অশান্ত প্রশান্ত

অশান্ত প্রশান্ত 

শান্ত একটা অবিশ্বাস্য কাজ করে ফেলেছে। 

সন্ধ্যেবেলা সবাই তাদের পড়ার টেবিলে বসেছে। কেউ পড়ছে, কেউ লিখছে, কেউ পড়ালেখার ভান করছে এবং সবাই একটু পরে পরে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখছে আর কতক্ষণ তাদের এই টেবিলে বসে থাকতে হবে—ঠিক তখন শান্ত হাতে অনেকগুলো কাগজ নিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, “আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।” 

যেকোনো হিসেবেই বাক্যটি শান্তর মুখে পুরোপুরি বেমানান, সে যদি কাউকে কিছু শোনাতে চায় তাহলে সে জোর করে সেটা শুনিয়ে ফেলে—কথাটা বলার জন্য কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। 

সবাই যে যেটা করছিল সেটা থামিয়ে শান্তর দিকে তাকাল। শান্ত তার মুখটা গম্ভীর করে বলল, “তোমরা যদি কথা দাও কাউকে বলবে না, তাহলে আমি তোমাদের একটা জিনিস দেখাতে চাই।” 

শান্তর সব প্রজেক্টই এরকম, বড়দের না জানিয়ে সেটা শুনতে হয়, কাজেই সবাই মাথা নাড়ল। যারা শান্তর থেকে বয়সে বড়, তারা বলল, “বল, কী বলতে চাস।” যারা ছোট তারা বলল, “বল শান্ত ভাইয়া।” 

শান্ত তখন হাতে ধরে রাখা কাগজের বান্ডিলটা উঁচু করে ধরে বলল, “আমি একটা বই লিখেছি।’ 

মনে হল ঘরে একটা বাজ পড়েছে। শান্ত যদি বলত, “আমি বিয়ে করে ফেলেছি” তাহলেও কেউ এত অবাক হতো না। সবার আগে মুনিয়া আনন্দে চিৎকার করে বলল, “কী বই? ডিটেকটিভ, মার্ডার কেস?” 

শান্ত মাথা নাড়ল, গম্ভীর গলায় বলল, “না।” 

এবারে শাহানাপু হাসি গোপন করে বলল, “কীসের উপর বই লিখেছিস?” 

প্রমি জিজ্ঞেস করল, “ফিকশন নাকি ননফিকশন?”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “নিজে নাকি নকল?” 

শান্ত টুম্পার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকাল, তারপর সবার দিকে ঘুরে বলল, “এটা একটা মোটিভেশনাল বই।”

মোটিভেশনাল বই বলতে কী বোঝানো হয় সেটি যারা জানে তাদের প্রায় হার্ট অ্যাটাকের মত অবস্থা হল। টুনি সবার আগে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “মোটিভেশনাল বই?” 

শান্ত কঠিন মুখে বলল, “হ্যাঁ।”

“মানে যারা পড়বে তারা মোটিভেটেড হবে? অনুপ্রাণিত হবে?”

“হ্যাঁ। একই সাথে মোটিভেটেড আর আত্ম-উন্নয়ন। যাকে বলে সেল্ফ হেল্প।” 

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “আত্ম-উন্নয়ন মানে কী?” 

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “আত্ম-উন্নয়ন বানান কী?”

শান্ত দুইজনের দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকাল, কোনো উত্তর দিল না। টুনি তখন জিজ্ঞেস করল, “কী বিষয়ে আত্ম-উন্নয়ন আর মোটিভেশন হবে?” 

শান্ত তার কাগজ উল্টে কিছু একটা দেখে বলল, “সব মিলিয়ে চৌদ্দটা বিষয় আছে—” 

একসাথে সবাই আর্তচিৎকার করে উঠল, “চৌদ্দটা?” 

“হ্যাঁ।” 

টুনি জানতে চাইল, “বিষয়গুলি কী কী?” 

শান্ত তার কাগজের দিকে তাকিয়ে বলল, “চৌদ্দটা বিষয়ের জন্য চৌদ্দটা চ্যাপ্টার! প্রথম চ্যাপ্টারটা হচ্ছে ভদ্র ব্যবহারের উপর।” 

শাহানাপু হাসি গোপন করে বলল, “চ্যাপ্টারটার টাইটেল কী?”

“টাইটেল হচ্ছে ‘মিষ্টি ব্যবহার কেন জীবনে সাফল্য এনে দেয়’।” টুনি জিজ্ঞেস করল, “আর বইটার নাম কী?” 

শান্ত বলল, এখনও ফাইনাল করি নাই। আপাতত দিয়েছি ‘তুমি কেমন করে বড় হবে’। 

মুনিয়া জানতে চাইল, “শান্ত ভাইয়া মিষ্টি ব্যবহার কেমন করে করতে হয়?” 

শান্ত গম্ভীর মুখে বলল, “তুই জানতে চাইলে বইটা পড়ে দেখিস।” 

প্রমি জিজ্ঞেস করল, “শান্ত তোর বইয়ের অন্য চ্যাপ্টারগুলি কীসের উপর?” 

শান্ত তার বইয়ের পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে বলল, লেখাপড়ার উপর দুইটা চ্যাপ্টার আছে। একটা হচ্ছে ‘সহজ মুখস্থ’ অন্যটা হচ্ছে ‘জিপিএ ফাইভ পাওয়ার শর্টকাট পদ্ধতি’। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার উপর একটা চ্যাপ্টার, মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার উপর একটা চ্যাপ্টার। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সেলিব্রেটি হওয়ার উপায়ের উপর তিনটা চ্যাপ্টার। চাকরি পাওয়ার উপর একটা চ্যাপ্টার, বিসিএস পরীক্ষার উপর একটা চ্যাপ্টার, চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার উপর একটা চ্যাপ্টার, টাকা পয়সা ম্যানেজ করার উপর একটা চ্যাপ্টার আর শেষ চ্যাপ্টারটা হচ্ছে জীবন-সঙ্গিনী বেছে নেওয়ার উপর!” 

সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল, “জীবন-সঙ্গিনী?” 

শান্ত বলল, “সন্তান পালনের উপরও একটা লিখতে চাইছিলাম কিন্তু পরে মনে হল এইটা ভালো জানি না, লেখা ঠিক হবে না।” 

প্রমি চোখ কপালে তুলে বলল, “অন্যগুলো জানিস?” 

“না জানার কী আছে? সব হচ্ছে কমনসেন্স।” 

প্রমি আবার কী একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছিল, শাহানাপু দুই হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিল, তারপর বলল, “আচ্ছা শান্ত, তোকে একটা প্রশ্ন করি।” 

“কর।” 

“আমাদের সবারই কখনো না কখনো আস্ত বই, না হোক অন্য কিছু লেখার ইচ্ছা হয়েছে। কাজেই তোরও যে বই লেখার ইচ্ছা হয়েছে সেটা দেখে অবাক হওয়ার কিছু নাই। কিন্তু—” 

শান্ত গম্ভীর হয়ে বলল, “কিন্তু কী?” 

“তুই গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ভৌতিক কাহিনি, রূপকথা, ডিটেকটিভ, ইতিহাস, বিজ্ঞান দর্শন, আর্ট, কালচার এরকম কোনো বই না লিখে আত্ম-উন্নয়ন আর মোটিভেশনের উপর বই কেন লিখেছিস?” 

শান্ত তার বই লেখার ঘোষণা দেওয়ার শুরু থেকে তার মুখে একটা আলগা লেখকসুলভ গাম্ভীর্য ধরে রেখেছিল। এই প্রথম তার গাম্ভীর্যে একটা ফাটল দেখা গেল এবং সে তার অতি পরিচিত ফিচলে হাসি দিয়ে বলল, “শাহানাপু তুমি এই সহজ জিনিস বুঝতে পারছ না?” 

“না, পারছি না। বুঝিয়ে দে।”

“তুমি অন্য যেকোনো বিষয় নিয়ে লিখতে হলে তোমার সেটা জানতে হবে। বিজ্ঞানের কিছু লিখতে হলে বিজ্ঞান জানতে হবে, স্পোর্টসের উপর লিখতে হলে স্পোর্টস জানতে হবে, ভূতের কাহিনি লিখতে হলে ভূতের কাহিনি বানাতে হবে—শুধু মোটিভেশনাল বই লিখতে হলে কিছু জানতে হয় না! যে কেউ এটা লিখতে পারে—যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারে।” 

শাহানাপু চোখ বড় বড় করে বলল, “যে কেউ লিখতে পারে? যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারে?” 

“হ্যাঁ। আমি মোটিভেশনাল বই পড়ে দেখেছি। যার যা ইচ্ছা তাই লিখে রেখেছে।” 

“তুইও যা ইচ্ছা তাই লিখেছিস?” 

“হ্যাঁ। যেমন লেখাপড়ার অংশে লিখেছি মনোযোগ বাড়ানোর জন্য সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনটা বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বলতে হবে, “আমার মনোযোগ চাই মনোযোগ চাই মনোযোগ চাই” তারপর ঠান্ডা পানিতে একটা রসুনের কোয়া কুচি কুচি করে কেটে সেই পানিটা এক ঢোকে খেয়ে ফেলতে হবে।” 

শাহানাপু চোখ বড় বড় করে শুনছিল, চোখ বড় বড় করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় যেটুকু হওয়া সম্ভব সেটা হয়ে গেছে, এখন চোখ আর বড় করা সম্ভব না, তাই মুখের হা বড় করে বলল, “তুই তাই লিখেছিস? কোনো প্রমাণ ছাড়া?” 

“হ্যাঁ।” শান্ত উদারভাবে হাসল, বলল, “আমি যেরকম প্রমাণ করতে পারব না যে সকালে রসুনের পানি খেলে মনোযোগ বাড়ে, তুমিও সেরকম কোনোদিন প্রমাণ করতে পারবে না যে মনোযোগ বাড়ে না। সমান সমান। কাটাকাটি।” 

মুনিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “কাটাকাটি। শান্ত ভাইয়া এখন তুমি জীবন-সঙ্গিনীর পার্টটা পড়ে শোনাবে।” 

শাহানাপু ধমক দিয়ে বলল, “তুই থাম তোর জীবন-সঙ্গিনী নিয়ে। আমি ব্যাপারটা আগে বুঝি।” শাহানাপু আবার শান্তর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোর পুরা বই এ রকম?” 

“মোটামুটি এইরকম। কোনোখানে রসুনের কোয়া, কোনোখানে দারুচিনির রস। আবার কোনোখানে মধু আর পেঁয়াজের ডাঁটি এইরকম। নানারকম নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আছে। তা ছাড়া অনেক প্র্যাকটিকেল কাজ আছে।”

“কীরকম প্র্যাকটিকেল কাজ?” 

“যেমন মনে করো মনোযোগ বাড়ানোর জন্য আধা কাপ চাউল আর আর আধা কাপ ডাল ভালোমত মিশিয়ে একটা একটা করে চাউল আর ডাল আলাদা করা।” 

মুনিয়া জোরে জোরে মাথা নাড়ল, তার আইডিয়াটা খুব পছন্দ হয়েছে! 

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই বইটা কী করবে, শান্ত ভাইয়া?” শান্ত বিরক্ত হয়ে বলল, “ছাপাব! বই আবার কী করে?” 

“কে ছাপাবে?” 

পাবলিশার, আবার কে?” 

“ছাপাতে রাজি হবে? তোমার তো বানান নিয়ে অনেক সমস্যা।” 

শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, “তুই জানিস কোনো বড় লেখক বানান জানে না, তাদের সবার প্রুফরিডার থাকে। প্রুফরিডাররা বানান ঠিক করে দেয়।”

টুনি ভয়ে ভয়ে বলল, “তুমি তো এখনও বড় লেখক হও নাই।” 

শান্ত মাথা নাড়ল, লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেইটা অবশ্য সত্যি। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি যারা মোটিভেশনাল বই লেখে, তারা সবাই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সেলিব্রেটি। আমি এখনও সেলিব্রেটি হওয়ার সুযোগই পেলাম না—এই বাসায় মানুষের কোনো দয়ামায়া নাই—এত বড় হয়েছি এখনও স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেয় না!” 

প্রমি বলল, “তাহলে তুই এই বইটা ছাপাতে চাস?” 

“অবশ্যই।” 

“দেখি তোর বইটা।” 

শান্ত সাবধানে তার হাতের কাগজগুলো প্রমিকে দিল। সবাই তখন কাগজগুলোর উপর ঝুঁকে পড়ল। প্রমি উল্টেপাল্টে দেখে শান্তকে কাগজগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “শান্ত। আমার মনে হয় তুই বই লেখার আইডিয়াটা কয়েক বছরের জন্য পিছিয়ে দে।” 

শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, “কত বছর?” 

প্রমি কিছু বলার আগেই টুম্পা বলল, “পঞ্চাশ!” 

শান্ত দাঁত কিড়মিড় করে টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোকে আমি খুন করে ফেলব।” 

মুনিয়া দাঁত বের করে হেসে বলল, “তাহলে তুমি আরেকটা বই লিখতে পারবে। বইয়ের নাম দিবে, ‘তোমরা যারা খুন করতে চাও!” 

শান্তর বই লেখার খবরে সবাই এত হকচকিত হয়ে গেছে যে, সেদিন পড়ার টেবিলে আর কারো পড়াশোনা হল না, সবাই এই বই নিয়ে আলোচনা করল। শান্ত অবশ্য একটু পরপর সবাইকে মনে করিয়ে দিল বড়দের কাউকে এই বই সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না, যখন এটি সত্যিকারের বই হিসেবে ছাপা হবে তখন তাদেরকে এক কপি বাঁধাই ব‍ই দিয়ে চমৎকৃত করে দেবে। শান্ত বই বের হওয়ার পর সেটি কীভাবে মার্কেটিং করবে সেটা নিয়েও চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে। শুধু তাই না, বই হিসেবে বের হওয়ার আগেই সে কিছু টাকা পয়সা উপার্জনের জন্য ঘোষণা দিয়েছে কেউ যদি তাকে এক হাজার টাকা দেয়, সে তাহলে বইটা তার নামে উৎসর্গ করতে রাজি আছে। এক হাজার অনেক টাকা, বাচ্চারা কেউই এত টাকা একসাথে দিতে পারবে না, মুনিয়া দশ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হয়েছে, শান্ত রাজি হয় নাই। তা ছাড়া শান্তর এই বই ছাপা হবে, সেটা কেউ এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। 

.

শান্ত অবশ্য তার বই ছাপানোর জন্য প্রকাশকদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে দিল। কিন্তু শান্তর মনমরা ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে সে প্রকাশকদের তার বই ছাপাতে রাজি করতে পারছে না। তাকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে মুখ খিঁচিয়ে কিছু একটা বলে। তাই আজকাল কেউ তার সাথে বই নিয়ে আলাপ করতে সাহস পায় না। 

একদিন সন্ধ্যেবেলা পড়ার টেবিলে শাহানাপু শান্তকে জিজ্ঞেস করল, “শান্ত তোর বইয়ের কী খবর? কোনো পাবলিশার পেয়েছিস।” 

শান্ত একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এখনও পাই নাই।”

“পাবি এরকম ভরসা আছে?” 

শান্ত মাথা চুলকে বলল, “ঠিক পাবলিশার পেলে নিশ্চয়ই ছাপাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি পাবলিশারদের পাণ্ডুলিপিটাই দেখাতে পারছি না।”

“দেখাতেই পারছিস না?” 

“না। আমি লিখেছি শুনে খুলে দেখতেই চায় না। খ্যাকখ্যাক করে হাসে।” 

শান্ত যেন দেখতে না পায় সেভাবে শাহানাপু অনেক কষ্ট করে হাসি গোপন করে বলল, “খুবই অন্যায়। দেখা উচিত ছিল।” 

শান্ত বলল, “অবশ্যই দেখা উচিত ছিল। আমি পাবলিশারকে বলেছি বয়স কম হলেই তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে হয় না। রবীন্দ্রনাথ বারো বছর বয়সে ভানুমতীর খেল লিখেছিলেন।” 

প্রমি একটু কেশে বলল, “আসলে ভানুমতীর খেল না, ভানুসিংহের পদাবলী। আর তখন বয়স মনে হয় আরেকটু বেশি—ষোল বছরের মত।” 

শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, “একই কথা।“

“ঠিক এক কথা না।”

 শাহানাপু বলল, “তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। তোর বইয়ের সাথে উনাকে টানাটানি করা মনে হয় ঠিক হবে না।” 

শাহানাপু না হয়ে অন্য কেউ হলে শান্ত নিশ্চয়ই একটু তর্ক জুড়ে দিত কিন্তু শাহানাপুর সাথে তর্ক করার সাহস পেল না। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “একজনকে অনেক কষ্ট করে দেখাতে রাজি করিয়েছি, ব্যাটা ম্যানাসক্রিপ্টের দিকে তাকিয়েই বলল, হাতে লেখা ম্যানাসক্রিপ্ট? ইয়াক! যেন তার বমি এসে যাচ্ছে।” 

মুনিয়া অবাক হয়ে বলল, “ইয়াক বলেছে? ইয়াক বলেছে?” 

টুম্পা বলল, “তোমার হাতের লেখা বেশি সুবিধার না। কিন্তু তাই বলে ইয়াক বলা ঠিক হয় নাই। অন্য কিছু বলা উচিত ছিল।” 

শান্ত দুজনের দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কম্পিউটারে কম্পোজ না করা হলে পাবলিশাররা তাকিয়ে দেখতেই চায় না।”

শাহানাপু বলল, “অন্যায়, খুবই অন্যায়।” 

টুনি বলল, “পাবলিশারদের খুব দোষ দেওয়া যায় না। বুড়ো লেখকেরা কম্পিউটার বুঝে না, সেই জন্য তারা মনে হয় হাতে লেখে। নতুন লেখকেরা সব কম্পিউটারে লিখে। শান্ত ভাইয়া তুমিও এটা কম্পিউটারে কম্পোজ কর না কেন?” 

শান্ত চোখ লাল করে বলল, “তুই আমাকে ল্যাপটপ কিনে দিবি?”

শাহানাপু বলল, “আমার কম্পিউটারে কম্পোজ করতে পারিস।”

শান্ত হতাশভাবে বলল, “না শাহানাপু আমার এত সময় নাই।”

টুম্পা বলল, “মনে হয় ধৈর্যও নাই।” 

মুনিয়া বলল, “চাউল ডাল মিশিয়ে আলাদা করলে ধৈর্য বাড়বে। তাই না শান্ত ভাইয়া?” 

শান্ত কোনো উত্তর না দিয়ে বিষদৃষ্টিতে মুনিয়ার দিকে তাকালো। শান্ত যেহেতু তার বই নিয়ে বেশি আলোচনা করার আগ্রহ দেখাল না, মুখটা ভোঁতা করে বসে রইল, তাই অন্যরা আর এটা নিয়ে আলাপ করার চেষ্টা করল না। 

কয়েকদিন পর হঠাৎ করে পড়ার টেবিলে শান্তকে খুবই উত্তেজিত দেখা গেল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার বইয়ের কিছু হলো শান্ত ভাইয়া?” 

শান্ত ইতস্তত করে বলল, “হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত একজন পাবলিশারকে পড়তে রাজি করাতে পেরেছি।” 

সবাই শান্তর দিকে ঘুরে তাকালো, প্রায় একসাথে সবাই শান্তকে জিজ্ঞেস করল, “কী বলেছে পাবলিশার?” 

শান্ত মাথা চুলকে বলল, “ঠিক বুঝতে পারছি না।”

শাহানাপু বলল, “ঠিক বুঝতে পারছিস না মানে? কী হয়েছে বল।” 

.

শান্ত যেটা বলল সেটা এরকম : 

যখন কোনো প্রকাশকই শান্তকে দেখে তার পাণ্ডুলিপিতে চোখ বুলাতে রাজি হয় না, তখন শান্ত হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল এবং প্রকাশকগুলোকে কীভাবে একটা জন্মের মত শিক্ষা দেওয়া যায় সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেছিল, ঠিক তখন প্রকাশক পাড়ায় শান্ত একটা প্রকাশনীর অফিস দেখতে পেল, সাইনবোর্ডে লেখা ‘ব্যাঙাচি প্ৰকাশনী’, নিচে লেখা : আমরা ভিন্ন ধরনের বই প্রকাশ করি, তার নিচে লেখা : যে বই অন্যরা প্রকাশ করতে সাহস পায় না, আমরা সেই বই প্রকাশ করি। 

নামটা দেখে শান্ত ভাবল একবার চেষ্টা করবে। সে প্রকাশনীর অফিসে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “প্রকাশক স্যার কি আছেন?” 

কয়দিন প্রকাশকদের দোকানে দোকানে ঘুরে সে আবিষ্কার করেছে প্রকাশকদের প্রকাশক স্যার বললে তারা খুশি হয়। 

টেবিলের উপর পা তুলে একটা মানুষ একটা টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিল, সে দাঁত খোঁচানো বন্ধ করো শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “না, আমরা গাইড বই বিক্রি করি না।” 

শান্ত বলল, “আমি গাইড বই চাই না।” 

“তাহলে কী চাও?” 

“আমি একটা বই লিখেছি, সেটা আপনাদের প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করতে চাই।”

মানুষটা এবারে সোজা হয়ে বসল, বসে তার দিকে ভালো করে তাকাল, তারপর কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তুমি একটা বই লিখেছ?” 

“হ্যাঁ।” 

“কীসের উপর বই? কবিতা?” 

“না। মোটিভেশনাল বই।”

মানুষটা বলল, “মোটিভেশনাল বই? তুমি মানুষকে মোটিভেট করতে পারবে?” 

শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, “আমার বইটা পড়ে দেখেন পারি কি না।” প্রকাশনী পাড়ায় ঘুরে ঘুরে এই কয়দিনে শান্ত শিখে গেছে যে, সব কথাই অনেক জোর দিয়ে আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে হয়। মানুষটা এবারে টেবিল থেকে পা নামিয়ে বলল, “তোমার নাম কী ছেলে?” 

“আমার নাম শান্ত, তবে আমি এই বইয়ে আমার নাম দিয়েছি অশান্ত প্রশান্ত।” 

“অশান্ত প্রশান্ত?” 

“হ্যাঁ।” 

মানুষটা কয়েকবার বলল, “অশান্ত প্রশান্ত”। তারপর শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “নামটা আমার পছন্দ হয়েছে।” 

শান্ত বলল, “বইটা আরও বেশি পছন্দ হবে।” 

মানুষটা আবার কিছুক্ষণ শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “আস। ভিতরে আস। বস।” 

এই প্রথমবার কোনো একজন প্রকাশক শান্তকে ভিতরে এসে বসতে 

বলেছে। শান্ত খুবই গম্ভীর মুখে ভিতরে ঢুকল, মানুষটার সামনে রাখা চেয়ারে বসল, তারপর ডান হাতের আঙুলগুলো নিজের মাথার চুলের ভেতর ঢুকিয়ে পিছন দিকে টেনে নিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। লেখকদের চুল একটু এলোমেলো থাকে। 

মানুষটা হাত বাড়িয়ে বলল, “দেখি তোমার ম্যানাসক্রিপ্ট।” 

শান্ত কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেটটা মানুষটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমার পাণ্ডুলিপি কিন্তু হাতে লেখা।”

“কেন?” 

“যে সময়টা টাইপ করে নষ্ট হবে, সেই সময়ে আমি অন্য কিছু ক্রিয়েটিভ কাজ করতে পারি।” শান্ত সত্যিকার লেখকের মত বড় বড় কথা বলার চেষ্টা করল। 

প্রকাশক মানুষটা প্যাকেটের ভিতর থেকে পাণ্ডুলিপিটা বের করে দেখল। হাতের লেখা দেখে একটুখানি বিমর্ষ হল, তারপর সূচিপত্রটা খুবই মনোযোগ দিয়ে দেখল। শান্ত তখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে—মানুষটা হঠাৎ খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠবে কি না সেটা চিন্তা করে তার বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করতে থাকে। 

মানুষটা সূচিপত্রটা একবার পড়ে দ্বিতীয়বার পড়ল। শান্ত দেখল দ্বিতীয়বার পড়ার সময় সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। তারপর ভেতর থেকে মাঝে মাঝে একটু একটু করে পড়ল। কোথাও হ্যাসূচকভাবে কোথাও নাসূচকভাবে মাথা নাড়ল। তারপর একেবারে শেষ চ্যাপ্টারটা—যেখানে জীবন-সঙ্গিনী খোঁজার বিষয়ে লেখা হয়েছে সেটা বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল এবং মাঝে মাঝেই তার মুখে একটু মুচকি হাসি দেখা দিল। 

পাণ্ডুলিপিটা দেখা শেষ করে মানুষটা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ উপর দিকে তাকিয়ে রইল এবং তখন মানুষটা তার মুখে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল, মনে হয় মানুষটা কিছু একটা চিন্তা করছে। চিন্তা করার সময় নিশ্চয়ই তার মুখে এরকম অঙ্গভঙ্গি চলে আসে। 

শান্ত মানুষটার এরকম বিচিত্র চিন্তায় বাধা দিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করবে কি না চিন্তা করছিল কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিল না। কাজেই সে অপেক্ষা করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মানুষটা চোখ খুলে শান্তর দিকে তাকাল, তারপর বলল, “হবে।” 

শান্ত ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, “কী হবে?” 

“প্ল্যানটা কাজ করবে।” 

“কী প্ল্যান?” 

“তোমার বইয়ের প্ল্যান।” 

শান্ত ঠিক বুঝত পারল না এখানে মানুষটা প্ল্যান বলতে কী বোঝাচ্ছে। তার জানা দরকার এই প্রকাশক বই ছাপাবে কি না। সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি বইটা ছাপাবেন?” 

মানুষটা বলল, “বই ছাপানো অনেক বড় ইনভেস্টমেন্ট। এতগুলো টাকা ইনভেস্ট করার আগে আমাদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে হয়। তোমার বইয়ের জন্য স্ট্র্যাটেজি কী হবে সেটা চিন্তা করছি।” 

শান্তর উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়—তার মানে এই ব্যাঙাচি প্রকাশনী তার বইটা আসলেই প্রকাশ করবে, তার ইচ্ছে হল আনন্দে একটা লাফ দিতে, কিন্তু সত্যিকার লেখকেরা কখনোই জায়গায় অজায়গায় লাফ দেয় না, তাই সে মুখে একটা গাম্ভীর্য ধরে জিজ্ঞেস করল, “কী স্ট্র্যাটেজি?” 

“একজন প্রকাশক একটা বই ছাপায় বই বিক্রি করার জন্য। একটা বই ভালো না ফালতু তার উপর বইয়ের বিক্রি নির্ভর করে না। একটা বই বিক্রি হয় যদি বইটাকে বিতর্কিত করা যায়। এক দল বলবে বইটা জঘন্য, আরেক দল বলবে, বইটা জঘন্য না—বইটা হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। দুই দলের ঝগড়াঝাঁটি যত বেশি হবে, বইয়ের বিক্রি হবে তত বেশি। যদি একেবারে মামলা মোকদ্দমা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে সবচেয়ে ভালো। লেখক অ্যারেস্ট হয়ে রিমান্ডে, প্ৰকাশক পলাতক—” মানুষটা আনন্দে হা হা করে হাসল। 

শান্ত শুকনো মুখে বলল, “আমার বই নিয়ে মামলা মোকদ্দমা হবে? অ্যারেস্ট করবে?” 

“সেটা আমাদের স্ট্র্যাটেজির উপর নির্ভর করবে। প্রথমেই মামলা মোকদ্দমা পর্যায়ে নিতে চাই না, বিতর্কের মাঝে রাখব।”

শান্ত এবার একটু ভয় পেয়ে যায়, ঢোক গিলে বলল, “কিন্তু বই নিয়ে বিতর্ক কেন হবে?” 

“প্রথমে কাউকে বলা হবে না যে, এই বইয়ের লেখকের বয়স কম, আমরা ভান করব এটা বড় মানুষের লেখা—আজকাল বিসিএস ক্যাডার পাবলিক সবচেয়ে বেশি খায়—” 

শান্ত দুর্বলভাবে বলল, “আমার বয়স কম না। চৌদ্দ—”

“একই কথা। যাই হোক, আমার পরিচিত লোকজন আছে যারা সোশ্যাল মিডিয়াতে খুব একটিভ। তাদেরকে দিয়ে একটা ক্যাম্পেইন হবে। তখন একদিন হঠাৎ করে বোমা ফাটানো হবে—”

“বোমা?” 

“হ্যাঁ প্রথমে একজন বলবে এই বইয়ের লেখক আসলে একজন শিশু। সাথে সাথে হইচই শুরু করে দেওয়া হবে। একদল বলবে, ছিঃ ছিঃ ছিঃ একজন শিশু কেন জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছে? আরেক দল বলবে, যার যেটা ইচ্ছা সে সেটা বলবে, এটা হচ্ছে বাকস্বাধীনতা—একদিনে তোমাকে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সেলিব্রেটি বানিয়ে দেওয়া হবে। তারপর আমরা তোমাকে এক্সপোজ করব—” মানুষটা দুলে দুলে হাসতে লাগল। 

শান্ত হঠাৎ করে তার বই প্রকাশ করা নিয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল, শুকনো গলায় বলল, “এইসব কিছু না করে শুধু বইটা ছাপানো যায় না?” 

“তাহলে কে বই কিনবে?” 

“কিন্তু” 

“আবার কিন্তু কীসের। তোমাকে বিখ্যাত বানিয়ে দেব। তুমি বিখ্যাত হতে চাও না?” 

“তা চাই। কিন্তু—”

“তোমার বইয়ে কিছু চেঞ্জ করতে হবে। জীবন-সঙ্গিনী চ্যাপ্টার যেখানে যেখানে তরুণী লেখা আছে সেখানে যুবতী করে দিতে হবে। একটা দুইটা অশ্লীল বাক্য ঢুকিয়ে দিতে হবে যেন বিতর্ক জমে ওঠে।” 

শান্তর এতক্ষণে বই প্রকাশ করার উৎসাহ কমে এসেছে। 

সে বলল, “স্যার, আমার মনে হয় একটু চিন্তা করা দরকার। আমাকে এক দুই দিন সময় দেন।” 

“তুমি আবার কী চিন্তা করবে? চিন্তাটা আমার উপর ছেড়ে দাও।” 

শান্ত বলল, “বাসার গার্জিয়ানদের সাথে একটু কথা বলতে হবে।” 

“যত ইচ্ছা বল। আমরা এদিকে কাজ এগিয়ে রাখি। তোমার ম্যানাসক্রিপ্ট কম্পোজ করতে দিয়ে দিই।” 

মানুষটা তখন গলা উঁচিয়ে ডাকল, “জলীল—শুনে যাও।” 

ভিতর থেকে একজন মানুষ দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে বলল, “জি স্যার?” 

ব্যাঙাচির প্রকাশক ম্যানাসক্রিপ্টের প্যাকেটটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এইটা কম্পোজ শুরু কর। ইমার্জেন্সী।” 

মানুষটা প্যাকেটটা নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। শান্ত কিছু বলতেও পারল না। প্রকাশক শান্তর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, “চা খেয়ে যাও। রং চা।” 

শান্ত এইটুকু বলে থামল। সবার দিকে তাকাল, অন্য সবাই তখন তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। শাহানাপু জিজ্ঞেস করল, “তারপর চা খেলি?” 

“হ্যাঁ।” 

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “চায়ের সাথে আর কিছু দেয় নাই? শিঙাড়া না হয় সমুচা?” 

শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “না।”

মুনিয়া বলল, “কী আশ্চর্য! শুধু চা কেউ খেতে দেয়?” 

শাহানাপু বলল, “তারপর ঠিক করেছিস, তোর বই নিয়ে কী করবি?” 

শান্ত মাথা চুলকে বলল, “ঠিক বুঝতে পারছি না।” 

শাহানাপু ধমক দিয়ে বলল, “বুঝতে পারছিস না মানে? টের পাচ্ছিস না তুই একটা মহা ধুরন্ধরের পাল্লায় পড়েছিস? তোর নাকে মুখে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে?” 

শান্ত মাথা চুলকালো, বলল, “ইয়ে—মানে—ভেবেছিলাম আমার প্রথম একটা বই বের হবে—”

শাহানাপু শান্তকে থামিয়ে দিল, “গাধার মত কথা বলবি না। এটাকে বই বের করা বলে না। তুই কী লিখেছিস তাতে ঐ ধুরন্ধরের কোনো মাথাব্যথা নাই—তার দরকার একটা কন্ট্রোভার্সি! বুঝেছিস?” 

শান্ত দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল। শাহানাপু বলল, “তোর যদি লেখক হওয়ার শখ থাকে নিশ্চয়ই একদিন লেখক হবি। তুই লিখতে থাক, যখন তুই ভালো একটা কিছু লিখবি, আমরা সবাই মিলে তোর বই ছাপিয়ে দেব। বুঝেছিস?” 

সব বাচ্চারা মাথা নাড়ল। শান্ত ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। 

শাহানাপু বলল, “আর তোকে অশান্ত প্রশান্ত দুশান্ত কুশান্ত নামে লিখতে হবে না। বুক ফুলিয়ে নিজের নামে লিখবি। আমরা তোর বইয়ের প্রকাশনা উৎসব করব।” 

টুম্পা বলল, “দাদি সভাপতি। ঝুমু খালা বক্তৃতা দেবে।” 

শাহানাপু বলল, “আমরা সবাই বক্তৃতা দিব।” 

শান্ত বলল, “তাহলে তুমি বলছ কালকে গিয়ে প্রকাশককে না করে দিয়ে পাণ্ডুলিপি ফেরত নিয়ে আসব?” 

“হ্যাঁ। অবশ্যই অবশ্যই অবশ্যই।” 

প্রমি বলল, “শান্ত, যে প্রকাশকের নাম ব্যাঙাচি, তোর সেখানে যাওয়াই ভুল হয়েছে।”

টুনি বলল, “এটার নাম ব্যাঙাচি, কাজকর্ম কেউটে সাপ!” 

শান্ত খুবই মনমরাভাবে গালে হাত দিয়ে বসে থাকল। সবার তার জন্য কেমন যেন মায়া হতে থাকে। 

.

পরদিন অবস্থা আরো গুরুতর হয়ে গেল। পড়ার টেবিলে সবাই শান্তর জন্য অপেক্ষা করছে, শান্ত এসেছে একটু দেরি করে। তার কেমন যেন বিধ্বস্ত চেহারা। তাকে দেখে সবাই একটু ভয় পেয়ে গেল। টুনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে শান্ত ভাইয়া? পাণ্ডুলিপি নিয়ে এসেছ ব্যাঙাচির কাছ থেকে?” 

শান্ত নাসূচকভাবে মাথা নাড়ল। 

টুনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আন নাই? কেন?” 

“দিতে রাজি হল না।” 

“কেন? দিতে রাজি হল না কেন?” 

“বলেছে কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে, কম্পোজ নাকি প্রায় শেষ প্রচ্ছদ করার জন্য আর্টিস্টকে অ্যাডভান্স করেছে, তার এত টাকা ইনভেস্ট হয়ে গেছে, এখন এই প্রজেক্ট বন্ধ করা সম্ভব না।” 

শাহানাপু মুখ শক্ত করে বলল, “তাই বলেছে?” 

“হ্যাঁ।” শান্ত প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমি যখন জোরাজুরি করলাম তখন আমাকে উল্টো ধমক দেয়। ভয় দেখায়। কী বিপদে পড়েছি!” 

সবাই চুপ করে থাকে। আসলেই এটা মোটামুটি একটা বড় বিপদ। প্রমি ফোঁস করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এখন বড়দের জানাতে হবে। ছোটাচ্চুকে দিয়ে শুরু করতে হবে।” 

শান্ত অসহায়ভাবে তাকালো, “ছোটাচ্চুকে বলবে?”

“আর কী করবি?” 

টুনি বলল, “দাঁড়াও। বড়দের কান পর্যন্ত পৌঁছালে আমাদের বিপদ আছে। বড়রা আমাদের সবকিছু করতে দেয় কারণ আমরা এখন পর্যন্ত কখনও কোনো উল্টাপাল্টা বিপদে পড়ি নাই।” 

শাহানাপু বলল, “টুনি ঠিকই বলেছে। বড়রা যদি জানে শান্ত এরকম ঘাপলার মাঝে পড়েছে তাহলে শুধু শান্ত না, তোদের সবার কপালে দুঃখ আছে।” 

টুনি বলল, “আমরা যখন দুষ্টুমি করি, ঝুমু খালা হাহুতাশ করে, দাদি বকাবকি করে, ছোটাচ্চু চিল্লাফাল্লা করে, এগুলো আসলে মজার মতন, কেউ কিছু মনে করে না। শুধু ভান করে রাগ হয়েছে।” 

প্রমি বলল, “কিন্তু এইটা জানলে সবাই আসলেই রাগ হবে।”

শাহানাপু বলল, “আমি কি প্রকাশকের কাছে যাব?” 

শান্ত বলল, “না না—তুমি যেও না। এই লোক খুব খারাপ।”

টুনি তখন খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা চিন্তা করছে। এবারে মুখটা সুচালো করে বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।” 

সবাই আশা নিয়ে টুনির দিকে তাকাল। শাহানাপু জিজ্ঞেস করল, “কী আইডিয়া?” 

“তার আগে শাহানাপু না হলে শান্ত ভাইয়া, তোমরা আমাকে একটু বল, এমন কি কোনো খারাপ কম্পিউটার ভাইরাস আছে যেটা একটা কম্পিউটারের সব ডাটা নষ্ট করে দিতে পারে?” 

শাহানাপু একটু চিন্তা করছিল তখন শান্ত বলল, “আছে। নতুন একটা ভাইরাস বের হয়েছে, কিন্তু সেটা ই-মেইলে পাঠাতে হয়।” 

“যদি পেন ড্রাইভ দিয়ে সরাসরি দেওয়া হয়?” 

“তাহলে অনেকগুলো আছে, সবচেয়ে ডেঞ্জারাসটার নাম টপিডো, ডেস্কটপের সব ডাটা নষ্ট করে দেয়।” 

“তুমি কি সেটা একটা পেন ড্রাইভে করে এনে দিতে পারবে?” 

শান্ত শাহানাপুর দিকে তাকাল, শাহানাপু বলল, “আমি আমার কম্পিউটার পাগল বন্ধুদের সাথে কথা বলে দেখতে পারি। কিন্তু তুই কম্পিউটার ভাইরাস দিয়ে কী করবি?” 

“বলছি শোনো। আমি আর প্রমি আপু, স্কুল ড্রেস পরে ব্যাঙাচির অফিসে যাব। সেখানে ভান করব আমরা আমাদের স্কুলের একটা প্রজেক্টে এসেছি, আমাদের কাজ হচ্ছে পাবলিশারদের ইন্টারভিউ নিয়ে একটা অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া। তারপর অফিসে ঢুকে শান্তর ম্যানাসক্রিপ্টটা চুরি করে আনব। আর এই ভয়ংকর কম্পিউটার ভাইরাসটা একটা পেন ড্রাইভে করে ওখানে ফেলে রেখে আসব!” 

শাহানাপু মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি। মানুষ পেন ড্রাইভ পেলেই কম্পিউটারে লাগিয়ে দেখে ভিতরে কী আছে। সেই লোক যখন দেখবে তখন কম্পিউটারের ডাটা নষ্ট হয়ে যাবে।” 

টুনি মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ।” 

“তোরা শান্তর ম্যানাসক্রিপ্ট কীভাবে উদ্ধার করবি?”

“আমাদের উপর ছেড়ে দাও। সেটা করে ফেলব।”

“যদি না পারিস?” 

“তাহলে প্ল্যান বি।” 

“সেইটা কী?” 

“ঝুমু খালা।” 

শাহানাপু ভুরু কুঁচকে বলল, “ঝুমু খালা?” 

“হ্যাঁ। ঝুমু খালা সবসময় আমাদের পক্ষে থাকে। ঝুমু খালাকে যে কোনো বিপদে সবকিছু বলা যায়।” 

“সেইটা ঠিক।” 

“যদি আমরা উদ্ধার করতে না পারি তাহলে ঝুমু খালাকে বলব, ঝুমু খালা ব্যাঙাচির গলা চেপে ধরে ম্যানাসক্রিপ্ট উদ্ধার করে আনবে।” 

শাহানাপু মাথা নাড়ল, বলল, “সেটা সত্যি। ঝুমু খালা পারবে।” 

পরদিন বিকালে টুনি আর প্রমি প্রকাশকদের পাড়ায় গিয়েছে। 

ব্যাঙাচি প্রকাশনী খুঁজে বের করে তার সামনে দুইজন দাঁড়িয়েছে। চোখের কোনা দিয়ে দেখে নিয়েছে প্রকাশক টেবিলে পা তুলে গভীর মনোযোগ দিয়ে কান চুলকাচ্ছে। শান্ত যে চেহারার বর্ণনা দিয়েছে সেটি মিলে গেছে, কাজেই দুজনেই প্রকাশকের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। টুনি জোরে জোরে প্রকাশককে শুনিয়ে বলল, “এই যে আরেকটা ইন্টারেস্টিং প্রকাশনী।”

প্রমি বলিল, “হ্যাঁ। নামটা খুবই ইন্টারেস্টিং। ব্যাঙাচি!” 

টুনি বলল, “আর দেখ—এরা অন্যদের মত না—এরা ভিন্ন ধরনের বই ছাপায়।” 

প্রমি বলল, “এদের ইন্টারভিউ নিতে চাও?” 

টুনি বলল, “আমাদের আরও দুইটা ইন্টারভিউ নিতে হবে। কাজেই এইটা নিই, দেখি প্ৰকাশক স্যার রাজি হন কি না।”

ব্যাঙাচির প্রকাশক তার কান চুলকানো বন্ধ করে তাদের কথা শুনছিল, যখন টুনি আর প্রমি অফিসের ভিতরে হাজির হল, মুখে একটা চালবাজের ভাব ধরে রেখে বলল, “তোমরা কী চাও?” 

প্রমি বলল, “আমাদের একটা ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টের জন্য পাঠিয়েছে। আমরা প্রকাশকদের ইন্টারভিউ নিতে এসেছি। আপনাদের প্রকাশনীটা খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে, আপনি কি ইন্টারভিউ দেবেন?” 

প্রকাশক একটা আলগা ভাব নিয়ে বলল, “আমি খুবই ব্যস্ত—তোমাদের মত এই পোলাপানদের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার মত সময় নাই।” 

তখন প্রমি আর টুনি দুইজনেই নেকু বাচ্চাদের মত আহ্লাদী ভাব করে বলল, “প্লিজ প্লিজ প্রকাশক আংকেল প্লিজ!” 

“আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু ঠিক দশ মিনিট—তার বেশি না। ঠিক আছে?” 

প্রমি আর টুনি খুশি হওয়ার ভান করে বলল, “দশ মিনিটে হয়ে যাবে।”

তারপর প্রমি একটা কাগজ বের করে প্রশ্ন করতে শুরু করে, “প্ৰথম প্রশ্ন হচ্ছে। প্রকাশনী হিসেবে আপনার উদ্দেশ্য কী?” 

ব্যাঙাচির প্রকাশক মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমার উদ্দেশ্য এই দেশের সাধারণ মানুষের চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করা। সেইজন্য যে বই অন্যরা ছাপাতে সাহস পায় না, আমি সেই বই ছাপাই।” 

প্রমি মুখ গম্ভীর করে বলল, “আপনার প্রকাশনী থেকে বের হওয়া এরকম একটা দুইটা বইয়ের নাম বলতে পারবেন?” 

ব্যাঙাচির প্রকাশক কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, “যেমন গত বছর বের করেছি ‘বিবর্তন : একটি ভুয়া তত্ত্ব’। এর আগে বের করেছিলাম ‘ভ্যাক্সিন নামে ষড়যন্ত্র’। আরও একটা বই হচ্ছে, ‘পৃথিবী কি আসলেই গোল’।” 

প্রমি মুখ গম্ভীর করে এবারে জিজ্ঞেস করল, “আপনার প্রকাশিত বইয়ের পাঠকের সংখ্যা কি বাড়ছে না কমছে।”

ব্যাঙাচির প্রকাশক উত্তর দেওয়ার আগেই টুনি বলল, “স্যার আমি কি আপনার অফিসটা একটু ঘুরে দেখতে পারি? প্রকাশক হতে কী কী লাগে একটু দেখি?” 

“দেখতে চাইলে দেখ। এখানে বেশি কিছু নাই, গোডাউনে বই থাকে।” 

টুনি মাথা নেড়ে ভিতরে ঢুকে গেল। ভিতরে একটি টেবিলে কাগজপত্রের মাঝখানে একটা পুরোনো ডেস্কটপ কম্পিউটার। সেই কম্পিউটারে একজন কাজ করছে। টুনি মনিটরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল বাংলায় কিছু একটা টাইপ করছে। হতে পারে শান্তর বইটাই কম্পোজ করছে। 

আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখল আসলেই তাই, টেবিলের উপর শান্তর বইয়ের পাণ্ডুলিপি। এখন তাকে এটা তুলে নিয়ে তার বদলে একই রকম দেখতে অন্য কিছু কাগজ রেখে যেতে হবে। সে বাসা থেকে এগুলো তৈরি করে এনেছে। একই রকম কাগজে শান্তকে দিয়ে টুনি আগড়ম বাগড়ম অনেক কিছু লিখিয়ে এনেছে। 

টুনি একটু শব্দ করে হেঁটে গেল, তখন যে মানুষটা টাইপ করছিল সে ঘুরে তাকাল, ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি কে? কার কাছে এসেছ?” 

গলার স্বর রুক্ষ, ভদ্রতা জ্ঞান কম। শান্তর বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টারটা এই লোকের ভালো করে পড়া দরকার। মানুষটা অভদ্র হলেও টুনি যথেষ্ট মিষ্টি স্বরে বলল, “আমরা আমাদের স্কুল থেকে প্রকাশক স্যারের ইন্টারভিউ নিতে এসেছি। আমার বন্ধু ইন্টারভিউ নিচ্ছে, আমি দেখতে এসেছি প্রকাশক হতে হলে কী লাগে।” 

মানুষটা চোখ পাকিয়ে বলল, “কীরকম স্কুল? লেখাপড়ার বদলে রাস্তা ঘাটে ঘোরাঘুরি?” 

টুনি তার গলার স্বর আরও মিষ্টি করে ফেলল, বলল, “আজকাল লেখাপড়া চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে, আগের মতন নাই। আমাদের সবকিছু এখন অভিজ্ঞতাভিত্তিক, যাকে বলে এক্সপেরিয়েন্সিল লার্নিং—” 

মানুষটা কিছু বুঝল না, গজগজ করে বলল, “যত্তসব—তারপর আবার তার কম্পিউটার কী বোর্ডের উপর ঝুঁকে পড়ল। টুনি আরেকটু এগিয়ে যায় এবং হঠাৎ করে হোঁচট খেয়ে নিচে পড়ে যায়। তার হোঁচট খাওয়াটি ছিল যথেষ্ট নাটকীয়, টেবিলের উপর রাখা মানুষটার চায়ের কাপ, কিছু কাগজপত্র, তার নিজের চশমা এবং জুতা, মানুষটার কী বোর্ড সবকিছু নিয়ে সে আছাড় খেল। সত্যিকারের আছাড় খেলে এরকম হওয়া সম্ভব নয়, যেহেতু হিসাব করে আছাড় খেয়েছে তাই এত নিখুঁত হয়েছে। বাসায় সবার সামনে সে অনেকবার এই আছাড়টি প্র্যাকটিস করেছে। 

মানুষটা একটা চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল, টুনি টেবিলটা ধরে নিজেকে সামলে নিল এবং মানুষটা যখন উবু হয়ে তার চায়ের কাপটা তুলছে তখন চোখের পলকে টুনি শান্তর বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা তুলে আগড়ম বাগড়ম লেখা কাগজগুলো টেবিলের উপর রেখে দিল। 

টুনি তখন চেঁচাতে লাগল, “আমার চশমা—আমার চশমা—” 

মানুষটা যখন চশমার জন্য টেবিলের তলায় উঁকি দিচ্ছে, তখন সে শান্তর পাণ্ডুলিপিটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে পেন ড্রাইভটা জায়গামত ফেলে রাখল। 

ঘরের ভেতর হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটার শব্দ শুনে সামনের অফিস থেকে ব্যাঙাচির প্রকাশক এবং তার পিছু পিছু প্রমি এসে ঢুকল। প্রকাশক জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? এত শব্দ কীসের?” 

জলীল নামের অন্যজন মেঝে থেকে টুনির চশমাটা তুলে টুনির হাতে দিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “এইরকম বেকুব পোলাপানকে অফিসের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া ঠিক হয় নাই। দেখেন আছাড় খেয়ে পড়ে কী অবস্থা করেছে।” 

টুনি ঘর থেকে বের হতে হতে প্রমির হাত ধরে টেনে বলল, “চল, আমরা যাই।” 

প্রমি বলল, “চল।” 

দুজনে দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। প্রকাশক অবাক হয়ে বলল, “কী হল? তোমার ইন্টারভিউ তো শেষ হয় নাই।”

প্রমি বলল, “আমরা শেষ করে নিব।” 

“তোমরা কীভাবে শেষ করবে।” 

“বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা লিখে দেব!” 

“বানিয়ে বানিয়ে লিখবে মানে?” 

টুনি দাঁত বের করে হেসে বলল, “লিখব আপনি বলেছেন, ভালো বই ছাপাতে হয় কে বলেছে! আলতু ফালতু বই বের করে বিতর্ক তৈরি করলেই বই বিক্রি হয়!” 

“কী বললে? কী বললে তুমি?” 

“তারপরে লিখব বই বের করে মামলা মোকদ্দমা শুরু করে দিতে হয়—” 

ব্যাঙাচির প্রকাশক চোখ কপালে তুলে বলল, “এ্যা এ্যা—কী বললে?” 

ততক্ষণে প্রমি আর টুনি হাওয়া হয়ে গেছে। প্রকাশক কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পর ভেতর থেকে জলীল বলল, “স্যার—এসে দেখেন।” 

প্রকাশক ভিতরে ঢুকে বলল, “কী দেখব?” 

“আমি অশান্ত প্রশান্তর বই কম্পোজ করতেছি, কিন্তু দেখেন বইয়ে কী লেখা।” 

“কী লেখা?” 

জলীল পড়ে শোনাল, “ব্যাঙাচি রে ব্যাঙাচি! তোরে আজকে আমি হামানদিস্তায় ছেঁচি—” 

“তাই লেখা?” 

“হ্যাঁ, পুরা পৃষ্ঠা জুড়ে—” জলীল অন্য পৃষ্ঠাগুলি দেখে বলল, “অন্য পৃষ্ঠাতেও এই রকম।” 

প্রকাশক মানুষটা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “জলীল, তুমি বুঝতে পারছ কী করছে?” 

“কী করছে?” 

‘ঐ যে মেয়ে দুইটা আসছিল তারা আছাড় খাওয়ার ভান করে সব কাগজ নিয়ে এইগুলা রেখে গেছে। পাজি মেয়ে—” 

প্রকাশক মানুষটা কয়েকবার ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে বলল, “মেয়ে দুইটা নিশ্চয়ই বেশিদূর যাইতে পারে নাই। আমি গিয়ে ধরে আনি—” বলে ব্যাঙাচির প্রকাশক লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে প্রায় ছুটতে ছুটতে টুনি আর প্রমিকে খুঁজতে লাগল। কয়েকটা গলি পার হয়ে বড় রাস্তার মোড়ে আসতেই সে টুনি আর প্রমিকে পেয়ে গেল। হুংকার দিয়ে তাদের সামনে গিয়ে সে খপ করে তাদের ধরে ফেলল। 

টুনি আর প্রমি চমকে উঠে মানুষটার দিকে তাকায়, এক সেকেন্ডের জন্য তাদের চোখে মুখে একটা আতঙ্ক ফুটে ওঠে, কিন্তু পরমুহূর্তে তাদের আতঙ্ক দূর হয়ে গেল, কারণ তারা দেখল মানুষটার পিছন থেকে একজন তার শার্টের কলার ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে হিংস্র গলায় বলছে, “এই যে মিয়া ভাই—কী করবার চান?” 

তারা একশ মাইল দূর থেকে এই গলার স্বর চিনে ফেলবে—কারণ এটা হচ্ছে ঝুমু খালার গলার স্বর! ঝুমু খালা এখানে কোথা থেকে এসেছে? 

ব্যাঙাচির প্রকাশক মানুষটা থতমত খেয়ে নিজের কলার থেকে ঝুমু খালার হাত সরাতে চেষ্টা করতে করতে বলল, “আপনি কে? কলার ধরেছেন কেন?” 

ঝুমু খালা হুংকার দিয়ে বলল, “তার আগে বলেন, ‘আপনি কে? এই মেয়েদের ধরার চেষ্টা করছেন কেন?” 

ঝুমু খালার হুংকার শুনে আশেপাশে কয়েকজন দাঁড়িয়ে গেছে। শুকনা লিকলিকে একজন হাতা গুটিয়ে বলল, “আপা, কুনো সমস্যা?” 

“না, আমার কুনো সমস্যা নাই। সমস্যা থাকলে এই মিয়া ভাইয়ের আছে- বলে সে ব্যাঙাচির প্রকাশককে জিজ্ঞেস করল, “কুনো সমস্যা?” 

ব্যাঙাচির প্রকাশক রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, “আপনি জানেন এরা কী করেছে? আমার অফিসে ঢুকে—”

“জানব না কেন?” ঝুমু খালা মুখ শক্ত করে বলল, “আপনি শান্তর বইটা ফেরত দেন নাই, তারা ফেরত আনছে। সমস্যা কী?” 

মানুষটা থতমত খেয়ে বলল, “এরা শান্তকে চিনে।”

“চিনে। আমিও চিনি।” 

“শা-শান্ত কই?” 

ঝুমু খালা আঙুল দিয়ে দেখাল, “ঐ যে আসে। পানি কিনতে গেছে।” 

ঠিক তখন শান্তকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেল। টুনি আর প্রমির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা—মানে তোমরা ঠিক আছ?” 

টুনি দাঁত বের করে হাসল, “ঠিক আছি।” 

“আমার ম্যানাসক্রিপ্ট?” 

“নিয়ে আসছি।” 

ঠিক তখন ব্যাঙাচির প্রকাশকের ফোন বেজে উঠল। সে ফোনটা ধরতেই জলীল চিৎকার করে বলল, “স্যার তাড়াতাড়ি আসেন—তাড়াতাড়ি।” 

“কেন? কী হয়েছে?” 

“আপনার কম্পিউটারে আগুন লেগে গেছে—” 

“আগুন লেগে গেছে? আগুন?” 

“জে। একটা পেন ড্রাইভ পড়েছিল—কী আছে দেখার জন্য খালি কম্পিউটারে ঢুকাইছি, ওমনি ঘড়ঘড় করে কয়েকবার শব্দ করল, তারপর আগুন!” 

ব্যাঙাচির প্রকাশক, মাথায় থাবা দিতে দিতে ছুটে যেতে থাকে। 

ঝুমু খালা হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “খালি নামে ব্যাঙাচি না—কামেও মনে হয় ব্যাঙাচি!” 

টুনি আর প্রমিও ঝুমু খালার সাথে হাসে। শুধু শান্ত মন খারাপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লেখক হওয়া সে যত সহজ ভেবেছিল, মনে হচ্ছে কাজটা তত সহজ না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *