1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৪

।। চার।।

সমুদ্র ক্রমে শান্ত হয়ে এল একসময়। বন্দর পেতে বেশি দেরি নেই। জাহাজিদের এ-সফরে প্রথম বন্দর। কাজেই অনেকে, সেই সকাল থেকেই কিনার দেখার চেষ্টা করছে। কিছুই তো দেখা যায় না। কেবল নীল আকাশ, নীল সমুদ্র, আর মাঝে মাঝে সমুদ্রপাখিদের ওড়াউড়ি। রাতের জ্যোৎস্নায়, নীল আকাশ, সবুজ নক্ষত্র এবং সমুদ্র থেকে ঠাণ্ডা বাতাস। একনাগাড়ে বসে থাকলে ডেকে মনে হয় কেমন এক গোলাকৃতি নীল বিরাট একটা টানেলের ভিতর দিয়ে জাহাজটা নিশিদিন ছুটে যাচ্ছে। যেন কোন অতিকায় এক স্পেস রকেট, অথবা আরও কিছু—তখন আর উঠতে ইচ্ছে হয় না। বসে থাকতে ভাল লাগে।

ছোটবাবু এখন ভালোর দিকে। বমি করতে করতে গলা চিরে যায়। এবং গলা চিরে গলগল করে রক্ত উঠে আসে। তারপর নুনজল, এবং নুনজনই জাহাজে একমাত্র ওষুধ, জাহাজে বমি করলে, খেতে না পারলে, মাথা ঘুরলে একমাত্র এই জল। সমুদ্র থেকে বালতি করে জল তুলে খেয়ে ফেলা। তারপর অভ্যাস, অভ্যাসে সব কিছু সহা হয়ে যায়, মাথাও ঘোরে না, বমিও হয় না। কেবল তখন মনে হয় এই জাহাজের পিচিং ভারি আরামের। চোখ বুজে আসে। ঘুম চলে আসে। কিনারায় বেশিদিন থাকলে অসুবিধা!

মেজ-মালোম আবার সেই ডেক-চেয়ারে বসে আছেন। চোখে বাইনোকুলার। কিনার কাছে নেই। তবু দেখার স্বভাব। জাহাজ বন্দরের কাছাকাছি এলে তিনি সময় পাবেন না। জাহাজের বাঁধাহাদা আছে। আগিলে, বড়-মালোম, পিছিলে, মেজ মালোম। দু’জন দু’দিকে! আর ডেক-জাহাজিরা আছে। ওরা হারিয়া বললে, দড়িদড়া হারিয়া করে দিচ্ছে, হাপিজ বললে, দড়ি টেনে ধরছে। ওয়ারপিন ড্রামে দড়িদড়া টানাটানি করে বাঁধাছাঁদা হয়ে গেলে ছুটি। মেজ-মালোম তখন আবার ডেক চেয়ারে বসে জুতসই বন্দরের বড় বড় গাছপালার ভেতর কিছু খুঁজে বেড়াবে। কারণ যা খবর, জাহাজ এখানে থামছে না। শুধু রসদ নেবে। রসদ নিতে কত আর সময়। সুতরাং ডেকে বসে থাকলে বাইনোকুলারটা একমাত্র তার সম্বল। জাহাজে সময় কাটানোর পক্ষে সে একটা বেশ কাজ পেয়ে যায় তখন।

তখন নিচে মৈত্র ছোটবাবুর কাছে খবর নিয়ে এল, রাতে জাহাজ বন্দর ধরছে। মৈত্রের বারোটা- চারটা ওয়াচ শেষ। রাতে ওয়াচ নেই। জাহাজ বাঁধাছাঁদা হলে একটা বয়লার শুধু চলে। জাহাজের যে সামান্য কাজ, উইন্‌চ চালানো, জেনারেটর চালানো, এ-সব কাজে একটা বয়লার চালালেই হয়ে যায়। তখন ছুটি ছুটি ভাব। বেশ একটা উত্তেজনা, মৈত্রকে দেখলেই বোঝা যায়। সে শিষ দিয়ে নামছে। অমিয় একটা গান গাইছে। ওর গলা ভাল। বেশ গায়। সে যেন কি একটা আকাশ টাকাশ নিয়ে গান গাইছে! ডেক-সারেঙ, ডেক-জাহাজিরা ছুটি পাচ্ছে না। ওদের কাজ জাহাজের বাঁদাছাঁদা না হলে শেষ হচ্ছে না। তবু জাহাজ বাঁধাছাঁদা হবে ভেবে, বন্ধু, অনিমেষ, মনু সবাই একবার করে খবর দিয়ে গেছে, সারেঙও এসেছিলেন, ছেলে, জাহাজ বন্দরে ঢুকছে। উপরে উঠে না গেলে দেখবে কি!

মৈত্র স্নান সেরে এসেছে। অমিয় লকার খুলে কি যেন খুঁজছে। বোধহয় খাম পোস্টকার্ড। কিন্তু অমিয় জানে না, দেশের খাম পোস্টকার্ডে চলবে না। মৈত্র একটা চিঠি লিখবে শেফালিকে, যা সময়, একটু সাবধানে না থাকলে চলবে না। মৈত্র বেশ আশায় আশায় আছে। সে জাহাজ বন্দরে ঢুকে গেলেই ঠিক খাম পোস্টকার্ড সংগ্রহ করে ফেলবে। এবং নানাভাবে সে ভেবে রেখেছে—শেফালির জন্য সে কি করতে পারে। বুনোসাইরিসে না যাওয়া পর্যন্ত সে কিছু করতে পারছে না। ওখানে জাহাজ বেশ কিছুদিন নোঙর ফেলে থাকবে। জাহাজ খালি হবে, জাহাজ বোঝাই হবে। বেশ কিছুদিন লেগে যাবে বোঝাই হতে। কোম্পানির ঘরে টাকা জমবে মন্দ না। সে এ বন্দর থেকে ভেবেছে কিছু কাঠের হাতি, ময়ূরের পালখ কিনে নেবে। ওগুলো বেশ দামে বিক্রি করা যাবে। এ ভাবে তার দু’পয়সা হবে। এবং এ-ভাবে সে শেফালিকে বেশ ভালো টাকা পাঠাতে পারবে।

ছোটবাবুর দিকে মৈত্র তাকিয়েছিল। কিছু ভাবছিল। শেফালির কথা। ছোটবাবু বেশ শুয়ে আছে! মুখে একটু সাদাটে ভাব। রক্তপাতে এমনটা হয়েছে। শুয়ে আছে সাদা চাদর গায়ে। সে লম্বা পাতলুন পরেছে আর ডোরাকাটা পাঞ্জাবি। ওর চুল আরও বড় হয়েছে। জাহাজে উঠলে শরীরের রঙ আরও মনোরম হয়। ছোটবাবু এমনিতেই ভীষণ সুন্দর, সুপুরুষ, তার ওপর নোনা জল লেগে এক আশ্চর্য সুষমা মুখে। খুব ভালবাসতে ইচ্ছে হয়। আদর করতে ইচ্ছে হয়। ছোটবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ ফেরানো যায় না।

মৈত্র বলল, ছোটবাবু তোমার কথা জ্যাক বলছিল।

—কি বলছিল! ছোটবাবু কোন রকমে উঠে বসার চেষ্টা করল। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

—তুমি কেমন আছ!

ছোটবাবু বলল, যাঃ।

—সত্যি! বললাম, ভালোর দিকে।

—কেন বললে না, ভালো আছি। আমি আবার দু-একদিনের ভেতর বাংকারে নেমে যেতে পারব।

–এটা তোমার ছোটবাবু বাড়াবাড়ি। তুমি পারবে না। তুমি বড্ড একগুঁয়ে।

—সবাই পারলে আমি পারব না কেন! তাছাড়া সবাই কি ভাববে!

—তুমিও পারবে। পারতে তোমার সময় লাগবে।

—এখন তো আর মাথা ঘোরে না। বেশ সয়ে গেছে সব। খুব খিদেও পায়।

—শরীর ভাল হলে পারবে। তোমাকে আমার ওয়াচে নেব ভাবছি। ফালতু থাকলে, আবার কখন কোন দরিয়ায় কিসে কে পড়বে, তখন হঠাৎ পারবে না। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে, দেখবে সব কাজই মানুষ পারে, মানুষ পারে না, পৃথিবীতে এমন কাজ নেই

ছোটবাবু কিছু বলল না। চুপ করে থাকল।

মৈত্র বলল, আচ্ছা ছোটবাবু তুমি এমন চুপচাপ থাক কেন। কথা বল না!

ছোটবাবু বাল্‌কেডে হেলান দিয়ে বসে আছে। সে মৈত্রের দিকে তাকিয়ে না হেসে পারল না। বলল—কথা বলি না কোথায়! বেশ কথা বলি।

—আচ্ছা ছোটবাবু জাহাজে তুমি এমন ভাবে থাকো কেন?

—কি ভাবে।

—এই যে মনে হয় কেউ তোমার যেন নেই।

—না না। তেমন ভাবে থাকি না তো।

—তুমি ভাল ছেলের মতো জাহাজে থাকলে ভীষণ কষ্ট পাবে।

—ভাল ছেলের মতো কোথায় থাকি!

—তুমি ছোটবাবু যাই বল খুব চাপা স্বভাবের। আমরা ফোকসালে কত কথা বলি, তুমি তো তোমার বৌদির সব খবর প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছ।

—তা বলতে পার। এত বেশি শেফালি বৌদির কথা বল, যে মনে হয়, পৃথিবীতে আর কেউ বাস করে না। একমাত্র শেফালি বৌদিই বাস করে।

—তবে! আর তুমি তোমার দেশে কে আছে, কেন এমন একটা কাজে এলে, অমিয় বলল, কলেজের পড়াশোনা পর্যন্ত তোমার আছে, জাহাজের ট্রেনিং-এ সব লুকিয়ে গেছ—এত সব কেন? কিনারায় একটা চাকরি দেখে নিতে পারলে না!

—তুমি তো জানো মৈত্রদা তোমার মতো, তোমার মতো কেন, আমাদের জাহাজে যারা আছে, একমাত্র ডেক-সারেঙ বাদে সবাই আমরা পাকিস্তানের, আমরা দেশ ছেড়ে চলে এসেছি। আমাদের তো কিছু একটা করে খেতে হবে। নাবিক বলতে আমরা জানি, সবাই সন্দীপ, নোয়াখালি, চিটাগাঙের লোক। এখন দেশ ভাগ হয়ে গেছে। ওরা কতদিন আর আমাদের জাহাজ চালাবে। আমাদের তো সমুদ্র-যাত্রায় বের হতেই হবে।

—এসব বড় বড় কথা। এ-সব কথা তোমাদের ট্রেনিং-এ শেখায়। আসলে এমন একটা অমানুষিক কাজ, একঘেয়েমির কাজ করতে কেউ সখ করে আসে না। নানা কারণে অবশ্য আসে। কিন্তু তোমার মতো মানুষ কেন আসে বুঝি না!

ছোটবাবু ফের হাসল। বলল, মৈত্রদা অভাবে সবাই আসে। আমিও এসেছি। তুমি আমার সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি না ভাবলেও চলবে।

বন্ধু এবং অনিমেষ পাশে বসেছিল। অমিয় ‘বিশুর’ ভাত ডাল সবজি গরম করে নিচ্ছে। একটু পরেই ওরা মেসরুমে খেতে বসবে। ছোটবাবু সকালে ওপরে উঠে গেছিল। মেসরুমে খেয়েছে। এখনও উঠতে চায়। নিচে বসে থাকতে ভাল লাগছে না। পোর্টহোল দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। এখন ওপরে ওঠে সমুদ্র দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। সমুদ্র ভীষণ শান্ত ঠিক শিশু সরল মানুষের মতো। লতিফ ভাল আছে। সে আবার বাংকারে নেমে যেতে পারছে। ডেকে উঠে যাবার সময় সেও একবার খবর নিয়ে গেল, কেমন আছেন ছোটবাবু।

ছোটবাবু হেসে বলল, ভাল। তুই কোথায় যাচ্ছিস!

—ওপরে। নামাজের সময় পার হইয়া যায়।

এনজিন-সারেঙ এসে বললেন, মৈত্র মশায়, ছোটবাবুকে ওপরে নিয়ে যান। কিনার দেখা যাচ্ছে।

এই কিনার দেখার ব্যাপারটা জাহাজিদের কাছে আশ্চর্য অভিজ্ঞতার মতো। যেন জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল, পৃথিবীর কোথাও ডাঙ্গা আছে ভাবাই যায় না। সমুদ্রে জাহাজ চললে, নিশিদিন জাহাজ চলতে থাকলে ভাবাই যায় না, মানুষেরা ডাঙ্গায় থাকে। কোথাও মানুষ, গাছপালা, পাখি এবং মাটি আছে বিশ্বাসই করা যায় না। কিনারার নামে নতুন ডাঙ্গা দেখার জন্য সবাই পাগলের মতো ওপরে ছুটছে। যে-যার কাজ ফেলে এখন ওপরে উঠে যাচ্ছে। কেউ ফোকসালে নেই। বুড়ো ভাণ্ডারি পর্যন্ত গ্যালিতে হাতা-খুন্তি ফেলে রেলিঙে এসে দাঁড়িয়েছে।

যারা নিচে কাজ করছিল, এনজিনরুমে, তারাও কেউ কেউ যেমন ছোট টিণ্ডাল উঠে এসেছে। কাপ্তান ব্রীজে, রেলিং-এ ভর করে দেখছেন! মেজ-মালোম ডেক-চেয়ারে বসে আছে। ওর চোখে বাইনোকুলার। জ্যাক বোট-ডেক থেকে লোয়ার-ডেকে নেমে এসেছে। জ্যাকের চলাফেরা অদ্ভুত। সে কখনও জাহাজে হাঁটে না। সে লাফিয়ে অথবা দৌড়ে দৌড়ে যায়। এক ফল্কা থেকে আর এক ফল্কায় যেতে সে নিচে নেমে ওপরে উঠে যায় না। সে লাফ মেরে ফল্কাটা ডিঙ্গিয়ে যায়। ছোটবাবু ওপরে উঠেই দেখল, জ্যাক মেজ-মালোমের পাশে বসে রয়েছে। চুপচাপ। চোখে তার বাইনোকুলার। জ্যাকের বড় চুল কেটে ফেলা হয়েছে। জ্যাককে ভীষণ নেড়া নেড়া লাগছে। এত খাটো চুলে জ্যাককে দেখতে ভালো লাগছে না।

তখন যা হয়, চারপাশে সবাই তখন ডাঙ্গা খুঁজে বেড়ায়। ওরাও খুঁজতে গিয়ে দেখল, দিগন্ত রেখায় সমুদ্রের নীল জল পার হয়ে ছায়া ছায়া ভাব, মেঘের মতো এক টুকরো জমির ছবি। কি যে আছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবু সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কেউ নিচে নেমে যাচ্ছে না। যেন দেখা, কিভাবে কাছে যাওয়া যায়। জাহাজ চালিয়ে কাছে যাওয়া যায়। প্রপেলার তেমনি জলের নিচে অন্তহীন ঘুরে চলছে, সাদা ব্লেড নীল জলে ঘুরছে, কেবল ঘুরছে, সাদা ফেনা তুলে দিচ্ছে পেছনে, আর অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে একটা সরলরেখার মতো ভাসমান তিমি মাছের ছবি, ছবিটা ক্রমে যেন জাহাজের সঙ্গে এগিয়ে আসছে, মনে হয় একটা না, অনেক কটা, সারি সারি, একটা আর একটার পেছনে, ছুটে আসছে। সমুদ্রের জল উঁচু হয়ে যাচ্ছে সরলরেখার মতো। প্রপেলার জল ভেঙে ভেঙে এমন একটা দূরের ছবি তৈরি করে রাখলে মনে হয় জাহাজটার পেছনে তিমি মাছেরা স্রোতের মতো জলের নিচে উঠে আসছে। ছোটবাবুর বেশ ভালো লাগছিল—সে যত দূরে সম্ভব চোখ মেলে দিচ্ছে।

আসলে এমন একটা সুন্দর দৃশ্য সে কবে দেখেছে জানে না। সে কেমন বিস্ময়ে নড়তে পারছে না। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সমুদ্র এখন ভীষণ লাল। আকাশ লাল হয়ে গেছে। আর সাদা জাহাজ। সাদা জাহাজটাকে সে কিছুতেই ভাবতে পারে না জাহাজ, আসলে সেই সৌরলোকের অন্তহীন যাত্রার মতো মনে হয়, যেন চারপাশে সব গ্রহ নক্ষত্র, উপগ্রহ আর এক সৌরলোক থেকে অন্য সৌরলোকে একটা যান অনবরত ছুটছে। তারা ক’জন জাহাজি তার ভেতর বসে রয়েছে। বিরাট এক স্পেসঅডিসির মতো এই যানে তাদের যাত্রা আরম্ভ হয়েছে।

জাহাজে ক্রমে আলো জ্বলে উঠল। দূরের বন্দরে আলো জ্বলছে। জ্যোৎস্না রাতে সমুদ্রে আলো জ্বললে এক আশ্চর্য মায়ার খেলা। ডেকের মাস্তুলের মাথায় আলো, ব্রীজের উইংসে আলো, কেবিনে কেবিনে আলো, সামনে পেছনে সব জায়গায় আলো। ডগ-ওয়াচে যার ‘আগিলে’ পাহারা দেবার কথা তার ছুটি, জাহাজ বন্দর ধরলে, ফরোয়ার্ড পিকে পাহারা লাগে না। তাকে কোনও দূরের জাহাজ অথবা পাহাড় দেখে তখন ঘণ্টা বাজাতে হয় না। সেও শিস দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডেকে

এভাবে জাহাজ ক্রমে বন্দরের কাছাকাছি চলে আসছে। কেউ নেমে যায়নি। সূর্যাস্তে জাহাজিরা রাতের খাবার মেসরুমে খেয়ে নেয়। সবাই ভুলে গেছে খেতে হবে। ভাণ্ডারি ভীষণ গালাগাল করছে। জাহাজিদের খাইয়ে দিতে পারলেই ছুটি। সেও তখন তার বুড়ো চোখে বন্দরে, আলো, অস্পষ্ট ছায়া অথবা দুরের কোন জাহাজে ব্যাণ্ড বাজতে থাকলে সুদূরে সেইসব বিদেশিনীদের কথা মনে করে জীবন অন্তহীন এক সৌরযানের মত—কেবল নিয়ত চলা, এমনি ভাববে। নামাজের সময় মনের ভিতরে কত কথা বুড়ো বয়সে যে উঁকি দেয়।

আসলে ছোটবাবুকে ওপরে ধরে তুলেছিল অমিয়। এখন এ-সব দেখে মনে হচ্ছে, সেও জাহাজের চারপাশে ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়াতে পারে। তার শরীর দুর্বল, সে ভাল করে এখনও খেতে পারে না, গলায় খেতে লাগে, এসব মনে থাকে না। কাপ্তানের ছেলেটা তো মেজ-মালোমের পাশে একটু বসে আবার কোথায় দু-লাফে নেমে গেল। পিছিলে সে আসে না। এখানে নিচে ফোরক্যাসেলে খালাসিরা থাকে, তার হয়তো মানা আছে এদিকটাতে আসা। তবু আজ ছোটবাবু দেখল সব বাঁধা নিষেধ ভেঙে জ্যাক ছুটে ছুটে পিছিলের যমুনাবাজু দিয়ে ঢুকে গঙ্গাবাজুতে বের হয়ে গেল। সবাই তখন তটস্থ। সারেঙ দু’হাত দিয়ে পিছিলের সব জাহাজিদের সরিয়ে দিচ্ছে। কোন কারণে যেন গায়ে না লেগে যায়।

আর ছোটবাবু তখন হাঁটছে। মৈত্র দেখছে না, ওর পাশে ছোটবাবু নেই। ছোটবাবু ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। বোট-ডেকে মেজ-মালোমের কাছে কী যে ওর আকর্ষণ। সে পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই মেজ- মালোম বলল, ও-কে?

সে বলল, ইয়েস ও-কে। তারপর সে বলল, এনি ওম্যান সেকেন্ড।

—নো।

ছোটবাবু চুপচাপ ওর চেয়ারের নিচে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। সেই প্রথম দিন থেকেই মানুষটিকে কেমন পাগলাটে পাগলাটে লাগে। থুতনিতে ওর লাল দাড়ি। সেই একমাত্র অফিসার মানুষ, ফোকসালে গিয়ে যে রোজ দেখে আসছে তাকে। কেমন আছে ছোটবাবু, এখন কি খাওয়া দরকার, সামান্য অষুধ অন্য সব আরও যা কিছু দরকার, সে দিয়ে আসছে। মানুষটিকে ছোটবাবুর ভীষণ ভালো লাগে। সে ওর সঙ্গে খুব সহজে কথা বলতে পারে। কোন সংকোচ বোধ করে না। এই যে সে বলে ফেলল, এনি ওম্যান সেকেন্ড যেন এটা না বললে আর কিছু বলার থাকে না। এখনতো জ্যোৎস্না রাত, এখনতো দূরের বন্দরে নানাবর্ণের আলো, শুধু হাজার জোনাকির মতো জ্বলছে, আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। আর জাহাজ ইতস্ততঃ চারদিকে নোঙর ফেলে আছে, অথবা বয়াতে বাঁধা। তার ভেতর দিয়ে কিছু দেখা যেতে পারে না। এমন কি বাড়ি ঘর মন্দির সব অস্পষ্ট। তার ভেতর মেয়েমানুষের ছবি দেখা স্বপ্নের মতো।

আসলে ছোটবাবুর মনে হল, মেজ-মালোম দূরবীনটা চোখে দিয়ে অন্য একটা জগতের সন্ধানে থাকে। সেখানে একটা বড় রাস্তা থাকে। দুধারে পাইনের গাছ থাকে, পাশে নীল জলের হ্রদ থাকে, সে একটা স্কুটারে বসে থাকে, পেছনে থাকে এক সুন্দরী যুবতী, যেন নিশিদিন সে স্কুটার চালাচ্ছে, আর পেছনে পিঠের কাছে যুবতী তাকে সাপ্টে বসে আছে। সে একা জাহাজে উঠে এলেও যুবতী তাকে বুঝি ছাড়ে না। তাছাড়া মানুষের কি যে আছে, কি যে আশা কুহকিনী, আশা কুহকিনী না হলে এমন ভাবে সমুদ্রের ভেতর একটি মানুষ দূরবীন চোখে বসে থাকতে পারে না।

মেজ–মালোম বলল, তুমি ছোটবাবু এটা ধর।

—আপনি স্যার!

—আমার এখন জাহাজ বাঁধাছাঁদা আছে।

—কিন্তু স্যার।

—কিন্তু কি আবার!

—এখানে একা বসে থাকব…

মেজ-মালোম জানে ছোটবাবু জ্যাককে ভীষণ ভয় পায়। জ্যাক সম্পর্কে একটা কৃত্রিম ভয় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জাহাজে। সবাই জ্যাককে ভীষণভাবে এজন্য এড়িয়ে চলে। কিন্তু মেজ-মালোম জানে জ্যাক, শান্ত, নিরীহ, সেও প্রথম প্রথম তার সম্পর্কে ভীষণ গুজব শুনেছে, এখন দেখছে উল্টো। জ্যাক আপন মনে থাকে, সে নিজের খুশিমতো কাজ করে। তার যেখানে খুশি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সে কাউকে বিরক্ত করে না। অথচ চিফ-অফিসার কেন যে সবাইকে জ্যাক সম্পর্কে ভীষণ সাবধান করে দিয়েছে।

মেজ-মালোম বলল, চলো তবে পিছিলে। আমার তো সেখানেই কাজ। তুমি দেখতে টেখতে পেলে সহজেই ডাকতে পারবে।

ছোটবাবু বলল, সেই ভাল স্যার। এবং এ-ভাবে সে মেজ-মালোমের পেছনে হেঁটে গেল। খুব ধীরে ধীরে সিঁড়ি ধরে লোয়ার ডেকে নেমে গেল। নামার সময় মেজ-মালোম বলল, কি ধরতে হবে?

ছোটবাবু বলল, না। আপনি এগোন আমি আস্তে আস্তে হাঁটছি। ছোটবাবু ডেকের ওপর ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। মাথার ওপর মাস্তুলের লাল আলো দুলছে। ছোটবাবুর ছায়াটা আলোর জন্য একবার বড় হচ্ছে আবার ছোট হচ্ছে।

আর কি যে জাহাজটা নিরিবিলি মনে হয় এখন! জাহাজ থেমে আছে। খুব কাছেই বন্দর। তবু সে বুঝল, প্রায় মাইলের ওপর হবে। সমুদ্রের ভেতরে জাহাজ বয়াতে বাঁধাছাদা হচ্ছে। দূরবীন চোখে লাগিয়ে সে বসে রয়েছে। দূরবীন চোখে লাগালেই ডাঙ্গার সব ফাঁকফোকরগুলো কেমন চোখের ওপর ভীষণভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে বসে বসে চারপাশে খুঁজতে থাকল। সে কি খুঁজছে! তার তো এভাবে খোঁজার কথা নয়। সে তো এমনভাবে জাহাজে বাঁচবে বলে আসেনি। এভাবে সে খোঁজাকে কেমন অসভ্যতা মনে করে থাকে, তবু বুঝি জাহাজের আছে এক অতীব কঠিন অসুখ, ছোটবাবু জানে না, এই ন-দশদিনেই তার ভেতরে ভেতরে একটা অসুখের জন্ম হয়েছে। তারও লুকিয়ে ডাঙ্গায় মেয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়।

মাঝে মাঝে হাঁক আসছে, হ্যালো ছোট, এনি ওম্যান।

—নো স্যার।

—একা দেখে ফেলবে না। ডাকবে।

—ইয়েস স্যার, ডাকব।

—এ ব্যাপারে মানুষেরা ভীষণ স্বার্থপর

—ছোটবাবু বলল, একটা স্যার কুকুর! —কুকুর!

—হ্যাঁ স্যার, কুকুরটা রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে।

মেজ-মালোম বলল, অস্পষ্ট আলোতে কুকুর, মানুষ, মেয়ে দূরবীনে একরকমের দেখায়। ভালো করে দ্যাখো।

—ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার।

মেজ-মালোম হাসিল ফেলে চলেও আসতে পারছে না। ডেক-জাহাজিরা এখন দড়িদড়া ঢিলা দিচ্ছে। উইন্‌চ চালাচ্ছে বংকু। ডেক-টিন্ডাল হাসান কেবল হারিয়া হারিয়া করছে। হাসিল ক্রমে নেমে যাচ্ছে জলে। দুটো ছোট নৌকা জাহাজের আগে এবং পিছনে। ওরা হাতের ইসারায় ঠিক বয়াতে হাসিল বেঁধে ফেলছে। অথচ মেজ-মালোম কি যে করে! সে আবার হাই করে ডাকল।

—আছে এখনও?

—আছে।

—আর একটু। এই হয়ে গেল। এই বাস্টার্ড টিন্ডাল—শালা লোগ, জাহাজ জখম করে দেবে। তারপরই যেন ক্রিশ্চিয়ানিটির সারমর্ম বুঝে ফেলার মতো দু’হাত ওপরে তুলে ফাদারের কায়দায় বলে যাওয়া—আ…স… তে আ…স..তে। তারপরই ছুটে ছোটবাবুর কাছে ফল্কার ওপরে চলে এলে শুনল, স্যার রাস্তা পার হয়ে চলে গেল। আর দেখা যাচ্ছে না।

মেজ-মালোম ছোটকে কিছুতেই বিশ্বাস করল না। সে প্রায় যেন জোরজার করে কেড়ে দূরবীনটা যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি চোখের ওপর রাখলে দেখল, শুধু অস্পষ্ট ঘর-বাড়ি, এলেবেলে রাস্তা। রাস্তা, সমুদ্রের বালিয়াড়ি, না জাহাজ, না কোন ব্রীজ-টিজ হবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আসলে এতদূর থেকে রাতে কিছু দেখা সম্ভব না। তবু নিরিবিলি দেখলে কখনও কখনও মনে হয় একটা বড় রাস্তা অনেক দূর, এই মিচিগান টান হবে তার দিকে চলে গেছে, সে একটা মোটর সাইকেলে বসে রয়েছে, তার শরীরে শীতের পোশাক পিছনে কেউ যেন সাপটে ধরে আছে। চুলের মেয়েলি গন্ধ নাকে লাগছে।

এ-ভাবে সে যখনই দূরবীনে চোখ রাখে, এমন একটা গন্ধ পায়। এখন জাহাজে তার, সারা অবসর সময়ে এই একটা আশ্চর্য আলাদিনের আকাঙ্ক্ষা হাতে। এটা নিয়েই সে আছে, সে এখন এই ফল্কাতেই বসে থাকবে, কতক্ষণ বসে থাকবে সে নিজেও জানে না। তার আকাঙ্ক্ষা, কারণ কিছুদিন সমুদ্রে থাকলেই বুঝি তার মনে হয় ডাঙা কবে সে ফেলে এসেছে। বন্দরে নেমে যেতে না পারলে ফুল, ফল, পাখী, মেয়েদের হেঁটে যাওয়া সব অর্থহীন।

ফল্কাতেই মেসরুম বয় এসে খবর দিয়ে গেল, রাতের খাবার দেওয়া হয়েছে। ডাইনিঙ হলে, কাপ্তান বসে রয়েছে। রাতের খাবারটা সবাই একসঙ্গে বসে খায়। ডাইনিঙ হলের লম্বা টেবিলের মাঝখানে কাপ্তান, পাশে জ্যাক, এ-পাশে চিফ-অফিসার, জ্যাকের পাশে সেকেন্ড। এভাবে থার্ড, মার্কনি সাব, ওপাশে চিফ এনজিনিয়ার, দু’পাশে সেকেন্ড থার্ড এবং এভাবে ফোর্থ ফিফথ্। স্টুয়ার্ড মেনু রেখে যায় প্রত্যেকের সমানে। টাইপ করা মেনুর কাগজটা হলদে রঙের থাকে। এবং ওপরে নানাবর্ণের আলো। ব্যান্ড বেজে উঠলেই কোন বড় হোটেলের একটা নাচের ঘর হয়ে যেতে পারে। জ্যাককে দেখা যায় তখন চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে।

আর এটা কেন যে হয়, জ্যাক ভারি সুন্দর; ‘মেজ-মালোম এ জাহাজে উঠেই কেমন সেই মেয়েলি চুলের গন্ধটা জ্যাকের কাছে গেলে তখন পায়। তার তো সাহস হয় না,সে বলতে পারে না, জ্যাক তুমি কি কেবিনে কোন মেয়ে নিয়ে রাত্রিবাস কর। তোমার শরীরে এমন গন্ধ কেন। তুমি তো বালক, সাবালকের কোন চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। বরং তোমার কোমর ভীষণ সরু, তুমি বেশ মেয়েদের মতো মাঝে মাঝে হেঁটে যাও। এটা কি তোমার এ জাহাজে একটা ভীষণ নেশা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য করা। তোমার এটাকে কি বলব, এই পেছন টেছন বলতে পারি, বেশ ভারি হয়ে উঠছে। জাহাজিরা যে কি এখন করে! আসলে সেও জ্যাককে ভয় পায়। ভীষণ আদুরে ছেলে। কাপ্তান তো সেদিন দেখেও কিছু বলল না, মেজ-মিস্ত্রি আর্চি বলেছে ইচ্ছা করে জ্যাক পা তার মাড়িয়ে দিয়েছে। এখন মেজ-মিস্ত্রি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। একেবারে থেতলে দিয়েছে নখটা।

ওর উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিল না, সে তবু উঠে পড়ল। পাশে তার কেউ নেই। ছোটকে, এনজিন- বড়-টিন্ডাল ধরে ধরে নিয়ে গেছে। ছোট বেশ ছেলে। ভীষণ লম্বা। একটু রোগা মতো। চোখ ভারি, নাক উঁচু, কপাল বেশ বড়। চিবুক বেশ ডিমের মতো। এবং মুখে সব সময় এক আশ্চর্য সুষমা বয়ে বেড়ায়। মানুষের মুখে, বিশেষ করে ওর মুখে নরম নীল রঙের গোঁফ দাড়ি মিলে সে যেন সুদূর এক পর্বতের গুহাবাসী মানুষের মতো জীবের কেবল মঙ্গল কামনা করছে। আগে মেজ ভাল করে দেখেনি, বাংকারে পড়ে গেলেই তার কিছু কাজ পড়ে যায়। ওদের ওষুধপত্র দেওয়ার একটা কাজ তাকে করতে হয়। ওতেই আসা যাওয়া। ছোটর চোখ দুটো ফোর-ক্যাসেলে গেলেই কেমন ব্যাকুলভাবে তাকাতো। সে যেতে যেতে ভাবল, সুন্দর মুখে ছোটবাবু এ-জাহাজে ক্রমে সবার প্রিয় পাত্র হয়ে উঠছে। কেবল একটা রাগ, মেজ-মিস্ত্রি পুষে রেখেছে। সে যখন ডেকের ওপর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে তখন এটা বোঝা যায়।

তবু সে নানাভাবে ভাবতে ভাবতে এলি-ওয়েতে ঢুকে গেল। এনজিনে কোন শব্দ নেই। সে যে হেঁটে যাচ্ছে, সে নিজের জুতোর শব্দ পাচ্ছে। কেবিনের ভেতর কেউ এখনও আছে। তার চলাফেরার শব্দ সে যেতে যেতে পাচ্ছে। ঠিকঠাক পোশাক না পরে গেলে, কাপ্তান ভীষণ ক্ষেপে যায়। এখন ওকে কেবিনে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে রাতের পোশাক পরে নিতে হবে। এবং সে যখন টিপটপ হয়ে বের হয়ে এল, বয় বাবুর্চিদের খুব দৌড়াদৌড়ি। আসলে কাপ্তান এসে অনেক আগেই বসে থাকেন। একটু গল্পগুজব করা, এই যে পৃথিবীর চারপাশটা সারাজীবন ধরে দেখে ফেলার পর নানারকমের গল্প মাথায় গিজ গিজ করছে, এ সব ঠিক বলতে না পারলে জাহাজি জীবনে মজা পাওয়া যায় না। জ্যাক কাছে থাকলে একরকমের গল্প, এই মাছ টাছের গল্প, তিমি মাছ, শুষোক মাছ, অথবা সিল মাছের গল্প, অথবা নানাবর্ণের সব যে দ্বীপ, তার গাছপালা পাখি এবং যেতে যেতে যে মনে হয় অনেক দ্বীপে একটা কাক পর্যন্ত নেই, কেবল, নিশিদিন সমুদ্রে একা থেকে থেকে কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে, এবং সেখানে যদি কেউ ভেড়ার পাল নিয়ে যায়, আর হাতে সুবর্ণ লাঠি থাকে, তবে কোন বাইবেলে বর্ণিত মেষপালকের মতো দেখাবে। আর জ্যাক না থাকলে অন্য রকমের গল্প। জ্যাক অনেক সময় তাড়াতাড়ি নিজের কেবিনেই খেয়ে নেয়। এতে কাপ্তান অমত করেন না। কেউ কিছু বললে, বলেন, ছেলেমানুষ সন্ধ্যা হলেই ঘুম পায়।

অথচ মেজ-মালোম দেখেছে, জ্যাক বেশ রাত করে ঘুমোয়। ওর পাশের কেবিনে বড় বড় সব লকার। বিচিত্র সব বই। সে বই পড়তে ভালোবাসে। আর বিস্ময়ের ব্যাপার জ্যাক এমন সব বই পড়ে যাতে শুধু সমুদ্রের কথাই আছে। সে কিনারার কথা জানতে চায় না। তার মনে হয় না, বড় একঘেয়েমি এ ভাবে চলা। গত সফরের আগের সফরে সে জ্যাকের সঙ্গে এই জাহাজেই ছিল। সে দু-সফর দিয়েছে এই জাহাজে। জ্যাককে সে দুবার দেখেছে। এবার জ্যাকের শরীরে আরও বেশি ভালবাসার কথা লেখা আছে যেন। সে জ্যাক কাছে এলেই কেমন টের পায় মানুষেরা পৃথিবীর চারপাশে, বনে জঙ্গলে, কোন দ্বীপে, কোন নির্জন পরিত্যক্ত জাহাজে শুধু মেয়েদের কথাই কেবল ভাবে। জ্যাককে দেখতে বেশ মেয়েলি মেয়েলি। কিন্তু জ্যাকের কথাবর্তা পুরুষের চেয়েও কঠিন। জ্যাক খুব আস্তে আস্তে কথা বলে। খুব ওজন রেখে কথা বলে। সে বোঝে, সে জাহাজের সর্বময় কর্তার ছেলে। সে খুব একা একা থাকতে ভালোবাসে। বোধহয় জ্যাকের ভীষণ অহঙ্কার—সে, অহঙ্কারে ডেকের ওপর পা না ফেলে লাফিয়ে লাফিয়ে যায়। মনে হয় না, জ্যাকের ভিতর এই একাকীত্বের কোন দুঃখ আছে। তখন জ্যাক শান্ত, গম্ভীর, নিরীহ আবার চঞ্চল কখনও। জ্যাককে বোঝা মুস্কিল।

মেজ-মালোম তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। সে তার ড্রিংকস বোট-ডেকে পাঠিয়ে দিতে বলল। মেসরুম- বয়, একটা ইজিচেয়ার, একটা টিপয়, একটা গ্লাস, আর রেশনের মদ রেখে এলে বেশ যেমন একজন মানুষ, চার ফেলে বড়শিতে মাছ ধরার জন্য একটা সিগারেট খেতে খেতে বের হয়ে যায়, তেমনি মেজ-মালোম দূরবীন হাতে ওপরে উঠে গেল। কিন্তু কিছু দেখতে পেল না।

তখন কেউ যেন বলে, এনি ওম্যান সেকেন্ড।

—নো।

—ইফ এনি ওম্যান?

—ডাকব। তাবৎ মনুষ্যকুলকে ডেকে বলব, এস, দ্যাখো।

জ্যাকও একবার বলে গেছে। এনি ওম্যান।

—নো।

—এনি ম্যান।

—ম্যান।

—ইয়েস ম্যান।

মেজ-মালোম বলল, ম্যান দিয়ে কি হয়।

জ্যাক বলল, ছোটকে কেমন দেখলে?

—ভাল।

মেজ-মালোম বুঝল এখানেই জ্যাকের অহঙ্কার। কোন প্রশ্ন শুনতে সে চায় না। কাপ্তানের সে ছেলে, এটা মনে হতেই সে বুঝিয়ে দিয়েছে, সব প্রশ্নের জবাব তাকে দিতে হবে এমন কথা নেই।

—ছোট কি দেখছিল দূরবীনে?

—ওকে পাহারায় রেখেছিলাম। যদি মেয়েটেয়ে চোখে পড়ে।

—ন্যাস্টি।

মেজ-মালোম বলল, ভীষণ ভালো, ভীষণ ভালো। বলে জিভে মেজ চুক চুক করতে থাকল। সে ড্রিংক করছে, চোখ বুজে ড্রিংক করছে। তার এখন দূরবীনে চোখ রাখতে ভাল লাগছে না।

জ্যাক প্রায় দৌড়ে তার কেবিনে ঢুকে গেল। সে দরজা বন্ধ করে দিল। পোর্টহোল খোলা। ভীষণ গরম বলে পোর্টহোল খোলা রাখতে হয়। পাখা ঘর ঠান্ডা রাখতে পারে না। তবু জ্যাক পোর্টহোল বন্ধ করে দিল। কাচের ওপর পর্দা টেনে দিল। বড় আয়না সামনে। সঙ্গে এটাচড বাথরুম। সে এখন ভাবল ঠান্ডা জ্বলে ভাল করে হাত মুখ ধোবে। এইসব ইন্ডিয়ান নেটিভদের সেকেন্ড বাজে সব ব্যপার শেখাচ্ছে। সেকেন্ড অফিসারের দুরবীনে মেয়েমানুষ খোঁজা কেমন তার অহঙ্কারে লাগে।

সে রাগেই হোক, দুঃখে হোক শরীর থেকে সার্ট খুলে ফেলল। একেবারে খালি গা। এও হতে পারে ভীষণ গরম বলে গায়ে জামা রাখা যাচ্ছে না। সারাদিন ডেকে পুরুষ সেজে থাকতে তার খারাপ লাগছে না। ডেকে যখন জাহাজিরা দুলে দুলে মাস্তুলে অথবা ফানেলে রঙ লাগায়, তখন তার মনে হয় সেও উঠে যাবে। কখনও কখনও উঠে যায়। নিচে তখন ডেক-সারেঙ ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। সে ভ্রূক্ষেপ করে না। তার ভাল লাগে এ-ভাবে দড়িদড়ায় লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে। কিন্তু আজ এসেই কেন জানি ইচ্ছা হচ্ছে শরীরের যেখানে যে-ভাবে ভালবাসার আধারগুলো ক্রমে পুষ্ট হচ্ছে, সেগুলো দাঁড়িয়ে একটু দেখবে।

সে আয়নায় দাঁড়ালে বুঝতে পারে বয়স অনুপাতে সে ভীষণ লম্বা। শরীর তার হালকা। খুব পরিমিত শরীর। মোটাও নয়, খুব রোগাও নয়। সে হাত লম্বা করে দিলে তাকে ব্যালাড সিংগারের মতো দেখায়। আশ্চর্যভাবে সে দাঁড়ালে দেখতে পায় আয়নায়, কি সুন্দর মসৃণ বুকের ভিতর ভালবাসার আধার সামান্য উঁচু হয়ে উঠছে, সে তখন হাত রাখে। এ-ভাবে হাত রাখলে ভাল লাগে সে যেন জানত না। আজ প্রথম তার এ-সব ভারি ভাল লাগছে।

জ্যাক অন্যদিন পুরুষের মতো রাত্রির পোশাক পরে শুয়ে পরে। কিন্তু আজ সে তার নাইটি বের করে নিল। সিল্কের নাইটির রঙ একেবারে শরীরের রংয়ের সঙ্গে মিলে গেছে। সে যখন নাইটি পরে হেঁটে যায় তখন তার ইচ্ছা করে আলোগুলো কেবিনের জ্বালা থাক। সে যেদিকে তখন ঘুরছে তার চারপাশে একটা ছায়া ঘুরছে। মোমের পুতুলের মতো ছায়াটা চারপাশে ঘুরছে। এবং সে দেখতে পেল, তার পাতলা সিল্কের ভিতর দিয়ে আজানু স্ত্রীজাতির অহঙ্কার শরীরে ক্রমে দেখা দিচ্ছে। এখন যদিও অস্পষ্ট, এবং মাসকাল পার হলে সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। সে এখনও ঢোলা জামাপ্যান্ট পরে না। এখনও তার তেমন সব পুষ্ট নয় বলে, প্রায় অঙ্কুরোদগমের মতো সারা শরীরে ব্যাপারটা নিয়ত ঘটছে বলে, সে বেশ হাল্কাভাবে চলাফেরা করতে পারে। তার কোন অসুবিধা হয় না।

কিন্তু সে এভাবে কতক্ষণ যে বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবা যত দিন যাবে তত ক্রমে চুল খাটো করে কেটে দেবে। চুল কাটবার সময় বাবার সঙ্গে ভীষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি করেছে। কিন্তু সে যাই করে, কেউ কাছে না থাকলে করে। বাবার অপমান হোক সে সেটা চায় না।

তবু কাপ্তান বলেছিল, বনি, চুল খাটো না করে দিলে তোমাকে ঠিক কেমন যেন দেখায়।

—ভাল দেখায় না বাবা!

—না।

—ভাল না দেখাক, তুমি আমার চুল বেশি ছেঁটে দেবে না।

—না বেশি ছাঁটছি না। দ্যাখ। বলে তিনি বনির চুল নেড়া করে দিতে দিতে বলতেন, আমি তখন জাহাজে তোর ডেক-এপ্রেন্টিস আছি! তখন ভাল চুল ছাঁটতে জানতাম না। ব্যাঙ্ক লাইনের লম্বা সফর। পোর্টে নেমে চুল কাটার সময় থাকে না। আমাদের চিফ-অফিসার বুঝলি, একটা ঘুঘু ছিল। সে আমাকে বলল, ওহে ছোকরা, জাহাজে উঠেছ, এ্যাপ্রেন্টিসগিরি করছ, চুল টুল কাটতে শিখেছ তো!

—ওঃ ঘাড় ধরে গেছে!

—এই হয়ে গেল, বলেই কাঁচি কচকচ করে চালাতে থাকলেন। —তারপর বুঝলি বনি, একখানা যা চুল ছেঁটে দিলাম না।

—মানে!

—মানে কাগে চুল ঠুকরে নিলে কেমন হয়। বড়র ঘাড় হেঁটে আমি প্রথম চুল কাটা শিখি। এখন তো সবারই ইচ্ছে চুল ছেঁটে দিই। আমার মতো জাহাজে কে এত ভাল চুল কাটে।

এবং বন্দরে নেমে চুল ছাঁটা দায়। কারণ বেশ লম্বা পাড়ি। বুয়েনস-এয়ার্স না যাওয়া পর্যন্ত চুল ছাঁটার কথা ওঠে না। মাঝে যা সব বন্দর পাওয়া যাবে, সেখানে একদিন কি দুদিন হল্ট, কাপ্তান পর্যন্ত জানে না। এজেণ্ট অফিস বলতে পারবে ব্যাপারটা। এবং বেশ যখন চুল ছেঁটে কাপ্তান আয়নার কাছে গিয়ে বললেন, দ্যাখ কেমন সুন্দর চুল ছেঁটেছি, তখন বনির দু-পা ছড়িয়ে চিৎকার, চেঁচামেচি। সবাই ছুটেএসেছিল। পাশাপাশি যারা থাকে সবাই। স্টুয়ার্ড পর্যন্ত। কাপ্তান কেবল সবার সমর্থন চাইছেন, কি স্টুয়ার্ড, চুলটা সুন্দর দেখাচ্ছে না? এদিক থেকে দ্যাখো, হ্যাঁ ঠিক হেঁটেছি না? এই যে মেজ এসে গেছ, তুমি বল তো কেমন হয়েছে?

—বা বেশ! সুন্দর! একেবারে বাটি ছাঁট।

—বাটি ছাঁট মানে? কাপ্তান প্রশ্ন করলেন।

—ইন্ডিয়ার রাজা মহারাজারা যেসব ছাঁট ফাটে চুল কাটে।

—তবে! তুমি জ্যাক কেবল লাফাচ্ছ।

অগত্যা জ্যাক কি করবে। সে সবার সামনে কাঁদতে পারে না। অহঙ্কারে লাগে। সে চুপচাপ উঠে যায়। এবং পরে ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালে তার হু-হু করে গলা বেয়ে কান্না উঠে আসে। তার এমন সুন্দর চুল বাবা জাহাজে উঠেই ক্যাচ ক্যাচ করে ছেঁটে দিয়েছে। বাবার একবার হাত পর্যন্ত কাঁপল না।

বনি এখন নিজের কেবিনে এ সব নিয়ে ভাবে না। বোধহয় বাবা খেয়ে-দেয়ে কেবিনে যাচ্ছেন। পাশের ল্যাডার দিয়ে ব্রীজে উঠে যাবার পথ। বোধহয় কোন কাজে কোয়ার্টার মাস্টার সিঁড়ি ধরে উঠছে। কেবিনে বসে সে সব টের পায়। জুতোর শব্দ প্রায় তার সব মুখস্থ, বাবা না সেকেন্ড অফিসার, না চিফ, না থার্ড অফিসার অথবা যদি কোয়ার্টার মাস্টার হয় তবু সে টের পায়। দরজা না খুলেও টের পায় কে যাচ্ছে। তার দরজা বন্ধ। দরজার সামনে দাঁড়াবার সাহস কারো নেই। সে এখন এ- কেবিনে সোজা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়বে। তার টিপয়ে জল। সে শুলে পায়ের কাছে বড় আয়না, বেশ পালিশ করা দামী মেহগিনি কাঠের বাঙ্ক। একেবারে সাদা বিছানা। প্রতিদিন সকালে চাদর, বালিশের ওয়ার পাল্টে দিয়ে যায় কাপ্তানবয়। সে অন্যদিন আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু আজ তার কেন জানি ঘুমোতে ইচ্ছা করছে না।

সে কেবিনের সবকটা আলো জ্বেলে দিল। দুটো আলো পাশাপাশি লাল নীল রঙের। একটা সাদা ডুম, কারুকার্য করা কাচের ঝালরে ঢাকা। আর ঠিক আয়নার সামনে কালো রঙের বাতিদানের ওপর হলুদ রঙের ডুম। ফুল স্পিডে সে পাখা ছেড়ে দিল। হাওয়া পাইপের মুখ ভাল করে ঘুরিয়ে দিল। তারপর সুন্দর প্রসাধন করে সে এসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।

তার শরীরে সোনালি গাউন। সিল্কের পাতলা গাউনের ভেতর ওর আশ্চর্য শরীর দেখা যাচ্ছে। খুব হাওয়া, প্রায় ঝড়ের মতো হাওয়ায় চুল, চাদর, পাতলা গাউন সব উড়ছে। সে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়নায় তার প্রতিবিম্ব ভাসছে। আয়নায় সে নিজেকে এমনভাবে দেখে কেমন মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। যদিও সুন্দর চুলের জন্য ওর ভারি মায়া হচ্ছিল, তবু এমন একটা পোশাকে সে ভীষণ বিহ্বল হয়ে গেছে। ওর মনে হচ্ছিল, হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে। অথবা গভীর সমুদ্রে সে ডুবে যাচ্ছে। চারপাশে নীল জল, কারণ ঘরের আলোটা এক নীল জলের আভার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে কেবিনে, সে তার ভিতর শুয়ে আছে, চারপাশে এখন সমুদ্রের মাছেরা ঘোরাফেরা করছে যেন। কোনও মাছ ওর খুব কাছে। তেমন সুন্দর মনে হচ্ছে না। কেবল একটা রুপোলি মাছ অনেক দূরে। ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না।

সহসা বনির মনে হল, সে এলিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড হয়ে গেছে। আবার সে যেন দেখতে পাচ্ছে আয়নায়, সেই ছোট্ট রাজকুমার যার একটা ছোট্ট গ্রহে বাস, যে সহসা পৃথিবীতে এসে আটকে পড়েছিল—যেতে পারছিল না, আর নানাভাবে প্রশ্ন পৃথিবীর সেই বিমানচালককে, অর্থাৎ বাওয়াব গাছের আগাছা ভীষণভাবে অনিষ্ট করে যাচ্ছে তার গ্রহে। একটাই গাছ সারা গ্রহে, এত ছোট্ট গ্রহ যে সেখানে এত বড় গাছ থাকা ঠিক না, ওর আগ্নেয়গিরি আছে একটা, যা অনায়াসে বাওয়াবের পাতায় ঢেকে রাখা যায়,

নদী আছে, যা সে ইচ্ছা করলেই ইউকনের পাতায় ঢেকে দিতে পারে—এমন একজন ছোট্ট রাজপুত্র তার পায়ের কাছে কেন যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সে ভেবে পায় না, চোখে তার এমন সব স্বপ্ন জড়িয়ে আসছে কেন! কেমন তার ভিতরটা ভীষণ আবেগে কাঁপছে। সে বুঝতে পারছে শরীরে এক অতীব উত্তেজনা। সে পৃথিবীতে এমন একটা সুন্দর মানুষ আছে জানত না। ভারি আরামে তার ঘুম আসছে। ছোট্ট রাজপুত্র, তার পৃথিবীতে এসে আটকে গেছে। তার নিজের গ্রহে আর ফিরে যেতে পারছে না। বনি স্বপ্নের ভেতর কেবল হাসছে, হেসে চলেছে। সে আলোর ভেতর দু’হাত বুকের ওপর রেখে কেবল এক অসমতল অমসৃণ পাহাড়ের চারপাশে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর তার কি যে মনে হচ্ছিল না! ছোট্ট রাজপুত্রের জন্য ভেতরে ভেতরে একটা মায়া গড়ে উঠছে। সে নিজেও সেটা কিভাবে কখন হয়েছে জানে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *