অশরীরিণী – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

অশরীরিণী – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

পুরাতন উই-ধরা ডায়েরিখানি সাবধানে খুলিয়া বরদা বলিল,—অদ্ভুত জিনিস, কিন্তু আগে থাকতে কিছু বলব না৷ আমাদের আবদুল্লা কুঁজড়াকে জান তো? সাহেবদের কুঠি থেকে পুরানো বই সেরদরে কিনে বিক্রি করতে আসে? তারি কাছ থেকে এটা কিনেছি৷ ঝাঁকায় করে এক গাদা বই নিয়ে এসেছিল, বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখি একটা বাংলায় লেখা ডায়েরি৷ নগদ দু-পয়সা খরচ করে তৎক্ষণাৎ কিনে ফেললুম৷

অমূল্য দৈবক্রমে আজ ক্লাবে আসে নাই, তাই বাকবিতণ্ডায় বেশি সময় নষ্ট হইল না৷ বরদা বলিল,—পড়ি শোনো৷ বেশি নয়, শেষের কয়েকটা পাতা খালি পড়ে শোনাব৷ আর যা আছে তা না শুনলেও কোনো ক্ষতি নেই৷ এ ডায়েরির লেখক কে তা ডায়েরি পড়ে জানা যায় না, তবে তিনি যে কলকাতা হাইকোর্টের একজন এ্যাডভোকেট ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই৷

ল্যাম্পটা উস্কাইয়া দিয়া বরদা পড়িতে আরম্ভ করিল৷—৭ ফেব্রুয়ারি৷ আজ মুঙ্গেরে আসিয়া পৌঁছিলাম৷ স্টেশন হইতে পীর-পাহাড় প্রায় মাইল তিনেক দূরে—শহরের বাহিরে৷ মুঙ্গের শহরের যতটুকু দেখিলাম, কেবল ধূলা আর পুরাতন সেকেলে বাড়ি৷ যা হোক, আমাকে শহরের মধ্যে থাকিতে হইবে না, ইহাই রক্ষা৷ স্টেশন হইতে আসিতে পথে কেল্লার ভিতর দিয়া আসিলাম৷ কেল্লাটা মন্দ নয়৷ পুরাতন মীরকাশিমের আমলের কেল্লা,—গড়খাই দিয়া ঘেরা৷ প্রাকারের ইটপাথর অনেকস্থানে খসিয়া গিয়াছে৷ বড় বড় গাছ উচ্চ প্রাচীরের উপর জন্মিয়া শুষ্ক গড়খাইয়ের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে৷ একদিন এই গড়ের প্রাচীরে সতর্ক সান্ত্রী পাহারা দিত, প্রহরে প্রহরে দুর্গদ্বারে নাকাড়া বাজিত, সন্ধ্যার সময় লোহার তোরণদ্বার ঝনৎকার করিয়া বন্ধ হইয়া যাইত৷—কল্পনা করিতে মন্দ লাগে না৷

পীর-পাহাড়ের বাড়িখানি চমৎকার৷ এমন বাড়ি যাহার, সে চিরদিন এখানে থাকে না কেন, এই আশ্চর্য! যা হোক, পাহাড়ের উপর নির্জন প্রকাণ্ড বাড়িখানিতে একাকী একমাস থাকিতে পারিব জানিয়া ভারি আনন্দ হইতেছে৷ বন্ধু কলিকাতায় থাকুন, আমি এই অবসরে তাঁহার বাড়িটি ভোগ করিয়া লই৷

কলিকাতা হাইকোর্টে প্রায় দেড়মাস ধরিয়া প্রকাণ্ড দায়রা মোকদ্দমা চালাইবার পর সত্যসত্যই বিশ্রাম করিতে হইলে এমন শান্তিপূর্ণ স্থান আর নাই৷ আমার শরীর যে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে তাহার কারণ শুধু অত্যধিক পরিশ্রম নয়—মানুষের সহিত অবিশ্রাম সংঘর্ষ৷ যে কোনো মিথ্যা কথা বলিবে বলিয়া দৃঢ় সংকল্প করিয়া অসিয়াছে তাহার পেট হইতে সত্য কথা টানিয়া বাহির করা এবং যে হাকিম বুঝিবে না তাহাকে বুঝাইবার চেষ্টা যে কিরূপ বুকভাঙা ব্যাপার তাহা যিনি এ পেশায় ঢুকিয়াছেন তিনিই জানেন৷ মানুষ দেখিলে এখন ভয় হয়, কেহ কথা কহিবার উপক্রম করিলেই পলাইতে ইচ্ছা করে৷ তাই একেবারে নিঃসঙ্গভাবে চলিয়া আসিয়াছি, বামুন-চাকর পর্যন্ত সঙ্গে লই নাই৷ ইকমিক কুকার সঙ্গে আছে, তাহাতেই নিজে রাঁধিয়া খাইব৷

কি সুন্দর স্থান! পাহাড়ের ঠিক মাথার উপর বাড়িটি, চারিদিকের সমতলভূমি হইতে প্রায় তিন-চারশ’ ফুট উচ্চে৷ ছাদের উপর দাঁড়াইলে দেখা যায়, একদিকে দিগন্তরেখা পর্যন্ত বিস্তৃত গঙ্গার চর৷ তাহার উপর এখন সরিষা জন্মিয়াছে—সবুজ জমির উপর হলুদ-বর্ণ ফুলের স্ফুলিঙ্গ৷ চাহিয়া চাহিয়া চক্ষু স্নিগ্ধ হইয়া যায়৷ অন্যদিকে যতদূর দৃষ্টি যায়, অগণ্য অসংখ্য তালগাছের মাথা জাগিয়া আছে, আরো কতপ্রকারের ঝোপ-ঝাড় জঙ্গল, তাহার ভিতর দিয়া গেরিমাটি-ঢাকা পথটি বহু নিম্নে গোলাপি ফিতার মতো পড়িয়া আছে৷ এ যেন কোন স্বর্গলোকে আসিয়া পৌঁছিয়াছি৷ বাড়িতে একটা মালী ছাড়া আর কেহ নাই৷ সে-ই বাড়ির তত্ত্বাবধান করে এবং দু-চারটা মৃতপ্রায় গোলাপগাছে জল দেয়৷ জল পাহাড়ের উপর পাওয়া যায় না, পাহাড়ের পাদমূলে রাস্তার ধারে একটি কূয়া আছে সেখান হইতে আনিতে হয়৷ মালীটার সহিত কথা হইয়াছে—আমার জন্য দু-ঘড়া জল রোজ আনিয়া দিবে, তাহাতেই আমার স্নান ও পান দুই কাজই চলিয়া যাইবে৷

মালীটাকে বলিয়া দিয়াছি, পারতপক্ষে যেন আমার সম্মুখে না আসে, আমি একলা থাকিতে চাই৷

৮ ফেব্রুয়ারি৷ কাল রাত্রে এত ঘুমাইয়াছি যে জীবনে বোধ হয় এমন ঘুমাই নাই৷ রাত্রি নয়টার সময় শুইতে গিয়াছিলাম, যখন ঘুম ভাঙ্গিল তখন বেলা সাতটা—ভোরের রৌদ্র খোলা জানালা দিয়া বিছানায় আসিয়া পড়িয়াছে৷

গোছগাছ করিয়া সংসার পাতিয়া ফেলিয়াছি৷ সঙ্গে কিছু চাল ডাল আলু ইত্যাদি আনিয়াছিলাম—তাহাতে আরো তিন চার দিন চলিবে৷ ফুরাইয়া গেলে মালীকে দিয়া শহরের বাজার হইতে আনাইয়া লইব৷ ট্রাঙ্কগুলা খুলিয়া দেখিলাম প্রয়োজনীয় দ্রব্য সবই আছে৷ দাড়ি কামাইবার সরঞ্জাম সাবান তেল আয়না চিরুনি কিছুই ভুল হয় নাই৷ এক বান্ডিল ধূপের কাঠিও রহিয়াছে দেখিলাম, ভালোই হইল৷ এখনো অবশ্য একটু শীত আছে, কিন্তু গরম পড়িতে আরম্ভ করিলে মশার উপদ্রব বাড়িতে পারে৷ চাকরটার বুদ্ধি আছে দেখিতেছি, কতকগুলা বই ও কাগজ পেনসিল ট্রাঙ্কের মধ্যে পুরিয়া দিয়াছে৷ যদিও এই একমাসের মধ্যে স্পর্শ করিব না প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তবু হাতের কাছে দু-একখানা থাকা ভালো৷

বইগুলা কিন্তু একেবারেই বাজে৷ পরলোক, ভূতদর্শন, উন্মাদ ও প্রতিভা—এসব বই আমি পড়ি না৷ চাকরটা বোধ হয় ভাবিয়াছে, আইন ছাড়া অন্য যে-কোনো বই পড়িলেই আমি ভালো থাকিব৷ সে একটু-আধটু লেখাপড়া জানে,—সাধে কি বলে, স্বল্পা বিদ্যা ভয়ঙ্করী৷

এখানেও একটা ছোটখাট লাইব্রেরি আছে দেখিতেছি৷ একটা ক্ষুদ্র আলমারিতে গোটাকয়েক পুরাতন উপন্যাস, অধিকাংশরই সম্মুখের ও পশ্চাতের পাতা ছেঁড়া৷ যা হোক, পড়িবার যদি ইচ্ছা হয়—বইয়ের অভাব হইবে না৷

দুপুর বেলাটা ভারি আনন্দে কাটিল৷ শূন্য বাড়িময় একাকী ঘুরিয়া বেড়াইলাম৷ পাহাড়ের উপর এই বৃহৎ বাড়ি কে তৈয়ার করিয়াছিল—ইহার কোনো ইতিহাস আছে কি? কলিকাতায় ফিরিয়া বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করিব৷

বাড়ি যে-ই তৈয়ার করুক তাহার রুচির প্রশংসা করিতে হয়৷ যে পাহাড়ের উপর বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত তাহা দেখিতে একটি উল্টানো বাটির মতো,—কবি হইলে আরো রসাল উপমা দিতে পারিতাম—হয়তো সাদৃশ্যটাও আরো বেশি হইত,—কিন্তু আমার পক্ষে উল্টানো বাটিই যথেষ্ট৷ সাদা বাড়িখানা তাহার উপর মাথা তুলিয়া আছে৷ বাড়িখানা যেমন বৃহৎ তেমনি মজবুত—মোটা মোটা দেওয়ালের মাঝখানে বিশাল এক একটা ঘর, নিজের বিশালতার গৌরবে শূন্য আসবাবহীন অবস্থাতেও সর্বদা গমগম করিতেছে৷ বাড়ির সম্মুখে খানিকটা সমতল স্থান আছে, তাহাতে গোলাপবাগান৷ গোলাপবাগানের শেষে ফটক, ফটকের বাহিরেই নীচে যাইবার ঢালু পাথরভাঙা পথ বাঁকিয়া বাড়ির কোল দিয়া নামিয়া গিয়াছে৷ ফটকের সম্মুখে কিছুদূরে একটা প্রকাণ্ড কূপ, গভীর হইয়া গিয়াছে, তাহার তল পর্যন্ত দৃষ্টি যায় না৷ কূপের চারপাশে আগাছা জন্মিয়াছে, একটা শিমুলগাছ তাহার মুখের বিরাট গর্তটার উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে৷ কূপের ভিতর এক খণ্ড পাথর ফেলিয়া দেখিলাম, অনেকক্ষণ পরে একটা ফাঁপা আওয়াজ আসিল৷ কূপটা নিশ্চয় শুষ্ক৷

সন্ধ্যার সময় কূপের কাছে গিয়া দাঁড়াইলাম৷ নীচে বেশ অন্ধকার হইয়া গিয়াছে, দূরে দূরে দু-একটা প্রদীপ মিটমিট করিয়া জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, কিন্তু উপরে এখনো বেশ আলো আছে৷ পশ্চিম দিকটা গৈরিক ধূলায় ভরিয়া গিয়াছে৷ দেখিতে ভারি চমৎকার৷ এই বাড়িতে আমার দুই দিন কাটিল৷

হঠাৎ কাঁধের উপর একটা স্পর্শ অনুভব করিয়া দেখি, এক ঝলক রক্ত সেখানে পড়িয়াছে৷ কিন্তু তখনি বুঝিতে পারিলাম, রক্ত নয়—ফুল৷ শিমুলগাছটায় দু’চারটা ফুল ধরিয়াছিল, ইতিপূর্বে লক্ষ করি নাই৷

ফুলটি হাতে লইয়া আসিলাম৷ মনে হইল, এই স্থানের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা ফুল দিয়া আমাকে স্বাগত সম্ভাষণ করিলেন৷

৯ ফেব্রুয়ারি৷ আজ শরীরটা ভালো ঠেকিতেছে না বোধ হয় একটু জ্বরভাব হইয়াছে৷ মাথার মধ্যে কেমন উত্তাপ অনুভব করিতেছি৷ মোকদ্দমা লইয়া যে অতিরিক্ত মানসিক পরিশ্রম করিয়াছি তাহার কুফল এখনো শরীরে লাগিয়া আছে, অকারণে স্নায়ুমণ্ডল উত্তেজিত হইয়া উঠে৷ আজ উপবাস করিয়াছি, আশা করি কাল শরীর বেশ ঝরঝরে হইয়া যাইবে৷

১০ ফেব্রুয়ারি৷ প্রাচীন গ্রীসে সংস্কার ছিল, প্রত্যেক গাছ লতা নদী পাহাড়ের একটি করিয়া অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আছে৷ আধুনিক বিজ্ঞানশাসিত যুগে কথাটা হাস্যকর হইলেও উপদেবতা-অধিষ্ঠিত গাছপালার কথা কল্পনা করিতে মন্দ লাগে না৷ সাঁওতালদের মধ্যেও এইরূপ সংস্কার আছে শুনিয়াছি৷ যাহারা বনেজঙ্গলে বাস করে তাহাদের মধ্যে এইপ্রকার বিশ্বাস হয়তো স্বাভাবিক৷ মানুষ যেখানেই থাকুক, দেবতা সৃষ্টি না করিয়া থাকিতে পারে না৷ আমরা সভ্য হইয়া ইট-পাথরের মন্দিরের মধ্যে দেবতার প্রতিষ্ঠা করিয়াছি, যাহারা বনের মানুষ তাহারা গাছপালা নদীনালাতেই দেবতার আরোপ করিয়া সন্তুষ্ট থাকে৷ আত্মবিশ্বাসের যেখানে অভাবে সেইখানেই দেবতার জন্ম৷ মানুষ সহজ অবস্থায় ভূত প্রেত উপদেবতা, এমন কি দেবতা পর্যন্ত বিশ্বাস করিতে পারে না, ও-সব বিশ্বাস করিতে হইলে রীতিমতো মস্তিষ্কের ব্যাধি থাকা চাই৷ কিন্তু সে যাহাই হোক, উপদেবতার কথা কল্পনা করিতে বেশ লাগে৷ আমার ঐ শিমুলগাছটায় যদি একটা দেবতা থাকিত তাহাকে দেখিতে কেমন হইত? কিংবা অতদূর যাইবার প্রয়োজন কি এবং পাহাড়টারও তো একটা দেবতা থাকা উচিত—তিনিই বা কিরূপ দেখিতে শুনিতে? তিনি যদি হঠাৎ একদিন আমাকে দেখা দেন তবে কেমন হয়?

১১ ফেব্রুয়ারি৷ দিনের বেলাটা পাহাড়ের উপরেই এধার-ওধার ঘুরিয়া এবং রান্নাবান্নার কাজে বেশ একরকম কাটিয়া যায়৷ কিন্তু সন্ধ্যার পর হইতে শয়নের পূর্ব পর্যন্ত এই তিন চার ঘণ্টা সময় যেন কিছুতেই কাটিয়ে চায় না৷ এখন কৃষ্ণপক্ষ যাইতেছে, সূর্যাস্তের পরই চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হইয়া যায়৷ তখন পৃথিবীপৃষ্ঠে সমস্ত দৃশ্য লেপিয়া মুছিয়া একাকার হইয়া যায়, কেবল আকাশের তারাগুলা যেন অত্যন্ত নিকটে আসিয়া চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া থাকে৷ আমি ইকমিক কুকারে রান্না চড়াইয়া দিয়া লণ্ঠন জ্বালিয়া ঘরের মধ্যে নীরবে বসিয়া থাকি৷ লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোয় ঘরটা সম্পূর্ণ আলোকিত হয় না— আনাচে-কানাচে অন্ধকার থাকিয়া যায়৷

প্রকাণ্ড বাড়িতে আমি একা

১২ ফেব্রুয়ারি৷ মনটা অকারণে বড় অস্থির হইয়াছে৷ সন্ধ্যার পর হইতে কেবলি মনে হইতেছে যেন কাহার অদৃশ্য চক্ষু আমাকে অনুসরণ করিতেছে, বার বার ঘাড় ফিরাইয়া পিছনে দেখিতেছি৷ অথচ বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেহ নাই৷ স্নায়বিক উত্তেজনা—তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু বড় অস্থির বোধ হইতেছে,—নার্ভের কোনো ঔষধ সঙ্গে থাকিলে ভালো হইত৷

১৩ ফেব্রুয়ারি৷ কাল রাত্রে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিয়াছে৷ আমার স্নায়ুগুলা এখনো ধাতস্থ হয় নাই—কিংবা—

না, না, ও সব আমি বিশ্বাস করি না৷

ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম, অনেক রাত্রে ঘুম ভাঙিয়া গেল৷ কে যেন আমার সর্বাঙ্গে অতি লঘু স্পর্শে হাত বুলাইয়া দিতেছে৷ কি অপূর্ব রোমাঞ্চকর সে স্পর্শ তাহা বলিতে পারি না৷ মুখের উপর হইতে আঙুল চালাইয়া পায়ের পাতা পর্যন্ত লইয়া যাইতেছে, আবার ফিরিয়া আসিতেছে৷ ঘর অন্ধকার ছিল৷ এই শারীরিক সুখস্পর্শের মোহে কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন থাকিয়া, ধড়মড় করিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিলাম৷ মনে হইল কে যেন নিঃশব্দে শয্যার পাশ হইতে সরিয়া গেল৷

এতক্ষণে ঘুমের আবেশ একেবারে ছুটিয়া গিয়াছিল৷ ভাবিলাম,—চোর নয় তো? কিন্তু চোর গায়ে হাত বুলাইয়া দিবে কেন? তা ছাড়া ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া শুইয়াছি৷ আমি উচ্চকণ্ঠে ডাকিলাম—কে? কোনো সাড়া নাই৷ গা ছমছম করিতে লাগিল৷ বালিশের পাশে দেশলাই ছিল, আলো জ্বালিলাম৷ ঘরে কেহ নাই, দরজা পূর্ববৎ বন্ধ৷ ভাবিলাম, ঘুমাইয়া নিশ্চয় স্বপ্ন দেখিয়াছি৷ এমন অনেক সময় হয়, ঘুম ভাঙিয়াছে মনে হইলেও ঘুম সত্যই ভাঙে না—নিদ্রা ও জাগরণের সন্ধিস্থলে মনটা অর্ধচেতন অবস্থায় থাকে৷

দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিলাম খোলা বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম এক-আকাশ নক্ষত্র জ্বলজ্বল করিতেছে৷ ঘরের বন্ধ বায়ু হইতে বাহিরে আসিয়া বেশ আরাম বোধ হইল৷ একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বাড়ির চারিদিকে যেন নিঃশ্বাস ফেলিয়া বেড়াইতেছে৷ কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক পায়চারি করিবার পর একটু গা-শীত-শীত করিতে লাগিল, আবার ঘরে ফিরিয়া দরজা বন্ধ করিয়া শুইলাম৷ আলোটা নিভাইলাম না, কমাইয়া দিয়া মাথার শিয়রে রাখিয়া দিলাম৷

এটা কি সত্যই স্বপ্ন?—রাত্রে আর ভালো ঘুম হইল না৷

১৪ ফেব্রুয়ারি৷ কাল আর কোনো স্বপ্ন দেখি নাই৷ আধ-আশা আধ-আশঙ্কা লইয়া শুইতে গিয়াছিলাম৷ হয়তো আজ আবার স্বপ্ন দেখিব, কিন্তু কিছুই দেখি নাই৷ আজ শরীর বেশ ভালো বোধ হইতেছে৷

চাল ডাল কেরোসিন তৈল ইত্যাদি ফুরাইয়া গিয়াছিল, মালীকে দিয়া বাজার হইতে আনাইয়া লইয়াছি৷ মালীটা জাতে গোয়ালা হইলেও বেশ বুদ্ধিমান লোক৷ সেই যে তাহাকে আমার সম্মুখে আসিতে মানা করিয়া দিয়াছিলাম, তারপর হইতে নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে আমার কাছে আসে না৷ কখন জল দিয়া যায় আমি জানিতেও পারি না৷ আমিও আসিয়া অবধি পাহাড় হইতে নীচে নামি নাই, সুতরাং মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ এ-কয়দিন হয় নাই বলিলেই চলে৷ নীচে রাস্তা দিয়া মানুষ চলাচল করিতে দেখিয়াছি বটে, কিন্তু এতদূর হইতে তাহাদের মুখ দেখিতে পাই নাই৷

আজ বাড়িতে চিঠি দিয়াছি৷ লিখিয়াছি, বেশ ভালো আছি৷ কিন্তু তাহাদের চিঠিপত্র দিতে বারণ করিয়া দিয়াছি৷ আমার এই বিজনবাসের মাধুর্য চিঠিপত্রের দ্বারাও খণ্ডিত হয়, ইহা আমার ইচ্ছা নয়৷ বাহিরের পৃথিবীতে কোথায় কি ঘটিতেছে-না-ঘটিতেছে তাহার খোঁজ রাখিতে চাই না৷

১৫ ফেব্রুয়ারি৷ আজ আবার মনটা অস্থির হইয়াছে৷ কি যেন হইয়াছে, অথচ ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না৷ শরীর তো বেশ ভালোই আছে৷ তবে এমন হইতেছে কেন?

কাল ভাবিতেছি একবার শহরটা দেখিয়া আসিব৷ শুনিয়াছি নবাবী আমলের অনেক দ্রষ্টব্য স্থান আছে৷

কাছেই কোথায় নাকি সীতাকুণ্ড নামে গরমজলের একটা প্রস্রবণ আছে, বন্ধু বলিয়া দিয়াছিলেন, সেটা দেখা চাই৷ অতএব সেটাও দেখিতে হইবে৷

১৬ ফেব্রুয়ারি৷ কাল রাত্রে আবার সেইরূপ ঘটিয়াছে৷ স্বপ্ন নয়—এ স্বপ্ন নয়! স্পষ্ট অনুভব করিলাম, কে আমার পাশে বসিয়া অতি কোমল হস্তে ধীরে ধীরে আমার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছে৷ অনেকক্ষণ চোখ বুজিয়া নিস্পন্দবক্ষে শুইয়া রহিলাম৷ বালিশের তলায় ঘড়িটা টিক-টিক করিতেছে শুনিতে পাইলাম, সুতরাং এ ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখা হইতেই পারে না৷

অদৃশ্য হাতটা কতবার আমার আপাদমস্তক বুলাইয়া গেল তাহা বলিতে পারি না৷ একবার হাতখানা যখন আমার বুকের কাছে আসিয়াছে তখন হাত বাড়াইয়া আমি সেটা ধরিতে গেলাম৷ মনে হইল আমার মুঠির মধ্যে হাতটা গলিয়া মিলাইয়া গেল৷ হাত-বুলানোও বন্ধ হইল৷ অনুভবে বুঝিলাম, সে শয্যার পাশে দাঁড়াইয়া আছে, এখনো যায় নাই৷ আমি চোখ চাহিয়া শুইয়া রহিলাম—সেও দাঁড়াইয়া রহিল৷ ঘর অন্ধকার, কিছুই দেখিতে পাইতেছি না,—চোখ খুলিয়া থাকা বা বুজিয়া থাকার কোনো প্রভেদ নাই৷ উৎকর্ণ হইয়া শুনিবার চেষ্টা করিলাম কোনো শব্দ হয় কিনা৷ দরজায় কোথাও ঘুণ ধরিয়াছে— তাহারই শব্দ শুনিতেছি৷ আর কোনো শব্দ নাই৷

অতীন্দ্রিয় অনুভূতি দ্বারা বুঝিলাম, সে আস্তে চলিয়া গেল৷ আজ আর আসিবে না৷ ঘুমাইয়া পড়িলে হয়তো থাকিত৷ আমি যখনই ঘুমাই, তখনি কি সে আমার সুপ্ত শরীরের উপর পাহারা দেয়?

কিন্তু আশ্চর্য, আজ আমার একটুও ভয় করিল না কেন?

১৭ ফেব্রুয়ারি৷ আবার শিমুলগাছ রক্তরাঙা ফুলে ফুলে ভরিয়া উঠিয়াছে৷ গাছে পাতা নাই, কেবলই ফুল৷

সেদিন যে আমার কাঁধের উপর এক ঝলক রক্তের মতো ফুল পড়িয়াছিল—সে কি স্বাভাবিক? এত স্থান থাকিতে আমার কাঁধের উপরই বা পড়িল কেন? তবে কি কোনো অদৃশ্য হস্ত গাছ হইতে ফুল ছিঁড়িয়া আমার গায়ে ফেলিয়াছিল? কে সে? বৃক্ষদেবতা, না আমারই মতো মানুষের দেহ-বিমুক্ত আত্মা? তাই কি? একটা দেহহীন আত্মা—সে আমাকে পাইয়া খুশী হইয়াছে তাহাই কি আকারে ইঙ্গিতে জানাইতে চায়? সে আমার সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করিতে চায়? তাই কি সেদিন ফুল দিয়া আমার সম্বর্ধনা করিয়াছিল?

তবে কি সত্যই প্রেতযোনি আছে? দেহমুক্ত অশরীরী আত্মা? বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু there are more things in heaven and earth–

একটা বিষয়ে ভারি আশ্চর্য লাগিতেছে, ভয় করে না কেন? এই নির্জন স্থানে একলা আছি, এ অবস্থায় ভয় হওয়াই তো স্বাভাবিক৷

১৮ ফেব্রুয়ারি৷ আনমনে দিন কাটিয়া গেল৷ শূন্য বাড়িময় কেবল ঘুরিয়া বেড়াইলাম৷

পশ্চিমী হাওয়া দিতেছে—খুব ধূলা উড়িতেছে৷ গঙ্গার চরের দিকটা বালিতে অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না৷

আজ কিছু ঘটে নাই৷ মনটা উদাস বোধ হইতেছে৷

১৯ ফেব্রুয়ারি৷ দিনটা যেন রাত্রির প্রতীক্ষাতেই কাটিয়া গেল৷ দিনের বেলা কিছু অনুভব করি না কেন?

সন্ধ্যার সময় দেখিলাম পশ্চিম আকাশে সরু একটি চাঁদ দেখা দিয়াছে—যেন অসীম শূন্যে অপার্থিব একটু হাসি৷ অল্পক্ষণ পরেই চাঁদ অস্ত গেল, তখন আবার নীরন্ধ্র অন্ধকার জগৎ গ্রাস করিয়া লইল৷

ইকমিক কুকারে রান্না চড়াইয়া অন্যমনে বসিয়াছিলাম৷ আলোটা সম্মুখের ভাঙা টেবিলে বসানো ছিল৷ অদূরে কতকগুলো ধূপ জ্বালিয়া দিয়াছিলাম, তাহারই সুগন্ধ ধূমে ঘরটি পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল!

আর তো যা-হোক একটা কিছু না পড়িয়া থাকা যায় না৷ বসিয়া বসিয়া সহসা কি মনে হইল, বাক্স হইতে সেই প্রেততত্ত্ব সম্বন্ধে বইখানা বাহির করিয়া পড়িতে আরম্ভ করিলাম৷

গল্প—নেহাত গল্প৷ সত্য অনুভূতির ছায়া মাত্র, এ সব কাহিনীতে নাই৷ আমি যেমন করিয়া তাহাকে অনুভব করিয়াছি, চোখে না দেখিয়াও সর্বাঙ্গ দিয়া তাহার সান্নিধ্য উপলব্ধি করিয়াছি—সেরূপভাবে আর কে প্রত্যক্ষ করিয়াছে?

ইহারা লিখিতেছে, চোখে দেখিয়াছে৷ চোখে দেখা কি যায়? যে আমার কাছে আসে সে কেমন দেখিতে? আমারই মতো কি তার হস্ত পদ অবয়ব আছে? মানুষের চেহারা, না অন্য কিছু?

বই হইতে চোখ তুলিয়া ভাবিতেছি, এমন সময় আমার দৃষ্টির সম্মুখে এক আশ্চর্য ইন্দ্রজাল ঘটিল৷ ধূপের কাঠিগুলি হইতে যে ক্ষীণ ধূমরেখা উঠিতেছিল তাহা শূন্যে কুণ্ডলী পাকাইতে পাকাইতে যেন একটা বিশিষ্ট আকার ধারণ করিতে লাগিল৷ অদৃশ্য কাচের শিশিতে রঙিন জল ঢালিলে যেমন তাহা শিশির আকারটি প্রকাশ করিয়া দেয়, আমার মনে হইল ঐ ধোঁয়া যেন কোনো অদৃশ্য আধারে প্রবেশ করিয়া ধীরে ধীরে আকারত্ব প্রাপ্ত হইতেছে৷ আমি রুদ্ধনিঃশ্বাসে দেখিতে লাগিলাম৷ ক্রমে ধূসর রঙের একটি বস্ত্রের আভাস দেখা দিল৷ বস্ত্রের ভিতর মানুষের দেহ ঢাকা রহিয়াছে, বস্ত্রের ভাঁজে ভাঁজে তাহার পরিচয় পাইতে লাগিলাম৷ ধূমকুণ্ডলী মূর্তি গড়িয়া চলিল৷ আবছায়া মূর্তির ভিতর দিয়া ওপারের দেয়াল দেখিতে পাইতেছি, কিন্তু তবু তাহার ডৌল হইতে বেশ বুঝা যায় যে একটা মানুষের চেহারা৷ ধূম পাকাইয়া পাকাইয়া ঊর্ধ্বে উঠিতে উঠিতে ক্রমে মূর্তির গলা পর্যন্ত পৌঁছিল৷ এইবার তাহার মুখ দেখিতে পাইব৷ কি রকম সে মুখ? বিকট? ভয়ানক? কিন্তু ঠিক এই সময় সহসা সব ছত্রাকার হইয়া গেল৷ জানালা দিয়া একটা দমকা হাওয়া আসিয়া ঐ ধূমমূর্তিকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দিল৷ মুখ দেখা হইল না৷

প্রতীক্ষা করিয়া রহিলাম যদি আবার দেখিতে পাই৷ কিন্তু আর সে মূর্তি গড়িয়া উঠিল না৷

২০ ফেব্রুয়ারি৷ সে আছে, তাহাতে তিলমাত্র সন্দেহ নাই৷ ইহা আমার উষ্ণ মস্তিষ্কের কল্পনা নয়৷ দিনের বেলা সে কোথায় থাকে জানি না, কিন্তু সন্ধ্যা হইলেই আমার পাশে আসিয়া দাঁড়ায়, আমার মুখের দিকে চোখ মেলিয়া চাহিয়া থাকে৷ আমি তাহাকে দেখিতে পাই না বটে, কিন্তু যাহা দেখিতে পাওয়া যায় না তাহাই কি মিথ্যা? বাতাস দেখিতে পাই না, বাতাস কি মিথ্যা? শুনিয়াছি একপ্রকার গ্যাস আছে যাহা গন্ধহীন ও অদৃশ্য, অথচ তাহা আঘ্রাণ করিলে মানুষ মরিয়া যায়৷ সে গ্যাস কি মিথ্যা?

না, আছে৷ আমার মন জানিয়াছে সে আছে৷

২১ ফেব্রুয়ারি৷ কে সে? তাহার স্পর্শ আমি অনুভব করিয়াছি, কিন্তু তাহাকে স্পর্শ করিতে পারি না কেন? ছুঁইতে গেলেই সে মিলাইয়া যায় কেন? সে দেখা দিতে চেষ্টা করে জানি, কিন্তু দেখা দিতে পারে না কেন? রক্তমাংসের চক্ষু দিয়া কি ইহাদের দেখা যায় না?

আমি এখন শয়নের পূর্বে ডায়েরি লিখিতেছি, আর সে ঠিক আমার পিছনে দাঁড়াইয়া আমার লেখা পড়িতেছে—আমি জানি৷ আমার শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে৷ কিন্তু মুখ ফিরাইলে তাহাকে দেখিতে পাইব না—সে মিলাইয়া যাইবে৷

কেন এমন হয়? তাহাকে কি দেখিতে পাইব না? দেখিবার কি দুর্দম আগ্রহ যে প্রাণে জাগিয়াছে তাহা কি বলিব! তাহার এই দেহহীন অদৃশ্যতাকে যদি কোনোরকমে মূর্ত করিয়া তুলিতে পারিতাম৷ কোনো কি উপায় নাই?

২২ ফেব্রুয়ারি৷ কাল রাত্রে সে আসে নাই৷ সমস্ত রাত্রি তার প্রতীক্ষা করিলাম, কিন্তু তবু সে আসিল না৷ কেন আসিল না? তবে কি আর আসিবে না?

নিজেকে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ মনে হইতেছে৷ আমার প্রতি রজনীর সহচর সহসা আমাকে ফেলিয়া চলিয়া গিয়াছে! আর যদি না আসে?

২৩ ফেব্রুয়ারি৷ জানিয়াছি—জানিয়াছি! সে নারী!

এ কি অভাবনীয় ব্যাপার, যেন ধারণা করিতে পারিতেছি না৷ আজ সকালে স্নান করিয়া চুল আঁচড়াইতে গিয়া দেখি, একগাছি দীর্ঘ কালো চুল আমার চিরুনিতে জড়ানো রহিয়াছে৷ এ চুল আমার চিরুনিতে কোথা হইতে আসিল? বুঝিয়াছি—বুঝিয়াছি এ তাহার চুল! সে নারী! সে নারী!

কখন তুমি আমার চিরুনিতে কেশপ্রসাধন করিয়া এই অভিজ্ঞানখানি রাখিয়া গিয়াছ? কি সুন্দর তোমার চুল! তুমি আমায় ভালোবাস তাই বুঝি আমার চিরুনিতে কেশপ্রসাধন করিয়াছিলে? আমার আরসীতে মুখ দেখিয়াছিলে কি? কেমন সে মুখ? তাহার প্রতিবিম্ব কেন আরসীতে রাখিয়া যাও নাই? তাহা হইলে তো আমি তোমাকে দেখিতে পাইতাম৷

ওগো রহস্যময়ী, দেখা দাও! এই সুন্দর সুকোমল চুলগাছি যে তরুণ তনুর শোভাবর্ধন করিয়াছিল, সেই দেহখানি আমাকে একবার দেখাও৷ আমি যে তোমায় ভালোবাসি৷ তুমি নারী তাহা জানিবার পূর্ব হইতেই যে তোমায় ভালোবাসি৷

কেমন তোমার রূপ? যে শিমুলফুল দিয়া প্রথম আমায় সম্ভাষণ করিয়াছিলে, তাহারই মতো দিক-আলো-করা রূপ কি তোমার? তাই কি নিজের রূপের প্রতিচ্ছবিটি সেদিন আমার কাছে পাঠাইয়াছিলে? অধর কি তোমার অমনই রক্তিমবর্ণ, পায়ের আলতা কি উহারই রঙে রাঙা?

কেমন করিয়া কোন ভঙ্গিতে বসিয়া তুমি আমার চিরুনি দিয়া চুল বাঁধিয়াছিলে? কেমন সে কবরীবন্ধ? একটি রঙরাঙা শিমুলফুল কি সেই কবরীতে পরিয়াছিলে?

আমার এই ছত্রিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত কখনো আমি নারীর মুখের দিকে চোখ তুলিয়া দেখি নাই৷ আজ তোমাকে না দেখিয়াই তোমার প্রেমে আমি পাগল হইয়াছি৷ ওগো অশরীরিণী, একবার রূপ ধরিয়া আমার সম্মুখে দাঁড়াও৷

২৪ ফেব্রুয়ারি৷ তাহার প্রেমের মোহে আমি ডুবিয়া আছি৷ আহার-নিদ্রায় আমার প্রয়োজন কি! আমার মনে হইতেছে এই অপরূপ ভালোবাসা আমাকে জর্জরিত করিয়া ফেলিতেছে, আমার অস্থি-মাংস-মেদ-মজ্জা জীর্ণ করিয়া জঠরস্থ অম্লরসের মতো আমাকে পরিপাক করিয়া ফেলিতেছে৷ এমন না হইলে ভালোবাসা?

২৫ ফেব্রুয়ারি৷ আজ সকালে হঠাৎ মালীটার সঙ্গে দেখা হইয়া গেল, তাহাকে গালাগালি দিয়া তাড়াইয়া দিয়াছি৷ মানুষের মুখ আমি দেখিতে চাই না৷

সমস্ত দিন কিছু আহার করি নাই৷ ভালো লাগে না—আহারে রুচি নাই—তা ছাড়া রান্নার হাঙ্গামা অসহ্য৷

গরম পড়িয়া গিয়াছে৷ মাথার ভিতরটা ঝাঁ-ঝাঁ করিতেছে৷ কাল সারারাত্রি জাগিয়াছিলাম৷

কিন্তু তাহাকে দেখিতে পাইলাম না৷ সে কাল আমার পাশে আসিয়া শুইয়াছিল৷ স্পষ্ট অনুভব করিয়াছি, তাহার অস্পষ্ট মধুর দেহ-সৌরভ আঘ্রাণ করিয়াছি৷ কিন্তু তাহাকে ধরিতে গিয়া দেখিলাম শূন্য—কিছু নাই৷ জানি সে আমার চোখে দেখা দিবার জন্য, আমার বাহুতে ধরা দিবার জন্য আকুল হইয়া আছে, কিন্তু পারিতেছে না৷ তাহার এই ব্যর্থ আকুলতা আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতেছি৷

মধ্যরাত্র হইতে প্রভাত পর্যন্ত খোলা আকাশের তলায় পায়চারি করিয়াছি, সেও আমার পাশে পাশে বেড়াইয়াছে৷ তাহাকে বার-বার জিজ্ঞাসা করিয়াছি, কি করিলে তাহার দেখা পাইব৷ সে উত্তর দেয় নাই—কিংবা তাহার উত্তর আমার কানে পৌঁছায় নাই৷

সকাল হইতেই চলিয়া গেল৷ মনে হইল, ঐ রক্তরাঙা শিমুলগাছটার দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল৷

চর্মচক্ষে তাহাকে দেখিতে পাওয়া কি সম্ভব নয়?

২৬ ফেব্রুয়ারি৷ না, রক্তমাংসের শরীরে তাহাকে পাইব না৷ সে সূক্ষ্মলোকের অধিবাসিনী৷ স্থূল মর্ত্যলোক হইতে আমি তাহার নাগাল পাইব না৷ আমার এই জড়দেহটাই ব্যবধান হইয়া আছে৷

২৭ ফেব্রুয়ারি৷ আহার নাই, নিদ্রা নাই৷ মাথার মধ্যে আগুন জ্বলিতেছে৷ আয়নায় নিজের মুখ দেখিলাম৷ এ কি সত্যিই আমি—না আর কেহ?

আমি তাহাকে চাই, যেমন করিয়া হোক চাই৷ স্থূল শরীরে যদি না পাই—তবে—

২৮ ফেব্রুয়ারি৷ হাঁ, সেই ভালো৷ আর পারি না৷

শিমুলগাছের ডালটা কূপের মুখে ঝুঁকিয়া আছে, তাহাতে একটা দড়ি টাঙাইয়াছি৷ আজ সন্ধ্যায় যখন তাহার আসিবার সময় হইবে—তখন—

সখি, আর দেরী নাই৷ আজ ফাগুনের সন্ধ্যায় যখন চাঁদ উঠিবে, তুমি কবরী বাঁধিয়া প্রস্তুত হইয়া থাকিও৷ তোমার রক্তরাঙা ফুলের থালা সাজাইয়া রাখিও৷ আমি আসিব৷ তোমাকে চক্ষু ভরিয়া দেখিব৷ আজ আমাদের পরিপূর্ণ মিলনরাত্রি—

বরদা আস্তে আস্তে ডায়েরি বন্ধ করিয়া বলিল,—এখানেই লেখা শেষ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *