অশান্ত ঘূর্ণি – ১.৫

কিন্তু ঐ শুয়ে পড়া পর্যন্তই। কম্বল মুড়ি দিয়ে শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারে মশার গুঞ্জন শুরু হয়। নাকে চোখে মুখে মশার কামড় সেই সঙ্গে।

সীমানা কম্বলটা মুখের উপর টেনে মাথাটা ঢেকে দেয়। কিন্তু তাও বেশীক্ষণ পারে না, মুখ ঢেকে রাখতে দম আটকে আসতে চায়। সীমানা আবার কম্বল থেকে মুখটা বের করে, মশাও সঙ্গে সঙ্গে এসে তাকে যেন ছেঁকে ধরে।

অসম্ভব। মশারি ছাড়া এখানে শোওয়া যাবে না। মশারিটা থেকে একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল বলে মশারিটা টাঙায়নি সীমানা—অন্ধকারেই উঠে বসল সীমানা। ঘরের আলোটা জ্বালালো।

সুধন্য মশারি টাঙিয়েই শুয়েছিল, সে তখনো ঘুমোয় নি। মশারির ভেতর থেকে শুধালো, কি হলো?

অসম্ভব—

কি?

মশারি না খাটিয়ে এখানে শোওয়া যাবে না।

সুধন্য হেসে ফেলে, জানতাম পারবে না। এ বাবা কৃষ্ণনগরের মশা!

সীমানা সুধন্যর কথার কোন জবাব না দিয়ে কোনমতে মশারিটা টাঙালো—টাঙাবার তেমন ভাল কোন ব্যবস্থা ছিল না। চারটে কোণ–কোনটা উঁচু কোনটা নীচু হলো, তা হোক আলোটা নিভিয়ে দিয়ে সীমানা মশারির মধ্যে ঢুকলো। গন্ধে নাক জ্বালা করে—তবু প্রচণ্ড মশার হাত থেকে তো নিষ্কৃতি। সীমানা কম্বলটা টেনে নিল।

ঘুমোবার চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম আসতে চায় না। ঘরের জানালার ফুটোফাটা দিয়ে শীতের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরে ঢুকছে। সামান্য ঐ একটা কম্বলে হাড়ে পর্যন্ত যেন কাঁপুনি ধরায়। পা-দুটো গুটিয়ে নিল সীমানা পেটের কাছে—হাত-দুটো দু’পায়ের ভাঁজের মধ্যে গুঁজে দিল, তবু শীত যেন মানতে চায় না। শীতে সীমানার মনে হয় সে বুঝি জমে যাবে। কে জানত কৃষ্ণনগরে এমন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা—প্রস্তুত হয়েও আসে নি। তা ছাড়া এখানে যে এভাবে রাত কাটাতে হবে একবারও কি ভাবতে পেরেছিল সীমানা?

রাত ক’টা হলো কে জানে! মা হয়ত বাড়িতে এখনো তার প্রতীক্ষায় রোজকার মত জেগে বসে আছে। এখনো ভাবছে হয়ত—দেরি হচ্ছে কোন কারণে সীমানার ফিরতে। ফিরে আসবে এখুনি। রাত দশটা নিশ্চয়ই বেজে গিয়েছে।

শেষ লোকাল ট্রেনটা রাত পৌনে এগারটায় পৌঁছায়—তারপর বারোটা সাড়ে বারোটা যখন বেজে যাবে, সীমানা ফিরবে না, মা হয়ত তখন সত্যিসত্যিই ব্যস্ত হয়ে উঠবে। এমন তো কখনো আগে হয় নি!

রাত্রে সে বাড়ি ফেরেনি এমন কখনো হয় নি।

হয়ত মা’র দুশ্চিন্তা বাড়বে, কি হলো মেয়েটার, কোন অ্যাক্সিডেন্ট বা কিছু হলো কিনা, হয়ত শেষ পর্যন্ত বাবাকেও বলবে মা—সীমা তো এখনো ফিরলো না!

বাবা বলবেন, ফেরে নি এখনো?

না। এমন তো কখনো হয় না!

কাকে দিয়েই বা মা-বাবা তার খবর করবে? আর কোথায়ই বা খবর করবে?

অসহায় এক বৃদ্ধ ও এক প্রৌঢ়া হয়ত সারাটা রাত জেগে বসে থাকবে। সে ফিরল বা না-ফিরল সে কারণে কারই বা মাথাব্যথা!

কেবল ঐ দুটি প্রাণী—প্রতীক্ষায় অজ্ঞাত আশঙ্কায় নিরুপায়ে ছটফট করবে। কারোরই ঘুম হবে না। কিন্তু হাত-পাগুলো যেন ঠাণ্ডায় কেমন অসাড় হয়ে আসছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কেমন যেন একটা ব্যথায় কনকন করে।

সুধন্য কি ঘুমিয়ে পড়লো?

কোন সাড়াশব্দ নেই তার। সামান্য হাত-দুয়েকের ব্যবধান দুটো খাটের মাঝখানে। এর চাইতে স্টেশনে ওয়েটিং রুমে বসে বসে কাটালেই বোধ হয় ভাল হতো। কোথায় একটা ঘুণ পোকা কিট্ কিট্ কিট্ শব্দ করে চলেছে।

নিঝুম শীতের ঠাণ্ডা রাত। ঘরের মধ্যে চাপ বাঁধা অন্ধকার আর কনকনে ঠাণ্ডা। তবু একসময় সারাটা দিনের ঘোরাঘুরির জন্য পরিশ্রমে অবসন্ন দেহে ঘুম নামে সীমানার চোখে। ঘুমিয়েই পড়েছিল সীমানা।

হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। অন্ধকারে। দুটো হাতের বলিষ্ঠ পীড়ন। দুটো হাত যেন সীমানার দেহটা নিবিড় করে আঁকড়ে ধরেছে।

প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারে নি। ঘুম-ভাঙা সদ্য অনুভূতি দিয়ে যেন সঠিক উপলব্ধি করতে পারে নি ব্যাপারটা সীমানা। কিন্তু পরমুহূর্তেই সীমানার সমস্ত চেতনা যেন সজাগ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। তবু তার মুখ দিয়ে সেই মুহূর্তে কোন শব্দ বের হয় নি। বরং আতপ্ত দুটি বাহুর নিবিড় নিষ্পেষণ তাকে ঐ মুহূর্তে কেমন যেন চেতনাহীন পঙ্গু করে দিয়েছিল। যে হিম-তীক্ষ্ণতায় তার শরীরের সমস্ত স্নায়ু এতক্ষণ অবশপ্রায় হয়ে ছিল, সেই স্নায়ুপথে যেন একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বহে যেতে লাগল। হারিয়ে ফেলেছিল সীমানা সেই মুহূর্তে নিজেকে। সমস্ত চেতনা যেন তার কি এক দুর্বার সম্মোহনে বিকল হয়ে গিয়েছিল। আদিম লালসার জারক রসে সীমানা যেন আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। নিঃসীম এক অন্ধকারের মধ্যে ক্রমশ তালিয়ে যাচ্ছিল সীমানা যেন চেতনার প্রান্তসীমায়। ব্যথা বেদনা ও অনাস্বাদিত এক্ পুলকের সঞ্চারে বার বার তার সমস্ত বোধশক্তি ও অনুভূতিতে মৃদু মৃদু শিহরণ তুলে যাচ্ছিল।

বলে নি, কোন কথা বলে নি সীমানা—কোন প্রতিবাদ তার দিক থেকে দেখা দেয় নি—সে যেন সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পিতা তখন

জ্ঞান ফিরে এসেছিল সীমানার সুধন্যর তপ্ত ওষ্ঠের নিবিড় চুম্বনে। শুকনো গলায় কোনমতে একটি কথা মাত্র উচ্চারণ করেছিল সীমানা, এ কি করলে সুধন্য!

সুধন্য সীমানাকে দু’হাতে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে তার কপালের উপর নিজের গালটা রেখে বলছিল, কাল হবে না—পরশুই আমরা রেজিস্ট্রি-অফিসে গিয়ে নাম রেজিস্ট্রি করিয়ে আসব সীমা।

কিন্তু—

তোমাকে ছেড়ে আর আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়।

তুমি তো আমার বাড়ির সব খবরই জানো সুধন্য-—

জানি।

দাদা সরে দাঁড়িয়েছে—সংসারের সব ঝুঁকি একা আমার ওপরে। আমি তো তাদের ফেলে চলে আসতে পারব না।

কে বলেছে চলে আসতে?

তবে?

তুমি যেমন আছ তেমনি থাকবে। বিয়েটা কেবল হয়ে যাক।

সে কেমন হবে?

উপায় কি বলো? যা বর্তমানে উপায় করি তা দিয়ে আর যাই হোক, ভদ্রভাবে দুজনের বেঁচে থাকা যায় না। তাছাড়া আমারও একটা সংসার আছে। তোমার মত আমারও একটা দায়িত্ব আছে। তোমাকে বলি নি একটা ভাল চাকরি বোধ হয় দু—একদিনের মধ্যেই পেয়ে যাবো।

কোথায়? কোন্ কোম্পানিতে? ভীরু কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলে সীমানা।

একই শয্যায়—একই কম্বলের তলায় দুজনে তখন শুয়ে। সুধন্য দুটো বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে সীমানার শরীরটা তখনো নিবিড় করে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রেখেছে।

সুধন্য বললে, সে আছে। সব পরে জানতে পারবে। একটা surprise দেবো তোমাকে। সে চাকরিটা হয়ে গেলে আর কোন ভাবনা থাকবে না।

সত্যি বলছো?

হ্যাঁ। প্রায় ঠিক। আর চাকরিটা পেলে আমাদের ভবিষ্যতের প্ল্যানটাও হবে অন্য।

বাকী আরো ঘণ্টা-তিনেক ওদের দুজনের কারো চোখেই ঘুম আসে নি সে-রাত্রে। বাইরে শীতের রাত্রের প্রহরগুলো নিঃশেষিত হয়ে আসছিল—একটা নেশার মধ্যে যেন দুজনে তলিয়ে ছিল।

হঠাৎ একসময় সীমানাই বলে, রাত তিনটের ট্রেনটা ধরতে হবে না! দেখ তো তোমার ঘড়িতে ক’টা বাজে?

সুধন্য শয্যা থেকে উঠে আলো জ্বালিয়ে হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, সর্বনাশ! তিনটে বাজতে মাত্র পাঁচ মিনিট!

তবে কি হবে সুধন্য?

পৌনে পাঁচটায় একটা ট্রেন আছে। সেটাই ধরবো—চল বের হয়ে পড়ি।

রিকশা তো বোধ হয় পাবো না! সীমানা বললে।

হেঁটে চলে যাবো।

দুজনে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু ভাগ্য ওদের ভালই বলতে হবে। হোটেলের দরজার সামনেই একটা সাইকেল-রিকশা ওরা পেয়ে গেল। সাইকেল-রিকশাটা স্টেশনের দিকেই যাচ্ছিল।

স্টেশনে এসে দেখল ট্রেনটা তখনো আসে নি। লেট রান করছে।

.

বাড়িতে যখন গিয়ে পৌঁছাল সীমানা, বেলা তখন পৌনে সাতটা।

সুহাসিনীর সারারাত ঘুম হয় নি। উনুন ধরিয়ে স্বামীকে চা দিয়ে ভাতের হাঁড়িটা সবে উনুনে চাপিয়েছে।

সীমানা এসে একেবারে সোজা রান্নাঘরেই ঢুকল। মা!

সারাটা রাত কোথায় ছিলি? সুহাসিনী কেমন যেন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তো নয় যেন তার অন্তর পর্যন্ত বিদ্ধ করছে।

অফিসের কাজে কৃষ্ণনগর যেতে হয়েছিল।

কৃষ্ণনগর!

হ্যাঁ। ট্রেনটা ফেল করলাম—

মা’র দু-চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখনো সীমানার সর্বাঙ্গে যেন কি অনুসন্ধান করছে। কি একটা প্রশ্ন যেন তার দু-চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

চা হয়েছে মা? ভীষণ চায়ের পিপাসা পেয়েছে। মায়ের চোখের অস্বস্তিকর দৃষ্টিটা এড়াবার জন্যই যেন কথাটা বললে সীমানা।

সুহাসিনী কোন জবাব দিল না মেয়ের কথায়। তখনো মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে সুহাসিনী।

আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি। তুমি চা করো। সীমানা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলো। এখুনি আবার বেরুতে হবে। অফিসে গিয়ে রাধেশ চক্রবর্তীকে গতকালের রিপোর্টটা দিতে হবে, সেই সঙ্গে ট্রাভলিং এলাউন্সটাও নিয়ে নিতে হবে চেয়ে। সীমানা জামাকাপড় ছেড়ে সোজা একেবারেই কলতলাতেই চলে গেল স্নানটা সেরে ফেলবার জন্য।

স্নান সেরে এসে দেখে টেবিলের উপরে মা কখন এক কাপ চা প্লেট দিয়ে ঢেকে রেখে গিয়েছে। চায়ের কাপটায় চুমুক দিয়েই আবার নামিয়ে রেখে দিল সীমানা। চা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।

যেমন প্রত্যহ যায় সকাল সাড়ে আটটার ট্রেন ধরেই কলকাতায় চলে গেল সীমানা।

অফিসে গিয়ে কিন্তু সুধন্যর সঙ্গে দেখা হলো না। রাধেশ চক্রবর্তী বললেন, সুধন্য আসাম গিয়েছে দিন পনের-কুড়ির জন্য। মাসের প্রথম দিকে ফিরবে।

সীমানা যেমন কাজ করছিল তেমনি আবার কাজ করতে লাগল। মধ্যে মধ্যে মনের মধ্যে একটা স্বপ্নকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে।

ছোট্ট একটি সুখের সংসার—সে ও সুধন্য। মা-বাবা ও নিজের বাড়ির কথাও মনে হয়—সে চলে গেলে ওদের কি হবে! পরক্ষণেই মনকে সান্ত্বনা দেয়, একটা কিছু ব্যবস্থা সুধন্য করবেই।

আগে থাকতেই ভেবে কি হবে?

.

কিন্তু সেই যে সুধন্য আসাম গিয়েছিল কাজে কৃষ্ণনগর থেকে ফিরে ঐদিন সকালেই, তারপর আর তার সঙ্গে দেখা নেই। খবর একটা পেয়েছিল একদিন বিকেলের দিকে অফিসেই। দিন-পঁচিশ বাদে আসাম থেকে ফিরে এসে অফিসে রিপোর্ট করে পরের দিন আবার আসবে বলে যে চলে গিয়েছে আর আসে নি।

তারপর আরো দুটো মাস চলে গেল। সুধন্য এলো না। সুধন্যর সঙ্গে আর দেখা হলো না, আর ঐ সময় থেকেই সীমানা তার শরীরের মধ্যে কেমন একটা ক্লান্তি, শিথিলতা ও অস্বস্তি বোধ করতে থাকে।

সকালবেলা মাথাটা কেমন ঘোরায়। গা বমি-বমি করে। কিছু ভাল লাগে না। কোন কিছুতেই যেন এতটুকু উৎসাহ পায় না।

কেমন যেন একটা সন্দেহের কাঁটা মনের মধ্যে কিচ কিচ করে বিঁধতে থাকে। এবং সন্দেহটা যে তার অমূলক নয় সেটাও বুঝতে কষ্ট হয় না সীমানার। কোন মেয়েরই ব্যাপারটা বোঝবার কষ্ট হবার কথা নয়। সমস্ত বোধশক্তি যেন কেমন অসাড় হয়ে যায় সীমানার।

সীমানা যেন পাগলের মতই সুধন্যর খোঁজ করতে থাকে। এবং এটাও সীমানার বুঝতে কষ্ট হয় না সুধন্য তার কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছে। সুধন্যকে আর সে কোনদিনই খুঁজে পাবে না। সুধন্য নিশ্চয়ই অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছে।

রাগে দুঃখে লজ্জায় ও আত্মগ্লানিতে সীমানার যেন নিজের হাত নিজেরই কামড়াতে ইচ্ছা করে। তার কাজ গেল সব গেল, সে কেবল রাস্তায় রাস্তায় সুধন্যর খোঁজে ঘুরতে লাগল। গতকালও সারাটি দিন ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে সীমানা।

কিন্তু কিছু টাকার অত্যন্ত প্রয়োজন। সংসারটা প্রায় অচল হয়ে এসেছে। টাকা। হ্যাঁ, কিছু টাকার একান্ত প্রয়োজন। শয্যায় শুয়ে-শুয়েই খোলা জানালাটার দিকে তাকাল সীমানা।

রাত শেষ হয়ে এলো। মা বোধ হয় উঠে পড়েছে।

বাবার স্ট্রোক হয়েছে। তাঁরও চিকিৎসার প্রয়োজন। সীমানা শয্যা ছেড়ে উঠে বসল। ক্লান্তি ও অবসন্নতায় শরীরটা যেন ভেঙে পড়তে চায়। মাথাটা ঝিম্ ঝিম্ করছে। তবু উঠতে হবে। তবু বেরুতে হবে। কোনমতে শরীরটাকে টেনে উঠে পড়ল সীমানা শয্যা থেকে। বেরুবার পথে একবার ঐ যতীন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে যেতে হবে।

সীমানা সোজা চলে গেল স্নানের জায়গায়। স্নান সেরে জামাকাপড় পরছে, সুহাসিনী এসে সামনে দাঁড়াল। হাতে এক কাপ চা—বেরুচ্ছিস নাকি?

হ্যাঁ।

খোকাকে একটা খবর দিলে হতো না?

দিয়ে কোন লাভ আছে?

তবু—

বেশ। বলছো যখন যাব একবার।

ডাক্তারবাবুর কাছে একবার যাবি না?

বাবা কেমন আছেন?

ঘুমোচ্ছেন।

সৌজন্য কোথায়?

সে তো সকালে উঠেই কখন বের হয়ে গিয়েছে।

বাবার অসুখের কথা জানে না? বল নি তাকে?

বলেছিলাম। বললে—

কি বললে?

দিদিকে বলো। আমি কি করবো।

সীমানা মা’র কথার কোন জবাব দিল না। ঝোলাটা কাঁধে করে দরজার দিকে এগুলো।

যাচ্ছিস? কিছু খেলি না?

না। ক্ষিধে নেই।

কাল রাত্রেও তো কিছু খাস নি?

বিরক্ত করো না মা। হঠাৎ যেন খিঁচিয়ে ওঠে সীমানা সুহাসিনীকে।

সুহাসিনী আর কোন কথা বলে না।

সীমানা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। চা-ও খেলো না।

.

যতীন ডাক্তার তার বাড়ির নীচে ডিসপেনসারি ঘরেই বসেছিল। সীমানাকে ঘরে ঢুকতে দেখে একগাল হেসে সাদর আহ্বান জানায়, এসো সীমানা, হরেনবাবু কেমন আছেন?

ঘুমোচ্ছেন। আপনি একবার সকালের দিকে যাবেন।

নিশ্চয়ই যাবো।

যা করবার করবেন। টাকার জন্য ভাববেন না।

আরে না, না–তোমরা কি আমার পর! হরেনবাবুর ভার আমার উপরেই ছেড়ে দাও। তুমি কেবল একটা যদি ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হয়—

কি বলুন?

কলকাতা থেকে একজন কার্ডিয়োলজিস্টকে এনে যদি একটা ই. সি. জি. করাতে পার!

দেখি আমি তো কলকাতায়ই যাচ্ছি—

ডাঃ সুনীল সেনকে আনাতে পার তো ভাল হয়। অল্প বয়েস কিন্তু শুনেছি খুব বিচক্ষণ হার্ট-স্পেশালিস্ট।

এখানে এলে কত নেবেন তিনি?

অত্যন্ত ভদ্র ও অমায়িক ডাক্তার সেন। তেমন করে বললে হয়তো এমনিতেই এসে দেখে যাবেন তোমার বাবাকে।

তাঁর ঠিকানাটা কি বলতে পারেন?

শচীন ডাক্তার ঠিকানাটা দিয়ে দিল একটা কাগজে লিখে।

সীমানা ঘর থেকে বের হয়ে এলো।

স্টেশনের পথে হাঁটতে হাঁটতে সহসা একজনের কথা মনে পড়ে সীমানার—ট্রেনের পরিচিত সেই ডাঃ কল্যাণ রায়কে।

কল্যাণ রায় কোন্ হাসাপাতালে কাজ করে তাও জানে সীমানা। সোজা কল্যাণ রায়ের সঙ্গে গিয়ে তার হাসাপাতালে দেখা করলে কেমন হয়। তাকে যদি সীমানা জানায় তার বিপদের কথা? ভদ্রলোক কি তাকে সাহায্য করবেন না? সাহায্য যদি নাই করেন, তাহলেও একটিবার দেখা করতে দোষ কি?

কথাটা সীমানা যত ভাবে, ততই সে একটিবার আজই কল্যাণ রায়ের সঙ্গে দেখা করবে স্থির করে। কলকাতায় পৌঁছে বাসে করে সীমানা সোজা আর. জি. কর হাসপাতালেই চলে গেল।

বেলা তখন পৌনে দশটা। হাসপাতাল তখন কর্ম-মুখরিত। আউটডোরে গিয়ে ঢোকে সীমানা।

আউটডোরে পেসেন্ট্ গিজগিজ করছে সমস্ত বিভাগে। সীমানা এর মধ্যে কি করে কল্যাণ রায়কে খুঁজে বের করবে?

ডাঃ কল্যাণ রায় কোন্ ডিপার্টমেন্টে কাজ করে তাও সে জানে না। কিছুক্ষণ অনির্দিষ্টভাবে ঘোরাঘুরি করে একজন স্টুডেন্টকেই ধরল সীমানা। শুনছেন!

স্টুডেন্টটি ফিরে দাঁড়াল, আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ, ডাঃ কল্যাণ রায়কে কোথায় পাবো বলতে পারেন?

ডাঃ চক্রবর্তীর সিনিয়ার হাউস-স্টাফ্ কল্যাণদাকে খুঁজছেন?

হ্যাঁ। কোথায় পাবো তাঁকে?

কল্যাণদাকে এখন মেডিকেল ইনডোরে পাবেন।

সেটা কোথায়? দয়া করে আমাকে একটু দেখিয়ে দেবেন? এখানকার কিছুই আমি জানি না—চিনি না।

স্টুডেন্টটি যেন কি ভাবল, তারপর বললে, আসুন আমার সঙ্গে।

স্টুডেন্টটি সীমানাকে মেডিকেল ওয়ার্ডের দোতলায় নিয়ে গেল। দাঁড়ান এখানে—দেখি কল্যাণদা আছেন কিনা।

স্টুডেন্টটি ওয়ার্ডের মধ্যে চলে গেল, সীমানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। নার্স, ডাক্তার ও স্টুডেন্টরা আসা-যাওয়া করছিল। সর্বত্র একটা ব্যস্ততার সাড়া। একটা মিশ্র ডেটলের ও ঔষধের গন্ধে সীমানার গা যেন গোলাতে থাকে।

এ কি, আপনি?

চমকে ফিরে তাকাল সীমানা। সামনে দাঁড়িয়ে ডাঃ কল্যাণ রায়।

সীমানা বললে, বিশেষ একটা বিপদে পড়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি ডাঃ রায়।

বিপদ! কি বিপদ!

কাল রাত্রে বাড়িতে ফিরে দেখি বাবার স্ট্রোক হয়েছে—আমাদের ওখানকার স্থানীয় ডাক্তার দেখেছেন, তিনি বলছিলেন একজন ভাল কার্ডিয়োলজিস্ট্রকে দিয়ে একবার বাবাকে পরীক্ষা করাবার জন্য। আমার সঙ্গে তো কারো জানাশোনা নেই—হঠাৎ মনে পড়লো আপনার কথা—

তাই তো! এখন বোধ হয় কাউকে পাওয়াও যাবে না! কল্যাণ রায়কে যেন একটু চিন্তিত দেখায়।

কল্যাণবাবু! বলুন?

আমাদের ডাক্তারবাবু ডাঃ সুনীল সেনের কথা বলছিলেন—

ঠিক বলেছেন—তবে তিনি তো এ হাসপাতালের নন, অন্য হাসপাতালের সঙ্গে অ্যাটাচড্—একটু দাঁড়ান এখানে, আমি আসছি—

কল্যাণ রায় ওয়ার্ডের মধ্যে আবার চলে গেল। জুনিয়ার পরিতোষকে ডেকে বললে, পরিতোষ, আমি একটু বেরুচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে। তুমি ভাই এদিকটা দেখো।

ঠিক আছে কল্যাণদা, আপনি যান—তারপরই হঠাৎ পরিতোষ কল্যাণের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, বাইরে যে ভদ্রমহিলাটি দাঁড়িয়ে আছেন, একটু আগে যার সঙ্গে আপনি কথা বলছিলেন, ওঁকে আপনি কত দিন চেনেন? পরিচয় কত দিনের?

কেন বল তো?

আমার বন্ধু সুধন্যকে—মানে সুধন্য মল্লিককে আপনার মনে আছে?

সুধন্য মল্লিক! সেই যে খুব লম্বামত—চেইনস্ স্মোকার? মুখে বসন্তের দাগ—

হ্যাঁ—

সুধন্যর সঙ্গে একসময় ঐ মহিলাটির খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল—

তাই নাকি?

গত পরশু বেনারস থেকে সুধন্যর একটা চিঠি পেয়েছি—মেয়েটি তাকে কি ভাবে প্রতারিত করেছে সব লিখেছে—

ঐ মেয়েটি!

হ্যাঁ—ওর নাম তো সীমানা চট্টোপাধ্যায়!

তা হবে, নাম আমি ওর জানি না।

ওয়ার্ডের ভিতর থেকে বের হয়ে এসে সীমানার দিকে তাকিয়ে কল্যাণ বললে বটে, চলুন—কিন্তু মনের ভিতর থেকে যেন তেমন সাড়া একটা পায় না সে। পরিতোষ যেন হঠাৎ তার মনের সুরটা কেটে দিয়েছে। কেমন যেন একটা বিশ্রী লাগছে।

দুজনে পাশাপাশি গেটের দিকে এগুতে থাকে।

ঐ সময়েই সীমানা একটু ইতস্তত করে ডাকে, কল্যাণবাবু!

কিছু বলছেন?

হ্যাঁ—একটা কথা বলছিলাম। ডাঃ সেনের মত ডাক্তারকে তাঁর ন্যায্য ফিস্ দিয়ে নিয়ে যাবার মতো যোগ্যতা তো আমার নেই—

তাহলে? কল্যাণ রায় থমকে দাঁড়াল, তাহলে তাঁর কাছে গিয়ে কি হবে?

আমি যদি তাঁকে আমাদের অবস্থার কথা খুলে বলি, তাঁর দয়া হবে না? কথাগুলো বলতে বলতে সীমানা কল্যাণের মুখের দিকে তাকাল। দু’চোখে সীমানার জল টলটল করছে।

সেই জলভরা দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেন যেন কল্যাণের মনে হয় মেয়েটি আৰু যাই হোক একটু আগে পরিতোষ যা বলল, তা হয়ত ঠিক নয়। তাছাড়া সামান্য যেটুকু পরিচয় তার সীমানার সঙ্গে হয়েছে তাতে করে কাউকে ও প্রতারণা করতে পারে বলেও যেন ঐ মুহূর্তে মনে হয় না কল্যাণের। ক্ষণপূর্বে হঠাৎ কল্যাণের মনটা যে সীমানার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিল, সেটায় যেন কেমন একটা চিড় ধরে।

সীমানা আবার বলে, আপনাকে বলতে দ্বিধা নেই কল্যাণবাবু, গত দু’মাসের কমিশন কিছুই বলতে গেলে পাই নি—সেলের উপরে তো কমিশন—সেল দেখাতে পারি নি—

চলুন দেখা যাক—ডক্টর সেনের সঙ্গে দেখা করে সব বলি—যদি তিনি কনসিডার করেন—

গেটের বাইরে এসে একটা ট্যাক্সিকে হাত-ইশারায় ডেকে দাঁড় করাল কল্যাণ রায়—উঠুন।

সীমানা ইতস্তত করে।

কি হলো, উঠুন?

ট্রামে গেলে হতো না?

না—চলুন উঠুন—

সীমানাকে উঠিয়ে নিজেও উঠে বসল ট্যাক্সিতে কল্যাণ। আবার যেন একটা বিরক্তি দেখা দেয় কল্যাণের মনের মধ্যে। এই সকালবেলা কি ঝুট-ঝামেলায়ই না সে পড়ল! কোথাকার এক উড়ো আপদ ঘাড়ে এসে চাপল।

ট্যাক্সিতে উঠেই কল্যাণ বলে দিয়েছিল ড্রাইভারকে কোথায় যেতে হবে। ট্যাক্সিটা নির্দিষ্ট পথে ছুটে চলেছিল। বেলা দশটা সোয়া দশটা হবে—রাস্তায় মানুষজন ও নানা যানবাহনের অসম্ভব ভিড়। বিচিত্র মিশ্র শব্দে কান পাতা দায়। কল্যাণ একটা সিগারেট ধরিয়ে জানলাপথে বাইরের দিকে তাকিয়ে ধূমপান করতে থাকে অন্যমনস্ক ভাবে।

সীমানা পাশে বেশ যেন একটু দূরত্ব রেখে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। হঠাৎ একসময় আবার কল্যাণ পাশে তাকাল। মুখ নীচু করে বসে আছে সীমানা। কয়েকগাছি চূর্ণ কুন্তল বাঁ গালের উপর এসে পড়েছে। মুখটা যেন কেমন শুকনো করুণ মনে হচ্ছে। মনটা কল্যাণের যেন সঙ্গে সঙ্গে আবার নরম হয়ে আসে। তেমন কোন পরিচয়ই হয় নি এখনো তার মেয়েটির সঙ্গে—পরিতোষের কথাটাই বা কেন সে পুরোপুরি সত্য বলে মেনে নিচ্ছে! সত্য নাও তো হতে পারে। তাছাড়া সেই সুধন্য, যার কথা পরিতোষ বলছিল, কেন যেন তাকে কখনো কল্যাণের ভাল লাগে নি। আরো একটা কথা, অনেকখানি আশা নিয়ে সীমানা তার কাছে এসেছে—সে যদি তার কিছুটা উপকার করতে পারে না হয় করলই। হয়ত আজকের পরে আর সীমানার সঙ্গে তার কোন দিন দেখাই হবে না। কোন সম্পর্কই থাকবে না। তবে কেন সে মিথ্যে তার সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করবে?

ডাঃ রায়!

সীমানার ডাকে চমকে তার মুখের দিকে আবার তাকায় কল্যাণ—কিছু বলছেন?

আপনাকে সামান্য একদিনের ট্রেনের সহযাত্রী হিসাবে পরিচয়ের সুযোগ নিয়ে খুব অন্যায়ভাবে বিরক্ত করছি বুঝতে পারছি

না, না—সে কি কথা মিস্ চ্যাটার্জী। এটা তো ডাক্তার হিসাবে আমাদের ডিউটি।

মনে হচ্ছে আপনাকে বোধ হয় অন্যায়ভাবে ব্যস্তই করলাম।

একটুও ব্যস্ত করেন নি—

দারিদ্র্য আর অভাব মানুষকে যে কত ছোট করে দেয় আমি জানি ডাঃ রায়—

ছি ছি, ওসব কথা বলছেন কেন?

আপনি আমাকে কি ভাবছেন তাও জানি—কিন্তু আমি যে কতখানি নিরুপায় হয়ে, সামান্য পরিচয়ের সূত্র ধরেই আপনার কাছে ছুটে এসেছি যদি আপনাকে বোঝাতে পারতাম—

ঐ সব কথা কেন আপনি বলছেন বলুন তো? ঐ সব কথা কেনই বা আপনার মনে হচ্ছে?

জানি না কেন মনে হচ্ছে—তবে সত্যিই মনে হচ্ছে।

দেখুন—তার চাইতে অন্য কথা ভাবা যাক—

অন্য কথা!

হ্যাঁ—ডক্টর সেন যদি দয়া করে দেখেও দেন—চিকিৎসা ঔষধপত্রের তো একটা খরচা আছে—তাই একটা কথা ভাবছিলাম।

কি? যদি আপনার বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা যায়।

সীমানা কোন কথা বলে না। কেবল কৃতজ্ঞভরা দু’চোখের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে কয়েকটা মুহূর্ত কল্যাণের মুখের দিকে। চোখ দুটো তার আবার ছলছল করে ওঠে। দু’ফোঁটা জল গাল বেয়ে তার গড়িয়েও পড়ে।

ইতিমধ্যে ট্যাক্সিটা নির্দিষ্ট হাসপাতালের গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। কল্যাণ পকেট থেকে টাকা বের করে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিল ট্যাক্সি থেকে নেমে। ডাঃ সেনকে হাসপাতালেই ডক্টরস্ রুমে পাওয়া গেল। কল্যাণ রায়ই নিজের পরিচয় দিয়ে সীমানার কথাটা বলতেই তিনি বললেন, আমার হাতের কাজটা শেষ করেই আমি যাবো। আপনি একটু অপেক্ষা করুন।

নিজের গাড়িতেই গেলেন তিনি ওদের নিয়ে হরেন্দ্রনাথকে দেখতে।

রোগীকে পরীক্ষা করে ও ইলেকট্রো কার্ডিয়োগ্রাম করে রোগীর অবস্থা দেখে নিজেই হাসপাতালে ভর্তি হবার কথা বললেন। ভর্তির ব্যবস্থা তিনিই করে দেবেন তাও বললেন।

বিকেলের দিকে অ্যামবুলেন্সের ব্যবস্থা করে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। সব ব্যাপারটা চুকতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল।

কল্যাণ আগাগোড়াই সঙ্গে ছিল। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবার পর কল্যাণ বললে, এবার আমি তাহলে চলি মিস্ চ্যাটার্জী!

সীমানা মৃদু কণ্ঠে বললে, কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব। সামান্য পরিচয়ে আপনি যা আমাদের জন্য করলেন ডাঃ রায়—

কল্যাণ বললে, একজন ডাক্তার হিসাবে আমার যেটুকু করা কর্তব্য তার বেশী আর কি করেছি—আপনি এবার তাহলে বাড়িতেই ফিরে যাবেন তো?

না—একবার আমার ভাইয়ের ওখানে যেতে হবে—

আপনার ভাই, যিনি কোন্ এক ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন কাল বলছিলেন?

হ্যাঁ, এই শহরেই থাকে—বাবার অবস্থা কেমন বুঝছেন কল্যাণবাবু?

চব্বিশ ঘণ্টা না গেলে ঠিক বোঝা যাবে না। হার্টটা একটু বেশীই ড্যামেজড্ হয়েছে—বাবা ভাল হয়ে যাবেন তো?

নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবেন। চিন্তা করবেন না। আপনি যান বরং আপনার দাদার সঙ্গে দেখা করে তাড়াতাড়ি খবরটা তাঁকে দিন—

আমাকে তো আজ রাত্রে আর হাসপাতালে ঢুকতে দেবে না?

না।

তাহলে কি করে খবর পাবো?

রাত সাড়ে আটটার পর আমি একবার আসব’খন।

আসবেন!

আসবো।

কল্যাণ চলে গেল।

.

সৈকত আর সীমানা প্রায় আড়াই বছরের ছোট-বড়। সৈকতকে তা সত্ত্বেও সীমানা দাদা বলে কখনো ডাকে নি। পরস্পর পরস্পরকে নাম ধরেই ডেকেছে।

সৈকত বেলেঘাটা অঞ্চলেই থাকে। সৈকতের এক বন্ধুর কাছ থেকেই সীমানা তার বাসার কথাটা মাস-আষ্টেক আগে শুনেছিল। মনে ছিল রাস্তাটা ও বাসার নম্বরটার কথা। শিয়ালদহ পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে একটা বাসে উঠে পড়ল সীমানা। বাস থেকে যেখানে এসে সীমানা নামল সেটা যে কেবল তার অপরিচিতই তাই নয় ইদানীং কয়েক বছরে জায়গাটার অনেক অদলবদল হয়েছে। বিরাট চওড়া রাস্তা মাঝখান দিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। মধ্যে মধ্যে সব নতুন বাড়ি উঠেছে। এখনো বহু জায়গা খালি পড়ে আছে। ঐ রাস্তা দিয়ে বাস যায় বটে তবে খুব ঘন ঘন নয়। দূরে দূরে লাইট-পোস্ট। কদাচিৎ এক—আধটা দোকান চোখে পড়ে। মানুষজনও বেশি চলে না। মধ্যে মধ্যে কেবল প্রাইভেট গাড়িগুলো এদিক ওদিক যাতায়াত করছে।

বাস থেকে নেমে সীমানা এদিক ওদিক তাকায়। কিছুদূরে একটা চায়ের দোকান চোখে পড়ে। সীমানা সেই চায়ের দোকানটার দিকেই এগুলো।

চায়ের দোকানটার একটা চটকদার নাম ঘরের মাথায় সাইনবোর্ডে লেখা : সোনালী কেবিন। কয়েকটি মস্তান গোছের যুবক ভিতরে বসে চা পান করছিল আর নিজেদের মধ্যে তর্ক চালাচ্ছিল। তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটি ২৩।২৪ বছরের যুবক সীমানার দিকে তাকাল। সীমানার মত খরিদ্দার কখনো বোধ হয় ইতিপূর্বে সোনালী কেবিনে পদার্পণ করে নি। তাইতেই বিস্ময়।

কেবিনের মালিক শশধর সাদর আহ্বান জানাল, আসুন, বসুন।

সীমানা শশধরকেই রাস্তার কথাটা জিজ্ঞাসা করে। বাসার নম্বরটাও বলে।

সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটি ছেলে বলে ওঠে, সৈকতদাকে খুঁজছেন?

হ্যাঁ। সীমানা বলে।

সোজা চলে যান—পশ্চিম দিকে—নতুন একটা দোতলা বাড়ির পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে সেই রাস্তাটাই।

সীমানা আর দাঁড়ায় না, বের হয়ে পড়ে।

পিছন থেকে চা-পানরত মস্তানদের দু’চারটে কথা ওর কানে আসে। সৈকতদার মনে হচ্ছে মালটি নতুন আমদানি।

অন্য একজনের মন্তব্য শোনা যায়, বেলা দেবীকে তাহলে সৈকতদা বাতিল করে দিয়েছে?

সীমানা হন্ হন্ করে হেঁটে চলে।

বাসাটা খুঁজে পেতে একটু সময়ই লাগে সীমানার। ঐ অঞ্চলের পুরাতন একটা অংশ। সি. আই. টি’র স্কীম থেকে বোধ হয় ঐ অংশটি বাদ পড়ে গিয়েছে। একটা মজা পুকুর—তার পাশ দিয়ে সরু একটা রাস্তা। রাস্তায় কোন আলোর ব্যবস্থা নেই তেমন।

বস্তি প্যাটার্নেরই কতকগুলো বাড়ি। টিনের সব সেড়—পাকা ভিত। তবে জায়গাটায় ইলেকট্রিকের ব্যবস্থা আছে।

সীমানা বিব্রতভাবে এদিক ওদিক তাকায়। চারিদিকে চাপ-চাপ ধোঁয়া। দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়, একটি বারো-তেরো বছরের কিশোর একটা সিনেমার গান গাইতে গাইতে আসছিল, তাকেই ডেকে দাঁড় করায় সীমানা।

শুনছো ভাই!

কে? কিশোরটি দাঁড়াল।

এখানে সৈকতবাবুর বাড়ি কোন্‌টা বলতে পার?

ঐ তো দরজা ভেজানো রয়েছে, আলো জ্বলছে—যান না।

ছেলেটি দাঁড়াল না। চলে গেল।

সীমানা সামনে এগিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে—কাদের কথাবার্তাও শোনা যায়।

সীমানা একটু ইতস্তত করে ডাকে, সৈকত!

কে?

আমি।

আমি কে? বলতে বলতে সৈকত বের হয়ে এলো। তার পিছনে একটি উনিশ-কুড়ি বছরের তরুণী। সৈকতের পরনে ড্রেন পাইপ প্যান্ট, হাওয়াই শার্ট—কাঁধের উপরে একটা গরম সোয়েটার। তরুণীটিরও বেশভূষার চটক আছে বেশ।

কে?

আমি সীমা—

সৈকত যেন হঠাৎ মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। তারপরই বলে, কি খবর? আয় ভিতরে আয়—

সীমানা এসে ঘরে ঢুকল।

ঘরটি বেশ ছিমছাম করে সাজানো-গোছানো। একপাশে একটা সিঙ্গল্ খাট—ছোট একটা টেবিল—টেবিলের ওপরে কিছু বই খাতাপত্র—একটা রেডিও—অ্যালার্ম-ক্লক। অন্য দিকে একটা কাঠের আলমারি—গোটা দুই কাঠের চেয়ার।

আমার এখানকার ঠিকানা কোথায় পেলি?

সে কথার জবাব না দিয়ে সীমানা বললে, বাবার খুব অসুখ। বাবা হাসপাতালে—

কেন—কি আবার হলো তাঁর?

করোনারি অ্যাটাক।

তা আমি কি করব? আমার কাছে কেন এসেছিস?

তুমি তার বড় ছেলে—

হ্যাঁ, ভদ্রলোক জন্ম দিয়েছিলেন বটে—

তুমি একবার যাবে না?

আমি গিয়ে কি করবো—তাছাড়া হাসপাতালেই তো দিয়েছিস—যা করবার তারাই করবে।

পাশের তরুণীটি তখন বলে ওঠে, সৈকত—সাড়ে সাতটা বাজে——সাড়ে আটটায় শো আরম্ভ—

হ্যাঁ হ্যাঁ, চল যাচ্ছি

সীমানার মাথার মধ্যে যেন হঠাৎ আগুন ধরে যায়। সে বলে, তোমার কি বাবার প্রতি কোন কর্তব্যই নেই?

না।

নেই?

না—আমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক তো ভদ্রলোক রাখেন নি। সম্পর্কই যেখানে নেই—সেখানে আবার কর্তব্য কি!

সীমানা দাঁত দিয়ে বারেকের জন্য নীচের ঠোটটা কামড়ে বললে, ঠিক আছে, তুমি যদি তাই মনে করো তো তাই। আমার কর্তব্য তোমাকে একটা খবর দেওয়া, দিলাম। এখন তুমি যা ভাল বুঝবে করবে।

সীমানা আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে এলো।

ক্ষোভমিশ্রিত গলায় সৈকত বললে, বেরুবার মুখে যত সব ঝুটঝামেলা। চল বেলা—

ও তোমার বোন নাকি? বেলা বললে।

হ্যাঁ।

মায়ের পেটের বোন নাকি?

ঐ রকমই।

সীমানার কানে কথাটা প্রবেশ করতেই সে চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। সারাটা দিন ঘোরাঘুরি করেছে—পেটে একটা দানা পড়ে নি। মাথাটার মধ্যে সীমানার যেন কেমন ঝিমঝিম করতে থাকে। গলাটা অসহ্য তৃষ্ণায় যেন কাঠ হয়ে আছে। বুকের মধ্যে একটা চাপা অস্বস্তি। পা-দুটো ক্লান্তিতে যেন পাথরের মত ভারি মনে হয়। একবার হাসপাতালে যেতে হবে। বাবার খবরটা নিতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে বাস-স্টপেজের দিকে এগুতে থাকে সীমানা।

প্রায় মিনিট পনের দাঁড়িয়ে থাকবার পর একটা বাস পাওয়া গেল। বাসে অসম্ভব ভিড়। দাঁড়াবার পর্যন্ত জায়গা নেই—তারই মধ্যে কোনমতে উঠে পড়ে সীমানা।

বাস থেকে নেমে হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকতে যাবে, ডাঃ কল্যাণ রায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

কল্যাণ তার কথামত সীমানার বাবাকে দেখে সীমানার জন্য অপেক্ষা করে করে সবশেষে ফিরে যাচ্ছিল।

মিস্ চ্যাটার্জী!

সীমানা কল্যাণের ডাকে ওর মুখের দিকে তাকাল।

আপনার বাবা এখন অনেকটা ভাল আছেন। কয়েকটা ওষুধের দরকার, আমি ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছি। চলুন ফেরা যাক।

সীমানা কোন কথা বলে না, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

বাড়ি ফিরবেন তো! আমিও আজ বাড়ি যাবো। চলুন।

কল্যাণ যাবার জন্য এগোয়—সীমানাও তাকে অনুসরণ করে দু’পা এগুতেই কেমন যেন তার মাথাটা ঘুরে ওঠে, সে টলে পড়ে যাচ্ছিল, কল্যাণ তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে সীমানার পতনোন্মুখ দেহটাকে ধরে ফেলল, কি হলো?

সীমানার শিথিল দেহটা কল্যাণের দু’হাতের মধ্যে এলিয়ে পড়ে। কল্যাণ বুঝতে পারে সীমানা জ্ঞান হারিয়েছে। প্রথমটায় কল্যাণ যেন একটু হতবুদ্ধি হয়ে যায়, তারপরই সীমানার অচৈতন্য দেহটা কোনমতে পাঁজাকোলা করে সামনের এমারজেন্সিতে নিয়ে গিয়ে তোলে।

এমারজেন্সি রুমের মধ্যে একটা বেঞ্চের উপর সীমানার অচৈতন্য দেহটা শুইয়ে দিয়ে এমারজেন্সিতে ডিউটিরত ডাক্তারটিকে ডেকে আনে।

ডাক্তারটি বয়েসে কল্যাণেরই মত হবে। কল্যাণ নিজে এত ঘাবড়ে গিয়েছিল ঘটনার আকস্মিকতায় যে নিজেই সে একজন ডাক্তার তাও ভুলে গিয়েছিল।

ডাক্তারটি যখন সীমানার পাল্স দেখে বললে ভয়ের কিছু নেই—সামান্য ফেইণ্ট হয়ে গিয়েছে—কল্যাণ কতকটা ধাতস্থ হয়।

চোখেমুখে জল দিতে ধীরে ধীরে সীমানা একসময় চোখ মেলে।

কল্যাণ সীমানার মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ে ডাকে,—মিস্ চ্যাটার্জী!

সীমানা তাকাল কল্যাণের মুখের দিকে।

এখন কেমন বোধ করছেন?

সীমানা উঠে বসবার চেষ্টা করে।

না, না—উঠবেন না—একটু শুয়ে থাকুন। এমারজেন্সির ডাক্তারটি বলে।

সীমানা কিন্তু শুনলো না, উঠে বসল। বললে, আমি ঠিক আছি।

একটু বিশ্রাম নিন না। কল্যাণ বললে।

না। আমি যাবো। সীমানা বললে।

যেতে পারবেন? কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল।

পারব।

বাড়ি যাবেন তো?

হ্যাঁ।

সৈকত বেলাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দরজায় তালা দিয়ে দিল। আছা আলো—আঁধারে সরু কাঁচা রাস্তাটা পার হয়ে দুজনে এসে চওড়া মেটাল-বাঁধানো সি. আই. টি. রোডে পড়ল।

সীমানা জানত না ঐ পল্লী থেকে বের হয়ে অন্য একটা রাস্তা ধরে সি. আই. টি. রোডের অন্য একটা অংশে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে আসা যায়। সীমানা যে রাস্তাটা দিয়ে পল্লীতে গিয়েছিল সেটা অপেক্ষাকৃত ঘোরা রাস্তা এবং সে রাস্তা দিয়ে যেতে-আসতে সময়ও বেশী লাগে, তবে রাস্তাটা প্রশস্ত অনেকটা এবং খোয়া দিয়ে পিটিয়ে পাকা করা। আলোর ব্যবস্থাও ঐ রাস্তাতেই আছে। সৈকত বেলাকে নিয়ে যে রাস্তা দিয়ে এলো, সেটায় আলোর ব্যবস্থা তেমন কিছুই নেই বলতে গেলে। এ রাস্তাটা অবিশ্যি ঐ পল্লীবাসীদের প্রয়োজনে পায়ে-পায়ে তৈরী হয়েছিল—-পল্লীতে যাতায়াতটাকে শর্টকাট করতে।

রাস্তাটার আরো একটা সুবিধা আছে—ঐ রাস্তাটা দিয়ে সি. আই. টি. রোডে এসে পড়লে পরবর্তী বাস-স্টপটার কাছাকাছি একেবারে চলে আসা যায়।

সৈকত সাধারণত ঐ রাস্তাটাই যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করে থাকে। রাস্তা ধরে চলতে চলতেই বেলা একসময় বলেছিল, আজ চলো না ট্যাক্সিতে যাই—সৈকত—

সৈকত কোন জবাব দেয় নি বেলার কথার। হন্ হন্ করে হাঁটছিল। বেলা সৈকতের চলার সঙ্গে তাল না রাখতে পেরে একটু পিছিয়েই পড়ছিল।

বেলা আবার বলে, দেরি হয়ে গিয়েছে বেশ। চল না একটা ট্যাক্সিতেই যাই—

সৈকত এবারেও কোন জবাব দেয় না।

বস্তুত সে একটু আগে সীমানাকে মুখে যাই বলুক না কেন এবং সীমানার কথাগুলো উড়িয়ে দেবার যতই চেষ্টা করুক না কেন, মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা কিসের বিরক্তি ক্রমশ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছিল। মনটা কেমন যেন একটু থিতিয়ে গিয়েছিল।

বাড়ির সঙ্গে এবং সংসারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক সৈকত একেবারে শেষ করে দিয়ে চলে এসেছে ঠিকই—বাড়ির ও সংসারের কোন খোঁজখবরই আর সে রাখে না ইদানীং ঠিকই, তবু সেই বাড়ি আর সংসারের সেই মানুষগুলোকে কেন্দ্র করেই যে মনের বর্তমানের বিরক্তিটা চাপ বেঁধে উঠছে ক্রমশ মুখে সেটা স্বীকার না করলেও মনে মনে বুঝতে পারছিল।

লেখাপড়ায় সৈকত সত্যিই একদিন যে ভাল ছেলে ছিল—অন্য এক শিক্ষা নিয়ে ক্রমশ তার মনটা গড়ে উঠছিল, মনের মধ্যে সেদিন ছিল অন্য এক স্বপ্ন—অন্য এক সাধনা। কিন্তু ক্লাস নাইনে উঠবার পর ক্লাসের গণেশ ও বিভূতিদের দলের সঙ্গে মিশবার পরই ক্রমশ একটু একটু করে যেন তার মনটা বদলে যেতে লাগল।

বয়সটা তার তখন কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণ। মানুষের জীবনের ঐ বয়সটা বড় একটা বিচিত্র সময়। মানুষের পরবর্তী জীবনের ছকটা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বয়সের ঐ সন্ধিক্ষণেই যেন আপনা থেকেই তৈরী হয়ে যায়। সৈকতেরও হয়েছিল তাই। গণেশ ও বিভূতিদের জীবনের সত্যটাকেই সে মেনে নিল। দ্রুত তাদের সঙ্গে তালে তাল রেখে পায়ে পা ফেলে চলতে লাগল। তার পরিচিত জীবনের ছক থেকে যেন সৈকত ছিটকে বের হয়ে গেল।

সুহাসিনী ওদের মা, বাবা হরেনবাবুকে অভিযোগ করেছিল ছেলেমেয়েদের কেন তিনি যথাযোগ্য শাসন করেন নি—কিন্তু সুহাসিনী জানতেন না যুগটা এমন ভাবে পাল্টে গিয়েছে যে ঐ শাসনের দড়ি হাজারো গুণে শক্ত করলেও সৈকত ও সৌজন্যকে তাদের পথ থেকে ফেরানো যেতো না সেদিন।

যুগই তাদের যুগের রাস্তা ধরে টেনে নিয়ে যেত। ওরা আজ যা হয়েছে তাই হতো। আজকাল বোধ হয় কেউ কাউকেই কোন পথ দেখিয়ে দিতে পারে না, যে যার নিজের নিজের পথ আপনিই তৈরী করে নেয়।

সৈকতও নিজের পথ ধরেই তেমনি নিজে চলে এসেছিল। পড়াশুনায় ইস্তফা দিয়ে কিছুদিন পাড়ায় মাস্তানী করে বেড়ালো, তারপরই ক্রমশ যেটা সে উপলব্ধি করতে শুরু করেছিল সেটা হচ্ছে একটা পকেটমানির প্রয়োজন। তাদের দলের অনেকেরই ও জানত ঐ পকেটমানিটা তাদের বাবা-দাদার পকেট থেকেই আসে নিয়মিত, কিন্তু সৈকতের সে উপায় ছিল না।

হরেন্দ্রনাথের সামান্য রোজগারে সংসারের খাঁই মিটিয়ে অতি আবশ্যকীয় খরচখরচাগুলো করে এমন কিছু উদ্বৃত্ত থাকত না যা থেকে সৈকতের বেকারী জীবনের অতি প্রয়োজনীয় খরচখরচার জন্য একটা নিয়মিত পকেটমানি আসতে পারে।

অথচ দিন-দিনই তার হাতখরচটা বেড়ে যাচ্ছিল। অগত্যা নিজের তাগিদেই তাকে যাহোক একটা কিছু উপার্জনের পথ খুঁজে বের করবার চেষ্টা করতে হলো। কিন্তু চেষ্টা করলেই সব কিছু পাওয়া যায় না। চাইলেই সব কিছু এসে মুঠোর মধ্যে ধরা দেয় না।

ফলে সৈকতের মেজাজটা যেন দিন-দিনই তিরিক্ষি হয়ে উঠতে লাগল। ঠিক সেই সময় আবার সীমানাটা পাস করে কলেজে গিয়ে ভর্তি হলো। সৈকত যখন সকালবেলা চা-রুটি খেয়ে পাড়ায় আড্ডা দিতে বের হয়ে যায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য, সীমানা তখন ছোটে কলেজে ক্লাস করবার জন্য।

কেমন যেন একটা হীনতাবোধ মধ্যে মধ্যে সৈকতকে পীড়ন করতে থাকে। কিসের একটা অস্থিরতা যেন তাকে প্রায়ই কেমন বিব্রত অন্যমনস্ক করে তুলতে থাকে। অথচ সে বুঝতে পারে না কিসের ঐ অস্থিরতা, কেন ঐ অন্যমনস্কতা।

হঠাৎ হয়ত আড্ডা দিতে দিতে পকেটে হাত ঢুকিয়ে চার্মিনারের প্যাকেটটা বের করে দেখলো প্যাকেটা চেপটে দুমড়ে রয়েছে—শূন্য, একটা সিগারেটও তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। দুস্ শালা!—বলে প্যাকেটটা কি এক অদ্ভুত আক্রোশে যেন দুমড়ে মুচড়ে দলা করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তারপরই পাশে কেউ থাকলে বলেছে, দে তো, একটা সিগারেট আছে? কিংবা হয়ত রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে যেতে যেতে মনে হয়েছে ঐ সময় এক কাপ চা পেলে মন্দ হতো না। রেস্টুরেন্টটা খরিদ্দারের হট্টগোলে জমজমাট—কিন্তু পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখেছে পকেট একেবারে ফাঁকা। একটা নয়াপয়সাও নেই। মেজাজটা সঙ্গে সঙ্গে বিগড়ে গিয়েছে। নিজের মনেই বলেছে, ধুস্ শালা—

বন্ধুরা হয়ত বলেছে, যা একখানা হিন্দী বই এসেছে না মৃণালিনীতে—নায়িকা একটা সুইমিং কস্টিউম পরে নায়কের সঙ্গে জাপটাজাপটি মাইরি—শির-শির করে ওঠে সারা শরীর।

কিন্তু সৈকতের পকেট শূন্য। দশ আনা তখন স্বপ্নেরও বুঝি অগোচর। মন-মেজাজ সৈকতের বিগড়ে তেতো হয়ে গিয়েছে। শালা সমস্ত দুনিয়াটার উপর সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। খানিকটা খিস্তিখেউড় নিজের মনেই নিজে করেছে।

ওটাই যেন একমাত্র সান্ত্বনা। কেবল কি তাই, সব কিছু সুন্দরের উপরে যেন একটা গভীর বিতৃষ্ণা। সভ্য ভব্য সাজানোগোছানো ছিমছাম কিছু চোখে পড়লেই সেই বিতৃষ্ণাটা যেন কণ্ঠ ঠেলে কঠিনতম এক তিক্ততায় প্রকাশ হয়ে পড়ে।

সঙ্গে সঙ্গে ঠোটটা কেমন সুচালু করে বিকৃত ভঙ্গিতে বলে ওঠে, শালা! যেন ঐ গালাগালিটা দিয়ে মনের বিতৃষ্ণাটা খানিকটা প্রশমিত করবার চেষ্টা করে।

আর ঠিক পরমুহূর্তেই নিজের উপর যেন একটা ঘৃণা সমস্ত অনুভূতি উপচে বিষের মত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

দিনের পর দিন অমনি এক বিতৃষ্ণা আর ঘৃণায় সৈকত বুঝি শেষ পর্যন্ত একটা জঘন্যতম ঘৃণ্য ব্যাপারই ঘটিয়ে বসতো, যদি না ঐ সময় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ওদের দলেরই আনোয়ার তাদের ফ্যাক্‌ট্রিতে একটা কাজ জুটিয়ে দিত।

তাও প্রথমটায় সৈকত আনোয়ারের কথায় মাথা পাতে নি, বলেছিল নাকটা কুঁচকে, আনোয়ারেরই দেওয়া চার্মিনার সিগারেটটায় একটা শেষ টান দিয়ে শুকনো তিক্ত ঠোটটা জিভের ডগা দিয়ে চাটতে চাটতে, কি কাজ?

আনোয়ার হাসতে হাসতে বলেছিল, আমাদের ফ্যাকট্রির ম্যানেজারী—

শালা গ্যাস দিচ্ছিস—-গাঁট্টা দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেবো—

তা আর দিবি না! নচেৎ শালা দোস্তী বলেছে কেন? স্কুল ফাইন্যালটাও তো পাস করতে পারিস নি—টুকলি-ফাইং করে ল্যাজেগোবরে হয়ে গিয়েছিস—তোর উপযুক্ত কাজ সেই কাজই—আমাদের ড্রিলিং মেশিন ডিপার্টমেন্টে একটা লোক নেবে।

মাইতে কত?

হাজার টাকা মাস—

আবার শালা!

আনোয়ার আবার হাসতে হাসতে বলে, ঐ কাজে যেমন মাইনে হওয়া উচিত তাই। শ’খানেক টাকা মাসে পাবি।

মোটে!

তবে যা শালা মরগে যা। ভালর জন্য বললাম—আমাদের ফোরম্যান আব্দুল মিঞাকে বলেছিলাম তোর কথা—তা বলেছিল তোকে একদিন নিয়ে যেতে—যা, মরগে যা—

আনোয়ার চলে গিয়েছিল সেদিন।

কথাটা হচ্ছিল সেদিন কাজে যেতে যেতে স্টেশনের পথে। আনোয়ার হাবড়াতে থেকেই ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করে, দু’দিন বাদে সৈকত নিজেই আনোয়ারকে ডেকে বলছিল, এই আনোয়ার—তুই যে সেদিন বলেছিলি—

কি বলেছিলাম!

আবার রোয়াবি হচ্ছে শালা! তোদের ফ্যাকট্রির সেই চাকরিটা—

করবি?

তা কি এমনি এমনি বলছি নাকি?

তবে কাল চ’—

কাল নয়, আজই চর্-—

আজি যাবি। হ্যাঁ।

তবে চ’-—

খেলাধুলো করা গড়াপেটা শক্ত-সামর্থ্য শরীর সৈকতের। আব্দুল মিস্ত্রীর সৈকতকে দেখে পছন্দই হয়ে যায়। তবু একবার জিজ্ঞাসা করে সৈকতের মুখের দিকে তাকিয়ে, পারবে তো মাস্টার—মেশিনের কাজ—

পারবো।

আগুনের মধ্যে টিনের শেডের নীচে দাঁড়িয়ে সর্বক্ষণ কাজ—দেখ ভেবে মাস্টার

পারবে তো!

না পারার কি আছে?

সৈকতও তখন মরীয়া হয়ে উঠেছে কতকটা। দিন-দুই আগে বাপ হরেন্দ্রনাথের সঙ্গে বিশ্রী কথা-কাটাকাটি হয়ে গিয়েছে। বাপ হরেন্দ্রনাথ তাকে বলেছে, কুলাঙ্গার, অপদার্থ। সেও মুখে মুখে জবাব দিয়েছে—-তারপরই হরেন্দ্রনাথ তাকে বলেছিল, বেরিয়ে যা—বেরিয়ে যা এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে। সৈকতও সমান সমান জবাব দিয়ে বাড়ি থেকে সেই যে বের হয়ে এসেছে আর ওমুখো হয় নি। বন্ধু রাজেনের কাছেই আছে।

রাজেন ট্রাম কোম্পানিতে কাজ করে—ইস্পেকটার কনডাকটার। বাড়িতে লোকজনের মধ্যে সে আর তার স্ত্রী মাধবী। যা হোক একটা চাকরি যেমন করেই হোক তাকে যোগাড় করতেই হবে। ও-বাড়িতে আর সে ফিরে যাবে না।

আবদুল মিস্ত্রী শুধায়, কি মাস্টার, পারবে তো, লেগে পড় কাল থেকেই—

কাল কেন, আজ থেকেই হয় না?

আজ থেকে?

হ্যাঁ, আজ থেকেই।

বেশ চল, ওভারসিয়ার সাহেবকে বলি।

ওভারসিয়ার সাহেব একজন পাঞ্জাবী—গুরুবচন সিং। লোকটার মনমেজাজ বেশ ভাল, তাছাড়া আব্দুল মিস্ত্রীকে সে খাতিরও করে তার কর্মদক্ষতার জন্য।

আব্দুল মিস্ত্রীর কথাতেই কাজটা হয়ে গিয়েছিল। মাসের সেটা পনের তারিখ। তারপর পনেরটা দিন সৈকত রাজেনের ওখান থেকেই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছে। ইতিমধ্যে এক সহকর্মী মানিকের সঙ্গে বেশ আলাপ হয়েছিল, তারই সন্ধানে একটা বস্তির মধ্যে একটা ঘর সৈকত ঠিক করে ফেলেছিল।

মাসের দু’তারিখে গিয়ে নতুন ডেরায় উঠলো সৈকত। তারপর আরো মাস দশেক পরে বস্তির সে-ঘর ছেড়ে বর্তমান বাসায় উঠে এসেছে। কাজে কখনো ফাঁকি দেয় না সৈকত, তাছাড়া খাটতেও পারে, কাজেই কাজে উন্নতি হয়েছে তার আরো। এখন প্রায় দেড়শ’র কাছাকাছি মাইনে পায়। কাজ পেয়ে কাজ করবার পর থেকেই একটু একটু করে সৈকতের মধ্যে আবার পরিবর্তন শুরু হয়েছে। সেই অস্থিরতা, বিতৃষ্ণা ও নিজের ওপরে ঘৃণাটা যেন ক্রমশ থিতিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে জীবনের দৃষ্টিভঙ্গিটাও নতুন এক মোড় নেয় যেন।

নতুন এক জীবনের মধ্যে সৈকত ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে তার অজ্ঞাতেই। আর সে জীবনের আস্বাদ এনে দিয়েছিল বঙ্কিম বাগ, তার ড্রিলিং ডিপার্টমেন্টের চার্জম্যান। মদ্যপান আর সেই সঙ্গে নারীসঙ্গ। সৈকত নিজের অজ্ঞাতেই ঐ নতুন জীবনের মধ্যে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছিল। আর সেই পথেই বেলা তার জীবনে এসে উপস্থিত হয়েছে একদিন। বেলা পূর্ববঙ্গের বাস্তুত্যাগী এক কলোনির মাস্টারের মেয়ে।

.

বেলার কথায় কান না দিয়ে সৈকত একটা বাসে উঠে পড়েছিল তাকে নিয়ে। বাসে প্রচণ্ড ভিড়—কোনমতে বাদুর-ঝোলা ঝুলতে ঝুলতে যেতে হবে। বেলাকে সামনে দাঁড় করিয়ে নিজে তার পিছনে আড়াল করে উপরের রডটা ধরে চলন্ত বাসের ঝাঁকুনি সামলাতে থাকে সৈকত। বেলা একেবারে লেপ্টে দাঁড়িয়ে থাকে সৈকতের দেহের সঙ্গে। অন্য দিন হলে ব্যাপারটা উপভোগ করত সৈকত যৌবনের একটা সুড়সুড়ি হিসাবে, কিন্তু আজ যেন তার মনটা সীমানার সঙ্গে কথা বলবার পর থেকেই বিচ্ছিন্ন ও নিরাসক্ত হয়ে ছিল।

নিজের চিন্তার মন্থনের মধ্যেই আবার তলিয়ে গিয়েছিল সৈকত। বাড়ির সঙ্গে আর অতঃপর সেদিন থেকে কোন সম্পর্কই রাখে নি ঠিক। দীর্ঘ সাত মাস বাদে এক সন্ধ্যার পর কি খেয়াল হতে কলকাতা থেকে ফ্যাকট্রির কাজের পর কি ভেবে যেন সৈকত হাবড়ার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিল। মা’র জন্য একটা শাড়ি ও কিছু নগদ টাকাও সঙ্গে নিয়েছিল।

সুহাসিনী দীর্ঘকাল পরে ছেলেকে দেখে কেঁদে ফেলেছিল।

আবার কান্না শুরু করলে কেন? যত সব ঢং—বলে ওঠে সৈকত, তার পরই শাড়ির প্যাকেটটা ও পঞ্চাশটা টাকা মা’র হাতে দিতে দিতে বলে, নাও—

কি?

দেখ না। তোমার একটা শাড়ি আর পঞ্চাশটা টাকা।

খোকা!

কি?

কি করছিস এখন?

কেন, তা দিয়ে কি হবে? কি দরকার জেনে?

সুহাসিনী অন্য কথা বলে, কোথায় আছিস এখন?

কলকাতায় থাকি।

ওর সঙ্গে দেখা করবি না?

না।

দেখা করবি না? এতদিন পরে এলি—

না। এখুনি আমি যাবো।

একটিবার দেখা করবি চল্। ওর শরীরটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছে—

তার আমি কি করবো—আচ্ছা আমি চলি—

এখুনি এলি, এখুনি চলে যাবি!

তবে কি এখানে বসবাস করবার জন্য এসেছি নাকি?

একটু চা খাবি?

না। রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে নেবো। সৈকত কথাটা বলে যাবার জন্য পা বাড়ায়।

চললি?

হ্যাঁ।

সৈকত আর দাঁড়াল না, বের হয়ে এসেছিল। তারপর থেকে মধ্যে মধ্যে মাসে দু’মাসে একবার করে গিয়েছে হাবড়ায় সৈকত, আর সঙ্গে দেনা করে কিছু কিছু টাকাও দিয়ে এসেছে, কিন্তু গত চার মাসে একবারও সে হাবড়ায় যায় নি, একটা টাকাও দেয় নি।

হঠাৎ যেন চমক ভাঙলো কন্ডাকটারের চিৎকারে, ধরমতলা—ধরমতলা।

বাসটা থেমেছে।

কোনমতে গুঁতোগুঁতি ঠেলাঠেলি করতে করতে দুজনে নেমে পড়ল বাস থেকে।

বেলা চেঁচিয়ে ওঠে, আমার স্যাণ্ডেলের একপাটি বাসে—কি হবে সৈকত!

খিঁচিয়ে ওঠে হঠাৎ সৈকত, কি আবার হবে, খালি পায়ে হাঁটো।

বাঃ তা হবে না! আমাকে ঐ সামনের দোকান থেকে আগে এক জোড়া স্যাণ্ডেল কিনে দাও—

তিক্ত-বিকৃত কণ্ঠে বলে ওঠে সৈকত, একজোড়া স্যাণ্ডেল। ঐ সঙ্গে একটা রুবিয়া ভয়েলের শাড়ি আর চিকনের একটা ব্লাউজ না! কথাটা শেষ করে সৈকত একটা কুৎসিত শব্দ উচ্চারণ করে।

বেলার যেন ভ্রুক্ষেপও নেই। ঐ কুৎসিত শব্দটা যেন তার গায়ে এতটুকু দাগ কাটে না।

সে বলে ওঠে, না হলে আমি যাবোই না!

সত্যি?

গড প্রমিস্। বেলা বলে।

সৈকত হঠাৎ যেন স্থানকাল ভুলে—হো-হো করে হেসে ওঠে। বেলা অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু বেলার বিস্ময়ের আরো বাকী ছিল।

একটা কমদামী স্যাণ্ডেল কিনে দিয়ে বেলাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে চা খেতে খেতে, একসময় বেলাই প্রশ্ন করে, কি হলো, অত গম্ভীর কেন?

একটা কথা ছিল বেলা—

কি?

তোমার পরের বোনটা, কি যেন নাম তার?

কেন?

কাল ওকে একবার সঙ্গে করে আনতে পারো? না, না—ঠিক সঙ্গে নয়, একা তাকে সন্ধ্যের পর আমার বাসায় পাঠিয়ে দিও।

কি হবে তাকে দিয়ে?

সত্যি কথাটা বলবো?

কি, বলই না!

তোমাকে আর ভাল লাগছে না।

বেলা বোবা। নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সৈকতের মুখের দিকে। লোকটা পিশাচ না শয়তান।

হ্যাঁ, সামনের মাস থেকে তাহলে ষাটটা করে মাসে মাসে তোমাকে যে টাকা দিই সেটা তেমনি থাকবে নচেৎ—

বল, থামলে কেন? বেলার হাতের কাঁটা-চামচ তখন থেমে গিয়েছে।

নচেৎ আমাকে অন্য মাল দেখতে হবে।

মুখে যেতে পারব বললেও সীমানার হাঁটতেও যেন কষ্ট হচ্ছিল।

মাথাটা তখনো ঘুরছে। পা দুটো যেন ভেঙে দুমড়ে আসছে। ক্লান্ত অবসন্ন পা দুটো টেনে টেনে গেটের দিকে এগুচ্ছিল সীমানা। কল্যাণ পাশে পাশে হাঁটছিল। কল্যাণ রায় ডাক্তার। সে সতর্কই ছিল।

সীমানার হাঁটা দেখেই বুঝতে পারে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে সীমানার।

মিস্ চ্যাটার্জী একটু দাঁড়ান—দেখি একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায় কিনা!

না, না—–ট্যাক্সির কোন দরকার নেই। আমি এখান থেকেই হেঁটে চলে যেতে পারব—ক্লান্ত অবসন্ন গলায় ক্ষীণ একটা প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করে সীমানা।

কিন্তু কল্যাণ ওর প্রতিবাদে মৃদু গলায় জবাব দেয়, না, আপনি পারবেন না। এখনো আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হন নি—দাঁড়ান এখানে। আমি আসছি। কথাগুলো বলে কল্যাণ গেটের বাইরে চলে গেল।

সীমানা দ্বিতীয়বার আর প্রতিবাদে কোন কথা বলতে পারে না। প্রতিবাদ জানাবার মত মনের জোর আর ছিলও না বোধহয় ঐ মুহূর্তে তার।

সারাটা দিন পেটে কিছু পড়ে নি। এক কাপ চা পর্যন্ত খায় নি। এখান থেকে ওখানে নিদারুণ একটা উদ্বেগ নিয়ে ছোটাছুটি করেছে। এমন তো কতদিনই হয়েছে, কিন্তু এমন অবসন্ন তো কখনো সে বোধ করে নি। সীমানা গেটের একটা পাল্লার শিক শক্ত মুঠিতে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো নচেৎ হয়ত পড়েই যেতো।

রাতও বেশ হয়েছে তখন, প্রায় দশটা বাজে। শীতের রাত হলেও বড় রাস্তায় লোক চলাচল ও যানবাহনের চলাচল তখনো বেশ আছে তবে অনেকটা যেন কমে এসেছে। শীতটাও বেশ পড়েছিল। গায়ের গরম স্কার্ফটাও সকালে তাড়াহুড়োয় বাড়ি থেকে বের হবার সময় সীমানা গায়ে দিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছিল। স্কার্ফটার কথা মনেই পড়ে নি। সামান্য পরিধেয় বস্ত্রে শীতটা যেন মানতে চায় না।

কেমন যেন অসহায় ও শূন্যদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে সীমানা। সামনের ঐ জগৎটা—ঐ রাস্তা—গাড়ি ট্রাম মানুষজন যেন তার মনের মধ্যে কোন অনুভূতিই জাগায় না। সব কিছুই যেন কেমন বিচ্ছিন্ন অসংলগ্ন।

একটু পরেই কল্যাণ একটা ট্যাক্সি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। ট্যাক্সিটা গেটের সামনে এসে দাঁড়াতেই কল্যাণ ট্যাক্সি থেকে নেমে বললে, আসুন, মিস্ চ্যাটার্জী। চলুন—

ট্যাক্সির দিকে এগুতে গিয়েই সীমানা আবার টলে পড়ে যাচ্ছিল, কল্যাণ মুহূর্তে তাকে ধরে ফেললে।

আপনি এখনো টলছেন! বলতে বলতে কল্যাণ তার হাত ধরে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নিয়ে ট্যাক্সি-ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললে, চলো শিয়ালদা——

ট্যাক্সি-ড্রাইভার ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। গাড়ির সীটে বসে সীমানা তার শরীরটা ছেড়ে দিয়েছিল, এলিয়ে দিয়েছিল।

মিস্ চ্যাটার্জী!

উঃ?

স্টেশন থেকে আপনার বাড়ি কত দূর?

তা প্রায় দেড় মাইল হবে, ক্লান্ত গলায় সীমানা জবাব দেয়।

আজ রাত্রে বরং আপনি বাড়ি ফিরে না গেলেন! কল্যাণ বললে।

না–না, আমি যাবো।

না—আমার মনে হয় না এ অবস্থায় রাত্রে অতটা পথ একা একা যেতে পারবেন!

পারবো। পারবো—

শেষ ট্রেনটা আমাদের ধরতে হবে—রাত অনেক হয়ে যাবে হাবড়ায় পৌঁছতে পৌঁছতে। তার চাইতে এক কাজ করুন না–আমার এক দাদা-বৌদি থাকেন শ্যামবাজারে, সেখানে আজকের রাতটা বিশ্রাম করুন।

না, বাড়ি যাবো।

কিন্তু আমার তো যাবার উপায় নেই। রাত্রে আমার ডিউটি আছে ইমারজেন্সিতে। একা একা, আপনার শরীরের যে অবস্থা দেখছি, ছেড়ে দিতে পারি না আমি।

কিছু হয় নি আমার, আমি ঠিক আছি—

কল্যাণ সীমানার সে কথার আর জবাব না দিয়ে ড্রাইভারকে সম্বোধন করে বললে, সর্দারজী, শ্যামবাজার চলিয়ে—

স্টেশন নেহি জায়গা বাবুজী?

নেহি—শ্যামবাজার চলিয়ে—

ড্রাইভার আর কোন কথা না বলে আমহার্স্ট স্ট্রীটের দিকে গাড়িটা ঘুরিয়ে দিল। সীমানা কল্যাণের নির্দেশের বিরুদ্ধে আর কোন প্রতিবাদ জানায় না। জানাবার তার ক্ষমতাও বোধহয় ছিল না। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটা যেন তার ঐ মুহূর্তে একটু বিশ্রামের জন্য সত্যিসত্যিই ভিতরে ভিতরে উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। আর সমস্ত ব্যাপারটা খতিয়ে বিবেচনা করে দেখবার মতও মনের অবস্থা তার ছিল না ঐ মুহূর্তে।

বাড়ি ফেরাই তার উচিত। সেই দুপুরের দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাবাকে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিল, মা হয়ত একা একাই বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছেন। কেউ তাঁর পাশে নেই। সৌজন্য এখনো বাড়ি ফিরেছে কিনা কে জানে! বাড়িতে মা’র পাশে থাকার মত ঐ একজনই—ছোট বোন সূচনা।

সূচনার উপরেই বা নির্ভর কি! মনে হতে থাকে সীমানার। সে তো তার সিনেমা ম্যাগাজিনের মধ্যে হয়ত ডুবে আছে। সে তো জানেই, সংসারের যত ঝামেলা বইবার জন্য—যত ভাবনা ভাববার জন্য তার দিদি সীমানাই আছে। আর তার মা সুহাসিনীও কোন কথা ওদের দুজনের কাউকেই কিছু বলে না। সেও সীমানার মুখের দিকে আজ চেয়ে আছে। কিন্তু সত্যিই যেন সীমানা আর ভাবতে পারছে না।

পাশে বসে কল্যাণও এলোমেলো নানা চিন্তার মধ্যে ডুবে ছিল। আজ রাত্রে তার ইমারজেন্সি ডিউটি আছে। আসার সময় অবিশ্যি রজতকে বলে এসেছিল যে একটা বিশেষ কাজে বের হচ্ছে, যদি একটু ফিরতে দেরি হয় তাহলে রজত যেন কাজটা একটু দেখে।

রজতও অস্বীকার করে নি। কল্যাণ যতক্ষণ না ফিরবে ও জানে রজত ইমারজেন্সিতে থাকবে। ফিরতে তার দু’এক ঘণ্টা দেরি হলেও ভাবনার কিছু নেই। সে ভাবছিল অন্য কথা। এ কি এক ঝামেলায় সে জড়িয়ে পড়ল!

কোথায় ভেবেছিল হাসপাতালে গিয়ে হরেন্দ্রনাথকে একবার দেখে তার খবরাখবর নিয়ে নিজের হাসপাতালে ডিউটিতে ফিরে যাবে! কিন্তু এখন কখন ফিরতে পারবে কে জানে?

শ্যামবাজারে রামধন মিত্র লেনে পিসতুত দাদা অনিল থাকে। বাড়িতে অনিলদা আর স্ত্রী মাধবী বৌদি। ওদের এখনো ছেলেমেয়ে কিছু হয় নি। অনিলদা ইনসুওরেন্সে কাজ করে, ভালই মাইনে পায়। তাছাড়াও পাবলিক থিয়েটারে অভিনয় করে নিয়মিত, মন্দ পায় না।

এখনো হয়ত ওদের খাওয়াদাওয়া হয় নি। অনিলদাদের থিয়েটারে নতুন নাটক হবে—কিছুদিন ধরে নিয়মিত রিহার্সেল চলছে কল্যাণ জানে। রিহার্সেল দিয়ে সাধারণত রাত সাড়ে দশটা বা এগারটার আগে বড় একটা বাসায় ফিরছে না ক’দিন ধরে। তারপর খাওয়াদাওয়া করে। অনিলদা বা মাধবী বৌদি হয়ত সীমানা সম্পর্কে কোন প্রশ্নই করবে না। একটা রাত্রির মত ওকে স্থান দেবেও, কিন্তু মুখে জিজ্ঞাসা না করলেও মনে মনে কি ভাববে না—কে সীমানা। কী সম্পর্ক ওর সীমানার সঙ্গে, হঠাৎ এত রাত্রে তাকে ওদের ওখানে রাতের মত আশ্রয় দিতে নিয়ে এলো! আরো একজন আছে—

মাধবী বৌদির ছোট বোন শমিতা। ইউনিভারসিটিতে এম. এ. পড়ে। প্রায়ই অনিলদার ওখানে আসে। সেইখানেই কল্যাণের সঙ্গে শমিতার আলাপ। আলাপ আজ প্রায় বছরখানেকের। দুজনার মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও যে কিছুটা হয় নি তাও নয়, রবিবারের সারাটা দিন তো প্রায়ই কল্যাণের অনিলদার ওখানে কাটে। খাওয়াদাওয়া আড্ডা, তার পর চৌরঙ্গীপাড়ায় ওদের দুজনের সিনেমায় যাওয়া। সিনেমা দেখার পর শমিতাকে বাসে তুলে দিয়ে কল্যাণ ফিরে যায় হাসপাতালে।

শমিতার কথা মনে হতেই ঐ কথাটাও মনে হয়, সীমানার কথাটা কি শমিতার কানে উঠবে না? উঠবে নিশ্চয়ই। অহেতুক কৌতূহল সাধারণত যা প্রায় মেয়েদেরই থাকে, যদিও শমিতার কথায়বার্তায় সেটা কখনো প্রকাশ পায় নি, তাহলেও সীমানার কথাটা শমিতার কানে গেলে—যা যাবেই হয়ত, তার মনেও কি কৌতূহল একটা জাগবে না? জাগবে নিশ্চয়ই। পরক্ষণেই কল্যাণের আবার মনে হয়, তা জাগলেই বা। সীমানার সঙ্গে আজ যা ঘটলো সেটা তো নিছক একটা সৌজন্যবোধ ছাড়া কিছুই নয়।

কিন্তু সত্যিই কি তাই? সামান্য সৌজন্যবোধ একটা? তাছাড়া আর কি? কাল সকালে হয়ত সীমানা সুস্থ হয়ে আবার তার বাড়িতে চলে যাবে। হয়ত আবার ভবিষ্যতে কোনদিন আগের মতই চলন্ত ট্রেনের কামরায় দেখা হবে। সৌজন্যবোধক দু’চারটে কথাবার্তা হবে।

চমক ভাঙলো কল্যাণের ট্যাক্সি ড্রাইভারের ডাকে। গাড়ি তখন হাতীবাগান মার্কেটের কাছে এসে পড়েছে।

সিধাই যায়গা বাবুজী? ড্রাইভার শুধায়।

অ্যা—হ্যাঁ—আর থোরা আগাড়ি যাকে বাঁয়ে—কথাটা বলে কল্যাণ একবার পার্শ্বে উপবিষ্ট সীমানার দিকে তাকাল। গাড়ির ভিতরটা অন্ধকার, ভাল করে স্পষ্ট দেখা যায় না। আবছা আবছা সীমানার মুখটা ও কেবল দেখতে পায়। সীমানা নিঝুম হয়ে যেন তার গা ঘেঁষে বসে আছে।

মিস্ চ্যাটার্জী!

বলুন? সীমানা সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয় পূর্ববৎ ক্লান্ত কণ্ঠেই।

এখন কেমন বোধ করছেন? একটু ভাল লাগছে কি?

আমি অনায়াসেই বাড়ি ফিরে যেতে পারতাম—মিথ্যে আপনি নিজের অসুবিধা করে—

অসুবিধা—অসুবিধা আবার কি!

এই রাত্রে একজনদের ওখানে যাওয়া—আমাকে চেনেন না জানেন না—

সীমানাকে কথাটা শেষ করতে দেয় না কল্যাণ, বলে, তাতে কি হয়েছে? আপনাকে নাই বা চিনলেন তাঁরা। আমি তো আর তাঁদের অপরিচিত নই। আমার সঙ্গে আপনি যাচ্ছেন—

গাড়ি ততক্ষণে বাঁয়ে মোড় নিয়ে সরু রাস্তাটার মধ্যে ঢুকেছে। আরো এগিয়ে ডানহাতি গলি।

গলির মধ্যে আর ট্যাক্সি নিল না কল্যাণ। গলির মোড়েই বাড়িটা অনিলদার। গলির মোড়েই ট্যাক্সিটা থামালো কল্যাণ, বাস্, হিয়াই রোখিয়ে সর্দারজী।

ট্যাক্সি থেমে গেল। গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল কল্যাণ। তারপর সীমানার দিকে তাকিয়ে বললে, চলুন মিস্ চ্যাটার্জী।

তিনতলা একটা বাড়ির নীচের তলায় তিনখানা ঘর নিয়ে অনিল থাকে। জানলাপথে দেখা গেল ঘরে আলো জ্বলছে। কলিং বেলের বোতামটা টিপতেই ভিতর থেকে সাড়া এলো নারীকণ্ঠে, কে?

বৌদি, দরজাটা খুলুন——আমি—

কে! বদ্ধ দরজার ওপাশ থেকে এবারে গলা শোনা গেল।

আমি কল্যাণ। দরজাটা খুলুন—

দরজাটা খুলে গেল। মাধবীকে দেখা গেল। রোগা পাতলা চেহারা—ছোটখাটো দেখতে, বছর সাতাশ-আটাশ হবে। পরনে সাধারণ একটা চওড়াপাড় মিলের শাড়ি।

কল্যাণ ঠাকুরপো যে এত রাত্রে, কথাটা বলতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গেল মাধবী, কল্যাণের ঠিক পাশেই অপরিচিতা সীমানাকে দেখে। দু’চোখে তার সপ্রশ্ন দৃষ্টি জেগে ওঠে। কল্যাণ সীমানার দিকে ফিরে বলে, আমার মাধু বৌদি-মিস্‌ চ্যাটার্জী—আসুন, চলুন। সীমানাকে যেন একপ্রকার হাত ধরেই টেনে নিয়ে কল্যাণ বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল।

মাধবী দরজাটা পুনরায় বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াল ওদের মুখোমুখি।

সরু একটা প্যাসেজ মত—পর পর সামনে দুটি ঘর। পিছনের দিকে আর একটা ঘর—সরু একফালি বারান্দা, তারই অন্য প্রান্তে বাথরুম ও রান্নাঘর। ঘরগুলো সবই ছোট ছোট। অবিশ্যি তারই ভাড়া একশ পঁচাত্তর টাকা। তবে মাত্র তো দুজন মানুষ, কোন অসুবিধা হয় না।

কল্যাণই আবার কথা বললে, অনিলদা এখনো ফেরে নি বুঝি মাধু বৌদি!

মাধবী বললে, না, আজ ফিরতে বলে গেছে রাত হবে।

কেন? কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল।

আজ বুঝি ওদের থিয়েটারে নাটকের ফুল রিহার্সেল! চল, ঘরের মধ্যে চল ঠাকুরপো—

চল, আসুন মিস চ্যাটার্জী—কল্যাণ সীমানার দিকে ফিরে তাকিয়ে মাধবীর পিছু পিছু ঘরে গিয়ে ঢুকল।

যে ঘরে ঢুকল ওরা সেটা মাধবীদের বসবার ঘর। সুন্দর করে সাজানো। এক পাশে একটি চৌকি, তার উপরে একটি রঙিন সুজনী পাতা। এক সেট ছোট সোফা। ছোট ছোট দুটো কাচের শো-কেস—তাতে সাজানো নানা দেশের নাট্যসাহিত্য ও নাটক। আর দেওয়ালে একদিকে রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, গিরীশচন্দ্র প্রভৃতির ফটো ও অন্যদিকে শিশিরকুমার, ছবি বিশ্বাস, দুর্গাদাস প্রভৃতির ফটো। শো-কেসের উপরে একটি রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ সাদা প্লাস্টারের মূর্তি—তার পাশে সুদৃশ্য একটি ফোটোস্ট্যাণ্ডে অনিলের প্রথম যৌবনকালের ফটো।

অন্য একটি শো-কেসের উপর একটা কাচের সুদৃশ্য ভাসে কিছু মরশুমী ফুল।

মাধবী বললে, বোস কল্যাণ ঠাকুরপো। বসুন মিস্‌ চ্যাটার্জী।

কল্যাণ বললে, না, এখন আর বসবো না বৌদি, আমার নাইট-ডিউটি আছে। একেই দেরি হয়ে গিয়েছে—এখুনি যেতে হবে, শোন, ইনি মানে মিস্ চ্যাটার্জী আমার বিশেষ পরিচিত, ওঁর বাবার করোনারী অ্যাটাক্ হয়েছে—হাসপাতালে আছেন, দেখতে এসেছিলেন—

তাই বুঝি?

হ্যাঁ—এখন আর ফিরবার শেষ ট্রেনটা পাবেন না বলে রাত্রে এখানে কোথায় থাকবেন, তাই তোমার এখানে নিয়ে এলাম।

বেশ করেছো ভাই—মাধবী বললে।

রাতটুকু থাকবেন। কাল চলে যাবেন। কথাটা বলে কল্যাণ দরজার দিকে পুনরায় এগুতে এগুতে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, ওঁর কিছু খাওয়াদাওয়া হয় নি বোধহয়—

সেজন্য তোমাকে ভাবতে হবে না—মৃদু হেসে মাধবী বললে।

তা জানি। তাই তো বললাম—মৃদু হেসে কথাটা বলে কল্যাণ আবার এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

মাধবী ফিরে তাকাল সীমানার দিকে। সে তখনো দাঁড়িয়েই আছে, যেন প্রস্তর—প্রতিমূর্তির মত, বোবা—নিশ্চল।

মাধবী বললে, দাঁড়িয়ে কেন ভাই, বসুন—আমি দরজাটা দিয়ে আসি। চল ঠাকুরপো—

দুজনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কল্যাণকে দরজা খুলে দিলে কল্যাণ বের হয়ে বাড়ি থেকে পথে গিয়ে নামল। কল্যাণও আর কোন কথা বললো না, মাধবীও কিছু জিজ্ঞাসা করল না। মাধবী দরজাটার খিল তুলে দিয়ে ঘরের মধ্যে ফিরে এল। সীমানা তখনো আগের মতই দাঁড়িয়ে।

এ কি—এখনো দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।

সীমানার তখন সত্যিই দাঁড়াবার মত অবস্থা ছিল না। কিন্তু তবু সে বসলো না।

মাধবী বললে, থাক্ বরং চলুন ভিতরের ঘরে, হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিন—আপনাকে খুব ক্লান্ত লাগছে—

উনি জানেন না বৌদি, এতক্ষণে সীমানা কথা বললে, আমি আসার সময় খেয়েই এসেছিলাম। ক্ষিধে এতটুকুও নেই। আপনি বরং আমাকে একটু শোবার ব্যবস্থা করে দিন, আমি শোব। তারপরই একটু থেমে জবাবের যেন কোন অপেক্ষা না করেই সীমানা বলল, আমি তো অনায়াসেই ঐ চৌকিটার উপরেই শুয়ে থাকতে পারি—

পাগল নাকি, এই শীতের রাত্রে জমে যাবেন একেবারে! মাধবী কথাটা শেষ করল, ক্ষিধে না থাকলেও হাতমুখ ধুয়ে কিছু অন্তত মুখে দেবেন চলুন, তার পর আমার বিছানাতেই শোবেন—উনি তো আজ রাত্রে কখন আসবেন তার ঠিকই নেই—

না, না—সীমানা বললে, আপনি ব্যস্ত হবে না আমার জন্য বৌদি—আমাকে কেবল গায়ে দেবার একটা কিছু আর বালিশ থাকলে দিন, ঐখানে ঐ চৌকিতেই রাতটা আমার অনায়াসেই কেটে যাবে।

আপনাকে বাইরের ঘরের ঐ চৌকিতে শুতে দিয়েছি জানলে ঠাকুরপো কি আমাকে ছেড়ে কথা বলবে! না, না—আপনি ভিতরের ঘরে চলুন—মাধবী বললে।

কিছু মনে করবেন না তিনি। তাছাড়া আমার সঙ্গে কল্যাণবাবুর এমন একটা কিছু ঘনিষ্ঠতা নেই বা আমি ওঁর এমন কিছু বিশেষ পরিচিতও নই যে উনি এখানে আমাকে আপনি শুতে দিলে কিছু ভাববেন—আমার ঐ চৌকিটার উপরেই বেশ রাতটা কেটে যাবে। কথাগুলো বলতে বলতে সীমানা অতঃপর এগিয়ে গিয়ে চৌকিটার উপরেই বসে পড়ল।

এ ঘরেই শোবেন?

হ্যাঁ-—

বেশ—তাহলে দাঁড়ান, একটা বিছানা পেতে দিই—

কিছুর দরকার নেই, কেবল একটা চাদর আর একটা বালিশ দিন—

কিছু না খান অন্তত এক কাপ চা করে দিই।

না, না—এই রাত্রে আবার চা—

আমি নিজেই খাবো বলে হিটারে একটু আগে চায়ের জল চাপিয়েছি, এতক্ষণে হয়ত চায়ের জল ফুটেও গিয়েছে—আপনি যদি খান তো চা তৈরী করবো, না হলে আর তৈরীই করবো না চা।

সীমানা আর প্রতিবাদ জানায় না। মাধবী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মাধবী সীমানার কোন আপত্তিই শোনে না। বাইরের ঘরের চৌকিতেই একটা বিছানা পেতে কম্বল এনে দেয়। আগেই চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

তাহলে আপনি শুয়ে পড়ুন মিস্ চ্যাটার্জী, আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যাই—মাধবী বললে।

সীমানা শুয়ে পড়ল কম্বলটা গায়ে টেনে দিয়ে।

মাধবী আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সীমানা ভেবেছিল শুলেই হয়ত ঘুমিয়ে পড়বে, কিন্তু ঘুম এলো না। অন্ধকার ঘরের মধ্যে চোখ বুজে পড়ে রইলো।

মাত্র মাস দুই আগে এমনিই একটা রাত্রির কথা যেন সহসা সীমানার স্মৃতিকে তরঙ্গায়িত করে তোলে। বেশিদিন নয়, মাত্র হয়ত মাস দুই। কৃষ্ণনগরের হোটেলের সেই রাতটা। এর চাইতেও সে-রাত্রে বেশী শীত ছিল।

সে আর সুধন্য।

সুধন্যর নামটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা তীব্র ঘৃণা যেন তার সমস্ত মনটাকে বিষিয়ে তোলে। আজকের তার এই দুর্দশা ও অনিশ্চয়তার জন্য দায়ী তো ঐ সুধন্যই। আজ বুঝতে পারে সীমানা, ভালবাসার তিলমাত্রও সুধন্যর মনের মধ্যে কোথায়ও ছিল না। যা ছিল সেটা কেবল হয়ত তার দেহকে ঘিরে একটা কুৎসিত লালসা। সেই লালসার পরিতৃপ্তি হবার সঙ্গে সঙ্গেই সে গা ঢাকা দিয়েছে।

উঃ, বেঁচেছে সে। আরো যে জড়িয়ে পড়ে নি। সারাটা জীবন ধরে যে তাকে এক ঘৃণা ও যন্ত্রণার বোঝা টেনে বেড়াতে হয় নি! কিন্তু বেশী চিন্তা করতে পারে না সীমানা, মাথাটা যেন লোহার মত ভারী হয়ে উঠেছে, অসহ্য একটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। হাত-পাগুলো যন্ত্রণায় মোচড়াচ্ছে। কে জানে জ্বর হবে নাকি? এখানে না এসে বাড়ি চলে গেলেই হতো!

ক্রমে রাত বাড়ছে। শীতের রাত–ক’দিন থেকে শীতটাও যেন প্রচণ্ড পড়েছে।

ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ ছিল ঘুঘুডাঙা অ্যাথলেটিক ক্লাবের সঙ্গে—খেলা শেষ হবার পর সৌজন্য বাড়িই ফিরবে ভেবেছিল, কিন্তু সুনীল অবনী মৃণাল ক্লাবের অন্যান্য মেম্বাররা যেতে দিল না তখুনি সৌজন্যকে।

বাড়ি থেকে বেরুবার সময় শুনে এসেছিল, বাবার নাকি স্ট্রোক মত কি হয়েছে—বেরুবার সময় মা’ও বলেছিলেন, আজ আর কলেজে নাই গেলি সৌজন্য—

কেন বল তো!

বাড়িতে একটা পুরুষ-ছেলে নেই,—সুহাসিনী বলবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মা’র কথাটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সৌজন্য বলেছিল, তাই বলে আমাকে বাড়ির মধ্যে বসে থাকতে হবে নাকি? সামনে পরীক্ষা—রোজ সব স্পেশাল ক্লাস হচ্ছে, এ সময় ক্লাস কামাই করলে যে ক্ষতিটা হবে সেটা পুষিয়ে দেবে কে?

তথাপি সুহাসিনী বলেছিল, একটা দিন ক্লাস কামাই করলে কি আর এমন হবে? তা বৈকি! তার পর পরীক্ষাতে গাড্ডি মেরে দাদার মত ফ্যাকট্রিতে গিয়ে ঢুকি, তাই চাও বুঝি?

যুক্তিটা যে কত মিথ্যা সুহাসিনী হয়ত ছোট ছেলের কথার জবাবে বলতে পারত, কিন্তু কিছুই আর সে বলে নি। চুপ করেই গিয়েছিল অতঃপর।

সৌজন্য তার পরেও বলেছিল, তাছাড়া আমাদের কলেজ-ক্লাবের মৃন্ময়ী শিল্ড ম্যাচের ফাইন্যাল খেলা আছে।

কথাগুলো বলে জামাকাপড় পরে কলেজের বইখাতা নিয়ে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হতে হতে বলেছিল, আমাকে খেতে দেবে চল—

ভাত এখনো চড়াই-ই নি। সুহাসিনী বলেছিল।

এখনো রান্না হয় নি?

না।

ঠিক আছে, ক্যাণ্টিনেই খেয়ে নেবো—গোটা দুই টাকা দাও আমাকে

টাকা কোথায় পাবো? কিছুই হাতে নেই।

দুটো টাকাও দিতে পারবে না?

হাতে না থাকলে কোথা থেকে দেবো?

হাতে তোমাদের কোন দিন টাকা থাকবেও না। কথাটা বলে গজগজ করতে করতে বের হয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে সৌজন্য।

সত্যি ঘেন্না ধরে গিয়েছে সৌজন্যর ওদের সংসারটার ওপর। নিত্য কেবল অভাব আর অভাব—নেই আর নেই।

গোটাচারেক শার্ট-প্যান্ট্ করার দরকার, বলে বলে হয়রান হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছা করে এক-একসময় দাদা যেমন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে, সেও চলে যায়। নিত্য দশদিন ঐ অভাব আর নেই-নেই ওর সত্যিই যেন ভাল লাগে না।

স্টেশনেই সুনীলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

সুনীলদের অবস্থা ওদের চাইতে অনেক ভাল। সুনীলের বাবার কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে একটা কাটা কাপড়ের দোকান আছে, বেশ দু’পয়সা উপার্জন হয় ঐ দোকান থেকে, একমাত্র ছেলে সুনীল দু’হাতে না হলেও বেশ রীতিমত খরচা করে।

স্টেশনের কাছাকাছিই একটা পল্লীতে সুনীলের বাড়ি।

সুনীলকে ও প্রথমে দেখতে পায় নি। সুনীল সৌজন্যকে দেখতে পেয়েছিল—হনহন করে ও হেঁটে চলেছে।

পিছন থেকে সুনীল ডাকে, এই সৌজন্য—এই—

সুনীলের ডাকে সৌজন্য দাঁড়াল।

পরনে টেরিলিনের প্যান্ট আর গায়ে টেরিলিনের হাফ-শার্ট। মুখে সিগারেট।

কি রে শালা, একেবারে ঘোড়ায় জিন দিয়ে ছুটছিস যে! সুনীল পাশে এসে হাঁটতে হাঁটতে বলে।

সৌজন্য একবার সুনীলের দিকে তাকাল। ওর পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় ও মাথায় চকচকে টেরির দিকে মধ্যে মধ্যে পাশাপাশি চলতে চলতে তাকায়।

অকারণেই যেন সুনীলের প্রতি একটা বিদ্বেষ অনুভব করে ও মনের মধ্যে। দিব্বি আছে সুনীল। কোন অভাব নেই—অনটন নেই। নিজের ইচ্ছা ও খুশিমত খরচ করে। কি রে—একেবারে স্পিকটি নট্ যে! আটটার ট্রেনটা তো আসতে এখনো অনেক দেরি।

সৌজন্য তথাপি কোন সাড়া দেয় না।

চল্ এক কাপ চা খেয়ে যাওয়া যাক নর্তকী থেকে। সুনীল আবার বলে।

সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়ে নি সৌজন্যর—কোন আপত্তি করে না সুনীলের প্রস্তাবে সৌজন্য। দুজনেই প্রায় সমবয়সী, তবে সুনীল রোগা-পটকা—সৌজন্যর চেহারাটা বেশ বলিষ্ঠ।

ইতিমধ্যে ওরা হাঁটতে হাঁটতে নর্তকী রেস্টুরেন্টের সামনে এসে গিয়েছিল—রাস্তা থেকেই ওদের নজরে পড়ে রেস্টুরেন্টে ইতিমধ্যেই বেশ ভিড় জমে উঠেছে।

সুনীল! কি রে?

গোটা দুই টাকা ধার দিতে পারিস?

সুনীল বললে, কেন, টাকা দিয়ে কি হবে?

দারকার আছে। থাকে তো দে

সুনীল আর কোন বাদ-প্রতিবাদ না করে প্যান্টের পকেটে হাত চালিয়ে দুটো টাকা বের করে সৌজন্যকে দিল।

ব্যাপারটা কিছু নতুন নয়, সুনীলের কাছ থেকে সৌজন্য প্রায়ই অমন দু’চার টাকা নেয় এবং আজ পর্যন্ত যা নিয়েছে ধার বলে নিলেও কখনো একটা পয়সাও শোধ করে নি। শোধ যে কোনদিন করবে না—করতে পারবে না সৌজন্য, সুনীল তা ভাল করেই জানে। তার জন্য তার কোন দুঃখও নেই।

আসল কথা, সুনীল শুধু কেন ওদের মধ্যে অনেকেই—সুনীল অবনী মৃণাল সৌজন্যকে কিছুটা ভয় করে—তোষামোদ করে।

ব্যায়ামপুষ্ট সৌজন্যের চেহারা—খেলাধুলায় যেমন সে চৌকস, তেমনি মারপিটেও। কলেজের সব ছেলেই একটু সমীহ করে সৌজন্যকে ঐ কারণেই। বোধ হয় ঐভাবে সমীহ ও তোষামোদ করে সৌজন্যকে ওরা হাতে রাখতে চায়।

নর্তকী রেস্টুরেন্টে ঢুকতে ঢুকতে সুনীল বলে, কি হয়েছে রে সৌজন্য?

ন? কি আবার হবে?

তবে অমন করে মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?

সৌজন্য বন্ধুর কথার আর কোন জবাব দেয় না। রেস্টুরেন্টের মধ্যে ঢুকে একপাশে দুটো টেবিল-চেয়ার পেয়ে গিয়ে একটায় বসে পড়ল।

সুনীলও ওর পাশে এসে বসল।

রেস্টুরেন্টের ছোকরা বয়টা—কার্তিক এগিয়ে এলো, কি দেবো স্যার?

দুটো মামলেট, চার পিস করে দু’প্লেট টোস্ট আর দু’কাপ চা। সৌজন্য বললে।

ওরে না না, আমি কেবল চা খাবো, আমি এইমাত্র বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে আসছি।

সুনীল প্রতিবাদ জানায়।

সৌজন্য একবার সুনীলের মুখের দিকে তাকাল, তার পর কার্তিকের দিকে তাকিয়ে বললে, তাহলে একটা ওমলেট, দু’পিস মাখন-রুটি আর দু’কাপ চা দে

কার্তিক চলে গেল।

সিগারেট আছে? সুনীলের মুখের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য বললে।

সুনীল কোন কথা না বলে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা আর দেয়াশলাইটা বের করে দিল।

প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে গোটা-দুই টান দিয়ে সুনীলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, আজ আমি ম্যাচে খেলব না।

ম্যাচ খেলবি না, সে আবার কি! ফাইন্যাল ম্যাচ—

তোদের শালা ঐ প্রফুল্ল-ক্যাপ্টেনের বড্ড রোয়াব হয়েছে। আজ আমি ব্যাকে না খেললে গোটাচারেক গোল খেলেই বুঝবে তখন।

প্রফুল্লটার ওপর রাগ করে তুই খেলবি না?

না, খেলব না।

তাতে প্রফুল্লর আর কি হবে? আমাদের কলেজ-টিমেরই প্রেটিজ যাবে। যাযা, ভারি তো কলেজ-টিম্~~তার আবার প্রেটিজ!

কার্তিক ইতিমধ্যে খাবারের প্লেটটা নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। একটা কাঁটার সাহায্যে ওমলেট থেকে কেটে কেটে মুখে তুলে চিবোতে চিবোতে সৌজন্য বললে, কলেজই আমি ছেড়ে দেবো ভাবছি, তার আবার কলেজ-টিম!

কলেজ ছেড়ে দিবি?

হ্যাঁ।

তার মানে, তুই এবার পরীক্ষা দিবি না?

না।

কেন রে?

কেন আবার কি, দেবো না।

তোর দিদিকে বলেছিস?

হঠাৎ খিঁচিয়ে ওঠে যেন সৌজন্য। কেন, সে আমার গার্জেন নাকি যে সব কথাই তাকে বলতে হবে? যা করবো তাকে জানিয়ে করতে হবে?

সৌজন্যর মুখের দিকে কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সুনীল বলে, বাড়িতে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?

ঝগড়া হতে যাবে কেন?

ডিমের প্লেটটা শেষ করে সেটা ঠেলে একপাশে, চায়ের কাপটা তুলে নেয় সৌজন্য।

তবে কি মাধবীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?

মাধবী চক্রবর্তী ওদেরই কলেজে এক ইয়ার নীচে পড়ে। সুনীল জানে, মাধবী—সৌজন্যের পরিচয়টা একটা রীতিমত সৌহার্দ্যের পর্যায়ে পৌঁছেছে। কলেজ-কমনরুমে প্রায়ই ওদের একসঙ্গে দেখা যায়। কলেজের বাইরেও অনেকে ওদের একত্রে দেখেছে।

মাধবীর প্রতি অনেক ছেলেরই অল্পবিস্তর নজর ছিল, কিন্তু সৌজন্যের ভয়ে সেদিকে বড় একটা কেউ ঘেঁষে না। ষণ্ডাগুণ্ডা গোঁয়ারগোবিন্দ টাইপের ছেলে সৌজন্য—-ধাঁ করে হয়ত নাকের ওপর একটা ঘুষি বসিয়ে দেবে!

কাজেই অন্যান্য সকলে, যারা মাধবীর প্রতি আকৃষ্ট, তারা মনে মনেই একটা চাপা আক্রোশে ছট্‌ফট করে কেবল। দু’পা এগিয়ে এসে নিজের স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত করবার সাহস কারোর মধ্যেই আজ পর্যন্ত বড়-একটা দেখা যায় নি—যায়ও না।

চায়ের কাপটা নিঃশেষ করে সৌজন্য আবার বলে, এই সুনীল, আর একটা সিগারেট দে।

সুনীল বিনা বাক্যব্যয়ে সৌজন্যের সামনে এগিয়ে দিল।

সুনীল বরাবরই সৌজন্যকে একটু খাতির ও তোয়াজ করে চলে। রোগা লিকলিকে চেহারা তার, দুর্বল-প্রকৃতির,—তাই বোধ হয় সৌজন্যর বলিষ্ঠ আড়ালে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে।

চল্ ওঠা যাক—সৌজন্য উঠতে উঠতে বললে।

সকালবেলা বাড়ি থেকে খালি পেটে বেরুবার পর মনটা যেভাবে বিগড়ে গিয়েছিল, এখন পেটে কিছু পড়ায় মনের সেই বিগড়ানো ভাবটা অনেকটা যেন থিতিয়ে এসেছিল। বলতে হলো না, সুনীলই রেস্টুরেন্টের পাওনাটা পকেট থেকে টাকা বের করে মিটিয়ে দিল। দুজনে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এল।

স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পাশাপাশি সুনীলই অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল—বেশী কথা সব সময়ই বলা সুনীলের একটা বদ অভ্যাস। সৌজন্য কত সময় ওকে থামিয়ে দিয়েছে, কি তখন থেকে বক্‌বক্ করছিস, থাম্‌ তো!

কিন্তু আজ আর সুনীলের বকানিতে কোন প্রতিবাদ জানায় না। নিঃশব্দে সিগারেট টানতে টানতে ওর পাশে পাশে হেঁটে চলে।

মনে পড়ছিল, অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাড়ি থেকে আজ বের হয়ে আসার সময় মায়েরই কথাগুলো : আজ আর কলেজ নাই গেলি সৌজন্য, বাবার নাকি স্ট্রোক মত কি হয়েছে! একবার যে একফাকে বাড়ি থেকে আজ সকালে বের হয়ে আসার আগে বাবার ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে নি তা নয়। ভদ্রলোক যেমন শুয়ে থাকেন তেমনিই বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে ছিলেন।

গত রাত্রে অবিশ্যি সে অনেক দেরিতে বাড়ি ফিরেছিল এবং ফিরেই সোজা গিয়ে শয্যায় আশ্রয় নিয়েছিল। বাড়ির মধ্যে কেবল মা আর দিদির কথাবার্তা শুনেছিল পাশের ঘর থেকে। কান দেয় নি ওদের কথায়।

কান তো কোনদিনই দেয় না ও বাড়ির কথায় কারো। বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা তার কতক্ষণের জন্যই বা, সকালে আটটা সাড়ে আটটায় বের হয়ে আসে—ফেরে সেই কোন্ ন’টা সাড়ে ন’টায়। কোন-কোনদিন আবার রাত দশটা-এগারটাও হয়ে যায়।

বাবা তো কিছু বলেনই না—মা আর দিদিও তার ব্যাপারে থাকে না! মাসের প্রথমে কলেজের মাইনেটা ও হাতখরচার টাকাটা দিদির কাছ থেকে চেয়ে নেয়। অবিশ্যি না চাইলেও দেয় দিদি। দাদা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর দিদিই যে সংসারটা চালাচ্ছে তাও জানে সৌজন্য। বাড়ি সম্পর্কে তার কোন মাথাব্যথাই নেই।

সুহাসিনী অবিশ্যি, দিদি কোন কথা না বললেও, মধ্যে মধ্যে দুটো-একটা কথা বলেন। কিন্তু সৌজন্য সে-সব কথা এক কান দিয়ে শোনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। আসলে ওসব কথা শুনতেই ওর ভাল লাগে না। বিরক্ত লাগে। ঘ্যানর ঘ্যানর—সেই একঘেয়ে অভিযোগ। আগে বিরক্তি বোধ করত সৌজন্য শুনতে শুনতে, এখন আর করে না। ভাবটা যেন, মা বলবেই আর ওকে শুনতেও হবে।

কিন্তু কেন যে ঐ সব অভিযোগ আজও বুঝতে পারে না সৌজন্য। লেখাপড়া! লেখাপড়া শিখে কি এমন দশটা বেশী হাত-পা গজাবে? কি এমন একটা সে মাতব্বর হয়ে উঠবে? এই যে তার দিদি বি. এ. পাস করেছে, কি করছে? কোথাকার এক পারফিউমারি ফ্যাক্টরির ভ্রাম্যমাণ সেলিং-এজেন্ট! ভাবতেও যেন কথাটা সৌজন্যর বিশ্রী লাগে।

বাবার অসুখ, তাতে হয়েছে কি? অসুখ মানুষের হয়ই। সবাইকেই তো একদিন-না—একদিন মরতে হবে। আজ বৃদ্ধ ভদ্রলোক যদি মরেই যান তাতে ক্ষতিটা এমন কি? অসুখ হয়েছে তার চিকিৎসা করাও—বাড়িতে না হয় হাসপাতালে নিয়ে যাও।

কলেজে দুটো ক্লাস ছিল। ক্লাসে গিয়ে সৌজন্য বসলো বটে, কিন্তু প্রফেসারদের লেকচারের এক বর্ণও তার কানে যায় না।

প্রথমটায় তো সৌজন্য খেলতেই চায় নি কিন্তু সকলের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত খেলার মাঠে ম্যাচে খেলতে নেমেও কেমন যেন অন্যমনস্ক ছিল সৌজন্য। কলেজ টিমের সব চাইতে দুর্ধর্ষ খেলোয়াড় সে, কিন্তু আজ যেন তার খেলার কোন ফর্মই কেউ দেখতে পেল না।

যেখানে অবধারিত জয় সুনিশ্চিত ছিল, সেখানে তাদের দল পর পর দুটো গোল খেল। ক্যাপ্টেন প্রফুল্ল তো খেলার পর মুখ দিয়ে খিঁচিয়েই উঠলো, আর খেলিস না সৌজন্য এবার থেকে!

অন্য সময় হলে সৌজন্য হয়ত কয়েকটা কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিত, কিন্তু আজ আর কিছু বললো না। খেলার মাঠ থেকে বের হয়ে গেল।

সুনীল অবনী আর মৃণাল—ওর তিন বন্ধু ওর সঙ্গে-সঙ্গেই ছিল।

সৌজন্যকে স্টেশনের দিকে হাঁটতে দেখে সুনীল বললে, কোথায় যাচ্ছিস? বাড়ি যাবো।

বাড়ি যাবি মানে! আজ জাগরণী ক্লাবের ফাংশান আছে না পাতিপুকুরে? নামকরা সব আর্টিস্ট আসছে—তিনটে টিকিট যোগাড় করে রেখেছি—

তোরা যা। আমি যাবো না।

যাবি না মানেটা কি? ওসব চলবে না, চল্।

দেখ সুনীল, সত্যিই আমার আজ কিছু ভাল লাগছে না।

কেন, গোল খেয়েছিস বলে খেলায়? অবনী হাসতে হাসতে বলে।

শালা গোল তো সেই জন্ম থেকেই খাচ্ছি, ও আর নতুন কি! সৌজন্য বলে।

তবে যাবি না কেন?

বললাম তো, ভাল লাগছে না।

চল্ না, ভাল ভাল দুটো গাল শুনলেই মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠবে দেখবি। সুনীল বলে।

অবনী বলে, বিমান আর তার বোন নিপুণা তো আসছে!

সুনীল-অবনী ওরা জানত, বিমানের বোন নিপুণার ওপরে একটা দুর্বলতা আছে সৌজন্যর।

বিমানও এককালে ওদের সহপাঠী ছিল, কিন্তু এখন যাদবপুর ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছাত্র। একজন অতিমাত্রায় মেধাবী ছাত্র বলেই তার নাম। ন্যাশন্যাল স্কলারশিপ-হোলডার।

একসময় বিমানরা হাবড়াতেই থাকতে ওদের কলোনিতে, পরে বিমানের বাবা বছরতিনেক হলো যাদবপুরে জায়গা কিনে বাড়ি করে চলে গিয়েছে।

ইদানীং তাই বিমান বা ওর বোন নিপুণার সঙ্গে ওদের বড় একটা দেখাশুনা হতো না।

তাহলেও মধ্যে মধ্যে যায় সৌজন্য বিমানদের বাড়িতে।

বিমান যেন কেমন বদলে গিয়েছে। ওকে যেন চেনাই যায় না। ওর কথাবার্তার ধরনটাও যেন বোঝা যায় না। প্রথম দিকে বিমানের বাবা সিদ্ধার্থবাবুর একটা ছোটখাটো ঔষধের দোকান ছিল, কেমন করে না-জানি বছর সাত-আটের মধ্যেই তাঁর ছোটখাটো ডিসপেনসারির ব্যবসাটা রীতিমত ফলাও হয়ে ওঠে। তাঁর অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে।

আগের দোকান তো তার বড় হয়েছেই, সঙ্গে সঙ্গে কোন এক মাড়োয়ারী পার্টনার জুটিয়ে গড়িয়ার ওদিকে একটা ঔষধ তৈরির ফ্যাক্টরিও খুলেছেন।

বিমান ছেলেটা কিন্তু ঠিক বাপের ধারা পায় নি। আগে আগে তার পোশাক—পরিচ্ছদের মধ্যে বেশ একটা বাবুয়ানীর ছাপ ছিল, কিন্তু বছরখানেক হলো যেন তার প্রভূত পরিবর্তন হয়েছে। দেখতে এমনিতে ভারি সুন্দর। রোগা ছিছিপে গড়ন, মাথার চুল বড় বড়—সর্বদাই এলোমেলো হয়ে থাকে।

পোশাক-পরিচ্ছদেরও পরিবর্তন লক্ষণীয়। পরনে সর্বদা একটা ঢোলা পায়জামা—গায়ে গেরুয়া রংয়ের খদ্দরের পাঞ্জাবি—পায়ে সাধারণ একটা চপ্পল।

লেখাপড়ায় কিন্তু আগের মতই ভাল।

তবু সিদ্ধার্থবাবু একমাত্র ছেলের প্রতি যেন আদৌ সন্তুষ্ট নন।

বাড়িতে বলতে গেলে খুব কম সময়ই পাওয়া যায় বিমানকে। কোথায় থাকে, কি করে—কে জানে?

বিমানের মা লতিকা দেবী প্রায়ই আক্ষেপ করেন, কোথায় থাকিস! কি করিস সর্বক্ষণই তো বাইরে বাইরে!

কেন, তাতে তোমার ক্ষতিটা হচ্ছে কি? বিমানের উদ্ধত রুক্ষ জবাব।

আয়নায় দেখিস তো চেহারাটা কি করছিস একবার!

কেন? চেহারার কি হয়েছে?

পড়াশুনাও তো করতে দেখি না!

ভাল লাগে না। বিমান একদিন বলেছিল।

ভাল লাগে না—সে কি রে!

সে তুমি বললেও বুঝবে না। বুঝবো না!

না।

তা না বুঝি, বুঝিয়ে বললেই তো পারিস!

এই যে আমাদের দেশে বর্তমান এডুকেশন সিসটেম, এর একেবারে সব কিছু বদল হওয়া দরকার—

সে আবার কি!

তাই। সেই গতানুগতিক সিলেবাস, গতানুগতিক মান্ধাতা আমলের শিক্ষা—পদ্ধতি—জান এতে করে তরুণ সম্প্রদায়ের কতখানি ক্ষতি করছে? সব—সবকিছুর অদলবদল হওয়া দরকার আজ। খবর তো রাখ না বাইরের জগতের?

অতি সাধারণ গৃহস্থ-বধু লতিকা দেবী—সত্যিই ছেলের কথার কোন অর্থই খুঁজে পান না।

বুঝলে মা, সব—সব কিছু যা পুরাতন, ভেঙে নতুন করে তৈরি করতে হবে—নতুন শিক্ষাপদ্ধতি চালু করতে হবে। একটা revolution—সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটিয়ে সব কিছু নতুন করে আবার গড়ে তুলতে হবে।

লতিকা আর বেশি তর্ক করেন না।

ছেলের ছন্নছাড়া চেহারার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *