1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৪১

।। একচল্লিশ।।

ছোটবাবু তখন ডেকের ওপর দিয়ে জোরে ছুটছে। যাকে সামনে দেখছে তাকেই বলছে, বন্ধু কোথায়। সারেঙ-সাব ছিলেন গ্যালির দরজায় দাঁড়িয়ে, ছোটবাবু সেখানে থেমে গেল, সামান্য দম নিল। বলল চাচা, বন্ধু কোথায়?

—নিচে তো ছিল। বড়-টিণ্ডালকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনেছিস?

বড়-টিণ্ডালকে পাওয়া যাচ্ছে না, পাওয়া যাবে। গভীর রাতে হয়তো সে ফিরে আসবে একা একা। একজন জাহাজি মানুষ রাতে ফিরে আসেনি, সকালে ফিরে আসবে। সকালে ফিরে না এলেই ভাবনার কথা, কিন্তু মৈত্রদা বন্ধুর সঙ্গে ছিল, সহসা বন্ধু দেখেছে, শহরে ভিড়ের ভেতর মৈত্র পালিয়ে গেছে। জাহাজে ফিরে ছোটবাবু এ-সব শুনেছিল।

তারপার আর যা শুনেছে, সেটা খুবই ভয়ের। বন্ধু মৈত্রদাকে হারিয়ে খোঁজখুঁজি করছে, করতে করতে আপিয়া শহরের শেষ প্রান্তে দেখেছে ছোট ছোট বালির ঢিবি, সেখানে সব খরমুজের রস পান করছে মেয়েরা, সেখানে মৈত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর হাতে ছিল বড় মাপের একটা জনি-ওয়াকার। সে সেটা প্রায় বগলদাবা করে হাঁটছিল। ওর বিচিত্র পোশাক দেখে সবাই চোখ ট্যারা করে ফেলেছিল। এই যেমন শরীরে ছিল তার প্লাসটিকের খেলনা, সেফটিপিনে আটকানো সব নীল পাথরের মালা, ঝিনুকের পুতুল, হলুদ রঙের পাতার বাঁশি। এবং মাথায় লম্বা টুপি জোকারের মতো। সবাই, যেমন বুড়ো- বুড়িরা, অথবা যুবতীরা মৈত্রকে ঘুরে ফিরে দেখছিল। মৈত্র কথা বলছিল সবার সঙ্গে, সামোয়ান নারী-পুরুষেরা, অথবা কিছু বিদেশিনী যারা, খরমুজের রস চেটে খাচ্ছিল, তারা হাঁ করে দেখছিল।

কিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ওর পায়ে পায়ে ঘুরছিল। সে সবাইকে গুড-আফটারনুন বলছিল। আর কথায় কথায় ম্যাণ্ডেলার গল্প, তার মায়ের গল্প বলছিল। ম্যাণ্ডেলার বাবার জাহাজডুবির গল্প বলছিল। একটা দু’টো করে লজেন্স চকোলেট দিচ্ছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের। কাউকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে নীল রঙের পাথরের মালা পরিয়ে দিচ্ছিল।

বন্ধু কোনো কথা বলছিল না। দূরে, আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। কারণ জায়গাটা ছিল মেলার মতো। অথবা যা হয়ে থাকে বিকেলে সবাই বালিয়াড়িতে নেমে আসে, সমুদ্রের সাঁ সাঁ গর্জন শুনতে শুনতে—খরমুজের রস খেতে ভারি মনোরম, রস চেটে খাবার সময় মৈত্রের নাম জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল—মি. বসন্তনিবাস। বসন্তনিবাস কথাটা ওদের কাছে স্পষ্ট না বলে সে আবার বলেছিল, মি. ব…স…ন্ত…নি…বা…স। আণ্ডারস্ট্যাণ্ড?

সবাই প্রায় বাউ করার মতো বলেছিল, ইয়েস ই বসনটো নি….বা….স। নিবাস।

—ইয়েস মি নিবাস। বন্ধু সব সময় আড়ালে আড়ালে ছিল। দেখে ফেললেই ফের ছুটে কোথাও মৈত্র পালিয়ে যাবার চেষ্টা করল। গোপনে তাকে কেউ অনুসরণ করছে বুঝতে পারলেই আবার সে ছুটবে।

জাহাজে ফিরে ছোটবাবু এমন সব নানাজনের কাছে শুনেছে। সবাই ডেকে উঠে এসেছে। কেউ বোধহয় নিচে নেই। এবং কি করা যায়, কাপ্তানের কাছে ইতিমধ্যে রিপোর্টে হয়ে গেছে। তিনি ব্রীজে অফিসারদের সঙ্গে বোধ হয় পরামর্শ করছেন। আর ছোটবাবু ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়াচ্ছে বঙ্কুকে। বন্ধুর মুখ থেকে সব শুনতে না পারলে সে স্বস্তি পাচ্ছে না।

—বন্ধু আছিস, বন্ধু!

মনু বলল, এই তো এখানে ছিল। কোথায় গেল!

আবার সে ডাকল, বন্ধু। বন্ধু কোথায়?

ডেক-কশপ বলল, বন্ধু বোধহয় মেস-রুমে গেছে।

কিন্তু ছোটবাবু ওপরে উঠে দেখল মেস-রুম খালি। করিডরে নানাজনের জটলা। কেউ চেঁচামেচি করছে, ভারী হট্টগোল, ওরা জাহাজে থাকবে না এমন বলছে। থাকলে বড়- টিণ্ডালের মতো ওরাও পাগল হয়ে যাবে। আসলে বড়-টিণ্ডালের কিছু হয়ে গেলে যেন ওরা আরও জোর পাবে। ওদের বিদ্রোহ করতে সুবিধা হবে। ছোটবাবুকে দেখে ফেললে সবাই চুপচাপ—একটা কথা বলছে না। কারণ ছোটবাবু তো আর ওদের সুখ-দুঃখ বুঝবে না। বেশ আরামে আছে, অফিসার মানুষ। ছোটবাবু ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে সুবোধ বালক হয়ে যাচ্ছে সবাই।

এ-ভাবে ঘুরতে ঘুরতে ছোটবাবু টের পেল, সবাই ওকে ক্রমে অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে। কেউ ওদের উসকে দিচ্ছে, কে দিচ্ছে বুঝতে পারছে না। ডেবিড উত্তেজিত হয়ে আছে। এক বছর আরও জাহাজে থাকতে হবে, সে সবাইকে গোপনে বড়-টিণ্ডালকে কেন্দ্র করে উত্তেজিত করে রাখতে পারে। আসলে কেউ সঠিক বলতে পারছে না মৈত্রদার কি হয়েছে।

এবং এ-সময়ে মনে হল, মাস্তুলের নিচে কারা দাঁড়িয়ে সংগোপনে অন্ধকারে সলাপরামর্শ করছে। ছোটবাবু বলল, বন্ধু তোকে খুঁজছি। মৈত্রদা কোথায়?

বন্ধু বলল, জানি না।

—জানি না মানে!

—আমি কি করে জানব ছোটবাবু!

—বন্ধু! এই প্রথম ছোটবাবু কেমন অহংকারী গলায় কথা বলল, আর যেন নতুন সে এক ছোটবাবু, সে আর আগের সেই ছোটবাবু নিরহঙ্কারী ছোটবাবু নয়। যেন কোনো এক জাদুবলে, ছোটবাবু, তার আত্মপ্রত্যয় খুঁজে পেয়েছে। সে বলল, ঠিক ঠিক বল, মৈত্রদা কোথায়! কোথায় ওকে শেষবারের মতো দেখেছিস! অহেতুক গুজব ছড়িয়ে সবার মাথা খারাপ করে দিস না।

বন্ধু বলল, আমি তো তোর কথা মতো ওর সঙ্গেই ছিলাম। তারপর দেখি সে ভিড়ের ভেতর নেই। আমি কি করব!

—আর খুঁজে পাস নি?

—পেয়েছিলাম। ওর বগলে তখন একটা বড় মদের বোতল। সে সামান্য দম নিয়ে বলল, তারপর যা করে। একদল ছোট ছোট ছেলেপেলে। সে তাদের নিয়ে পাতার বাঁশি বাজাচ্ছিল। ঘুরছিল ফিরছিল। আড়ালে আড়ালে ওকে লক্ষ্য রাখছিলাম।

—তখন ক’টা বাজে?

—বিকেলে হবে। এই মানে সূর্য সমুদ্রে অস্ত যাচ্ছিল।

—কোথায় তখন তোরা?

সে বলল, বিচটা দেখছিস? বেশ লম্বা বিচ। অনেক দূরে কাল সকালে দেখা যাবে, দেখবি খুব দূরে একটা পাহাড়, সাঁকোর মতো সমুদ্রে ঢুকে গেছে। অতদূর যেতে হয় না। তার একটু এদিকে, সী-বিচে যারা বেড়াতে এসেছিল তাদের সঙ্গে পাগলামি করছিল মৈত্র। ওরা বেশ মজা পেয়ে ওকে সবাই বসন্তনিবাস বলে ডাকছিল।

সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধু বার বার কতবার যে একটা কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছে। চিফ-মেট ডেকে পাঠিয়েছিল বন্ধুকে। সে তাকে বলে এসেছে। ডেক-সারেঙ তাকে চিফ-মেটের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। যতটা পেরেছে সে ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে সবটা বুঝিয়ে বলতে চেয়েছে। ডেক- সারেঙ, আর পাঁচ-নম্বর, চিফ-মেটকে মাঝে মাঝে বিশদভাবে ব্যাপারটাকে আরো ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। চিফ-মেট সব লগ-বুকে নোট করে নিয়েছে। তারপর সেখান থেকে নেমে আসতেই মেজ- মিস্ত্রি আর্চি প্রায় অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসার মতো বলেছে, একে একে তোমরা সবাই যাবে। সেই অশুভ প্রভাব আবার জাহাজে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বুড়ো হিগিনসকে আর মানতে চাইছে না। বন্ধু ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিল কথাটাতে। সে সবাইকে বলেছে, আর্চি বলেছে আমাদের কারো রক্ষা নেই। মৈত্রকে দিয়ে শুরু।

কি শুরু কোথা থেকে শুরু—কী যে সব হচ্ছে জাহাজে ছোটবাবু কিছুই বুঝতে পারছে না। সবারই চোখ প্রায় জ্বলছে। একটা আজগুবি জাহাজে ওরা উঠে এসে বিপদে পড়ে গেছে এমন ভাব যেন! এনজিন-সারেঙ ভয়ে ভয়ে আছে। সে খুব জোর গলায় এখন কথা বলতে পারছে না। যাদের সে জোর করে কলার টেনে জাহাজে তুলে এনেছিল তারা সবাই যেন ওৎ পেতে আছে। সময় এবং সুযোগ এলেই গলা টিপে ধরবে এনজিন-সারেঙের। গ্যালিতে এনজিন-সারেঙ চুপচাপ ভীতু মানুষের মতো লুকিয়েছিল। ছোটবাবু এতক্ষণে যেন আঁচ করতে পারছে সব। আর বুঝি এ-ভাবেই জাহাজে কখনও কখনও বিদ্রোহ দেখা দেয়। কোনো কিছু ভাববার তখন আর জাহাজিদের ক্ষমতা থাকে না।

ছোটবাবু প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছে সব। সে বলল, তারপর, তারপর কি?

বন্ধু বলল, আমি তো জানি আমাকে দেখলেই দৌড়ে পালাবে।

—দৌড়ে পালাবে বুঝলি কি করে?

—মৈত্রকে বললাম আমার সঙ্গে বের হতে। বললাম ছোটবাবু তোমাকে একা বের হতে বারণ করেছে। মৈত্র তেড়ে মেরে বলল, ছোটবাবু কে। ছোটবাবু বলে কাউকে তো চিনি না। কি করি বল! তুই বলে গেছিস। অনিমেষও বলল, লক্ষ্য রাখা দরকার। কিন্তু কাকে লক্ষ্য রাখব! সোজাসুজি বলে দিল, আমার সঙ্গে কাউকে যেতে হবে না। আমার কিচ্ছু হয়নি।

তারপর বন্ধু বলল, তুই ছোট জানিস, বেশি চেঁচামেচি করলে, হয়তো সারেঙ ঝামেলা করবে, একেবারেই নামতে দেবে না। আটকে রা।বে। ভাবলাম নেমে যাক, পেছনে পেছনে আমিও নেমে যাব। আর নেমে যেই না দেখল, আমি পেছনে আছি, কি খিস্তি! যা মুখে আসে। তারপর সেই শহরের একটা গোলমেলে জায়গায় এসে গেছি, দেখি মৈত্র নেই। অনেক দূরে একটা গলির ভেতর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। আমি সঙ্গে থাকি কিছুতেই সে রাজি না।

—সঙ্গে থাকলে পাগলামি করবে কি করে! তারপর কেমন চিৎকার করে ছোটবাবু বলল, কোথায় গেল তারপর?

বন্ধু বলল, সত্যি জানি না। আমার যে কি লোভ হল! ভাবলাম একটু খরমুজের রস খাই। ভাঁড়ে সামান্য খরমুজের রস, তামাটে রঙ, কি যে খেতে সুস্বাদু ছোটবাবু, আর তখন দেখি, একদল লোক চেঁচামেচি করছে, ঐ যে চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে! ফিরে দেখি অনেক দূরে একটা লোক পাহাড়ের সেই যে লম্বা সাঁকো আছে, তার নিচ দিয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটে যাচ্ছে। ছোটবাবু আমি স্পষ্ট কিছু দেখিনি।

—সমুদ্রের দিকে!

—ওদিকে মাইলের পর মাইল সমুদ্রের ভেতরে সব অদ্ভুত বালির ঢিবি আছে। গাছপালা নেই। পাথর নানা রঙের। জোয়ার এলে সব ডুবে যায়।

ছোটবাবু আবার বলল, তখন কটা বাজে?

—আমি ঘড়ি দেখিনি। সূর্য ডুবে গেছে বলে সারা সমুদ্র তখন লাল ছিল ভীষণ।

—তুই বুঝলি কি করে মৈত্রদা গেছে?

—ওরা তো সবাই বলছিল আরে লোকটার দেখছি একদম মাথা খারাপ। কোথায় যাচ্ছে! এ- সময়ে ওদিকে কেউ যায় না। ওরা সবাই হা হা করে কিছুটা ছুটে গিয়ে ফিরে এসেছে। আমিও ভালো কিছু দেখিনি খরমুজের রস খেয়ে ততক্ষণে বেশ নেশা ধরে গেছে। কেবল দেখছি ক্রমে বিন্দুর মতো কালো একটা ফড়িং অনেক দূরে সমুদ্রের ওপর নাচছে। ওটা মৈত্র, না একটা ফড়িং কি করে বুঝব! ছোটবাবু বুঝতে পারল, তারাও এমন একটা ঢিবিতে চলে গিয়েছিল। ঢিবিগুলোর একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। সে আর এক মুহূর্তে দেরি করল না। যদিও জানে জোয়ার হয়তো এসে গেছে, না এলেও আর দেরি নেই। ওরা জোয়ারের আগে ফিরে এসেছে, এবং জোয়ার এলে জাহাজে টের পাওয়া যায়। যেন জাহাজটা লাফিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যায় এমন মনে হয়। যাই হোক সে লাফিয়ে পার হয়ে গেল ফল্কা। এলি-ওয়েতে ঢুকে দরজায় নক করল, ডেবিড দরজা খোলো। বোধহয় ভেতরে ডেবিড নেই। সে ওপরে উঠে দেখল স্যালি হিগিসন সবাইকে গালাগাল করছেন। জাহাজে তিনি ছিলেন না, এতক্ষণ সবাই এভাবে চুপচাপ বসে আছে! খোঁজাখুঁজির দায়দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। যদিও এসব ঘটনায় স্থানীয় পুলিস সাহায্য করতে পারে, এবং লাইফ-সেভিং সমিতি। স্যালি হিগিনস এক এক করে সবাইকে ফোনে খবরটা দিয়েছেন—আর বড়-টিণ্ডালকে যে জাহাজে রাখা যাবে না, দেশে পাঠিয়ে দিতে হবে, দেশে পাঠিয়ে দেবার কথা মনে হলেই তাঁর মাথাটা ভীষণ গরম হয়ে যায়। এসব লোকগুলো জহাজটাকে ভালবাসে না। মিথ্যা পাগলামি করে দেশে ফিরে যেতে চায়। দেশে ফিরে যাবার একটা মোক্ষম ওষুধ। আর সঙ্গে সঙ্গে স্যালি হিগিনসের ভীষণ তিক্ত চোখ মুখ। সারেঙকে ডেকে পাঠালেন, বললেন, বড়- টিণ্ডালকে জাহাজ থেকে আর নামতে দেবে না। প্রায় লগ-বুকের ওপর একটা আদেশনামার মতো তিনি কথা বললেন।

তখন মৈত্র জ্যোৎস্না রাতে একটা ঢিবির ওপর বসেছিল। সে লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে এসেছে সব ঢিবি, বালির চরা। অনেক দূরে সেই পাহাড়ের ছাদ প্রায় সাঁকের মতো দু’হাত বাড়িয়ে যেন এগিয়ে আসছে ওকে ধরতে। কিছুতেই সে ধরা দেবে না। সে কেবল লাফ মেরে ঢিবি, বালির চরা পার হয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত। জ্যোৎস্না রাত বলে অস্পষ্ট সবকিছু চারপাশে।

ওর পায়ের কাছে সমুদ্র। আর দ্বীপে অজস্র পাথর, লাল লাল পাথর। সে একটা দু’টো করে হাতে পাথর নিচ্ছে, আর দূরে ঢিল ছুঁড়ে দিচ্ছে। একটা মাটির ভাঁড়। ভাঁড়ে সে মদ ঢালছে, খাচ্ছে। মাঝে মাঝে একাকী সে সেই খালি ভাঁড় নিয়ে পৃথিবীকে যেন বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে নাচছে। সে ক্রমে মাতাল হয়ে উঠছে। সে বসন্তনিবাস। সে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সব পাতার বাঁশি বানিয়ে দিয়েছে। সে ইচ্ছে করলে বাতাসের ওপর ভেসে যেতে পারে—এই যে সামনে সমুদ্র, অনায়াসে সমুদ্র পার হয়ে যাবে, ওর মাথায় যখন পালক গোঁজা, যখন সে বসন্তনিবাস এবং যদি হাইতিতির ঘণ্টা বাতাসে বাজতে থাকে তখন সে কিছু ভাবে না। সে সাদা জ্যোৎস্নায় এমন একটা নির্জন দ্বীপে বসে অনায়াসে সারারাত মদ খেতে পারে, নাচতে পারে, অমিয় যেসব গান গাইত মদ খেলে, তেমন একটা গান, বাবু আমার কিছু ভাল লাগে না…সে নেচে নেচে গাইছিল।

আর তার মনে হচ্ছিল সমুদ্র চারপাশে তার ঘুরে ঘুরে নাচছে। সে এখন যেদিকে তাকাচ্ছে শুধু নীল জল। কেবল ওর ঢিবিটা উঁচুমতো এবং মনে হয় নিচে অর্কেস্ট্রা বাজছে। কান পাতলে আশ্চর্য সে মিউজিক শুনতে পাচ্ছে সমুদ্রের নিচে। এবং মনে হল সে অদ্ভুত একটা দেশের বাসিন্দা হয়ে গেছে। এক্ষুনি সে বাতাসে ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাবে। আসছে আসছে। ম্যাণ্ডেলা হাইতিতি বাতাসে ভেসে আসছে। সে এবার মাটির ভাঁড় সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সে আর ভাঁড়ে মদ ঢালতে পারছে না, হাত কাঁপছে। ঢালতে গেলে পড়ে যাচ্ছে মদ। হাত তার ঠিক নেই। সে টলছে। তার চেয়ে মনে হল গলায় ঢেলে দেবে সোজা। সে হাঁ করে কিছুটা ঢেলে দিল মুখে। মুখ কুঁচকে গেল। বাঁ হাতের তালুতে মুখ মুছে শুয়ে থাকল চিৎ হয়ে। আকাশে অজস্র নক্ষত্র এবং জ্যোৎস্না সমুদ্রের জলে সাদা মসলিনের মতো ছড়িয়ে আছে। ওর আর যা মনে হচ্ছিল এক্ষনি শুনতে পারে বাতাসে ঘণ্টাধ্বনি। সে দেখতে পাবে একে একে সবাই নেমে আসছে। ম্যাণ্ডেলা, ম্যাণ্ডেলার মা, হাইতিতি, এলসা দ্য কেলি—সেই মেয়েটা যার শরীরে বিজবিজে ঘা। ওরা সবাই নেমে এলে কোথাও তার যাবার কথা

বোধহয় সেই মানুষটা জাহাজডুবির পর নির্জন দ্বীপে যে আটকা পড়েছিল—সেও আসছে। সে চিৎকার করে বলল, তুমি একা দ্বীপে কি করতে পার? সে বুঝতে পারল, মানুষটা এখন বড় বড় গাছ কেটে তার গুঁড়ি কেটে ভেলার মতো বানাচ্ছে। অতিকায় সব কচ্ছপ তুলে নিচ্ছে ভেলাতে। সুস্বাদু জল নিচ্ছে ঝরনা থেকে। পাল বানিয়েছে বড় বড় ইউকন গাছের পাতা দিয়ে। মানুষটা ফিরে আসছে। ফিরে আসছে। সমুদ্রে ঝড়ঝঞ্ঝার ভেতর দিয়ে মানুষটা সমুদ্রের ওপর পাল তুলে চলে আসছে। বড় বড় কচ্ছপের বুক কেটে সে মাংস বের করছে। আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে নিচ্ছে মাংস। সমুদ্রের জলে সামান্য চুবিয়ে খাচ্ছে। কি যে সুস্বাদু মনে হচ্ছে। শরীরে তার পাতার পোশাক। মাথায় পাতার টুপি। মুখে বড় বড় দাড়ি। চুল লম্বা। তার ভেলাটা সমুদ্রে বেশ হেলে-দুলে এগিয়ে আসছে। তারপর কেন যে তার মনে হল, লোকটা আর কেউ নয়। সে নিজে। ঝড়ের রাতে বাড়ি ফিরে দেখছে, শেফালী ঘরে নেই। শেফালী বিমলবাবুর স্ত্রী হয়ে গেছে ফের। আর মনে হল ম্যাণ্ডেলার মতো একটা ছোট মেয়ে জানালা খুলে এমন বন্য একটা মানুষকে দেখে ভয়ে চিৎকার করছে। সে কিছুতেই বলতে পারছে না, আমি বসন্তনিবাস। বিশ্বাস কর ম্যাণ্ডেলা আমি বসন্তনিবাস। তোমার মা’কে ডাকো। তার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

তখন একটা মাছি কোত্থেকে এসে মুখের ওপর বসল। সে ভাল করে হাত নাড়াতে পারছে না। সমুদ্র ফুঁসছে। পাহাড় সমান তরঙ্গমালা ক্রয়ে এগিয়ে আসছে। তীব্র শীস্ বাজছে আকাশে-বাতাসে। ব্রেকার ভেঙে যাচ্ছে, ফসফরাস পায়ের নিচে জ্বলে জ্বলে নিভে যাচ্ছে। যেন অজস্র জোনাকি পোকা ঘোরা ফেরা করছে জলে, আবার নিভে যাচ্ছে। সব প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঢেউ চলে আসছে আবার, আবার সেই জোনাকি পোকারা, পায়ের কাছে ক্ৰমে এত কাছে চলে আসছে কি করে! এবং মনে হচ্ছে ক্রমে দ্বীপটা ছোট হয়ে যাচ্ছে, ক্রমে মনে হচ্ছে, সে চারপাশে শুধু সমুদ্র দেখছে, সমুদ্রের জল গুলিয়ে উঠছে পেট গুলিয়ে ওঠার মতো। এবং আর সে উঠতে পারছে না। সে শুয়ে শুয়ে এ সব দেখছে। যেন এবার সে হাত দিলেই সমুদ্রের নাগাল পাবে। এবং ওর শেষ বিন্দু সেই মদ্যপানের অন্তিম মুহূর্তে মনে হয়, মাছিটা ভীষণ গণ্ডগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে। সে বার বার ধরতে চাইছে মাছিটাকে। সে বার বার উঠে দাঁড়াতে চাইছে মাছিটাকে ধরার জন্য। জলের কল্লোল দমকে দমকে চারপাশে এত বেড়ে যাচ্ছে যে অনেক দূরে কে তাকে ডাকছে শুনতে পাচ্ছে না। সে কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে, কে ডাকছে। মনে হচ্ছে অনেক দুরে সমুদ্রের তরঙ্গমালায় ভেসে চলে আসছে ডাকটা, মৈত্ৰ..দা তু..মি কোথায়। সে শুনতে পাচ্ছে। ভারি অস্পষ্ট। তবু মনে হচ্ছে ছোট তাকে ডাকছে। তার তখন ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। সে ফের উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। বলতে চাইল, আমি এখানে ছোটবাবু। সমুদ্র চারপাশে নেচে বেড়াচ্ছে। আমি একটা টিবির ওপর শুয়ে আছি। কিন্তু সে উঠতে পারছে না কেন! চোখে ভাল দেখতেও পাচ্ছে না। এখন যেদিকে হাত দিচ্ছে শুধু জল, জল উঠে আসছে, আবার নেমে যাচ্ছে, জল চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীরে এখন জলকণা উঠে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। ঝাপসা মনে হচ্ছে চারপাশটা। আর তখনও দূরে কেউ ডাকছে—টিণ্ডাল।

কেউ ডাকছে—মৈত্র।

কেউ ডাকছে—মৈত্রদা তুমি কোথায়!

কেউ ডাকছে—বড়-টিণ্ডাল।

কেউ ডাকছে—বসন্তনিবাস।

সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে দাঁড়াল ঢিবিটার মাথায় সে দাঁড়িয়ে গেল। সে এক হাতে বোতল বাতাসে উঁচিয়ে ধরল। কোনরকমে টলতে টলতে খালি বোতলটা বাড়িয়ে দিল আকাশের দিকে। জড়ানো গলায় বলল, মি বসন্তনিবাস। মনার্ক অফ অল আই সার্ভে। সে শেষবারের মতো জল এগিয়ে আসতে থাকলে সমুদ্রের মাথায় খালি বোতলটা ভাঙবে ভাবল। তার ভারি ইচ্ছে ছিল জীবনে, সমুদ্রের মাথায় বড় মাপের একটা বোতল ভাঙবে। কতদিন পর সে সুযোগটা পাচ্ছে ভেবে হা হা করে হেসে উঠল। দিগন্তব্যাপী কালো অন্ধকার এগিয়ে আসছে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টলছিল। তবু বাতাসে উঁচিয়ে রেখেছে বোতলটা। মারবে। কাছে এলেই মারবে। মেরে মাথা ফাটিয়ে দেবে। মাগির ছেনালীপনা বের করবে।

তখনও সেই বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের ভেতরে আর্ত ডাক, মৈত্রদা তুমি কোথায়! অস্পষ্ট সেই স্বর গুনগুনিয়ে বাজছে মৈত্রের মাথায়। সে আরও উৎফুল্ল হয়ে উঠছে। বেশ প্রতিশোধ নেওয়া যাবে, সে ছেলেমানুষের মতো আনন্দে ফের ছুটে পালাবে ভাবল। ছোটবাবু জ্যোৎস্না রাতে হয়তো তাকে দেখে ফেলেছে। পাহাড়ের ছাদ দু-হাত লম্বা করে যাকে ধরতে পারে নি, তুমি ছোটবাবু তার নাগাল পাবে! আর সেই বোতলটা তখনও ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো হাতে দুলছে। যেন সেই এবট অফ এবট ব্রথক, ঘণ্টা বাজাচ্ছে পাহাড়ের মাথায়, এদিকে না, এদিকে না। জল পায়ের পাতা ভিজিয়ে চলে গেল। এখন শুধু জল, আর জল। আর তরঙ্গমালা এবং ক্রমে সেই জলের চারপাশে শুধু ভয়াবহ ঘূর্ণি, অথবা নীল জলে, অতিকায় পাহাড়ের মতো শ্বাপদরা নিঃশ্বাস ফেলছে। এত বেশী জলকণা উড়ছে যে সে শ্বাস ফেলতে পারছে না।

তখনও দূরে, সমুদ্রের এইসব গর্জনের ভেতর একটা ক্ষীণ ডাক ভেসে আসছিল, মৈত্রদা কাল থেকে আমি তোমার সঙ্গে বের হব। তুমি কোথায়? কাল আ…মি… কোথাও যা-চ্ছি না।

শিশুর মতো সে পুলকে বলল, আমি এখানে। সে বোতলে চুমু খেতে খেতে বলল, আমি এখানে ছোটবাবু। আমি ভাল আছি।

জল আরও ওপরে উঠে আসছে। সে আর দাঁড়াতে পারছিল না। সে যে এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, আসুক এলেই মারবে, কিন্তু এখন সে হাতের বোতল ঠিকবুকের কাছে এনে টলতে টলতে বসে পড়তেই তরঙ্গমালা চলে যেতে থাকল ওপর দিয়ে। নিচে সে ভেসে ভেসে প্রায় সেই জলের ভেতর কাটা ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে হারিয়ে যাচ্ছিল। এবং শিশুর আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিল। সমুদ্রের অতলে শিশুরা কাঁদছে। সে আরও জোরে জলের নিচে বোতলটাকে একমাত্র সন্তানের আত্মরক্ষার্থে যেন চেপে ধরল। তারপর শুধু নীল জলের খেলা, অবিমিশ্র জল তার আপন প্রবাহে মত্ত। কোথাকার কে এক বসন্তনিবাস স্রোতের মুখে পড়ে কুটোগাছটির মতো ভেসে যাচ্ছে, তার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই।

পাহাড়ের উঁচু মতো জায়গায় তখন ওরা দাঁড়িয়েছিল। বিশ্বচরাচরে এ-ভাবে জ্যোৎস্না কখনও জোয়ারের জলে মিশে যায়, অথবা উঁচু সব তরঙ্গমালা ক্রমে নিস্তেজ হতে হতে শান্ত সমুদ্রের জলরাশি হয়ে যায়, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সমুদ্রের প্রবল গর্জন এ-ভাবে ক্রমে কমে আসতে থাকল। জল উঁচু হতে হতে সেই পাহাড়-ছাদের কাছাকাছি জায়গায় চলে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে পাহাড়ের ছাদে ছাদে জেটির মতো, অনেকটা সমুদ্রের ভেতরে অনায়াসে হেঁটে যাওয়া যেতে পারে। ওরা শেষ প্রান্তে এসে বুঝল, কিছু করার নেই।

পুলিস কর্তৃপক্ষ জানাল, জল নেমে না গেলে কিছু করা যাবে না।

সমুদ্রে ভেসে গেলে খোঁজাখুঁজি করে যারা, তাদের দলটা ফিরে এসেছে। তারাও একই কথা বলল।

রাত ক্রমশ বাড়ছে। প্রবল জোয়ারের মুখে জ্যোৎস্না তেমনি ছায়া ফেলে যাচ্ছে। পাহাড়ের মাথায় সব অজস্র মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। অথবা এখন এক খবর এই দ্বীপের ভেতর, একজন মানুষ সমুদ্রের ছলনায় আবার পড়ে গেছে। কোন খোঁজ-খবর নেই!

ডেক-সারেঙ এনজিন-সারেঙ সমেত প্রায় জাহাজ খালি করে সবাই চলে এসেছে! ওরা কেউ আর বিন্দুমাত্র উৎসাহ পাচ্ছে না জাহাজে ফিরে যেতে। ছোটবাবুর গলা ভেঙে গেছে ডাকতে ডাকতে। বনি ছোটবাবুকে বার বার বুঝিয়েছে—এ-ভাবে ডেকে লাভ নেই। কতদূরে কোথায় আছে বড়-টিণ্ডাল! তুমি অযথা ডাকছ।

ছোটবাবুর মন তবু মানছিল না। যেন তার বিশ্বাস তার আওয়াজ পেলেই মৈত্রদার সব অভিমান ভেঙে যাবে। আবার ফিরে আসবে।

সমুদ্র দেখে এখন মনেই হবে না, কখনও প্রবল তরঙ্গমালায় সে ক্ষেপে যায়। আশ্চর্য শান্ত হয়ে গেছে। বিকেলে যা ছিল বেড়াবার জায়গা, যেখানে মানুষেরা বসে খরমুজের রস পান করেছে এখন তা সব সমুদ্রের অতলে। সকাল হতে না হতেই আবার বালিয়াড়ি জেগে উঠবে। সামোয়ান পুরুষ- রমণীদের তখন দেখা যাবে সমুদ্রের কিনারে ঝিনুক, শঙ্খ, স্টার-ফিশ কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এবং কত রকমের সব বড় বড় ঝিনুক—ঝিনুকের ভেতর কখনও কখনও ওরা মুক্তো খুঁজে পায়। সকাল হলে আর বোঝা যারে না, সমুদ্র এখানে গতকাল মাথাসমান উঁচু জলরাশি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

স্যালি হিগিনস একটা কথা বলছেন না। সবার সামনে, একেবারে সেই ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছেন। পাথরের সাঁকো নীল জলে ভেসে আছে মাত্র। বাতাস আসছে। ওঁর চুল পোশাক সব উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। ওঁর হাতে রুপোলী স্টিক। তিনি স্টিকে ভর করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর শেষ সফরে এমন একটা দুর্ঘটনা বড়ই তাঁকে বিষণ্ণ করে দিচ্ছে। তিনি ভাবছেন, এমন তো হবার কথা না। সমুদ্রে এত দীর্ঘদিনের সফর, কখনও তিনি এমন বিচলিত বোধ করেন নি। এতো প্রায় আত্মহত্যার সামিল। তিনি কি এখন করবেন ভেবে উঠতে পারছেন না।

তবু সব স্থির সিদ্ধান্তের মতো, লাঠি উঁচিয়ে বললেন, আমাদের এখন জাহাজে ফিরতে হবে। সবাই স্যালি হিগিনস আর কি বলবেন ভেবে দাঁড়িয়ে থাকল। কেউ নড়ল না।

তিনি বললেন, বড়-টিণ্ডাল এটা ভাল কাজ করল না।

ওরা দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছে ওরা, স্যালি হিগিনস একটা কথা শেষ করছেন আর মাথা নিচু করে রাখছেন। যেন সমুদ্রের কাছে তিনি পরাজয় স্বীকার করছেন এমনভাবে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে আছেন।

তিনি ফের বললেন, ওকে পেলে আগাপাশতালা চাবকাতাম। তারপর যেমন জিভে দাঁত ঠেলে আবার ঠিক জায়গায় বসিয়ে দেন তেমনি বসিয়ে দিতে দিতে বললেন, স্কাউণ্ডেল।

তারপর তিনি আর একটা কথাও বললেন না। ঠিক লাঠি সামনে তরবারির মতো উঁচু করে হেঁটে যেতে থাকলেন। কে এল, কে এল না পেছনে ফিরে একবার দেখলেন না। সোজা সমুদ্রকে ওঁর লাঠির ঋজুতা দেখিয়ে ছাদের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে থাকলেন। জুতোয় ঠকঠক শব্দ শোনা যাচ্ছে। নীল রঙের জাহাজি পোশাক, পাতলা কদম ছাঁটের চুল এবং সাদা এক মহীয়ান যুবক এখন যেন পাহাড় বেয়ে শীর্ষে উঠে যেতে চাইছে।

প্রথম ডেবিডের হুঁশ হল। আরে চলে যাচ্ছে বুড়ো। সবাই তোমরা দাঁড়িয়ে থাকলে কেন!

সারেঙ তাঁর এনজিন-রুম কর্মীদের প্রায় চুন মুখে বলার মতো হেঁকে বললেন, ফিরে যান সবাই।

ডেক-সারেঙ তাঁর লোকদের বলল, নসিব মিঞা। পেটের দায়ে তোমরা ভাঙা জাহাজে মরতে এসেছ।

ছোটবাবু বলল, সবাই চাচা পেটের দায়ে এসেছে। এখন এ-সব বলার সময় না। প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল সে। কেউ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, টুটি ছিঁড়ে নিতে পারে এখন, বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারে নি। এবং যেন জাহাজিরা মারপিট শুরু করে দিতে পারে সহজেই সামান্য কথায় ডেক-সারেঙের অপমান হবে সে বুঝতে পারে নি। ডেক-সারেঙকে অপমান—তার লোকেরা সহ্য নাও করতে পারে। দূরে দাঁড়িয়ে তখন খাটো গলায় শিস্ দিচ্ছিল আর্চি।

এনজিন-কশপ হাত উঁচিয়ে বলল, লম্বা লম্বা বাত দেশে গিয়ে ঝাড়বে ছোটবাবু।

ছোটবাবু অবাক! সে বলল, কশপ আপনাকে কিছু বলি নি।

বনি বলল, ছোটবাবু চল।

ছোটবাবু এগিয়ে গেল। বলল, কশপ মাথা গরম করছেন কেন? এখন আমাদের মাথা গরম করার সময় না।

ডেবিড বলল, কি বলছে ছোটবাবু?

ছোটবাবু বলল, কিছু না।

এনজিন-সারেঙ বললেন, ছোট তুই ঝামেলায় থাকিস না।

—কিসের ঝামেলা চাচা!

এনজিন-কশপ তখনও বেশ সোরগোল করছে। সবাইকে তাতাচ্ছে। ছোটবাবু ডেক-সরেঙকে অসম্মান করেছে। কথাবার্তা ঠিক জানে না। বেয়াদপ। এবং কশপ যখন এ-ভাবে চিল্লাচিল্লি করছিল, তখন জ্যাক বলল, ছোটবাবু কি বলছে কশপ?

ছোটবাবু তেমনি নিস্পৃহ গলায় বলল, কিছু না।

এনজিন-সারেঙ বললেন, ছোটবাবু তুই চলে আয়। বলে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন।

—ওরা কিছু একটা করতে চাইছে, কি চাইছে আমিও ঠিক জানি না। শুধু বুঝতে পারি, ওদের মতলব ভাল না।

ছোটবাবু হাঁটতে হাঁটতে বলল, ওরা কি করতে চায়, আমি সব জানি।

সারেঙ সহসা দাঁড়িয়ে গেলেন। –কি করতে চায়?

—চায়, কিছু একটা করতে চায় চাচা। এখন তোমাকে বলা যাবে না।

—ওরা তোর কোন ক্ষতি করবে নাতো?

—তা করতে পারে। তুমি ভেব না।

এনজিন-সারেঙ আর একটা কথাও বলতে পারলেন না। আর্চি পেছনে তার দলবল নিয়ে আসছে। ছোটবাবু বুঝতে পারছে আর্চি বাজে গুজব ছড়াচ্ছে জাহাজে। সে জাহাজিদের তার পক্ষে টানছে। তারপর কি কি করতে পারে আর্চি তার সব যেন জানা। সে বলল, মৈত্রদা তুমি থাকলে কত আমার সাহস থাকতো বলতো। সে দু-হাত তুলে চিৎকার করে বলতে পারলে যেন বাঁচত, তুমি ভারী স্বার্থপর মৈত্রদা। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। ওর চোখ জলে ভার হয়ে আসছিল। অমিয় নেই, মৈত্রদা নেই। ভারী নিঃসঙ্গ, সে ভীষণ একলা। এত বড় প্রতিপক্ষের সঙ্গে কি করে যুঝবে এখন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *