অশরীরী
বর্ধমান সাহেবগঞ্জ লুপে গুসকরা নামে একটি স্টেশন আছে। ব্রিটিশ আমলে প্রথম যখন রেললাইন পাতা হয় এখানে—সেই সময়কার কথা। গুসকরা থেকে দশ-বারো মাইল দূরে এক গ্রামের নবগোপাল নামে এক ছেলে মিলিটারিতে চাকরি পেয়ে পাঞ্জাব অঞ্চলে চলে যায়। সেখান থেকেই মাসে মাসে মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠাত সে। চিঠিপত্র লিখত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইচ্ছে করলেই বাড়ি আসতে পারত না।
এ নিয়ে বাড়ির লোকেদের অভিযোগের আর অন্ত ছিল না! নবগোপালের বাবা ছিলেন, মা ছিলেন। নতুন বিয়ে করেছিল, তাই বউও ছিল। ভাইবোন এবং বাড়ির অন্যান্য লোকজন তো ছিলই।
এইভাবেই দিন কাটছিল।
নবগোপাল কিছুতেই বাড়ি আসার ছুটি আর পায় না। এদিকে বেশ কিছুদিন হল নবগোপালের বাড়ি থেকে চিঠি আসাও বন্ধ হয়ে গেল। নবগোপাল বুঝল বাড়ির লোকেরা তার দেশে না ফেরার জন্য রাগ করেই চিঠি লেখা বন্ধ করেছে। কেননা শেষ চিঠিতে বাবা লিখেছিলেন, ‘আজ চার বছরেও যখন তুমি বুড়ো বাপ-মাকে একবার এসে দেখে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না, নতুন বউমার জন্য যখন তোমার কোনও কর্তব্য আছে বলে মনে হচ্ছে না, তখন আমরা ধরে নিলাম নতুন পরিবেশে গিয়ে তুমি আমাদের ভুলে গেছ। শুধু মাসে মাসে টাকা পাঠালেই পরিবারের প্রতি কর্তব্যের শেষ হয় না। শ্রীশ্রী ভগবানের কৃপায় আমাদের বিষয়-সম্পত্তি কী আছে না আছে তা তোমার অজানা নয়। অতএব তোমার এই দান না পাঠালেও চলবে।’—এই চিঠি পাওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই নবগোপালের মন কেঁদে উঠল। তারপর একদিন যখন সত্যি সত্যিই মানিঅর্ডারও ফেরত এল তখন আর সে থাকতে পারল না।
ইতিমধ্যে পাঞ্জাব অঞ্চল থেকে কাশ্মীর অঞ্চলে বদলি হয়ে যায় নবগোপাল। সেখানে গিয়ে সেনাবাহিনীর কিছু নতুন বন্ধুদের সাহায্যে উচ্চতর পর্যায়ে আবেদন করে বহুকষ্টে এক মাসের ছুটি মঞ্জুর করাল এবং দেশে ফিরল। আসবার আগে একটা চিঠিও লিখল বাড়িতে। চিঠিতে লিখে দিল, অমুক দিন আমি গুসকরায় পৌঁছচ্ছি। স্টেশনে আবদুলকাকা যেন আমার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করে।
সেইমতোই নির্দিষ্ট তারিখে নবগোপাল যখন গুসকরায় ট্রেন থেকে নামল, রাত্রি তখন বারোটা।
ঘন অন্ধকারে স্টেশন এলাকা খাঁ খাঁ করছে।
দু-তিনজন মাত্র যাত্রী নামল ট্রেন থেকে।
নবগোপাল ভাবল, হয় বাড়ির লোকেরা ওর চিঠি পায়নি, নয়তো বাবা রাগ করেই গাড়ি পাঠায়নি। অথবা গাড়ি নিয়ে এসে ওর বিলম্ব দেখে আবদুলকাকা ফিরে গেছে। কেননা ও শুধু আসবার তারিখটাই লিখেছিল। দিনে আসবে কি রাতে আসবে তা তো লেখেনি। কেননা তখনকার দিনে ওই দূর দেশ থেকে নির্দিষ্ট সময়সূচি নির্ধারণ করে ঠিক সময়টিতে আসা এত সহজ ছিল না। তাই স্টেশনে আবদুলকাকাকে না দেখে হতাশ হয়ে পড়ল সে। নতুন স্টেশনমাস্টার নবগোপালকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার, আপনি কারও জন্য অপেক্ষা করছেন নাকি?”
নবগোপাল বলল, “হ্যাঁ। আমার বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে লোক আসবার কথা ছিল। কেন এল না তাই ভাবছি। অথবা এসে ফিরে গেল কি না?”
স্টেশনমাস্টার বললেন, “না। এসে ফিরে যায়নি। কেননা আমি তো সবসময় এখানে আছি। আমি কোনও গাড়িকেই অপেক্ষা করতে দেখিনি।”
“তা হলে কি ওরা চিঠি পায়নি আমার?”
“তাই হবে। তা আপনার বাড়ি এখান থেকে কতদূর?”
নবগোপাল বলল, “অনেক দূর। দশ-বারো মাইল।’ “ওরে বাবা। তবে তো হেঁটে যাওয়াও চলবে না।”
“না। দিনমানে হলে যেতাম। এই রাত্রে কখনও নয়। ভূতের উপদ্রব আছে। চোর-ডাকাতের ভয় আছে। ঠ্যাঙাড়ের উৎপাত আছে।”
স্টেশনমাস্টার বললেন, “তা হলে এক কাজ করুন। আজ আর কোনও ট্রেন তো আসবে না। আমি অফিসঘরের চাবি দিয়ে আমার কোয়ার্টারে শুতে যাচ্ছি। আপনি বরং ওয়েটিংরুমে শুয়ে রাতটুকু কাটিয়ে দিন। তারপর সকালে দেখি আপনার জন্য কী করতে পারি। যদি কারও গোরুর গাড়ি একটা পাই তো বলেকয়ে দেব।”
নবগোপাল বলল, “পেলে ভাল। নইলে হাঁটা দিতেও আমার আপত্তি নেই।” এই বলে সে ওয়েটিংরুমেই কাঠের বেঞ্চির ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে ছারপোকার কামড় খেতে লাগল। অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর সবে তন্দ্রাটি এসেছে, এমন সময়, “খোকাবাবু!”
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে উঠে বসল নবগোপাল, “আরে আবদুলকাকা!”
“কতক্ষণ এসেছেন আপনি?”
“তা প্রায় ঘণ্টাখানেক হল। স্টেশনের বাইরে গাড়ি দেখতে না পেয়ে ভাবছিলাম তুমি আসোনি।”
“আসব না কী বলছেন? আপনার চিঠি পাওয়ার পর থেকে সবাই হানটান করছি। তবে গাড়ি তো আমি এখানে রাখিনি। গাড়ি ওই বাঁধের ওপর রয়েছে। আপনার চিঠি পেয়েছি। কিন্তু আপনি কখন আসবেন চিঠিতে তা লেখেননি! তাই এখানে জায়গা জোড়া না করে গাড়িটাকে বাঁধের ওপর রেখেছি। আমি ঠিক করেছিলুম লাস্ট ট্রেনটা দেখে তারপর ফিরে যাব। এই ভেবে গাড়িতে গিয়ে শুয়ে ছিলুম। কিন্তু এমন ঘুম এল যে, না ঘুমিয়ে থাকতে পারলুম না।”
নবগোপাল বলল, “ঠিক আছে। রাত যখন হল তখন রাতটা কাটুক। কাল একটু ভোর ভোর রওনা হওয়া যাবে।”
“সে কী খোকাবাবু? কর্তাবাবুর অবস্থা জানেন? মা, বউমা সবাই আপনার চিঠি পাওয়ার পর থেকেই ঘর-বার করছেন। রান্নাবান্না রেডি করেই আপনার জন্য পথ চেয়ে বসে আছেন সব।”
“কিন্তু আবদুলকাকা, পথঘাটের যা অবস্থা তাতে…।”
“খোকাবাবু! আপনি কি ভুলে গেলেন, আমার নাম আবদুল। আমার শরীরে একফোঁটা রক্তও যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ কারও সাধ্য আছে আমাদের কিছু করে? ওসব ভয় করবেন না খোকাবাবু, চলুন। উদো আর বুধোকে সঙ্গে এনেছি। গোরুর গাড়িকে আমি ঘোড়ার গাড়ির মতো ছোটাব।”
অতএব নবগোপাল আর দ্বিরক্তি না করে আবদুলের সঙ্গে চলল।
আবদুল নবগোপালের সুটকেসটা মাথায় নিয়ে আগে আগে চলল। নবগোপাল চলল পিছু পিছু।
যেতে যেতে নবগোপাল দূর থেকেই দেখতে পেল সেই অন্ধকারে বাঁধের ওপর দুটো করে চারটে চোখ যেন ভাঁটার মতো জ্বলছে। চতুষ্পদ জন্তুদের চোখ রাত্রিবেলা জ্বলে। কিন্তু তাই বলে এইভাবে?
নবগোপাল কাছে যেতেই উদো আর বুধো গোরু দুটো বহুদিন পরে মনিবকে দেখে শিং নেড়ে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করল।
আবুদল বলল, “বাবু, গাড়িতে খড় বিছিয়ে গদির মতো করে আপনার বিছানা পেতে রেখেছি। আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি জোর কদমে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি।” নবগোপাল তাই করল।
দূরের ট্রেনভ্রমণে একেই সে ক্লান্ত ছিল, তার ওপর রাতও হয়েছিল অনেক। তাই গোরুর গাড়ির বিছানায় দেহটা এলিয়ে দিল সে।
এদিকে আবদুল গোরুর গাড়ি নিয়ে বাঁধ থেকে মাঠের রাস্তা ধরল।
প্রথমটা বেশ একটু মন্থর গতিতে চলার পর গাড়ি এত জোরে ছোটাতে লাগল যে, ওর মনে হল ও যেন এখনও ট্রেনের মধ্যেই রয়েছে।
নবগোপাল ভয়ে ভয়ে বলল, “এ কী করছ! এইভাবে গাড়ি চালালে গাড়ি উলটে যাবে যে!”
আবদুল বলল, “কেন ঘাবড়াচ্ছেন খোকাবাবু? আমার নাম আবদুল। কোনও ভয় নেই আপনার। চুপচাপ শুয়ে থাকুন।”
নবগোপাল বলল, “না। আমার ভীষণ ভয় করছে।”
কিন্তু কে কার কথা শোনে!
আবদুলের তখন জেদ চেপে গেছে। জোরে গাড়ি সে চালাবেই।
নবগোপাল বুঝতে পারল গোরুর গাড়ি এত জোরে ছুটছে যে, মাঝে মাঝে চাকা মাটি স্পর্শ করছে না। যেন হাওয়ায় উড়ে চলছে।
এইভাবে কিছুক্ষণ যাওয়ার পরই গ্রামে পৌঁছল ওরা। গ্রামে ঢোকার মুখেই একটা খাল আছে। গোরুর গাড়িটা লাফিয়ে খাল পার হয়ে গেল।
নবগোপাল আর নবগোপালের মধ্যে নেই তখন। সে বুঝতেই পারল কার পাল্লায় সে পড়েছে। এখন ভালয় ভালয় বাড়ি পৌঁছলে হয়!
যাই হোক, গাড়ি এসে বাড়ির কাছে থামল। সাবেক কালের দোতলা মাঠকোঠা। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বেশ বড়সড়।
নবগোপাল গাড়ি থেকে নামলে আবদুল বলল, “অনেক রাত হয়ে গেল খোকাবাবু। আপনি ভেতরে যান। আমি গোরু দুটো গোয়ালে রেখে আসি।” এই বলে আবদুল চলে গেল।
ভীত সন্ত্রস্ত নবগোপাল দরজায় কড়া নাড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে ওর মা-বাবা দু’জনেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন।
নবগোপাল প্রণাম করতে যেতেই বাবা বললেন, “থাক বাবা, তোমার চিঠি যথাসময়েই পেয়েছি। কিন্তু এত রাত্রে তুমি কী করে এলে? তোমার আসার সময় জানতে না পারার জন্য আমি কোনও গাড়িই পাঠাইনি। জানি তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, কারও না কারও একটা গাড়ি ভাড়া নিয়েই আসবে। তবুও সারাদিন অপেক্ষা করে এই সবে শুয়েছি আমরা। এত রাতে এইভাবে আসাটা তোমার ঠিক হয়নি।”
নবগোপাল বলল, “আমাকে আবদুলকাকা নিয়ে এসেছে বাবা।”
“আবদুল ! আবদুল নিয়ে এসেছে?”
“হ্যাঁ। আবদুলকাকা।”
“সে কী? ঠিক বলছ? আবদুল নিয়ে এসেছে তোমাকে? না অন্য কেউ?” “না বাবা। অন্য কেউ নয়। আবদুলকাকাই নিয়ে এসেছে আমাকে। আমি কি ভুল দেখব?”
“কীসে এলে?”
“কেন, গোরুর গাড়িতে। উদো আর বুধো…।”
“থাক। আর বলতে হবে না। আবদুল আমাদের বহুদিনের পুরনো লোক। সে তার উপযুক্ত কাজই করেছে। তবে বাবা একটা কথা কী জানো? আবদুল আর বেঁচে নেই। উদো বুধোও না।”
“সে কী?”
“হ্যাঁ। যাক, ওসব কথা থাক এখন। পথে তোমার কোনও অসুবিধে হয়নি তো? রাত কিন্তু অনেক হয়েছে। এবার খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ো। কেমন?” বলেই ডাক দিলেন, “বউমা!”
“যাই বাবা।” একগলা গোমটা দিয়ে নবগোপালের বউ এসে দাঁড়াল।
“নবুকে খেতে দাও।”
নবগোপাল হাত-মুখ ধুয়ে ওর ঘরে গিয়ে ঢুকল। তারপর বউ ভাত-তরকারি ধরে দিলে তৃপ্তির সঙ্গে খেতে লাগল সে। খেতে খেতে বলল, “ওরো বাবা! এতসব রান্না করলে কী করে?”
বউ নিরুত্তর।
নবগোপাল বলে, “অনেকদিন বাড়ি আসিনি বলে রাগ করেছ আমার ওপর? কিন্তু কী করব বলো। আমি কি ইচ্ছে করে আসিনি! আমি যে নিরুপায়।”
নবগোপাল দেখল বউয়ের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে। যাই হোক, খাওয়া
শেষ করে খাটের বিছানায় নবগোপাল শুয়ে পড়ল। ওর বউ পাশে বসে সযত্নে পাখার বাতাস করতে লাগল নবগোপালকে। সারাদিনের ক্লান্তির পর তৃপ্তির আহার এবং তার ওপর এই সুখশান্তির শয্যায় শোওয়ামাত্রই গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ল নবগোপাল।
ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে লোকজনের চেঁচামেচিতে। কে যেন নাম ধরে ডাকল, “নবা! এই নবা!”
ঘুম ভাঙতেই নবগোপালও হকচকিয়ে গেল। দেখল অর্ধভগ্ন ঘরে অপরিচ্ছন্ন ধূলি ধূসরিত খাটের ছেঁড়া বিছানায় সে শুয়ে আছে। ঘরের চারদিকে ঝুল, মাকড়সার জাল। হতচকিত নবগোপাল জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ওর পরিচিত লোকজনেরা পাশের মাঠ থেকে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “নবা, তুই! তুই কখন এলি?”
নবগোপাল জড়ানো গলায় বলল, “কাল রাত্রে।”
“ঠিক আছে। তুই ওখানেই থাক। আমরা গিয়ে তোকে নিয়ে আসছি।” এই বলে সকলে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে নবগোপালকে বাইরে নিয়ে এল।
নবগোপাল কান্নাধরা গলায় বলল, “আমার ঘরবাড়ির এরকম অবস্থা কেন? আমার মা
বাবা, আমার ভাইরা, আমার বউ কোথায়?”
সবাই বলল, “তুই কি কিছুই বুঝতে পারছিস না?”
“না। আমার গা-মাথা ঘুরছে। ওরা যে কাল রাতেও এ বাড়িতে ছিল।”
“ওরা কেউ ছিল না রে পাগল, কেউ ছিল না। কাল রাত্রে যাদের দেখেছিস তারা ওদের প্রেতাত্মা। বেশিদিন নয়, মাত্র ছ’মাস আগে কলেরার মহামারিতে সব শেষ হয়ে গেছে। আমরা এই সামান্য ক’জন ছাড়া গোটা গ্রামই উজাড় হয়ে গেছে প্রায়। তোদের বাড়ির কেউই বেঁচে নেই। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি তোকে খবর দেওয়ার। কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট ঠিকানা না থাকায় চিঠি দিতে পারিনি।”
নবগোপাল সব শুনে ডুকরে কেঁদে উঠল একবার। তারপর গত রাত্রের ঘটনার কথা সবাইকে বলে দিন-দুই গ্রামে থেকে আবার কর্মস্থলে ফিরে গেল।