1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৩২

।। বত্ৰিশ।।

সকাল থেকে ভীষণ কুয়াশা। চারপাশের কিছু দেখা যাচ্ছে না। আবার ঠাণ্ডা জোর পড়েছে। রবিবার বলে জাহাজিদের ছুটি। কুয়াশার আবছা অন্ধকারে গোটা বন্দর এলাকা একেবারে ডুবে আছে। পাশের মানুষটিকে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না, কেবল জাহাজের ভোঁ ভোঁ শব্দ। মোটর-বোটগুলো ভীষণ হাঁকছে। আবছা অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছে না বলে কেবল ভোঁ ভোঁ করছে। আর্চি জাহাজেই আছে। বের হচ্ছে না। গতকাল বিকেলে বের হয়ে সে ভীষণ ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল। এমন হবে যদি জানত, তবে বের হত না।

বন্দর এলাকাতে সে টের পায় নি, সবাই ওকে দেখছে। সবারই চোখ ট্যারা কারণ মানুষের মুখ বাঘের মতো হয়ে যায় দেখতে, আর্চিকে দেখার আগে তারা তা জানত না। শহরে সে গিয়েছিল কিছু কেনা-কাটা করবে বলে। পিকাকোরা পার্কে ঘুরে বেড়াবে ভেবেছিল। যদি কোনও মাউরি মেয়ের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যায়। শুঁড়িখানায় ঢুকে মেয়েদের খোঁজ খবর নিয়েছিল, এমনকি বন্দর থেকে বের হবার মুখে দু-এক জায়গায় খোঁজ করতে গিয়ে দেখেছে বৃথা। খোঁজ খবর সে পায় নি, এবং দেখাসাক্ষাৎ হয় নি তা ঠিক না। ওকে দেখলেই—সবাই এত বেশি হাসাহাসি করেছে অথবা দরদামে এমন একটা ভাব দেখিয়েছে আর্চির পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছে। যত পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে তত ক্ষেপে যাচ্ছিল। জাহাজে বালিকা যুবতী হচ্ছে, আর বালিকা যে তার হাত কামড়ে দিয়েছিল প্রায়, ছেড়ে না দিলে ঠিক কামড়ে দিত, এ-সব ভেবে সে আজ সকাল থেকেই মদ খাচ্ছে।

আর্চি দরজা বন্ধ করে বসে রয়েছে। মেস-রুম-বয় মাঝে মাঝে ডাকলে হাজিরা দিচ্ছে। আর কিছু না। জাহাজের কাজকাম শেষ হয় না। সবাইকে কাজ ভাগ করে দিয়েছে। ছোটবাবুকে বিল্‌জে পাঠাতে পারলে সে যেন প্রতিশোধ নিতে পারত। কিন্তু সে আর পাঠাতে পারছে না। সবাইকে নামতে হবে, একদিন ছ’নম্বর নামলে দ্বিতীয় দিন পাঁচ নম্বর, এভাবে ঘুরে ঘুরে সবাই কাজটা করবে। সে যত মদ খাচ্ছিল তত বুঝতে পারছে জাহাজে এভাবে সে সবাইকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে না। কাপ্তান টের পেয়ে গেছে, ছোটবাবুকে অহেতুক বিজের ভেতর সে ফেলে রেখেছিল। বিন্জ-পাম্প ঠিক কাজ করছে, কোথাও কোনো বাল্ব আর্চি ইচ্ছে করে এঁটে দিয়েছিল এবং বিজে জল জমিয়ে এটা করেছে তিনি তা টের পেয়েছেন। এটা ওর উন্নতির পক্ষে ক্ষতিকর। সে এখন কিভাবে যে ছোটবাবুকে ফের নাজেহাল করবে বুঝতে পারছে না। উপায় উদ্ভাবনের জন্য সে কেবল পায়চারি করছে। গতকাল শহরের শিশুরা ওকে একটা অদ্ভুত জীব ভেবে পেছনে পর্যন্ত লেগেছিল।

আর তখন ছোটবাবু লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে ডেকে। কান খাড়া করে রেখেছে। বারোটার ঘণ্টা বাজলেই ছুটি। যা কাজ দিয়েছে মেজ-মিস্ত্রী সে আর চার নম্বর মিলে বারোটার ভেতর শেষ করে ফেলতে পারবে। রবিবারে কাজকর্ম কাপ্তান খুব একটা পছন্দ করেন না। অন্তত বন্দরে একটা দিন সপ্তাহে ছুটি থাকবে না, একটা দিন সপ্তাহে ডাঙায় নেমে হৈ-চৈ করবে না, তা হয় না। এত লম্বা সফরে জাহাজিদের মন-মেজাজ ঠিকঠাক রাখা চাই। মেজ-মিস্ত্রী খুব কাজ দেখাচ্ছে।

সুতরাং বারোটার পর তার ছুটি। সে ভাল করে স্নান করবে। বেশ গরম জলে স্নান। তারপর ডাইনিং হলে আহার। এবং বার বার মনে হচ্ছিল সে আসছে। ক্যাথারিন আসছে। তাদের নিতে আসবে ক্যাথারিন।

জ্যাকের সঙ্গে আবার কথা বন্ধ। সে তার বাবার কাছে অথবা কেবিনে থাকছে। মাঝে মাঝে ফানেলের গুঁড়িতে চিপিঙ করার ছুতোয় বসে থাকছে। সে পাশ কাটিয়ে গেলে আগের মতো ছুটে আসছে না। সে যদি কথা বলে সেই ভয়ে যেন জ্যাক কাজে বেশি মনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। জ্যাক কাজে বেশী মনোযোগী হয়ে গেলে ছোটবাবু কথা বলতে আর সাহস পায় না। জ্যাকের চুল শুধু পেছন থেকে দেখতে পায়। চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। নীলাভ চুলে সোনালী সূর্য মাঝে মাঝে কিরণ দিলে, সে থমকে দাঁড়ায়। বালিকার মতো কেন যে মনে হয় তখন জ্যাককে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে।

এবং এভাবে ওর ভারি ইচ্ছে ছিল বলে, জ্যাক, ক্যাথারিন আসছে।

কিন্তু জ্যাক কোনো কথাই বলতে চায় না। সে বলতেই পারে নি, জ্যাক ক্যাথারিন আসছে। তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে?

সে গতকাল সন্ধ্যায় নিচে নেমে যাবার সময় দেখেছে, জ্যাক বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। সারাদিন জ্যাক ওপরে ছিল। দিনের বেলাতে বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না, কেবল সারা ডেকময় সালফারের গুঁড়ো উড়ছে। সবাই মাথায় টুপি পরে এবং রুমাল বেঁধে মুখ ঢেকে কাজকর্ম করছে। জ্যাক বোধ হয় এত নোংরা ঘাঁটতে পছন্দ করে না। সে সারাদিন বাপের সঙ্গে ব্রীজেই প্রায় বসেছিল। একবার নিচে থেকে বলার ইচ্ছে ছিল, যাবে নাকি জ্যাক। আমরা পিকাকোরা পার্কে ঘুরতে যাচ্ছি। আগামীকাল মিস ক্যাথারিন আসছে। ভারী সুন্দর মেয়ে। কথা বললে বুঝতে পারতে ক্যাথারিন কত ভালো মেয়ে।

মিস ক্যাথারিন উড, ভারী সুন্দর নাম মেয়ের। সে একবার মাত্র মুখ তুলে দেখেছিল। ভাল করে দেখেও নি। ক্যাথারিন ওকে চুরি করে দেখছিল। সে যে কেন ভাল করে দেখতে পারল না। একবার সেও চুরি করে দেখবে ভেবেছিল। কিন্তু যদি চোখে চোখ পড়ে যায়। ওকে বেহায়া ভাবতে পারে। তারপর আর সে জানেই না ক্যাথারিন দেখতে কেমন। চার-পাঁচ দিনেই ক্যাথারিন ওকে ভীষণ চঞ্চল করে তুলেছে। এ-বয়সে মেয়েদের জন্য এমন, আরও বড় হলে সে কি না করে ফেলবে।

দুপুরের দিকে কুয়াশা পাতলা হয়ে যাচ্ছে। ছোটবাবু স্নানাহার শেষে বেশ পরিপাটি বেশভূষায় নিজের কেবিনে বসে রয়েছে। ক্যাথারিন আসছে, সে ডেভিডকে পর্যন্ত বলে নি। সে কেবিনের কোথাও এতটুকু অপরিচ্ছন্ন রাখে নি। যে লোকটা গোলাপ ফুলের তোড়া দিয়ে যায় সে তাকে আজ সবার চেয়ে বড় ফুলের গুচ্ছ দিতে বলেছিল। সাদা গোলাপের গুচ্ছ। ফলদানিতে গোলাপগুচ্ছ। শিশিরে ভেজা গন্ধ এত টাটকা যে সে মাঝে মাঝে নিশ্বাস টেনে নিচ্ছিল। ক্যাথারিন এলেই মৈত্রদা এখানে নিয়ে আসবে।

ছোটবাবু তার মায়ের ছবিটা মুছে ফের টানিয়ে রাখছে। একটা সুন্দর মেয়ের ছবি ক্যালেণ্ডারের পাতায় বেশ হাসছে। সে এখন যেন ছবির মেয়েটাকেই ক্যাথারিন ভাবছে। কেমন লাগছে কেবিনটা। ভাল লাগছে না। তোমরা মেয়েরা ভাল না বললে আমাদের কিছু ভাল লাগে না।

টিপয়ের ওপর কিছু বই। কোথায় কি রাখলে ভাল দেখাবে, একবার যদি জ্যাককে ডেকে এনে দেখাতে পারত। জ্যাক কি করছে! সে জ্যাকের সঙ্গে এ-ব্যাপারে কথা না বলে যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। জ্যাকের কেবিনে ঢুকে দেখেছে যেখানে যা রাখলে ঠিক ঠিক মানায় জ্যাক ঠিক সেভাবে সব সাজিয়ে রাখতে জানে। বয়-বাবুর্চিদের কাজ তার পছন্দ না। সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে ডাকল, জ্যাক।

জ্যাক কেবিনে নেই। জ্যাক বোট-ডেকে একটা ডেক-চেয়ারে চুপচাপ বসে বই পড়ছে। সে পেছনে দাঁড়িয়ে ডাকল, জ্যাক আমার কেবিনে একটু আসবে?

জ্যাক চারপাশে সন্তর্পণে কি দেখল। তারপর বলল, তুমি যাও। আমি যাচ্ছি।

সে নিচে নেমে ভেবেছিল, জ্যাকের আসতে দেরি হবে। অথবা জ্যাক এখন আসছে না। ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে। মৈত্রদার ফোকসালে যেতে পারত। সকাল থেকে সে একবারও অমিয়কে দেখে নি। কে কে যাচ্ছে তাও ঠিক জানে না। বাংকের সাদা চাদরে ফুল-লতাপাতা আঁকা। এবং একেবারে পাটভাঙা বলে বেশ মনোরম। সে চাদরটা ভাল করে টেনে দিল। সাদা দেয়ালে সামান্য কালো দাগ, সে তাড়াতাড়ি সাবান জল এনে মুছে সবকিছু পরিচ্ছন্ন করে দেবার সময় দেখল, জ্যাক দরজা খুলে ঢুকছে। এবং ধীরে ধীরে কেবিনের দরজা বন্ধ করে অনেকটা নিশ্চিন্ত গলায় বলছে, কী, আমাকে ডেকেছ কেন?

ছোটবাবু বলল, কেবিনটা দেখে কিছু মনে হচ্ছে না?

–কী মনে হবে?

ছোটবাবু কেমন দমে গেল। তার অগোছালো কেবিন এমন পরিপাটি জ্যাক কবে দেখেছে! জ্যাক কিছু বুঝতে পারছে না কেন? সে বলল, বারে, তুমি দেখছ না কোথাও এতটুকু ময়লা নেই। সুন্দর গোলাপের গুচ্ছ ফুলদানিতে!

—সে তো দেখতে পাচ্ছি।

—তবে! সব ঠিকঠাক আছে, তাই না?

জ্যাক বুঝতে পারল না ছোটবাবু কি বলতে চাইছে।

—এই যেখানে যা রাখা দরকার।

জ্যাক বলল, না। হয় নি। ফুলদানিটা তো ঠিক রাখো নি। আর ওখানে ওভাবে বই রাখে? লকারের মাথায় ওটা কি ঝুলছে!

ছোটবাবু প্রায় জিভে কামড় বসিয়ে দিয়েছিল।—তাই তো। ওর নোংরা বয়লার স্যুট, লকারের মাথায় ফুলে ফেঁপে থাকায় দেখা যাচ্ছে। জ্যাক যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়! সে তাড়াতাড়ি লাফিয়ে বাংকে উঠে গেল। বয়লার স্যুটটা চাপা দিয়ে বলল, এবার?

জ্যাক নিজেই হাত লাগাল। এবং জ্যাক যেন এ-কেবিনে এসে প্রাণ পেয়ে গেছে। সে অজস্র কথা বলছে আর কাজে হাত লাগিয়ে এমন চেহারা করে ফেলল কেবিনটার যে ছোটবাবু দেখে অবাক। সে বুঝতে পেরেছিল কেবিনটাকে সে আগের মতোই এলোমেলো করে রেখেছে। কেবল জায়গা বদল ছাড়া এতক্ষণ সে কিছুই করতে পারে নি।

জ্যাক কাজ করতে করতে বলেছিল, হঠাৎ তোমার এমন সুমতি ছোটবাবু!

—আর বলবে না। ক্যাথারিন আসছে।

—ক্যাথারিন! কেমন সহসা কর্কশ গলায় জ্যাক বেঁকে দাঁড়াল। কাজে হাত নেই। সে যেন বজ্রপাতে স্থির।

—মিস ক্যাথারিন উড, ভারী সুন্দর মেয়ে। সে আজ আমাদের নিয়ে যাবে। এলে তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।

জ্যাক চিৎকার করে বলল, না।

ছোটবাবু একেবারে থ। সে বলল, না কেন? তোমার ভাল লাগবে জ্যাক। আমার কি যে ভাল লেগেছে। ওর সঙ্গে কথা বললে তোমারও ভাল লাগবে।

জ্যাক সহসা যা কিছু আছে এই কেবিনে, সে যেভাবে যা কিছু সাজিয়েছিল, নিমেষে কেমন পাগলের মতো লণ্ডভণ্ড করে দিতে থাকল। আর বলতে থাকল, তুমি একটা নচ্ছার পাজি। তুমি নরক ছোটবাবু।

ছোটবাবু হতাশ। জ্যাক মেয়ের কথায় আবার ক্ষেপে গেছে। সেই ভয়ঙ্কর চোখ। যেন জ্যাক এক্ষুনি এ-কেবিনে আগুন ধরিয়ে দেবে এবং সে যখন দেখল জ্যাক মুহূর্তে ওর সুন্দর ফুলদানিটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলছে তখন আর স্থির থাকতে পারল না। সে বলল, জ্যাক প্লিজ। আমি আর তোমাকে ডাকব না। তুমি ওটা ভেঙে ফেলো না। এবং হাত ধরে ফেললে জ্যাক কেমন আরও পাগলের মতো হাত ছিনিয়ে নিল। তারপর দু’হাতে ছোটবাবুর ফ্লানেলের শার্ট ছেঁড়া কাগজের মতো ছিঁড়ে দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেল। ছোটবাবু পাথরের মতো স্থির। একটা আর কথা বলতে পারছে না। আয়নায় নিজের ছেঁড়া পোশাকের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হল। জ্যাক তুমি পাগল। তুমি আমার এমন সুন্দর দিনটা এভাবে নষ্ট করে দিলে!

তখন মৈত্রদার গলা—ছোট আছিস?

ছোটবাবু তাড়াতাড়ি বিছানার চাদারটা টেনে গায়ে জড়িয়ে ফেলল। বলল, একটু দাঁড়াও। তাড়াতাড়ি সে ভাঙা ফুলদানি গোলাপের পাপড়ি সংগ্রহ করার সময় দেখল ক্যাথারিনকে নিয়ে মৈত্রদা ঢুকে যাচ্ছে। ঢুকেই মৈত্র অবাক। ঘরটাতে যেন এখুনি একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে। মৈত্র বলল, ছোটবাবুর কেবিন।

ছোটবাবু বলল, এই আমার কেবিন। বস।

মৈত্র বলল, ফুলদানিটা হাত থেকে ফেলে ভেঙেছিস?

ছোটবাবু বলল, হ্যাঁ। পড়ে গেল।

—বাংকের এ অবস্থা কেনরে? ভারি নোংরা তুই। এমন সুন্দর কেবিনটাকে কি করে রেখেছিস? ছোটবাবু বলল, সময় পাই না দাদা। একবার ইচ্ছে হল বলে, নচ্ছার ছেলেটা আবার আমার পেছনে লেগেছে। চিৎকার করে বলতে পারলে যেন তার দুঃখ হতাশা লাঘব হত। কিন্তু সে বলতে গিয়েও থেমে গেছে। কাপ্তানের ছেলে জ্যাক। সারেঙসাব বার বার তাকে সতর্ক করেছেন। সে তার বোকামির জন্য ভুগছে—কে কি করতে পারে।

মৈত্র বলল, ক্যাথারিন তুমি কিছু মনে করবে না। আমাদের ছোটবাবুর ভারি অগোছালো স্বভাব।

—না-না। এ-বয়সে এটা হয়।

ছোটবাবুর বলতে ইচ্ছে হয়েছিল—হ্যাঁ হয়। তুমি আমাকে আর শেখাবে না। কিন্তু মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে বলল, কখন এলে?

—এই এক্ষুনি।

মৈত্রদার দিকে তাকিয়ে ছোটবাবু বাংলায় বলল, ওকে তোমার ফোকসালে নিয়ে বসাও। আমি যাচ্ছি। ছোটবাবুকে ভীষণ রাগী দেখাচ্ছিল। মৈত্র কেন জানি ছোটবাবুর সঙ্গে আর একটা কথা বলতে সাহস পেল না। সে ক্যাথারিনকে নিয়ে ডেক পার হয়ে গেল। এবং ক্যাথারিন এসেছে, জাহাজে ডেকের ওপর তাকে দেখা গেছে, সবার মুখে তখন যেন একটাই শব্দ, মেয়ের নাম ক্যাথারিন। পাতলা ভয়েলের স্কার্ট, এবং হাঁটুর নিচে খালি পায়ের সুচারু দৃশ্য। হাতে সাদা দস্তানা। এবং সোনালী চুল। স্কার্টের ওপর মীনা করা রঙ্গীন কাঁচের প্রজাপতি। এবং চোখ ভারি সুন্দর মেয়েটার। নাক একটু চাপা। থুতনির এক পাশে প্রজাপতির মতো দ্বীপবাসীদের ছোট উল্কি আঁকা। আর সুগন্ধ শরীরে। তখন সব নাবিকেরা যে যার খাবার ফেলে উঁকি মেরে দেখছিল।

তারপর এক সময় ছোটবাবু, মৈত্র, বন্ধু, অনিমেষ নেমে যেতে থাকল। অমিয় নেই। সকাল থেকে সে কোথায় বের হয়েছে। সংগোপনে সে কিছু একটা করছে। ওরা যেতে যেতে দেখতে পেল না, ঠিক ওপরে তখন বোট ডেকের কোনো কেবিনে দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া লুকিয়ে কেউ দেখতে পারে। এবং ওরা বুঝতে পারছে না, জ্যাক পোর্ট-হল থেকে অপলক দেখছে। ছোটবাবুর পাশে সেই মেয়েটা। মেয়েটার মুখ সে দেখতে পাচ্ছে। ওরই মতো লম্বা। চুল সোনালী—কি সুন্দর পোশাক পরে এসেছে। ছোটবাবুকে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। কেমন যাদুমন্ত্রের মতো ছোটবাবুর পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। আর এক অতীব অধীরতা। ওর ভেতরে হাহাকার বাজছে। সে ছোটবাবুর কেবিনে যা সব করে এসেছে! আর এ-সব ভেবে সে ভীষণ ম্রিয়মাণ। কেবল ওদের চলে যাওয়া দেখছে। পোর্টের ওপাশে ওরা হারিয়ে গেল। ক্রেনের ছায়া পার হলে ছোট পাহাড়ী উপত্যকাতে ওরা উঠে গেল। আর জ্যাক একান্তে সে-সব দেখতে দেখতে কি করবে স্থির করতে পারল না।

আয়নায় সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। নিজেকে দেখল। সে এবার ওর সবচেয়ে ভাল পোশাক এবং দামী আতর, প্রজাপতি ক্লিপ কিছু রয়েছে কিনা, সোনালী দস্তানা অর্থাৎ ক্যাথরিন যে যে পোশাকে এ জাহাজে উঠে এসেছে ঠিক সেই সেই পোশাকে—যেমন সে হাতে শেষ পর্যন্ত সোনালী দস্তানা না পরে সাদা দস্তনা পরেছে। পাতলা ভয়েলের স্কার্ট এবং ওর শরীর এত বেশি সুচারু যে সব পোশাকই ভীষণ মানিয়ে যায়। জ্যাক জানত না মেয়েটার থুতনির নিচে ছোট্ট একটা প্রজাপতি উল্কি আছে। প্রজাপতির এই উল্কি ক্যাথারিনকে মায়াবিনী করে ফেলতে পারে। জ্যোৎস্না রাতে যদি ক্যাথরিন মাঠ পার হয়ে যায় ছোটবাবুর সঙ্গে তবে ঠিক ক্যাথারিনের উল্কিটা উড়ে উড়ে ছোটবাবুর চিবুকে বসে পড়বে। জ্যাক দুর থেকে দেখেছে ক্যাথারিনকে। অভিমানে সে প্রথম দেখতেই চায়নি। কিন্তু পরে কি মনে হয়েছে সে কেমন মেয়ে যার সঙ্গে ছোটবাবু অনায়াসে চলে যেতে পারে—জ্যাক শেষ পর্যন্ত স্থির থাকতে পারে নি। পোর্ট-হোলের কাঁচ খুলে দেখেছে ওরা হাসতে হাসতে তখন জেটি পার হয়ে যাচ্ছে। থুতনির নিচে প্রজাপতির উল্কি আঁকা আছে ক্যাথারিনের, জ্যাক এত দূর থেকে তা টের পেল না। প্রজাপতি আঁকা আছে দেখতে পেলে জ্যাক ঠিক পেনসিলে থুতনির নিচে সুন্দর একটা প্রজাপতি পর্যন্ত এঁকে রাখত। ছোটবাবুকে বলতে পারত, দ্যাখো থুতনির নিচে আমারও ছোট্ট প্রজাপতি আছে। আমাকে তুমি অবহেলা করে এত কষ্ট দিও না।

আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে ক্রমে ভীষণ অধীর হয়ে পড়ল জ্যাক। ভেতরে কি যে ভীষণ জ্বালা! ওর কিছু ভাল লাগছে না। সব ভেঙেচুরে দিতে ইচ্ছে করে। এবং নিজেকে সে ভেতরে বন্দী করে রেখেছে। সে দেখেছে রেগে গেলে তার মাথা ঠিক থাকে না। ওপরে উঠে বাবার পাশে বসে থাকতে পারত। যখন তার সবকিছু হারিয়ে যায় বাবার পাশে বসে থাকলে কেমন একটা নিরিবিলি শান্তি। সব শোক দুঃখ বাবার কাছে গেলে সে ভুলে যেতে পারে। কিন্তু এখন তার বাবার কাছে যেতে পর্যন্ত ইচ্ছে হচ্ছে না। সে বুঝতে পারছে ওর চোখে ভীষণ জ্বালা ফুটে উঠেছে। সে এখন কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না।

সে কতক্ষণ এভাবে ঠিক ক্যাথারিনের মতো পোশাক পরে দাঁড়িয়েছিল জানে না। সে কতক্ষণ এ-ভাবে নিজেকে দেখতে দেখতে নিবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারছিল না। সে এখন কি করবে! সে সহসা আর্তনাদ করে উঠল, আমি কি করব ছোটবাবু। আমাকে তুমি কেন বুঝতে পার না।

বোধহয় এই বুঝতে না পারার জন্য জ্যাক মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিছু একটা করার কথা ভেবে ছটফট করছিল। যেন ছোটবাবুকে ছিঁড়ে ফুঁড়ে দিয়েও তার শান্তি নেই। সে নিজেকে নানাভাবে ক্ষত- বিক্ষত করে এখন ছোটবাবুর কাছে ধরা দিতে চায়। ওর ইচ্ছে হচ্ছিল, ছোটবাবু ফিরে এলে, সে ছোটবাবুর কেবিনে ঢুকে যাবে। দরজা বন্ধ করে দেবে। তারপর দু’হাতে যে-ভাবে ছোটবাবুর ফ্লানেলের শার্ট দাঁতে ছিঁড়ে ফেলেছে, তেমনি নিজের পোশাক নাভিমূল পর্যন্ত ছিঁড়ে দেখাবে—এই দ্যাখো—আমি কি দ্যাখো। আমি বনি। কাপ্তানের একমাত্র মেয়ে বনি। বাবা আমাকে গোপনে জাহাজে ছেলে সাজিয়ে রেখেছে।

তারপর যখন মনে হয়, এ-ভাবে ধরা দিলে তার কাছে ভীষণ ছোট হয়ে যাবে বনি, তখন দুঃখ আর অবিমিশ্র কান্না। বালিকার মতো দু’চোখ ভাসিয়ে দিতে পারে গোপনে। কেউ জানল না, ক্ষোভে দুঃখে মেয়েটা নিজের কেবিনে একান্তে বসে কাঁদছে।

তখন ক্যাথারিন বলল, কেমন লাগছে ছোটবাব?

—খুব সুন্দর।

—এমন সুন্দর দেশ আর হয় না।

—তা হবে। ছোটবাবুর কথায় যেন প্রাণ ছিল না।

গাড়ি যাচ্ছে। গাড়ি চালাচ্ছিল ক্যাথারিন। শহর ছাড়ালেই বড় রাস্তা। ক্যাথারিন বলল, গাড়ি ওয়েস্ট কোস্ট রোড ধরে যাচ্ছে। দূরে এগমন্ট হিলের চূড়ো দেখতে পাচ্ছ?

ছোটবাবু কথা বলছে না। মৈত্র বুঝতে পারছে ছোটবাবুর রাগ পড়ে নি। রাগ পড়লে ছোটবাবু ছেলেমানুষের মতো এটা কি ওটা কি করত। মৈত্র বলল, তোর কি হয়েছে রে ছোট?

—কি আবার হবে!

তখন অনিমেষ বলল, সত্যি ভারি সুন্দর জায়গা। ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না।

বঙ্কু বলল, এমন সুন্দর মেয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলে কারো ছেড়ে যেতে ভাল লাগে না।

ক্যাথারিন বুঝতে পারছে না, বাংলায় বললে না বোঝারই কথা। অনিমেষ বন্ধু ভাল ইংরেজী বলতে পারে না। একবার ইচ্ছে হয়েছিল মৈত্র বলে, বন্ধু ক্যাথারিন তোদের কথা বুঝতে পারছে না। যতটুকু পারিস ইংরেজীতে বল। ও হয়তো ভাববে ওর সম্পর্কে কিছু বলছিস। কিন্তু মৈত্র জানে, তবে অনিমেষ বন্ধু একেবারে চুপ মেরে যাবে। একটা কথাও বলবে না। কথা বলতে ওদের সংকোচ হবে।

মৈত্র ক্যাথারিনকে বলল, বন্ধু অনিমেষ ভাল ইংরেজী জানে না। ওরা কথা বললে তুমি কিছু মনে কর না।

ক্যাথারিন যেন কিছুই শুনছে না। সে সাদা রঙের গাড়ির ভেতরে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে অনেক দূরে যেন কিছু দেখছে। আসলে কিছুই দেখছে না। বড় বড় ট্রাক বাস সব সাঁ সাঁ করে বের হয়ে যাচ্ছে। এবং যেন গাড়ি নিজের ইচ্ছেমতো গতিবেগ বাড়িয়ে প্রায় উড়ে চলেছে। ক্যাথারিনের চুল মাঝে মাঝে উড়ে এসে মুখে পড়ছে। সে ছোটবাবুকে এই দেশ সম্পর্কে কত কথা বলে যে যাচ্ছে।

ক্যাথারিন বলল, আসলে ছোটবাবু আমাদের ছোট শহরটা এগমন্ট ন্যাশানাল পার্কের ভেতরে। ডানদিকে ডসন ফলস্ ফেলে চলে যাচ্ছি। ঐ যে দেখছ পাহাড়ের ওপর বাড়িটা, ওটা ডসন ফলস্ টুরিস্ট লজ। দু’একদিন এখানে এসে থাকতে পার। এখন তত ভিড় নেই। ফেব্রুয়ারিতে ন’দিন ধরে আমাদের পাইন ফেস্টিভ্যাল। তখন তোমরা হয়তো থাকবে না।

মৈত্র বলল, থেকে যেতেও পারি। যা আমাদের একখানা জাহাজ।

ক্যাথারিন কেমন ছেলেমানুষের মতো বলল, থেকে গেলে কি যে মজা হবে না! দাদু একেবারে সে ক’দিন তোমাদের তার যা কিছু ভাল ভাল খাবার—এই যেমন ছোট ভেড়ার বাচ্চার রোস্ট আর তোহে রো স্যুপ। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ওস্টার থেকে তৈরি। দাদু ঠিক তোমাদের হোয়াইটবেইট না খাইয়ে ছাড়বে না। আরও কত সব খাবারের নাম যে বলে যেতে লাগল ক্যাথারিন। যেন দেশটাতে শুধু পর্যাপ্ত খাবার, এবং ফুলে ফলে ভরা। ওরা যেতে যেতে আপেলের বাগান দেখতে পেল মাইলের পর মাইল। আঙ্গুরের জমি, গমের ক্ষেত, ভেড়ার পাল পাহাড়ী উপত্যকাতে হাজারে হাজারে চরে বেড়াচ্ছে। আর কেবল সবুজ সমারোহ।

ছোটবাবুর যা স্বভাব, খাবারের নাম শুনলেই জিভে জল আসে। ওর যত রাগ জ্যাকের ওপর ছিল ক্রমে কমে আসছে। এই মেয়ে, ক্যাথরিন ওর সমবয়সী হবে, অথবা কিছু বড় হতে পারে, কি সুন্দরভাবে গাড়ি চালাতে শিখে গেছে। আর যেন কতকালের চেনা, কত সহজ কথাবার্তা। মনেই হয় না তিন-চার দিন আগে সামান্য সময়ের জন্য ওরা ক্যাথারিনকে দেখেছিল। ওর এখন কথা বলতে বেশ ভাল লাগছে। সে বলল, শীতকালে ঠাণ্ডায় খুব কষ্ট পাও না!

–কেন বল তো?

–এখনই যা শীত।

ক্যাথারিন হেসে ফেলল। কোথায় শীত! ছোটবাবু জ্যাকের দেওয়া গরম পোশাক পরে এসেছে। কারণ এর চেয়ে দামী স্যুট ওর নেই। ক্যাথারিনকে সে তার পোশাক এবং সৌন্দর্যে মুগ্ধ করতে চেয়েছিল। এটা ছোটবাবুর স্বভাব। মেয়েদের সঙ্গে সহজে কথা বলতে পারে না। কিন্তু ক্যাথারিন যেভাবে অতি সহজে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে তাতে সে কিছুতেই আর চুপচাপ থাকতে পারছিল না।

ক্যাথারিন বলল, আমাদের দেশটাতে খুব শীতও পড়ে না, খুব গরমও পড়ে না। দশের বেশি নামে না সাতাশের বেশি ওঠে না। এমন সুন্দর দেশ কোথায় পাবে বল।

–তুমি তো ভারতবর্ষে থাকতে। তোমার তো কষ্ট হবার কথা।

–বাবা মা মারা যাবার পর দাদু আমাকে এখানে খুব ছোটবয়সে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মামারা এখানে থাকতেন। বছর চার-পাঁচ আগে দাদু আসেন।

বাবা মার কথা বলেই মেয়েটা চুপ মেরে গেল। বুড়ো মানুষটার কোথায় দুঃখ ছোটবাবু এতক্ষণে ধরতে পারছে। মৈত্রও কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। রাতের বেলা বুড়োকে দেখে এবং এই মেয়ে ক্যাথারিনকে দেখে সে যা সব ভেবেছিল!

বন্ধু অনিমেষ পেছনে আছে। ওরা বোধহয় ক্যাথারিনের সব কথা ঠিক বুঝতে পারছে না। নিজেরা নানারকম কথা বলে যাচ্ছিল, কখনও ক্যাথারিনের চুল, কখনও সুন্দর মেয়ে রাস্তায় দেখলে অথবা এই ক্যাথারিন যে বেশ তাদের বাড়ি-ঘরের কথায় ভুলিয়ে রাখছে এ-সব সম্পর্কে অদ্ভুত অদ্ভুত সব মন্তব্য। ভাগ্যিস ক্যাথারিন বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারলে ক্যাথারিনের লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠত।

ছোটবাবুর মনে হল, বুড়ো মানুষটা তার সন্তান সন্ততি অথবা বাপ পিতামহকে এবং এ-ভাবে বলা যায়, ওর যা কিছু নিজের বলতে, সবাইকে ভারতবর্ষের মাটিতে রেখে এসেছে। যতই চলে আসুক দূরে, কখনও কখনও স্মৃতি তাকে অস্থির করে তোলে। সে তখন হয়তো কোনো জাহাজের সন্ধানে থাকে। ভারতবর্ষের নাবিকেরা বন্দরে এলে এই বুড়ো মানুষটা রাতের বেলা লণ্ঠন জ্বেলে তাদের খুঁজে বেড়ায়। শহরে বন্দরে লণ্ঠন জ্বেলে চলে আসা কিছুটা বিস্ময়ের। একবার ভেবেছিল বলবে, ক্যাথারিন, তোমার দাদু কি চোখে কম দেখতে পান!

ক্যাথারিন নিজেই এখন বলছে, বাবা মারা যাবার পর দাদু কেমন ভীতুগোছের মানুষ হয়ে গেছেন। সামান্য অন্ধকার দেখলেই ভীত হয়ে পড়েন। অন্ধকার একদম সহ্য করতে পারেন না। যতই আলো থাক, তাঁর ঘরে সব সময় রাতে লণ্ঠন জ্বেলে রাখা হবে। কখন কি তার-টার শর্ট হয়ে যাবে, অন্ধকারে ডুবে যাবেন ভাবতেই ওর মুখ নীল হয়ে যায়।

গাড়ি চলছিল আর এমন সব কথাই হচ্ছিল। ওরা অনেকটা পথ চলে এসেছে। কখনও সমতল ভূমি, কখনও নীল পাহাড়ী উপত্যকা পার হয়ে যাচ্ছে। আর সেই ড্যাং ড্যাং করে পুজোর বাজনার মতো কেবল কি যেন বাজছে ছোটবাবুর মনে। সে ক্যাথারিনকে চুরি করে দেখছিল।

মৈত্র বলল, বেশ দূর!

—কোথায়! ক্যাথারিন ঘড়ি দেখল, মাত্র চল্লিশ মিনিটের মতো এসেছি। আর চল্লিশ মিনিট। বেশ তবেই দেখতে পাবে আমাদের বড় কৌরি-পাইন গাছটা। তার ছায়ার ভেতর কিছুটা দূরে—বেশ জায়গা নিয়ে আমাদের বাড়িটা। ছুটির সময় আমি দাদুর কাছে থাকি। আমাদের এখন লম্বা ছুটি। ক্রিসমাস- ডে, বকসিং-ডে, এনিভারসারি-ডে পাইন-ফেস্টিভ্যাল সব এক সঙ্গে পড়েছে।

ছোটবাবু বলল, অমিয়র কি ব্যাপার বল তো!

ক্যাথারিন বুঝতে না পেরে তাকাল।

মৈত্র বলল, না তোমাকে না। আমাদের আর একটা অপোগণ্ড আছে। ওটাকে নিয়ে আসা গেল না। তারপর ছোটবাবুর দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলল, ইয়াসিন গতকাল রাতে ওকে পিকাকোরা-পার্কে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। সঙ্গে সুন্দর মতো একজন মাউরি মেয়ে রয়েছে।

—খুব সুন্দর! ছোটবাবু কথাটা বেশ জোরে বলল।

—খুব সুন্দর! লক্ষ্য করেছিস মাউরি মেয়েরা একেবারে বাঙালী মেয়েদের মতো।

ছোটবাবু বলল, আসলে এরা কিন্তু পলিনেশিয়ান। আমাদের মা বোনদের সঙ্গে খুব মিল ক্যাথারিন এখন চুপচাপ। ওরা যা সব বলছে তার এক বর্ণও বুঝতে পারছে না।

মৈত্র বলল, আমরা মাউরি যুবক-যুবতীদের কথা বলছি ক্যাথারিন। ওরা ঠিক আমাদের মতো দেখতে।

ক্যাথারিন বলল, ছোটবাবু কিন্তু দেখতে তোমাদের মতো নয়।

ছোটবাবু বলল, আমি রাজার মতো দেখতে। সে হা হা করে হেসে উঠল।

ক্যাথারিন বলল, তোমাকে কেমন যেন লাগে। তোমার দাড়ি না থাকলে তোমাকে হয়তো এত ভাল লাগত না। তুমি খুব সুন্দর দেখতে ছোটবাবু।

বন্ধু বুঝতে পেরে বলল, ছোটবাবু তোমার হয়ে গেল।

অনিমেষ বলল, এই আমরা নেমে যাব। তুমি যাও। তোমার জন্যই এতসব হচ্ছে।

মৈত্র বলল, কি সব হচ্ছে! তোরা কি সব জায়গায় এক রকম থাকবি।

ক্যাথারিন এবার বলল, আমরা এসে গেছি। ঐ দ্যাখো আমাদের সেই কৌরিপাইন গাছটা।

পাশেই ছোট ছিমছাম মাউরি গ্রাম। ঠিক বড় রাস্তার ওপরে। একজন মাউরি বুড়ো মতো মানুষ মাঠে ভেড়ার পাল চরাচ্ছে। প্রায় চারপাশটা যেন তৃণভূমি। ছোট ছোট কাঠের বাড়ি-ঘর এবং দু’পাশে ছোট্ট জলের রেখা, প্রায় পরিখার মতো খনন করা। ওপরে কাঠের পাটাতন। তার ওপরে গাড়িটা উঠে গেলে ওরা দূরে প্রায় ফার্লং-এর মতো দূরে দেখতে পেল সেই বুড়ো মতো মানুষটা সাদা পোশাকে রোদে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে।

.

তখন জ্যাক ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যাচ্ছে। হিগিনস তখন জরুরী চিঠি লিখছেন হেড-অফিসে। জাহাজের অবস্থা জানিয়ে চিঠি দিচ্ছেন। মেন-জেনারেটর ঠিকমতো কাজ করছে না, বয়লার-চক বসে যাচ্ছে—যা সব মেরামত দরকার এ-বন্দরে সারা যাবে না, জাহাজের সব মেরামতের জন্য বড় বন্দরে দু’ চার মাস বসিয়ে না দিলে চলছে না, এ-সব বিস্তারিত লিখে জানাচ্ছেন। জাহাজ ফসফেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বন্দরগুলিতে যাবার কথা। পোর্ট মেলবোর্নে অথবা মেলবোর্ন বন্দরের সাউথ- ওয়ার্ফ জেটিতে ক’মাস ফেলে রাখা দরকার। সাউথ-ওয়ার্ফ জেটিতে সব ভাঙা জাহাজ মেরামতের কাজ হয়ে থাকে, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কিছু ব্যবস্থা করে ফেলতে পারলে হিগিনস জাহাজ নিয়ে বন্দরে ঠিক ঢুকে পড়তে পারবেন। সবই নির্ভর করছে এখন হেড অফিসের মর্জির ওপর।

খুবই জরুরী চিঠি। ‘একান্ত গোপন’ খামের ওপর লেখা। একমাত্র রিচার্ড ফেল চিঠিটা খুলে পড়তে পারবেন। তখন জ্যাক পাশের চেয়ারে চুপচাপ বসে রয়েছে। তিনি খেয়াল করেননি বনি চার্ট-রুমে ঢুকেছে। চার্ট-রুমের দেয়ালে সব চাবির রিঙ। জাহাজের সব কেবিনের এবং স্টোররুমের সব চাবি ঝুলছে। বনি চাবির গোছা হাঁটকাচ্ছে বসে বসে। বনিকে খুব নিরীহ এবং শান্ত স্বভাবের মনে হচ্ছিল।

হিগনিস বলল, আমার সঙ্গে তুমি বের হতে পার বনি। অকল্যাণ্ডে যাচ্ছি।

বনি বুঝতে পারছে বাবা এজেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। এখন বের হলে ফিরতে অনেক রাত হবে। গাড়ি যত জোরেই যাক তিন ঘণ্টার আগে বাবা অকল্যাণ্ডে পৌঁছাতে পারবেন না। ফিরতে অনেক রাত হলে আজ আর ছোটবাবুর সঙ্গে দেখা হবে না। ফিরে হয়ত দেখবে ছোটবাবু নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ছোটবাবুর সঙ্গে সে আজই যা হয় হেস্ত নেস্ত কিছু করে ফেলবে। কারণ মাথার ভেতরে অস্থিরতা তার ক্রমে বাড়ছে। সে কোথাও দু’দণ্ড স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছে না। কেবল সেই রাস্তাটা, যেখানে সে দেখতে পাবে হেলে দুলে নেমে আসছে ছোটবাবু, রাস্তাটার দিকে বারবার নজর চলে যাচ্ছে। কেন যে মনে হচ্ছে জাহাজ ছেড়ে তাকে ছেড়ে, ছোটবাবুর কোথাও বেশি সময় ভাল লাগবে না।

বনি বলল, আমার ভাল লাগছে না।

কাপ্তান বললেন, যাবার সময় ওয়াতেমো গ্রামের ভেতর দিয়ে যাব। গ্রামটা পার হলেই আমাদের গাড়ি সুন্দর একটা গুহার ভেতরে ঢুকে যাবে। কিছুদূর গেলেই দেখা যাবে শুধু পাথর আর পাহাড়, পাহাড়ের ছাদ। মধুর চাকের মতো হিজিবিজি সব জোনাকিদের আবাস। লাল নীল হলুদ রঙ হ্রদের জলে ভাসছে। নৌকায় বেড়াচ্ছে কত সব মানুষ। তাদের দেখতে প্রায় রঙীন ছবির মতো। গ্লো- ওয়ার্মি—গ্রুতোতে হাজার হাজার লার্ভা পাহাড়ের ছাদে দেয়ালে জাদুকরের মতো আলোর মালা তৈরি করছে। এ-সব দেখার জন্য পৃথিবীর সব লোক চলে আসে। এত হাতের কাছে অথচ তুমি যাবে না, এটা ঠিক না।

বনি ততক্ষণে ঠিক চাবিটা খুঁজে বের করে ফেলেছে। সে চাবির গোছাটা পকেটে প্রায় গোপনে ভরে রাখল। বাবা নিরন্তর যেমন কথা বলতে ভালবাসেন, কাজও করতে ভালবাসেন। বনির দিকে তিনি তাকিয়ে কিছু বলছেন না। এই মাথার টুপিটা ঠিক করতে করতে অথবা কোনো মানচিত্রে লাল একটা টিক মারার সময়, অথবা স্টোররুমের স্টক দেখার সময় তিনি যে অনায়াসে গল্প করে যেতে পারেন, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বনি বাবার এই অফিস-ঘরে চাবি চুরি করতে এসেছে তিনি তা টেরই পেলেন না।

বনি বলল, বাবা শরীরটা ভাল নেই

বনি বড় হয়ে যাচ্ছে বলে মাঝে মাঝে শরীর খারাপ হবে—সুতরাং আর পীড়াপীড়ি করা যুক্তিসঙ্গত নয় ভেবে বললেন, সাবধানে থেকো। বেশি রাত হলে ফিরতে নাও পারি। চিন্তা করবে না। চিফ থাকছে জাহাজে। অসুবিধা হলে ওকে বলবে। থার্ড-মেট সঙ্গে যাচ্ছে।

বনি সরল বালিকার মতো ঘাড় কাত করে দিল। বলল, আচ্ছা।

তারপর সে নেমে গেল। নিজের কেবিনে ঢুকে এখন শুধু অপেক্ষা করা, বাবা যতক্ষণ জাহাজে থাকছে, সে কিছু করতে পারছে না। এবং পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে কখন বাবা নেমে যান, দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। আর নেমে গেলেই সে সোজা সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে থাকল। এ-সময়ে সবাই প্রায় বাইরে, কেবল আর্চি নিজের কেবিনে, অথবা ঘোরাঘুরি কখন একবার দেখা যাবে বালিকাকে। বনি এ-সব ভেবে খুব দ্রুত চারপাশ দেখে কেবিনের দরজা খুলে ফেলল। এলি-ওয়ে ফাঁকা খাঁ খাঁ করছে। ডাঙা পেলে যা হয় মানুষের, জাহাজে কেউ থাকতেই চায় না। সে ভিতরে ঢুকে খুব সন্তর্পণে দরজা লক করে ফেলল।

কেবিনে ঢুকে আলো জ্বেলে দিল জ্যাক। ভেতরে তেমনি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ফ্লানেলের ছেঁড়া জামা প্যান্ট পড়ে আছে একপাশে। সে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর দু’হাতে খুব যত্নের সঙ্গে তুলে নিল ছেঁড়া জামা প্যান্ট। ভাঁজ করার সময় ছোটবাবুর অসহায় মুখ বার বার দেখতে পেল।

তার কিছু এখন ভাল লাগছে না। কেন যে তার মাথা এ-ভাবে মাঝে মাঝে খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় পৃথিবীতে সবাই ওর সঙ্গে শত্রুতা করে যাচ্ছে। তখনই মাথার ভেতরে একটা তীব্র ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে। সে নিজেকে তখন আর কিছুতেই সামলাতে পারে না।

সে ভারি অসহায়। দুঃখী মুখ তার। সে এখন বাংকে বসে আছে চুপচাপ। কাঁধের ওপর সেই ছেঁড়া জামা প্যান্ট। এখনও যেন ছোটবাবুর গায়ের উষ্ণতা সে জামা প্যান্টের ভেতর টের পাচ্ছে। তারপর নিচু হয়ে ভাঙা কাচ, ফুলের পাপড়ি, ছেঁড়া কাগজের টুকরো একপাশে কুড়িয়ে জমা করতে থাকল। বিছানার চাদর বেশ টেনে টেনে বিছিয়ে দিল। আয়না সব জলের দাগ। সাদা মসৃণ তোয়ালে দিয়ে আয়নার কাঁচ ভাল করে মুছে, সে তার কেবিনের এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ ফুলদানিতে ভরে রাখল। এবং ছোটবাবুর মায়ের ছবি দেয়ালে, সে লণ্ডভণ্ড করে দেবার সময় ওটাও কি করে নিচে পড়ে গেছে—তুলে, হাতের ভেতর কিছুক্ষণ ঝুঁকে দেখতে থাকল। কাঁচ অথবা ফ্রেম কিছু নষ্ট হয় নি। একটা বড় টিপ কপালে। হাতে সাদা শংখের কিছু অলংকার পরেছে। শাড়ি-পরা মাথার প্রায় সবটা ঢাকা হুবহু ছোটবাবুর মুখ। ছোটবাবু মেয়ে সেজে থাকলে ওর মার মতো হয়ে যেত। অনেকক্ষণ এ-ভাবে সে দেখল ছবিটা। এখনও ছোটবাবু পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে এই যুবতীকে। ওর ভীষণ হিংসে হচ্ছিল, আবার কখনও অভিমান, যেন বলার ইচ্ছে ছোটবাবু কিছু বুঝতে পারে না কেন। দেয়ালে ভাল করে টাঙ্গিয়ে রাখল ছবিটা। তারপর সে যেখানে যা কিছু দাগ জলের অথবা ভাঙা কাচের সব মুছে যেমন চেয়েছিল ছোটবাবু তেমনি রেখে ওপরে উঠে গেল।

সারা বিকেল সে বোট-ডেকে বসে থাকল। কখনও পায়চারি করে বেড়াল। সন্ধ্যার সময় সে ফোনে জানতে পারল বাবা আজ ফিরছে না। কাল সকালে তিনি ফিরছেন। সঙ্গে সঙ্গে বনির সব অস্থিরতা কেটে গেল। রাত বাড়লে সে একটা ছোট এটাচি কেসে তার যাবতীয় সবকিছু—এই যেমন সাদা সাটিনের লম্বা গাউন, সাদা মোজা, সাদা জুতো, জরির মূল্যবান জ্যাকেট, সুগন্ধ আতর, পাতলা দুধের মতো নীলাভ ক্রিম নিয়ে নিচে নেমে গেল। সে সন্তর্পণে ছোটবাবুর কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখে বুঝল কেউ নেই। সে যত দ্রুত সম্ভব সতর্কতার সঙ্গে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতর থেকে দরজা লক করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর এক এক করে সে তার পুরুষের পোশাক শরীর থেকে খুলে ফেলতে থাকল। সব খুলে ফেলতেই নিজেকে সে খুঁজে পেল। সে বনি। তার সুন্দর স্তনে গভীর ভালবাসার কোমল উষ্ণতা ক্রমে জন্ম নিচ্ছে। জংঘার পাশে সোনালি রেশমে ঢাকা এক আশ্চর্য দ্বীপের বর্ণমালা। সে ক্রমে এ-ভাবে অধীর হয়ে উঠছে।

সে তার মূল্যবান পোশাক, এই যেমন মসলিনের ওপর কারুকার্যময় ফুলফল লতাপাতা আর গভীর উজ্জ্বলতা নিয়ে আছে তার রেশমের মতো নীলাভ চুল, গুচ্ছ গুচ্ছ চলে সে অলিভ পাতার সুগন্ধ মেখে আস্তে আস্তে নরম আঙুলে সারা মুখময় আশ্চর্য সব পারফিউম ছড়িয়ে বসে থাকল। মাঝে মাঝে চোখ মেলে আয়নায় সে নিজেকে দেখছে। যেন পা হাত এবং নাভিমূলে আছে প্রাচীন ফারাও-সম্রাজ্ঞীদের সব রহস্য আর শরীরে সেই সুদূর অতীত থেকে তেমনি প্রবহমান—নীল নদের অববাহিকায় অথবা ইউফেটিস নদীর তীরে যে যুবতী স্নান শেষে ফিরে গেছে খোঁপায় গমের শিস সে আছে তারই মতো। তারই মতো চুলে গোলাপ ফুল গুঁজে পোর্ট-হোলে ছোটবাবুর জন্য অপেক্ষা করছে। তখন আকাশের নক্ষত্রমালা প্রতিবিম্ব ফেলছে সমুদ্রে। অনেক দূরে গীর্জায় তখন ঘণ্টা বাজছিল। ওয়েস্ট কোস্ট রোড ধরে দূরন্ত গতিতে ছোটবাবুর গাড়ি ছুটছে তখন

ভীষণ ভীরু নিষ্পাপ এক পবিত্র প্রতীক্ষা বনির। ছোটবাবু আসছে। বাতাসে ফলের পাপড়ির মতো বনি উত্তেজনায় কাঁপছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *