1 of 2

অলৌকিক জলযান – ২৯

।। ঊনত্রিশ।।

পর পর দু’রাত স্যালি হিগিনস ঘুমোতে পারলেন না। দেয়ালে ক্রাইস্টের মুর্তি। যতবার চেষ্টা করেছেন সোজা রাখার, ততবার কাত হয়ে গেছে। তার পায়ের নিচে তিনি সারারাত চুপচাপ বসে থেকেছেন। ভেবেছিলেন, সোজা করে রাখতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। জাহাজে কোন পিচিং নেই। সমুদ্র একেবারে শান্ত। জাহাজ দুলে দুলে চললে এটা হতে পারত। কিন্তু কি যে হয়ে গেল! কলকাতা বন্দর থেকে ছাড়ার সময় চীফ-মেট বেশ সোজা করে রাখতে পেরেছিল, কিন্তু আবার ঠিক আগের মতো। ইচ্ছে করলে দেয়ালে পেরেক ঠুকে প্রায় আবার যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার মতো কিছু একটা করে ফেললে, মূর্তিটাকে সোজা রাখা যেত। কিন্তু তিনি তা করতে ভয় পাচ্ছেন।

আসলে একটা শঙ্কা এবং ভয় তাঁকে ক্রমে গ্রাস করছে। হয়তো যীশু ঠিকই আছেন, ঠিকভাবে সোজা সরলরেখায় ঝুলে আছেন কিন্তু মনের ভেতর শঙ্কা তাঁকে ক্রমে সব বিভ্রমের ভেতর ফেলে দিচ্ছে। স্যালি হিগিনস ঘুমের পোশাক পরেছিলেন—রাতের পোশাক ঢিলেঢালা হওয়া স্বাভাবিক—ঢিলেঢালা আছে ঠিকই তবু যতবার শুতে গেছেন মনে হয়েছে সমস্ত শরীরে পোশাকটা ফাঁসের মতো এঁটে যাচ্ছে। পাল্টে আর একটা পরেছেন—তাও সেই একরকমের। যতবার যত পোশাক পাল্টেছেন সবই যেন অন্যের মনে হয়েছে—নিজের মনে হচ্ছে না, এবং কি যে অস্বস্তি তখন, লাফিয়ে উঠে পড়েছেন, কখনও পোর্ট-হোল খুলে আকাশ দেখেছেন, ঠিক ঠিক সব নক্ষত্র আকাশে আছে কি নেই দেখেছেন, দরজা খুলে ব্রীজে যারা ডিউটিতে আছে তারা আছে কিনা দেখেছেন—না সবই ঠিক আছে। মাস্তুল, চিমনি, ব্রীজের উইংস, ডেবিড, কোয়ার্টার-মাস্টার সব তাঁর চেনা, তবু কেন যে মনে হচ্ছিল—জাহাজটা সিউল-ব্যাঙ্ক নয়, জাহাজটা কোনো ভুতুড়ে জাহাজ। ভুতুড়ে জাহাজে উঠে তিনি লুকেনারের পোশাক পরেছেন। পোশাকটা কেমন ভারি, যেন অনেক পোশাক—একটা দুটো নয়, অজস্র পোশাকের ভার তাঁকে একটা কিম্ভুতকিমাকার মানুষ বানিয়ে দিচ্ছে। যখন এসব ভেবে কুলকিনারা পান না, তখনই মাথা নিচু করে যীশুর পায়ের কাছে বসে থাকেন। তাঁর সারারাত ঘুম হয় না। বিড় বিড় করে বকেন, হ্যালেলুজা আই এ্যাম অন মাই ওয়ে।

তখন সমুদ্রের ভেতরে শুনতে পান দীর্ঘ শবযাত্রার মিছিল—তাদের নিথর পায়ের শব্দ, এবং শবাধারে ফুলের ভেতরে কীটের আস্তানা—কটকট করে তারা ফুলের পাপড়ি কাটছে। তাঁর দৃষ্টি দেয়াল থেকে উঠে সেই সমুদ্রের শান্ত প্রবাহের ভেতর আটকে গেলে বুঝতে পারেন, সকাল হয়ে যাচ্ছে। তিনি বুঝতেই পারেন না কেন সারারাত তিনি না ঘুমিয়ে ছিলেন। সব কিছু কেমন নিজের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে।

তখন কাপ্তান-বয় এসে যায়। বাইরের ডেক চেয়ারে গিয়ে তিনি বসেন। এক কাপ কফি, কফি খেতে খেতে বুঝতে পারেন চোখ জ্বালা করছে—এভাবে পর পর দু’রাত না ঘুমিয়ে শরীরে অবসাদ। উঠতে ইচ্ছে করে না। বনিকে ডেকে পাঠাতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় সব খুলে মেয়েটাকে বলেন—বনি, আমার এমন কেন হচ্ছে? বনি তুমি সত্যি করে বল তো, রাতে তুমি হাল্কা পোশাকে কোথায় গিয়েছিলে? এলিস না তুমি! এলিস এবং তুমি দুজনে মিলে ভীষণ আমাকে বিভ্রমের ভেতর ফেলে দিয়েছ?

মাঝে মাঝে তাঁর সহসা কেন যে মনে হয় এ-জাহাজে এলিস আসবে কোত্থেকে! হয়তো রাতে বনি, এই জাহাজে মেয়ে হয়ে যায়। সারাদিন ছেলের পোশাকে থেকে বনি যখন আর পারে না, রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, যে যার ওয়াচ ওপরে নিচে যখন করছে, তখন বনি গোপনে রাতের পোশাকে জাহাজে ঘুরে বেড়ায়। এবং তারপরই তিনি যা ভেবেছিলেন, বনি গোপনে ঘুরে বেড়াতে পারে, কিন্তু তাঁর চোখের ওপর দৃশ্যমান হলে বনির গোপনীয়তা কিছু থাকে না। আর তখনই ভেবে পান না, বনির এত সাহস কি করে সম্ভব। কিন্তু বনিকে তো তিনি বারবার এলিসের মতো দেখেছেন। বনির পোশাক দেখেছেন, হাল্কা পোশাক—যে-পোশাকে এলিস ওঁর জন্য কেবিনে অপেক্ষা করত। বনি ঠিক সেই পোশাকে কেবিনের দরজা খুলে ওঁর সামেন দাঁড়িয়েছিল। বনি কি তবে রাতে তাঁকে সারা জাহাজ ঘুরিয়ে মেরেছে? বনির ভেতরে এলিস যদি আশ্রয় নেয় তখন! এমন তো ঘটনা তিনি ডাঙ্গায় কত শুনেছেন। এবং বুনি হয় তো তখন সজ্ঞানে থাকে না, মাথার ভেতরে তার এক অশুভ আত্মা ক্রমাগত পাক খেতে থাকে। বনি এলিস হয়ে যায়। আসলে এলিস তাঁকে নিষ্ঠুরতার ভেতর ফেলে ভীষণ মজা পাচ্ছে। এমন সুন্দর মেয়েটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে।

এসব চিন্তা তাঁকে বেশ কাবু করে ফেলেছিল। আর সেই থেকে তিনি ঘুমোতে পারছেন না। একটা ঘোরের ভেতর পড়ে গেছেন তিনি। বনি রাতের পোশাকে সামনে দাঁড়ালে ঘোরের ভেতর মনে হয় এলিস দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজে বনি বলে তাঁর মেয়ে আছে, এবং জাহাজে মেয়ে থাকতে পারে ঘোরের ভেতর কিছুতেই মনে থাকে না। এই শেষ সমুদ্র সফরে এসব একে একে তাঁকে কঠিন অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। তখন যিশুর পায়ের কাছে, বাইবেলের কোন পবিত্র সুরা পাঠ করে আত্মশুদ্ধির আকাঙ্ক্ষা। মাথায় আর কিছু আসে না। অন্যান্য অনেক কাপ্তানের জাহাজ ছেড়ে দেওয়ার পেছনে বোধ হয় কিছু এমন রহস্যজনক ঘটনা থেকে গেছে। তাঁরা ভয়ে হয়তো জাহাজের নামে মিথ্যা দুর্নাম রটিয়ে বন্দরে নেমে গেছে। বার বার অসুস্থ হয়ে তাঁরা ফিরে গেছেন জানেন, কিন্তু আসলে কেন এটা হয়েছে—সঠিক কিউ- টি-জি মাঝে মাঝে পাওয়া যায় না কেন এবং জাহাজ নিশীথে সমুদ্রে ঘুরিয়ে মারলে পাগল হয়ে যাবার কথা ঠিক—তবু মনে হচ্ছে তাঁরা লুকেনারের মৃত আত্মা অথবা এলিসের মোহে পড়ে গিয়ে এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কিন্তু এসব কর্তৃপক্ষকে বলে তো আর তিনি তামাসার ভেতর পড়ে যেতে পারেন না।

তিনি কফি খাচ্ছিলেন। তাঁর পাইপ থেকে ধোঁয়া উঠছে না। কখন নিভে গেছে। দু’দিনে তিনি আরও বুড়ো হয়ে গেছেন। সূর্য সমুদ্রে ভেসে উঠছে। সেই যায় যায়, যেন সূর্য সন্ধ্যার আগে সমুদ্রে ডুবে পালিয়ে যায়, তারপর সারারাত সাঁতার কাটতে থাকে, এবং আবার সকালের দিকে সমুদ্রে একটা গোলাকার অগ্নিপিন্ডের মতো ভেসে ওঠে। অথবা মনে হয় অতিকায় জাহাজের মতো রাজহাঁসটা একটা সোনার ডিম পেড়ে ওপরে উঠে গেল। যত সময় যায়, তত ডিমটা সেই নীল আকাশের নিচে সামান্য উষ্ণতার জন্য লেগে থাকে, এবং সন্ধ্যা হলেই ডিম ফুটে যায় কিংবা ডুবে যায়, আবার সকালে ভেসে ওঠে—এ সবের ভেতর মনে হল, বনিকে সামনের বন্দরে বরং নামিয়ে দেবেন। বনিকে তিনি ক্রমে একটা বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। জাহাজ থেকে বনি নেমে গেলেই হয়তো এলিস প্রতিশোধ নেবার আর কোন অবলম্বন পাবে না। নিজের সম্পর্কে ভাবেন না। বয়স হয়েছে, সমুদ্রে যে-কোনোভাবে মৃত্যু অনিবার্যতার সামিল।

এবং আর যা ভাবলেন, বনিকে কিছু প্রশ্ন করার আছে। তা না হলে তাঁর অস্বস্তি কাটবে না। কফি খাওয়া হলে তিনি কাপ্তান-বয়কে বললেন, একবার জ্যাককে পাঠিয়ে দেবে।

জ্যাক ঘুমোচ্ছিল। সে দু’তিন দিন বাবার কাছে যায়নি। লজ্জায় সংকোচে সারাদিন কেবিনে কাটিয়ে দিয়েছে। ওর যে এটা কি করে হল? এবং বাবা মনে মনে বিরক্ত হতে পারেন। এত সকালে যখন সে শুনতে পেল, তাকে তিনি ডাকছেন, সে লাফ দিয়ে উঠে বসল। বাইরে কাপ্তান বয়ের গলা। সে বলল, যাচ্ছি।

হাত মুখ ধুয়ে ঠিক সেই ঢোলা পুরুষের পোশাকে জ্যাক যখন উঠে গেল ওপরে, বাবার পাশে যখন দাঁড়িয়ে ডাকল, আমি বনি, তখন কাপ্তান ধীরে ধীরে চোখ তুলে মেয়েকে অনেকক্ষণ দেখলেন। মুখ থেকে এক আশ্চর্য নীল আভা যেন বের হচ্ছে। গোলাপী রঙ এবং নীল চোখে কি যেন আশ্চর্য সজীবতা। পৃথিবী ফুলে ফলে ভরে গেলে এমন হয়। তিনি যে ডেকেছেন, ভুলেই গেছিলেন। মেয়েটাকে দেখতে দেখতে কেন তিনি ডেকেছেন মনে করতে পারলেন না। তারপর খানিকক্ষণ কি ভেবে যখন মনে করতে পারলেন—কেমন সংকোচ হল তাঁর। বনি সম্পর্কে কি যে আজেবাজে দু’রাত ধরে ভেবেছেন। শুধু বললেন, বোস। তোমাকে ডেকেছিলাম! হ্যাঁ—মনে হয়েছে। আচ্ছা বনি, খুব সন্তর্পণে বললেন, তোমার শরীর ভাল যাচ্ছে?

এই সাতসকালে বাবার এমন কথা শুনে সে আশ্চর্য হয়ে গেল। বলল, কেন বল তো বাবা?

—না এমনি। দু’দিন দেখিনি। ভাবলাম…।

—আমার শরীর ভাল আছে বাবা।

—আচ্ছা বনি, তোমার কি কখনও—তারপরই কেমন সতর্ক হয়ে গেলেন। এ-সব তো বনিকে ভেবেছেন বলবেন না। আবার কেন সেই এক কথা।

বনি দেখতে পেল, বাবার মুখের দৃঢ়তা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর যেন তার বাবা ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস নন, সামান্য একজন ডাঙ্গার মানুষ। সমুদ্রে দীর্ঘদিন থাকলে মানুষের যে আত্মপ্রত্যয় থাকে তাঁর মুখে বিন্দুমাত্র তার চিহ্ন নেই। সে যেন তার বাবার সঙ্গে কথা বলছে না, কেমন অপরিচিতের মতো তিনি। এবং তখনই সেই ভয়টা গুড়গুড় করে ওঠে। আর্চিকে দেখলে সে যেমন দৌড়ে পালায়, বাবাকে দেখেও তার এখন দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করছে।

তখনই স্যালি হিগিনসের যে কি হয়ে যায়। তিনি বললেন, বনি তুমি বড় হয়ে গেছ।

বনি এবার মাথা নিচু করে পায়ের কাছে বসে পড়ল।

জাহাজিরা তখন যে যার কাজ করে যাচ্ছে। ডেক-জাহাজিরা ডেক ধোয়ামোছা করছে। একদল জাহাজি ফল্কার ওপর মাদুর বিছিয়ে নামাজ পড়ছে। পিছিলে কেউ চর্বি ভাজা রুটি খাচ্ছে। ছোটবাবু বালতি হাতে, তেলের টব কোমরে গুঁজে মেইন-মাস্টের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ওপরে চিফ-মেট ব্রীজে পায়চারি করছে। ওরা দেখতে পেল, সাতসকালে বাপ-বেটাতে ব্রীজের পাশে চার্টরুমের বারান্দায়, কি সব গোপন সলাপরামর্শ চলছে।

স্যালি হিগিনস বললেন, জাহাজ খারাপ জায়গা। এখানে রাখতে তোমাকে আর সাহস পাচ্ছি না বনি।

বনির মুখ থমথম করছে। বোধ হয় চোখ ফেটে জল বের হয়ে যাবে। সে কিছু বলছে না। কেবল চুপচাপ শুনে যাচ্ছে।

বাড়ির পরিচারকদের লিখে দিচ্ছি, তুমি যাচ্ছ। তোমার পিসি এসে থাকবে। আমার ফিরতে আর এক বছর। এ কটা দিন দেখতে দেখতে তোমার কেটে যাবে।

বনির মুখ দেখা যাচ্ছে না। চুল বড় হয়ে গেছে বলে মুখ ঢেকে গেছে। তিনি চান বনি কিছু বলুক। কিন্তু বনি দু-হাঁটু মুড়ে অসহায়ভাবে বসে রয়েছে। স্যালি হিগিনস বুঝতে পারেন, বনির স্বভাব আগের মতো নেই। স্থির ধীর। বয়স হলে মেয়েরা এভাবে বসে থাকতে ভালবাসে। আগের বয়সে বনি এত সহজে এ কথাটা মেনে নিত না।

তিনি ফের বললেন, ভাল হয়ে থাকবে। তোমাকে আমি বাড়ি ফিরে সারপ্রাইজ দেব।

বনি এবার উঠে যাচ্ছিল। সে কিছুতেই বাবাকে যেন ওর মুখ দেখাতে চায় না। মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। বাবা তার এই দুঃখ টের পাক সে চায় না। সে ছুটে বের হয়ে গেল। এবং কেবিনের দরজা বন্ধ করে বিছানায় হাউ হাউ করে ভেঙে পড়ল।

তখন কি যে দ্রুতবেগে মেন-এনজিন ঘুরপাক খাচ্ছে। কি অতিকায় শব্দ মেন-এনজিনের। একেবারে যেন প্রপেলার স্যাফট ভেঙ্গে-চুরে দিতে চাইছে। দ্রুতবেগে ঘুরছে প্রপেলার স্যাফট। এনজিনের অতিকায় পিস্টন নেমে আসছে, উঠে যাচ্ছে। ক্রাংক-ওয়েভ ঘুরে ঘুরে নেমে যাচ্ছে, কনডেনসারে স্টিম ক্রমে ঠান্ডা হচ্ছে আর পাম্প চলছে অনবরত, তার কিট কিট শব্দ এবং বয়লারের গেজে লাল দাগ সঠিক স্টিমের জায়গায় কাঁপছে একটা কবুতরের পাখার মতো।

বনি বিছানায় ঠিক এমনি থরথর করে কাঁপছে। ফুলে ফেঁপে উঠছে ওর শরীর। সে দু’হাতে বিছানার যাবতীয় বালিশ চাদর একসঙ্গে করে বুকের কাছে টেনে আনছে। সে কিছুতেই এই দুঃখ, ভেতরে যে এক আশ্চর্য ভালবাসা তার এ জাহাজে গড়ে উঠেছে—কাউকে বলতে পারল না। সে বলতে পারল না, বাবা জাহাজ ছেড়ে চলে গেলে আমি মরে যাব। যেন বললেই বাবা টের পেয়ে যেতেন, যা তিনি আশংকা করেছিলেন ঠিক। বনি এ-জাহাজে ভারি কষ্টের ভেতরে পড়ে গেছে। বনিকে তিনি কিছুতেই কষ্টের ভেতর ফেলে দিতে চান না।

ছোটবাবু তখন পালিয়ে পালিয়ে পাখিটাকে খাবার খাওয়াচ্ছিল। সেই সকাল থেকে সে চারপাশে সতর্ক নজর রেখে যায়। আর্চি অথবা পাঁচ-নম্বরের চোখে পড়লেই তাকে আবার নিচে নামিয়ে দেওয়া হবে। বয়লার-প্লেট তুলে ভেতরে নামিয়ে দেবে তাকে। এবং প্লেট ফেলে কতদিন যেন মনে হয় দীর্ঘকাল ওকে সেই অন্ধকারে—পচা জল আর তেল-কালির ভেতর ফেলে রাখতে চায়। সে ভয়ে ভয়ে থাকে। খুব ভালো ছেলের মতো কাজকর্ম করে এবং এই যে দু’দিন জ্যাকের সঙ্গে তার দেখা হয় নি —সেটা কপাল ভাল, দেখা না হলেই সে বেঁচে যায়। জ্যাকের জন্য অযথা এই কষ্টের ভেতর পড়ে যেতে তার ভয় হয়। কিন্তু পাখিটার বেলায় সে অন্যরকম। সে ফাঁক পেলেই পাখিটাকে খাবার খাওয়ায়। আর্চিকে তখন সে এতটুকু যেন গ্রাহ্যের ভেতর আনে না। তখন সে কেমন জেদী একগুঁয়ে।

তখন মৈত্র পরীতে নামবে। হাতে দস্তানা। গায়ে সেই নীল পোশাক। মাথায় ক্রিকেট ক্যাপ। এবং বোধ হয় সে এবং অমিয় ছোটবাবুকে মনে মনে খুঁজছিল। ছোটবাবু ক’দিন হল ওদের সঙ্গে কথা বলছে না। ছোটবাবুর সঙ্গে প্রায় দিনই দু-একবার ডেকে দেখা হয়, খুব কাজের মানুষের মতো ছোটবাবু উইনচের ভেতর মুখ গুঁজে রাখে। ডেক ধরে কারা হেঁটে গেল যেন ছোটবাবু টের পাচ্ছে না। ভীষণ নিবিষ্ট কাজে এমন একটা ভাব। আসলে ছোটবাবু রাগ করেছে।

মৈত্র দেখছে, ছোটবাবু পাখিটার খাওয়া হয়ে গেলে ফিরে আসছে। খুব খুশী ছোটবাবু। পাখিটাকে খাওয়াতে পারলে ছোটবাবুর আর কোন দুঃখ থাকে না এবং এই ঠিক সময়। অমিয় বলল, এই ছোটবাবু তুই আমাদের সঙ্গে কথা বলছিস না কেন? খুব গরম হয়েছে?

ছোটবাবু বলল, মৈত্রদাকে না নিয়ে গেলেই পারতে।

মৈত্র বলল, রাখ রাখ বাপু, আলগা দরদ তোর দেখাতে হবে না। কেমন আছি একবার তো খবর নিলি না।

—তুমি ভাল থাকলে আমার কি হবে? ছোটবাবু কেমন গম্ভীর গলায় কথা বলল। ছোটবাবুর এমন কঠিন মুখ মৈত্র কখনও দেখে নি। ছোটবাবু যেন নিজের ভেতর ক্রমে একজন সঠিক মানুষকে খুঁজে পাচ্ছে। আগে এই ছেলেটা ছিল একেবারে নরম মাংসপিন্ড, যা খুশি বানানো যেত। এখন ইচ্ছে করলেই আর ছোটবাবুকে যা খুশি বানানো যাবে না। এবং এভাবেই বোধ হয় ক্রমে এক সমীহ গড়ে ওঠে। জাহাজে ছোটবাবু উঠেছিল সবার অপোগন্ড হয়ে, এখন মৈত্রের মনে হল, জাহাজে অপোগন্ড সে নিজে। অমিয়, মনু এবং বংকু সবাই সুখে দুঃখে ছোটবাবুর কাছে পরামর্শ নিতে পারে। সে বলল, ছোট ভুল হয়ে গেছে। কিছু মনে করিস না। এখন ভাল আছি।

—এ-ভাল তোমার ভাল নয়। তোমাকে দাদা সাবধান হতে হবে। তারপর কেমন সহসা মনে পড়ার মতো বলল, শেফালী বৌদির চিঠি আর এল?

—না। বোধ হয় রাগ করেছে। করুক গে। আমি কি করব। টাকা থাকলে যদি না পাঠাতাম তবে বলতে পারত। কেমন মৈত্র মুখ গোমড়া করে রাখল।

—তাহিতিতে চিঠি লিখলে?

—লিখেছি। প্লাইমাউথে জবাব পাব আশা করছি।

—বাবা হলে কিন্তু আমাদের খাওয়াতে হবে।

—হ্যাঁরে খাওয়াব। বাবা হলে খাওয়াব না তো কখন খাওয়াবো। এত খাটছি কি জন্য। এবং ছোটবাবুর মনে হল এক্ষুনি মৈত্র চোখ বুজে তার সেই শিশুসন্তানের কথা ভাবতে ভাবতে নিবিষ্ট হয়ে যাবে।

মৈত্র বলল, বলত ছোট, “মেয়ে হবে না ছেলে হবে?

ছোটবাবু বলল, তোমার কি ভাল লাগে? মেয়ে না ছেলে?

অমিয় বলল, মেয়ে হোক মৈত্র। তোর মেয়ের সঙ্গে বড় হলে আমি প্রেম করতে পারব।

—খুব রস দেখছি।

—দ্যাখ মৈত্র, বলে ওরা স্টার-বোর্ড ধরে হাঁটছে। ছোটবাবু দাঁড়িয়ে এভাবে গল্প করতে পারে না। তবু এভাবে দেশ-বাড়ি অথবা ডাঙ্গার কথা ভাবলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এবং অহেতুক কথাবার্তা—কোনো মাথামুণ্ডু নেই তবু বলে যাওয়া, আর বাজি রাখা, বারবার এভাবে বাজি রাখতে ভালবাসে নাবিকেরা। যেন মৈত্র বাজি ফেললে, ছেলে হলে অমিয় দেবে, চার পাউণ্ড, অমিয় রাজী কিন্তু মেয়ে হলে, মেয়ে হলে তুমি হেরে যাবে মৈত্র। তুমি তখন কত দেবে? সেও বলল, চার পাউণ্ড। চার পাউণ্ড যেই দিক এবং নিজেরা কিছু চাঁদা তুলে ফেললে বেশ ভোজ হবে কিনারায় এবং স্ফূর্তি সারারাত। অমিয় বলল, ছোটবাবু, তুই কিছু দিবি না?

—আমিও চার পাউণ্ড দেব।

—তাহলে চার চার আট হয়ে গেল। অমিয় দেখল বংকু, অনিমেষ কোথাও রঙ করে ফিরছে। এখন টিফিন, সকালের চর্বিভাজা রুটি চা খেতে ওরা পিছিলের দিকে যাচ্ছে। অমিয় ওদের জামা ধরে বলল, তুমি এক পাউণ্ড, অনিমেষ তুমি এক পাউণ্ড। মনু দেবে দশ শিলিং, জব্বার দেবে দশ শিলিং তা অনেক হয়ে যায়।

বংকু বুঝতেই পারল না কিসের পাউণ্ড আর কিসের দশ শিলিং। সে বলল, তোমার বাপের পয়সা! চাইলেই পাওয়া যায়।

অমিয় অন্য সময় হলে মারামারি লাগিয়ে দিত। সামান্য অহেতুক কথাবার্তায় সহজেই জাহাজে মারামারি লেগে যায়, এখনও যেত, কিন্তু ছোটবাবুর সামনে বংকু বাবা তুলে কথা বলে ঠিক করে নি। ছোটবাবু বলল, দিবি তো একটা পাউণ্ড, কথা বলিস একশো পাউণ্ড ওজনের। শোন, আমরা ঠিক করেছি মৈত্রদা বাবা হলে এক রাতে বেশ জমজমাট কাটাব। নিউ. প্লাইমাউথে খবর ঠিক এসে যাবে। তখন দশ মাস না এগারো? ছোটবাবু এত উত্তেজিত যে, বৌদিকে নিয়ে সামান্য রসিকতা পর্যন্ত করে ফেলল।

—তা ছোটবাবু কত মাস হবে, বৌদির কাছে চিঠি দিয়ে জেনে নিতে পারিস।

তখন ওয়াচ থেকে লোকেরা উঠে আসছে। অমিয় মৈত্র ওপরে। ওদের লোক নিচে নেমে গেছে। ওরাও নামবে এবার। সুতরাং মৈত্র, অমিয় আর দাঁড়াতে পারল না।

ওরা বলল, আমরা যাইরে। বলে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে বোট-ডেকে উঠে গেল।

দুপুরে খাবার নিয়ে তখন ঝামেলা। বনির কেবিনে তখন কাপ্তান হিগিনস এবং কাপ্তান-বয়। দুজনের চেষ্টায় বনি সামান্য পরিজ খেল। বনি কিছুতেই খাবে না বলছে। ওর শরীর ভাল না থাকলে হিগিনস ভীষণ বিচলিত বোধ করেন। কি হয়েছে—কিছু জানতে পারছেন না। তিনি ভেতরে ভেতরে বিরক্ত বোধ করছেন। আর মেজাজ সামলাতে না পারলে বলছেন, কি হয়েছে বলবে তো?

—কিছু হয় নি বাবা। তুমি চিন্তা কর না।

—তবে খাচ্ছ না কেন?

—খেতে একদম ইচ্ছে করছে না।

হিগিনস মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। চোখ মুখ ফোলা ফোলা। খুব কান্নাকটি করলে এমন হয়। তিনি বুঝতে পারলেন না, বনি কেন কাঁদতে পারে। তাঁকে ছেড়ে বনির থাকতে কষ্ট হবে ঠিক, তবু সে তো সামান্য কয়েকটা মাস। আর তাছাড়া তিনি তো চিরদিন থাকছেন না। তখন কি হবে বনির? এ-সব মনে হলেই তিনি নিজেও আর জোর পান না, বনিকে ধমক দিতে পারেন না। বলতে পারেন না, মানুষ না খেলে বাঁচে!

বনি বলল, তুমি ভেব না বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু বিকেলে ফল, কফি সব এমনি পড়ে থাকল। রাতে একটু পোট্যাটো-অনিয়ন মুখে তুলেছে। সামান্য মাংসের রোস্ট মুখে দিয়েছে। আর কিছু না। পরদিন সে আরও কম। এবং এভাবে কমে গেলে সবাই জেনে ফেলল জ্যাক ক্যাবিনে অসুস্থ।

ছোটবাবু দেখছে, জ্যাক ক’দিন ডেকে একেবারেই বের হচ্ছে না। যতবার ওর কেবিনের পাশ দিয়ে গেছে ততবার দেখেছে দরজা বন্ধ। পোর্ট-হোলে উঁকি মেরে দেখেছে, পর্দা ফেলা। কিছু দেখা যায় না। কাপ্তান হিগিনসের ভীষণ দুঃখী মুখ! জ্যাকের তবে কিছু হয়েছে—এবং কিছু হয়েছে শুনলেই সে স্থির থাকতে পারে না। সেই যেমন সে লতিফ বাংকারে পড়ে গেলে কারো নিষেধ গ্রাহ্য করেনি, এখন তেমনি সে কিছুটা মনে মনে একগুঁয়ে। ইচ্ছে হল, রাতে একবার জ্যাকের কেবিনে যাবে। আর্চি তখন মাতাল থাকবে, তার হুঁস থাকবে না। সে সময় মত জ্যাকের কেবিনে উঠে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকল, জ্যাক, আমি ছোটবাবু। দরজা খোল।

জ্যাক ভেতরে আছে বোঝাই যায় না। কোন সাড়াশব্দ নেই। সবাই ডাইনিং হলে রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে। এবারে যে যার মতো শুয়ে পড়বে। সকাল সকাল শুয়ে পড়া দরকার। রাত থাকতে ওকে তুলে দেয় ডেবিড। সে তার নিত্য দিনের কাজের মতো খুব সকালে পাখিটাকে আকাশে অন্ধকারে উড়িয়ে দেয়। সকাল সকাল শুয়ে না পড়লে রাত থাকতে উঠতে কষ্ট হয় ছোটবাবুর।

দরজায় দাঁড়িয়ে ফের ডাকল, জ্যাক, আমি ছোটবাবু। দরজা খোল।

জ্যাক দরজা খুলছে না।

কাপ্তান হিগিনসের দরজা খোলা। আলো জ্বলছে না। ব্রীজে এখন থার্ড-মেটের ডিউটি। ছোটবাবু একটা উইণ্ডসেলের আড়ালে দাঁড়িয়ে ডাকছে। খুব জোরে ডাকতে পারছে না। খুব সন্তর্পণে সে জ্যাককে ডাকছে। এবং এটা জ্যোৎস্না রাত বোঝাই যায়। মাথার ওপর চাঁদ। মায়াবী জ্যোৎস্নায় সমুদ্রের গর্জন সে শুনতে পাচ্ছে। অথচ জ্যাক এমন একটা সময়ে সাড়া দিচ্ছে না। ওর মনে হল,জ্যাক তবে সত্যি খুব অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না হয়তো। সে নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভাবল। এই জাহাজে, ঠিক নিচে সে রয়েছে—সারাদিন কাজের পর জ্যাকের সঙ্গে বোট-ডেকে চুপচাপ বসে থাকা এবং কখনও কখনও জ্যাক আপনজনের মতো এমন কথাবার্তা বলে তাকে যে মনেই হয় না, জাহাজে উঠে জ্যাকের সঙ্গে পরিচয়। যেন জ্যাক কতকালের চেনা।

আসলে সে বুঝতে পারে জ্যাক যে সেই তাহিতিতে ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল, তারপর থেকে কেমন চাপা অভিমান। জ্যাক নিজে এসে ডেকে না নিয়ে গেলে সেই বা যায় কি করে। জ্যাক একদিনও আর নিচে নামে নি। তাকে ডেকে নিয়ে যায় নি। তাকে ডেকে কথা বলেনি। সেও নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কেমন সচেতন হয়ে উঠেছিল—জ্যাক ডেকে না কথা বললে যেন জীবনেও সে কথা বলবে না।

এর ফলে সে কাজের শেষে ডেবিডের ঘরে বসে আড্ডা দিয়েছে। অথবা ডেবিডের সঙ্গে মদ্যপান- এটা ওর সারাদিন পর বেশ ভাল লেগে গেছিল। সামান্য মদ্যপানের পর ডাইনিং হলে নানারকমের খাবার, তারপর আর সে দাঁড়াতে পারত না। সোজা কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ত। ওর চোখ জড়িয়ে আসত ঘুমে। জ্যাক ওপরে অসুস্থ, সে চিন্তাই করতে পারত না।

সে এবার দরজায় ধীরে ধীরে টোকা মারল। বলল, জ্যাক, আমি ছোটবাবু। তুমি অসুস্থ শুনলাম। তোমাকে দেখতে এসেছি। কিছুটা সে অপরাধ স্বীকার করার মতো কথা বলল।

এবার মনে হল দরজাটা নড়ছে। দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। জ্যাককে চেনাই যায় না। কেমন শীর্ণকায়, দুর্বল। জ্যাক এতটা যেন কেবল ছোটবাবুর জন্য হেঁটে এসেছে।

জ্যাক দরজা বন্ধ করে দিতে চাইল।

ছোটবাবু বলল, খোলা থাক না! এখন আর্চি এদিকে আসবে না।

জ্যাক তবু দরজা বন্ধ করে ধীরে ধীরে নিজের বিছানায় একটা চাদর টেনে শুয়ে পড়ল। তারপর ছোটবাবুকে অপলক দেখতে থাকল।

ছোটবাবু বলল, কি হয়েছে। তোমার চোখ-মুখ কোথায় গেছে জ্যাক!

জ্যাকের ঠোঁটে সামান্য হাসি ফুটে উঠল। আবার কেমন মিলিয়ে গেল সেই সুন্দর হাসিটুকু! তারপর সেই এক বিবর্ণ চোখমুখ জ্যাকের।

ছোটবাবু বসে থাকতে পারল না। ওর কপালে হাত রাখল। জাহাজ এখন ভিড়িয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু কাছাকাছি বন্দর বলতে নিউ-প্লাইমাউথ। ডেবিডের কাছে সে সব খবর নিতে পারত। আর সে ভেবে পাচ্ছে না, জ্যাক এত রুগ্ন হয়ে গেছে অথচ ডেবিড, একদিনও ওকে কিছু বলেনি। কাপ্তান কি ডেবিডকে ডেকে জ্যাকের সম্পর্কে কোনো পরামর্শ করেনি! জ্যাকের কপাল ঠাণ্ডা। সে থাকতে না পেরে বলল, কোনো ওষুধ খাচ্ছ না?

জ্যাক বলল, আমার কোন অসুখ করেনি ছোটবাবু। তুমি ভাববে না।

—তুমি কি হয়ে গেছ দেখেছ? একবার আয়নায় দেখেছো?

—এই তো দেখতে পাচ্ছি।

তা দেখতে পাবে জ্যাক। পায়ের কাছে বড় কাঠের আলমারিতে মানুষ-সমান উঁচু আয়না ফিট করা। জ্যাক শুয়ে শুয়ে ওর সব দেখতে পায়। জ্যাক এবার কেমন স্বাভাবিক গলায় বলল, লেডি-অ্যালবাট্রস আবার জাহাজে ফিরে এসেছে শুনলাম।

ছোটবাবু জ্যাককে স্বাভাবিক গলায় কথা বলতে দেখে সামান্য আশ্বস্ত হল। বলল, এসেছে। তোমাকে কে বলল?

জ্যাক বলল, আমি ওর কান্না শুনতে পাই ছোটবাবু।

—তুমি ওর কান্না শুনতে পাও!

—মাঝ-রাতে সে আমার কেবিনের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। আর কেমন একটা শব্দ, ঠিক যেন কান্নার মতো। তুমি শুনতে পাও না ছোটবাবু?

ছোটবাবু বলল, না। তারপর বলল, তুমি ঘুমোও না?

—আমার ঘুম আসছে না ছোটবাবু।

—এ-বয়সে ইনসমনিয়া খুব খারাপ। জাহাজ বাঁধলেই ভাল ডাক্তার দেখাবে।

জ্যাক উঠে বসার চেষ্টা করলে বলল, শুয়ে থাকো। ওঠার কি আবার দরকার!

জ্যাক কোন কথা শুনল না। বেশি সময় এখানে বসে থাকা ছোটবাবুর ঠিক না। বাবা শুতে যাবার আগে আর একবার আসবেন। অবশ্য দরজা বন্ধ থাকলে, সে ঘুমোচ্ছে ভেবে তাকে আর নাও ডাকতে পারেন। তিনি ওপরে উঠে যাবেন। কিন্তু ছোটবাবু তো এ-সব জানে না। বাবা টের পেয়ে গেছে, সে জাহাজে বড় হয়ে গেছে। যখন বড় হয়ে গেছে তখন আবার ওর কেবিনে ছোটবাবুর গলা পাওয়া যায় কেন? ছোটবাবু বিপদে পড়ে যেতে পারে। ছোটবাবুর যা স্বভাব, সে তো বারবার কেবল জোরে কথা বলতে চাইবে। চুপচাপ বসে থাকার মানুষ না ছোটবাবু।

জ্যাক ভালভাবে দাঁড়াতে পারছে না। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। এখন আবার বিছানা ছেড়ে ওঠার কি যে দরকার! সে বলল, আমি ধরব জ্যাক! তুমি কোথাও যাবে? বাথরুমে গেলে দরজা খুলে দিচ্ছি। আমি ধরছি তোমাকে। এস।

ছোটবাবু জ্যাকের কাছে গেলে প্রায় মাথাটা ছোটবাবুর কাঁধে এলিয়ে দিল। ভারি আরাম বোধ করছে জ্যাক। ওর দু’চোখ ফেটে জল আসছে। ছোটবাবু ওর চোখে জল দেখে ঘাবড়ে যেতে পারে। সে বেশ আলগাভাবে মুখটা ঘুরিয়ে আলমারির দরজা খুলে ফেলল। এবং কি খুঁজে বের করার মতো উবু হয়ে বসল।

ছোটবাবু বলল, আমাকে বল না, বের করে দিচ্ছি।

জ্যাক এবার মুখে কোনরকমে আঙ্গুল ঠেকিয়ে আস্তে কথা বলতে বলল ছোটবাবুকে। সে তারপর একটা প্যাকেট, আরে সেই প্যাকেটটা জ্যাক টেনে বের করছে। তারপর আলমারির দরজা বন্ধ করে বাংকে উঠে এল। এবং তাকাল ছোটবাবুর দিকে।—তোমাকে খুব জ্বালিয়েছি জাহাজে? না ছোটবাবু?

–সে তো জ্বালিয়েছ। তার জন্য আমি ভাবি না।

—আর তোমাকে জ্বালাচ্ছি না। বলে সে উঠে ওর কাছে গিয়ে বলল, তোমার স্যুট। এটা পরবে। আমি যখন চলে যাব, তখন তুমি ডেকে এ-পোশাকটা পরে দাঁড়িয়ে থাকবে। কেমন! মনে থাকবে তো!

ছোটবাবু অবাক! সে বলল, তুমি চলে যাচ্ছ? তোমার অসুখের জন্য কাপ্তান তোমাকে নামিয়ে দিচ্ছেন!

জ্যাক বলল, হ্যাঁ। আমার খুব একটা বড় অসুখ, মানুষের যেন এটা না হয় ছোটবাবু! জ্যাকের কথাবার্তা কেমন অভিজ্ঞ মানুষের মতো। এ-বয়সে জ্যাক এত বুঝতে পারে কি করে। সে বলল, কি অসুখ আমরা জানতে পারলাম না।

—কাপ্তানের ছেলের অসুখ। সবাই জানলে আর সে কাপ্তানের ছেলে হবে কেন ছোটবাবু।

ছোটবাবু বুঝতে পারল, সে সামান্য অনধিকারচর্চা করে ফেলেছে। সে বলল, তা ঠিক। তুমি বাড়ি পৌঁছে আমাকে চিঠি দেবে কিন্তু।

আর তখনই হাহাকার শব্দে জ্যাক কেমন ভেঙ্গে পড়ল। জ্যাক ছেলেমানুষের মতো কাঁদছে। ছোটবাবু কি যে করে! সে বলল, কি হয়েছে জ্যাক! এই জ্যাক—আহাঃ, কি হয়েছে বলবে তো? সে তাড়াতাড়ি কিছু বুঝতে না পেরে কাপ্তানকে ডাকতে যাবে ভাবল, আর তখন নিষ্ঠুর গলা জ্যাকের। সে বলল, ছোটবাবু তুমি এবারে যাও। আমি ঘুমোব। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। কাউকে ডাকতে হবে না। আমি ভাল আছি। তুমি ভাল থেকো। সাবধানে থেকো।

আর ছোটবাবু তখন কি করে। সে দ্রুত নেমে এল সিঁড়ি ধরে। শেষের কথাগুলো কেমন ভয়ের। ওকে জ্যাক সাবধানে থাকতে বলেছে। জাহাজে এবার কি কোন গণ্ডগোল আরম্ভ হবে। জাহাজে কি কোন বিদ্রোহ দেখা দেবে। জাহাজিরা এতদিন একনাগাড়ে জাহাজ চালিয়ে ক্লান্ত। দেশে ফেরার জন্য সবাই ক্ষেপে যাচ্ছে। জাহাজ হয়তো আর দেশের মুখে পাড়ি দিচ্ছে না। যা স্বাভাব এই জাহাজের, হয়তো সারামাসকাল দক্ষিণ সমুদ্রেই পড়ে থাকবে। ডেবিড ওকে তবে মিথ্যে বলেনি।

ঘুম এল না ছোটবাবুর। সে শুয়ে শুয়ে এ-পাশ ওপাশ করল, জ্যাকের কি যে চোখমুখ হয়েছে! এমন সুন্দর ছেলেটা ক’দিনে কি হয়ে গেছে! চেনাই যায় না। সে পোর্ট-হোল খুলে রেখেছে। বাইরে জ্যোৎস্না। প্রপেলারের শব্দ ভেসে আসছে। জল কেটে এত সব নির্যাতনের ভেতরও জাহাজ ঠিক যাচ্ছে। ওর ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসল এবার। বারোটার ওয়াচ শেষ হয়েছে। শেষ ঘণ্টি থেকে সে তা টের পেয়েছিল।

ভোররাতে ডেবিড ছোটবাবুকে ডেকে সাড়া পেল না। অন্য সময় দু-তিন ডাকেই সে সাড়া দেয়। আজ আবার ডেকেও যখন সাড়া পেল না, তখন ডেবিডের মনে হয়েছিল ঘুমোক ছেলেটা।

এবং সকালে কে জানত, মাস্তুলের ওপরে পাখিটারও ঘুম ভাঙবে না। ঠোঁট গুঁজে সে-ও ঘুমিয়ে ছিল, সে তো জানত, ছোটবাবু রোজকার মতো মাস্তুলের নিচে এসে ওর ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেবে। ছোটবাবু হাতে তালি না বাজালে ওর সকাল হয় না।

এবং তখনই খবর ছোটবাবুর কেবিনে, শিগগির ছোট, অমিয় এসে ওর দরজায় ধাক্কাচ্ছে। ওপরে গিয়ে দ্যাখ কি হচ্ছে!

ছোটবাবু লাফিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজা খুলে বলল, কি হয়েছে?

মেজ-মিস্ত্রি বন্দুক নিয়ে ওপরে উঠে গেছে। পাখিটাকে হয়তো মারবে।

ছোটবাবুর তখন দিক-বিদিক জ্ঞান ছিল না। একেবারে পাগলের মতো। জ্যাকের কেবিন পার হতেই দেখল আর্চি ক্রলিং করছে বোট-ডেকে। সে বন্দুক নিয়ে বোটের নিচে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। পাখিটা বুঝতেই পারছে না, কেউ তাকে হত্যা করার জন্য আড়ালে এগিয়ে আসছে। ছোটবাবু এবারে সবকিছু অগ্রাহ্য করে আর্চির ওপর লাফিয়ে পড়ল। গুলি ছোড়ার মুখে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দিল। হয়তো বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় আর্চি বাড়ি বসিতে দিত, কিন্তু তখন ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গীতে ছোটবাবু বলছে, সি’জ দ্য ওনলি ওম্যান ইন দ্য সিপ, স্যার।

তারপর সে বলল, এ্যাণ্ড টু মোর ডেজ টু হ্যাভ দ্য পোর্ট এবং সঙ্গে সঙ্গে আর্চির ভয়ংকর নিষ্ঠুর মুখ দেখে সে কেমন ঘাবড়ে গেল। বলল, প্লিজ একম্‌কিউজ মি স্যার!

মেজ-মিস্ত্রি আর্চি সোজা নেমে গেল। লেডি-অ্যালবাট্রস আবার উড়ছে। উড়ে উড়ে দিগন্তের দিকে চলে যাচ্ছে। বন্দুকের আওয়াজে যে যেখানে ছিল উঠে এসেছিল। ওরা দেখছে ছোটবাবু চুপচাপ একা দাঁড়িয়ে আছে বোট-ডেকে। মেজ-মিস্ত্রি বন্দুক হাতে নেমে যাচ্ছে। পিঠ কুঁজো মানুষটা কেন যে এত ফুঁসছে।

আর তখন কি যে হয়ে যায়—সেই শব্দতরঙ্গ, অথবা বলা যেতে পারে ঘণ্টাধ্বনি ছোটবাবুর মাথার ভেতর কেউ ঢং-ঢং করে বাজাচ্ছে—যেন সমুদ্রের গভীরে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে, যেন আকাশে-বাতাসে এবং সমুদ্রের সব তরঙ্গমালায় সেই ঘণ্টাধ্বনি—তাকে সতর্ক হতে বলছে। অথচ ছোটবাবু কি বুঝতে পারে না, মাথার ভেতর ও-ভাবে কে তার ঘণ্টাধ্বনি করতে থাকে, কোন সে সন্ন্যাসী—সে তখন কেবল দেখতে পায়, এক জলদস্যুর পোশাকে তার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার মুখোস। বাঘের মুখোশ পরে সেই জলদস্যু বোট-ডেকে হাঁটছে। তারপরই কেন যে সেই মখোশ সে দেখতে পেল আর্চির মুখে। মুখে ডোরাকাটা সব কালো কালো দাগ, চোখের পাশে, গোঁফের নিচে। হিংস্র মুখ আর্চির।

তার সঙ্গে আর্চি একটা কথা বলল না। আর্চির অহংকারী মুখ দেখে সে বুঝতে পেরেছে, আৰ্চি তাকে ক্ষমা করেনি। এবং পরদিন সকালে জাহাজ বন্দর পেলে সে সেটা ঠিক টের পেল। তখন সে উইনচে কাজ করবে বলে ডেকে হেঁটে যাচ্ছিল, মনে হল পেছনে কেউ ডাকছে—ম্যান ওদিকে নয়। এদিকে। ভীষণ অসহিষ্ণু গলা এবং দাম্ভিকতার যেন শেষ নেই। পেছনে তাকাতেই দেখল, আর্চি এলি-ওয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট খাচ্ছে। আর্চির চোখদুটো বাঘের মতো জ্বলছে।

এতদিনে টের পেল ছোটবাবু, আসলে আর্চির মুখটা জিরাফের মতো হয়ে যায়নি। আর্চির মুখটা বাঘের মতো হয়ে গেছে। হিংস্র বাঘকে মানুষ অনায়াসে হত্যা করতে পারে। এবং তখনই ওর মনে হল, মাথার ভেতরে অথবা মগজের সব শিরা-উপশিরায় কেউ আর ঘণ্টাধ্বনি করছে না। সব ঠিকঠাক। বন্দরে জাহাজ বাঁধাছাদা শেষ।

সে নেমে যেতে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *