1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৩০

।। ত্ৰিশ।।

মৈত্র জাহাজ বাঁধলেই সিঁড়ি ধরে নেমে গেল। সে যেন প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। কোথাও একজন ডাক্তারের সঙ্গে তার এক্ষুনি দেখা করা দরকার। ট্যাবলেটে কাজ হচ্ছে না। জ্বালা-যন্ত্রণা কমে গেছিল, মনে হয়েছিল সেরে যাবে। কিন্তু দুরাত থেকে আবার জ্বলছে। দু’রাত সে চোখ এক করতে পারেনি। মনে হচ্ছে ভেতরের সব রক্তে বিজবিজ করছে পোকা। এবং জ্বালায় অসহ্য যখন, সে নিজের ফোকসালে বসে বসে চুল ছিঁড়ছে। অমিয়কে একবারও ডেকে তোলেনি। ওয়াচের সময় দাঁত কামড়ে কাজ করেছে। এমন কি শেফালীর চিঠি আসার কথা। এজেণ্ট-অফিস থেকে লোক এসেছে। সারেঙ চিঠি আনতে গেছে। একটু অপেক্ষা করলেই সে চিঠিটা দেখে যেতে পারত কিন্তু মনে হয়েছে একদণ্ড দেরি করলে সে মরে যাবে। রক্তের ভেতরে পর পর সুঁই না ফোটালে সে আর বাঁচবে না।

তখন একটা লোক কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। ঝুড়িতে সব গোলাপের গুচ্ছ। মৈত্র নেমে গেলে সে উঠে এল। সে এখন ডাইনিং হলে ফুল দিয়ে যাবে। সব দামী দামী ফুল। লাল সাদা গোলাপ। সবুজ রঙের অন্য সব কি ফুল। লোকটা ফুল বেচে খায়। সে জেনে ফেলেছে—আজ এ জাহাজে একটা উৎসব হবে। লাঞ্চে সবাই তাজা সুস্বাদু খাবার খেতে পাবে। চিফ-কুকের গ্যালিতে জাহাজ বাঁধা-ছাদার সঙ্গে শূকরছানা চলে এসেছে। তাছাড়া একেবারে এখনই কিলখানা থেকে আনানো। বড় টার্কি। ছোট ছোট মুরগীর ছানা, আর ডিম এবং ফলের রস। লোকটা শুধু স্টুয়ার্ডকে ডাইনিং হলের জন্য ফুল দিয়ে -গেল না। প্রত্যেক কেবিনে ফুল দিয়ে গেল।

কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। সবই কাপ্তানের মর্জি মতো হচ্ছে। স্টুয়ার্ড আদেশমতো কাজ করে যাচ্ছে। চিফ-কুক মেনু-মাফিক কাজকাম করবে ভেবেছিল, কিন্তু সবই কেমন গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। স্টোররুম থেকে কিছুই আসছে না। সব সদ্য বাজার থেকে কিনে আনা হচ্ছে। এবং যেন কোন উৎসবের আয়োজন হচ্ছে এ জাহাজে। কেক বানাবার জন্য দামী মসলাপাতি। দু’রকমের পুডিং। নিত্য যা খায় অফিসার মানুষেরা আজকের খাবার একেবারে আলাদা। ভেড়ার বাচ্চা শূকরছানা আস্ত, সব আস্ত রোস্ট—বড় বড় রেকাবীতে সাজানো থাকবে—টমাটো স্লাইস। স্যালাড একেবারে তাজা সব ফলের আর কি মনোহারিণী ভোজের তালিকা। চিফ-কুকের জিভে জল এসে যাবার মতো।

জ্যাক চুপচাপ কেবিনে বসেছিল। ও পরেছে প্রায় বেলবটমের মতো পোশাক। সে নীল রঙের প্যান্ট এবং দামী সিল্কের ফুল পাখি আঁকা সার্ট পরেছে। পায়ে হাল্কা সু। এবং চুপচাপ বাবাকে দেখছে।

হিগিনস মেয়ের পাশে বসে ওর বাকসো গুছিয়ে দিচ্ছেন। আর সব কথাবার্তা—এই যেমন বাড়ি ফিরে বাগানের যত্ন ঠিক হচ্ছে কিনা দেখা এবং পিসিমাকে ভালবাসতে হবে। দরকার হলে গ্রীষ্মের ছুটিতে কনটিনেন্ট ঘুরে আসতে পারে। ব্ল্যাক ফরেস্টে পিকনিক এবং প্যারিসের কোনো মিউজিয়ামে ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকা ইচ্ছে করলে শিখতে পারে। ওর বন্ধু হামবোল্ট বাতিঘরে যখন আছে কিছু ভাল না লাগলে ছোট মোটর বোটে বিকেলে সেই পাহাড়ী দ্বীপে চলে যেতে পারে। বেশ ভাল লাগবে। ছোট ছোট সব কচ্ছপ দেখতে পাবে, আর সে গাছপালার ভেতর থেকে তখন দেখবে দূরে সব জাহাজ ভেসে যাচ্ছে, তখন সে তার বাবার কথা মনে করতে পারবে। আর ক’দিন। সে গুনে গুনে একবছর পার করে দিতে পারবে সহজেই। মানুষের জীবনে একটা বছর তেমন বড় নয়। হিগিনস মেয়েকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব বোঝাচ্ছিলেন।

তখন আর্চি বলল, ম্যান এখানে!

ছোটবাবু দেখল, আর্চি টর্চ মেরে বয়লারের পেটের নিচে ঢুকে যেতে বলছে। সে ঠিক টর্চের আলোর শেষ প্রান্তে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল।

—ম্যান দ্যাখো ওখানে ট্যাংক-টপের একটা ঘুলঘুলি আছে।

ছোটবাবু দেখল শুধু স্তূপীকৃত ছাই। প্রায় ফুটের ওপর এই ছাই ক্রমান্বয় পড়ে পড়ে কাদার মতো হয়ে আছে। এবং তিনটে বয়লারের পেটের নিচে এভাবে প্রায় একটা সমতলভূমি হয়ে গেছে। কখনও এনজিনের নিচে, কখনও পোর্টসাইডের বয়লারের পাশে, কখনও ঠিক জেনারেটরের পাশে প্লেট তুলে ফেললে একটা ঘুলঘুলি পাওয়া যায়। এসব ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে গেলেই কোনো না কোনো বিলজ্‌ পাওয়া যায়। জল রাখার সব আধার। কিন্তু সে এমন একটা জায়গায় কখনও নামেনি। সে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকছে, নাকে মুখে ছাই লাগছে। সামান্য সোজা হলেই বয়লারের পেটে ঠাস করে মাথা লেগে যাচ্ছে। হামাগুড়ি না দিলে এদিক ওদিক ঠোক্কর খাচ্ছে। অন্তত সে যাতে জখম না হয়, তার জন্য খুব সন্তর্পণে এগিয়ে গেলে মনে হল দাঁত শক্ত করে আর্চি উচ্চারণ করছে—হেল। ‘হেল’শব্দটি আর্চির ঠোঁটের ডগায় থাকে। হেল না বলতে পারলে সে যেন ঠিক কাজ করাতে পারে না। ছোটবাবু ঠিক জায়গায় ঢুকে সোজা হয়ে বসতে চাইল। পারল না। ঘাড় বাঁকিয়ে প্রায় হাঁটুর কাছে মাথা এনে বসে থাকল। আর্চি উঁকি দিয়ে দেখছে ছোটবাবুকে। ওর হাতে লোহার জালিতে রাবারে মোড়া বালব। সে সেটা ছোটবাবুর মুখের সামনে দোলাচ্ছে।

ছোটবাবু বলল, শুধু ছাই স্যার।

—সাফ করতে হবে ম্যান। সাফ করে দ্যাখো আছে।

এতবড় জায়গায় ছাই তুলতেই বারোটা বেজে যাবে। তারপর কি কাজ আছে বিল্‌জে সে জানে না। ওর দু’পা ক্রমে ছাইয়ের ভেতর বসে যাচ্ছে। বসে যাওয়ায় সামান্য সুবিধা সে পেয়েছে। মাথাটা সামান্য সে তুলতে পারছে। একটা টিনের হাতল এবং বালতি গড়িয়ে দিচ্ছে আর্চি। ওগুলো পরিষ্কার হলে—বাকি কাজের কথা বলবে।

আর একজন হলে কাজটা অনেক সহজে করা যেত। সে ভরে দিত, কেউ তুলে নিয়ে গেলে আর কষ্ট হত না। সে বারবার সন্তর্পণে যখন বালতি টেনে বাইরে বের হয়ে আসছে তখন কোথাও না কোথাও টুটা-ফাটা অ্যাজবেস্টরে লেগে হাত-পা মুখ কেটে যাচ্ছে। আর জ্বালা করছে এভাবে। সে তবু খুব যত্নের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছিল। এবং শরীরে শক্তি পাচ্ছে না। নুয়ে থাকার দরুণ ঘাড় কোমর ধরে যাচ্ছে। ওপাশে আছে একজন ফায়ারম্যান। সে বুঝতেই পারছে না, বয়লারের পেটের নিচে ঠিক ট্যাংক-টপের ওপরে বসে কেউ কাজ করছে। বালতি বালতি ছাই ওপরে জমা করে রাখছে ছোটবাবু। তারপর যখন আর পারছে না চিৎ হয়ে শুয়ে থাকছে ছাইগাদায়। এবং কখন এগারোটা বাজবে, ঠিক এগারোটা বাজলেই ছুটি, সে স্নান করবে, লাঞ্চে যাবে, আজ আবার সে শুনেছে, জ্যাক চলে যাবে বলে, জ্যাকের সম্মানে ডাইনিং হলে ভোজ দিচ্ছেন কাপ্তান। সে যখন গ্যালির পাশ দিয়ে আসছিল তখন অতি উপাদেয় সব সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ পেয়েছে। যেন সে যে এখানে এখন লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, এখানেও সেই ঘ্রাণ, এবং জোরে নাক টানলে সে ঠিক ঠিক টের পাচ্ছে। আর তখনই মনে হল সেই ঘুলঘুলি, সে আবিষ্কার করে ফেলেছে। নাট-বোল্টে মোড়া। প্রায় ডিম্বাকৃতি ঢাকনা।

আর্চি তখন তার টর্চ দুলিয়ে নেমে আসছে।

সে নিচ থেকে দেখতে পাচ্ছে সিঁড়িতে আর্চির পা। আর্চি বাদে আর কে হবে! এনজিন-রুমে এখন কোনো কাজ নেই। টুকিটাকি কাজ কিছু ওপরে আছে। সিলিণ্ডারের কাছে, যেখানে সার্কুলেটিং ফ্যান সিলিন্ডারের মাথার ওপর রয়েছে, সেখানে থার্ড-এনজিনিয়ার মেরামতের কাজ করছে। গোটা এনজিন- রুম ফাঁকা। বন্দরে প্রথম দিন বলে, কোনো কোলবয় অথবা ফায়ারম্যান এনজিন-রুমে মাজা-ঘসার কাজ করতে আসেনি।

আর্চিকে নেমে আসতে দেখে ভীষণ কাজে মনোযোগী হয়ে গেল ছোট। সে আর লম্বা হয়ে শুয়ে নেই। খুটখাট কাজ করছে।

তখন আর্চি বলল, ম্যান ওপেন ইট। বলে সে একটা নাইন-সিকস্টিনথ স্প্যানার ছুঁড়ে দিল। এগারোটার ঘণ্টা পড়ে গেছে। সুতরাং এখন আর কিছু করতে হবে না। আবার লাঞ্চের পর এসে নামবে। তখন আর্চি বলল, ম্যান ওপেন ইট। ম্যান নেমে যাও। বিল্জ-পাম্প কাজ করছে না। নিচে নেমে ডানদিকে ঢুকে একেবারে পোর্ট-সাইডের কিনারায় চলে যাবে।

পেটে ভীষণ খিদে। তবু সে দাঁত শক্ত করে স্প্যানার নাটে বসিয়ে দিল। নাট খুলবে কেন! সেই কত যুগ আগে জাহাজ নির্মাণের সময় যে মুখ বন্ধ করা হয়েছিল বোধ হয় তারপর কেউ আর খোলেনি। নোনা জলে নাট-বোল্ট জাম হয়ে গেছে। জং ধরে এমন হয়েছে যে সে কিছুতেই কিছু করতে পারছে না। নাট-বোল্ট একটা দুটো নয়, চারপাশে ডিমের মতো আকারের ঢাকনার সর্বত্র এই সব নাট-বোল্ট। সে চিজেল আর হাতুড়ী না হলে একটাও খুলতে পারবে না। এবং এত ক্ষিদে পেটে যে এসব কাজ করলে ওর শরীরের সব রক্ত, পেটে কিছু না পড়লে হিম হয়ে আসবে।

সে বলল, একটা চিজেল স্যার।

সেকেণ্ড একটা চিজেল ছুঁড়ে দিল। এত জোরে দিয়েছিল যে সে যদি লুফে না নিতে পারত তবে কপালে এসে পড়ত। আর্চি কি ইচ্ছে করে এমনভাবে ঢিল মেরেছে! সে তো কত সামান্য ওর কাছে। আর্চি সহজেই তাকে অপমান করতে পারে। মা-মাসি তুলে গালাগাল করতে পারে। কপালে চিজেল ছুঁড়ে ওর কি লাভ!

আর্চি বলল,ম্যান কাজ না সেরে ওপরে উঠবে না। বলে সে চলে গেল।

ছোটবাবু শুনল ঢং ঢং করে বারোটা বাজছে। সে গোটা চারেক নাট কেটে কেটে খুলেছে। সে ঘেমে নেয়ে গেছে। ওর সাদা বয়লার স্যুট এখন আর সাদা নেই। জল-কাদায় মাখা সারা বয়লার স্যুট, হাতে, মুখে, মাথায় সর্বত্র, তেল চিটচিটে রং ধরেছে। এবং সে জানে সবাই স্নান করে ডাইনিং হলের দিকে হাঁটছে। এমন একটা সুন্দর ভোজে সে থাকবে না। সবাই গল্পগুজব করে খাবে—সে থাকবে না।

সে নামার আগে দেখেছে ডাইনিং হলটা আজ একেবারে নতুন করে সাজানো হয়েছে। প্রত্যেকের টেবিলে দামী গোলাপের গুচ্ছ। সবাই দামী পোশাকে একেবারে পরিপাটি মানুষের মতো খেতে যাবে। সে তখন কাজ করছে নিচে। জ্যাকের বিদায়-উৎসবে সে থাকবে না। ওর কেমন চোখ ফেটে জল আসতে থাকল। জ্যাক চারটায় জাহাজ থেকে নেমে যাবে। যা কাজ কি মর্জি আর্চির কে জানে, তাকে আর ওপরে উঠতে দেবে কিনা এখন এবং সে যদি না খেয়ে থাকে একমাত্র ডেবিড খোঁজ নেবে। কাপ্তান লক্ষ্য করতে নাও পারেন—ওর মন ভাল নেই! ছেলেটাই একমাত্র সম্বল, তাকে পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে—বোধহয় জ্যাক আবার কি বিপদে ফেলে দেবে কাপ্তানকে সেই ভয়ে আর না পাঠিয়ে থাকতে পারছেন না। সে আর একটা নাট কেটে ফেলার জন্য নুয়ে খুব জোরে যেই না হাতুড়ির ঘা বসাতে গেছে—অমনি ফসকে একেবারে বুড়ো আঙুলের ওপর। গোটা হাতটা মনে হচ্ছিল অবশ হয়ে আসছে। কেউ নেই। সে আঙুল ধরে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর রাগে দুঃখে দমাদম বকসে হাতুড়ি দিয়ে মারতে থাকল। যেন তার এত দিনের ক্ষোভ এই মুহূর্তে আগুনের ফুলকির মতো চারপাশে ছিটকে পড়ছে।

জ্যাক সবচেয়ে রঙ্গীন পোশাক পরতে পারত আজ। সবচেয়ে জমকালো পোশাক। কিন্তু তার কিছুই ভাল লাগছে না বলে যেমন সে অন্যদিন পোশাক পরে থাকে আজও তেমনি সাদাসিদে পোশাকে দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। হিগিনস মেয়ের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন বনি ভীষণ সহজভাবে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরের রিক্ততা বাবা টের পাক সে চায় না।

বনি বলল, চল বাবা।

সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে দেখল, অন্য সবাই ওদের জন্য প্রতীক্ষা করছে। প্রায় প্যারেডের মতো আগে হিগিনস পরে জ্যাক তারপর চিফ-মেট, আর্চি, থার্ড এনজিনিয়ার, ডেবিড এবং ক্রমে লাইন বেঁধে হেঁটে হেঁটে সবাই যাচ্ছিল তখন মাত্র একজন নেই। ছোটবাবুকে না দেখে জ্যাক মনে মনে যে ভীষণ ভেঙ্গে পড়ছে—কাউকে বুঝতেই দিচ্ছে না। ছোটবাবু বলে জাহাজে কেউ আছে সে যেন জানে না। এত বেশি হাসি খুশি এবং এমন মেজাজ শরিফ মনেই হয় না সে একমাত্র একজনের জন্য এত সব করেছিল!

স্টুয়ার্ড, কাপ্তান-বয়, মেস-রুম বয় এবং অন্য বয়-বাবুর্চিরা ঝকমকে পোষাকে যাওয়া-আসা করছে। রেডিওগ্রামে বাজনা বাজছে। নীল আলো এবং বর্ণমালা সব কাগজের ফুলের। যেন একটা ক্রীসমাস উৎসব এই জাহাজে। তখন জাহাজের তলায় কেউ রাগে ক্ষোভে দমাদম বয়লারের পেটে ঘা মারছে বোঝাই যাচ্ছে না।

কাপ্তান নিজে দাঁড়িয়ে সবাইকে বসতে অনুরোধ করলেন। একটা মাত্র আসন এক কোনায় খালি থাকছে। মনে হল একজন আসে নি। সে না এলে তিনি যেন বসতে পারেন না। চিফমেটও দেখল ছোটবাবুর আসন খালি। তিনি ডেবিডের দিকে তাকালেন। এটা ভীষণ বেয়াদপী ছোটাবাবুর —সময়- জ্ঞান ছেলেটার ভীষণ কম। কাপ্তান অপেক্ষা করছেন এবং চিফ-মেট নিজে দরজার বাইরে এসে এলি- ওয়েতে লক্ষ্য রাখছেন—ডেবিড বুঝতে পেরে বলল, স্যার, ছোটবাবু তো কেবিনে নেই। দু’বার খোঁজ করেছি। সে যে কোথায় বুঝতে পারছি না।

আর্চি চুরি করে তখন জ্যাককে দেখছে। জ্যাক, আর্চি এবং অন্য সবাই দাঁড়িয়ে আছে। হিগিনস না বসলে ওরা কেউ বসতে পারছে না। আর্চি শেষ পর্যন্ত যেন কৈফিয়ত দেবার মতো বলল, ছ- নম্বর নিচে আছে স্যার। বিজে জল উঠে আসছে। পাম্প কাজ করছে না। সারভিস পাম্প চালিয়ে দেখা হয়েছে। কেবল হাওয়া টানছে।

হিগিনিস জানেন এনজিনের জরুরী সব কাজের দায়িত্ব এখন আর্চির। এনজিনের ভাল মন্দ সব ওর জিন্মায়। সুতরাং তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। তারপর চড়া সুরে বাজনা বাজতে থাকল। টেবিলে সাজানো সব রঙ-বেরঙের খাবার। আস্ত চিকেন টার্কি এবং ভেড়ার বাচ্চার রোস্ট—দামী মদ।

হিগিনস দাঁড়িয়ে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা করছেন। জ্যাক চলে যাবে বলে মন খারাপ বুঝতে দিচ্ছেন না। জ্যাক চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছিল। বাবা সবই বাইবেল থেকে যেন পড়ে শোনাচ্ছেন। মানুষের ইতিহাস, বিশেষ করে সমুদ্রে মানুষ কত অসহায় এ-সব বলছিলেন। যেন তিনি বক্তৃতা শেষ করে বলতে চাইলেন—যতক্ষণ বেঁচে থাকো ঈশ্বরের পৃথিবীতে—খাও দাও, কাজ করো। আর আনন্দ করো। মানুষ এ-ভাবেই তার জীবন শেষ করে দেয়।

জ্যাক ভেতরে ভেতরে হাহাকারে ভুগছে। এতসব জাঁকজমকের ভেতর ছোটবাবু নেই। আর্চি তাকে বন্দী করে রেখেছে জাহাজের তলায়। ছোটবাবু খেতে খুব ভালবাসে। সে দেখেছে ছোট ভাল খাবার পেলে ভীষণ খুশী হয়ে খায়। ছেলেমানুষের মতো কোনটা আগে খাবে ঠিক করতে পারে না। কখনও কখনও দেখেছে ছোটবাবু টেবিলের নিয়মকানুন ভেঙ্গে নিজের খুশিমতো খেয়ে উঠে গেছে। কতদিন দেখেছে, ডেবিড এই নিয়ে পেছনে লেগেছে, ছোটবাবুকে এত করেও টেবিল ম্যানার্স শেখাতে পারেনি। আসলে ছোটবাবু খাবার লোভে পড়ে গেলে কাঁটা চামচের ব্যবহার একেবারে ভুলে যায়। সেই প্রাচীন মানুষের মতো দু’হাতে নিয়ে আকণ্ঠ পান করে। জ্যাক যত এ-সব মনে করতে পারছে তত হাহাকারে ভুগছে। সে একটা কথাও বলতে পারছে না কারোর সঙ্গে।

কিন্তু কথা না বললে তো চলবে না। বাবা এইমাত্র তাঁর বক্তৃতামালা শেষ করেছেন। এবার তাকে দুটো একটা কথা বলতে হবে। সে জাহাজের কেউ নয়, কেবল বাবার সঙ্গে সে জাহাজে উঠে এসেছে। এত বড় লম্বা সফরে সে এত বেশি বড় হয়ে গেছে, যে আর বড় না হলেও চলবে। সে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় রহস্যের কথা এখানেই জানতে পেরেছে। সে তার বক্তৃতামালায় এ-সবই বলতে পারত। কিন্তু সে উঠে দাঁড়ালে বুঝতে পারল, মাথা ভীষণ ঝিম ঝিম করছে। কেমন অন্ধকার দেখছে চোখে-মুখে

সে চোখ বুজেই যেন কোনরকমে সব রকমের দুঃখ হতাশা হজম করে শক্ত গলায় বলল, জাহাজে অনেকদিন আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। এবারে চলে যাচ্ছি। যদি সামান্য দোষ-ত্রুটি কোথাও আমার আপনাদের চোখে পড়ে থাকে আশা করি ক্ষমা করবেন। বলেই সে একেবারে সোজা বসে পড়ল। আর একটা কথাও সে যে বলতে পারত না, বলতে গেলে একটা কেলেঙ্কারী করে ফেলত, এবং ধরা পড়ে যেত, এটা সে বসে পড়েই বুঝতে পেরেছিল।

তখন রিনরিন করে বাজনা বাজছে। স্টুয়ার্ড দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার সার্ভিস দেখে মনে হচ্ছে কাপ্তান ভীষণ খুশী। কোথাও কোনো ত্রুটি রাখেনি সে। কিন্তু সে দেখল, কাপ্তান আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। খাবার আগে সামান্য সময় ঈশ্বরের নামে মাথা নিচু করে রাখলেন। ওঁর দেখাদেখি সবাই মাথা নিচু করে রাখল। তারপর তিনি সবার দিকে তাকিয়ে কি দেখলেন শেষে বললেন, কিছু খবর আপনাদের জানা দরকার মনে করছি। আমাদের জাহাজ এখন এক বছরের মতো সাউথ-সিতে ঘোরাফেরা করবে। আমরা মাটি টানার কাজে সেই-সব দ্বীপগুলোতে ফের চলে যাব।

সেইসব দ্বীপগুলো বলতে ওরা বুঝতে পারছে কোন সব দ্বীপ। কাপ্তান আর কিছু ভেঙ্গে বলবেন না ওরা বুঝতে পারছে। এমন একটা সময়ে এ-সব খবর দিচ্ছেন কেন কাপ্তান—ওরা বুঝতে পারছে না, এমন সব দামী খাবার টেবিলে, খাবার থেকে ধোঁয়া উঠছে—চারপাশের সবকিছু যখন ভীষণ মনোরম তখন তিনি কেন যে একটা এমন দুঃসংবাদ দিচ্ছেন। কারণ এটা দুঃসংবাদই বটে। ভাঙ্গা জাহাজে আরও এভাবে এক বছর ঘুরলে নির্ঘাত কেউ আর দেশে ফিরতে পারবে না।

কারণ এদের সবার জানা আছে, বড় বড় বন্দরে জাহাজ যায় না। ছোট ছোট বন্দরে কেউ খবর রাখে না—কি আছে জাহাজের কি নেই। বেশ যখন আছে, পত পত করে কার্সি ফ্ল্যাগ উড়ছে, তখন উড়তে দাও। বড় বড় বন্দরে সে-সব চলবে না। সার্ভে থেকে গণ্ডগোল বাধাবে। এবং কাপ্তান সব জেনে-শুনে এতগুলো জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। সামান্য ছোটখাটো মেরামত চলবে—বড় ধরনের মেরামত—যেমন এক্ষুনি আর্চি চিৎকার করে বলতে পারে—স্যার বয়লার চকের অবস্থা ভীষণ খারাপ। বয়লার-চক মেরামত করতে হলে ঠিক বড় বন্দরে দু-তিন মাস জাহাজ বসিয়ে দিতে হবে। এবং যখন সার্ভে থেকে লোক এসে দেখবে—ঠুকে ঠুকে দেখবে—বলবে, আরে এতো আর জাহাজ নেই মরে কবে ভূত হয়ে গেছে তখন কোম্পানীর ঘরে আর্চির নাম অনেক পেছনে চলে যাবে। সুতরাং সবাই এখন মুখ বুজে সব শুনে যাচ্ছে। কোনো প্রতিবাদ করতে পারছে না।

তারপর কাপ্তান সবাইকে বললেন, আপনারা বসুন। এবং কোনো শ্রেণীকক্ষে যেন তিনি দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছেন—এই যে জাহাজ সিউল- ব্যাংক—এতদিনের সফরে আপনারা তাকে আর নাও ভালবাসতে পারেন। দেশে ফেরার জন্য আপনারা এখন সবাই উদগ্রীব বুঝতে পারি—কিন্তু কোম্পানীর ক্ষতি হোক আমরা কিছুতেই চাই না। এতে আমাদের সুবিধা হবে না। আমরা যখন খেটে খাওয়া লোক—কোম্পানীর ভালমন্দের ওপর আমাদের জীবন, তখন আশা করি চোখ বুজে আমরা ঠিক সমুদ্রে একটা বছর কাটিয়ে দিতে পারব। বলেই তিনি কি ভাবলেন, মেয়েকে দেখলেন। জ্যাক একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছে না, বাবা এখন এ-সব কথা বলছেন কেন। সে দেখল, তখন বাবা আবার বলে যাচ্ছেন—

স্যালি হিগিনস গীর্জার পাদ্রীর মতো গাঢ় গলায় বললেন, জাহাজ এবং সমুদ্র সম্পর্কে কিছু কথা আপনাদের খুলে বলতে চাই। তিনি একটু নুয়ে এবার টেবিলের ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালেন, কাঁধে ওর সোনালী স্ট্রাইপগুলো খুব ঝক ঝক করছে। নীল রঙের স্যুট এবং মাথায় টুপি থাকলে পুরোপুরি ইউনিফরমে থাকতেন। তিনি মাথায় একবার হাত বুলালেন এবং যেমন দাঁত ঠেলে ওপরে তুলে দেন তেমনি দিয়ে কথাবার্তা শুরু করার সময় বললেন, জাহাজ সিউল-ব্যাংক আর দশটা জাহাজের মতো নয়। সবার ভেতরে একটা গুঞ্জন উঠছে। কেউ অবশ্য জোরে প্রতিবাদ করতে পারছে না। যেন বলার ইচ্ছে, আমরা বার বার এক কথা শুনতে চাই না।

তিনি বললেন, সিউল-ব্যাংক গেটস হার পোর্ট ইন টাইম।

তিনি বললেন, বেশ জোর দিয়ে বললেন, ভেরি ফেথফুল। ভেরি ভেরি ফেথফুল সি ইজ। সবাই বুঝতে পারল কাপ্তান সিউল-ব্যাংকের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে বলছেন।

তিনি বললেন, এটা আমার বিশ্বাস, যতই সে মরে ভূত হয়ে যাক আপনারা জানেন, সামান্য থেমে তিনি একটু মুচকি হেসে বললেন, সার্ভে থেকে আমাদের জাহাজটার অস্তিত্ব অনেক ক’ বছর আগেই বেমালুন ধুয়ে মুছে গেছে। আপনাদের কে ছিল সেই উনিশশো সাতচল্লিশে, কেউ ছিলেন আপনারা? ডেবিড উঠে বলল, আমি ছিলাম স্যার।

তিনি বললেন, মনে আছে ইস্টার আয়ল্যাণ্ডের কাছে ভীষণ নিম্নচাপের ভেতর পড়ে গেছিলাম। সেই ঘূর্ণিঝড়ের কথা তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে ডেবিড, পানামা থেকে চারটা জাহাজ, পর পর, সব আধুনিক জাহাজ—তোমার তো মনে আছে ডেবিড, আমরা প্রায় একই লংগিচুড, ল্যাটিচুডে রান করছি—তিনটে জাহাজের একটাও পার পায়নি, কারও ব্রীজ উড়িয়ে নিয়েছে, একটা জাহাজ তো ডুবেই গেল—কি অন্ধকার আর বজ্রপাত, বোধহয় এনজিনে বজ্রপাতেই জাহাজটা ডুবেছিল—আর কি হতে পারে, আমরা তো ঘণ্টা তিনেকের ভেতর পৌঁছে দেখলাম পৃথিবী কালো করে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা। সমুদ্রের রং সাদা এবং কুয়াশার মতো দিকচক্রবাল—কুটোগাছটি খুঁজে পাইনি—বাট দ্য সিপ এস এস সিউল-ব্যাংক মুভস অন।

তারপরই কিছুটা নাটকীয় ভঙ্গীতে বললেন, তথাপি এই জহাজ কিন্তু কারো অপরাধ ক্ষমা করে না। জাহাজের নাবিকগণ আপনারা মনে রাখবেন, সমুদ্রে কোন পাপ কাজেরই ক্ষমা নেই। আমার বয়স হয়েছে, এখন এটা আমি বুঝতে পারছি। আপনারা অনেকে এখনও যুবক আছেন, অথবা বয়স আপনাদের বাড়ছে, আপনারা সংস্কার ভেবে সব উড়িয়ে দিতে পারেন, কিন্তু বয়স বাড়লে এটা আপনিও বুঝতে পারবেন। আসলে কি কাপ্তান এতক্ষণ এত কথা আৰ্চিকে উদ্দেশ্য করে বলছেন। আর্চি গতকাল লেডি-এ্যালবাট্রসকে হত্যা করতে চেয়েছিল।

আর্চি, তখন মুখের চারপাশে হাত বুলিয়ে দেখছে। যেন বুঝতে পারছে দাগগুলো ক্রমে আরো প্রকট হয়ে উঠছে। ভেতরে তখন তার প্রতিশোধের স্পৃহা বেড়ে যায়। আর্চির মুখ থমথম করছে।

এবং এভাবেই কিছুটা এলার্মিং বেল বাজিয়ে দিয়ে কাপ্তান স্যালি হিগিনস বসে পড়লেন। সবাই যে যার ন্যাপকিন হাঁটুতে বিছিয়ে নিয়েছে। সবাই প্রায় উপুড় হয়ে পড়েছে। দু’একজনের ফিস ফিস গলায় কথা, কাপ্তানের বুড়ো বয়সে, নাতির বয়সী ছেলেকে নিয়ে দুটো একটা রসিকতা। খুব আস্তে আস্তে চিবিয়ে চিবিয়ে এ সব কথাবার্তা যখন চলছিল, তখন জ্যাক ভীষণ ঝুঁকে আছে টেবিলে। কি খাচ্ছে, কি খাচ্ছে না সে বুঝতেই পারছে না।

ডেবিড বুঝতে পারছে না, এভাবে এমন একটা সুন্দর লাঞ্চের সময় কাপ্তান এলার্মিং বেল বাজিয়ে দিলেন কেন? লেডি অ্যালবাট্রসের কথা ভেবে, না অন্য কোন দূরবর্তী বিদ্রোহের আশঙ্কার কথা ভাবছেন তিনি। অর্থাৎ মিড্‌-সিতে যদি শেষ পর্যন্ত কিছু হয়ে যায়—কারণ জানা আছে, সেই প্রাচীনকাল থেকে—নাবিকেরা দীর্ঘদিন সমুদ্রে ঘুরতে ঘুরতে পাগল হয়ে যায়—তারা ডাঙ্গায় ফেরার জন্য যে কোনো ইতর কাজ করে ফেলতে পারে। এবং পুরো এক বছর—মাটি টানার কাজ, সব খাবার ভেতর থেকে উঠে আসছে। কাপ্তান প্রথম থেকেই এলার্মিং বেল বাজিয়ে দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিলেন। জ্যাককে নামিয়ে দিয়ে তিনি নিজে ঝাড়া হাত পা হয়ে যেতে চান

এবং এটা ডেবিডের কাছে ভীষণ স্বার্থপরতার ব্যাপার মনে হল। জীবন বলতে একমাত্র জ্যাক, আর সবাই যেন সিউল-ব্যাংকের কলকব্জা। স্ক্রু-নাট-বোল্টের সমান। জাহাজের সঙ্গে তাদের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। ডেবিডের খেতে ভাল লাগছে না।

আর ছোটবাবু না থাকায় ডেবিড কেমন ভালভাবে খেতে পারছে না। ছোটবাবুকে আর্চি নিচে এত কি জরুরী কাজ দিয়ে রেখেছে—একবার সে ভাবল খেয়ে উঠে দেখে আসবে।

এবং যখন সে নেমে গেল নিচে, দেখল কোথাও ছোটবাবু তখন নেই। সে মেন-জেনারেটারের পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, ছোটবাবু!

কেউ সাড়া দিচ্ছে না।

সে পোর্ট-সাইডের বয়লারের পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, ছোটবাবু! কেউ সাড়া দিচ্ছে না।

সে এভাবে প্রপেলার-শ্যাফট পার হয়ে গেল এবং ছোটবাবুর নাম ধরে ডাকলে কেবল গমগম করছে এনজিম-রুম। সব কলকব্জা বন্ধ জাহাজের। কেবল বিজ-পাম্প চলছে। তার কিট কিট সামান্য শব্দ। আর শব্দ বলতে দুটো একটা কক ফ্যাচ ফ্যাচ করছে। সামান্য স্টিম বের হচ্ছে ককের মুখ থেকে। এমন কি এনজিন-রুমে কেউ কাজ করছে না। একেবারে ফাঁকা। ছোটবাবু তবে কোথায়!

আর্চি ছোটবাবুকে এভাবে কেন জব্দ করছে বুঝতে পারছে না। আর্চি অমানুষের মতো ব্যবহার করছে ছোটর সঙ্গে! সে সিঁড়ি ধরে ওঠে যাবার সময় দেখল, থার্ড, এনজিনের ফিল্টার খুলছে। একেবারে ওপরে। সার্কুলেটিং ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে কাজ করছে। সে বলল, থার্ড, ছোটবাবুকে দেখেছ?

সে বলল, ছোটবাবু তো নিচে কাজ করছিল।

–নেই

–তবে বোধহয় ওপরে উঠে গেছে।

তখন জ্যাক খুব স্বাভাবিক গলায় শিস দিচ্ছে ফানেলের গুড়িতে। চারপাশটা সে দেখছে। সে এবার নিচে নামবে। খুব সন্তর্পণে নামতে হবে। বাবা দেখে ফেললে টের পেয়ে যাবেন। সে এভাবে শিস দিয়ে যেন বোঝাতে চাইছে—ছোটবাবু বলে এ-জাহাজে সে কাউকে চেনে না।

যখন দেখল, কেউ নেই এবং এবারে নামা যাবে—সে টুপ করে সিঁড়িতে নামতে নামতে প্ৰায় অদৃশ্য হয়ে গেল বোট-ডেক থেকে। সে ক্রমে সিঁড়ি ধরে নেমে যেতে থাকল। দেখলে মনেই হবে না আর জ্যাকের উঠে দাঁড়ারার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই। সে দ্রুত লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে গেল। তাকে ফের তাড়াতাড়ি উঠে যেতে হবে। ব্রীজে বাবা এখন জাহাজের অন্য অফিসারদের সঙ্গে কথা বলছেন। সকালে তিনি তাঁর সব গোছগাছ করে দিয়েছেন। এখন আবার নেমে এসে কি কি বাকি থাকল সব দেখেশুনে একেবারে ঠিকঠাক করে বিদায়ের আগে যেমন হাত তুলে দেওয়া, বাবা তেমনি সময় হলে হাত তুলে দেবেন। আর তখনই তাকে এজেণ্ট-অফিসের লোকদের সঙ্গে নেমে যেতে হবে।

ঘুরে ঘুরে সিঁড়িটা যত নামছে তত তার বুক কাঁপছে। সে আরও নিচে নেমে গেল। বয়লার রুম পার হয়ে এনজিন-রুমে ঢুকে গেল।

সে ডাকল, ছোটবাবু!

কেউ সাড়া দিচ্ছে না।

সে ডাকল, ছোটবাবু আমি এখন চলে যাব, তুমি কোথায়?

না, কেউ সাড়া দিচ্ছে না।

—ছোটবাবু! সে প্রায় ফিসফিস গলায় ডাকছে। জোরে ডাকলে ওপরে থার্ড আছে, শুনতে পাবে।

থার্ড অনেক উঁচু থেকে বলল, হ্যাল্লো!

জ্যাক খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যাল্লো। কোনো উদ্বিগ্নতা নেই গলায়। যেন জাহাজ থেকে নেমে যাবার আগে ঘুরে ফিরে এনজিন-রুমটা দেখছে।

থার্ড বলল, কি মজা! তুমি হোমে ফিরে যাচ্ছ।

জ্যাক বলল, ভীষণ মজা। হোমে ফিরে যাচ্ছি। কথা বলছে আর সন্তর্পণে দেখছে সে কোথায়! ওদিকটায় থাকতে পারে। ওখানে একবার আর্চি ছোটবাবুকে ট্যাংকের ভেতরে নামিয়ে দিয়েছিল। না ওখানে নেই। থাকলে প্লেট তোলা থাকত।

ছোট্ট জ্যাক এখন দানবের মতো এনজিনের চারপাশে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে একটা পুতুলের মতো হেঁটে বেড়াচ্ছে যেন। তার কেমন চোখ-মুখ সাদা হয়ে যাচ্ছে। সে ঝুঁকে কখনও টানেল-পথে নেমে, কখনও সিঁড়ি ধরে ওপরে ওঠে, স্মোক-বকসের ভেতর যদি এবং এভাবে সে আবার নিচে ঘুরে ঘুরে স্টারবোর্ডের ভেতর ঢুকে যেতেই দেখল, বয়লারের পাশে ছোটবাবুর তেলের টব, বালতি। ছোটবাবু ঠিক এখানে কোথাও আছে। সে খুব সন্তর্পণে ডাকল, ছোটবাবু, আমি চলে যাচ্ছি। তোমার এখনও কাজ শেষ হল না!

না, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। সে ফের বলল, ছোটবাবু, তুমি কী মানুষ না ছোটবাবু! আমি চলে যাব, এখনও তোমার কাজ শেষ হচ্ছে না! সে বয়লারের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে খুঁজল। ডাকল ফের, ছোটবাবু, তুমি কোথায়?

আর তখনই আশ্চর্য ফ্যাসফ্যাসে গলার আওয়াজ। শীতে ঠাণ্ডা লেগে ভেঙ্গে গেলে যেমন হয়ে থাকে অথবা মনে হয় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে কেউ নিচে বোধহয় প্রাণপণ ওপরে উঠে আসার জন্য লড়াই করছে।

জ্যাক পাগলের মতো হয়তো চিৎকার করে উঠত ভয়ে। কিন্তু সে তো ছোটবাবুকে ভালবাসে না। সে তো ভেবেই নিয়েছে, ছোটবাবুর কথা আর ভাববে না। তবু চলে যাবার আগে সে একবার দেখা করে যেতে চায়। কিন্তু ছোটবাবু কি উঠতে পারছে না! উপরে উঠতে এত দেরি করছে কেন ছোটবাবু! ছোটবাবু কি এভাবে বিজের ভেতর পড়ে থেকে একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে! আর তখন মাথায় কি যে হয়ে গেল তার। সে দ্রুত ছুটে গেল ওপরে সিঁড়ি বেয়ে। ওপরে উঠে বলল, বাবা সবাইকে ডাকো। এবারে আমি যাব।

তখন সব ঘরে খবর পৌঁছে গেল। জাহাজের ছোটসাব নেমে যাবে। সবাইর সঙ্গে নেমে যাবার আগে দেখা-সাক্ষাতের পালা প্রায় যেন ঐতিহাসিক ঘটনার মতো সবাই যে যার ভাল পোশাকে ওপরে উঠে যাচ্ছে। নিয়মমাফিক ছোটবাবু হাজিরা না দিলে আর্চির গাফিলতি—আর্চির অধীনে একটা ছোট ছেলে ছোকরা কাজ করে, নিয়ম-কানুনের ধার ধারে না, বেয়াদপ। এবং আর্চি নিজে নেমে এসে ডাকল, হেই বাস্টার্ড। ওপরে যাও, পোশাক পাল্টে বোট-ডেকে যাবে।

তখন ছোটবাবু প্রায় কোনরকমে সিঁড়ি ভেঙে উঠছিল। রাস্তায় দেখা কাপ্তান-বয়ের সঙ্গে। আপনার বড় দেরি, জলদি যান। ছোটসাব চলে যাচ্ছে। ছোটবাবু আর পারছে না। শীতে সে হি হি করে কাঁপছে। সে ওপরে উঠে যাচ্ছে। ফানেলের গুঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে। উঠেই দেখল সবাই এসে গেছে। চিফ-মেট, সেকেণ্ড-মেট, ‘থার্ড-মেট, রেডিও-অফিসার এবং এনজিনের সবাই। ডেবিড চেঁচাচ্ছে—ছোটবাবু, শিগগির নিচে নেমে যাও। এটা কি হয়েছে তোমার! কোথায় ছিলে? তোমাকে ভীষণ কুৎসিত দেখাচ্ছে।

ছোটবাবু কোনও কথার জবাব দিতে পারছে না। জামা-প্যান্ট জবজবে ভেজা। ভীষণ ঠাণ্ডা হাওয়া সমুদ্র থেকে উঠে আসছে। গরম দেশের মানুষ ছোটবাবু, শীতে একেবারে চোখ সাদা হয়ে গেছে। আর কালো ধূসর। যেন ভূতের মতো সে একটা ডামি। ফানেলের গুঁড়িতে পোকামাকড়ের মত লেপ্টে আছে। নিচে নেমে সাফসোফ হয়ে আসতে অনেক সময়। জ্যাকের সঙ্গে তবে ওর শেষ পর্যন্ত দেখাই হবে না। সে শীতে হি হি করে কাঁপতে থাকল।

আর্চি হিংস্র বাঘের মতো ক্ষেপে যাচ্ছে। যেহেতু ওপরে কাপ্তান, চার্ট-রুমের পাশে জ্যাক, আর ফানেলের গুঁড়িতে বাস্টার্ড ছ’নম্বর। সব মিলে ওকে ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে। কাপ্তান অথবা জ্যাক না থাকলে পাছায় একটা লাথি মারতে পারত। এভাবে তাকে অন্তত অপ্রস্তুত করতে পারত না ছ-নম্বর।

জেটিতে তিনটে মনোরম দামী গাড়ি। একটাতে জ্যাক এবং কাপ্তান নিজে থাকবে। দু-নম্বর গাড়ি এজেণ্ট-অফিসের খোদ কর্তার, তিন-নম্বর গাড়ি খালি। কেউ সঙ্গে গেলে যেতে পারে।

জ্যাকের সেই সাধারণ পোশাক। মনে হচ্ছে জাহাজেই সে আছে; কোথাও যাবার কথা নেই তার। সে খুব ধীরে ধীরে বাবার পেছনে নেমে আসছিল। সবার সঙ্গে হ্যাণ্ড-শেক করার একটা ব্যাপার রয়েছে। আসলে সে দূর থেকেই দেখে ফেলেছে। সে দেখে আর এক পা নড়তে পারেনি। মূর্তিমান ভূতের মতো ছোটবাবু ফানেলের গুঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। শীতে কাঁপছে আর ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে। হেসে দু’হাত তুলে বিদায় জানাচ্ছে। দু’পাটি উজ্জ্বল সাদা দাঁত কেবল জ্যাক দেখতে পেল। একজন মানুষের অবয়বে এভাবে ক্রমান্বয়ে নিষ্ঠুরতার দাগ, এবং এই মানুষ অতীব সরল, যেন কিছু আসে যায় না, শীতে দাঁড়াতে পারছে না দাঁত ঠকঠক করছে, ঠোঁট বরফের মত সাদা, তবু অকপট সরল হাসিটুকু লেগে রয়েছে ঠোটে। যেন সেই এক জোকার হাসি ঠাট্টায় সব দর্শকদের উত্তেজিত করে রাখছে, নিজে মরে যাচ্ছে টের পাচ্ছে না।

এবং জ্যাক বোধহয় এভাবে বুঝতে পারে, ছোটবাবুর ভেতরে রয়েছে এক আশ্চর্য দুঃখী মানুষ। সেই দুঃখী মানুষটির সঙ্গে অন্তত নেমে যাবার আগে একবার দেখা হোক সে চেয়েছিল, সে জানত এই দুঃখী মানুষকে আর্চি বাঘের মতো থাবায় খেলাবে। যত দিন যাবে আর্চির থাবা হিংস্র হয়ে উঠবে। তবু সে স্থির ছিল, কিছুতেই ভেঙ্গে পড়বে না। স্থির ছিল, ছোটবাবুকে সে ভুলে যাবে। কিন্তু ক্রমে কি যে হয়ে যায়, দূর থেকে একজন সাধারণ জোকার, কত উঁচু ফানেলের গুঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাত তুলে দিতে পারে, কত কষ্টের ভেতরও অকপটে হাসতে পারে তখন সে তো সামান্য জ্যাক। সেও সবার দিকে হাত তুলে দিল। কিছুটা বিদায়ের ভঙ্গীতে। ওদের দিকে সে আর এক পা হেঁটে গেল না। সে কেবিনের দিকে ফিরে যেতে থাকল।

কাপ্তান সারাদিন অস্বস্তিতে কাটিয়েছেন। কোনো রকমে ওয়েলিংটন পর্যন্ত গাড়িতে নিয়ে যেতে পারলে ভাবনা থাকবে না। বনিকে তিনি সুন্দর সুন্দর পোশাক কিনে দেবেন। দু-চারদিন বনির সঙ্গে থাকবেন। মেয়েদের পোশাকে বনি তখন এত বেশি উৎফুল্ল হয়ে যাবে যে মনেই থাকবে না তার বুড়ো বাপ জাহাজে কাজ করে। এবং বুঝতে পারেন সুন্দর পোশাকে বনিকে দু-দণ্ড একা থাকতে হবে না। সে তার ঠিক নিজের মতো কাউকে খুঁজে পাবে। খুঁজে পেলে সত্যি বনি আর বুড়ো বাপকে মনে রাখতে পারবে না।

আর তখন তিনি কেমন হতবাক। বনি কেবিনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। কেবিনের দিকে ফিরে যাচ্ছে বনি। কেবিনে বনির কিছু পড়ে নেই তো! তাছাড়া মেয়েদের কোথাও যাবার আগে কাজ থাকে কিছু। ভাবলেন, বনি এক্ষুনি ফিরে আসবে।

বেশ সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তিনি বার বার ঘড়ি দেখছেন। এত সময় লাগার কথা না। তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখলেন বনি দরজায় ঠেস দিয়ে কেমন স্থির উদাস চোখে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি এত কাছে, তাঁকে যেন বনি দেখতেই পাচ্ছে না। হঠাৎ কেমন ভয় পেয়ে ডাকলেন, বনি!

বনির মনে হল কেউ তাকে ডাকছে। সে দেখল বাবা সামনে। বাবাকে দেখেই মনে হল কোথাও তার যাবার কথা। সে ভেতর থেকে তখন এক কঠিন দুঃখ সামলে নিচ্ছিল। স্থির নিশ্চিত গলায় এবং খুব শান্তভাবে বলল, আমি যাব না বাবা, তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।

–কি বলছিস বনি! সবাই অপেক্ষা করছে।

–তুমি ওদের চলে যেতে বল বাবা। তোমাকে ছেড়ে থাকলে আমি মরে যাব বাবা। একেবারে শিশুর মতো বনি বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।

তিনি নিজে এখন কি করবেন বুঝতে পারছেন না। দূরে ওরা দাঁড়িয়ে আছে। নিচে এজেণ্ট-অফিসের বড় কর্তা। সব ঠিকঠাক। বনি কাঁদছে। কতদিন যেন বনি এভাবে কাঁদেনি। তিনি সেই কবে যেন মনে করতে পারছেন না বনি ওঁর বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদত। এবারে মনে করতে পারছেন। বনি ওর মা চলে যাবার পর এভাবে ওর বুকে মুক লুকিয়ে কাঁদত। আর বলত বাবা আমি মা’র কাছে যাব। আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চল। এবং এভাবেই মনে হয়—তিনিই সব দুঃখের মূলে। বনিকে তিনি আর একটা শক্ত কথা বলতে সাহস পান না। এবং যেন এই মেয়ে এখন জোরে জোরে চিৎকার করে বলতে পারে বাবা, আমি কি অপরাধ করেছি যে জাহাজ থেকে তুমি আমাকে নামিয়ে দিতে চাইছ।

তিনি ধীরে ধীরে বোটডেকে-হেঁটে গেলেন। কারও দিকে তাকালেন না। কেমন মাথা নীচু করে রাখলেন এবং বলে গেলেন বন্ধুগণ আপনারা যান। জ্যাক জাহাজে থাকবে। এই ভাঙ্গা জাহাজে জ্যাক থাকছে। আপনারা আমাকে আর নিশ্চয়ই স্বার্থপর ভাববেন না।

তারপর ফের তিনি চিৎকার করে উঠলেন, হেই, হেই সেকেণ্ড। সেকেণ্ড বললেই সবাই বুঝতে পারে তিনি আর্চিকে ডাকছেন। ডেবিডকে ডাকলে তিনি বলতেন হেই সেকেণ্ড-মেট। তিনি আর্চিকে বললেন, বন্দুকটা আমার কেবিনে রেখে আসবে। ওটা আর ধরবে না। আর যখন আর্চি বন্দুকটা দিতে এসেছিল, তিনি ক্রোজ-নেস্টের একটা ঝুলন্ত বালব দেখিয়ে বললেন, হাতের টিপস্ দেখবে, বলেই বালবটা ক্রোজ-নেস্ট থেকে গুলিতে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, কি মনে হচ্ছে। হাত ঠিক আছে তো!

তারপর থাকে সেই দ্বীপ সমুদ্র আর মানুষের অন্তহীন রহস্য। জাহাজটা আবার কবে সমুদ্রে যাত্রা করবে, এবং কি সব অঘটনের অপেক্ষায় আছে কেউ জানে না। তবু দেখা যায় জাহাজের মাস্তুলে কার্সি ফ্ল্যাগ উড়ছে। আর বনির পোর্ট-হোলে কত সব অপার্থিব নক্ষত্রমালা। ছোটবাবুর মুখ প্রতিটি নক্ষত্রে বিন্দু বিন্দু হয়ে জ্বলছে। কোথাকার এক ছোটবাবু জীবনের সব কিছু তার হরণ করে নিয়েছে। সে নিশীথে মানুষটার শুভাশুভের জন্য তার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *