1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৪৭

।। সাতচল্লিশ।।

ভারী কঠিন সময়। কি যে দুর্যোগ আরম্ভ হয়ে গেল। মাস্তুলের দড়ি-দড়া বাতাসে উড়িয়ে নিচ্ছে। বৃষ্টিপাতে অন্ধকার আরও গভীর। পোর্ট-হোল খুলে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল বিদ্যুতের তরবারি আকাশ ফালা ফালা করে দিলে মনে হচ্ছে, নীল রঙের অতিকায় সব মনস্টার এগিয়ে আসছে। আবার কখনো মনে হচ্ছে জলস্তম্ভ সামনে।

বাতাসের গতি ঠিক থাকছে না। জাহাজিদের এখন টালমাটাল অবস্থা। ডেকে কেউ উঠছে না। দিনে দিনে ভান্ডারী সবাইকে খাইয়ে দিয়েছে। সমুদ্রের অবস্থা ক্রমে খারাপের দিকে যাচ্ছে। হিবিং-লাইন দু’বার ছিঁড়ে গেছে। অন্ধকারে হেঁইয়ো হেঁইয়ো শব্দ জাহাজিদের। কারণ ঝড়ের ভেতর হিবিং-লাইন ফের বেঁধে দিতে হচ্ছে। অন্ধকারে আর ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। যে কোনো সময় সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। দু’জন ডেক-জহাজি আর ডেক-টিন্ডাল প্রায় প্রাণ হাতে করে ডেকে উঠে এসেছে। ডেকের ওপর ভুতুড়ে কিছু আলো, আর চারপাশে সমুদ্রে এখন যেন লক্ষ লক্ষ শিশুর আর্তনাদ। কি যে বাতাসের বেগ! ডেরিক তুলে ফেলছে। হাসিল সব ছিঁড়ে ফেলছে। যেন ওয়ারপিন, ড্রাম, উইনচ, মাস্তুল সব মুহূর্তে উড়ে যাবে বাতাসে। বাতাসের ঝাপটা মুখে এসে লাগলে নিশ্বাস নেয়া যাচ্ছে না। আর জাহাজিরা আশ্চর্য এই কঠিন সময়ে কে যেন বোট-ডেকে হিবিং-লাইন ধরে ঝুলে আছে। ঠিক ওরা নিচ থেকে বুঝতে পারছে না। হিবিং-লাইন ধরে কে ক্রমান্বয়ে টলে টলে অন্ধকারে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটার কি দুঃসাহস। কে এমন প্রাণ হাতে করে ওপরে উঠে এসেছে। লোকটাকে দেখার জন্য ডেক-টিন্ডাল ঝড়ের সমুদ্রে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেতে থাকল। এবং ভয়ে সে প্রায় চিৎকার করে উঠত। জাহাজের মরা আলোর ভেতর আর্চির মুখ স্থির। ডোরাকাটা এক অতিকায় জীব। তাকে দেখেই খেঁকিয়ে তেড়ে আসছে মেজ মিস্ত্রি। শরীরে রেনকোট। মাথায় টুপি। মুখটা অতিকায় আলোর ভেতরে বিভীষিকার মতো ডেক-টিন্ডাল এক লাফে ভূত দেখার মতো হিবিং-লাইনে ঝুলে ঝুলে চলে আসার সময়ই নীল তরঙ্গ মালা অথবা বলা যায় উড়ন্ত জলস্তম্ভ মাথার ওপরে ভেসে গেলে সে হিবিং-লাইন বরাবর ঝুলে পড়ল। জাহাজ সমুদ্রের নিচে অতলে ডুবে যাচ্ছে বুঝি। কিন্তু প্রাচীনতা শরীরে একেবারে কোনো তিমি মাছের মতো। দু’দন্ড ডুবে থেকে ভেসে উঠলে সে চো দৌড়। আর্চি একটা জাহাজে অতিকায় জীব হয়ে গেছে। অতিকায় জীব হয়ে যত রাতে ঘোরাফেরা করছে, তত যেন সমুদ্র ক্ষেপে যাচ্ছে। ডেক-টিন্ডাল নিচে নেমে কারো সঙ্গে একটা কথা বলতে পারল না। ভয়ে ভেজা জামা-পান্ট খুলে নেংটা হয়ে শুয়ে থাকল কম্বলের নিচে। আবার ওকে ডেকে উঠে যেতে বললে সে ঠিক সমুদ্রে লাফিয়ে আত্মহত্যা করবে। মানুষের মুখে কখনও সে এমন বিভীষিকা দেখেনি। সে ত্রাসে পড়ে গেছে—সে যেখানে যেমনভাবে থাকছে, চোখ মুখের ওপর স্থির হয়ে আছে। ডেক-টিন্ডাল ভয়ে তাড়াতাড়ি কম্বলে মুখ ঢেকে ফেলল।

বনির দরজায় তখন ঠক ঠক শব্দ। সমুদ্রে তেমনি রোলিং হচ্ছে। বনি বাংকে শুয়েছিল। পুরুষের পোশাক সে আর খুলছে না শরীর থেকে। বন্দুকটা যখন তখন আর্চি চেয়ে নিচ্ছে। হিবিং-লাইনে ঝুলে ঝুলে অথবা ঝড়ো হাওয়ার ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে লেডি-অ্যালবাট্রসকে খুঁজছে। জাহাজের মাথায় পেলেই গুলি করবে। আর পাখিটা তখন দূরে, ঝড়ো বাতাসে অথবা জলস্তম্ভের মাথায় বসে থেকে ভেসে যাচ্ছে দুরে আবার উড়ে আসছে। কখনও জাহাজের অনেক ওপরে ভেসে থাকছে। নাগাল পাচ্ছে না আর্টি। ছোটবাবুকে দেখা যাচ্ছে না। তবু সে জানে ছোটবাবু চুরি করে পাখিটাকে খাওয়াচ্ছে। পাখিটাকে উড়িয়ে দিচ্ছে মাস্তুল থেকে। এক ভয়ংকর লুকোচুরি খেলা চলছে জাহাজে। দরজায় জোরে কড়া নাড়ছে আর্চি। রাতে আর্চি যখন তখন মাঝে মাঝে ছুটে চলে আসে। জ্যাক জ্যাক ভেতরে আছো? ঝড়ের সমুদ্রে জ্যাক ভেতরে থাকতে পারে, ওপরে উঠে যেতে পারে, নিচে নেমে যেতে পারে। জ্যাক দরজা খুলে বলল, হ্যাঁ ভেতরে আছি।

—আবার সী-ডেভিলটা আসছে।

জ্যাক বলল, তাই বুঝি।

—বন্দুকটা কোথায় রেখেছ?

জ্যাক বলল, ঐতো, নিয়ে যাও।

—জ্যাক তুমি রাগ করছ না তো?

—আরে না। জ্যাক যেন ঠিক ছোটবাবুর সঙ্গে কথা বলছে।

—বুঝতে পারছ, আসলে ওটাকে আমি মারব না। তবু দেখাতে হয় মাঝে মাঝে ওদের দেখাতে হয় আমি বসে নেই। রাত নেই দিন নেই খুঁজছি। সমুদ্রে সী-ডেভিলটাকে খুঁজছি। ঝড়ের মধ্যেও খুঁজছি।

জ্যাক দরজা থেকে নড়ল না। এত রাতে আর্চি বন্দুকটা নিতে এসেছে। আর্চির চোখ মুখ সে ঠিক দেখতে পাচ্ছে না। অন্ধকারে আর্চি রেনকোট গায়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। যেন ভেতরে ঢুকতে দিলেই আর্চি রেনকোট খুলে বাংকে বসে পড়বে। তারপর কত ডিপ্রেসান, সী-হাইট কত যাচ্ছে—বাতাসের ফোর্স কত—সোয়েল কোনদিক থেকে আসছে —এবং এভাবে কখন সে আরও ক’বার সমুদ্রে অতিকায় ঝড়ে পড়ে গেছে তার গল্প বলে হাত ছড়িয়ে দেবে। বিশ্রাম করার মতো এমন সুন্দর জায়গা আর বুঝি তার কোথাও নেই।

জ্যাক বন্দুকটা বের করে বলল, ধরো।

এত তাড়াতাড়ি! আর্চি বলল, দাঁড়াও। সে দু’পা ফাঁক করে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ফের বলল, দাঁড়াও। বলে সে বন্দুকটা নেবার অছিলাতে হাত বাড়িয়ে দিল। বলল, নো। নো গার্ল। নাগাল পাচ্ছি না। তারপর সে ঝুঁকে যেন জাহাজের পিচিং-এ টাল সামলাতে পারেনি, কেবিনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মতো ভেতরে ঢুকে বলল, বাইরে ভীষণ ঝড়। ডেকে যাওয়া যাবে না। একটু বসলে আশা করি তুমি রাগ করবে না।

ভেতরে ঢুকলে বনি আর্চির মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল। আর্চি উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে। ধূর্ত চোখ লালসায় জ্বলছে। বারবার আর্চি অতি সাধারণ মানুষের মতো বলছে, জ্যাক দরজাটা বন্ধ করে দাও। কিন্তু জ্যাক দরজা বন্ধ করছে না। আর্চি এবার নিজেই দরজা লক করে বলল, ভেতরে জল ঢুকছে, ভাল হল না? জ্যাক তবু কিছু বলছে না। আর্চি তখন বলল, জ্যাক কি ঠাণ্ডা! ঠাণ্ডায় মরে যাব। ঝড় আর থামবে না!

জ্যাক একপাশে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা এখন ইচ্ছে করলে যেন কুকুর দিয়ে ছোটবাবুকে খাইয়ে দিতে পারে। বারবার তাকে আর্চি এমন ভয় দেখিয়েছে। কেবল সেই রক্ষা করতে পারে সব। আর্চির মুখে এভাবে অস্বাভাবিক ক্রুরতা। আর্চি বাংকে বসে পড়েছে। মুখের ডোরাকাটা দাগ আরও বেশি হিংস্র। আর্চি পোর্ট-হোলের কাঁচ বন্ধ করে বলছে, জ্যাক কেউ টের পাবে না। জ্যাক প্লিজ।

জ্যাক নড়ছে না। সমুদ্রে তেমনি তরঙ্গমালা। জাহাজ সমুদ্রে ওঠানামা করছে। জ্যাক দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শক্ত চোখ মুখ। এ দু’দিন আর্চি যতবার এসেছিল বাইরে দাঁড়িয়ে ভাল মানুষের মতো বন্দুকটা নিয়ে গেছে। জ্যাক দরজা খুলে অপেক্ষা করেছে। কিছু সময় পার হলে ফিরে এসেছে আর্চি। বন্দুকটা জ্যাকের কেবিনে রেখে ফের নিচে নেমে গেছে। প্রাণে কি যে ভয়! আর্চি ডেকে বন্দুক হাতে ঘুরে বেরিয়েছে। জ্যাক বাইরে তখন ঝড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে সব সময় লক্ষ্য রেখেছে কোথায় আর্চি। আর্চি যদি এলি-ওয়েতে ঢুকে যায়! ভয়ে ওর বুক গলা শুকিয়ে উঠেছে। এবং এভাবে আর্চিকে সে চোখের ওপর রেখেছে। আসলে সে চেয়েছে বন্দুকটা নিয়ে যেন কখনও আর্টি এলি-ওয়েতে ঢুকে না যায়। একবার সে ভেবেছিল বন্দুকটা সমুদ্রে ফেলে দেবে, তখনই আর্চির ভেতরের বীভৎস মানুষটা যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। চিৎকার করে সে বলতে থাকে যেন লোয়ার দ্য বোট, আই উইল গেট দিস হারপুন ইন ইউর বেলি। জ্যাক ভয়ে আর বন্দুকটা সমুদ্রে ফেলে দিতে পারেনি।

আর এভাবে যা হয়ে থাকে এক ধূর্ত ব্যবসায়ীর মতো আর্চি চোরাকারবারী জাহাজের এবং অতিশয় হীন চক্রান্তে শেষবারের মতো সে কেবিনের ভেতরে ঢুকে বসে থাকবে জ্যাক কিছুতেই অনুমান করতে পারেনি। জ্যাকের এই কেবিনটাই ছিল সবচেয়ে বড় নিরাপদ আশ্রয়। আর্চি কত সহজে এখানে ঢুকে গেল। সে কাউকে ডাকতে পারছে না। ডাকলেই চিৎকার চেঁচামেচি জাহাজে, এই যে এখানে সুন্দরী বালিকা যুবতী হচ্ছে। স্যালি হিগিনস গোপনে জাহাজে সুন্দরী বালিকা দেশে যুবতী করে নিয়ে যাচ্ছেন। এর চেয়ে বড় পাপ কি আছে! ফলে ঝড়ে জাহাজডুবি পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। আমাদের পাপের শেষ নেই। এতেও কাজ না হলে বলবে, আসুন আপনারা, আপনাদের আমি জ্যান্ত পরী দেখিয়ে দিচ্ছি। একেবারে জ্যান্ত। রক্তমাংসের। জ্যাক বুঝতে পারছে সে জাহাজে ভারী অসহায়। ভয়ে সে প্রায় কেঁদে ফেলবে এবার।

আর্চির যেন তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। বেশ রয়ে সয়ে সে সব দেখে যাচ্ছে। জ্যাক কি লম্বা! জ্যাকের পোশাক ছিঁড়ে ফেললে আশ্চর্য সব সুগন্ধ সারা কেবিনে ম ম করবে। জ্যাকের শরীরে সামান্য হাত যেন কতকাল পর যুবতী নারী-সুধা-পারাবার হয়ে যুবতী নারী তার সামনে। পোশাকের ভেতরে সেই সব চমৎকারিত্ব, সে একেবারে দু’হাতে লুণ্ঠন করে নেবার জন্য মাঝে মাঝে গোপনে চোখ তুলে দেখছে। একটা চুরুট সে অনায়াসে খেতে পারে। জ্যাককে সামান্য সময় দেবার জন্য, অথবা এটা এমন কিছু দুর্ঘটনা নয়, সে ইচ্ছে করলেই আর্চিকে খুব সহজে সুধা-পারাবারে নিমজ্জিত করে এই প্রবল ঝড় এবং সব আশঙ্কা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। সে চুরুট জ্বালিয়ে পায়ের ওপর পা রাখল। একটা হাত বিছিয়ে দিল বাংকের রেলিঙে। প্রায় শরীর এলিয়ে নিশ্চিন্তে চুরুট টানছে। ধোঁয়ার রিঙ মুখে এবং বগলের কাছে ঘুরেফিরে নেমে যাচ্ছে। জ্যাক একটা কথা বলতে পারছে না। মুখ নামিয়ে রেখেছে। জালে পড়া ভীরু কবুতরের মতো কাতর চোখ। তখনই সে ডাকল, জ্যাক। জ্যাক তাকাচ্ছে না। আর্চি উঠে দাঁড়াল।—জ্যাক, সে আবার ডাকল। জিভে লালা জমছে। দু’ঠোঁটে আঠা আঠা লাগছে—সে ফের বসে পড়ল। ডাকল,জ্যাক। জ্যাক কাছে আসছে না। তাড়াহুড়ো করে সব সে মাটি করে দিতে পারে না। ওর চোখ জ্বলছে। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে এবং শরীরে জ্বর আসার মতো। সে ফের উঠে দাঁড়াল। জ্যাক এতটুকু নড়ছে না। একবারে স্থির। জ্যাক যেন সামনে ভূত দেখছে।

আর এভাবে ভীষণ অস্থির যেন সেই পাখিটা। সে সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে। বড় বড় সব সমুদ্রের নীল জলস্তম্ভের ওপর পাখা ছড়িয়ে দিচ্ছে জলে। আকাশের সেইসব ঝড়ো হাওয়া অথবা বিদ্যুতের ঝলকে সে যেন বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছে না। বরং এমন একটা ভয়ংকর সমুদ্রে সে কতকাল পর চুপচাপ বসে থাকতে পারছে, ভেসে থাকতে পারছে, তাকে পাখা ছড়িয়ে দিতে হচ্ছে না। সব তরঙ্গমালার মাথায় সে আছে কখনও পাহাড়র মতো ঢেউয়ের শীর্ষে, কখনও পাতালের মতো নীল জলের তলায়। আর জাহাজটা দূরে কাছে কখনও। কখনও ডুবে যাচ্ছে, কখনও কাত হয়ে যাচ্ছে ভীষণ। রাশিরাশি মেঘ ভেসে যাচ্ছে মাথার ওপরে। তার ওপরে রয়েছে সেই চিরদিনের নক্ষত্রমালা। যেন পাখিটা মেঘ ফুঁড়ে উঠে গেলেই দেখতে পাবে পৃথিবীর মতো সব গ্রহ নক্ষত্র আপন মহিমায় স্ব স্ব কক্ষপথে বিচরণ করছে। এক অমোঘ শক্তি সবকিছুর অন্তরালে নিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। কেউ তার মহিমা ইচ্ছে করলেই পাল্টে দিতে পারে না।

ঘোর দুর্যোগের ভেতর অন্ধকার সমুদ্রে মাঝে মাঝে পাখিটার কক কক আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। কোন লোহার তার-টার বোধহয় মাস্তুল থেকে আল্গা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে লোহার তারে তারে বাড়ি খাচ্ছে। গং গং করে কঠিন ধাতব শব্দটা ঝড়ের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আবার কোথাও কাঠের ঘসা লেগে শব্দ উঠছে। ঝড়ের মুখে স্টিয়ারিং এনজিনের সব পেনিয়ান একটার ওপর আর একটা উঠে আসতে চাইছে। যেন মার মার কাট কাট। হাল বারবার জাহাজের ঘুরে যাচ্ছে। প্রবল ঝড়ের জন্য কম্পাসের কাঁটা ভীষণ কাঁপছে। কম্পাসের কাঁটা লাফিয়ে লাফিয়ে ঘর পার হয়ে যাচ্ছে। হালের ওপর প্রবল চাপ পড়ছে তখন। প্রপেলার বাতাসে ভেসে উঠলে হালে পানি পাচ্ছে না জাহাজ। যেন দম আটকে জাহাজটা সত্যি সমুদ্রে মরে যাবে।

তখন স্যালি হিগিনস আর কেবিনে ফিরে যেতে পারেন না। তিনি পায়চারি করছেন ব্রীজে। মাঝে মাঝে ঝুঁকে আকাশ দেখছেন। সী-হাইট ক্রমশ বাড়ছে। বাতাসের গতিবেগ প্রবল হয়ে উঠছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় রেডিও-অফিসার বেতার সংকেতে সমুদ্রের খবর পাঠিয়ে যাচ্ছে। স্যালি হিগিনস তখন ভিজিবিলিটি কত, লক-বুকে উপুড় হয়ে দেখছেন। দেখে চক্ষু স্থির হয়ে যাচ্ছে। জাহাজ তবু চলছে।

তিনটে বয়লারের সামনে তিনজন ফায়ারম্যান। এনজিন-সারেঙ উইণ্ড-সেলের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। স্টিম এক ঘর নামতে দিচ্ছেন না। টলতে টলতে সব ফায়ারম্যানরা এগিয়ে আসছে। রমারম কয়লা হাঁকড়ে যাচ্ছে। তবু স্টিম কিছুতেই ঠিক রাখা যাচ্ছে না। বার বার স্লাইস মেরে আগুনের কলজে উপড়ে আনার মতো সব ঘেঁটে নতুন কয়লা, এয়ার-বালব ছেড়ে একটু হাঁফ ছাড়তে না ছাড়তেই সেই ঐশী শক্তির ওপর নির্ভরশীল মানুষেরা চিৎকার করতে থাকে—আল্লা হু আকবর। অর্থাৎ আপনি এখন একমাত্র আমাদের ভরসা। সমুদ্রের নোনা জল তখন হুড়মুড় করে নিচে নেমে আসে। জাহাজটা আবার একটা বড় রকমের ঢেউ সামলে উঠেছে। ফায়ারম্যানরা পা ঠিক রাখতে পারছে না। পিছলে পড়ে যাচ্ছে।

আর সেই গুম গুম শব্দ—যেন পাতালপুরী থেকে লক্ষ লক্ষ মনস্টার ধেয়ে আসছে। ভেসে আসছে অথবা উড়ে আসছে। কানে তালা লেগে যাচ্ছে। শিস্ দিচ্ছে সমুদ্রের চোরা বাতাস। এনজিন-রুমে ফাইভার দেখছে তখন প্রপেলার স্যাফটা ঘুরতে ঘুরতে আর দম পাচ্ছে না। প্রপেলার স্যাফট ঘুরতে ঘুরতে সহসা থেমে যাচ্ছে, ঝুপ করে জলের ভেতর প্রপেলার পড়ে গেলেই প্রাণ পেয়ে যাচ্ছে ফের। সেণ্টার-বয়লার যে ক্রমে নিচে বসে যাচ্ছে কেউ এতটুকু বুঝতে পারছে না।

ছোটবাবু ডেবিডের ঘরে বসে ছিল। ডেবিডের ওয়াচ এবার আরম্ভ হবে। ডেভিড ছোটবাবুকে বার বার উঠতে বলছে—কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়তে বলছে। কিছুতেই উঠছে না ছোটবাবু। চুপচাপ বসে আছে। ডেবিড বুঝতে পারছিল, ছোটবাবুর চোখ-মুখের অবস্থা ভাল না। ছোটবাবু বোধহয় এবার কোনো কঠিন অসুখে পড়ে যাবে। ছোটবাবুর জন্য ওর ভীষণ ভাবনা হচ্ছিল।

সারাদিন প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে ছোটবাবু কাজ করেছে উইনচে। যখন কেউ ডেকে উঠতে সাহস পাচ্ছে না যখন ডেকে ওঠা নিষেধ তখনও তাকে দিয়ে কাজ করিয়েছে আর্চি। সে কোমরের সঙ্গে লম্বা দড়ি দিয়ে নিজেকে উইনচের সঙ্গে আটকে নিয়েছিল। আর সমুদ্র থেকে তরঙ্গমালা নাচতে নাচতে চলে গেলে সে ডুবে থাকত, শ্বাস ফেলতে পারত না। মনে হত এই বুঝি তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। জল যতক্ষণ সরে না যাচ্ছে, জলের নিচে দু’হাতে শক্ত করে ধরে রাখতো সে উইনচের লিভার। জল নেমে গেলে সে ভীষণ হাঁপিয়ে পড়ত। আর এভাবে যখন ছোটবাবুকে নিয়ে জাহাজে নিষ্ঠুরতার খেলা চলছিল—তখন কাপ্তান অথবা জ্যাক একটা কথা বলতে পারে নি। আর্চির কোনো ওয়াচ নেই। ওর ওয়াচের ভার এখন পাঁচ-নম্বরের ওপর। সে বেশ যেন এই খেলায় মেতে গিয়ে ভারী মজা পাচ্ছিল। বন্ধু অনিমেষ গণি জব্বার মাঝে মাঝে উঠে এসেছে ওপরে—সব দেখে ফোকসালে নেমে গেছে। এনজিন সারেঙকে বলেছে, কিছু একটা করুন। ছোট তো মরে যাবে। সারেঙ চুপচাপ বসে থেকেছে। একটা কথা বলেনি। পবিত্র কোরান থেকে বারবার সেইসব আয়াত সুরা দীর্ঘস্বরে যেন কতকাল থেকে আছে মানুষের দীপ্যমান আল্লাহ তাঁর কথাই একমাত্র এখন উল্লেখ করা যেতে পারে—তিনি পর পর সব সুরা পাঠ করে যাচ্ছেন, কারো কাছে তাঁর কোনো নালিশ নেই।

আর আর্চি বার বার ঘুরে গেছে ওপরে। সে ঝড়ের ভেতর ঘুরে ঘুরে বোট-ডেক থেকে দেখছে ছোটবাবু ঠিকঠাক ডেকে এখনও আছে না সাবাড় হয়ে গেছে। ডেবিড আর্চিকে বলল, না, এ সময়ে তুমি ছোটবাবুকে ডেকে কাজ করতে পাঠিয়ে ঠিক করনি। বার বার সে অনুরোধ করেছে—আর্চি, এখন সময় নয়। আর্চি বলেছে, ভাঙা জাহাজ। কখন আর সময় পাওয়া যাবে। সমুদ্রে ‘সব ঠিকঠাক করে না নিলে বন্দরে উইনচ চালানো যাবে না।

ডেবিড এক্তিয়ারের বাইরে কথা বলছে, আর্চি তার কথা আদৌ গ্রাহ্য করছে না। এবং ডেবিড বুঝতে পারছে আর্চির মতলব ভাল না। তবু ছোটবাবুর জন্য ডেবিডের ভীষণ মায়া। খাবার সময়ে সে বলেছে, ছোটবাবু তুমি সাবধানে কাজ করবে। ছুটির পর ছোটবাবুর চোখে ভীষণ আতঙ্ক! সে দেখেছে ছোটবাবু চুপচাপ শুয়ে থেকেছে ওর কেবিনে। শরীর চাঙ্গা করার জন্য সামান্য ড্রিংকস দিলে সে খেয়েছে। তবু ওর চোখ-মুখের চেহারা পাল্টায় নি। চোখের নিচে অনিশ্চিত অন্ধকার। যেন আবার সকাল হবে, ঝড় থাকলে সেই ডেকে আবার তার কাজ, যে-কোন সময় সমুদ্র তাকে ভাসিয়ে নিতে পারে। যে-কোনো সময় সমুদ্রের তরঙ্গমালা তাকে জলের নিচে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে পারে। ফলে ডেবিড বার বার ওকে ঘুমোতে যেতে বলছে। এমন অমানুষিক পরিশ্রমের পর ভাল ঘুম না হলে শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়বে। পরদিন এই নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তবে ঠিক ঠিক যুঝতে পারবে না।

ছোটবাবু কেবিনে ঢুকে দরজা লক করে দিল। সে শুল না। ডেবিড ওয়াচে চলে যাচ্ছে। সে বসে থেকে ডেবিডের পায়ের শব্দ পাচ্ছে। মাথার ওপর জ্যাকের কেবিন। পায়চারি করছে বোধহয় জ্যাক। খুব ধীরে ধীরে কেউ হেঁটে গেলে কাঠের পাটাতনে যেমন শব্দ হয় তেমন চতুর পদক্ষেপ, যেন প্রতিটি পদক্ষেপ ভীষণ সতর্ক। বনি তো এভাবে কখনও হাঁটে না! বনি তো এভাবে পায়চারি করে না। এখন আবার সব চুপচাপ। কেউ হাঁটছে না। ছোটবাবু দু’হাতের ভেতরে মুখ ঢেকে বসে পড়ল। বনি বার বার তাকে সতর্ক করে দিয়ে গেছে—ছোটবাবু তুমি আমার জন্য ভেব না। তুমি সাবধানে থেকো। আমাদের পোর্ট-মেলবোর্ন পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই।

তারপর বনি বুকে মুখ লুকিয়ে বলেছে, আমাকে নেমে যেতে হবে ছোটবাবু। আমি নেমে যাব। বাবাকে তোমাকে এতবড় বিপদে কিছুতেই পড়তে দেব না। বনি তারপর কিছুক্ষণ কেঁদেছে। চলে যাবে বলে কেঁদেছে। ছোটবাবুকে বলেছে, তুমি ঠিকই বলেছ ছোটবাবু, আমাকে নামিয়ে না দিলে জাহাজটা অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তি পাবে না।

ছোটবাবু বলেছিল, বনি তুমি ওকে বন্দুকটা দিয়ে দাও। ওটা তোমার কাছে না রাখাই ভাল।

বনি কি বলবে, সে তো বুঝিয়ে বলতে পারে না, ছোটবাবু সমুদ্রে এখন সাইক্লোন এখন যে-কেউ জাহাজে গোপনে কিছু একটা করে ফেলতে পারে। তুমি কখন কিভাবে থাকবে, আর আর্চি তোমাকে ভয় পায় ছোটবাবু, আর্চি তোমাকে কিছু একটা করে ফেললে আমার কি হবে ছোটবাবু। যতক্ষণ আৰ্চি বোট-ডেকে থাকে, বন্দুকটা ওর হাতে থাকে। আসলে আমি পাহারায় থাকি তখন। ঝড়ে জলে আমি ভিজে যাই, তবু হিবিং-লাইনে ঝুঁকে অলক্ষ্যে ছোটবাবু এগিয়ে যাই দেখি আর্চি কতদূর যেতে পারে। তুমি ছোটবাবু আমার জান্য ভেব না। তুমি এখন আর কিছু করতেও পারবে না। বাবা বুঝতে পারছ কেমন হয়ে গেছে। বাবা এখন মাঝে মাঝে রাতে চিৎকার করে ওঠেন—কে? আর্চি তখন সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে জবাব দেয় ছোটবাবু, আমি আর্চি স্যার। সী-ডেভিলটাকে খুঁজছি। আসলে সে আমার কেবিনের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। এলবাকে খোঁজার নামে আমার শরীরের গন্ধ শুঁকে বেড়ায়। সব বুঝতে পারি ছোটবাবু। বাবাও বুঝতে পারেন। কিন্তু বাবা আর কিছু করতে পারছেন না। আমাকে নামিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তিনি কিছু করতে পারবেন না। তুমি ছোটবাবু কি আর করবে! মুখ বুজে সব সহ্য করে যাওয়া ছাড়া তোমার উপায় নেই।

সে ছোটবাবুকে শুধু বলেছে, আমি আর নিচে আসছি না। তুমি ছোটবাবু আমার জন্য ভাববে না। বল ভাববে না। সে ছোটবাবুর কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়ে গেছে। ছোটবাবু আর কিছু করতে পারছে না। রাতে সে ভাল ঘুমোতে পারছে না। ঘুম ভেঙে যাচ্ছে বার বার। সে জেগে গেলেই শুনেছে বাইরে সেই সাইক্লোনের হাহাকার শব্দ। সমুদ্রের অস্থির গর্জনে কান পাতা যাচ্ছে না। সব পোর্ট-হোল, এলি-ওয়ের দরজা বন্ধ। ভেতরে একবিন্দু জল ঢুকতে পারছে না। দরজা অথবা পোর্ট-হোল খুললেই জলের ঝাপটায় কেবিন এলি-ওয়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর তখনই মনে হচ্ছে ফের মাথার ওপর কে বার বার হেঁটে যাচ্ছে। পাটাতনে খুব সতর্ক নিস্তেজ পায়ের শব্দ। আসলে এটা ওপরে হচ্ছে না মাথার ভেতরে সেই ঘণ্টাধ্বনি যা সে মাঝে মাঝে আতঙ্কের ভেতর ডুবে গেলে শুনতে পায় এমন সব শব্দ কি মগজের ভেতরে নড়ানড়ি করছে! সে মাথা চেপে বসে থাকল দু’হাতে। সে দু’হাতে কান চেপে ওপরের কোন শব্দ শুনতে চাইছে না। তবু সে শুনতে পাচ্ছে যেন ঘোড়ার পায়ের শব্দ। ঠক ঠক মাথার ভেতরে বাজছে। চোখে মুখে অবসাদ আর ক্লান্তি। সে যত চেষ্টা করছে শুয়ে পড়বে—কোনো ঘণ্টাধ্বনি তাকে কাতর করতে পারবে না—তবু কি যে হচ্ছে মাথার ভেতরে সেই সব শব্দমালা। পাটাতনে কিছু পড়ে গেল যেন। হাত ফসকে পড়ে গেছে মতো। জ্যাক এত রাতে এভাবে কেবিনে ছুটোছুটি করছে কেন? ধাক্কা লেগে কিছু পড়ে গেল যেন। মনে হচ্ছে এক ভয়ংকর ধ্বস্তাধ্বস্তি চলছে ওপরে। কোনো দানবের পাল্লায় কেউ পড়ে গেছে মনে হয়। এবং কাঁচের গ্লাস ভাঙার শব্দ। এবং সে নিজে ক্রমে নিজের ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছে।

তখন অবিশ্রান্ত মার মার কাট কাট এনজিন-রুমে। স্টিম-গেজের কাঁটা দু’শো বিশে কিছুতেই লাল দাগ বরাবর তুলে দেয়া যাচ্ছে না। বয়লারের আগুন দাউ দাউ জ্বলছে। র‍্যাগ মেরে সব আগুন ঘেঁটে ক্রমান্বয় কয়লা হাঁকড়াচ্ছে, একদণ্ড বিশ্রাম পাচ্ছে না কেউ। এনজিন-সারেঙ গেজের কাঁটা শুধু দেখছেন। কাঁটাটা ক্রমশ ওপরে উঠে যাচ্ছে ক্রমশ ক্রমশ ওপরে উঠে যাচ্ছে, আর ঠিক জায়গায় যেতে না যেতেই দপ করে নেমে যাচ্ছে। এনজিন-সারেঙ চিৎকার করতে করতে ছুটছে, জাহাজ চলছে না, জাহাজ ঝড়ে পড়ে গোঙাচ্ছে। মিঞারা সাহস সঞ্চয় কর। দরিয়া দামাল হয়ে উঠছে। তোমরা কেন পারছ না।

জ্যাক দু’হাতে আত্মরক্ষার্থে প্রাণপণ লড়ছে। ওর প্যান্ট জামা ছিন্নভিন্ন। ওর পা তুলে ফেলছে—ঠিক লাল দাগের কাছে কাঁটাটা উঠে যাচ্ছে আর সে দু’হাতে এনজিন-দানবের সঙ্গে লড়ছে। মুখে মুখোশ। বনি পা শক্ত করে রাখছে। পা সে কিছুতেই শিথিল করছে না। আর্চি লুটিয়ে পড়েছে শরীরে। সব আসুরিক ক্ষমতা তার ক্রমে পাগলের মতো মাথায় এসে জড়ো হচ্ছে। সে বনির স্তনের ওপর সজোরে খাবলে ধরতে যাচ্ছে। মুখে ঠোটে লালা। বাংকের ওপর লুটিয়ে পড়েছে বনি। দু’হাতে আর্চির মুখ ঠেলে তুলে রেখেছে ওপরে। যেন হাত ফসকে গেলেই মুখটা তার ঠোঁট কামড়ে ধরবে। পা তুলে ফেলছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে জ্যাকের। সে তবু পা প্রাণপণ জড়ো করে রাখছে। আর্চি এক হাতে ডান পাটা কব্জা করে আনছে। আঁচড়ে খামচে জ্যাক তাকে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে, যে কোনো মুহূর্তে আর্চি চিৎকার করে উঠতে পারে—লোয়ার দ্য বোট আই উইল গেট দিস হারপুন ইন ইউর বেলি, যে কোনো মুহূর্তে মুহূর্তে……মুহূর্তে আর তখনই মনে হল ঝড়ের দরিয়ায় কে দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকছে, জ্যাক দরজা খোল। ভীষণ ঠাণ্ডা গলা। ভীষণ স্থির। কতদিন পর কেউ ফিরে এসে যেভাবে ডাকে যে ভাবে বলে আমি এসেছি জ্যাক, দরজা খোল।

সমুদ্রের হাহাকার বাতাসে এখন আর কোনো তঞ্চকতা নেই। জলোচ্ছ্বাস এসে ডেক ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে। জাহাজ কাত হয়ে একেবারে খাড়া হয়ে যাচ্ছে কখনও। ছোটবাবু বালকেডে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। ওপরে সব কেবিনের দরজা পোর্ট-হোল বন্ধ। ব্রীজে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দরজা বন্ধ বলে কেউ দেখছে না নিচে ছোটবাবু জ্যাকের দরজা ধাক্কাচ্ছে।

সহসা দরজা খুলে ছিটকে বের হয়ে গেল আর্চি। জ্যাক বিছানায় পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বালিশ, চাদর, লাইফ জ্যাকেট, জলের কুঁজো এবং ফুলদানি বই যা কিছু এই যেমন জামা প্যান্ট সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ছোটবাবু একটা কথা বলল না। সে যেন পাথর হয়ে যাচ্ছে। আর ক্রমাগত সেই ঘণ্টাধ্বনি—সে দেখতে পাচ্ছে, কেউ যেন উঠে যাচ্ছে দ্বীপে। পাহাড়ের মাথা থেকে সেই ঘণ্টাধ্বনি মুছে দিতে যাচ্ছে—জলের ভেতরে সেই ঘণ্টাধ্বনি অজস্র বুদবুদের মতো, অথবা মনে হচ্ছে মোষ বলির সময় সেই যে ঢাকীরা ঘুরে ঘুরে কেবল বাজায়, ধূপধুনো এবং মন্ত্রোচ্চারণ, মোষের ডাক, আর রক্তপ্রবাহ সব একসঙ্গে যেন তার মাথার ভেতরে বাজছে। জ্যাক মুখ তুলে ছোটবাবুকে দেখতেই আতঙ্কে ছোটবাবুর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল—নো নো। ছোটবাবু তুমি এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? ছোটবাবু তুমি তুমি কথা বলছ না কেন! ছোটবাবু তুমি তুমি ছোটবাবু… ছোট…. বাবু।

ছোটবাবু বনির দু’হাত ছাড়িয়ে নেমে গেল। এটা তার কাছে কোনো ঘটনা নয়। ছোটবাবু সিঁড়ি ধরে নেমে যাচ্ছে। যেন এটা একটা সহজ ঘটনা, সে একেবারে সহজভাবে নিয়েছে সব—এবং আলোর ডুম দুলছে। ছোটবাবুর ছায়া একবার বড় হয়ে যাচ্ছে আবার ছোট হয়ে যাচ্ছে। ছোটবাবুর কাছে এটা একটা কিছু নয়—ছোটবাবু হেঁটে যাচ্ছে। মাথার ভেতর মোষ বলির বাজনা বাজছে। মন্ত্রোচ্চারণের মতো মনে হচ্ছে এই সমুদ্রের হাহাকার বাতাস। সে হেঁটে যাচ্ছে। নিশীথে জাহাজ তখন উন্মাদের মতো মাথা কুটে মরছে, পেরে উঠছে না। কিছুতেই, পেরে উঠছে না সমুদ্রের সঙ্গে যুঝতে তখন ছোটবাবু নেমে যাচ্ছে। টলতে টলতে নেমে যাচ্ছে। সে নেমে সোজা আর্চির কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকছে, স্যার আমি ম্যান। দরজা খুলুন।

—ম্যান। তোমার এত সাহস। আমার দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকছ। সে দরজা খুলে ভেবেছিল বন্দুকের বাঁটে একটা মাথায় বাড়ি মারবে—তুমি যত নষ্টের গোড়া তুমি আমার এমন সুযোগ নষ্ট করে দিলে হে। ইণ্ডিয়ান ডগ। কুত্তার বাচ্চা। কিন্তু দরজা খুলেই আর্চির মুখ আতঙ্কে শুকিয়ে গেল। ম্যানের চোখে শূন্যতা। যেন সাক্ষাৎ শয়তানের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ম্যানের চোখে পলক পড়ছে না।

হায় তখন কেউ জানে না, একটা বিদ্যুতের শেকড় যেন ক্রমাগত মাংকি-আয়ল্যাণ্ডের ছাদ থেকে নেমে আসছে। বিদ্যুতের শেকড় কি বাতাসের ঝাপটায় এমন একটা অতিকায় দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে জাহাজিরা কেউ টের পাচ্ছে না। চিরে যাচ্ছে। আঁকাবাঁকা দাগের মতো মস্ত ফাটল দেখা দিচ্ছে। ঠিক সোজা বোট-ডেকে উইংসের নিচে দাঁড়ালে ফাটল গভীর থেকে ক্রমশ গভীরতর হয়ে যাচ্ছে। আর একভাবে দাঁড়িয়ে আছে বনি। দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটবাবুর পেছনে পেছনে সে যেতে সাহস পায়নি। সে চিৎকার করে বলতে পারত, বাবা ছোটবাবু পাগল হয়ে যাচ্ছে। সেই যে তুমি বলেছিলে বাবা মাথায় ওর কোনো গণ্ডগোল দেখা দিতে পারে বাবা ওর বুঝি সত্যি সেই গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে—কোথায় অন্ধকারে নেমে গেল! বনি এভাবে কিছুতেই আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সে অস্থির হয়ে উঠছে। ছোটবাবু কিছু একটা করে ফেলতে পারে। ছোটবাবুকে আর্চি কিছু একটা করে ফেলতে পারে। সে দ্রুত নেমে আসছিল সিঁড়ি ধরে। তার পা ফেলা ঠিক থাকছে না। সে বুঝতে পারছে ঠিক এ-ভাবে এখন হেঁটে কোথাও যাওয়া যায় না। সে কোনরকমে সিঁড়ি ধরে নিচে নামতেই বুঝতে পারল আহাম্মকের মতো পোশাক না পাল্টে সে নেমে এসেছে। তাকে ওপরে উঠতে হবে। ঝুলে ঝুলে প্রায় কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে ওপরে ফের উঠে গেল। এবং মনে হল জাহাজের নিচে কোলাহল শোনা যাচ্ছে! বোধহয় এনজিন-রুমে। ছোটবাবু কোথায়! সে জামা গলিয়ে নিচে নেমে এসে দেখল, না সব ঠিক, কোথাও কোনো কোলাহল নেই। একেবারে আর দশটা দিনের মতো এলি-ওয়ে নির্জন। ছোটবাবুর দরজা বন্ধ। সে বার বার ডেকেও সাড়া পেল না।

আর ঠিক জাহাজের এটা একটা অন্তিম সময় কেউ টের পেল না! জাহাজ ওঠানামার ভেতর কখন সেই ইণ্টারমিডিয়েট স্টপ ভালভ মুরগীর গলা ছেঁড়ার মতো কোন এক দানব দু’হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। টের পাচ্ছে না কেউ কী করে জেনারেটর ঘুরতে ঘুরতে আর ঘুরতে পারল না। কখন এই অতিকায় যুদ্ধবাজ ঘোড়া ক্রমে অবসন্ন হতে হতে হাঁটু মুড়ে যাচ্ছে কেউ বুঝি বুঝতে পারছে না। সহসা সব অন্ধকার হয়ে গেল। জেনারেটর ফেল করেছে, সহসা মনে হল ভূখণ্ড চিরে অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে। আর ভীষণ বীভৎস তীক্ষ্ণ শিস্ শোনা যাচ্ছে। সহসা মনে হচ্ছে লোকজন ছোটাছুটি করছে। এলি-ওয়ে ধরে কেউ ছুটে গেল। সারা এনজিন-রুমে ভয়ংকর উত্তাপ, যেন ঝলসে যাচ্ছে শরীর, গরম স্টিমে সারা এনজিন-রুম ছেয়ে গেল। বনি আর শ্বাস নিতে পারছে না। আর চারপাশে শুধু গভীর অন্ধকার। বনি কোনো রকমে চেনা পথটা আবিষ্কারের চেষ্টায় হামাগুড়ি দিতে গেলে ওর ঘাড়ে এসে অন্ধকারে কেউ ছিটকে পড়ল। বনি এখন বুঝতে পারছে বোট-ডেকে উঠে যাবার জন্য প্রাণরক্ষার্থে সবাই যে যেদিকে পারছে এলোপাথাড়ি ছুটছে। এনজিন-রুমে ভয়ংকর রকমের দুর্ঘটনা। এ-সময়ে টর্চ জ্বালিয়ে কেউ টলতে টলতে ছুটে আসছে। অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এবং টর্চের আলোতে বনি বুঝতে পারল পাগলা- ঘণ্টি বাজিয়ে দিলে যেভাবে মানুষ ছুটে যায় সবাই তেমনি ছুটছে। বনি কাউকে কিছু বললে, কেউ দাঁড়াচ্ছে। বনি কাউকে কিছু বললে, কেউ দাঁড়াচ্ছে না। ডেকের দিকে পালাচ্ছে। আর তখনই কোথা থেকে ছোটবাবুর গলার স্বর সে সহসা শুনতে পেল। সতেজ, যেন সে ঘুম থেকে উঠে এসেছে। গলার স্বর এমনই মনে হয়েছিল। ছোটবাবুর হাতে টর্চ। সে বনিকে টানতে টানতে এবার ওপরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সব এলি-ওয়ে, সব কেবিন, সব এনজিন-রুম আর সব ফাঁকফোকড় স্টিমে অন্ধকার হয়ে গেছে। মুহূর্ত মাত্র দেরি করে ফেললে সবাই শ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাবে।

আর যা হয় ছোটবাবুর এ-সময়ে। শুধু ছোটবাবুর কেন সবাই যে যার প্রাণ রক্ষার্থে নিজের নিজের যা কিছু আছে, এই যেমন ছোটবাবুর বনি আছে তাকে বগলদাবা করে ওপরে উঠে যাচ্ছে। অন্ধকারে কত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে কেউ অনুমানই করতে পারছে না। নিচে ঠিক জালির নিচে ক’জন লোক মনে হয় আটকা পড়েছে। ফানেলের কিছুটা অংশ উড়ে গেছে। দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। সে ডাকল, হাই

আবার সে ফের ডাকল, হাই। এবং সঙ্গে সঙ্গে বনির বুক ফেটে যাচ্ছে, বাবা! বাবা! অন্ধকারে ওপরে বাবা দু’হাত তুলে যেন সেই কঠিন প্রেতাত্মার মতো ঝুলে আছেন। যারা এনজিন-রুম থেকে আসতে পেরেছে, যারা নিঃশ্বাস নিতে পারছে না বলে বোট-ডেকে টুইন-ডেকে ছোটাছুটি করছে এবং চিফ-মেট পর্যন্ত সত্যি ওপরে উঠে দেখল মাস্টার প্রায় কোনোরকমে ঝুলে আছেন। বড় রকমের আর একটা ঢেউ এলেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, তখন টর্চের আলো বরাবর ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে ওরা দু’জন অর্থাৎ ছোটবাবু আর চিফ-মেট প্রায় বগলদাবা করে তুলে এনে নিচে জ্যাকের কেবিনে ঠেলে দিতেই হুড়মুড় করে ঝুলে থাকা মাংকি-আয়ল্যাণ্ড চার্টরুম সহ মনে হল নিমেষে উধাও হয়ে গেল সমুদ্রে। যারা ডেকে ছিল হিবিং-লাইন ধরে জলের নিচে কিছু কাল সাঁতার কেটে ওঠার মতো এবং এই জলরাশি কিছুটা স্টিম সঙ্গে নিয়ে যাওয়ায় মনে হল, জাহাজের ভেতরটা হাল্কা। কোথায় কি হয়েছে কেউ বলতে পারছে না। কোথায় আর্চি, কোথায় অন্য সব এনজিনিয়াররা এবং এমন একটা অন্তিম সময়ে শুধু থার্ড- মেট বলল, স্যার এস. ও. এস.। স্যার আমরা সব হারিয়েছি। স্যার আমাদের সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে! ডেবিডের পাত্তা নেই। রেডিও-অফিসারের পাত্তা নেই। ব্রীজ, মাংকি-আয়ল্যাণ্ড, চার্ট-রুম সব ভাসিয়ে নিয়ে গেলে যা হয় সবাই অন্ধকার নিশীথে জাহাজে মৃত্যুর মতো শীতল গভীর ঠাণ্ডা স্পর্শে মুহ্যমান কি করণীয়, কি এখন এনজিনের অবস্থা এবং জাহাজডুবী কি হয়ে যাচ্ছে, আসলে জাহাজটা ভেসে আছে তাও কেউ যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। জাহাজ ক্রমশ কাত হয়ে যাচ্ছে। জাহাজের অবস্থা একটা ভাসমান কাঠের গুঁড়ির মতো কেউ অনুমানই করতে পারছে না। যেন এক্ষুনি আবার আলো জ্বলে উঠবে। আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। যেন এক পরাভূত মানুষের দল জয়লাভের নিমিত্ত স্বপ্ন দেখছে। সমুদ্রের দমকা বাতাস প্রবল পরাক্রম যুদ্ধবাজ—বিরাম নেই বিশ্রাম নেই। অন্ধকারে জাহাজ যে কাত হয়ে গেল কাতই হয়ে থাকল। অন্ধকারে জাহাজ যে ঘুরতে থাকল সমুদ্রে, কেবল ঘুরতেই থাকল। তবু কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। কোনো মন্ত্রঃপূত মানুষের মতো স্যালি হিগিনস বাইরে এসে দাঁড়ালেন তখন। শরীরের সব পোশাক জলে ভেজা। তখন একমাত্র সম্বল এল. বি. সেট, তার চেয়েও দরকার একবার দেখা আর্চি কোথায়। আর্চি, আর্চি। থার্ড এনজিনিয়ার এবং ফাইভার সামনে দাঁড়িয়েছিল। হাউমাউ করছে সব জাহাজিরা। কেউ কাপড় নষ্ট করে দিয়েছে। এবং কপাল থাবড়াচ্ছে যখন অর্থাৎ ওরা বুঝতে পারছে না, কোয়ার্টার-মাস্টার মহসীনের কি খবর। ওর ডিউটি ছিল ব্রীজে। অনেকের খবর নেই। এনজিন- রুম থেকে সবাই উঠতে পেরেছে কিনা, স্টিম নির্গত হলে যে অতিশয় শব্দ তা ক্রমে কমে আসছে। স্কাইলাইটের ভেতর থেকে একেবারে ধূম উদ্‌গিরণের মতো তখন সব স্টিম বের হয়ে আকাশ-বাতাস ঢেকে দিচ্ছে। ইচ্ছে করলেই কিছু করা যাবে না। তখন সবাই বুঝতে পারছে সমুদ্র শয়তান তার শেষ আক্রোশ জাহাজের ওপর মিটিয়ে নিয়েছে। মাংকি-আয়ল্যাণ্ডে ট্রান্সমিটার-রুম। মাংকি-আয়ল্যাণ্ড উড়িয়ে নিয়েছে। হুইল-রুমের সব লণ্ড ভণ্ড। দুমড়ে মুচড়ে একটা বীভৎস অবস্থা করে রেখেছে। আর ঠিক পাকা ফলটি তুলে নেবার মতো মাঝখান থেকে চার্ট-রুম উড়িয়ে নিয়েছে বলে ভারি মজার দৃশ্য। জাহাজের মাথা নেড়া। সবাই যেন হাসাহাসি করতে পারত। তখনই স্যালি হিগিনসের গলা, শিগগির দেখুন আর্চি কোথায়? দেখুন ডেবিড কোথায়। এল. বি. ট্রান্সমিটার সেট দ্যাখো কোথায় রেখেছে রেডিও-অফিসার। একটা টর্চ। আপনারা কেউ আমাকে একটা টর্চ দিতে পারেন! নিজের টর্চ নিজের বলতে যা কিছু চার্ট- রুমে। চার্ট-রুম উড়ে গিয়ে ভিখিরীর মতো তিনি। এটা ডেবিডের টর্চ। ছোটবাবু টর্চ দিয়ে বলল, এই নিন স্যার।

স্যালি হিগিনস বললেন, ছোটবাবু! তুমি ছোটবাবু বেঁচে আছ!

ছোটবাবু বলল, বনি আপনার পাশে। অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না বলে তিনি বনির কাছে মুখ নামিয়ে বললেন, বনি তাহলে তুমিও বেঁচে আছ! তারপরই যেন দ্বিগুন উৎসাহে বললেন, এনজিন- রুমের কি খবর। দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।

থার্ড এনজিনিয়ারের মুখ স্টিমে সামান্য ঝলসে গেছে। সে উবু হয়ে বসে আছে। স্যালি হিগিনস ডাকতেই সে উঠে দাঁড়াল। বলল, শুধু দেখলাম স্যার বালব ফেটে বেরিয়ে গেছে। আর কিছু দেখার সময় ছিল না স্যার। ভয়াবহ শব্দে আমাদের মাথা ঠিক ছিল না। সারা এনজিন-রুম মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল স্যার। এলার্ম বাজিয়ে উঠে এসেছি স্যার।

আর তখন যে যার লাইফ-জ্যাকেট পরে নেবার কথা। কিন্তু অন্ধকারে এখন নিচে নামা পাতালে নামার সামিল। স্যালি হিগিনস বুঝতে পারছেন যা কিছু করণীয় খুব ঠাণ্ডা মাথায় করে ফেলতে হবে। হাল ঠিক নেই জাহাজের তিনি এটা বুঝতে পেরেই বললেন, হারি আপ ম্যান। সবার দিকে হাত তুলে দিলেন। চিফ-মেট বলল, স্যার এল. বি. সেট পাওয়া যাচ্ছে না। ডেবিডকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

তখন স্যালি হিগিনস বললেন, চিফ তুমি ওদের নিয়ে আফটার-পিকে চলে যাও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্টিয়ারিঙের পিনিয়ান ব্লক করে দিতে হবে। হাল ঠিক নাইনটি ডিগ্রিতে রাখবে! মনে রাখবে- কি বললাম? অন্ধকারে মুখ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলেন স্যালি হিগিনস।

—আচ্ছা স্যার। সে টর্চ নিয়ে কিছু লোকজন সঙ্গে নিয়ে প্রায় ঝুলে পড়ল নিচে।

আর তখন তিনি জোরে হাঁকলেন, ডেবিড কোথায় আছ? ডেবিড, আর্চি কোথায় আছ! তিনি জানেন আর্চিকে খোঁজা বৃথা, তোমরা কে কোথায়! এবং এ-সময়ে মনে হল কারো গোঙানি শোনা যাচ্ছে, মেন-মাস্টের নিচে জড়াজড়ি করে দু’জন পড়ে আছে। বোট-ডেক থেকে টর্চ মেরে বুজতে পারলেন, ওরা ডেবিড আর রেডিও-অফিসার। ওরা দু’জন ভয় পেয়ে কখন একসঙ্গে লাফিয়ে নেমে আসছিল নিচে। কাপ্তানকে খবর দেবে বলে, তারপর কি হয়েছিল ওরা বলতে পারল না। স্যালি হিগিনসের গলা শুনে ওরা বিশ্বাস করেছে ওরা বেঁচে আছে। ওরা ভয়ে ভয়ে উঠে আসছে। ওদের টর্চ মেরে পথ দেখাচ্ছেন স্যালি হিগিনস। ওরা উঠে আসার সময় মনে হল, জালির নিচে কেউ আটকা পড়েছে। ছোটবাবু এদিকে নেই। সে গেছে নিচে সেই আফটার-পিকে—এনজিন-সারেঙ, এবং বন্ধু অনিমেষ সবার খবর নিতে গিয়ে দেখেছে কেউ আর নিচে নেই—সবাই উন্মুখ। সঠিক কি হয়েছে কেউ জানে না। এনজিন-রুমে কি হয়েছে, এনজিন-রুমে কেউ নামতে পারছে না কেন? জাহাজটা এভাবে মাতালের মতো ঘুরছে কেন? এমন সব প্রশ্ন করছে। স্টিম কোথা থেকে এত বের হয়ে আসছে। কোল-বয় দু’জনের খবর পাওয়া গেছে। ওরা উঠে এসেছে। এনজিন-সারেঙ কেবল আটকা পড়েছেন। সবাইকে তুলে দিয়ে নিচে আটকা পড়ে গেছেন। এবং তখনই ছোটবাবুর মনে হল, সেও শুনেছিল এমন। অথচ মাথা তার ঠিক ছিল না। কোনদিকে কি ভাবে সে এগুবে ঠিক বুঝতে পারছে না। যেন সেই অশুভ প্রভাব জাহাজ ছেড়ে যাবার আগে শেষবারের মতো শোধ তুলে নিয়ে গেছে। সে আর দেরি করতে পারল না। প্রায় ঝুলে ঝুলে হিবিং-লাইনে ঝুলে ঝুলে কখনও দড়িদড়া ধরে লাফিয়ে মুহূর্তে বোট-ডেকে উঠে জালির কাছে টর্চ মারতেই দেখল এনজিন-সারেঙ উপুড় হয়ে পড়ে আছেন নিচে! এ-সময় নামা ঠিক না, কারণ জাহাজের কড়িবরগা যা কিছু আছে সব প্রায় লণ্ডভণ্ড—কোনটা কিভাবে ছিটকে এসে পড়বে কেউ বলতে পারবে না। তবু যা হয়ে থাকে ছোটবাবুর কোনো কোনো সময় হুঁস থাকে না। স্বার্থপরের মতো মাথা ঠিক রেখে কাজ করতে পারে না। আর সে তো এখন আর অপোগণ্ড নেই। জাহাজে সে এখন সবচেয়ে বোধহয় শক্ত মানুষ। সে দু’হাতে ফাঁক করে ফেলল লোহার জালি। বনি ওপরে ঝুঁকে আছে। হাতে টর্চ। লোকজনের ভিড় চারপাশে। অন্ধকারে কারো মুখ চেনা যাচ্ছে না। এনজিন-সারেঙের গোটা শরীরটা কাঁধে ফেলে যখন সে সত্যি উঠে এল, এবং অন্ধকার সমুদ্রে সেই তরঙ্গমালা যখন শান্ত হয়ে আসছে, বাতাসের ঝাপটা আর তেমন প্রবল নেই বরং মনে হচ্ছে সব আকস্মিকতা শেষে সমুদ্র আবার শান্ত এবং শীতলপাটির মতো নির্ভরশীল আশ্রয়—তখন আর যেন ছোটবাবুর বিন্দুমাত্র ভয় থাকল না। সে ডেকের ওপর অন্ধকারে সারেঙকে শুইয়ে দিল। ডাকল, চাচা।

এনজিন-সারেঙ তেমনি পড়ে আছেন। স্যালি হিগিনস, বয়-বাবুর্চিরা, এবং ডেক-জাহাজিরা জড়ো হচ্ছে চারপাশে। এখন দাঁড়িয়ে থাকার সময় নয়। কেউ কেউ মাথা চাপড়ে কাঁদতে বসে গেছে। এক ধমক তখন স্যালি হিগিনসের। পালস্ দেখে বললেন, নুনজল খাওয়াও। জলের ঝাপটা দাও চোখে। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তখন সেই মাস্তুলে এলবা পাখা ঝাপটে সবাইকে কিছুটা যেন আশ্বস্ত করে দিল। স্যালি হিগিনস নিজের এই অবস্থার কথা আর ভাবতে পারছেন না। অর্থাৎ জাহাজিরা পৃথিবীর সব সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তখন যেন মাস্তুলে উঠে কেউ বলছে এবানডান দ্য শিপ। তখনই তিনি লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেলেন ডেক, বললেন সেই চরম পরিণতির উদ্দেশ্যে, নো। তিনি ডেকে দাঁড়িয়ে যখন এমন বারবার চিৎকার করে বললেন, নো, নো। শী ইজ ফেথফুল! সমুদ্রে শয়তান যতই চেষ্টা করুক, সিউল ব্যাংক আমাদের ঠিক কোনো ডাঙায় ভিড়িয়ে দেবে। এতগুলো মানুষের আশা- আকাঙ্ক্ষা এবং নির্ভর বলতে যা কিছু এখন তিনি। চিফ-মেট বুঝতে পারছে সকাল না হলে কিছু স্থির করা যাবে না। তিনিও গলা ছেড়ে বললেন, জাহাজ আমাদের ঠিক পৌঁছে দেবে। নাবিকগণ আপনারা এখন ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করুন। ঈশ্বর ব্যতিরেকে সম্বল বলতে আমাদের আর কিছু নেই। তারপর তিনি চিৎকার করে হেঁকে গেলেন, আর্চি আর্চি তুমি কোথায়? তখন মনে হল অতিশয় দূরবর্তী সমুদ্রে কেউ বাতাসে প্রবল শিস্ দিয়ে যাচ্ছে। আর্চির শিসের মতো প্রায় সঠিক আওয়াজ। চিফ-মেট বলল, আর্চি, বোধহয় স্যার সমুদ্রে ভেসে গেল। এবং কি মনে হতেই স্যালি হিগিনস গুম মেরে গেলেন।

সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক টর্চের আলো দূরবর্তী সমুদ্রের মাথায় ভেসে উঠল। না, কিছু নেই সেখানে সাদা ফেনা সমুদ্রের অথবা জলের বুদবুদ অজস্র। টর্চের আলো ফেলে সর্বত্র এভাবে দেখার সময় স্যালি হিগিনস বললেন, একবার এনজিন-রুমে নামা দরকার! ওখানে যদি আর্চি আটকা পড়ে থাকে। মনে মনে বললেন, ছলনা ছাড়া আমার আর কিছু করণীয় নেই ঈশ্বর।

ওরা সকাল পর্যন্ত চেষ্টা করেও এনজিন-রুমে নামতে পারল না। ধূম উদ্‌গিরণের মতো গরম স্টিম তখনও ভক ভক করে বের হচ্ছে। হালের পিনিয়ান ব্লক করে দেয়া হয়েছে। বড় বড় সব রড ভেতরে ঢুকিয়ে ব্লক করা হয়েছে পিনিয়ান। পিনিয়ান নড়তে পারছে বলে মনে হয় না। শক্ত সোজা লম্বা জলের ভেতরে হাল দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজটা এখন কাত হয়ে যাচ্ছে না। সোজা এবং সরল কাঠের মতো ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। ওরা এনজিন-রুমে যখন শেষ পর্যন্ত নেমে গেল, অবাক সিলিণ্ডারের নিচে তিনটে পিস্টন-রড একেবারে হাঁটু ভাঙা দ-এর মতো উবু হয়ে আছে। সেণ্টার বয়লার ছিটকে বেরিয়ে এসেছে কিছুটা। পোর্ট-সাইড বয়লার স্টাফোর্ড-সাইড বয়লার ঝুলে পড়েছে নিচে। তামার মোটা পাইপ ঠিক সিলিণ্ডারের মুখে ছিঁড়ে গেছে। ইণ্টারমিডিয়েট ভালভের কোনো হদিস নেই। মরা সাপের মুখের মতো হাঁ-করা পাইপ থেকে এখনও অল্প স্টিম বের হচ্ছে। জাহাজের এনজিন একেবারে অকেজো করে দিয়েছে। সমুদ্রের কোনো তুফান এভাবে এনজিন বিনষ্ট করতে পারে না। সেই অশুভ প্রভাব যাবার আগে শেষবারের মতো জাহাজের সব শক্তি হরণ করে চলে গেছে। চিফ-মেট কোথাও আর্চির বিন্দুমাত্র চিহ্ন পেল না। ওরা এখন নিয়তির হাতে পড়ে গেছে। আর একমাত্র সিউল-ব্যাংক পারে কোথাও তাদের এখন পৌঁছে দিতে। ঈশ্বরের প্রায় কাছাকাছি এই বিশ্বস্ত জাহাজ। এত কিছু ঘটে যাবার পরও স্যালি হিগিনস যেন নিশ্চিন্ত। তিনি যেন জানেন ভারী বিশ্বস্ত জাহাজ। এতদিন তার সঙ্গে ঘর করে এ-বয়সে জাহাজের এমন দুঃসময়ে আর তাকে অবিশ্বাস করেন কি করে! আবার তাঁর ছলনা তিনি বললেন, তোমরা আর্চির কেবিন খোঁজ করেছ?

ফাইভার ঝুঁকে ছিল এনজিন-রুমের দরজায়। সে নিচে নামতে সাহস পায়নি। কোথায় কি আগা হয়ে আছে কখন কি মাথার ওপর পড়ে যাবে—সে পেছনে পেছনে দরজা পর্যন্ত গিয়েছিল। আর নিচে নামেনি। তারপর যখন ওরা উঠে আসছে খুব একটা কাজের মানুষের মতো সে চেঁচিয়ে উঠল, কেবিনের দরজা বন্ধ। কেউ সাড়া দিচ্ছে না স্যার, বেঁচে থাকলে ঠিক সাড়া দিতেন তিনি।

স্যালি হিগিনস ডেকে উঠে দেখলেন বাতাস একেবারে পড়ে গেছে। তিনি আর্চির কেবিনে গেলেন না। সারা জাহাজ তাকে ঘুরে দেখতে হচ্ছে। অর্থাৎ তিনি ঘুরে ঘুরে বুঝতে পারছেন জাহাজটার খোলের কোনো ক্ষতি হয়নি। জল ঢুকে যাচ্ছে না জাহাজে। যতদিন খাবার থাকবে জাহাজে সবাইকে তিনি বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন। জল, খাবার, কয়লা এখনও মাসের মতো হয়ে যাবে। এবং মাসের ভেতর সিউল- ব্যাংক ঠিক কোনো ডাঙায় তাঁদের পৌঁছে দেবে—অথবা কোনো জাহাজ পাশাপাশি দেখা গেলে, অথবা যদি নিখোঁজ জাহাজের সন্ধানে উপকূল থেকে উড়োজাহাজ চলে আসে কিংবা গভীর সমুদ্রে কোনো মাছ-ধরা জাহাজের সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়—কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে।

ফাইভার ছুটে এসে বলল, খোলা যাচ্ছে না। কোনো চাবি লাগছে না। ডুপ্লিকেট চাবি পাওয়া যাচ্ছে না। স্যালি হিগিনস জানেন দরজা ভেঙে ঢুকতে হবে। এই ছলনার আশ্রয় না নিয়েও তাঁর উপায় নেই। তবু এসব করার আগে তন্ন তন্ন করে তিনি সব খুঁজে শেষে দরজা ভেঙে যখন বোঝা গেল শেষ পর্যন্ত মহসীন আর আর্চি সমুদ্রে ভেসে গেছে তখন সামান্য সময় মৌন থাকা দরকার। বোট-ডেকে সবাই ফের গোল হয়ে দাঁড়াল। মাথা হেঁট করে সমুদ্রের ভেতর সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সবাই সমুদ্রে অসীম জলরাশির ভেতর অথবা আকাশে কোনো দৈববাণী হবে এমন প্রত্যাশা করছে যেন। তখনই ছোটবাবুর মনে হয়েছিল, একমাত্র লেডি অ্যালবাট্রস বুঝি তাদের খবর ডাঙায় পৌঁছে দিতে পারে।

সে ছুটে বোট-ডেক থেকে নেমে গেল। মেন-মাস্টের গোড়ায় দাঁড়িয়ে ডাকল, এলবা আমাদের কি হবে? এলবা ওকে তখন ঘাড় বাঁকিয়ে দেখল। বাতাসে উড়ে গেল না। যেন বাতাসে উড়ে গেলেই সে ভাবতে পারত এলবা ডাঙায় খবর পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। সে ফের বলল, আমাদের জন্য তুমি কিছু করছ না! এলবা এবার ঘাড় বাঁকিয়ে দেখল না পর্যন্ত। সে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। শত চেষ্টায়ও সে পাখিটাকে আজ বাতাসে উড়িয়ে দিতে পারছে না। সামান্য খড়কুটোর মতো অবলম্বন এই জাহাজ এখন সব হারিয়ে শুধু পাখিটার আশায় যেন আছে। সেও চুপচাপ। যেন ছোটবাবু বুঝতে পারছে পাখিটা আর তাকে বিশ্বাস করছে না। এবং কেন বিশ্বাস করছে না সে কি করেছে এমন! সে বলল, আমি কি করেছি? সেই ঘণ্টাধ্বনি যেন ফের—একটা আশ্চর্য ঘোরের ভেতর পড়ে যাচ্ছে সে এবং মনে করতে পারছে সব। সে বলল, না আমি কোনো পাপ কাজ করিনি। আমার কোনো অনুশোচনা নেই। আমি আমার মনুষ্যত্ব হারাইনি। বরং মনুষ্যত্ব আমি এই প্রথম অর্জন করেছি এলবা। আমি এখন সম্পূর্ণ মানুষ। তবু এলাবা মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। ভেতরটা কেমন শঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠছে। সে ফের বলল, আমার কিছু আসে যায় না। যদি এটা পাপ কাজ হয়ে থাকে তবে আমার আসে যায় না। বনির জন্য আমি সব করতে পারি। যে-কোনো পাপ কাজ। আমার ভয় করে না।

বরফ-ঘর থেকে সব শুয়োর ভেড়া-গরু তুলে আনা হচ্ছে তখন। অনিমেষের কাঁধে একটা বড় মাদি গরুর ঠ্যাং। সে ছোটবাবুকে দেখে বলল, কিরে বিড়বিড় করে কি বকছিস?

ওদের দুর্জনের কথায় পাখিটা ফের ঘাড় বাঁকিয়ে নিচে তাকাচ্ছে।

বন্ধু পাশ কাটিয়ে যাবার সময় বলল, কারো মাথা ঠিক থাকবে না। কে কার মাংস কামড়ে খায় এখন দ্যাখো।

ছোটবাবুর কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে শুধু পাখিটাকে দূরবর্তী কোনো ভূখণ্ডে পৌঁছে যেতে বলছে। কিন্তু সমুদ্রে এলবা কিছুতেই উড়ে গেল না। ফের ঠোঁট গুঁজে দিল পাখার ভেতরে। কত কাল পর কত দীর্ঘকাল পর সে যেন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। তখন কিছু ডলফিন ভেসে আসছিল, কিছু পারপয়েজ মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এমন একটা অদ্ভুত জীবকে সমুদ্রে আবিষ্কার করে পায়লট মাছের ঝাঁক ধেয়ে আসছে। দুটো একটা অতি ক্ষুদ্রকায় র‍্যামোরা মাছ ইতিমধ্যেই জাহাজের খোলে শামুকের মতো বসে গেছে। আর অন্তহীন জলরাশি লীলাচ্ছলে জাহাজটার চারপাশে খেলা করে বেড়াচ্ছিল।

তখন ফের ছোটবাবু এলবাকে ডাকছে। সামান্য খড়কুটোর মতো পাখিটাই একমাত্র জাহাজের ত্রাণকর্তা। ওর বিশ্বাস পাখিটাই বুঝি একমাত্র এতগুলো অসহায় মানুষের বার্তা ডাঙায় পৌঁছে দিতে পারে। আর আশ্চর্য পাখিটা এত ডাকেও সাড়া দিচ্ছে না। চোখ বুজে আছে। সে বলছে, এলবা কি ভেবেছ! আমরা কি এমন পাপ করেছি যে সমুদ্রে হারিয়ে যাব। আর তখনই যা হয় ঘোরের ভেতর থেকে স্বপ্নাবলীর মতো কঠিন দৃশ্য আবার চোখের ওপর ভেসে যেতে থাকল। ওর গলা বুক শুকিয়ে উঠছে। সে দু’হাত তুলে বলতে চাইল, না না, এলবা আমি করিনি। সত্যি বলছি আমি করিনি। ঘোরের ভেতর কি করেছি আমার মনে নেই। এলবা তবু ঘুমোচ্ছে! কোনো সাড়া দিচ্ছে না। যারা উপাসনার মতো দাঁড়িয়েছিল তারা দেখল ছোটবাবু পাগলের মতো পাখিটার সঙ্গে কি সব কথা বলছে।

এখন এমন সব ঘটনা ঘটবে—কেউ এসবে পাত্তা দিচ্ছে না। ছোটবাবু কেন জাহাজে সবাই উন্মাদ হয়ে যেতে পারে। ছোটবাবু ফের ডাকছে, এলবা আমার কোনো দোষ নেই। এতে আমার কিছু পাপ হয়নি। তুমি বুঝতে পারছ না কেন আমি না করলে বনির কি হত।

দূর থেকে ওরা তখনও দেখছে মাস্তুলের নিচে দাঁড়িয়ে আছে ছোটবাবু। সে তখনও বলে যাচ্ছে—দ্যাখোনা আমার অনুশোচনা নেই। কেউ আবার আসছে না তো? সে চারপাশে দেখল। সে যে ফিসফিস করে কথা বলছে অথবা পাখিটার সঙ্গে এক আশ্চর্য তার টেলিপ্যাথি আছে ওরা কেউ বুঝি তা জানে না। সে বলল, বয়ে গেল! খবর পৌঁছে দেবে না ভারী বয়ে গেল। আমার কোনো দুঃখ নেই। বরং সে বনির জন্য এমন একটা কাজ করতে পেরে ভীষণ খুশী। সে বনির পবিত্রতা রক্ষার জন্য সব করতে পারে। তার আর কোন দুঃখ নেই। সমুদ্রে নির্বাসিত হলেও দুঃখ নেই। কি এক আনন্দে সে ছুটে গেল বনির কাছে। বনির কাছে গেলে শঙ্কা দূর হয়ে যাবে। সে ঘাবড়ে যাবে না। সারা সকাল সে বনিকে জাহাজ-ডেকে দেখতে পায়নি। সে বনিকে কেবল খুঁজছে। ওপরে উঠে দেখল দরজা লক করা ভেতর থেকে। সে ডাকল, বনি বনি।

বনি বলল, শুয়ে আছি। ভারি নিষ্প্রাণ গলা বনির।

—অসময়ে শুয়ে আছ! দরজা খুলে বনি মুখ বাড়াল তখন। বনিকে চেনা যাচ্ছে না, ভারী অসহায় মুখ। মুখে সব আঁচড়। দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় যখন মাথা সবার খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় ছোটবাবু তখন কেমন চঞ্চল বালকের মতো কি বলতে গেল বনিকে। বনি চাদর গায়ে ফের শুয়ে পড়ছে। বলছে, আমার শরীর ভাল নেই ছোটবাবু। তুমি এখন যাও

ছোটবাবু আর একটা কথাও বলতে পারল না। বনি ওর দিকে তাকাচ্ছে না। কঠিন সংশয়ে বনির মুখ থমথম করছে। কথা বললেই যেন সারা মুখে তার ঘৃণা ফুটে উঠবে। বনি টের পেয়েছে বুঝি ছোটবাবু একজন জঘন্য হত্যাকারী যুবক। বনির সব বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষ খুন করলে বুঝি মুখের ছবি বদলে যায়। বনি তার দিকে তাকাচ্ছে না। কথা বললেই বনির চোখে মুখে বুঝি অতিশয় ঘৃণা ফুটে উঠবে। সে বনির সামনে আর দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছে না। মাথা হেঁট করে নিচে নেমে গেল সিঁড়ি ভেঙে। মনে হল জাহাজে অথবা এই পৃথিবীতে জীবনযাপনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সব সে হারিয়েছে।

ভেতরে ঢুকে সে এবার কেবিনের দরজা বন্ধ করে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে কোনো বীভৎস রেখা ঠিক আর্চির মতো ফুটে উঠে কিনা দেখার সময় সে কেঁদে ফেলল। সে বলল, ঈশ্বর আমি খুন করেছি। আমার পাপের শেষ নেই। পাপের শেষ নেই, পাপ তাকে আজীবন অনুসরণ করবে এবার থেকে। সে অসহায় নিরলম্ব মানুষের মতো এবার দেয়ালে মাথা কুটতে থাকল। সে হাউ মাউ করে কাঁদছে। তার এতদিনের পারিবারিক পরিমণ্ডল নষ্ট হয়ে গেল। সে একজন খুনি।

স্যালি হিগিনসের কাছেও খবরটা পৌঁছে গেল। কেবিনের ভেতরে দরজা বন্ধ করে ছোটবাবু বালকের মতো উপুড় হয়ে কাঁদছে। দরজার সামনে ভিড়। সবাই দরজা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু খুলতে পারছে না। কেবল ছোটবাবু হাউ হাউ করে কাঁদছে—আর কি সব বলে যাচ্ছে! জাহাজের অনিশ্চিত এই যাত্রায় বুঝি প্রথমেই ছোটবাবু ধরাশায়ী হল। স্যালি হিগিনস দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বুকে ক্রস টানলেন। জাহাজে এবার শুধু আত্মহত্যা। সমুদ্রে মরীচিকা দেখে শুধু জলে লাফিয়ে পড়া। মৃত্যু-ভয় মানুষকে এভাবে দীন-হীন এবং বড় করুণভাবে যখন নিয়তির হাতে তুলে দিচ্ছে, স্যালি হিগিনস তখন ছোটবাবুকে দড়িদড়ায় বেঁধে ফেলে রাখার নির্দেশ দিলেন। এছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই। সংক্রামক ব্যাধির মতো রোগটা আবার সবার ভেতর যে কোনো সময় ছড়িয়ে পড়তে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *