অশুভের সমস্যা
সংসারে অশুভ কেন রয়েছে এই প্রশ্ন অসম্পূর্ণতা কেন রয়েছে, অথবা, অন্যভাবে বলতে গেলে, সৃষ্টি আদৌ কেন রয়েছে এই প্রশ্নের সমান। আমাদের ধরে নিতে হবে যে অন্যরকম কিছু হতে পারতো না; সৃষ্টি অবশ্যই অসম্পূর্ণ, অবশ্যই ক্রমান্বয়ে হয়েছে, আর তাই আমরা কেন আছি এই প্রশ্ন নিরর্থক।
অথচ এই হলো আসল প্রশ্ন যা আমাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত: এই অসম্পূর্ণতা কি সর্বশেষ সত্য, অশুভ কি চরম ও চূড়ান্ত? নদীর নিজের সীমানা আছে, তীর আছে, কিন্তু নদী কি শুধুই তীর মাত্র? কিংবা তীর কি নদীর শেষ তথ্য? এই সকল বাধা নিজেরাই কি নদীর জলকে সামনে এগিয়ে দেয় না? গুণ টানার দড়ি নৌকাকে বেঁধে রাখে, কিন্তু দড়ির অর্থ কি শুধু বাঁধা? একই সঙ্গে সে কি নৌকাকে সামনে টেনে নিয়ে যায় না?
জগতের স্রোতের সীমানা আছে, তা না হলে তার কোনো অস্তিত্ব থাকতো না, কিন্তু যে সীমানা তাকে ধরে রেখেছে, তার মধ্যে তার লক্ষ্যকে দেখা যায় না, দেখা যায় গতির মধ্যে, এই গতি পূর্ণতার দিকে। এ জগতে বাধা-বিপত্তি ও দুঃখ-বেদনা অবশ্যই আছে সেখানে বিস্ময়ের কিছু নেই, কিন্তু আইন ও শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য ও আনন্দ, শুভ ও প্রেমও যে অপরিহার্য এখানেই বিস্ময়। মানুষের সত্তার মধ্যে ঈশ্বরের যে ধারণা রয়েছে তাই হলো সকল বিস্ময়ের বড় বিস্ময়। তার অস্তিত্বের গভীরে সে অনুভব করেছে যা অসম্পূর্ণ রূপে প্রতীয়মান তা পূর্ণতারই প্রকাশ; ঠিক যেমন গান শোনার কান যার আছে সে বাস্তবে গানের সুর পর্যায়ক্রমে শুধু শুনতে থাকলেও গানের পূর্ণাঙ্গ রূপ উপলব্ধি করতে পারে। মানুষ আবিষ্কার করেছে যা সীমাবদ্ধ তা সীমার মধ্যে অবরুদ্ধ নয় বলে আপাত দৃষ্টিতে আত্মবিরোধী হলেও পরম সত্যের বিরোধী নয়; সে সদা চলমান, প্রতি মুহূর্তে সে তার সসীমতা ত্যাগ ক’রে চলেছে। বস্তুতঃ, অপূর্ণতা পূর্ণতার নেতিবাচক দিক নয়; সসীমতা অসীমতার বিপরীত নয়: আংশিকভাবে তারা পরিপূর্ণতারই প্রকাশ মাত্র, সীমার মধ্যে অসীমের প্রকাশ।
বেদনা সসীমতার অনুভূতি হলেও আমাদের জীবনে স্থায়ী নয়। আনন্দের মতো এ নিজের মধ্যে নিজে নিঃশেষিত নয়। একে ভোগ করতে গেলে জানতে হয় সৃষ্টির প্রকৃত স্থায়িত্বে এর কোনো অংশ নেই। আমাদের বুদ্ধিকেন্দ্রিক জীবনে ভুল ভ্রান্তি যেমন, এও সেই রকম। বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে যেতে হলে বিভিন্ন সময়ে যে সব ভুল ভ্রান্তি বিজ্ঞান করেছে তার গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অথচ বিজ্ঞান যে ভুল ভ্রান্তি ইতস্তত ছড়িয়ে দেওয়ার এক নিখুঁত পদ্ধতি মাত্র এ কেউ বস্তুতঃ বিশ্বাস করে না। অসংখ্য ভুল ভ্রান্তি নয়, সত্য প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতি বিজ্ঞানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্মরণীয় বিষয়। ভুল কখনো স্বরূপতঃ অপরিবর্তনীয় হতে পারে না; সত্যের সঙ্গে থাকতে পারে না; ভবঘুরে যেমন তার দেনা পুরোপুরি মেটাতে না পেরে বাসস্থান ছেড়ে চলে যায়, ভুলও সেইরকম করে।
বুদ্ধির ভুলের মতো যে কোনো ধরনের অশুভের বৈশিষ্ট্য হলো অস্থায়িত্ব, কারণ পূর্ণতার সঙ্গে সে কোনো সংগতি স্থাপন করতে পারে না। প্রতি মুহূর্তে প্রকৃত তথ্যের সামগ্রিকতায় অশুভের সংশোধন হতে থাকে, আর সে তার রূপের পরিবর্তন করতে থাকে। আমরা তাকে নিশ্চল কল্পনা ক’রে তার গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলি। প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে যে পরিমাণে মৃত্যু ও বিকৃতি হয়ে চলেছে, আমরা যদি তার পরিসংখ্যান জড়ো করতে পারতাম, তা হলে তা আমাদের আতঙ্কিত করতো। কিন্তু অশুভ সদা চলমান; তার বিশালত্ব অপরিমেয় হলেও কার্যতঃ সে আমাদের জীবন স্রোতে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না; আর আমরা দেখতে পাই মাটি, জল ও বায়ু জীবিতদের জন্য সুমিষ্ট ও নির্মল থাকে। চলমান সবকিছুকে স্থির ক’রে দেখাবার চেষ্টা আমাদের এই সমস্ত পরিসংখ্যানে আছে; আর বাস্তবে না থাকলেও এই প্রক্রিয়ায় সবই আমাদের মনে বোঝা হয়ে ওঠে। এই কারণে একজন মানুষ, জীবিকায় যিনি জীবনের কোনো এক বিশেষ দিকের সঙ্গে যুক্ত, সেই দিককে বড় ক’রে দেখাতে তিনি উন্মুখ হয়ে ওঠেন; তথ্যের উপরে অযথা গুরুত্ব দিয়ে সত্যের উপর তাঁর অধিকার হারান। একজন সত্যান্বেষী যাবতীয় অপরাধ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিশ্লেষণের সুযোগ পেতে পারেন, কিন্তু সমগ্র সমাজের অর্থনীতিতে এই অপরাধের আপেক্ষিক স্থান সম্বন্ধে তাঁর অনুভূতি হারিয়ে ফেলেন। পশু-জগতে বেঁচে থাকার জন্য যে সংগ্রাম চলছে, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞান যখন তথ্য সংগ্রহ করে তখন সে আমাদের মনে “রক্তাক্ত নখদন্তময়ী প্রকৃতির” এক ছবি তুলে ধরে। আমরা মনের মধ্যে এই ছবিগুলির রঙ ও আকারে এক স্থায়ী রূপ দিয়ে থাকি কিন্তু বাস্তবে এই রূপ অদৃশ্য হয়ে যায়। এ যেন আমাদের শরীরের প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে বাতাসের ওজন মেপে প্রমাণ করা যে এই বাতাস অবশ্যই আমাদের চূর্ণ করার মতো ভারী। তা সত্ত্বেও, প্রত্যেক ওজনের এক এক রকম নিয়ন্ত্রণ থাকে, আর সেইজন্য আমরা সহজে আমাদের ভার বহন করতে পারি। প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার সংগ্রামের মধ্যে এক পারস্পরিক সম্বন্ধ আছে। শিশুদের প্রতি ও সঙ্গীদের প্রতি ভালবাসা আছে; আছে আত্মত্যাগ, যা ভালবাসার থেকে উৎসারিত; আর এই ভালবাসা নিঃসন্দেহে জীবনের মূলসূত্র।
আমাদের পর্যবেক্ষণের তীব্র সন্ধানী আলো আমরা যদি মৃত্যুর বাস্তবতার উপরেই দিয়ে রাখতাম, তা হলে আমাদের কাছে এই জগৎ, কবর খুঁড়ে তুলে আনা অস্থি রাখবার এক বিশাল জায়গা বলে মনে হতো; কিন্তু পার্থিব জীবনে আমরা দেখি আমাদের মনের উপরে মৃত্যুচিন্তার প্রাধান্যের সম্ভাবনা নিতান্তই কম। তার কারণ এই নয় যে সে অস্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান; বরং তার কারণ সে জীবনের নেতিবাচক দিক; ঠিক যেমন, প্রতি মুহূর্তে আমরা যে চোখের পাতা বন্ধ করি তা বাস্তব সত্য হলেও, চোখ বার-বার খুলে রাখাকেই গ্রাহ্য করা হয়। সামগ্রিক ভাবে জীবন কখনো মৃত্যুকে গুরুত্ব দেয় না। মৃত্যুর মুখের উপর সে হাসে, নাচে ও খেলে, সে গঠন করে, জমা ক’রে রাখে ও ভালবাসে। একমাত্র যখন কোনো এক মৃত্যুর বাস্তবতাকে আমরা আলাদা ক’রে ধরি, তখনই মৃত্যুর শূন্যতা দেখতে পাই আর আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। মৃত্যু যে কোনো জীবনের পূর্ণতার এক অংশ মাত্র তা আমরা দেখতে পাই না। এ যেন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে এক টুকরো কাপড় দেখা। সেই কাপড়টি জালের মতো দেখায়; আমরা স্থির দৃষ্টিতে বড় বড় ফুটোর দিকে তাকিয়ে থাকি আর কল্পনায় শিউরে উঠি। কিন্তু সত্য হলো, মৃত্যু চরম তত্ত্ব নয়। সে দেখতে কালো, আকাশ যেমন দেখতে নীল; কিন্তু সে জীবনকে কালিমা লিপ্ত করে না, যেমন ক’রে আকাশ পাখির ডানায় তার দাগ রেখে যায় না।
আমরা যখন লক্ষ্য করি একজন শিশু হাঁটতে চেষ্টা করছে, তখন আমরা তার অগুনতি অসাফল্য দেখি; তার সাফল্য কিন্তু অল্পই থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের পর্যবেক্ষণকে যদি সীমিত করতে হতো, তা হলে দৃশ্যটি নির্মম হতো। কিন্তু আমরা দেখি বার-বার অসাফল্য সত্ত্বেও শিশুটির ভিতরে এক খুশির প্রেরণা আছে, আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব কাজ ক’রে যেতে এই প্রেরণা তাকে ধরে রাখে। আমরা দেখি সে তার পড়ে যাওয়া সম্বন্ধে ততটা ভাবে না যতটা ভাবে তার এক মুহূর্তের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষমতা সম্বন্ধে।
একজন শিশুর হাঁটার চেষ্টার এইসব দুর্ঘটনার মতো, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আমরা নানা ধরনের দুঃখের সম্মুখীন হয়ে থাকি, এই দুঃখ আমাদের জ্ঞানের, ও আমাদের অধিগত ক্ষমতার, ও আমাদের ইচ্ছা প্রয়োগের অসম্পূর্ণতা দেখায়। এরা যদি আমাদের কাছে কেবল আমাদের দুর্বলতা দেখাতো তা হলে চরম হতাশায় আমাদের মৃত্যু বরণ করাই উচিত হতো। আমাদের কাজের পর্যবেক্ষণের জন্য যখন আমরা সীমিত ক্ষেত্র মাত্র নির্বাচন করি তখন আমাদের মনে আমাদের ব্যক্তিগত অসাফল্য ও দুঃখ বেদনা বড় হয়ে দেখা দেয়; কিন্তু সহজাত ভাবে জীবন আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করার দিকে নিয়ে যায়। পূর্ণতার এক আদর্শ সে আমাদের সামনে তুলে ধরে, এই আদর্শ বর্তমানের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে চিরকাল আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের মধ্যে এমন এক আশা রয়েছে যা সারাক্ষণ বর্তমানের সংকীর্ণ অভিজ্ঞতা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে চলে; আমাদের মধ্যে যে অসীম রয়েছেন এ হলো তাঁর প্রতি শাশ্বত বিশ্বাস, আমাদের কোনো অসামর্থ্যকে এ চিরস্থায়ী সত্য বলে কখনো গ্রহণ করে না; তার নিজের কর্মের পরিধির কোনো সীমা নির্ধারণ করে না; দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করার সাহস রাখে যে মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে এক; এবং এর বন্ধনহীন কল্পনা প্রতিদিন সত্য হয়ে ওঠে।
আমাদের সত্য দর্শন হয় যখন আমাদের মন আমরা অসীমে নিবিষ্ট করি। সংকীর্ণ বর্তমানে সত্যের আদর্শ থাকে না, আমাদের তাৎক্ষণিক অনুভূতিতেও থাকে না, কিন্তু থাকে পূর্ণতা সম্বন্ধে আমাদের চেতনার মধ্যে, এই চেতনা আমাদের ‘যা রয়েছে’ তারই মধ্যে আমাদের ‘যা পাওয়া উচিত’ তার আস্বাদ দেয়। সচেতন ভাবে হোক বা অচেতন ভাবে হোক সত্যের এই অনুভূতি আমাদের জীবনে রয়েছে যে যা প্রকাশিত হয় তার থেকে এ চিরদিনই অনেক বড়; কারণ আমাদের জীবন তার গতিশীলতার মধ্যে অসীমের মুখোমুখি হয়। তাই তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা যা পেয়েছে তার থেকেও অসংখ্য গুণ বেশী, আর যত সে এগিয়ে চলে তত দেখে যে সত্যের কোনো উপলব্ধি সীমাবদ্ধতার মরুভূমিতে তাকে কখনো আটকে রেখে যায় না, বরং এই অবস্থা অতিক্রম ক’রে তাকে অন্য কোনোখানে নিয়ে যায়। অশুভ কখনো পুরোপুরি জীবন যাত্রার রাজপথের গতিরোধ করতে পারে না আর তার অধিকৃত বিষয়ও কেড়ে নিতে পারে না। কারণ অশুভকে এগিয়ে চলতে হয়, তাকে শুভ হয়ে উঠতে হয়; সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না আর সর্বময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে না। অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিন্দুমাত্র অশুভ যদি কোথাও থেমে থাকতে পারতো, তা হলে সে গভীরে ডুব দিয়ে অস্তিত্বের একেবারে মূলে ঢুকে যেতো। মানুষ, এমনিতে, অশুভে আসলে বিশ্বাস করে না, ঠিক যেমন সে বিশ্বাস করতে পারে না যে বেহালার তারগুলিকে বেসুরের তীব্র যন্ত্রণা সৃষ্টি করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক ভাবে তৈরী করা হয়েছিল, যদিও গাণিতিক পরিসংখ্যানের সাহায্যে প্রমাণ করা যায় সামঞ্জস্যের থেকে অসামঞ্জস্যের সম্ভাবনা অনেক বেশী, আর যে বেহালা বাজাতে পারে তার থেকে হাজার জন আছে যারা বাজাতে পারে না। বাস্তবের অসংগতিকে দক্ষতার শক্তি ছাপিয়ে যায়। সন্দেহ নেই এমন অনেক মানুষ ছিলেন যাঁরা ঘোষণা করেছিলেন জীবন হলো চরম অশুভ, কিন্তু মানুষ কখনো তাঁদের গুরুত্ব দিতে পারে না। তাঁদের দুঃখবাদ শুধু বুদ্ধি বা আবেগের ভঙ্গি মাত্র; অথচ জীবন নিজে আশাবাদী: সে চলতে চায়। দুঃখবাদ এক ধরনের মানসিক সুরাসক্তি, স্বাস্থ্যকর আহারকে সে ঘৃণা করে, নিন্দার কড়া পানীয়কে প্রশ্রয় দেয়, আর এক কৃত্রিম হতাশা সৃষ্টি করে, এই হতাশা আরও কড়া পানের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়। জীবন যদি অশুভ হতো, তা হলে তা প্রমাণ করার জন্য কোনো দার্শনিকের অপেক্ষায় থাকতো না। এ যেন একজন মানুষকে আত্মহত্যার দায়ে অপরাধী করার মতো, যদিও সারাক্ষণ তোমার সামনে সে রক্তমাংসের দেহে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে জীবন নিজে উপস্থিত থেকে প্রমাণ করছে যে সে অশুভ হতে পারে না।
কোনো অসম্পূর্ণতা যা পুরোপুরি অসম্পূর্ণতা নয়, বরং সম্পূর্ণতা যার আদর্শ, তাকে এক স্থায়ী উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই ভাবে, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির কাজ হলো সমস্ত অসত্যের মধ্যে দিয়ে সত্যের উপলব্ধি করা, এবং জ্ঞান হলো ক্রমাগত ভুলভ্রান্তি পুড়িয়ে দিয়ে সত্যের আলো উন্মুক্ত করা ছাড়া আর কিছু নয়। সম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য আমাদের ইচ্ছাকে, আমাদের স্বভাবকে, ক্রমাগত আমাদের ভিতরের বা বাইরের বা উভয়ের অশুভকে অতিক্রম করতে হয়; আমাদের শারীরিক জীবন প্রতি মুহূর্তে জীবনের আগুন জ্বালিয়ে রাখার জন্য দৈহিক উপাদানগুলির ক্ষয় করছে; আর আমাদের নৈতিক জীবনেরও পোড়ানোর মতো ইন্ধন আছে। এই জীবন-প্রক্রিয়া চলছে— আমরা তা জানি, আমরা তা অনুভব করেছি; আর আমাদের বিশ্বাস আছে অশুভ থেকে শুভ হলো মানবজাতির লক্ষ্য, এর বিপরীত কোনো স্বতন্ত্র উদাহরণ এই বিশ্বাসকে টলাতে পারে না। কারণ আমরা অনুভব করি শুভ হলো মনুষ্য প্রকৃতির ইতিবাচক উপাদান, প্রত্যেক যুগে, প্রত্যেক দেশে মানুষ তার শুভ বা মঙ্গলের আদর্শকে সর্বাধিক মূল্য দিয়েছে। আমরা শুভকে জেনেছি, আমরা তাকে ভালবেসেছি, আর নিজের জীবনে যাঁরা দেখিয়েছেন শুভ কি, তাঁদের প্রতি আমরা আমাদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানিয়েছি।
প্রশ্ন করা হবে শুভ কী? আমাদের নৈতিক প্রকৃতি বলতে কি বোঝায়? আমার উত্তর হলো, নিজের যথার্থ স্বরূপের প্রতি মানুষের দৃষ্টি যখন প্রসারিত হতে শুরু করে, যখন সে উপলব্ধি করে যে বর্তমানে তার নিজেকে যা মনে হচ্ছে, তার থেকে সে আরও অনেক বড়, তখন সে নিজের নৈতিক প্রকৃতি সম্বন্ধে সচেতন হতে শুরু করে। যা তাকে হতে হবে, [সে সম্বন্ধে] সে তখন সতর্ক হয়ে ওঠে, আর যে অবস্থার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তার হয়েছে তার থেকে যে অবস্থার অভিজ্ঞতা তার এখনো হয়নি সেই অবস্থা তার কাছে আরো বাস্তব হয়ে ওঠে। অপরিহার্য ভাবে, তার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়, আর তার ইচ্ছা, তার আকাঙ্ক্ষার স্থান নেয়। কারণ ইচ্ছা হলো বৃহত্তর জীবনের চরম আকাঙ্ক্ষা, এই বৃহত্তর জীবনের বেশীর ভাগ অংশ বর্তমানে আমাদের নাগালের বাইরে, তার লক্ষ্যের অধিকাংশ আমাদের চোখের সামনে নেই। এর পরই শুরু হয় আমাদের ছোট আমির সঙ্গে বড় আমির, আমাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ইচ্ছার, আমাদের ইন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করে এমন কিছু পাওয়ার বাসনার সঙ্গে আমাদের অন্তরের অভীষ্ট লক্ষ্যের সংঘাত। তখন আমরা তাৎক্ষণিক আকাঙ্ক্ষা প্রেয়ের সঙ্গে যা শ্রেয় তার পার্থক্য করতে শুরু করি। কারণ আমাদের বৃহত্তর সত্তা বড় আমির জন্য যা অভীষ্ট তাই হলো শ্রেয়। এই ভাবে আমাদের আরো যথার্থ জীবন-দর্শনের মধ্যে থেকে শ্রেয় বা মঙ্গলের ধারণা বেরিয়ে আসে, যা বিস্তৃত জীবনের সম্পূর্ণতার সংযোগকারী ধারণা, এবং আমাদের সামনে যা রয়েছে শুধুমাত্র তার নয়, যা নেই, আর যা হয়তো কখনো মানুষের দ্বারা সম্ভব হতে পারবে না এ তারও বিবেচনা করে। মানুষ দূরদর্শী, যে জীবন তার আছে, তার থেকে যে জীবনের অস্তিত্ব এখনো নেই সেই জীবন সম্বন্ধে সে আরো অনেক বেশী অনুভূতিশীল; তাই যে ভবিষ্যৎ এখনো বাস্তবে পরিণত হয়নি, তার জন্য সে তার বর্তমান অনুরাগ ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে। এতে সে মহৎ হয়ে ওঠে, কারণ সে সত্য উপলব্ধি করে। এমনকি সুদক্ষ ভাবে স্বার্থপর হতে গেলেও মানুষকে এই সত্য স্বীকার করতে হয়, আর তার নিজের তাৎক্ষণিক আবেগ খর্ব করতে হয়— অন্য ভাবে বললে তাকে নীতিপরায়ণ হতে হয়। কারণ আমাদের নৈতিক শক্তি এমন এক শক্তি যা দিয়ে আমরা জানতে পারি জীবন বিচ্ছিন্ন অংশে তৈরী নয়, উদ্দেশ্যহীন নয় ও ধারাবাহিকতাহীন নয়। মানুষের এই নৈতিক বোধ শুধু যে কালের মধ্যে আত্মা অবিরাম রয়েছেন এই দেখার শক্তি তাকে দিয়েছে তা নয়, কিন্তু তাকে এও দেখতে সাহায্য করেছে যে যতক্ষণ সে কেবল নিজের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখে ততক্ষণ সে নিজেও সত্য থাকে না। বাস্তবের মধ্যে সে যতটা রয়েছে তার থেকে বেশী রয়েছে সত্যের মধ্যে। আসলে সে সেই সব ব্যক্তিদের একজন যাঁরা তার নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অন্তর্ভুক্ত নন, আর যাঁদের জানার কখনো কোনো সম্ভাবনাও তার নেই। তার বর্তমান চেতনার বাইরে নিজের ভবিষ্যৎ সত্তা সম্বন্ধে তার যেমন এক অনুভূতি আছে, সেই রকম তার ব্যক্তিত্বের সীমার বাইরে নিজের বৃহত্তর সত্তা সম্বন্ধেও এক অনুভূতি আছে। এমন কোনো মানুষ নেই যাঁর এই অনুভূতি কিছু মাত্রাতেও নেই, যিনি কখনো নিজের স্বার্থপর বাসনা অন্য কোনো লোকের জন্য ত্যাগ করেননি, অন্য কাউকে খুশী করার জন্য যিনি কখনো কোনো ক্ষতি বা সংকটের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আনন্দ পাননি। এ কথা সত্য মানুষ কোনো বিচ্ছিন্ন প্রাণী নয়, তার এক সর্বব্যাপী চেহারা আছে; আর যখন সে তা বুঝতে পারে, তখন মহান হয়ে ওঠে। এমনকি সব থেকে ক্ষতিকারক স্বার্থপরতাও যখন অশুভ কাজ করার শক্তি খোঁজে, তখন তাকে এই অবস্থা স্বীকার করতে হয়; কারণ সত্যকে অগ্রাহ্য ক’রে সে শক্তিশালী হতে পারে না। কাজেই সত্যের সহযোগিতা দাবি করতে গেলে, স্বার্থপরতাকে কিছু মাত্রায় নিঃস্বার্থ হতে হয়। কোনো দস্যুদলকে দলবদ্ধ থাকতে গেলে অবশ্য ন্যায়পরায়ণ হতে হয়; তারা সারা বিশ্ব লুঠ করতে পারে কিন্তু একে অন্যকে নয়। কোনো অনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করতে হলে, এর কিছু অস্ত্রশস্ত্রকে ন্যায়পরায়ণ হতে হয়। বস্তুতঃ, প্রায়ই আমাদের নৈতিক শক্তি আমাদের অমঙ্গল ঘটানোর কার্যকরী ক্ষমতা দেয়, আমরা ব্যক্তিগত লাভের জন্য অন্যদের শোষণ করতে পারি, যথার্থ অধিকার থেকে অন্যায় ভাবে অন্যদের বঞ্চিত করতে পারি। একটি পশুর জীবনে নৈতিকতা নেই, কারণ সে কেবল তাৎক্ষণিক বর্তমান সম্বন্ধেই সচেতন; একজন মানুষের জীবন অনৈতিক হতে পারে, কিন্তু তার একমাত্র অর্থ হলো অবশ্যই তার মূলে কোনো নীতি আছে। যা অনৈতিক, আসলে তা অসম্পূর্ণ ভাবে নৈতিক, ঠিক যেমন যা মিথ্যা তা অল্প মাত্রায় হলেও সত্য, তা না হলে সে মিথ্যা হতে পারে না। দেখতে না পাওয়া অন্ধ হয়ে যাওয়া, কিন্তু ভুল ভাবে দেখা শুধুমাত্র অসম্পূর্ণ ভাবে দেখা। মানুষের স্বার্থপরতায় জীবনের কিছু সম্পর্ক, কিছু উদ্দেশ্য দেখতে পাওয়া শুরু হয়; আর তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে গেলে, আত্মসংযম ও ব্যবহারে শৃঙ্খলার প্রয়োজন হয়। একজন স্বার্থপর মানুষ নিজের জন্য স্বেচ্ছায় অনেক অসুবিধার মধ্যে দিয়ে যায়, অস্পষ্ট ভাবেও কোনো অসন্তোষ প্রকাশ না করে সে অভাবের মধ্যে থাকে ও কষ্ট ভোগ করে, তার সহজ কারণ সে জানে যে অল্প সময়ের ব্যবধানের দিক থেকে দেখলে যা দুঃখ ও কষ্ট, বৃহত্তর দৃষ্টিতে আসলে তা ঠিক বিপরীত। তাই ক্ষুদ্র মানুষের কাছে যা ক্ষতি, মহতের কাছে তাই লাভ, আর বিপরীত ভাবেও সেই রকম।
যে ব্যক্তি নিজের দেশের জন্যই হোক, মানব জাতির মঙ্গলের জন্যই হোক, কোনো আদর্শ নিয়ে জীবন যাপন করেন, তাঁর কাছে জীবনের এক ব্যাপক অর্থ থাকে, আর সেই ব্যাপ্তি অনুযায়ী তাঁর কাছে দুঃখের গুরুত্ব কমে যায়। মঙ্গলের জন্য জীবন যাপন করা হলো সকলের জন্য জীবন যাপন করা। সুখ কেবল নিজের জন্য, কিন্তু মঙ্গল সকল মানবজাতির ও সর্বকালের আনন্দের সঙ্গে যুক্ত। মঙ্গলের দৃষ্টিকোণ থেকে সুখ ও দুঃখ ভিন্ন অর্থে প্রতীত হয়; এতটাই হয় যে সুখকে পরিহার করা যায়, সেই জায়গায় দুঃখকে বরণ করা যায়, আর জীবনকে এক উচ্চতর মূল্য দেয় বলে স্বয়ং মৃত্যুকেও স্বাগত জানানো যায়। মানবজীবনের এই উচ্চ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য, মঙ্গলের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য, সুখ ও দুঃখ তাদের চরম মূল্য হারিয়ে ফেলে। ইতিহাসে শহীদেরা এর প্রমাণ দিয়েছেন, আর আমরাও আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ছোট ছোট শহীদ হয়ে তা প্রমাণ করি। আমরা যখন সমুদ্র থেকে এক কলসী জল নিয়ে থাকি তার একটা ওজন থাকে, কিন্তু আমরা যখন সমুদ্রেই ডুব দিই, তখন আমাদের মাথার উপর দিয়ে হাজার কলসী জল বয়ে যায়, অথচ আমরা তার কোনো ওজন অনুভব করি না। আমাদের শক্তি দিয়ে আমাদের অস্তিত্বের কলসী বয়ে নিয়ে যেতে হয়; আর সেই জন্য, যতক্ষণ আমরা স্বার্থপরতার স্তরে থাকি, সুখ ও দুঃখের ভার ততক্ষণ পুরোপুরি থাকে, নৈতিকতার স্তরে সেই ভার এতই হালকা হয়ে যায় যে যিনি সেই অবস্থায় পৌঁছে যান তিনি কষ্টভোগের প্রবল চাপের মধ্যে ধৈর্য্য দিয়ে, নিদারুণ নির্যাতনের সামনে ক্ষমা দিয়ে আমাদের কাছে প্রায় মহামানব রূপে প্রতিভাত হন।
যথার্থ মঙ্গলের মধ্যে থাকা হলো অসীমের মধ্যে নিজের জীবনকে উপলব্ধি করা। আমাদের অন্তরে জীবনের সম্পূর্ণতা সম্বন্ধে যে সুস্পষ্ট নৈতিক ধারণা রয়েছে তার শক্তিতে আমরা জীবনের এই সর্বব্যাপী দৃষ্টি পেতে পারি। আর বুদ্ধদেবের শিক্ষা এই নৈতিক শক্তির সর্বোচ্চ উন্নতি সাধন করার শিক্ষা, আমাদের ক্ষুদ্র সত্তার স্তরে আমাদের কর্মক্ষেত্র যে আবদ্ধ নয় তা জানার শিক্ষা। এই হলো যিশুখ্রীষ্টের দৃষ্টিতে স্বর্গরাজ্য। আমরা যখন সর্বব্যাপী নৈতিক জীবন লাভ করি, তখন সুখ দুঃখের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাই, আর আমাদের ব্যক্তিসত্তার যে স্থান খালি হয়, সেই স্থান এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে যায়, অপরিমেয় ভালবাসা থেকে সেই আনন্দ উৎসারিত হয়। এই অবস্থায় আত্মার কর্ম অনেক বেশী উন্নত হয়, তবে তার ক্রিয়াশক্তি বাসনা থেকে আসে না, আসে তার নিজের আনন্দ থেকে। এই হলো গীতার কর্ম-যোগ, নিরাসক্ত মঙ্গলজনক কর্মের অনুশীলন দিয়ে ঈশ্বরের অনন্ত কর্মের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার পথ।
দুঃখের প্রভাব থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করার পথ অনুসন্ধানে বুদ্ধদেব যখন ধ্যানস্থ ছিলেন, তখন তিনি এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন: মানুষ যখন ব্যক্তিকে বিশ্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ক’রে তার চরম লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, তখন সে দুঃখের দাসত্ব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এই বিষয়ে আরো বিস্তৃত ভাবে আমরা আলোচনা করতে পারি।
আমার এক ছাত্র একবার আমার কাছে ঝড়ের মধ্যে তার দুঃসাহসিক অভিযানের কথা বলেছিল, আর অভিযোগ করেছিল, সারাক্ষণ এই ভেবে সে কষ্ট পাচ্ছিল যে প্রকৃতির এই বিশাল আলোড়ন তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছিল যেন সে একমুঠো ধুলো ছাড়া আর কিছু নয়। তার যে এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব আছে, নিজস্ব ইচ্ছা আছে, তার কিছু মাত্র প্রভাব, যা ঘটে যাচ্ছিল তার উপর পড়েনি।
আমি বলেছিলাম, “আমাদের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের গুরুত্ব যদি প্রকৃতিকে তার নিজস্ব পথ থেকে দুলিয়ে দিতে পারতো, তা হলে ব্যক্তিরাই বেশী কষ্ট পেতো।”
কিন্তু সে তার সংশয়ে অটল ছিল, বলেছিল— আমি আছি এই অনুভূত সত্য অগ্রাহ্য করা যায় না। আমাদের মধ্যে “আমি” এমন এক সম্বন্ধ খোঁজে যা তার ব্যক্তিগত।
আমি উত্তর দিয়েছিলাম যার সঙ্গে “আমি”র সম্বন্ধ সে আমি— নই।” কাজেই আমাদের এমন এক মাধ্যম প্রয়োজন যা দু’জনের জন্য সমান, আর আমাদের এই বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে হবে যে, এ “আমি”র কাছেও যা, “আমি— নই” এর কাছেও তাই।
এখানে এর পুনরাবৃত্তি করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য স্বভাবতঃ বিশ্বের খোঁজে অনুপ্রাণিত হয়। আমাদের দেহ যদি নিজের সারাংশ খাওয়ার চেষ্টা করে তা হলে সে শুধু বিনষ্ট হতে পারে, আর আমাদের চোখ যদি শুধু নিজেকেই দেখে তা হলে তার দেখার অর্থ হারিয়ে ফেলে।
ঠিক যেমন ক’রে আমরা দেখি যে কল্পনা যত জোরালো হয় তত সে কেবল অলীক কল্পনা মাত্র থাকে না ও সত্যের সঙ্গে সে তত বেশী সমন্বিত হয়, সেইরকম আমাদের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য যত বলিষ্ঠ হয় তত সে বিশ্বের দিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে। কারণ ব্যক্তিত্বের মহত্ত্ব তার নিজের মধ্যে নেই, আছে তার নিখিল আধারে, ঠিক যেমন কোনো হ্রদের গভীরতা বিচার করা হয় তার গহ্বরের আয়তন দিয়ে নয় তার জলের গভীরতা দিয়ে।
সুতরাং, এ যদি যথার্থ হয় যে আমাদের প্রকৃতির আকুল আকাঙ্ক্ষা বাস্তবতার জন্য রয়েছে, আর আমাদের ব্যক্তিত্ব তার নিজের সৃষ্ট অসার কল্পনার জগতে কখনো সুখী হয় না, তা হলে স্পষ্টতঃ তার পক্ষে সব থেকে এটিই ভাল যে আমাদের ইচ্ছা একমাত্র সব বিষয়ের নিজস্ব নিয়ম নীতি অনুসরণ ক’রে তাদের ব্যবহার করতে পারে, আর নিজের খুশী মতো তা করতে পারে না। বশ্যতা স্বীকার করে না এমন নিশ্চিত বাস্তবতা অনেক সময় আমাদের ইচ্ছাকে ব্যাহত করে, আর প্রায়ই আমাদের সর্বনাশের দিকে নিয়ে যায়, যেমন ক’রে যে শিশু হাঁটতে শিখছে সে যখন পড়ে যেতে থাকে তখন শক্ত মাটি তাকে অবশ্যই আঘাত করে। তা সত্ত্বেও যে দৃঢ়তা তাকে আঘাত করে সেই আবার তার হাঁটা সম্ভব করে। একবার একটা সেতুর নীচ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার নৌকার মাস্তুল সেতুর একটা বড় কড়িকাঠে আটকে গিয়েছিল। মাত্র এক মুহূর্তের জন্য মাস্তুলটি যদি দু’-এক ইঞ্চি নীচু হয়ে যেত, অথবা সেতুটি তার পশ্চাৎ ভাগ হাই তোলা বেড়ালের মতো উঁচু ক’রে দিতো, কিংবা নদী যদি হার মেনে নিতে বাধ্য হতো, তা হলে আমার সব কিছুই ঠিক থাকতো। কিন্তু তারা কেউ আমার অসহায় অবস্থার প্রতি ভ্রূক্ষেপও করলো না। এটাই হলো কারণ, যার জন্য আমি নদীটি ব্যবহার করতে পারতাম, তার উপর দিয়ে মাস্তুলের সাহায্যে পাল তুলে যেতে পারতাম, আর এইজন্য নদীর স্রোত দিয়ে যাওয়া যখন অসুবিধাজনক হতো তখন সেতুর উপর নির্ভর করতে পারতাম। সবকিছু যেমন তেমনি থাকে, আর তাদের ব্যবহার করতে গেলে তাদের জানতে হয়, আর আমাদের ইচ্ছা তাদের নিয়ম নীতি নয় বলে তাদের জানা সম্ভব হয়। এই জানা আমাদের আনন্দ দেয়, কারণ জ্ঞান হলো বাইরের সমস্ত কিছুর সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ স্থাপনের অন্যতম প্রণালী; সব কিছুকে সে আমাদের আপন ক’রে তোলে, আর এই ভাবে আমাদের ব্যক্তি-সত্তার পরিধি বিস্তার করে।
প্রতি পদক্ষেপে আমরা নিজেদের থেকে অন্যের কথা বেশী বিবেচনা করতে বাধ্য হই। কারণ একমাত্র মৃত্যুতে আমরা একা। একজন কবি তখনই যথার্থ কবি যখন তিনি তাঁর নিজস্ব ভাবকে সকলের জন্য আনন্দদায়ক ক’রে তুলতে পারেন, তাঁর সকল শ্রোতার বোধগম্য এক সাধারণ মাধ্যম তাঁর কাছে না থাকলে এ তিনি করতে পারতেন না। এই সাধারণ ভাষার নিজস্ব রীতি আছে কবিকে তা অবশ্যই আবিষ্কার করতে হয় ও অনুসরণ করতে হয়, এর দ্বারা তিনি সত্য হয়ে ওঠেন ও কাব্যে অমরত্ব লাভ করেন।
আমরা তখন দেখি যে মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যই চরম সত্য নয়; তার মধ্যে এমন কিছু আছে যা বিশ্বজনীন। যদি তাকে এমন জগতে বাস করতে হতো যেখানে তার নিজের সত্তাই একমাত্র বিবেচনার বিষয়, তা হলে তা তার কল্পনার নিকৃষ্টতম কারাগার হয়ে উঠতো, তার কারণ মানুষের সব থেকে গভীর আনন্দ রয়েছে সকলের সঙ্গে আরো বেশী মিলনের মধ্যে দিয়ে মহৎ থেকে মহত্তর হয়ে ওঠায়। আমরা দেখেছি, সকলের মধ্যে কোনো সাধারণ নিয়ম না থাকলে এ হওয়া অসম্ভব। এই নিয়ম আবিষ্কার করলে ও তা অনুসরণ করলেই আমরা একমাত্র মহৎ হয়ে উঠতে পারি, নিখিল বিশ্বকে উপলব্ধি করতে পারি; সেই সময়, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ব্যক্তিগত বাসনা বিশ্ব নিয়মের বিরোধিতা করে, ততক্ষণ আমরা দুঃখ ভোগ করি আর ব্যর্থ হতে থাকি।
এক সময় ছিল যখন আমরা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করতাম, আশা করতাম যে আমাদের নিজেদের সুবিধার জন্য প্রকৃতির নিয়মকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা উচিত। কিন্তু এখন আমরা আরো ভাল ক’রে জেনেছি। জেনেছি নিয়মকে পাশে সরিয়ে রাখা যায় না, আর এই জেনে আমরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছি। তার কারণ এই নিয়ম আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়; এ আমাদের নিজস্ব। বিশ্বজনীন শক্তি যা বিশ্বজনীন নিয়মে প্রকাশিত হয় আমাদের নিজস্ব শক্তির সঙ্গে তা এক। যেখানে আমরা ক্ষুদ্র, যেখানে আমরা ঘটনা প্রবাহের বিরুদ্ধে, সেখানে সে আমাদের বাধা দেবে; কিন্তু যেখানে আমরা মহৎ, যেখানে আমরা সকলের সঙ্গে একাত্ম, সেখানে সে আমাদের সাহায্য করবে। এইভাবে, বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা যত বেশী প্রকৃতির নিয়ম সকল জানতে পারি, তত আমরা শক্তি লাভ করি; আমরা বিশ্বজনীন দেহ লাভে প্রবৃত্ত হয়ে থাকি। আমাদের দর্শনেন্দ্রিয়, আমাদের কর্মেন্দ্রিয়, আমাদের দৈহিক শক্তি বিশ্বব্যাপী হয়ে ওঠে; বাষ্প ও বিদ্যুৎ আমাদের স্নায়ু ও পেশী হয়ে ওঠে। এইভাবে আমরা দেখি, আমাদের অঙ্গ বিন্যাসে যেমন সম্বন্ধের এক নিয়ম আছে যার শক্তিতে আমরা আমাদের সমগ্র দেহকে আমাদের নিজস্ব বলতে পারি, আর সেই ভাবে ব্যবহার করতে পারি, সেই রকম সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সম্বন্ধের এমন এক অবাধিত নিয়ম আছে যার শক্তিতে আমরা সমগ্র বিশ্বকে আমাদের প্রসারিত অঙ্গ বলতে পারি আর সেই ভাবে তাকে ব্যবহার করতে পারি। আর বিজ্ঞানের এই যুগে আমাদের প্রচেষ্টা হলো আমাদের বিশ্বসত্তার অধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করা। আমরা জানি যে আমাদের সমস্ত দারিদ্র্য ও দুঃখের মূলে রয়েছে আমাদের এই ন্যায়-সঙ্গত অধিকার বাস্তবে পরিণত করার অক্ষমতা। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের শক্তির কোনো সীমা নেই, কারণ আমরা সেই বিশ্বশক্তির বাইরে নেই যা বিশ্বজনীন নিয়মের প্রকাশ। আমরা রোগ ও মৃত্যুকে অতিক্রম করার, কষ্ট ও দারিদ্র্যকে জয় করার পথে এগিয়ে চলেছি; কারণ বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানের মাধ্যমে নিখিল বিশ্বকে তার বাস্তব রূপে উপলব্ধি করার দিকে আমরা সর্বদা চলেছি। আর যত আমরা এগিয়ে চলেছি তত দেখছি যে ব্যথা বেদনা, রোগ ও শক্তির অভাব চরম সত্য নয়, কিন্তু এক মাত্র আমাদের ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে বিশ্বসত্তার সমন্বয়ের অভাবের জন্য এরা মাথা তুলেছে।
আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনও এই রকম। বিশ্বমানবের বৈধ নিয়মের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যক্তিমানব যখন উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তখন আমরা নৈতিক দিক থেকে ক্ষুদ্র হয়ে যাই, আর আমাদের নিশ্চিত ভাবে দুঃখ ভোগ করতে হয়। এই অবস্থায় আমাদের সমস্ত সাফল্য আমাদের সব থেকে বড় পরাজয় হয়ে ওঠে, আর আমাদের সকল বাসনার চরিতার্থতা আমাদের আরো বেশী দরিদ্র ক’রে ফেলে। আমরা বিশেষ কিছু লাভের জন্য লালায়িত হয়ে উঠি, আমরা এমন সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে চাই যা আর কেউ আমাদের সঙ্গে ভাগ ক’রে নিতে পারবে না। অথচ যা কিছু শুধুই বিশেষ তাকে সাধারণের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রাম করতে হয়। এই ধরনের গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে মানুষ সবসময় নানা ব্যূহের পিছনে বাস করে, এবং যে কোনো সভ্যতা স্বার্থপর হ’লে আমাদের গৃহ আর প্রকৃত গৃহ থাকে না, আমাদের চারপাশে কৃত্রিম বেষ্টনী হয়ে দাঁড়ায়। তবুও আমরা অভিযোগ করি আমরা সুখী নই, যেন সব কিছুর প্রকৃতির মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমাদের অসুখী ক’রে তোলে। বিশ্ববিধাতা আমাদের আনন্দের মুকুট পরানোর জন্য অপেক্ষা ক’রে আছেন, কিন্তু আমাদের ব্যক্তিসত্তা তা গ্রহণ করছে না। আমাদের জীবনে ব্যক্তিসত্তা সর্বত্র বিরোধ ও জটিলতা ঘটায়, সমাজের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করে আর সব রকমের দুঃখ দুর্দশা সৃষ্টি করে। সব কিছুকে সে এমন এক সঙ্কটের অবস্থায় নিয়ে আসে যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আমাদের কৃত্রিম দমন নীতি ও সংগঠিত ভাবে পরপীড়নের শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হয়, আর আমাদের মধ্যে যে সব জঘন্য প্রতিষ্ঠান আছে তাদের সহ্য করতে হয়, তা’তে প্রতি মুহূর্তে মনুষ্যত্বের অবমাননা হয়।
আমরা দেখেছি যে, শক্তিশালী হওয়ার জন্য আমাদের বিশ্বশক্তির নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়, আর তাদের নিজস্ব ক’রে নিয়ে কাজে পরিণত করতে হয়। সেইরকম, সুখী হওয়ার জন্য, আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে বিশ্ব ইচ্ছার শ্রেষ্ঠত্বের কাছে সমর্পণ করতে হয়, আর যথার্থই অনুভব করতে হয় যে এ আমাদের নিজস্ব ইচ্ছা। যখন আমরা সেই অবস্থায় পৌঁছে যাই যেখানে অসীমের সঙ্গে আমাদের সসীমতার সমন্বয় সম্পূর্ণ হয়, তখন দুঃখ নিজেই এক মূল্যবান সম্পদ হয়ে ওঠে। সে আমাদের আনন্দের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করার মাপকাঠি হয়ে ওঠে।
সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা মানুষ তার জীবন থেকে লাভ করতে পারে তা এই নয় যে জগতে দুঃখ বেদনা আছে, বরং তাকে শুভ বলে বিবেচনা করা নির্ভর করে তার নিজের উপরে, তার পক্ষেই একে আনন্দে রূপান্তরিত করা সম্ভব। আমাদের কাছে সেই শিক্ষা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি এবং এমন কোনো জীবিত মানুষ নেই যিনি স্বেচ্ছায় দুঃখ বেদনা ভোগ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন, কারণ এ তার মনুষ্যত্বের অধিকার। একদিন একজন গরীব শ্রমিকের বউ খুবই বিরক্তি সহকারে আমার কাছে অনুযোগ করেছিল যে তার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে এক ধনী আত্মীয়ের বাড়িতে বছরের কিছু সময়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাকে তার সমস্যা থেকে বাঁচানোর যে সহানুভূতিপূর্ণ প্রচ্ছন্ন পরিকল্পনা এর পিছনে ছিল তা তাকে মানসিক আঘাত দিয়েছিল, কারণ অপসারণের অযোগ্য ভালবাসার অধিকার অনুযায়ী একজন মায়ের সমস্যা মায়ের নিজের, আর এই অধিকার কোনো যুক্তিপূর্ণ নির্দেশের কাছে সমর্পণ করতে সে রাজি ছিল না। মানুষের স্বাধীনতা কখনোই দুঃখ দুর্দশা থেকে পরিত্রাণের মধ্যে নেই, বরং এই স্বাধীনতা রয়েছে নিজের মঙ্গলের জন্য কষ্ট ভোগ করার মধ্যে, দুঃখ দুর্দশাকে তার আনন্দের অংশ ক’রে নেওয়ার মধ্যে। একমাত্র তখনই তা সম্ভব যখন আমরা উপলব্ধি করি যে আমাদের ব্যক্তিসত্তা আমাদের অস্তিত্বের চরম অর্থ নয়, আমাদের মধ্যে যে বিশ্বমানব রয়েছেন তিনি অবিনশ্বর, তিনি মৃত্যু অথবা দুঃখ যন্ত্রণায় ভীত নন, তিনি ব্যথা বেদনাকে আনন্দেরই অন্য এক দিক রূপে দেখেন। যিনি এই উপলব্ধি করেছেন তিনি জানেন যে, অসম্পূর্ণ জীব রূপে দুঃখই আমাদের আসল সম্পদ, আর সেই আমাদের মহান করেছে ও পূর্ণের সঙ্গে এক আসনে বসার যোগ্য ক’রে তুলেছে। তিনি জানেন আমরা ভিখারী নই; আমাদের শক্তি, আমাদের জ্ঞান, আমাদের প্রেম, এই যা কিছু জীবনে মূল্যবান তার জন্য কঠিন মূল্য দিতে হয়; পূর্ণতার অনন্ত সম্ভাবনা, আনন্দের চিরন্তন প্রকাশ দুঃখের মধ্যে প্রতীক হয়ে রয়েছে; এবং যিনি দুঃখকে স্বীকার করতে গিয়ে সব আনন্দ হারিয়ে ফেলেন তিনি অভাব ও অমর্যাদার নিম্নতম গভীরতায় ক্রমে ক্রমে তলিয়ে যান। একমাত্র যখন আত্মতুষ্টির জন্য আমরা দুঃখকে আহ্বান করি তখন সে অশুভ হয়ে ওঠে আর আমাদের দুঃখের মধ্যে সজোরে নিক্ষেপ ক’রে তার অপমানের প্রতিশোধ নেয়। কারণ সে অবিনশ্বর পূর্ণতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ ক’রে চিরকুমারী, আর অনন্তের পূজাবেদীতে যখন সে তার যথাস্থান গ্রহণ করে তখন অন্ধকার অবগুণ্ঠন খুলে দেয় ও পরমানন্দের প্রকাশ রূপে দর্শনার্থীর কাছে তার মুখ অনাবৃত ক’রে দেয়।