অশরীরী

অশরীরী

বর্ধমান সাহেবগঞ্জ লুপে গুসকরা নামে একটি স্টেশন আছে। ব্রিটিশ আমলে প্রথম যখন রেললাইন পাতা হয় এখানে—সেই সময়কার কথা। গুসকরা থেকে দশ-বারো মাইল দূরে এক গ্রামের নবগোপাল নামে এক ছেলে মিলিটারিতে চাকরি পেয়ে পাঞ্জাব অঞ্চলে চলে যায়। সেখান থেকেই মাসে মাসে মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠাত সে। চিঠিপত্র লিখত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইচ্ছে করলেই বাড়ি আসতে পারত না।

এ নিয়ে বাড়ির লোকেদের অভিযোগের আর অন্ত ছিল না! নবগোপালের বাবা ছিলেন, মা ছিলেন। নতুন বিয়ে করেছিল, তাই বউও ছিল। ভাইবোন এবং বাড়ির অন্যান্য লোকজন তো ছিলই।

এইভাবেই দিন কাটছিল।

নবগোপাল কিছুতেই বাড়ি আসার ছুটি আর পায় না। এদিকে বেশ কিছুদিন হল নবগোপালের বাড়ি থেকে চিঠি আসাও বন্ধ হয়ে গেল। নবগোপাল বুঝল বাড়ির লোকেরা তার দেশে না ফেরার জন্য রাগ করেই চিঠি লেখা বন্ধ করেছে। কেননা শেষ চিঠিতে বাবা লিখেছিলেন, ‘আজ চার বছরেও যখন তুমি বুড়ো বাপ-মাকে একবার এসে দেখে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না, নতুন বউমার জন্য যখন তোমার কোনও কর্তব্য আছে বলে মনে হচ্ছে না, তখন আমরা ধরে নিলাম নতুন পরিবেশে গিয়ে তুমি আমাদের ভুলে গেছ। শুধু মাসে মাসে টাকা পাঠালেই পরিবারের প্রতি কর্তব্যের শেষ হয় না। শ্রীশ্রী ভগবানের কৃপায় আমাদের বিষয়-সম্পত্তি কী আছে না আছে তা তোমার অজানা নয়। অতএব তোমার এই দান না পাঠালেও চলবে।’—এই চিঠি পাওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই নবগোপালের মন কেঁদে উঠল। তারপর একদিন যখন সত্যি সত্যিই মানিঅর্ডারও ফেরত এল তখন আর সে থাকতে পারল না।

ইতিমধ্যে পাঞ্জাব অঞ্চল থেকে কাশ্মীর অঞ্চলে বদলি হয়ে যায় নবগোপাল। সেখানে গিয়ে সেনাবাহিনীর কিছু নতুন বন্ধুদের সাহায্যে উচ্চতর পর্যায়ে আবেদন করে বহুকষ্টে এক মাসের ছুটি মঞ্জুর করাল এবং দেশে ফিরল। আসবার আগে একটা চিঠিও লিখল বাড়িতে। চিঠিতে লিখে দিল, অমুক দিন আমি গুসকরায় পৌঁছচ্ছি। স্টেশনে আবদুলকাকা যেন আমার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করে।

সেইমতোই নির্দিষ্ট তারিখে নবগোপাল যখন গুসকরায় ট্রেন থেকে নামল, রাত্রি তখন বারোটা।

ঘন অন্ধকারে স্টেশন এলাকা খাঁ খাঁ করছে।

দু-তিনজন মাত্র যাত্রী নামল ট্রেন থেকে।

নবগোপাল ভাবল, হয় বাড়ির লোকেরা ওর চিঠি পায়নি, নয়তো বাবা রাগ করেই গাড়ি পাঠায়নি। অথবা গাড়ি নিয়ে এসে ওর বিলম্ব দেখে আবদুলকাকা ফিরে গেছে। কেননা ও শুধু আসবার তারিখটাই লিখেছিল। দিনে আসবে কি রাতে আসবে তা তো লেখেনি। কেননা তখনকার দিনে ওই দূর দেশ থেকে নির্দিষ্ট সময়সূচি নির্ধারণ করে ঠিক সময়টিতে আসা এত সহজ ছিল না। তাই স্টেশনে আবদুলকাকাকে না দেখে হতাশ হয়ে পড়ল সে। নতুন স্টেশনমাস্টার নবগোপালকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার, আপনি কারও জন্য অপেক্ষা করছেন নাকি?”

নবগোপাল বলল, “হ্যাঁ। আমার বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে লোক আসবার কথা ছিল। কেন এল না তাই ভাবছি। অথবা এসে ফিরে গেল কি না?”

স্টেশনমাস্টার বললেন, “না। এসে ফিরে যায়নি। কেননা আমি তো সবসময় এখানে আছি। আমি কোনও গাড়িকেই অপেক্ষা করতে দেখিনি।”

“তা হলে কি ওরা চিঠি পায়নি আমার?”

“তাই হবে। তা আপনার বাড়ি এখান থেকে কতদূর?”

নবগোপাল বলল, “অনেক দূর। দশ-বারো মাইল।’ “ওরে বাবা। তবে তো হেঁটে যাওয়াও চলবে না।”

“না। দিনমানে হলে যেতাম। এই রাত্রে কখনও নয়। ভূতের উপদ্রব আছে। চোর-ডাকাতের ভয় আছে। ঠ্যাঙাড়ের উৎপাত আছে।”

স্টেশনমাস্টার বললেন, “তা হলে এক কাজ করুন। আজ আর কোনও ট্রেন তো আসবে না। আমি অফিসঘরের চাবি দিয়ে আমার কোয়ার্টারে শুতে যাচ্ছি। আপনি বরং ওয়েটিংরুমে শুয়ে রাতটুকু কাটিয়ে দিন। তারপর সকালে দেখি আপনার জন্য কী করতে পারি। যদি কারও গোরুর গাড়ি একটা পাই তো বলেকয়ে দেব।”

নবগোপাল বলল, “পেলে ভাল। নইলে হাঁটা দিতেও আমার আপত্তি নেই।” এই বলে সে ওয়েটিংরুমেই কাঠের বেঞ্চির ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে ছারপোকার কামড় খেতে লাগল। অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর সবে তন্দ্রাটি এসেছে, এমন সময়, “খোকাবাবু!”

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে উঠে বসল নবগোপাল, “আরে আবদুলকাকা!”

“কতক্ষণ এসেছেন আপনি?”

“তা প্রায় ঘণ্টাখানেক হল। স্টেশনের বাইরে গাড়ি দেখতে না পেয়ে ভাবছিলাম তুমি আসোনি।”

“আসব না কী বলছেন? আপনার চিঠি পাওয়ার পর থেকে সবাই হানটান করছি। তবে গাড়ি তো আমি এখানে রাখিনি। গাড়ি ওই বাঁধের ওপর রয়েছে। আপনার চিঠি পেয়েছি। কিন্তু আপনি কখন আসবেন চিঠিতে তা লেখেননি! তাই এখানে জায়গা জোড়া না করে গাড়িটাকে বাঁধের ওপর রেখেছি। আমি ঠিক করেছিলুম লাস্ট ট্রেনটা দেখে তারপর ফিরে যাব। এই ভেবে গাড়িতে গিয়ে শুয়ে ছিলুম। কিন্তু এমন ঘুম এল যে, না ঘুমিয়ে থাকতে পারলুম না।”

নবগোপাল বলল, “ঠিক আছে। রাত যখন হল তখন রাতটা কাটুক। কাল একটু ভোর ভোর রওনা হওয়া যাবে।”

“সে কী খোকাবাবু? কর্তাবাবুর অবস্থা জানেন? মা, বউমা সবাই আপনার চিঠি পাওয়ার পর থেকেই ঘর-বার করছেন। রান্নাবান্না রেডি করেই আপনার জন্য পথ চেয়ে বসে আছেন সব।”

“কিন্তু আবদুলকাকা, পথঘাটের যা অবস্থা তাতে…।”

“খোকাবাবু! আপনি কি ভুলে গেলেন, আমার নাম আবদুল। আমার শরীরে একফোঁটা রক্তও যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ কারও সাধ্য আছে আমাদের কিছু করে? ওসব ভয় করবেন না খোকাবাবু, চলুন। উদো আর বুধোকে সঙ্গে এনেছি। গোরুর গাড়িকে আমি ঘোড়ার গাড়ির মতো ছোটাব।”

অতএব নবগোপাল আর দ্বিরক্তি না করে আবদুলের সঙ্গে চলল।

আবদুল নবগোপালের সুটকেসটা মাথায় নিয়ে আগে আগে চলল। নবগোপাল চলল পিছু পিছু।

যেতে যেতে নবগোপাল দূর থেকেই দেখতে পেল সেই অন্ধকারে বাঁধের ওপর দুটো করে চারটে চোখ যেন ভাঁটার মতো জ্বলছে। চতুষ্পদ জন্তুদের চোখ রাত্রিবেলা জ্বলে। কিন্তু তাই বলে এইভাবে?

নবগোপাল কাছে যেতেই উদো আর বুধো গোরু দুটো বহুদিন পরে মনিবকে দেখে শিং নেড়ে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করল।

আবুদল বলল, “বাবু, গাড়িতে খড় বিছিয়ে গদির মতো করে আপনার বিছানা পেতে রেখেছি। আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি জোর কদমে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি।” নবগোপাল তাই করল।

দূরের ট্রেনভ্রমণে একেই সে ক্লান্ত ছিল, তার ওপর রাতও হয়েছিল অনেক। তাই গোরুর গাড়ির বিছানায় দেহটা এলিয়ে দিল সে।

এদিকে আবদুল গোরুর গাড়ি নিয়ে বাঁধ থেকে মাঠের রাস্তা ধরল।

প্রথমটা বেশ একটু মন্থর গতিতে চলার পর গাড়ি এত জোরে ছোটাতে লাগল যে, ওর মনে হল ও যেন এখনও ট্রেনের মধ্যেই রয়েছে।

নবগোপাল ভয়ে ভয়ে বলল, “এ কী করছ! এইভাবে গাড়ি চালালে গাড়ি উলটে যাবে যে!”

আবদুল বলল, “কেন ঘাবড়াচ্ছেন খোকাবাবু? আমার নাম আবদুল। কোনও ভয় নেই আপনার। চুপচাপ শুয়ে থাকুন।”

নবগোপাল বলল, “না। আমার ভীষণ ভয় করছে।”

কিন্তু কে কার কথা শোনে!

আবদুলের তখন জেদ চেপে গেছে। জোরে গাড়ি সে চালাবেই।

নবগোপাল বুঝতে পারল গোরুর গাড়ি এত জোরে ছুটছে যে, মাঝে মাঝে চাকা মাটি স্পর্শ করছে না। যেন হাওয়ায় উড়ে চলছে।

এইভাবে কিছুক্ষণ যাওয়ার পরই গ্রামে পৌঁছল ওরা। গ্রামে ঢোকার মুখেই একটা খাল আছে। গোরুর গাড়িটা লাফিয়ে খাল পার হয়ে গেল।

নবগোপাল আর নবগোপালের মধ্যে নেই তখন। সে বুঝতেই পারল কার পাল্লায় সে পড়েছে। এখন ভালয় ভালয় বাড়ি পৌঁছলে হয়!

যাই হোক, গাড়ি এসে বাড়ির কাছে থামল। সাবেক কালের দোতলা মাঠকোঠা। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বেশ বড়সড়।

নবগোপাল গাড়ি থেকে নামলে আবদুল বলল, “অনেক রাত হয়ে গেল খোকাবাবু। আপনি ভেতরে যান। আমি গোরু দুটো গোয়ালে রেখে আসি।” এই বলে আবদুল চলে গেল।

ভীত সন্ত্রস্ত নবগোপাল দরজায় কড়া নাড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে ওর মা-বাবা দু’জনেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন।

নবগোপাল প্রণাম করতে যেতেই বাবা বললেন, “থাক বাবা, তোমার চিঠি যথাসময়েই পেয়েছি। কিন্তু এত রাত্রে তুমি কী করে এলে? তোমার আসার সময় জানতে না পারার জন্য আমি কোনও গাড়িই পাঠাইনি। জানি তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, কারও না কারও একটা গাড়ি ভাড়া নিয়েই আসবে। তবুও সারাদিন অপেক্ষা করে এই সবে শুয়েছি আমরা। এত রাতে এইভাবে আসাটা তোমার ঠিক হয়নি।”

নবগোপাল বলল, “আমাকে আবদুলকাকা নিয়ে এসেছে বাবা।”

“আবদুল ! আবদুল নিয়ে এসেছে?”

“হ্যাঁ। আবদুলকাকা।”

“সে কী? ঠিক বলছ? আবদুল নিয়ে এসেছে তোমাকে? না অন্য কেউ?” “না বাবা। অন্য কেউ নয়। আবদুলকাকাই নিয়ে এসেছে আমাকে। আমি কি ভুল দেখব?”

“কীসে এলে?”

“কেন, গোরুর গাড়িতে। উদো আর বুধো…।”

“থাক। আর বলতে হবে না। আবদুল আমাদের বহুদিনের পুরনো লোক। সে তার উপযুক্ত কাজই করেছে। তবে বাবা একটা কথা কী জানো? আবদুল আর বেঁচে নেই। উদো বুধোও না।”

“সে কী?”

“হ্যাঁ। যাক, ওসব কথা থাক এখন। পথে তোমার কোনও অসুবিধে হয়নি তো? রাত কিন্তু অনেক হয়েছে। এবার খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ো। কেমন?” বলেই ডাক দিলেন, “বউমা!”

“যাই বাবা।” একগলা গোমটা দিয়ে নবগোপালের বউ এসে দাঁড়াল।

“নবুকে খেতে দাও।”

নবগোপাল হাত-মুখ ধুয়ে ওর ঘরে গিয়ে ঢুকল। তারপর বউ ভাত-তরকারি ধরে দিলে তৃপ্তির সঙ্গে খেতে লাগল সে। খেতে খেতে বলল, “ওরো বাবা! এতসব রান্না করলে কী করে?”

বউ নিরুত্তর।

নবগোপাল বলে, “অনেকদিন বাড়ি আসিনি বলে রাগ করেছ আমার ওপর? কিন্তু কী করব বলো। আমি কি ইচ্ছে করে আসিনি! আমি যে নিরুপায়।”

নবগোপাল দেখল বউয়ের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে। যাই হোক, খাওয়া

শেষ করে খাটের বিছানায় নবগোপাল শুয়ে পড়ল। ওর বউ পাশে বসে সযত্নে পাখার বাতাস করতে লাগল নবগোপালকে। সারাদিনের ক্লান্তির পর তৃপ্তির আহার এবং তার ওপর এই সুখশান্তির শয্যায় শোওয়ামাত্রই গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ল নবগোপাল।

ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে লোকজনের চেঁচামেচিতে। কে যেন নাম ধরে ডাকল, “নবা! এই নবা!”

ঘুম ভাঙতেই নবগোপালও হকচকিয়ে গেল। দেখল অর্ধভগ্ন ঘরে অপরিচ্ছন্ন ধূলি ধূসরিত খাটের ছেঁড়া বিছানায় সে শুয়ে আছে। ঘরের চারদিকে ঝুল, মাকড়সার জাল। হতচকিত নবগোপাল জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ওর পরিচিত লোকজনেরা পাশের মাঠ থেকে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “নবা, তুই! তুই কখন এলি?”

নবগোপাল জড়ানো গলায় বলল, “কাল রাত্রে।”

“ঠিক আছে। তুই ওখানেই থাক। আমরা গিয়ে তোকে নিয়ে আসছি।” এই বলে সকলে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে নবগোপালকে বাইরে নিয়ে এল।

নবগোপাল কান্নাধরা গলায় বলল, “আমার ঘরবাড়ির এরকম অবস্থা কেন? আমার মা

বাবা, আমার ভাইরা, আমার বউ কোথায়?”

সবাই বলল, “তুই কি কিছুই বুঝতে পারছিস না?”

“না। আমার গা-মাথা ঘুরছে। ওরা যে কাল রাতেও এ বাড়িতে ছিল।”

“ওরা কেউ ছিল না রে পাগল, কেউ ছিল না। কাল রাত্রে যাদের দেখেছিস তারা ওদের প্রেতাত্মা। বেশিদিন নয়, মাত্র ছ’মাস আগে কলেরার মহামারিতে সব শেষ হয়ে গেছে। আমরা এই সামান্য ক’জন ছাড়া গোটা গ্রামই উজাড় হয়ে গেছে প্রায়। তোদের বাড়ির কেউই বেঁচে নেই। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি তোকে খবর দেওয়ার। কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট ঠিকানা না থাকায় চিঠি দিতে পারিনি।”

নবগোপাল সব শুনে ডুকরে কেঁদে উঠল একবার। তারপর গত রাত্রের ঘটনার কথা সবাইকে বলে দিন-দুই গ্রামে থেকে আবার কর্মস্থলে ফিরে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অশরীরী

অশরীরী

অশরীরী

পুরাতন উই-ধরা ডায়েরিখানি সাবধানে খুলিয়া বরদা বলিল, অদ্ভুত জিনিস, কিন্তু আগে থাকতে কিছু বলব না। আমাদের আবদুল্লা কুঁজড়াকে জান তো? সাহেবদের কুঠি থেকে পুরানো বই সের দরে কিনে বিক্রি করতে আসে? তারি কাছ থেকে এটা কিনেছি, ঝাঁকায় করে এক গাদা বই নিয়ে এসেছিল, বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখি একটা বাংলায় লেখা ডায়েরি। নগদ দু-পয়সা খরচ করে তৎক্ষণাৎ কিনে ফেললুম।

অমূল্য দৈবক্রমে আজ ক্লাবে আসে নাই, তাই বাকবিতণ্ডায় বেশী সময় নষ্ট হইল না। বরদা বলিল, পড়ি শোনো। বেশী নয়, শেষের কয়েকটা পাতা খালি পড়ে শোনাব। আর যা আছে তা না শুনলেও কোনও ক্ষতি নেই। এ ডায়েরির লেখক কে তা ডায়েরি পড়ে জানা যায় না। তবে তিনি যে কলকাতা হাইকোর্টের একজন য়্যাডভোকেট ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।

ল্যাম্পটা উস্কাইয়া দিয়া বরদা পড়িতে আরম্ভ করিল,-৭ ফেব্রুয়ারি—আজ মুঙ্গেরে আসিয়া পৌঁছিলাম। স্টেশন হইতে পীর-পাহাড় প্রায় মাইল-তিনেক দূরে শহরের বাহিরে। মুঙ্গের শহরের যতটুকু দেখিলাম, কেবল ধূলা আর পুরাতন সেকেলে বাড়ি। যাহোক, আমাকে শহরের মধ্যে থাকিতে হইবে না ইহাই রক্ষা। স্টেশন হইতে আসিতে পথে কেল্লার ভিতর দিয়া আসিলাম। কেল্লাটা মন্দ নয়। পুরাতন মীরকাশিমের আমলের কেল্লা–গড়খাই দিয়া ঘেরা। প্রাকারের ইট-পাথর অনেকস্থানে খসিয়া গিয়াছে। বড় বড় গাছ উচ্চ প্রাচীরের উপর জন্মিয়া শুষ্ক গড়খাইয়ের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। একদিন এই গড়ের প্রাচীরে সতর্ক সান্ত্রী পাহারা দিত, প্রহরে প্রহরে দুদ্বারে নাকাড়া বাজিত, সন্ধ্যার সময় লোহার তোরণদ্বার ঝনৎকার করিয়া বন্ধ হইয়া যাইত–কল্পনা করিতে মন্দ লাগে না।

পীর-পাহাড়ের বাড়িখানি চমৎকার। এমন বাড়ি যাহার, সে চিরদিন এখানে থাকে না কেন এই আশ্চর্য। যা হোক, পাহাড়ের উপর নির্জন প্রকাণ্ড বাড়িখানিতে একাকী একমাস থাকিতে পারিব জানিয়া ভারি আনন্দ হইতেছে। বন্ধু কলিকাতায় থাকুন, আমি এই অবসরে তাঁহার বাড়িটি ভোগ করিয়া লই।

কলিকাতা হাইকোর্টে প্রায় দেড়মাস ধরিয়া প্রকাণ্ড দায়রা মোকদ্দমা চালাইবার পর সত্য সত্যই বিশ্রাম করিতে হইলে এমন শান্তিপূর্ণ স্থান আর নাই। আমার স্ত্রীর যে ভাঙিয়া পড়িয়াছে তাহার কারণ শুধু অত্যধিক পরিশ্রম নয়—মানুষের সহিত অবিশ্রাম সংঘর্ষ। যে-লোক মিথ্যা কথা বলিবে বলিয়া দৃঢ় সঙ্কল্প করিয়া আসিয়াছে তাহার পেট হইতে সত্য কথা টানিয়া বাহির করা এবং যে-হাকিম বুঝিবে না তাহাকে বুঝাইবার চেষ্টা কিরূপ বুকভাঙা ব্যাপার তাহা যিনি এ পেশায় ঢুকিয়াছেন তিনিই জানেন। মানুষ দেখিলে এখন ভয় হয়, কেহ কথা কহিবার উপক্রম করিলেই পলাইতে ইচ্ছা করে। তাই একেবারে নিঃসঙ্গ ভাবে চলিয়া আসিয়াছি, বামুন-চাকর পর্যন্ত সঙ্গে লই নাই। ইমি কুকার সঙ্গে আছে, তাহাতেই নিজে রাঁধিয়া খাইব।

কি সুন্দর স্থান! পাহাড়ের ঠিক মাথার উপর বাড়িটি, চারিদিকের সমতলভূমি হইতে প্রায় তিন-চার শ ফুট উচ্চে। ছাদের উপর দাঁড়াইলে দেখা যায়, একদিকে দিগন্তরেখা পর্যন্ত বিস্তৃত গঙ্গার চর। তাহার উপর এখন সরিষা জন্মিয়াছে—সবুজ জমির উপর হলুদ বর্ণ ফুলের স্ফুলিঙ্গ। চাহিয়া চাহিয়া চক্ষু স্নিগ্ধ হইয়া যায়। অন্যদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় অগণ্য অসংখ্য তালগাছের মাথা জাগিয়া আছে, আরও কত প্রকারের ঝোপ-ঝাড় জঙ্গল; তাহার ভিতর দিয়া গেরিমাটি-ঢাকা পথটি বহু নিম্নে গোলাপী ফিতার মতো পড়িয়া আছে। এ যেন কোন্ স্বর্গলোকে আসিয়া পৌঁছিয়াছি। বাড়িতে একটা মালী ছাড়া আর কেহ নাই, সে-ই বাড়ির তত্ত্বাবধান করে এবং দুচারটা মৃতপ্রায় গোলাপ গাছে জল দেয়। জল পাহাড়ের উপর পাওয়া যায় না, পাহাড়ের পাদমূলে রাস্তার ধারে একটি কৃয়া আছে সেখান হইতে আনিতে হয়। মালীটার সহিত কথা হইয়াছে আমার জন্য দু-ঘড়া জল রোজ আনিয়া দিবে, তাহাতেই আমার স্নান ও পান দুই কাজই চলিয়া যাইবে।

মালীটাকে বলিয়া দিয়াছি, পারতপক্ষে যেন আমার সম্মুখে না আসে। আমি একলা থাকিতে চাই।

৮ ফেব্রুয়ারি। কাল রাত্রে এত ঘুমাইয়াছি যে, জীবনে বোধ হয় এমন ঘুমাই নাই। রাত্রি নয়টার সময় শুইতে গিয়াছিলাম, যখন ঘুম ভাঙিল তখন বেলা সাতটা—ভোরের রৌদ্র খোলা জানালা দিয়া বিছানায় আসিয়া পড়িয়াছে।

গোছগাছ করিয়া সংসার পাতিয়া ফেলিয়াছি। সঙ্গে কিছু চাল ডাল আলু ইত্যাদি আনিয়াছিলাম, তাহাতে আরও তিন-চার দিন চলিবে! ফুরাইয়া গেলে মালীকে দিয়া শহরের বাজার হইতে আনাইয়া লইব। ট্রাঙ্কগুলা খুলিয়া দেখিলাম প্রয়োজনীয় দ্রব্য সবই আছে। দাড়ি কামাইবার সরঞ্জাম সাবান তেল আয়না চিরুনি কিছুই ভুল হয় নাই। এক বাণ্ডিল ধূপের কাঠিও রহিয়াছে দেখিলাম, ভালই হইল। এখনও অবশ্য একটু শীত আছে, কিন্তু গরম পড়িতে আরম্ভ করিলে মশার উপদ্রব বাড়িতে পারে। চাকরটার বুদ্ধি আছে দেখিতেছি, কতকগুলা বই ও কাগজ পেনসিল ট্রাঙ্কের মধ্যে পুরিয়া দিয়াছে। যদিও এই একমাসের মধ্যে বই স্পর্শ করিব না প্রতিজ্ঞা করিয়াছি তবু হাতের কাছে দু একখানা থাকা ভাল।

বইগুলা কিন্তু একেবারেই বাজে। পরলোক ভূতদর্শন, উন্মাদ ও প্রতিভা—এ-সব বই আমি পড়ি না। চাকরটা বোধ হয় ভাবিয়াছে আইন ছাড়া অন্য যে-কোনও বই পড়িলেই আমি ভাল থাকিব। সে একটু-আধটু লেখাপড়া জানে—সাধে কি বলে, স্বল্পা বিদ্যা ভয়ঙ্করী।

এখানেও একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি আছে দেখিতেছি। একটা ক্ষুদ্র আলমারিতে গোটাকয়েক পুরাতন উপন্যাস, অধিকাংশই সম্মুখের ও পশ্চাতের পাতা ছেঁড়া। যাহোক, পড়িবার যদি ইচ্ছা হয়–বইয়ের অভাব হইবে না।

দুপুরবেলাটা ভারি আনন্দে কাটিল। শূন্য বাড়িময় একাকী ঘুরিয়া বেড়াইলাম। পাহাড়ের উপর এই বৃহৎ বাড়ি কে তৈয়ার করিয়াছিল—ইহার কোনও ইতিহাস আছে কি? কলিকাতায় ফিরিয়া বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করিব।

বাড়ি যে-ই তৈয়ার করুক, তাহার রুচির প্রশংসা করিতে হয়। যে-পাহাড়ের উপর বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত তাহা দেখিতে একটি উল্টানো বাটির মতো,কবি হইলে আরও রসাল উপমা দিতে পারিতাম, হয়তো সাদৃশ্যটাও আরও বেশী হইত,—কিন্তু আমার পক্ষে উল্টানো বাটিই যথেষ্ট। শাদা বাড়িখানা তাহার উপর মাথা তুলিয়া আছে। বাড়িখানা যেমন বৃহৎ তেমনি মজবুত—মোটা মোটা দেওয়ালের মাঝখানে বিশাল এক একটা ঘর, নিজের বিশালতার গৌরবে শূন্য আসবাবহীন অবস্থাতেও সর্বদা গমগম করিতেছে। বাড়ির সম্মুখে খানিকটা সমতল স্থান আছে, তাহাতে গোলাপ বাগান। গোলাপ বাগানের শেষে ফটক, ফটকের বাইরেই নীচে যাইবার ঢালু পাথরভাঙা পথ বাঁকিয়া বাড়ির কোল দিয়া নামিয়া গিয়াছে। ফটকের সম্মুখে কিছুদূরে একটা প্রকাণ্ড কূপ, গভীর হইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে তাহার তল পর্যন্ত দৃষ্টি যায় না। কূপের চারিপাশে আগাছা জন্মিয়াছে, একটা শিমূল গাছ তাহার মুখের বিরাট গর্তটার উপর ঝুকিয়া পড়িয়াছে। কূপের ভিতর এক খণ্ড পাথর ফেলিয়া দেখিলাম, অনেকক্ষণ পরে একটা ফাঁপা আওয়াজ আসিল। কূপটা নিশ্চয় শুষ্ক।

সন্ধ্যার সময় কূপের কাছে গিয়া দাঁড়াইলাম। নীচে বেশ অন্ধকার হইয়া গিয়াছে, দূরে দূরে দু-একটি প্রদীপ মিটমিট করিয়া জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, কিন্তু উপরে এখনও বেশ আলো আছে। পশ্চিম দিকটা গৈরিক ধূলায় ভরিয়া গিয়াছে। দেখিতে ভারি চমৎকার। এই বাড়িতে আমার দুই দিন কাটিল।

হঠাৎ কাঁধের উপর একটা স্পর্শ অনুভব করিয়া দেখি, এক ঝলক রক্ত সেখানে পড়িয়াছে। কিন্তু তখনই বুঝিতে পারিলাম, রক্ত নয়—ফুল। শিমুল গাছটায় দু-চারটা ফুল ধরিয়াছিল, ইতিপূর্বে লক্ষ্য করি নাই।

ফুলটি হাতে লইয়া ফিরিয়া আসিলাম। মনে হইল, এই স্থানের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা ফুল দিয়া আমাকে স্বাগত সম্ভাষণ করিলেন।

৯ ফেব্রুয়ারি। আজ শরীরটা ভাল ঠেকিতেছে না; বোধ হয় একটু জ্বরভাব হইয়াছে। মাথার মধ্যে কেমন একটা উত্তাপ অনুভব করিতেছি। মোকদ্দমা লইয়া যে অতিরিক্ত মানসিক পরিশ্রম করিয়াছি তাহার কুফল এখনও শরীরে লাগিয়া আছে; অকারণে স্নায়ুমণ্ডল উত্তেজিত হইয়া ওঠে। আজ উপবাস করিয়াছি, আশা করি কাল শরীর বেশ ঝরঝরে হইয়া যাইবে।

১০ ফেব্রুয়ারি। প্রাচীন গ্রীসে সংস্কার ছিল, প্রত্যেক গাছ লতা নদী পাহাড়ের একটি করিয়া অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আছে। আধুনিক বিজ্ঞান-শাসিত যুগে কথাটা হাস্যকর হইলেও উপদেবতা অধিষ্ঠিত গাছপালার কথা কল্পনা করিতে মন্দ লাগে না। সাঁওতালদের মধ্যেও এইরূপ সংস্কার আছে শুনিয়াছি। যাহারা বনে জঙ্গলে বাস করে তাহাদের মধ্যে এই প্রকার বিশ্বাস হয়তো স্বাভাবিক। মানুষ যেখানেই থাকুক, দেবতা সৃষ্টি না করিয়া থাকিতে পারে না। আমরা সভ্য হইয়া ইট-পাথরের মন্দিরের মধ্যে দেবতার প্রতিষ্ঠা করিয়াছি, যাহারা বনের মানুষ তাহারা গাছপালা নদী-নালাতেই দেবতার আরোপ করিয়া সন্তুষ্ট থাকে। আত্মবিশ্বাসের যেখানে অভাব, সেইখানেই দেবতার জন্ম। মানুষ সহজ অবস্থায় ভূত-প্রেত উপদেবতা, এমন কি দেবতা পর্যন্ত বিশ্বাস করিতে পারে না; ও-সব বিশ্বাস করিতে হইলে রীতিমত মস্তিষ্কের ব্যাধি থাকা চাই। কিন্তু সে যাহাই হোক, উপদেবতার কথা কল্পনা করিতে বেশ লাগে। আমার ঐ শিমুল গাছটার যদি একটা দেবতা থাকিত তাহাকে দেখিতে কেমন হইত? কিংবা অতদূর যাইবার প্রয়োজন কি, এই পাহাড়টারও তো একটা দেবতা থাকা উচিত—তিনিই বা কিরূপ দেখিতে শুনিতে? তিনি যদি হঠাৎ একদিন আমাকে দেখা দেন তবে কেমন হয়?

১১ ফেব্রুয়ারি। দিনের বেলাটা পাহাড়ের উপরেই এধার-ওধার ঘুরিয়া এবং রান্নাবান্নার কাজে বেশ একরকম কাটিয়া যায়। কিন্তু সন্ধ্যার পর হইতে শয়নের পূর্ব পর্যন্ত এই তিন-চার ঘন্টা সময় যেন কিছুতেই কাটিতে চায় না। এখন কৃষ্ণপক্ষ যাইতেছে, সূর্যাস্তের পরই চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হইয়া যায়। তখন পৃথিবী-পৃষ্ঠে সমস্ত দৃশ্য লেপিয়া মুছিয়া একাকার হইয়া যায়, কেবল আকাশের তারাগুলা যেন অত্যন্ত নিকটে আসিয়া চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া থাকে। আমি ইমি কুকারে রান্না চড়াইয়া দিয়া লণ্ঠন জ্বালিয়া ঘরের মধ্যে নীরবে বসিয়া থাকি। লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোয় ঘরটা সম্পূর্ণ আলোকিত হয় না—আনাচে-কানাচে অন্ধকার থাকিয়া যায়।

প্রকাণ্ড বাড়িতে আমি একা।

১২ ফেব্রুয়ারি। মনটা অকারণে বড় অস্থির হইয়াছে। সন্ধ্যার পর হইতে কেবলি মনে হইতেছে যেন কাহার অদৃশ্য চক্ষু আমাকে অনুসরণ করিতেছে, বার বার ঘাড় ফিরাইয়া পিছনে দেখিতেছি। অথচ বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেহ নাই। স্নায়বিক উত্তেজনা—তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু বড় অস্থির বোধ হইতেছে,—নার্ভের কোনও ঔষধ সঙ্গে থাকিলে ভাল হইত।

১৩ ফেব্রুয়ারি। কাল রাত্রে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিয়াছে। আমার স্নায়ুগুলা এখনও ধাতস্থ হয় নাই কিংবা

না, না, ও-সব আমি বিশ্বাস করি না।

ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম, অনেক রাত্রে ঘুম ভাঙিয়া গেল। কে যেন আমার সর্বাঙ্গে অতি লঘুস্পর্শে হাত বুলাইয়া দিতেছে! কি অপূর্ব রোমাঞ্চকর সে স্পর্শ তাহা বলিতে পারি না। মুখের উপর হইতে আঙুল চালাইয়া পায়ের পাতা পর্যন্ত লইয়া যাইতেছে, আবার ফিরিয়া আসিতেছে। ঘর অন্ধকার ছিল; এই শারীরিক সুখস্পর্শের মোহে কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন থাকিয়া, ধড়মড় করিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিলাম। মনে হইল কে যেন নিঃশব্দে শয্যার পাশ হইতে সরিয়া গেল।

এতক্ষণে ঘুমের আবেশ একেবারে ছুটিয়া গিয়াছিল, ভাবিলাম—চোর নয় তো? কিন্তু চোর গায়ে হাত বুলাইয়া দিবে কেন? তা ছাড়া ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া শুইয়াছি। আমি উচ্চকণ্ঠে ডাকিলাম—কে? কোনও সাড়া নাই। গা ছমছম্ করিতে লাগিল। বালিশের পাশে দেশলাই ছিল, আলো জ্বালিলাম। ঘরে কেহ নাই, দরজা পূর্ববৎ বন্ধ। ভাবিলাম, ঘুমাইয়া নিশ্চয় স্বপ্ন দেখিয়াছি। এমন অনেক সময় হয়, ঘুম ভাঙিয়াছে মনে হইলেও ঘুম সত্যই ভাঙে না—নিদ্রা ও জাগরণের সন্ধিস্থলে মনটা অর্ধচেতন অবস্থায় থাকে।

দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিলাম, খোলা বারান্ডায় আসিয়া দেখিলাম এক আকাশ নক্ষত্র জ্বজ্ব করিতেছে। ঘরের বদ্ধ বায়ু হইতে বাহিরে আসিয়া বেশ আরাম বোধ হইল। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বাড়ির চারিদিকে যেন নিঃশ্বাস ফেলিয়া বেড়াইতেছে। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক পায়চারি করিবার পর একটু গা শীত-শীত করিতে লাগিল, আবার ঘরে ফিরিয়া দরজা বন্ধ করিয়া শুইলাম। আলোটা নিবাইলাম না, কমাইয়া দিয়া মাথার শিয়রে রাখিয়া দিলাম।

এটা কি সত্যই স্বপ্ন? রাত্রে আর ভাল ঘুম হইল না।

১৪ ফেব্রুয়ারি। কাল আর কোনও স্বপ্ন দেখি নাই। আধ-আশা আধ-আশঙ্কা লইয়া শুইতে গিয়াছিলাম—হয়তো আজ আবার স্বপ্ন দেখিব; কিন্তু কিছুই দেখি নাই। আজ শরীর বেশ ভাল বোধ হইতেছে।

চাল ডাল কেরোসিন তৈল ইত্যাদি ফুরাইয়া গিয়াছিল, মালীকে দিয়া বাজার হইতে আনাইয়া লইয়াছি। মালীটা জাতে গোয়ালা হইলেও বেশ বুদ্ধিমান লোক, সেই যে, তাহাকে আমার সম্মুখে আসিতে মানা করিয়া দিয়াছিলাম তারপর হইতে নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে আমার কাছে আসে না। কখন জল দিয়া যায় আমি জানিতেও পারি না। আমিও আসিয়া অবধি পাহাড় হইতে নীচে নামি নাই, সুতরাং মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ একয়দিন হয় নাই বলিলেই চলে। নীচে রাস্তা দিয়া মানুষ চলাচল করিতে দেখিয়াছি বটে, কিন্তু এতদূর হইতে তাহাদের মুখ দেখিতে পাই নাই।

আজ বাড়িতে চিঠি দিয়াছি, লিখিয়াছি—বেশ ভাল আছি। কিন্তু তাহাদের চিঠিপত্র দিতে বারণ করিয়া দিয়াছি। আমার এই বিজন বাসের মাধুর্য চিঠিপত্রের দ্বারাও খণ্ডিত হয় ইহা আমার ইচ্ছা নয়। বাহিরের পৃথিবীতে কোথায় কি ঘটিতেছে-না-ঘটিতেছে তাহার খোঁজ রাখিতে চাই না।

১৫ ফেব্রুয়ারি। আজ আবার মনটা অস্থির হইয়াছে। কি যেন হইয়াছে, অথচ ঠিক বুঝিতে পারিতেছি। শরীর তো বেশ ভালই আছে। তবে এমন হইতেছে কেন?

কাল, ভাবিতেছি, একবার শহরটা দেখিয়া আসিব। শুনিয়াছি নবাবী আমলের অনেক দ্রষ্টব্য স্থান আছে।

কাছেই কোথায় নাকি সীতাকুণ্ড নামে গরম জলের একটা প্রস্রবণ আছে, বন্ধু বলিয়া দিয়াছিলেন সেটা দেখা চাই। অতএব সেটাও দেখিতে হইবে।

১৬ ফেব্রুয়ারি। কাল রাত্রে আবার সেইরূপ ঘটিয়াছে। স্বপ্ন নয়—এ স্বপ্ন নয়! স্পষ্ট অনুভব করিলাম, কে আমার পাশে বসিয়া অতি কোমল হস্তে ধীরে ধীরে আমার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছে। অনেকক্ষণ চোখ বুজিয়া নিস্পন্দ বক্ষে শুইয়া রহিলাম। বালিশের তলায় ঘড়িটা টিক টিক করিতেছে শুনিতে পাইলাম, সুতরাং এ ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখা হইতেই পারে না।

অদৃশ্য হাতটা কতবার আমার আপাদমস্তক বুলাইয়া গেল তাহা বলিতে পারি না। একবার হাতখানা যখন আমার বুকের কাছে আসিয়াছে তখন হাত বাড়াইয়া আমি সেটা ধরিতে গেলাম। মনে হইল আমার মুঠির মধ্যে হাতটা গলিয়া মিলাইয়া গেল। হাতবুলানোও বন্ধ হইল। অনুভবে বুঝিলাম, সে শয্যার পাশে দাঁড়াইয়া আছে, এখনও যায় নাই। আমি চোখ চাহিয়া শুইয়া রহিলাম–সেও দাঁড়াইয়া রহিল। ঘর অন্ধকার, কিছুই দেখিতে পাইতেছি না,—চোখ খুলিয়া থাকা বা বুজিয়া থাকায় কোনও প্রভেদ নাই। উৎকর্ণ হইয়া শুনিবার চেষ্টা করিলাম কোনও শব্দ হয় কি-না! দরজায় কোথাও ঘুণ ধরিয়াছে—তাহারই শব্দ শুনিতেছি। আর কোনও শব্দ নাই!

অতীন্দ্রিয় অনুভূতি দ্বারা বুঝিলাম, সে আস্তে আস্তে চলিয়া গেল; আজ আর আসিবে না! ঘুমাইয়া পড়িলে হয়তো থাকিত। আমি যখনই ঘুমাই, তখনই কি সে আমার সুপ্ত শরীরের উপর পাহারা দেয়?

কিন্তু আশ্চর্য! আজ আমার একটুও ভয় করিল না কেন?

১৭ কেব্রুয়ারি। আমার শিমুল গাছ রক্তরাঙা ফুলে ফুলে ভরিয়া উঠিয়াছে। গাছে পাতা নাই, কেবলই ফুল।

সেদিন যে আমার কাঁধের উপর এক ঝলক রক্তের মতো ফুল পড়িয়াছিল-সে কি স্বাভাবিক? এত স্থান থাকিতে আমার কাঁধের উপরই বা পড়িল কেন? তবে কি কোনও অদৃশ্য হস্ত গাছ হইতে ফুল ছিঁড়িয়া আমার গায়ে ফেলিয়াছিল? কে সে? বৃক্ষদেবতা? না, আমারই মতো মানুষের দেহ-বিমুক্ত আত্মা? তাই কি? একটা দেহহীন আত্মা! সে আমাকে পাইয়া খুশি হইয়াছে, তাহাই কি আকারে ইঙ্গিতে জানাইতে চায়? সে আমার সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করিতে চায় তাই কি সেদিন ফুল দিয়া আমার সংবর্ধনা করিয়াছিল।

তবে কি সত্যই প্রেতযোনি আছে? দেহমুক্ত অশরীরী আত্মা? বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু there are more things in heaven and earth

একটা বিষয়ে ভারি আশ্চর্য লাগিতেছে,—ভয় করে না কেন? এই নির্জন স্থানে একলা আছি, এ অবস্থায় ভয় হওয়াই তো স্বাভাবিক!

১৮ ফেব্রুয়ারি। আনমনে দিন কাটিয়া গেল। শুন্য বাড়িময় কেবল ঘুরিয়া বেড়াইলাম।

পছিয়াঁ হাওয়া দিতেছে—খুব ধুলা উড়িতেছে। গঙ্গার চরের দিকটা বালুতে অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না।

আজ কিছু ঘটে নাই। মনটা উদাস বোধ হইতেছে।

১৯ ফেব্রুয়ারি। দিনটা যেন রাত্রির প্রতীক্ষাতেই কাটিয়া গেল। দিনের বেলা কিছু অনুভব করিকেন?

সন্ধ্যার সময় দেখিলাম পশ্চিম আকাশে সরু একটি চাঁদ দেখা দিয়াছে–যেন অসীম শূন্যে অপার্থিব একটু হাসি! অল্পক্ষণ পরেই চাঁদ অস্ত গেল, তখন আবার নীর অন্ধকার জগৎ গ্রাস করিয়া লইল।

ইকমিক কুকারে রান্না চড়াইয়া অন্যমনে বসিয়া ছিলাম। আলোটা সম্মুখের ভাঙা টেবিলে বসানো ছিল। অদূরে কতকগুলা ধূপ জ্বালিয়া দিয়াছিলাম, তাহারই সুগন্ধ ধূমে ঘরটি পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল।

আর তে যাহোক একটা কিছু না পড়িয়া থাকা যায় না। বসিয়া বসিয়া সহসা কি মনে হইল, বাক্স হইতে সেই প্রেততত্ত্ব সম্বন্ধে বইখানা বাহির করিয়া পড়িতে আরম্ভ করিলাম।

গল্প—নেহাত গল্প : সত্য অনুভূতির ছায়া মাত্র এ-সব কাহিনীতে নাই। আমি যেমন করিয়া তাহাকে অনুভব করিয়াছি, চোখে না দেখিয়াও সর্বাঙ্গ দিয়া তাহার সামীপ্য উপলব্ধি করিয়াছি—-সেরূপ ভাবে আর কে প্রত্যক্ষ করিয়াছে?

ইহারা লিখিতেছে, চোখে দেখিয়াছে। চোখে দেখা কি যায়? যে আমার কাছে আসে, সে কেমন দেখিতে? আমারই মতো কি তার হস্ত পদ অবয়ব আছে? মানুষের চেহারা, না অন্য কিছু!

বই হইতে চোখ তুলিয়া ভাবিতেছি, এমন সময় আমার দৃষ্টির সম্মুখে এক আশ্চর্য ইন্দ্রজাল ঘটিল। ধুপের কাঠিগুলি হইতে যে ক্ষীণ ধুমরেখা উঠিতেছিল তাহা শূন্যে কুণ্ডলী পাকাইতে পাকাইতে যেন একটা বিশিষ্ট আকার ধারণ করিতে লাগিল। অদৃশ্য কাচের শিশিতে রঙীন জল ঢালিলে যেমন হা শিশির আকারটি প্রকাশ করিয়া দেয়, আমার মনে হইল ঐ ধোঁয়া যেন কোনও অদৃশ্য আধারে প্রবেশ করিয়া ধীরে ধীরে তদাকারত্ব প্রাপ্ত হইতেছে। আমি রুদ্ধনিঃশ্বাসে দেখিতে লাগিলাম। ক্রমে ধূসর রঙের একটি বস্ত্রের আভাস দেখা দিল। বস্ত্রের ভিতর মানুষের দেহ ঢাকা রহিয়াছে, বস্ত্রের ভাঁজে ভাঁজে তাহার পরিচয় পাইতে লাগিলাম।…ধূম কুণ্ডলী মূর্তি গড়িয়া চলিল; আবছায়া মূর্তির ভিতর দিয়া ওপারের দেয়াল দেখিতে পাইতেছি, কিন্তু তবু তাহার ডৌল হইতে বেশ বুঝা যায় যে, একটা মানুষের চেহারা। ধূম পাকাইয়া পাকাইয়া ঊর্ধ্বে উঠিতে উঠিতে ক্ৰমে মূর্তির গলা পর্যন্ত পৌঁছিল। এইবার তাহার মুখ দেখিতে পাইব…কি রকম সে মুখ? বিকট? ভয়ানক? কিন্তু ঠিক এই সময় সহসা সব ছত্রাকার হইয়া গেল! জানালা দিয়া একটা দমকা হাওয়া আসিয়া ঐ ধূমমূর্তিকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দিল। মুখ দেখা হইল না।

প্রতীক্ষা করিয়া রহিলাম যদি আবার দেখিতে পাই। কিন্তু আর সে মূর্তি গড়িয়া উঠিল না। ২৫ ফেব্রুয়ারি। সে আছে, তাহাতে তিলমাত্র সন্দেহ নাই। ইহা আমার উষ্ণ মস্তিষ্কের কল্পনা নয়। দিনের বেলা সে কোথায় থাকে জানি না, কিন্তু সন্ধ্যা হইলেই আমার পাশে আসিয়া দাঁড়ায়, আমার মুখের দিকে চোখ মেলিয়া থাকে। আমি তাহাকে দেখিতে পাই না বটে, কিন্তু যাহা দেখিতে পাওয়া যায় না তাহাই কি মিথ্যা! বাতাস দেখিতে পাই না, বাতাস কি মিথ্যা? শুনিয়াছি একপ্রকার গ্যাস আছে যাহা গন্ধহীন ও অদৃশ্য, অথচ তাহা আঘ্রাণ করিলে মানুষ মরিয়া যায়। সে গ্যাস কি মিথ্যা?

না, সে আছে। আমার মন জানিয়াছে সে আছে।

২১ ফেব্রুয়ারি। কে সে? তাহার স্পর্শ আমি অনুভব করিয়াছি, কিন্তু তাহাকে স্পর্শ করিতে পারি না কেন? ছুঁইতে গেলেই সে মিলাইয়া যায় কেন? সে দেখা দিতে চেষ্টা করে জানি, কিন্তু দেখা দিতে পারে না কেন? রক্তমাংসের চক্ষু দিয়া কি ইহাদের দেখা যায় না?

আমি এখন শয়নের পূর্বে ডায়েরি লিখিতেছি, আর সে ঠিক আমার পিছনে দাঁড়াইয়া আমার লেখা পড়িতেছে। আমি জানি। আমার শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু মুখ ফিরাইলে তাহাকে দেখিতে পাইব না—সে মিলাইয়া যাইবে।

কেন এমন হয়? তাহাকে কি দেখিতে পাইব না? দেখিবার কি দুর্দম আগ্রহ যে প্রাণে জাগিয়াছে। তাহা কি বলিব! তাহার এই দেহহীন অদৃশ্যতাকে যদি কোনও রকমে মূর্ত করিয়া তুলিতে পারিতাম! কোনও কি উপায় নাই?

২২ ফেব্রুয়ারি। কাল রাত্রে সে আর আসে নাই। সমস্ত রাত্রি তার প্রতীক্ষা করিলাম, কিন্তু তবু সে আসিল না। কেন আসিল না? তবে কি আর আসিবে না?

নিজেকে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ মনে হইতেছে। আমার প্রতি রজনীর সহচর সহসা আমাকে ফেলিয়া চলিয়া গিয়াছে! আর যদি না আসে?

২৩ ফেব্রুয়ারি। জানিয়াছি—জানিয়াছি! সে নারী!

এ কি অভাবনীয় ব্যাপার, যেন ধারণা করিতে পারিতেছি না। আজ সকালে স্নান করিয়া চুল আঁচড়াইতে গিয়া দেখি, একগাছি দীর্ঘ কালো চুল আমার চিরুনিতে জড়ানো রহিয়াছে। এ চুল আমার চিরুনিতে কোথা হইতে আসিল! বুঝিয়াছি বুঝিয়াছি এ তাহার চুল। সে নারী! সে নারী!

কখন তুমি আমার চিরুনিতে কেশ প্রসাধন করিয়া অভিজ্ঞানখানি রাখিয়া গিয়াছ? কি সুন্দর তোমার চুল! তুমি আমায় ভালবাস তাই বুঝি আমার চিরুনিতে কেশ প্রসাধন করিয়াছিলে? আমার আরসীতে মুখ দেখিয়াছিলে কি? কেমন সে মুখ? তাহার প্রতিবিম্ব কেন আরসীতে রাখিয়া যাও নাই? তাহা হইলে তো আমি তোমাকে দেখিতে পাইতাম।

ওগো রহস্যময়ি, দেখা দাও! এই সুন্দর সুকোমল চুলগাছি যে-তরুণ তনুর শোভাবর্ধন করিয়াছিল সেই দেহখানি আমাকে একবার দেখাও। আমি যে তোমায় ভালবাসি। তুমি নারী তাহা জানিবার পূর্ব হইতেই যে তোমায় ভালবাসি।

কেমন তোমার রূপ? যে-শিমুল ফুল দিয়া প্রথম আমায় সম্ভাষণ করিয়াছিলে তাহারই মতো দিক-আলোকরা রূপ কি তোমার? তাই কি নিজের রূপের প্রতিচ্ছবিটি সেদিন আমার কাছে পাঠাইয়াছিলে? অধর কি তোমার অমনই রক্তিম বর্ণ, পায়ের আলতা কি উহারই রঙে রাঙা!

কেমন করিয়া কোন্ ভঙ্গিতে বসিয়া তুমি আমার চিরুনি দিয়া চুল বাঁধিয়াছিলে? কেমন সে। কবরীবন্ধ! একটি রক্তরাঙা শিমুল ফুল কি সেই কবরীতে পরিয়াছিলে?

আমার এই ছত্রিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত কখনও আমি নারীর মুখের দিকে চোখ তুলিয়া দেখি নাই। আজ তোমাকে না দেখিয়াই তোমার প্রেমে আমি পাগল হইয়াছি। ওগো অশরীরিণি, একবার রূপ ধরিয়া আমার সম্মুখে দাঁড়াও।

২৪ ফেব্রুয়ারি। তাহার প্রেমের মোহে আমি ড়ুবিয়া আছি। আহার নিদ্রায় আমার প্রয়োজন কি? আমার মনে হইতেছে এই অপরূপ ভালবাসা আমাকে জর্জরিত করিয়া ফেলিতেছে, আমার অস্থি-মাংস-মেদ-মজ্জা জীর্ণ করিয়া জঠরস্থ অম্নরসের মতো আমাকে পরিপাক করিয়া ফেলিতেছে। এমন না হইলে ভালবাসা?

২৫ ফেব্রুয়ারি। আজ সকালে হঠাৎ মালীটার সঙ্গে দেখা হইয়া গেল, তাহাকে গালাগালি দিয়া তাড়াইয়া দিয়াছি। মানুষের মুখ আমি দেখিতে চাই না।

সমস্ত দিন কিছু আহার করি নাই। ভাল লাগে না—আহারে রুচি নাই। তা ছাড়া রান্নার হাঙ্গামা। অসহ্য।

গরম পড়িয়া গিয়াছে। মাথার ভিতরটা ঝাঁ ঝাঁ করিতেছে। কাল সারা রাত্রি জাগিয়াছিলাম।

কিন্তু তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। সে কাল আমার পাশে আসিয়া শুইয়াছিল। স্পষ্ট অনুভব করিয়াছি, তাহার অস্পষ্ট মধুর দেহ-সৌরভ আম্রাণ করিয়াছি। কিন্তু তাহাকে ধরিতে গিয়া দেখিলাম শূন্য কিছু নাই। জানি, সে আমার চোখে দেখা দিবার জন্য, আমার বাহুতে ধরা দিবার জন্য আকুল হইয়া আছে। কিন্তু পারিতেছে না। তাহার এই ব্যর্থ আকুলতা আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতেছি।

মধ্যরাত্রি হইতে প্রভাত পর্যন্ত খোলা আকাশের তলায় পায়চারি করিয়াছি, সেও আমার পাশে পাশে বেড়াইয়াছে। তাহাকে বার বার জিজ্ঞাসা করিয়াছি, কি করিলে তাহার দেখা পাইব। সে উত্তর দেয় নাই—কিংবা তাহার উত্তর আমার কানে পৌঁছায় নাই।

সকাল হইতেই সে চলিয়া গেল। মনে হইল, ঐ রক্তরাঙা শিমুল গাছটার দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল।

চর্মচক্ষে তাহাকে দেখিতে পাওয়া কি সম্ভব নয়?

২৬ ফেব্রুয়ারি। না, রক্তমাংসের শরীরে তাহাকে পাইব না। সে সূক্ষ্মলোকের অধিবাসিনী; স্থূল মর্ত্যলোক হইতে আমি তাহার নাগাল পাইব না। আমার এই জড়দেহটাই ব্যবধান হইয়া আছে।

২৭ ফেব্রুয়ারি। আহার নাই নিদ্রা নাই। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলিতেছে। আয়নায় নিজের মুখ দেখিলাম! এ কি সত্যই আমি—না আর কেহ?

আমি তাহাকে চাই, যেমন করিয়া হোক চাই। স্থূল শরীরে যদি না পাই—তবে—

২৮ ফেব্রুয়ারি। হাঁ, সেই ভাল। আর পারি না।

শিমুল গাছের যে ডালটা কুপের মুখে ঝুঁকিয়া আছে তাহাতে একটা দড়ি টাঙাইয়াছি। আজ সন্ধ্যায় যখন তাহার আসিবার সময় হইবে—তখন

সখি, আর দেরি নাই, আজ ফাগুনের সন্ধ্যায় যখন চাঁদ উঠিবে তুমি কবরী বাঁধিয়া প্রস্তুত হইয়া থাকিও। তোমার রক্তরাঙা ফুলের থালা সাজাইয়া রাখিও। আমি আসিব। তোমাকে চক্ষু ভরিয়া দেখিব। আজ আমাদের পরিপূর্ণ মিলনরাত্রি…

.

বরদা আস্তে আস্তে ডায়েরি বন্ধ করিয়া বলিল, এইখানেই লেখা শেষ?

১৬ ফাল্গুন ১৩৩৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *