অল্পে তুষ্ট

অল্পে তুষ্ট

০১.

আমার পরিচিত জনৈক সমাজসেবী ভদ্রসন্তান রাত করে বাড়ি ফিরছিলেন। শরট কট করার জন্য যে গলি ধরেছিলেন সেটা প্রায় বস্তি অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে এসেছে। হঠাৎ শুনতে পেলেন, পরিত্রাহি চিৎকার– যা এ অঞ্চলে রাতবিরেতে আকছারই শোনা যায়। সমাজসেবীটি একটু কান পাততেই বুঝতে পারলেন, যুগ যুগ ধরে সমাজ স্বামীকুলকে যে হক দিয়েছে এস্থলে সে কুলেরই জনৈক বস্তি-সন্তান সেটি তার স্ত্রীর উপর কিঞ্চিৎ পশুবলসহ প্রয়োগ করছে। এস্থলে সুবুদ্ধিমান মাত্রই তিলার্ধ কাল নষ্ট করে না, কিন্তু আমাদের সমাজসেবীটি একালের যারা সেবার নামে মস্তানি করে তাদের দলে পড়েন না। দরমার ঝাঁপ ধাক্কা মেরে খুলে হুঙ্কার ছাড়লেন, ব্যস, থামো। এসব কী বেলেল্লাপনা হচ্ছে। আমাদের পাবৃলিক স্পিরিটেড ইয়ংম্যানটি নাটকের এর পরের দৃশ্যে অবশ্যই আশা করেছিলেন সেই অবলা মুক্তি পেয়ে তার সামনে নতজানু হয়ে অঝোরে কৃতজ্ঞতাশ্রু ঝরাবে, এবং তিনিও তার দক্ষিণ হস্ত দ্বারা অদৃশ্য বাতাসের একাংশ অবহেলে দ্বিখণ্ডিত করে, বিলক্ষণ, বিলক্ষণ (ইংরেজিতে যাকে বলে নটেটোলনটেটোল) বলতে বলতে আত্মপ্রসাদাৎ ডগমগ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। ও হরি। কোথায় কী? স্বামী-স্ত্রী দু-জনাই প্রথমটায় একটুখানি থতমতিয়ে তার পর বিপুল বিক্রমে হামলা করল তার দিকে। তিনি প্রায় পালাবার পথ পান না। ইতোমধ্যে বস্তির আরও দু-পাঁচজন জড়ো হয়ে গিয়েছে। সমাজসেবী সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন ওদেরও দরদ যুযুধান দম্পতির প্রতি।

এটা কিছু একটা উটকো ফ্যাচাং নয়। পরবর্তী যুগে আমি দেশবিদেশে এস্তেক অতিশিক্ষিত মধ্য ও পশ্চিম ইয়রোপেও এহেন কীর্তন একাধিকবার শুনেছি। দু-জনার কাজিয়া মেটাতে গিয়েছ কি মরেছ। দু-জনা একজোট হয়ে তোমাকে মারবে পাইকিরি কিল।

এ তো গেল সাদামাটা পশুবল প্রয়োগের বর্বরতা ঠেকাবার প্রচেষ্টা। কিন্তু যে স্থলে দুই পক্ষই সাতিশয় শিক্ষিত বলতে কী, যেন দেশমাতৃকার উচ্চতম অনবদ্য শিক্ষিত সন্তান এবং যা হচ্ছে সেটি মার্জিততম বাকযুদ্ধ, সেস্থলেও আপনি যদি ফৈসালা করে দিতে চান তবে ফল একই। উভয়পক্ষ একে অন্যের প্রতি নিক্ষিপ্ত আপন আপন বাক্যবাণ তন্মুহূর্তেই সংবরণ করে আপনাকে করে তুলবেন এজমালি চাঁদমারির টারগেট।

এ তো হল সে-দুর্দৈবের কীর্তন যে স্থলে আপনার নিজস্ব আপন বিশ্বাস অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তৃতীয় মত আপনি পোষণ করেন না; আপনি সে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক সুবিবেচনাসহ প্রণিধান করে সুলে-সুপারিশসহ একটা মধ্যপন্থা বাতলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যেস্থলে আপনি তৃতীয় মত পোষণ করেন সেখানে– ঈশ্বর রক্ষতু!–আপনার অকালমৃত্যু অনিবার্য।

ভূমিকাটি আমার অনিচ্ছায় দীর্ঘ হয়ে গেল, কিন্তু প্রয়োজনাতীত বৃহল্লাঙুল নয়। কারণ ভবিষ্যতেও বহু-বহুবার বহু বাদানুবাদের সম্মুখে আমাকে ঠিক এইভাবেই সরকারি প্রাণ (আজকালে ফ্যামিলি প্ল্যানিঙের জমানায় ওটা আর পৈতৃক নয়, এবং জন্মের পরও দুগ্ধাভাবে, অন্নাভাবে ওটা সরকারের হাতেই সমর্পিত) হাতে নিয়ে এগোতে হবে।

***

একদল গুণীজ্ঞানী বলছেন প্রত্যেক আমি প্রত্যেক শব্দটির ওপর বিশেষ জোর দিতে চাই– অধমের যা কিছু বক্তব্য সে ওই প্রত্যেক (বা তাবত্, কুল্লে) শব্দটি নিয়ে ছাত্রটিকে শিখতে হবে নিদেন দুটি ভাষা। কেউ কেউ বলেন, সে শিখবে (ক) আপন মাতৃভাষা ও ইংরেজি, কেউ কেউ বলেন (খ) মাতৃভাষা এবং হিন্দি। এঁরা ইহলোকের তাবল্লোককে দোভাষী বানাতে চান– একেবারে শব্দার্থে নয় (ইহসংসারে কটা লোকের মাত্র একবারের তরেও প্রফেশনাল দোভাষীর প্রয়োজন হয়?}, ভাবার্থে। তফাত এঁদের মধ্যে এইটুকু : একদল মাতৃভাষা ও তদুপরি ইংরেজি শেখাতে চান, অন্য দল ইংরেজির বদলে হিন্দি। (আর যাদের মাতৃভাষাই হিন্দি তাঁদের কী হবে? সেটা এখনও স্থির হয়নি। তাঁরাই স্থির করবেন। অবশ্যই। কই সে মরদ যার মাতৃভাষা হিন্দি নয় এবং তৎসত্ত্বেও সে হিন্দিভাষীদের সামনে কোনও বাত্ প্রস্তাবও করবে? হায়, আপসোস! কেন হিন্দিভাষী হয়ে জন্মালুম না?)

এ তো গেল দোভাষীর দল।

অন্য দল ত্রিভাষী। এঁরা বলেন, অত ঝগড়া-ফ্যাসাদের কী প্রয়োজন? বিদ্যার্থী তিনটে ভাষাই শিখবে। (গ) মাতৃভাষা, হিন্দি এবং ইংরেজি অর্থাৎ মাতৃভাষা শিখতেই হবে, তার পর কেউ বলছেন সেকেন্ড ল্যানগুইজ হবে হিন্দি, কেউ বলছেন, না, ইংরেজি, আর এই ত্রিভাষীর দল মাতৃভাষা তো খাবেনই, তদুপরি ডুডুও খাবেন, টামাকও খাবেন।

এই দোভাষী ও ত্ৰিভাষীতেই ঝগড়া।

এ ছাড়া আরও বহুবিধ আছেন। যেমন কেউ কেউ বলেন, ভারতীয় সংস্কৃতি, বৈদগ্ধ্য সভ্যতার প্রধান ভাণ্ডার সংস্কৃতে। সেই সংস্কৃতই যদি বিদ্যার্থী না শিখল তবে সে নিজেকে ভারতীয় বলে কোন মুখে? যে বেদ উপনিষদ ষড়দর্শন নিয়ে আমরা নিজে গর্ব অনুভব করি, বিশ্বজনের সামনে তুলে ধরি, সেসবই তো সংস্কৃতে। এবং এই সংস্কৃতই একমাত্র বিদগ্ধ ভাষা যে ভাষা একদা আসমুদ্র হিমাচল আর্য-অনার্য সকলকে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করে রেখেছিল। আজ যদি আমরা সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় আমাদের কারিকুলামে সংস্কৃতকে স্থান না দিই এবং ফলে তার মৃত্যু ঘটে তবে ঐতিহ্যবিহীন হটেন্টটে ও ভারতীয়তে একদিন আর কোনও পার্থক্য থাকবে না। যুক্তিগুলো যে খুবই সত্য এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ সম্প্রদায় রণাঙ্গন থেকে ক্রমেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। সংগ্রামে পরাজিত হওয়ার ফলে নয়। কারণ এঁদের বিরুদ্ধে কেউই সংগ্রাম ঘোষণা করে না– দেশের কর্তাব্যক্তিরা এদের সে অবহেলা করে, just by ignoring এদের hors de combat, রণাঙ্গন থেকে অপসারিত করেন। কারণ সংস্কৃত বাবদে এইসব কর্তাব্যক্তিদের বৃহত্তমাংশ ১০০% ignoramus 1… এরই পিঠ পিঠ মুসলমানরা বলেন, তাজমহল (কোনও মারকিন টুরিস্ট যখন তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে কোনও ভারতীয় হিন্দুকে ওই ইমারতের প্রশংসা করে অভিনন্দন জানায় তখন সে তো মুখ বাঁকিয়ে বলে না, না মশাই এটা আমার দেশের মাটিতে আছে বটে কিন্তু আমার ঐতিহ্যগত সম্পদের অংশ নয়, এটা মোচলমানদের ইউ আর বারকিং আপ দি রঙ ট্রি!), মোগল চিত্রকলা, খেয়াল, ঠুংরি, ফারসিতে লিখিত ভূরি ভূরি ইতিহাসাদি অমূল্য গ্রন্থরাজি ভারতীয় সংস্কৃতির অংশবিশেষ এদের সম্যক চর্চার জন্য ফারসি শেখানো উচিত, এবং ধর্মচর্চার জন্য যে আরবি ভাষা শিক্ষা ভিন্ন নান্য পন্থা বিদ্যতে সে তো স্বতঃসিদ্ধ। সংস্কৃতওলাদের মতো এরাও বারোয়ারিতে কল্কে পান না–উপরে উল্লিখিত একই কারণে …এর পরে আছেন জৈন ধর্মাবলম্বী। এদের ধর্মগ্রন্থ অর্ধমাগধীতে। পার্সিদের ধর্মগ্রন্থ প্রধানত আবেস্তার প্রাচীন পারসিকে। এদেশে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর সংখ্যা নগণ্য কিন্তু তাদের শাস্ত্রীয় ভাষা পালিকে নিরঙ্কুশ উপেক্ষা করলে আমরা বৃহত্তর ভারতে মুখ দেখাতে পারব না। আমার এ নগণ্য জীবনে যে দুটি বিদেশির সঙ্গে আমি একই ডরমিটরিতে কিছুকাল বাস করি তাদের উভয়ই ছিলেন সিংহলের বৌদ্ধ শ্ৰমণ। শ্ৰমণ ধর্মপাল ও শরণাঙ্কর : এদেশে এসেছিলেন পালি ও সংস্কৃত অধ্যয়নের জন্য। এছাড়া শ্যামের রাজগুরুও বার্ধক্যে এদেশে এসেছিলেন তথাগতের আপন দেশে নির্বাণ লাভার্থে। হিন্দুর বার্ধক্যে বারাণসির ন্যায় … এবং আছেন খ্রিস্টসম্প্রদায়, যদ্যপি বাইবেলের আদিমাংশ (পূর্ব মীমাংসাঃ) হিবরুতে ও নবীনাংশ (উত্তম মীমাংসাঃ) গ্রিকে, তথাপি খ্রিস্টানদের সর্বজনমান্য বাইবেলের অনুবাদ ভুলগাতে লাতিন ভাষায়। লাতিন ভিন্ন খ্রিস্ট পাদরির শিক্ষাদীক্ষা অসম্পূর্ণ।

হালফিল বিজ্ঞানের জয়জয়কার! এ বিদ্যা ষোল আনা রপ্ত করতে হলে নাকি জরমন ভাষা অবর্জনীয়।

অতি অবশ্য এখানে একটি কথা বলে রাখা উচিত। নিতান্ত কট্টর ভিন্ন কোনও মহামহোপাধ্যায়ই বিধান দেন না যে সর্ববিদ্যার্থীকে ঘাড়ে ধরে সংস্কৃত শেখাতে হবে, কট্টর ভিন্ন কোনও মোল্লা বল্লোকের কল্লা ধরে বিসমিল্লা শেখাতে চায় না। প্রাগুক্ত দোভাষী এবং ত্রিভাষীরা কিন্তু যেসব ভাষা শেখাতে চান, সেগুলো ঘাড়ে ধরে শেখাতে চান। অতএব এই ভাষার রেস্-এ সংস্কৃত ফারসি পালিওয়ালাদের উপস্থিত also ran বলে খারিজ করে দেওয়া যেতে পারে। আমি শুধু নির্ঘণ্ট নিরঙ্কুশ করার জন্য এদের উল্লেখ করলুম।

***

কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী শ্রীযুক্ত ত্রিগুণা সেন আসলে বৈজ্ঞানিক বটে, কিন্তু হিউম্যানিটিজেও তার আবাল্য অনুরাগ। তদুপরি তার কমনসেন্স আছে। অতএব তিনি সার্থকনামা ত্রিগুণধারী (সেন-এর বহুবচন সেন্স বা sense)।

দোভাষী-ত্রিভাষীদের সামনে আরেকটি জীবনমরণ সমস্যা : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম কী হবে? ইংরেজি, হিন্দি, আঞ্চলিক ভাষা– তিনটেরই সমর্থক আছেন।

এই সুবাদে আঞ্চলিক ভাষার সমর্থন করতে গিয়ে শ্রীসেন বলেন (হুবহু বাক্যগুলো আমার মনে নেই বলে শ্রীসেন তথা পাঠকের প্রতি যদি অবিচার করে ফেলি তবে কোনও সজ্জন যেন আমার মেরামতি করে দেন), পৃথিবীর কোন সভ্য স্বাধীন দেশে মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়? শিক্ষামন্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে আমাদের নিবেদন :

একশো বছরও হয়নি কবি হেম বাঁড়ুয্যে লিখেছিলেন–

চীন ব্রহ্মদেশ অসভ্য জাপান।
তারাও স্বাধীন, তারাও প্রধান।

 সেই জাপানেও কি কখনও জাপানি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়েছে? বস্তুত পাঠক প্রত্যয় যাবেন না, মাত্র কিছুদিন হল ক্যান্সার রোগের এক স্পেশূলিস আমাকে বলেন, ওই রোগের গবেষণা জাপানে যা হয়েছে সেটা না জেনে সে সম্বন্ধে আপটুডেট হওয়া যায় না। এবং ওর সবকিছুই হয় জাপানি ভাষাতে।… কিন্তু অত দূরে যাবার কী প্রয়োজন? আফগানিস্তানের জনসংখ্যা কত? দেশটা কি খুবই মডারুন? না তো। আমি যখন সেদেশে পৌঁছই (১৯২৭) তখন সেখানে সবে প্রথম কলেজের প্রথম বর্ষ আরম্ভ হব-হব করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অরুণোদয় হতে ঢের ঢের দেরি। অথচ পরের বছর যখন ওই ফার্স্ট ইয়ার চালু হল তখন তার মাধ্যম হল ফারসি। কিন্তু বৃথা বাক্যব্যয়। পাঠক একটু অনুসন্ধান করলেই জানতে পারবেন ক্ষুদ্র ফিনল্যান্ডই বলুন আর বলিভিয়াই বলুন, শিক্ষার বাহন সর্বত্রই মাতৃভাষা।

***

এইবারে আমরা পৌঁছলুম রণাঙ্গনের কেন্দ্রভূমিতে।

এই যারা দোভাষী-ত্রিভাষী হয় ইংরেজি নয় হিন্দি কিংবা উভয়ই নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করছেন তাঁদের শুধোই–শিক্ষামন্ত্রীর মন্ত্র এবং যন্ত্রের সঙ্গে টায় টায় গলা মিলিয়ে পৃথিবীর কোন সভ্য স্বাধীন দেশে ক-জন উচ্চশিক্ষিত লোক মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য একটি ভাষা– উত্তমরূপে না হোক মধ্যম বা অধমরূপেই— জানে?

আমি জনপদবাসী বা নগরের অর্ধশিক্ষিতদের কথা তুলছিনে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রীতিমতো বিএ পাস করেছে, তাদেরই ক-জন মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য আরেকটি ভাষা পড়তে পারে, শুনলে বুঝতে পারে, লিখতে পারে এবং মোটামুটি সাদামাটা কথাবার্তা বলতে পারে? বলা বাহুল্য, যারা কোনও বিদেশে বেশ কিছুকাল কাটিয়েছে তাদের কথা হচ্ছে না। সেস্থলে সম্পূর্ণ অশিক্ষিত লোকও বিদেশি ভাষা অনেকখানি রপ্ত করে ফেলে আপন আপন মেধা অনুযায়ী।

এদেশের কথাও হচ্ছে না। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি মাত্র সেদিন। যদ্যপি এই কুড়ি বছরেই আমরা কী তীব্র গতিতেই না ইংরেজির খোলস বর্জন করছি– এ বর্জনের জন্য কোনও মেহনত-কেরামতি করতে হয় না, আমাদের চৌকশ গোপখেজুরে আলস্যই এর পরিপূর্ণ ক্রেডিট পায়।(১) এবং এই দেশেই প্রায় সাতশো বছর ফারসি ছিল স্টেট ল্যান্গুইজ– সেইটে একদম পালিশ করে ভুলতে আমাদের একশো বছরও লাগেনি।

ফরাসি দেশের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির কত পারসেন্ট ইংরেজি বই পড়তে পারে? বলতে পারে? এক পারসেন্টও না। মারকিন উচ্চশিক্ষিত লোক– স্কুল-কলেজে আট বছর ফরাসি শিখেছে–ক পারসেন্ট ফরাসি পড়তে-বলতে পারে? ঠিক বিএ পাসের পর? তার দশ বছর পর?

অর্থাৎ স্বাধীন দেশের শিক্ষিত লোককেও দোভাষী করা যায় না। এটা একটা ফ্যাশান স্কুল-কলেজে সেকেন্ড ল্যানগুইজ পড়ানো।

পেটের ধান্ধায় অনেকে দোভাষী হয়– স্কুলে না গিয়েও। মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী তামাম আসাম চষে খায়। ও! মারওয়াড়ের গ্রামে গ্রামে বুঝি সুবোম স্কুলে স্কুলে আসামি ভাষার দিগগজ পণ্ডিত বানানো হয়।

তাই বলি, দোভাষী-ত্রিভাষী– এদেশের শিক্ষিত লোকও হবে না। থাকবে একভাষী। এবারে দোভাষী-লিভাষীর দল আপসের চুলোচুলি ভুলে গিয়ে একজোট হয়ে আমাকে আমি, একভাষীকে মারবেন পাইকিরি কিল। এখন বলুন, আমার ভূমিকাটি কি অতি দীর্ঘ হয়েছিল?

.

০২.

ব্যক্তি-বিশেষের বেলা পুরুষকারই যেরকম শেষ কথা নয়, একটা জাতি বা দেশের বেলাও তাই। আমরা যতই ভেবেচিন্তে পারলিমেনটে তর্কাতর্কি করে, কাগজে কাগজে পাবলিসিটি দিয়ে আটঘাট বেঁধে একটা প্রোগ্রাম বা প্ল্যান চালু করি না কেন, শেষ পর্যন্ত তার ফল যে কী উতরাবে সে সম্বন্ধে আগের থেকে দৃঢ়নিশ্চয় হওয়া যায় না। একটা দেশের ধর্ম, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এগুলো এমনই বিরাট বিরাট ব্যাপার যে এগুলোকে মানুষ আদৌ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কি না সে নিয়ে আমার মনে গভীর সন্দেহের উদয় হয়; মনে হয় কী যেন এক অদৃশ্য নিয়তি মানবসমাজকে শাসন করে চলেছে, তার ওপর আমাদের কর্তৃত্ব যদি-বা থাকে সে অতিশয় যৎসামান্য। তা হলে প্রশ্ন উঠবে, এসব বিষয় নিয়ে আমাদের কি তবে চিন্তা করবার কিছুই নেই? অন্ধ নিয়তিই সব? তার নাম অদৃষ্ট, কর্মফল, কিসমতু যে নামেই তাকে ডাকুন।

হজরত মুহম্মদ একদিন বেদুইনদের সামনে পুরুষকার ও অদৃষ্ট সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়ার পর এক বেদুইন তাঁকে শুধাল, তবে কি, হজরত, উটগুলোকে আমরা দড়ি দিয়ে না বেঁধে আল্লার ভরসায় (কিসমতের ওপর ছেড়ে দেব? হজরত বললেন, না, দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে তার পর আল্লার ওপর ভরসা রাখবে। অর্থাৎ আমরা আটঘাট বেঁধে যতই প্ল্যানিং করি না কেন, সকালবেলা বেদুইনের মতোই হয়তো দেখব, উট হাওয়া, প্ল্যান ভণ্ডুল। কিন্তু তবু উট বাঁধতে হয়, প্ল্যানিং করতে হয়।

বৌদ্ধধর্মও নাকি বলেন, মানুষের জীবন নদীস্রোতে নিচের দিকে চলমান গাছের গুঁড়ির মতো; ধাক্কাধাক্কি করে সেটাকে খানিকটে ডাইনে-বাঁয়ে সরানো যায় কিন্তু স্রোতের উল্টোদিকে চালানো যায় না।

এবং কার্ল মারও নাকি বলেছেন, ইতিহাসের নিয়তি নানা সামাজিক প্যাটার্ন পরিবর্তন করতে করতে সর্বশেষে প্রলেতারিয়া-রাজ আনবেই আনবে। মানুষ সজ্ঞানে আপন চেষ্টা দ্বারা তার গতি দ্রুততর করে দিতে পারে মাত্র।

অতএব তর্কবিতর্ক করি, চেষ্টা দিই– কিন্তু জানি, শিক্ষার্থী আজ দোভাষীই হোক, আর ত্ৰিভাষীই বলুক আখেরে সে একটি ভাষাই শিখবে, তাই দিয়ে জ্ঞানার্জন করবে, কাজকর্ম চালাবে।

পাঠককে ফের বলছি, এখানে আমি বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলছি। অর্থাৎ জোর করে দেশের তাবৎ স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীকে দুটো বা তিনটে ভাষা শেখাবার চেষ্টা পণ্ডশ্রম। তারা নিছক পরীক্ষা পাস করার জন্য ভাষা শিখবে কিন্তু পরবর্তী জীবনে দ্বিতীয় বা/এবং তৃতীয় ভাষার চাবি দিয়ে ওইসব ভাষার জ্ঞানভাণ্ডার খুলে ওই জ্ঞান জীবনে সঞ্চারিত করে চিন্তাধারাকে বহুমুখী করবে না– অথচ বিদেশি ভাষা শেখার প্রধান উদ্দেশ্য তো ওইটেই।

এবারে একটা উদাহরণ নিই।

নরমানরা ইংল্যান্ড জয় করে সেখানে চালাল ফরাসি ভাষা। শুধু যে রাজদরবারেই ভাষা ফরাসি হয়ে গেল তাই নয়, শিক্ষাদীক্ষার বাহন, সংস্কৃতি বৈদগ্ধের মাধ্যম, নাট্যশালা সঙ্গীতের ভাষা– সবকিছুই তখন ফরাসি এবং ফরাসির মাধ্যমে তার জননী লাতিন। পাকা তিনশোটি বছর চলল ফরাসি ভাষার একচ্ছত্রাধিপত্য। ইংরেজিতেও যে কোনও প্রকারের চিন্তা বা অনুভূতি প্রকাশ করা যায় সেকথা দেশের ভদ্রজন সম্পূর্ণ ভুলে গেল। ফরাসি ভাষা নাকি আল্লাতালা স্বয়ং এমনই মধুর পরমপ্রিয় করে নির্মাণ করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি (এদেশেও আমরা সংস্কৃতকে দেবভাষা খেতাব দিয়েছি এবং সন্ত তুকারাম তাই বক্রোক্তি করেছিলেন, সংস্কৃতি যদি দেবভাষা হয়, মারাঠি কি তবে চোরের ভাষা?।… পুরো তিনশোটি বছর পর ইংল্যান্ডের রাজার মাতৃভাষা আবার হল ইংরেজি কিন্তু হলে কী হয়, ফরাসি যদিও ক্রমে ক্রমে হটে যেতে লাগল তবু দেখা যাচ্ছে এই সেদিন–১৭ শতাব্দী অবধি আইন-আদালতের ভাষা ছিল ফরাসি।(২)

ইংরেজি একদিন পদ পেল বটে, তাই বলে কি ফরাসি কর্তার ভূত কাঁধ থেকে অত সহজে নামে? ইংল্যান্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত M. Ed.-রা বলতে পারবেন কবে বিলেত থেকে ফরাসি কমপালসরি সবজেকটরূপে লোপ পেল। কিন্তু তার পরও, আজ অবধি, ওই ফরাসি অপশনাল হিসেবে পড়াবার জন্য বিলেত প্রতি বছর কত খরচা করে?

এবং আজও ইংরেজ মুখে ফরাসিকে নিয়ে যতই মশকরা করুক না কেন, জেবে দুটো কড়ি জমামাত্রই হলিডে করার জন্য পরানভয়ে হরিণের মতো ছুট লাগায় প্যারিস পানে– মনে আশা সেইসব কুকীর্তি করবে, যেগুলো আপন দেশে করা যায় না–সিম্পলি নট ডান্। ইংরেজি সাহিত্য যে ফরাসি সাহিত্যের কাছে কতখানি ঋণী তার জরিপ করা আমার কর্ম নয়। শব্দবিদ না হয়েও বেপরোয়া আন্দাজে বলি, ইংরেজির শতকরা নব্বইটি চিন্ময় শব্দ (আবস্ট্রাক্ট ভকাবুলারি) হয় ফরাসি নয় ওরই মারফত লাতিন গ্রিক থেকে নেওয়া।

আরও কত শত বাবদে আজও ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য, রান্নাবান্না (মেনুটা এখনও ৮০% ফরাসিস; বিফ, মাটন, পর, ভিল, ভেজ = গরু, ছাগল, শুয়োর, বাছুর, হরিণের মাংস– সবকটা শব্দ ফরাসি থেকে এসেছে), আদব কায়দা (R. S. V. P থেকে P PC), মদ্যাদি (কন্যাক থেকে শ্যামপেন) ফরাসির কাছে ঋণী বস্তুত বিলেতে, আজও সভ্যতা ভদ্রতার কোন না বস্তু ফরাসি প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল বা আছে?

***

একদা কতিপয় শিক্ষাবিদ ইংরেজের মনে প্রশ্ন জাগল, সেই যে আমরা ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য শেখানোর জন্য আমাদের দেশে প্রায় হাজার বছর ধরে এত টাকা ঢেলেছি, দেখি তো, তার ফলটা কী হয়েছে? জনৈক ফরাসি ভদ্রলোককে নাবানো হল লন্ডনের রাস্তায়। যারই বেশভূষা আচার-আচরণ দেখে মনে হল লোকটি মার্জিত উচ্চশিক্ষিত তাকেই ফরাসি ভদ্রলোক ফরাসিতে শুধলো, আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, বলতে পারেন, কোনদিকে গেলে সবচেয়ে কাছের টুব স্টেশনে পৌঁছব? কথিত আছে ৯৩ না ৯৭ নম্বরের ভদ্রলোক প্রশ্নটা বুঝতে পারলেন বটে কিন্তু ফরাসিতে উত্তর দিতে পারলেন না। ১০৩ না ১০৭ নম্বরের জনা বুঝি কোনওগতিকে অতি ভাঙা-ভাঙা ফরাসিতে উত্তরটা দিলেন।

এর পর আরও নানা উদাহরণ, নানা যুক্তি দেখিয়ে প্রাগুক্ত গবেষকগণ অতিশয় ন্যায্য প্রশ্ন শুধিয়েছেন, তা হলে ওই পোড়ার ফরাসি শেখাবার জন্য এদেশে অত কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালার কী প্রয়োজন?

***

এ বিষয়টি আরও সবিস্তর আরও উদাহরণ দিয়ে গুছিয়ে বলতে হয়। আমার শক্তি অতিশয় সীমাবদ্ধ। তদুপরি যখন জানি, যা হবার তা হবেই, তখন কেমন যেন উৎসাহের অভাবে কলমের কালি শুকিয়ে যায়। তবু লিখছি, এলোপাতাড়ি হাবিজাবি বিস্তর বেহুদা এক্সপেরিমেন্ট করার পর মার খেয়ে খেয়ে যখন মাত্র একটি ভাষাই বাধ্যতামূলক করা যায় এ তত্ত্বটি আবিষ্কার করব, যা অন্যান্য স্বাধীন দেশ করে ফেলেছে, তখন কেউ যেন না বলে, এ যুগের, অর্থাৎ আমাদের বর্তমান যুগের লোকের বিন্দুপরিমাণ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা শক্তি ছিল না।

ইংরেজি তো এদেশে একশো বছর ধরে কমপালসারি ছিল। ইংরেজি শিখলে আর্থিক সামাজিক উন্নতি হবে বলেই লোকে ইংরেজি শিখেছে। জ্ঞানার্জন করে চিত্তপ্রসারের জন্য ইংরেজি শিখেছে একথা বললেও আমি বিশ্বাস করব না। এখন বলুন কটা লোক অবসর সময় ইংরেজি বই পড়ে, ইংরেজি বই কেনে? এ তো সাধারণ জনের কথা, কিন্তু প্রত্যয় যাবেন না, আমার পরিচিত একটি ছোকরা ইংরেজির লেকচারার সর্বক্ষণ বাঙলা বাঙলা করছে, রবীন্দ্রসাহিত্যে তার সুন্দর দখল, কৌতূহল প্রশংসনীয়। ওদিকে ইংরেজির বেলা সেখানে পড়াশুনো করে আরও চৌকশ হবার কোনও চাড় নেই। জানে যেটুকু ইংরেজি রপ্ত আছে সেইটে ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে সে একদিন রিডার ও যথারীতি প্রফেসরও হবে।

এই সেমি-কমপালসরি সংস্কৃত, ফারসি, আরবি (বা পালি লাতিন) নিন। সায়েনসে সিট পায়নি বলে, বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, প্রায় অনিচ্ছায় বিএ পাসের সময় সংস্কৃত ছিল। হয়তো-বা অনার্সও ছিল। তাদেরও কজনকে আপনি অবসর সময় সংস্কৃত (বা ফারসি) পড়তে দেখেছেন, তার শেলফে নতুন কেনা সংস্কৃত বই দেখেছেন? ফারসি তো অতি সরল ভাষা– কজন ফারসি অনার্সওলা গ্রাজুয়েট ফারসি আউট-বুক পড়ে?

অবশ্য যারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় দুই বা তিনটি ভাষা শেখেন– বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, তাঁদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। অধ্যাপক সত্যেন বোস স্বেচ্ছায় ফরাসি-জরমন শিখেছেন। এখনও ওই দুই ভাষায় বই পড়েন।

***

অগুনতি দফে প্রশ্ন শুনতে হয়েছে, ইংরেজিতেই চলবে তো? অন্য কোনও ভাষা না জানলেও চলবে–না? কনটিনেনটে তো সবাই ইংরেজি বোঝে না?

হু, বোঝে। খুব বোঝে! তবে শুনুন। গল্পটি অবশ্য প্যারিস সংক্রান্ত নয়– যদিও খুদ প্যারিসেরই কোনও একটা মুদির দোকানে তেল-নুন কেনার চেষ্টা করে দেখুন না ইংরেজির মারফত তবে এটি পৃথিবীর যে কোনও জায়গা সম্বন্ধে প্রযোজ্য, সেটা পৃথিবী প্রদক্ষিণ না করেও বলা যায়।

প্রভাঁসের একটি দোকানের সামনে বেশ মোটা মোটা হরফে লেখা : ENGLISH SPOKEN। এটার উদ্দেশ্য মারকিন টুরিস্টকে আকর্ষণ করা। ইংরেজকে নয়। কারণ ফরাসি জাত বিস্তর মার খেয়ে খেয়ে ভালো করেই জানে, ইংরেজ কিপটেমিতে প্রায় তাকেও হার মানায় এবং জাতটার আগাপাশতলা বেনেদের হাড্ডি দিয়ে তৈরি বলে দোকানের প্রত্যেকটি জিনিসের পাইকিরি ভাও, খুচরো দর, কমিশন, সেল ট্যাক্স দফে দফে জানে। তা সেকথা থাক গে … এস্থলে ঢুকেছে এক মারকিন। খাজা মারকিন ড্রল (আড়) সমেত একাধিকবার মারকিনি জবানে বলে গেল তার প্রয়োজন অথচ কাউন্টারের পিছনে ফরাসি দোকানউলি শুধু মিটমিটিয়ে মৌরি হাসি চিবোয়–মাল কাড়বার কোনও নিশানাই নেই। মারকিন বার বার একই কথা বলতে বলতে হঠাৎ বুঝতে পারল, মাদাম তার কথা এক বর্ণও বুঝতে পারছে না। বিরক্ত হয়ে তখন সে সেই সাইনবোর্ড-টার দিকে আঙুল তুলে বলল, তবে ওটা ওখানে ঝুলিয়েছ কী করতে? ইংরেজি যখন বোঝে না এক বর্ণও? এবারে যেন মাদাম ব্যাপারটা বুঝেছে নিশ্চয়ই এ ফারুস্ আকছারই হয়– একগাল হেসে তার ইংরেজিভাষা ভাণ্ডারের শেষ শব্দটি খরচা করে বলল, উই, উই, ইয়েস ইয়েস, এঙলিশ স্পোকেন! সারতেনলি। আওয়ার কসতোমারস স্পিক–উই নত স্পিক— হ্যাঁ, যা, ইংরেজি বলা হয় বইকি! আমাদের খদ্দেররা বলেন। আমরা বলি না।

এটি মনে রাখবেন। আপনার অন্য কোনও কাজে না লাগলেও এটি দিয়ে ব্যাকরণের প্যাসিভ ভইস এবং তস্য প্রসাদাৎ কী কী সুখ-সুবিধে হয় সেটা বাচ্চাদের শেখাতে পারবেন। মাদাম তো আর নোটিশে বলেনি, উই স্পিক ইংলিশ, বলেছে ইংলিশ স্পোকেন এবং ইহসংসারে কে কোথায় ইংরেজি বলে কি না বলে, সেটা কুইনজ ইংলিশ না সাউথ ক্যারোলাইনার নিগার ইংলিশ সে খতিয়ান দেবার জিম্মেদারি তো বেচারি প্রভাসিনী দোকানউলির নয়!

খোদ প্যারিসের মুদির কথা বলছিলুম। আপনি হয়তো বিরক্ত হয়ে বলবেন, তুমিও য্যামন! আমি কি প্যারিস যাচ্ছি ঘৃতলবণতৈলতণ্ডুলের জন্য! এস্থলে আমাকে একটু কথা কাটতে হল। বলতে কী, আমার মনে হয়, এইসব বস্তু আপনি যদি প্যারিসে কিনে এদেশে চালান দিতে পারেন– অবশ্য অম্মদেশীয় সদাশয় সরকার যদি তার ওপর বেদরদ ট্যাকশো না চাপান তবে আপনার প্যারিস ভ্রমণের খরচটাই উঠে যাবে। আর ইতালির ব্রিদিসি, বারি অঞ্চলে চালের কিলো নিশ্চয়ই আড়াই/ তিন টাকা নয়! সর্বোপরি অলিভ তেল! লাল হয়ে যাবেন, মোয়াই, লাল হয়ে যাবেন। ফ্রান্‌সের মার্সেই অঞ্চলের পাঁচসিকের তেল হেলায়–কালোবাজারে নিদেন পঞ্চবিংশতি তঙ্কা! তা সে যা গে! ইংরেজের সঙ্গে দুশো বছর ঘর করে আমি– সৈয়দের ব্যাটা–আমিও বেনে বনে গিয়েছি– প্যারিস পৌঁছে কোথায় না সন্ধান নেবো উবিগা কোতির ভুরভুরে খুশবাই তা না, ত্যালের কেলো, চেলের ভাও! লাও!

প্যারিসের প্যারিসের কেন– পৃথিবীর পয়লা নম্বরি সর্ব হোটেলের ওয়েটার, রুমবয়, কাউন্টারের কেরানি এরা সবাই অল্প-বিস্তর ইংরেজি বলতে পারে। কিন্তু আপনি সেসব হোটেলে উঠবেন না– গ্যাটে আপনার অত রেস্তো নেই, থাকলে আমার লেখা পড়তেন না। আর যদি বলেন, না, আপনার সে রেস্তো আছে, তা হলে আর ভাবনা কী? আপনি কোন দুঃখে প্যারিস বালিনে কে কতখানি ইংরেজি বোঝে না বোঝে তাই নিয়ে মাথা ঘামাবেন? রেখে দিন হাজার দুই-আড়াইয়ের মাইনের একজন প্রাইভেট সেক্রেটারি– সে নিদেন আধা ডজন কটিনেন্টাল ভাষা ঝাড়তে পারে, আপনাকে আর দেখতে হবে না। স্বপ্নেই যখন খাচ্ছেন তখন পোলাই খান, ভাত খাচ্ছেন কেন, আর সে পোলাওয়ে ঘি ঢালতেই-বা কসি কচ্ছেন কেন? বরদার মহারাজাকে দিনের পর দিন অনায়াসে মিশরে চলাফেরা করতে দেখেছি। কবীন্দ্র রবীন্দ্র যখন প্রাগ বা বুডপেশটে বক্তৃতা দিতেন তখন সেখানকার য়ুনিভারসিটির সবচেয়ে সেরা ইংরেজিবাগীশ অধ্যাপক হতেন তার দোভাষী। এদের কথা আলাদা। আপনি যদি সে পর্যায়ে হন তবে আমার লেখা পড়ছেন কোন বদকিসমতের গেরোতে?

পক্ষান্তরে দেখুন, জলপাইগুড়ি থেকে বেরিয়ে অন্ধ খঞ্জ শ্রীধামে পৌঁছয় না, কেদার-বদরির পুণ্যসঞ্চয় করে না! ভারতীয় কত কালা বোবা কপর্দকহীন প্রতি বছর মক্কায় গিয়ে হজ করে! রাখে আল্লা, মারে কে!

চলে যাবে, প্যারিসে ইংরেজি জানা না থাকলেও চলে যাবে, জানা থাকলে অল্পস্বল্প সুবিধে হতে পারে। লন্ডনে যদি শতেকে একজন লোক ফরাসি বলে, তবে দ্বিতীয় যুদ্ধের পূর্বে প্যারিসের রাস্তায় হাজারে একজন ইংরেজি বলত কি না সন্দেহ। তাই আঁদ্রে মোরোয়া যিনি এই হালে গত হলেন, বা ল্যগুই কাজাৰ্মা ফ্রান্স দেশের আজব চিড়িয়া। প্যারিসবাসী তাজ্জব মেনে শুধোবে ওরা ইংরেজি শিখেছিল! কী করতে মরতে?

জরমনিতে অবশ্য আপনার ইংরেজিজ্ঞান একটু বেশি কাজে লাগবে। যদ্যপি ওই দেশ ইংরেজের প্রতিবেশী নয়। তার অনেকগুলো কারণ আছে। তার একটা কারণ আমাদের মূল বক্তব্যের সঙ্গে বিজড়িত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জরমনির আপন ভূমির উপর কোনও সগ্রাম হয়নি, অর্থাৎ কোনও বিদেশি সৈন্য সেখানে পদার্পণ করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারকিনিংরেজ লড়াই করতে করতে, কদম কদম এগোতে এগোতে জরমনির এক বৃহদংশ দখল করে সেখানে থানা গাড়ে এবং কয়েক বছর সেখানে বাস করে। গোড়ার দিকের মারকিনিংরেজ চালিত মিলিটারি শাসনকর্তাদের ভাষা তখন যে অতি সামান্যও বলতে পেরেছে সে-ই রেশন সহজে পেয়েছে, ফালতো রুটিটা-আণ্ডাটাও তার কপালে নেচেছে। আমার এক জরমন সতীর্থ ধরা পড়ে মারকিন দল জরমন সীমান্তে প্রবেশ করা মাত্রই। ইংরেজি বলাতে তার ভালো অভ্যাস ছিল বলে (তার জন্য আমি স্বয়ং কিছুটা দায়ী। আমাদের পরিচয়ের গোড়ার দিকে আমি জরমন জানতুম না বলে সে তার টুটিফুটি ইংরেজি চালিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে আমার জরমন খানিকটে সড়গড় হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে পুরনো অভ্যাস ছাড়েনি) মারকিনরা তাকে পত্রপাঠ দোভাষীর শব্দার্থে নোকরি দিয়ে দেয়। ফলে তার বাচ্চাদের দুধের অভাব হয়নি, বৃদ্ধা রুগ্‌ণ শাশুড়ির ওষুধপত্রের অভাব হয়নি। আর সে ভসভস করে অষ্টপ্রহর হাভানা সিগার ফুকেছে যা ইতোপূর্বে তার জীবনে কখনও জোটেনি। মার্কিন সৈন্য চলে যাওয়ার পর মনোদুঃখে সে ধূমপান সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছে। আমি তার জন্য গেল বারে বিড়ি নিয়ে গিয়েছিলুম। তার পুনরপি সেই মনস্তাপ। তবে আমি মাঝে-মধ্যে এখনও তাকে দু-পাঁচ বান্ডিল পাঠাই। ভয়ে বেশি পাঠাতে পারিনে– জরমন কসটস আমাদের চেয়ে কম যান না।

১৯৪৪ থেকে জরমনির যা দুর্দিন গেছে বিশ্বের অর্বাচীন ইতিহাসে সেটা উল্লেখযোগ্য। মারকিনিংরেজ সেখানে থানা গাড়ার পর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কাকে না রেশনের সন্ধানে ছুটতে হয়েছে ওদের পিছনে? সবাই পড়িমরি হয়ে তখন শিখেছে ইংরেজি। কবে কোন ঠাকুদ্দা একবার বেখেয়ালে একখানা গাইডবুক টু ইংলিশ কিনেছিলেন, এ আমলে ঠাকুন্দা তারই গা থেকে সন্তর্পণে ধূলি ঝেড়ে এক-পরকলাঙলা চশমা নাকে চড়িয়ে লেগে গেলেন ইংরেজি অধ্যয়নে– ছাপাখানা আবার কবে বসবে, চশমার দোকান কবে খুলবে কে জানে?

এর পর আর কী আশ্চর্য যে প্রথম স্কুল ফের খোলামাত্রই আণ্ডাবাচ্চারা ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করল, তার তুলনায় আমাদের ঊনবিংশ সালের ইংরেজি শেখার প্রচেষ্টা ধূলির ধূলি।

একমাত্র পরাধীনতাই মানুষকে মাতৃভাষা ভিন্ন দ্বিতীয় ভাষা শেখায়। চোখের জলে নাকের জলে শেখায়।

এই পরাধীনতার পিঠ পিঠ আসে আর্থিক পরাধীনতা। আজ জগৎজোড়া মারকিনি ডলারের গরমাই। ইংরেজের তম্বি কমেছে, কিন্তু তিনিও আছেন। উভয়ের ভাষা মোটামুটি একই–ইংরেজি।

তাই আমরা আজ কল্পনাও করতে পারিনে ইংরেজি না শিখে গুষ্টিসুদ্ধ দোভাষী না হয়ে আমাদের চলবে কী করে?

একথা খুবই সত্য, ইংরেজি নিরঙ্কুশ বর্জন করা অনুচিত।

কিন্তু দুনিয়াসুদ্ধ লোককে ঘাড়ে ধরে দোভাষী বানিয়ে সে সমস্যার সমাধান নয়।

———–

১. গোপখেজুরের গল্পটি প্রাচীন ক্ল্যাসিক পর্যায়ের : খেজুরগাছতলায় একটা লোক শুয়েছিল। একটা খেজুর কপালে পড়ে গড়াতে গড়াতে তার গোঁপে এসে ঠেকল। কিন্তু লোকটা এমনই হাড়-আলসে যে জিভ দিয়ে সেটা টেনে নিয়ে মুখে না পুরে অপেক্ষা করতে লাগল। দিনশেষে পদধ্বনি শুনে বিড়বিড় করে বলল, দাদা, এদিকে একটু ঘুরে যাবার সময় যদি দয়া করে তোমার পা দিয়ে ওই খেজুরটা আমার মুখের ভিতর ঠেলে দাও! থ্যাঙ্কয়ু!

২. আইন ব্যবসায়ীদের মতো রক্ষণশীল প্রাণী ত্রিলোকে দুর্লভ। ইংরেজি অবহেলিত বা বিতাড়িত হলে এই বেহেশতি ভারতভূমি যে কোন দোজখে পরিণত হবে তারই কল্পনায় অধুনা শ্ৰীযুত ছাগলা [ওটা ছাগলাই, স্যর, চাগলা নয়। পরপর পুত্রসন্তান মারা গেলে যেরকম আমরা এককড়ি ফকির নফর নাম রাখি গুজরাতিরা তেমনি ছাগলা (ছাগল), মাকড় (পিঁপড়ে, ক্রিকেটার), ঝিড়া (জিন্না, ছোট) রাখে] করুণ আর্তনাদ করে বলেছেন : এই একশো বছর ধরে আইন ব্যবসা যে (পর্বতপ্রমাণ) আইনের কেতাবপত্র ইংরেজিতে রচনা করেছেন সেটা লোপ পাবে, তার ব্যবহার থেকে ভারতবাসী বঞ্চিত হবে। এর ওপর দীর্ঘ মন্তব্য না করে শুধু বলব, এদেশ থেকে ইংরেজিকে নিরঙ্কুশ বিতাড়িত করার জন্য এই একটি মোক্ষম যুক্তি পাওয়া গেল বটে! এবং ছাগলা সম্প্রদায়কে সবিনয় প্রশ্ন : তবে কি প্রলয়াবধি এদেশে আইনের বাহন ইংরেজিই থাকবে? কারণ যত দিন যাবে, পর্বত যে পর্বততর হতে থাকবে! মায়া যে মায়াতর মায়াতম হতে থাকবে! অবশ্য আমি ইংরেজি বিতাড়নের জন্য হন্যে হয়ে উঠিনি, একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী সম্প্রদায়ের মতো।

৩. এস্থলে বক্ষ্যমাণ রচনাটি যদি আমাকে কপালের গর্দিশবশত ইংরেজিতে লিখতে হত তবে পরানভয়ে হরিণের ছোটাটা হুবহু ফরাসি ইডিয়মে লিখতুম–Ventre a terre– অর্থাৎ with belly to ground; এমনি সামনের দিকে ঝুঁকে প্রাণপণ ছুটছে যে মনে হয় মানুষটার পেটটা বুঝি মাটি ছুঁয়ে ফেলেছে! (ফরাসি শব্দতাত্ত্বিকদের জন্য ভাত্র ভেনট্রিলোকুইস, পেট থেকে যে কথা বের করে; তের টেনেট্রিয়াল = পার্থিব তুলনীয়)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *