অলৌকিক জলযান – ৫৩

।। তিপ্পান্ন।।

বনি অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। হিগিনস ভাঙা যীশুর মূর্তি টেবিলে জোড়া লাগাচ্ছেন। সারেঙ পোর্ট- হোলে দাঁড়িয়ে আছেন। ফ্যাকাশে চাঁদ সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে এবং অজস্র চাঁদ এভাবে যেন হাজার লক্ষ চাঁদের প্রতিবিম্ব ভাসছে সমুদ্রে। তারপর অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। সমুদ্রে তেমনি কল-কল ছল-ছল শব্দ। ছোটবাবু হেঁটে যাচ্ছে ডেক ধরে। সে শেষবারের মতো জাহাজটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। সবই মনে পড়ছিল। যেন পাশে দাঁড়িয়ে মৈত্রদা বলছে—কিরে ছোট, তোরাও চললি। সে পিছিলের রেলিঙে এসে ঝুঁকে দাঁড়াল। ডাঙার কাছে এলে, মৈত্রদা সে অমিয় জব্বার মনু দাঁড়িয়ে থাকত।—কিরে ছোটবাবু বিফ খেয়েছিস বলে মন খারাপ! পৃথিবীটাকে এত ছোট ভাবিস কেন। আমি বামুনের ছেলে না! আমার জাত নেই বুঝি? অথবা যেন দূরে বোট-ডেকে ডেবিড দাঁড়িয়ে হাঁকছে, ছোটবাবু সামনে আটলান্টিক। এবার আমরা ভারত মহাসাগর পার হয়ে যাচ্ছি। অথবা মৈত্রদার দু’টি একটা কথা, হেঁটে যাবার সময় মনে করতে পারছে। গ্যালিতে ভাণ্ডারি জ্যেঠার চর্বি ভাজা চাপাটির গন্ধ একটু নাক টানলেই যেন পেয়ে যাবে। সে পিছিলে এসে গেছে। কত জমজমাট ছিল জায়গাটা। অনিমেষের গলা যেন এক্ষুনি শুনতে পাবে—সে যেন পায়ে ঘুঙ্গুর বেঁধে গাইছে—ওলো সই ললিতে, যাচ্ছি আমি গলিতে। অথবা গানের সঙ্গে তার গলায় বাজছে—ছোটবাবু ভূত দেখেছে। সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেলে অন্ধকারটা আরও চাপ বেঁধে আছে। কোন শব্দ নেই। কেবল স্টিয়ারিং-এনিজিনের পেনিয়ান এখনও বাতাসে কক্ কক্ করছে। কাল তাদের জাহাজ ছেড়ে সমুদ্রে ভেসে পড়তে হবে। বনি এত বড় বিপদের কথা বিন্দুমাত্র জানে না। বনি অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সব ফোকসালের দরজা বন্ধ। দু’টো-একটা ইঁদুর ছুটে যাচ্ছে। আর এক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে গেলে তার ফোকসাল। জাহাজে এটাই ছিল তার প্রথম আস্তানা। সে টর্চ জ্বেলে এবার ভিতরে ঢুকে নিজের বাংকে কিছুক্ষণ বসে থাকল। মৈত্রদা পাশেই আছে মনে হচ্ছিল। যেন বলছে, খাও ছোটবাবু, খাও। সমুদ্রে কারো বাবা-মা থাকে না। আমরাই আমাদের বাবা-মা। বাংকে তেমনি মৈত্রদার বিছানা পাতা। অমিয় যাবার আগে ওর বিছানাটা উল্টে রেখে গেছে। সব হুবহু তেমনি আছে। সবই এখন স্মৃতি। ডেবিড বন্ধু অনিমেষ জব্বার কিভাবে সমুদ্রে বেঁচে আছে কে জানে! চুপচাপ অন্ধকারে সে বসে থাকল। সে কিছু আর ভাবতে পারছে না।

ছোটবাবুর এভাবে তন্দ্রার মতো এসে গেছিল। তখন মনে হল সারেঙ- সাব ডাকছেন। ছোটবাবু বুঝতে পারছে সারেঙ-সাব দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকছেন। হাতে একটা লম্ফ! সারেঙ-সাবের সাদা পোশাক সাদা চুল সাদা দাড়ি, কোনো কিংবদন্তীর পুরুষের মতো অথবা মনে হয় সেই শৈশবের ফকিরসাব যেন—হাতে তাঁর মুশকিল আসান। একটা পয়সা লম্ফের ভেতর ফেলে দিলেই তিনি তার কপালে ফোঁটা টেনে দেবেন—মুশকিল আসান আসান করে—সেই মাঠে লম্ফ জ্বালিয়ে অন্ধকার রাতে শৈশবে সে যেমন দেখেছে, একজন মানুষ উঠে আসছে, গলায় মালা তাবিজ, গায়ে কালো কাপড়ের অজস্র তালি মারা জোব্বা, হাতে মুশকিল আসানের লম্ফ—তিনি এখন তেমনি দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। বলছেন—কখন তুই এখানে নেমে এয়েছিস! ভাবলাম ছোট ওদিকে যাচ্ছে কেন! তারপর আর তোর পাত্তা নেই। আমার দিলে ধুকপুক উঠে গেছে। নেমে এলাম। এখানে তুই কি করছিস!

সে বলল, চাচা কাল তো আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন না!

সারেঙ-সাবের মুখটা কালো হয়ে গেল।

ছোট বলল, তখন এভাবে কে দেখবে! কে খুঁজে বেড়াবে আমি কোথায় আছি!

তিনি ওপরে হাত তুলে দিলেন! যেন বলার ইচ্ছে, তিনি দেখবেন, ছোট। তারপর বললেন, ওপরে চল। কতক্ষণ বসে থাকবি!

ছোটবাবু ঘড়িতে দেখল চারটে বেজে গেছে।

—একটু ঘুমিয়ে নে ছোট।

—সকাল হয়ে যাচ্ছে। ঘুম আসবে না।

—তবু একটু গড়িয়ে নে।

—শুলে আর উঠতে ইচ্ছে করবে না। চলুন ওপরে যাই।

আর ওপরে এসেই ছোটবাবু তাজ্জব। সেই ক্রস, সেই আলো—প্রায় ফসফরাসের মতো সাদা উজ্জ্বল-বর্ণময় আলো ক্রসটা থেকে দপদপ করে জ্বলছে। একেবারে সামনে। মনে হয় আধ মাইলের ভেতর—কি আরও কাছে কি দূরে কতদূরে হবে—সে এবং সারেঙ-সাব বুঝতে পারছে না। আর ফসফরাসের আলো কখনও জ্বলছে নিভছে। কখনও নীল হলুদ অথবা রক্তবর্ণ হয়ে যাচ্ছে—প্রাচীন মোজেসের সেই দৈববাণীর মতো যেন ক্রসটা বিধাতার করুণ অহমিকা। অথবা অট্টহাস্য করছে সমুদ্রে। ওরা ছুটে যেতে পারল না। হাত পা স্থবির হয়ে যাচ্ছে। বোধ হয় ছোটবাবু মূর্ছা যেত। তখনই কাপ্তানের গলা, আমার সঙ্গে এস।

হিগিনস যেতে যেতে সহসা সতর্ক গলায় ধমক দিলেন, তুমি ওদিকে কোথায় গিয়েছিলে?

—ফোকসালে স্যার।

—কি দরকার এখন সেখানে ঘোরার!

—নেমে যাবার আগে…

তখনও তেমনি ক্রসটা আকাশের নিচে জ্বলছে। সমুদ্রে সামান্য ঢেউ আছে। বাতাস বেশ জোরে বইছে। জাহাজটা উঠছে নামছে। তার মনে হচ্ছিল ক্রসটা উঠছে নামছে। কখনও আকাশের গায়ে অতিকায় হয়ে যাচ্ছে কখনও ঢেউ-এর আড়ালে পড়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে।

তিনি ওদের নিয়ে বোট-ডেকে উঠে যাচ্ছেন। কিছু বলছেন না। চুপচাপ। ছোটবাবু আর না পেরে খুব সতর্ক গলায় বলল, আপনি কিছু বলুন। আমাদের এ কোথায় নামিয়ে দিচ্ছেন।

হিগিনস খুব সহজ গলায় বললেন, ক্রসটা দেখে ঘাবড়ে যাবে না। তারপর বললেন, সকাল হয়ে যাচ্ছে। যত সকাল হবে ক্রসটার সব আগুন অথবা লাল নীল ফসফরাসের জ্বলা কমে আসবে। দিনের আলোতে কিছু দেখতে পাবে না। বোধ হয় কোনো প্রবালের পাহাড়টাহাড় সমুদ্র থেকে ভেসে উঠে এমন হয়েছে। ঝড়ে বৃষ্টিতে রোদে জলে ক্ষয়ে পাহাড়ের মাথাটা এক অতিকায় ক্রস। যত দিন যাচ্ছে তত এটা বড় হয়ে যাচ্ছে। বিশ বছর আগে যা দেখেছিলাম ওটা, এখন তার চেয়ে অনেক বড়। ক্রমশ ওটা সমুদ্রের পাতাল থেকে ওপরে উঠে আসছে বুঝি। গায়ে তার অজস্র ফসফরাস জোনাকির মতো। আত্মগোপন করে আছে।

এবং সত্যি ছোটবাবু দেখল যত পুবদিক ফর্সা হয়ে যাচ্ছে, যত সমুদ্র আর আকাশ কুসুম-কুসুম রঙ ধরছে তত ক্রসটার বিচ্ছুরণ নিস্তেজ হয়ে আসছে। আর সকালে স্পষ্ট দেখল ওটা একটা পাহাড়ের শীর্ষদেশ। এঁকেবেঁকে ক্রুশের মতো। ক্ষয়ে গিয়ে চারপাশে চারটা কালো স্তম্ভ। এবং দূর থেকে দেখতে হুবহু একটা লম্বা প্রায় মাস্তুলের মতো উঁচু ক্রস। ছোটবাবু বলল, কেমন ভয় পেয়ে গেছিলাম পাহাড়টা দেখে। পাহাড়টা কেমন ওপরে উঠে যাচ্ছে।

—ওর দোষ কি বল! ওতো উঠে আসতে চাইবেই।

আর চেঁচামেচিতে বনিও উঠে এসেছে। সে খুব অবাক—ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে একটা কালো কুচকুচে প্রবালের খাড়া পাহাড় দেখতে দেখতে কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ক্রসের মাথা থেকে যে জল চুইয়ে পড়ছে নিচে তাও দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউ পাহাড়টাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে।

বনি বলল, বাবা জাহাজটা ওটার গায়ে গিয়ে আবার ধাক্কা খাবে নাতো!

কারণ তখন তো জাহাজটাও যে কি কারণে ছুটে যাচ্ছে। কোন দিকে যাবে—ওটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না চারপাশে গভীর খাদে নিবিষ্ট এক চোরাস্রোতে পড়ে গেছে জাহাজ বোঝা যাচ্ছে না। তিনি হেঁকে উঠলেন, বনি, তোমার যা কিছু আছে ঠিক করে নাও। তোমরা নেমে যাবে। পাহাড়টা দেখে সব ঠিক করে ফেলেছি।

বনি বলল, কি ঠিক করে নেব?

—তোমার যা কিছু আছে সব।

—কেন বাবা! কি হবে?

—কাছে একটা দ্বীপ পাবে। সেখানে তোমরা যাবে। ছোটবাবুকে আমি সব বুঝিয়ে দিয়েছি। তোমরা খবর পাঠালে আমরা ঠিক উদ্ধার পাব। জাহাজটা উদ্ধার পাবে। দ্বীপে মানুষজন আছে। একটু থেমে বললেন, সবাইর জাহাজ ছেড়ে যাওয়া ঠিক না। আমি আর সারেঙ থাকলাম।

বনি মাথামুণ্ডু কিছু বুঝছে না। সে কি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে! ভাল করে চোখ মুছে দেখল, না, সে ঠিকই দেখছে। বাবা তাকে ভীষণ তাড়াতাড়ি করতে বলছেন। আর ছোটবাবুকে ধমক—এই তোমাকে যে বললাম, বনিকে নিয়ে যাও তুমি, কি হে এত তুমি ভীতু—তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই কিছু। বয়সে তো আর ছোট নেই, কবে দামড়া হয়ে গেছ।

বনি বলল, কতদূর বাবা?

—এই কাছেই। দু-তিন দিনের ভেতর ডাঙা পেয়ে যাবে। সব বলে দিয়েছি। কম্পাসের কাঁটা কত ডিগ্রী বরাবর রাখলে দ্বীপটা পেয়ে যাবে তাও বলে দিয়েছি। পালে জোর বাতাস লাগলে এক আধ দিনেও পেয়ে যেতে পার। দ্বীপটায় সবকিছু পাবে।

বনি বলল, কি মজা! সে ছুটে প্রায় চলে যাচ্ছিল—কিন্তু কি মনে হওয়ায় সে ফের ফিরে এসে বলল, একটু চা করে তোমাদের খাইয়ে যাচ্ছি বাবা। আর কোনও আমাদের তা হলে ভয় নেই বলছ ত!

হিগিনস বললেন, আরে না না, কোনও ভয় নেই। এবারের মতো সবাই বেঁচে গেলাম। তারপর কি মনে পড়ায় বললেন, তা মন্দ না, কি বল সারেঙ। চা করলে ভালই লাগবে। বনি তাড়াতাড়ি করবে! এই রাসকেল—কি, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। হাত লাগাও। বলে তিনি বোটে দু’লাফে উঠে গেলেন। হুড তুলে বললেন, রেশন আগে রাখো। জল রাখো। বাকি সব কাল আমি ঠিক করে রেখেছি। সব আছে। এই একটা দা রেখে দিয়েছি দ্যাখো। রাত-বিরেতে অক্টোপাসের ঠাণ্ডা পা বোটে উঠে এলে দা দিয়ে কোপ মারবে। একজন ঘুমোবে একজন পাহারায় থাকবে।

বনি নিচে নেমে গেছে। ছোটবাবু বোটে উঠে এসেছে। সারেঙ-সাব নিচ থেকে রেশন টেনে তুলছেন। ছোটবাবু আর কাপ্তান সব সাজিয়ে রাখছে—যেন হাতে যা সময় পাওয়া যায়—ছোটবাবুকে সমুদ্র সম্পর্কে আরও কিছুটা অভিজ্ঞ করে তোলা। কাল রাতে একবারে ভেঙে পড়েছিলেন—মাথা ঠিক ছিল না। এখন খুব মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজকাম করে যেতে হবে। বার-বার তিনি সমুদ্র সম্পর্কে বলে যাচ্ছেন—বুঝলে ছোটবাবু, খাবার ফুরিয়ে গেলে প্ল্যাংকাটন সম্বল। প্রাণীজাতীয় শৈবালজাতীয় দু’রকমেরই পাবে। সমুদ্রে এমন সব অনু-পরিমাণ মাছ ভেসে বেড়ায়। চোখে ঠিক দেখা যায় না। হিগিনস আশেপাশে খুঁজে দেখলেন, বনি কাছে কোথাও আছে কিনা। এই দেখছ এটা তোমাদের দিয়ে দিলাম। এটা জলে ফেলে এই বিশ পঁচিশ মিনিট পরে তুললে সামান্য প্ল্যাংকাটন উঠে আসবে। বেশ জল ঝরে গেলে প্রায় সবুজ জেলির মতো দেখতে। আর মনে রাখবে জল না থাকলে তোমরা কাঁচা মাছ চিবিয়ে খেতে পার। ওতে তেষ্টা নিবারণ হবে। আর শোনো সবসময় দু-চারটা মাছ তুলে ভেতরে গর্ত করে রাখবে—কিছুটা লালার মতো জমলে চেটে খেলে তেষ্টা নিবারণ হবে। ওয়াটার ওয়াটার এভরিহোয়েয়ার বাট নট এ ড্রপ টু ড্রিংক—মিথ্যে কথা। ঈশ্বর কোথাও মানুষের আহার রাখেননি তা হতে পারে না। কোলরিজ কিছু জানতেন না। তাঁর কবিতায় নায়কেরা মরীচিকা দেখেছে। সব রপ্ত হয়ে গেলে তোমরা সমুদ্রকে কলা দেখাতে পারবে। একজন যুবকের পক্ষে দীর্ঘ দিন সমুদ্রে বেঁচে থাকা খুব কঠিন না।

আসলে তিনি ছোটবাবুকে সাহস দিচ্ছিলেন। সমুদ্র সম্পর্কে যতটা জ্ঞানগম্যি আছে—যা তিনি পড়াশোনা করেছেন—এবং কিছুদিন আগে কনটিকি অভিযানের সব পৃথিবী তোলপাড় করা খবর তিনি জানেন এবং এইসব ঘটনা, অর্থাৎ মহাসমুদ্রে সামান্য মানুষেরা ভেলায় চড়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিলে কি কি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় তার একটা নিদারুণ ছবি তিনি ছোটবাবুকে দিতে পারতেন—কিন্তু ইচ্ছে করেই দিলেন না। কেবল বললেন, যদি কোন অতিকায় হাঙর দেখ পেছন নিয়েছে—তাকে অনিষ্ট করার চেষ্টা করবে না। সমুদ্রের কোন জীব অহেতুক হত্যা করবে না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাছ সমুদ্র থেকে তুলবে না। ছোট ছোট সব কাঁকড়া এইসব ক্রান্তীয় সমুদ্রে ভেসে বেড়ায় খেতে বেশ সুস্বাদু। তোমার সঙ্গে জল, কয়লা, এবং এই দ্যাখো লোহার উনুন, একেবারে পাটাতনের সঙ্গে ফিট করা সব—সমুদ্রের দুলুনিতে যেন কিছু আবার ছিটকে পড়ে না যায়।

কাল সারাদিন কখন যে সারেঙ-সাব সব করে রেখেছেন! তিনি এতটুকু সময় নষ্ট করেন নি। খেতে পরতে যা লাগে সব তিনি তুলে এনেছেন বোটে।

বনি উঠে আসছিল। চা-এর ট্রে হাতে। কাপ উপুড় করে সন্তর্পণে উঠে আসছে। কালো অ্যাপ্রন, সাদা ফ্রক এবং সে গলায় বেশ সাদা পাথরের মালা পরেছে। নীলাভ চোখে কি দীপ্তি, ছোটবাবু ইশারায় চোখ টিপে দিল। বলল, আসছে।

সঙ্গে সঙ্গে হিগিনস প্রায় লাফ মেরে নামলেন নিচে। ছোটবাবুও নিচে নেমে গেল। ওরা বোটে হেলান দিয়ে চা খেতে খেতে তখন কত রকমের কথা বলতে থাকল—বনি, বাবা এবং ছোটবাবুর দিকে তাকিয়ে আছে। দ্বীপটার কি নাম, শহরে কি পাওয়া যায় কাপ্তান সব বানিয়ে বলে যাচ্ছেন। সব আম, জাম, নারকেল গাছ আর লেবুর জঙ্গল—আনারসের খেত—ঠিক সামোয়ার মতো দেখতে—সামনে তার দিগন্ত জোড়া বালিয়াড়ি—কি আনন্দ ছোটবাবু। খুব সাবধান, আমাদের কথা গিয়ে ভুলে যাবে না। ওখানে পৌঁছে প্রথমে তোমরা খবরের কাগজের অফিসে দেখা করবে—তোমাদের কথা বলবে—আমাদের কথা বলবে—মিসিং জাহাজটার তোমরা ক্রু বলবে। কাপ্তান, বৃদ্ধ সারেঙ জাহাজটায় রয়ে গেছে বলবে। ওদের জন্য রেসকু চাই। তারপরই দেখবে জাহাজটা নিয়ে আমরা পৌঁছে গেছি। একজন কাপ্তানের পক্ষে এর চেয়ে গৌরবের আর কি আছে!

বনি বলল, আমার ভাল লাগছে না বাবা! মনটা আমার কেমন করছে!

—দূর বোকা মেয়ে—স্যালি হিগিনস সহসা যেন মুখ ফিরিয়ে সমুদ্রে ঝুঁকে পড়লেন। বললেন, ছোটবাবু বোটে ক্রস তুলে নাও। এস এদিকে এস। তিনি কাপ বনির হাতে দিয়ে এগুতে থাকলেন। বনি বলল, বাবা ক্রস কেন?

—বুঝতে পারছ না, সমুদ্রে কত রকমের অপদেবতা থাকে। শয়তান থাকে। অশুভ প্রভাব থাকে। তাদের হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করতে হলে আর কি দিতে পারি। ক্রসটা মাঝখানে থাকবে। তিনি বলতে চাইলেন, মহাসমুদ্রের অন্তহীন এই যাত্রায় মৃত্যু প্রায় অনিবার্য—তবু শুভ প্রতীকের মতো অথবা ঈশ্বরের সেই অমোঘ বাণী খোদিত আছে যেন ক্রসের গায়ে—সেই কঠিন বিভীষিকার ভেতর মৃত্যু যত অনিবার্য হয়ে উঠবে—তত এই ক্রস সব অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে বনি এবং ছোটবাবুর মৃতদেহ—অর্থাৎ তিনি যেন জানেন, বোট ভাসতে ভাসত্বে কোথায় চলে যাবে—অথবা পালে বাতাস লাগলে কতদিন কে জানে এবং যখন কিছু জানা নেই মৃত্যু অনিবার্যতার সামিল এবং যেহেতু মেয়েটার কঠিন মৃত্যুর দৃশ্য চোখের ওপর দেখার তাঁর সাহস নেই—ছোটবাবুকে দিয়ে দূরে পাঠিয়ে তিনি এলিসের ক্রূরতার হাত থেকে রেহাই পেতে চাইছেন। সঙ্গে ক্রস থাকলে কবর-ভূমির ওপর কোনোদিন কেউ যদি ক্রসটা পুঁতে দেয়। যেন ক্রসের নিচে শুয়ে আছে বনি এবং ছোটবাবু।

তিনি বনির দিকে এখন তাকাচ্ছেন না। যতটা দ্রুত সম্ভব ওদের নামিয়ে দিতে পারলে তিনি বেঁচে যান। জাহাজ এবং সেই পাহাড় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। অথবা সেই অতিকায় ক্রসটা—প্রায় দু’টো ষাঁড় লড়ার মুখে মনে হয়। এবং আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ। সারেঙ সব তুলে যা যেখানে দরকার রেখে দিচ্ছেন। কাপ্তান একটা ক্রস কাঁধে বয়ে আনলেন। ক্রসটা বোটের মাঝখানে শুইয়ে রাখা হল। অন্য ক্রসটা ছোটবাবু এবং কাপ্তান মিলে জাহাজের মাথায় পুঁতে দিচ্ছে। লোহার বড় বড় পেরেক পুঁতে ওটাকে জাহাজে দাঁড় করিয়ে কিছুটা ভয় থেকে মুক্ত হবার মতো তিনি চিৎকার করে ডাকলেন—সারেঙ।

সারেঙ কাছে এসে দাঁড়ালে ডাকলেন, বনি!

বনি কাছে এলে বললেন, সব তুলে দিয়েছ?

বনি ফের কেবিনে ঢুকে ওর শেষ সম্বল দুটো বর্শা এবং অক্সিজেন সিলিণ্ডার তুলে দিল বোটে। তিনি বললেন, খুব রোদ উঠলে হুড তুলে দেবে। নিচে দু’জনের মতো শোবার জায়গা আছে। হুড খুলে দিলে কতটা জায়গা তাও দেখিয়ে দিলেন। কোথায় কি রেখেছেন বনিকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কোথায় ওরস্ ক্রাচেজ, বোট-হুক, প্লাগস, বাকেট, বেলার সব ঠেলে ঠেলে দেখিয়ে দিলেন। কম্পাস, কুড়োল, ল্যাম্প, ম্যাচিজ, কোথায় কিভাবে রেখেছেন দু’জনকেই দেখিয়ে দিলেন। পালের মাস্তুল বোটের কিনারায় ঝুলিয়ে নেবে। তবে কিছুটা তোমাদের বেশি জায়গা হবে। ছোটবাবুকে ডেকে বললেন, এই দ্যাখ্যো এখানে অয়েলব্যাগ থাকল। মাথায় সী-অ্যাংকার। গ্যালনের মতো এনিম্যাল অয়েল রেখে দিয়েছি। হাত- পাম্প কোথায় রাখলাম আবার! তিনি জলের ড্রামের পেছনে উঁকি দিলেন, আরে এখানেই তো রেখেছি! না, সেই দূরের পাহাড় আর কাছে আসছে না। জাহাজের মাথায় ক্রস তুলে দিয়ে তিনি সব অশুভ ভয় থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন। বেশ নিশ্চিন্তে তিনি খুঁজছেন যেন।—এই তো হাত-পাম্প। এই হচ্ছে বিস্কুটের টিন, বার্লি চিনি সব ষোল আউন্সের মতো করে আছে। এগুলোতে প্রথমেই হাত দেবে না।

ছোটবাবু দেখল, স্যালি হিগিনস নিজের কথায় নিজে ধরা পড়ে যাবেন। সে তাড়াতাড়ি বলল, স্যার সিগন্যালিং টর্চ কোথায় রেখেছেন?

সারেঙ বললেন, ওপরের দিকে আছে। এই দ্যাখ বলে তিনি সিগন্যালিং টর্চ-রকেট-প্যারাসুট, ফ্ল্যাশ- লাইট সব এক এক করে তুলে দেখালেন। এখানে ফার্স্ট-এড, একটা ছোট্ট কাঠের বাকসের ভেতরে রেখেছেন কোরামিনের ফাইল। জীবন ধারণের শেষ প্রয়াস এটা। খুব যত্নের সঙ্গে কাঠের বাকসে মানুষের আত্মার মতো বন্দী করে রেখেছেন সারেঙ। তিনি বোটে ছুটে ছুটে যাচ্ছিলেন বলে, বোট, দু’টো ডেবিডের হুকে বেশ দুলছিল, দু’টো কপিকল দিয়ে ডেবিড কাত করে দিলেই বোট নিচে ঝুলে পড়বে। তারপর উইনচ চালিয়ে শুধু দড়ি ছেড়ে দেওয়া। কপিকলে ঝুলে থাকা ডেবিডের হুক থেকে বোট ধীরে ধীরে নেমে যাবে। পাল তিনি মাস্তুলে পরিয়ে একেবারে ঠিকঠাক করে শেষবারের মতো নেমে এলেন। এখন বোধহয় বোট নামিয়ে দেওয়া হবে।

সারেঙ-সাব ছোটবাবুকে বললেন, তোর আর কিছু পড়ে থাকল না তো!

ছোটবাবু ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়ছে। সে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। এই ছোট্ট বোট নিয়ে এমন অকুল সমুদ্রে একা ভেসে পড়া—কি যে কঠিন আর ভয়াবহ—তার হাত পা যত সময় এগিয়ে আসছে তত যেন ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছে –বনি প্রায় অবলার মতো—এবং সে একা থাকলে তবু দায়িত্ব কম—নিজের জন্য চিন্তা-ভাবনা তার তত নয়, এই মেয়েটা ফুলের মতো মাত্র ফুটে-ওঠা মেয়েটা জানে না সামনে কি নিদারুণ সমুদ্র হাঁ করে আছে। তার ভেতর ঢুকে গেলে পৃথিবীর কোনো মানুষের সাধ্য নেই ফের তাকে আবিষ্কার করে—তখন কিনা-সারেঙ-সাব তার কি আর পড়ে আছে জিজ্ঞাসা করছেন—সব জেনে কেন এমন করছেন তাঁরা! কি হবে কিছু পড়ে থাকলে! সে দাঁত চেপে বলল, সরুন এখান থেকে, সামনে থেকে সরে যান! সরে যান বলছি! আপনারা আমাকে কি পেয়েছেন!

স্যালি হিগিনস তখন কাঁধে হাত রাখলেন ছোটবাবুর। তাকে খ্রীষ্টের গল্প শোনালেন। বললেন, ছোটবাবু স্ট্রাগল ইজ দ্যা প্লেজার। এত সহজে ভেঙে পড়লে চলবে কেন! বনি আসছে। তিনি মুহূর্তে গলার স্বর পাল্টে ফেললেন। সতর্ক হয়ে গেলেন খুব। ছোটবাবুকে টিপে দিলেন।

কাপ্তান এবার হাঁকলেন, বনি! বনির দিকে তাকিয়ে আর একটা কথাও বলছেন না। বনি কিছুতেই বাবার মুখ দেখতে পাচ্ছে না। সে বলল, এই তো আমি।

—ওপরে উঠে বসো।

—ছোটবাবু!

—ছোটবাবু দড়ি ধরে নেমে যাবে। আমরা দু’ বড়ো ডেবিড থেকে বোট হারিয়া করতে পারব না। স্থির এবং ভীষণ গম্ভীর গলা। বনি আর একটা কথা বলতে সাহস পেল না। সে লাফ দিয়ে বোটে উঠে বসল। পাটাতনে একটা ম্যাট্রেস পেতে নিতে পার। তিনি বনিকে যেন বলছেন না। অন্য কাউকে। বনি এখনও বাবার মুখ দেখতে পাচ্ছে না। সে সেই দুঃসময়ের মতো, মা চলে যাবার পর যেমন অসহায় গলায় ডাকত, বাবা, তেমনি ডেকে উঠল, বাবা।

কিন্তু স্যালি হিগিনস তখন ডেবিডের গোড়ায় গিয়ার খুলে প্রায় ছোটবাবুর সঙ্গে সঙ্গে ডেবিডের মাথা এগিয়ে ধরলেন, ছোটবাবু তখন চিৎকার করছে, বনি শক্ত করে ধরো, না হলে পড়ে যাবে—বোট ভীষণ দুলছে। বনি বোটের একটা দিক চেপে ধরে আছে। বোট দুলে দুলে নিচে নিয়ে গেলে সে যেন নিচে না পড়ে যায়। এবং উইনচ ছেড়ে দিলে হড়হড় করে বোট নিচে নেমে গেল। বনি তখনও ডাকছে, বাবা বাবা! তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছ না কেন! আমার ভীষণ ভয় করছে! এবং ছোটবাবু দেখল বোট জলে নেমে গেছে, সে তাড়াতাড়ি দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল নিচে। দড়ি বেয়ে বেয়ে নেমে যেতে থাকল। বোট সরে যাচ্ছিল—আর সে চিৎকার করছে, বনি দড়ি টেনে রাখ। আমি পড়ে যাব সমুদ্রে। বনি তখনও চিৎকার করছে, বাবা, তুমি কোথায়? তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন! বনির খেয়াল নেই বোট নিচে নেমেই জাহাজের পাশে থাকছে না। ঢেউ খেয়ে ছিটকে দূরে সরে গেছে। ছোটবাবু তেমনি দড়িতে ঝুলে থাকল, বনি দড়ি টেনে ধরো প্লিজ। কি করছ তুমি! তোমরা সবাই মিলে আমাকে কি পেয়েছ?

বনি এবার কেমন নিচে তাকালে দেখল ছোটবাবু দড়িতে ঝুলে আছে। পা প্রায় কিছুটা সমুদ্রের জলে ডুবে গেছে। ঢেউ এলে ওর সবটা ডুবে যাবে। সে তাড়াতাড়ি এবার দড়ি টেনে ধরলে বোট ছোটবাবুর কাছে এগিয়ে গেল। ছোটবাবু বোটে লাফ দিয়ে পড়লে বনি অতি করুণ গলায় ডেকে উঠল, বাবা তোমরা আমাদের কোথায় পাঠিয়ে দিচ্ছ! বাবা আমি তোমাকে আর দেখতে পাচ্ছি না কেন!

ছোটবাবু আর বিন্দুমাত্র দেরি করল না। সে বোটের গুড়াতে মাস্তুল বসিয়ে দিল। তারপর সব রিং পরিয়ে পাল টানিয়ে দিল বোটে। লাল রংয়ের শালুর তেকোনা পাল, তুলে দিতেই হাওয়ায় টান ধরল। নিমেষে বোট চঞ্চল হয়ে উঠল। ছোটবাবু এক হাতে দড়ি সামলাচ্ছে, অন্য হাতে বোটের হাল ধরার জন্য ছুটে যাচ্ছে। পালের দড়ি দড়া আলগা বলে এক দিকে বোট একেবারে হাওয়ায় কাত হয়ে গেছিল। এবং সে দেখল, বনি প্রায় ছিটকে ওদিকে পড়ে গেছে। এবং এখন ওর এ-সব দেখার সময় নয়। ভীষণ দ্রুত সে দড়ি বোটের হুকে বেঁধে দিতেই এবার বোট সোজা হয়ে গেল। আর তখনই জাহাজের ডেকে স্যালি হিগিনস প্রায় দু’হাত আকাশে তুলে চিৎকার করে উঠলেন, এম্মানুয়েল—আমাদের সহিত ঈশ্বর। বনির গলার সেই অসহায় স্বর আর তিনি শুনতে চান না। বোট যত এগিয়ে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে তত তিনি চিৎকার করে হেঁকে যাচ্ছেন—এম্মানুয়েল, আমাদের সহিত ঈশ্বর। এম্মানুয়েল, আমাদের সহিত ঈশ্বর—বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি হাঁটু মুড়ে রেলিঙের ধারে বসে পড়লেন—তারপর হা হা করে হারিয়ে যাওয়া ছোট শিশুর মতো মাঠে বসে যেন কান্না। সব হারিয়ে তিনি হা হা করে কাঁদছেন। সারেঙ সাব পাশে মাথা গুঁজে বসে আছেন। তিনি কি বলে সান্ত্বনা দেবেন বুঝতে পারছেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *