1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৩

।। তিন।।

বারোটা-চারটার ওয়াচ শেষে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠে এল মৈত্র। জাহাজের পিচিঙ ক্রমে বাড়ছে। সমুদ্রে বেশ বাতাস আছে। তবু আকাশ পরিষ্কার থাকলে তেমন ভয় থাকে না। ভয় অমিয় এবং ছোটবাবুকে নিয়ে। এরা দুজনই নতুন। এদের দুজনেরই প্রথম সফর। ছোটবাবু হয়ত পিচিঙ কোন রকমে সামলাবে। কারণ তাকে বাঙ্কারে কাজ করতে হচ্ছে না। কিন্তু অমিয় এ-ওয়াচেই যা দেখাল। সুট খালি পড়ে আছে। বাংকারে সে দাঁড়াতে পারছে না। র‍্যাগ দিয়ে আগুন ফার্নেস থেকে টেনে নামানোর সময় অমিয় জল জল করছিল। একসঙ্গে তিনজন ফায়ারম্যানের আগুন টানার ভিতর বেচারা নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছিল না। ছাই উড়ছে। আগুনের গনগনে উত্তাপ, আর আগুনের ওপর জল ঢেলে দিলে প্রচণ্ড গ্যাস। সে গ্যাসের ভিতর নতুন জাহাজির সাধ্য কি দাঁড়ায়। তার ওপর ইণ্ডিয়ান কোল। একেবারে অসার।

ওপরে এসেই মৈত্র টের পেল অমিয়র কাজ শেষ হয়নি। অমিয়র স্বভাব আগে উঠে ফানেলের গোড়ায় বসে থাকা। কিন্তু সে নেই। আকাশ বেশ মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এ-সব লক্ষণ ভাল না। ঝড় অথবা সাইক্লোনের লক্ষণ। এমনিতেই রক্ষা নেই, ঝড়ের ভিতর যে অমিয়টা কি করবে! পাশের বাংকারের কোলবয়, বয়সী মানুষ। তার এই নিয়ে এগারো-সফর। সে সব কায়দা-কানুন জানে। সে জানে ওয়াচের পরও কাজ করতে হবে। অন্ততঃ এক ঘণ্টা এক নাগাড়ে ওয়াচের পর কাজ না করলে সুট ভরতে পারবে না। অথবা সে এমন ভাবে এক নাগাড়ে কাজ করে যায়, কোন তাড়াহুড়ো নেই আবার আস্তেও নয়, সে বেশ সোজা সরলভাবে কাজটাকে নিয়ে ফেলেছে। বয়স হলেও মানুষটা কয়লা টানার কষ্ট গ্রাহ্যের ভেতর আনে না। সফরের অভিজ্ঞতায় সে সি-সিকনেস হজম করে ফেলেছে।

মৈত্র, বড়-টিণ্ডাল বলে ওয়াচের দায়-দায়িত্ব তার। স্টিম ঠিক রাখার দায়-দায়িত্ব থেকে সব কিছু। সুট ভর্তি না পেলে পরের ওয়াচের ছোট-টিণ্ডাল অমিয়কে বেগার খাটিয়ে মারবে। ছোট-টিণ্ডালের দলটা নিচে নেমে গেছে। নেমে এখন আগুন টানছে ফার্নেস থেকে। ফার্ণেসের ছাই ঝেড়ে ভেতরে কয়লা হাকড়াবে। এর ভেতর অমিয় সুট ভরে না দিতে পারলে রক্ষে নেই। মৈত্র তাড়াতাড়ি ফের নেমে গেল। ভেতরে একটা লম্ফ জ্বলছে। লম্ফটা আবছা মতো দেখা যাচ্ছে। কয়লার গুঁড়ো উড়ে চার পাশটা ভীষণ অন্ধকার। প্রথমে ঢুকে সে কিছু দেখতে পেল না। তারপর চোখ সয়ে এলে দেখল, কয়লা সুট থেকে বেশি দূরেও না। সুটে কয়লা এনে ফেলছে অমিয় আর মনে হচ্ছে সব কয়লা গড়গড় করে নিচে নেমে যাচ্ছে। সে আপন মনে দুটো একটা খিস্তি করছে। দুটো-একটা অশালিন চিৎকার এবং চোখ লাল, ঘামে ওর জামা-প্যান্ট জবজবে। টুপি ভিজে গেছে। চোখ আগুনের মতো লাল। সে টলছে। ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। বোধ হয় দু-একবার হড়-হড় করে জল খেয়ে বমিও করেছে।

মৈত্র তাড়াতাড়ি নিজেই গাড়িটা টেনে পর পর ক’গাড়ি খুব দ্রুত কয়লা ভরে ফেলে দিল। অমিয়কে বলল, তুই বোস। এভাবে সুট ভরে না। এতক্ষণ কি করছিলি!

ইচ্ছা হল অমিয়র, বেলচে দিয়ে ঠাস করে মৈত্রের মাথায় একটা বাড়ি মারে। সে এতক্ষণ বসেছিল বুঝি মৈত্র মনে করছে। সে বলল, টিণ্ডাল, তোমাকে কে আসতে বলেছে! যাও শালা। ভাগো। আর্মার কাজ আমি যেভাবে পারি করব। কাউকে ডাকি নি তো। শালা নবাবী দেখাতে এয়েছে।

এসব কাজে মাথা গরম হয়। মৈত্র অনেক সফরে এমন সব দেখেছে। সেজন্য সে কিছু বলল না। কেবল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কয়লা ভরে যেতে থাকল। বলল, হাত লাগা আমার সঙ্গে। দাঁড়িয়ে থাকিস না।

এবং এক সময় সুট ভরে গেলে ওরা ওপরে উঠে দেখল, বৃষ্টিতে ডেক ভিজে গেছে। ছোটবাবু কি করছে কে জানে! সে দুদিন থেকে দেওয়ানিতে ভুগছে। কিছু খেতে পারছে না। সব ওক দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। এখন তো আরও বেশি হবার কথা। ছোটবাবু পিচিঙের জন্য ভাল করে রাতে ঘুমোতে পারছে না। হয়ত গিয়ে দেখবে, সে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে বাংকে। চোখে ঘুম নেই। তবু চোখ বুজে আছে। এভাবে নতুন জাহাজিদের হ্যাপা সামলাতে সামলাতে ওর সফর শেষ হয়ে যায়। কোম্পানিগুলো এসব অজুহাত দেখিয়ে, নানাভাবে এই সব নতুন জাহাজিদের নিতে চায় না। মৈত্র বোঝে এতে তার দেশের সুনাম নষ্ট। কোম্পানিগুলি এভাবে দুর্নাম ছড়িয়ে ক্রমে এ-বন্দর থেকে ক্রু নেওয়া কমিয়ে দিচ্ছে। ওরা বেশী করে এখন চালনা অথবা চাটগাঁ থেকে ক্রু তুলে নিচ্ছে। এ- সব কারণে সে অমিয়র হ্যাপা সামলাচ্ছে এখন। এবং এভাবে কিছুদিন চালিয়ে যেতে পারলেই অমিয় ঠিকঠাক একদিন সব নিজেই চালিয়ে নিতে পারবে।

চারপাশটা অন্ধকার। সমুদ্রে কোনো রঙ ফুটে উঠছে না। সকাল হতে এখনও অনেক দেরি। অবশ্য সে এ-সময়টা জামা কাপড় ছেড়ে হাত পা ধুয়ে শুয়ে পড়ে না। সে নিজেই চা করে নেয়। অমি ও ছোটবাবুকে দেয়। তারপর সকাল হলে যখন ডেক জাহাজিরা কাজে বের হয়ে যায় তখন সে গড়িয়ে নেয়! ছোটবাবু চা খেয়েই যা সামান্য কিছু আরাম পায়।

নুন জল মাঝে মাঝে মৈত্র খেতে দিচ্ছে ছোটবাবুকে। এতে দেওয়ানি কমে শরীরের। মাথা তেমন ঘোরে না। সব স্বাভাবিক হয়ে আসে। সে ডেক ধরে হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারল, দেওয়ানি তাকেও বেশ কাহিল করেছে। প্রথম প্রথম সবাই কিছু-না-কিছু কাহিল হয়ে যায়। কিন্তু ছোটবাবুর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। দু-তিন দিনেই চোখ কোথায় ঢুকে গেছে। সুন্দর সুশ্রী মুখ চুপসে গেছে। আর মনে হয় কি যেন একটা ভয় সবসময় ছোটবাবুর। ছোটবাবু কিছু বলছেও না। ঝড়ের সময়ই সব চেয়ে বেশি আশঙ্কা। মৈত্র কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।

মাঝে মাঝে মৈত্র ভীষণ রেগে যায়। কেন আসা জাহাজে! কে দিব্যি দিয়েছে। তারপরই মনে হয় কেউ দিব্যি দেয় না। কিনারায় কাজের কোন সুরাহা না হলে এই সব বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা জাহাজে চলে আসে। সবারই ভেতর একটা ইতিহাস থাকে। দুঃখের ইতিহাস। কেউ সখ করে জাহাজে মরতে আসে না। তখন তার ভীষণ মায়া হয় সবার জন্য।

সে গ্যালি পার হয়ে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল। খুব আস্তে আস্তে নামতে হয়। কেউ যেন পায়ের শব্দে জেগে না যায়। সারা সময় স্টিয়ারিং এনজিনের একটানা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ। প্রথম প্রথম এ-জন্যও ছোটবাবুর ঘুম আসত না। সম্পূর্ণ একটা আলাদা জীবনে এই ছোটবাবু কেমন হয়ে গেছে।

অমিয় কোন রকমে জামা-কাপড় ছেড়ে বাংকে গা এলিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু মৈত্র কিছুতেই ওকে বাংকে বসতে দিল না। একজন স্বাভাবিক জাহাজির মতো অমিয় থাকুক সে চায়। সে বলল, এই ওঠো। স্নান না করে এলে তোমাকে শুতে দেওয়া হবে না। এমন কিছু হয় নি, স্নান না সেরে তুমি বাংকে শুয়ে পড়বে। যাও। ওঠো। সে এই সব কথাগুলো খুবই আস্তে আস্তে বলছিল। যদি ছোটবাবুর চোখে সামান্য ঘুম লেগে থাকে। সে এমনকি আলো জ্বালল না। পোর্ট-হোলের কাঁচটা কে বন্ধ করে রেখেছিল। গুমোট ভাব। পাইপ থেকে ঠিকমতো হাওয়া বের হচ্ছে না। মৈত্র ছোটবাবুর পাইপের মুখ ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে দিল। বেশী হাওয়া লাগলে ছোটবাবুর ঘুম ভাল হবে। কিন্তু কি আশ্চর্য ছোটবাবু চোখ বুজেই বলছে, মৈত্রদা, আমি যে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছি না। মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছি।

মৈত্র কেমন ক্ষেপে গেল, না দাঁড়াতে পারলে আমি কি করব!

—আমাকে বাথরুমে যেতে হবে। কতবার চেষ্টা করেছি। তুমি একটু ধরবে?

মৈত্র হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ওঠ, ওঠ। কে বলছে দাঁড়াতে পারছিস না। যত সব বাজে কথা।

—না, সত্যি মৈত্রদা দাঁড়াতে পারছি না। সকাল হয়ে যাচ্ছে ভয়ে আর ঘুম আসছে না। সারেঙের টান্‌টু শব্দ কেবল শুনতে পাচ্ছি।

—ওঠ ওঠ বলছি। সে ঠেলে তুলে দিল। সে প্রায় যেন লাথি মারার মতো ঘাড় ঠেলে বের করে দিল ছোটবাবুকে।

—যা যা বলছি। পেচ্ছাপ করে আয়।

শরীর টলছে বলে সে একটু গিয়েই বালকেড ধরে দাঁড়িয়ে থাকল

এবার মৈত্র খিস্তি করে বলল, কেন যে মরতে আসা। কেউ নেই তোমার জাহাজে। যাও ছোটবাবু। না গেলে সমুদ্রে হারিয়া করে দেব। তবু সুনাম নষ্ট হতে দেব না আমাদের।

অমিয় ভয়ে ভয়ে আগেই উঠে গেছে। সে স্নান করেছে। স্নান করায় শরীরটা ভীষণ হাল্কা লাগছে। সে এখন আর ক্লান্তি বোধ করছে না। ছোটবাবুর জন্য মৈত্র এখনও চেঁচাচ্ছে। এবং সবাই জেগে গেছে। সবাই ফোকসাল ছেড়ে চলে এসেছে। সারেঙ বলছে, মৈত্রমশায়, আপনি ওর পেছনে কেন লেগেছেন?

—কি বলছে শুনুন। এই যা বলছি। পেট খালি করে আয়। চা করে দিচ্ছি। তারপর ঘুমোবার চেষ্টা কর।

সবাই যে যার ফোকসালে চলে গেল। নতুন জাহাজিদের নিয়ে এমন সব কত ঘটনা এই জাহাজের ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে। রেড-সিতে একবার একজন নতুন জাহাজি স্টোকহোলডের গরম সহ্য করতে না পেরে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। অথবা একবার এক জাহাজির সি-সিকনেস এমন হল, সে স্কাই-হোলের ভেতর দিয়ে এনজিনে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। কেউ কেউ তো পাগল হয়ে যায়। এ-সব ব্যাপারে কারো কিছু বলার থাকে না।

সারেঙ শুধু বললেন, ছেলে সাহস করে এয়েছিস যখন, সাহস করে একবার উঠে যা। দ্যাখ না কি হয়।

এ-সবে ছোটবাবু ভীষণ লজ্জিত এবং অপমানিত। সে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না পর্যন্ত। জাহাজে যখন সবাই নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছে, খাচ্ছে দাচ্ছে, সে মনে মনে বলল, ‘মাগো আমি ঠিক পারব। দ্যাখো পারব। ওরা আমাকে সময় দিচ্ছে না। সে আর দাঁড়াল না। সে উঠতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। মৈত্র ধরতে গেলে বলল, ধরবে না মৈত্রদা। আমি দেখছি পারি কিনা। ভদ্রা জাহাজের সেকেণ্ড অফিসার, চ্যাটার্জির শেষদিনের বক্তৃতার সময়ের মুখ ভেসে উঠল চোখে। তিনি যেন বলছেন, আমার জাহাজি বন্ধুরা, আজ তোমাদের যাবার দিন। জাতীয় সঙ্গীত গাইবার পরই বিউগিল বেজে উঠেছিল। ডাইনিং হলে সব মাসতার দিলে তিনি বক্তৃতার মতো করে বলে যাচ্ছিলেন। বলতে বলতে ওঁর গলা ধরে এসেছিল। তিনি বলেছিলেন, জাহাজি বন্ধুরা, আমি তোমাদের নানাভাবে টরচার করেছি। তোমাদের সহ্যসীমা কতদূর দেখেছি। আমার বিশ্বাস তোমরা পারবে। এর চেয়েও অনেক অনেক কষ্ট তোমাদের জন্য জাহাজে অপেক্ষা করছে। হলিস্টোনে তোমাদের হাতের রক্তপাত আমাকেও ভীষণ ভাবে টরচার করত। সিনিয়ার রেটিঙসদের র‍্যাগিংয়ের কথাও তোমাদের মনে থাকবে। সবই জাহাজে একজন ভালো জাহাজি হবার জন্য! আমার বিশ্বাস যাবার দিনে নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করতে পারবে। এখন না পারলেও জাহাজে গেলে ঠিক পারবে। আমার তখন দুঃখ থাকবে না।

আরও অনেক কথা। সব মনে পড়ছে না। এখন সব মনে পড়ার কথাও নয়। তবু সব কথার ভেতর এমনই বুঝি যন্ত্রণা ছিল তাঁর। ছোটবাবু সিঁড়ির রেলিং ধরে কোনরকমে এবার উঠে দাঁড়াল। সহজভাবে দাঁড়াতে চাইল। মাথা ঘুরছে। কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তবু অন্ধের মতো ওপরে উঠে প্যান্ট খুলে সামনেই পেচ্ছাপ করে দিল। নেমে যাবার ক্ষমতা ক্রমে এভাবে হারিয়ে ফেললে কি যে হবে! অহঙ্কার শরীরে ফুলে ফুলে উঠছে। সে বলল, স্যার আপনি এত বড় জানতাম না। আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। আমি যে কিছুতেই পারছি না। আমাকে তো সবাই নানাভাবে সাহায্য করে যাচ্ছে। আমাকে এখনও বাংকারে পাঠায় নি। জানি না পাঠালে আমার কি হবে!

সে প্রায় চোখ বুজেই হাত ধরে ধরে নেমে এল। সমুদ্র থেকে প্রচণ্ড বাতাস উঠে আসছে। সমুদ্রে ঢেউ প্রবল। ঢেউ-এর জলকণা শরীরে এসে লাগছে। সে বুঝতে পারল, এখন মে-জুনের সময়। এখন এ-সমুদ্রে ঝড়-ঝন্‌ঝা লেগে থাকারই কথা। এ ক’দিন ঝড়-বৃষ্টি হয় নি সে কপাল ভাল বলে। নিচে নেমে গেলে মৈত্র সোজা দাঁড় করিয়ে রাখল ওকে কিছুক্ষণ। এখন শোবি না। আর যখন ঘুম আসবে না বসে থাক। চা করে আনছি।

ছোটবাবু বলল, এত সকালে কিছু খাব না। খেলে আবার ফোকসাল পরিষ্কার করতে হবে।

—সে দেখা যাবে। আমি না পারি টোপাস করে যাবে। টোপাস আছে কি করতে!

—বেশ ভাল বলছ। বমি করে ভাসাই, আর ওরা ঐ কেবল করুক!

—বাছা তোমার গলা থেকে তো এখনও রক্ত উগলে ওঠেনি। এতেই টোপাসের জন্য তোমার এত ভাবনা।

ছোটবাবুর কাছে এর চেয়ে কষ্টের কি আছে জানা নেই। তবু সে চায় না এ-সব কথা আবার দু কান হোক। সে বলল, মৈত্রদা তুমি চেঁচামেচি না করলেই পারতে। বাড়িয়ালা শুনলে কি বলবে! কি ভাববে!

—কিছু ভাববে না। জাহাজে সবারই প্রথম প্রথম এমন হয়। আমারও হয়েছে। সারেঙেরও হয়েছে। তবে ভেঙ্গে পড়বি না। মনে জোর রাখ। কাজ করতে এয়েছিস। বসে থাকতে তো আসিস নি। এখন না হয় মোটর ভেসেল, অয়েল এনজিন এসব হয়েছে, আগে তো এ-সব ছিল না। তোর মতো মানুষেরাই কোম্পানীর আমলে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে গেছে। জাহাজ সমুদ্রে থেমে থাকে নি। সে লকার থেকে চা, চিনি কনডেন্সড মিল্কের টিন বের করে তরতর করে ওপরে উঠে গেল। জলটা গ্যালিতে বসিয়ে স্নান করে নেবে বাথরুমে। জল গরম হতে হতে ওর স্নান হয়ে যাবে। নানাভাবে অমিয় এবং মৈত্রদা ওকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে। শেষের কথাগুলো মৈত্রদার ভারী মজার। যেন এতক্ষণ যে চেঁচামেচি করেছে তার জন্য লজ্জিত। এখন কি করে যে এদের একটু তোয়াজ করবে ভেবে পাচ্ছে না। ছোটবাবু মনে মনে হাসছিল।

আসলে জাহাজে এভাবেই আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। এভাবেই আবার বিদ্রোহ গড়ে ওঠে। এভাবেই জাহাজিরা কখনও কখনও আবার প্রতিপক্ষ হয়ে যায় যেমন কাপ্তানের ছেলেটা জাহাজে উঠেই ওর সঙ্গে কেমন শত্রুতা আরম্ভ করে দিয়েছে। সে তো কখনও তাকায় না। কিন্তু কি যে ভয়, সে না তাকিয়ে পারে না। তাকালেই দেখতে পায় বড় বড় চোখে ওকে দেখছে। সে তখন ভেবে পায় না এমন করে তাকাচ্ছে কেন। ভয়ে বুক গলা শুকিয়ে যায়। দুটো চোখ এভাবে ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাকে বুঝি লক্ষ্য রেখে যাচ্ছে। সে ঠিকমতো কাজ করতে পারে কিনা, না সে কাজে ফাঁকি দেয়। সে এ জাহাজে একজন অক্ষম মানুষ এসব খবর পৌঁছে দেওয়া ওর স্বভাব হতে পারে।

এভাবে সকাল হয়ে যায়। সে চা খেয়ে আজ বমি করে নি। শরীরটা হাল্কা লাগছে। সে আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল। পোর্ট-হোলের কাঁচটা বন্ধ ছিল, সেটা আবার খুলে দিয়েছে। পিচিঙ বাড়ছে বলে, জল পোর্ট-হোল দিয়ে মেঝেতে এসে পড়ছে। সে এবার নিজেই উঠে বসল, এবং বালকেডে একটা পা রেখে কাঁচটা বন্ধ করে দিল। ঢেউয়ের ঝাপটায় সব ভিজে যাচ্ছিল।

সবাই ক্রমে সকাল হলে উঠে পড়ছে। সকালের দিকে সূর্যের লাল আলো এসে ফোকসালে পড়ছে। ওর ইচ্ছা হচ্ছিল, ওপরে উঠে বসে থাকে। কিন্তু, ওপরে বসতে পারবে না। কারণ জাহাজ সামনে পেছনে দুলছে। এখন সোজা হাঁটা যাচ্ছে না। পেছনে সামনে-ঝুঁকে হাঁটতে হচ্ছে। সারেঙ টাটু না বললে সে উঠছে না। যতক্ষণ পারে সে এভাবে শুয়ে থাকবে।

এবং কাজের সময়ে সে ফাইবারের সঙ্গে কথায় কথায় হাসতে পারল না। অতিকায় সব ঢেউ চারপাশে। আকাশ আবার মেঘলা। বৃষ্টি হচ্ছে না। অথচ কি ভীষণ জোরে হাওয়া দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ডেকের ওপর সমুদ্রের জল। উইনচের নীচে ছোটবাবু কাজ করছিল—ওর প্যান্ট-জামা জলের ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছে। সারসপাখিগুলো জলের ঝাপটায় কোঁ কোঁ করে উঠছে। এখন আসছে আবার সেই ছেলেটা। ফাইবার বুঝতে পারছিল, ছোটবাবুকে সি-সিকনেসে খুব কাবু করেছে। ওকে আজ সে খাটাচ্ছে না। সে নিজেই কাজ করছে। ছোটবাবু পাশে বসে কেবল নাটবোল্ট, তেল এসব এগিয়ে দিচ্ছে। কখনও কখনও বা দু’পা ছড়িয়ে বসে থাকছে ডেকে। দূরের দিগন্তরেখায় সমুদ্রের অজস্র ঢেউ, ওপরে সমুদ্রপাখিদের বিচরণ, কখনও বা একঘেয়ে নিরিবিলি অশান্ত সমুদ্রের ভেতর থেকে জাহাজে এনজিনের শব্দ—আমি যাচ্ছি, যাচ্ছি, আমি যাচ্ছি, যাচ্ছি। এভাবে একটানা শব্দ করে চলেছে এনজিনটা। আর মাস্তুলে ডেক-জাহাজি ইমরান উঠে গেছে। ফলঞ্চা বাঁধতে সে ওপরে উঠে গেছে। এ ঝড়ের দরিয়ায় মাস্তুলে রঙ হবে ভাবতে ছোটবাবুর কেমন গা গুলিয়ে উঠল।

এবং তখনই জ্যাক লাফিয়ে লাফিয়ে বোট-ডেক থেকে নেমে আসছে। সে অবলীলায় এ-ঝড়ের সমুদ্রে কেমন লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। সে বেশ ঝুঁকে ঝুঁকে হেঁটে যাচ্ছে। শরীরে ব্যালেন্স রেখে হেঁটে যাচ্ছে। কখনও লাফিয়ে ডেক পার হচ্ছে। সে পড়ে যাচ্ছে না। উইনচের ফাঁক দিয়ে ছোটবাবু এমন দেখে অবাক। কাপ্তানের ছেলেটা তো তার চেয়েও কমবয়সী। অথচ কি শক্ত সমর্থ। যখন ঢেউ এসে ডেক ভিজিয়ে দিচ্ছে, তখন এ কি খেলা তার! জল থৈ থৈ করছে ডেকে। সে জল নিয়ে খেলা করছে। সে পরেছে গামবুট। সে সারস পাখিগুলোকে ফল্কার কাঠে তুলে দিচ্ছে। সমুদ্রের জল ততটা এখনও উঠতে পারছে না। সে লম্বা একটা দড়ি দিয়ে কাঠের বাক্সগুলোকে মাস্তুলের সঙ্গে বেঁধে ফেলছে। এবং কাজ করে যাচ্ছে ঠিক একজন পাকা নাবিকের মতো। উইনচের ফাঁক দিয়ে এ-সব দেখতে দেখতে ছোটবাবুর মনে হল, জ্যাক কাউকে এরই ভিতর খুঁজছে। সে সঙ্গে সঙ্গে ও-পাশের ওয়ারপিনড্রামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। না, আর এখান থেকে ওকে জ্যাক দেখতে পাবে না। তখন পঁচিশ টাকার খালাসী উঠে গেছে মাস্তুলের ডগায়। সে দুলে দুলে সার্কাসে ট্র্যাপিজের খেলা দেখানোর মতো রঙ লাগিয়ে যাচ্ছে।

এখন ভাণ্ডারিরা ক্রুদের রসদ নিয়ে ফিরছে। চীফ কুক এপ্রন জড়িয়ে দরজার মুখে এসে দাঁড়াল। কার্পেন্টার লম্বা একটা সুতোয় বাঁধা গেজে জাহাজের সাউণ্ডিং নিচ্ছে। মার্কনি সাব রেলিঙে ভর করে সমুদ্র দেখছেন। মেজ-মালোম ব্রীজে দাঁড়িয়ে আছেন। ওর চোখ লাব্বাস লাইনের দিকে। কোয়ার্টার মাস্টার কম্পাসের কাঁটা মিলিয়ে স্টিয়ারিঙ সোজা করে রেখেছে। জাহাজ যতই কাত হোক, হেলতে- দুলতে থাকুক, সে কখনও কাঁটা থেকে নড়বে না। কাপ্তান তখনও ঘুমোচ্ছেন। কারণ দিনের বেলায় জাহাজের তেমন ভয় থাকে না। রাতটাই সব সময় সমুদ্রে নানাভাবে কষ্টদায়ক। কি যে গভীর অন্ধকার। তবু তিনি শৈশব থেকে এভাবে সমুদ্রে বিচরণ করে কি অন্ধকার, কি আলোতে, সমুদ্রের ক্ষমতা কতটুকু ধরে ফেলেছেন। যেন সমুদ্রেরও একটা খেলা আছে—এইসব অতি ছোট ছোট কাগজের নৌকার মতো জাহাজ এই সেদিন ওর বুকে ভেসে এল। এই সেদিন সমুদ্র দেখেছে, ক্রমে এক-দুই, তারপর শয়ে, হাজারে। কি যে তাদের রূপ! কোনটা সাদা, কোনটা কালো, কোনটা নীল রঙের। নানা রংয়ের বাহার। আর যখন সমুদ্রে সূর্য ওঠে, সূর্য অস্ত যায়, অথবা জ্যোৎস্নার কি যে মায়াবিনী এক খেলা। মাঝে মাঝে ঝড়ের ভিতর এই এক খেলায় অথবা নিচে কত সব প্রবালের দ্বীপ, বরফের পাহাড়, চোরা স্রোতে জাহাজ আটকে যেতে পারে—তবু এক খেলা, অসীমে এলে এই খেলার রহস্য ধরা যায়। কেবল লুকোচুরি খেলা। খেলায় কাপ্তান দেখেছেন, প্রায়ই জিতে গেছেন তিনি। কারণ সমুদ্রেরও বুঝি আছে অসীম ভালবাসা। মানুষের এই সব অতিকায় জাহাজ অতি ছোট কাগজের নৌকার মতো ভেসে বেড়ালে সমুদ্রের ছেলেমানুষী হাতগুলো আকাশের দিকে লাফিয়ে ওঠে। পোষা বেড়ালছানার মতো ধরতে চায়। আর জাহাজগুলোও বেশ জল কেটে ঢেউ কেটে ক্রমে সুদূরে চলে যায়। তখন আকাশের নিচে নীল রঙের ছায়ায় আশ্চর্য ছবি। কাপ্তানের ভারি মজা লাগে দেখতে। সমুদ্রের জন্য তখন মমতা তার বাড়ে। তিনি হোমে ফিরে বেশিদিন একা থাকতে পারেন না। সমুদ্র তাঁকে টানে।

ছোট-টিণ্ডালের আজ ভারি খারাপ অবস্থা। টিণ্ডাল দেখছিল, ঝড়ে পড়ে বয়লারগুলো ভীষণ মারমুখো হয়ে উঠছে। স্টিম কিছুতেই রাখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে তিন নম্বর মিস্ত্রি ছুটে স্টোক হোলডে চলে আসছে। এনজিনের শব্দে কিছু শোনা যায় না বলে, দু’হাত ওপরে তুলে চিৎকার করছে স্টিম স্টিম; আর তখন স্টোক-হোলডে, তিনজন ফায়ারম্যান, দুজন কোলবয়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। ফার্নেস ডোর খুলে অনবরত কয়লা হাকড়াতে হচ্ছে। মুখে আগুনের আভা, দাঁড়ানো যাচ্ছে না। গতকালের চেয়ে পিচিঙ আরও বেড়েছে। সমুদ্রের অবস্থা ক্রমে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ডেকে হিবিঙলাইন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কেউ যেন এখন আর বোট-ডেক ধরে উঠে না যায়। দিনের বেলাতে গেলেও রাতের বেলাতে কেউ যেন না যায়। নিচে টানেল-পথ খুলে দেওয়া হয়েছে—সেখান থেকে একটা সোজা সিঁড়ি প্রপেলার স্যাফটের গোড়া দিয়ে ওপরে উঠে গেছে। এনজিন-জাহাজিরা যেন সেখান দিয়ে যাওয়া- আসা করে—সারেঙ এই বলে সবাইকে সাবধান করে দিয়েছেন।

এখন টিণ্ডালের মুখেও ভীষণ দুশ্চিন্তার ছাপ। প্রত্যেকটা ফার্নেস ডোরে উঁকি দিয়ে দেখছে। এয়ার- বালব সব খুলে দিয়েছে। স্লাইস মেরে ফার্ণেসের ভিতর সব আগুন ঘেঁটে দিচ্ছে। ছাই ঝেড়ে দিচ্ছে। কয়লা ফায়ারম্যানদের অনবরত হাঁকড়াতে বলছে। সে হাত তুলে যাচ্ছে আর বলছে, জলদি জলদি, কয়লা হাঁকড়া। ফার্নেস জ্বালিয়ে দে। সব পুড়িয়ে দে। কসবীর কলজে উপড়ে আন। বলেই সে কখনও মনে ঐশীশক্তি পাবার লোভে, দু’হাত ওপরে তুলে চিৎকার করে ওঠে, আল্লা হু আকবর। অর্থাৎ যারা স্টোক-হোলডে আছে তাদের প্রত্যেকে তখন এই এক ধ্বনি মিলে একসঙ্গে যুস পেয়ে যায়। কেউ তখন ফার্নেস ডোর খুলে কয়লা হাঁকড়াচ্ছে, কেউ তখন ভীষণভাবে আগুনের জ্বলন্ত কঠিন চাঙগুলি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। কেউ তখন শ্বাস ফেলতে না পেরে উইণ্ডসেলের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। শাঁ-শাঁ করে জল নেমে আসছে ফানেলের গোড়া দিয়ে।

এভাবে টিণ্ডাল বুঝতে পারে দরিয়া ক্ষেপে গেছে। দরিয়া ক্ষেপে গেলে মজা পায় বয়লারগুলো। ওদের তখন ভেতরে ভেতরে ফেলা। স্টিম গেজের কাঁটা তখন আর উঠতে চায় না। সব স্টিম হজম করে বসে থাকে। তখন লড়াই মানুষে আর এই বয়লারে। তখন এনজিনিয়ার ছুটে আসে বার বার। এবং যা কিছু গালাগাল আছে সব সে অনায়াসে বলে যেতে পারে। টিণ্ডাল তখন এ-সব গালাগাল শুনতে হবে ভেবে ফের হল্লা এবং ঐশীশক্তির ওপর নির্ভরশীল না হলে উপায় নেই। বিশাল সমুদ্রের বুকে খুবই অসহায় এই মানুষের তৈরী কল—এবং বোধ হয় সেজ-মিস্ত্রির ইতর কথাবার্তা না শোনার জন্যও ফের চিৎকার সকলে মিলে, আল্লা-হু-আকবর। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন বেড়াল পালায় জানালা টপকে, সেজ-মিস্ত্রি, সুড়সুড় করে সরে পড়ে। কারণ জানা আছে অনেক ঘটনা এমন। ঝড়ের দরিয়ায় বয়লারের পেটে কত এনজিনিয়ার এভাবে হাপিজ হয়ে গেছে। ধর ধর শালোকে। আন ধরে, ক্ষিপ্ত লাল চোখ, এবং অমানুষের মতো মুখ-চোখ এই সব ফায়ারম্যানদের। তখন না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না, যেন ওরা মানুষ না, আসলে দানব, দানব হয়ে যায়। এবং ফার্নেস ডোর খুলে ঠেলে দেয়, যাও জাহান্নামে। মিস্ত্রি মানুষেরা সেজন্য ঝড়ের দরিয়ায় খুব একটা স্টোক-হোলাডের ভেতর ঢোকে না। গলা বাড়িয়েই যা যা বলার বলে চলে যায়—স্টিম মাংতা।

তখন সমুদ্রের জল স্টোক-হোলডের ভেতর। জাহাজ ভীষণ কাত হয়ে যাচ্ছে। আবার উঠে যাচ্ছে, আবার ডানদিকে হেলে পড়ছে। সমুদ্রের ঢেউ বোট-ডেকে উঠে আসছে। মনে হচ্ছে ঝড় মাস্তুলের দড়িদড়া উড়িয়ে নিচ্ছে। আকাশে নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে শুধু সমুদ্র, গভীর জল, নীল অন্ধকার আর ট্রেনের চাকায় যেমন শব্দ তেমনি এনজিনে শব্দ হচ্ছে, আর যাচ্ছি না আমি, যেতে পারছি না আমি। এনজিন এবং বয়লার ক্রমাগত যেন এমন বলে চলে যাচ্ছে।

এবং এরই ভিতর সেই অমানুষের মতো দানবের চোখ-মুখ, হিংস্র ভয়াল। দেখলে বোঝাই যায় না, গনি, জব্বার, মান্নান এদের নাম। লম্বা উঁচু চেহারা। মাথায় ফেজ টুপি, কালো রঙ। বয়লারের ছাই টানায় মুখ সাদা ফ্যাকাশে। ওপরে বাংকারের অন্ধকারে কেউ নেই, শুধু লম্ফ জ্বলছে। নিচে কোলবয় দুজন জল খাচ্ছে। আর যে আগুন নিচে স্টোক-হোলডে টেনে নামানো হয়েছে, তা জ্বল দিয়ে তারা নেভাচ্ছে! ওরা মাত্র দুজন। তিনজন ফায়ারম্যান আয়াসে যা করছে, ওরা জীবন দিয়েও যেন সেটা নেভাতে পারছে না। কি প্রচণ্ড আগুনের তাপ। সারা স্টোক-হোলড লাল এবং মনে হয় আগুনের উত্তাপে সব গলে যাবে। ওরা দুজন, অর্থাৎ দুজন কোলবয় ক্রমান্বয়ে জল মেরে ছাই এস- রিজেকটারে হাপিজ করে যখন উঠে যাচ্ছে তখন ওদের মানুষ বলে চেনা যাচ্ছে না। যেন দুটো পোকা লোহার রেলিং ধরে উঠছে, উঠতে উঠতে একটু দাঁড়িয়ে পড়ছে, জাহাজ কাত হলে ওরা শক্ত হয়ে যাচ্ছে। জাহাজের ওপর দিয়ে জল গড়ালে ওরা রেলিঙের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তারপর ক্রমে উঠতে উঠতে ওপরের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে না।

আর ঠিক সাতটার সময় পিছিলে হঠাৎ খবর এসে গেল, একজন পড়েছে।

কে পড়েছে! সবার মুখ অধীর।

পড়েছে। নাম, লতিফ। লতিফ মানে সেই বুড়ো রোগা লোকটা। সারেঙ যাকে ধরে এনেছিল। যে কান্নাকটি করেছে—যাবে না, এমন বলেছে, যে সিপিং অফিসে এ-জাহাজে আসতে হবে ভেবে নদীর পাড়ে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়েছিল, যাকে এনজিন সারেঙ প্রায় টানতে টানতে এনে দাঁড় করিয়েছিল।

বড় নিরীহ মুখ। বয়সের ছাপ মুখে ভীষণ। বয়স নলিতে কি আছে ঈশ্বর জানে। কিন্তু মুখ চোখ দেখলেই মনে হয়, ভেতরে ভেতরে সে ভারি অসহায়। কয়লার জাহাজের নাম শুনলেই মুখ ফ্যাকাসে! সে যেতে চায় না। এস. এস. সিউল ব্যাঙ্ক আসছে শুনলে, সে লাথি থেকে বের হয় না। না খেয়ে থাকে, টাকা পয়সা শেষ হয়ে যায় তবু মানুষটা কয়লার জাহাজে যাবে না। সেই মানুষটাই পড়েছে।

কেউ ডেক ধরে যেতে পারছেনা। ঝড় বৃষ্টিতে সমুদ্র আবছা মতো। জাহাজ কাত হয়ে জলের কাছাকাছি যাচ্ছে আবার ভেসে উঠছে। সব পাখিগুলোর খাঁচা বোট-ডেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। মোটা দড়ি দড়ায় বাঁধা। একটা খাঁচা এর মধ্যে কখন যে ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে কেউ জানে না। উপরে ওঠা যাচ্ছে না। দুজন অতি প্রাচীন নাবিক খুব দরকারি কাজে ডেকের ওপর দিয়ে হিবিং লাইনে ঝুঁকে ঝুঁকে বোট-ডেকে উঠে যাচ্ছে। বেশ একটা খেলার মতো যেন ওরা ব্যালেন্সের খেলা দেখাচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউ ওপর দিয়ে ভেসে গেলে ওরা হিবিং লাইন ধরে ডুবে যায় জলে। আবার ভেসে ওঠে।

অর্থাৎ ওরা লম্বা হয়ে যায়। প্যারালাল বারে খেলা দেখাবার মতো। খুব অনায়াসে ওরা ঢেউ মাথার ওপর দিয়ে বের করে দিতে পারে। তারপর জলে ডুব দিয়ে ওঠার মতো অবস্থা। নোনাজলে শরীর তখন জবজবে ভেজা। এমন যখন জাহাজের অবস্থা তখন ছোটবাবু দেখল, কেউ নড়ছে না। গল্প গুজব করছে সবাই।

ছোটবাবুর এখন ডেকে কাজ। সে আজ চপাটি কিছুটা খেতে পেরেছে। সে খুব দুর্বল ভেতর থেকে। তবু সে শক্তভাবে চলাফেরা করার চেষ্টা করছে। যখন মানুষটা বাংকারে পড়েছে তখন নিশ্চয় সবাই সেখানে এখন ছুটে যাবে।

সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় বুঝল, আসলে সে এখন কিছুই তাড়াতাড়ি করতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্য কেউ পিছিলে কোন তাড়াহুড়ো করছে না, কেমন যেন এটা জাহাজে সব সময়ই হয় ভাব। কেউ বলছে, কে পড়ল রে! ট্যারা লতিফ না বুড়া লতিফ।

জাহাজে দুজন জাহাজি, লতিফ নামে। একজন ফায়ারম্যান। অন্যজন কোলবয়।

—বুড়া লতিফ।

—বুড়া মানুষের হাড় শক্ত। এটা কি কামের কথা। বুড়া জানে জাহাজ চলে ভাল!

আরও সব রসিকতা, কেউ বড় একটা লতিফকে নিয়ে ভাবছে না। মৈত্র এখন ঘুমোচ্ছে অমিয় ঘুমোচ্ছে। ওদের শরীর একবার ডাইনে আবার বাঁয়ে হেলে যাচ্ছে। তবু ওরা নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছে। ওপরে ছাদের গ্যালিতে থালাবাসন পড়ার শব্দ। এবং ঝড় ঝঞ্ঝা হলে যা হয়, একটা চাপা গোঁ গোঁ আওয়াজ আর স্টিয়ারিং এনজিনের কক্ কক্ শব্দ। অতিকায় সব প্যানিয়ানের ভেতর কক্ কক্ আওয়াজ উঠলে ছোটবাবু ঘাবড়ে যায়। এটা যে কি হচ্ছে! বুড়ো লতিফের জন্য কেউ ভাবছে না। এবং যেতে যেতেই সে শুনল কে যেন বলছে, বেটা কুঁড়ের বাদশা। কতদিন থেকে সফর করে। সেই কয়লায়ালা। আর এক ধাপ এগোল না।

যেন এটা ধারণা মানুষের বিশেষ করে এই সব জাহাজিদের, পড়ে যাওয়া মানে দুবলা লোক, দুবলা লোকের জায়গা জাহাজে নয়। সরমের কথা। এবং এদের জন্য মায়া মমতা দেখানো পাপ। যেন এটা ঠিকঠাক থাকে, সমুদ্রে সাইক্লোন টাইফুন অথবা কঠিন হিমবাহের পাশাপাশি জাহাজ চালিয়ে নেওয়া, কখনও কখনও কলকব্জার ভেতরও মারামারি লেগে যায় অথবা যদি ইণ্ডিয়ান কোল থাকে জাহাজে তবে তো একটা কঠিন মারামারি। এসব জয়ের ভেতর জাহাজি জীবনের হামেসা সুখী হওয়ার ব্যাপারটা থেকে যায়। এবং যারা এ-সব পারে না, তারা জাহাজিদের মুখে কালি দেয়। তাদের জন্য মায়া দ্যাখানো ঠিক না।

একবার ইচ্ছা হল মৈত্রদাকে ডেকে তোলে। এখন মৈত্রদাই তার কাছে সব। সুখে-দুঃখে সব পরামর্শ সে দেয়। কিন্তু ওয়াচের পর ঘুম, ঘুম ভাঙ্গানো ঠিক না। এমন একটা যখন কঠিন মারামারি, মার মার কাট কাট বয়লারে, তখন ওদের ঘুমোতে দেওয়াই উচিত। ওপরে উঠতে পারলে ঝড়ের দরিয়াটা একবার দেখা যেত। সে একবার গ্যালির ওপরে উঠেও গিয়েছিল, কিন্তু সেই সমুদ্রের অতিকায় সব ঢেউ পাহাড় প্রমাণ ছুটে আসছে দেখলে কেমন মাথা ঘুরে যায়। এবং সেই চাপা আওয়াজ, লক্ষ লক্ষ দানবের হাহাকারের শব্দ। সে ভয়ে সিঁড়ি ধরে ওপরে না উঠে, নিচে সোজা টানেলপথে নেমে গেল! এবং ক্রমে সিঁড়ি ধরে নেমে যেতে যেতে, অনেক নিচে নেমে যেতে যেতে কিছুটা প্রায় পাতালে নেমে যাবার মতো, সে প্রপেলার স্যাটের পাশ কাটিয়ে নুয়ে নুয়ে এনজিনরুমে ঢুকে গেল। তারপর যেন দেখতে না পায় কেউ, কিছুটা চুপিচুপি সে যাচ্ছে। তার কাজ ফাইবারের সঙ্গে। কিন্তু ডেকের ওপর সমুদ্রের ঢেউ এসে ঝাপটা মারছে বলে হয়তো ফাইবার অন্য কোন কাজটাজ করছে। ফাইবারকে খুঁজতে স্টোক-হোলডে ঢুকে গেল। এখানে কাজকর্ম ঠিক চলছে। সে ছোট-টিণ্ডালকে দেখতে পেল না। আর সবাই কাজ করে যাচ্ছে। কে বলবে, এই জাহাজে একজন মানুষ বাংকারে পড়ে আছে। সে আবার সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠতে গিয়ে দেখল, সারেঙ বাংকার থেকে বেরিয়ে আসছেন। সারেঙকে দেখে ছোটবাবু না বলে পারল না, চাচা লতিফ পড়ে গেছে শোনলাম।

—হুঁ!

—পড়ে গেছে কেন?

—তুই নিচে যা। এখন ওদিকে যাস না।

—কেন!

—না। বলছি, যাস না।

—কে আছে ওর পাশে?

—কেউ না।

—আমি একটু দেখে আসছি চাচা।

সহসা সারেঙ ওর হাত ধরে ফেললেন।—যাবে না। যাবে না বলছি। চোখ গরম করে বললেন, নিজের কাজ করগে।

—কিন্তু …..।

—কিন্তু টিন্তু জাহাজে না……।

তবু মানুষের কি হয়ে যায়। সে বলল, না আমি যাব।

সারেঙ বললেন, যাও। গেলে মরবে।

মানুষের এমন হয়, এমন হয়ে থাকে, এটা মানুষের স্বভাব। ছোটবাবু ঠিক বোঝে না জাহাজে এলে মানুষেরা এমন নিষ্ঠুর হয়ে যায় কেন। সে বোঝে না মানুষের তো এটা স্বভাব না, মানুষ তো বিপদে আপদে ছুটে যাবেই। এমনভাবে সবকিছু এড়িয়ে যাওয়া ঠিক না। ভেতর ভেতর তার যে অসহায় ভাবটা ছিল কেন জানি সেটা ক্রমে ক্রমে কমে আসছে। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই সে অবাক হয়ে গেল। বড়-মিস্ত্রি, মেজ মালোম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। বাংকারে ভীষণ অন্ধকার। একটা মাত্র লম্ফ জ্বলছে বলে সে প্রথমে দেখল সাদা পোশাকে কারা ঘোরাফেরা করছে। ভূতের মতো যেন এবং কাছে গেলে সে আর ফিরে আসতে পারল না। দেখল, লতিফ লম্বা হয়ে পড়ে আছে। হাত- পা ছড়ানো। মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। চোখ কেমন ওপরে উঠে গেছে। এবং মুখের রঙ কয়লার ধুলোতে কালো। পিছনে পাহাড়প্রমাণ কয়লার ঢিবি। ছাদ পর্যন্ত ঠেকে আছে। কয়লার গাড়িটা উল্টে গেছে। সুট থেকে কয়লা হড় হড় করে নেমে যাচ্ছে। এবং কয়লা টেনে ফায়ারম্যানরা সুর্ট একেবারে খালি করে ফেলেছে।

তখনই যেন পেছন থেকে হাঁক। কারণ ছোটবাবু বুঝেছিল ওখানে ওর থাকা ঠিক না। সে পালাবে। কিন্তু তখনই শব্দ—হেই।

সে ফিরে তাকাল। দেখল মেজ-মিস্ত্রি খুব শক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

মেজ মিস্ত্রি ফের চিৎকার করে বলছে, গো অন!

সে ঠিক বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে আছে।

এবং বোধ হয় মেজ-মিস্ত্রি জানে এও জাহাজি মানুষ, অক্ষরজ্ঞান নেই মূর্খ এবং কথা বোঝে না। মেজ-মিস্ত্রি নুয়ে বেলচাটা তুলে কয়লার ঢিবির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর এক দুই করে বেলচায় কিছু কয়লা তুলে দেখাল। এ-কাজটা ছোটবাবুর এখন করা দরকার। না হলে জাহাজ চলবে না। সুট খালি হয়ে গেছে। নিচে যমুনাবাজুর ফায়ারম্যানের কাছে কয়লা নেই।

ছোটবাবুর অন্য কাজের কথা, তবু মেজ-মিস্ত্রি জাহাজে সব। ওদের অন্তত সব। ওর ওপরে ফায়ারম্যান, তার ওপরে গ্রীজার, তারপর টিণ্ডাল, সারেঙ, সারেঙের মা-বাপ জাহাজে মেজ-মিস্ত্রি। ছোটবাবুর কোন কিছু করার নেই। সে হাতে বেলচে নিয়ে প্রায় যেন ভূত দেখার মতো গাড়িটা কয়লার পাহাড়ের কাছে নিয়ে গেল। এবং সে জানে এই জাহাজে সে ঠিক এখন লতিফের মতো। অন্ধকার বাংকারে দিনের পর দিন তার কাজ। সে ঠিক বুঝতে পারল না, সে কি কাজ করছে। সে জানে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মহামহিম মেজ-মিস্ত্রি। প্রায় তার কাছে তিনি সেই প্রাচীনকালের ফারাওদের মতো। অসীম ক্ষমতা। ছোটবাবু গড় গড় করে গাড়িটা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, আর ষাঁড়ের খেলার মতো অসীম উৎসাহ মানুষটার, যেন লাল রুমাল উড়িয়ে দেওয়া, সাবাস। জলদি। আরও জলদি। জোরে। দু’হাত ওপরে তুলে হারি আপ। ম্যান, হারি আপ। থামো মাত। চলো জলদি। কাম ঠিক মাংতা। এবং ছোটবাবুর হঁস ছিল না। সে একটা তাঁতের মাকুর মতো সুটের কাছে গাড়ি ভরে, আসছে যাচ্ছে। অন্ধকারে সে এখন কয়লার গুঁড়োর ভিতর অস্পষ্ট দেখছে সব। কয়লা হড়হড় করে নেমে আসছে নিচে। পায়ের কাছে। গাড়ি ভরে সে হাতল ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং ভেতরে রয়েছে জ্যাক। জ্যাক মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখছে ওকে। কখনও কখনও অপলক। তখন ছোটবাবুর ভেতর কি করে যে ভয়টা কেটে গেছে। সে মানুষের মতো ভাবছে নিজেকে। সে সত্যি ভয় পাচ্ছে না। আর তখনই মনে হল, মেজ-মিস্ত্রি লতিফের মুখের কাছে জুতোর টো নিয়ে আসছে। জুতোর টো দিয়ে দেখছে, মানুষটা কেমন আছে। অর্থাৎ মুখ নেড়ে দিতে যাচ্ছে। এবং তখনই ছোটবাবুর সেই সবদিনের কথা, কেউ যেন হাতি চড়ে যায়, রাজার মতো নিরুদ্দেশে যায় সব মনে পড়ে যায়। এবং বড় এক নদীর কথা মনে পড়ে। নদীর পাড়ে পাড়ে সেই সব প্রাচুর্যের দিনগুলো মনে পড়লেই ভেতরে সাহস বেড়ে যায়। সম্মানবোধ বেড়ে যায়। মানুষ হিসাবে সে কালো বলে কালো মানুষের ওপর তার প্রীতি বেড়ে যায়। এই যে মেজ-মিস্ত্রি মাঝে মাঝে টো দিয়ে মুখ নেড়ে দিচ্ছে, জ্ঞান ফিরে এসেছে কি না দেখছে এটা সারেঙ. সাব দেখেও কিছু বলতে পারছেন না। তিনি চুপচাপ। এবং দেখছেন, অর্থাৎ যা ভেবেছিলেন, ছোঁড়াটা নিজের দোষে মরল। এবং রাগে তিনি আর ছোটবাবুর দিকে তাকাচ্ছেন না।

সারেঙের মাথায় এখন নানা ভাবনা। কি করে ওটাকে বোট-ডেকে তোলা যাবে। এখানে পড়ে থাকলে চলবে না। ওপরে তুলে নুন জল খাওয়াতে হবে। ভাল করে স্নান করিয়ে দিতে হবে। এবং মাঝে মাঝে সেই জুতোর টো এগিয়ে আসছে। সাহেব-মানুষেরা লতিফকে নিয়ে হাসি-তামাসা করছে। ছোটবাবু দেখছে সব। ভিতরে যে এমন একটা রক্তপ্রবাহ মানুষের মাঝে মাঝে থেকে যায় সে জানে না। মাথাটা কেন যে গরম হয়ে যাচ্ছে। সে কাজে কোন অবহেলা দেখাচ্ছে না। তবু আবার জুতোর টো মেজ-মিস্ত্রি লতিফের মুখের দিকে এগিয়ে আনলে সে গাড়ি উল্টে দিল, বেলচেটা দূরে ফেলে দিল, এবং কাছে এসে খুব আলতোভাবে যেন কত বিনয়ের সঙ্গে সে মেজ-মিস্ত্রির পায়ের কাছ থেকে করুণ ভিক্ষার মতো লতিফের মুখটা সরিয়ে নিল। তারপর চোখ তুলে তাকাল মেজ-মিস্ত্রির দিকে। ছোটবাবু লম্বা মানুষ। সে এই বেঁটে ছোটখাট মানুষটাকে কাঁধে ফেলে নিল এবার।

সারেঙ কেমন ঘাবড়ে গেলেন। লতিফকে এভাবে তোলা যাবে না। তিনি তোলার জন্য দড়িদড়ার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলেন। আর ছোটবাবু ভোররাতের দিকে বমি করেছে। ওপরে উঠতে পারত না। কেমন নির্জীব মানুষ। সে কিনা এখন ঝড়ের সমুদ্রে এমন একটা ভয়াবহ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। মেজ-মিস্ত্রি প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারে নি। সে একটা নেটিভ ইণ্ডিয়ানের কাছে কি আশা করতে পারে, অথচ নেটিভ-ইণ্ডিয়ানটা অনায়াসে বের হয়ে যাচ্ছে টলতে টলতে। পড়ে গেলেই নিচে, স্টোক হোলডে দুটোই গুঁড়ো হয়ে যাবে। কিন্তু এমনভাবে কাঁধের ওপর ফেলে নিয়েছে যে এখন আর কিছু বলাও যায় না। সন্তর্পণে হেঁটে যাচ্ছে। ফানেলের গুঁড়ি ধরে সমুদ্রের ঢেউ, তখন থেকে উঠে আসছে। আর সে উঠে যাচ্ছে। সে উঠে যাচ্ছে লোহার সিঁড়ি ধরে। সে টলছে। সে কাঁপছে। কিন্তু ওর হাত পা ভীষণ শক্ত মজবুত। সে বোট-ডেকে উঠেই আর পারল না। বমির মতো উঠে আসছিল, সে চায় না বমিটা এখানে হোক। সে তাড়াতাড়ি লতিফকে বোট-ডেকে রেখে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে যেতে থাকল এবং বাংকারে ঢুকে দেখল, কয়লা অনেক নিচে নেমে গেছে। যেন সে সারা মাস বৎসর কাজ করেও এই পাতালে নেমে যাওয়া সুটের ভেতরটা ভরতে পারবে না। বমিটা এবার সজোরে নাকমুখ দিয়ে বের হয়ে এল। এবং তাজা নোনতা স্বাদ। চ্যাট-চ্যাট করছে। কেমন কালো রঙ। অন্ধকার বাংকারে সে বুঝতে পারছে না, আসলে এটা কি। সে বেলচেটা আবার তুলে নিল। মুখটা মুছে ফেলল ভারি তোয়ালে দিয়ে। আসলে ওর মুখ এখন হিজিবিজি নিগ্রো দুঃখী মানুষদের মতো দেখতে হয়ে গেছে। তার যতসব স্বপ্ন, এখন হিজিবিজি খাঁজকাটা একটা মাকড়সার জালের মতো ছিঁড়ে যাচ্ছে। হাত দিলেই ছিঁড়ে যাচ্ছে।

সে জানে সে থেমে গেলেই হেরে যাবে। সে জানে পাশে এক অজগর পাতালের দিকে নেমে গেছে, তার সঙ্গে এক লড়াই তার। না-হলে সেই হাসি ঠাট্টা! মসকরা করবে, সে করুণার পাত্র হয়ে যাবে। সে দাঁড়াতে পারছে না—এমন আর কখনও ভাববে না। সে বেশ আছে, ভালো আছে, মাগো আমি ভাল আছি। টাকা পেলে কিনা জানাবে। কম টাকা, তবু তোমাদের কিছু অন্তত হয়ে যাবে। আমি এখন যাচ্ছি কলম্বো, তারপর আমেরিকা, আমি যে কত বড় হব বলে নিরুদ্দেশে চলে এসেছি। আমার আকাঙ্ক্ষা অনেক, আমি সুন্দর এক পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে বাঁচতে চাই। আমি হেঁটে যাব মা, চারপাশে মানুষেরা বলবে, ঐ যে মানুষটা হেঁটে যাচ্ছে। আমি স্বপ্ন দেখব মা, হ্যাঁ স্বপ্ন, পাশে স্টাবোর্ড-সাইডের বাংকারে এখনও গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মনু কাজ করছে ওখানে। খুব পরিশ্রমী মনু, মৈনুল হক, তা তুমিও তো বেশ কাজ করে যাচ্ছ। আমার এমন ভাবে ওক উঠে আসছে কেন। বার বার। এই নিয়ে সাত বার। তুমি কি এখন একবার এ-বাংকারে আসবে! এসে খোঁজ নেবে আমি পারছি কিনা! সারেঙসাব বলে গেছেন দেখতে, মাঝে মাঝে দেখতে। তুমি আমাকে দেখবার আগে বলছি, ঠিক সুট ভরে দেব। তোমার আগে ভরে ফেলব।

এ-ভাবে সে ক্রমান্বয়ে একটা মাকুর মতো বাংকারের অন্ধকারে কাজ করতে করতে এক সময় দেখল, কয়লার লুট ভরে গেছে। সে তাড়াতাড়ি গাড়িটা প্রায় ঠেলে ফেলে দিয়ে হাত তুলে হৈ হৈ করে উঠলেই ছুটে এসেছিল মনু। সে দেখতে পেয়েছিল, ছোটবাবু হাত দিয়ে সুটের কয়লা সাজিয়ে দিচ্ছে। সে কেমন একটা গন্ধ পেল বাংকারে। তাজা রক্তের গন্ধ যেন। এমন হয় সে জানে এবং মনু তাড়াতাড়ি ওর কাছে লম্ফ নিয়ে গেল। লম্ফ তুলে দেখল। মুখটা ভীষণ বীভৎস। চোখ লাল। কালো মুখে সাদা দাঁত বের করে হাসছে। হাসিটা ভারি কষ্টের। মনু বলল, তোর বাংকারে বাঁস কেন রে!

—কোথায় বাঁস!

—তাজা খুনের বাঁস।

—যাঃ।

—হ্যাঁ। পাচ্ছি! দ্যাখতো বলে সে লম্ফটা নিয়ে অস্পষ্ট আলোতে খুঁজতে থাকল। তারপর এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল। বলল, এখানে তুই বমি করেছিস?

ছোটবাবু বলল, হ্যাঁ।

—এসে দেখ কি করেছিস।

ছোটবাবু বলল, আমি আর উঠতে পারছি না! আমার ওয়াচ শেষ, আমিও শেষ।

তবু মনু ওকে ধরে নিয়ে গেল। ছোটবাবু দেখল, লাল তাজা রক্তে ভেসে গেছে ডেক। সঙ্গে সঙ্গে আবার ওক ওঠে এল ভিতর থেকে। তারপর টলতে টলতে পড়ে গেল নিচে। ছোটবাবু যথার্থই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল। সমুদ্রে ঝড়ের ঝাপটা তখন আরওবেগে নামছে। জাহাজ উঠছে নামছে। ফুলছে। ক্ষেপা সমুদ্র। মেঘলা আকাশ। প্রচণ্ড ঝড়ে দানবের মতো নীল রঙের ঢেউ। মাথায় সাদা ফেনা। এ্যালবাট্রস পাখিদের আর্তনাদ কখনও ঢেউয়ের মাথায়—ওরা উড়ে উড়ে ভেসে যাচ্ছে। অস্পষ্ট এক কুয়াশার ছবি যেন চারপাশে।

এবং খবর চারপাশে আবার ছড়িয়ে পড়ল। ছোটবাবু পড়েছে। মৈত্রের এখন ওয়াচ। সে নেমে যাবার মুখে এমন শুনল। মেজ-মিস্ত্রি আবার এসে নেমেছে! তার যা স্বভাব! জ্যাক এসে নেমেছে। সে পাশে দাঁড়িয়ে দেখল ছোটবাবু কাত হয়ে পড়ে আছে। সে পাশে বসবে ভাবল, কিন্তু মনে হচ্ছে সেকেণ্ড পা তুলে আছে। যারা ছোট কাজ করে তাদের মুখ হাত দিলে বড় অপমান। সম্মান থাকে না বুঝি। পা বাড়িয়ে মুখটা একটু নেড়ে চেড়ে দেখা। সত্যি পড়েছে না ভয় পেয়ে এমন করছে। মুখে রক্তের দাগ দেখেও মায়া হয় না। জ্যাক এবার উঠে দাঁড়াল। ঠিক পাশে। এবার পা তুলতে যাচ্ছে আর্চি। আর্চি স্নান সেরে নেমে এসেছে। পায়ে তার বাথরুম স্লিপার। বুড়ো আঙ্গুল বের হয়ে আছে। জ্যাক এখনও শক্ত বুটজুতো পরে আছে। পা-টা উঠে আসছে। ডান পা তুলে আর্চি ছোটবাবুর মুখের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। আর তখন ঠিক পাশে অর্চির বাঁ পা। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের মাথায় জ্যাক তার গোড়ালির সর্বশক্তি দিয়ে চাপ দিতেই চিৎকার করে উঠল আর্চি।—এহো গেলাম! গেলাম!

আর্চির বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটা ভীষণভাবে থেঁতলে গেছে। না দেখে এমন একটা কাজ করে ফেলেছে জ্যাক। সে চোখ টেনে বলল, সরি মিঃ আর্চি। কোথায় লাগল। উপুড় হয়ে পায়ের কাছে বসতেই দেখল, আর্চি পাটা নিয়ে ঘুরে ঘুরে এক পায়ের ওপরে নাচছে। জ্যাকের ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু মৈত্র যখন ছোটবাবুকে কাঁধে ফেলে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন ফোঁটা ফোঁটা রক্ত দেখে জ্যাক ঘাবড়ে গেছে। মুখ থেকে ছোটবাবুর ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। জ্যাক কেবল নিশি পাওয়া মানুষের মতো ছোটবাবুর পেছনে হেঁটে যেতে লাগল। সে হাসতে পারল না, কাঁদতেও পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *