অলৌকিক জলযান – ৫২

॥ বাহান্ন।।

হিগিনস বোট থেকে চিৎকার করে বললেন, নো নো। সব কেবিনে লম্ফ জ্বালতে হবে না। এখানে একটা লম্ফ দিয়ে যাও। গ্যালিতে রাখো একটা আর একটা বোট-ডেকে ঝুলিয়ে রাখো।

বনি নেমে যাবার সময় হঠাৎ দেখল তখন পায়ের কাছে দু’তিনটে ফ্লাইং ফিশ পড়ে আছে। ওদের বোধ হয় কোনো অতিকায় মাছটাছ তাড়া করেছিল, উড়ে এসে ডেকে পড়েছে। বনি মাছগুলো কুড়িয়ে নেবার আগে এমন চেঁচামেচি লাগিয়ে দিয়েছিল যে ছোটবাবু ভয় পেয়ে লাফ মেরে ছুটছে সেদিকে। গিয়ে সে অবাক। তিনটে মাছ। রুপোলী লম্বা, এবং বড় পাখনাঅলা মাছ। প্রায় পারশে মাছের মতো এবং খেতে বসে ছোটবাবু দেখছে এ-বেলাতেও হিগিনস তাঁর অধিকাংশ খাবার তার পাতে তুলে দিচ্ছেন। মাছভাজা সে একটা আস্ত পেয়েছে। বনির কি যে স্বভাব হয়েছে! ওকে খাওয়াতে পারলে বাঁচে। আর কেউ খাবে সে যেন মনে রাখতে পারে না। ছোটবাবু বুঝতে পারছে না বুড়ো বনির ওপর রাগ করে সব খাবার ওকে দিয়ে দিচ্ছেন কিনা। সে ভেবেছিল বনিকে জোর ধমক দেবে—কিন্তু তখন হিগিনস বললেন, ছোটবাবু তুমি খুব ভাগ্যবান হে!

ছোটবাবু বললে, না স্যার এটা বুঝতে পারি বনির উচিত হচ্ছে না।

হিগিনস বললেন, ভারী মজা কি বল!

ছোটবাবু বলল, বনি সবাইকে সমান দিতে হয়।

বনি, মাত্র মুখে সামান্য মাছভাজা পুরেছে, লম্ফের আলোতে ওর মুখ রহস্যময়ী নারীর মতো, চোখে অপার বিস্ময় ছোটবাবু সম্পর্কে এবং হিগিনস ঝুঁকে আছেন সামান্য—তখন ছোটবাবু কি যে বাজে বকছে। সে বলল, আমি কি বাবাকে কম দিয়েছি?

হিগিনস বললেন, তোমাকে খুব হিংসে হচ্ছে ছোটবাবু।

বনি বলল, বাবা তোমাকে বলছি, এ-সব আমার সহ্য হয় না। তুমি ওকে দিতে যাও কেন? তুমি খেতে না পার ফেলে দেবে।

ছোটবাবু বলল, বনি কি বকছ আজেবাজে! এতে কারো পেট ভরে! তুমি খাচ্ছ না তিনি খাচ্ছেন না, আমাকে তোমরা সব দিচ্ছ! কি পেয়েছ তোমরা! প্রায় সব ছুঁড়ে ফুঁড়ে সে উঠে যেতে চাইলে হিগিনস বললেন, কোথায় যাচ্ছ! তুমি না খেলে আমরা খাব ভেবেছ? বুঝলে ছোটবাবু মাঝে মাঝে তুমি ভারী স্বার্থপর হয়ে যাও। তোমার সব ভাল লাগে এটা কিন্তু ভাল লাগে না।

বনির মুখ অপমানে থমথম করছে। যেন সে কথা বললেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে। সে মুখ নামিয়ে রেখেছে। খাচ্ছে না! যেন কিছু বলতে পারলে এতটা সে অপমানিত হত না অথবা সে যদি বলতে পারত বাবা, তুমি ওকে আর কতটুকু চিনেছ আমি ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি। ও নিজেকে ছাড়া পৃথিবীতে আর কাউকে চেনে না। আমি এমন সুন্দর পোশাক পরে দাঁড়িয়ে থাকি রেলিঙে—কতবার ভেবেছি ও আসবে, আমার পাশে ঠিক দাঁড়াবে, কথা বলবে—কত কিছু আমি আশা করি ওর কাছে—সে আসে না বাবা। একবার বলে না বনি তোমাকে মেয়ের পোশাকে এমন সুন্দর দেখায় জানতাম না।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। ছোটবাবু এখনও হাত নামিয়ে রেখেছে। হিগিনস বললেন, খাও। বনির ওপর রাগ কর না। কি ব্যাপার! তোমরা কেউ খাচ্ছ না। আচ্ছা জ্বালা হল দেখছি—ছোটবাবু তোমাকে আমি খেতে বলছি। তুমি না খেলে মেয়েটা আমার খেতে পারবে ভাবছ!

ছোটবাবু ধীরে ধীরে মুখ নামিয়ে কাঁটা-চামচ টেনে নিলে।

হিগিনস ফের বললেন, তুমি ভীষণ ভাগ্যবান হে ছোটবাবু। তোমাকে আমার হিংসে হচ্ছে। সারাজীবন যা চেয়েছি, কত সহজে তুমি ছোটবাবু তা পেয়ে গেছো। এত সহজে তাকে নষ্ট করে দিও না।

স্যালি হিগিনস ফের খেতে খেতে বললেন, আমি পাইনি। কত সহজভাবে তিনি এখন কথা বলছেন! ডাইনিং হলে তেমনি সব বড় বড় তৈলচিত্র। এখন আর ফুলদানিতে কোনো ফুল নেই। অন্ধকারে অস্পষ্ট আলোর ভেতর সেইসব কাপ্তানের ছবি কেমন অর্থহীন। বড় টেবিল, সাদা চাদর, কারুকার্যময় ন্যাপকিন, সব আছে শুধু মানুষগুলো একে একে তাঁকে ছেড়ে গেছে। তিনি বললেন, তোমাকে হিংসে করতেও আমার ভাল লাগছে। মানুষের জন্য পৃথিবীতে তারপর আর কি দরকার থাকে বুঝি না। তোমরা ঝগড়া করলে আমার খুব খারাপ লাগে।

তারপর যেন ছোটবাবুকে বলার ইচ্ছে ওহে মানবজাতির অপোগণ্ড তুমি বুঝতে পারছ না, সবকিছু হারিয়ে সামান্য একটা জাহাজের ওপর বাজি রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, দেয়ার লাইজ এ ওয়াইড অ্যাণ্ড প্লেজেন্ট রোড দ্যাট সিমস রাইট, কিন্তু এখন দেখছি দ্যাট এণ্ডস ইন ডেথ। কেউ আমাদের কোনো ডাঙায় পৌঁছে দেয় না ছোটবাবু। নিজেকে সাঁতরে পার হতে হয়।

স্যালি হিগিনস মুখ ন্যাপকিনে মুছে বললেন, তোমরা খাও। আমি উঠছি। ফের ঝগড়া করলে খুব খারাপ হবে। বলে তিনি উঠে গেলেন।

বনি বলল, খাবার নিয়ে কি দরকার ছিল নাটক করার!

ছোটবাবু বলল, বেশ করেছি।

স্যালি হিগিনস এলি-ওয়েতে দাঁড়িয়ে গেলেন। ধমক দিলেন—আবার!

দু’জন চুপচাপ ফের। কোনো কথা আর কানে ভেসে আসছে না। তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। নড়তে ইচ্ছে করছে না। সৌরলোকে আর একটা নতুন পৃথিবী তৈরি হয়ে গেছে। দু’জনই সমুদ্রে দাঁড়িয়ে লম্ফের আলোতে নতুন ডাঙার অনুসন্ধানে আছে। তিনিও ছিলেন—আজীবন সেই ডাঙা খুঁজে বেড়িয়েছেন। সামান্য আশ্রয় প্রেম। বিশ্বাসহীনতায় বেঁচে থাকতে কখনও চাননি। অথচ সংশয় সন্দেহ এবং এক অশুভ প্রভাব যেন কি করে এই এক মহাজীবনে এসে যায়—মনে হয় তিনি, তার অস্তিত্ব এক মহামায়া, শেষ নেই যার। কেনো অলৌকিক জলযানের মতো নিরুদ্দিষ্ট যাত্রা। অথচ পাশেই আছে জীবনপ্রবাহ—কি তাজা আর খাঁটি! এত জেনেও তাঁর কেন এখন চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ধরা পড়ে যাবেন ভেবে তিনি ওপরে উঠে যাচ্ছেন। আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে হাউ-হাউ করে এভাবে তিনি কার জন্য কাঁদছেন। বুক থেকে কেন সেই অমোঘ বাণী জোরে উঠে আসছে না—কেন জোরে জোরে গাইতে পারছেন না, গ্লোরি হ্যালেলুজা আই অ্যাম অন মাই ওয়ে। আড়ষ্ট গলায় তবু তিনি কোনোরকমে গাইলেন, গ্লোরি হ্যালেলুজা—আই অ্যাম অন মাই ওয়ে। কেউ দেখছে না, স্যালি হিগিনস অন্ধকার সমুদ্রে ভাঙা জাহাজ-ডেকে দাঁড়িয়ে গাইছেন—চোখে অবিরাম অশ্রুপাত—কি করুণ আর অসহনীয় এই শেষ সমুদ্রযাত্রা। তাঁকে সব ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। তিনি তবু সবকিছু তুচ্ছ করে হাঁকলেন, এলিস আমি ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস বলছি—শুনতে পাচ্ছ! এলিস এ-আমাদের শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে এলে! কি চাও তুমি! কি ইচ্ছে তোমার! এলিস, ভগবানের দোহাই, সবার অশুভ প্রভাব থেকে বনিকে বাঁচাও। আমি আর কিছু চাই না এলিস। পৃথিবীতে আমার আর কিছু চাইবার নেই।

গমগম করে সেই অসীম অজানা সমুদ্রে স্যালি হিগিনসের কণ্ঠস্বর ভেসে যাচ্ছিল। দূরদিগন্তে নীহারিকালোকে যেন তিনি তাঁর শেষবার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। ছোটবাবু, বনি, সারেঙ বুঝতে পারছিল না স্যালি হিগিনস কোথায় দাঁড়িয়ে এভাবে পাগলের মতো চিৎকার করছেন। ওরা লম্ফ নিয়ে জাহাজ- ডেকে ছোটাছুটি করছে। কোথায় তিনি! বোট-ডেকে নেই, আফটার-পিকে নেই, কেবিনে নেই। তবু কিছু অস্পষ্ট চিৎকার জাহাজের কোথাও থেকে যেন উঠছে। সমুদ্রে ডুবে যাবার আগে যেভাবে একজন আর্ত মানুষ দুহাত তুলে চিৎকার করতে থাকে—স্যালি হিগিনস তেমনি এক মুহ্যমান আর্তনাদে ভেঙে পড়ছেন। ছোটবাবু তাঁকে শেষ পর্যন্ত ফরোয়ার্ড-পিকে খুঁজে পেল। উইণ্ড-সেলের আড়ালে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। সেই শান্ত মুখ আর নেই। পরনে সোনালী রংয়ের রাতের পোশাক। একজন সন্ত মানুষের মতো দাঁড়িয়ে সমুদ্রের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলছেন—যেন কোনো রমণীর চেয়েও বেশি রহস্যময়ী সমুদ্রকে তাঁর জীবনের সুখ দুঃখ হতাশার কথা শোনাচ্ছেন। জ্যোৎস্না রাতে সমুদ্রের ভয়ংঙ্কর নির্জনতার ভেতর বনি বাবার বুকে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। বলল, বাবা কি হয়েছে তোমার! কি হয়েছে বল! এমন করছ কেন? এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে কাকে কি বলছ! কি, কথা বলছ না কেন! আমরা কি সত্যি আর ফিরে যেতে পারব না!

স্যালি হিগিনস শান্ত কণ্ঠে শুধু বললেন, তুই তো জানিস আমার মাঝে মাঝে এমন হয়। তুই ঘাবড়ে গেলে চলবে কেন! খুব আদর করে মেয়ের কপালে চুমো খেলেন। তারপর লজ্জায় যেন মুখ লুকিয়ে ফেললেন বনির চুলের ভেতর। কি তাজা ঘ্রাণ চুলে। এমন একটা ছেলেমানুষী করে তিনি যেন আর লজ্জায় মুখ তুলতে চাইছেন না। কাউকে আর মুখ দেখাতে চাইছেন না।

বাপ মেয়ে পৃথিবীর যাবতীয় সুখ দুঃখ ভুলে গেছে বুঝি। ওরা পরস্পর কি নিবিড় স্নেহ মমতায় পরস্পরকে জড়িয়ে রেখেছে। ছোটবাবুর কেন জানি বুক বেয়ে এই বৃদ্ধ মানুষটির জন্য কান্না উঠে আসছিল। হাঁটু গেড়ে প্রায় কোনো মধ্যযুগীয় নাইটদের মতো তার বলার ইচ্ছে হচ্ছিল, আপনি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। তারপর সেই নাটকীয় শব্দসমূহ তার কণ্ঠে প্রায় ভেসে আসছিল, স্যার সমুদ্র আর ঈশ্বরের নামে শপথ করছি। যেন তরবারি থাকলে সে এক্ষুনি মাথার ওপরে দুলিয়ে অশুভ প্রভাব জাহাজের কেটে কেটে ফালা ফালা করে দিত। কোনো প্রাচীন ঐতিহাসিক যুবার মতো এই জ্যোৎস্না রাত, নির্জন সমুদ্র, কাঠের ক্রস আর আকাশের অন্তহীন নক্ষত্রমালা ছুঁয়ে ওর শপথ নিতে ইচ্ছে করছিল—আমি আছি, আমি থাকব। আমি কোনো পাপ কাজ করব না। কোনো অশুভ প্রভাবে বনিকে পড়ে যেতে দেব না।

সারেঙ্গ-সাব দেখলেন, ছোটবাবু জ্যোৎস্নায় শুধু সমুদ্র দেখছে। একটা কথা বলছে না। তিনি হিগিনসকে বললেন, সাব অনেক রাত হয়েছে।

ওরা তারপর নিঃশব্দে নেমে আসছিল ডেকে। বোট-ডেকে যে যার মতো উঠে গেল। কেউ কোনো কথা বলল না। বোট-ডেকে এখন সবাই থাকে বলে ক্যাপ্টেন তাঁর কেবিনে, বনি নিজের কেবিনে এবং সারঙে-সাব খোলা ডেকে শুয়ে পড়লেন। ছোটবাবু শুয়ে থাকল ও-পাশের বয়-কেবিনে। আর মধ্যরাতে মনে হল তার কেউ ডাকছে। পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে ফিস-ফিস করে ডাকছে। বনির কথা ভেবে কি করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু চোখ মেলে সে দেখল—পোর্ট-হোল থেকে টর্চের ফোকাস আসছে—সে বলল, বনি তুমি আমাকে পাগল করে দেবে দেখছি। আর তখনই সামান্য জোরে কথা বলছে কেউ। বনির গলা মনে হল না। ক্যাপ্টেন পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে ডাকছেন—স্যালি হিগিনস বলছি ছোটবাবু। শিগগির ওঠো। চেঁচামেচি করবে না। ভারী সন্তর্পণে কথা বলছেন।

দরজা খুলে ছোটবাবু বের হয়ে এল। হিগিনস আর একটা কথা বললেন না। সিঁড়ির নিচে সে দেখল, সারেঙ-সাব দাঁড়িয়ে আছেন। সমুদ্রে তেমনি ছলছল কলকল শব্দ। ঢেউ-এর ওপর জ্যোৎস্না পিছলে যাচ্ছে। দূরে নদীর পাড় ভেঙে পড়ার মতো সহসা সব ভারী শব্দ উঠছে। হিগিনস তখন বলছেন—ভয় পাবে না। বোধ হয় কোনো বড় তিমি মাছ দূরে কোথাও ডুবছে ভাসছে।—এস। এবং ওরা তিনজন এভাবে সেই কার্পেন্টারের ঘরের দিকে এগুতো থাকলে ছোটবাবু বলল, বনি জেগে গেলে ভয় পাবে স্যার। ওকে একা এভাবে ওপরে রেখে আমাদের ঠিক নিচে নামা উচিত হবে না।

স্যালি হিগিনস বললেন, ওপরে অসুবিধা আছে ছোটবাবু।

—কোনো অসুবিধা হবে না। আপনি আসুন। আমরা বরং বোট-ডেকের নিচেই বসি। বনি ডাকলেই সাড়া দিতে পারব।

হিগিনস বললেন, বনি জেগে গেলে সব টের পাবে।

—তা-হলে চাচা ওপরে থাকুক। তিনি আমাদের দরকারে খবর দেবেন।

স্যালি হিগিনস যেন নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচলেন। বনির জন্য তবে পৃথিবীতে আর একজন তাঁর চেয়ে কম দুর্ভাবনায় থাকে না। তাঁর ভীষণ ভাল লাগল। তিনি প্রায় ভেতরে পুলক বোধ করলেন। এবং সেই ছেলেমানুষের মতো পুলকে প্রায় শিস্ দিতে যাচ্ছিলেন। তখন ছোটবাবু বলল, স্যার আপনার কেবিনেও আমরা বসতে পারি।

স্যালি হিগিনস দাঁড়িয়ে গেলেন। ছোটবাবু এবং সারেঙ দাঁড়িয়ে গেল। ওদের ছায়া স্থির। এবং মনে হচ্ছে জাহাজটাকে বাতাসে সামান্য ভাসিয়ে নিচ্ছে। বাতাস কি সমুদ্রস্রোত ওরা বুঝতে পারছে না। তবু এই মধ্যরাত্রে মনে হচ্ছে জাহাজটা যেন নিয়ত চলছে।

স্যালি হিগিনস বললেন, খুব সাবধান।

ওরা এবার প্রায় চুপি চুপি উঠে যাচ্ছিল। যাবার সময় টর্চ মেরে ছোটবাবু দেখল বনি সাদা চাদর গায়ে ঘুমিয়ে আছে। নীলাভ চুলে ওর মুখ প্রায় ঢাকা। এবং সুন্দর স্তন এই প্রথম সে বুঝতে পারল খুবই ভারী হয়ে উঠেছে। বোধহয় ওর শরীরে রাতের পোশাকও নেই। ছোটবাবুর মাথা ঝিমঝিম করছে।

স্যালি হিগিনস ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন। ছোটবাবুর দেরি দেখে বললেন, দ্যাখো তো সারেঙ ছোটবাবু কি করছে!

সারেঙ ঘুরে ও-পাশে নেমে গেলেই ছোটবাবু সতর্ক হয়ে গেল। টর্চের আলো নিভিয়ে দিল। বলল, ঘুমোচ্ছে। বাঁচা গেল। সিঁড়িতে ওঠার মুখে খুব আস্তে আস্তে বলল, স্যার বনি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমরা নিশ্চিন্তে এখন বসতে পারি।

স্যালি হিগিনস এবার লম্ফ জ্বালিয়ে দিলেন। একটা বড় নীল রঙের চার্ট বের করলেন পকেট থেকে। সাদা সব দাগ। সেই দাগগুলো বড় একটা কাগজে সোজা কেটে কেটে বললেন, ছোটবাবু এদিকে এসে তুমি বোস। সারেঙ-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। বোস।

সারেঙ-সাব বললেন, ঠিক আছে সাব।

ছোটবাবু টেবিলে ঝুঁকে আছে। হিগিনস ঝুঁকে আছেন। তিনি বললেন, ছোটবাবু কাল তোমাদের বোট দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার আগে সব বুঝে নাও। তোমরা থাকছ না।

—আপনি কি বলছেন!

হিগিনস সহসা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, চেঁচাবে না। বনি ঘুমোচ্ছে। মাঝে মাঝে তোমার হাবভাব আমার একদম ভাল লাগে না ছোটবাবু। তুমি চেঁচাবে আমি জানতাম। এজন্য নিচে নেমে যেতে চেয়েছিলাম।

ছোটবাবু বলল, কিন্তু স্যার।

—আগে আমার কথা শেষ করতে দাও। আমার বলা শেষ হলে বলবে। কতদিন বলেছি কথার মাঝে কিছু বলবে না। আগে শুনবে তারপর বলবে।

ছোটবাবু বসে পড়ল।

—ছোটবাবু, তুমি ভয় পাচ্ছ। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন।

ছোটবাবু বলল, স্যার আস্তে। বনি ঘুমোচ্ছে।

হিগিনস বসে পড়লেন। তারপর কপাল টিপতে থাকলেন। মাথা ধরেছে বুঝি। এবং চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। তিনি যেন কতদিন না ঘুমিয়ে আছেন।

ছোটবাবু বলল, বোটে আমরা কে কে থাকছি?

—বনি এবং তুমি।

—আপনারা?

—আমরা জাহাজে থেকে যাচ্ছি।

—সবাই নেমে গেলে হত না!

—এই রাসকেল, জাহাজটা তোমার না আমার। জাহাজের কাপ্তান তুমি না আমি। কে নামবে, কে নামবে না তুমি বলবে, না আমি বলব।

ছোটবাবুর এটা ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে বুড়ো অহেতুক রেগে যায়। ভাল কথা বললেও রেগে যায়। কেমন রগচটা মানুষের মতো তখন আবোল-তাবোল বকতে থাকে। সে আর একটা কথা বলল না।

আর হঠাৎ কি যে হয়ে যায় হিগিনসের। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সারেঙ, তুমি ওপরে থাক। .আমরা নিচে যাচ্ছি। বনি জেগে গেলে বলবে, আমরা স্টোর-রুমে আছি। তিনি প্রায় দ্রুতগতিতে এবার নেমে যেতে থাকলেন। ছোটবাবুকে একবার বললেনও না, তুমি আমার সঙ্গে এস। অথচ ছোটবাবু প্রায় লেজ তুলে বুড়ো মানুষটার পেছনে ছুটছে।

সিঁড়ি ধরে নিচে নামার সময় ওপরে টর্চ মেরে বললেন, কি পায়ে জোর পাচ্ছ না? খুব জোয়ান! একটা বুড়ো মানুষের ঘাড়ে চেপে থাকতে খুব ভাল লাগছে!

ছোটবাবু বলল, স্যার সমুদ্রের আমি কিছু জানি না।

হিগিনস বললেন, কেউ জানে না। সবাই বড় বড় কথা বলে। সমুদ্রকে জানা বুঝি ইয়ার্কি। বলে লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন নিচে। তারপর হাত নেড়ে অন্ধকারে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ছোটবাবু বলল, স্যার টর্চ জ্বালুন। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তিনি ফস করে দেশলাই জ্বালিয়ে লম্ফ খুঁজে বের করলেন। ওটা জ্বেলে দেয়ালে টানিয়ে দিলেন। প্রায় খাদের নিচে এখন দু’জন মানুষ। দু’জন যতই চেঁচামেচি করুক কেউ টের পাবে না। দু’জন মানুষ আর দু’টো ছায়া যতক্ষণ থাকবে, ছোটবাবুর ভয় থাকবে না। কারণ একটা হয়ে গেলেই বুঝতে পারবে হিগিনসের কোনো ছায়া নেই। জাহাজে হিগিনস তবে সত্যি আস্ত শয়তান। জাহাজটার সবই ভুতুড়ে। প্রলোভনে ফেলে ছোটবাবুকে রেখে দিয়েছে হিগিনস। সে সব সময় হিগিনসের চেয়ে তার ছায়ার প্রতি বেশি নজর রাখছিল।

হিগিনস বড় একটা কাঠের বোর্ডে পেরেক পুঁতে দিচ্ছেন। আর অজস্র কথা, ছোটবাবু সমুদ্রে অগ্নিকাণ্ড নিজের চোখে দেখেছ। কি কথা বলছ না কেন? আরে আমি মানুষ। শয়তান নই। তোমার চোখ এমন হয়ে যাচ্ছে কেন?

—স্যার বলুন। আমি শুনছি।

—কী মনে হয়েছে? জাহাজ-ডুবি ভুতুড়ে ব্যাপার—আমেরিকান অয়েল-ট্যাঙ্কার ভূত সেজে ভয় দেখাচ্ছে। কিছু না। কোথায় কি প্রাকৃতিক কারণে ঈশ্বরের ইচ্ছেয় কি হচ্ছে আমরা জানি না। আমরা নানাভাবে তাঁকে বিশ্বাস করতে ভালবাসি। কিছু অবিশ্বাস্য দেখলে ভূতটুত ভাবি। বাজে কথা। সব বাজে কথা।

ছোটবাবু কি বলতে যাচ্ছিল তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন, শেষ করতে দাও।

তিনি এবার লম্ফের আলোতে চার্টের মাথায় কি দেখালেন।—কাছে এস। দূরে দাঁড়িয়ে তুমি কি দেখবে! এই দ্যাখো, যদি তুমি সোজা নব্বই ডিগ্রি বরাবর উঠে যাও মনে রাখবে পালে বাতাস’ পাবে দক্ষিণ-পূর্ব আয়নবায়ুর। তোমার হাল ঠিক থাকলে, যে-কোনো দিকে বোটের মুখ ঘুরিয়ে দিতে পার—একমাত্র সাউথ-ইস্ট বাদে সব দিকে। জুন মাসের এখন মাঝামাঝি সময়। তুমি জুলাই অবধি এই বায়ুপ্রবাহ পাবে মনে রাখবে। বাতাস উঠলেই পাল খুলে দেবে। আর সব সময় কম্পাসের কাঁটা নব্বই ডিগ্রি বরাবর। পাঁচ-সাতশ’ মাইলের ভেতর তুমি দু’টো দ্বীপ দু’পাশে পাচ্ছ, যদি কোনো কারণে ভুল, ভুল হওয়া স্বাভাবিক। বরং ঠিক ঠিক উঠে যাওয়া কঠিন, তবে দু’টো দ্বীপের ফাঁকে আরও ওপরে চলে যাচ্ছ মনে রাখবে। প্রায় তিনশো তেত্রিশ-টেত্রিশ হবে দূরত্ব, এলিস দ্বীপ, এ-দ্বীপগুলোতে সব পলিনেশিয়ানদের বাস। এছাড়া আশেপাশে অজস্র দ্বীপ আছে ভয় পাবে না। হাতে দেড়-দু’মাস সময় বায়ুপ্রবাহ তোমার অনুকূলে। যা খাবার আছে, যদি আধপেটা খাও মাস চালিয়ে দিতে পারবে। জল যতটা দরকার নেবে। সব ফুরিয়ে গেলে ঘাবড়ে যাবে না। সামুদ্রিক সব মাছ দেখবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দরকারে বড়শিতে মাছ শিকার করবে। আগুনে ঝলসে খেয়ে নেবে। আর যদি দ্যাখো ঝড়ে পড়ে গেছে বোট—সী-অ্যাংকার ফেলে দেবে সামনে। ছোটবাবু মনে রাখবে—ইউ হ্যাভ এ গুড সোল। জল, খাবার ফুরিয়ে গেলে মরীচিকা দেখবে সব অদ্ভুত রকমের, ভয় পাবে না। দেন প্ৰেজ দ্যা লর্ড। হি ইজ দ্যা গ্লোরি অফ হিজ পীপল্ প্রেইজ হিম। তারপর তিনি বললেন, ইয়ং ম্যান লিসেন টু মি অ্যাজ ইউ উড টু য়োর ফাদার। লিসেন অ্যাণ্ড গ্রো ওয়াইজ ফর আই স্পিক দ্য ট্রুথ। ডোণ্ট টার্ন অ্যাওয়ে।

ছোটবাবু ওঁর কথা শুনতে শুনতে কেমন আবিষ্ট হয়ে গেছে। সে দেখছে স্যালি হিগিনস তার মাথার ওপর হাত রেখে যেন দাঁড়িয়ে আছেন। পৃথিবীতে এই জাহাজ, বনি, সারেঙ-সাব এবং বুড়ো মানুষটা বাদে আর কোনো তার অস্তিত্ব আছে—সে ছোটবাবু নয়, সে অতীশ দীপঙ্কর দেবশর্মণঃ, সে শ্রীযুক্ত চন্দ্রনাথ দেবশর্মণ নামক ব্যক্তির জাতক—মা তাঁর দরজায় রাতে শব্দ হলে জেগে যায়—আর মনে করতে পারছে না।

তিনি ফের বলছেন, লিসেন টু মি, মাই সন। লার্ন টু বি ওয়াইজ। ডেভেলাপ গুড জাজমেন্ট অ্যাণ্ড কমনসেন্স। সমুদ্র তোমাকে অযথা তবে ভয় দেখাতে পারবে না।

তিনি এবার ঘুরে দাঁড়ালেন—ছোটবাবু এবার দেখতে পাচ্ছে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পেছন ফিরে। সে তাঁর মুখ দেখতে পাচ্ছে না। তিনি কি পেছন ফিরে কাঁদছেন। তিনি তাঁর সব সাহস হারিয়ে ফেলেছেন! সে তাঁর সাহস ফিরিয়ে আনার জন্য কিভাবে যে কি করবে বুঝতে পারছে না। ভেতরে ছটফট করছে। এবং লম্ফের আলোতে অতীব অস্পষ্ট এক করুণ অপার্থিব অভিজ্ঞতা। সে কেমন স্থির গলায় তখন স্যালি হিগিনসকে ঈশ্বরের কথা বলে যাচ্ছে। নিজেকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না—সে এভাবে বলতে পারে। বিশ্বাস করতে পারছে না—সে বলছিল, স্যার উই লিভ উইদিন দ্যা শ্যাডো অফ দ্য অলমাইটি, শেলটারড বাই দ্য গড হু ইজ এভাভ অল গডস্। তবে আমরা ভয় পাব কেন। যেখানেই যাই তাঁর কাছে আমরা থাকব।

আর তখন হিগিনস প্রায় ঈশ্বরের নামে অশ্রুপাতের মতো ছোটবাবুকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকলেন—সব বাইবেলের কথা তুমি জানলে কি করে! বলেই কেমন শক্ত গলায় বললেন, তোমাদের নিশ্চিন্তে বোটে নামিয়ে দিতে পারতাম—আমার বিশ্বাস ছিল কেউ তোমাদের অনিষ্ট করতে পারবে না। কেউ না। কিন্তু ছোটবাবু, আর্চিকে তুমি খুন করেছ। তিনি তোমাকে ক্ষমা করবেন না। আর তারপরই ঘুরে ঘুরে প্রায় জাহাজডুবির গল্প যেন বলে যাচ্ছেন—সমুদ্রে অতীব মায়ায় পড়ে গেলে মরীচিকা প্রায়, তেষ্টায় যখন বুক ফেটে যাবে, মাঝে মাঝে সমুদ্রে ডুবে স্নান করে নিতে পার ছোটবাবু। ঘামে যা নুন বের হয়ে যাবে, শরীর ঠাণ্ডা হলে তা লাঘব হবে। সামান্য লোনা জল খেয়ে ফেলতে পার। তারপরও দেখবে তৃষ্ণা যাচ্ছে না। চোখ বসে যাচ্ছে, গলা শক্ত হয়ে যাচ্ছে কাঠের মতো। তখন যদি পারো কোনো মাছ শিকার করে য়ো ক্যান সাক্ হার ব্লাড। এবং মনে রাখবে যা হয়ে থাকে, তখন মানুষ দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়, সে পাশের লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে তার গলা কামড়ে ধরে। তুমি বনিকে অনায়াসে ধরতে পার। তুমি তাহলে বেঁচে যাবে।

ছোটবাবু বুঝতে পারছিল মাথা ঠিক রাখতে পারছেন না তিনি। মাঝে মাঝে ছোটবাবুকে ভীষণ অবিশ্বাস করছেন। তিনি তবে জানেন, তিনি জানেন সে আর্চিকে খুন করেছে। সে কিন্তু কোনো পাপ কাজ করেছে বলে মনে করতে পারে না। একটা হত্যাকাণ্ড—এটা সে কেন যেন বুঝতে পারে না, শ্বাসরোধ করে মারা হত্যাকাণ্ডের সামিল। অথচ বার বার সে আর্চির মুখে সামান্য কীট-পতঙ্গের ছায়া দেখেছে। নির্বোধ, অর্থহীন চোখে যে সামান্য মায়া থাকে, তাও পর্যন্ত ছিল না। সে কোনো কীট-পতঙ্গ হত্যার মতো আর্চিকে হত্যা করেছে। হিগিনসের কথায় সে সামান্যতম ব্যাকুল বোধ করল না। বলল, শুধু একটা কথা আমার। যদি রাগ না করেন।

তিনি হাত উঁচিয়ে বললেন, নো। আমার এখনও শেষ হয়নি। সব খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছ আশা করি। আর একটা কথা। খাবার ফুরিয়ে গেলে সমুদ্রে প্ল্যাংকাটন পাবে। ছাঁকনি দিয়ে তুলে নেবে। শ্যাওলার মত সবুজ। সঙ্গে কুচোচিংড়ির মতো জেলি ফিশ থাকবে। সব অণুর মতো। ওগুলো বেছে নেবে। খেতে খুব খারাপ লাগবে না। খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেলে দেখবে, সমুদ্রে তোমার জল এবং খাবার না হলেও চলবে। যতদিন বোট ভেসে থাকবে, তোমরা ততদিন বেঁচে থাকতে পারবে।

ছোটবাবু আবার হাত তুলে কিছু বলতে চাইলে তিনি বললেন—নো। আর কোনো কথা না। তুমি কি বলবে আমি জানি। তুমি আমাকে নিয়ে নামতে চাইবে। সারেঙকে আমি সব খুলে বলেছি। সারেঙ আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছে না। সেই এক অহঙ্কার। জাহাজটাকে সমুদ্রে ফেলে ডাঙায় ফিরে গেলে লোকে হাসাহাসি করবে। বুঝতে পারছ না জাহাজ না নিয়ে আমাদের বন্দরে যাবার নিয়ম নেই। আর সেই বা কি ভাববে?

তারপর তিনি থেমে থেমে বলতে থাকলেন—সিউল-ব্যাংক আমাকে ছেড়ে দেবে না। আমি সঙ্গে থাকলে সব অশুভ প্রভাব তোমাদের বোটে উঠে যাবে। আমাকে কেউ ছেড়ে দেবে না। সিউল-ব্যাংক, এলিস, ক্যাপ্টেন লুকেনার এতদিন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ওদের হাতে সুযোগ এসে গেছে। সিউল- ব্যাংক আমার ওপর তার সব বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। আমিও তার বিশ্বাসের মর্যাদা দেইনি। জাহাজ বিক্রিবাট্টার কাগজ পত্রে আমি সই করেছি। নেমকহারাম আমি।

ছোটবাবু আবার কিছু বলার চেষ্টা করলে চিৎকার করে উঠলেন—যা বলছি শোনো। এটা সেই সমুদ্র, সেই আকাশ, সেই নক্ষত্রমালা যার নিচে এলিসকে আমি খুন করেছিলাম ছোটবাবু। এলিস মৃত্যুর পর আমাকে কোথাও ছেড়ে যায়নি। মাঝে মাঝে আমি ওকে দেখতে পেতাম ছোটবাবু। এখন আমার পাশে সেও নেই। তাকে আর দেখতে পাচ্ছি না। সে আমাদের ঠিক তার জায়গায় টেনে এনেছে।

কথা বলতে বলতে হিগিনস কেমন ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছেন। করুণ চোখ-মুখ। ভীতু মানুষের মতো ছোটবাবুর দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। আর যেন প্রায় স্বীকারোক্তির মতো তিনি সব বলে যাচ্ছেন। লম্ফটা তেমনি দপদপ করে জ্বলছে।—বুঝলে ছোটবাবু, এলিস আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রী। বনি আমার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। স্বাভাবিক কারণেই বনির ওপর তার আক্রোশ। এতদিনে বুঝতে পারছি—সে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সকালে দেখতে পাবে সামান্য একখণ্ড জমি সমুদ্রে দ্বীপের মতো। ওপরে ক্রস। প্রবালে দ্বীপে হয়তো পলি পড়ে পড়ে ক্রসটা আরও মাথার ওপরে উঠে এসেছে। আমার কেন জানি মনে হয় এলিস শুয়ে আছে তার নিচে। মমির মতো শরীর। সারাক্ষণ সমুদ্র তার ওপর আছড়ে পড়ছে। তুমি ভুল দ্যাখোনি। আমিও না। তারপর মুখ নামিয়ে নিলেন। আর একটা কথাও বলছেন না।

ছোটবাবুর মনে হল তিনি আর কথা বলবেন না। সে এগিয়ে গেল। এবং ডাকল, স্যার…! তিনি তবু কেমন স্থির আর অস্বাভাবিক রকমের ঠাণ্ডা।

—আর কথা না ছোটবাবু। এই বলে তিনি লম্ফটা হাতে নিলেন। চার্ট তিনি ছিঁড়ে ফেললেন। এবং সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় সহসা থমকে দাঁড়ালেন।

ছোটবাবু বললে, কি হল স্যার?

—বনি জানবে না। বনি জানবে না, তোমাদের সমুদ্রে আমরা ভাসিয়ে দিচ্ছি। তোমরা, কাছে কোথাও ডাঙা আছে সেখানে যাচ্ছ। দু-একদিনের ভেতর লোকালয় পেয়ে যাবে—আমরা আছি জাহাজে। ডাঙা পেয়ে গেলে খবরাখবর পৃথিবীতে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করা হবে। তারপর রেসকিউ—আমরাও ফিরে যাচ্ছি তখন। ঘুম থেকে উঠে বনি চোখ-মুখ দেখে যেন টের পায় আমরা ভাল আছি। আমরা বেঁচে আছি। কারো চোখে-মুখে মরা মানুষের ছবি দেখতে চাই না ছোটবাবু। তারপর ওপরে উঠে যেতে যেতে বললেন, আমার সামনে বনি ক্ষুধায় তৃষ্ণায় মরে যাবে –আর আমি ভাবতে পারছি না ছোটবাবু আশা করি তুমি ওকে ঠিক পৌঁছে দেবে। তাকে কোনো কষ্ট দেবে না। বলতে বলতে ছোটবাবুর দু’হাত জড়িয়ে ধরলেন। মুখ তাঁর অন্য দিকে। ছোটবাবু বুঝতে পারল, তিনি এখন বালকের মতো কাঁদছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *