1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৭

।। সাত।।

রাত থাকতেই জাহাজ নোঙর তুলেছে। ডেবিডের ওয়াচ আটটা বারোটা। কিন্তু জাহাজ নোঙর তুলেছে বলে, শেষ রাতের দিকে পিছিলে হাড়িয়া হাফিজ করতে হয়েছে তাকে। জাহাজ নোঙর তুলে সমুদ্রে না পড়া পর্যন্ত সে ডেকে বসেছিল। কেবিনে ফিরে গিয়ে সে ঘুমোবার আর চেষ্টা করেনি।

এটা ওর স্বভাব। কিনারায় জাহাজ ভিড়লেই তার আর ঘুম আসে না। যতক্ষণ সমুদ্রে জাহাজ ভেসে না যায়, সে বসে থাকে চুপচাপ। মাথার ওপর আকাশ থাকে। আকাশের অজস্র তারা ক্রমে কেমন অনুজ্জ্বল হয়ে যায়। চারপাশে এক আশ্চর্য নিস্তব্ধতা থাকে। এনজিনের শব্দ বাদে আর কিছু তখন কানে আসে না। স্টোক-হোলডে স্লাইস অথবা র‍্যাগের শব্দ। বেলচায় কয়লা মারার শব্দ। আর কিছু কানে আসে না। সমুদ্রের কিনারায় গাছপালাও ক্রমে চোখের ওপর থেকে সরে যায়। পৃথিবীর সব বন্দরে সে এ-ভাবে বসে থাকে। স্ত্রী এবির কথা মনে হয়। ছেলে-মেয়ের মুখ ভেসে ওঠে। ওরা ওকে প্রত্যেকে একটা করে চিঠি দেয়। চিঠিতে ওদের নানা বায়নাক্কা থাকে। বউ নানাভাবে লেখে তুমি চিন্তা কর না, আমরা ভাল আছি। তখন মনে হয় এবির চোখ দুটো তেমন সুন্দর নয়। চুল সোনালি, এবি ভারী সংসারী মেয়ে। এত ভাল যে মাঝে মাঝে এবিকে খুব একঘেয়ে লাগে। সে তার ছেলেপিলে সংসার বাদে আর কিছু জানে না।

এবি নিজেও একটা কাজ করে। স্কুলে সে শিক্ষকতা করছে সেই কবে থেকে। দুজনের রোজগারে ওরা ডলফিনে বেশ সুন্দর ছিমছাম একটা বাড়ি করেছে। খুব শখ হে-ঘাসের ভেতর দিয়ে এবির হেঁটে যাবার। সূর্য উঠলে এবিকে সে কখনও দৌড়াতে দেখেনি। ওর ইচ্ছা হত, সূর্য উঠলে সে এবিকে নিয়ে হে-ঘাসের ভেতর দৌড়াবে।

এবি সবসময় কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে চায়। সে বেশি হৈ-চৈ পছন্দ করে না। চার্চে প্রতি রবিবার তার যাওয়া চাই। খুব ধর্মভীরু এবি! এতটা ধর্মভীরু যে মাঝে মাঝে ডেবিডের এবির ঈশ্বর সম্পর্কে খুব ঠাট্টা করতে ইচ্ছে হয়। খুব রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। ক্যাথলিক এবং আচার-আচরণে আন্তরিক। এমন আন্তরিকতাও ডেবিডের খুব পছন্দ না। বৌ একটু ছলনা করবে না, একটু চাতুরি খেলবে না, একেবারে সতীসাধ্বী হয়ে থাকবে ভাবতে তার ভারি খারাপ লাগে। সমুদ্র থেকে ঘুরে গেলে ওর মনে হয় সে এবির প্রতি নানাভাবে অবিশ্বাসের কাজ করেছে। এবি যদি সামান্য অবিশ্বাসের কাজ করত তবে বোধ হয় তার এতটা অনুতাপ থাকত না।

কিনার সরে গেলেই সে ভাবে ধার্মিক হবে। স্ত্রীর প্রতি আন্তরিক হবে, কিন্তু কিনারায় গেলে কিচ্ছু তখন মনে থাকে না। কেবল একটা মুখ ভাসে, দূরবীনে সে এবির মুখ আর দেখতে পায় না। যেন এক পাখি নিরন্তর উড়ছে, সেটা যে কি, কেন ওড়ে, কেন সমুদ্রে ছায়া ফেলে যায়, দিগন্তরেখায় অদৃশ্য হয়ে গেলে কিছু ভাল লাগে না। সব গাছপালা দ্বীপ তখন কেন যে এত মনোরম লাগে সে বুঝতে পারে না। সে আজও বসেছিল, যতক্ষণ কিনার দেখা গেছে, চোখে দূরবীন। কাল তার ভারি ইচ্ছে ছিল কোথাও ঠিকানা খুঁজে যাবার, কিন্তু ছোটবাবুকে সঙ্গে নিয়ে সে যেন ভুল করে ফেলেছিল। আসলে সে চায় আন্তরিক থাকতে। একজন পাহারাদারের কাজ করবে ছোটবাবু। ছোকরা সে। ভেতরে এখনও রক্ত ততটা দামাল নয়। কিছুটা সত্ত মানুষের মতো লাগে। সে এখন ভাবছে ছোটকে সঙ্গে না নিয়ে বের হলেই ভাল হত। বড়-মিস্ত্রির মতো তবে একটা ঘরের খোঁজে যাওয়া যেত।

আসলে, রাতে জাহাজে কেউ ছিল না। কাপ্তান, চিফ-অফিসার, জ্যাক বাদে সবাই নেমে গেছিল। ক্রুদের ভেতর থেকেও কেউ কেউ নেমে গেছে। শেষ পর্যন্ত বড়-মিস্ত্রি মিলড্রেডকে নিয়ে কেবিনেই রাত কাটিয়েছে। এতটা অবশ্য ওর ভাল লাগে না। নির্লজ্জের মতো সে এটা এখনও করতে পারে না। কিনার চলে গেলেই ওর মায়া হয় গাছপালার জন্য। এবার সে ভেবেছে সামনের বন্দরে ঠিক নামবে। যে-ভাবে হোক, কারণ এই প্রায় মাস দুই হল সে জাহাজে উঠে এসেছে, জাহাজটা পুরানো বলে বেশিদিন একনাগাড়ে কাজ করা যায় না। অনেকে অসুখে পড়ে যায়। সে সিঙ্গাপুরে উঠেছে। সে, বড়-মিস্ত্রি, মেজ মিস্ত্রি। জাহাজ হোমে গেলে সে নেমে যেতে পারবে না। ব্যাঙ্ক লাইনের সফরে বেশিদিন থাকার নিয়ম। পাঁচ-সাত মাসে নেমে গেলে, কোম্পানি সুনজরে দেখে না। যদিও সে যতটা জানে জাহাজ বুয়েন-এয়ার্স থেকে ব্রাজিলের ভিকটোরিয়া বন্দরে, তারপর সোজা কার্ডিফে। যদি জাহাজ ড্রাইডক হয় তবে বেশ কিছুদিন এবির সঙ্গে কাটাতে পারবে। ওর ভারি ইচ্ছে তখন এবিকে নিয়ে হে-ঘাসের ভেতর কেবল লুকোচুরি খেলবে। কিন্তু এবি যেন কেমন, সে এটাকে ভারি অসভ্যতা ভাবে। কখনও কোনও মাঠের ভেতর ঘাসেব ছায়ায় এবি দূরবীনে চোখ রাখতে চায় না। ওর ভারি লজ্জা। এই বয়সে এ-সব ওর এতটুকু ভাল লাগে না।

অথচ এবি জানে না, দূরবীনে মেয়েদের ছবি আশ্চর্যভাবে বদলে যায়। সে দেখতে পায় একটা জীবন, হ্যাঁ জীবনই তো যেন সচল আন্তরিক আকাশ ওর কাছে মাথা পেতে রেখেছে। ছুঁয়ে দিলেই ঝর ঝর করে বৃষ্টিপাত হবে। এমনটা না হলে ডেবিডের মন ভরে না। মাঝে মাঝে ডেবিড তখন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কোন দ্বীপে বন্যমেয়ের স্নান সে চুরি করে দেখতে ভালবাসে। মানুষের অদিমতা তাকে অত্যন্ত জীবন্ত করে রাখে।

একা একা ডেকে বসে থাকলে কত কিছু এমন মনে হয়। রাতে জাহাজ বাংকার নিয়েছে বলে সারাটা ডেক কয়লার গুঁড়োতে ভরে গেছে। সারাটা ডেক হ্যাচ ডেরিক, বয় কেবিন, লাইফ বোট সব কয়লার ধুলোয় ঢেকে গেছে। হেঁটে গেলে জুতোর ছাপ পড়ছে ডেকে। তার হাঁটতেও ভাল লাগছে না।

ক্যাপ্টেন হিগিনস্ তখন ব্রীজ থেকে বারবারই সমুদ্রে কি যেন উঁকি দিয়ে দেখছেন। কিছু খুলে টুলে গেল নাকি। যা একখানা লক্কড় মার্কা জাহাজ, কখন যে কি হয়! বে-অফ বেঙ্গলে বড় রকমের একটা ঝড়ে পড়েছিল—তারপর তো জাহাজ পাট-রাণীর মতো চলছে। হেলে-দুলে কেবল দক্ষিণ পশ্চিমে এবং ক্রমে দক্ষিণে, কখনও দক্ষিণ-পূর্বও করতে হচ্ছে। স্টিয়ারিং হুইলের সঙ্গে কম্পাসের কাঁটার হিসাব ঠিক রাখা এবং জাহাজ চালানো তেমন কঠিন না। কিন্তু মুশকিল নদীর মতো সমুদ্র কখনও কখনও দামাল হয়ে যায়। কোথাকার স্রোত, কি ভেঙে এনে কোথায় জমা করে এবং কিভাবে চড়া পড়ে যেতে পারে আর তার চড়ায় উঠে গেলে হয়ে গেল। যেতে যেতে এমন যে দুটো একটা ছবি এই যেমন জাহাজ চড়ায় আটকে আছে, অথবা একটা বয়াতে লাল, নীল আলো, অর্থাৎ নিচে অতলে একটা জাহাজ ডুবে আছে, সেখানে এখন সমুদ্র প্রাণীরা নানাবর্ণের লতার ভেতর জলজ ঘাসের ভেতর আস্তানা বানিয়েছে—এমন সব দৃশ্য দেখতে পাওয়া যে না যাবে তা নয়। এ সব দেখলেই পুরোনো জাহাজের ভয়। অবশ্য পুরোনো জাহাজ অনেক সময় পুরোনো টনিকের মতো কাজ করে। ঝড় জলে সে বেশি সময় যুঝতে পারে।

হিগিন্‌স্‌ এখন চার্টরুমে ঢুকে যাবেন। ডেবিড এবার সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল। ডেক-জাহাজিরা হোসপাইপে জল মেরে যাচ্ছে ডেকে। টিন্ডাল বোট-ডেকে উঠে সি-ওয়াটার ভালব ঘুরিয়ে দিচ্ছে। নানা জায়গায় নানাভাবে এইসব ভালব্ ছড়িয়ে আছে। যেখানে যেভাবে জলের দরকার ভালব ঘুরিয়ে দিলেই হল। হোসপাইপ লাগিয়ে দিলেই হল। জেনারেল সার্ভিস পাম্প থেকে নানাভাবে সব পাইপ জাহাজের চারপাশে ছড়িয়ে গেছে। এবং এ-জাহাজ পুরোনো বলে, স্টিমএঞ্জিন বলে, সবসময় জাহাজে জলের দরকার বেশি। লম্বা সফরে জল কখনও কখনও ফুরিয়ে যায়। তখন এভাপরেটিঙ করতে হয়। নোনা জল থেকে মিষ্টি জল করে নিতে হয়।

ডেবিড বুঝতে পারে এভাবে এক বিচিত্র জীবন এ জাহাজে থাকলে গড়ে ওঠে। কিনারার প্রতি টান, পরিবারের জন্য মায়া, তারপর দীর্ঘদিন বাদে মনে হয়, সে একজন নিরালম্ব মানুষ, সে আছে এই জাহাজেই, জাহাজেই তার জন্ম, জাহাজেই তার শৈশব, যৌবন এবং বার্ধক্য এবং এভাবে সে মরে যাবে। তখন মনে হয় না, তার স্ত্রী আছে, ছেলেপুলে আছে, কেবল মনে হয় সে একটা যানে চড়ে ক্রমান্বয়ে সমুদ্র, দ্বীপ এবং পাহাড় অতিক্রম করে পৃথিবীর সব মানুষের ঘরে ঘরে পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে। সাংসারিক জীবন, স্ত্রী-পুত্র সব অনেক দূরের মনে হয় তখন। বন্দরে নেমে তখন একটু বেলাল্লাপনা করতে না পারলে ভাল লাগে না। পুরোনো ছবির মতো মেয়েমানুষের শরীর একটা যাদুঘর হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে ঠান্ডা, অতি ঠান্ডা কোমরের নিচু অংশটা। কেন যে সেখানে ফুল ফোটার মতো উত্তাপ থাকে না।

ডেবিড ভেবেছিল, এক বিকেলে ছোটবাবুকে নিয়ে বোট-ডেকে বসবে। একটা দ্বীপের পাশ দিয়ে তখন তারা যাবে। দ্বীপটা সোনালি। নানারকমের ক্যাকটাস। ক্যাকটাসগুলো এত বড় যে কখনও ওদের বড় গাছটাছ মনে হয়। এমন সব ক্যাকটাস পৃথিবীর অন্য কোথায় আছে তার জানা নেই। সে তো অন্তত দেখেনি। দূরবীনে এ-সব এত ভাল দেখা যায় যে, মনে হয় সমুদ্রের নীল জল যখন এ-ভাবে এমন একটা দ্বীপকে পৃথিবীর জন্ম থেকে ঘিরে রেখেছে, আর সেই ক্যাকটাস সব ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে তখন সেখানে কোন মানুষের পায়ের ছাপ থাকবে না হয় না। কিন্তু সে জানে, এ দ্বীপে মানুষেরা আসেনি। কি হবে, এইসব দ্বীপে শুধু ক্যাকটাস, এবং এত ছোট যে ফার্লঙের মতো বৃত্তাকারে ভেসে আছে। মাটির রঙ সে যতবার যে-ভাবেই দেখেছে, সোনালি এবং ক্যাকটাসগুলো অতি প্রাচীন বলে নীল রঙের। আর সূর্য উঠলে ওর মনে হত পৃথিবীতে প্রথম মানুষ আদম ইভ এখানে বোধ হয় শৈশবে বড় হয়েছে। আদম ইভের পক্ষে এর চেয়ে নির্জন জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সে দূরবীনে কোনও গিরগিটি দেখেনি, কোনও টিকটিকি দেখেনি। পিঁপড়ে টিপড়ে আছে কিনা, বুঝতে পারে না। কেবল দ্বীপটার চারপাশে নানারকমের শঙ্খের মরা খোল পড়ে আছে। হঠাৎ দেখলে মানুষের মাথার কঙ্কালের মতো মনে হয়। তখন গা’টা শিউরে ওঠে।

কিন্তু সে দেখল, ছোটকে তখন ভীষণ ধমকাচ্ছে মেজ-মিস্ত্রি। ছোট কাজ করছিল ফাইভারের সঙ্গে। ফাইভারকেও খিস্তি করছে। এবং গালাগাল, মুখে যা আসে তাই বলছে। বড় বেশি হামবড়া ভাব এই মেজ-মিস্ত্রি আর্চির। সে জাহাজের এনজিনঘরের সব। দায়িত্ব সব তার। সে জোরে জোরে হাঁকছে—সারেঙ, সারেঙ! ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে হাঁকছে। এবং ওর চিৎকারে জ্যাক পর্যন্ত ছুটে এসেছিল। কাপ্তান চার্টরুমের পোর্টহোল দিয়ে দেখছে, আর্চি ভীষণ মেজাজে কথা বলছে সারেঙের সঙ্গে। সারেঙ আমতা আমতা করছে।

ছোট চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

আর্চি চেঁচিয়ে বলছে, এ ছোকরা এখানে কেন? এখানে কেন জবাব দাও।

হঠাৎ মেজ-মিস্ত্রি ক্ষেপে যাবার কারণ সে বুঝতে পারছে না। সে বলল, সারেঙসাব বলেছেন ফাইভারকে একটু হেল্প করতে।

—হেল্‌প, মানে তুমি ফাইভারকে হেল্প করবে! তোমার এত সাহস কোথা থেকে আসে হে ছোকরা! তুমি কি ভেবেছ!

ছোট যথাযথ ইংরেজীতে বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিল, আমি কিছু ভাবিনি স্যার।

—মুখের ওপর কথা! কি সাহস! এইসব ছোকরাদের বেজায় সাহস। তুমি কাল কার পারমিশনে জাহাজ থেকে নেমে গেছ?

—কারো না। যাবার সময় সারেঙসাবকে বলে গেছি।

আর্চি বুঝল এখানে তার কিছু করার নেই। নিচে নেবে যাবার অনুমতি সারেঙ অনায়াসে দিতে পারে। সে আবার হেঁকে উঠল, ওহে ছোকরা, শুনে রাখো জাহাজের কাজে নবাবি চলে না।

ছোট বলল, জানি স্যার।

—তুমি জানো! কি জানো! কি জানো, যাও হতভাগা পাজি, নচ্ছার, নিচে যাও। ফাইভার, এই রাসকেল ফাইভার, তোমার মুখের চামড়া খুলে এবার দেখছি একজোড়া জুতো না বানালে চলছে না। আহম্মক, তুমি হেল্পার নিয়েছ কেন!

—একা পারা যাচ্ছে না সেকেন্ড। দেখুন, কি পুরোনো জং ধরা, মনে হচ্ছে, জাহাজে যারা গত সফরে ছিল, তারা হাতই দেয়নি।

—রাখো তোমার নোংরামো। পরের ঘাড়ে দোষ চাপাবে না। পুরোনো জাহাজে এমন হয়।

—দেখুন স্ট্রেপারগুলো কেমন জ্যাম। দেখুন, বলে সে তেলকালিতে মাখামাখি হয়েও স্ট্রেপারের নাট আলগা করতে পারল না।

আর্চি দেখল, বেশ লম্বা হয়ে ফাইভার ডেক বরাবর উইনচের নিচে ঢুকে গেছে। ওর পা থেকে কোমর পর্যন্ত বাইরে। আর বাকিটা ভেতরে। নাট টেনে জ্যাম ছাড়াতে পারছে না। এ-শীতেও সে ঘামছে। এবার আর্চি খুব জোরে ফাইভারের পায়ের ওপর চাপ দিল। –আঃ একটা চিৎকার। টানো। এবং সঙ্গে সঙ্গে নাট-বোল্ট আলগা হয়ে গেল। এমন একটা নির্যাতনের ভেতর আর্চির নিষ্ঠুরতার যেন শেষ থাকে না। জাহাজ ডারবান যাচ্ছে! সেখানে কিছু পাটের গাট নামানো হবে। কিছু চায়ের পেটি। ডেরিকগুলো ঠিকঠাক, এবং উইনচগুলো সব চালু করে নিতে না পারলে মেজ-মিস্ত্রি আর্চির বদনাম হয়ে যাবে।

অথচ ছোটবাবু জানে মেজ মিস্ত্রি আগেও দেখেছে, সে ফাইভারের সঙ্গে কাজ করছে। কাল বড়- মিস্ত্রি ওকে মেজ-মালোমের সঙ্গে দেখেছে। সে জাহাজে কি কাজ করে হয়ত এমন খবর নিয়েছে। আর একটা রাগ তো পুষেই রেখেছে মেজ-মিস্ত্রি! এখন বড়-মিস্ত্রি পাশে থাকলে ঝাল মেটাতে সময় লাগবে না। সে মেজ-মিস্ত্রির এমন ব্যবহারে অবাক হল না। কেবল বলল, স্যার, আমি কোথায় কাজ করব।

সামান্য কোলবয়ের সোজাসুজি মেজ-মিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলার এক্তিয়ার নেই। এসব বেয়াদপী সে সহ্য করতে পারে না। সে গম্ভীর হয়ে যায়। সারেঙকে শুধু কি বলে দিল। মেজ-মিস্ত্রির দায় নেই ছোটকে সোজাসুজি কিছু বলার। এবং এই যে সোজাসুজি ছোট জিজ্ঞাসা করল, এতে অপমান, ভীষণ অহংকারে লাগে। আগে এসব জাহাজে ছিল না। আগে যারা আসত, ওরা সবাই প্রায় যেন ক্রীতদাসের সামিল। একটা কথাও বুঝত না। সারেঙ সব কাজ বুঝে নিত, তারপর সে সবাইকে দিয়ে কাজগুলো করাত। এখন এরা নতুন উঠে আসছে। কেউ কেউ বেশ সুন্দর ইংরাজিতে কথাবার্তাও বলতে পারে। আর কি যে এরা ভাবে, একটু ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতে পারলেই, যথাযথ বলেছে ভেবে ফেলার চেষ্টা করে। আর্চি তখন মনে মনে না হেসে পারে না।

আর্চির গালাগাল ছোটকে ভীষণ কাবু করে দিয়েছে। আবার জ্যাক মাথার ওপর বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। জ্যাক কাছে না থাকলে সে যেন এতটা অপমানিত বোধ করত না। সে জ্যাকের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারল না পর্যন্ত। চুপচাপ সারেঙের পিছু পিছু এনজিনরুমের দরজায় ঢুকে গেল। লোহার জালিতে হেঁটে গেলেই সামনে সোজা সিঁড়ি নেমে গেছে। সে সিঁড়ির দু’রডে হাত রেখে শরীর সোজা ছেড়ে দিয়ে নেমে গেল না আজ। ধীরে ধীরে কোন কারাগারে বন্দী মানুষের মতো হেঁটে গেল। আর্চি যেভাবে পেছনে লেগেছে, আজ হোক কাল হোক সে একটা হয়তো কিছু করে ফেলতে পারে। ছোটবাবু ভেতর ভেতর কেমন সহসা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। তখন সারেঙ বললেন, ওদিকে না। এদিকে।

ছোট, জেনারেটারের ডানদিকে হেঁটে গেল। তারপর বয়লার এবং ক্র্যাঙ্ক স্যাটের মাঝখানে ঢুকে সে ও-পাশের কনডেনসার বাঁয়ে ফেলে আরও ভেতরে ঢুকে গেল। এখানে সারেঙ একটা প্লেট তুলে বললেন, নিচে নাম। নিচটা ভীষণ অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। ছোটর ভীষণ ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল। সে নিচে নেমে গেলে যদি সারেঙ প্লেট চাপা দিয়ে সরে যান। অন্ধকারে পর পর জলের খালি ট্যাঙ্ক নিচে। ভেতরে ঢুকে গেলে, একটা দিয়ে আর একটায় বের হয়ে যেতে পারবে, কিন্তু ওপরে উঠে আসার রাস্তাটা তার জানা থাকবে না। কেমন একটা গুম গুম শব্দ ভেতরে। সারেঙ একটা বাতির ব্যবস্থা করছে। নিচে কিছু দেখা যাচ্ছে না। একটা বালব জ্বলছে লম্বা রবারে মোড়া তারে। সে সেটা নিয়ে ভেতরে নেমে গেলে দেখল, ট্যাঙ্কগুলো থেকে জল পাম্প করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ওর এখন কাজ বালতিতে সব ময়লা তোলা। লাল সবুজ নানারকমের শ্যাওলা জমেছে। ট্যাঙ্কের ছাদে, চারপাশে শ্যাওলার জট। এ-কাজ একা এক নাগাড়ে এক বছরেও শেষ করতে পারবে না। সে বুঝল, এটা শাস্তি দেবার কৌশল।

ছোট চুপচাপ কাজ করে গেল। সে ক্রমে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। বালতির সঙ্গে দড়ি বাঁধা। এনজিনরুমের নিচে এই ট্যাঙ্ক ছড়ানো। এক একটা এপারটমেন্টের মতো। ভেতরে গোলগোল হোল। একটার ভেতর দিয়ে আর একটা ট্যাঙ্কে চলে যাওয়া যায়। সারেঙ বালতিটা ভরে গেলেই তুলে ফেলছেন। মেজ-মিস্ত্রি জেনারেটারের পাশে দাঁড়িয়ে স্টিম দেখছে জাহাজের। আর বেশ একটা যেন মজা পাচ্ছে। সে হাভানা চুরুটের ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার করে ফেলেছে।

ছোট এভাবে কাজ করে যাচ্ছিল। সে বেশ ভেতরে ঢুকে গেছে। সে সব সময় সঙ্গে আলোটা রেখেছে, একটা এপারটমেন্ট থেকে অন্য এপারটমেন্টে ঢুকে যাবার সময় সে বাতিটা ছাড়ছে না। ভয়, সে একটা না গোলকধাঁধায় পড়ে যায়। এমন একটা জায়গা এই জাহাজে আছে যে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। ওপরে বিশাল প্লেটের ওপর বড় বড় কলামে সিলিন্ডার। বড় বড় তিনটে পিস্টন থামের মতো মোটা ঘুরে যাচ্ছে। অতিকায় প্রপেলার স্যাফট মাথার ওপর অনবরত ঘুরছে। আর তার তলায় সেই আলাদিনের দৈত্যের মতো সারেঙ গুহার মুখে। সে কোথায় যে ক্রমে চলে যাচ্ছে! সে বুঝতে পারছে তার পায়ের নিচে জাহাজের তলা, খোলের শেষ বিন্দ!

ছোটবাবুর ঘাড় ধরে গেছে। কারণ, ভেতরে সোজা বসা যায় না। নুয়ে নুয়ে কাজ করছে সে। সে ট্যাঙ্কের জল সাদা কাপড়ে মুছে দিচ্ছে। ওর জামা প্যান্ট ভিজে গেছে। ভেতরটা এত ঠান্ডা যে শীতের গুহা যেন। ওর মনে হচ্ছিল হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। সে বুঝতে পারছে আর কিছু সময় থাকলে সে এখানে ঠান্ডায় বরফ হয়ে যাবে।

কিন্তু সে তো কাজকে ভয় পায় না। সে তো মরে গেলেও বলতে পারবে না, শীত করছে। যতক্ষণ না সারেঙ নিচে নেমে বলছেন, উঠে আয়, ততক্ষণ এখানেই তাকে থাকতে হবে।

ছোট সেজন্য খুব দ্রুত কাজ করে যাচ্ছে! বসে বসে করলে শরীরের রক্ত গরম থাকে না, ঠান্ডা হয়ে যায়। সে কিছুটা হাঁটু গেঁড়ে কাজ করে যেতে থাকল। দাঁত, ঠকঠক করছে। তবু সে কাজ করে যাচ্ছে। যতটা সম্ভব সে হাত পা নেড়ে করে যাচ্ছে। ওর মুখ চোখে এখন নানাবর্ণের দাগ। কোথাও সবুজ, কোথাও খয়েরি। সে জানে না, ওর চোখ মুখ এখন একজন সারকাসের জোকারের মতো।

ছোটকে সারেঙ কোথায় নিয়ে গেল! জ্যাক কাজের অছিলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোটকে খুঁজে মরছে। আর্চি বেশ মজা করছে ছোটকে নিয়ে। জ্যাকের তাই মনে হল। আর্চি ভেবেছে, জ্যাক কিছু বোঝে না। জ্যাক লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে। সে কাউকে কিছু বলছে না। সে চিমনির পাশে, বয়লার ঘরে নেমে যাবার সিঁড়িতে বেশ শিস দিতে দিতে নামছে। অথবা সেই গানটা যেন শিসের ভেতর—উই আর ইন দি সেম বোট….. অথবা মনে হয় জ্যাক ভীষণভাবে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছে। জ্যাককে এখন খুব চতুর মনে হচ্ছে। ছোটকে দিয়ে আর্চি কি করাচ্ছে, অথবা কি করাতে চায় সেটা না দেখতে পারলে ভেতরের অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। সে লম্বা বয়লার স্যুটের ওপর একটা কালো সোয়েটার চাপিয়েছে। কারণ শীত ক্রমে বাড়ছে। যত ডারবানের দিকে যাচ্ছে তত ঠান্ডা বাড়ছে। এবং এভাবে ওরা এখন শীতের দেশে চলে যাবে। ছোট যে এখন কোথায়! সে বাংকারে উঁকি দিয়ে দেখল অন্ধকারে একজন কোলবয় বসে বসে বিড়ি খাচ্ছে। সে জ্যাককে দেখেই তাড়াতাড়ি বিড়িটা ফেলে বেলচে হাতে গাড়িটা টানতে টানতে কয়লার কাছে নিয়ে গেল। পাশের বাংকারের লোকটা মাঝ-বয়সী মানুষ অনবরত গাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর কয়লা ফেলছে।

না, এখানেও নেই। সে সিঁড়ি ভেঙ্গে আরও নিচে ঠিক বয়লার ঘরে নেমে গেল। টিন্ডাল, ফায়ারম্যান, ওকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। সারেঙের ওয়াচ। সবাই এখন দমাদম কয়লা হাকড়াচ্ছে চুল্লীতে। জ্যাক- এ-সব বুঝতে পারে, এটা ওরা ওর সম্মানে কাজ দেখাচ্ছে। এখন কয়লা ফার্ণেসে না দিলেও চলত। সে এখানেও ছোটকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হল। মিঃ আর্চি ছোটকে কোথায় নিয়ে সেঁদিয়েছে।

জ্যাক এবার গঙ্গাবাজুর বয়লার আর বালকেড বরাবর যে রাস্তাটা এনজিনরুমে চলে গেছে তার ভেতর ঢুকে গেল। এখানে এলে চারপাশের ছাই ঝুরঝুর করে মাথার ওপর পড়তে থাকে। সে যেতে যেতে বুঝতে পারল ওর মুখেও ছাই লেগেছে। রুমাল দিয়ে ভালভাবে ছাই মুছে ভেতরে ঢুকে দেখল মিঃ আর্টি সিঁড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখছে না, জ্যাক সামনে। জ্যাক বলল, গুড মৰ্ণিং মিঃ আৰ্চি।

—গুড মৰ্ণিং জ্যাক। হঠাৎ এখানে। তুমি তো কখনও আস না।

—আপনার এনজিনঘর দেখতে এলাম।

—তুমি আগে দ্যাখোনি।

—কবে দেখলাম! খুব বিস্ময়ের সঙ্গে তাকাল।

—বেশ, এস, দেখাচ্ছি।

মিঃ আর্চির কথাবার্তা কি সুন্দর এখন। বড় ভাল মানুষ। যেন সে জ্যাকের জন্য যা কিছু দরকার সব করতে পারে। জ্যাককে নিয়ে সে প্রপেলার স্যাটের পাশে চলে গেল। কখনও কনডেনসারের পাশে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখালো। জ্যাক আসলে কিছুই দেখছে না। সে তো সব জানে, সে তো কতবার এসব দেখেছে। কিন্তু সারেঙ যে ছোটকে এদিকে নিয়ে এল তারপর কোথায়! সে বলল, মিঃ আর্চি আপনার এনজিনঘর খুব পরিষ্কার। এমন পরিষ্কার রাখেন কি করে! তারপর খস খস শব্দ। কেউ মনে হয় প্লেট তেল আর শিরিস কাগজে ঘসছে। মনে হল জ্যাকের, হয়তো ছোট হবে। ওরা নীল রঙের পোশাক পরে সবাই। কিন্তু কাছে গেলে দেখল, একজন বুড়ো মতো মানুষ কোলবয় টয় হবে, প্লেট ঘসছে। জ্যাক আর ভেতরে উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না। সে তো, সারেঙ, ছোটবাবুকে নিয়ে এনজিনরুমে নেমে এলে অনেকক্ষণ বোট-ডেকের রেলিঙে দাঁড়িয়েছিল। এনজিনরুম থেকে উঠে যাবার দুটো পথ। একটা এনজিনরুম থেকে সোজা সিঁড়ি ধরে, অন্যটা বয়লারঘর দিয়ে চিমনির পাশে। সে বোট-ডেকে, বয়-কেবিনের পাশে ছিল বলে দুটো পথই চোখের ওপর। ছোট এবং সারেঙ এনজিনরুম থেকে উঠে গেলে ঠিক চোখে পড়ত।

অথচ সে বলতে পারছে না, মেজ, তুমি ওকে কোথায় রাখলে। মিঃ আর্চি, ছোট তো সামান্য একজন নাবিক, তুমি কত বড় কাজ কর জাহাজে, একজন সামান্য নাবিককে এভাবে অকারণ কষ্ট দিয়ে কি লাভ! তুমি নিজেকে ছোট করছ আর্চি। এ সবই মনের কথা। সে আর না পেরে, শেষবারের মতো যমুনাবাজুর বয়লারের ফাঁকে উঁকি মারলেই দেখল, সারেঙ দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে দড়ি! তিনি টেনে টেনে বালতি তোলার সময় দেখলেন, একেবারে সামনে জ্যাক। তিনি খুব থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন, গুড মৰ্ণিং সাব।

জ্যাক বলল, গুড মর্ণিং! এখানে কি করছ সারেঙ?

—টাংকি সাফ করছি সাব।

—আমি টাংকিতে নামব!

—না না সাব। নামলে সব ভিজে যাবে। জুতা ভিজে যাবে। ঠান্ডা লাগবে। ভীষণ ঠান্ডা।

জ্যাক কিছু শুনল না। সে লাফিয়ে নিচে নেমে গেল। দেখল অনেক দূরে আলোর তারটা ভেতরের দিকে চলে গেছে! সে বলল, কি চমৎকার সারেঙ। সে ছোটকে দেখতে পাচ্ছে না।

মাথার ওপর ট্যাঙ্ক-টপ প্রায় ছাদের মতো। নির্জন কারাগারের মতো জায়গা। কেবল এনজিনটা গর্জাচ্ছে বলে কঠিন একটা ধাতব শব্দ। ভেতরে জলের আধার। এবং শ্যাওলার গন্ধ। ঠান্ডা এক অতীব হিমশৈল ভেসে বেড়ালে সমুদ্রে যেমন লাগে ঠিক তেমনি। জ্যাক শীতের দেশের মানুষ, ওরও কেমন ভেতরটা শীত শীত করছে। কিছুক্ষণ থাকলে ওরও দাঁত ঠক ঠক করবে।

এবং এ-সময়ে মনে হল, ঠিক ভূতের মতো অথবা ছায়া ছায়া অন্ধকারে কেউ হামাগুড়ি দিয়ে এদিকে আসছে! ক্রমে কাছে এলে বুঝতে পারল, ছোট। জলে ভিজে একেবারে সাদা হয়ে গেছে। মুখে নানাবর্ণের বর্ণমালা, সঠিক জোকার। চোখ তবু উজ্জ্বল। সে জ্যাককে দেখেই হাসল। জামাকাপড় জবজবে ভেজা। ভীষণ ক্লান্ত এবং দাঁত ঠক ঠক করে কাঁপছে।

জ্যাক হাসতে পারল না। কিছু বলতেও পারল না। ছোট, প্লেটের মুখে এসে বালতিটা সারেঙের হাতে দেবার সময় বলল, একটু আগুন না হলে চাচা মারা যাব।

জ্যাককে বলল, তুমি এখানে! দাঁত ঠক ঠক করে কাঁপছে বলে কথা স্পষ্ট হচ্ছে না। কেমন লম্বা হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি শব্দ। যেন জলে ঠক ঠক শব্দ করে মাছ ধরার মতো এক পাখি। জ্যাক এবার ওপরে উঠে সোজা চলে গেল। একটা কথাও ছোটর সঙ্গে বলল না। সারেঙ কিছুটা এতে ঘাবড়ে গেছে। সে বলল, চল ওপরে। খাবার সময় হয়ে গেছে। পরে দেখা যাবে।

সে ছুটি পেয়ে এক দৌড়ে ওপরে উঠে গেল। সে যে সাদা হয়ে গেছে এবং তাকে অকারণ মেজ-মিস্ত্রি টরচার করছে এটা মৈত্র পিছিলে সব জাহাজিদের বলে বেড়াচ্ছে। এটা কেন হবে! সারেঙের কি ইচ্ছা। ওর কি ইচ্ছা ছোটকে মেরে ফেলবে! মেজ-মিস্ত্রি কি ভাবেন! তাকে কি আমাদের মাথা নেবার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এবং ছোট, পিছিলে ঢুকে গেলেই বুঝতে পারল ভীষণ উত্তেজনা সৃষ্টি করছে মৈত্র, অমিয়, লতিফ, মনু, জব্বার। সারেঙকে ওরা এলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। —আপনি কি ভেবেছেন!

—কি ভেবেছি!

–মেজ-মিস্ত্রি যাই বলবে আপনাকে তাই করতে হবে! —তা ছাড়া কি!

—আপনি নিজের বুদ্ধি বিবেচনা খাটাবেন না? এখনও আপনি ভেবেছেন, আমরা ওদের গোলাম আছি!

—কিন্তু উনি অর্ডার দিলে আমি কি করব।

—বলতে পারলেন না, ডারবানের ঘাটে হবে। সবাই নেমে যা পারা যায় করা যেত। ছোটর একার কি দায় কাজ করার।

—কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখা যাচ্ছে।

—শুনুন, মৈত্র বলল, তোষামোদ আর করবেন না। আর না। জব্বার বলল, আর না। ওরা যা খুশী একসময় করতো, এখন আর না।

সারেঙসাব পুরোনো মানুষ। তার কাজ করার স্বভাব। আদেশ তামিল করা তার কাজ! সে ভেবে পেল না কি অন্যায়টা মেজ-মিস্ত্রি করেছে। ওর বরং ছোটর ওপরই রাগ হল। একটুতেই কাহিল হয়ে যায়! এবং ছোটও ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেছে। সে গ্যালিতে আগুন পোহাবার সময় বলল, আরে মৈত্রদা কিছু তো করতে হবে।

—যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস না। ডারবানের ঘাটে আমরা সবাই মিলে করলে কি আর কাজ! এতো আর তকতকে ঝকঝকে করা হয় না। একটু মুছে পরিষ্কার করে দেওয়া। ঠিক পরিষ্কার করতে গেলে এক বছরে কেন, জাহাজের জীবনেও হবে না। এটা আবার জাহাজ নাকি! তাপ্পি মারা জাহাজ তায় মেজ-মিস্ত্রি তার আবার কত রোয়াব! শেষ পর্যন্ত মেজ সম্পর্কে মৈত্রদা কিছু উঁচুদরের খিস্তিও ঝেড়ে দিল।

মাঝে মাঝে এটা দেখেছে ছোট, মৈত্রদা ঝগড়ার সময় কেমন ছেলেমানুষ হয়ে যায়। সে সারা সফরেই এভাবে জাহাজিদের পক্ষ নিয়ে কথা বলে। সে সেদিনও ঝগড়া করেছে। সারেঙসাব, মেজ- মিস্ত্রির কি রাইট আছে জুতো দিয়ে মুখ নেড়ে দেখার! কি রাইট আছে বলুন। আপনারা কিছু বলেন না বলে পেয়ে বসে। আপনারা বলবেন না, আমাদেরও যেতে দেবেন না।

সারেঙসাব বললেন, আরে সাহেবদের সঙ্গে ঝগড়া করে পারা যায় না। ওরা আমাদের তো ওপরওয়ালা। ওরা আমাদের অনেক ক্ষতি করতে পারে।

মৈত্রদা যেমন বলে থাকে বলে ফেলল, কচু করতে পারে। কই দু-দুবার তো ব্ল্যাক লিসটেড হয়েছি, জাহাজ পাই না এমন তো হয় না।

ছোট কি করবে তখন ভেবে পায় না। সারেঙসাব এভাবেই সারাজীবন কাজ করে এসেছেন। সব কাজই জাহাজের কাজ, সবই করতে হবে, ভয় পেলে চলবে না। ছোট আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে এই একটা ভয় থেকে গেল। জ্বরটর আসতে পারে। বুকে কফ বেঁধে একটা কেলেঙ্কারি হতে পারে। কারণ ভেতরে ভেতরে সে খুব আড়ষ্ট বোধ করছিল। খাবার খেয়ে আবার কি কাজ করতে হবে সে জানে না। যদি আবার ট্যাঙ্কের ভিতর নেমে যেতে হয়—ও কেমন অসহায় বোধ করতে থাকল।

তবু বিকেলের দিকে কেউ জানে না, কেন মেজ-মিস্ত্রি সারেঙকে বলে পাঠাল, এখন ট্যাঙ্কটপের কাজ বন্ধ থাকবে। ছোট যেমন কাজ করছে, তেমনি করবে।

ছোট কেবল বুঝতে পারল, এটা জ্যাকের কাজ। জ্যাক কিভাবে এটা করেছে সে জানে না। প্ৰথমে সে জ্যাকের ওপর ভীষণ খুশী। তারপরই জ্যাকের ওপর ওর কেমন একটা রাগ, অথবা জ্যাক কি ভেবে থাকে, আমি কোন কাজের উপযুক্ত নই, আমি কি কিছু পারি না! জ্যাক কি আমাকে খুব সাহসী মনে করে না? সে ভাবল, জ্যাককে একা পেলে দু-কথা শুনিয়ে দেবে। এবং তারপরই মনে হল, সত্যি সে সাহসী নয়। ভাবতেই ভেতরে কেমন হীনমন্যতা জন্মে গেল। এমন কি জ্যাকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেও ভারি লজ্জার ব্যাপার। সে সারাটা বিকেল ফাইভারের সঙ্গে প্রায় ঠিক আগের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করল। জ্যাক যাতে দেখতে না পায়—সে জাহাজে সেঁধিয়ে গেল।

এভাবে সেকেন্ড অফিসারও বিকেলে বসে থাকল, ছোটকে দেখতে পেল না। এভাবে জ্যাক চুপচাপ বয়কেবিন পর্যন্ত বার বার ঘুরে গেছে তবু ছোটকে দেখতে পেল না’। বেশ জাহাজ যাচ্ছে। এবং কিছু উডুক্কু মাছ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, আর নীল জলে ডুবে যাচ্ছে। সামনে জল কেটে যাচ্ছে জাহাজ, দু’পাশে অজস্র বিন্দু বিন্দু সাদা ফেনা। আর আকাশটাকে কখনও মনে হয় নীল চাঁদোয়ার মতো। এবং কতভাবে যে এ-আকাশ সুন্দরভাবে সেজে থাকতে ভালবাসে। কখনও কিছু মেঘ ভেসে গেলে, সমুদ্রে তাদের ছায়া, কখনও সাদা, কখনও লাল, অথবা হলুদ রঙের ছায়া। নীল জলে এইসব ছায়া খেলা করে বেড়ালে জ্যাকের মনে হয় পৃথিবীতে সে খুব ভালবাবে বেঁচে আছে। ঠিক সেই নদীর পারে কোন দুর্গের পাশে তার বাবার প্রাসাদের মতো বাড়িতে সে যখন হেঁটে যায়, চারপাশে ডেইজি ফুলেরা তখন ফুটে থাকে। এখানে ফুল নেই, কিন্তু ছোট আছে। ছোট আছে বলেই বোট- ডেকে তার বার বার হেঁটে বেড়াতে ভাল লাগে।

এভাবে একদিন সেই ক্যাকটাসের দ্বীপটাও দূরে দেখা গেল। তখন বিকেল, সূর্য অস্ত যাবে আর কিছু সময় বাদে। ছোটকে সেকেন্ড অফিসার ডেবিড খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ তিন-চারদিন কেউ ওকে দেখতে পায়নি। ডেবিড বুঝতে পারছে ছোটকে এভাবে মেজ-মিস্ত্রি গালাগাল করছে বলে তার খুব আত্মসম্মানে লেগেছে। এবং এভাবে ডেবিড মানুষের স্বভাব বুঝতে পারে—ছোট ঠিক দশটা জাহাজির মতো নয়। কোথায় যেন সে একটা প্রাচীন সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছবি তার ব্যবহারে সব সময় ঝুলিয়ে রাখে। তখন ছেলেটার জন্য ডেবিডের কেন জানি কষ্ট হয়।

ছোটকে ডেবিড ফোকসাল থেকে ডেকে নিল। বলল, এস।

ছোট এবং ডেবিড পাশাপাশি হাঁটছে। ছোট পরেছে একটা সাদা পাজামা, একটা ডুরে সার্ট। সে একটা ফুলহাতা সোয়েটার গায়ে দিয়েছে। সোয়েটারটা সেই আগের—মৈত্রদা দিয়েছে। কথা আছে ডারবানে গিয়ে মৈত্রদা সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেট থেকে ওকে সব গরম জামা-কাপড় কিনে দেবে। কারণ জাহাজ যত যাবে তত ক্রমশ শীত বাড়বে। অবশ্য একটা কালো রঙের ফুলহাতা সোয়েটার আর কম্বলের গরম প্যান্ট কোম্পানী তাকে দিয়েছে। সেটা এত ঢোলা যে পরা যায় না। আর শীত আরও না পড়লে পরা যাবে না। তা ছাড়া জাহাজি মানুষেরা ফিটফাট থাকবে, পরিচ্ছন্ন থাকবে, শহরে বের হবার সময় টিপটপ বের হতে হবে, কারণ বিদেশে ছোট একজন ভারতীয়, সে যেভাবে বাঁচবে, সেখানে তার দেশ সেভাবে বাঁচবে।

ওরা এসে দুটো ক্যাপস্টানের পাশাপাশি প্রথমে বসল। এক নম্বর ফল্কার ঠিক পাশে। ওরা জাহাজের সামনে আছে এবং গঙ্গাবাজুতে আছে। ক্রমে দ্বীপটা দূরবীনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মেজ বলল, তুমি কি দেখতে পাও বলবে!

ছোট দেখছে, সেই সোনালী রঙের দ্বীপ। বড় বড় ক্যাকটাস। কি যে বড়! শৈশবে সে একবার বনের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিল। এবং মনে হয় সংসারে সবার জন্য এমন একটা প্রিয় বন অথবা তপোবন থাকা দরকার যেখানে মানুষ হেঁটে গেলে নিজেকে খুঁজে পায়। মেজ-মালোম এই দ্বীপের কাছে এলে কি যেন পেয়ে যায়, যা ওর মুখ না দেখলে ঠিক বিশ্বাস করা যাবে না।

মেজ বলল, জানো ছোট, আমার মাঝে মাঝে এই সব দ্বীপে নেমে যেতে ইচ্ছে হয়।

ছোট বলল, দু-একদিন ভাল লাগবে। তারপর আর ভাল লাগবে না।

—না তুমি জান না। তারপর মেজ-মালোম কেমন সঙ্কোচ বোধ করল, যেন ছোটকে এ সব ঠিক বলা যায় না। আসলে এমন একটা দ্বীপ দেখবে বলে সে সব সময় বসে থাকে। যদি গভীর রাতে কথা থাকে দ্বীপটা পার হয়ে যাবে—যদি এমন হয় ওয়াচ শেষে আরও দু-তিন ঘন্টা, দরকার হলে চার-পাঁচ ঘন্টা জেগে থাকতে হবে, সে তাও করে। দ্বীপে সে এবং এক সুন্দরী দ্বীপবাসিনী, সে আর কিছু চায় না। কিছু পাতি লেবুর গাছ থাকবে, আর থাকবে—নীল জলের গভীরে, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আশ্চর্য সব ঝিনুক। শালতিতে দ্বীপের চারপাশে সোনালী রোদে ঝিনুক খোঁজা সে যে কি বিষ্ময়! সে ডুবে ডুবে ঝিনুক তুলে আনবে, ঝিনুকের খোল ভেঙ্গে শাঁস সে লেবুর রসে আর নুনে ভিজিয়ে খাবে। সে আর সেই যুবতী। যার শরীরে কোন পোশাক থাকবে না। সে মাথায় পাতার মুকুট পরতে ভালবাসবে আর সে রোদে অথবা বৃষ্টিপাতে মাঠের ছায়ায় ঘাসের ভেতর নিরন্তর ছুটে বেড়াবে। সে তার চিবুকে, তারপর স্তনে এবং নিচে নেমে যেতে যেতে ক্রমে গভীর সমুদ্রে ডুবে গেলে, মনে থাকবে না এবি তার স্ত্রী। মনে থাকবে না এবি আগামী বসন্তে ওর জন্য জন্মদিনের কেক বানাবে, এবং চার্চে সে সব কিছুর ভেতর তার স্বামী যে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার জন্য প্রার্থনা করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *