়েছিল পুলিশ; মিলিটারির জন্য ছাড়তেই হবে। কে বলেছিল সরকারি জমিতে ঘর বাঁধতে, চাষবাস করতে? সরকার তো বলেনি। জমির কোনো কাগজ আছে কারও কাছে? ছিল না। সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েছিল পরস্পরের মুখের দিকে যে, জমির কোনো কাগজ তাদের কাছে নেই বলে পুলিশ চোখ রাঙাচ্ছে। তারা জানত সরকারি জমি। তারা কানাঘুষো শুনেছিল জমিতে নোটিশ পড়েছিল পঁয়ত্রিশ বছর আগে। সে আমলের মানুষ এখন আর কোথায়? তারা এও জানত যে, ওই নোটিশের কোনো মানে ছিল না। ওই নোটিশ তামাদি হয়ে গেছে। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে কোনো নোটিশ সক্রিয় থাকে?

তারা সবই ভুল জানত। এখন তা থানার মেজকর্তার চোখ রাঙানিতে সব বুঝতে পারছিল। তারা অনেকবার গেছে বালেশ্বরে, ওই জমি যদি লিজ পায় তো বেঁচে যায়। সরকার লিজ দিক তাদের, তারাও সরকারকে খাজনা দিয়ে অধিকার পাকা করে নেবে। কিন্তু লিজ আদায় করতে পারেনি। এত বছরেও সরকার লিজ দেয়নি কারণ ওই জমিতে নোটিশ পড়েছিল। বালেশ্বরে ল্যান্ড রেভিনিউ অফিস তখনও বলেছিল লিজ না নিয়ে তো চলছে। কেউ তো কাউকে উচ্ছেদ করছে না বা সরকার তো উচ্ছেদ করছে না, যে লিজ দলিল নিয়ে অধিকার পাকা করতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারি লোকই তো এলো উচ্ছেদ করতে। থানার পুলিশ চোখ রাঙিয়ে নারকেলের কাঁদি ভেঙে, তরমুজের খেত তছনছ করে, চিনাবাদাম খেত মাড়িয়ে দখল নিতে লাগল। জমি যখন সরকারের, তখন জমির ফসলে তো সরকারি লোকের অধিকার। গ্রামের মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে তাড়া করল সার্ভেয়রের দল আর পুলিশকে। পুলিশ সাময়িক পালালেও, রাত্তিরে সেজেগুজে এলো গ্রামে। বন্দুক উঁচিয়ে ঘরে ঘরে টর্চ মারতে লাগল। পছন্দমতো মেয়েমানুষ খুঁজতে লাগল।

দে-পালের লোকের সংঘাতে যাওয়া ছাড়া পথ ছিল না। মিলিটারির হাতে চলে যাচ্ছিল বহু বছরের শিকড়। সেই সূত্রে পুলিশ রাতে গাঁয়ে ঢুকে টর্চ মারতে মারতে ঘর থেকে টেনে বের করছিল জোয়ান পুরুষ। জোয়ান পুরুষ এবং যুবতীও। দুপুরে সার্ভেয়রের দলকে তাড়া করেছিল যারা, তাদের ভিতর মেয়েরাও তো ছিল। পুলিশ জানত, পুরুষগুলো ভয় পেতে পারে তাদের ঘরের মেয়েদের বে-আব্রু করে দিলে। কিন্তু বে-আব্রু সত্যিই পুলিশ করেছিল কি না, মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল কি না পুলিশ এবং কাঁটাতার বসানোর ঠিকেদারের মাস্তান বাহিনী, সে কথা বলার মতো তো কেউ ছিল না। কোন মেয়ে তার লাঞ্ছনার কথা বলে? বলে না, বলতে পারে না বলেই তো ধর্ষণ, লাঞ্ছনাই পুলিশের হাতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

ঘরে ঘরে টর্চ মেরে মেয়েমানুষ টেনে বের করে পুলিশ আর ঠিকেদারের লোক ভয়তাড়িত করে দিয়েছিল চাষাদের। সেই রাতের পর কাঁদতে কাঁদতে তারা বহুদিনের বসবাস তুলে, ঘরবাড়ি, গাছগাছালি, জমিজমা ছেড়ে সমুদ্রের মায়া ছেড়ে যাত্রা করে অন্যত্র। তাদের কেউ কেউ মহাপাত্রপুর, কুসমাড়, ভীমাপুরের দিকে গেল, কেউ কেউ গেল বালিমুণ্ডার পথে। হাইরোডের গায়ে ঝুপড়ি তুলল। নিরাবরণ ঘরে ঢুকে কাঁদতে লাগল। আশ্চর্য! এসবের পরেও কেউ কেউ থেকে গেল। মহাপাত্রপুর, কুসমাড়, ভীমাপুরের মানুষ তাদের পিছনে দাঁড়াল। একসঙ্গে মিছিল করল। সেই রাতের কথা কানে কানে রটতে লাগল।

ভানু অবাক, এত কাণ্ড, বাবু কিছু জানে না?

জানে। রামচন্দ্র বলে।

বাবু কী বলেছিল?

কহিছিলা ইসব নিয়া মাথা না ঘামাতে।

ভানু বলল, বাবু তো মোরেও কিছু কহেনি।

কহিবে কেনে, বাবুর কী? ই জায়গায় বাবুর চাষবাড়ি, আর তো কুছু লয়, টঙ্কা মিলি গিলা তো হই গিলা, বাবুর ভিটাও নাই ইখানে, মেয়াছেলাও নাই যে পুলিশ অসি বে-ইজ্জত কইরবে।

সেটা ছিল ফাল্গুনের শেষ। রাতে শীত পড়ে, দিনে গরম। ধানমাঠ খাঁ খাঁ। তরমুজ ফলেছিল বালিজমিতে। খুব বড় হয়নি তখনও। তবু খেত পাহারায় ছিল কিছু মানুষ। পুলিশ ঢুকল বড় বড় টর্চ হাতে। সঙ্গে লোক ছিল। তারা ধর্ষণের রকম জানে। পুলিশ নিজে ধর্ষণ করেনি। তারা করেছিল। তবে তাদের ভিতরে প্লেন ড্রেসের পুলিশ ছিল কি না কে জানে? সমস্ত রাত ধরে তছনছ করে পুলিশ সবকিছু। খুব সাজানো গ্রাম ছিল খাস দে-পাল! সমস্ত রাত মত্ত হাতির মতো তারা ভেঙেছিল সবকিছু। সব জানা গেল পরদিন। পুরুষরা এসে বলল, এসব কথা না বলতে। পুলিশ যখন ওসব করেছে তবে আর থাকা যাবে না। কথাগুলো উড়ছিল খুব চাপা হয়ে দু-চার দিন ধরে, কিন্তু কেউ বলছিল না। প্রথমে বলেছিল সুভদ্রা। পাণ্ডবকুমারের বউ সুভদ্রা মুখ খুলল গাঁয়ের লোকের কাছে। সুভদ্রার খবর বালেশ্বর পৌঁছে গেল, ভুবনেশ্বর পৌঁছে গেল। খবরের কাগজের লোক ছুটে এলো দশ দিক থেকে। কী সাহস মেয়্যামানুষটার! রামচন্দ্র বিড়বিড় করছে।

ডাক দেখি সুভদরারে।

উ কহিবে না।

কেন?

ডরায় ইখন।

ভানু বলল, আমি এখন বালিমুণ্ডা যাব না, ওকে ডাক।

বালিমুণ্ডা যাওয়া হলো না। দূর দে-পাল, মহাপাত্রপুরের দিক থেকে মেঘ উঠল। সেই মেঘে আলো মরেই গেল প্রায়। মেঘ গর্জন করতে লাগল থেকে থেকে। বৃষ্টিও এলো দশ দিক ভাসিয়ে। সেই বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রামচন্দ্র, ই জায়গায় মায়া বসি গিইছে, সব যদি গরমিন লিয়ে লেয় কুনথে যাবু? বাবু যদি কহে ইবার তু যা রামচন্দর, কী কইরব? হুটেল মোর পোষাবেনি।

সুভদ্রার সমস্ত দিন সময়ই হয় না। আসলে সে এড়িয়ে যাচ্ছিল। রান্নাবান্না করে বৃষ্টির ভিতর তাল-পেখ্যা মাথায় কোথায় যে উধাও হয়ে গেল, দুপুরে খেয়েছে কি খায়নি তাও বোঝা গেল না। ফিরল সন্ধেয়। তখন চরাচরে অন্ধকার ঘন। কালো রঙের ওপর রং পড়ছে আরও কালো। মাথা অনেকখানি ঘোমটাতে ঢেকে সুভদ্রা বলে, নায়েব সবু জানে, মোকে কেনে কহিতে কহ মশায়?

রামচন্দ্র বলে, আপন কথা আপনিই কহা ভালো।

মাথা নাড়ে সুভদ্রা, বলে, কহিতে ঘিন্না লাগে, ডর লাগে, মোর সোয়ামি যাহা কহিছিলা উ ঠিকই ছিলা, সি রাতির কথা লুকাই গিলে মোকে ই যন্তন্না সহিতে হতোনি।

ভানু বলল, তুমি যাও, তোমাকে বলতে হবে না!

সুভদ্রা উঠে গেল। উঠে যেতে ভানু যেন নিশ্চিন্ত হলো। সত্যি তো সুভদ্রার মুখে তার লাঞ্ছনার কথা শুনত কী করে ভানু? মেয়েমানুষ তার লজ্জার কথা বলতে পারে? সুতরাং উঠে গিয়ে বসে আছে ঢালা বারান্দার আর একদিকে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে পাথর। ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। জোলো হাওয়া বইছিল। ভানুর আচমকা মনে পড়ল বিষ্ণু পাতরের কথা। সে কোথায়? এলো না সমস্ত দিন। রামচন্দ্ৰ শুনে বলল, কামকাজ মিলে গেছে তাই আসেনি, রোয়া বুনার কাল, ইখন তো কাজ অনেক, কেউ বসে থাকেনি।

কিন্তু ও তো জমি বন্দোবস্ত নেয়ার জন্য দীঘা পর্যন্ত দৌড়েছিল?

তা ঠিক, আবার আসিবেও, কিন্তু বেকার হউক, তখন আসিবে, আর ইখেনে বন্দোবস্ত লিয়া মানে পরে টঙ্কা মিলিবে গরমিন লিলে, সেই জন্য। ভানু আবার সুভদ্রার প্রসঙ্গ তোলে, তার কথা কি কহিবে নায়েব?

হাঁ কহিব, কিন্তু কী যে কহি, উয়ার সোয়ামি ঘরে ছিলনি সি রাতে, ঘরে ফিরেনি, পাণ্ডবকুমার গিঁইছিলা বালেশ্বর, সি রাতে যে সি বালেশ্বর রহি যাবে ইমন কুনো কথাও ছিলনি, বালেশ্বরে কুনথে রহিবে পাণ্ডবকুমার? সি ছিল ফাগুন মাস, পুন্নিমের আটো দিন বাকি, জুছনা ছিলা, বাতাসে বাস ছিলা নিম পুষ্পর, কী শেতলই না ছিলা রাতখানি, সুভদরা হুঁকাইতে পারে নাই, উয়ারে ঘর থিকে টানি বাহিরে নি এলা তাহারা, সি বড় যন্তন্নার কথা।

সোয়ামি কখন ফিরল?

সকালা, ভোর ভোর, তখনও কানছিলা সুভদরা, রাতভর কানছিলা, পাণ্ডবকুমার ঘুরতে উয়ার পরে ঝাঁপাই পড়িলা, মুর সব্বোনাশ হই গিলা, তুমি কুনথে ছিলা রাতভর।

রাতজাগা পাণ্ডবকুমার তখন হাত চাপা দিল বউয়ের মুখে, চুপ যা, লকে যেন না জানে, মেয়্যামানুষের ইজ্জত গিইছে ই কথা লকে জানলে বড় বিপদ, লকে তুরে দোষ দিবে, ঘর থিকে বাহার যাবিনি।

সুভদ্রা বলল, থানায় যাবু ত?

না, উয়াদের দলে পুলিশ ছিলা।

থাকুক, তবু থানায় যাবু ত?

পাণ্ডবকুমার মাথা নাড়তে লাগল, বলল, ঠিকাদার আর পুলুশের লক ইসব করিছে, তুই চুপ কর, ভুলি যা, থানায় গিয়া পুলুশের নামে কি ডায়রি দিব?

কী হলো তখন?

সুভদরা চুপ ইঁই গিলা, মেয়্যামানুষ তো বটে, ইজ্জত লুটের কথা কহে কী করে, আর পাণ্ডবকুমার তো ঘরে থাকে, বাহারে যায় ঘরে ফিরে, মাথা নাড়ে, কুনো কথা কহা যাবেনি, পুলুশ হাজতে ভরি দিবে কহিছে।

কখন কহিলা? সুভদ্রা কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করে।

পাণ্ডবকুমার চুপ করে থাকে। কিছুই বলে না, তারপর একদিন দেখল তার স্বামী পাণ্ডবকুমারের সঙ্গে একটা লোক ভিটের উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সুভদ্রা ভয়ে হিম হয়ে যায়। মুখটা পরিষ্কার চেনা যায়।

সত্যি বলছ? ভানু জিজ্ঞেস করে।

হাঁ, সুভদরা ভঁরাই গিলা, লকটারে সি তো ভুলে নাই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *