1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৮

।। আট।।

আবার ব্যস্ততা জাহাজে। বন্দর আসছে, বন্দর ধরছে জাহাজ। জাহাজিরা সবাই কাজ ফেলে ওপরে ছুটে যাচ্ছে। মেজ-মালোম ডেবিড দূরবীনে বন্দর দেখছে। এনজিন-সারেঙ মাঝে মাঝে উঠে আসছেন ডেকে। মৈত্র বার বার অমিয়কে সাবধান করছে, ঠিক ফাদার যেমন গীর্জায় ঈশ্বর সম্পর্কে বক্তৃতা করেন, তেমনি মৈত্র, ডাঙ্গার মেয়েরা কি ভয়াবহ তার বর্ণনা, জ্যান্ত ছবি এঁকে এঁকে সাবালক অমিয়কে বুঝিয়ে যাচ্ছে। বাংকে গল্পগুজব করার সবয় মৈত্র প্রাচীন নাবিকের মতো সব বন্দরের রহস্য ব্যাখ্যা করে যায়। অমিয়র যা স্বভাব দাঁড়াচ্ছে দিনকে দিন!

ছোটবাবু বসে বসে সব শুনছিল। সে এমন সব আজগুবি কথা কখনও শোনে নি। ওর মাঝে মাঝে মৈত্রের কথা অবিশ্বাস করতে ইচ্ছা হত। এমন সব নক্কারজনক কথা, যা সে বিশ্বাসই করতে পারে না, সে কি করে বিশ্বাস করবে কেউ তার মার জন্য মানুষ সংগ্রহ করে নিতে পারে। সে কেমন শুনতে লজ্জা পায়। সে তখন না বলে পারে না, মৈত্রদা চুপ কর। এসব আগলি কথা না শোনাই ভাল।

মৈত্র ভীষণ ক্ষেপে গেল এ-কথায়। দেখ ছোট, তোকেও বলে রাখি, বেশি বাড়াবাড়িও ভাল নয়। অত সোজা না দুনিয়াটা। বয়স এখনও হয় নি, বয়স ভাল করে হোক। আমার মতো ঝানু না হলে এ-সব বিশ্বাস করতে তোমার কষ্ট হবে। তুমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবে না।

—তা হোক তুমি অন্য কথা বল।

—বন্দরে আবার অন্য কথা কি।

মনু বসেছিল পাশের বাংকে। সে বলল, ঠিক, বন্দরে আবার অন্য কথা কি!

—কেন কত কথা থাকতে পারে। আমরা ইচ্ছা করলে নেমে সব ঘুরে দেখতে পারি। বাসে চড়ে বেশ দূরে—এই সব আফ্রিকার জঙ্গলে ঘুরে আসতে পারি। এখানে যে ইন্ডিয়ানরা থাকে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারি। তারা কিভাবে আছে তা জেনে নিতে পারি। কি কি অসুবিধা, কালার-বার কি রকম ভয়াবহ এ-সব জেনে নিতে পারি।

অমিয় বলল, জেনে লাভ! ঘোরাঘুরির পয়সা কোন বাবা দেবে?

—লাভ আমরা জানলাম।

—মৈত্র শোন, ছোটর কথা শোন। সে ফস করে সিগারেট জ্বেলে টানতে থাকল। তারপর চুপ। অমিয় এখন এমন ভাবে তাকাচ্ছে যে ছোট ভেবে পাচ্ছে না কি করবে। অমিয় এবার ঠিক খিস্তি করবে। তাড়াতাড়ি ছোট বলল, এই আমি আসিরে!

—থাম, যাবি কোথায়! আমরা বুঝি অভিযানে এসেছি!

—না, তা না।

—তোর কথা শুনে তো এমনই মনে হয়।

ছোট বলল, ধুস, আমি এমনি বললাম। না বললে মৈত্রদা যেভাবে আরম্ভ করেছিল………

-–কি বললি, তুই ভাবলি আমি মিথ্যা বলছি?

—মিথ্যা বলবে কেন। হয়তো হয়েছে।

—হয়তো না, হয়েছে। হাসানকে ডাকব?

মনু বলল, হাসানটা আবার কে! মনু ডেক-জাহাজিদের পাত্তা দিতে চায় না। করে কয়লায়ালার কাজ। এবং মুখের ওপর কথা বলতে পারে। ওকে ডেক-টিন্ডাল হাসান একদিন বলেছিল, বোঝলাৱে মিঞা, দ্যাশের চকিদার আর জাহাজের কয়লায়ালা কামে তফাৎ নাইরে মিঞা।

—হ হ যান, মিঞা কইবেন না, খালাসির কাম করেন বড় বড় কথা কন!

—তুমি মিঞা এনজিনিয়ার!

—আরে আমার কাজ এনজিনের লগে। পানি মারা কাম না। ওড়া তো টোপাসের কাম!

এভাবে জাহাজে ডেক-জাহাজিদের সঙ্গে এনজিন-জাহাজিদের বেশ একটা রেষারেষি থাকে। এবং মাঝে মাঝে বেশ মজার ব্যাপার স্যাপার ঘটে যায়। যেভাবে যাকে যে চটাতে পারে। হাসান খুব ইয়ার্কিবাজ মানুষ। জাহাজিদের পেছনে লাগা তার স্বভাব। তাকে ডাকার যে কি দরকার এখন, এলেই বলবে, আহা কি যে করেন! কয়লায়ালা বইসা আছে, আমার জাত মান আর থাকল না। এবং কখনও এক কথায় দু’কথায় কথা কাটাকাটি, ঝগড়া। মনু এটা পছন্দ করে না। সে বলল, আর ডাইকা কাম কি!

—ছোট বিশ্বাস করছে না।

—সেই পোলাডার কথা?

—হ্যাঁরে, লেমো নাম ছিল। ভাল নাম ডেবিড এ্যালবার্টসন না কি যেন, শালা এসব ইংরেজি নামফাম আমার মনে থাকে না। নাম ওলটেপালটে যায়। আগেরটা পরে, পরেরটা আগে বলে ফেলি।

—তা ঠিক ছোটবাবু। হাসানকে এ-বন্দরে এলেই ভালোমানুষের মতো দেখবে। সে ইয়ার্কি ফাজলামো করবে না। কেমন দুঃখী মানুষ। সে যেন তখন কি ভাবে! মাঝে মাঝে পয়েন্টস-রোড ধরে সামনের যে পাহাড়টা দেখছ সেখানে চলে যায়। আমার সঙ্গে চার-পাঁচ সাল আগে এক জাহাজে সফর ছিল। তখন দেখেছি।

ছোট বলল, কেন যেত?

—কেন আবার? জাহাজিরা যেখানে যায়, সেও যেত। ছেলেটা নিয়ে যেত। ওর মার কাছে নিয়ে যেত। আর ছেলেটার মার সঙ্গে ডেক-টিণ্ডাল কেমন তোমার মোহব্বতে পড়ে গেছিল। তারপর যা হয়—এখন আর ছেলেটা আসে না। পুরোনো ঠিকানায় বোধহয় আর ওরা নেই। তবু ডেক-টিণ্ডাল জাহাজ এখানে এলেই দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন আবার হয়তো ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। তাকে নিয়ে যাবে।

মৈত্র বলল, আশা কুহকিনী। ছেলেটা আসলে ওর নিজের ছেলে।

ছোটবাবু বলল, মৈত্রদা তোমার মায়া-দয়া ভারি কম।

—হবে। বলে সে বাংকে এলিয়ে পড়ল। শালা হাসান গত যুদ্ধে এখানে আটকা পড়েছিল। বুঝলে।

ছোট, জাহাজ বাঁধা হলে সত্যি দেখল, ডেক-টিণ্ডাল হাসান খুব সেজেগুজে রেলিঙে দাঁড়িয়ে আছে। চুপচাপ। কেউ কিছু বললে জবাব দিচ্ছে না। সে নিচে নামার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।

গল্পটা শোনার পর হাসানের জন্য ছোটর মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। অথবা এক বালকের মুখ, যেন সে নিচে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে ম্যাণ্ডোলিন, সে এই জেটিতে দাঁড়িয়ে বাংলা গান গাইছে। এমন একটা বন্দরে, সেই বালক, এখন তো সেই লেমো ওর বয়সিই হবে, কি তার বড়ও হতে পারে—আর আসে না। ডেক-টিণ্ডাল হাসান এখানে এলেই বার বার সারা শহরে হেঁটে যায়, যদি ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয়। ওর মার সঙ্গে দেখা হয়।

হাসান এ-ভাবে আজও বিকেলটা এখানেই বুঝি কাটিয়ে দেবে। সে যদি ফিরে আসে। এবং এ- ভাবে ঠিক আশা কুহকিনী, হাসানের আশা আছে একদিন না একদিন লেমোর সঙ্গে ওর ফের দেখা হবে। তখন আর হাসানকে শুধু ডেক-টিণ্ডাল মনে হয় না, যেন জাম-জামরুলের ছায়ায় হেঁটে যাওয়া বাংলার মানুষ। তাকে মনে হয় প্রাচীন নাবিক। সে অনেক সাগরে ঘুরেছে মনে হয়। তার বেদনা যেন সবার চেয়ে গভীর।

এ-সব ভাবতে ভাবতে ছোটবাবু দেখল, মেজ-মালোম ঠিক আগের জায়গায়। ওর চোখে দূরবীন। সে ওদিকে আর যাবে না। গেলেই ডেবিড ওকে দূরবীনটা দিয়ে নিজে চুপচাপ বসে থাকবে।

এবং এক কথা।

এনি ওম্যান।

—নো স্যার।

—বন্দরে মেয়েরা কেন যে আসে না!

—এখানে মালটাল নামানো হয়! এখানে কেন ওরা আসবে?

–কেন বেড়াতে!

তখন ছোট শুনল, কেউ ওকে ডাকছে। সে দেখল, বোট-ডেকে জ্যাক। সে তাকে ডাকছে। জ্যাক ডাকলে সে প্রায় দৌড়ে যায়। জ্যাককে সে সারাদিন দেখেনি। কোথায় যে থাকে। জ্যাক না ডাকলে সে যেতে পারে না। সে বলল—তুমি আমাকে ডাকছ?

—তুমি এস না! —কি ব্যাপার?

—আরে এস না।

ও গেলেই জ্যাক বলল, বেশ শীত পড়েছে।

—খুব।

—তোমার শীতে ডেকে দাঁড়াতে ভাল লাগছে!

—খুব।

—কেন তোমার ভাল লাগছে!

—কেন ভাল লাগে কি করে বলব।

—তুমি কিন্তু রাতে মেজ-মালোমের সঙ্গে কিনারায় যাবে না।

—গেলে কি হবে?

—গেলে ভাল হবে না।

—মেজ আমাকে যেতে বললে না গিয়ে থাকব কি করে! মেজ এ-জাহাজে সবচেয়ে ভাল লোক। -বাজে কথা।

—বাজে কথা কি ভাল কথা আমি জানি না জ্যাক। তবু বলি মেজকে আমার খুব ভাল লাগে।

–তোমাকে আজ বলেনি কিছু?

—কি কলবে?

—কিনারে যেতে।

—না-তো।

—ও ঠিক নেমে যাবে। যাবার সময় তোমাকে সঙ্গে নেবে।

—ও তো এখন বাইনোকুলারে কিসব দেখছে।

—কিছু দেখতে পাবে না, তবু দেখবে। তারপর একটু থেমে জ্যাক বলল, তুমি আমার কেবিনে একটু আসবে?

—কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।

জ্যাকের মুখটা সহসা লাল হয়ে গেল। তারপর সামলে নিল।—কেউ খারাপ ভাববে না।

—মিঃ আর্চি টের পেলে আবার জাহাজের তলায় পাঠাবে।

—গুলি মারো। এসতো। বলে হাত ধরে টানতে থাকল।

ছোট খুব বিব্রত বোধ করতে থাকল। জাহাজের সর্বময় তিনি—তাকে জাহাজের ‘লর্ড বলা যেতে পারে, মাস্টার তিনি জাহাজের, তাঁর একমাত্র ছেলে জ্যাক। ছোটকে যতই আসকারা দিক, এ-ব্যাপারে কাপ্তানও কিছু মনে করতে পারেন। সে খুব মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, জ্যাক আমাকে বিপাকে ফেলে তোমার কি লাভ?

জ্যাক কেমন ঘাবড়ে গেল।—বিপাকে মানে!

—আমার মতো মানুষ তোমার কেবিনে গেলে খুব খারাপ দেখাবে।

—কিছু খারাপ দেখাবে না।

—তোমাদের অন্য অফিসাররা কিছু মনে করতে পারেন।

—তারা তো আমার গার্জিয়ান নয় ছোট। বলেই সে ছোটর হাত চেপে ধরল। খুব উষ্ণ হাত মনোরম। অদ্ভুত নেশার মতো এই হাত দুটো ছোটবাবুর। ছোট এখন এত কাছাকাছি যে সেই সুন্দর ঘ্রাণ, ছোট কি শরীরে কিছু মাখে! ছোটর কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে জ্যাকের মনে হয় শরীরের ভার তার কেমন লাঘব হয়ে যায়। সে বলল, তুমি না এলে আমি ভীষণ দুঃখ পাব ছোটবাবু।

—তোমার বাবা কোথায় জ্যাক?

—তিনি কিনারায় গেছেন।

—চিফ-অফিসার?

—তিনিও নেই। এজেণ্ট অফিসে গেছেন চিঠিপত্র আনতে। ফিরতে দেরি হবে।

—মেজ-মালোম!

—সে তো ওর জায়গা থেকে উঠবে না।

—কেউ দেখতে পাবে না তো?

—আরে না। এস না।

জ্যাক প্রায় ছোটকে টানতে টানতে ওর কেবিনে নিয়ে গেল। কি সুন্দর সাজানো কেবিন। পর- পর দুটো ঘর। একটা ঘরে নানারকম বই। সাদা দেয়ালে নীল রঙের ক্যালেণ্ডার। একটা সুন্দর ছেলে সমুদ্র-বেলায় দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় একরাশ চুল। জ্যাক কেবিনে নীল আলো জ্বেলে দিল।

জ্যাক বলল, ঠিক তোমার মতো দেখতে।

—আমার মতো! সে সন্তর্পণে দরজার দিকে তাকাতেই জ্যাক বলল, তুমি খুব ভীতু ছোটবাবু। বলে সে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর বলল, এখন ভয় করছে?

—না। কিন্তু ক্যালেণ্ডারের পাতায় আমার মতো ছেলের মুখ কৈ দেখি। বলে সে উঁকি দিয়ে দেখল জ্যাক ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। জ্যাকের লম্বা হাতা সার্ট গায়, জামাটা আগের চেয়ে বেশ ঢোলা। ওর প্যান্টের কাট-ছাট অদ্ভুত রকমের। জ্যাকের চুল আবার সামান্য বড় হয়েছে। ওর নীল রঙের চোখে কি যে আকাঙ্ক্ষা সে বোঝে না। জ্যাক ওর এত ঘনিষ্ঠ যে সে জ্যাকের শরীরের আশ্চর্য ঘ্রাণ পাচ্ছে। কিছুটা ফুঁইফুলের মতো গন্ধ। অথবা বনের ভিতর হেঁটে গেলে বৃষ্টিপাতের সময় যে সবুজ গন্ধ পাওয়া যায় জ্যাক যেন তার চারপাশে তেমনি গন্ধ ছড়িয়ে রেখেছে। জ্যাক বলল, ছোট তুমি কাল আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে।

—কাল!

—হ্যাঁ কাল! এখানে আমরা একটা পাহাড়ের টিলায় উঠে যাব।

—আমার তো কাল সেকেণ্ড-হ্যাণ্ড মার্কেটে যাবার কথা। গরম জামাকাপড় কিনতে হবে।

জ্যাক কেন যে আর কিছু বলতে পারে না। সে চুপচাপ থাকল। তারপর কেমন ভুল হয়ে গেছে মতো বলল, তুমি বসো ছোটবাবু।

ছোট খুব আস্তে আস্তে কথা বলছিল। এখন মৈত্র অথবা অন্য কেউ খুঁজে বেড়ালেই সে বিপদে পড়ে যাবে। সে বলল, এবারে যাই জ্যাক?

—বারে এই তো এলে। আমি কতদিন থেকে ভাবছি, তোমাকে আমার কেবিনে নিয়ে আসবো।

—মাস্টার জানতে পারলে ভীষণ খারাপ হবে। আমাকে এমন কি জাহাজ থেকে নামিয়েও দিতে পারে। তিনি এতটা বাড়াবাড়ি সহ্য করবেন কেন! শর্ত হলেও কয়লায়ালা। বলে, ছোট মুখ ভীষণ গম্ভীর করে ফেলল।

জ্যাক এবার বলল, ছোট, বাবা আমাকে খুব বিশ্বাস করেন। তিনি জানেন আমি এমন কিছু করব না, যাতে তাঁর অপমান হয়। তিনি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারেন না। আমিও না। আসলে বাবা বাদে আমার আর কেউ নেই।

ছোট জানে জ্যাকের মা ওর বাবার সঙ্গে থাকে না। জ্যাকের জন্য এ-ভাবেও ভেতরে ভেতরে কেমন একটা টান গড়ে উঠেছে। ওর এখন মনে হয় জাহাজে যারা কাজ করে তাদের ভীষণ একটা দুঃখ থাকে।

জ্যাক বলল, তুমি হয়তো এবার চিঠি পাবে।

—চিঠি! মায়ের!

—হ্যাঁ।

—না, পাব না। আমি জানি পাব না। মা আমার চিঠি পেলে তক্ষুনি উত্তর দিতেন। চিঠি কোনদিন ওদের কাছে পৌঁছবে না।

জ্যাক ফের বলল, তুমি বসো। আমার কেবিন তোমার কেমন লাগছে?

—খুব সুন্দর। মনেই হয় না জাহাজে আছি। সব রকমের ব্যবস্থা আছে। আমার খুব ইচ্ছে এমন একটা কেবিনে ঘুমোই।

জ্যাক কিছু বলতে পারল না। শুধু বলল, তুমি জাহাজে কাজ করলে একদিন এমন একটা কেবিনে ঠিক থাকতে পাবে। বাবা মাঝে মাঝে তোমার কথা বলেন।

—কি বলছ জ্যাক? আমার কথা বলেন!

জ্যাক বলল, হ্যাঁ। তারপর বলল, তুমি আমার ফ্রেণ্ড; আমি তোমার কাছে তেমন ব্যবহার পেতে চাই।

—জ্যাক!

জ্যাকের মুখ বড় সরল দেখাচ্ছে। সে বলল, তুমি আমাকে কখনও ভয় পাবে না বল?

ছোট চুপ করে থাকল।

—বল, আমাকে তোমার সুবিধা অসুবিধার কথা সব বলবে।

ছোট কিছু বলল না। সে কেমন অভিভূত। এত ভাল জ্যাক! অথচ এতদিন সে জ্যাককে এড়িয়ে গেছে।

ছোট ধীরে ধীরে বলল, তুমি বসো। তুমি আমার অনেক ছোট জ্যাক। আমি তোমার বন্ধু হতে পারি না।

জ্যাক কেমন অধীর গলায় বলল, কেন! কেন?

তারপর ছোট আর কিছু বলতে পারল না। জ্যাক ওর কাঁধে পড়ে। জ্যাক শরীরে অতীব এক সুষমা বয়ে বেড়ায়। সে কেন যে নিজেকে এত অসম ভেবে থাকে। আসলে জ্যাক কখনও কখনও হয়তো আবেগে ভোগে। এটা একটা খেয়ালও হতে পারে। এবং নানাভাবে জ্যাক সম্পর্কে ছোট ভেবে বুঝল, সে কথা দিতে পারে না। সে পালিয়ে এসেছে। জ্যাক খুব ছেলেমানুষ। জ্যাক খুব আদূরে। জ্যাক ভীষণ খেয়ালি। নিজের ভাগ্য এত বেশি সুপ্রসন্ন ভাবতে সে পারে না। আসলে সে হয়তো আর একটা বিপদে জড়িয়ে পড়ছে। যেমন কাল সে মেজ-মালোমের সঙ্গে গিয়ে ঠিক করেনি। সে এবার বলল, জাহাজে তোমার সঙ্গে কথায় বলার কেউ নেই। তোমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াবার কেউ নেই। তুমি খুব একা বুঝি? তোমার একজন কাছের মানুষ দরকার। যদি তিনি মনে করেন আমাকে দিয়ে হবে, তুমি যেখানে বলবে তখন যাব। তুমি যেমন আমার মনিবের মতো আছো তেমনি থাকো। যখন যা সার্ভিস চাইবে, পাবে।

জ্যাক কেমন সহসা ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। সে চিৎকার করতে থাকল,—ইউ গেট-আউট। আই সে ইউ গেট-আউট।

ছোট বলল, যাচ্ছি স্যার।

ছোট চলে গেলে জ্যাক দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর যেখানে যা আছে সব ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। ওর দু-চোখ বেয়ে ভীষণ প্রবল বেগে কি যেন নেমে আসছে। সে নিজেই এই অসম্মানে যা কিছু আছে সব তছনছ করে দিচ্ছে। চিৎকার চেঁচামেচিতে বাটলার, কাপ্তান-বয়, ডেবিড ছুটে এসেছিল।

—কি হয়েছে জ্যাক। কাপ্তান বয় বলল, কি হয়েছে সাব।

জ্যাক কিছু বলছে না। কেবল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

তখন ছোট দৌড়ে পালাচ্ছিল। পাশে মেজ-মালোমকে সে ফেলে চলে যাচ্ছে। মেজ-মালোম ডাকল, এই ছোট শোন, শোন।

ছোট তখন ওর পাশে ঘাপটি মেরে বসল। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এনি ওম্যান সেকেণ্ড!

—নো।

—তবে আমি যাই।

—কোথাও গেছিলে?

—কোথাও না সেকেণ্ড।

—এত জোরে ছুটছ?

ছোট বলল, বড়-মিস্ত্রি কিনারায় নামছে

—এত ভয় বড়কে?

ছোট মিথ্যা কথা বলে পার পেল। তারপর কেমন নিশ্চিন্ত গলায় বলল, দূরবীনে মেয়ে ধরা পড়লে আমাকে ডাকবে।

—ঠিক ডাকব।

—একা একা দেখে ফেলবে না।

—আরে না না। একা আমি কিছু দেখি না। জাহাজিদের মতো এত স্বার্থপর নই।

তখন বড়-মিস্ত্রি হেঁটে হেঁটে ঠিক রেলব্রীজের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ছায়া-ছায়া অন্ধকারে আবার একজন ইণ্ডিয়ান। সে একটু থেমে গেলেই বুঝল বেশ নেশা করে বাবু ব্রীজের থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় হেঁটে বাড়ি ফেরার সাহসটুকু নেই। কিন্তু এ যে সেই ইণ্ডিয়ান। আরে ওকে তো ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। ওকে তো মনে মনে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

সে ওর কাছে গিয়ে বলল, গুড ইভিনিং।

অমিয় হাঁটতে পারছিল না। সে টলছিল। সে কোনো রকমে বলল, গুড ইভিনিং!

—অনেক ধন্যবাদ। তোমাকে বন্ধু ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। দুজনেই বোঝা যাচ্ছে নেশা করেছে খুব। বড়-মিস্ত্রি নেশা করলেও ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবে। ওকে কেউ ফোন করেছিল। রেলব্রীজের ও-পাশে গাড়ি থাকবে। আর অমিয় বড়মিস্ত্রির কাছ থেকে যা খসিয়েছিল, এখানে ঠিক তা একজন দালালকে ধরে পাউণ্ডে বদলে নিয়েছে। এবং এ-পয়সায় এ-দেশের সস্তা মদ, চোলাই বলাই ভাল ঠিক ইণ্ডিয়ান মার্কেটের পাশে সবার সঙ্গে কাঠের মোড়াতে বসে হুস হাস পান করে, নেচে গেয়ে—সেই এক নাচ, বসে বসে, কখনও পিঠ উঁচু করে কখনও নুয়ে নুয়ে যখন একেবারে চোখ বুজে এসেছিল, একটি রিক্সা করে চলে এসেছে। আর কি চেহারা রিক্সায়ালার, একেবারে মা কালীর মতো। মাথায় পালকের টুপি, কোমরে পালক পাখির, মুখে নানারকম উল্কি আঁকা। প্রথম তো ভয়ে একেবারে ঠাণ্ডা। তারপর মনে হল তা অনেকেই, মেয়েরা পর্যন্ত উঠে বেশ এখানে সেখানে যাচ্ছে। সেও উঠে বসল। আর এখানে এসেই রিক্সা সে ছেড়ে দিয়েছে। পোর্টের ভিতরে ঢুকতে দেবে না। সে এখানে হাঁফ ছেড়ে তারপর যাবে—ভেবেছিল, তখনই কিনা ভূতের মতো বড়-মিস্ত্রি টলতে টলতে বলছে, বেশ আছো বাবা, তা তোমার কথামতো চলে গেলে দেখা হতো না। তুমি আমার বন্ধু। তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গেই আছ দেখছি। ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে।

অমিয়র মুখ শুকিয়ে গেছে। ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। নেশা টেশা একেবারে গোল্লায়। সে বলল, না স্যার আমি…

দাঁড়িয়ে কথা শোনার মতো সময় নেই বড় মিস্ত্রির। কি বলছে বিড় বিড় করে বোঝাও যাচ্ছে না! আসলে আমিয় নিজেও বুঝতে পারছে না কি বলছে। সে বাংলায় বলে যাচ্ছে। বাংলাকে সে ইংরেজি ভাষা মনে করছে। সে কলকাতার কোন খালাসী টোলা ভেবেছে এটা। সে যে এখানে, এই আফ্রিকার বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষণেকের জন্য ভুলে গেছে। তারপর সব খেয়াল হতেই কেমন সেও ছুটতে থাকল। সে এবার ক্রমে নিজের জালে নিজে জড়িয়ে পড়ছে। তাকে এখন এ-জাহাজে শেষ পর্যন্ত ভূতের অভিনয় না করতে হয়। বড়-মিস্ত্রি ওকে ছেড়ে দেবে না। কিভাবে যে কি করবে কিছুই, এখন মাথায় আসছে না। মৈত্রকে বলতে পারছে না। ছোট তো আরও সরল সে এমন শুনলে আরও ঘাবড়ে যাবে জাহাজে।

অমিয় সব ভুলে যাবার জন্য আবার গান ধরেছে। আসলে সে গ্যাংওয়ে ধরে উঠে আসতে পারছে না। পড়ে যাবে, পড়ে গেলে একেবারে অতলে। ওর জড়ানো গলায় গান শুনলে যদি কোয়ার্টার- মাস্টার ফোকসালে খবর দেয়।

শেষ পর্যন্ত মৈত্র নিচে নেমে দুমদাম পাছায় লাথি মারতে থাকল। জাহাজে কেন আসা। বেশ তো মা ভাইদের জ্বালাতন করছিলে, তাই করতে। আমাদের কেন। সে লতিফকে বলল, নে তোল। চ্যাঙদোলা করে তুলে নে। তারপর বাথরুমে ফেলে জল ঢাল।

অমিয় সব বুঝছিল। জাহাজের ওপরে এসেই সে ঠেলেঠুলে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে বলল, আমাকে

ছোঁবে না। আমি ঠিক হেঁটে যাব। ঠিক এক দুই সে তারপর পা মুড়ে বসে পড়ল। সে বলল, উঠব না।

–কেন উঠবি না?

—আমাকে তুমি অপমান করেছ।

—অপমান মানে!

—আলবৎ অপমান। তুমি আমার পাছায় লাথি মারলে কেন?

—সবাই দেখছে। ওঠ প্লিজ, আর পাছায় লাথি মারব না!

—দেখুক। সবাই তো বেশ মৌজ করছে। বন্দর এলেই সব শূয়োরের বাচ্চা নাগর সেজে বের হচ্ছে। যত দোষ নন্দ ঘোষ।

মৈত্র বলল, অমিয় জাহাজ থেকে শালা তোমায় হারিয়া করে দেব।

—দাও না, বারণ করেছি। শালা এ মনুষ্যজন্ম থাকা না থাকা সমান। তুমি আমার পাছায় লাথি মেরেছ। ছোটকে না বলেছি তো আমি কুত্তার বাচ্চা।

এবং ছোট দেখল, পিছিলে কি যেন একটা গণ্ডগোল। সে বোট-ডেক থেকেই বুঝল, সবাই সেখানে জড় হয়েছে। সেও ছুটে গেলে দেখল অমিয় বেহুঁশ হয়ে আছে। কেউ এদিকে আসতে পারে, কিংবা কোনও অফিসার। এনজিন সারেঙ তাড়াতাড়ি ওকে নিচে নিয়ে যেতে বলছে। এবং ওকে ঠেলে ঠুলে নিচে নিয়ে গেলে মনে হল, অনেক দূরে একটা অতিকায় ট্রেন, কোন গভীর বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে ছুটছে। গাছ পালা পাখি সব ভয়ে উড়ে যাচ্ছে। এবং এক আশ্চর্য শব্দ জাহাজে উঠলে সবাই শুনতে পায়, শব্দটা, সেই ট্যানি টরেন্টো, ট্যানি টরেন্টো। গর্ভিণী তিমি শিকার করে ফিরে আসার সময় শিকারিরা এমন একটা শব্দে ডেকে দাঁড়িয়ে গান গাইতে ভালবাসে।

.

পরদিন সকাল সাতটা বাজতে না বাজতেই কিনারার সব মানুষেরা উঠে আসছে। ওরা অধিকাংশ নিগ্রো কুলি। ক্রেনগুলো সব এগিয়ে আসছে।

ডেরিকগুলো তুলে দেওয়া হচ্ছে। উইনচের বল বিয়ারিঙে তেল দিচ্ছে গ্রিজার। মেজ-মালোম ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে। ছোটকে দুবার দেখেও যেন চেনে না এমন ভাবে তাকিয়েছে। পাখিগুলো প্রথমে নেমে গেলো। ফল্কা একেবারে খালি। নিগ্রো কুলিরা এসে গ্যালিতে ভাত ভাত করছে। ওরা ভাত মুড়িমুড়কির মতো জ্যাবের ভিতর নিয়ে কাজ করছে আর খাচ্ছে। জাহাজিরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিগ্রো কুলিদের সঙ্গে ভাঙা ইংরেজিতে হাসি ঠাট্টা করছে। বাদশা মিঞা একজন নিগ্রো কুলির হাত পা দড়ি দিয়ে কত মোটা মাপছে। সে একটা বড় টুল টেনে এনেছে। তার ওপরে উঠে দৈত্যের মতো মানুষটার হাতের পেশী কি যে সবল, এমন মাপবার সময় খুব দুঃখ, সে এতটা দুর্বল কেন! আর নিগ্রো কুলিটা ফিক্‌ফিক করে হাসছে। মাপবার সময় যখন যা বলছে মানুষটা তাই করছে। বাদশা মিঞাকে ছোট একটা পুতুলের মতো লাগছে। কি কালো আর সবল শরীর। মাথায় রোঁয়া রোঁয়া কোঁকড়ানো চুল। বাদশা মিঞা হাসতে হাসতে ঠাট্টা করছে—তোমার কটা বিবি মিঞা?

—তিন। সে আঙ্গুল দেখিয়ে এমন বলছে।

বাদশা খুব যেন কাছের মানুষ পেয়ে গেছে, সে একেবারে দাঁত বের করে বলল, মি…সে বুকে আঙ্গুল ঠেকাল, যেন ‘মি’ দিয়ে ঠিক নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে না, বুকে আঙ্গুল ঠেকিয়ে সেটা সে প্রমাণ করছে—মি বুঝলে সাব্ ফোর। ফোর বিবি।

—ফোর! মাই গড। লিটল ম্যান। ভেরি লিট্ল।

বাদশা মিঞা লিট্ল কথার অর্থ বোঝে। সে খুব চুপসে গেল। ওকে সোজা কথায় হালার হালা বলেছে। এ-হালার গতরে চার বিবিরে সামলানো দায়।

—সাব, ফোর নো গুড?

—ইয়েস, গুড। ওয়ান নো গুড, টু গুড, থ্রি ভেরি গুড। নাইস। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে। ফোর! ও ভাবা যায় না।

—তুমি নাস্তায় কি খাও সাহেব?

—আণ্ডা।

—কটা করে?

—আটটা করে। কাঁচা। সরবৎ করে খাই।

—আমার খেলে হবে!

—জরুর হবে।

বাদশা মিঞা বলল, ভাত নেবে? সে ওর দু জ্যাব ভরে ভাত দিয়ে দিল। নিগ্রো কুলিটা তারপর দুলাফে নেমে গেল। ফল্কায় সব ভারি ভারি কাঠ হাওয়ায় উড়িয়ে দেবার মতো টেনে ফেলে দিচ্ছে। এবং এ-ভাবে জাহাজে কাজ সুরু হলে মনে হয়, কেউ এখন আর নিজের দুঃখের কথা ভেবে বসে নেই। সবাই কাজ করছে। চার নম্বর মিস্ত্রি সামনের উইনচে আছে, পাঁচ নম্বর আছে এদিকের উইনচে। কাপ্তান পায়চারি করে সব দেখছেন। মেজ-মালোমের কাছে হিসাবপত্র আছে। কি নামবে সে জানে। জাহাজে কোন আলাদা ক্লার্ক নেই। চিফ-অফিসার সেকেণ্ড-অফিসার এ সব কাজ ভাগ করে নেয়। আর্চি নিচে রয়েছে। কিছু মেরামতের কাজ আছে। কিনার থেকে কন্‌ট্রাক্টর এসেছে মেরামত করতে। বড় বড় অক্সিজেন সিলেণ্ডার নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্লেট খুলে ফের মেরামত হচ্ছে। স্মোক-বকসে কাজ পড়েছে ছোটর। সকাল থেকে ওর দেখা নেই। দুজন দুজন করে তিনটে-স্মোক বকস ভাগ করে নিয়েছে। মৈত্র নিজে গেছে সঙ্গে। ছ’জন কোলবয় স্মোক-বক্স সাফ করার জন্য রয়েছে বলে, ছোটকে সকাল থেকে দেখা যাচ্ছে না।

অনিমেষ, বন্ধু এবং অন্য ডেক-জাহাজিরা ফলঞ্চা বেঁধে রঙ লাগাচ্ছে। চিমনিতে রঙ লাগাচ্ছে পঁচিশ টাকার জাহাজিরা। তেইশ টাকার জাহাজিরা ফলঞ্চা বেঁধে জাহাজের খোল রঙ করছে। বন্দরে এলেই এ-সব কাজ ওদের বেড়ে যায়। সমুদ্রের ঢেউ এসে ক্রমান্বয়ে সব রঙ ধুয়ে নিতে চায়। আর ওরা যেখানে যেভাবে রঙ ধুয়ে যায় আবার বন্দরে এসেই রঙ করে ফেলে। যেন নিয়ত এক সংগ্রাম এই সমুদ্রের সঙ্গে।

স্মোক-বকসের ভেতরে বসে তখন ছোট চেঁচামেচি করছিল, মৈত্রদা কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

—মার জোরে, জোরে মার। জোরে বুরুশ চালা। মাগীর কলিজাতে পাড় দে।

এগুলো এমন সব কথা যা মৈত্রকে বলতে হয়। না বললে যারা কাজ করছে, মেজাজ পাবে না। এই যে এক মাসের ওপর ওরা জাহাজ চালিয়ে এসেছে, এই যে এক মাস ধরে স্মোক-বকসের পাইপগুলো ধোঁয়া গিলে গিলে জ্যাম হয়ে গেছে কালিতে, এগুলো ঠিক মতো বুরুশ না চালালে বয়লারে ঠিক স্টিম উঠবে না। ধোঁয়া বের হবার পাইপ জ্যাম থাকলে আগুন ভালো জ্বলবে না। আগুনের ভেতর আগুন, সে যে কি আগুন এই বয়লারে নিয়ত জ্বলে কেউ না দেখলে টের পাবে না। এ- ভাবে হাজার হাজার টন কয়লা পুড়বে বয়লারের পেটে। স্মোক-বকস সাফসোফ না থাকলে বয়লারের বদহজম হবে। এবং এটা মৈত্র ভাল বোঝে, সে সেই সকাল থেকে লেগেছে। চারপাশটা এখন ধোঁয়ার মতো, আসলে সব শুকনো ভুসো কালি, ফর্ ফর্ করে চারপাশে উড়ছে। এবং ওরা যে নীল জামা প্যান্ট পরে এসেছিল, তার ওপর পলেস্তারা পড়েছে ভুসো কালির। ভুসো কালিতে মুখ একেবারে মা-কালী। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। নাকে সবাই রুমাল বেঁধেও পার পাচ্ছে না। গলা থেকে থুতু উঠে আসলে কেবল মনে হয় দলা দলা কালো কফ। কেউ বেশিক্ষণ ভেতরে বসে থাকতে পারে না। পাইপের ভেতর বুরুশ ঠেলে বের করে ঘসে দুবার, তারপর বাইরে বের হয়ে আসে। আবার যখন যাচ্ছে ভেতরে সেই ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভুসো কালির ঝড়টা কিছুটা থেমে গেছে তখন। বার বার গিয়ে তা প্রায় বিশ বাইশটা পাইপ, ঠিক গোনার মতো তখন অবস্থা থাকে না, এক এক করে সবাই সাফ করে যখন ঠিক বারোটায় উঠে গেল দল বেঁধে তখন মনে হচ্ছে একদল অভিযাত্রী সত্যি কোন দুর্গম কয়লা খনির ভেতর থেকে জীবন-মরণ লড়াই শেষে ক্লান্ত অবসন্ন পায়ে উঠে যাচ্ছে।

মৈত্রের ভীষণ তখন গর্ব হয়। গতকালের অমিয়র এমন বেলাল্লাপনা ভুলে যায়। এমন একটা কাজের পর যদি এটুকু না করল তবে আর বাঁচা কেন। কিন্তু এইসব জাহাজিদের এত কম পারিশ্রমিক, আর্টিকেলে ওদের জন্য এত কম বরাদ্দ যে তখন তার মন খারাপ হয়ে যায়। মৈত্রের তখন এই সব হতভাগা জাহাজিদের জন্য আফশোস হয়।

জ্যাক তখন খুট খুট করে জাহাজে চিপিঙ করছে। ঠিক দু নম্বর লাইফ-বোটের নিচে সে বসে আছে। এবং সে দেখতে পাচ্ছে কতজন অভিযাত্রী ক্রমে পিছিলের দিকে চলে যাচ্ছে। ওদের চেহারা এক রকমের। মাথায় কালো টুপি। জামা প্যান্ট ভুসো কালিতে ঢাকা। ওরা কে এবং ছোটবাবু কোনটা সে বুঝতে পারল না। কিন্তু সে জানে ছোটবাবু ওদের ভেতর সব চেয়ে লম্বা। ছোটকে যে যে- ভাবেই সাজিয়ে রাখুক সে ঠিক চিনে ফেলতে পারবে। দূর থেকে না পারলেও, কাছে গেলে চিনতে পারবে। ছোটর শরীরে আশ্চর্য একটা সৌরভ আছে যা কখনও উবে যায় না।

সে কালকে রেগে গিয়ে যে কি করে ফেলল! ছোটকে এ-অবস্থায় দেখে সব রাগ-অভিমান সে ভুলে গেল। হঠাৎ এমন সরগোল এবং কাজকর্মের ভেতর সব ভুলে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর চিৎকার করে ডাকল, ছো…ট। ছোট আমি এখানে! কেমন সরলভাবে বলে যাওয়া। ছোট যেতে যেতে হাত তুলে দিল। কিছু বলল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *