অশুভ সংকেত – ১০

দশ

ক্যাথির চোট পাওয়ার অজুহাতে অফিস থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিল রবার্ট স্টাফদের সে জানাল রোম থেকে ক্যাথির জন্যে হাড়-বিশারদ আনতে যাচ্ছে-কিন্তু তার এই যাত্রার আসল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। হেবার জেনিংসকে সব কথাই খুলে বলেছে সে। ওর পরামর্শ মতই একেবারে গোড়া থেকেই—অর্থাৎ ডেমিয়েনের জন্ম যে হাসপাতালে সেখানেই খোঁজ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা।

রোম ট্রিপের জন্যে একটা প্রাইভেট জেট চার্টার করল রবার্ট। রওনা হবার আগে হেবার নিজেকে ব্যস্ত রাখল রিসার্চের সামগ্রী জোগাড় করে। বাইবেলের কয়েক ধরনের ব্যাখ্যা আর প্রেততত্ত্বের ওপর গোটা তিনেক বই জোগাড় করেছে সে। রবার্ট পেরিফোর্ডে ফিরল নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিতে। হ্যাট আর কালো চমশাও সাথে নিল সে যেন সহজে তাকে কেউ চিনতে না পারে।

পেরিফোর্ড অস্বাভাবিক রকম শান্ত, চুপচাপ। খালি বাড়ির ভিতর ঘুরে টের পেল মিসেস হর্টন চলে গেছে—সাথে তার স্বামীও গেছে। গাড়ি দুটো গ্যারেজে পাশাপাশি পার্ক করে রেখে গেছে সে।

‘ওরা চলে গেছে,’ থর্ন রান্নাঘরে ঢুকতেই বলে উঠল বেল্‌ক।

সিল্কের ধারে কাজে ব্যস্ত মেয়েটা। সব্জি কুটছে—মিসেস হর্টন যেমন করে কুটত ঠিক তেমনি।

‘বাইরে গেছে?’ প্রশ্ন করল রবার্ট।

‘না, একেবারে চাকরি ছেড়ে দিয়ে গেছে। একটা ঠিকানা রেখে গেছে ওদের গত মাসের বেতন পাঠাবার জন্যে।’

দুঃখ পেল রবার্ট।

‘কেন গেল বলেছে কিছু?’

‘চিন্তার কিছু নেই, স্যার, আমি সব সামলাতে পারব।’

‘কারণ একটা নিশ্চয়ই দেখিয়েছে ওরা?’

‘বলে থাকলেও আমার কাছে বলেনি। এমনিতেই আমার সাথে বিশেষ কথা বলত না ওরা। লোকটারই যাওয়ার গরজ ছিল বেশি। আমার মনে হয় মিসেস হর্টন থাকতেই চেয়েছিল।’

করুণ চোখে মেয়েটার দিকে চাইল থর্ন! ডেমিয়েনকে ওর সাথে একা রেখে যেতে মন সরছে না-ভয় পাচ্ছে, কিন্তু উপায়ও নেই, তার যেতেই হবে।

‘আমি কয়েক দিনের জন্যে বাইরে গেলে তুমি একা চালাতে পারবে?’

‘পারব, স্যার। দু’সপ্তাহের আন্দাজ বাজার করা আছে। ডেমিয়েনও বাড়ির এই নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।’

মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়াল রবার্ট।

‘মিসেস বেল্‌ক?’ ডাকল রবার্ট।

‘জ্বী, স্যার?’

‘ওই কুকুরটা।’

‘হ্যাঁ, ওটাকে আজকের দিনের মধ্যেই বিদায় করা হবে।’

‘ওটা এখনও এখানে রয়েছে কেন?’

আমরা ওকে অনেক দূরে গ্রামের মধ্যে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম—কিন্তু ঠিকই পথ চিনে ফিরে এসেছে কুকুরটা। গতরাতে…মানে ওই দুর্ঘটনার পর দেখি দরজার ধারে বসে আছে। অ্যাকসিডেন্টের পর থেকেই ডেমিয়েন খুব মনমরা ছিল-কুকুরটাকে নিজের ঘরে রাখতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করছিল ও। আমি ওকে বলেছি আপনি এটা পছন্দ করবেন না—কিন্তু ওর মনের অবস্থা দেখে…’

‘আমি ওটাকে আর এই বাসায় দেখতে চাই না।

‘ঠিক আছে, স্যার, আমি আজই হিউমেন সোসাইটিকে ফোন করে ব্যবস্থা করছি।’

ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে ঘুরলো রবার্ট। ‘মিস্টার থর্ন?’

‘বল?’

আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?’

‘ভাল, দ্রুত উন্নতি হচ্ছে তার।’

আপনি বাইরে গেলে ছেলেটাকে একদিন তার মাকে দেখতে নিয়ে যেতে পারি?’

একটু ভাবল থর্ন। একটা তোয়ালে তুলে নিয়ে হাত মুছছে বেল্‌ল্ক। একেবারে ঘরোয়া সংসারী মেয়ের প্রতিচ্ছবি। তবু মেয়েটাকে সহ্য করতে পারে না কেন সে?

‘তার দরকার নেই—ফিরে এসে আমিই নিয়ে যাব ওকে।

‘তাই হবে, স্যার।’

ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে চলে এল রবার্ট ডক্টর বেকারের সাথে আলাপ করে জানল ক্যাথি জেগেই আছে আর মোটামুটি ভাল বোধ করছে। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালে ভাল হবে বলায় বেকারকে সে ডক্টর গ্রীয়ারের টেলিফোন নাম্বার দিল। এরপরে ক্যাথির কামরায় ঢুকল রবার্ট। ওকে দেখে দুর্বল ভাবে একটু হাসল ক্যাথি।

‘হাই,’ বলল রবার্ট।

‘হাই,’ ফিসফিস করে জবাব দিল ক্যাথি। ‘ভাল বোধ করছ?’

‘কিছুটা।’

‘ওরা বলল খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে তুমি।’

‘তাই?’

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ক্যাথির বিছানার পাশে বসল রবার্ট। অসুস্থ অবস্থাতেও অপূর্ব দেখাচ্ছে ক্যাথিকে। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে তার চুলে পড়েছে।

‘তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে,’ বলল ক্যাথি।

‘আমি তোমার সম্বন্ধে ঠিক ওই কথাই ভাবছিলাম,’ জবাব দিল থর্ন।

‘আমার চেহারা একটা দেখার মত চেহারাই হয়েছে বটে, বুঝতে পারছি,‘ হাসল ক্যাথি।

ওর হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে চোখে চোখে চাইল রবার্ট।

‘খারাপ দিন পড়েছে আমাদের,’ মৃদু স্বরে বলল ক্যাথি।

‘হ্যাঁ।’

‘কোনদিন কি আবার সব ঠিক হবে?’

‘আমার তো মনে হয় হবে।’

করুণ ভাবে একটু হাসল ক্যাথি। হাত তুলে রবার্ট ওর চোখের ওপর থেকে এক গোছা চুল সরিয়ে দিল।

‘আমরা মানুষ ভালই, তাই না, রবার্ট?’

‘আমি তো তাই বিশ্বাস করি।

তবে আমাদের সব কিছুই এমন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে কেন?’

জবাব খুঁজে না পেয়ে মাথা নাড়ল রবার্ট।

‘আমরা যদি খুব খারাপ লোক হতাম…’ মৃদু স্বরে বলে চলল ক্যাথি। … তবে মেনে নিতাম যে ঠিক আছে, এটাই আমাদের প্রাপ্য ছিল। আমরা কি কোন ভুল করেছি? কবে, কখন আমরা ভুল করলাম?’

‘জানি না আমি,’ ধরা গলায় বলল থর্ন।

এমন নিষ্পাপ আর ভঙ্গুর মেয়েটা, ভাবাবেগে ভেসে গেল রবার্টের মন।

‘এখানে নিরাপদ থাকবে তুমি,’ নিচু গলায় বলল রবার্ট। ‘আমি কয়েক দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি।

ক্যাথির চেহারার কোন পরিবর্তন হল না—এমন কি কোথায় যাচ্ছে তা-ও জানতে চাইল না সে।

‘কাজে যেতে হচ্ছে আমাকে—এড়ানোর উপায় নেই।’

‘কত দিন?’

‘তিনদিন। রোজ একবার ফোন করে তোমার খবর নেব আমি।

মাথা ঝাঁকাল সে। ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে রবার্ট ঝুঁকে পড়ে ক্যাথির ছিলে যাওয়া গালে আলতো করে একটা চুমো খেল।

‘রবার্ট?’

‘উঁ?’

‘ওরা আমাকে বলছিল আমি নাকি নিজেই লাফিয়ে পড়েছি।’ চোখ তুলে তাকাল ক্যাথি, ওর চোখের দৃষ্টি বিভ্রান্ত, শিশুর মত।

‘তোমাকেও কি তাই বলেছে ওরা?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু তা কেন করব আমি?’

‘জানি না,’ জবাব দিল থর্ন। ‘সেই উত্তরটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।’

‘আমার কি মাথা খারাপ?’

স্থির দৃষ্টিতে ক্যাথির দিকে চাইল রবার্ট। তারপর আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল।

‘হয়ত আমাদের সবারই মাথা খারাপ।’

‘আমি লাফ দেইনি,’ অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে বলল ক্যাথি। ‘ডেমিয়েন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল আমাকে।’

নীরবতার মাঝে কেটে গেল কিছুটা সময়। তারপর ধীর পায়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এল থর্ন।

ছয় সিটের লিয়ার জেটে যাত্রী কেবল রবার্ট আর হেবার। অন্ধকার আকাশ চিরে এগিয়ে যাচ্ছে প্লেন। হেবার তার বইপত্র খুলে ছড়িয়ে বসেছে আর বারবার রবার্টকে খোঁচাচ্ছে ট্যাসোন কি কি বলেছিল মনে করার জন্যে।

‘মনে পড়ছে না আমার,’ তীব্র মানসিক অশান্তি নিয়ে জবাব দিল রবার্ট। ‘সব কিছুই এখন আমার কাছে ঝাপসা।’

‘প্রথম থেকে শুরু করুন—যা মনে পড়ে বলে যান।

প্রথম দেখা থেকে আরম্ভ করে পার্কে দেখা হওয়া পর্যন্ত সবই আবার হেবারকে শোনাল রবার্ট। পার্কেই সে ওই অদ্ভুত কবিতাটা আবৃত্তি করে।

‘একটা কিছু…সমুদ্র থেকে উঠবে…’ বিড়বিড় করে বলল রবার্ট, মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। …মৃত্যু…আর সৈন্যদল…রোমান সাম্রাজ্য…’

‘এতে চলবে না, আরও ভাল করে মনে করার চেষ্টা করুন।’

‘মনের অবস্থা খারাপ ছিল আমার। আমি ধরেই নিয়েছিলাম লোকটা পাগল—তাই ভাল করে শুনিনি আমি।’

‘কিন্তু শুনেছেন আপনি-আপনার কাছেই আছে পুরো ঘটনার চাবিকাঠি। মনে করতেই হবে আপনাকে।’

চোখ বুজে সমস্ত মনের জোর একত্রিত করে মনে করার চেষ্টা করল রবার্ট।

‘মনে পড়ছে…আমাকে খ্রিস্টের ভোজে যোগ দিতে বলেছিল সে। বলেছিল, যীশুর রক্ত পান করতে হবে…হ্যাঁ এই কথাই বলেছিল।’

‘কিসের জন্যে?’

‘শয়তানের পুত্রকে পরাস্ত করার জন্যে। সে বলেছিল যীশুর রক্ত পান করলেই একমাত্র শয়তানের সন্তানকে পরাজিত করা সম্ভব।’

‘আর কি?’ জানতে চাইল হেবার।

‘একটা বুড়ো, একজন বুড়ো লোকের সাথে…

‘কোন্ বুড়ো লোক?

‘আমার দেখা করতে হবে ওর সাথে।’

‘বলে যান…’

‘মনে আসছে না…!’

‘নাম বলেছিল কোন?’

‘ম্‌…ম্যাগডো, ম্যাগডো। মেগ্‌গাইডো–না, ওটা শহরের নাম।’

‘কোন্ শহর?’

‘যে শহরে আমাকে যেতে বলেছিল তার নাম মেগ্‌গাইডো। হ্যাঁ, এই নামই। ওই শহরেই সে আমাকে যেতে বলেছিল।’

উত্তেজিত ভাবে ব্রিফকেস থেকে ম্যাপ বের করে খুলে বসল জেনিংস।

‘মেগ্‌গাইডো…’ বিড়বিড় করছে সে, ‘…মেগ্‌গাইডো…’

‘আগে শুনেছ তুমি এই নাম?’ প্রশ্ন করল থর্ন।

‘বাজি রেখে বলতে পারি শহরটা ইটালিতে হবে।

কিন্তু আসলে তা না। সারা ইউরোপের সব শহরের মধ্যে খুঁজেও ওই নাম পাওয়া গেল না। পুরো আধঘন্টা বৃথা খোঁজখুঁজি করে মাথা নেড়ে ম্যাপটা ভাঁজ করে রাখল সে। আড়চোখে চেয়ে দেখল অ্যামবাসেডর গভীর ঘুমে অচেতন। তাকে আর না জাগিয়ে প্রেততত্ত্বের বইগুলো খুলে বসল হেবার। যীশুর দ্বিতীয় আবির্ভার সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে ডুবে গেল সে। অপবিত্র সন্তান যীশু বিরোধী পশুর জন্মের পরেই আবির্ভাব হবে ত্রাণকর্তা প্রভুর। বইয়ে লেখা আছেঃ

“…পৃথিবীতে নেমে আসবে শয়তানের সন্তান মানুষের রূপ ধরে—কিন্তু তার জন্ম হবে একটা চতুষ্পদ জন্তুর পেটে। যীশু যেমন দয়া আর ভালবাসার কথা প্রচার করেছেন, এই অপবিত্র শয়তান মানুষের মধ্যে ছড়াবে ঘৃণা আর ভয়। সে তার আদেশ পাবে সরাসরি নরক থেকে।।”

একটা ঝাঁকি খেয়ে প্লেনটা রোমের মাটিতে নেমে আসতেই হেবার তার কাগজপত্র সব গুছিয়ে নিল। বৃষ্টি হচ্ছে। মাথার উপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই সাথে ভেসে আসছে মেঘের অশুভ গর্জন।

ফাঁকা এয়ারপোর্ট থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিল ওরা। বৃষ্টির মধ্যে তিরিশ মাইল দূরে শহরে যাবার পথে যেতেই গাড়িতে কটা ছোটখাট ঘুম দিয়ে নিল হেবার। রবার্ট নিথর হয়ে বসে আছে গাড়িতে। ভায়া ডি ভেনেডোর আলোকিত ভাস্কর্যের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল গাড়ি। রবার্টের মনে পড়ল প্রায় বিশ বছর আগে ক্যাথির সাথে হাত ধরাধরি করে কত আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়েই না তারা হেঁটেছে এসব রাস্তায়। এখনও নাকে আসে তার ব্যবহার করা সুগন্ধির সুবাস, কানে বাজে তার প্রাণবন্ত সুরেলা হাসির শব্দ।

‘অসপিডাল ডি সান্তো,’ গাড়িতে ব্রেক কষে ঘোষণা করল ড্রাইভার।

জেগে উঠে বসল জেনিংস। থর্ন বিভ্রান্ত চোখে অন্ধকারে চেয়ে আছে হাসপাতালের দিকে।

‘এটা না,’ বলে উঠল রবার্ট।

‘এটাই অসপিডাল ডি সান্তো।‘

‘না আমি জানি পুরানো দালান ছিল সেটা—ইটের।‘

‘এটাই কি ঠিক জায়গা?’ প্রশ্ন করল হেবার।

‘অসপিডাল ডি সান্তো,’ পুনরাবৃত্তি করল ড্রাইভার।

‘অন্য রকম লাগছে এটা,’ অটল থাকল রবার্ট।

‘আহ্,’ জবাব দিল ড্রাইভার। ‘ফিউওকো।

‘কি বলছে ও?’

‘আগুন—ফিউওকো মানে আগুন।’

‘তা আগুনের আবার কি হল?’

‘মনে হচ্ছে পুরানো হাসপাতাল আগুনে পুড়ে যাবার পরে আবার নতুন করে তৈরি করা হয়েছে এটা।’

‘তিন বছর আগে,’ জানাল ড্রাইভার। ‘অনেক লোক মারা গেছে আগুনে।’

ট্যাক্সি ড্রাইভারকে টাকা মিটিয়ে দিয়ে তাকে অপেক্ষা করতে বলল ওরা। ভাড়া হিসাবে যে টাকা তাকে দেয়া হয়েছে তা দেখেই সাথে সাথে অপেক্ষা করতে রাজি হয়ে গেল সে। ভাঙা ভাঙা ইটালিয়ানে রবার্ট ওকে বুঝিয়ে বলল রোম ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাকেই রাখতে চায় ওরা। ড্রাইভার তার বৌকে টেলিফোন করে খবরটা জানিয়ে এখনই ফিরে আসবে বলে চলে গেল।

ভিতরে ঢুকে আবার এক বিভ্রাট। রাত বেশ হয়েছে, অফিসের লোকজন সকালের আগে কেউ আর আসবে না। হেবার নিজেই কাউকে পাওয়া যায় কিনা ঘুরে দেখতে গেল। ইতিমধ্যে রবার্ট একজন ইংরেজি জানা নার্সের দেখা পেয়ে তার কাছ থেকে শিওর হল সত্যিই তিন বছর আগে একটা ভয়াবহ আগুনে হাসপাতালটা পুড়ে যায়।

‘কিন্তু আগুনে সব কিছুই নষ্ট হয়েছে এমন হতে পারে না,’ যুক্তি দিল রবার্ট। ‘খুঁজলে কিছু রেকর্ড নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে?’

‘আমি তখন এখানে ছিলাম না। শুনেছি সবই নাকি ছাই হয়ে গেছে।’

‘এমনও হতে পারে কিছু কাগজপত্র অন্য কোথাও রাখা হয়েছিল?’

‘তা ঠিক বলতে পারব না আমি।’

নিরাশ হয়ে মুখ বিকৃত করল রবার্ট। নার্সটিও আর নতুন কিছু জানাতে পারল না।

‘আমি এখান থেকে একটা বাচ্চা দত্তক নিয়েছিলাম। আমার কাছে এটা খুব জরুরি। আমার সেই বাচ্চা জন্মের রেকর্ড দরকার।’

‘এখান থেকে কোন বাচ্চাকে দত্তক দেয়া হয়নি কোনদিন।’

‘একটা হয়েছিল। অবশ্য ঠিক পালক পুত্র হিসেবে দেয়া হয়নি।’

ভুল করছেন আপনি। এখানকার সব অ্যাডপশন রিলিফ এজেন্সির মাধ্যমে হয়।’

আচ্ছা, জন্মের রেকর্ড তো থাকবে? এখানে যারা জন্মেছে তাদের জন্মের কোন রেকর্ড?’

‘অবশ্যই।’

‘যদি দিন তারিখ দিই আমি…’

‘কোন লাভ নেই,’ বাধা দিল হেবার।

রবার্ট ঘুরে দেখল হেবার এগিয়ে আসছে। নিরাশ চেহারা তার।

‘আগুনের উৎপত্তিই হয়েছিল রেকর্ড ঘরে। মাটির তলায় বেসমেন্টে। সব কাগজপত্র ওখানে ছিল, সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’

‘অনেক কাজ পড়ে রয়েছে আমার— ক্ষমা করবেন,’ নার্স রওনা দিল

‘এক মিনিট,’ আকুতি জানাল রবার্ট। ‘স্টাফদের কি হয়েছে? তাদের সবাই নিশ্চয়ই মারা পড়েনি?’

‘কিছু স্টাফ বেঁচেছিল বটে।’

‘একজন ছিলেন, পাদরী, বিশাল আকৃতি লম্বা।

‘তাঁর নাম কি স্পিল্পেটো?’

‘হ্যাঁ,’ উৎসাহে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবার্ট। ‘স্পিন্নেট্টো।’

‘সে ছিল স্টাফদের প্রধান।’

‘হ্যাঁ, সেই চার্জে ছিল…সে কি…’

‘না, মরেনি।’

‘এখানে আছে সে?’ আবার আশার সঞ্চার হচ্ছে রবার্টের মনে।

‘না।’

‘…. কোথায়…’

সুবিয়াকোর একটা সন্ন্যাসীর আশ্রমে আছে সে। যারা জীবিত ছিল তাদের অনেককেই ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেকে ওখানে মারাও গেছে। এখন কি অবস্থা জানি না, তবে আগুনে মরেনি সে।’

‘সুবিয়াকো?’ প্রশ্ন করল জেনিংস।

মাথা ঝাঁকাল নান। ‘সান্তা বেনেডিকটাস মন্যাস্টারি।’

তাড়াতাড়ি ট্যাক্সিতে ফিরে ম্যাপ খুলে বসল ওরা। সুবিয়াকো ইটালির দক্ষিণ সীমান্তে। ওখানে পৌঁছুতে ট্যাক্সিতে সারারাত চলতে হবে ওদের। ট্যাক্সি ড্রাইভার আপত্তি জানাল—কিন্তু আরও বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে লাল কালি দিয়ে ম্যাপে রুটটা দাগ দিয়ে দিল জেনিংস। ওরা ঘুমিয়ে থাকলেও ঠিক ঠিক পথ চিনে যেতে পারবে ড্রাইভার। ট্যাক্সি ছুটে চলল ইটালির গ্রাম্য পথ ধরে।

‘অবাক কাণ্ড!’ ফিসফিস করে বাইবেলের খোলা পাতার দিকে চেয়ে বলে উঠল হেবার। ‘সবই আছে এখানে।

‘কি আছে?’

‘সবই লেখা আছে বাইবেলের অন্তখণ্ডে (new testament)। যখন জু’রা জায়নে ফিরবে…’

‘মনে পড়েছে,’ উত্তেজিত ভাবে হেবারকে থামিয়ে বলে উঠল রবার্ট। কবিতাটার আরম্ভ ঠিক ওই ভাবে। তারপর ধূমকেতুর কি একটা ব্যাপার ছিল।’

‘সেটাও আছে এখানে,’ আর একটা বই খুলে পড়ল হেবার, তারার সৃষ্টি আর পবিত্র রোম সাম্রাজ্যের জাগরণ। এগুলোকেই অপবিত্র শয়তান সন্তানের আবির্ভাবের পূর্বাভাস বলে বর্ণনা করা হয়েছে।’

ট্যাক্সির ভিতর ওরা দু’জনেই পড়ায় মন দিল। থর্ন তার ব্রিফকেস থেকে একটা মীটিঙের জন্যে তৈরি করা নোটগুলো বের করে পড়তে বসল। বাইবেলে লেখা অনেক ইঙ্গিতেরই সুন্দর ব্যাখ্যা পেল সে ওই লেখায়।

‘তাহলে জু’রা ফিরেছে জায়নে…’ মন্তব্য করল জেনিংস। ‘একটা কমেটও দেখা গেছে সাড়ে চার বছর আগে। আর পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানকে অনেক পণ্ডিত কমন মার্কেটের গঠন বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।’

‘কল্পনা একটু বেশি হয়ে গেল না?’ চিন্তিতভাবে মন্তব্য করল রবার্ট।

‘তাহলে এ সম্বন্ধে আপনি কি বলবেন?’ আর একটা বই খুলে বসল হেবার। ‘নিউ টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে, সে আসবে অনন্ত সমুদ্রের ভিতর থেকে।

‘ট্যাসোনের কবিতাটা,’ ভুরু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করল থর্ন। …সে জাগবে অসীম সমুদ্রের মাঝ থেকে…দুই কূলেই থাকবে সৈন্যের দল…এই ভাবেই আরম্ভ হয়েছিল কবিতা।

নতুন নিয়মের বই থেকেই উদ্ধৃতি দিয়েছিল ট্যাসোন।’ একটা বই দেখাল হেবার, ‘এই যে বইটা দেখছেন এতে লেখা আছে যে ‘ইন্টারন্যাশনাল থিওলজিক্যাল সাইন্স’ সমিতির ওরা ‘অনন্ত সমুদ্রের’ মানে করেছে ‘রাজনৈতিক জগত’। এই সমুদ্র সব সময়েই গর্জাচ্ছে আন্দোলন আর অসন্তোষের প্রবল ঘূর্ণি পাকে।’

থর্নের চোখে চোখে কঠিন দৃষ্টিতে চাইল হেবার।

‘ইবলিসের ছেলের জন্ম হবে রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে,’ রুক্ষস্বরে ঘোষণা করল হেবার।

কোন জবাব দিল না রবার্ট। চোখ ফিরিয়ে সে চেয়ে রইল ফিকে হয়ে আসা ভোরের আকাশের দিকে।

.

সান্তা বেনেডিকটাস প্রায় ভাঙা-চোরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের তৈরি দুর্গ। আস্তর খসে পড়া আরম্ভ হলেও নিজের গৌরব নিয়ে শক্তভাবেই দাঁড়িয়ে আছে বিশাল দালান। সেই হিরডের সময় থেকেই ওটা দাঁড়িয়ে আছে ইটালির দক্ষিণাঞ্চলের পাহাড়ের ওপর। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মঠের সব সন্ন্যাসীকে হত্যা করেছিল জার্মানরা। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ইটালির লোকেরাই এর ওপর মর্টার চালিয়েছিল এর ভিতরে যে সব অপকর্ম হত তার প্রতিবাদে। এত কিছুর পর আজও সান্তা বেনেডিকটাস একটা পবিত্র জায়গা বলেই পরিচিত। যুগে যুগে এর প্রতিটি দেয়ালে প্রার্থনার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

সারা গাড়িতে কাদার ছিটে লাগা ট্যাক্সিটা যখন ওটার সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়াল ভিতরের যাত্রী দু’জন তখনও গভীর ঘুমে অচেতন। ট্যাক্সি ড্রাইভারের রীতিমত ধাক্কাধাক্কি করে জাগাতে হল ওদের।

‘সিনোরেস?’

আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল ওরা। রাস্তা থেকে প্রায় আধ মাইল ভিতরে দেখা যাচ্ছে দুর্গটা। সকালের ভিজে ভিজে ফ্রেশ হাওয়া ওদের মুখে ঠাণ্ডা প্ৰলেপ মেখে দিচ্ছে।

‘সান্তা বেনেডিকটাস,’ বিড়বিড় করল ক্লান্ত ড্রাইভার।

‘দেখেছেন কি বিশাল ব্যাপার!’ অবাক বিস্ময়ে মন্তব্য করল হেবার।

‘আর কাছে যাওয়া যায় না?’ প্রশ্ন করল থর্ন।

‘মনে হয় না,’ জবাব দিল জেনিংস।

গাড়ি ঘুরিয়ে ড্রাইভারকে ঘুমিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে কোমর সমান ঘাসের মধ্যে দিয়ে ওরা পায়ে হেঁটে দুর্গের দিকে এগুলো। তাদের জামাকাপড় এর ভিতর হাঁটার উপযোগী নয়। হাতে পায়ে পেঁচিয়ে তাদের টেনে ধরে রাখতে চাইছে বড় বড় ঘাস। বাধা অতিক্রম করে এগুতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে ওদের। তবু জেনিংসের ছবি তোলায় বিরতি নেই–একটা ফিল্মের প্রায় অর্ধেক সে ওখানেই শেষ করল।

ছবি তুলতে গিয়ে একটু পিছিয়ে পড়েছিল হেবার—আবার ধরে ফেলল রবার্টকে। দূর থেকে একটা সমবেত সুর ভেসে আসছে। চারপাশে স্তব্ধতার মাঝে মনে হচ্ছে যেন শত শত লোক বিলাপ করে কাঁদছে।

‘অনেক বেদনা অনেক ব্যথা লুকিয়ে আছে এর মাঝে,’ সদর দরজায় পৌঁছে বলল হেবার। শুনুন—ওই যে, শুনতে পাচ্ছেন ওদের কান্না?’

প্রার্থনার গানের শব্দ প্রতিটা দেয়ালে বাড়ি খেতে খেতে ভেসে আসছে ওদের কাছে। মনে হচ্ছে যেন দেয়ালের ভিতর থেকেই শব্দ বেরিয়ে আসছে। শব্দের উৎস খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেল ওরা।

‘এটাই মনে হয় ভেতরে ঢোকার পথ,’ একটা লম্বা করিডোর দেখিয়ে বলল হেবার। ‘দেখছেন পায়ের ঘষায় পাথর কেমন ক্ষয়ে গেছে?’

সত্যি মেঝেটা শত শত বছর মানুষের পায়ের চলায় ক্ষয়ে চকোলেট রঙের দেখাচ্ছে। করিডোর ধরে এগিয়ে যেতেই গানের আওয়াজ ধীরে ধীরে জোরাল হয়ে উঠতে লাগল। প্রায় অন্ধকার একটা বিশাল হল ঘরে পৌঁছল ওরা। এখানেই প্রার্থনা করা হয়। হল ঘরের অন্য প্রান্তে ক্রসের ওপর যীশুর প্রতিকৃতি—মোমের আলোতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দূরে কয়েকজন হুড পরা সন্ন্যাসীকে দেখা যাচ্ছে প্রার্থনারত। হেবার জেনিংস তার লাইট মিটার বের করে ভিতরের আলোর অবস্থা বুঝে দেখার চেষ্টায় ব্যস্ত।

‘ওটা রেখে দাও এখন,’ চাপা গলায় ধমক দিল রবার্ট।

‘আমার ফ্ল্যাশ নিয়ে আসা উচিত ছিল।’

‘বলছি ওসব রেখে দাও।’

কটমট করে কিছুক্ষণ হেবার চেয়ে রইল রবার্টের দিকে, তারপর ব্যাগে ভরে রাখল মিটারটা। মানসিকভাবে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছে রবার্ট, হাঁটু কাঁপছে তার। ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত মুঠো করে তার ওপর মাথা রেখে প্রার্থনা আরম্ভ করল সে।

‘কি হল?’ শঙ্কিত হয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল হেবার।

‘…আমি ক্যাথলিক,’ কান্নারুদ্ধ কাঁপা গলায় জবাব দিল রবার্ট।

হঠাৎ তার মুখের চেহারা বদলে গেল। অন্ধকারের মধ্যে একদৃষ্টে কিছু একটা চেয়ে দেখছে সে। হেবার দেখল, একটা হুইল চেয়ারে বসে রয়েছে বিশাল আকৃতির একটা মানুষ। হাত দুটো একটু ভাঁজ করে সোজা হয়ে বসে আছে লোকটা। মাথাটা সামান্য সামনের দিকে হেলানো। লোকটাকে দেখে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মনে হয়।

‘এই সেই লোক?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল জেনিংস।

মাথা ঝাঁকাল রবার্ট; বিস্ফারিত চোখে ভাল করে চেনার চেষ্টা করছে সে। এগিয়ে গেল ওরা সামনের দিকে। কাছাকাছি এসে ওর চেহারাটা আরও ভাল করে দেখা গেল। চেহারা দেখে মুখ বিকৃত হল হেবারের। লোকটার অর্ধেক মুখ গলে একেবারে তাল পাকিয়ে গেছে-একটা চোখ ঘোলাটে, শূন্য দৃষ্টিতে ওপর দিকে চেয়ে আছে চোখটা। ডান হাতটাও ভীষণ ভাবে বিকৃত হয়ে গেছে। জামার হাতা থেকে হাতটা একটা মসৃণ লাঠির মত বেরিয়ে রয়েছে।

‘আমরা জানি না ও দেখতে বা শুনতে পায় কিনা,’ বললেন মঠের সামনের উঠানে স্পিল্লেট্টোর ধারে দাঁড়ানো সন্ন্যাসী। ‘সেই আগুনের পর থেকে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি ও।

ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা কোন এককালে বাগান ছিল। রবার্টের সাথে আলাপ করে ওই সন্ন্যাসী নিজেই স্পিন্নেটোর হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে এসেছেন বাইরে।

‘এখানকার ব্রাদারেরা ওকে খাওয়ায় আর দেখাশোনা করে,’ বলে চললেন মঙ্ক। তার আরোগ্যের জন্যে আমরা প্রার্থনা করি।’

‘অনুশোচনা?’ প্রশ্ন করল থর্ন।

মাথা ঝাঁকালেন বক্তা।

ধিক সেই মেষপালককে যে তার মেষের তদারক করে না। তার ডান হাত শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যাবে আর চোখের দৃষ্টি হারাবে সে।

‘পাপ করেছে সে?’ জানতে চাইল রবার্ট।

‘হ্যাঁ।’

‘কেন এই শাস্তি তার?’

‘যীশুকে পরিত্যাগ করার জন্যে।’

থর্ন আর জেনিংসের দৃষ্টি বিনিময় হল।

‘আপনি কি করে জানলেন সে যীশুকে পরিত্যাগ করেছে।’

‘স্বীকারোক্তির মাধ্যমে।‘

কিন্তু সে নাকি কথা বলতে পারে না?’

‘লিখিত স্বীকারোক্তি। সে তার বাম হাত এখনও নাড়তে পারে।’

‘কি ধরনের স্বীকারোক্তি?’

আপনার এতসব প্রশ্নের কারণ জানতে পারি আমি?’

‘বিশ্বাস করুন এটা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,’ সহজ ভাবেই স্বীকার করল থর্ন। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন—একজনের মরা-বাঁচা নির্ভর করছে এর ওপর।

কিছুক্ষণ থর্নের মুখের চেহারা পড়ার চেষ্টা করে মাথা ঝাঁকালেন সন্ন্যাসী।

‘আমার সাথে আসুন।’

স্পিল্লেট্টোর ঘরটা একটা ছোট্ট বাক্সের মত খুপরি। ভিতরে কেবল একটা তোশক আর একটা পাথরের টেবিল। উপরটা খোলা—আলোও যেমন আসে তেমনি বৃষ্টি ঢুকতেও বাধা নেই। গতরাতের বৃষ্টির ফলে ঘরের মাঝে কিছুটা পানি জমে রয়েছে। ম্যাট্রেসটাও যে ভিজে তা লক্ষ্য করল থর্ন। সে ঠিক বুঝল না, স্পিল্লেট্টো অনুতাপ করার জন্যেই এই পদ্ধতি বেছে নিয়েছে, নাকি এখানকার সবাই এই একই অসুবিধা ভোগ করছে।

‘এটা তার টেবিলের ওপর কয়লা দিয়ে দাগ কেটে আঁকা হয়েছে।’

টেবিলের ধারে জড়ো হল সবাই। টেবিলের ওপর একটা অদ্ভুত নকশা আঁকা রয়েছে।

‘এখানে প্রথম এসেই এটা এঁকেছিল সে-কিন্তু এর পরে আজ পর্যন্ত কিছু লেখেনি।’

টেবিলের ওপর আঁকা আকৃতিটা কাঁচা হাতে আঁকা একটা বাচ্চার আকৃতির মত। মাথাটা একটা অর্ধবৃত্ত দাগ দিয়ে ঘেরা। চট করে হেবারের দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওই অর্ধবৃত্তের নিচে লেখা তিনটে অক্ষর–তিনটা ছয়। ঠিক ট্যাসোনের ঊরুতে যেমন ছিল।

‘মাথার উপর এই অর্ধবৃত্তের মানে হল সন্ন্যাসীর শিরবস্ত্র বা হুড। ওর নিজের।’

‘এটা কি তার নিজের ছবি এঁকেছে সে?’ হেবার প্রশ্ন করল।

আমাদের তাই বিশ্বাস।

‘ওই ছয়গুলো কি?

‘শয়তানের সঙ্কেত। সাত হচ্ছে নিখুঁত—যীশুর সংখ্যা। আর ছয় হচ্ছে ইবলিসের সংখ্যা।’

‘তিনটে সংখ্যা কেন?’

‘আমাদের ধারণা এতে তিনটে অপবিত্র জিনিসের সমষ্টি বোঝায়। শয়তান, যীশু বিরোধী আর মিথ্যা নবী।

‘…পিতা, পুত্র, এবং পবিত্র আত্মা,’ মন্তব্য করল থর্ন।

মাথা ঝাঁকালেন সন্ন্যাসী। ‘প্রতিটি পবিত্র কিছুর বিপরীতেই একটা করে অপবিত্র কিছু আছে। প্রলোভনের মূল ভিত্তিই এই।’

‘এই ছবিটাকে কনফেশন বলে ধরে নিচ্ছেন কেন?’

‘আপনার মনেও প্রশ্ন উঠেছিল এটা তার নিজের প্রতিকৃতি কিনা—আমাদের বিশ্বাস তাই, আর ওটার মাথাটা নরকের সঙ্কেতে ঘেরা।’

‘তাহলে এটা আপনার জানা নেই ঠিক কোন বিশেষ পাপের জন্যে সে অনুতপ্ত বা কনফেস করেছে?’

‘খুঁটিনাটি জানার দরকার নেই আমাদের,’ জবাব দিলেন সন্ন্যাসী। মূল কথা হচ্ছে সে অনুতপ্ত : ক্ষমা প্রার্থী।’

জেনিংস রবার্টের দিকে চাইল। সেও চোখ তুলে চাইল জেনিংসের দিকে। তার চোখে ফুটে উঠেছে রাজ্যের নৈরাশ্য।

‘আমি কি একটু কথা বলতে পারি ফাদার স্পিল্লেট্টোর সাথে?’ অনুমতি চাইল রবার্ট।

‘আমার মনে হয় না কোন লাভ হবে তাতে।’

স্পিল্লেট্টোর ঝলসানো জমাট বাঁধা মুখের দিকে চেয়ে শিউরে উঠল রবার্ট।

ফাদার স্পিল্লেটো…’ দৃঢ় স্বরে বলল সে। ‘আমার নাম থর্ন।’

নির্বিকার ভাবে উপর দিকে মুখ তুলল সে, চোখ নড়ছে না, হয়ত কিছু শুনছেও না।

‘কোন লাভ নেই,’ উপদেশ দিলেন মঙ্ক।

কিন্তু রবার্ট ছাড়ল না।

‘স্পিল্লেট্টো,’ আবার ডাকল রবার্ট, এবারে তার গলার স্বর আরও চড়া। ‘…. বাচ্চাটা, আমি জানতে চাই ওটা কোত্থেকে এল।’

‘প্লীজ সিনর…’ অনুরোধ জানালেন সন্ন্যাসী।

‘ওদের কাছে স্বীকার করেছ তুমি,’ চিৎকার করল রবার্ট। ‘এবার আমার কাছে বল, ওই ছেলেটা কোত্থেকে এল?’

‘আমি বাধ্য হচ্ছি আপনাকে…’

‘স্পিল্লেট্টো! শোন! জবাব দাও!’

মঙ্ক হুইল চেয়ারের দিকে এগুবার চেষ্টা করলেন কিন্তু জেনিংস পথ আটকে দাঁড়ানোয় আর আগে বাড়তে পারলেন না তিনি।

‘ফাদার স্পিল্লেট্টো, চুপ করে থেক না, জোড় হাত করছি বল ওর মা কোথায়, কে ছিল সে?’

হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে প্রচণ্ড শব্দে চার্চ টাওয়ারের ঘন্টা বেজে উঠল। কান ফাটানো আওয়াজ। এই সময়ে থর্ন দেখল পাদরীর বাম হাতটা কাঁপতে কাঁপতে উপরের দিকে উঠছে।

‘কয়লাটা,’ চেঁচিয়ে উঠল থর্ন। ‘কয়লাটা দাও ওকে!’

দ্রুত কাঠ কয়লার টুকরোটা তুলে নিয়ে হেবার স্পিল্লেট্টোর কম্পিত হাতে গুঁজে দিল। ঘন্টার ধ্বনির সাথে সাথে হাত থেমে থেমে ঝাঁকিয়ে কয়েকটা এবড়োখেবড়ো অক্ষর লিখল সে টেবিলের ওপর।

‘একটা শব্দ,’ উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল হেবার। ‘সি…ই…আর…’

পাদরীর হাত থরথর করে কাঁপছে কষ্ট করে লেখার পরিশ্রমে। তার বিকৃত মুখের ভিতর থেকে অত্যন্ত ব্যথায় কুকুরের কান্নার মত আওয়াজ বেরিয়ে এল।

‘থেম না, লিখে যাও—’ উৎসাহ জোগাতে চেষ্টা করল রবার্ট Į

‘…ভি…’ পড়ছে হেবার, ‘…টি…টি…’

হঠাৎ ঘন্টার শব্দ থেমে গেল। সেই সাথে স্পিল্লেট্রোর হাত থেকে পড়ে গেল কয়লার টুকরোটা–মাথাটা হেলে পড়ল পিছন দিকে হুইল চেয়ারে। পরিশ্রান্ত দেহে উপর দিকে চেয়ে রইল সে–মুখটা ঘামে ভিজে গেছে।

ঘন্টার শব্দের ধ্বনি প্রতিধ্বনি দেয়ালে ঘা খেতে খেতে মিলিয়ে গেল। ওরা তনজনে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে আঁকিবুকি টানা টেবিলটাকে ঘিরে।

‘….সারভেট?’ প্রশ্ন করল থর্ন।

‘সারভেট।’ তোতা পাখির মত আওড়াল হেবার।

‘ইটালিয়ান শব্দ?’

দুজনেই মঠের সন্ন্যাসীর দিকে ফিরল। তিনি একবার শব্দটার দিকে দেখে সন্দিগ্ধ চোখে স্পিল্লেট্টোর দিকে চাইলেন।

‘কথাটার মানে আপনার জানা আছে?’ প্রশ্ন করল রবার্ট।

‘সারভেতেরি,’ জবাব দিলেন মস্ক।

‘সেটা কি?’

‘একটা পুরানো কবরখানা, এট্টুসকান আমলের। গ্রিপ ডি স্যান অ্যাঞ্জেলো।’ স্পিন্নেট্টোর আড়ষ্ট দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠল। গলা দিয়ে গোঙানির শব্দ বেরুল একটা। মনে হল যেন সে কিছু বলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু আর কিছুই জানা গেল না তার কাছ থেকে। আবার নীরব হয়ে গেল সে। তার দেহের সীমিত শক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে।

থর্ন আর জেনিংস মঠের সন্ন্যাসীর কাছ থেকে আরও কিছু জানার আশায় তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল। কিন্তু বিস্মিত মুখে মাথা নাড়লেন তিনি।

‘ধ্বংসাবশেষ ছাড়া এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই সারভেতেরিতে। টেকুলকার মন্দিরের ভগ্নাবশেষ।’

‘টেকুলকা?’ প্রশ্ন করল হেবার।

‘এটুসকান প্রেত-দেবতা। ওরা প্রেতের পূজা করত। কবরখানাকে তারা

বলীদানের জায়গা হিসেবেও ব্যবহার করত।’

‘স্পিল্লেট্টো ওই শব্দটা কেন লিখল তবে?’ জানতে চাইল রবার্ট।

‘সেটা আমিও বুঝতে পারছি না।’

‘জায়গাটা কোথায়?’ জেনিংস প্রশ্ন করল।

‘ওখানে কিছুই নেই, সিনর, আছে কেবল কবর আর কিছু বুনো কুকুর। ‘কিন্তু জায়গাটা কোথায়?’ না শুনে ছাড়বে না জেনিংস।

‘আপনাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার চিনবে জায়গাটা। ওটা রোম থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার উত্তরে।’

ট্র্যাক্সি ড্রাইভারকে জাগানো বেশ কষ্টসাধ্য হল। এবার কোথায় যেতে হবে শুনেই ওর মুখ হাঁড়ি হয়ে গেল। বেশি টাকার লোভে কেন যে এই লোক দুটোকে সে গাড়িতে তুলে ছিল সেই আপসোসে মনটা ছোট হয়ে গেল তার। এই সারভেতেরি এমন একটা জায়গা যেখানে ধর্মভীরু লোকে দিনের বেলাও সহজে যেতে চায় না—আর ওরা কিনা সেখানে পৌঁছবে গভীর রাতে।

রোমের আকাশে যে মেঘ দেখা গেছিল তা এখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রবল বৃষ্টি ওদের গাড়ির গতি অনেক কমিয়ে দিয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে ওর হাইওয়ে ছেড়ে একটা ছোট্ট রাস্তায় নামল। কাদা আর গর্তে পড়ে ওদের গাড়ির চাকা প্রায়ই পিছলে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা বড় গর্তে পড়ে আটকে গেল গাড়ি। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে দুজনে মিলে বৃষ্টিতে ভিজে কাদা মেখে ধাক্কা দিয়ে গর্ত থেকে ঠেলে ওঠাল গাড়ি। ওরা যখন আবার গাড়ির ভিতর ঢুকল তখন দুজনই ভিজে একাকার হয়ে গেছে। জেনিংস যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না সে, কেবল মনে আছে ঘুমাবার আগে একবার ঘড়ি দেখেছিল, তখন প্রায় রাত বারোটা বাজে। কয়েক ঘন্টা পর ঘুম ভেঙে টের পেল ট্যাক্সিটা থেমে রয়েছে। পাশেই কম্বল মুড়ে ঘুমাচ্ছে রবার্ট। সামনের সিটে ড্রাইভারও ঘুমে অচেতন। কম্বলের তলা থেকে কেবল ওর কাদা মাখা জুতো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সামান্য নাক ডাকছে ঘুমের ঘোরে।

অন্ধকার হাতড়ে দরজা খুলে বাইরে একটা ঝোপের কাছে দাঁড়িয়ে নিজেকে হালকা করে নিল সে। ভোর হতে বেশি দেরি নেই, পুবের আকাশ একটু ফিকে হয়ে এসেছে। অন্ধকারেই তারা কোথায় আছে বোঝার চেষ্টা করল হেবার। অনেকক্ষণ এদিক ওদিক চেয়ে সে টের পেল পৌঁছে গেছে ওরা। তার সামনেই লোহার কাঁটা বসানো বেড়া। আর একটু দূরেই স্মৃতিফলকের আকৃতিগুলো আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে ফিকে হয়ে আসা আকাশের গায়ে।

গাড়ির কাছে ফিরে গিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে রবার্টের দিকে চাইল হেবার। এখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। গাড়ির স্টার্টার সুইচ থেকে চাবিটা খুলে নিয়ে বুট খুলল। নিজের সুটকেস থেকে ক্যামেরা, ফ্ল্যাশগান, ফিল্ম ইত্যাদি বের করে ক্যামেরায় ফিল্ম ভরে নিয়ে ফ্ল্যাশগানটা ঠিক কাজ করেছে কিনা চেক করে দেখল একবার। সন্তুষ্ট হয়ে তার সব সরঞ্জাম কাঁধে চাপাল। বুট বন্ধ করতে গিয়ে তার চোখ পড়ল বুটে কতগুলো তেলমাখা ন্যাকড়ার সাথে একটা টায়ার খোলার লোহার রড রয়েছে। কি মনে করে ওটা তুলে নিয়ে বেল্টে গুঁজল। তারপর শব্দ না হয় এমন ভাবে বুটটা বন্ধ করে এগিয়ে গেল সে জংধরা কাঁচা লোহার বেড়ার দিকে। বেড়ার ধার দিয়ে দু’দিকেই কিছু দূর হেঁটে দেখল, কোন প্রবেশ পথ নজরে পড়ল না তার। মাটি ভিজে আর নরম। হাঁটতে হাঁটতে বেশ ঠাণ্ডা অনুভব করছে হেবার। নিজের জিনিসপত্র সামলে নিয়ে একটা গাছের ডাল ধরে বেড়া পার হবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ওর, ভিজে ডালে পিছলে গেল হাত। অক্ষত অবস্থায় বেড়ার ওপাশেই সে পড়ল বটে, কিন্তু লোহার কাঁটার খোঁচায় কোট ছিঁড়ে গেল তার। ক্যামেরাটা ছবি তোলার জন্যে তৈরি করে নিয়ে কবরখানার ভিতরের দিকে রওনা হল সে। চারদিক ফর্সা হয়ে আসছে, মূর্তি আর স্মৃতিফলকগুলো বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন আকৃতির সব কারুকাজ করা মূর্তি। কোনটা ক্ষয়ে গেছে, কোনটা ভাঙা, কোনটা শ্যাওলা পড়ে কালচে হয়ে রয়েছে।

ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘেমে উঠেছে জেনিংস। অস্বস্তি ভরে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে এগিয়ে চলেছে সে অযত্নে বেড়ে ওঠা ঘন আগাছার ভিতর দিয়ে। কেবলই মনে হচ্ছে যেন আড়াল থেকে ওর ওপর নজর রাখছে কেউ। মূর্তিগুলোও যেন শূন্য চোখে লক্ষ্য রেখেছে তার দিকে। হঠাৎ উপর দিকে চেয়েই চক্ষু স্থির হয়ে গেল তার। বিশাল একটা পাথরের মূর্তি। বিকট চেহারা করে রাগের চোখে চেয়ে আছে তারই দিকে! যেন জেনিংসের এখানে অনধিকার প্রবেশের স্পর্ধা দেখেই চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। চাইছে হেবার ফিরে যাক। মুখটা মানুষের, কিন্তু মুখের ভাবটা ঠিক হিংস্র জন্তুর মত। কুঁচকানো কপাল, বোঁচা থ্যাবড়া নাক, মাংসল মুখটা যেন কাঁচা চিবিয়ে খাওয়ার জন্যেই হাঁ করে রয়েছে। অনেক চেষ্টায় নিজের ভয়টাকে সংযত করে ক্যামেরাটা কোনমতে উঁচিয়ে পরপর তিনটে ছবি তুলল হেবার। ফ্ল্যাশের উজ্জ্বল আলো যেন তিনবার চপেটাঘাত করল বিকট মূর্তিটার মুখে।

গাড়ির মধ্যে চোখ মেলে চাইল রবার্ট। পরক্ষণেই সে টের পেল জেনিংস তার পাশে নেই। গাড়ি থেকে নামতেই সামনের কবরস্থান চোখে পড়ল তার। সকালের আলোয় কবরের স্মৃতিফলক আর মূর্তিগুলো এখন আলোকিত হয়ে উঠেছে।

‘….জেনিংস…?’

কোন জবাব নেই। ঘেরা বেড়ার ধারে গিয়ে আবার চিৎকার করে ডাকল সে। এবার দূর থেকে একটা শব্দ শুনতে পেল রবার্ট। কেউ যেন কবরখানার ভিতর থেকে তার দিকেই আসছে। লোহার ভিজে খুঁটি বেয়ে উঠে বেড়া টপকে ধপ করে ওপারে লাফিয়ে পড়ল রবার্ট।

‘জে নিং স,’ আবার হাঁকল থর্ন।

শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে হেবারকে খুঁজতে লাগল রবার্ট পাথরের ভাঙা মূর্তির গোলক ধাঁধায়। পাঁকে জুতো ডুবে যাওয়ার পরিচিত শব্দ হচ্ছে মাটি থেকে। বিদঘুটে চেহারার মূর্তিগুলোর মাঝে দিয়ে চলতে রবার্টের ভয় ভয় করছে। এখানে এমন এক ধরনের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে যেটা এর আগেও সে উপলব্ধি করেছে পেরিফোর্ডে। মনে হয় যেন বাতাসও শ্বাস নিতে ভুলে দম বন্ধ করে রয়েছে। পেরিফোর্ডে যে রাতে সে জঙ্গলের ধার থেকে একজোড়া চোখকে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখেছিল, ঠিক তেমনি অনুভূতি হচ্ছে তার আজও। কেউ যেন অলক্ষ্যে তার ওপর নজর রেখেছে। চারপাশের মূর্তিগুলোর ওপর ধীরে ধীরে চোখ বুলাল রবার্ট। হঠাৎ উল্টো করে মাটিতে পোঁতা একটা বিশাল ক্রুশের ওপর দৃষ্টি পড়তেই তার বুকের ভিতরটা একেবারে শুকিয়ে গেল একটা অশুভ আশঙ্কায়। ক্রুশের ঠিক পিছন থেকেই শব্দটা আবার কানে এল ওর। কারও পথ চলার শব্দই—কিন্তু এবারে শব্দটা দ্রুত এগিয়ে আসছে সোজা তার দিকে। দৌড়ে ছুটে পালাতে মন চাইছে, কিন্তু নড়তে পারছে না সে মোটেও। হাত পা জমে পাথর হয়ে গেছে তার। একটা বড় ঝোপের ডালপালা ভেঙে সশব্দে বেরিয়ে এল শব্দের উৎস। বড় বড় চোখে চেয়ে রইল রবার্ট।

‘থর্ন!’

রবার্টের সামনে বেরিয়ে এসেছে হেবার। চোখ দুটো বুনো, উত্তেজনায় ছোট ছোট শ্বাস পড়ছে—লোহার রড হাতে এগিয়ে এল সে রবার্টের কাছে।

‘পেয়েছি!’ হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল হেবার।

‘কি পেয়েছ?’ বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল থর্ন।

‘এদিকে, আমার সাথে আসুন!’

প্রায় ছুটতে ছুটতে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে। জেনিংস ঠিক অবস্ট্যাকল রেসের প্রতিযোগীর মতই কবরের পাথর কাটিয়ে ছুটছে— রবার্ট প্রাণপণ চেষ্টা করছে ওর সাথে তাল মিলিয়ে চলার।

‘এই যে!’ একটা ছোট্ট ফাঁকা জায়গায় থেমে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল হেবার। আমরা এইগুলোই খুঁজছি— কাছে গিয়ে দেখুন।’

তার সামনেই দুটো কবর। অন্যান্যগুলো দেখে সহজেই অনুমান করা যায় এই দুটো কবরই কেবল অপেক্ষাকৃত নতুন। একটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের, অন্যটা ছোট। স্মৃতিফলকের পাথরে কোন কারুকার্য নেই—কেবল নাম আর তারিখ লেখা।

‘তারিখ দেখেছেন?’ উত্তেজিত স্বরে বলল হেবার। ছয়ই জুন! ঠিক সাড়ে চার বছর আগের ছয়ই জুন। একজন মা আর একজন ছেলে।’

ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে হেবারের পাশে দাঁড়াল রবার্ট। কোনও কথা না বলে হাঁটু গেড়ে বসে পাথরটার ওপর থেকে হাত দিয়ে মাটি কাদা সরাতে আরম্ভ করল।—মারিয়া আভেদিসি স্যানটোয়া…’ পড়ল সে। ‘ব্যামবিনো স্যানটোয়া—ইন মর্তে এত্‌ ইন নাতে আমপ্লেক্সারেনতুর জেনারেশিয়নস্।’

‘এর মানে কি?’

‘ল্যাটিন ভাষায় লেখা।‘

‘কিন্তু লেখাটার মানে কি?’

‘….মরণে…আর…জন্মে…আলিঙ্গনাবদ্ধ হয় বিভিন্ন জেনারেশন।‘

জেনিংসও হাঁটু গেড়ে বসল রবার্টের পাশে। লক্ষ্য করল রবার্টের গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে—কাঁদছে সে। মাথা হেঁট করে লুকোবার কোন চেষ্টা না করেই অঝোরে কাঁদল থর্ন। ওর কান্নার বেগ কমার অপেক্ষায় রইল হেবার।

‘এটাই,…আমার মন বলছে এটাই,’ বিলাপ করে উঠল থর্ন। ‘এখানেই ঘুমিয়ে আছে আমার ছেলে।

‘সম্ভবত আপনি যাকে মানুষ করছেন, তার মাকেই পাশে কবর দেয়া হয়েছে।’

থর্ন হেবারের চোখে চোখ রাখল।

‘মারিয়া স্যানটোয়া,’ বড় কবরটার দিকে দেখিয়ে বলল জেনিংস। ‘একটা ছেলে আর একজন মা।

মাথা নাড়তে নাড়তে কথাটা বিবেচনা করছে রবার্ট।

‘শোনেন,’ ডাকল হেবার। ‘আপনি স্পিন্নেট্টোর কাছে জানতে চেয়েছিলেন ছেলেটার মা কোথায়। এটাই মায়ের কবর। আর ছোটটা সম্ভবত আপনার ছেলের।’

‘কিন্তু কেন? এই জায়গায় কেন?’

‘জানি না।’

‘এই অদ্ভুত আর বিচ্ছিরি জায়গায় কেন?’ স্বগতোক্তি করল থর্ন।

আমরা যখন এত দূরই এসেছি, ভাল করে সব না দেখে ফিরব না।’ শাবলের মত লোহার রডটা কবরের ওপর মাটিতে গাঁথল হেবার। কিছু দূর মাটিতে ঢুকে একটা ভোঁতা শব্দ করে থেমে গেল ওটা।

‘কাজটা সহজই হবে। মাত্র ফুট খানেক নিচেই কফিন।’ টায়ার খোলার লোহা দিয়েই মাটি খুঁড়তে লেগে গেল হেবার। মাটির চাকগুলো হাত দিয়ে সরাচ্ছে।

‘আমি কি একাই কাজ করব?’ বলল হেবার।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঠাণ্ডায় অবশ আঙুল দিয়ে মাটি তুলে সরাতে শুরু করল রবার্ট। আধঘন্টা পরিশ্রমের পরে পুরো মাটি সরিয়ে ফেলল ওরা কফিন দুটোর ওপর থেকে। তাদের পরবর্তী করণীয় কাজের কথা চিন্তা করে দুজনেই ইতস্তত করছে।

‘গন্ধ পাচ্ছেন?’ প্রশ্ন করল হেবার।

‘হ্যাঁ।’

‘মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি কাজ সেরেছে। কবর দেয়ার সব নিয়মকানুন মানেনি।’

জবাব দিল না থর্ন। ওর মুখে একটা অব্যক্ত ব্যথার ছাপ।

‘কোন্‌টা আগে খুলব?’ জিজ্ঞেস করল জেনিংস।

‘এটা কি না করলেই না?’

‘না।’

‘কাজটা আমার কাছে অন্যায় মনে হচ্ছে।‘

‘তাহলে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে আসি আমি?’

রবার্টের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল— মাথা নাড়ল সে।

‘ঠিক আছে, বড়টাই আগে খোলা যাক।’

জেনিংস টায়ার খোলার রডটা কফিনের পাশ দিয়ে সিমেন্টের ঢাকনার নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে চাড় দিল। কিছুটা ফাঁক হতেই আঙুল ঢুকিয়ে দিল সে ফাঁকের মধ্যে।

‘হাঁ করে কি দেখছেন—ধরুন! আঙুল যে চ্যাপটা হয়ে গেল আমার!’ তাড়া দিল হেবার।

তাড়াতাড়ি ধরল রবার্ট। দুজনে অনেক চেষ্টার পরে কোনমতে খুলল ঢাকনাটা। দুজনে মিলে দুহাতে ঢাকনাটা উঁচিয়ে রেখেই ভিতরে আধো অন্ধকার গর্তে উকি দিল।

‘ঈশ্বর! একি?’ বলে উঠল বিস্ময়ে অভিভূত জেনিংস।

একটা শিয়ালের হাড়গোড় আর অবশিষ্টাংশ রাখা হয়েছে ভিতরে। বিভিন্ন ধরনের মাছি আর পোকা গিজগিজ করছে ওখানে।

ভূত দেখার মত চমকে লাফিয়ে পিছনে সরে গেল রবার্ট। ভার রাখতে না পেরে ঢাকনাটা ছেড়ে দিল হেবার। সশব্দে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে নিচে গর্তের ভিতর পড়ল পাথরটা। একদল মাছি উড়ে এল উপর দিকে। ভয়ে দ্রুত সরতে গিয়ে পিছলে পড়তে পড়তে রবার্টকে ধরে টাল সামলাল হেবার। ভীষণ ভয় পেয়েছে—ওখান থেকে চলে যাবার জন্যে রবার্টের হাত ধরে টানল সে।

‘না!! চিৎকার করে উঠল থর্ন।’

‘চলুন যাই!’

না!’ অস্বাভাবিক কণ্ঠে বলল থর্ন। ‘এবার অন্যটা খুলতে হবে!’

‘কি দরকার? যা দেখার তা তো দেখেছি আমরা।’

‘না, অন্যটাও দেখাতে হবে আমাকে,’ জেদি স্বরে বলল সে। ‘ওটাও একটা জন্তু হতে পারে!’

‘তাতে কি?’

‘তাহলে বুঝব আমার ছেলে বেঁচে আছে!’

দ্বিধায় পড়ল জেনিংস। রবার্টের কাতর চোখের দিকে চেয়ে টায়ার খোলার রডটা আবার হাতে তুলে নিল সে। ছোট কফিনের ঢাকনার ভিতর ওটা ঢুকিয়ে দিল। সাহায্য করার জন্যে থর্ন ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বুক ঢিপ ঢিপ করছে তার। জোরে চাপ দিয়ে এক টানে ঢাকনা তুলে ফেলল হেবার। তীব্র ব্যথায় কুঁচকে গেল রবার্টের মুখ। ছোট বাক্সটার মধ্যে রয়েছে একটা মানব শিশুর অবশিষ্ট অংশ। ওর ছোট্ট মাথাটা একেবারে থেঁতলে ভাঙা।

‘উহ’ ফুঁপিয়ে উঠল রবার্ট।

‘…যীশু…!’

‘বাচ্চাটাকে ওরা খুন করেছে! ‘চলুন বেরিয়ে যাই এখান থেকে।’

‘ওরা খুন করেছে আমার ছেলেকে।’ চড়া গলায় চিৎকার করে উঠল রবার্ট। সশব্দে ঢাকনাটা পড়ে বন্ধ হয়ে গেল ওটা।

‘খুন করেছে বাচ্চাটাকে,’ বিলাপ করে উঠল সে। ‘আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে ওরা!’

জোর করে রবার্টকে টেনে তুলে টানতে টানতেই তাকে নিয়ে চলল হেবার। কিন্তু থামতে বাধ্য হল সে। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর দেহ।

‘থর্ন।’

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে চাইল থর্ন। দেখল ঠিক সামনেই ঝোপের ফাঁক দিয়ে একটা জার্মান শেপহার্ড কুকুরের মাথা দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো কাছাকাছি বসানো, চকচক করছে। ওর আধখোলা মুখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা লালা পড়ছে। আক্রমণ করার আগে যেমন গলার ভিতর থেকে একটা ‘গ্র্’ শব্দ করে কুকুর, তেমনি ক্রুদ্ধ আওয়াজ করছে ও। হেবার আর বরার্ট নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এল কুকুরটা। ডানপাশে বুকের কাছে একটা দগদগে ঘা। ওটা থেকে কস লেগে আশেপাশের লোমগুলো জমাট বেঁধে গেছে। ওর পাশের ঝোপ থেকেও নড়াচড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। বেরিয়ে এল আর একটা কুকুরের মাথা। সাদা রঙ, মুখটা বিকৃত; এরও মুখ থেকে লালা ঝরছে! আর একটা বেরিয়ে এল ঝোপের আড়াল থেকে—তারপর আর একটা। কবরখানাটা জীবন্ত হয়ে উঠছে। দশটা! সবকটার মুখ থেকেই লালা ঝরছে।

নড়াচড়া করলেই আক্রমণ করে বসতে পারে এই ভয়ে ওরা নড়ছে না। এমন কি মাথা ঘুরিয়ে নিজেরা চোখাচোখি করতেও সাহস পাচ্ছে না।

‘….শবদেহের গন্ধ। ওই লোভেই বেরিয়ে এসেছে ওরা…’ ফিসফিস করে বলল হেবার। ‘ধীরে ধীরে পিছনে সরে যান।

এক রকম দম বন্ধ করেই পিছু হটতে আরম্ভ করল ওরা। কুকুরগুলোও সাথে সাথে একই গতিতে আগে বাড়তে আরম্ভ করল, যেন শিকারকে কোণঠাসা করছে। কি যেন বলতে চেষ্টা করল রবার্ট, কিন্তু তার গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বেরুল না। জেনিংস তার হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে সাহস জোগাল।

‘দৌড়াবেন না…ওরা কেবল… কবরের হাড়গোড়গুলো চায়…’ কাঁপা গলায় অভয় দেয়ার চেষ্টা করল হেবার।

কবর দুটো পার হয়ে এসেছে ওরা। কুকুরগুলো কবরের দিকে একবারও ফিরে চাইল না; কবর পার হয়ে সোজা ওদের দিকেই ক্রমাগত এগিয়ে আসছে ওরা। ওদের ওপর থেকে মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরাচ্ছে না। গতি বাড়িয়েছে কুকুরগুলো; ওদের মাঝে দূরত্ব ইঞ্চি ইঞ্চি করে কমে আসছে। মরিয়া হয়ে হেবারের চোখ বেড়া খুঁজল, দেখল এখনও প্রায় একশো গজ দূরে রয়েছে ওটা। দুজনেই ভয়ে পাংশু মুখে পিছু হটছে। পিঠে শক্ত কি যেন ঠেকতেই শিউরে উঠল রবার্ট। পাথরের সেই বিশাল মূর্তিটার নিচে এসে ঠেকেছে ওরা। কুকুরগুলো ছড়িয়ে পড়ে ঘিরে ফেলল ওদের, পালাবার কোন পথ নেই। কয়েক মুহূর্ত শিকারী আর শিকার, উভয় পক্ষই নিশ্চল রইল। সূর্য উঠেছে এখন। স্মৃতিফলকগুলোর মাথায় লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ অদৃশ্য কোন সঙ্কেত পেয়েই যেন কুকুরগুলো জাল গুটানোর মত ঘের কমিয়ে আনতে আরম্ভ করল। পিছনের পা দুটো গুটিয়ে লাফ দেয়ার জন্যে তৈরি হয়েই এগুচ্ছে সব কটা কুকুর।

‘ই-ইয়াহ্-হু!’ বিকট চিৎকার দিয়ে সামনে লাফিয়ে পড়ে সামনের কুকুরটাকে লক্ষ্য করে লোহার রডটা ছুঁড়ে মারল হেবার। মুহূর্তে গতি চঞ্চল হয়ে উঠল এলাকাটা, কুকুরগুলো একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপর। ওরাও ঠিক একই সময়ে ছুট দিল। কিন্তু কুকুরের লাফিয়ে পড়ার ধাক্কা সামলাতে না পেরে পড়ে গেল হেবার। কুকুরগুলো বারবার ওর গলায় কামড় বসাতে চাইছে। উপায় না দেখে গড়িয়ে চলল হেবার। ক্যামেরার স্ট্র্যাপটা শক্তভাবে পেঁচিয়ে গেছে ওর গলায়। থুতনির নিচে ক্যামেরাটা অনুভব করতে পারছে সে। কামড়ে ক্যামেরার লেন্সটা টুকরো টুকরো করে দিল আক্রমণকারী জন্তুগুলোর একটা। ওটা ছিঁড়ে সরিয়ে ফেলতে চাচ্ছে ওরা।

থর্নকে অনেক দূর যেতে দিয়েছে জন্তুগুলো। ছুটে চলেছে সে। হঠাৎ একটা বড়সড় কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিঠে কামড় বসিয়ে দিয়ে ঝুলছে কুকুরটা। সামনের পা দুটো শূন্যে। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল থর্ন। এখনও বেড়ার ধারে যেতে চেষ্টা করছে সে। আরও কয়েকটা কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। কামড়ে ওকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করছে ওরা। প্রাণপণে ওদের ঠেকাতে ঠেকাতে বেড়ার দিকে এগুতে চেষ্টা করছে সে। কিন্তু কোন ফল হচ্ছে না দেখে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বলের মত গোল হয়ে গেল রবার্ট। পিঠে বারবার দাঁত বসানর তীব্র ব্যথা অনুভব করছে ও। একবার চোখে পড়ল হেবার তখনও গড়াচ্ছে আর ঘুরছে—কুকুরগুলো ওর গলায় কামড় বসাবার চেষ্টা করছে। এখন আর কামড়ের ব্যথা অনুভব করছে না থর্ন, পালাবার তাগিদটাই বড় হয়ে উঠেছে তার। হামাগুড়ি দিয়ে সে এগিয়ে চলল। কুকুরগুলো তার পিঠ কামড়ে ঝুলছে। হঠাৎ তার হাতে ঠাণ্ডা কি যেন ঠেকল—জেনিংসের ছোঁড়া সেই লোহার রডটা। ওটা তুলে নিয়েই বাড়ি কষাল তার পিঠ কামড়ে থাকা কুকুরগুলোর উদ্দেশে। ‘কেঁউ কেঁউ’ আওয়াজ শুনে বুঝল জায়গা মত লেগেছে বাড়ি। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটেছে তার মাথার পাশ দিয়ে। পরমুহূর্তেই ওর সামনেই ঘুরে পড়ে গেল কুকুরটা; বাম চোখটা খুলে বেরিয়ে একটা রগের মাথায় ঝুলছে। উৎসাহিত হয়ে আবার সজোরে আঘাত হানল থর্ন তারপর রডটা দু’হাতে ধরে বাড়ি মারতে মারতে দু’পায়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল।

গড়াতে গড়াতে হেবার একটা গাছের তলায় চলে এসেছে। উঠতে চেষ্টা করছে সে, আর কুকুরগুলো এখনও ক্যামেরা আর গলায় পেঁচানো স্ট্র্যাপ কামড়াচ্ছে। তার গলায় কামড় বসিয়ে তাকে শেষ করার মতলবে আছে। ধস্তাধস্তিতে তার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠল। হঠাৎ উজ্জ্বল বাতি জ্বলে ওঠায় ভয়ে পিছিয়ে গেল জন্তুগুলো।

উঠে দাঁড়িয়েছে রবার্ট। দুহাতে ধরা রডটা দিয়ে কুকুরগুলোর মাথায় আর মুখে মারতে মারতে বেড়ার দিকে পিছাচ্চে সে। লাফিয়ে উঠে হেবারও পিছু হটে বেড়ার দিকে দ্রুত সরে আসছে। ফ্ল্যাশগানটা তার মুখের কাছে ধরা, কুকুরগুলো বেশি কাছে এলেই একবার করে ফ্ল্যাশ করছে। বেড়ার ধারে পৌঁছে গেল সেও।

রবার্টের কাছে পৌঁছে কুকুরগুলোকে সামলে অ্যামব্যাসেডরকে বেড়া বেয়ে ওঠার সুযোগ দিল হেবার। ছেঁড়া জামাকাপড় আর রক্তাক্ত দেহে বেড়ার ওপর উঠে নিজেকে সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে। একটা মরচে ধরা লোহার চোখা ফলা ঢুকে গেল রবার্টের বগলে। ব্যথায় চিৎকার করে নিজেকে অনেক কষ্টে টেনে তুলে লাফিয়ে বেড়ার ওপাশে পড়ল। এবার জেনিংসের পালা, কুকুরগুলো সামনে এলেই ফ্ল্যাশ করছে সে। ওপরে উঠে নিচের গর্জনরত কুকুরগুলোর দিকে রাগের মাথায় ফ্ল্যাশগানটাই ছুঁড়ে মারল সে। তারপর লাফিয়ে পড়ল ওপারে। ওখানে বসে ককাচ্ছে রবার্ট। হেবার ওকে তুলে প্রায় বয়েই নিয়ে এল গাড়ির কাছে। ওদের দিকে একবার আতঙ্কিত চোখে চেয়ে চিৎকার করে উঠল ড্রাইভার। সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে রবার্ট আর হেবারকে পিছনের সিটে উঠতে সাহায্য করল। গাড়িতে বসে ওরা দেখল বেড়ার ওপাশে একেবারে হন্যে হয়ে উঠেছে জন্তুগুলো। একটা কুকুর লাফিয়ে পার হতে চেষ্টা করল কিন্তু শেষ পর্যন্ত অতদূর পৌঁছতে পারল না—গলাটা গেঁথে গেল উপরের চোখা লোহার কাঁটায় ফোয়ারার মত রক্ত বেরিয়ে আসছে। রক্তের স্বাদে পাগল হয়ে অন্যান্য কুকুরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। জ্যান্তই ওরা খেয়ে ফেলল তাকে। নিষ্ফল আক্রোশে সে কেবল পা ছুঁড়ল, কাউকে বাধা দিতে পারল না।

ট্যাক্সি ছুটে চলল। ড্রাইভার তার রিয়ার ভিউ মিররে লক্ষ্য করল পিছনের লোক দুজনকে আর মানুষ বলে চেনার উপায় নেই। ছেঁড়া কাপড় আর রক্তে কিম্ভূতকিমাকায় চেহারা হয়েছে ওদের। দুজনে দুজনকে ধরে ওরা ফোঁপাচ্ছে ছোট বাচ্চার মত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *